ট্রেন বর্ধমানে পৌঁছোনোর ঠিক আগে রূপাঞ্জনার মোবাইল বাজলো। সুতপা। শেয়ালদায় আসার আগে গাড়িতে একবার কথা হয়েছে। সুতপাই ফোন করেছিলেন। পবনের সঙ্গে দেখা হয়েছে কিনা জানার জন্যে। পবন অনেক আগেই স্টেশানে পৌঁছে সাত নম্বর প্লাটফরমে ঢোকার মুখেই দাঁড়িয়েছিল। পবনের কাছে একটা মোবাইল থাকে। রূপাঞ্জনাকে দূর থেকে দেখামাত্রই বাড়িতে ফোন করে দিয়েছে। ট্রেন ছাড়ার পর বাড়িতে আর ফোন করা হয়নি।
— শোন রূপু, কার্শিয়াং ঢোকার আগেই মাফলারটা জড়িয়ে নিস গলায়। ওখান থেকেই মেঘ ঢুকতে থাকে গাড়ির জানালা দিয়ে, আর তুই তো জানালা বন্ধ করবি না জানি। সেবার ঠান্ডা লেগে তোর যা অবস্থা হয়েছিল। এবার তেমন কিছু হলে যাওয়াটাই বৃথা হবে। এন জে পিতে নেমেই একটা ফোন করিস। ঠিক সময় খেয়ে নিস। ঠিক সময় খেয়ে নিস। হ্যাঁ রে কিছু বলছিস না কেন?
— তুমি থামবে, তবে তো বলবো। তুমি তো দার্জিলিং মেলের আগে আগে ছুটছো। কিচ্ছু চিন্তা কোরো না মা, ঠিক মনে মনে যেমনটা চাও, আমি সেভাবেই সব কিছু করবো। রাতে আর ফোন করতে হবে না, ঠিক আছে?
বর্ধমানে ঢুকে গেছে ট্রেন। খিদে পেয়েছে খুব। কিন্তু আশপাশে অন্যরা খাবার বার না করলে ওর খেতে খারাপ লাগে। একটু পরেই পাশের কেবিন থেকে মৌলিদের দলের একটি মেয়ে এসে ওদের তিনজনকে তিনটে খাবারের প্যাকেট দিয়ে গেল। প্যাকেটটা একটু ফাঁক করে দেখে নিয়ে মৌলি ঠোঁট বাঁকালো — উহ, সেই বালির ডাইনি!
উজ্জয়িনী হাসলো - জার্নিতে হালকা খেতে হয়। খেয়ে নে, ঝামেলা করিস না।
রূপাঞ্জনা ব্যাগ খুলে নিজের খাবার বার করলো। হাতে গড়া রুটি, পনির আর মিক্সড সব্জির তরকারি আর গোটা চারেক সন্দেশ। টিফিন বক্স খুলে ওদের অফার করলো,
— আমার খাবার পছন্দ হলে শেয়ার করতে পারো। যদিও সহযাত্রীদের কাছ থেকে কিছু খাওয়া নাকি নিরাপদ নয়।
— আমার ষোলো জন আছি। তার মধ্যে তিন জনকে খাইয়ে কিছু সুবিধে হবে না।
মৌলির কথায় সবাই জোরে হেসে উঠলো। উজ্জয়িনী আর ঋতু একটা করে সন্দেশ তুলে নিল। আর মৌলি খানিকটা সব্জি নিয়ে বললো, স্যান্ডউইচ মোটেই খুব ভালো অফার নয়। তবু জিজ্ঞেস করছি একটু মুখ নষ্ট করবেন?
রূপাঞ্জনা একটু হেসে মাথা নেড়ে খাওয়ায় মন দিল। জলের বোতল খুলে গলায় ঢেলে বুঝলো, ওটা নির্ভেজাল জল নয়, লেবুর শরবত। মনে মনে হাসলো, গৌরীদি পারেও। কানে বাজলো গৌরীর গলা – সারাদিন মিটিং টিটিং করে শরীরটা গরম হয়ে আছে, লেবুর শরবতটা গলায় ঢেলে নাও, শরীর জুড়োবে। ব্যাগে উঁকি মেরে দেখলো আর একটা বোতল আছে। ওটা নিশ্চয় জল।
খাওয়ার পাট চুকিয়ে নিয়ে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিল রূপাঞ্জনা, হঠাৎ একটা বাক্য কানে যেতেই উৎকর্ণ হলো।
— আমি তুলতুল রে, ফোন এতক্ষণ এনগেজ কেন?
চোখ থেকে খবরের কাগজটা একটু সরিয়ে আর একবার ভাল করে তাকালো। মুখটা দেখতে শান্তাকাকিমার মতো। তাহলে কি কুয়াশাটা সরছে? হতেও তো পারে। এমন ঘটনা তো ঘটে। বহুকাল পরে আচমকা কোনো পূর্ব পরিচিতের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। অপেক্ষা করে আছে রূপাঞ্জনা।
ভেতরের উদ্বেগ রাগ আর বিরক্তি হয়ে প্রকাশ পেলো উজ্জয়িনীর গলায়।
— এই নিয়ে সাত আটবার চেষ্টা করে তবে পেলাম। প্রথমবার রিং হল ধরলি না। তারপর থেকে এনগেজ পাচ্ছি। আমার টেনশান হয় বুঝিস না?
— কী হয়েছে জানো তো দিদি, সেই সন্ধে থেকে উলটপালটা ফোন আসছিল। আমি মায়ের মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছিলাম, মায়ের একটু ঝিমুনি মতো আসছিল আর শধু ভেঙে যাচ্ছিল ঘুমটা। দু’একবার ধরে দেখলাম কোনো কাজের ফোন না। আমি তাই বুদ্ধি করে ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখেছিলাম, আর তুলে রাখতে মনে নেই।
— খুব বাহাদুরি করেছ। মা কি ঘুমোচ্ছে?
— না।
— ওষুধগুলো ঠিকমতো দিয়েছিস?
— হ্যাঁ, নাও তুমি মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলে নাও।
— ঠিক আছে, দে। আর শোন এই ক’দিন একদম বেরোবি না বাড়ি থেকে। মনে থাকবে তো ও যতক্ষণ ফোনে কথা বললো, রূপাঞ্জনা আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, কুড়ি বাইশ বছরের একটা দীর্ঘ পথ। একটা পাঁচ ছয় বছরের ফুটফুটে মেয়ে একটু একটু করে বছরগুলো পার হচ্ছে আর পালটে যাচ্ছে তার অবয়ব। তাকে কি ঠিকঠাক চেনা সম্ভব? একটু বেশি আশা করে ফেলছে না তো রূপাঞ্জনা? কল্পনাকে একটু বেশি প্রশ্রয় দেওয়া হয়ে যাচ্ছে না তো? একই নাম তো কতজনের হতে পারে। কিন্তু ওর সামনে যে বসে আছে অবিকল অন্য একজনের ছবি হয়ে, তাকে অস্বীকার করবে কী করে? শান্তা কাকিমা। বড় প্রিয় মানুষ ছিলেন। ওদের সঙ্গে সম্পর্কটা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল যে কারণে সেটা কোনোদিন বিরূপতা জাগায়নি রূপাঞ্জনার মনে। শান্তাকাকিমা আর তুলতুলকে ঘিরে যে ভালোলাগা, সেটা কোনোভাবেই কমেনি। কেননা নির্মাল্যকাকু ওদের খুব আদরের মানুষ ছিলেন।
রূপাঞ্জনা বারবার চেয়েছে ওদের কাছে যেতে, ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কোনো না কোনো ঝামেলায় আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ওরা দুজন মনের মধ্যে ছিলই। আজ সেকথা আরো বেশি করে মনে হচ্ছে। শুধু সময়ের ধুলো জমে একটু ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। ধুলোটা মুছে নিয়ে দেখাই যাক না। উজ্জয়িনী নামের পোশাক সরিয়ে যদি তুলতুলকে পাওয়া যায়। ভাবে দেখা হয়ে যাবে এটা কল্পনাতীত। অবাস্তব লাগছে।
ফোনে কথা বলা হয়ে গেছে। উজ্জয়িনীর চোখে মুখে এতক্ষণ যে উদ্বেগ ছিল, সেটা আর নেই। খবরের কাগজটা ভাঁজ করে পাশে রাখলো রূপাঞ্জনা। নিজের আবেগ সংযত রেখে আরও একটু নিশ্চিন্ত হতে চাইলো।
— উজ্জয়িনী, তুমি কি কৃষ্ণনগরেই থাকো?
— না না। কলকাতা থেকে রোজ যাওয়া আসা করি।
— কলকাতায় কোথায় থাকো?
— আনন্দ পালিত রোডে।
শব্দটা কানে যেতেই উত্তেজনাটা আর একটু বাড়লো রূপাঞ্জনার। না ভুল হয়নি। এবার আর একটু সাহস করে এগোলো।
— বাবার নাম নির্মাল্য সরকার?
— আপনি চিনতেন আমার বাবাকে?
— আমি তুলতুল নামের একটা ছোট্ট মেয়েকেও চিনতাম।
— তাহলে হয়তো আমিই সে। চিনতে পারছেন?
— এত বছর পর উজ্জয়িনী বলে পরিচয় দিলে চিনতে তো একটু অসুবিধা হয়ই। কিন্তু শান্তাকাকিমাকে যে ভুলিনি। তোমার চেহারাটা একদম শান্তাকাকিমার মতো।
— হ্যাঁ, সবাই তাই বলে।
— আমাকে মনে আছে?
একটু অসহায়ের মতো তাকালো উজ্জয়িনী।
— ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে একটু একটু মানে খুবই ঝাপসা... একজনের কথা মনে হচ্ছে। খুব ছোটবেলার স্মৃতি... বলতে ঠিক ভরসা পাচ্ছি না।
— বলে ফেল, নম্বর কাটা যাবে না। কার কথা মনে হচ্ছে?
— রূপুদিদি?
— ফুল মার্কস।
তুলতুল উত্তেজিতভাবে উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো রুপাঞ্জনাকে।আপসোসের গলায় বলল,
— ইস আমরা তো এনজেপি-তে নেমে কালিম্পং চলে যাবো। আমার যে কি এক্সাইটিং লাগছে। দাঁড়াও মাকে ফোন করে বলি... নাহ থাক সারপ্রাইজ দেবো ফিরে গিয়ে। তোমরা ক’দিন থাকবে দার্জিলিং-এ?
— তিন চারদিন।
মৌলি আর ঋতু হাঁ করে তাকিয়ে আছে। মৌলি চোখ বড় বড় করে বললো,
— এ যে পুরো সিনেমা!
আরও দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গে বসে কফি খাচ্ছে রূপাঞ্জনা। একজনকে সেদিন ট্রেনে দেখেছিল, খবরের কাগজ দিতে এসেছিল রূপাঞ্জনাকে। পাশেই আর একটা টেবিলে ওদের বসতে বলে সঙ্গীদের আর ওকে তো সেদিন সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল রূপাঞ্জনা — বিভাসরঞ্জন বসু, আর ওকে তো সেদিন ট্রেনে দেখে থাকবি, সুনন্দ।
বিভাসের দিকে ফিরে বলল, বিভাসদা, ও উজ্জয়িনী, কৃষ্ণনগর গার্লস কলেজের অধ্যাপিকা, আর...
তুলতুল উত্তর দিল, এরা দুজনই আমার সহকর্মী। বিপাশা আর ও সোমদত্তা। তারপর বিভাসের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার নাম শুনেছি। মানে খবরের কাগজে পড়েছি, ছবি দেখেছি।
বিভাস এই টেবিলে আর একটা চেয়ার টেনে এনে দিয়ে সুনন্দকে নিয়ে কোনের দিকে একটা টেবিলে গিয়ে বসল। তারপর বেয়ারাকে ডেকে নতুন অতিথিদের জন্যে তিনটে কফি বলে দিল।
— কোথায় উঠেছিস তোরা?
হাত দিয়ে দেখাল তুলতুল, এই তো পাশেই, হোটেল চানক্য। তোমরা কোথায় আছো?
— ট্যুরিস্ট লজে।
আমরাও ট্যুরিস্ট লজেই বুকিং করতে বলেছিলাম। যিনি বুকিং এর দায়িত্বে ছিলেন, বললেন – একটা রাজনৈতিক দলের সম্মেলন আছে, সেই জন্যেই লজ প্রায় প্যাকড। এই হোটেলটাও অবশ্য খুব ভালো। তবু ট্যুরিস্ট লজের পোজিশানটা দারুণ। আমি আর মা অনেকদিন আগে একবার এসে ছিলাম ওখানে। মনে হয় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে।
— কিন্তু দু’দিন যা মেঘলা যাচ্ছে, তাতে কাঞ্চনজঙ্ঘা কততা মুখ দেখাবে বলা যায় না। আমি তো এই দু’দিনে একবার মাত্র একটা পিক দেখতে পেয়েছি। আজও তো আকাশ মেঘে ঢাকা, দেখতেই পাচ্ছিস।
— দেখো কাল থেকে আকাশ পরিস্কার হয়ে যাবে।
— তোরা ক’দিন থাকবি?
— পাঁচদিন।
— আমরা পরশু চেক-আউট করবো। অনেক ঘর আজ ফাঁকা হয়ে গেছে। আমরা যারা কলকাতা থেকে এসেছি সেই ক’জন আছি। তোরা এখানে সিফট করতে পারিস। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি।
— দেখ না, দারুণ হয় তাহলে।
— বিভাসদাকে বলি। দু’তিনটে রুম আর ডর্মিটরি মিলিয়ে যদি হয় আপত্তি নেই তো?
&mdashh; না না।
তুলতুল এতক্ষণে বুঝে গেছে রাজনৈতিক দলটিরই একজন রূপাঞ্জনা। হঠাৎ কিছু ভাবলো। তারপর বলল,
— আচ্ছা রূপুদি মাঝে মাঝে খবরের কাগজে একজন রূপাঞ্জনা গুহর নাম পাই, একটি দলের নেত্রী। সে কি তুমি?
রূপাঞ্জন উত্তরে কিছু বললো না, মৃদু হেসে বললো, কাল সকালে চলে আয় ট্যুরিস্ট লজে। একসঙ্গে বেড়াতে বেরোবো।
বাড়িতে ভোরে ওঠার অভ্যেস নেই রূপাঞ্জনার। এখানে এসে উঠে পড়েছে খুব ভোরে। অনেক রাতে ঘুমোতে গেছে তবুও। রোজই তাই উঠছে। ঘুমভাঙার পর জানালা দিয়ে অপেক্ষা করে থেকেছে, কোথায় কী? জলভরা মেঘ ঢেকে রেখেছে রূপোর পাহাড় আর নবারুণের মায়ার খেলা।
কাল বিভাসদার রুমে অনেক রাত অব্দি সবাই মিলে নানারকম গল্প আড্ডা চলছিল। প্রায় সবার দার্জিলিংএর পূর্বস্মৃতি ছাড়াও মিটিংএর ফিডব্যাক নিয়ে আলোচনা চলছিল। রূপাঞ্জনার রেকর্ডেড বক্তৃতার অংশ শোনাচ্ছিল সুনন্দ “আমি জানি আপনারা একটা রাজনৈতিক আদর্শকে ভালোবেসে এই সভায় এসেছেন। তবু আমি আমার দল সম্পর্কে কিছুই বলব না। আজ আমি দলের সমর্থনে কিছু বলতে আসিনি। আপনাদের সঙ্গে একটা আত্মীয়তাবোধ থেকে একজন আপনজন হিসেবে শুধু কয়েকটা অনুরোধ করতে এসেছি।
আপনারা আপনাদের বিবেককে জাগ্রত রাখুন, সচেতন হোন। কোনো অবস্থাতেই কোনো স্বার্থান্বেষী রাজনীতির কারবারী যেন নিজের স্বার্থে আপনাদের ব্যবহার করতে না পারে। আপনার অঞ্চলকে ভালোবেসে ব্যক্তিস্বার্থের বিরোধিতা করুন। দার্জিলিং আমার স্বপ্নের শহর, এই পাহাড় আমাকে মাথা উঁচু রাখতে শিখিয়েছে। পাহাড়ের মানুষের সারল্য আর আন্তরিকতা সেই ছোটবেলা থেকে আমাকে বারবার টেনে আনে এখানে। নিজের হাতের তালুর মতো চিনি আমি দার্জিলিংকে। আমি আপনাদের ঘরের মেয়ে। আপনাদের মতো আমিও চাই একে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শৈলশহর রূপে গড়ে তুলতে। তার জন্যে আপনাদের সবার হাত চাই আমাদের গঠনমুখী হাতকে মজবুত করার জন্যে।
এখানে আমরা কী কী কাজ করেছি, সেটা শোনাতে আসিনি। যে কাজ করা উচিত ছিল, অথচ আমরা করিনি, সেটা জানতে এসেছি। আপনারা আমাদের পাশে থাকুন। আমাদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিন, দেখবেন তা শুধরে নেব আমরা। ভাবুন সমালোচনা করুন, নিজেদের জমানো ক্ষোভ প্রকাশ করুন, কিন্তু এই আত্মীয়তার বন্ধনকে ছিঁড়বেন না…”। সুনন্দ টেপ বন্ধ করল।
সবাই খুব খুশি। সত্যিই দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ মিনিট রূপাঞ্জনা মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল পাহাড়ের মানুষকে। দূর দূরান্ত থেকে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মানুষের ঢল নেমেছিল। মিটিংএর শেষে সবার মুখে মুখে আমাদের নেত্রী ‘রূপাংজনা-জি’।
— এই জন্যেই বলি ওর ভাবনায় নিজস্বতা আছে - বিভাস অভিভূত। দলের সবাই জানে সামনে লোকসভার নির্বাচন, বিভাসদার চোখ সেইদিকে।
স্বাভাবিকভাবেই ঘুমোতে দেরি হয়েছিল। রূপাঞ্জনা ভাবছিল, বিভাসদা বারবার ওকে বলেন, ভাবনার বৃত্তটাকে ছড়িয়ে দাও। বড় করে ভাবতে শেখো। দূরের দিকে তাকানোর অভ্যেস করো। কে জানে কোন দূরের ইঙ্গিত করেন বিভাস?
কালই ফিরে যেতে হবে। মনটা একটু খারাপ লাগছিল, এবার আর কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে দেখা হল না। মাঝরাত থেকে শুরু হলো অঝোর বৃষ্টি, সঙ্গে মেঘের গর্জন। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমক জানালার পর্দা ভেদ করে ঘরে এসে জানান দিচ্ছিল বাইরের প্রলয়কে।
ভোরে দরজায় নক শুনে ঘুম ভাঙল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ছ’টা পনেরো। উঠে অলস ভঙ্গীতে গায়ে শালটা জড়িয়ে দরজা খুলল। বেয়ারা চায়ের সরঞ্জাম রেখে বেরিয়ে গেল। এক কাপ চা ঢেলে নিয়ে জানালার সামনে দাঁড়াল। পর্দা সরাতেই রূপাঞ্জনার মুখ দিয়ে একটা বিস্ময়ের চিৎকার বেরিয়ে এল। গোটা জানালা জুড়ে যেন এক বিশাল রূপোর পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। সিঁড়ির মুখের ঘরটা বিভাস আর সুনন্দর। দরজায় নক করে ‘সুনন্দ জানালার পর্দা সরিয়ে দে’ বলেই নিচে নেমে লনে এসে দাঁড়াল।
ভেজা লন, উলের মোজা ভেদ করে পায়ের পাতা ছুঁয়েছে ঘাসে জমে থাকা বৃষ্টির জল। কোনোদিকে খেয়াল নেই। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সামনে এক অপার বিস্ময়। মনে হল যেন সূর্যের প্রথম রশ্মি কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে প্রতিফলিত হয়ে এসে ওর শরীর স্পর্শ করল। বুকের ভেতর থেকে কেউ উচ্চারণ করল, এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর, পুন্য হল অঙ্গ মম ধন্য হল অন্তর… একবার না, বারবার।
— রূপুদি, তুমি এই ঘরটা আমার জন্যে বুক করে দিয়ে যাও যেভাবে পারো।
— বিভাসদা বলে রেখেছেন হয়ে যাবে। তোদের সবারই এখানে হয়ে যাবে। কাল থেকে ট্যুরিস্ট লজ ফাঁকা। তোরা কাল সকালেই চলে আয়। আমরা তো ব্রেকফাস্ট করেই ন’টা নাগাদ বেরিয়ে যাবো। নাগাদ বেরিয়ে যাবো।
— কিন্তু তোমাদের ট্রেন তো সন্ধেবেলায়।
— শিলিগুড়িতে কাজ আছে।
ওরা প্রথমে ম্যালের পূবদিকের রাস্তা ধরে নিচের দিকে নামলো। চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়ি ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ এর পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। একটু অপ্রচলিত, খানিকটা এবড়ো খেবড়ো সরু পথ। বাঁদিকে পাহাড়ের গায়ে গায়ে বুনো লতায় ফুটে থাকা নানা রঙের ফুল, ফার্ণ এর জঙ্গল, অন্য পাশে খাদ গড়িয়ে নেমেছে। অনেক নিচুতে বাসরাস্তা দেখা যাচ্ছে। এদিকে ট্যুরিস্টরা আসে না। লোকাল লোকের যাওয়া আসা। ওদের নিয়ে নর্থ পয়েন্ট স্কুলের সামনে এসে দাঁড়ালো রূপাঞ্জনা।
— কি রে আরো হাঁটতে পারবি? মৌলী কী বলছে?
— কেন পারবো না? চলুন দেখি পথের শেষ কোথায়। দারুণ লাগছে। মনে হচ্ছে এটা ট্যুরিস্ট স্পট নয়। অন্য এক দার্জিলিং। এই যে না চেনা পথে পায়ে হেঁটে ঘুরছি এটা খুব অন্যরকম লাগছে। দার্জিলিংকে ছুঁয়ে ছেনে দেখা। এর আগে যেবার এসেছিলাম, গাড়ি ভাড়া করে ফাইভ পয়েন্ট, সেভেন পয়েন্ট-এ চোখ বুলিয়ে শপিং করে ফিরে গেছি।
মৌলী খুব এক্সাইটেড। এমনিতে ও খুব হাসি খুশি মজার মেয়ে। এখন চুপচাপ ফুল তুলছে, পাতা কালেক্ট করছে। তুলতুল অবাক হয়ে বলল,
— তুমি এই সব পথঘাট চিনলে কী করে? মনে হচ্ছে তোমার বাড়ি এখানে।
— দার্জিলিং-এ অনেকবার এসেছি।
— সে তো আমিও এসেছি, তিন চারবার।
— তোর সঙ্গে তো বিভাস রঞ্জন বসুর পরিচয় হয়নি আগে, চিনবি কী করে?
— ওঁর সঙ্গে এর আগেও এসেছো?
— বছর দশেক আগে। আমি, আমার ছোটকা, ছোটকাকিমা আর আমার ভাই রন এসেছিলাম। তখন বিভাসদাও ছিলেন আমাদের সঙ্গে, ওঁর নিজের কাজেই এসেছিলেন সম্ভবত। বিভাসদা আমাদের হাঁটিয়ে নিয়ে বেড়াতেন। খুব ভালো লেগেছিল সেবার। খুব ভালো চিনিয়ে দিয়েছিলেন দার্জিলিং এর আনাচ কানাচ। তারপর আমি আরো দু’বার এসেছি। তখনও এমনি হেঁটে বেড়িয়েছি। বিভাসদা আসলে আমার ছোটকার বন্ধু। এখন রাজনীতির সম্পর্কে দাদা ডাকলেও ছোটবেলায় আমি বিভাসকাকুই বলতাম।
ঝকঝকে রোদ উঠেছে। ধুপি গাছের ছায়া ধরে হাঁটতে বেশ লাগছিল। মাঝে মাঝেই একটা দুটো করে রডোডেনড্রন। ঝেঁপে ফুল এসেছে লাল, গোলাপি, সাদা বিভিন্ন রঙের। দার্জিলিং-এর প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ফুলের খুব সমাদর। ছোট ছোট কাঠের বাড়ির বারান্দায় সিঁড়িতে ছোট ছোট টব, কিংবা প্লাস্টিকের ব্যাগে মাটি ভরে তাতেই ফুলচাষ। বাড়িটা যতই সাদামাটা বা জীর্ণ হোক পরিচ্ছন্ন আর সুন্দর করে সাজানো, ফুলে ফুলে রঙিন।
বেশ খানিকটা নিচে নেমে শান্ত সুন্দর ভুটিয়া মনাস্ট্রিতে পৌঁছে চুপ হয়ে গেল মৌলি। আচমকা ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে জড়িয়ে ধরল রূপাঞ্জনাকে। অনেকক্ষণ ওখানেই বসে রইল ওরা। ছবি তুললো প্রচুর।
— কী রে তুলতুল হাঁপিয়ে যাসনি তো?
— না না। একটা অদ্ভুত এনার্জি পাচ্ছি। রূপুদি, ভাগ্যিস তোমাকে পেলাম। এ এক অন্য দার্জিলিং-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে।
চড়াই এ বাঁদিকের পথ ধরলো ওরা। বেশ খানিকক্ষণ হেঁটে আসার পর ধুপি গাছের ছায়ায় একটা কাঠের বেঞ্চ দেখে বসে পড়ল মৌলি। এবার ওরা সত্যিই হাঁপিয়ে গেছে। নিচে দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজ। বৃটিশ আমলের কাঠের বাড়ি। গঠনশৈলিও খুব সুন্দর। বড় বড় কাচের জানালা দিয়ে ক্লাসরুমের ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। মৌলি উঁকিঝুকি মারছে – এরা সবাই কি নেপালি?
— না না প্রচুর বাঙালি আছে। অধ্যাপকরা বেশিরভাগই তো বাঙালি। যাবে নাকি কলেজের ভেতর? ঘুরে দেখতে পারো। আমার এক পরিচিত দাদা আছেন এখানে, ইকনমিকস পড়ান।
— না বাবা। ক্লাসরুম ভুলে থাকতে চাই। এখন কি আমরা ম্যালে যাচ্ছি?
— হ্যাঁ ম্যালের দিকেই যাচ্ছি। তবে তার আগে এক জায়গায় কফি খাবো।
— কোথায়?
— চলো সামনেই। এটা তোমার সেভেন পয়েন্টের তালিকায় পাবে না। কিন্তু সত্যিই সুন্দর।
— তাইতো দেখছি, সেভেন পয়েন্টের আওতার বাইরে যা সবই খুব সুন্দর।
হট স্টিমুলেটিং কাফে। পাহাড়ের গায়ে প্রায় ঝুলন্ত ছোট্ট রেস্টুরেন্ট। নিচে চা বাগান। ওরা রেস্টুরেন্টের ভেতরে না বসে এর গায়ে লেগে থাকা খোলা একটুকরো ছাদে গিয়ে বসল। চারপাশে টবে টবে নানারকম ফার্ন আর মরসুমি ফুলের গাছ।
— নামটাও তো দারুণ সুন্দর। ভাগ্যিস আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
তুলতুল আর মৌলি দুজনেই উচ্ছ্বসিত। সমানে ক্যামেরার শাটার টিপে চলেছে।
এত বছর পর প্রায় মাটি খুঁড়ে তুলে আনা একটা সম্পর্ককে ঘিরে ভেতরে যে আবেগের বাষ্প জমেছে তাকে এখনও স্বপ্নের মতো লাগছে রূপাঞ্জনার। ও তো ভবিষ্যতের দিকে চোখ রেখে বর্তমানকে নিয়ে বাঁচার প্রতিজ্ঞা করেছে। এতদিন নিজের ধারণা ছিল পিছন দিকে তাকাতে চায় না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সেকথা পুরোপুরি সত্যি নয়। নতুন গল্পের নিচে পুরোনো কিছু শব্দ জলছবির মতো ঝাপসা হয়ে লেগে ছিল, সামান্য ভেজা বাতাসে আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ওর বৃত্তের পরিধিতে কিছু কিছু পুরোনো আবেগ আর ভালোবাসা এসে জমছে। সময় ও ঘটনার যোগসাজসে একদিন যারা ছিটকে গিয়েছিল, এক অদৃশ্য চুম্বক আবার ফিরিয়ে আনছে তাদের। নিজের গায়ে কি কোমল আস্তরণ পড়ছে, যা ওকে দুর্বল করে দিতে পারে? কিন্তু এখন ও জানে, রূপাঞ্জনা যেটুকু চায় তার এক কণাও বেশি গ্রহণ করবে না অতীত থেকে।
কিন্তু মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল তুলতুলের মুখে যখন শুনলো শান্তার শরীরের একটা দিক পুরোপুরি প্যারালাইজড, বিছানায় দিন কাটে।
ট্রেনে এবার কেন যেন খুব গাঢ় ঘুম হয়েছে। দমদম পৌঁছোনোর একটু আগে ঘুম ভেঙেছে। ফেরার সময়েও আপার বার্থ ছিল বলে কোনো ডিসটারবেন্স হয়নি। কাজেই জার্নির ক্লান্তি নেই এবার। ভেতরে একটা অন্য উত্তেজনা বোধ করছে। দুপুরে স্নান খাওয়া দাওয়া করে টুকটাক গিফটগুলো সবাইকে দেওয়ার পর সুতপার ঘরে এল রূপাঞ্জনা। সুতপা শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। রুপাঞ্জনাকে ঢুকতে দেখে বইটা বন্ধ করে বালিশের পাশে রেখে উঠে বসল।
— একটু ঘুমিয়ে নিলে পারতিস।
— দরকার নেই। কাল রাতে ট্রেনে বেশ ভালো ঘুমিয়েছি।
বিছানায় উঠে সুতপার কাছ ঘেঁসে শুয়ে পড়লো। সুতপা মেয়ের মাথায় একবার হাতটা বুলিয়ে নিয়ে বললেন,
— মিটিং কেমন হল? তোর বক্তব্য?
— সে তো যারা শুনেছে তারা বলতে পারবে। তবে দলের সবাই খুব খুশি এটা বলতে পারি। জানো মা, এবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে।
— অদ্ভুত মানে?
— না ঠিক অদ্ভুত না, অভাবিত বলতে পারো। শুনলে অবাক হয়ে যাবে।
— কী হয়েছে বলবি তো?
— তুলতুলের সঙ্গে দেখা হয়েছে।
— কে বল তো?
— এই দেখ, তুমিও ভুলে গেছ!
— নামটা কখনো শুনেছি হয়তো।
— নির্মাল্যকাকুর মেয়ে তুলতুল।
— সে কী! কোথায়? তুই চিনলি কেমন করে তাকে এত বছর পর?
রূপাঞ্জনা লক্ষ্য করলো সুতপার উত্তেজনা। তার মানে তুলতুলরা একেবারে মুছে যায়নি। ওদের জন্যে মায়ের মনে এখনো উত্তাপ আছে। শান্তার অসুস্থতার কথা শোনার পর হঠাৎ যেন কথা হারিয়ে ফেললো সুতপা। মুখের রেখায় স্পষ্ট বেদনার ছাপ। চোখের কোন চিকচুক করছে।
— তুমি একবার যাবে মা?
— যেতে তো খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন আমার যাওয়ার চেয়ে যার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো তাকে পাঠানো যায় কিনা দেখি।
— মেজকা?
রূপাঞ্জনা খানিকটা বিস্মিতও বটে। তাহলে সেই সময়কার ঘটনাটার ভেতর সিরিয়াস কিছু ছিল না, না কি এটা মায়ের উদারতা ঠিক বুঝতে পারছিল না।
— তুই কি ভাবছিস আমি জানি। দেখ রূপু, এটা ভুললে চলবে না যে সবার আগে শান্তা নির্মাল্যর বউ, ও সম্পর্কে অপর্ণার বোনও বটে। নির্মাল্য দীপুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমি তো দেখেছি নিজের সব ব্যাপারে দীপুর ওপর ওর কি সাংঘাতিক নির্ভরতা ছিল।
রূপাঞ্জনা উঠে বসলো। একটু ইতস্তত করলো, তারপর বালিশের পাশে রাখা বইটা হাতে নিয়ে পাতা ওলটালো, বন্ধ করল, ফের ওটা নাড়াচাড়া করতে করতে বললো,
— আচ্ছা মা, মেজকা কি মেজকাকিমার সঙ্গে সত্যিই কোনো অন্যায় করেছিলেন বলে মনে হয় তোমার?
— ন্যায় অন্যায় এত সহজে বিচার করা খুব মুশকিল। তবে এটুকু বলতে পারি, বেসিকালি দীপু খুব সৎ, ভালোমানুষ। ওসব ছাড়। এখন এত কিছু কাটা ছেঁড়া করার সময় নয়। জানতাম না, কিছু করারও সুযোগ ছিল না। এখন যখন ওদের এত বড় দুঃসময়ের কথাটা জানতে পারলাম, কাছে গিয়ে না দাঁড়িয়ে কি থাকতে পারবো আমরা? আমি ত যাবোই, তুমি আমার সঙ্গে যাবে মা?
— আগে দীপু গিয়ে একবার দেখা করে আসুক।
— মেজকাকিমা আবার অন্যভাবে নেবে না তো ব্যাপারটা?
— সে আমি দেখবো।
দার্জিলিং থেকে ফিরে একটা দিন মাত্র বিশ্রাম। কোথাও বেরোয়নি। দু’চারটে ফোন অ্যাটেন্ড করেছে শুধু। অনেকদিন পর নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগছে। ওখানে কিছু ছবি তুলেছিল। রম্য সেগুলো কমপিটারে তুলে নিয়েছে। পৌলমীর ঘরে বসে অমলা, পৌলমী আর রম্য ছবিগুলো দেখছিল। রূপাঞ্জনা ঢুকতেই পৌলমী বললো, কাউকে তো চিনতে পারছি না চিনিয়ে দাও তো দিদিভাই।
অধিকাংশ প্রাকৃতিক দৃশ্য। তুলতুলদের গ্রুপের সবার কিছু না কিছু ছবি আছে। তুলতুল আর মৌলীর বেশ কয়েকটা ছবি তুলেছিল রূপাঞ্জনা। আর ওর সঙ্গে তুলতুলের গোটা তিন চার ছবি মৌলী তুলে দিয়েছিল। বেড়াতে গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলার ব্যাপারে ওর নিজের খুব একটা আগ্রহ নেই। তার ওপর যাওয়াটা নেহাতই রাজনীতির দায় ছিল। যাওয়ার সময় রম্যই জোর করে ক্যামেরা দিয়ে দিয়েছিল। রূপাঞ্জনা ওকে হতাশ করেনি। কাঞ্চনজঙ্ঘা উপহার দিয়েছে।
রম্য খুব উচ্ছ্বসিত — ছবির ফ্রেমগুলো এক্সেলেন্ট পিসিমনি।
— হবে না কেন দিদিভাই নিজে ছবি আঁকে। পৌলমী রূপাঞ্জনার অন্ধভক্ত। সুযোগ পেলেই যেখানে সেখানে গুণ গুঁজে দেয়।
— এখানে আমার কৃতিত্ব নেই। ক্যামেরা তাক করলে গৌরীদির ক্যামেরায়ও অমন ছবিই উঠবে।
এত কথার মাঝে অমলা কী আর চুপ করে থাকতে পারে? বললেন, রূপু তো আগে কত ভালো ভালো ফটোও তুলেছে আমার। তোরা তো দেখিসনি। নিয়ে আসবো?
দিব্যেন্দুর একটা ক্যামেরা ছিল বিয়েতে উপহার পাওয়া। নিজের ছবি তোলার সখ ছিল না বলে পড়েই ছিল ঘরে। কলেজে ঢোকার পর সেই ক্যমেরা দিয়ে অমলার কয়েকটা ছবি তুলেছিল রূপাঞ্জনা। তার মধ্যে একটা ছবি খুব সুন্দর হয়েছিল। অমলা স্নান করে ভেজা কাপড়ে ফুল তুলে নিয়ে ঠাকুর ঘরে ঢুকছিলেন পিছন থেকে আচমকা ডাকতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছিলেন। সবাই খুব ভালো বলেছিল ছবিটা। অমলার আবদারে দিব্যেন্দু ওটা এনলার্জ করে বাঁধিয়ে দিয়েছিল। ছবিটা অমলার ঘরের দেয়ালে টাঙানো থাকত। একবার ঝড়ে ছিটকে পড়ে কাঁচ ভেঙে গিয়েছিল। তারপর থেকে ছবিটা অমলা আলমারিতে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। এতদিন পরে হঠাৎ সেটার কথা মনে পড়তেই উঠে নিজের ঘরের দিকে চললেন।
সন্ধের দিকে সুতপাকে ঘরে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে দীপ্তেন্দুদের ঘরে এলো রূপাঞ্জনা। সুতপা আর অপর্ণা বসে আছে চুপ করে। অপর্ণার চোখ ভেজা। একটু থমকে গেল রূপাঞ্জনা। অর্থপূর্ণ জিজ্ঞাসা নিয়ে সুতপার দিকে তাকালো। সুতপা ইশারায় ওকে বসতে বললো। রূপাঞ্জনা জানে মেজকাকে মা তুলতুলদের বাড়িতে যেতে বলেছিলেন। তবে কি মেজকার সেই যাওয়ার কারণেই কোনো প্রবলেম?
— তুলতুলদের কথা বলছিলাম অপুকে।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো রূপাঞ্জনা। অনেক বছর তো কেটে গেছে। অপর্ণাকে তুলতুলের দিকে আর একটু এগিয়ে দেওয়ার জন্যে রূপাঞ্জনা বলল,
— তুলতুলের কথাটা ভাবো একবার। অসুস্থ মায়ের দেখশোনা করবে, না রোজ দেড়শো দেড়শো তিনশ কিলোমিটার ট্রেনজার্নি করে চাকরি করতে যাবে। নিজেকে নিয়ে ভাবারই অবকাশ নেই মেয়েটার। একটা মানুষ নেই যে ওর পাশে দাঁড়াবে।
অপর্ণা চোখ মুছে গলাটা একটু পরিস্কার করে নিয়ে রূপাঞ্জনার দিকে তাকালো।
— আমরা তো আছি। আমাদের একটা খবর তো দিতে পারতো। এত অভিমান!
আবার কেঁদে ফেললো অপর্ণা। রূপাঞ্জনা বিস্মিত হয়ে ভাবলো অপর্ণার এই চোখের জলকে কোন মাপকাঠিতে মাপবে? সময়ের প্রলেপ? বয়স মানুষকে উদার করে? না কি নেহাতই মানবিকতা? সহমর্মিতা? সিস্টারহুড? যা রমলাকে বারবার টেনে নিয়ে গেছে পূর্ণেন্দু গুহর দ্বিতীয় সংসারের দিকে?
— কী রে, সুইচ বন্ধ কেন?
— পেশেন্ট দেখার সময় আমি ফোন বন্ধ রাখি মা।
— যদি কোনো জরুরি দরকার থাকে কারো?
— মাত্র তো ঘন্টা তিনেকের ব্যাপার। তার মধ্যে যদি আমার কিছু হয়?
— মা, আমি আসার সময় দিব্যি দেখে এলাম তুমি ডিনারের জন্যে মোমো তৈরি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলে। আমাকে ওটা না খাইয়ে মরবে না তুমি, আমি জানি।
— খুব অসভ্য হয়েছিস।
— ফোন করেছিলে কেন?
— বিকেলে টিফিন করেছিস?
— হুঁ।
— কী খেলি?
— অ্যাজ ইউজুয়াল স্যান্ডউইচ, চিকেন। তা এটা জানার জন্যে ফোন করেছিলে?
— না। তুই কখন ফিরবি জানার জন্যে। আমি আর তোর বাবা একবার শ্যামবাজারে যাবো ছোটমামাকে দেখতে।
— নিশ্চিন্তে যাও, আমার ফিরতে রাত হবে। নীলাঞ্জনদের ওখানে যেতেই হবে। আবার ফোন করেছিল।
— তার মানে তো ওখানেই ডিনার করে ফিরবি।
— অবভিয়াসলি।
— গিফট কিনেছিস?
যাওয়ার পথে ফুলটুল কিছু কিনে নেব।
— ফুলটুল কি রে! এটা ওদের ফার্স্ট অ্যানিভারসারি। তাছাড়া তুই ওর বিয়েতে যাসনি। তোর আর কবে বুদ্ধি সুদ্ধি হবে রে? একটা ভালো গিফট নিয়ে যাবি।
— দেখছি।
কফি শেষ করে সাবে উঠে দাঁড়িয়েছে, প্রায় ঝোড়ো হাওয়ার মতো ঢুকলো তৃণা। হাতে গোটা দুই তিন ম্যাগাজিন, কাঁধে যথারীতি ক্যামেরার ঢাউস ব্যাগ। ঢুকেই ঝপঝপ করে দুটো ইংরেজি ম্যাগাজিন নামিয়ে রাখলো টেবিলের ওপর। রন জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো তৃণার মুখের দিকে।
— আরে বাবা আমাকে দেখছিস কেন, ম্যাগাজিন দুটো উলটে দেখ।
— কী আছে ওতে?
— তৃণা উত্তর না দিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। রন বাধ্য হয়ে ম্যাগাজিন দুটো হাতে নিল। একটার কভারে কলকাতার প্রতিমা বিসর্জনের ছবি। ঠিক বিসর্জনের নয়, বিসর্জনের পরের। তৃণার তোলা। অন্যটার থার্ড কভারে বর্ষার ছবি। দুটো বাচ্চা বৃষ্টির জমা জলে ছাতা ভাসিয়ে তার মধ্যে স্কুলব্যাগ রেখে নৌকোর মতো ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলেছে, নিজেরা ভিজছে। বেশ ভালো ছবিটা।
— বাহ, তুই তো সেলিব্রিটি ফটোগ্রাফার হয়ে গেলি।
ম্যাগাজিন দুটো বন্ধ করে রন এবার নীলাঞ্জনের নম্বর ডায়াল করলো। তৃণা চোখ কুঁচকে তাকালো। আপনমনে বললো, এটা ঠাট্টা না কমপ্লিমেন্ট বোঝা গেল না। ম্যাগাজিন দুটো আবার ব্যাগে পুরে নিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। এ পাশটায় এখনও ছোট ছোট ঝুপড়ি রয়ে গেছে। অদ্ভুত কনট্রাস্ট এই পাড়াটা। একদিকে ঝাঁ চকচকে হাইরাইজ। তার পাশে দুঃখের অন্ন বেটে খাওয়া এই বস্তি। বাচ্চাগুলো খেলছে, মুখে অদ্ভুত প্রসন্নতা। চাহিদা কম থাকলে হয়তো অল্পেই মানুষ সুখের নাগাল পায়। এই সুখের ছবিটা ওর দরকার। ব্যাগ খুলে ক্যামেরা বার করলো তৃণা।
নীলাঞ্জনের নম্বর ডায়াল করে গুছিয়ে বসলো রন। শুনলো ওপাশে নীলাঞ্জনের গলায় ব্যস্ততা,
— রন, তুই এক মিনিট হোল্ড কর আমি গাড়িটাকে সাইড করে নিয়ে কথা বলছি। শোন, তুই ছেড়ে দে। আমিই কল করবো তোকে।
ফোন কেটে দিয়ে তৃণার দিকে ফিরলো রন। জিনসের ওপর ইন করা সাদা শার্ট, শার্টের একটা কোন বেরিয়ে আছে সামনের দিকে। যখন ঢুকেছিল, টপ নট করা ছিল। এখন খোলা চুল পিঠের ওপর ছড়ানো। মুখের একটা পাশ ঢেকে আছে চুলে, তারই ফাঁক দিয়ে উজ্জ্বল চোখের মণি দেখা যাচ্ছে। গভীর মনোযোগে লেন্সের ফোকাস ঠিক করছে। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে আছে। এটা ওর অতি পরিচিত একটা ভঙ্গী। খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু করতে গেলেই এটা করে ও। চোখ ফেরাতে পারছে না রন। ও জানে না এর চেয়ে সুন্দর মুখ আর দেখেছে কিনা।
সুদীপ এসে দাঁড়িয়েছে। ওর অ্যাটেন্ডেন্ট।
— স্যার, কাল আমি একটু দেরী করে আসবো। একটা অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন আছে। মানে আমার মাসতুতো বোনের ছেলের।
— কখন আসবে?
— সাড়ে তিনটের মধ্যেই চলে আসবো। আমি ব্রতীনকে বলেছি আমি না আসা অব্দি ও চেম্বারে থাকবে। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না।
তৃণা লেন্সের ঢাকনা বন্ধ করতে করতে এদিকে ফিরে বলল,
— ব্রতীনকে কিছু বলতে হবে না সুদীপ। কাল তোমার ডিউটি আমি করে দেব। তুমি নিশ্চিন্তে অন্নপ্রাশন অ্যাটেন্ড করো। গ্রান্টেড ডঃ গুহ?
উত্তরের আশায় তাকালো রনর দিকে। ওর কথায় সুদীপ একটু অপ্রস্তুত মুখ করে হাসলো। রন সুদীপের দিকে তাকিয়ে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লো। কারণ ও জানে কল হয়তো তৃণা সত্যিই চেম্বারে এসে বসে থাকবে। ওর কাজকর্মই এমন অদ্ভুত।
তৃণা একটা বিখ্যাত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ায়। ওর ক্লাস মূলত সকালের দিকে। কলেজে চাকরি পেয়েও জয়েন করলো না। মেডিকেলে দু’বছর পড়ার পর ছেড়ে দিল শুধু ইনটারেস্ট পাচ্ছে না বলে। দুটো বছর নষ্ট করে ফের ফিজিওলজি নিয়ে ভর্তি হল প্রেসিডেন্সিতে। এমএসসি পড়তে পড়তে ফটোগ্রাফির নেশায় পেয়ে বসেছিল। সারাক্ষণ ক্যামেরা কাঁধে ছুটে বেড়াতো। রন পড়াশুনার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। ও একদিন রেগে মেগে বলেই ফেলল,
— এমবিবিএসটা ছাড়লি, এমএসসি-টাও বোধ হয় হবে না শেষ পর্যন্ত। কেন শুধু শধু ভুলভাল জায়গায় ঢুকছিস? তোর সঠিক জায়গা তো ছিল ফটো-জার্নালিজম।
রন ওকে খোঁচা দিতে ভালোবাসে। তৃণা অবশ্য খুব একটা গায়ে মাখেনা খোঁচাগুলো। একটু হেসে বলল,
— জানিস তো আমার যখন জন্ম হয়, আমার বাবা তখন অস্ট্রেলিয়ায়। তেরো মাস বয়েস পর্যন্ত বাবার একটা ছবি দেখিয়ে আমার সঙ্গে পরিচিত করানো হয়েছিল বাবাকে। শুধু পরিচয় নয়, ঘনিষ্ঠতাও। সেই ঘনিষ্ঠতাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, বাবা যখন ফিরলেন, তাঁকে বাবা বলে কিছুতেই মানতে চাইতাম না। প্রায় মাস দুয়েক লেগেছিল ফটোর বাবাত্ব ভোলাতে। আমার ফটোগ্রাফি প্রেম জন্ম থেকে। এমবিবিএস এ ভর্তি হয়েছিলাম মায়ের প্রেশারে, স্বেচ্ছায় নয়। আর এমএসসি? ভাবিস না স্টেজে মেরে দেব।
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত ফার্স্টক্লাসটা পেয়েছিল।
আবার মোবাইল বাজলো রনর। নীলাঞ্জন।
— শোন রন তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি,
— বল।
— তুই কিন্তু অবশ্যই তৃণাকে নিয়ে আসবি। আমি ওকে ফোনে পাচ্ছি না। যতবার করছি, বলছে — সুইচড অফ। কী ব্যাপার বলতো তোরা দুজনেই সুইচ অফ করে রেখেছিস কেন? তোরা কি বাইরে কোথাও গেছিস? তৃণাকে তো কাল রাত থেকে এ পর্যন্ত পাঁচবার ট্রাই করেছি।
— তুই কথা বলবি তৃণার সঙ্গে?
— তাই বলো চাঁদ, দেবী তোমার সঙ্গে আছে। এবার বোঝা গেল দুজনের সুইচ অফ রহস্য।
— কাঁচা বকিস না। আমি এখন চেম্বারে, তিনি এইমাত্র এলেন।
— হ্যাঁ রে ওকে এখন নেমন্তন্ন করলে আসবে তো? মানে কিছু মনে করবে না তো?
— এতদিনে এই চিনলি তৃণাকে? নে, কথা বল।
তৃণাকে ফোনটা ধরিয়ে দিল রন। নীলাঞ্জন কথা শুরু করল ধমক দিয়ে।
— এই মেয়ে ফোন বন্ধ করে রাখিস কেন?
— ফোনের গল্পটা পরে বলছি, তুমি কী বলবে বল।
— সন্ধেবেলায় আসিস কিন্তু।
— যাবো। তোমার বউকে পটেরবিবি সাজতে নিষেধ কোরো প্লিজ। আমার ক্যামেরার কটকটে রঙে অ্যালার্জি আছে। ছবি উঠবে না কিন্তু।
নীলাঞ্জনের বউ খুব উগ্র সাজগোজ করে। বন্ধুরা সবাই আড়ালে এটা নিয়ে টিপ্পনি কাটে। তখন তৃণা তার প্রতিবাদ করে। তৃণার কোনো আড়াল নেই। বলা ভালো পারতপক্ষে আড়ালে ও কারো সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করে না। বন্ধুস্থানীয় হলে যা বলার মুখের ওপরই হুটহাট বলে দেয়। কেউ কিছু মনে করে না আজকাল। যাকে বলে, সে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়লেও অন্যরা উপভোগ করে। রন বরং লজ্জা পায়। কিন্তু তৃণার সেই এক কথা — আমি বনিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলতে পারবো না। বললে সত্যিটা বলবো, নাহলে চুপ করে থাকবো।
ফোনটা কেটে দেওয়ার পর তৃণার দিকে তাকালো রন।
— তোর ফোনের গল্পটা এবার বল।
— গল্প আবার কী, হারিয়েছে। ট্যাক্সিতে ফেলে এসেছি।
— তোর আর ফোনের মাঝখানে ট্যাক্সি কোত্থেকে এল?
— কাল রুমনির জন্মদিন ছিল। তোকে বললাম না সন্ধেবেলায়? আমি আর মিতু ট্যাক্সিতে ফিরেছি। কাল ওর গাড়ি ছিল না।
ঘড়ি দেখলো রন। ছ’টা কুড়ি। সময়ের হিসেব করে নিল। গিফট কিনে নিয়ে নিউ আলিপুর পৌঁছোতে অন্তত সাড়ে আটটা বাজবে। তৃণার দিকে একবার তাকালো। এইরকম ক্যাজুয়াল ড্রেসে ওর যাওয়া চলবে কিনা একবার জরিপ করে নিলো। ওর নিজের তো যে কোনো সাজেই ভালো লাগে তৃণাকে। কিন্তু নীলাঞ্জনের অ্যারেঞ্জ করা পার্টিতে নিশ্চয় বিউটি কনটেস্ট হবে। ওর বউ-এর বন্ধুবৃত্ত যেমন।
— কি রে তুই বাড়ি হয়ে তারপর যাবি তো?
বাড়ি থেকেই তো এলাম।
— নীলাঞ্জনদের ওখানে এভাবেই যাবি?
— না বেনারসি পরে যাবো। চল একটা কিনে দিবি।
— তা বলোনি, তবু অন্যরকম কিছু যদি পরতে চাস, চেঞ্জ করে নিতে পারিস।
— ফ্যাশান প্যারেড হবে বুঝি? তাহলে তো আরো ভালো, আমি ওখানে জাজমেন্ট দেবো। নে চল এবার বেরোই।
রন মনে মনে হাসলো। মা যদি জানতে পারে এই ড্রেসে তৃণা নীলাঞ্জনের ম্যারেজ অ্যানিভারসারি অ্যাটেন্ড করতে যাচ্ছে, হার্টফেল করবে। শর্মিলা সাজগোজের ব্যাপারে এতটাই খুঁতখুঁতে যে কোথাও বেরোনোর সময় পাক্কা একটি ঘন্টা সময় লাগে রেডি হতে। পৌলমীকে ফোনে মাঝে মাঝে নানারকম টিপস দেয়।
তুলতুল যখন কলেজে পড়ে, এই পাড়াটা তখনো পুরোপুরি হাউজিং কমপ্লেক্সের কবলে পড়েনি। কিছু পুরোনো বাড়ি তখনো তাদের যাবতীয় স্মৃতির শ্যাওলা মেখে অক্ষত ছিল। সরু সরু গলি, গায়ে গায়ে বাড়ি, বর্ষাকালে গলিতে একহাঁটু জল নামতে সপ্তাহ কেটে যেতো। এত সব অসুবিধা থাকলেও একটা পাড়া সুলভ আন্তরিকতা টের পাওয়া যেতো সবার আচরণে। তুলতুল দু’একবার মাকে বলেছে একটা ভালো ফ্ল্যাট দেখে অন্য জায়গায় উঠে যাওয়ার কথা। শান্তা রাজি হয়নি। বহুদিনের চেনা মানুষজন, ডাকলে ছুটে আসে।নিশ্চিন্ত লাগে। নির্মাল্যকে সবাই খুব ভালোবাসতো। নির্মাল্যর মৃত্যুটাকে প্রতিবেশিরা নিজেদের আত্মীয় বিয়োগ বলে মনে করেছিল।
দেখতে দেখতে পুরোনো বাড়ি হাতবদল হতে শুরু করলো। রঙজ্বলা বাড়িগুলোর জায়গায় ঝাঁ চকচকে হাউজিং কমপ্লেক্স উঠলো একের পর এক। তুলতুলদের বাড়িটাও আর গা বাঁচিয়ে থাকতে পারলো না। চারদিকে তাকিয়ে নিজেরাই হীনমন্যতায় ভুগতো। বছর চারেক আগে নির্মাল্যর এক ছাত্র, দায়িত্ব নিয়ে বাড়িটা ভেঙে তার জায়গায় এই বহুতল বানিয়েছে। বিনিময়ে তুলতুলরা পেয়েছিল পনর লাখ টাকা আর দোতলায় বারোশো স্কোয়ার ফুটের এই ফ্ল্যাট।
এ পাড়ার পুরোনো বাসিন্দা যারা তারা সবাই তুলতুল আর শান্তার প্রতি এখনও একটা অলিখিত কর্তব্যবোধ অনুভব করে। খানিকটা সেই কারণেও মাকে একলা রেখে সারাদিন নিশ্চিন্ত বোধ করে তুলতুল মালতী অবশ্য শান্তার খুবই যত্ন নেয়। ওর একটাই দোষ, একটু সুযোগ পেলেই ফুড়ুৎ করে একটু পাড়া বেড়িয়ে আসে।
তুলতুল বলেছিল, তুই দুপুরে না গিয়ে বরং সন্ধের দিকে যাস। ছ’টার পরে। তখন আমি বাড়ি থাকি। মাকে আর একা থাকতে হয় না।
— না দিদি, তখন কাস্টমারদের এত ভিড় হয়ে যায় যে, শোভনাদি তাদের নিয়েই হিমশিম খায়। ঠিক মতো অর্ডার বুঝে নিতে খুব ঝক্কি হয়। দুপুরবেলাটা ফাঁকা থাকে, ধীরে সুস্থে সব জেনে নিতে পারি।
— বেশ তো তাহলে সকালের দিকে দোকান খোলার সময় যাস।
— ও মা তাই হয় নাকি! তুমি কলেজে যাবে, রান্নাবান্না,তোমার খাবার গুছিয়ে দেওয়া, মায়ের স্নানের ব্যবস্থা করা।
— আমার খাওয়ার কথা তোকে ভাবতে হবে না। একটু কিছু সেদ্ধ আর ভাত করে রাখলে আমি নিজেই নিয়ে খেয়ে নেব। তুই পরে ধীরেসুস্থে রান্না কমপ্লিট করিস।
শান্তাকেই মধ্যস্থতা করতে হয়।
— যাক না ওর সুবিধে মতো। ওইটুকু সময় একা থাকতে আমার কোনো অসুবিধে হবে না। তুই মনে করে রোজ চাবিটা নিয়ে যাস, তাহলে তো আর সমস্যা নেই।
সমস্যা তো একটাই, উঠে দেয়াল ধরে ধরে গিয়ে দরজাটা খোলা। তুলতুল একটা হুইল চেয়ার কিনতে চেয়েছিল। শান্তা আঁতকে উঠেছে।
— কক্ষনো না। হুইল চেয়ারে বসলেই নিজেকে সত্যি সত্যি পঙ্গু মনে হবে।
— কিন্তু মা তোমার চলফেরাটা কত সহজ হয়ে যাবে ভাবো তো।
— চলাফেরা সহজ হবে, কিন্তু বাঁচাটা কষ্টকর হবে।
— মানে?
শান্তা আর কথা না বাড়িয়ে পাশ ফিরে জানালার বাইরে চোখ রাখলো। গত দেড় বছর ধরে ওই জানালা, তার গ্রিলের প্রতিটি বাঁক, জানালার ওপর ঝুঁকে আসা গুলমোহরের ডাল, এমন কি প্রতিদিন দুপুরবেলায় গ্রিপ পেরিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে আসা চড়ুই দুটোর প্রত্যেকটা নড়াচড়া মুখস্ত হয়ে গেছে। এই সব কিছু নিয়ে একটা নিস্তরঙ্গ জীবন। একটা নির্দিষ্ট ফ্রেমে স্তব্ধ হয়ে থাকা এই দীর্ঘ সময় এমন ভার হয়ে চেপে আছে সব দিক দিয়ে, যে নিজেকে একটা জবুথবু অপ্রয়োজনীয় সামগ্রী মনে হয় আজকাল। মনে হয় জগদ্দল পাথরের মতো তুলতুলের মাথার ওপর চেপে বসে আছে। ফিজিওথেরাপিস্ট ছেলেটি যদিও প্রত্যেকদিন হাসিমুখে বলে — ম্যাডাম, অনেক ইম্প্রুভ করেছেন আপনি। এবার খুব দ্রুত রিকভার করবেন।
শান্তা জানে এই কথাগুলো ওর চিকিৎসার অঙ্গ। তবু শুনতে ভালো লাগে। এই আশ্বাসটুকু খানিকটা আরাম দেয়। শান্তার আশা, আস্তে আস্তে হয়তো ভালো হয়ে উঠবে। কিন্তু তুলতুল জানে শান্তা আর কোনোদিন ভালো হবে না। ডাঃ সিনহা তুলতুলকে বলেছেন।
প্রবলেমটা প্রথম যখন শুরু হয়েছিল, শান্তা উপেক্ষা করেছে। কোমর থেকে বাঁ পায়ের দিকটা মাঝে মাঝে কনকন করতো, কখনো অবশ লাগতো। ব্যথা করলে নিজেই একটা ব্যথার ওষুধ খেয়ে নিতো। মালতীকে বলতো একটু টিপে দিতে। এইভাবে বছর খানেক চলেছে। তুলতুলকে কিছুই জানতে দেয়নি। রকেই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে রোজ কলেজ করতে হয়। ওকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে আর ইচ্ছে করেনা। নিজেই নিজের মতো করে কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করতো।
কিন্তু রিটায়ারমেন্টের দিন, ওর ফেয়ারওয়েলের পর বিদায়ীভাষণ দিতে দিতে একটু বেশিই আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল শান্তা। তিরিশ বছর ধরে একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। সহকর্মীদের চোখ ভেজা, ছাত্রীদের ফুঁপিয়ে কান্নার মধ্যে নিজেও কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। হেডমিস্ট্রেস রেবাদি ধরে বসিয়ে দিয়েছিলেন শান্তাকে। তারপর উঠে আসার যখন দাঁড়াতে গেল, মনে হলো কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত যেন পুঁতে গেছে মেঝের সঙ্গে। কিছুতেই টেনে তুলতে পারছে না। স্কুল থেকেই সোজা পিজিতে। পনেরোদিন পর বাড়ি ফিরে সেই যে বিছানায় আশ্রয় নেওয়া, একইভাবে চলছে।
তুলতুল যেদিন চাবি নিতে ভুলে যায়, আর মালতী ফেরার আগেই ফিরে আসে, সেদিন দরজা খুলে দেওয়ার জন্যে একটা বিশাল পাথরকে টানতে টানতে দরজার কাছে পৌঁছোয় শান্তা। আর ওইটুকু যেতে হাজার মাইল পেরোনোর ক্লান্তি অনুভব করে। তবু হুইল চেয়ারে বসতে চায় না। শুধু মনে হয় হুইল চেয়ারে বসা মানেই যেন কনফার্ম পঙ্গুত্ব। স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া — তুমি চলৎশক্তিহীন, পরনির্ভর একটা জড় বস্তু। দরজা খোলার পর তুলতুল যখন হাসিমুখে গভীর মমতায় ওর শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে, শান্তা পরম তৃপ্তিতে নিজেকে ছেড়ে দেয় তুলতুলের ওপর। আর তখন, শুধু তখনই নিজেকে পালকের মতো হালকা মনে হয়।
এসব কথা শুনে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে তুলতুলের। কিন্তু নিজের অসহায়তার কাছে আত্মসমর্পন করে। বোঝে হুইলচেয়ার নিতে না চাওয়ার এই ব্যাপারটা সইকোলজিকাল। তাই জোর করে না। ওর একটা বড় ভরসা মালতী। পিজিতে মাকে দেখতে গিয়ে কান্নায় এমনভাবে ভেঙে পড়েছিল মালতী, বাড়ি ফেরে আসার পরও দুদিন ধরে থেকে থেকেই চলেছিল সে কান্না। তারপর থেকে মাকে ও একটা শিশুর মতো আগলে রাখে, যত্ন করে। খুব ছোটবেলা থেকে এ বাড়িতে আছে মালতী।
মালতীর মা এন্টালি বাজারে সব্জি বিক্রি করতো, আর দুপুর বেলায় একটা বাড়িতে ঠিকে কাজ করতো। মালতী তখন খুব ছোট, বাজারে মায়ের পাশে বসে হাতে হাতে সাহায্য করতো । শান্তা একদিন সব্জি কিনতে গিয়ে ওর মাকে বলেছিল, মেয়েটাকে বাজারের মধ্যে বসিয়ে না রেখে আমার কাছে দাও। ঘরে এক আধটু ফাই ফরমাস খাটবে। সারাদিন থাকবে, খাওয়া দাওয়া করবে। তুমি সন্ধেবেলায় বাড়ি ফেরার সময় নিয়ে যাবে। আমার তো অন্য কাজের লোক আছেই। সে সবই করে দিয়ে যায়। ওর কোনো কষ্ট হবে না।
মালতীর বয়স তখন আট ন’বছর। সেই থেকে পরিবারের একজন হয়ে আছে। তুলতুল মাকে বলেছিল — মা, মালতীকে তুমি ঝি হতে দিও না।
ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল শান্তা। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর ফেল করতে শুরু করলো ক্লাসে। তারপর থেকে আর স্কুলেই যেতে চাইতো না। বলতো, পড়তে আমার ভালো লাগে না মা, মাথায় কিছু ঢোকে না। তুমি আমাকে বাড়িতে পড়িও।
স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে ওকে সেলাইএর স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল শান্তা। খুব ভালো কাটছাঁট শিখেছে। হাতের কাজ ভালো বলে সেলাই এর স্কুল থেকেই ওকে একটা লেডিস টেলারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে অর্ডার এনে বাড়িতে বসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে সেলাই করে আয় করে। শান্তা ওকে সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে আশেপাশের মহিলারাও ব্লাউজ বানাতে দেয়োকে। বলতে গেলে ওর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত।
আজ দরজা খুলে তুলতুল টের পায়,মালতী ঘরেই আছে। দরজা খোলার শব্দে ও রান্নাঘর থেকে মুখ বার করে দেখলো একবার। তুলতুলের ভুরুতে ভাঁজ।
— কি রে তুই বেরোসনি আজ?
— না, আগের অর্ডারগুলো শেষ হয়নি।
বলেই রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক লাগলো তুলতুলের। কারণ আজ পর্যন্ত কখনো দেখেনি নির্দিষ্ট সময়ে মালতীর অর্ডারি কাজ শেষ হয়নি। দরকারে রাত জেগেও কজ করে। সেলাই-এর ব্যাপারে দারুণ নিষ্ঠা ওর। কিন্তু এই মুহূর্তে সেইসব ভাবনার দিকে গেল না তুলতুল। ডাইনিং স্পেস পেরিয়ে দ্রুত পায়ে মায়ের ঘরে এলো। শান্তা চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে শুয়ে আছে, ঘুমোচ্ছে কিনা বোঝা গেল না। তুলতুল অন্যদিন বাড়ি ফিরে দেখে, শান্তা বই বা কোনো পত্রিকা পড়ছে, কিংবা টুকটাক কিছু এমব্রয়ডারি করছে। ভাবলো, ঘুমিয়ে থাকলে এখন আর ডাকবে না। কারণ ঘুম নিয়ে শান্তার খুব সমস্যা। রাতে তো প্রায়ই ঘুম হয় না, ছটফট কর। তখন বাধ্য হয়ে ঘুমের ওষুধ খেতে হয়।
তুলতুল মাকে এক ঝলক দেখে নিয়ে রান্নাঘরের দরজায় উঁকি দিল।
— মালতী, মা এই অসময়ে ঘুমোচ্ছে, শরীর ঠিক আছে তো?
— কই ঘুমোচ্ছে না তো। এিতো তুমি ফেরার একটু আগেই আমাকে বলছিল তোমার জন্যে জলখাবার বানিয়ে রাখতে। যাও কথা বলো গিয়ে।
মালতী মুখ নিচু করে নিজের কাজ করতে করতে উত্তর দিল। ও সবসময় খুব কলবল করে। এখন উত্তরটা সংক্ষিপ্ত এল। এটা নিয়েও আর ভাবলো না তুলতুল। দ্রুত মায়ের কাছে ফিরে এলো। চোখ থেকে হাত সরেছে শান্তার।
— ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিস কেন? যা, চেঞ্জ করে নে।
তুলতুল পাশে বসে মায়ের কপালে গলায় হাত দিয়ে দেখলো। শান্তা মৃদু হেসে শরীরটাকে একটু ওপরের দিকে টেনে তুললো। তুলতুল তাড়াতাড়ি পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে ঠিক করে বসিয়ে দিল মাকে।
— তোমার শরীর ঠিক আছে তো মা?
— হ্যাঁ। তুই যা না ফ্রেস হয়ে আয়।
— দিদি তোমার খাবার কি মায়ের ঘরে নিয়ে যাবো?
— হ্যাঁ, দশ মিনিট পর।
মালতীর গলা পেয়ে চটপট উঠে পড়লো তুলতুল। চেঞ্জ করে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। অনযদিন ফিরে এসে স্নান করে আজ নিজেকে অতটা সময় দিতে চাইল না। চোখে মুখে জল ছোঁয়ানোর পর আবার ওর মনে হল, আজ ঘরের পরিবেশ অনযদিনের চেয়ে একটু আলাদা। ট্রেন ঠিক সময়ে ছেড়েছিল কি না, কেমন ভিড় ছি। ও বসার জায়গা পেয়েছিল কি না — মা তার প্রতিদিনের এই রুটিন এনকোয়ারি করলো না। মালতীও প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথাও বলছে না। ভুরুতে ভাঁজ নিয়েই আবার মায়ের কাছে এলো তুলতুল। শান্তা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো বটে, কিন্তু হাসির নিচে চাপা পড়ে থাকা কান্নার দাগ চোখ এড়ালো না তুলতুলের। কিন্তু এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না।
মালতী বিছানার পাশে একটা ছোট টুল টেনে এনে তুলতুলের খাবার রেখে চলে গেল।
— মা, মালতীকে বকাবকি করেছ নাকি?
— না তো।
— সিরিয়াস মুখ করে ঘুরছে, যেটা অর পক্ষে মোটেই স্বাভাবিক না।
— মা তুমি আর চা খাবে?
মালতী আবার এসে দাঁড়িয়েছে, শান্তা এ প্রশ্নের উত্তর দিল না। তুলতুল ওর প্রশ্নগুলোকে আপাতত সরিয়ে রেখে খাওয়ায় মন দিল। একটুখানি মুখে দিয়েই বলল — উঁম, দারুণ বানিয়েছে। মালতী তোকে নিয়ে আমি রেস্টুরেন্ট খুলবো রে। রোজ রোজ এই এত পথ পাড়ি দিয়ে এই মাস্টারি করতে যেতে আর ভালো লাগে না।
খেতে খেতে হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়াতে উঠে ডাইনিং স্পেসে গেল। চেয়ারের কোনে ঝোলানো ব্যাগটা তুলে নিতে গিয়ে এতক্ষণে খেয়াল হল টেবিলের ওপর একটা কাপপ্লেট রাখা। কেউ চা খেয়েছে। বাইরের কেউ। এই কাপ সধারণত বাইরে বেরোয় না। দ্রুত মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
— কে এসেছিল মা?
— তোর ভালোকাকু।
তুলতুল এক মুহূর্ত নিজের ভেতর ডুব দিল। ভালোকাকু মানে রূপুদিদির মেজকা, মানে দীপ্তেন্দু গুহ। রূপুদিদির কাছে ওদের সব খবর শোনার পর দেখা করতে এসেছিলেন। খুবই স্বাভাবিক। পুরোনো আত্মীয়তা। মাঝে যোগাযোগ ছিল না। কেন তা নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি। এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার ভেতরই ও ওর শৈশব কৈশোর পেরিয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন পর দেখা, আবেগে চোখে জল আসাটাও স্বাভাবিক। তবু কেন এই স্বাভাবিকতাকে ছাপিয়ে অন্যরকম লাগছে? মালতী কেন এত চুপচাপ, মাকেও মনে হচ্ছে কেঁদেছে, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিই। কেন?
দীপ্তেন্দু হঠাৎ করেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল। প্রথমে কারণটা জানতো না বলেই খুব অসহায় লাগতো শান্তার। কষ্ট হতো। ওদের বাড়িতে একদিন ফোন করলো। দীপ্তেন্দুর মা ফোন ধরেছিলেন। কেন যেন ওর কথাগুলো খুব ঠান্ডা কাটা কাটা লগছিল। শান্তার মনে হয়েছিল কোথাও সুর কেটে গেছে। ক’টা দিন চরম অশান্তিতে ভুগে শেষপর্যন্ত দীপ্তেন্দুর স্কুলে যোগাযোগ করেছিল। সেই শেষবার দীপ্তেন্দু এসেছিল এখানে। তখনই আঁচ পেয়েছিল ওকে কেন্দ্র করে দীপ্তেন্দুদের পারিবারিক অশান্তির কথা। শান্তা নিজেই ওকে আর আসতে নিষেধ করেছিল। উত্তেজনার মুহূর্তে নিষেধ করেছিল বটে, কিন্তু সত্যিই কি চেয়েছিল দীপ্তেন্দু আর না আসুক? কতদিন অপেক্ষা করেছে, ওএ স্থির বিশ্বাস ছিল যে দীপ্তেন্দু না এসে থাকতে পারবে না। বিশ্বাসটা ভেঙেছে, মনও।
রূপাঞ্জনার ফোন নম্বরটা নেওয়া হয়নি। সাক্ষাৎটা বা বলা চলে পুনর্মিলনটা এতই নাটকীয় ছিল যে এনজেপি-তে নেমে যখন ওদের জন্যে অপেক্ষমান গাড়িতে গিয়ে উঠলো রুপাঞ্জনা, তুলতুল শুধু হাত নাড়লো। গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার পর কথাটা মনে হয়েছিল। যদিও তারপর আবরও দেখা দার্জিলিং-এ, সেই দুটো দিন রূপাঞ্জনার সঙ্গটা এত বেশি উষ্ণতায় জড়ানো ছিল, মনে হয়নি যোগাযোগের জন্যে অন্য কোনো মাধ্যম প্রয়োজন হবে।
দার্জিলিং থেকে ফিরে এসে মায়ের কাছে খুব উত্তেজিতভাবে তুলতুল যখন বর্ণনা করছিল রূপাঞ্জনার সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনাটা, শান্তাও আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়লো। বারবার বলছিল, কী করলি বলতো ওর ফোন নম্বরটা নিলি না? আসতে বলেছিস তো? ও তো বাড়ি চেনে, একাই এসেছে বারদুয়েক।
পুরোনো তিক্ততা, গ্লানির ওপর সময়ের প্রলেপ পড়েছে। পুরোনো আবেগটা আবার ফিরে এসেছে। যে অপ্রিয় প্রসঙ্গটা ও বাড়ির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছিল, রূপাঞ্জনা যেন তা থেকে বিচ্ছিন্ন অনেক দূরের এসেদিনক টুকরো সবুজ দ্বীপ। বড় আপন মনে হয়েছে। সারল্য আর মমতায় জড়ানো একটা সুন্দর স্মৃতি শান্তার কাছে।