চাঁপা গাছের তলায় সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চটায় বসে বই পড়ছিল বিভাস। পাশে আধখাওয়া চায়ের কাপ। বাড়ির সামনে গাড়ি থামার শব্দ, তারপর মরচে ধরা লোহার গেটের ক্যাচক্যাচ কানে যেতেই বই এর পাতা থেকে চোখ তুলে অসময়ে রূপাঞ্জনাকে ঢুকতে দেখে অবাক হলো বিভাস।
- আরে, এসো। কী ব্যাপার আজ কোনো মিটিং আছে নাকি?
- না। বরং আজ অন্য কেউ আসবে না বলেই এলাম। আপনার সঙ্গে একটা অন্য দরকার আছে বিভাসদা।
- চলো। ভেতরে বোসো। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।
রূপাঞ্জনা বুঝতে পারছিল না কথাটা কীভাবে বলবে। পার্টির কাছ থেকে কখনো কোনো ব্যক্তিগত সুবিধা নেয়নি। অবশ্য এই ব্যাপারটাকে ঠিক ব্যক্তিগত সুবিধা বলা যাবে কি? প্রয়োজন বুঝলে কতজনকেই তো সাধ্যমত সাহায্য করে ও। এটাকে সেইভাবে নিলেই তো হয়। তবু এই সুবিধাটুকুর কথা সবার সামনে বলতে সঙ্কোচ হয়েছে।
বসার ঘরে ঢুকে রূপাঞ্জনা বইয়ের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে বই দেখছিল। বিভাসের মা ঢুকলেন। পিছনে একটা বারো তেরো বছরের মেয়ের হাতে ট্রের ওপর বসানো প্লেটে কয়েকটা পিঠে আর জলের গ্লাস। ট্রে-টা টেবিলে নামিয়ে রেখে মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, দিদা চা করবো?
-না, তুই যা।
বলে রূপাঞ্জনার দিকে ফিরলেন। রূপাঞ্জনা নিচু হয়ে প্রণাম করতে একটু আদর করলেন। তারপর প্লেটের দিকে দেখিয়ে বললেন, খাও। এগুলো আমি নিজে বানিয়েছি।
-এখনও এসব বানান আপনি?
-বানাতেই হয়। খোকন খুব ভালোবাসে। এই এরা সব হাতে হাতে সব এগিয়ে দেয়, অসুবিধা হয় না। খোকন তো দোকানের মিষ্টি টিষ্টি খায় না। তাই ঘরেই এক আধটু বানাতে চেষ্টা করি।
-আপনি কিন্তু গেলেন না আমাদের বাড়ি।
-অনেক আগে দু’একবার গেছি পুজোর সময়। দিব্যেন্দু নিয়ে গেছে। তোমাদের তখন জন্ম হয়নি, কিংবা হলেও খুব ছোট। খুব ভালো লেগেছিল তোমাদের বাড়িটা। পুকুরটা আছে এখনও?
-হ্যাঁ।
-আর তোমাদের পাশের সেই পরীবাগান? কত রেয়ার গাছ ছিল।
-তেমনিই আছে।
-তোমার আম্মা কেমন আছেন?
-ভালো। আসুন না একদিন। আমি বিভাসদাকে বলে যাবো। বিভাসদা সময় না পেলে আমার ভাইপোকে পাঠিয়ে দেবো, সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। আপনি গেলে আম্মা খুব খুশি হবেন।
-সে দেখা যাবে। আজকাল শরীরও ভালো থাকে না প্রায়ই। কোথাও বেরোতে ইচ্ছে করে না। ওই যে বিভাস এসে গেছে। কথা বলো তোমরা। তার আগে পিঠেগুলো খেয়ে নিও। খোকন তোকে দেব একটু?
-দাও নাহলে একা বসে বসে পিঠে খেতে ভালো লাগবে না ওর।
মা বেরিয়ে যাওয়ার পর বিভাস রূপাঞ্জনার দিকে ফিরে বলল,
-হ্যা, বলো তোমার দরকারের কথা।
-আপনি নির্মাল্যকাকুকে চিনতেন বিভাসদা? নির্মাল্য সরকার?
-দীপুদার বন্ধু?
-হ্যাঁ।
-খুব চিনতাম। তোমাদের বাড়িতেই পরিচয় হয়েছিল। মানুষটা এমন যে পরিচয়কে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত করতে তার এক মিনিটও লাগতো না। ভারী আমুদে ছিলেন ভদ্রলোক। আমি দিব্যেন্দুর সঙ্গে একবার ওঁর বাড়িতেও গেছি। খুব কম বয়েসে মারা গিয়েছিলেন।
বিভাসের কথা শেষ হলে রূপাঞ্জনা শান্তা আর তুলতুলের এখনকার অবস্থা খুলে বলল। বিভাস খুব মন দিয়ে শুনল সবটা।
-তুলতুলকে আপনি দেখেছেন, সেই যে দার্জিলিংএ কেভেন্টারস’-এ। উজ্জয়িনী। কৃষ্ণনগর গার্লস কলেজে পড়ায়।
-হ্যাঁ মনে পড়েছে।
-ওদের একটু সাহায্য করতে পারি না আমরা?
-কী করতে চাও বলো?
-বেশি কিছু না। তুলতুলকে যদি কলকাতার কোনো কলেজে নিয়ে আসা যায়। ওর অ্যাকাডেমিক রেকর্ড খুব ভালো। তা ছাড়া তিন বছর তো কৃষ্ণনগর কলেজে কাজ করল।
-উঁম,
-কলকাতায় ট্রান্সফারের ব্যাপারে এটা একটা জেনুইন কেস।
-জানি। কিন্তু পার্টির কাছে আমি নিজে প্রোপোজালটা নিয়ে যেতে চাই না।
-ঠিক আছে আমি দেখছি। কিন্তু আমার ধারণা ওপর মহলে তোমার রেফারেন্সে বেশি কাজ হতো। তুমি পার্টির গুডবুকে আছো। যাই হোক তুমি নিজে যখন বলতে চাইছো না, আমি আমার দিক থেকেই চেষ্টা করবো। ওদের কিন্তু এখনই কোনো আশ্বাস দিও না।
রূপাঞ্জনার বুকের ওপর থেকে একটা পাথর নেমে গেল। শান্তা কাকিমার কথাগুলো ভার হয়ে চেপে ছিল মাথায়। শুধু ভার নয় একটা দায় যেন। ও উঠি উঠি করছিল বিভাস বললো, এত তাড়া কীসের? বাড়ির খবর বলো। আমি তো বলতে গেলে তোমাদের পরিবারেরই একজন। অথচ তোমার সঙ্গে কখনো কোনো পারিবারিক কথা বলারই সুযোগ হয় না। দেবুও আজকাল আর ফোনটোন করে না তেমন। আমি নিজে থেকে করলে তবেই ওর খবর পাই। আমার প্রতি ওর একটা ক্ষোভ আছে জানো তো?
-ছোটকার আপনার ওপর ক্ষোভ? এ কথা মনে হলো কেন?
-ওর কথাতে টের পেয়েছি।
এই কথার পিঠে রূপাঞ্জনা আর কিছু বললো না।
দিব্যেন্দু ওদের পারিবারিক অনেক ব্যাপারই বিভাসের সঙ্গে শেয়ার করে। বিভাসও নির্দ্বিধায় জানতে চায়। একদিন কথায় কথায় দিব্যেন্দুকে জিজ্ঞেস করেছিলো, হ্যাঁ রে দেবু তোরা রূপাঞ্জনার বিয়ের কথা ভাবছিস না?
-আমরা ভাবলেই তো শুধু হলো না, ওরও তো ইচ্ছে এবং সায় থাকতে হবে।
-সায়টা নেই কেন সেটাই তো জানতে চাইছি। ভেবেছিস তা নিয়ে?
-এর জন্যে তুই দায়ী।
-মানে!
-তুই ওকে রাজনীতির যে ঘুর্ণির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিস, তা থেকে ও কি আর বেরোতে পারবে, না কি বেরোতে চাইবে?
-রাজনীতিটাকে ঘুর্ণি বলছিস কেন? রাজনীতি একটা সচেতনতা। যে কোনো বিবেকবান অনুভূতিসম্পন্ন মানুষেরই রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ না নিলেও সেটা নিয়ে ভাবা উচিত।
-অতশত জানি না। শুধু বুঝতে পারি ও যেভাবে জড়িয়ে পড়েছে, তা থেকে বেরিয়ে একটা ছোট গণ্ডির মধ্যে নিজেকে বেঁধে রাখা সহজ নয় ওর পক্ষে। ক্ষমতা একটা নেশা।
-আমি মনে করি না শুধু ক্ষমতা উপভোগ করার জন্যে এখানে আটকে আছে রূপাঞ্জনা। ও দায় নিতে ভালোবাসে। মানুষকে ভালোবেসে তাদের জন্যে কিছু করতে চায়। একটা বিশুদ্ধ সৎ ভাবনার স্ট্রেংগথ দেখেছি আমি ওর মধ্যে। ও স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সে স্বপ্ন হয়তো একটা ছোট্ট সংসারের নয়। এটা ঠিক।
দিব্যেন্দু চুপ করে গেছে, বিভাসও আর কথা বাড়ায়নি। দিব্যেন্দুর কথাগুলোকে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার কায়দা মনে হয়েছে। রাজনীতি করলে কি আর বিয়ে করে সংসার করা যায় না? ইচ্ছে থাকলে অবশ্যই যায়। সেই ইচ্ছেটা রূপাঞ্জনার নেই কেন এটাই প্রশ্ন। ওরা নিশ্চয় জানে সেটা। স্বীকার করতে চায় না। কিংবা জানাতে চায় না। কিন্তু রূপাঞ্জনার মতো একটা চমৎকার মেয়ে সারাজীবন একা একা কাটিয়ে দেবে এটা ভাবতে ভালো লাগে না বিভাসের। সরাসরি রূপাঞ্জনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-সারাক্ষণই কার কী প্রয়োজন তাই নিয়ে ভাবছো, কে কী চায় তাই নিয়ে দরবার করছো, কখনো নিজের জন্যে কিছু চাইতে ইচ্ছে করে না?
চমকে উঠলো রূপাঞ্জনা। বিভাসের সঙ্গে এর আগে ব্যক্তিগত স্তরে কোনো কথা হয়নি কখনো। পার্টির প্রয়োজনের বাইরে এভাবে আর কখনো একা আসেওনি এখানে। ছোটবেলায় দিব্যেন্দুর সঙ্গে দু’তিনবার এসেছে রবীন্দ্রজয়ন্তীর সময়। বিভাসের ব্যবস্থাপনায় ছোটদের নিয়ে খুব সুন্দর অনুষ্ঠান হতো এ বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটায়। তখন সেই অনুষ্ঠানে একবার আবৃত্তিও করেছে। বিভাস যেহেতু দিব্যেন্দুর বন্ধু, তাই সবসময় একটা দূরত্ব নিয়ে কথাবার্তা বলতো। পার্টিতে জয়েন করার পর সম্পর্কটা খানিকটা প্রফেশনাল হয়ে গিয়েছিল। খুব কাছাকাছি পৌঁছোনোর সুযোগ হয়নি, যাতে ব্যক্তিগত কথা বলা যায়। আজ হঠাৎ এই এই ধরণের প্রশ্নে ও প্রথমে একটু থমকে গেলেও খুব সাবলীলভাবে বললো,
-কার কাছে চাইব?
-কারো কাছে, যে কারো কাছে।অন্তত নিজের কাছে তো কিছু চাও।
-কী চাইব?
-নিজের প্রাপ্যগুলো নিয়ে ভাবো। তোমার মধ্যে কোনো অভাববোধ নেই? মানুষের তো কত কিছু চাওয়ার থাকে।
একটুক্ষণ চুপ করে থাকে রূপাঞ্জনা। তারপর যেন অনেকদূর থেকে বিভাসের প্রশ্নটাই আউড়ে গেল - কী আমার চাওয়ার আছে? আর কী চাই সেটাই তো ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।
-এতটা তো দুর্বল মনে হয় না তোমাকে। বরং সব ব্যাপারেই বেশ সচেতন, অন্তত আমার তো তাই ধারণা।
-বিভাসদা, আমার চারপাশে এত আছে যে, কী নেই সেটা খুঁজতে গেলে নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। প্রশ্ন হলো যা নেই তা কি আমাকে পীড়িত করে? ভেবে দেখিনি। তাই কখনো খুঁজতেও চেষ্টা করিনি।
বিভাস কথা শুরু করেছিল ক্যাজুয়ালি। সেটা আর ক্যাজুয়াল রইল না। রূপাঞ্জনাও সিরিয়াস। হয়তো এই প্রশ্নগুলো কেউ কখনো রাখেনি ওর সামনে। তাই তলিয়ে ভাবার সুযোগ হয়নি। বিভাস জানে কোনো প্রশ্নের সামনে অপ্রস্তুত হয় না রূপাঞ্জনা। সবসময় সাবলীল। তাই আরো একটু স্পষ্ট হল।
-তুমি কি নিজের মনের ভেতরটা দেখতে ভয় পাও? দেখার চেষ্টা করো কখনো?
-এসব কথা আজ হঠাৎ মনে এলো কেন আপনার?
-এলো কারণ দিব্যেন্দুর কিছু কথায় খুব ক্ষীণ হলেও আমার ভেতর একটা অপরাধবোধ তৈরি হয়েছে। আচ্ছা সত্যি বলো তো তুমি যদি রাজনীতিতে না আসতে, আমাদের পর্টিতে যোগ না দিতে, তাহলে তোমার জীবনটা কেমন হতো? মানে নিজেকে তুমি কীভাবে দেখতে চাইতে? এসব নিয়ে তো আগে কিছু ভাবিনি। নিজের বাড়ির লোকেরা ছাড়া কেই বা ভাবে। তোমার সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছিল পর্টির স্বার্থে এই মেয়েটিকে আমাদের চাই। দেখলাম তুমি ইন্টারেস্ট নিচ্ছো। আমি তো জানিনা তুমি নিজেকে কীভাবে দেখতে চেয়েছিলে।
-সত্যি বলতে কি তখন আমার সামনে জীবনের শেষ গন্তব্য বলে কিছু ছিল না। আমি শধু অন্যের মুঠো থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো নিজেকে চালাতে চাইছিলাম। একান্তভাবে আমার সেই ইচ্ছে। আমার ভালোলাগা আমাকে যেখানে যেভাবে নিয়ে যাবে আমি সেখানেই যাবো, এটুকু সিদ্ধান্তই নিতে পেরেছিলাম সেই মুহূর্তে। সেই স্ব-ইচ্ছায় চলার ভালোলাগাটুকু এখনো আমার সঙ্গ ছাড়েনি, এটুকুই বলতে পারি।
-এই ভালোলাগাটুকু যখন আর থাকবে না, তখন?
-আমি বর্তমান নিয়ে বাঁচি বিভাসদা। আপনার কোনো অপরাধবোধ থাকার কারণই নেই।
যা নিজেই স্পষ্ট করে সবটুকু জানে না তা অন্যকে কি বলা যায়? বলা গেল না। রূপাঞ্জনার অস্বস্তি আর বিক্ষিপ্ত ভাবনার ওপর দিয়ে সন্ধে ঘনিয়ে এলো। চারপাশে আলো জ্বলছে, তবু মনে হলো বিভাস আর ওর মাঝখানে যেন টুকরো টুকরো অন্ধকার আটকে রইলো।
ফিরতে ফিরতে আটটা হলো। বাড়ি ফেরার পরও প্রশ্নটা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে তো সঠিক চিনতে হবে নিজেকে। চিনতে হলে নিজের ভেতরই ডুব দিতে হবে, আর ডুব দিলেই কি ঝকঝকে মুক্তো উঠে আসবে হাতে? হয়তো কিছুই পাবে না, শুধু থিতিয়ে থাকা জলস্তর ঘোলা হবে।
গেট দিয়ে ঢোকার সময়ই লক্ষ্য করলো মেজকাকিমা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রূপাঞ্জনা ওপরে আসতেই ওর কাছে এসে দাঁড়ালো অপর্ণা।
-কী রে গিয়েছিলি?
-কোথায়?
-বিভাসের বাড়িতে।
-হ্যাঁ।
-কথা হলো তুলতুলের ব্যাপারটা নিয়ে? মানে কোনো আশ্বাস?
-বিভাসদা যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। হয়তো হয়েও যাবে। তবু এখনই কাউকে বলার দরকার নেই।
রূপাঞ্জনা অবাক হয়ে অপর্ণাকে দেখছিল। এখনও স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে লেগে আছে সেই বিশ্রী তেতো দিনগুলোর কথা। মেজকার সঙ্গে কথা বন্ধ। খাওয়া দাওয়াও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে, চোখের পাতা সারাক্ষণ ভেজা। রূপাঞ্জনা নিজে সবটা বুঝে বা না বুঝে মুখ গোমড়া করে ঘুরে বেড়ানো তোতাকে আগলে আগলে বেড়াচ্ছে। সুতপা প্রাণপনে বুঝিয়ে যাচ্ছে অপর্ণাকে। তখন তুলতুলদের নাম প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে গেছে বাড়িতে। সেই অপর্ণা গত দুদিন ধরে শান্তাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আছে! দীপ্তেন্দু বরং প্রকাশ্যে কিছু বলছে না।
রমলার কাছে তুলতুলদের কথা আগে কেউ বলেনি। রূপাঞ্জনার হঠাৎ মনে হলো আম্মাকে একবার জানানো উচিত। চেঞ্জ করে রমলার ঘরে এলো। রম্য নিজের ইন্টারেস্টে রূপাঞ্জনার দার্জিলিং-এর বেশ কিছু ছবি প্রিন্ট করে এনেছে।রমলার কাছে বসে অমলা সেগুলো দেখাচ্ছে দিদিকে। রূপাঞ্জনাকে দেখে উৎসাহ দ্বিগুন হলো।
-তুই একটু বলে দে তো এরা সব কারা, আমি ঠিকমতো বলতে পারছি না।
রমলা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গিয়েছিলি? রম্য তোকে খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
একটু কাজ ছিল, বলে রূপাঞ্জনা বিছানায় উঠে পা গুটিয়ে বসলো। ছড়িয়ে থাকা ছবিগুলো গুছিয়ে নিয়ে তা থেকে বেছে বেছে যে ছবিতে তুলতুল আছে সেই ক’টা হাতে নিয়ে রমলার সামনে মেলে ধরলো।
- দেখো তো আম্মা এদের মধ্যে কাউকে চেনো কিনা।
রমলা খুব ভালো করে দেখে টেখে বললেন, না। তারপর রূপাঞ্জনা আর তুলতুলের ছবিটা নিয়ে বললেন, এখানে একজনকে চিনি। রূপাঞ্জনা একটু হাসলো।
-ভালো করে দেখ, অন্যজনকে চেনা লাগছে কি না?
-না তো। কে?
-তুলতুল।
-ওভাবে নাম বললেই চেনা যায় নাকি?
-আমি কিন্তু ভেবেছিলাম চিনতে পারবে। কারণ ওর চেহারার সঙ্গে অন্য একজনের চেহারার খুব মিল আছে।
-কেন ভেবেছিলি?
-ও নির্মাল্যকাকুর মেয়ে।
-সে কি! তুই চিনলি কী করে? মানে এত বছর পর।
কোনো উত্তর দিলো না রূপাঞ্জনা, মনে মনে বললো, এই নতুন করে চিনে নেওয়ার পরিচ্ছেদটা আমার গল্পে আছে আম্মা। আমি লিখে নিয়েছি। তাই এমন অভাবিত ভাবে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে। ও পরিচয় দেওয়ার আগেই আমি ওকে চিনে নিয়েছি। ওদের আমি খুঁজে পেতে চয়েছিলাম তাই।
রমলা বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছেন দেখে হাসলো রূপাঞ্জনা। আম্মা ভুলে গেছেন যে নিজের গল্প নিজের মনের মতো করে লিখে নেওয়ার এই তাগিদটা কে জাগিয়ে দিয়েছিল ওর মধ্যে। অন্যের বিশ্বাস অবিশ্বাসের উর্দ্ধে উঠে লেখা এ গল্প। মুক্ত ইচ্ছে দিয়ে রচনা করা এ এক অন্য কাহিনী।
-তোমার মনে নেই আম্মা, তুমিই তো বলেছিলে নিজের জীবনটাকে নিজেই লিখে নিতে হয়। নিজের ইচ্ছের মূল্য দিতে হয়। আমি লিখে নিয়েছি। আমার জীবনে আমি যাকে যাকে যেমনভাবে চাই, তেমনিভাবেই যুক্ত হবে তারা। দরকার হলে তাদের আমি খুঁজে নেব।
আচমকাই রমলা পাশে বসা রূপাঞ্জনাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন। রূপাঞ্জনাও সেই বন্ধনে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করল, করতে ভালো লাগলো। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও রমলার বুকের ভেতরকার স্পন্দন পুরোপুরি টের পেল না। অমলা পাশে বসে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। ধাঁধাঁর মতো লাগছে দুজনের কথাবার্তা। কিন্তু চোখ ওঁর জলে ভরা। কারণ অমলাও তো নিজের দিদিকে প্রকাশ্যে এমন আবেগাক্রান্ত হতে দেখেননি কখনো।
রূপাঞ্জনার ছাড়তে ইচ্ছে করছে না রমলাকে। এই উত্তাপটুকু কেন যেন আজ খুব দরকার ছিল। একটা বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে সেই সন্ধে থেকে। এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে খুব একা লাগছে নিজেকে। যেন গভীর গোপন অতলে ডুবতে হবে, যেখানে ওকে সাহায্য করার আর কেউ নেই। আম্মাও না, তবু মনে হচ্ছে স্পষ্ট না হলেও আম্মাই একমাত্র ছুঁতে পারেন ওর সবটুকু। রমলার সামনে একটা আয়না যেন ও। তাই এখন আর কোনো প্রশ্ন, ওর জীবন গড়ে দেওয়ার কোনো চেষ্টা নিয়ে আর সামনে দাঁড়াননা রমলা। রমলার চেয়ে স্পষ্ট করে আর কেউ জানে না ওকে। এটুকু রূপাঞ্জনা বোঝে।
শান্তার কথা শুনে একটু বিষণ্ণ হয়ে গেলেন রমলা। ওদের দেখার জন্যে ভেতরে ভতরে একটা ছটফটানি টের পেলেন। একবার ওদের কাছে যেতে খুব ইচ্ছে করলেও মুখে কিছু বললেন না। জানেন রূপু যখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে পাশে, চিন্তা করার আর কিছু নেই।
তুলতুলকে একটা ফোন করতে হবে ভেবে উঠে পড়লো রূপাঞ্জনা। তুলতুল বলেছিল শুক্রবার ওর অফ ডে। সেদিনই এসে যদি ওর সব দরকারি কাগজপত্র গুলো দিয়ে যেতে পারে তাহলে ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি মুভ করা যাবে।
রন জেদ ধরে বসে আছে টোপর পরে বিয়ে রবে না। এটা নিয়ে বাড়িতে বেশ অসন্তোষ চলছে। অসন্তোষ না বলে মন খারাপ বলাই ভালো। শর্মিলাও গোঁ ধরে বসে আছে বিয়ের যতরকম আচার অনুষ্ঠান আছে, তার পালন করবে। এক কণাও ছাড় দেবে না। রন সবার কাছে যতই আহ্লাদ পাক না কেন এই ব্যাপারে কিন্তু বাড়ির সবাই শর্মিলা পাশে। তোতার বিয়ে যথেষ্ট জাঁকজমক করেই হয়েছিল। সেবার উদ্যোগটা নিয়েছিল রূপাঞ্জনা নিজে। কারণ রূপাঞ্জনার ব্যাপারটা তখনও সবার মনে ক্ষতের মতো লেগেছিল বলে কেউ খুব একটা ঘটা করার কথা ভাবছিল না। বিশেষ করে তোতা। ওর মনোভাব ছিল, সবাই বলছে তাই বিয়েটা করছি এই পর্যন্ত। রূপাঞ্জনা তখন ল’প্র্যাকটিসে বেশ নাম করেছে। ওর নিজের মধ্যে একটা স্থিতি এসেছে। পুরোনো ঘটনা থেকে বেরিয়ে গুছিয়ে তুলেছে নিজেকে। ওর হঠাৎ খেয়াল হলো, তোতার বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে অথচ বাড়িটা কেমন ঝিমিয়ে আছে। একদিন সবাইকে ডেকে বললো, ছোটকার বিয়ের পর আমাদের বাড়িতে আর কোনো বড় অনুষ্ঠান হয়নি। তোতার বিয়েতে একটু বেশি জাঁকজমক চাই। নাহলে কিন্তু আমি এ বিয়েতে নেই।
তোতাকে বললো - হাঁদারাম, কীসের ম্যানেজমেন্ট পড়েছিস তুই। নিজের বিয়ের বেশ জবরদস্ত ভাবে অ্যারেঞ্জ করে দেখিয়ে দে তো।
রূপাঞ্জনা নিজে বসে তখন মেনু ঠিক করেছে, শর্মিলাকে সঙ্গে নিয়ে পৌলমীর জন্যে শাড়ি গয়না পছন্দ করে কিনেছে। সবার বুকের মধ্যে ছেয়ে থাকা গুমোট মেঘ এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়েছে।
রূপমের বিয়েটা হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। ক্যালিফোর্নিয়ায় দুজনে প্রথমে লিভ-টুগেদার করছিল। এক বছর পর শর্মিলার পীড়াপীড়িতে রেজিস্ট্রি করেছে। তখন ওর বউ অলরেডি কনসিভ করেছে। এটা নিয়ে শর্মিলার মনোকষ্টের শেষ নেই। কাজেই রূপমকে নিয়ে যে আক্ষেপ ছিল, রনকে দিয়ে সেটা পুষিয়ে নিতে চায়। বহুদিন থেকে নানারকম পরিকল্পনা করে বসে আছে। কিন্তু রন-র সেই এক কথা - আমাকে ঘিরে তোমরা অদ্ভুত অদ্ভুত আচারআচরণ করবে আর আমি চুপ করে মিচকি মিচকি হাসবো,সিম্পলি ইমপসিবল।
এক বুধবারে রন-র সঙ্গে দিব্যেন্দু আর শর্মিলাও চলে এলো বাড়িতে। সবাই মিলে রনকে অনেক করে বোঝানো হলো। ও বেশ কায়দা করে পাশ কাটিয়ে গেল। পৌলমী খুব আবদারের ভঙ্গীতে বললো,
-কেন আমাদের সঙ্গে এমন শত্রুতা করছিস। তোর বিয়েতে সব্বাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে সাজগোজ করবো বলে খুঁজে খুঁজে শাড়ি গয়না কিনেছি, সেগুলো তাহলে পরা হবে না?
-পরো না, কে মানা করেছে? দাদাভাইএর সঙ্গে আর একবার তোমার বিয়ে দেবো।
সাহস পেয়ে রম্যও সরব হলো, ছোটকু তুমি রাজি হয়ে যাও প্লিজ। আমি কখনও বরযাত্রী যাইনি। আমাদের বাড়িতে কারো বিয়েই হয়নি।
-কেন তোর বাবার তো বিয়ে হয়েছে, তখন বরযাত্রী নেয়নি তোকে?
রম্য কথার ঝোঁকে কিছু না ভবেই বলে উঠলো, না তো।
ঘরের ভেতর হাসির ঝড় বয়ে যেতেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লজ্জায় উঠে পালালো।
কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীর মতো রনকে চারপাশ থেকে সবাই ঘিরে ধরে নিজের মতো করে নানাভাবে পরাস্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, এতক্ষণ রূপাঞ্জনা চুপ করে উপভোগ করছিল ব্যাপারটা। এবার সিরিয়াস মুখ করে বললো,
-তুই শুধু নিজের কথা ভাবছিস, নিজের মতটাকেই গুরুত্ব দিচ্ছিস। বিয়েটা তো দুজনের ব্যাপার। অন্যজনেরও ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু আছে। তার মতামতটাও তো জানা দরকার।
-অন্যজনকে তুমি চেনো না?
-শুধু চিনলেই হয় না। ইচ্ছেগুলো বিষয় ভেদে আলাদা হয়। কার মনের মধ্যে কোন ইচ্ছে লুকোনো থাকে, বাইরে থেকে দেখে কিচ্ছু বোঝা যায় না। কাজেই তুই জোর দিয়ে বলতে পারিস না বিয়ের ব্যাপারে তৃণার ইচ্ছে তোর সঙ্গে মিলবে। কাজেই তুই ওর ওপর তোর মতটাকে চাপিয়ে দিতে পারিস না।
এবার একটু নরম হলো রন। চুপ করে কিছু ভাবলো। তারপর বললো,
-বেশ তুমি ওকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিও।
-এখনই জেনে নিচ্ছি।
রূপাঞ্জনা আর দেরি না করে একটু সরে গিয়ে ফোন করলো তৃণাকে। বার দুয়েক রিং হওয়ার পর সাড়া মিললো।
-বলো দিভাই।
-তুই কি স্কুলে? তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে, এখন বলা যাবে?
-যাবে। কী ব্যাপার বলো তো?
রন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রূপাঞ্জনা ফোনের লাউডস্পিকার অন করে দিল।
-রন তো জেদ ধরে বসে আছে ও টোপর পরতে পারবে না। বিয়েটা শুধু রেজিস্ট্রি করে হবে। তোরও কি সেই মত?
-কক্ষণও না। ওকে তাহলে অন্য পাত্রী খুঁজে নিতে বলো। কাগজের বউ হওয়ার মোটেই শখ নেই আমার।
-খুলে বল।
-দেখো দিভাই আমি একবারই বিয়ে করবো তা টিকলেও ভালো, না টিকলেও কোই বাত নেই। কাজেই বিয়ের সবটুকু আমি উপভোগ করতে চাই। আমি হলুদ মাখবো, ভোরবেলায় দই দিয়ে খই খাবো, সারাদিন উপোস করে সেজেগুজে চার বাহকের পিঁড়েয় চেপে বরের গলায় মালা দেব। হাজারবার দেখা বরের সঙ্গে শুভদৃষ্টি বিনিময় করবো। আগুনকে সাক্ষী রেখে হৃদয় দেয়া নেয়ার শপথ নেব। আর সব শেষে দুধে আলতায় পা ডুবিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ঢুকবো। এর চেয়ে এক কণা কম হলেও আমার চলবে না।
-শুনলি তো?
-জাতে মাতাল তালে ঠিক।
বলে নিজের অভিব্যক্তি লুকিয়ে সরে গেল রন।
ক’দিন টানাপোড়েন চলার পর এখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে বাড়িতে। সব অনুষ্ঠান এখানেই হবে। বউভাতও। পরে সল্টলেকে একটা আলাদা পার্টি দেবে দিব্যেন্দু। পৌলমী আর শর্মিলা মিলে প্রাণ ভরে কেনাকাটা করছে। কখনও বা জোর করে সুতপা আর অপর্ণাকে সঙ্গে নিচ্ছে। একদিন শুধু শর্মিলার পীড়াপীড়িতে রূপাঞ্জনা গিয়েছিল শর্মিলা আর পৌলমীর সঙ্গে তৃণার শাড়ি কিনতে। তোতার নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। তারই মধ্যে এক ফাঁকে রূপাঞ্জনাকে একা পেয়ে অপর্ণা মনে করিয়ে দেয়,
-হ্যাঁ রে শান্তাকে নিয়ে এলে হয় না? ক’টাদিন সবার মাঝখানে থাকলে ওর মনটা ভালো থাকবে। তোতাকে নিয়ে আমিই নাহয় নিয়ে আসবো।
-আনতে পারলে তো ভালো হতো। কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না হয়তো। তুলতুলের ট্রান্সফারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে তাতেই খুব খুশি শান্তাকাকিমা। কিন্তু তুলতুলকে এখনও মাসখনেক যাওয়া আসা করতে হবে। আর এই মুহূর্তে ও ছুটি নিতে পারবে না। কাজেই শান্তাকাকিমাকে এখানে আনার পরিকল্পনাটা ঠিক হবে না। তুলতুল বলেছে ও বরযাত্রী যাবে। আর সল্টলেকের পার্টিতেও যাওয়ার চেষ্টা করবে। পরে রন আর তৃণা গিয়ে শান্তাকাকিমাকে দেখা করে আসবে। আমি এটাই ভেবে রেখেছি।
অপর্ণা জানে এখন সিদ্ধান্ত সব রূপুই নেয়, আর সেটা সবসময় যথাযথ হয়। ব্যবস্থাটায় খুশি মনে হলো অপর্ণাকে।
একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ সারা বাড়ি জুড়ে। শুধু সবার সব উচ্ছ্বাস আর আনন্দের আড়ালে রমলা একটুকরো বিষাদকে গোপনে ঢেকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন সকলের অগোচরে। কিন্তু একজনের কাছে এখন আর কিছুই লুকোনো থাকে না। পরিবারের হৃৎস্পন্দন এখন সে মাপতে শিখে নিয়েছে।
কিছুদিন থেকে চন্দন সরকার বলে এক প্রোমোটারের চোখ পড়েছে পরীবাগানের ওপর। চোখ তার ছিল অনেক আগেই, কারণ সে তোতার পরিচিত। তোতার সঙ্গে দু’একবার এসেছে আগে। তখন বাগানটাকে শুধু উপভোগ করেছে। এখন সেটাকে হাতে পেতে চাইছে। এর আগেও অনেকে নানারকম প্রস্তাব দিয়েছে। ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। চন্দন একেবারে নাছোড়বান্দা। প্রথমে ও তোতাকেই ধরেছিল।
-তুই তোর দিদিকে বলে বাগানটা আমাকে ম্যানেজ করে দে না।
-আমার দিদি খুব স্ট্রেটকাট মানুষ। আমি তোর হয়ে দালালি করছি জানলে খুব রেগে যাবে। যা বলার তুই নিজে গিয়ে বল। তবে আমার মনে হয় না তোর হাউজিং প্রোজেক্ট দিদিকে ইম্প্রেস করবে। তবু একবার লাক ট্রাই করে দেখতে পারিস।
তোতা রূপাঞ্জনাকে খুব ভালোভাবে জানে বলেই চন্দনের হয়ে কিছু বলেনি কখনও। ও একসময় স্কুলে তোতার সহপাঠী ছিল, সেই সুত্রটাকে আঁকড়ে ধরে চন্দন নিজেই রূপাঞ্জনার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে অনেকদিন ধরে। যেখানেই রূপাঞ্জনার মিটিং থাকে, ওকে ঠিক স্টেজের পাশটিতে দেখা যায়, তারপর ম্যানেজ করে ওর গাড়িতে কখনো সখনো জায়গা করেও নেয়। ও খুব ভালো জানে যে, প্রোমোটারি করতে হলে পার্টির কাছাকাছি থাকাটা খুব জরূরি। অন্য নেতাদের সঙ্গেও ওর ভালোই দহরম মহরম। পার্টির হয়ে অনেক কাজ টাজ করে দেয়। ইদানিং দিনরাত রূপাঞ্জনার পিছন পিছন ঘুরছে।একটু সুযোগ পেলেই ইনিয়ে বিনিয়ে ওর নানারকম পরিকল্পনার কথা শোনাচ্ছে। সঙ্গে এটা জানাতেও ভুলছে না যে সমাজসেবামূলক অনেক সংস্থার সঙ্গে ও জড়িত। তবুও রূপাঞ্জনাকে রাজি করাতে পারছে না। তোতার কারণেই শুধু রূপাঞ্জনা সহ্য করছে ওকে।
-পরীবাগানটা তোমার মাথায় ঢুকলো কেন?
-আসলে কাছাকাছি একসঙ্গে এতটা জায়গা তো আর নেই এদিকে।
-অন্য কোথাও করো।
-অন্যত্রও চলছে আমার প্রোজেক্ট। কিন্তু নিজের এলাকার জন্যেও আমি কিছু করতে চাই এখানকার মানুষকেও আমি ভালোবাসা দিতে চাই।
-কোনো পোড়ো বাড়িটাড়ির খোঁজ করো। মরা জমিতে প্রাণ সঞ্চার করতে পারলে সেটাই তো বেশি প্রশংসাযোগ্য ব্যাপার। কেন একটা সতেজ সপ্রাণ বনভূমিকে বধ করার ইচ্ছে জাগলো?
এর উত্তরে আর যুৎসই যুক্তি খুঁজে না পেয়ে তখনকার মতো ও তর্কে ইতি টেনে চলে গিয়েছিল। তোতা পরদিন হাসতে হাসতে বললো,
-চন্দনকে তুই কী বলেছিস রূপুদি?
-ওকে কিছু ভালো পরামর্শ দিয়েছিলাম। কেন কিছু বলছিল তোকে?
-বলছিল ম্যাডাম কি সাহিত্য টাহিত্য করেন নাকি? যা সব কথা বলছিলেন, উত্তরে আমি বলার মতো কিছু আর খুঁজেই পেলাম না।
রূপাঞ্জনা জানে এই ধরণের মানুষ সহজে রণে ভঙ্গ দেবে না। ও আবার আসবে। বিরক্ত লাগছিল। আবার অন্য কাজের চাপে ব্যাপারটা মাথা থেকে বেরিয়েও গেল। এর মাস পাঁচ ছয় পরে একদিন সকালবেলায় তোতার সঙ্গে এলো চন্দন। হাতে বড় মিষ্টির প্যাকেট। রমলা আর অপর্ণাকে সামনে পেয়ে প্রণাম করলো। তারপর প্যাকেটটা অপর্ণার হাতে ধরিয়ে দিল। রমলা জিজ্ঞেস করলেন,
-হঠাৎ মিষ্টি কেন
-আমার একটা খুব বিরাট প্রজেক্ট অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে কমপ্লিট হলো।
সেজন্যে মিষ্টি তো তাদের প্রাপ্য, যারা বিপত্তিটা দূর করতে সাহায্য করেছে।
তারা কি আর মিষ্টিতে সন্তুষ্ট হয়? মিষ্টিটা মানুষ আপানজনদেরই খাওয়ায়।
-দিদি, আমি আজ আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।
-আবার অনুরোধ?
-না না ভয় পাবেন না। এটা ছোটো ভাইএর একটা অন্য আবদার।
-বলে ফেলো।
-পরশু সকাল এগারোটায় আমার এই নতুন হাউজিং কমপ্লেক্সএর উদবোধন। আমার খুব ইচ্ছে আপনার হাত দিয়ে উদবোধনটা হোক।
-আমি কেন? কোনো মন্ত্রী বা বিশেষ কোনো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এসো।
-আমার চোখে আপনিই বিশেষ ব্যক্তিত্ব। আমি তো দেখেছি গত দু’বছরে আপনি এই অঞ্চলটাকে কী দারুণভাবে পালটে দিয়েছেন। আপনার হাতে যাদু আছে। না বলবেন না। তাহলে খুব দুঃখ পাবো।
-আমি দেখছি পরশু সকালের দিকে আমার অন্য কোনো কাজ আছে কি না। তুমি কাল একবার ফোন করে নিও।
এর মাস দু’য়েক পরে একদিন সকালের দিকে বাড়ির সামনের বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে পবনের বাগান পরিচর্যা দেখছিল রূপাঞ্জনা আর তোতা। চন্দন এসে হাজির। হাতে দুটো দেবদারুর চারা।
-গাছ দুটো নিয়ে এলাম আপনাদের এই গেটের দুপাশে লাগানোর জন্যে। গেটটা কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে। অনেক দিন থেকেই ভাবছিলাম। আমার এক বন্ধুর নার্সারি আছে বারুইপুরের দিকে। ওকে বলে রেখেছিলাম। নাও পবনভাই লাগিয়ে দাও।
পবনের দিকে এগিয়ে দিল চারা দুটো। মুখ দেখে বোঝা গেল পবন আর তোতা দুজনেই খুব ইমপ্রেসড। তোতা হাসি মুখে রূপাঞ্জনার দিকে তাকালো। তারপর গৌরীকে ডেকে চন্দনকে চা দিতে বললো। চন্দন চেয়ার টেনে নিয়ে পরীবাগানের দিকে মুখ করে বসলো।
-আমিও গাছ খুব ভালোবাসি। আমার নিজের বাড়িতে ফাঁকা জায়গা নেই বলে ছাদে বাগান করেছি। তোতা দেখেছে।
গাছ ভালোবাসো। তাহলে বাগান ধ্বংস করে হাউজিং কমপ্লেক্সের প্ল্যান তোমার মাথায় এলো কেন?
-দেখুন ম্যাডাম, জঙ্গল কেটে বসত গড়ার ধারা তো সেই কত যুগ ধরে চলে আসছে। না হলে সভ্যতা এগোতো না। ভাবুন তো কত লোকের মাথা গোঁজার ঠাই হবে।
বোঝা গেল চন্দন আজ একেবারে রচনা বই মুখস্থ করে বেশ ভালোমতো হোমওয়ার্ক করে এসেছে। মনে মনে হাসলো রূপাঞ্জনা।
-ও বাগান এ অঞ্চলের ফুসফুস। ওদিকে চোখ দিও না। এতদিনের গাছ গাছালি আত্মীয়ের অধিক। আমার আম্মা কিছুতেই রাজি হবেন না।
-তাঁকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। কিন্তু ও বাগান তো আপনার আমি জানি। প্রথমে আপনি একবার হ্যাঁ বলুন। কিচ্ছু ভাববেন না, গাছ আমি লাগিয়ে দেব। কত গাছ চান? কমপ্লেক্সের ভেতরে ভেতরে এমন সব গাছ লাগাবো যা এ তল্লাটের মানুষ কখনো চোখে দেখেনি। বিদেশ থেকে গাছ আনাবো। জাপান থেকে অনেক বাহারি গাছ আমদানি করে ছবির মতো সাজিয়ে দেব।লোকের চোখ ধাঁধিয়ে যাবে।
-ওসব বলে লাভ নেই। ও জমিতে গাছ লাগালে সে গাছ বাঁচে না, শোনোনি তুমি? তোতা বলেনি তোমাকে?
-নতুন মাটি ফেলে জমি তো পালটে দেব, তখন ওসব প্রবাদও মুছে যাবে। মানুষের স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল। মানুষ সবসময় নতুন কিছু চায়। দেখুন না আমাদের এখানকার কাউন্সিলর অভিজ্ঞ নেতা, কাজকর্মও ভালো করেছেন, অথচ তার বদলে কী হিউজ সাপোর্ট দিয়ে আপনাকে জিতিয়ে আনলো জনগন। চেঞ্জ চায় মানুষ।
-শুধুমাত্র একটু চেঞ্জের জন্যে মানুষ আমাকে জিতিয়েছে বলছো?
-না না তা নয়। আপনার মতো শিক্ষিত বুদ্ধিমান মানুষ ক্ষমতায় এলে যুক্তি দিয়ে কাজ হয় সেটা সাধারণ মানুষ বোঝে। আপনার ওপর ভরসা হয়েছে বলেই না পরের বার আরো বেশি ভোটে জিতলেন আপনি। মনে হলো যেন আপনার কোনো প্রতিদ্বন্দীই ছিল না। শুনছি তো এবার লোকসভার ইলেকশানে পার্টি থেকে আপনাকেই নমিনেশান দেওয়া হবে। আমিও তো সেই ভরসাতেই এসেছি। একবার তাকিয়ে দেখুন এলাকাটা এত পালটে গেছে, আপনার হাত দিয়েই কত উন্নতি হয়েছে, শুধু পরীবাগানটাই লস্ট-ওয়ার্ল্ড হয়ে পড়ে আছে।
চন্দনের শেষ কথাটায় চমকে ওঠে রূপাঞ্জনা। সত্যিই তো নষ্ট পৃথিবী। অনেকদিন আগে একটা ইংরেজি সিনেমা দেখেছিল, ‘দা ল্যান্ড দ্যাট দা টাইম ফরগট’। আবছা মনে আছে, একটা দ্বীপ এক সময় সেখানে একটা জনপদ ছিল, সম্ভবত কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অবলুপ্ত হয়ে যায়। বহু বছর পর এক দল অভিযাত্রী সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। তারপর আবার একটু একটু করে প্রাণ সঞ্চার করে সেই মৃত ভূখন্ডে।
সত্যিই তো ওদিকে তাকালে মনে হয় অমনোযোগে অবহেলায় বড় মনমরা হয়ে পড়ে আছে বাগানটা। হতশ্রী, ভালোবাসাহীন এক টুকরো জঙ্গল। পরীবাগানের প্রেতাত্মা। সন্ধের পর ওদিকটা সত্যিই ভুতুড়ে লাগে। ঝঁ চকচকে এলাকাটার গায়ে যেন একটা অন্ধকার ক্ষত। রমলা ঠিকই বলেছেন।
তোতা চন্দন সরকারের একটা বড় সাপোর্ট। সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হয়েও রূপাঞ্জনার সুবাদে সর্বত্র ও যথেষ্ট ফায়দা তোলে। রূপাঞ্জনা বুঝতে পারে। কিন্তু সেটা তোতা এমন ভাবে করে যা নিয়ে সরাসরি আঙুল তোলাও যায় না। কিন্তু পরীবাগানের ব্যাপারে ও যে নিজের কোনো স্বার্থসিদ্ধির কারণে কিছু করছে না, সেটা রূপাঞ্জনা বোঝে। টের পায়, তোতার মধ্যে অন্য কোনো ভাবনা কাজ করছে। সতেরো নম্বর বাড়ি থেকে একটা নামকে ও মুছে ফেলতে চায়।