• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৬ | এপ্রিল ২০২২ | উপন্যাস
    Share
  • পরীবাগান ও এক গল্পের মেয়ে (৯) : অঞ্জলি দাশ



    || ১৫ ||

    ছোটবেলায় যেমন ছিল, সেই নিরিখে তোতাকে বরাবর খুব সরল, বোকাসোকা ভালোমানুষ মনে হতো। কিন্তু পরে বোঝা গেল মোটেও তা নয়। এক ধরনের সারল্য ছিল বটে, সেটা ওর স্বভাবের ভালোমানুষী। যা আজও অবশ্য আছে।

    ক্লাস নাইন থেকে প্রেম করা শুরু করেছিল ওর কোচিং ক্লাসের একটা মেয়ের সঙ্গে। প্রচুর ভুল বানানের প্রেমপত্র দেয়ানেয়া হতো। ওর বইয়ের ভেতর থেকে একদিন আমি আবিষ্কার করলাম তারই একটা। ওকে না জানিয়ে লুকিয়ে রেখেছিলাম সেটা ওকে একটু জব্দ করার জন্যে। একদিন সকাল বেলায় পড়তে বসে দেখলো চিঠিটা নেই। প্রথমে নিজেই সব বই ওলোটপালোট করে খুঁজলো। তারপর দেখলাম আমার পিছনে ঘুরঘুর করছে। আমি না দেখার ভান করে থাকলাম। তোতা আমার মুখের দিকে বার বার তাকিয়ে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিল ব্যাপারটায় আমার কোনো হাত আছে কি না। এক সময় থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,

    —রূপুদি তুই কি আমার ট্রিগনোমেট্রি বইটা কখনো নিয়েছিলি?

    —তোর ট্রিগনোমেট্রি বই দিয়ে আমি কী করবো?

    —এমনি নিয়েছিলি কি না বল না।

    —না। কেন কী হয়েছে?

    —আমার একটা দরকারি জিনিস খুঁজে পাচ্ছি না।

    —কী জিনিস বললে খুঁজে দিতে পারি।

    —একটা কাগজ,

    —শুধু একটা কাগজ! তার জন্যে এত খোঁজাখুঁজি!

    —কাগজ মানে ওতে একটা জিনিস লেখা ছিল।

    —কী লেখা ছিল বলবি তো।

    —পরীক্ষার রুটিন।

    —পরীক্ষার রুটিন আলগা কাগজে লিখেছিস কেন?

    —আসলে ওটা ক্যালেন্ডারে আটকে দেব বলে লিখেছিলাম।

    —আচ্ছা, খুঁজে দেব পরে। এখন যা। আমার অনেক পড়া আছে।

    —ও।

    তবু নড়ছে না দেখে মায়া হলো। আমার টেবিলের ড্রয়ার থেকে চিঠিটা বার করে ওর দিকে বাড়িয়ে দিতেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটা নিয়েই ছুটে পালালো। কলেজে ঢুকে প্রেমিকা পালটালো। ভাবলাম এটা সিরিয়াস প্রেম। কিন্তু তার সঙ্গে চার বছর প্রেম করার পর বিয়ে করলো মেজ কাকিমার নির্বাচিত পাত্রীকে। মেজ কাকিমার বান্ধবীর মেয়ে পৌলমী অবশ্য খুব ভালো মেয়ে, আমাদের সবার খুব পছন্দের মানুষ। একটু আহ্লাদি ধরনের। সাজতে খুব ভালোবাসে। সারাক্ষণ আহ্লাদিপনা আর হইচই দিয়ে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে। প্রায় প্রতিমাসে একটা করে শাড়ি কেনে। ছ’মাস অন্তর গয়নার ডিজাইন পালটায়। আমি এগুলো জানি তার কারণ সেগুলো দেখে আমাকেই মতামত দিতে হয়। আমি নিজে ওর একেবারেই বিপরীত, তবু ওকে আমার ভালো লাগে।

    তোতার নিজস্ব একটা সোর্স অফ ইনকাম আছে, শেয়ার কেনাবেচা। বউয়ের মুখ থেকে কথা পড়তে না পড়তেই তোতা সেটা হাজির করে। সবাই জানে ও বউ অন্ত প্রাণ। জানাটা হোঁচট খেল আমার।

    আমি তখন ল’পাশ করে বাবার চেম্বারে বসি। আমাদের ভবানীপুরের হেলথকেয়ারে সপ্তাহে দু’দিন একজন চাইল্ড স্পেশালিস্ট বসেন। তোতা হঠাৎ তার প্রেমে হাবুডুবু। ওই দু’দিন ঝড়জল অসুখবিসুখ উপেক্ষা করে তোতা ডিসপেন্সারিতে উপস্থিত থাকে। তারপরও নাকি বাড়ি ফিরে সারাক্ষণ দুজনে এস এম এস করে। পৌলমী সেটা ধরে ফেলে। তোতা মোবাইল রেখে বাথরুমে গিয়েছিল, তখন একটা এস এম এস আসে – পৌলমী সেটা পড়ে কিছুটা হতভম্ব। তারপর থেকে সুযোগ পেলেই চুরি করে ওর মেসেজ পড়ে। একদিন কেঁদে চোখমুখ ফুলিয়ে আমার কাছে এলো। বুঝলাম দীর্ঘক্ষণ কেঁদেছে। হাত ধরে বিছানায় বসালাম।

    —কী হয়েছে?

    —চোখ নিচু করে বিছানার চাদর খুঁট তোলা হলো। কাছে গিয়ে মুখটা তুলে ধরতেই আমার হাতের পাতায় টপটপ করে জল ঝরে পড়লো।

    —কাঁদছিস কেন? ঝগড়া হয়েছে তোতার সঙ্গে?

    —না।

    —তাহলে?

    —ও আমাকে ঠকাচ্ছে দিদিভাই।

    —দূর পাগল, ঠকাবে কেন, তোতা তো বউ অন্ত প্রাণ, এটা আমরা সবাই জানি।

    —ছাই জানো।

    —ওসব অভিনয়। আসলে ও মালিনী দত্তর সঙ্গে প্রেম করে।

    —কোন মালিনী দত্ত?

    —তোমাদের ওই চাইল্ড স্পেশালিস্ট।

    —কে বললো তোকে?

    —কে আবার বলবে, আমি কি বাচ্চা মেয়ে নাকি? কিছু বুঝবো না? সারাক্ষণ তো দুজনে এসএমএস করে।

    —করলোই বা, এসএমএস করলেই প্রেম করা হয় নাকি? মালিনী দত্ত আমাদের হেলথকেয়ার-এ বসে, ওর সঙ্গে তো তার কাজের কথা থাকতেই পারে।

    —কাজের কথা থাকলে ফোনে কথা বলে নিলেই হয়। এত কাজের কথা যে রাতে বিছানায় শুয়ে অন্ধকারেও মেসেজ পাঠাতে হয়। তুমি ওদের এসএমএস-গুলো দেখলে বুঝতে পারতে। মোবাইলটা সারাক্ষণ আগলে বেড়ায়।

    বুঝতে পারছিলাম না কী বলে ওকে শান্ত করবো। ওদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমার নাক গলানোটা কতখানি সঙ্গত, বা তোতা ওদের দাম্পত্যে আমার খবরদারি কতখানি মেনে নেবে বুঝতে পারছিলাম না। তবু যখন দেখলাম দু’দিন ধরে তোতার সঙ্গে পৌলমীর বাক্যালাপ বন্ধ। পৌলমী সারাদিন মুখ ভার করে ঘুরছে; তোতাকে ডাকলাম।

    —হ্যাঁরে মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছিস কেন?

    তোতা একটু হকচকিয়ে গেল। ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে রইলো দরজায়। ও ভাবতে পারেনি আমার কাছ থেকে এইরকম একটা প্রশ্ন আসবে। ভালো মানুষের মতো উলটো প্রশ্ন করলো।

    —কার কথা বলছিস বলতো?

    —কার আবার, পৌলমীর।

    —কেন কী হয়েছে ওর? তোর কাছে কিছু নালিশ করেছে?

    —নালিশ করবে কেন?

    —তাহলে তোর কেন শুধুশুধু মনে হলো আমি ওকে কষ্ট দিচ্ছি?

    ওর কথার উত্তর না দিয়ে আমি ওকে ভেতরে এসে বসতে ইশারা করলাম। তোতা একটু দ্বিধা নিয়ে ঘরে ঢুকে একটা মোড়া টেনে বসলো।

    —আমার চোখ নেই? দু’দিন ধরে দেখছি পৌলমী মুখ ভার করে ঘুরছে।

    —আমি তো বুঝতে পারিনি। মুখ ভার তো হয় সখের কিছু কিনতে না পারলে। তেমন কোনো দাবীর কথা তো জানি না।

    —একদম বাজে বকবি না।

    —মোটেই বাজে বকছি না। ওর তো এটা ছাড়া কোনো কষ্টের কারণ থাকতে পারে আমার অন্তত জানা নেই। আমার কোনো ব্যাপার নিয়ে ও মাথা ঘামায় না।

    এটা কি তোতার কোনো সত্যিকারের অভিমান নাকি নিজেকে আড়াল করার অজুহাত বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি জানি পৌলমী তোতাকে খুব ভালোবাসে। বাড়িতে তোতার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে ও সবসময় তোতার পক্ষ নিয়ে কথা বলে। তোতা ছোটখাটো ভুল করলেও ও সেটাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে।

    —তুই ওকে পুরোপুরি চিনিস না। তোর ভালো যা কিছু তা নিয়ে যেমন ও আপ্লুত থাকে, খারাপ যেটুকু তাকে সমালোচনা করে। তুই তো আর ধোয়া তুলসীপাতা নোস। ওর ভালোবাসায় সততা আছে।

    —তুই তোর নিজের মতো ভাবিস।

    —তাইতো ভাববো। যাইহোক আমি এতক্ষণ যে কারণে তোর সঙ্গে এতগুলো কথা বললাম এতক্ষণে নিশ্চয় সেটা বুঝতে পারছিস। অমন হাসিখুশি একটা মেয়ে লুকিয়ে চোখের জল ফেলবে, সেটা কার ভালো লাগবে? ব্যাপারটা আম্মার নজরে আসার আগে ঝামেলাটা মিটিয়ে নে।

    আম্মার নাম শুনে তোতা এতক্ষণে বিচলিত হলো। পৌলমী যে আমাকে সবকিছু বলেছে, সেটা বুঝতে পেরেছে। বললো, কাউকে একটা এসএমএস করলে যদি ও…

    ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, পৌলমীর অভিযোগ ‘শুধু একটা এসএমএস’ করার জন্যে যে নয়, সেটা তুইও ভালো জানিস।

    —শোন রূপুদি, ও যা বলেছে… তোকে আমি দেখাতে পারি, তার মধ্যে ওর বিচলিত হওয়ার মতো কিছু নেই।

    —না থাকলে শুধু শুধু চোখের জল ফেলার মতো মেয়ে নয় পৌলমী। ও হাসতে ভালোবাসে।

    —তুই ওকে বড্ড প্রশ্রয় দিস। আমাকে বললেই হতো, সবকথা তোকে লাগানোর দরকার কী।

    —বেশ করেছে। তোর ভাগ্য ভালো যে আম্মাকে লাগায়নি। যা না ওকে নিয়ে কিছুদিন কোথাও বেড়িয়ে আয়। ওরও রাগটা কমবে, আর তোর ওপর থেকেও এই নতুন রোগের প্রভাব কিছুটা চলে যাবে। আমি আম্মাকে বলে তোদের যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কোথায় যেতে চাস পৌলমীর কাছে জেনে জানিয়ে দিস আমাকে। তবে হ্যাঁ, তোর মোবাইল বন্ধ থাকবে। পৌলমীরটা দিয়ে কাজ চালাতে হবে। প্রতিদিনের ব্যবহৃত পরিবেশ থেকে বেরিয়ে গিয়ে হয়তো মানুষের মানসিকতার সাময়িক কিছু পরিবর্তন আসে। নতুন পরিবেশে পুরোনো মানুষটাকে নতুন করে চিনে নেয়ার একটা অবকাশ থাকে।

    পৌলমীর পছন্দে ওদের গন্তব্য হলো দক্ষিণ ভারত। পনেরো দিন বেড়িয়ে ফিরে এলো সেই ঝলমলে পৌলমী। প্রচুর কেনাকাটা, প্রচুর ছবি।

    সমস্যাটার কতটুকু সমাধান হলো বা পৌলমী কতটা জিতলো আমি জানি না। স্বভাব কিছুটা পালটানো গেলেও মানুষের মনকে কোনো নিষেধের গণ্ডি দিয়ে আটকে রাখা যায় বলে আমি মনে করি না। তবে ওই ঘটনার পর থেকে লক্ষ্য করি, তোতা খুব অনুগত হয়ে থাকে পৌলমীর।

    এমনিতে তোতা নড়বড়ে ব্যক্তিত্বের মানুষ। ওর সঙ্গে বাবা আর মেজকার উপমাটা ভাবতে ভলো লাগে না। তবু মাঝেমাঝে ভাবি, এ বাড়ির পুরুষদের ভেতর দাম্পত্য সম্পর্কের প্রতি এই যে বিশ্বাসভঙ্গের খেলা, এটা কি জিন বাহিত?

    হয়তো ছোটকা এর ব্যতিক্রম। ছোটকার জীবনের এমন কোনো ঘটনা এখনও সামনে আসেনি। অন্তত আমরা তো জানতে পারিনি। আম্মার ছেলেদের মধ্যে ছোটকাই খুব খোলামেলা। নিজের পরিবার পরিজনদের নিয়েই হইচই আনন্দ করে থাকতে ভালোবাসে। কিংবা হতে পারে ছোটকা খুব সাবধানী। সবচেয়ে প্রার্থিত সম্ভাবনা এটাই যে, ওরা প্রেম করে বিয়ে করেছিল এবং ছোট কাকিমার মধ্যেই ছোটকার সব চাওয়া পূর্ণতা পেয়েছিল বলেই। কিংবা ছোট কাকিমা জানতেন কী করে নিজের পুরুষটিকে অনুগত রাখা যায়।

    ছোট কাকিমাকে নিয়ে ছোটকা মাঝে মাঝে মা আর মেজ কাকিমার সামনে ঠাট্টা করে বলতো, পুলিশকে বিয়ে করেছি বৌদি। ঘাড় ঘোরাতে দেয় না।

    ছোট কাকিমা চিমটি কাটতে ছাড়ে না, তোমাদের যা পারিবারিক ইতিহাস, তাতে পুলিশ না হয়ে উপায় কী?

    মা বলতো, দেবু তো অল্পে তুষ্ট ভোলানাথ। বরাবর দেখেছি ও যা পায় সেটুকুকেই নিজের ন্যায্য বলে খুশি হয়। আর তাছাড়া তুই তো তিন বছর ধরে বাজিয়ে নিয়েছিস।


    || ১৬ ||

    ছোট কাকিমা তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। ছোটকার বিয়ের বছর দু’য়েক পরই ছো্ট কাকিমার মা মারা গিয়েছিলেন। সেজন্যেই আগে ছোট কাকিমা প্রায়ই গিয়ে সল্টলেকে থাকতেন। ছোটকাও মাঝে মাঝে দু’চার দিন টানা থেকে আসতেন। বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর ছোটকা পাকাপাকিভাবে শ্বশুরবাড়িতে বাস করতে শুরু করলেন। অজুহাত ছিল – ওখানে ছোটকার প্র্যাকটিসের সুবিধে আর রূ, রন-এর স্কুল কাছে। আম্মার খুব একটা সম্মতি না থাকলেও বাধা দেননি। প্রথম প্রথম সবাইকে নিয়ে ছোটকা উইকএন্ডে চলে আসতেন। শুক্রবার বিকেলে এসে রোববার বিকেলে ফিরে যেতেন। পরে কমতে কমতে মাসে দু’মাসে একবার। তারপর সেটা বছরে তিন বারে এসে ঠেকলো। পুজোয়, ভাইফোঁটায় আর গ্রীষ্মের ছুটিতে। ছোটকা একা অবশ্য মাঝে মাঝেই আসতেন। বাড়ির সব ব্যাপারেই ওদের অভাব অনুভব করতাম। ধীরে ধীরে সেটাও অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। আম্মা শুধু একবার ছোটকাকে বলেছিলেন, বাচ্চা দুটোর ভালবাসার বৃত্তটাকে ছোট করে ফেলিস না।

    ছোটকা কী বুঝেছিলেন জানি না, কাকিমা না এলেও প্রতি মাসে রূ সবসময় না এলেও রনকে নিয়ে নিয়ম করে একবার আসতেন। রন-এর বাড়ির সবার প্রতি কেন যেন খুব টান ছিল। মা-বাবাকে ছাড়া আমাদের কাছে ও চমৎকার থাকতে পারতো। ছোট কাকিমা সঙ্গে এলেই বরং একটু আড়ষ্ট, একা এলে মুক্ত বিহঙ্গের মতো আনন্দে থাকতো। কাকিমা বলতেন, দল ছাড়া গরুর মতো।

    বাড়ির পুকুরটা প্রতি বছর তখন লোক লাগিয়ে সংস্কার করাতেন, আমরা সাঁতার কাটবো বলে। ছোটকা আমাকে আর তোতাকে সাঁতার শিখিয়েছেন। রনকে আমি সাঁতার শিখিয়েছিলাম। পুকুরে ইচ্ছেমতো অনেকক্ষণ দাপাদাপি করে স্নান করাটা ওর একটা অন্যতম আকর্ষণ ছিল। কিন্তু কাকিমার সঙ্গে এলে সেটা হতো না।

    গ্রীষ্মের ছুটিটাকে রূ বলতো আমকাঁঠালের ছুটি। আমাদের বাড়িতে এখনও পুকুরের ধারে ধারে পাঁচ ছ’টা আম গাছ আছে। আগে আরো বেশি ছিল। দুটো কাঁঠাল গাছে গা ভর্তি কাঁঠাল হয়। রূ রন দুজনেই এখানে এলে সহজে যেতে চাইতো না। যাওয়ার দিন হলে ছোট্ট রন আমার কাছে এসে বলতো, দিভাই আমাকে লুকিয়ে ফেলো। বলেই আমার ওড়নার প্রান্ত নিয়ে নিজের মুখটুকু ঢেকে রাখতো। কখনো বা রাঙাদিদার বড় কাঠের আলমারিটার পাল্লা একটু ফাঁক করে রেখে তার মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকতো। ছোটকারা মাঝে মধ্যে ওকে রেখেই চলে যেতেন। পরে তোতা বা মেজকা ওকে পৌঁছে দিয়ে আসতো। যে ক’দিন এখানে থাকতো সারাক্ষণ আমার পায়ে পায়ে ঘুরতো রন।

    সেইসব দিন যে কী অনাবিল ভালোবাসা আর আমোদ আহ্লাদের ছিল, ভাবলে এখনো বুকের ভেতর আলো হয়ে ওঠে। পরিবারে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার কমতি এখনো নেই, অভাব শুধু আমোদ আহ্লাদের।

    রূ এখন ক্যালিফোর্নিয়ায়। সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। ওর বউ জাপানের মেয়ে। সেও ইঞ্জিনিয়ার। পুতুলের মতো দুটো মেয়ে কুহু আর কেকা। দু’বছর অন্তর একবার আসে।

    রন এমবিবিএস পাশ করার পর প্রথমে ভবানীপুরে বসতো, কখনও-সখনও সল্টলেকে ছোটকার চেম্বারে। এখন ও আর ওর এক নিউরোলজিস্ট বন্ধু মিলে পাম এভিনিউ-এ চেম্বার করেছে। আমার অনুরোধে আমাদের বাড়ির একতলায় প্রতি বুধবার বিনা পয়সায় রোগী দেখে। ও এলে ঝিমিয়ে পড়া বাড়িটা চনমন করে ওঠে। আমার প্রতি ওর আনুগত্য সেই ছোটবেলার মতো। অনেকবার প্রত্যন্ত গ্রামে আমরা মেডিক্যাল ক্যাম্প করেছি। রন সোৎসাহে সেটা লিড করেছে। যেকোনো সমাজসেবামূলক কাজে ওর উৎসাহ। নিজে থেকে দু’সপ্তাহ আগে নিজেই ফোন করে বলছিলো,
    —দিভাই, আবার কবে মেডিক্যাল ক্যাম্প করছো? এবার আরো রিমোট কোনো অঞ্চলকে টার্গেট কর। যেখানে মানুষ শুধু শেকড়বাকড়ের ওপর নির্ভর করে রোগের সঙ্গে লড়াই করে।

    —তুই যেতে পারবি সেখানে? হাঁটু অব্দি জলকাদা ভেঙে, অন্য লোকের সাইকেলের রডে বসে?

    —তুমি ভুল করছো, আমি পিকনিকে যেতে চাইছি না।

    —তুই নিজে থেকে কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে ভালো করলি। সুন্দরবনের ওদিকে একটা ক্যাম্পের কথা ভাবা হচ্ছিল। এবার তোকে অ্যাসিস্ট করার জন্যে কাউকে সঙ্গে নিস। গতবার তোর খুব অসুবিধা হয়েছিল।

    —এবার ভাবছি একজন হাফ-ডাক্তারকে সঙ্গে নেবো।

    —তবে তো সেটা তোর পিকনিকই হবে।

    —যা ভাবছো তা নয়। এসব ব্যাপারে আমার চেয়েও সিরিয়াস।

    আমি জানি রন কার কথা বলেছে। ওর কথার মধ্যে খানিকটা জেনেছি, হয়তো জানতে চাইলে ডিটেলসে বলতো, কিন্তু আমি আগ্রহ দেখাইনি বলে কিছু আর বলেনি। কী জানি আজকাল কোনো কিছু নিয়েই আগে ভাগে বেশি জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করে না আমার। বেশি দূর ভাবতে ভয় লাগে।

    আমার চেয়ে অন্তত চোদ্দো-পনেরো বছরের ছোট, কিন্তু আমার সঙ্গে রন সব থেকে স্বচ্ছন্দ। ওর সময়মতো নিশ্চয় বলবে তৃণার কথা। আমি জানি আমার সাপোর্টের দরকার ওর। ছোট কাকিমার কথায় তেমন আঁচ পেয়েছি। এমনিতে ছোট কাকিমা চালচলনে যথেষ্ট আধুনিক, কিন্তু নিজের ছেলের ব্যাপারে বেশ রক্ষণশীল ভাবনা। সব মানুষই কমবেশি এইরকম দ্বিচারিতায় ভোগে। শুধু রন-এর এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে একদিন একাই চলে এসেছিলেন।

    —দেখ রূপু, ও প্রেম করে নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে এতে তো আর আপত্তি থাকার কথা নয়, আমরাও তো প্রেম করে বিয়ে করেছি। রূ-ও তো তাই করেছে। কিন্তু তুই ভাব ওর মা ওই মেয়েকে নিয়ে তিন বার স্বামী পালটে তবে এখানে থিতু হয়েছে। নিজের বায়োলজিকাল বাবার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই ওর। মায়ের প্রভাব কিছুটা হলেও তো থাকবে মেয়ের মধ্যে।

    —তার কোনো মানে নেই। তাছাড়া ওর মাকে যে তিন বার স্বামী পালটাতে হয়েছে, তার জন্যে তাঁকেই দায়ী করছো কেন?

    ছোট কাকিমাকে একটু অপ্রস্তুত লাগলো। আমারও এই ধরনের কথাবার্তা খুব খারাপ লাগছিল। কথা পালটালাম,

    —তুমি তৃণাকে দেখেছো?

    —দেখব না কেন, বাড়িতে আসে তো নিজের ঘরে আসার মতো করে।

    —বাহ, দারুণ তো। কথা বলেছো?

    —বলেছি।

    —কেমন লেগেছে?

    —ভীষণ সোজাসাপটা কথাবার্তা। যা একবার মনে আসে, মুখ দিয়ে বার করে দেয়। সেন্সারের বালাই নেই। মেয়ে হিসেবে খুবই... মানে কী বলবো, জোর করে ভালোবাসা ছিনিয়ে নেয়।

    তুমি যা যা বললে, একটাও কিন্তু ওর বিরুদ্ধে গেল না।

    —এমনিতে মেয়ে হিসেবে ওর বিরুদ্ধে বলার তো সত্যিই কিছু নেই। কিন্তু ওর পারিবারিক পরিবেশটা যে বড় গোলমেলে।

    —এই কথা? তা রন-এর সঙ্গে বিয়ে হলেই তো ওর পারিবারিক পরিচয় পালটে যাবে।

    —তোর সঙ্গে কথায় পারা যায় না।

    —তুমি তো আমার সঙ্গে লড়াই করতে আসোনি আমার সাপোর্ট চাইতে এসেছো।

    —তবু মনটা খচখচ করে।

    —ছোটকা কী বলে?

    —মুখে কিছু বলে না, তবে আমার মনে হয় এটা নিয়ে তোর ছোটকার ভেতরও একটু ঢোক গিলে নেওয়ার মতো ব্যাপার আছে।

    —আমাকে কী করতে বলো?

    —তুই রন-এর সঙ্গে কথা বলে দেখ বিয়ের ব্যাপারে ও সিরিয়াসলি ভাবছে কি না। নাকি মেলামেশাটা শুধুই বন্ধুত্বের। একমাত্র তোর সঙ্গেই তো ও মন খুলে কথা বলে।

    —পরোক্ষে ওদের সম্পর্কটা ভেঙে দিতে বলছো না তো আমাকে?

    —তা নয়, আমি বলতে চাইছি তুই একটু যাচাই করে দেখ যে সম্পর্কটাকে ওরা বিয়ের নিরিখে ভাবছে কি না। আমাকেও তো মনটাকে তৈরি করে নিতে হবে।

    —বিয়ের নিরিখে যদি না ভাবে, তুমি তাহলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচো। এই তো? তৃণার জন্যে পরে আপসোস হবে না তো?

    তৃণাকে তখনও আমি দেখিনি। সেজন্যেই খুব তলিয়ে ভাবিনি ওদের সম্পর্কটাকে নিয়ে। ও তৃণার প্রসঙ্গ তোলার পর আমি খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। সব কথা বলার পর খুব খুশি মনে হলো রনকে। তবু এটা বলতেও ভুললো না যে, মা তৃণাকে খুব একটা পছন্দ করে না। ও বাড়িতে এলেই মায়ের ভুরু কুঁচকে যায়।

    ওর ধারণাটা ভুল, সেটা বোঝালাম রনকে।

    —রিপোর্ট কার্ড ধরিয়ে দিলাম, এবার সই করিয়ে আনার দায়িত্ব তোমার। বলে হাসলো রন। ও যখন নিচু ক্লাসে পড়তো, কোনো সাবজেক্টে নম্বর কম হলে ও কিছুতেই ছোটকার কাছে ওর প্রোগ্রেসিভ রিপোর্ট সই করাতে যেতো না। আমার হাতে দিয়ে বলতো, প্লিজ দিভাই এটা সই করিয়ে দাও। এও যেন সেইরকম হলো। আমিও হেসে ফেললাম।

    ছোটবেলায় তোতার ছেলে রম্য আমার কাছে বড় একটা ঘেঁসতো না। কেবলমাত্র কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ বা নিজের কোনো সমস্যার কথা জানাতে হলে এসে দরজায় দাঁড়াতো। আমি কাছে ডাকলে তবেই ঘরে ঢুকতো। রূ বা রনএর মতো আমার সাহচর্য ওকে হয়তো তেমন আরাম দেয়নি কখনও। একটা নির্ভরতার অনুভূতি জুগিয়েছে শুধু। এখন এই চোদ্দ বছর বয়সেও সেই দূরত্ব বজায় রেখেছে রম্য। অথচ ও তো দেখেছে ওর মা-বাবা আমার কত কাছের। দেখেছে রূ, রন বাড়ি এলে আগে আমার কাছে ছুটে আসে এখনও। আসলে জন্মের পর থেকে রম্য যে পিসিমনিকে দেখেছে, সে তো জন্মান্তরে অন্য এক মানুষ। যাকে সহজে ছোঁয়া যায় না। যেভাবে আমরা আম্মার ওপর নির্ভর করতাম, ভরসা করতাম, কিন্তু খুব কাছে যেতে পারতাম না। ঠিক সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলছে। আমি কি তাহলে অজান্তে নিজেকে আম্মার আদলেই



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ | পর্ব ১৬ | পর্ব ১৭ | শেষ পর্ব
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments