"তোরা যাই বলিস, এখানে থাকা পোষাবে না আমার!" ঘোষণা করল অমিতাভ।
"মানিব্যাগ থেকে নতুন নোটগুলো বের করে গন্ধ শুঁকে নে একবার। তারপর আবার বল কথাটা।" -- অমিতাভকে উপদেশ দিল কিংশুক। হো হো করে পাশ থেকে হেসে উঠল অভ্র, বলল, "স্টার্টার হিসেবে চিকেন টিক্কা আসছে আর পাঁচ মিনিট পরে। আগে গেল ওগুলো। তারপরেও যদি মন-টন খারাপ থাকে তাহলে আজকের খাওয়াটা তুইই না হয় স্পনসর কর পুরো।” টেবিলের উপর একটু ঝুঁকে উল্টোদিকে বসা অমিতাভর দিকে বড় বড় চোখ করে চাইল অভ্র, “কতবার বলব তোকে, মন ভালো করার একমাত্র ওষুধ হল কাউকে মোগলাই খানা খাওয়ানো।"
আজ মাইনে পেয়েছে ওরা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম অনুযায়ী কড়কড়ে নতুন নোটে পুরো মাইনে। আর মাইনে হাতে আসা মানেই দিল্লি দরবার, বোম্বের ফোর্ট এরিয়ার খানদানি মোগলাই রেস্টুরেন্ট। একবার খেলে ভোলা যায় না এমন স্বাদ এখানকার কাবাব, টিক্কা আর বিরিয়ানিতে।
আটটা অবধি লেট সিটিং করে অফিস থেকেই সরাসরি চলে এসেছে ওরা এখানে, ওরা মানে অভ্র, অমিতাভ, কিংশুক আর স্নেহাশিস। স্নেহাশিস ওদেরই ব্যাচের স্ট্যাটিসটিক্স ক্যাডারের অফিসার, বান্দ্রা কুর্লা অফিসে পোস্টিং। ওদের সাথে একই কমপ্লেক্সে থাকে স্নেহাশিস। সাধারণত বাইরে খেতে রাজি হয় না স্নেহাশিস। বহু সাধাসাধির পর আজ ওদের সাথে এখানে খেতে আসতে রাজি হয়েছে ও।
অমিতাভর রাগের কারণ আছে। আজ বসের কাছে ঝাড় খেয়েছে অমিতাভ। খুব সামান্য কারণে ঝাড়। এখানে টপ ম্যানেজমেন্টের কাছে পাঠানো অফিস মেমো যায় একধরনের বিশেষ কাগজে, যাকে থিক ব্লু পেপার বলা হয় অফিসে। অমিতাভর দোষ, ও সাধারণ কাগজে ঐ মেমো পাঠিয়েছিল ওর বসের কাছে।
"ঠাট্টা নয়। এত ব্যুরোক্রেসি এখানে, বাপ রে বাপ। দম বন্ধ হয়ে যাবে যে কোনো সুস্থ লোকের। দশটা আলাদা জায়গার জন্য দশ রকমের আলাদা আলাদা পেপার। দশজন আলাদা আলাদা rank-এর লোকের জন্য দশ রকমের টেবিল, চেয়ার আর ফ্ল্যাট। মিটিঙে কে কার পাশে বসবে তার হিসেবে করতে করতে একটা পুরো দিন, আর সেসব হিসেব মনে রাখতে না পারলে উদ্দুম গালাগালি। বলছি তো, এখানে পোষাবে না আমার। কড়কড়ে টাকা দিয়ে করবি টা কি শুনি? টাকার পিরামিড বানাবি? কিছু কিনলেই তো বেরিয়ে যাবে সব হাত থেকে!"
"আরে চটছিস কেন? গালাগালি খাওয়াটা পার্ট অফ লাইফ। ইনডাকশন ট্রেনিঙে শুনিস নি, ভিতরে গণ্ডারের চামড়া না থাকলে ভালো ম্যানেজার হওয়া যায় না!", অভ্র হাসতে হাসতে বলল অমিতাভকে।
-- তোদের হতে হয়, তোরা হ। খালি চামড়া না, এই বলে রাখলাম তোদের, এখানে আর কিছুদিন থাকলে দেখবি মাথায় মনুমেন্টের সাইজের শিঙও গজাবে।
অপমানটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না অমিতাভ। সকলের সামনে বলে আরও বেশি আঁতে লেগেছে ওর।
-- ইচ্ছে করে ফাঁসালো, জানিস, ঐ গায়কোয়াড়টা!
"কোন গায়কোয়াড়, লম্বু না মোটু?", জিজ্ঞাসা করল কিংশুক।
-- মোটু। এমনি এমনি শালা ওদের ঘসেটি বলে সিনিয়র অফিসাররা। নিজেরা বিশ বছর ঘষে ঘষে ক্লার্ক থেকে অফিসার হয়েছে বলে আমাদের মতন অল্পবয়সী ডিরেক্ট রিক্রুটদের উপর খার আছে ওদের। মেমোটা পাঠানোর আগে দেখিয়েছিলাম ওকে, জানিস! জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "কেয়া গায়কোয়াড় সাব, ঠিক হ্যায় তো সবকুছ?" এমন বদমাস তখন বলল না কিছু ইচ্ছে করে।
“মোটু গায়কোয়াড় একটা জিনিস মাইরি! আমাকে দেখলেই তেড়ে বাংলা বলতে আসে, “বাবুমোসাই, হামি তোমাকে বালোবাসি!”, আমি তো প্রথমে মালটাকে হোমো ভেবেছিলাম!” অভ্র হাসতে হাসতে বললো, “সেদিন কি হলো জানিস? একটা লোক ওর কাছে ফ্লোরা ফাউন্টেনের কাছে কোনো একটা দোকানের ডিরেকশন জানতে এসেছিল। মালটাকে ও এমন ঘেঁটে দিল যে আমি তো হাঁ। লোকটা ঘোল হয়ে চলে যাবার পরও ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম আমি, তখন আমায় বললো, ‘বাবুমোসাই, আপনে সমঝা ম্যায় কিঁউ অ্যায়সা কিয়া?’ আমি বোকার মতন ঘাড় নাড়লাম। তখন বললো, “উও হামারা আপনা আদমি নেহি হ্যায়!’ আমি না তখনও বুঝি নি ঠিক কি বলতে চাইছে মোটু, তখন ও নিজের থেকেই ফিসফিস করে আমাকে বললো, “আরে বাবুমোসাই! মুসলমান হ্যায় উও!” আমি তো হাঁ। আমার মাথায় আসছিলো যে বলি, “গায়কোয়াড় সব, আপ মারাঠি হ্যায়, ম্যায় বঙ্গালী হুঁ, কিঁউ ম্যায় আপকা আপনা আদমি হুঁ ইয়া নাহি?’
পাশের থেকে স্নেহাশিস বললো, “উত্তরটা কি হতে পারে সেটা কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছে!”
অভ্র আবার প্রশ্ন করলো অমিতাভকে, “পরে ঝাড়লি না কেন ওকে?”
-- ন্যাকা সাজলো। বলল "ম্যায়নে শোচা উও অফিস কপি হ্যায়।" আর কি বলব বল? সিনিয়র অফিসার হিসেবে আমারই প্রোটোকলগুলো জানা উচিত।
-- এখন তো জানলি। ওরকম একটা দুটো ভুল সবার হয়।
-- হয়, তবে এত অপমানিত হয় না সবাই। না, না, এই বলে রাখলাম তোদের, এখানে পোষাবে না আমার।
-- যাবিটা কোন চুলোয় শুনি? কটা বড় শ্বশুর আছে তোর যে ডেকে ডেকে চাকরি দেবে তোকে?
-- চাকরি নেব কেন? পিএইচ ডি করতে যাব আমেরিকায়। আমার যা মার্ক্স তাতে এমনিতে হয়তো হত না, কিন্তু এক দু বছরের সেন্ট্রাল ব্যাংকিং এক্সপিরিয়েন্স থাকলে সেটা ওরা হয়তো আলাদা করে কনসিডার করবে। তোরাও অ্যাপ্লাই করা শুরু কর, নইলে ছুঁচোর কামড় খাবি দিনরাত।
সেদিন ট্রেনে ফিরতে ফিরতে অমিতাভর কথাগুলো ভাবছিল কিংশুক।
রাত এগারোটা বেজে গেছে। ট্রেন বেশ ফাঁকা এখন। দাদারের আগে লোক বিশেষ উঠবে না।ফাস্ট ট্রেন এটা। সব স্টেশনে থামবে না। জোরতালে চলেছে বলে হু হু করে হাওয়া আসছে জানলা দিয়ে।
জানলার ধার বরাবর মুখোমুখি চারটে সিটে বসে ওরা। জানলার ধারে কিংশুক। ওর পাশে অমিতাভ। উল্টোদিকের জানলায় স্নেহাশিস অভ্রকে পাশে নিয়ে বসে।
কেউই কথা বলছিল না বিশেষ। জানলার ধারে বসলে কিংশুকের পুরো নজরটা বাইরের দিকে থাকে। তাই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল ও।
অমিতাভ যা বলছে সেটা কি ঠিক? কিংশুকের অভিজ্ঞতা ঠিক মিলছে না অমিতাভর সাথে। ওদের ডিপার্টমেন্টের হেড গোস্বামী সাহেবকে ওর একেবারে মাটির মানুষ মনে হয়েছে। কিংশুককে এরই মধ্যে একাধিকবার আলাদা করে ডেকে পাঠিয়েছেন গোস্বামী সাহেব, হাতে কাজও ধরিয়ে দিয়েছেন কিছু। এই নিয়ে অবশ্য অফিসে কথা উঠছে প্রচুর। ধাপ ডিঙিয়ে বড় বসের সাথে সরাসরি কাজ করাটাকে ভালো নজরে নিচ্ছে না কেউ। কিন্তু এই নিয়ে কি করার আছে কিংশুকের? ও তো আর গোস্বামী সাহেবকে বারণ করতে পারে না ওকে ডাকতে।
অমিতাভ বলছে ওকে বাইরে অ্যাপ্লাই করতে। প্রস্তাব হিসেবে এটা হয়তো মন্দ নয়, তবে ভীষণ খাটুনি এতে। জি আর ই আর টয়েফেল পরীক্ষায় বসতে হবে, তার প্রিপারেশন রয়েছে। সেসব হয়ে গেলেও অফিস টাইমের পর অন্তত দুটি ঘন্টা রোজ দিতে হবে চিঠিপত্তর আর বিভিন্ন ফর্ম ফিল আপ করতে। অফিসটাইমে ম্যানেজ করে সেগুলো পোস্ট করতে হবে। ঠিক কি নিয়ে ও গবেষণা করবে সে সব ভেবে একটা স্টেটমেন্ট অফ পারপাজ লিখতে হবে খুব যত্ন করে। রেকমেন্ডেশনের অনুরোধ করতে হবে পুরোনো মাস্টারমশাইদের। এত কিছুর পরে ভালো স্কলারশিপ সমেত অফার না এলে পুরো পরিশ্রমটাই মাটি।
আর অফার এলে? নিশ্চিন্তির চাকরি ছেড়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোনো। ডক্টরেট করেও রেহাই নেই। বছরের পর বছর পোস্ট ডক করা এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে যদি কোনো এক সময়ে বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে।
পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা যাওয়ায় এরই মধ্যে বিতৃষ্ণা ধরে যাচ্ছে কিংশুকের। এই এক বছরের মধ্যেই চার চারবার লোটাকম্বল নিয়ে বাসা বদলাতে হয়েছে ওকে।
প্রথমে কান্দিভালি-র ভাগের ফ্ল্যাট থেকে আন্ধেরির ছোট ঘুপচি ট্র্যানসিট ফ্ল্যাটে যাওয়া। একার ফ্ল্যাট এটা। একটা বেডরুম আর একটা ছোট্ট হল -- রান্নাঘর, বাথরুম ইত্যাদি বাদ দিয়ে। একটা খুব ছোট ব্যালকনিও রয়েছে এই ফ্ল্যাটে। দিনের বেলা অন্ধকার জিনিসটা একদম ভালো লাগে না কিংশুকের। মনে মনে নিজেকে তাই সান্ত্বনা দিয়েছে যে বোম্বাইয়ের মতন শহরে এইটুকু জায়গাই বা কজনের ভাগ্যে জোটে। আর তাছাড়া এখানে তো আর বেশিদিন থাকতে হবে না।
সিনিয়রদের কাছ থেকে শুনে আগে থেকেই ওরা জানত যে অন্তত দু থেকে তিন খেপ বাসা বদল আসছে সামনে। ইচ্ছে করেই সে জন্য বেশি ফার্নিচার কেনে নি ওরা কেউ। জিনিসপত্তর কিছু ছিল না বলে অনেক সহজ ছিল কান্দিভালি থেকে সব গুটিয়ে আন্ধেরিতে এই বাসা বদল।
সেখান থেকে দীর্ঘ ইন্ডাকশন ট্রেনিং এর জন্য আবার সুটকেস গুছিয়ে মাদ্রাজ স্টাফ কলেজ। ফিরে এসে অল্প কিছুদিন পরে আবার বাসা বদল, এবার গোরেগাঁওএর গোকূলধামের অফিসার্স কোয়ার্টার। এত তাড়াতাড়ি এই ফ্ল্যাট পাবার কথা ছিল না ওদের। একটা বড় সেট অফ ট্র্যানসফারের জন্য এবার এই ফ্ল্যাট জুটে যায় ওদের ব্যাচের সকলের।
আমেরিকা যাওয়া মানে আবার বেশ কয়েক রাউন্ড বাসা বদল। এবার বিদেশে, আরো অনেক দূরে। আর এবার হয়তো পুরো একা। অভ্র আর অমিতাভর মতন কোনো বন্ধু থাকবে না এবার।
স্নেহাশিস কিছু একটা বলছে।
ঘাড় ঘোরাল কিংশুক, "কিছু বলছিস?"
খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসল অভ্র। যোগ দিলো অমিতাভ আর স্নেহাশিস।
"কোন জগতে ছিলি?" জানতে চাইল অভ্র।
স্নেহাশিস বলল, "আমি বলছিলাম, অমিতাভ কিন্তু ঠিকই ভেবেছে। আমিও ভাবছি বাইরে অ্যাপ্লাই করবো, তবে এক্ষুনি নয়। আরো এক বছর পরে। এই একটা বছর ভাইয়ের পড়াশুনোর খরচটা যোগাতে হবে আমাকে। ও পাস করে চাকরিতে ঢুকলে আর আমার কোনো বাধা নেই।"
আই এস আইয়ে পড়াশুনো স্নেহাশিসের। স্ট্যাটিস্টিক্সে মাস্টার্স ওর। ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে একা নিজের চেষ্টায় উঠে আসা। বাবা গরীব দিনমজুর। পড়তে পড়তে ভাইয়ের পড়ার খরচ যুগিয়ে গেছে স্নেহাশিস, দুই বোনের বিয়েতে বাবার যত ধার হয়েছিল সেই সব ধার শোধ করে দিয়েছে টিউশনি করে। সব ধরনের রান্না জানে ও। গোকুলধামের ফ্ল্যাটে ওরা চারজন এখন একসাথে রান্না করে খায় একমাত্র স্নেহাশিসের ভরসায়। কিংশুকদের হাতে ধরে রান্না শিখিয়েছে এই স্নেহাশিস।
ওদের দিকে চেয়ে এবার কিংশুকের মনের কথাটা বলল স্নেহাশিস। "ভয়ানক পরিশ্রমের কাজ এই বাইরে অ্যাপ্লাই করাটা। দেখেছি তো আই এস আইয়ে অনেককে। ভাগ্গিস আমাকে তখন ওসব করতে হয় নি। করতে হলে খাল হয়ে যেতো।"
খাল হয়ে যাওয়াটা নাকি আই এস আইয়ের জনপ্রিয় একটা লব্জ। সকাল বিকেল খাল হচ্ছে স্নেহাশিস। দিনের মধ্যে অন্তত বার দশেক ওর মুখে এই খাল হবার ব্যাপারটা আসবেই।
না, অ্যাপ্লাই করে আর খাল হতে চায় না কিংশুক। এর চেয়ে অ্যাপ্লাই না করে খাল হওয়া বরং ভালো। তাতে অতিরিক্ত এই পরিশ্রমটুকু অন্তত করতে হবে না।
সেদিন থেকে কেমন যেন পাল্টে গেল অমিতাভ। নাকি, আগেও এরকমই ছিল, খালি উপরে একটা হাসিঠাট্টার পর্দা রাখা থাকত বলে ওর আসল রূপটা নজরে আসত না।
অফিসের পর সারাটা সময় জিআরই আর টয়েফল পরীক্ষার প্রিপারেশনের পিছনে ঢালবে অমিতাভ, অথবা গুচ্ছের ফর্ম ফিল আপ করবে বসে।
ওদের চারজনের মেসে কেউ একজন এরকম করলে বাকি তিনজনের উপর পুরো কাজের চাপ-টা এসে পড়ে।
অসম্ভব ভদ্র ছেলে স্নেহাশিস। কিন্তু বুদ্ধি রাখে, অমিতাভ যে ফাঁকি দিচ্ছে সেটা ওর নজরে পড়লেও তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করে নি কখনো। কিংশুক আর অভ্রর দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হেসেছে শুধু, যেন তোমাদের পুরোনো বন্ধু, তোমরাই সামলাও।
রান্নাবান্না হয় স্নেহাশিসের ফ্ল্যাটে। রান্নার কাজটা সাধারণত স্নেহাশিস নিজে করে, যোগান দেয় বাকি তিনজনের মধ্যে একজন। বাকি দুজন খাবার পর বাসনগুলো মাজে আর রান্নার জায়গাটা সাফ করে। কেউ যদি কোনোদিন যোগান না দেয়, তাহলে এটা কি আশা করা অন্যায় যে সে বাসনগুলো মাজার কাজে অন্তত হাত লাগাবে? অথচ খাবার পর ঠিক কোনো না কোনো অজুহাতে অমিতাভ নিজের ফ্ল্যাটে পালাবে। তারপর আর ওর দেখা মিলবে না।
অমিতাভর স্বার্থপরতা নিয়ে এর আগে অবশ্য একটা সন্দেহ হয়েছিল কিংশুকের। কলেজে থাকতে কেবিজির অফিসে একবার দেখা করতে গিয়ে এবার পরীক্ষাতে কি প্রশ্ন আসতে চলেছে বুঝে ফেলেছিল কিংশুক। বলা বাহুল্য, নিজে জানার পর অন্যদেরও সেটা জানিয়ে দিতে ভোলে নি। কিন্তু এরকম কোনো সাহায্য কখনো অমিতাভর কাছ থেকে ও পায় নি, অথচ অমিতাভ প্রায়ই বিভিন্ন স্যারেদের পটাতে যেতো। শেষদিকে তাই একটা ক্ষীণ সন্দেহ হয়েছিল কিংশুকের, তবে এই নিয়ে আর কাউকে কিছু বলে নি কিংশুক।
সেদিনও রাত্রে অমিতাভ নিজের ফ্ল্যাট থেকে ঘুরে আসার নাম করে বেরোতে যাচ্ছে, কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল অভ্রর।
-- দ্যাখ অমিতাভ, আমাদের কি পাঁঠা ঠাউরেছিস? নিজের কোটার কাজ যদি না করিস, তো বের হয়ে যা মেস থেকে। রোজ রোজ তোর এঁটো বাসন আমরা মাজব কেন রে?
কোথায় লজ্জা পাবে তা নয়, রেগে তেড়ে এল অমিতাভ, “বের করে দিবি আমায়? তুই একা বের করার কে রে? আর সবাই যদি করেও, ভেবেছিস পথে বসবো! ভারী তো এক তরকারি-ভাত দিয়ে খাওয়া! ও আমি নিজেই করে নিতে পারি!”
-- তবে তাই কর গে। তোর বেগার খাটার জন্য জন্ম হয় নি আমাদের।
জেদ নাকি নির্লজ্জতা? শেষ পর্যন্ত সেই বাসন মাজল না অমিতাভ।
পরের দিন চার্চগেট স্টেশনে তিনজনের বদলে দুজন। কিংশুক আর অভ্র সেদিন অমিতাভর জন্য আর অপেক্ষা করে নি। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের কফির দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে কফি খেতে খেতে ওরা লক্ষ্য করল, অমিতাভ আসছে। মুখে এক গাল হাসি। যেন কোনোকিছুই হয় নি ওদের মধ্যে।
-- রচেস্টারে পেয়ে গেছি, বস। চোদ্দ হাজার দিচ্ছে। বাড়ি চল, আজ বাইরে খাবো, সব খরচা আমার।
রাগের চোটে প্রথমে না বলতে যাচ্ছিল কিংশুক। পরে মনে হল অমিতাভকে রেহাই দেবার কোনো মানে হয় না। খাবে তো বটেই, নির্লজ্জের মতন হামিয়ে খাবে। দরকার পড়লে ফিরে এসে বমি করবে পঁচিশবার।
পরের দিন অমিতাভ ওর এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেল।
তারপর কিছুদিন ছুটি নিয়ে কলকাতা চলে গেল। ফিরে এল নিজের মা, বাবা আর বোনকে নিয়ে। পুরো একমাস এখানে থাকবেন তাঁরা এখন। তারপর আবার অমিতাভ কলকাতা যাবে কয়েকদিনের জন্য ওদের সাথে। তারপর সেখান থেকে দু দিনের জন্য বোম্বে ফিরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমেরিকা চলে যাবে সোজা।
যতই স্বার্থপর হোক কেউ, ঝগড়া জিইয়ে রাখার মানে হয় না, বিশেষ করে কেউ যখন চলে যাচ্ছে।
অমিতাভকে আমেরিকার ফ্লাইটে তুলে দিতে এয়ারপোর্ট গেছিল ওরা। শেষ রাতের ফ্লাইট। রাত এগারোটায় অমিতাভ এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢুকে যাবার পর অটোরিকশা ধরল ওরা তিনজন।
কিংশুক মাঝখানে, ওর একপাশে অভ্র আর অন্যপাশে স্নেহাশিস।
অটোয় উঠতে উঠতে স্নেহাশিস বলল, “আমার তো মনে হয় ঠিক ডিসিশন-ই নিয়েছে অমিতাভ। দেখবি, শেষ পর্যন্ত ভালোই হবে ওর।”
“অমিতাভর কি হবে জানি না, তবে ভালো হবে আমাদেরও।”, অন্য পাশ থেকে মুখ বেঁকিয়ে বলল অভ্র, “একজনের বাসন কম মাজতে হবে আমাদের এখন থেকে!”
অমিতাভর বছরখানেক পরে বিদায় নিলো স্নেহাশিস।
যাবার দিন ভোম মেরে বসেছিল স্নেহাশিস। কিংশুকের ফ্ল্যাট থেকেই রওনা দেবে স্নেহাশিস। দুটো বড় স্যুটকেস আর একটা স্কাইব্যাগ গোছানো অবস্থায় পরে আছে মেঝেতে। কোথায় হাসিমুখে থাকবে এখন তা নয়, এমন একটা মুখ করে রয়েছে স্নেহাশিস যে দেখে বুঝবার উপায় নেই আমেরিকা যাচ্ছে নাকি ফাঁসিকাঠে চড়তে।
কিংশুক হাসতে হাসতে ওকে জিজ্ঞাসা করল, “কি রে নার্ভাস লাগছে নাকি এতক্ষণ প্লেনে থাকতে হবে বলে?”
প্লেনে চড়াতে ভীষণ ভয় স্নেহাশিসের। মাদ্রাজে ইন্ডাকশন ট্রেনিঙে যাবার সময় সারাটা পথ কাঠ হয়ে বসেছিল ও। মাদ্রাজ পৌঁছানোর পর সেজন্য এই নিয়ে খুব হাসাহাসি করেছিল ওরা।
মজা এই যে মাদ্রাজ ট্রিপে ওদের মধ্যে প্লেনে চড়া নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভুগল স্নেহাশিস। যাবার সময় আর আসার সময়, দুবার-ই কানে হাওয়া ঢুকে গিয়েছিল ওর। অনেক কষ্টে অভ্রর শেখানো টেকনিক ব্যবহার করে কান থেকে হাওয়াটা বের করে দিতে পেরেছিল ও।
কিংশুকের প্রশ্ন শুনে একটু বোকা বোকা হাসল স্নেহাশিস, “না, না, নার্ভাস লাগবে কেন?”
-- তাহলে অমন মুখ ভেটকে পড়ে আছিস কেন? কাম অন, চিয়ার আপ!
-- ভাবছি, এত দূরে এই আমেরিকা, কে জানে ফিরে আসতে পারব কিনা!
-- এখন থেকেই ফিরে আসা নিয়ে ভাবছিস কেন? আগে গিয়ে সেটল তো হ ওখানে!
-- জানিস, আমার বাবা চায় নি যে আমি আমেরিকা যাই। খুব জেদ ধরেছিল, যেন না যাই।
-- কেন? চাকরি ছেড়ে দিচ্ছিস তাতে আপত্তি?
-- না, আমেরিকা ক্যাপিটালিস্টদের দেশ । শত্রুর দেশ। বাবা চায় না আমি ওদের দেশে যাই!
-- কি অদ্ভুত, তুই তো আর ক্যাপিটালিস্ট হতে যাচ্ছিস না, যাচ্ছিস লেখাপড়া করতে। সেটা তো ভালো ব্যাপার। এতে আপত্তি হবে কেন?
-- আমিও তো তাই বোঝালাম। তখন আমার দিকে কিরকম অদ্ভুত চোখে চেয়ে বলল, “ফিরবি তো? ফিরতে পারবি তো? বল, কথা দে আমায় ” আমার কি রকম যেন একটা লাগল। বাবাকে ভীষণ শক্তপোক্ত দেখেছি ছেলেবেলা থেকে। এখন দেখে মনে হল ভেঙে পড়েছে একেবারে। মাথা নিচু করে কথা দিয়ে ফেললাম বাবাকে।
-- বয়েস হলে মা-বাবারা অনেক সময় ওরকম করে। বেশি ভাবিস না এখন ও নিয়ে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্নেহাশিস, “সে কি আর জানি না, বস! চেষ্টা তো করছি। পারছি কই?”
সুটকেস দুটোকে খাড়া করতে করতে স্নেহাশিস বলল, “উপায় নেই, ফিরে আসতেই হবে আমায়। আমার কাজটা অনেক বেশি শক্ত হয়ে গেল আরও”
একটু থেমে দরজার দিকে এগোতে এগোতে স্নেহাশিস বলল, “আমেরিকা যাওয়া যত শক্ত, আমেরিকা থেকে ফেরাটা আরও অনেক বেশি শক্ত। আমি আই এস আইয়ের ছাত্র বলে বলছি না, স্টাটিস্টিক্সে ভারতে একমাত্র ভদ্র-সভ্য জায়গা হল আই এস আই। প্রচুর কম্পিটিশন আই এস আইয়ে ফ্যাকাল্টি হয়ে ঢোকার। তাই ভাবছি, আমার কাজটা অন্য সবার থেকে শক্ত হয়ে গেল আরও অনেক!”
শেষ পর্যন্ত ফিরতে পারল না স্নেহাশিস।
দু বছর বাদে দিল্লি আই এস আই এসেছিল স্নেহাশিস একটা কনফারেন্সে। কনফারেন্স শেষ করে দেশের বাড়ি যাবার কথা ছিল মেদিনীপুরে।
বাড়ি যাবার আগের দিন রাতে একদম হঠাৎ করে সেরিব্রাল অ্যাটাক হয় ওর। পরের দিন সকালে যখন গেস্ট হাউসের দরজা ভাঙা হয় তখন সব শেষ।
খবরটা কিংশুককে দিয়েছিল অভ্র। বলেছিল ওর এক আই এস আইয়ের বন্ধু ওকে জানিয়েছে যে ডাক্তার নাকি বলেছে যে ক্রমাগত না ঘুমিয়ে খুব বেশি পরিশ্রম করে গেলে অনেক সময় অল্পবয়সে এরকম হয়।
অমিতাভর যাওয়াটা ছিল প্রায় রেহাই পাওয়া।
স্নেহাশিসের ব্যাপারটা আবার অন্যরকম। ওর সাথে কিংশুকের পরিচয় অল্প দিনের জন্য। আলাদা অফিসে কাজ করত স্নেহাশিস। ওর সাথে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হত শুধু রাতে রান্না করার সময়টাতে। বন্ধু হিসেবে পাবার মতন আদর্শ ছেলে স্নেহাশিস। কিন্তু ভীষণ শ্রদ্ধা করলেও ওর সাথে সেই ঘনিষ্ঠতা কিংশুকের হয় নি, যতটা ছিল অভ্রর সাথে।
অভ্রর চলে যাওয়াটা তাই কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি কিংশুক।
দুজনেই বেশ কিছুটা সিনিয়র হয়ে পড়েছে তখন। একটা করে প্রমোশন হয়েছে অফিসে, বিয়ে করেছে, বাচ্চা হয়েছে দুজনেরই।
রোজ দুপুরবেলা লাঞ্চের পরে অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে মিনিট পনের গল্পগুজব করত ওরা, আরও কয়েকজনের সাথে। অনেক সময় একটুখানি হেঁটেও আসত ওরা রাস্তা ধরে, কখনো শুধু দুজনে কখনো বা অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে।
ততদিনে গোকুলধাম থেকে বান্দ্রা-কুর্লা কমপ্লেক্সে চলে এসেছে ওরা, মোটামুটি এক সময়েই। একই কমপ্লেক্সে থাকার ফলে অফিসের বাইরে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ, পরিবার সমেত এ ওর বাড়িতে যাওয়া-আসা তো ছিলই।
সেই অভ্র যে এমন একটা কাণ্ড ঘটাবে কে বুঝতে পেরেছিল?
মেয়েকে সাবধানে সোফার উপর বসিয়ে কোনো ভূমিকা না করে বলেছিল অভ্র, “শোন, একটা ভালো খবর দিচ্ছি তোকে। এখনই আর কাউকে বলিস না। কলকাতা আই আই এম থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের অফার পেয়েছি আমি।”
-- বলছিস কি? কবে পেলি?
-- আজকে। এই একটু আগে অফিস থেকে ফিরে চিঠি পেলাম।
-- তার মানে কলকাতা ফিরে যাবি? এ তো তোর পক্ষে অসাধারণ ভালো খবর রে।
অভ্রদের বাড়ি আবার বেহালাতেই। সেখান থেকে আই আই এম কলকাতা প্রায় এক ঢিলের দূরত্ব।
-- সত্যি বলছি, ভালো লাগছিল না আর। হাঁপিয়ে উঠছিলাম। তোকে তো আগেও বলেছি যে আমার পি এইচ ডি করাও এই জন্য, যাতে এখান থেকে বেরোতে পারি। পরের প্রমোশন আমাদের যে কবে হবে, আদৌ হবে কিনা সেটা ভগবানও জানে না!
কথা বলতে বলতে একটু থামল অভ্র। একদৃষ্টে ওর দিকে চেয়েছিল কিংশুক। খবরটা হজম করতে সময় লাগছে ওর। কিংশুক কিছু বলছে না দেখে আবার শুরু করল অভ্র, “ পি এইচ ডি শেষ করার পর থেকেই সুযোগ খুঁজছিলাম। এবার অরূপদার সাথে কাজ করার সুযোগ যখন মিললো, একদিন কথাটা পেড়েই ফেললাম ওনার কাছে।”
অরূপদা, অর্থাৎ প্রফেসর অরূপ সামন্ত। সম্প্রতি আর বি আইয়ের ডেভলপমেন্ট রিসার্চ গ্রূপের প্রজেক্টে কলকাতা আই আই এম থেকে নিয়মিত ওদের অফিসে আসছিলেন প্রফেসর সামন্ত। অভ্রদের ইউনিটের সাথেই ওনার কাজ ছিল।
এরকম অনেকেই আসে বাইরে থেকে ওদের কাছে। যখন আসে তখন অনেকটা সময় তাদের সাথে বসতে হয় ওদের, যদি অবশ্য কাজটা ওদের নিজেদের ইউনিটকে দেওয়া হয়। প্রফেসর সামন্তর সাথে দীর্ঘ সময় ধরে অভ্রকে কাজ করতে দেখে সেজন্য আলাদা কোনো সন্দেহ হয় নি কিংশুকের।
-- আরে তোকে তো কংগ্রাচুলেটই করা হয় নি আগে। এর চেয়ে ভালো খবর কিছু হতে পারে না তোদের কাছে। সেমিনার কবে দিলি, সেই যে একমাস আগে কলকাতা গিয়েছিলি তখন?
সম্মতি জানিয়ে ঘাড় নাড়ল অভ্র।
“কবে নাগাদ কলকাতা যাবার কথা ভাবছিস তোরা?” কিংশুক জিজ্ঞাসা করল।
-- মিনিমাম তিন মাস নোটিস পিরিয়ড তো দিতেই হবে। কাল লি এন নেবার অ্যাপ্লিকেশন করবো। অ্যাপ্রুভ হতে হতে তিন সপ্তাহ। ধরে রাখ মাস চারেক পরে।
বলতে বলতে আবার থামল অভ্র। একমুখ হাসি নিয়ে অতসী ঘরে ঢুকেছে চা আর বিস্কুট নিয়ে, “কংগ্রাচুলেশন্স! আমি শুধু ভাবছি কি মজা তোমাদের। খুব হিংসে হচ্ছে কলকাতা ফিরবে বলে! বনি খুব খুশি নিশ্চয়ই!”
বনি মানে নন্দিনী, অভ্রর স্ত্রী। এখানে কুর্লার দিকে কাছাকাছি একটা স্কুলে পড়ায় বনি।
মেয়েলি যে প্রশ্নটা কিংশুকেরও মাথায় এসেছিল, কিংশুককে রেহাই দিয়ে অতসীই সেটা আগে করল, “বনি কি করবে? চাকরি ছেড়ে দেবে?”
-- ও যে রকম চাকরি করে সেটা কলকাতাতেও জুটিয়ে নেওয়া সম্ভব।
অভ্ররা বেশ বড়লোক। বহুদিন কলকাতা থাকার জন্য প্রচুর চেনাজানা।
“বাঃ, তাহলে তো কথাই নেই! এই নাও, তোমার তো আবার লেবু চা!” বলে অভ্রর দিকে ওর কাপ এগিয়ে দিলো অতসী।
“তোমারটা ওই কলকাতার চা-টা দিয়েই করেছি।” অতসী কিংশুকের দিকে তাকিয়ে বলল।
হাসল অভ্র। বলল, “একই রকম করলেই পারতে!”
তারপর কিংশুকের দিকে চেয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, “দ্যাখ, আবার তোকে বলছি, পি এইচ ডি-টা করে ফেল। তারপর তুইও ভাগ এখান থেকে। এখানে আমাদের মতন ফ্যাতাড়ুদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই!”
অভ্রর কথাগুলো এক মনে শুনছিল অতসী।
অভ্র আবার যেন বাচ্ছা ছেলেকে বোঝাচ্ছে এমনভাবে বলল, “শমীক এখনো ছোটো। ও স্কুলে ঢোকার পর কিন্তু তোর পক্ষে অন্য কোথাও গিয়ে নতুন করে সেটল করা শক্ত হয়ে উঠবে আরও।”
চুপ করে রইল কিংশুক। জানা কথা অভ্রর আই আই এম কলকাতায় পাওয়াটাকে এই ভাবেই নেবে অতসী। এখন ওর মেজাজ চড়বে, চড়তেই থাকবে। এখন কিংশুক কিছু যদি বলতে যায়, তাহলে অজস্র অপমানের বন্যা নামবে ওর উপর।
ফ্ল্যাটবাড়িতে গোঁসাঘর বলে কিছু থাকে না।
রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল আবার অতসী। কিছুক্ষণ পরে পরেই দুম দুম ঝন ঝন করে সব বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ আসতে লাগল রান্নাঘর থেকে।
মীনাক্ষীর সাথে ঝগড়া হয়েছে ওর বয়ফ্রেন্ড সেন্থিলের।
কিছুদিন ধরেই মনে এরকম একটা সন্দেহ দানা বাঁধছিল অতসীর, মীনা যেন ঠিক আগের মতন নেই। দিল্লিতে আসার পর ওর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মীনার মতন একটা মেয়েকে বন্ধু হিসেবে পাওয়া। বয়সে ওর চেয়ে অনেকটাই ছোট মীনা, শৈশবের সরলতার রেশটা পুরোপুরি এখনো কাটে নি ওর মধ্যে, এখনো দুটো বিনুনি বাঁধে মাথায়। চুল খুব ঘন বলে দিব্যি মানিয়েও যায় ওকে। মীনাকে অনেকটা নিজের না হওয়া ছোট বোনের মতন দেখে অতসী। ওকে কষ্ট পেতে দেখলে খারাপ লাগে খুব।
সেন্থিলকে মীনা ক্রমাগত চাপ দিচ্ছিল বিয়ের জন্য। দেখতে দেখতে প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল দিল্লি এসেছে মীনাক্ষী। আর কত অপেক্ষা করবে ও? তবু এখনই বিয়ে করতে রাজি নয় সেন্থিল। সেন্থিলের বক্তব্য এখন বিয়ে করলেই ওর বাড়ির লোক দিল্লি এসে নানা ধরনের চাপ দেওয়া শুরু করবে। আর অল্প কিছুদিনের মধ্যে বিদেশে পোস্টিং হবে ওর। বিদেশে যাবার ঠিক আগে বিয়েটা সেরে নেবে ওরা, যাতে বিয়ের পরে পরেই বাইরে চলে যেতে পারে। তারপর যখন ফিরে আসবে ততদিনে বিয়েটা পুরোনো হয়ে যাবে, দুই পরিবারেরই তখন বিয়েটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
সেন্থিলের এই যুক্তি মানতে রাজি নয় মীনাক্ষী। সেন্থিল খালি নিজের দিকটা দেখছে, ওর দিকটা দেখছে না একেবারেই। কেন বুঝতে পারছে না সেন্থিল যে একা একা এইভাবে দিল্লি থাকার জন্য মীনাক্ষীর উপরও ক্রমাগত চাপ আসছে তামিলনাড়ু ফিরে যেতে। উপরি রয়েছে বিয়ের চাপ। একের পর এক সম্বন্ধে আনছে মা-বাবা আর একের পর এক সেগুলো নাকচ করে দিচ্ছে মীনাক্ষী। এভাবে কতদিন চলবে? সন্দেহ দানা বাঁধছে ওর মনে, সেন্থিল স্রেফ খেলাচ্ছে না তো ওকে?
দিল্লি এসে যে এইভাবে অ্যাগনি আন্টের ভূমিকা নিতে হবে সেটা আগে কখনো ভাবে নি অতসী। মীনাক্ষীর সমস্যাটা বুঝতে পারছে অতসী। কয়েকবার মীনাক্ষীর সাথে সেন্থিলকেও দেখেছে ও। ছেলেটাকে দেখে মোটেই সুবিধের মনে হয় নি অতসীর। বেঁটে, কালো, খোঁচা-খোঁচা ভুরু আর উঁচু দাঁত। বাঁ দিকে গলার নিচের দিকে, একটা বড় আঁচিল আছে ছেলেটার। মীনাক্ষীর মতন রীতিমতন সুন্দরী মেয়ে কি দেখে যে ঐরকম একটা ছেলেকে পছন্দ করল কে জানে। আরও আশ্চর্য, চেহারা ওরকম হলে কি হবে, ঐটুকু অল্প সময়ের মধ্যেই ছেলেটাকে বেশ ডমিনেটিং বলে মনে হয়েছে ওর। একটা মোটামুটি ভালো চাকরি করছে বলে যেন সেই অহংকারে গোটা দুনিয়া কিনে নিয়েছে। মীনাক্ষী যে শুধু ওর জন্য নিজের মা-বাবাকে ছেড়ে এতদূর এসেছে সেজন্য কৃতজ্ঞতা তো দূরের কথা, ওকে প্রতি কথায় বুঝিয়ে দিতে চায় যে ওর নিজের চাকরি মীনাক্ষীরটার তুলনায় কত বেশি ভালো। বিয়ে হলে মীনাক্ষীর ঘাড় ধরে ওই ছেলে নিজের যা যা দরকার সব আদায় করে নেবে। এই সহজ ব্যাপারটা মীনা কেন যে বুঝতে পারছে না কে জানে?
সমস্যা এই যে এই সব নিয়ে বেশি ভাবতে গেলে নিজের কথা মনে পড়বে অবধারিতভাবে। মীনাক্ষীর মতন নিজে প্রেম করে বিয়ে করার কথা তখন ভাবে নি অতসী। হয়তো পরে কোনো এক সময় নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নিতো, কিন্তু সেই সুযোগটুকুই বা অতসী পেল কই? একদম হঠাৎ করেই বাবার এক সহকর্মীর মাধ্যমে এসে গেল সম্বন্ধটা। আর বাবার মাথা গেল বিগড়ে। অত ভালো ছেলে হয় না। বিশাল চাকরি, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। যখন যেখানে পেরেছে সুযোগ দেখলেই সেটাকে আঁকড়ে ধরে পকেটে পুরে ফেলবার চেষ্টা করেছে বাবা। অতসী যেন বাবার মতন হয়, হাতের লক্ষ্মীকে যেন কোনোভাবেই পায়ে না ঠেলে অতসী।
তবু বাবার মধ্যে এইটুকু বোধ অন্তত ছিল যে অতসীর সামনে পরীক্ষা বলে সাথে সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয় নি বাবা। ওদের বিয়ে হয়েছিল পাকা কথাবার্তা হয়ে যাবার প্রায় এক বছর পরে।
প্রথম দেখায় কিংশুককে মন্দ লাগে নি অতসীর। দেখতে শুনতে ভালো। ভদ্র ব্যবহার। কোনোরকম অসভ্যতা বা ইল্লুতেপনা করে নি কিংশুক সেই সব দিনগুলোতে। এক বছর পরে বিয়ে বলে নিজেদের মধ্যে বেশ কিছু চিঠি চালাচালি করেছিল ওরা। তখন বেশ ভালো লেগেছিল চিঠিগুলো। গুছিয়ে চিঠি লিখত কিংশুক। ঝরঝরে বাংলা, তাই পড়তে বেশ ভালো লাগত চিঠিগুলো।
আজ অবশ্য মনে হয় অতসীর যে কিংশুকের আর ওর, দুজনের সব চিঠিগুলোই ছিল উপর-উপর, ছেঁদো অর্থহীন যত কথায় ভরা, আসল কোনো দরকারি কথা ছিল না ওগুলোতে। যৌনতা, প্রেগন্যান্সি, বাচ্চা মানুষ করা, চাকরি -- যে যে জিনিসগুলো নিয়ে বিয়ের পরে ঠোকাঠুকি লাগতে পারে সেসব নিয়ে একটাও কোনো কথা হয় নি ওদের মধ্যে বিয়ের আগে।
বোম্বে পৌঁছনোর কিছুদিন পর বুঝতে পেরেছিল অতসী, কিংশুককে আসলে চেনে নি ও, বুঝতে পারে নি ওকে। ওকেও একেবারে চেনে না আর বুঝতে পারে না কিংশুক।
অসম্ভব মুডি কিংশুক।
যখন ভালো মুডে, তখন বাবুর আজেবাজে কথাবার্তাতেও কোনো আপত্তি নেই। অতসীর পিরিয়ডস নিয়ে বা প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ার ভয় নিয়ে মাঝেমাঝেই আজেবাজে ঠাট্টা করত কিংশুক, ভয় দেখাত চোখ বড় বড় করে। এই ধরনের সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ঠাট্টা একদম ভালো লাগত না অতসীর।
মুশকিল হল এইটুকু ভালো মুডও থাকত না প্রায়ই।
মুখ গম্ভীর, বাংলার পাঁচের মতন, ঘন্টার পর ঘন্টা। জিজ্ঞাসা করলেও জবাব পাওয়া যাবে না কোনো। প্রথম দিকে অতসী ভেবেছে ও নিজেই এমন কিছু করেছে যে চটে গেছে কিংশুক। কিন্তু এত চাপা কিংশুক যে নিজের বউকেও সব কিছু বলে হালকা হতে রাজি নয় ও। বিয়ের কয়েক মাস পার হবার পর থেকে তাই বিরক্তি আসত অতসীর।
সাংসারিক যে কোনো ব্যাপারেও উদাস কিংশুক। সমস্ত কিছুতেই একটা গয়ংগচ্ছ ভাব। যেন যা চলছে চলতে দাও, তুমি-আমি এই পৃথিবীতে দু দিনের অতিথি মাত্র। তা, এত বৈরাগ্য যার মনের মধ্যে, সে হঠাৎ বিয়ে করতে গেল কেন?
অতসীর ক্যারিয়ারের ব্যাপারেও চূড়ান্ত উদাসীন কিংশুক। বোম্বেতে আশেপাশের যে সব বাড়ির মেয়েরা চাকরি করতে যায়, প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রে অতসী লক্ষ্য করেছে তাদের বরেরাই উদ্যোগী হয়ে কোথাও না কোথাও বৌকে চাকরিতে জুড়ে দিয়েছে। এসব খবর অবশ্য প্রথম প্রথম চেপে রাখে সবাই, এমন ভাব করে যেন নিজের যোগ্যতায় সবাইকে মুগ্ধ করে কাজ জুটিয়ে নিয়েছে ওরা সকলে। কিছুদিন বাদেই অবশ্য ধরা পরে যায় সব। একবার কাজে যাওয়া শুরু হলে এইসব মেয়েরা নিজেদের অন্য গৃহবধূদের তুলনায় এত উঁচুদরের মনে করে যে যে কোনো মেয়েলি আড্ডায় কোনো না কোনো ছলে অফিসের গল্প পারবেই। আর কাজের গল্প করতে গিয়েই ধরা পরে যায় যে অফিসে সকলেরই কেউ না কেউ আগে থেকেই পরিচিত ছিল। অতসী বোকা নয়। দুই আর দুইয়ে চার করতে অতসীর দেরি হয় নি তাই।
যার ভরসায় এই শহরে আসা, সে নিজে যদি কোনো উদ্যোগ না নেয়, কারুর সাথে যোগাযোগ না রাখে, লোকজনের সাথে কথাবার্তা না বলে, তাহলে সে সব খবরই বা পাবে কোত্থেকে আর তার বৌয়ের জন্য লোকে হাতে ধরে চাকরি দেবেই বা কেন? হয়তো হাতে আর একটু সময় পেলে নিজেই নিজেরটা জোগাড় করে নিত অতসী, কিন্তু তাও হল না কিংশুকের জন্য। বাড়িতে এত ছোট বাচ্চা রেখে চাকরি করতে যাওয়া সম্ভব নয়। শ্বশুরবাড়ি থেকে কোনো সাহায্য যে আসবে না সেটি শ্বাশুড়িঠাকরুন এর অনেক আগেই পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন। অতসীর মা-বাবাই বা কলকাতা ফেলে এখানে এসে কতদিন থাকবেন?
না, শেষ পর্যন্ত অ্যাবরশন আর করা হয় নি।
কিংশুকের জরুরি তলব পেয়ে প্রায় সাথে সাথে বোম্বে ছুটে এসেছিল ওর মা-বাবা। বাবা প্রথমে খুব ধমকেছিল, তারপর মায়ের সাথে মিলে অনেক বুঝিয়েছিল ওকে। বাচ্চা একটু বড় হয়ে গেলেই নাকি চাকরি করা শুরু করতে পারবে অতসী। কত মেয়ে তো আজকাল তাই করছে। ও যখন খুব বড় কিছু করতে চায় না, তখন এই কয়েকটা বছর কি অপেক্ষা করতে পারবে না? অন্যদিকটাও তো ভাববে অতসী, পরে বাচ্চা হয়ে চাকরি ছেড়ে দিতে হলেও তো সেই একই ব্যাপার হতো। মাঝের থেকে বয়স বেড়ে যেত শুধু।
মা-বাবা আরও কথা দিয়েছিল ওকে যে বাচ্চা হবার পর যতখানি পারে সাহায্য করবে ওকে। মা-বাবার কাছে অবশ্য সেই সাহায্য মানে হল বছরে দুবার করে এসে মাসখানেক থেকে যাওয়া, বা অতসীকে মাসখানেক করে বার দুয়েক নিজেদের কাছে রাখা। কিন্তু বছরের বাকি আট মাস যদি ছেলের পুরো বোঝা নিজেকে বইতে হয়, তাহলে যে অপরিসীম ক্লান্তি আসে শরীরে বা মনে তাতে নিজের আর আশেপাশের সবার প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছু কি হওয়া সম্ভব?
সেদিন রাত্রে খাওয়ার পরে মীনাক্ষীকে এই সবই বোঝাচ্ছিল অতসী। মেঘা নেই, ক্রিসমাসের ছুটিতে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি গেছে। গেস্ট হাউস প্রায় ফাঁকা এখন। ওরা দুজনও যে যার বাড়ি যাবে কাল বিকেলে।
অতসী মুখিয়ে আছে শমীককে আবার দেখবে বলে। এবার প্রায় তিনমাস একটানা থাকা হয়ে গেল দিল্লিতে। এতদিন শমীককে ছেড়ে থাকা এই প্রথম।
মীনাক্ষী কিন্তু টেনশনে আছে। বাড়ি না গেলেও উপায় নেই, অথচ গেলেই ওর উপরে শুরু হয়ে যাবে বিয়ের চাপ।
“গুডনাইট, দিদি!” বলে এক সময় উঠে পড়ল মীনাক্ষী। আলগা একটা হাসি লেগে আছে ওর মুখে। মনে হচ্ছে অতসীর বোঝানোতে কাজ হয়েছে অল্প হলেও, একটু আগের সেই থমথমে কান্নাভেজা মুখচোখ আর নেই।
মুগ্ধ হয়ে মীনাক্ষীকে দেখছিল অতসী।
হাসলে খুব সুন্দর দেখায় মীনাক্ষীকে। হাসলে ওর ঘাড়টা ডানদিকে সামান্য কাত হয়ে যায়। গালদুটো টোল খায় একটু। সুন্দর, নিটোল গানের গলা ওর। শুধু গান-ই নয়, স্কুল-কলেজে পড়ার সময় নিয়মিত ভারতনাট্যম চর্চা করেছে মীনা। এমন মেয়েকে যে পুরুষ জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পাবে সে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান।
একটা ঘন নীল রঙের সালোয়ার-কামিজ পরেছে মীনাক্ষী, কাশ্মীরি স্টাইলের সালোয়ার কামিজ, কিন্তু কামিজের উপরে লখনৌয়ের চিকন প্যাটার্নের সাদা সুতোর কাজ। ঠিক এই রঙের আর এই ডিজাইনের একটা সালোয়ার-কামিজ বোম্বের গোকুলধামের একটা দোকান থেকে বিয়ের অল্প কিছুদিন পরেই ওকে কিনে দিয়েছিল কিংশুক। তখনও অবধি বেশ ভালো ছিল কিংশুক। লোভ-লোভ চোখে সালোয়ার কামিজটা দেখছিল অতসী, কিন্তু তখনই কিনবার সাহস হয় নি। কিভাবে কে জানে, ওর মনের কথাটা সেদিন বুঝে ফেলেছিল কিংশুক।
দাম-ও মনে আছে সালোয়ার কামিজটার। ন’শো নিরানব্বই টাকা।
কত হেসেছিল ওরা সেদিন, কড়কড়ে দশখানা একশ টাকার নোট দোকানদারকে দিয়ে একটা পুরো টাকা ফেরত পেয়েছিল বলে। ফ্ল্যাটে ফেরার পথে এক টাকার কয়েনটাকে বদ্ধ পাগলের মতন রাস্তাতেই টস করতে করতে কিংশুক বলেছিল, “এ-এ-ক টাকা! চল তিসি, এই টাকাটা দিয়ে মালাবার হিলসে একটা বাংলো বুক করে আসি!”
তারপর কি যে হয়ে গেল সব ...
কেন যে মীনাক্ষী এখনো বুঝতে পারছে না যে একা একা শুধুমাত্র বরের ভরসায় বিদেশ চলে গেলে ঠিক যা যা হয়েছে ওর সাথে সেই একই জিনিস হবে মীনাক্ষীর বেলাও!
একা একা ঘনিষ্ঠ কারুর সাহায্য ছাড়া একটা বাচ্চাকে সামলানো কি মুখের কথা!
অতসীর পরিষ্কার মনে আছে সেই সব দিনগুলোর কথা।
কিংশুকের কলিগদের বৌয়েরা যখন চাকরি করতে যেত বা চাকরি থেকে ফিরত, সেই সময়টা নিচে নামত না অতসী। অসহ্য একটা কষ্ট হত ওদের দেখলে। এর চেয়ে ছেলেকে চান করানো, খাওয়ানো, সাফ করানো বরং অনেক ভালো। মন খারাপ লাগলে ছেলের সাথে কথা বলত অতসী। নিজেই বকবক করে যেত, আর ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে চেয়ে থাকত শমীক। কখনো কখনো খিলখিল করে হাসতো। খুব মিষ্টি হাসি ছেলেটার। অতসী লক্ষ্য করেছে, বাইরে পাখি দেখলে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে শমীক। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে সেই দিকে আর কেন জানি না ওর সারা মুখ দিয়ে লালা ঝরতে থাকে সেই সময়।
ছেলেকে নিয়ম করে বেড়ালের ডাক, কুকুরের ডাক, ঘোড়ার ডাক, বাঘ সিংহের ডাক সব রোজ রোজ ডেকে শোনাত অতসী। মাছি উড়লে কিরকম জজজ আওয়াজ হয় দু হাত পাখার মত করে নেড়ে নেড়ে দেখাত ওকে। শমীকের তখন আট মাস বয়স। একদিন অতসীকে ঘরে ঢুকতে দেখে খুব উত্তেজিত হয়ে শমীক বলে উঠল, “জজজ”। অতসী একটু বাদে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল একটা মাছি ঢুকেছে ঘরে আর শমীকের দুই চোখ সেই মাছির ওড়াটাকে ফলো করে চলেছে।
অনেকদিন পরে খুব আনন্দ হল অতসীর। এই প্রথম কিছু একটা নিজে চিনে কথা বলল শমীক।
বলা যায় না, একবার ছেলে কথা বলা শুরু করলে হয়তো এমন একজনকে পাবে অতসী যার কাছে সবকিছু খুলে বলা যায়।
মীনাক্ষীকে বরের সাথে একা বিদেশ গেলে কি কি অসুবিধে হতে পারে সে সব বললেও বাচ্চার ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা কিছু বলে নি অতসী।
কেন জানি না, প্রেগন্যান্সি নিয়ে মীনাক্ষীর ভিতরে ভীষণ একটা ভয় রয়েছে। ওর যখন চোদ্দ বছর বয়স, তখন ওর এক দূর সম্পর্কের দিদি বাচ্চা হবার সময় মারা যায়। সেই থেকে কেন জানি না ওর একটা বদ্ধমূল ধারণা, প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে ও আর বাঁচবে না।
যদিও মীনাক্ষীকে অতসী জিজ্ঞাসা করে নি, অতসীর সিক্সথ সেন্স বলছে যে সেন্থিলকেও ওর এই ভয়ের কথাটা বলে নি মীনাক্ষী।
বড়ে সাব অর্থাৎ স্মরজিত সেনগুপ্ত আসছেন অফিসে।
সারা অফিসে তাই একটা সাজ সাজ রব। কাগজপত্র, ফাইল ইত্যাদি সব যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হচ্ছে। এমনিতে পরিষ্কার অফিস ওদের, তবে এখন সবকিছু আবার ঝেড়েঝুড়ে নতুনের মতন করে রাখার চেষ্টা চলছে।
বড়ে সাব এলে সবার সাথে একটা যৌথ মিটিং তো করবেনই। এছাড়াও নাকি এখনো অবধি যতবার এসেছেন, অফিসের প্রত্যেকের সাথে আলাদা করে দশ পনের মিনিট কথা বলেছেন।
এবারে অতসীর উপরেই দায়িত্ব পড়েছে সেই সব মিটিংয়ের শিডিউল বানানোর। ওর নিজের মিটিংটা দ্বিতীয় দিনে, সাড়ে চারটের সময়ে।
-- আসবো?
-- এসো। বসো।
বলে অতসীকে উল্টোদিকের চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করলেন স্মরজিত সেনগুপ্ত।
-- তোমার স্টুডেন্ট ফিডব্যাক, রিভিউ রিপোর্ট সবই এক্সেলেন্ট। এখানে শাকধেরও তোমার পারফরম্যান্সে খুব খুশি। তাই ওসব নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাই না। আমি যেটা জানতে চাইছি, এখানে কাজটা করতে তোমার ভালো লাগছে কিনা।
-- হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই।
অতসীর হাবভাব দেখে সামান্য হাসলেন স্মরজিত সেনগুপ্ত। বললেন, "এই ভালো লাগাটাকে আমি খুব গুরুত্ব দিই। বর-ছেলেকে অন্য শহরে রেখে এসেছ তুমি। এইটুকু কাজের একটা পরিবেশ তো দিতেই হবে তোমাদের"।
একটু থেমে স্মরজিত সেনগুপ্ত আবার বললেন, “গেস্ট হাউসের সবকিছু ঠিক তো? ওখান থেকে সার্ভিস যা যা পাবার কথা সব পাচ্ছো তো?”
-- হ্যাঁ, হ্যাঁ, কোনো অসুবিধা নেই।
-- এরপর কি করবে ভাবছো?
হঠাৎ করে এমন একটা প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না অতসী। একটু অবাক হয়ে বলল, "মানে? কি বলতে চাইছেন বুঝলাম না!"
-- এম বি এ করবে?
-- এম বি এ? আমি? কেন?
সত্যি সত্যিই খুব অবাক হয়েছে অতসী।
-- এখানে তুমি এখন টিচিং পসিশনে আছো, জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর। এরপরের ধাপ সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর, আর তারপরে হল টিম লিডার আর তারও পরে কো-অরডিনেটর। এই তিনটে ধাপ পেরোতে ধরো তোমার আরো আট-ন’ বছর লাগবে। আমি নিশ্চিত জানি, এই সময়ের মধ্যেই এই তিনটে ধাপ পেরোতে পারবে তুমি। আর তোমার কাজ যেটুকু দেখেছি, ভালো কোঅরডিনেটর হতে পারবে তুমি। এরপরের ধাপ ম্যানেজমেন্ট টিম। সেই ধাপে উঠতে হলে কিন্তু ফিনান্স, অপারেশনস, মার্কেটিং বা এইচ আর, এর কোনো একটা ভালোভাবে জানা দরকার। এম বি এ করলে শিখতে পারবে এসব। তাছাড়া এম বি এ করা থাকলে অন্য জায়গা থেকে আরো ভালো সুযোগ পেতে পারো।
-- আশ্চর্য! আপনি নিজে অন্য কোম্পানিতে যাবার রাস্তা দেখাচ্ছেন আমাকে?
-- তোমাদের যদি ভালো হয়, কেন নয়? না, না, সিরিয়াসলি বলছি, ভেবে দেখো।
-- এম বি এ করতে গেলে তো চাকরি ছাড়তে হবে।
-- না! একেবারে ভুল ধারণা এটা। প্রচুর প্রোগ্রাম আছে যেখানে চাকরি করতে করতে এম বি এ করতে পারো।
-- ও বাবা, তাতে তো প্রচুর খাটুনি!
-- তা একটু আছে, তবে গেস্ট হাউসে যাবার পর আর কিছু তো এখন সেরকম করো না নিশ্চয়ই।
-- সেটা ঠিকই। কিন্তু ভয় হচ্ছে খুব, পড়াশুনোর অভ্যাস তো আর নেই, যদি সুযোগ পেয়ে পাস না করতে পারি লোকে যা তা বলবে।
-- আরে যারা বলবে তারা অ্যাডমিসনটা তো পেয়ে দেখাক আগে। না, না, কোনো তাড়া নেই। আমি শুধু বলছি, ভেবে দেখো। তুমি অঙ্ক নিয়ে পড়েছো আর মোটামুটি চর্চায় আছো, তাই টেকনিকাল সাবজেক্টগুলোতে ভালোই উৎরে যাবে। অন্য সাবজেক্টগুলো নিয়েও আমার মনে হয় না তোমার কোনো বড় সমস্যা হবে। হ্যাঁ, খাটুনি থাকবে ভয়ানক রকমের। দুটো বছর অন্য কোনো দিকে তাকানোরও সুযোগ পাবে না।
-- ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন নিশ্চয়ই চেষ্টা করবো।
-- গুড। আমি শুধু বলছি চেষ্টা করে দেখো, চেষ্টাতে সেরকম ক্ষতি তো কিছু নেই, বরং লেগে থাকলে লাভের আশা প্রচুর।
টেবিলে রাখা ফাইলটা ড্রয়ারে ঢোকাতে ঢোকাতে স্মরজিত সেনগুপ্ত বললেন, "ব্যাস, এইটুকুই। তুমি গিয়ে কপিলকে একটু পাঠিয়ে দাও।"
দরজা খুলে বেরোতে যাচ্ছিল অতসী। আবার ডাকলেন স্মরজিত সেনগুপ্ত।
-- শোনো, আর একটা কথা। আজ গ্রূপ মিটিংয়ে কেন জানি না আমার মনে হল মীনাক্ষী কোনো কারণে খুব ডিপ্রেসড আছে। বাচ্চা মেয়ে, ওর নিয়মিত মেন্টরিং দরকার হতে পারে। এ কম্মটা কোনো ছেলেকে দিয়ে হবে না। পারলে ওকে একটু সাহায্য কোরো।