|| ১০ ||
আম্মার চেয়ে প্রায় দশ-বারো বছরের ছোট অমলা, আম্মার বোন। সহোদরা নন, বাবা একজন। আম্মা বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে আসার পর থেকেই এখানে ওঁর যাওয়া আসা। বলতে গেলে আম্মার স্নেহ আর প্রশ্রয়ে ওঁর বেড়ে ওঠা। বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তবু রমলা আর অমলা দুই মেয়েকে ভালো ঘরে বরে বিয়ে দিতে অসুবিধে হয়নি। খুব ফর্সা না হলেও নজরকাড়া চেহারা আম্মার। এখনও। আর রাঙাদিদা তো ফুটফুটে সুন্দর। যে জন্যে ওঁকে আমরা রাঙাদিদা বলি। বাবা কাকা মা কাকিমারা রাঙামা বলে ডাকেন। কিন্তু আমি সত্যিই ওঁর ইচ্ছেপূরণ।
আমার সামনে এলে রাঙাদিদাকে কথায় পেয়ে বসে। একটা কথার পিঠে হাজার কথা বেরিয়ে আসে মুখ থেকে। এ বাড়িতে আমার মতো আগ্রহী শ্রোতা আর কেউ নেই ওঁর। কেননা বেশি কথার জন্যে বাড়ির সবাই ওঁকে এড়িয়ে চলে। অথচ সারাদিন কথা বলার জন্যে মুখিয়ে থাকেন রাঙাদিদা। কতদিন দেখেছি, নিজের ঘর গোছাতে গোছাতে আপনমনে বকে যাচ্ছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হতো ভাদ্র মাসে। যখন আলমারি, ট্রাঙ্ক সব উজাড় করে কাপড়চোপড় রোদ্দুরে দিতেন। ন্যাপথিলিনের গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো স্মৃতিরাও ছেঁকে ধরতো রাঙাদিদাকে। সেই স্মৃতির মানুষদের সঙ্গে তখন চলতো তাঁর আদর সোহাগ রাগ অভিমানে মেশা হাজারো বাক্যের ফুলঝুরি। শব্দ বাক্য ওঁর ঠোঁটের ফাঁকে সবসময়ই মজুত থাকে।
শুধু সকাল বেলাটা খুব তাড়া থাকে রাঙাদিদার। তেত্রিশ কোটি দেবদেবতা ওঁর জন্যে অপেক্ষা করে থাকেন।
এমনিতে আমাদের বাড়িতে আলাদা ঠাকুরঘর আছে। গৃহদেবতা যিনি, তিনি দেবী চণ্ডী। একসময় নাকি প্রতিদিন বাঁধা পুরোহিত এসে পুজো করতেন। ধীরে ধীরে সেসব নিয়ম উঠে গেছে। কোনো ব্যাপারেই বাহুল্য আম্মার একেবারেই পছন্দ নয়। আর এ বাড়িতে আম্মার পছন্দই শেষ কথা। শুধু বাৎসরিক পুজোটাই এখনও খুব আড়ম্বরের সঙ্গে হয়। এখন রাঙাদিদার তত্ত্বাবধানে থাকা আমাদের ঠাকুরঘরে ছবি আর মূর্তি মিলিয়ে আমার চেনা অচেনা অনেক দেবতার অধিষ্ঠান। মায় ক্রুশবিদ্ধ যিশু পর্যন্ত। তাঁরা সকলেই ফুল বাতাসায় পূজিত হন। কবে কোথা থেকে যে তাঁরা সংগৃহীত হয়েছেন, বাড়ির অন্য কেউ জানে না। এক একজনের কাছে তাঁর এক এক রকম প্রার্থনা, অনেকদিনের চেষ্টায় সেটা আবিষ্কার করেছি আমি। এই সকাল বেলার পুজোটা তাই ওঁর দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। তারপর সারাটা দিন সারাবাড়ি জুড়ে ওঁর আনন্দধারা বয়।
বড্ড মনখোলা মজার মানুষ। বলা ভালো ওঁর বুকের আগল আর মুখের আগল দুই-ই সবসময় খোলা থাকতো। এমন কিছু কথা বা ঘটনা যা আমার জানার কথা নয়, বা আম্মা মনে করতেন আমার জানার প্রয়োজন নেই, সেই অপ্রয়োজনের কথাগুলো জেনে নেয়ার জন্যে ছুটে যেতাম রাঙাদিদার পৌরাণিক মিউজিয়ামের মতো ঘরটাতে। যেখানে ছেঁড়া কাঁথার সঙ্গে লাখটাকার সহাবস্থান ছিল।
বিয়ের আগে বাবার বাড়িতে থাকতে যেসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ, জিনিস জমিয়েছিলেন – পুঁতির মালা, রুপোর মল, চুলের কাঁটা থেকে ফুলতোলা রুমাল পর্যন্ত, সব পুঁটলি বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়িতে। আবার শ্বশুরবাড়ি থেকে যখন বিতাড়িত হলেন, তখন স্বামীর দেওয়া অনেক মহার্ঘ জিনিসের সঙ্গে যখের ধনের মতো আগলে নিয়ে এসেছিলেন ওঁর সেই সব তুচ্ছ সংগ্রহ।
এত গয়না কাছে রাখতেন বলে আম্মা, মা সবাই মিলে অনেকবার বোঝাতে চেষ্টা করেছেন ওগুলো লকারে রেখে দেওয়া জন্যে। তা হওয়ার জো ছিল না। কিছুতেই রাজি করানো যায়নি। রাঙাদিদার একটাই কথা,
- কাছে থাকলে নেড়েচেড়ে আনন্দ পাই, লকারে রাখলে মনেই হবে না আমার কিছু আছে।
- বাড়িতে থাকলে যদি চুরি হয়ে যায়, তখন তো আর কোনোদিন ছুঁয়ে দেখতেও পাবে না।
- তাহলে বুঝবো ও জিনিস কখনো আমার ছিলই না। ও পরের ধন।
ভুল হোক ঠিক হোক সব ব্যাপারেই ওঁর নিজস্ব জীবনদর্শন ছিল। তাকে কেউ কখনো প্রভাবিত করতে পেরেছে বলে তো মনে হয়নি আমার। কেউ কখনও জোর করে ওঁকে পালটাতে চেষ্টাও করেনি। বরং আম্মা বাদে আর সবাই কমবেশি প্রশ্রয় দিত ওঁকে।
রাঙাদিদাই চিরকাল আমার সমস্ত পারিবারিক তথ্যের উৎস। প্রত্যক্ষভাবে এই বংশের কেউ না হলেও আমাদের পরিবারের নাড়ীনক্ষত্র, গলিঘুঁজির ইতিহাস ভূগোল সব আমার চোখের সামনে ছবির মতো এঁকে দিয়েছেন। এর কতটা যথার্থ, আর কতখানি ওঁর ভাবনাপ্রসূত, তা যাচাই করার উপায় ছিল না তখন। তবে ওঁর কথার চুম্বকে মুগ্ধ হয়ে আত্মস্থ করতাম সব। অকপট স্বীকারোক্তির মতো ওঁর কথা।
আর নিজের জীবনটাকে মুঠোর মধ্যে, আর নিজের সম্পর্কে সব কথা বুকের সিন্দুকে আগলে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন যিনি তিনি আমার পিতামহী। আমার জীবনে জরুরি তিনজন নারীর একজন। এমন ডিগনিফায়েড মহিলা আমি খুব কম দেখেছি। প্রথাগত শিক্ষার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ছিল ওঁর অধীত বিদ্যা। কম কথা বলতেন, কিন্তু তাঁর উপস্থিতিটাই ছিল বাঙ্ময়। যেকোনো সমস্যা নিয়ে ওঁর কাছে গেলে কত সহজেই যে তার সমাধান মিলে যেত। মনে হতো পৃথিবীতে যেন কোথাও কোন জটিলতা নেই। আম্মার জন্যেই এ পরিবারের সবাই জীবনের অনেক এবড়োখেবড়ো পথ, অনেক খানাখন্দ মসৃণভাবে পেরিয়ে আসতে পেরেছে। আম্মা মানেই যেন মুশকিল আসান।
অন্যদিকে আমার মধ্যে সুরেলা যেটুকু, প্রয়োজনের বাইরের যে সুষমাটুকু, সেটুকু রচনা করে দিয়েছেন আমার মা সুতপা। মায়ের মধ্যে একটা মেঘলা সৌন্দর্য ছিল। দু’দণ্ড জিরিয়ে নেওয়ার ছায়াতরু যেন। তাঁর না ছিল শাসন করার ঔদ্ধত্য, না ছিল কাউকে প্রভাবিত করার ইচ্ছে। ছিল মায়া দিয়ে জড়িয়ে ফেলার অদৃশ্য জাদুকাঠি। আমার দুই কাকিমা আম্মাকে সব ব্যাপারে সমর্থন করার জন্যে আড়ালে মায়ের অনেক সমালোচনা করতেন বটে, তবে ভালোবাসতেন খুব। আম্মার চেয়ে বেশিই ভরসা করতেন। নিজেদের দাম্পত্যের ছোটখাটো অসংগতি, সমস্যা নিয়ে মায়ের কাছেই ছুটে আসতে দেখেছি।
আমাকে আম্মা যদি আগলে থাকেন দুই বাহুর নিয়ন্ত্রণে, মা আগলাতেন চোখের পাতায়। কোনো সমস্যা নিয়ে মায়ের কাছে গেলে কখনও উপদেশ দিতেন না, পরামর্শ দিতেন।
- তোর নিজের মন থেকে সায় না পেলে শুধু আমি বলছি বলে এটা করবি না। অন্যের অভিজ্ঞতাকে নিজের অনুভূতি দিয়ে যাচাই করে নিবি।
ঠিক বেঠিক চিহ্নিত করে সামনে রাখতেন, বেছে নেওয়ার ভার আমার। ছোটবেলায় আমি সাধারণত আম্মার কাছে ঘুমোতাম। কিন্তু কোনো কারণে মন খারাপ হলে সেদিন মায়ের কাছে শুতে যেতাম। আমার মন খারাপের কারণ জেনেও, তা নিয়ে একটা কথাও বলতেন না। একেবারে অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে আমার চুলের ভেতর আঙুল চালাতে চালাতে খুব মৃদু স্বরে কখনও ওঁর ছোটবেলার গল্প, কখনো বা সদ্য বিয়ে হয়ে আসা শ্বশুরবাড়ির যত মধুর স্মৃতি, সেইসব শোনাতেন। মনে হতো অনেক দূর থেকে কোনো অল্প চেনা গানের সুর ভেসে আসছে, মন ভালো করে দেওয়া সুর। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম।
মা আর আম্মা দুই বিপরীত মেরুর মানুষ বলেই হয়তো দুজন দুজনের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। মায়ের প্রতি আম্মার কিছু অতিরিক্ত প্রশ্রয়ও ছিল। কেন জানি না খানিকটা ডানা মেলে আগলাতেন মাকে। দুজনই আমার প্রিয়, দুজনের ছায়াতেই লালিত হয়েছে আমার শৈশব কৈশোর, মাকে আমি খুবই পছন্দ করি, তীব্রভাবে ভালোবাসি, তবু শেষ পর্যন্ত আমি নিজের ভেতর আম্মার ছায়া দেখতে পাই এখন। আম্মা যেন তাঁর আত্মাটাকে পুঁতে দিয়েছেন আমার মধ্যে। বাস্তববাদী, জেদি, কর্তব্যপরায়ণ এবং আপাতদৃষ্টে এক অর্থে কিছুটা স্বার্থপরও হয়তো।
আম্মার কোনো কাজ আমার ভালো না লাগলেও ভাবতাম, ঠিক এ রকমটাই হওয়া উচিত। সচেতনভাবে কখনও তাঁকে অনুসরণ করতে চাইনি, কিন্তু প্রভাবিত হয়েছি একটু একটু করে, নিজেরই অজান্তে। আজ দেখলে বুঝি এক স্বপ্নজীবী বালিকার রূপান্তর ঘটিয়ে আজ আমাকে এইখানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আম্মার সম্মোহন। জিতেছি কি হেরেছি জানি না, তবে ধুলোয় ছড়িয়ে পড়া নিজের অস্তিত্বটাকে আবার ঝেড়েমুছে তুলে নিয়ে একটা অবিচল রূপ দিতে পেরেছি।
আম্মা এটা পারেন, চাইলেই ওঁর মানসিক শক্তির আবেশ অন্যের ভেতর সঞ্চারিত করতে পারেন। যে শক্তির ওপর নিজেকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।
আমার বাবার যখন এগারো বছর বয়েস, মেজকার সাত আর ছোটকার তিন–-তখন আমার দাদু কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যান। আম্মা তখন তিরিশ বছরের তরুণী। অজস্র আঙুল উঠেছিল তাঁর দিকে, আমাদের সমাজে যেটা সচরাচর হয়ে থাকে। আম্মা ভ্রুক্ষেপ করেননি। আত্মীয়স্বজনের দোষারোপ, বিদ্রুপ, বক্রোক্তি উপেক্ষা করে তিন সন্তানকে বুকে আগলে সব ঝড়ঝঞ্ঝা সামলেছেন। কারও গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগতে দেননি। ওঁর সন্তানরা কোনোদিনই বাবার অভাব অনুভব করেনি।
এ ছাড়াও সম্পত্তি নিয়ে শরিকি ঈর্ষা-বিবাদের সঙ্গে একা লড়াই করে নিজের পরিবারের জন্যে ভীষণ মজবুত আর সম্মানজনক ভিত গড়ে নিতে পেরেছেন। এক সময় যারা ওঁর বিপরীতে দাঁড়িয়ে ওঁকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার জন্যে কোনো চেষ্টার কসুর করেনি, এখন তারাই কথায় কথায় জো-হুজুর করেন। কারো কাছে এতটুকু মাথা নোয়ানো তো দূরে থাক, চিরকাল দেখেছি অনেক উঁচু থেকে কথা বলেন আম্মা। যাতে ওঁকে কেউ মাড়িয়ে যেতে না পারে। ভেতরে অহঙ্কার থাক না থাক, অহঙ্কারের একটা বলয় তৈরি করে রেখেছিলেন নিজের চারপাশে। কিন্তু সেই অহঙ্কারের মধ্যে ঔদ্ধত্য ছিল না। গাম্ভীর্য ছিল, রূঢ়তা ছিল না। কেউ খুব বেশি কাছে আসতে সাহস পেত না। দূর থেকে সম্ভ্রম করতো।
কারো সহযোগিতা ছাড়াই তিন ছেলেকে মনের মতো করে মানুষ করেছেন। পারিবারিক ব্যবসাকে নিজের মুঠোর মধ্যে রেখেছেন। ব্যবসা বাড়িয়েছেন। এইভাবে একটু একটু করে পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে গিয়ে আপাতদৃষ্টে নিজেকে একটু আবেগহীন করে ফেলেছেন। কাকিমারা আড়ালে বলেন, পাথরের মা। কেন বলেন আমি জানি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্যের আবেগের সামনে নিজেকে অসম্ভব সংযত রাখেন।
ছোটবেলায় আমাদের প্রতিটি ব্যাপারে ওঁর সদাজাগ্রত মনোযোগ থাকলেও কখনো খুব আপ্লুত আদর পাইনি। কিন্তু কাকিমারা মুখে যা-ই বলুন, আম্মাকে ছাড়া ওঁরা কেউ এক পাও চলতে পারেন না। আম্মাই যে এ বাড়ির মেরুদণ্ড, এটা সবাই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে। ওঁর চরিত্রের দৃঢ়তা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, এইসব কিছুর ভরসায় চোখ বন্ধ করে নিশ্চিন্ত আরামে বাঁচে এ বাড়ির সবাই। আম্মার কখনো অসুখবিসুখ করলে আমার ভয় করতো ছোটবেলায়। শুধু মনে হতো আম্মার কিছু হয়ে গেলে আমাদের এই বিশাল বাড়িটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে।