মা ও বাবার মাটিতে মিশে যাবার স্বপ্নটা দেখার সময় মাটির অনেক উপরে ছিল ও।একটা বড় এয়ার পকেটে পড়েছিল প্লেনটা। ঝাঁকুনি দিয়ে নিচে নামার সময় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ওর।
স্বপ্নে আকাশে ওড়া ব্যাপারটা হয়তো মন্দ নয়, কিন্তু আকাশে উড়তে উড়তে স্বপ্ন দেখার মতন বাজে ব্যাপার আর হয় না কারণ স্বপ্ন যখন ভাঙে, মাটি তখন অনেক, অনেক নিচে।
অথচ একটু আগেও স্বপ্নে মাটির উপর দাঁড়িয়ে ছিল ও, একটা নির্জন রেল লাইনের ধারে। রেল লাইনটা একটা শক্ত উঁচু জমির উপর। একটু দূরে একটা কালভার্ট, তার নিচে বাঁ-দিকে একটা বড় ঝুরিওলা বটগাছ। বটগাছের ডালে একটা কালো রঙের ঘুড়ি আটকে রয়েছে। হাওয়ায় লটপট করতে করতে দুলছে ঘুড়িটা, যেন মুক্তি পেতে চায় বাঁধন থেকে।
বটগাছের আশপাশ জুড়ে কাদার মতন নরম কিন্তু ঝুরঝুরে দোঁয়াশ মাটি। আবছা অন্ধকারে ও দেখল, মা আর বাবা সেই আলগা মাটির মধ্যে আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে। বাবার হাতে একটা খাম। তার মধ্যে ওর পাসপোর্ট। বাবাকে চিৎকার করে ডাকল ও। বলল, যাবার আগে পাসপোর্টটা ওর কাছে রেখে যেতে, আগামীকাল জার্মানি যেতে হবে ওকে। কিন্তু বাবা ওর কথা শুনতে পেল না। নাকি শুনতে চাইল না?
এয়ার পকেটের দৌলতে মাটিতে নয়, আকাশে ফিরে এল ও। শুনতে পেল, এয়ার হোস্টেস ঘোষণা করছে যে কলকাতার মাটি ছুঁতে প্লেনের আর মাত্র মিনিট দশেক বাকি।
১
অনেক দূর থেকে দেখা যায় এ বাড়ির বারান্দাটা।
বড় রাস্তার উপরে বাস স্টপ। বাস থেকে নেমে বাঁ-পাশের মাটির রাস্তা ধরে সেখান থেকে গজ-পঞ্চাশেক হাঁটলে রাস্তার বাঁপাশে এ বাড়ির সদর দরজা। চার পাশে প্রায় চার ফুট উঁচু পাঁচিল বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে। পাঁচিলের গা বেয়ে আম, জাম, কাঁঠাল অথবা নারকেলের মতন বড় বড় গাছের সারি। বাড়ির ভিতর দিকে পাঁচিল বরাবর প্রায় ফুট তিনেক জায়গা জুড়ে ইঁটের সীমানা বানানো রয়েছে এইসব গাছেদের জন্য। বাড়ির সামনের দিকে, ফটকের দুপাশে প্রায় বারো ফুট চওড়া ঘাসের লন আর তারও সামনে বাড়ির ঠিক আগে আরো তিন ফুট করে জায়গা নিয়ে ফুলের বাগান। বাড়িটার ঘরগুলো সেই লন আর বাগানের থেকে কিছুটা উপরে, দু ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় মূল বাড়িতে ঢুকতে গেলে। সদর দরজা থেকে প্রায় পনের ফুট লম্বা একটা বিছোনো রাস্তা বাড়িতে ওঠার সেই সিঁড়িতে গিয়ে মিশেছে। এ’বাড়ির একটা বৈশিষ্ট্য এই যে এর তিনদিকেই চওড়া খোলা বারান্দা, শীতের দিনে তাই কোনো না কোনো বারান্দাতে বসলে রোদের আমেজটুকু শরীরে শুষে নেওয়া যায়।
আশ্চর্য এই যে মাটির রাস্তার ডান পাশে আর বাঁ-পাশে বড়রাস্তা পর্যন্ত এই পুরো জায়গাটা এখনও অবধি ফাঁকা পড়ে রয়েছে ঘাসজমি আর ঝোপ হয়ে। এত দিনেও কোনো বাড়ি ওঠে নি এখানে, হয়তো শহর এখান থেকে অনেকটা দূরে বলে। বাস থেকে নেমেই শমীক তাই দেখতে পেল দাদুকে।
পুব দিকের বারান্দাতে একটা ডেক চেয়ারে বসে আছে দাদু। শীতের সকালের হালকা নরম রোদ দাদুর মুখের উপরে। দাদুর কোলের উপরে একটা খবরের কাগজ, কিন্তু এত দূর থেকেও দিব্যি বোঝা যাচ্ছে দাদু চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছে।
কিচ্ছু করার নেই। ইচ্ছে না থাকলেও ঘুম ভাঙাতে হবে দাদুর। বাড়ির সামনে এসে আস্তে আস্তে ডাকল শমীক, “দাদু! দাদু!”
— কে?
ধড়মড় করে উঠে বসল দাদু। চোখ দুটো একবার কচলে লুঙ্গির খুঁট দিয়ে চশমার কাঁচদুটো মুছে নিয়ে তাকাল শমীকের দিকে।
— আরে, শিশু-বাবু যে! কি আশ্চর্য, আয়, আয়, ভিতরে আয়!
প্রণাম করার অভ্যাস শমীকের নেই, তবু আজ নিচু হয়ে দাদুকে প্রণাম করতে গেল শমীক।
— কলকাতায় কাজ পড়ে গেল একটা। এতদূর যখন আসছি, ভাবলাম তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।
— জানি, জানি, তোর বাবা আমায় বলেছে, প্রচুর নাকি কাজ করছিস আজকাল! তাহলে তো আর শিশু-বাবু নামটা চলবে না! কি বলে ডাকব বল তো তোকে, কর্মযোগী না কর্মবীর?
আনন্দে মুখ ঝলমল করছে তমালবরণের। এক ঘন্টা আগেও ভাবেন নি যে আজকের দিনটা তাঁর জন্য এরকম মধুর একটা উপহার এনে দেবে।
— আসছিস কোথা থেকে? কানপুর?
— না। আসছি দিল্লি থেকে। প্লেন আধ ঘন্টা লেট, নইলে আরও আগে এসে যেতাম।
— আয়, ভিতরে এসে হাত পা ছড়িয়ে ভালো করে বোস আগে। তারপর না হয় লিস্টি ধরে ধরে আমাদের কর্মবীরের কত কাজ সব শুনবো।
প্লেনটা মোটামুটি ঘুমিয়ে কাটালেও, বাসে করে কলকাতা থেকে বর্ধমান আসতে আসতে দাদুর সঙ্গে কি কি বিষয় নিয়ে কথা বলবে তা নিয়ে অনেক ভেবেছিল শমীক। কিন্তু বাড়ির ভিতরে ঢোকামাত্র এক লহমায় ভুলে গেল সব।
ভোলার কারণটা আর কিছু নয় — এই বাড়ি।
শেষ কবে এসেছিল শমীক এই বাড়িতে? ক্লাস এইটে? সেই যেবার রঘুর মাথা ফাটল গোল বাঁচাতে গিয়ে বারপোস্টে ধাক্কা লেগে? ঠিক! ঠিক! তার পরে পরেই তো বোম্বে ফিরে শুরু হল মা-বাবার আলাদা হয়ে যাওয়া …
হ্যাঁ, এক-দুই-তিন করতে করতে কোন ফাঁকে পুরো বারো বছর কেটে গেছে এর মধ্যে!
“খেয়ে আসিস নি তো কিছু?” দাদু জিজ্ঞাসা করল।
— কোনো চিন্তা কোরো না! ব্রেকফাস্ট ঠিক সময় মতন হয়েছে, এখনই কিছু খাবার দরকার নেই।
— তবু চা-মিষ্টি তো খাবি এখন। দাঁড়া, আমি দেখে আসি পিন্টু-টা আবার গেল কোথায়!
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল শমীক। জানে অসভ্যতা, তবু এই মুহূর্তে ঠিক কারুর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ওর। কথা না বললে দাদু হয়তো কিছু মনে করবে না, তবু ভিতরের অস্বস্তি আর অপরাধবোধটা ঠিক যায় না।
হাঁ করে বাড়িটাকে গিলতে থাকে শমীক।
সিমেন্টের নয়, চুন-সুরকির গাঁথুনি এই বাড়ির। বিশাল চওড়া দেওয়াল, মোটা-মোটা শিকের জানলা, উঁচু কড়ি-বরগা লাগানো ছাত, আর একতলা দোতলা মিলিয়ে রান্নাঘর, বাথরুম ইত্যাদি ছাড়াও অন্তত পাঁচ ছ’খানা ছোট-বড় ঘর। আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত বোম্বের ফ্ল্যাটবাড়িতে মানুষ হয়েছে শমীক। তাই যতবার এই বাড়িতে আসে, শৈশবের সেই বিস্ময়ের রেশটা যেন কাটে না।
এ বাড়ির ইতিহাস শমীকের অজানা নেই। স্বয়ং বর্ধমানের মহারাজার বানিয়ে দেওয়া এই বাড়ি। নিজের হাতে মহারাজা তুলে দিয়েছিলেন এই উপহার অঘোরনাথকে — অর্থাৎ শমীকের দাদু তমালবরণের দাদুকে। মহারাজের ছেলেকে কঠিন অসুখের হাত থেকে বাঁচানোর পুরস্কার।
অঘোরনাথকে বর্ধমানেই রেখে দিতে চেয়েছিলেন মহারাজা, কিন্তু বরিশালের সাতবেড়িয়া গ্রামে নিজেদের যৌথ পরিবার ছেড়ে পাকাপাকিভাবে বর্ধমানে আসতে রাজি হন নি অঘোরনাথ। তারপরই তাঁকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে সদ্য বানানো এই বাড়িটি উপহার দেন মহারাজ। স্বভাবতই অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে এত দামি উপহার প্রথমে নিতে রাজি হন নি অঘোরনাথ, কিন্তু মহারাজেরও ভদ্রতায় কোনো খামতি ছিল না। অঘোরনাথকে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “ডাক্তারবাবু, ঈশ্বরের কৃপায় জমি-বাড়ির আমার অভাব নেই। তবু ভাবুন তো একবার, ছেলে না বাঁচলে সে সব নিয়ে করতাম কি? আপনাকে ধরে তো রাখতে পারলাম না, তবু শুধু এই বাড়িটার টানেই যদি ছুটিছাটায় কয়েকটা দিন আমাদের সঙ্গে কাটান …”
তারপর থেকে প্রতি বছর ছেলেমেয়েদের গরমের ছুটির সময় সপরিবারে কয়েকদিন এই বাড়িতে কাটিয়ে যেতেন অঘোরনাথ।
বর্ধমানে পাকাপাকি না থাকলেও, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মহারাজার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব অমলিন ছিল।
পাকাপাকি সেই আসতেই হল বর্ধমানে।
না, অঘোরনাথ আসেন নি। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস তাঁর নিজেদের সেই ভিটেবাড়িতেই পড়েছিল। হঠাৎ করেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চোখ বোঁজেন অঘোরনাথ, স্বাধীনতার দু বছর আগে। তখন তাঁর পঁয়ষট্টি বছর বয়েস। স্বাধীনতার পর উদ্বাস্তুদের সেই স্রোত, চিরকালের ভিটেমাটি ছেড়ে পরবাসে আশ্রয় নেওয়া তাঁকে তাই আর দেখে যেতে হয় নি। দেখে যেতে হয় নি যে এই বন্যায় ভেসে যাবে তাঁর নিজের পরিবার-ও।
উদ্বাস্তুদের স্রোত যখন কলকাতা বা তার আশপাশের যে কোনো ফাঁকা জমি জবরদখল করে বস্তি বানাতে ব্যস্ত, সেই সময় বৌ ছেলেমেয়ের হাত ধরে আর অল্প যা কিছু বাক্স-প্যাঁটরা, গয়নাগাঁটি সঞ্চয় ছিল তাই নিয়ে বর্ধমানের এই বাড়িতে বাসা বাঁধলেন অঘোরনাথের একমাত্র পুত্র আনন্দমোহন।
তমালবরণ, অর্থাৎ শমীকের দাদুর তখন ষোলো বছর বয়েস।
পিন্টুদাকে নিয়ে আবার ঘরে ঢুকল দাদু।
পিন্টুদা দাদুর Man-Friday, অর্থাৎ সব সময়ের সঙ্গী। মুখে সবসময় একটা দেঁতো হাসি লেগে থাকে পিন্টুদার, মুখের সামনের দাঁতটা বোগ-দাঁত বলে মনে হয় হাসিটা যেন মুখটাকে ঠেলে সরিয়ে বেরিয়ে আসছে, যেন সামনে যে থাকবে তাকেই ধাক্কা মেরে চিৎপটাং করবে।
চেহারাতে বুড়োটে একটা ছাপ পড়েছে পিন্টুদার। মাথার সামনের দিকের চুল উঠে গিয়ে কপালটা লম্বা হয়েছে আরও, মাথার বাকি চুল-গুলো-ও সাদা।
— কেমন আসো, শুমিক?
প্রাণপণে হাসি চাপার চেষ্টা করল শমীক। পিন্টুদার মাছের ঝোলকে ঝুল বলা আর শমীককে শুমিক বলা শতবার মনে করালেও বদলাবে না। হাসলে পরে একটা ভুরু অন্যটার তুলনায় কপালে একটু বেশি উঠে যাওয়াটাও আগের মতন-ই রয়ে গেছে।
— ভালো আছি। তুমি কেমন?
— থাকবা তো অহন। আমি যাই, বাজারে যাই।
— না, না, থাকব না, রাতে কলকাতা ফিরতে হবে আমাকে।
দাদু কি আশাহত হল একটু? মনে মনে খুশি হল শমীক প্রশ্নটা পিন্টুদা করায়। দাদু জিজ্ঞাসা করলে সরাসরি উত্তর দেওয়াটা একটু শক্ত হতো।
আশ্চর্য সংযম দাদুর। আশাহত হলেও মুখে তার কোনো ছাপ নেই। অল্প একটু হেসে বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন-ই তো যাবি না। পিন্টু বাজার থেকে একটু মিষ্টি-টিষ্টি নিয়ে আসুক। চা করুক। তুই যা, হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।”
এই বাড়ির পিছনে উঠোনের একদিকে একটা কুয়ো আছে। দাদু কেন জানি না, কুয়ো শব্দটা না বলে বলেন ইঁদারা। কুয়ো আর ইঁদারার তফাৎটা কি সেটা বাবাকে জিজ্ঞাসা করেও কোনো সোজা জবাব পায় নি শমীক।
ছোটবেলায় এই ইঁদারার জলে চান করাটা ছিল এই বাড়িতে আসার একটা বড় আকর্ষণ। বাড়িতে ততদিনে কিন্তু মিউনিসিপ্যালিটির জল এসে গেছে। তবু পিন্টুদাকে একদিন ওখানে চান করতে দেখে শমীকের ইচ্ছে হয় সে ও ঐভাবে চান করবে। মায়ের আপত্তি ছিল, কিন্তু বাবার প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকায় মা আর কিছু বলে নি। তবু বহুদিন এই ইঁদারাটা নিয়ে মায়ের ভয় কাটে নি। যদিও ইঁদারার চারপাশ অনেকটা উঁচু করে বাঁধানো, মার ভয় ছিল শমীক না ইঁদারায় পড়ে যায়। তাই শমীক চান করার সময় মা আগাগোড়া দাঁড়িয়ে থাকত সামনে।
ইঁদারার বাঁ পাশে একটা ছোট্ট ঘাসজমি, তার একপাশ জুড়ে বাগান। বেশির ভাগই বড় বড় ফলের গাছ, আম, জাম আর কাঁঠাল। গাছগুলো প্রায় সবই লাগানো বাড়ির পাঁচিল বরাবর, খালি একটা নারকেল গাছ ঘাসজমির অন্যপাশে, বাড়ির দিকে। ওই নারকেল গাছটার বরাবর সরলরেখায় পাঁচিলের পাশে আরো একটা নারকেল গাছ। ছুটিতে এই বাড়িতে এলে ঐ দুটো নারকেল গাছে নেট টাঙ্গিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলত ওরা।
হাত-পা ধোবার কথা ভুলে চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল শমীক। আশ্চর্য এই যে মানুষের বয়স যত তাড়াতাড়ি বেড়ে যায়, গাছেদের সেরকম বাড়ে না। সতেজে খাড়া হয়ে আছে সব গাছগুলো এতদিন পরেও।
ইঁদারার কাছে গিয়ে শমীক দেখল যে দড়ি আর বালতি নেই। মানে খুব পরিষ্কার। এই ইঁদারা দাদু বা পিন্টুদা কেউই আর এখন ব্যবহার করে না।
খিড়কির দরজা দিয়ে আবার বাড়ির মধ্যে ঢুকল শমীক। শক্ত গাঁথুনি সত্ত্বেও অযত্নের ছাপ পড়েছে দেয়ালে, আর দরজা জানলাতে। দেয়ালের চুন-সুরকির প্লাস্টার খসে খসে পড়ছে বেশ কয়েকটা জায়গায়। জানলার শিকে জায়গাতে জায়গাতে মরচে পড়েছে। দেয়ালের কোণে কোণে মাকড়শার ঝুল।
ছোটবেলায় শমীক দেখেছে ঠামি, বড়-ঠামি, দাদু আর বড়-দাদু নিজেদের হাতে এই সমস্ত সাফ করতেন। অকর্মন্য পিন্টুদা ভক্ত হনুমানের মতন ওনাদের পিছন পিছন শুধু জলের বালতি, ঝাঁটা আর ন্যাকড়া নিয়ে ঘুরতো। শমীক শুনেছে, বাকি তিনজন মারা যাবার পরে দাদু নাকি অনেকদিন একা একাই এই সব কাজ করতেন। এই নিয়ে আত্মীয়-মহলে কথা চালাচালি খুব কম হয় নি। কিন্তু বাড়িতে পা দিয়েই শমীক বুঝেছে যে দাদু বাড়ির এই সব কাজ করা এখন একেবারে ছেড়ে দিয়েছে, আর টানতে পারছে না।
পারার কথাও নয়। দাদুর এখন অষ্টাশি বছর বয়স।
দুমাস আগে ক্যান্সার ধরা পড়েছে দাদুর লিভারে। পেটের আরও দু তিন জায়গায় আর ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়েছে সেই ক্যান্সার।
ডক্টর সিদ্ধার্থ মিত্র দুমাস আগেই পরিষ্কার জবাব দিয়েছেন, “খুব বেশি হলে আর ছ’মাস।”
শমীকের এবারে বর্ধমান আসাটা স্রেফ দাদুর সঙ্গে শেষ দেখা করার তাগিদে।
শুধু এই মুহূর্তে কেন, আগামী চার-পাঁচ মাসের যে কোনো সময়ে আলাদা করে বর্ধমান আসাটা শমীকের কাছে একটা মস্ত বড় সমস্যা হতো। থিসিস লেখার কাজ শুরু হয়ে গেছে। শনি-রবিবার ছাড়া ইনস্টিটিউটে ছুটি নেই। ওই দুটো দিন-ও ওর পুরো সময়টা চলে যায় লাইব্রেরিতে আর ল্যাবে। কানপুর আই আই টি-তে গবেষক হিসেবে টিঁকে থাকতে গেলে বছরে তিনশ পঁয়ষট্টি দিন চব্বিশ ঘণ্টা পড়াশুনোর কাজে নিজেকে বেঁধে রাখতে হয়। আর এর উপরে বিদেশে পোস্ট-ডক করতে চাইলে তো কথাই নেই। মাঝে মাঝে শমীকের তাই মনে হয় একটা দিনে যদি ছত্রিশ ঘণ্টা সময় থাকতো, তাহলে কি যে ভালো হতো।
দাদুর খবরটা প্রথম শমীক শোনে মায়ের কাছে। মায়ের সমস্ত কিছু হয় ঘড়ি মেপে — ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুতে যাওয়া পর্যন্ত পুরোটা সময় মা কাটায় এক নিখুঁত যন্ত্রমানবীর মতন। শমীকের সঙ্গে কথা বলাটাও অনেকটা সেই রকম। দিনে একবার মা ফোন করবে, রাত ন’টার সময়। তারপর, দিনের পর দিন সেই এক প্রশ্নোত্তরের নাটক:
— শরীর কেমন আছে?
— ভালো। (খারাপ থাকবে কেন?)
— পড়াশুনো ঠিকঠাক চলছে?
— হ্যাঁ, ভালো চলছে। (কেন? বেঠিক থাকার কথা ছিল নাকি?)
— কাজ ভালো এগোচ্ছে?
— হ্যাঁ।
— বাঃ, খুব ভালো। বেশি করে জল খেতে ভুলিস না যেন।
— না, ভুলব না। রাখি?
একবার দুবার শমীক-ও মা-কে কিছু প্রশ্ন করে উত্তর পেয়েছে এক দু কথায়। এখন কেন জানি না শমীকের মনে হয় মা যেন কাউকেই, এমনকি শমীককেও, আর নিজের গন্ডির মধ্যে ঢুকতে দিতে চায় না। শমীকের-ও তাতে খুব বেশি আপত্তি নেই। মায়ের নিজস্ব গন্ডির ভিতরে ঢুকবার ইচ্ছে আজ বহুদিন হল ওর মরে গেছে। ওর নিজের জীবনে কাজ এত বেশি যে এই সব ব্যাপারে শমীক আর মাথা ঘামাতেও চায় না। পি এইচ ডি শেষ করেই ও জার্মানি চলে যাবে। বন্ ইউনিভার্সিটির প্রোফেসর আর্নস অনীশ স্যারের একসময়ের সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওর গবেষণার ব্যাপারে প্রোফেসর আর্নস প্রথম থেকেই ভীষণ আগ্রহী। শমীককে উনি বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যেতে চান। শমীকের সারা মন এখন পাখির চোখের মতন জার্মানির দিকে তাকিয়ে। তবু মা’র অকারণ অবহেলা মাঝে মাঝে তাকে পীড়া যে দেয় না তা নয়।
দাদুর খবরটা আসলে দেওয়ার কথা ছিল বাবার। এখন দাদুর সঙ্গে যেটুকু যোগাযোগ আছে তা বাবারই। কিন্তু বাবা যখন ফোন করেছিল শমীক তখন ল্যাবে। প্রফেসর অনীশ বোস আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স নিয়ে আগামী পাঁচ বছরে কি কি নতুন ধরণের গবেষণা করা যেতে পারে তাই নিয়ে শমীক আর ওর দুই বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলেন। ফোনে ওকে না পেয়ে ওর বাবা ওর মাকে আগে খবরটা দিয়ে দেয়।
— একটা খবর আছে, শমী!
মা টেলিফোনে সেদিন কথা শুরু করেছিল একটু নতুন ভাবে। খবর বলতে তো দুটো জিনিস মাত্র হতে পারে, হয় মায়ের আরও একটা প্রমোশন হয়েছে, নয়তো বাবা কিছু একটা করেছে যার থেকে বাবা কত বড় দায়িত্বজ্ঞানহীন, তা আবার প্রমাণিত হবে। ভালো খবর যখন নয়, তার মানে আবার দ্বিতীয়টা ...
মা’র মুখে খবরটা শুনে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেছিল শমীকের। মন খারাপটা যত না দাদুকে হারানোর ভয়ে তার চাইতেও বেশি এই রোগটার জন্য। চিন্তাটা শুধু দাদুর জন্য না, বাবার জন্যও। একের পর এক প্রশ্ন আসছিল ওর মনে, বাবা পুরো ব্যাপারটা সামলাবে কি করে? বাবা কি দাদুকে এর মধ্যে দেখে এসেছে? দাদুকে কি বাবা নিজের কাছে নিয়ে যাবে? নিয়ে গেলে একা সামলাবে কি করে? দাদু কি যেতে রাজি হবে? রাজি হলে বর্ধমানের বাড়িটার কি হবে? বাড়িটাকে কি শুধুমাত্র পিন্টুদার ভরসাতেই ছেড়ে দিয়ে আসা হবে?
বাবার সঙ্গে কথা বলে প্রশ্নগুলোর ঠিকঠাক জবাব পেল না শমীক। কেন জানি না শমীকের মনে হল বাবা চাইছে মা গিয়ে এখন কিছুদিন বর্ধমানে থাকুক, অন্তত যতদিন পর্যন্ত না বাবা কোনো পাকাপাকি ব্যবস্থা করতে পারছে। কিন্তু এই চাওয়াটা যে অবাস্তব, মা যে এতে রাজি হবে না সেটা বাবা হয় বোঝে নি, নয়তো বুঝেও না বোঝার ভান করছে।
গত কয়েকদিন ধরে শমীকের মন দাদুর জন্য তৈরি হওয়া এই সমস্যাটার সমাধান ঠিক কি হতে পারে তাই নিয়ে অনেক ভেবেছে, কিন্তু কোনো জবাব খুঁজে পায় নি। সবচেয়ে মুশকিল এই যে এই সমস্যাটা আবার আরও বড় একটা সমস্যা তৈরি করতে চলেছে শমীকের জীবনে। শমীক বেশ বুঝতে পারছে মা আর বাবার পুরোনো সাংসারিক অশান্তি, গত দশ-বারো বছর ধরে যা চাপা ছিল, তা আবার একটা নোংরা চেহারা নেবে। এই মুহূর্তে বাবা আর মায়ের মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র সেতু শমীক। কিন্তু নতুন করে এই লড়াইয়ে রেফারির দায়িত্ব নেবার ইচ্ছে বা আগ্রহ শমীকের আর নেই।
মাঝে মাঝেই আজকাল সবকিছু ছেড়েছুড়ে অনেক, অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে করে। শমীক-ও যাবে, তবে গেরুয়া বস্ত্র পরে নয়, গবেষকের বেশে, বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মন অশান্ত হলে শমীক আজকাল ইন্টারনেটে বন্ শহরের ছবি দেখে।
ছবি দেখে দেখে আর অনীশ স্যারের কাছে গল্প শুনে শুনে বন্ শহরটা কেমন সে ব্যাপারে এরই মধ্যে একটা স্পষ্ট ধারণা হয়ে গেছে শমীকের। বন শহরটা রাইন নদীর ধারে। রাইন নদীর দুপাশই খুব সুন্দর করে সাজানো। শহরের রাস্তা দিয়ে ট্রাম চলে। মাঝখানে এসে সেই ট্রাম মাটির নিচে মেট্রো হয়ে যায়। আবার শহর ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে ঢুকলে সেখানে ট্রেনের মতন রেল লাইনের উপর দিয়ে চলে। বাসগুলো মার্সিডিজ বেন্স কোম্পানির। বাসের মাঝখানে দরজার সামনে কোনো সিট্ থাকে না, যাতে প্যারাম্বুলেটর সমেত বাচ্চা নিয়ে মা-বাবারা সহজে যাতায়ত করতে পারে।
অনীশ স্যারের অফিসে বন্ ইউনিভার্সিটির ছবি আছে একটা। প্রফেসর আর্নসের নিজের হাতে আঁকা ছবি। বন্ ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট ডক শেষ করে অনীশ স্যার যখন পাকাপাকিভাবে কানপুরে চলে এলেন, সেই সময়ে তাঁর ফেয়ারওয়েল পার্টিতে ছবিটা এঁকে ওনাকে উপহার দিয়েছিলেন প্রফেসর আর্নস। অনীশ স্যারের মতন উনিও পোস্ট ডক করছিলেন সেই সময়।
বন্ ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্টগুলো সারা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়ানো। প্রফেসর আর্নসের আঁকা ছবিটা ওরকম একটা বড় বাড়ির। বাড়িটার সামনে প্রকাণ্ড একটা ঘাসজমি।
ওই বাড়িটা আর ঘাসজমিটা আজকাল শমীককে ভয়ঙ্করভাবে টানে।
মা আর বাবা শুধু ঝগড়া করে বেড়াক দুজনে মিলে, শমীক দিনরাত তার ল্যাবে কাজ করে যাবে সে সব ভুলে। গবেষণার কাজে ক্লান্তি এলে ওইধরনের কোন ঘাসভরা মাঠে চুপচাপ বসে থাকবে, নয়তো রাইন নদীর ধার বরাবর হেঁটে যাবে মাইলের পর মাইল।
পড়ার বইগুলো আর এইসব ছবিই আজকাল তার সব কিছু ভুলে থাকার শক্তি।
বর্ধমান আসার সুযোগটা জুটে গেল হঠাৎ করেই।
এবার আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স সোসাইটির কনফারেন্স হবে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। প্রফেসর অনীশ বোসের সঙ্গে শমীকের করা পেপারটা অ্যাকসেপ্টেড হয়েছে কনফারেন্সে। খবরটা বাবাকে ফোন করে বলার পর বাবা একটু যেন দ্বিধার সঙ্গে শমীকের কাছে জানতে চেয়েছিল বর্ধমান গিয়ে দাদুকে দেখে আসার সময় পাওয়া যাবে কিনা।
একটু অসুবিধে হবে, তবে পারা যাবে।
সকাল আট'টার সময় কলকাতা এয়ারপোর্টে নেমেই সেখান থেকে বর্ধমানের বাস ধরলে সাড়ে দশটার মধ্যে বর্ধমান বাসস্ট্যান্ড, তারপর সেখান থেকে অন্য বাসে আরও পনের মিনিট। সব ঠিক থাকলে এগারোটার মধ্যে পৌঁছে যাবে শমীক।
পরের দিন সকালে শমীকের পেপার প্রেজেন্টেশন, তাই কলকাতাতে ফিরতে হবে ওই দিনই। প্রফেসর বোসের বাড়ি কলকাতার বেকবাগানে, তবে ঐদিন রাত্রে হোটেলে থাকবেন প্রফেসর বোস। ওনার সঙ্গে বসে রাত্রে প্রেজেন্টেশনের স্লাইডগুলো ফাইনাল করা হবে। শুধুমাত্র শমীকের জন্য নিজের বাড়ি ছেড়ে একরাত হোটেলে থাকছেন প্রফেসর বোস।
শমীক হিসেবে করে দেখেছে প্লেন দুঘণ্টা লেট করলেও একটার সময়ে ও বর্ধমান পৌঁছে যাবে। সেরকম হলেও অন্তত ঘণ্টা চারেক দাদুর সঙ্গে কাটানোর মতন সময় হাতে থাকবে।
২
আজকাল দিনে বা রাতে কখনোই ভালো ঘুম হয় না। শোয়ার অনেকক্ষণ পরে একটু ঝিমুনির মতন এসেছিল, কিন্তু এমন একটা বাজে স্বপ্ন দেখলেন তমালবরণ যে সেই ঘুমও গেল ভেঙে। দেখলেন, সিঁদুর ফুরিয়ে গেছে কৃষ্ণার। বাজারে যাবার সময় তমালবরণকে নাকি কৃষ্ণা বারবার বলেছিল সিঁদুর নিয়ে আসতে, কিন্তু ভুলে গেছেন তমালবরণ। রাগে ঠোঁট ফুলিয়ে কৃষ্ণা বলছে, “আমার সিঁথির সিঁদুর মুছে না গেলে তোমার শান্তি নেই!”
ভুল, সব ভুল!
এরকম যাত্রাপালার ডায়ালগ জীবিত থাকতে কৃষ্ণা কোনোদিন মুখে আনে নি, ঘোরতর সংসারী জীব হলেও অহেতুক নাটক করা স্বভাবে ছিল না কৃষ্ণার। কিন্তু সেটা কথা নয়, কথা হল কৃষ্ণা-কে নিয়ে এরকম একটা স্বপ্ন হঠাৎ এতদিন বাদে দেখলেন কেন তমালবরণ?
গলার কাছে একটা দলা-দলা ভাব। কিছু খেলে অ্যাসিড হবেই, কিছু না খেলেই বরং রেহাই! সারা দিনরাত অপরিসীম ক্লান্তি, পিঠে আর বগলে সামান্য ব্যথা আর শরীরে একটা জ্বর-জ্বর ভাব ছাড়া এই রোগের আপাততঃ এই একটি-ই বড় উপসর্গ সারা শরীরে। এ যে আর ঠিক হবে না সেটা এতদিনে তমালবরণ বেশ বুঝে গেছেন। যত অসুবিধেই হোক, নিজের মনকে প্রবোধ দিয়েছেন এই ভেবে যে এখনো অবধি বিছানা তো আর নিতে হয় নি!
উঠে বড় এক গ্লাস জল খেলেন তমালবরণ, সঙ্গে একটা প্যান্টসিড ট্যাবলেট। দিনে দিনে ওষুধের মাত্রা বাড়ছে। এরপরে বোধ হয় গাড়ি গাড়ি অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট লাগবে।
শিরশিরে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা এখন। দীর্ঘদিনের সহকর্মী আর বন্ধু বরেন তাঁদের অল্পবয়সের সময় বলতো, “বুড়ো-পড়া ঠাণ্ডা — একবার সর্দি লাগলেই নিমোনিয়া আর তারপরেই সিধে পটলের ক্ষেত …”। নিমোনিয়া নিয়ে আর কোনো ভাবনার কারণ নেই এখন। তাঁর রোগ তাঁকে এই সব তুচ্ছ চিন্তার থেকে মুক্তি দিয়েছে। সমুদ্রে শয়ান যার শিশিরে কি ভয়?
এই রোগ হবার পর থেকে এই পৃথিবীর সব কিছুই যেন নতুন চোখে ধরা পড়ছে তমালবরণের কাছে। এই বাড়ি, এই ঘর, ঘরের পালঙ্ক, চেয়ার, টেবিল, আলমারি, পোশাক-আশাক সব। কত যত্ন করে এক সময় এসব বানায় মানুষ, কত সন্ধান করে এসব কেনে। আলমারিটা কেনার আগে বর্ধমানের প্রায় সাত-আটখানা কাঠের দোকান ঘুরেছিলেন তমালবরণ, কৃষ্ণার সঙ্গে। নিজে এত খোঁজ করে কেনা বলেই হয়তো এত মায়া তাঁর আলমারিটার উপর, পরে সস্তায় ভালো গোদরেজের আলমারি কেনার সুযোগ এলেও তাই বদলান নি আর এটি। এই ঘরের বাকি সব জিনিস – চেয়ার-টেবিল, পালঙ্ক – এসব অবশ্য তাঁর দাদুর আমলের। কত যত্ন করে এসব বানিয়েছিলেন দাদু। বর্ধমানের ছুতোর দিয়ে নয়, সেই কলকাতার থেকে ছুতোর নিয়ে এসেছিলেন দাদু এসবের জন্য। এরকম পালঙ্ক প্রায় পাঁচ-ছখানা বানানো হয়েছিল সেই সময়ে, সব ঘরের জন্য একটা করে। এখনকার কাঠের দোকানের খাট দেখে তাঁর দীর্ঘশ্বাস পরে। সবই যেন সরলরেখায়, সহজভাবে বানানো। কাঠের উপর সেই কাজ ফোটানো কই? তাঁদের ছোটবেলায় এক একটি পালঙ্ক ছিল এক একজন ছুতোরের ব্যক্তিগত দক্ষতার স্বাক্ষর। শুধু কাঠের কাজ জানলেই হত না, শিল্পী হতে হত তাদের। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তমালবরণ ভাবলেন যে শুধু শিল্পী নয়, শিল্পের কদরও ছিল তখন, সত্যিকারের শিল্পী ছুতোর খুঁজে বের করবার জন্য প্রচুর সময় খরচ করতেন সেই আমলের সচ্ছল ভদ্রলোকেরা।
চেয়ার-টেবিল অবশ্য তখন সারা বাড়িতে একটাই ছিল। দোতলায় দাদুর শোবার ঘরের জানলার পাশে রাখা থাকত এই চেয়ার-টেবিল। পরে এই বাড়িতে পাকাপাকিভাবে আসার পর চেয়ার-টেবিলটি দাদা পলাশবরন তাঁকে ব্যবহার করার জন্য ছেড়ে দেন। দাদা জানত এই দুটি জিনিসের উপর লোভ ছিল তমালবরণের।
সত্যি-সত্যি-ই সেই ছোট্ট থেকে এই চেয়ার আর টেবিলটা খুব পছন্দ ছিল তমালবরণের। তাঁদের দেশের বাড়িতে এসব জিনিসের পাট খুব একটা ছিল না। তাঁরা লেখাপড়া করতেন মেঝের উপর আসন পেতে অথবা খাটের উপর বসে, সামনে থাকত একটা জলচৌকি। গরমের ছুটিতে একবার বর্ধমানের বাড়িতে বেড়াতে এসে এই চেয়ার-টেবিলে বসে দাদুকে চিঠি লিখতে দেখেছিলেন যেদিন, সেদিন থেকেই জিনিসদুটির উপর ভীষণ লোভ হয়েছিল তমালবরণের। অবাক হয়ে দেখেছিলেন কত ভেবেচিন্তে জিনিস বানায় মানুষ! নিচে পা রাখার মতন একটা কাঠ পর্যন্ত রয়েছে টেবিলটাতে! প্রথম ব্যবহারের সময় অবশ্য সেই কাঠ পর্যন্ত পা পৌঁছত না তাঁর। শুধু এই পা রাখবার জায়গাটি নয়, ছোটবেলায় টেবিলের ড্রয়ারগুলোও ভীষণভাবে টানত তাঁকে। কত কী যে রেখে দেওয়া যায় এদের গহ্বরে!
দাদু কাছাকাছি না থাকলে ছোটবেলায় বর্ধমানের বাড়িতে ঐ টেবিলে বসে লেখাপড়া করতেন তমালবরণ। একবার গরমের ছুটির বদলে শীতকালে বর্ধমানে এসেছিলেন তাঁরা। সেই ছুটিতে, ভোরবেলা বিছানা ছেড়ে সারাগায়ে লেপমুড়ি দিয়ে জবুথবু হয়ে ওই টেবিল-চেয়ারে বসে বই পড়তেন তমালবরণ। বর্ধমানে পাকাপাকিভাবে আসার পরও ঘন্টার পর ঘন্টা এই চেয়ার-টেবিলে লেখাপড়ার কাজ করেছেন তমালবরণ। তাঁর গবেষণা সংক্রান্ত প্রায় সমস্ত লেখা হয়েছে এই টেবিলে বসে। আজ অবশ্য মনে হয় এই সব মায়া করে লাভ হয় না কোনো। যাবার সময় কেউ তো আর সঙ্গে নিয়ে যাবে না এসব। সব পড়ে থাকবে, ধুলো পড়বে দিনের পর দিন, যত্নের অভাবে নষ্ট হবে। তারপর একদিন হয়তো জলের দরে এই সব চেয়ার-টেবিল অন্য কাউকে বেচে দেওয়া হবে, অথবা বিলিয়ে দেওয়া হবে পয়সা খরচ করে কেউ না কিনলে।
গতরাতেও এই টেবিলে বসে লেখালেখির কাজ করেছেন তমালবরণ। টেবিলের উপর তার সাক্ষী হিসেবে পড়ে রয়েছে হলুদ রঙের ফাইলটা। ফাইলের মধ্যে রাশি রাশি কাগজ। যত্ন করে সাজানো এই সব কাগজ ভরে রয়েছে তাঁর স্মৃতিকথা। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে লেখা। আজ একটু বেশি সময় দিতে পারলে মনে হয় শেষ করা সম্ভব হবে।
ডাক্তাররা যেদিন তাঁর মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করল, সেই দিনই ঠিক করে রেখেছিলেন তমালবরণ — যে স্মৃতিকথাটা লেখা শুরু করেছিলেন আজ থেকে প্রায় পনের বছর আগে — স্রেফ কুঁড়েমির জন্য এখনো অবধি শেষ করতে পারেন নি — যেভাবেই হোক, সেটাকে এবারে শেষ করে যাবেন।
তাঁর লেখা স্মৃতিকথার কোনো সাহিত্যিক মূল্য যে থাকবে না সে ব্যাপারে তমালবরণ নিশ্চিত, নিজের লেখা নিয়ে কোনো অকারণ অহংকার তো তাঁর নেই-ই, বরং তাচ্ছিল্য আছে। তবে তিনি ইতিহাসের অধ্যাপক। ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে স্মৃতিকথা যে কত অমূল্য সম্পদ তা তাঁর চেয়ে ভালো আর কে জানে? রাজা নয়, মন্ত্রী নয়, ইতিহাস তো গড়ে তোলে তাঁর মতন সাধারণ মানুষেরাই। এরকম বেশ কিছু মানব-মানবীর সুখদুঃখের কাহিনী ঐতিহাসিক হিসেবে তিনি যেরকম যত্ন করে পড়েছেন, সেরকম তাঁর লেখাও কি ভবিষ্যতে অন্য গবেষকরা পড়বে না? পাকাপাকিভাবে বিছানায় পড়ার আগে এই কাজটা তাই তাঁকে শেষ করে যেতে হবে।
এই দুমাস যখনই সময় পেয়েছেন লিখে গেছেন তমালবরণ। একটানা খুব বেশিক্ষণ লিখতে পারেন না। বিদ্রোহ করে ডান হাতের আঙুলগুলো। ক্রমশঃ যেন অসাড় হয়ে আসছে তারা। একটানা পনের মিনিটের বেশি লিখলেই কনুই থেকে হাত পর্যন্ত একটা সুঁচ বেঁধার মতন তীব্র যন্ত্রনা হয়। ব্যাথা করে ঘাড়ে আর পিঠে। তমালবরণ তাই লেখেন থেমে থেমে।
নয় নয় করে বড় সাইজের ফুলস্ক্যাপ কাগজের প্রায় ছ’শ পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে এখনো পর্যন্ত। কাগজ একটু বেশি-ই লাগে। হাত কেঁপে যায় বলে ইচ্ছে করেই বড় বড় অক্ষরে লিখতে হয়, আর বাজারে যাবার সময় প্রায়ই কাগজ-ও নিয়ে আসতে হয় পিন্টুকে। তবে সৌভাগ্যের বিষয় এই যে আর কয়েক ঘণ্টা লিখতে পারলেই সম্পূর্ণ হবে তাঁর স্মৃতিকথা।
চেয়ারে বসে টেবিলের উপরে রাখা ফাইলটার থেকে কাগজ বের করে লেখা শুরু করলেন তমালবরণ।
কি লিখবেন তা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন তমালবরণ। তাঁর স্মৃতিকথা শেষ হবে তাঁর মৃত্যুচিন্তা নিয়ে।
তাঁর মতন এক সাধারণ মানুষের এই চিন্তার হয়তো কোনো ঐতিহাসিক মূল্য নেই, কিন্তু কে বলতে পারে এর দার্শনিক মূল্য কত? আস্তে আস্তে হাঁটি-হাঁটি-পা-পা করে অমোঘ নিয়তির মতন যে মৃত্যু তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে, তার সঙ্গে কিছু কাল্পনিক সংলাপ দিয়ে শেষ হবে তাঁর স্মৃতিকথা।
ঘড়ির দিকে তাকালেন তমালবরণ — চারটে বেজে পাঁচ মিনিট। যত কষ্টই হোক না কেন এখন থেকে দু ‘ঘণ্টা একটানা লিখে যাবেন তমালবরণ। তারপর লেখা শেষ হলে বাগানে দাঁড়িয়ে সূর্য ওঠা দেখবেন।
বিশ বছর আগে স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে প্রথমেই বেশ সমস্যায় পড়েছিলেন তমালবরণ। তাঁর স্মৃতিকথার মূল্য যদি হয় স্রেফ ঐতিহাসিক দলিল বলে, তাহলে তাতে কোনো ব্যক্তির গুণকীর্তন কি খুব বেশি করা উচিত? অথচ মুশকিল এই, যেকোনো স্মৃতিকথা শুরু হয় শৈশব থেকে। আর শৈশব থেকে যৌবনের দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত যে মানুষটি তাঁর সারা আকাশের ধ্রুবতারা হয়ে ছিলেন তিনি হলেন তাঁর ঠাকুরদা অঘোরনাথ।
তাঁর এই দীর্ঘ অষ্টাশি বছরের জীবনে এরকম মানুষ তমালবরণ আর দ্বিতীয়টি দেখেন নি। এমনই সেই দুর্ধর্ষ পৌরুষ, এমনই সেই প্রবল ব্যক্তিত্ব যে সারা সাতবেড়িয়ার অবিসংবাদিত নেতা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অঘোরনাথ।
ছ’ ফুটের উপর লম্বা, দীর্ঘ, বলিষ্ঠ চেহারা। গায়ের রং ঠিক ফর্সা নয়, সামান্য তামাটে। রোদে পুড়ে জলে ভিজে যে সমস্ত কর্মবীরেরা নয়-কে হয় করে, তাদের মতন। উন্নত গরুড়-নাসা, তীক্ষ্ণ, আয়ত দুই চক্ষুর উপরে দুটো বিশাল চওড়া ভুরু, দৃঢ় পেশীবদ্ধ চোয়াল। একবার দেখলেই বোঝা যায় এই লোকের উপরে কোনো কর্তৃত্ব ফলানো যাবে না। যেন কর্তৃত্ব করার জন্যই এই লোকের জন্ম।
রোজ দুবেলা নিয়ম করে ব্যায়াম করতেন অঘোরনাথ। ডন, বৈঠক, মুগুর ভাঁজা। বাড়ির গোয়ালঘরের পাশে ছোট একটা কুস্তির আখড়া ছিল তাঁর। শুধু কুস্তিতে আশ মেটে নি, একসময় সাহেবদের কাছে বেশ কিছুদিন বক্সিং শিখেছিলেন তিনি।
শুধু কি চেহারা? দুর্দান্ত সাহস ছিল তাঁর। জলে জঙ্গলে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো ছিল তাঁর একটা নেশা। বছরের একটা বড় সময় তাঁর কাটত কলকাতাতে। কিন্তু সুযোগ পেলেই চলে আসতেন দেশের বাড়িতে। আর একবার বাড়ি এলেই সাত সকালে সূর্য ওঠারও আগে হাতে বন্দুক আর পিঠে একটা ব্যাগে সামান্য খাবার ও জল নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন সারাদিন। সেই সব জঙ্গলে তখন হিংস্র প্রাণীর কোনো অভাব ছিল না। অঘোরনাথ কারো সাবধানবাণীই কানে তুলতেন না। নিজের শক্তির উপর এতটাই আস্থা ছিল তাঁর যে আর কেউ সাবধান করতে এলে হো হো করে হেসে তার কথা উড়িয়ে দিতেন। হাসবেন না কেন? লাঠিখেলায় বা কুস্তিতে সারা বরিশাল জেলায় তাঁকে হারাবে কে? বন্দুকেই বা তাঁর মতন এরকম অব্যর্থ লক্ষ্য সারা দেশে কজনের রয়েছে? ষাট বছরের উপরে বয়স, তবু আশপাশের কারো বাড়িতে সাপ ঢুকলে কেন সবাই আগে তাঁকে ডাকে?
হ্যাঁ, সেই ছোটবেলার থেকে অসংখ্য সাপ মেরেছেন অঘোরনাথ, গোখরো, কেউটে, চন্দ্রবোড়া, কালাচ — জলে, জঙ্গলে, বাড়িতে। দাদুকে প্রথম যখন সাপ মারতে দেখেন অঘোরনাথ তখন দাদুর ষাটের উপর বয়স। বারান্দার চালের থেকে থপ করে নিচে উঠোনে পড়ে গেছিল সাপটা, আর একটু হলেই নাড়ুর গায়ে পড়তো।
বাচ্চাদের চিৎকারে ঘরের থেকে বেরিয়ে আসেন অঘোরনাথ। এক মুহূর্তে বুঝে নেন ব্যাপারটা। বাচ্চাদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে, মুহূর্তের মধ্যে ঘরের থেকে একটা মোটা বাঁশের লাঠি নিয়ে হাজির হন আবার।
তারপরের দশ সেকেন্ডের দৃশ্য একেবারে সিনেমার মতন।
হাঁ হয়ে গেছিলেন সেদিন তমালবরণ — গোখরোর মতন ওই রকম একটা প্রাণীকে কেউ এত অনায়াসে মারতে পারে? মনে মনে দাদুর নেওটা হয়ে গেছিলেন সেই সেদিন থেকে।
শুধু সাপ-ই নয়, অন্য যে কোন প্রাণী মারার বেলাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন অঘোরনাথ। জঙ্গলে গেলে প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের পাখি মেরে নিয়ে আসতেন। অঘোরনাথ বাড়িতে থাকলে রাত্রে সকলের জন্য সেই শিকারের মাংস ছিল বাঁধা। এসব ব্যাপারে ধর্মঘটিত কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করতেন না তিনি।
উঠোনের একপ্রান্তে বসে নিজের হাতে শিকারের পালক, চামড়া ইত্যাদি সব ছাড়াতেন অঘোরনাথ। মাংস কেটে টুকরো করে বাড়ির মেয়েদের সাজিয়ে দিতেন নিজে। এসব কাজে তাঁর কোনো সংকোচ ছিল না। গ্রামের মন্দিরের কালীপুজোর পাঁঠাবলির ভারও একসময় স্বেচ্ছায় নিয়েছিলেন। জীবজন্তুর প্রতি যেমন একবুক-ভরা দয়া ছিল, তার পাশাপাশি যেন একবুক-ভরা নিষ্ঠুরতাও ছিল তাঁর। মানুষের জন্যও তাই। এ লোক যেমন ডাক্তার হয়ে যমের সঙ্গে লড়াই করে লোককে প্রাণ দিতে পারে, সেরকম যেন দরকার হলে কারো প্রাণ নিয়ে নিতেও পারে। তাই তাঁকে ভয় করত না এরকম লোক সারা সাতবেড়িয়াতে কেউ ছিল না।
পাড়ার বা শহরের লোক নয়, অঘোরনাথকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেত তাঁর একমাত্র পুত্র আনন্দমোহন।
নিজের ছেলে সম্বন্ধে অঘোরনাথের ছিল এক অসীম তাচ্ছিল্য, তাকে মেনিমুখো এক জরদ্গব ছাড়া আর কিছু ভাবতে তিনি রাজি ছিলেন না। আজ এতদিন পরে পিছনের দিকে তাকিয়ে তমালবরণ ভেবে পান না কেন অঘোরনাথ ছেলের ব্যাপারে এতটা নিষ্ঠুর ছিলেন। বাড়ির বড়রা ঠাট্টা করে বলত যে আনন্দমোহন নামটাকেই উনি সহ্য করতে পারেন না। যেদিন থেকে অঘোরনাথের বাবা রামকান্ত তাঁর নাতির নাম আনন্দমোহন রেখেছেন সম্পর্কটা যেন বিগড়ে গেছে সেই সেদিন থেকেই। স্বাভাবিক সংস্কারবশত নিজের বাবাকে কিছু বলতে পারেন নি অঘোরনাথ, ঝালটা ঝেড়েছেন নিজের ছেলের উপর।
হবেও বা!
তমালবরণের মনে আছে যে তাঁর ছোটবেলায় পিতা-পুত্রের অর্থাৎ অঘোরনাথ আর আনন্দমোহনের দেখা বা কথাবার্তা হত সামান্যই। সাংসারিক কথাবার্তা আনন্দমোহন সাধারণত তাঁর মায়ের সঙ্গেই সারতেন, খুব জরুরি দরকার না পড়লে বাবার আশপাশে থাকতেন না। তাঁর বেশিরভাগ সময়টা কাটত বাড়ির অন্দরে।
আসলে অঘোরনাথ যতখানি বহির্মুখী ছিলেন, আনন্দমোহন ছিলেন ঠিক ততটাই অন্তর্মুখী। চুপচাপ খাটের উপর শুয়ে একের পর এক বই পড়ে যাওয়াই তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি আনন্দের কাজ ছিল। আর ঠিক এই ব্যাপারটাই সহ্য করতে পারতেন না অঘোরনাথ। সমবয়সী বা গুরুজনদের কাছে দুঃখ করে বেড়াতেন, “মামাগো ধাত পাইসে। লক্কা পায়রা হইব, পুরুষ হইব না।”
নিজে ডাক্তার, তাই ছেলেকেও ডাক্তারি পড়িয়েছিলেন অঘোরনাথ। কঠিন সেই পরীক্ষা যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গেই উতরে গিয়েছিলেন আনন্দমোহন। কিন্তু ডাক্তারিতে তাঁর মন ছিল না, মন পড়ে থাকত সাহিত্যচর্চায়, বিশেষ করে কবিতায়। আর কবিতা ছিল অঘোরনাথের দু চক্ষের বিষ। আরে বাবা, চার পাশে মানুষ মরছে গরু ছাগলের মতন, আর তুমি পালঙ্কে বসে শুধু পূর্ণিমার চাঁদের দিকে ভাবুকের মতন তাকিয়ে থাকবে?
বাড়ির ছেলেদের নিজের মনের মতন করে গড়ে তুলতে পারেন নি অঘোরনাথ। সবচেয়ে বেশি বাধা এসেছে তাঁর বাবা ও কাকাদের থেকে। সংসারের কর্তা হবার পরে তাই নাতিদের আঁকড়ে ধরলেন তিনি।
ওরা যেন পুরুষ হয়, যেন মেনিমুখো বাঁদর না হয়।
কলকাতার চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর পাকাপাকিভাবে যেদিন সাতবেড়িয়া চলে এলেন অঘোরনাথ, সেদিন থেকেই নিয়ম করে দিলেন যে বাড়ির সমস্ত ছোট ছেলেদের রোজ ভোর বেলা উঠে তাঁর সঙ্গে শরীরচর্চা করতে হবে। এই নিয়ে সামান্য গুঞ্জন উঠেছিল পরিবারে, তবে তাঁর সামনাসামনি এসে তর্ক করার সাহস আর কারোর ছিল না।
তমালবরণের সঙ্গে দাদুর ভাব হওয়া শুরু এই শরীরচর্চা দিয়ে।
বাড়ির অন্য ছোট ছেলেমেয়েরা ফাঁকি দেবার চেষ্টা করত, ডন-বৈঠক দিত হাই তুলতে তুলতে। আর অঘোরনাথ কখনো কখনো কলকাতা বা অন্য কোথাও গেলে তো কথাই নেই, তখন তাদের অখণ্ড অবসর। কিন্তু কেন জানি না এই শরীরচর্চার ব্যাপারটা খুব ভালো লেগে গিয়েছিল তমালবরণের। প্রথমদিকে এক-দু দিন ছাড়া ভোর বেলা উঠতে তাঁর কোন কষ্ট তো হতোই না, বরং শরীরচর্চার টানেই ঘুম ভেঙে যেত তাড়াতাড়ি। তাই ফাঁকি দেবার কথাটা তাঁর মনেও আসে নি।
এরপর আস্তে আস্তে শুরু হল দাদুর সঙ্গে জঙ্গলে যাওয়া।
জঙ্গলে যাবার সময় তমালবরণ ছাড়া অন্য কোনো বাচ্চাকে সঙ্গে নিতেন না অঘোরনাথ। এই নিয়ে হিংসে করে তারা কোনো কথা তুললেই চোখ পাকিয়ে তাদের ধমক দিয়ে বলতেন আগে নাতিবাবুর মতন চেহারাটা তৈরি করতে।
হ্যাঁ, নাতিবাবু। মৃদু ঠাট্টার ছলে তমালবরণকে তখন ওই নামেই ডাকতে শুরু করেছেন অঘোরনাথ, যেন বাড়ির অন্য ছোটো ছেলেমেয়েরা কেউ তাঁর নাতি-ই নয়।
অঘোরনাথের এই পরিষ্কার পক্ষপাতিত্ব বাড়ির বড়দের নজর এড়ায় নি। বাড়ির বৌদের মধ্যে এই নিয়ে মন কষাকষি ছিল এক নিত্য ঘটনা। বাকি সকলের এই রাগের ঝাঁঝটা সবচেয়ে বেশি পড়ত তমালবরণের মায়ের উপরে। কিন্তু যেহেতু এই সব ঘটত অঘোরনাথের আড়ালে তাই তিনি এ সব টের পান নি, আর তমালবরণ তখন দিনে কতটা সময়ই বা মায়ের কাছাকাছি থাকতেন?
ভোর বেলা বেরোতেন তাঁরা। মাইলের পর মাইল দুজনে হেঁটে যেতেন অক্লান্তভাবে। যেতে যেতে নানান রকমের গাছ আর পশু-পাখি চেনাতেন অঘোরনাথ, তমালবরণকে। একটা ছোট ডিঙি-নৌকো ছিল অঘোরনাথের। কখনো কখনো সেই নৌকো বাইতেন তাঁরা ঘণ্টার পর ঘন্টা। নৌকো বেয়ে বেয়ে এক নদী পেরিয়ে অন্য নদীতে গিয়ে পড়তেন। কিভাবে দাঁড় টানলে নৌকো জোরে চলে, হাল কিভাবে ধরতে হয়, পাগলা নদীর ঘূর্ণি চিনতে হয় কিভাবে, নদীতে জোয়ার বা বান আসছে কিনা খেয়াল রাখা, নৌকো পারে লাগানোর সময় কাদায় যাতে আটকে না যায় লক্ষ্য রাখা – এই সব কিছুর শিক্ষা তমালবরণের দাদুর কাছ থেকে।
সাতবেড়িয়া ছাড়িয়ে একটা বড় জলা। জলা পার হয়ে আরও এক মাইল গেলে বিশাল চওড়া নদী। নদীর অন্য পার থেকে জঙ্গলের শুরু। প্রথমে ঘাসজমি আর অবিন্যস্ত ছোটো বড়ো গাছের সারি। সেই গাছের সারি ক্রমশ ঘন হয়ে মাইলের পর মাইল জুড়ে পড়ে রয়েছে।
সেই জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে একটা ছোট্ট পায়ে চলার পথ।
নদী পেরিয়ে যেখান থেকে জঙ্গলের শুরু, পায়ে চলা সেই পথের পাশে ছিল একটা বড় বটগাছ। বহু বছর আগে জমিদারের লোকেরা এই বটগাছের চারপাশটা বাঁধিয়ে দিয়েছিল। কখনো-সখনো শিকারে গেলে তাঁরা এই গাছের তলায় বিশ্রাম করতেন।
দাদুর সঙ্গে এই গাছের তলাতেই বনে ঢোকার আগে হালকা প্রাতরাশ সেরে নিতেন তমালবরণ।
খেতে খেতে নানা রকম গল্প বলতেন অঘোরনাথ, জীবজন্তুর গল্প, শিকারের গল্প, ডাকাতের গল্প, তাঁদের বাপ-ঠাকুরদার গল্প। দাদুর কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারেন তমালবরণ যে অঘোরনাথের এক দাদু, তাঁর বাবা রামকান্তর ছোটকাকা, ডাকাতের হাত থেকে একটি মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দেন। এই ঘটনার কিছু আগে, ফরিদপুর ছেড়ে তাঁদের বরিশালে চলে আসাও এক অত্যাচারী জমিদারের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে না পারার জন্য। ফরিদপুরে তাঁদের তিনপুরুষের সেই ভিটে পুড়িয়ে দিয়েছিল জমিদারের গুন্ডাবাহিনী। বাড়ির মেয়েদের সম্মানরক্ষার জন্য সেই অসম যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন বাড়ির পুরুষদের কয়েকজন, যাতে তারা সবাই বাকি পুরুষদের সঙ্গে পালিয়ে যেতে পারে। ফরিদপুর থেকে আরও দক্ষিণে জলা-জঙ্গলে ভরা সাতবেড়িয়াতে চলে আসা তাঁদের সেই স্বাধীনভাবে বাঁচার প্রয়াসে, কারণ এত দুর্গম জায়গাতে জমিদারের শাসন ছিল আলগা।
জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ আর সব জায়গাতে সাপ নিয়ে জীবন। রাক্ষুসে সব নদী দিয়ে ঘেরা আশপাশ। এক এক দিন এক এক জায়গা দিয়ে বয়ে চলেন তেনারা। গ্রীষ্মের চাঁদিফাটা রোদ বছর বছর ডেকে আনে বীভৎস সাইক্লোনকে। বর্ষাকালে চতুর্দিকে খালি জলে জল, ডুবে যায় ঘর, বাড়ি, চাষের মাঠ সবকিছু। তবু যারা মানুষের মতন মানুষ, তারা কি কখনো হার মানে? বাঘকে পাশে নিয়েই চাষবাস, কুমিরকে পাশে নিয়েই ডিঙি নৌকো চালিয়ে মাছ ধরা আর বছর-বছর ঝড়ে বা বন্যায় ভেঙে পড়া বাড়িকে আবার গড়ে তোলা। এই নিয়েই প্রায় পঞ্চাশ বছর কাটিয়েছিলেন তাঁরা ওই অঞ্চলে। অঘোরনাথের ছোটবেলায় তাঁরা সেই পুরোনো গ্রামের আর একটু উত্তরে এসে বাসা বাঁধেন। জমি এখানে আশপাশের জায়গার তুলনাতে একটু উঁচু, তাই বর্ষাকালে বেশি জল জমে না এখানে, বরং জল তার স্বাভাবিক নিয়মে নিচু জায়গা খুঁজে নিয়ে দূরে চলে যায়।
এই সব গল্প বলার সময় দাদুর চোখদুটো উত্তেজনায় আর এক প্রচ্ছন্ন গর্বে ঝলমল করতো।
— বোঝলা নাতিবাবু, এই মাথাডা আর শরীরডা সর্বদা খাড়া রাখবা। অত ভয় পাওনের আসে ডা কি, কও আমারে? জন্ম যখন হইসে, মরণ তো আইবোই একদিন না একদিন। তাই বইল্যা স্রেফ বাঁচনের লাইগ্যা মাথাডা নিচু কইরা থাকুম ক্যান?
গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে অঘোরনাথ এই রকম সব উপদেশও দিতেন তমালবরণকে — খালি সারাদিন বই মুখে করে বসে থাকলেই হয় না, ভাবতে হয় সব কিছু, প্রশ্ন করতে হয়। নিজের শরীরকে এমন তৈরি করতে হয় যেন যখন যা খুশি তাই করা যায় শরীরটা নিয়ে, আর হ্যাঁ, ভয়কে জয় করতে হয়। তমালবরণ যেন কাউকে কোনোদিন ভয় না করে।
দাদুর সব উপদেশ আলাদা করে মনে রাখেন নি তমালবরণ। সেই সব উপদেশ আবহমানকাল ধরে বড়োরা ছোটদের দিয়ে এসেছে। নীতিকথার বইয়ে, হিতোপদেশ বা ঈশপের গল্পতে এইসব উপদেশের দেখা মেলে। বরং যে সব উপদেশ কোনো বইয়ে কখনো পান নি, সেগুলোই যেন মনের গভীরে দাগ কেটে বসত।
সে দিন ঘিয়ে ভেজানো পরোটা চিবোচ্ছিলেন তাঁরা বটগাছের তলায় বসে। আশ্চর্য মানুষের স্মৃতি, কি তাঁরা খাচ্ছিলেন তা তো মনে আছেই, এটাও মনে আছে সেদিন অঘোরনাথ তাঁকে দাদুভাই বলে কথা শুরু করেছিলেন, নাতিবাবু বলে নয়।
— জানো দাদুভাই, পুরুষ মানুষ হইব এড্ডা বড় গাছের মতন।
— মানে?
দাদু একটু হেসে মানে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে। তমালবরণ যেন বিশাল আর দৃঢ় হয়ে উঠতে পারে মহীরুহের মতন, যেন আশ্রয় দিতে পারে আশপাশের সবাইকে।
— তোমার নাম তমাল রাখসি সে কি অমনি অমনি? বড় হইয়া তমাল হইতে হইব তোমারে!
কবে বড় হবে তমালবরণ? এক মহীরুহের মতন?
তমালবরণের বারো বছরের জন্মদিনে তিনি সবচেয়ে দামি উপহারটা পেলেন দাদুর কাছ থেকে।
একটা এয়ারগান।
শুধু উপহার-ই নয়, দাদু বলেছে, পরের দিন সকালে বন্দুক চালানো শিখিয়ে দেবে — উত্তেজনায় সেই রাত্রে ঘুম হল না তমালবরণের।
আবারও গুরু সেই অঘোরনাথ।
শিক্ষা শুরু হল জলার পাশে।
কিন্তু শিক্ষার সত্যিই কোনো দরকার ছিল কি?
এয়ারগানটা হাতে নিয়েই তমালবরণের মনে হয়েছিল এ তো বন্দুক নয়, এ যেন তাঁর দেহের-ই এক অংশ। বন্দুক কিভাবে চালাতে হয় মাত্র একবার দেখিয়ে দেবার পর দাদু যেখানে যেখানে লক্ষ্য স্থির করে দিলেন, ঠিক সেইখানে সেইখানে গুলি বিঁধল তাঁর।
ছেলেমেয়েদের বেশি প্রশংসায় বিশ্বাসী ছিলেন না দাদু, তাতে অহংকার বাড়ে। সেই তিনি পর্যন্ত না বলে থাকতে পারলেন না, “খুব ভালো হইতাসে!”
— বড় বন্দুক চালানো কবে শিখাইবা, দাদু?
দাদু হেসে বুঝিয়ে দিলেন, বড় বন্দুকে ঝটকা বেশি দেয়। তবে আর বেশি দেরি নেই, আর একটু বড় হলে নাতিবাবু আপনিই বড় বন্দুক চালাতে পারবে।
দুজনে এবার বনে ঢুকলেন শিকারের সন্ধানে।
এই প্রথম দাদুর নয়, তাঁর নিজের করা শিকার হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরলেন তাঁরা।
— আমারে বাঘ দেখাইবা দাদু?
আরও প্রায় দু বছর কেটে গেছে। সম্প্রতি বড় বন্দুক চালানো আয়ত্ত্ব করে ফেলেছেন তমালবরণ। আর আয়ত্ত্ব করার পরেই মনে হয়েছে এবার জঙ্গলের রাজাকে তার নিজের রাজত্বে দেখবার সময় হয়েছে।
কিন্তু যতবার এই প্রশ্ন দাদুকে করেছেন, দাদু ঘাড় নেড়েছেন।
— অহন না।
আজ আরও একবার দাদুকে সেই এক প্রশ্ন করলেন তমালবরণ।
— বাঘ দ্যাখবা? নিজেরে বাঘ বানাও আগে!
— কেন? আমি বাঘ নই?
“না!” অঘোরনাথ একটু দুষ্টু হাসি হাসলেন। তমালবরণের চোখে চোখ রেখে বললেন, “বাঘের নাতি!”
বাঘের নাতির জোয়ান বাঘ বনতে কিন্তু বেশি সময় লাগল না।
শরৎকালের শুরু তখন। উজ্জ্বল রোদ চার দিকে। মহালয়া আসতে আর দিন পনের বাকি। তমালবরণ আর বাড়ির অন্য সব ছোটরা অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে পুজোর জন্য। কুমোরপাড়ায় প্রতিমার কাঠামো গড়ার প্রাথমিক কাজটা শেষ হয়ে গেছে। মাটি পড়বে এবারে, রং চড়বে পুজোর কয়েকদিন আগে। প্রতিমায় যেদিন রং চড়ানো শুরু হয়, সেই দিনটা হল এই বাড়িতে পুজোর জন্য নাড়ু তৈরি করার দিন। বাচ্চাদের মন মুখিয়ে রয়েছে নতুন জামাকাপড় আর নাড়ুর জন্য।
বাড়ির বড়রা সেদিন সবাই মহকুমা শহরে গিয়েছিলেন, জমিজমা সংক্রান্ত কিছু দরকারে।
হঠাৎ বেলা দশটার সময় কানে এল চিৎকার, প্রথমে বড়কাকিমার, তারপরে মায়ের, “সাপ! সাপ!”
ভাঁড়ার ঘরে সাপ ঢুকেছে ইঁদুরের লোভে। বিশাল গোখরো, প্রায় সাত ফুটের মতন লম্বা।
হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে দরজার একটা খিল নিয়ে ছুটলেন তমালবরণ। ভাঁড়ার ঘরের বাইরে মা, বড়কাকিমা আর ছোটকাকিমা (আপন কাকিমা নয় এনারা, দুজনেই অঘোরনাথের ছোটভাই ভূতনাথের ছেলে-বৌ) শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে জটলা করছে বাড়ির ছোটরা।
পল্টুকে দিয়ে হাফিজ আর মুস্তাফাকে ডাকতে পাঠিয়েছেন মা আর কাকিমারা। হাফিজ আর মুস্তাফা বাড়ির ভাগচাষি। দুজনেরই খ্যাতি রয়েছে সাপ মারার ব্যাপারে।
লাঠি হাতে ভাঁড়ার ঘরে ঢুকতে যাবার সময় বাধা দিতে এসেছিল বাড়ির মেয়েরা। এক ধাক্কায় তাদের সরিয়ে দিলেন তমালবরণ।
এর আগে খেলার মাঠে ছোটখাট সাপ মেরেছেন তমালবরণ, তবে সেটা একা নয়। ভোম্বল, বগলা, আতাউর, বিমল, আবুল — সকলে মিলে। এতবড় গোখরোর সঙ্গে মুখোমুখি মোলাকাত এই প্রথম।
ঠান্ডা মাথায় সাপটাকে খতম করতে তাঁর লেগেছিল মাত্র পাঁচ সেকেন্ড। কিন্তু সেই পাঁচ সেকেন্ডেই তমালবরণ বুঝেছিলেন যে পূর্ণবয়স্ক গোখরোর সঙ্গে লড়াই মোটেই সহজ নয়। পালাবার রাস্তা খুঁজছিল সাপটা, সেই জন্য ছোবল মারতে এক মুহূর্ত দেরি করেছিল সে। তাই পা দুটোকে সময় মতন সরিয়ে আনতে পেরেছিলেন তমালবরণ। অল্পের জন্য মরণের হাত থেকে বেঁচে যান তিনি। ছোবলটা আছড়ে পড়েছিল তাঁর পায়ের ঠিক দু ইঞ্চি দূরে।
ঠিক ঐটুকু সুযোগেরই দরকার ছিল তাঁর। এর পরেই তাঁর খিলের প্রথম এবং মোক্ষম মার সেই গোখরোর মাথা থেঁতলে দেয়।
সাপটাকে মারবার একটু পরে এসে হাজির হয় হাফিজ আর মুস্তাফা।
বাঁশে করে গোখরোর মৃতদেহ নিয়ে সারা পাড়া চক্কর দেবার সময় পাড়ার লোক একবাক্যে বলেছিল, এত বড় গোখরো তারা কখনো আগে দেখে নি।
— একলাই এত্তবড় একখান গোক্ষুর সাপ মাইররা ফ্যালসেন, দাদাবাবু! ঠাকুর্দায় খুব খুশি হইব আপনার উপর!
মৃত গোখরোটাকে দেখে হাসতে হাসতে বলেছিল হাফিজ।
তমালবরণ জানত দাদু খবরটা শুনলে খুশি হবেন। কিন্তু এতটা খুশি হবেন ভাবতে পারেন নি। সব শুনে আনন্দে আর গর্বে মুখ ঝলমল করছিল অঘোরনাথের।
সন্ধ্যা বেলা তমালবরণকে ডেকে পাঠালেন অঘোরনাথ।
— নাতিবাবু, কাল রাতে বাইরাইব আমরা খাওনের পর। তৈরি থাকস।
— কেন দাদু?
— বাঘ দ্যাখাইব তরে!
পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিল চারদিক।
রাত নটার পরে বেরোলেন দুজনে। যদিও জ্যোৎস্নায় পথ দেখতে কোনো অসুবিধে হয় না, তবুও দুজনের হাতেই দুটো টর্চ। রাস্তাঘাটে সাপের ভয়ানক উপদ্রব। এছাড়া দুজনের সঙ্গেই অল্প কিছু শুকনো খাবার আর জল আর কাঁধে বন্দুক। নদী পেরিয়ে পায়ে চলার যে পথটা জঙ্গলে ঢুকে গেছে সেই পথ ধরে সাবধানে এগোলেন দুজনে। নিজের টর্চ নিভিয়ে ইশারায় তমালবরণকেও টর্চ নেভাতে বললেন দাদু।
একটুখানি সামনে যাবার পর দাদু মূল পথটা ছেড়ে বাঁদিকে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকলেন। প্রায় তিন-চার মিনিট হাঁটার পর তমালবরণ দেখলেন আরও একটা পায়ে চলা পথ রয়েছে সেখানে। সেই পথ ধরে নিঃশব্দে প্রায় আধ ঘণ্টা হেঁটে গেলেন দুজনে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না ঠিকরে পড়ছিল মাটিতে। দাদু ফিসফিস করে তমালবরণকে বললেন, “দ্যাখ!”
বাঘের থাবার ছাপ মাটিতে।
এই ছাপ কখনকার তমালবরণ জানেন না। বাঘ আশপাশে ঘুরছে কিনা সেটা দাদু হয়তো জানে।
আবার হাঁটা। এবার বেশি নয়, মাত্র দু-তিন মিনিট।
এইবার তমালবরণ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন যে সামনে একটা বড় পুকুর।
পুকুর থেকে একটু দূরে একটা বিশাল গাছ। অন্ধকারে ঠিক কি গাছ বোঝা শক্ত। দাদু ইশারায় জানালেন গাছে উঠে বসতে।
বন্দুক আর খাবার নিয়ে গাছে ওঠা সহজ নয়। তবে গাছে চড়বার অভ্যাস ছিল দুজনেরই, তাই একটু অসুবিধে হলেও হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে পড়লেন দুজনে, মাটি থেকে প্রায় কুড়ি ফুট উপরে।
এবারে অপেক্ষা — ক্রমাগত মশার কামড় খেতে খেতে।
একের পর এক নানারকমের জন্তু এসে জল খেয়ে যাচ্ছে।
মুগ্ধ হয়ে তমালবরণ সে সব দেখছেন, আর হাঁ করে গিলছেন রাতের জঙ্গলের সেই অপার্থিব রূপ।
অপেক্ষা সার্থক হল রাত একটার পর।
কি একটা আওয়াজের পর, দাদু ফিসফিস করে ওর কানের কাছে বলল, “ফেউ!”
তার ঠিক মিনিট দুয়েক পরে দেখা দিলেন তাঁরা।
একটা বাঘিনী, সঙ্গে দুটো বাচ্চা।
বাচ্চা দুটো খুব ছোট নয়, সাইজে বড়সড় কুকুরের মতন, একা শিকারে যাওয়ার মতন বড় হয় নি এখনো।
প্রথমে পুকুরের জল চেটে চেটে খেল ওরা। তারপর বাচ্চাদুটো মনের আনন্দে এ ওর গায়ে জল ছেটাল কিছুক্ষণ। ওদের মা পারে বসে নির্লিপ্তভাবে দেখল সব। তারপর আলতো করে একটা ডাক ছাড়লো।
বাঘিনী মায়ের কি দাপট। সঙ্গে সঙ্গে জল ছেড়ে বাচ্চারা মায়ের পিছনে।
আস্তে আস্তে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল তারা।
উত্তেজনায় এর পরে আর কি হল ভালো করে আর দেখতে পারেন নি তমালবরণ।
পাঁচটার পরে সকালের আলো ফুটলে গাছ থেকে নেমে আবার বাড়ি ফিরে এলেন তাঁরা।
ফিরবার পথে দাদু বললেন, এর পরে বাঘ দেখাবেন গাছে না উঠে, মাটির পরে দাঁড়িয়ে।
খোলা জঙ্গলে মাটির পরে দাঁড়িয়ে বাঘ দেখা কিন্তু আর হল না তমালবরণের।
সেবার বাড়ি ফেরার পর জ্বরে পড়লেন অঘোরনাথ। জ্বর থেকে উঠতে না উঠতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পুজোর কাজে। তারপর কয়েকদিনের জন্য গেলেন কলকাতা।
কলকাতা থেকে ফেরার দু দিন পরে হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দেহ রাখলেন অঘোরনাথ।
মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে সব শেষ।
শেষ সময়ে পাশে ছিলেন তমালবরণ। মৃত্যুর ঠিক আগে তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও তাঁকে যেন কিছু বলতে চেয়েছিলেন দাদু, কিন্তু পারেন নি।
শ্মশান থেকে ফেরার পর সকলের চোখের আড়ালে গিয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন তমালবরণ। দাদুর জন্য কষ্ট তো ছিলই, তবে এই কান্নাও পুরোপুরি স্বার্থশূন্য ছিল না।
আর কে তাঁকে নিজের হাতে জঙ্গল চেনাবে? আর কে তাঁকে খোলা জঙ্গলে বাঘ দেখাবে?
৩
গতকাল সন্ধ্যা বেলা অফিস থেকে ফিরবার সময় পায়ে একটা বেশ বড় চোট লেগেছে।
মনে হচ্ছে ভোগাবে।
বান্দ্রা স্টেশন থেকে বান্দ্রা-কুরলা কমপ্লেক্স সাধারণত অটোরিক্সাতে যাতায়াত করে কিংশুক। খুব গরম না থাকলে অনেকসময় হেঁটেও বাড়ি ফেরে। পনের মিনিটের মতন হাঁটতে হয়। হাঁটতে কিংশুকের ভালো লাগে, তবে বান্দ্রা স্টেশনের আশপাশটা বেশ নোংরা আর ঘিঞ্জি। বোম্বে শহরে স্টেশনের আশপাশে সামান্য খোলা জায়গা থাকলেই সেটা মানুষের প্রাকৃতিক কুকম্মের জায়গা হয়ে যায়। ফলে যে গন্ধটি নাকে আসে সেটি মোটেই খুব সুবিধের নয়। চলার মতন কোনো ফুটপাথও নেই আলাদা করে। কোনোরকমে নাক-মুখ সামলে ঐটুকু রাস্তা পার হয়ে এসে ওয়েস্টার্ন এক্সপ্রেস হাইওয়ে পেরোলে যেন অন্য জগৎ। যেমন চওড়া রাস্তা তেমনি চওড়া ফুটপাথ দুদিকে। রাস্তার মাঝখানে বড় বড় গাছ। একবার বান্দ্রা-কুরলা কমপ্লেক্সের রাস্তায় পা দিলে নাক আর চোখ নিয়ে আর কোনো সমস্যা হয় না।
গতকাল অটোরিকশার লাইনটা ছিল বিশাল। একদম একসঙ্গে আপ লাইনের একটা ফাস্ট আর একটা স্লো ট্রেন ঢুকেছে ডাউনের একটা ফাস্ট ট্রেনের সঙ্গে। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তাই অধৈর্য লাগছিল কিংশুকের। অন্যদিকে একটু দূরে দাঁড়ানো ৩১০ নম্বর বাসটা ঠিক তখনই স্টার্ট নিল কুরলার দিকে। আরও অনেকের মতন তাই তাড়াতাড়ি লাইন ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে বাসে উঠে পড়তে গিয়েছিল কিংশুক।
এখনো এত বুড়ো হয় নি যে সামান্য চলন্ত বাসে উঠতে পারবে না কিংশুক। কালও ঠিকঠাক উঠে পড়তো, কিন্তু কিংশুকের দুর্ভাগ্য যে ঠিক ওর উঠবার সময়েই হঠাৎ করে স্পিড বাড়িয়েছিল বাসটা। কিংশুকের একটা হাত তখন বাসের হ্যান্ডেলে, কিন্তু পা-জোড়া মাটিতে। অন্য আর একজন যাত্রী ঠিক তখনই উঠতে সাহায্য না করলে আরও মারাত্মক অবস্থা হতে পারতো।
বাসে উঠেই কিংশুক টের পেয়েছিল অবস্থা খুব সুবিধের নয়। চোট লাগা পা-টা সিধে ফেলতে পারছে না, ল্যাংচাচ্ছে। তবে কষ্ট হলেও, চলতে যখন পারছে, আশা করা যেতে পারে কিছু ভাঙেটাঙে নি। লেংচে লেংচে বাড়ি ফিরে এল কিংশুক। ব্যথা বাড়ছে, তবে এখনো এমন অসহ্য হয়ে ওঠে নি যে সবকিছু ফেলে ডাক্তারের চেম্বারে ছুটতে হবে।
গতকাল অনেক রাত অবধি জেগে ব্যথা নিয়েই কম্পিউটারে অফিসের কাজ করেছিল কিংশুক। খালি রাতে শোবার আগে ব্যথা কমানোর জন্য একটা ক্রোসিন ট্যাবলেট খেয়ে নিয়েছিল। ক্রোসিনের জন্যই হোক বা চোটের জায়গাটা বিশ্রাম পাবার কারণেই হোক, রাতে ঘুমোতে খুব একটা অসুবিধে হয় নি।
ভোর বেলার ঘুমটা ভেঙে গেল কলিং বেলের কর্কশ আওয়াজে। বিরক্তির সঙ্গে দরজা খুলতে খুলতে মনে পড়ল গতকাল রাত্রে দুধ দেবার থলেটা বাইরে রাখতে আবার ভুলে গেছে ও। এরকম ভুল প্রায়ই হয়। দুধ দেবার ছেলেটাও সেটা জানে, তাই কলিং বেল না টিপে দরজার একপাশে প্যাকেটটা রেখে দেয়। আজ ওর ভাইটা এসেছে। ও একটা গাধা। হাজার-বার বললেও কোনো কিছু মনে রাখতে পারে না।
ব্যথাটা বেশ কম এখন। তবে হাঁটাচলা করলে আবার হয়তো বাড়বে।
মরুক গে ব্যাথা।
আর ঘুমোনোর মানে হয় না। না ঘুমোনোর ক্লান্তি থাকলে থাক, আপাতত একটু গা হাত পা ছড়িয়ে এই ভোর বেলাটা উপভোগ করা যাক। অনেকদিন পরে আজ একটু আগে উঠে পড়েছে কিংশুক। অন্যান্য দিনগুলোতে তো ঘুম থেকে উঠেই যন্ত্রের মতন লেগে পড়তে হয় অফিস যাবার জন্য তৈরি হতে। আজ একটু আরাম করে কফি খাওয়া যাক। লেংচে লেংচে গ্যাসে দুধ গরম করতে বসায় কিংশুক।
আজ না হয় পায়ে চোট, তবু কেন জানি না, সকালে ঘুম থেকে উঠে শরীরের সব জায়গাতে রোজই আজকাল একটা আড়ষ্টতা অনুভব করে কিংশুক। যেন শরীর জানান দিচ্ছে, “আমি আর আগের মতন নেই হে!” শরীরকে বাগে আনতে তাই কাপের পর কাপ কফি খেয়ে চলে কিংশুক। এতে শরীর হয়তো আরও খারাপ হচ্ছে। হোক। মরুক গে শরীর। বেশি ভেবে আর কি হবে? আর কয়েক বছর পরে রিটায়ারমেন্ট। তারপর বান্দ্রা-কুরলা কমপ্লেক্সের এই বড় তিন কামরার ফ্ল্যাট ছেড়ে পানভেলের পায়রার খোপের মতন ছোটো নিজের ফ্ল্যাটে জীবনের বাকি বছরগুলো কাটানো। দশ বছর না কুড়ি বছর সেসব ভেবে কি হবে? কিংশুক জানে পানভেলের আশপাশের কোনো শ্মশানেই পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে তার মরদেহ। অতসীকে আসতেই হবে একবার, নিজের স্বামীটির প্রতি শেষ কর্তব্যটুকু করবার জন্য। শমীক আসতে পারবে কি পারবে না এখন থেকে ভেবে লাভ নেই। ও তখন কোথায় থাকবে কেউ জানে না। বিদেশে থাকলে আসা অত সহজ নয়, এমনকি মা-বাবার মৃত্যু হলেও নয়।
আজকাল কারণে অকারণে মাথার মধ্যে এই মৃত্যুর চিন্তাটা ঘুরছে। বাবার খবরটা আসার পর থেকেই যেন নিজের ভবিষ্যৎটাও দেখতে পাচ্ছে কিংশুক। বর্ধমানের বিশাল বাড়িতে একা বৃদ্ধ, সঙ্গে শুধু তাঁর এতদিনের বশংবদ সেবকটি। কিংশুকের নিজের বেলা এরকম একান্ত বিশ্বস্ত কোনো সেবকও জুটবে না। হয়তো ছোট ফ্ল্যাটে তার মৃতদেহ পড়ে থাকবে বেশ কিছুদিন। তারপর গন্ধটন্ধ বেরোলে দরজা ভাঙবে প্রতিবেশীরা।
বান্দ্রা-কুরলার এই ফ্ল্যাটে জায়গার অভাব নেই। তিনখানা মোটামুটি বড় সাইজের ঘর। কিংশুকের একার জন্য একটা ঘরই যথেষ্ট, তাই শুধু তমালবরণ কেন, পিন্টুকেও অনায়াসে এনে রাখা যায় এখানে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না বোম্বে আসতে। এই অবস্থায় বোম্বেতে থাকার যে অনেক সুবিধে, কিংশুক সেটা বারবার বাবাকে বলেছে। কিন্তু বাবা বাচ্চা ছেলের মত জেদ করছে। হেসে বলেছে, “দ্যাখ, ষোলো বছর বয়সে একবার ভিটেমাটি ছেড়েছি। এই শেষ কটা দিনের জন্য কেন আর আমায় ফের রেফিউজি বানাবি!”
নিজের শেষটুকু দেখতে পাচ্ছে বলেই বাবার উপর বেশি জোর ফলাতে চায় না কিংশুক। বাবার জায়গায় নিজেকে রেখে বুঝতে পারছে যে বাবার কথাগুলো কতখানি নির্মমভাবে সত্যি। কি হবে অন্য আর একজনের স্বাধীন ইচ্ছে-অনিচ্ছের উপর ছুরি চালিয়ে? শেষবয়সে কিংশুকেরও কি দ্বিধা হবে না শমীকের ঘাড়ে চাপতে? শমীক জোর করলেও কি সেই দ্বিধা যাবে? তার চেয়ে পানভেলের ওই দেশলাইয়ের খোপই বরং ভালো মনে হবে কিংশুকের।
মুশকিল হচ্ছে অতসী কিংশুকের এই দিকটা বুঝবে না। কিংশুককে কবেই বা বুঝেছে অতসী? নিজের ভিতরে এই ভাঙনের কথা তাই অতসীকে বলবার প্রয়োজন মনে করে নি কিংশুক। শুনলে হয়তো হাসবে অতসী, অথবা অবজ্ঞায় মুখ বেঁকিয়ে বলবে “মিড্-লাইফ ক্রাইসিস!” বাবা বোম্বে আসতে চায় নি — এর মধ্যেও কিংশুকের অপদার্থতাই দেখবে অতসী। বাবা কেন আসতে রাজি নন? নিশ্চয়ই তুমি ঠিক মতন ওনাকে বোঝাতে পারো নি! ব্যক্তিত্বহীন, অপদার্থ লোক একটা।
দুধটা উঠলে পড়েছে। তাড়াতাড়ি করে গ্যাস বন্ধ করতে ছোটে কিংশুক।
চোটের জায়গাটা টনটন করে ওঠে তাড়াহুড়ো করার জন্য।
মাস খানেক আগে বর্ধমান ঘুরে এসেছে কিংশুক।
স্কুলের বন্ধু কৌস্তুভ এখন বর্ধমানের নামকরা ডাক্তার। তার মাধ্যমে যোগাযোগ করে কলকাতার সেরা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডক্টর সিদ্ধার্থ মিত্রর কাছে নিয়ে গেছে বাবাকে। কিংশুককে প্রচুর সময় দিয়েছেন ডক্টর মিত্র। তবে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন কি হতে চলেছে।
— দেখুন ওনার বয়সটা আর বছর দশেক কম হলেও আমরা লড়ে যেতাম, কিন্তু ওনার এই বয়সে ওনাকে আর বেশি কষ্ট দেবার মানে হয় না। জানেন বোধহয়, এই রোগের চিকিৎসাটাও একটা আসুরিক চিকিৎসা। I suggest benign inaction. কিছু ওষুধ দিচ্ছি, তবে ওগুলো সব যন্ত্রণা কমানোর জন্য।
— আর কতদিন রয়েছে হাতে?
— আমার অভিজ্ঞতা বলে যে খুব বেশি হলে ছ’মাস। বয়স্ক মানুষদের বেলা ওটা আরও কম হতে পারে।
— এর মধ্যে কতদিন উনি চলাফেরা করে বেড়াতে পারবেন?
হাসলেন ডক্টর মিত্র।
— এই চলাফেরার ব্যাপারটা অনেকখানি নির্ভর করছে ওনার মানসিক শক্তির উপর। এমন রোগী আমরা দেখেছি যে মরবার সাতদিন আগেও হাঁটাচলা, কাজকম্ম সব করেছে, আবার এমনও আছে যে খবরটা শুনেই সেই যে বিছানা নিয়েছে আর ওঠে নি।
এর পরে খুব বেশি হলে হয়তো বাবাকে বোম্বেতে নিয়ে গিয়ে একটা সেকন্ড ওপিনিয়ন নেওয়া যায়। আর সেই জায়গাটাতেই তমালবরণের আপত্তি, যেন বুঝতে পেরেছেন যে বোম্বে-যাত্রাই হবে তাঁর অগস্ত্য-যাত্রা।
বাবা নেই — কথাটা ভাবতে খারাপ লাগে। তবে আগে থাকতে মানসিক প্রস্তুতি থাকলে হয়তো এই খারাপ লাগাটা কমে যায় অনেকটা।
ক্যান্সার রোগটা রোগীর আশপাশের মানুষ যারা তাদের এই সময়টা দেয়। কিংশুকের মা এই সময়টা কিংশুককে দেয় নি। পাঁচ বছর আগের এক শীতের মধ্যরাতে টেলিফোন এসেছিল বাবার। খবর পেয়ে তখনই সকালবেলার ফ্লাইট বুক করে বর্ধমান ছুটে আসতে হয়েছিল কিংশুককে।
মোবাইলটা সুইচ অফ ছিল সেদিন। তাই ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিল বাবা।
ল্যান্ডলাইনটা বসার ঘরে। মশারি তুলে অন্য ঘর থেকে উঠে বসার ঘরে আসতে আসতে প্রথম যে চিন্তাটা মাথায় এসেছিল কিংশুকের সেটা হল: বাবা না মা?
এই টেলিফোন যে একদিন না একদিন আসবে সেটা কিংশুক জানতো। ওর মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছিল বহু আগে। এক এক করে তার সমবয়সীরা তাদের মা-বাবাকে হারানো শুরু করেছে প্রায় এক যুগ আগের থেকে। কিংশুকের বেলাও যে একই ব্যাপার ঘটবে, সেটা জানা কথা।
কে না জানে যে মাঝরাতে ফোন এলে আর অন্যপ্রান্তে বাড়ির কারুর গলা পেলে সেটা কখনো ভালো খবর হবে না?
কলকাতায় বাবাকে যদি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় সেজন্য এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিল কিংশুক। টেস্ট-ফেস্ট করাতে হলে হাতে কিছুটা সময় থাকা দরকার।
Benign inaction-ই যখন ট্রিটমেন্ট তখন আর থাকার মানে হয় না। ছুটি নিয়ে বেশি সেন্টিমেন্টাল হবারও কোনো কারণ নেই। বাবার এখন যা অবস্থা তাতে আবার আসতে হবে ওকে। হয়তো এক বার নয়, বেশ কয়েক বার। আর কেউ জানে না কদিন থাকতে হবে সেই সব সময়। সেক্ষেত্রে হাতে ছুটি জমিয়ে রাখাটা একান্তই প্রয়োজন।
বর্ধমানে ফিরেই প্রায় তিন হাজার টাকা গচ্চা দিয়ে এক সপ্তাহ পরের প্লেনের টিকিট পাল্টে পরশুর করে নিল কিংশুক। ডাকাত, শালা, এই প্লেন কোম্পানিগুলো। মরেও না এদের মালিকেরা।
ওষুধ-টষুধ যা কেনার ছিল, মাসখানেকের মতন কেনা হয়ে গেছে। বাবার জন্য এমনকি একটা হুইলচেয়ারও কিনে এনেছে কিংশুক। এই চেয়ার কেনার কাজটি করতে হয়েছে একান্ত গোপনে, বাবাকে না জানিয়ে। বাড়ির একপ্রান্তের একটা ছোট ঘরে সেটা রেখে ঘরটা তালাবন্ধ করে পিন্টুকে সেই চাবি দিয়ে সব বুঝিয়ে বলেছে কিংশুক। কৌস্তুভের নার্সিং হোম রয়েছে বর্ধমানে। আলাদা করে কৌস্তুভের সঙ্গে আর পিন্টুর সঙ্গে কথা বলে নিয়েছে যাতে যেকোনো অবস্থায় জরুরি দরকার পড়লে বাবাকে সেই নার্সিং হোমে ভর্তি করে নেওয়া হয়। তারপরের ব্যাপারটা কৌস্তুভের জাজমেন্ট। ও যেমন যেমন বলবে সেরকম সেরকম করা যাবে তখন।
এখন কোনো কিছু আর করার নেই কিংশুকের। এত বড় বাড়ি এখন ভূতের মতন ওর ঘাড়ে এসে চড়বে।
পাঁচ বছর আগে বাবা ছাড়াও আরো কতজন ছিল এই বাড়িতে — মা, জেঠু, জেঠিমা, দাদা-বৌদি, অন্তু-সন্তু। কলকাতা থেকে মুনিয়া আর দেবরাজ আসত প্রায়ই এলা আর তুলিকে নিয়ে। মাঝে মাঝে মামাবাড়ি আসত কিংশুকের দুই পিসতুতো দিদি নন্দিনী আর দেবযানী, বরেদের আর মেয়েদের নিয়ে। কিংশুকের পিসির কোনো ছেলে হয় নি। পিসির মেয়েদেরও তাই। ভাইফোঁটার সব অনুষ্ঠান তাই বর্ধমানের বাড়িতেই হতো। সারাবাড়ি লোকে গমগম করত তখন। সকাল থেকে ভরপেট খাওয়াদাওয়া আর জমিয়ে আড্ডা, কাপের পর কাপ চা আর কফি উড়ে যেত সেদিনটায়।
শেষের দিকে এদের কারুর সঙ্গেই ঠিক যেন বনত না কিংশুকের। এমনকি বাড়ির ছোটদের কেউও তার খুব কাছের হতে পারে নি। বহুদিন বাইরে বাইরে থাকার জন্য কিংশুক যে ঠিক কবে ওদের সবার কাছে খুব দূরের লোক হয়ে গিয়েছিল তা ওর নিজেরও জানা নেই। ওকে অতিথির মতন করে দেখার মধ্যে কোথাও যেন কোনো সূক্ষ্ম অপমান লুকিয়ে ছিল। কিন্তু আজ এই বাড়িটাকে এত ফাঁকা দেখে কিংশুকের মনে হল মানুষে-মানুষে এই সম্পর্কগুলো যতই জটিল হোক, মানুষ না থাকলে এত বড় বাড়ি ঠিক জমে না।
সাধারণত ছুটিছাটার দুপুরে ঘুমোয় না কিংশুক। কিন্তু কিছু না করতে পাড়ার আলস্যে দুপুরে খাবার পরে সেদিন সামান্য একটু ঝিমুনি এসেছিল ওর। ঘুম থেকে ওঠার পর দেখল একটা ম্যাজম্যাজে ভাব যেন সারা শরীরে লেপ্টে রয়েছে। অ্যাসিড হয়েছে, গলায় একটা জ্বালা-জ্বালা ভাব। তাড়াতাড়ি একটা জেলুসিল ট্যাবলেট মুখে পুরে দিলো কিংশুক। জল খেল দু-তিনবার।
বিকেল বেলাটা একদম বাড়িতে থাকতে পারে না কিংশুক। ছোটবেলার থেকে সারা বিকেলটা বাড়ির বাইরে কাটিয়েছে ও। অফিসে থাকতে হলেও এই সময়টায় ওর একটা অসহ্য কষ্ট হয়। সূর্যাস্তের রাঙা আলোর মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমাদের প্রথমে বাইরে টেনে নিয়ে আসে, তারপরে ঘরে ফেরায়। অফিসে থাকলে এই সময় ও ছোট্ট একটা ব্রেক নেয়। বাইরে বেরিয়ে হেঁটে আসে মিনিট পনের। আজও একবার বেরোলে কেমন হয়?
বড় রাস্তার মোড়ে একটা রিকশা দাঁড়িয়ে। অল্পবয়েসী ছেলে একটা। ছেলেটাকে চেনে কিংশুক। টেরু, বিদেশের ছেলে। বৌ-বাচ্চাকে নিখাদ একটি লেঙ্গি মেরে বিদেশ এখন অন্য বৌ নিয়ে ঘর করছে অন্য শহরে। ফল — খুব অল্প বয়স থেকে কাজে নেমে পড়তে হয়েছে টেরুকে। শেষ যখন এসেছিল বর্ধমানে তখন রিকশা ছেড়ে টেরু কলকাতার কাছে একটা কারখানায় কাজ নেবার কথা ভাবছিল। এখনও রিকশাই চালিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা?
আজকাল ছেলের বয়েসী কারুর সেবা নিতে গেলে বুকের ভিতরে একটা দলা পাকিয়ে ওঠে কিংশুকের। একটা অপরাধবোধ কোথাও কুরে কুরে খায়। ওদের জীবনটা কি এরকমই হবার কথা ছিল? কিন্তু একা কি করতে পারে কিংশুক, একটুখানি দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া?
রিকশাটা আজ খুব দরকার। টেরু ছাড়া আর কারুর রিকশা নিলে কি টেরুরও খারাপ লাগবে না? তার চেয়ে বরং উঠে পড়া যাক, ওকে আজ একটু ভালমতন পয়সা দিয়ে দেবে কিংশুক। এমনভাবে দেবে যাতে ভিক্ষা দিচ্ছে মনে না হয়।
কিংশুককে দেখে একগাল হাসলো টেরু।
— কবে এলেন কাকু?
— গতকাল। যাবি?
— আপনি বলছেন আর যাব না! কোথায় যাবেন, কাকু?
— শ্মশানে।
চমকে উঠল টেরু।
— শ্মশানে? কেউ মারা গেছে?
— হ্যাঁ। ওখানে পৌঁছে আমায় ছেড়ে দিবি। তারপর ঘন্টা দুয়েক বাদে আবার ওখানে আসিস।
— ঠিক আছে, উঠুন।
টেরুকে মিথ্যে কথা বলতে একটু খারাপ লাগছিল। কিন্তু সত্যি কথাটা হজম করার ক্ষমতা ওর নেই। যতদূর জানে কিংশুক, ও সোজাসাপটা ছেলে। সত্যিটা জানলে কিংশুককে পাগল ভাববে।
নিজের মনকে প্রবোধ দিতে লাগল কিংশুক। কেউ না কেউ তো আজ মরেছে, আর মানুষ মাত্রেই তো মানুষের আত্মীয়!
রিকশায় ওঠার পর এই নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করল না টেরু। তবে বকর বকর করেই চলল শহর আর পাড়ার নেতাদের নিয়ে – শুধুমাত্র যেন টেরুর জীবনে ঝামেলা বাড়ানোর জন্যই ওদের জন্ম হয়েছে। টেরুর একটা বড় আক্রোশ মণির বিরুদ্ধে। ছোটবেলার খেলার সঙ্গীদের একেবারে ভুলে গেছে মণি। দু হাতে টাকা লুটছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এত অল্প বয়সেই বর্ধমানের মতন জায়গায় দু দুটো বাড়ি এখন মণির, গাড়িও রয়েছে দুখানা। পুরোনো বন্ধুদের দেখলে এখন অবশ্য না চেনার ভান করে মণি। একবার রেশন কার্ড সংক্রান্ত একটা ঝামেলায় মণির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েই টেরুর শিক্ষা হয়ে গেছে।
– জানেন কাকু, আপনাদের বোম্বাইয়েও নাকি বাড়ি কিনে রেখেছে একটা! এখানে কেউ বাম্বু দিলেই যাতে টাকাপয়সা নিয়ে ওখানে পালিয়ে যেতে পারে!
হুঁ, হ্যাঁ করে এক দু কথায় জবাব দিল কিংশুক। বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন।
গত পাঁচ বছরের মধ্যে এই নিয়ে তিন বার বর্ধমানের শ্মশানে আসা হল কিংশুকের।
প্রথমে মায়ের জন্য। তারপর জেঠা-জেঠির জন্য একসঙ্গে। অ্যাক্সিডেন্ট বলে জটিল কেস ছিল সেটা।
নতুন করে বদলায় নি কিছুই। সেই একই রকম নোংরা, সরু রাস্তার পর রাস্তা আর গলিঘুঁজি। শ্মশানও সেই একই রকম নোংরা। মায়ের বেলা প্রথম বর্ধমানের শ্মশানে এসে সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল এই নোংরা ব্যাপারটা। মৃতদেহ নামিয়ে পিণ্ড দেবার জায়গায় তিন ইঞ্চি পুরু ধুলো, জায়গায় জায়গায় জল পড়ে কাদা হয়ে গেছে। তার মধ্যে আটকে রয়েছে আগের শবের জন্য তৈরি করা পিণ্ডের টুকরো। মাছি বসছে তার উপরে। অনেক চেষ্টা করে কান্না চেপেছিল কিংশুক। পরিষ্কার থাকাটা মায়ের একটা বাতিক হয়ে গিয়েছিল শেষদিকে। সেই মায়ের শেষযাত্রা কিনা এই রকম একটা জায়গায়?
জেঠু-জেঠিমার বেলা মৃতদেহ নামানো ছিল বহুক্ষণ। বোম্বে থেকে কিংশুক বাড়ি পৌঁছে গেছিল আগে। দাদা আর বৌদি আসবে জলপাইগুড়ি থেকে। বর্ধমানের কাছে কোথাও একটা ট্রেন অবরোধের জন্য আসতে দেরি হচ্ছিল ওদের। নেটওয়ার্ক নেই বলে কোনো যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না ওদের সঙ্গে। হতাশ হয়ে ওরা দাহকাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়। শ্মশানে আসার পর দাদার ফোন পায় কিংশুক। ট্রেন চালু হয়েছে আবার। বর্ধমান পৌঁছতে আর পনের মিনিট। সরাসরি স্টেশন থেকে শ্মশান আসবে ওরা। ততক্ষণ অবধি যেন অপেক্ষা করে সবাই।
নদীর ধারে দেবরাজের সঙ্গে আরও এক ঘন্টা সেদিন অপেক্ষা করেছিল কিংশুক। গম্ভীর মুখে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে চলেছিল দেবরাজ, আর ঘোলাটে চোখে চেয়েছিল নদীর ঘোলাটে কালো জলের দিকে।
আজও একই রকম নোংরা নদীর ধারটা। নদীর জল একই রকম ঘোর কালো, জায়গায় জায়গায় চড়া জেগে আছে। নদী না নর্দমা বোঝা শক্ত। নদীর আশপাশ জুড়ে ঝোপ — তবে ঘন নয়, বেশ কিছুটা অংশ ন্যাড়া। ঐ ন্যাড়া অংশগুলো আবার ভাঙা মেটে হাঁড়ির টুকরোয় ভর্তি। কিছু বাঁশের মাচানও ছড়িয়ে রয়েছে জায়গায় জায়গায়। ওগুলো হয়তো তুলে নিয়ে গিয়ে ব্যবহার করা হবে আবার।
কেন হঠাৎ এই নোংরা জঘন্য শ্মশানে এল কিংশুক? এই ধরনের উদ্ভট খেয়ালে শেষ কবে গা ভাসিয়েছে ও?
আসলে কিংশুক নিজেদের পুরোনো বাড়িটাকে আর সহ্য করতে পারছে না। এই নিঃঝুম বাড়িতে একা নিজের ঘরে থাকতে রীতিমতন ভয় করছে ওর। শ্মশানের শান্তি এখন সারা বাড়িটাতে। মা, জ্যাঠা, জেঠি — যাদের সঙ্গে গত পনের বছর ঝগড়া ছাড়া আর অন্য কোনো কথা হয় নি তারা কেউ নেই, অথচ যেন আছে। দাদা-বৌদি অন্য শহরে। আজ বিকেলে ঘুম থেকে ওঠার পর মনের গহিন থেকে কেউ একটা তাকে উপদেশ দিল, বরং আসল শ্মশানে চলো কিংশুক। হয়তো শান্তি পাবে সেখানে।
পাগলামি?
থাক, কেউ তো আর জানছে না!
ইলেকট্রিক চুল্লির আশপাশটা একটু পরিষ্কার। একটা মৃতদেহ পুড়ছে ভিতরে। আরও একটা মৃতদেহ নামানো রয়েছে নিচে। মরেও রেহাই নেই, পঞ্চভূতে বিলীন হতে গেলেও লাইন। আশ্চর্য এই যে শবটার আশপাশে কেউ নেই।
আবছা অন্ধকার এখানে। শবের মুখটা শুধু বেরিয়ে। বাকিটা সাদা চাদরে ঢাকা। পুরুষ। মুখ দেখে মনে হয় বয়স ষাটের নিচে। তার মানে কিংশুকের আশপাশেই বয়েস লোকটার।
লোকটার কথা ভেবে খুব মন খারাপ হয়ে যায় কিংশুকের। একা যাবে লোকটা? না, তা হয় না। আপনমনে বিড়বিড় করে কিংশুক, "আমি আছি, বন্ধু, আমি আছি।"
মুসলিম আর ক্রিশ্চানরা পোড়ায় না, কবর দেয়।
গত বছর একটা কনফারেন্সে সুইৎজারল্যান্ডের বাসেল শহরে গিয়েছিল কিংশুক। ওর হোটেলের খুব কাছে একটা কবরখানা ছিল। নিছক কৌতূহলের বশে একবার তার ভিতরে ঢুকেছিল কিংশুক। বড় বড় গাছ চারপাশে। কবরগুলোও একেবারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে নয়, এক একটা কবর অনেকটা জায়গা নিয়ে। যেন মৃত্যুর পরেও হাত পা ছড়িয়ে থাকতে পারে লোকে। একটা দুটো কবরের উপর ফুল রাখা।
কত সুন্দর! আর কি পরিষ্কার।
কবরের পাশে যে বসে সে জানে যে যার জন্য আসা, সে সেই মাটির নিচে ঘুমিয়ে। এ যেন বাড়ির এক তলা আর দোতলা। এই মাটির আবরণটুকু হল ছাতের মতন। যেন একই বাড়িতে রয়ে গেছি আমরা। ঘুম ভাঙলেই যে নিচে সে আবার উঠে আসবে উপরে। কিন্তু যাকে পোড়ানো হয়ে গেল তাকে আর অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। সে কোথাও নেই অথচ যেন সব জায়গায় রয়েছে।
মায়ের মৃত্যুর পর একটা গাড়ি ভাড়া করে ত্রিবেণী গিয়ে গঙ্গায় মায়ের অস্থিভস্ম বিসর্জন দিয়ে এসেছিল কিংশুক। কোনোদিন কিংশুকের কাছে এই ইচ্ছের কথা বলেন নি কৃষ্ণা, কিন্তু কিংশুক জানত এই ইচ্ছের কথা। নিজেদের মা-বাবার বেলা তার মামা-মাসীরা পরম নিষ্ঠাভরে এই কাজটি করে এসেছে। মায়ের অস্থিভস্ম হাতে আসবার পরে এমন একটা বড় ভাঙন হয়েছিল ভিতরে যে কিংশুক — পাষণ্ড, নাস্তিক কিংশুক — ধর্মভীরুর মতন গঙ্গার পথে রওনা হয়েছিল গাড়ি চেপে।
এই সেই ইলেকট্রিক চুল্লি। এই চুল্লিকেই কবর ভেবে এর পাশে কিছু সময় কাটাবে এখন কিংশুক।
বসার জন্য কোনো বেঞ্চি নেই এখানে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ইলেকট্রিক চুল্লির ধোয়াঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে কিংশুক।
সময় এগিয়ে আসছে। আর কিছুদিন পরে নিজেও অমন ধোঁয়া হয়ে যাবে কিংশুক।
টেরু এল একটু দেরি করে। হাতে কোনো ঘড়ি নেই, দোষ দেওয়া যায় না ছেলেটাকে।
পথে রিক্সা থামিয়ে সর্বমঙ্গলা পাড়ার ছোটো একটা মুদির দোকান থেকে একটা পাঁউরুটি, মাখন আর ডিম কিনল কিংশুক। কাল পথে লাগবে। ক্রমাগত বাইরে খেয়ে খেয়ে শরীর নষ্ট হচ্ছে। পিন্টু বলেছে, আলু আর ডিম দিয়ে স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেবে কাল, পথে নিয়ে যাবার জন্য।
রাত ন’টার সময় বাড়ি ঢুকল কিংশুক।
তমালবরণের শরীর আজ ভালো নেই। খাওয়া কমে গেছে অস্বাভাবিক রকমের। কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন তমালবরণ। কিংশুক লক্ষ্য করেছে, আজকাল কারণে অকারণে যে কোনো সময়ে, যে কোনো জায়গায় ঘুমিয়ে পড়ছেন তমালবরণ।
বাবার ঘরের দরজা জানলা সব খোলা। ঘর অন্ধকার হলেও জানলা দিয়ে আবছা জ্যোৎস্নার আলো এসে মুখে পড়েছে বাবার।
কি রোগা হয়ে গেছে বাবা। রক্তশূন্য, পাণ্ডুর চেহারা। একেই বোধ হয় মৃত্যুর ছাপ বলে।
গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে আসছে কিংশুকের। বাবাও চলল এবার। আরো শূন্য হয়ে যাবে এই বাড়ি। কিন্তু কিংশুকের রেহাই নেই। তারপরও আসতে হবে তাকে এই বাড়িতে, হয়তো থাকতেও হবে বেশ কিছু দিন। অনেক কাজ — বাড়ি বিক্রি, সকলের সঙ্গে — মানে দাদা-বৌদি আর মুনিয়া-দেবরাজের সঙ্গে — টাকা-পয়সার ভাগ-বাঁটোয়ারার আলোচনা। নন্দিনী আর দেবযানীরও অংশ আছে এই বাড়িতে।
মুশকিল হল আর সকলে বাড়ি বিক্রিতে রাজি হলেও দাদা আর বৌদি রাজি হচ্ছে না। দাদার দুই যমজ ছেলে অন্তু-সন্তু এখন দুবাইয়ে। দুবাইতে ওরা ঠিক কি করছে সে ব্যাপারটা বেশ রহস্যে মোড়া। তা সে যে কাজই করুক, দুবাই থেকে ওরা দাদা-বৌদির মগজ ক্রমাগত ধোলাই করছে এই বলে যে এই বাড়িটাতে ওরা হেরিটেজ হোটেল খুলবে। এই প্রস্তাবে একেবারেই সায় নেই বাকি সকলের। বর্ধমানের মতন জায়গায় শহরের কেন্দ্র থেকে অনেকটা দূরে এরকম একটা হোটেল যে চলবে না সে ব্যাপারে শুধু কিংশুক নয়, অন্য কারোরই কোনো সন্দেহই নেই, ভরসাও নেই কোনো অন্তু-সন্তুর উপর। কিন্তু দাদা-বৌদি একগুঁয়ের মতন এক কথা আঁকড়ে পড়ে আছে। এমনকি বাড়িটাকে নিজেরা কিনে নিতেও ওরা রাজি নয়।
কিংশুকের সবচেয়ে বড় মুশকিল এই যে অতসীও কিছুতেই নিজের জেদ ছাড়বে না, যেখানে শমীকের স্বার্থ জড়িয়ে, সেখানে দরকার পড়লে বাঘিনী মায়ের মতন শিকারে বেরোবে অতসী। কাজ না এগোলে দিনের মধ্যে পনের বার ফোন করবে দিল্লি থেকে। নিজেদের ভাগের অংশ পুরো বুঝে নিতে চায় অতসী, আর এই কাজটা করিয়ে নিতে চায় নিজে আড়ালে থেকে কিংশুককে শিখণ্ডীর মতন সামনে খাড়া করে।
কিংশুকের মন-মেজাজ আরও খারাপ কারণ এই সব গোলমালে আসল কাজ, মানে বাবার যত্নের অবহেলা হচ্ছে।
বাবা কিংশুকের কাছে একটা বিরাট দুর্বল জায়গা। ছোটবেলায় কোনোদিন বাবার হাতে মার খায় নি কিংশুক, ধমকও নয়। বাবার সঙ্গে কথা হত খুব কম, একটু দূরে দূরে থাকাই পছন্দ করত বাবা, তবু কোনো দোষ করলে নিজে শাসন না করে বাবার কাছেই ঠেলে দিত মা। সেই সব সময়ে গলা না তুলে ঠান্ডা মাথায় স্নেহের সুরে সবকিছু বোঝাত বাবা।
পড়াশুনো নিয়েও কোনোদিন কোনো জোর খাটায় নি বাবা, কিংশুকের উপরে। অন্য অনেক মা-বাবার মতন নিজের পছন্দ-অপছন্দ, নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে কিংশুকের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয় নি কোনোদিন। মা কখনো কিংশুকের উপরে রেগে গেলে, নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে চাপাতে চাইলে এক-ই রকম ঠান্ডা মাথায় গলা না তুলে মাকে বুঝিয়েছে।
কিংশুক জানে, বাবার এই নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে না চাপানো কোনো দুর্বলতা নয়। অন্যের ইচ্ছেকে সম্মান দেওয়া। নিজের সন্তানও যে একজন ব্যক্তি, তারও যে নিজের কিছু ইচ্ছে-অনিচ্ছে থাকতে পারে সেই শিক্ষা কি কিংশুক বাবাকে দেখেই শেখে নি?
না, অতসী কিছুতেই বুঝবে না। এই বাবার উপর কি করে আজ নিজের জোর খাটাবে কিংশুক?
— ডাইকলেন ছোটবাবুরে?
একটু বিরক্ত হয়ে পিছনে পিন্টুর দিকে ফিরল কিংশুক।
— না, ঘুমোচ্ছে যখন ঘুমোতে দে। তুই ভাত বাড়, আমি আসছি নিচে।
ফোনটা এল রাত সাড়ে দশটায়।
— কি ব্যাপার, সারাদিন ফোন করো নি কেন?
প্রাণপণে নিজের বিরক্তি চাপে কিংশুক। গলায় সামান্য বিরক্তির অভ্যাস পেলেও ছাড়বে না অতসী। অপমান করবে। এখন আর ঝগড়া করার এনার্জি নেই কিংশুকের।
— কি বলব বলো তো?
— বাঃ, একটা লোক অসুস্থ, সে কেমন আছে না আছে সেটা তো অন্তত জানাবে।
— কি করবে জেনে? যখন আসবে না বলে ঠিক করেই ফেলেছো, তখন ওটুকু তোমার না জানলেও চলবে।
কথাটা বলে ফেলেই ভয় হল কিংশুকের। ছাড়বে না অতসী। খুব বিশ্রী কোনো আঘাত এবার এল বলে।
না, রাগল না অতসী। মনে হল দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা।
— শোনো, তোমাকে তো আগেও বলেছি, বর্ধমানে কাউকে আমি চিনি না। ক্যান্সারের রোগী নিয়ে আমি একা থাকব কি করে ওখানে? ওটা তোমার শহর। যা করবার তোমাকেই করতে হবে।
— তোমাকে তো মাত্র দু-তিনটে দিনের জন্য বলেছিলাম আসতে। একবার তো দেখেও যায় লোকে।
— তুমি আগে বোম্বে নিয়ে চলো বাবাকে, বলেছি তো আসব। ওখানে ভালো হাসপাতাল আছে, সাপোর্ট-সিস্টেম অনেক ভালো। বর্ধমানে এসে খামোখা দুজনের সময় নষ্ট করার মানে হয় না।
তার মানে নিজের জেদ থেকে নড়বে না অতসী। সারাজীবন ধরে দেখে গেল কিংশুক, সকলেরই নিজের নিজের জেদ রয়েছে, বাবার, মায়ের, দাদার, বৌদির, বৌয়ের … শুধু কিংশুকেরই যেন কোনো জেদ থাকতে নেই।
আরও অনেকক্ষণ ধরে কিংশুককে বকুনি আর উপদেশ দিল অতসী। ফোন ছাড়ার পর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কিংশুক দেখল এগারোটা বেজে গিয়েছে।
দরজা খুলে বাইরের খোলা ছাতে এল কিংশুক। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক, কিন্তু কিংশুকের একটুও ভাল লাগছে না এসব। রাগ হচ্ছে। অসহায় লাগছে নিজেকে।
বেশ কিছুক্ষণ অন্ধকারে একা ভূতের মতন বসে রইল কিংশুক।
নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্নার আলো পড়ছে গায়ে। অল্প হাওয়ায় কাঁপছে নারকেল গাছের পাতাগুলো।
একটু দূরে একটা চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। রাইস মিলের ধোঁয়া। ধান সেদ্ধ হচ্ছে রাইস মিলে। সেদ্ধ ধানের একটা মাতাল করা গন্ধ আছে। আজ সারারাত এই গন্ধ থাকবে।
এই গন্ধের ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। বান্দ্রা-কুরলাতে কিংশুকদের কমপ্লেক্সের ঠিক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মিঠি নদী। এই নদীটি এখন আসলে একটি কাঁচা ড্রেন। এই ড্রেনটির আশপাশে যে গন্ধটি বেরোয় তাতে অন্নপ্রাশনের ভাত উল্টে আসাটাও স্বাভাবিক। ট্রেনে যদি খুব ভিড় হয়, ভিতরে বসে যদি বাইরের কিছু দেখা না যায় — তা হলেও, বান্দ্রা স্টেশন আসছে কিনা বোঝা যায় এই গন্ধ দিয়ে, কারণ চার্চগেট থেকে বান্দ্রা আসার আগে রেল লাইন চলে গেছে মিঠি নদীর উপর দিয়ে।
প্রথম দিকে মাস খানেক বান্দ্রা-কুরলা কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাটে বেশ অসুবিধে হয়েছিল কিংশুক আর অতসীর এই গন্ধের সঙ্গে মানিয়ে নিতে। তারপর কেমন যেন আস্তে আস্তে সয়ে গেল সব। যেন গন্ধটাই মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। অথচ কিংশুক জানে গন্ধ রয়েছে তার জায়গাতেই। নতুন কেউ এলেই সেটা টের পায়। কিংশুকদের নাক আসলে মানিয়ে নিয়েছে এই গন্ধের সঙ্গে।
ভালো গন্ধ, শরীর মন যার জন্য মুখিয়ে থাকে, সেগুলো বোধ হয় এত সহজে মিলিয়ে যায় না। সেদ্ধ ধানের এই গন্ধ যেমন।
বর্ধমানে এলে তো বটেই, বোম্বেতেও মাঝে মাঝে মাঝরাতে ঐ গন্ধে কিংশুক জেগে ওঠে। যেন হাজার হাজার মাইল কোনো অজানা হাওয়ায় ভর করে পাড়ি দিতে পারে সেই গন্ধ।
প্রথম যেদিন ওই গন্ধে উঠে জেগে বসেছিল কিংশুক, মনটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বর্ধমানের বাড়িতে একবার ঘুরে আসতে ইচ্ছে করছিল তখন।
পাশে অতসী শুয়ে। দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অথচ কিংশুক জানে আসলে ভীষণ হালকা ঘুম অতসীর। খুব সাবধানে মশারি তুলে সেই রাতে বেরিয়ে এসেছিল কিংশুক। বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে ব্যালকনির রেলিং ধরে রাস্তার দিকে চেয়েছিল অনেকক্ষণ ধরে।
ফাঁকা রাস্তা। কোনো লোক দেখা যাচ্ছে না। তবু দুতিনটে অটো আর ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে বাইরের রাস্তায়। ড্রাইভারেরা ওই গাড়িতেই হয়তো ঘুমিয়ে। কিংশুক জানে এই ড্রাইভারদেরও একটা বড় অংশের বাড়ি অন্য কোনো শহরে বা গ্রামে। ওদের মতন প্রতি পদে টিঁকে থাকার যুদ্ধ করবার দরকার নেই কিংশুকের, তবু নিজের শহরের বা গ্রামের প্রতি টানের ব্যাপারে কোথাও যেন ওরা আর কিংশুক এক। আকবর বাদশা আর হরিপদ কেরানি এক হয়ে যায় এই টানে। কে জানে গাড়ির মধ্যে শুয়ে শুয়ে কি গন্ধ পাচ্ছে ওরা ঘুমের ঘোরে?
বড় এক গ্লাস জল খেল কিংশুক। তারপর চুপচাপ শুয়ে পড়ল আবার। অতসীর যদি ঘুম ভেঙে যায় আর যদি দেখে কিংশুক মাঝরাতে রাস্তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে, ভীষণ চটে যাবে।
অতসী ভয়ঙ্কর রকমের স্বাভাবিক। এইসব পাগলামি অতসী একেবারে বরদাস্ত করতে পারে না।
আজও হাল্কা মিষ্টি একটা হাওয়া বইছে। অল্প হাওয়ায় স্প্রিঙের মতন এঁকেবেঁকে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে রাইস মিলের ধোঁয়া।
একদিন যখন আমরা সবাই মিলিয়ে যাব ওই ধোঁয়ার মতন, তখন সবকিছুর মধ্যে এত জড়িয়ে পড়ার কি মানে হয়? কিন্তু কে বুঝবে এসব কথা? জড়িয়ে যে পড়তে চায় না, তাকেও টেনে আনবে বাকি সবাই। তারপর একসময় সে বেচারা দেখবে তার চারপাশের রাস্তাগুলো সুতোর মতন জট পাকিয়ে গেছে। বেরোবার রাস্তা নেই। কৌটোয় আটকানো পোকার মতন ছটফট করবে সে শুধু।
এখন অতসী নেই ধারেকাছে। যতক্ষণ ইচ্ছে এখানে বসে থাকতে পারে কিংশুক। তবু মন সাড়া দিলেও, শরীর রাজি হচ্ছে না।
মাথার পিছনে ঘাড়ের দিকটাতে অল্প অল্প ব্যথা করছে ফোনটা ছাড়ার পর থেকেই। আজকাল অতসীর সঙ্গে কথা বলা মানেই ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যাওয়া।
না, এভাবে একা একা অন্ধকারে ভূতের মতন বসে থেকে নিজেকে নষ্ট করে ফেলার কোনো মানে হয় না।
ঘরে এসে ল্যাপটপটা চালু করল কিংশুক। মোবাইলটাকে হটস্পট করে ইন্টারনেট চালু করে দিল চটপট।
এখন বেশ কিছুক্ষণ প্লে-বয় গ্যালারির নগ্নসুন্দরীদের সঙ্গে সময় কাটাবে কিংশুক। মনে মনে শয্যাসঙ্গিনী করবে তাদের।
নইলে ঘুম আসবে না আজ রাতে।
৪
মাথা গরম হয়ে আছে। ঘুম আসছে না। একটা লোক কতটা অপদার্থ হতে পারে?
একের পর এক লোকটার অকর্মণ্যতার নিদর্শন দেখতে দেখতে এখন আর অবাক হয় না অতসী, তবে বিরক্তিটা যায় না। কোনো কাজ করাতে গেলে অন্তত ষোলোবার মনে করাতে হবে, এদিকে আবার বাবুর মেজাজ ষোলোর উপরে আঠারো আনা। বহুদিন ধরে ঠেকে ঠেকে এখন অতসী প্রচুর কাজ নিজে করে নেয় অথবা অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নেয়। নিজের ব্যাপারে এখন তার আর কিংশুকের উপর কোনোই নির্ভরতা নেই, কিন্তু শ্বশুরবাড়ি সংক্রান্ত ব্যাপারগুলোতে কিংশুকের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।
পইপই করে কিংশুককে স্রেফ দুটো পরামর্শ দিয়ে চলেছে অতসী। বাবাকে বোম্বে নিয়ে এসো। এখন এই অবস্থায় স্রেফ পিন্টুর ভরসায় ওনাকে বর্ধমানে ফেলে রাখা ঠিক নয়। আর, ওই সব হেরিটেজ হোটেল-টোটেল নয়, বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে বাকি সকলের সঙ্গে এখন থেকেই কথা বলে রাখো। শমীক যদি রিসার্চ স্কলারশিপ না পায়, বা পেলেও যদি সেটা প্রয়োজনের তুলনায় কম হয়, কিছু টাকাপয়সার দরকার হতে পারে সেই সময়।
কি এমন অন্যায় কথা বলেছে অতসী? দাদা-বৌদি, মুনিয়া-দেবরাজ, নন্দিনী-দেবযানী আর তাদের বরেরা — কাউকে তো ও বিন্দুমাত্র ঠকাতে চায় না। কিংশুকের ভাইপোরা যদি হেরিটেজ হোটেল খুলতে চায়, তাহলে কিনে নিক পুরো বাড়িটা। নিজেদের টাকায় কম পড়লে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার করে কিনুক। কত লোক তো আজকাল এরকম করছে! সবাইকে অযথা ওদের ব্যবসাতে জড়াতে চাইছে কেন ওরা? ধান্ধাটা কি? কিংশুকের দুবাই-বাসী ওই ভাইপো দুটির সবই কেমন গোলমেলে। ওদের একটুও বিশ্বাস করে না অতসী। ওদের সকলের যার যা প্রাপ্য সেটা বাড়ি বিক্রির পরে ওদের কড়ায় গণ্ডায় মিটিয়ে দিক কিংশুক। দরকার পড়লে সাক্ষি রেখে, উকিলের মাধ্যমে। আশপাশের লোকের সঙ্গে কথা বলুক বাড়ি বিক্রি নিয়ে। ইন্টারনেটে অ্যাড দিক। কত কি করার রয়েছে। এখন দার্শনিকের মতন শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় কাটালে চলবে?
শ্বশুরমশাইয়ের ব্যাপারটাতেও চরম ঢিলে দিচ্ছে কিংশুক। অতসী চায় কিংশুক বারবার করে ওর বাবাকে বলুক বোম্বে আসতে। জোরের সঙ্গে বলুক, মিনমিন করে নয়। “তোমাকে আসতে হবে।” ব্যাস, খেল খতম। মা-বাবার একটা বয়স পেরিয়ে গেলে সন্তানকে জোর খাটাতেই হয়। এটা দ্বিতীয় শৈশব। শিশুকে যেমন একটু শাসনের মধ্যে রাখতে হয়, বৃদ্ধ মা-বাবাকেও সেই রকম। ভালোবাসা আর কর্তব্যবোধ থাকলে মা-বাবাও কিছু মনে করে না। নিজের মা-বাবার বেলায়ও একই রকমের জোর ফলিয়েছে অতসী। কেউ কিছু মনে করেছে? দাদা তো বিশ্ব উদ্ধার করছে, তাই মা-বাবার ব্যাপারে হাত গুটিয়েই আছে সবসময়। অতসী শক্ত হাতে হাল ধরেছিল বলেই তো বাবার কোমর ভাঙার সময়ে অতটা নিশ্চিন্ত ছিলেন ওঁরা। সেই সময়ে বাবার জন্য কি না করেছে অতসী? মা তো বটেই, যে বাবা বরাবর অতসীর থেকে দাদার ক্যারিয়ারকে অনেক বেশি প্রাধান্য দিয়ে এসেছে, অতসী অনেক ভালো রেজাল্ট করা সত্ত্বেও, তিনি পর্যন্ত ওর সামনে ওর মাকে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, “তিসি-র মতন মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের কথা!”
মনে হচ্ছে নিজেই জোর করতে হবে এবার। কিন্তু মুশকিল এই যে ভালোবাসার যে জোরটা নিজের মা-বাবার উপর খাটে, সেটা শ্বশুর-শাশুড়ির বেলায় খাটে না। শ্বশ্রূমাতাটির সঙ্গে অতসীর সম্পর্ক কোনোদিনই খুব মধুর ছিল না। দূর থেকে যতটা জ্বালানো সম্ভব, বেঁচে থাকতে ঠিক ততটাই জ্বালিয়ে গেছেন তিনি। শ্বশুরমশাই অবশ্য ভালো লোক। দীর্ঘদিন ধরে ওনাকে দেখে অতসীর মনে হয়েছে লোকটির মধ্যে কিছু মানবিক গুণ রয়েছে। দায়িত্ববোধও নিজের ছেলের থেকে অনেক বেশি। অতসীকে শ্বশুরমশাই ওই বাড়ির আর পাঁচজনের মতন খারাপ চোখে দেখেন না, কিন্তু বিয়ের পর থেকেই দূরে দূরে থাকার জন্য অতসীর সঙ্গে ওনার আলাদা করে এমনকি কোনো বিশেষ স্নেহের সম্পর্কও তৈরি হয় নি। এ অবস্থায় ঠিক কতটা জোর করতে পারে অতসী? আর, জোর করতে গেলেও সেটা তো টেলিফোনে হয় না।
না, ঠিক যে ভয়টা অতসী করছিল, ঠিক সেটাই হয়েছে। এ কাজ কিংশুকের দ্বারা হবার নয়। মনে হচ্ছে একবার অল্প কয়েকদিনের জন্য সেই বর্ধমান ঘুরে আসতেই হবে।
বিয়ের পর প্রায় প্রত্যেক দিন একা একা কাঁদত অতসী।
সকালে কিংশুক অফিস বেরিয়ে গেলে পুরো ফ্ল্যাটটা যেন ভূতের মতন চেপে বসত ওর ঘাড়ে। চারপাশে দেয়াল, অন্ধকার। ছোট দুই বেডরুমের ফ্ল্যাট, বিল্ডিংটা এমনভাবে বানানো যে আশপাশে অন্য ফ্ল্যাটগুলোর জন্য আলো ঢোকে না এই ফ্ল্যাটে ঠিক মতন। কোনো টেলিফোনও নেই বাড়িতে। একটা এসটিডি কল করতে গেলে নিচে নেমে ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে আরো দু-তিন মিনিট হেঁটে উল্টোদিকের দোকানে যেতে হবে। দিনের বেলা কথা বলা চলবে না কারুর সঙ্গে। তিন দিন আধ ঘন্টা করে কথা বললেই কিংশুকের অর্ধেক মাইনে টেলিফোনের পিছনে বেরিয়ে যাবে। আর কথাই বা কার সঙ্গে বলবে অতসী? মা-বাবা-দাদার সঙ্গে? কেন বলবে? দিব্যি তো রয়েছে ওরা সকলে, এখানে কষ্টে অতসীর বুক ফেটে যাচ্ছে অথচ ওদের সময় করে বোম্বে আসা তো দূরের কথা, একটা চিঠি পর্যন্ত লেখার সময় নেই – যেন যত দায় সমস্ত অতসীর একার।
বোম্বে আসার পর প্রথম কয়েকটা দিন কিংশুক ছুটিতে ছিল। নতুন শহরের সব কিছুই অতসীর কাছে তখন অজানা আর রোমাঞ্চকর। একটা শহরের মাঝখান দিয়ে এরকম ট্রেন চলে? সেই ট্রেন থেকে আবার সমুদ্র দেখা যায়? ওয়েস্টার্ন লাইনের চার্নি রোড স্টেশন এলেই ওর মুখে একটা হাসি ফুটে উঠতো। প্রথমদিকে অনেক সন্ধ্যা মেরিন ড্রাইভে বসে কাটিয়েছে ওরা। কিংশুকের সঙ্গে বসে সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখাটা প্রায় অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল অল্প কয়েকদিনেই। রাস্তার আলো জ্বলে ওঠারও অনেক পরে ফিরত ওরা। নানান দোকানে ঘুরে বেড়াত আরও কয়েক ঘন্টা। অতসীর তখন নতুন সংসার সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার নেশা। অবাক চোখে বোম্বের বিশাল বিশাল দোকানের থরে থরে সাজানো জিনিস দেখে যেত অতসী। এত জিনিস কারা কেনে? কিসে লাগে? আগাগোড়া মফস্বল শহরে মানুষ হয়ে ওঠা অতসীর সেই বিস্ময়ের ঘোর কাটতে অনেকটা সময় লেগেছিল।
অবস্থাটা পুরোপুরি বদলে গেল কিংশুকের ছুটি ফুরোনোর পর। সকালে সাড়ে আটটায় বেরিয়ে পড়ে কিংশুক। ফলে ঘুম থেকে উঠেই প্রস্তুতি নিতে হয় অফিস যাবার। ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় আটটা হয়ে যায়। যদিও ছুটির সময় সাড়ে পাঁচটা, অলিখিত নিয়ম হল অফিসারদের রোজ আরও অন্তত এক ঘন্টা সময় দিতে হয় অফিসকে, কোনো জরুরি কাজ এলে আরও বেশি। বোম্বের ট্রেন আর বাসের মানবসমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে বাড়ি ফিরে এসে ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়ত কিংশুক। শনি-রবিবার বা ছুটির দিনগুলোতে বাড়ি থেকে বেরোতে তার প্রবল আলসেমি। সোম থেকে শুক্র তো বটেই, শনি-রবিবারও তাই অনেক সময় বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে কাটত অতসীর। আশপাশে এমন কেউ ছিল না যে একটু মন খুলে কথা বলবে।
কিংশুক অফিসে বেরিয়ে যাবার পর একটা প্রবল হতাশা এসে গ্রাস করত অতসীকে। কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করত না। “গৃহবধূ” বলে যে শব্দটাকে ও মনেপ্রাণে ঘৃণা করে, ও জানত সেই শব্দটাই এখন থেকে ওর পরিচয়। ভাবতে গেলেই অঝোরে কান্না নামত দু চোখ বেয়ে।
একটানা আর কত কাঁদবে একটা মানুষ? চোখের জল-ও শুকিয়ে যেত একসময়। যন্ত্রের মতন বাড়ির সব কাজ করত অতসী আর করতে করতে ভাবত এই জীবনই কি ওর প্রাপ্য ছিল। মা-বাবার উপরের রাগ আর বিরক্তিটার প্রকাশ হত রোজ রাত আটটার পর কিংশুক ফিরলে ওর সঙ্গে ঝগড়া করে।
পড়াশুনোয় ভালো হলেও, একটা চাকরি পেতে গেলে যে চেনা লোক থাকা কতটা জরুরি সেটা বোম্বে আসার পর আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করে অতসী। বোম্বেতে প্রথম তিন মাস কাটানোর পর থেকে পরবর্তী দু বছর অ্যাপ্লিকেশনের পর অ্যাপ্লিকেশন করে গেছে অতসী। বেশিরভাগ জায়গা থেকেই কোনো জবাব আসে নি, তবু যতগুলোর থেকে জবাব এসেছে, সে সংখ্যাটাও কম না। সেই সময়টাতে সপ্তাহে অন্তত দুটো ইন্টারভিউ বা অফিস ভিজিট ওর বাঁধা ছিল। প্রথমদিকের একটা দুটো জায়গায় খালি কিংশুক ওর সঙ্গে গিয়েছিল। বোম্বের রেল স্টেশনগুলোর নাম আর কোনটা কার পরে সেটা একবার মুখস্থ হয়ে যাবার পর কিংশুককে আর সঙ্গে যেতে দেয় নি ও। একাই যেত। কোনো কাজ হয় নি এত পরিশ্রম করেও। কেউ ওকে সেদিন চাকরি দেয় নি। মাঝের থেকে মাথায় জুটেছে রাশি রাশি অপমানের বোঝা। কিছু কিছু জায়গা থেকে ইন্টারভিউর সময়েই এমন ইঙ্গিত এসেছে যার মানে বুঝতে কোনো মেয়ের অসুবিধা হয় না।
এই অপমানগুলোকে মাথার থেকে সহজে তাড়িয়ে দিতে পারত না অতসী। পড়াশুনোয় ব্রিলিয়ান্ট না হলেও যথেষ্ট ভালো ছাত্রী সে। মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিসন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষাগুলোতে ফার্স্ট ক্লাস। ক্যারিয়ার ভালো হলেও, খুব বেশি কিছু সে তো চায় নি সেদিন। শুধু নিজে একটু স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছিল অতসী, যাতে কারুর, এমনকি বরেরও মুখাপেক্ষী হয়ে না থাকতে হয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে মেয়েদের যে কি অবস্থা হয় সেটা ওর নিজের মাকে চোখের সামনে দেখে শেখা। তাই একটা মোটামুটি ভালো ভদ্র সভ্য স্কুলে বা অফিসে, পড়ানোর বা ছোটখাটো দায়িত্বওলা কাজ পেলেই ওর খুশির সীমা থাকত না সেদিন।
বোম্বের মতন মস্ত শহরে হয়তো কিছু না কিছু জুটে যেত আর একটু লেগে থাকলে। কিন্তু সেটুকু সময়ও হাতে পেল না অতসী, শরীরের মধ্যে শমীকের আবির্ভাবে।
পিরিয়ডস বন্ধ হওয়া মানেই তখন টেনশন।
এর আগে বহুবার টেস্টের রেজাল্ট নেগেটিভ আসায় এবারও অতসী ভেবেছিল রেজাল্টটা নেগেটিভ আসবে। পজিটিভ রেজাল্ট দেখে সেদিন একা সেই ফ্ল্যাটে পাগলের মতন হাউহাউ করে কেঁদেছিল অতসী। তার চাকরি, তার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন সব নষ্ট হয়ে গেল বরাবরের মতন। নষ্ট করে দিল কিংশুক।
এখন থেকে ওর কাজ হবে শুধু রান্না করা আর ছেলে মানুষ করা।
প্রথমে অতসী ভেবেছিল কিংশুকের সঙ্গে হেস্তনেস্তটা হবার আগে মা-বাবাকে টেলিফোনে খবরটা জানিয়ে প্রবল গালাগালি দেবে, কিংশুকের সঙ্গে এত তাড়াতাড়ি ওর বিয়ে দেবার জন্য। তারপর মনে হল, না, কোনো কিছু না বলাটাই হবে ওদের সবচেয়ে বড় শাস্তি। ওদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না অতসী।
আর, আসুক কিংশুক আজ। রোজ রাতে ওকে নিয়ে মজা লোটা বের করে দেবে আজ অতসী।
অ্যাবরশন। হ্যাঁ, অ্যাবরশনই এখন একমাত্র মুক্তির পথ।
শমীককে তার জন্মসংক্রান্ত প্রায় সমস্ত কিছু বলেছে অতসী। পেটের মধ্যে থাকার সময় দিনে গড়ে কতবার করে শমীক লাথি মারত, সিজারিয়ান বেবি হওয়া সত্বেও কত কষ্ট দিয়েছিল ও, জন্মের পর ঠান্ডা লেগে গিয়েছিল বলে ঠিক কত ঘন্টা ওকে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়েছিল — সব বলেছে, সব। কিন্তু সেই প্রথম দিনের অ্যাবরশন চাওয়ার ব্যাপারটা কখনো মুখ ফুটে বলতে পারে নি অতসী। কোনো মা কি কখনো পারে?
যে ছেলের জন্ম প্রথমে সে চায় নি, একবার কোলে আসার পর ঠিক কবে যে সে সবচেয়ে কাছের হয়ে গেল অতসী নিজেও সেটা জানে না। শুধু জানে যে রাতের পর রাত জেগে কাটিয়েছে ও শমীক আসার পরে। ছেলেকে ভালো রাখার জন্য, সুস্থ-সবল রাখার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করেছে, কাজের লোকের ভরসায় ছেড়ে দেয় নি। প্রথমদিকে বড় রোগা ছিল ছেলেটা। জ্বরে ভুগত প্রায়ই। সেই সময় সারা রাত তার পাশে জেগে থাকতে থাকতে আবার কান্না পেত অতসীর। কিংশুকের থেকে একটু সাহায্য তো দূরের কথা, কোনো মেন্টাল সাপোর্টও পায় নি সেই সময়। ছেলেপুলে একটু তো ভুগবেই, ওতে নাকি তাদের ইমিউনিটি বাড়ে। ব্যাস, হয়ে গেল। রাত্রে নাক ডাকিয়ে ঘুম, আর সকাল আটটা বাজলেই অফিস যাবার প্রস্তুতি। এবার সারাদিন ধরে অসুস্থ ছেলেকে একা সামলাও তুমি।
ছোটবেলায় অতসীর খুব নেওটা ছিল শমীক। সবসময় পিছন পিছন ঘুরতো। কলকল করে কথা বলতো। সব কিছু কথা ওর মা’কে বলা চাই। একটু বড় হবার পর, শমীককে কখনো দূরে সরে যেতে দেখলেই তাই আতঙ্কে ভুগেছে অতসী। একটা সন্দেহ, একটা ভয় কুরে কুরে খেত অতসীকে — একদিন না একদিন কিংশুক শমীককে বলে দেবে যে ওকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল অতসী। যদিও কিংশুক ওকে কথা দিয়েছে, তবু এক ফোঁটা বিশ্বাস নেই ওর কিংশুককে। অতসীর উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য এমনকি নিজেরও বিরাট ক্ষতি করতে পারে লোকটা।
চাকরি যখন শেষ অবধি জুটলো, শমীক তখন কৈশোরের দোরগোড়ায়, ক্লাস নাইনে পড়ে। লম্বা হয়েছে অনেকটা। হালকা কালো একটা গোঁফের আভা দেখা দিয়েছে ঠোঁট আর নাকের মাঝখানে। স্বরভঙ্গ হয় নি, গলার আওয়াজ এখনো বাঁশির মতন সরু আর মিষ্টি।
স্বপ্নের অফার। এসেছে অতসীর স্কুলের বান্ধবী শিখার মাধ্যমে। একটা নতুন কোচিং ইনস্টিটিউট লোক খুঁজছে অঙ্ক পড়ানোর। অতসী কি ইন্টারেস্টেড? ইন্টারেস্টেড হলে যেন শিখার এক দূর সম্পর্কের দাদার সঙ্গে টেলিফোনে-এ যোগাযোগ করে। ভদ্রলোকের নাম স্মরজিৎ সেনগুপ্ত। আমেরিকা প্রবাসী সফ্টওয়ার ইঞ্জিনিয়ার, এই কোচিং ইনস্টিটিউট তাঁর শুধুমাত্র লাভের জন্য খোলা নয়, ভারতীয় ছাত্রদের অংক আর বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তুলবার জন্য।
অসাধারণ ইন্টারভিউ দিয়েছিল অতসী। প্রত্যেকটা প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পেরেছিল অনায়াসে। শুধু অঙ্কর উত্তর দেওয়া নয়, স্কুলের বাচ্চাদের কোথায় কোথায় অংক বুঝতে অসুবিধে হতে পারে, তাদের সঠিকভাবে বোঝাতে গেলে ঠিক কি কি করা দরকার, এ’সব ব্যাপারে তার মতামত শুনে মৃদু হেসে ঘাড় নেড়েছিল ইন্টারভিউ বোর্ডের সকলে।
ইন্টারভিউ দিতে দিতেই অতসীর মনে হয়েছিল বড়সড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে এই কোম্পানিতে ওর চাকরি বাঁধা। মনে হয়েছিল যে এতদিন ধরে শমীককে অংক শেখানোর সমস্ত চেষ্টা আজ সার্থক হল অন্যভাবে।
মুশকিল একটাই। চাকরিটা দিল্লিতে।
না। কিংশুক কোনো আপত্তি করে নি। খুশি হবার ভান করেছিল। ওই নাটকটুকু না করলেও পারতো, তবে অতসী কিংশুককে আর ওই নিয়ে ঘাঁটায় নি। এর আগেও বার দুয়েক ডিভোর্সের সীমারেখায় চলে গিয়েছিল ওরা দুজনে। বিকেলবেলা শমীক খেলতে বেরিয়ে গেলে চা-এর কাপ হাতে নিয়ে কথা হয়েছিল দুজনের।
— তুমি সামলাতে পারবে তো এদিকের সব?
একটু ক্লান্ত হাসি হেসেছিল কিংশুক।
— না পারার আছেটা কি? এখন শমীক অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। নিজের যা যা দরকার সব নিজেই করতে পারে। ঘরের কাজের জন্য তো কাজের লোকেরা থাকছেই।
— চালাতে পারবে তো ওদের? আমি তো থাকব না, কি যে হাল হবে বাড়ির!
— কি আর হাল হবে? দুনিয়াতে কারুর জন্যই কিছু পড়ে থাকে না।
— আশ্চর্য! একবারও আমাকে তো থাকতে বললে না!
— বললেও কি তুমি শুনতে?
— না, শুনতাম না। তবে সম্পর্কটা যেরকমই থাক, কেউ তোমাকে থাকতে বলছে শুনলে তো ভালো লাগে!
একটু গম্ভীর হল কিংশুক।
— সত্যি কথা বলছি, তিসি। আমার মনে হয় একটু দূরে দূরে থাকলেই হয়তো আমাদের সম্পর্কটা তবু টিঁকে থাকবে।
কিংশুক কি ভাবল না ভাবল তাতে সত্যিই কিছু যেত আসত না অতসীর। কিন্তু এই বাড়িতে একজন অন্তত রয়েছে যার ইচ্ছে-অনিচ্ছার দাম অতসীর কাছে অনেক।
অফিসের কাজ নিয়ে কিংশুক বাইরের ঘরে ব্যস্ত। কাল সকালেই নাকি একটা রিপোর্ট ফাইনাল করতে হবে। আজকাল বসার ঘরের ডিভানেই শোয় কিংশুক।
বড় শোবার ঘরের বিছানায় শুয়ে একটা কমিক্স পড়ছিল শমীক। আর সময় নষ্ট করার মানে হয় না।
— শমী?
কমিক্স থেকে চোখ না তুলেই শমীক বলল, “হ্যাঁ, বলো!”
— তুই তো শুনেছিস আমার চাকরির কথা?
— বাঃ, জানব না কেন? আমার সামনেই তো চিঠিটা খুললে! তারপর লাফ দিলে একটা লেডি ক্যাঙ্গারুর মতন!
— চাকরিটা নিতে গেলে দিল্লি যেতে হবে সেটা বুঝতে পেরেছিস কি?
— অদ্ভুত! আমার সামনেই তো তুমি পড়লে, “Your posting will be in our Delhi office.” এত সহজ ইংরেজির মানে না বোঝার কি আছে?
— তুই কি চাস? আমি নেব চাকরিটা?
কমিক্স থেকে চোখ সরিয়ে উঠে বসে সিধে মায়ের চোখে চোখ রাখল শমীক।
— শোনো মা! এই বাজারে চাকরি অত সোজা নয়। এতদিন পরে একবার যখন সুযোগ পেয়েছো, চলে যাও। এখানে আমি আর বাবা সামলে নেবো।
এত সোজা?
শমীক ঘুমোনোর পর বহুদিন পরে কেন জানি না কান্না আসছিল অতসীর। অতসী চলে যাবে এত দূরে, কই, একটুও তো দুঃখ হল না অতসীর ছেলের?
ঘুমের ঘোরে অতসীর আরও কাছে সরে আসে শমীক। অসম্ভব বিচ্ছিরি শোয়া ছেলেটার। নাভিটাকে কেন্দ্র করে ওর শরীরটা বিছানায় ঘুরতে থাকে সারারাত। ফলে প্রায়ই হাত আর পায়ের গুঁতো সইতে হয় অতসীকে। ভীষণ রেগে যায় অতসী। ওজন বাড়ছে শমীকের, এখন আর ঠেলা মেরেও ওকে সরাতে পারে না।
এখন ঘুমের ঘোরেই ওকে মাথা দিয়ে গুঁতোবার ধান্ধা করছে শমীক।
চোখের জল থামতে চাইছে না আবার। সাবধান না হলে শমীকের মুখে পড়বে ওই জল। তাড়াতাড়ি একটু সরে যায় অতসী।
তুই কক্ষনো আমার থেকে দূরে যাস না, শমী!