পরীবাগান ছিল সোমনাথের একমাত্র অহঙ্কার। সেজন্যেই সুবিমলকাকুর সিদ্ধান্তকে ও মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। ও মনে করতো আম্মা ওদের অসহায়তার সুযোগ নিয়েছেন, সদিচ্ছা থাকলে আম্মা আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতেই পারতেন। ভেতরে ভেতরে ফুঁসতো ও।
ছোট ছোট ঘটনার কথা মনে পড়ে – সুবিমলকাকু তখন বেঁচে। সোমনাথ যখন কলেজ ছুটির সময় বাড়িতে আসে, তোতা ওর কাছে অঙ্ক করতে যায়। একদিন তোতা হঠাৎ আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-রূপুদি, তুই ভরসা করিস সোমনাথদাকে?
-এ কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
-বলবো, তুই আগে বল ভরসা করিস কিনা।
-হ্যাঁ করি।
-সোমানাথদার কিন্তু ভেতরে ভতরে খুব রাগ।
-আমার ওপর?
-না, আম্মার ওপর।
-তুই কী করে জানলি?
-আমি পরশু সোমনাথদার কাছে অঙ্ক করতে গেছি, ঘরে ঢুকতে যাবো – তখনই ওর খুব উত্তেজিত কথাবার্তা শুনে ঘরে ঢুকবো কি ঢুকবো না ভেবে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। কানে এলো ও সুবিমলকাকুকে বলছে, আমার গলায় তো তোমরা বকলস পরিয়ে রেখেছ, যার শিকলটা ধরা রমলা গুহর হাতে। আমার পড়াশুনা করতে একদম ভালো লাগে না। কিচ্ছু উৎসাহ পাই না। মনে হয় আমার সার্টিফিকেটগুলো বুক করে রেখেছে অন্য কেউ। তুমি কেন বুঝতে পারো না যে ধীরে ধীরে তুমিও বিক্রি হয়ে যাচ্ছো?
চমকে গেলাম ওর কথা শুনে। বিশ্বাস হচ্ছিল না। বললাম,
-তুই নিজে কানে শুনলি?
-হ্যাঁ।
-তারপর?
-তারপর তো চুপিচুপি পালিয়ে এলাম। সেদিন থেকে ওদের বাড়িতে আর যেতে ইচ্ছে করছে না। ভয় লাগছে, সত্যি বলছি রূপুদি সোমনাথদাকে আমার ভয় লাগছে। আমারও বুকের ভেতর একটা ভয় ঢুকে গেল। সামান্য মন খারাপও। তবু ওটা নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাইনি। দিন দু’য়েক পর সোমনাথ নিজেই এসে তো তাকে পাকড়াও করলো,
-কী রে, তোর অঙ্কের মাথা সাফ হয়ে গেছে বুঝি হঠাৎ? এই দু’দিন যাসনি কেন অঙ্ক করতে?
-স্কুলে ভলিবল ম্যাচ ছিলো।
তোতা মুখ গোঁজ করে বললো।
-খুব ভালো কথা। কিন্তু আমি তো কাল চলে যাবো। খেলা থেকে অবসর পেলে দয়া করে অঙ্কের দিকে একটু নজর দিও। নাহলে পরীক্ষায় ডাব্বা খাবে। হায়ার সেকেন্ডারির অঙ্ক কিন্তু বলের গায়ে চাটি মারা নয়।
ওর কথা শুনে আমার একবারও মনে হলো না ভেতরে কোনো আক্রোশ পুষে রেখেছে। ও যে তোতার পরম শুভাকাঙ্খী সেটাই তো মনে হলো। তাহলে আমি কেন ভরসা হারাতে যাবো ? এখন বুঝতে পারি ওর ওই আন্তরিকতাটুকু যেমন সত্যি ছিল, ক্ষোভটাও মিথ্যে নয়। দুই সোমনাথই সত্যি। একজন তোতার আপনজন, অন্যজন আম্মার অবদমিত প্রজা। মাঝখানে আমি।
তোতা তখন থেকে সন্দেহের চোখে দেখতো সোমনাথকে। ও কলেজে ঢোকার পর রীতিমতো গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছিল। সোমনাথ কোথায় যায়, কার সঙ্গে ঘোরে, ওর সঙ্গে কী ধরণের আচরণ করে, মাঝেমাঝেই গল্পচ্ছলে কায়দা করে জানিয়ে যেতো আমাকে।
সোমনাথ চাকরিতে জয়েন করার বছরখানেক পর সুবিমলকাকু চলে গেলেন। আমার শুধু মনে সোমনাথের সঙ্গে আমাদের বাড়ির সম্পর্কের জোড়টা তখন থেকেই আলগা হয়ে আসছিল। চাকরি পাওয়ার পর ও চার ছ’মাসে একবার বাড়ি আসে। নিজেদের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কদাচিত এ বাড়িতে আসে। আমাদের দুজনের নিভৃতের মুহূর্তও যেন আর তেমন গুরুত্ব পায়না ওর কাছে। আমি ভাবি পারিবারিক দায়দায়িত্বের চাপে ব্যক্তিগত আবেগকে চেপে রাখতে হচ্ছে। পরে একটু দাঁড়িয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়নি। আর ঠিক হয়নি।
সোমনাথ খড়গপুরে পড়তে যাওয়ার সময় থেকে একটা অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছি – প্রত্যেকবার বাড়ি থেকে যাওয়ার আগে আমিই ওর সব জিনিসপত্র গুছিয়ে দিতাম। ওর প্রয়োজনের খুঁটিনাটি ছাড়াও দু’একটা কবিতার বই ওর কবিতা লেখার ডাইরি। সেই ডাইরির ভেতর একটা করে ফলসা পাতা রেখে দিতাম। তাতে জলরঙে নিজের নামটা লিখে দিতাম। এটা আমাদের একটা পাগলামির খেলা ছিল। নতুন কবিতা লেখা হলে ও সেই কবিতার নাম লিখে পাতাটা আমাকে ফিরিয়ে দিতো। কবিতার প্রতি আমার ততটা আগ্রহ না থাকলেও খেলাটা খেলতে ভালো লাগতো।
অনেক কবিতার নাম, অনেক ফলসা পাতা জমে আছে আমার কাছে। এখনও হয়তো আছে কোথাও। খুঁজলে পাওয়া যাবে কেননা আজ দেখছি আসলে কিছুই আমি ফেলে দিইনি, সেটা আবেগে নাকি অবজ্ঞায় তা নিয়ে আর ভাবি না।
ওর লেখা শেষ যে কবিতাটা আমার কাছে এসেছিল, সেটা ফলসা পাতায় নয়। পোস্ট অফিসের ছাপ দেওয়া একটা খামে। ডাকে এসেছিল।
ভালোবেসে এই করতলে মুখ রেখেছিলে,কবিতা পড়ার আনন্দে তখন আমি একবার পড়ে নিয়ে জমিয়ে রেখেছিলাম। আমার পছন্দমতো আমি অর্থ করে নিতাম সোমনাথের কবিতার। রাজহাঁসের মতো এর ভেতর থেকেও আমি খুঁজে নিয়েছিলাম ওর ভালোবাসার আকুতিটুকু শুধু। অন্য কিছু ভাবতে চাইনি। চাকরিতে ঢোকার পর থেকে কবিতা থেকে ধীরে ধীরে সরে এলো ও। বলা ভালো কবিতাই ছেড়ে গেল ওকে। মানুষটাও আশ্চর্য রকম পালটে গেল। ওর ভেতরের সবটুকু কোমলতা, সবটুকু আবেগ কে যেন শুষে নিলো।
সেইখানে বিষ পাপড়ি ঝরে যদি, তা দিয়েই বিছানা সাজাবো,
সেখানেই জীবনকে পেতে দেবো।
জানি আমৃত্যু ও পাপতন্তু আমাকে জড়াবে,
তবু বন্ধ কোনো অন্ধ কুঠুরিতে
আমি ঘুমোতে দেবো না তোকে মেয়ে।
ভালোবাসা কতখানি ভার বইতে পারে?
একটু সুখ, একটু ভুল,
তার পাশে একটিমাত্র অপরাধ রাখি যদি,
সবকিছু উড়ে পুড়ে যাবে?
খেয়াল করি আমার নাম লেখা ফলসা পাতা আর ফেরত আসে না আমার কাছে। কবিতার খাতাটাও আর চোখে পড়ে না।। তবু আমি ভুলি না। তবু আমি ওর দূরের যাত্রায় আমার নাম লেখা ফলসাপাতাটা সঙ্গে দিতে ভুলি না। একটু একটু করে ভাবতে শুরু করি, সে পাতা হয়তো ও হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়, হয়তো পথের পাশে ফেলে দিয়ে চলে যায় ওর গন্তব্যে।
পুরোনো অভ্যেসে সুবিমলকাকুর শ্রাদ্ধের দু'দিন পর আমি ওদের বাড়ি গেছি। জানি তার পরদিন বাঙালোর চলে যাবে সোমনাথ। দেখলাম ও একাই স্যুটকেস গোছাচ্ছে। বিছানার ওপর জামাকাপড়, সব জিনিসপত্র ছড়ানো। আমি কাছে এগিয়ে যেতে সোমনাথ জানালার পাশে রাখা চেয়ারটা দেখিয়ে বললো - বোস।
অর্থাৎ স্যুটকেস গোছানোয় আমার সাহায্যের দরকার নেই। ওর কথা গায়ে না মেখে আমি স্যুটকেসের কাছে এগিয়ে গেলাম। সোমনাথ হাতের কাজ রেখে আমার দিকে ফিরে দাঁড়ালো। আমার কাঁধে দু'হাত রেখে একদৃষ্টে মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
-তুই বড্ড সরল, বড্ড ভালো রে রূপু। আমার সমস্যা এটাই।
- আমি ভালো হলে তোর তো নিশ্চিন্ত হওয়ার কথা, সমস্যা হবে কেন?
- সে তুই বুঝবি না।
- বুঝিয়ে বললেই বুঝবো।
- তোকে বলে কোনো লাভ নেই। তোকে আমি বোঝাতে চাইও না। আমি বোঝাতে চাই অন্য কাউকে। অন্যভাবে।
হতাশ ভঙ্গিতে বিছানার ওপর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। ওকে বুঝতে পারছিলাম না। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। তবু কাছে যাওয়ার সহজ পথটাই ধরলাম। আমি ওকে আদর করার চেষ্টা করলাম, ও তাতে সাড়া দিল না। সোমনাথের এইরকম পাথরের মতো শরীর এর আগে কখনও অনুভব করিনি। আমি পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও একটু ছুঁয়ে দেওয়ার সেই চেষ্টা, ছোঁয়া লাগলে চোখ বুঁজে আসা সেই সোম কোথায়?
তোতার ক্লাস নাইনের অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন সোমনাথ এসেছে ওকে অঙ্ক দেখিয়ে দিতে। আমাদের একতলার বসার ঘরের পাশে একটা ঘর আছে, সেটাকে আমারা পড়ার ঘর বলতাম। যদিও আমরা কেউ সেখানে বসে পড়তাম না। ওই ঘরে সারি সারি আলমারি ভর্তি অনেকরকম বই ছিল। রামায়ন মহাভারত বেদ পুরাণ থেকে শুরু করে নানারকম গল্পের বই, এমনকি আইনের বইও। মাঝে মধ্যে মেজকার কাছে কিছু ছেলে পড়তে আসতো বলে একদিকে একটা বড় টেবিল ঘিরে চারপাঁচটা চেয়ার রাখা ছিল।
এক কোনে বহুকালের পুরোনো একটা ক্যারাম বোর্ড ছিল। আমরা কখনো ক্যারাম খেললে টেবিলটা ব্যবহার করতাম। নিরিবিলি সেই ঘরে বসেই তোতাকে অঙ্ক করাচ্ছিল সোমনাথ। ও ঘরে আমার তখন আমার যাওয়ার কথা নয়, গেলে আম্মা সেটা পছন্দ করবেন না জানতাম বলেই একটা ছুঁতো খুঁজছিলাম। সুযোগটা পাওয়া গেল। একটা সুগন্ধ পেয়ে রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম গৌরিদি চপ ভাজছে। কাছে গিয়ে বললাম,
- তোতাকে আর সোমকে চপ দিয়ে আসি?
- না, তোমাকে দিতে হবে না। তুমি নিজের কাজ করোগে যাও।
- এটাও আমার কাজ, তুমি দাও।
গৌরীদি কী বুঝলো কে জানে, প্লেটে চপ আর কাসুন্দি দিয়ে আমার হাতে দিয়ে বললো, যাও সোমদাদাকে দিয়ে এসো।
চপ দিতে গিয়ে আটকে গেলাম। চুপচাপ বসে ওদের অঙ্ক করা দেখছিলাম। টের পেলাম টেবিলের তলায় আমার পায়ের পাতায় নিজের পা দিয়ে বারবার চাপ দিচ্ছে সোমনাথ। তোতা আছে বলে প্রথমে একটু আড়ষ্ট থাকলেও সাড়া দিলাম। শরীরে বিদ্যুৎ বইতে শুরু করেছে, চোখের পাতা বুঁজে আসতে চাইছে। খেলাটা চলছিল। হঠাৎ খেয়াল হলো তোতা বারবার অঙ্ক নিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে সোমকে, ও কোনো উত্তর দিচ্ছে না। আমার মতো ওরও চোখমুখ ঝিম ধরা।
তোতা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, - তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে সোমনাথদা?তাহলে আজ আর পড়াতে হবেনা। বলেই এক দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটলো তোতা।
সেই সোমনাথ কোথায়? ওর ভেতর যে একটা তোলপাড় চলছে শুধু সেটা বুঝতে পারছিলাম। বুকের ওপর মুখ রাখলাম। হঠাৎ আমাকে আঁকড়ে ধরলো সোমনাথ। আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে দিতে আমাকে শুইয়ে দিল বিছানায়। তারপর আমার বুকের মাঝখানে মুখটা রাখলো। মনে হলো ওর ভেতর থেকে তীব্র অগ্নিস্রোত ছুটে বেরোতে চাইছে আর তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে সোম। প্রবল যুদ্ধ চলছে ওর ভেতর বাইরে। আমি টের পেলাম আমার বুক ভিজে যাচ্ছে। ওর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। কেন জানিনা আমারও বুক ভেঙে যাচ্ছিল কান্নায়। কান্নাটা ছোঁয়াচে বলেই হয়তো। নিজেকে ভেঙেচুরে ওর শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। আরো আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরলাম ওকে। চারপাশ ভুলে শঙ্খ লাগা সাপের মতো জড়িয়ে পেঁচিয়ে উঠছিল দুটো শরীর। কিন্তু না, সোমনাথ আচমকাই আমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। অন্যদিকে চোখ রেখে কঠিন গলায় বললো - রূপু তুই এখন বাড়ি যা।
ওর কথার ভেতর কী যেন ছিল, আমি নিঃশব্দে এক অদ্ভুত কুয়াশা সঙ্গে নিয়ে বাড়ি চলে এলাম। কুয়াশাটা বৃষ্টি হয়ে ঝরলো রাঙাদিদার কাছে এসে। রাঙাদিদা সব শুনে বললেন, শুধু ক্ষোভটুকু নিয়ে ফিরে এলি, ভালোবাসা দেখলি না? ওর ওই চোখের জল, ওরে ওটাই তো ভালোবাসা। সেটাকে যত্ন করে আগলে রাখ, উবে যেতে দিস না।
রাঙাদিদার এই অনুভব কি সঞ্চারিত হয়েছিল আমার মধ্যে, শুধু প্রেমের ব্যথাটুকু আগলে বসে থাকার শক্তির বোধ?
ভালোবাসার অভাব তো ছিল না আমার চারপাশে, তিন প্রজন্মের মধ্যে আমি একমাত্র মেয়ে বলে আমার পরিবার তো আমাকে প্রশ্রয় আর ভালোবাসা দিয়ে মুড়ে রেখেছিল। তবু… তবু কেন আমার নিজেকে নতুন করে লিখতে হলো, সে কথা একজন ছাড়া কেউ জানে না। এটুকু রাঙাদিদাও জানেন না।