দিল্লি আসার আগেই ক্যালেন্ডারে কতগুলো লাল দাগ আছে দেখে রেখেছিল অতসী। মাস দুয়েক পরে একটা বুধ আর বৃহস্পতিবারে ছুটি আছে পরপর দু’দিন, শনিবারও কিসের একটা ছুটি। শুক্রবার আর পরের সোম-মঙ্গল ছুটি নিয়ে নিলে হাতে সময় এসে যাবে সাত দিনের মতন।
চাকরিতে যোগ দেবার পর অবশ্য বোঝা গেলো ব্যাপারটা অতটা সহজ নয়। কোচিং ইনস্টিটিউটগুলোর প্রচুর কাজ থাকে শনি আর রবিবারে। সাধারণ স্কুলগুলোতে ওই দুদিন ছাত্রদের ছুটি দেওয়া হয় বলে কোচিং ইনস্টিটিউটে ছাত্রদের ভিড় ওই দিনগুলোতে অনেক বেশি হয়। ছুটি নিতে গেলে তাই সপ্তাহের মধ্যে নেওয়া ভালো। অতসীর ছুটির আবেদনে প্রথমে তাই এখানকার হেড অমিত শাকধের একটু ভুরু কুঁচকে মন্তব্য করেছিলেন, “সানডে ভি?” তারপরই অবশ্য কি ভেবে মত পাল্টে বললেন, “ঠিক হ্যায়, ইয়ে তো পহেলি ছুট্টি হ্যায়, যাইয়ে!”
টিকিট কাটার পর থেকে ধৈর্য যেন আর বাঁধ মানছিল না।
এই দু’মাসের মধ্যে অফিসে নিজের কাজের সাথে মানিয়ে নিতে খুব একটা কষ্ট হয় নি অতসীর। হেড শাকধের স্যারকেও মন্দ লাগে নি ওর। মাঝারি হাইট ভদ্রলোকের, চোখে পুরু কাঁচের চশমা আর মাথার সামনে টাক। খুব আস্তে আস্তে একটু থেমে থেমে কথা বলেন শাকধের স্যার। ওনাকে প্রথম দেখে অতসীর ওর দাদার স্কুলের হেডস্যার অবিনাশবাবুর কথা মনে এসেছিলো। অবিনাশবাবুর চেহারায় যতটা ব্যক্তিত্বের ছাপ ছিল, অমিত শাকধেরের চেহারাতে অবশ্য সেটা নেই। তবে চেহারা যেমনই হোক, ভদ্রলোক নিজের কাজে যথেষ্ট দক্ষ আর পোশাকে-আষাকে বেশ পরিপাটি। ওনার আরো একটা গুণ অতসীর খুব ভালো লেগেছে, অফিসের সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর সাজানো আছে কিনা সেই দিকে ওনার বেশ ভালো নজর, আর যে কোনো কাজই গুছিয়ে করতে ভালোবাসেন। অন্য সহকর্মীরা অতসীকে জানিয়েছে যে শাকধের স্যার অকারণে চ্যাঁচামেচি বা টেনশন করেন না, আর সবচেয়ে ভালো ব্যাপার অবশ্য এই যে নতুনদের সঙ্গে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করেন।
অতসীর আসল যেটা সমস্যা সেটা হল বাকি লোকজনের সাথে মানিয়ে নেবার। বিবাহিত মহিলা, ছেলে রয়েছে ক্লাস নাইনে পড়া -- হঠাৎ করে সেই মহিলা একা একা কেন বোম্বে থেকে দিল্লি আসবে চাকরি করতে? বোম্বেতে এতটাই কি চাকরির অভাব? আসল ব্যাপারটা কি? বরের সাথে সম্পর্কটা ঠিক আছে তো? চরিত্র-টরিত্র কেমন মহিলার?
প্রকাশ্যে কেউ অবশ্য অভদ্রতা করে নি। কিন্তু এসব ব্যাপারে অতসীর একটা সিক্সথ সেন্স কাজ করে। লোকের চোখমুখ হাবভাব দেখে ও তাদের মনের ভিতরটা পড়ে নিতে পারে। এখনো অবধি এই সিক্সথ সেন্স কোনো বড় ভুল করায় নি অতসীকে লোক চিনতে। অতসীর সিক্সথ সেন্স অতসীকে বলছে যে কিছু অদৃশ্য চোখ ওকে সিকিউরিটি ক্যামেরার মতন ফলো করে চলেছে আর ওকে নিয়ে নিয়মিত আলোচনা চলছে ওর আড়ালে। ও কিরকম পোশাক পড়ে, কি ভঙ্গিতে চলাফেরা করে, কিভাবে সিনিয়রদের সাথে – বিশেষ করে তারা যদি পুরুষ হয় – কথা বলে, এই সব কিছুর উপর নজর রাখা হচ্ছে নিয়ম করে। অবশ্যই সকলে এরকম নজর রাখা পার্টি নয়, তবে দু তিনজনের প্রথমদিকের হাবভাব ওর খুব একটা সুবিধের লাগে নি। এখানে পঙ্কজ, পুষ্পেন্দ্র, আর প্রেম বলে তিনজন টিচিং স্টাফ রয়েছে। দল পাকানোতে ওস্তাদ এরা।
প্রথম আলাপেই এদের হাবেভাবে কেন জানি না অতসীর মনে হয়েছিল যে এরা নিজেদের কাজ অন্যের ঘাড়ে গছিয়ে দিয়ে দিনের মধ্যে যতটা সময় পাবে, গুলতানি করবে। ঠিক তাই। কিছুদিন পরে একবার শাকধের স্যারের নাম করে একটা স্টুডেন্ট রিপোর্ট লেখার কাজ অতসীকে ধরিয়ে দিতে গিয়েছিলো পঙ্কজ। কি ভাগ্গি, কাজটা ঠিক কিভাবে করতে হবে সেই ব্যাপারে একটু শাকধের স্যারের গাইডেন্স চাইতে গিয়েছিলো অতসী। অতসীর মুখে সব শুনে অবাক হয়ে শাকধের স্যার ওকে বলে, “লেকিন ইয়ে কাম তো ম্যায় পঙ্কজকো দিয়া? লাগতা হ্যায় উয়ো ফাঁসায়া আপকো! ঠিক হ্যায়, আপ যাকে পঙ্কজ কো একবার মেরে পাস ভেজিয়ে!” এর পরে ঠিক কি হয়েছিল অতসীর জানা নেই, তবে যাই হয়ে থাক পঙ্কজ যে খুশি হবে না সেটা না বুঝতে পারার কোন কারণ নেই।
এখানে অঙ্কিত আর কপিল বলে অন্য দুজন টিচিং স্টাফের সাথে অবশ্য প্রথম থেকেই মোটামুটি একটা কাজ চালানোর মতন বন্ধুত্ব হয়ে গেছে অতসীর। দুজনকেই প্রথম আলাপে বেশ ভদ্র সভ্য বলে মনে হয়েছে অতসীর। এরা দুজনেই দিনের বেশির ভাগ সময় চুপচাপ নিজেদের কাজ করে যায়, ফালতু আড্ডা দেয় না। বলা বাহুল্য পঙ্কজদের দলটাকে এরা দুজন খুব একটা ভালো চোখে দেখে না। একবার অফিসের জানলা থেকে ওদের তিনজনকে অফিসের বাইরে সিগারেট খেতে দেখেছিলো অতসী। ঠিক সেই সময় কপিল এসেছিলো ওকে একটা বই দিতে। জানলার দিকে তাকিয়ে বাইরে ওদের তিনজনকে দেখে হাসতে হাসতে বলেছিল কপিল, “দেখ লিজিয়ে অতসী দিদি, ইয়ে তিনো হ্যায় ইয়ে অফিসকা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর!”
এর কিছুদিন পরে কপিলের কাছ থেকেই অতসী জানতে পারে যে ওর জায়গাতে নিজের বোনকে চাকরিতে ঢোকাতে শাকধের স্যারের কাছে দরবার করেছিল পঙ্কজ। শাকধের স্যার চাকরি তো দেনই নি পঙ্কজের বোনকে, উল্টে স্মরজিত সেনগুপ্তকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছেন। স্মরজিত সেনগুপ্ত নাকি সব শুনে সাংঘাতিক বকুনি দিয়েছেন পঙ্কজকে আর বলেছেন নর্মাল প্রসেসের বাইরে যে-ই উমেদারি করুক, তাকে উনি ভাগিয়ে দেবেন চাকরি থেকে।
এই কদিনের মধ্যেই অতসী এটাও বেশ বুঝতে পেরেছে যে শাকধের স্যার এই অফিসের সব নিয়মিত কাজ সামলে দিলেও এখানে বড়ে সাব অর্থাৎ স্মরজিত সেনগুপ্তর দাপট সাঙ্ঘাতিক রকমের। পঙ্কজদের দলটা ওকে যে লম্বা জেরার হাত থেকে রেহাই দিয়েছে সেটা খুব সম্ভবত “বড়ে সাব” নিজে ওকে চাকরি দিয়েছেন বলে। কে জানে এই পঙ্কজ-টঙ্কজ আবার আড়ালে ওকে বড়ে সাব কা আওরত ভাবছে কিনা!
উপায় নেই কোনো। এদের সাথে যখন থাকতেই হবে, তখন এই ধরনের ব্যাপারগুলো মেনে নেওয়া ছাড়া আর কি করবে অতসী? এসব নিয়ে কোনো ঝগড়াঝাঁটি বা চ্যাঁচামেচি করবার মানে হয় না, এসবে নিজেরই ক্ষতি। নিজের কাজে মন দিতে হবে আর ব্যক্তিগত ক্ষেত্রটায় একটা গন্ডি তৈরি করে রাখতে হবে প্রথম থেকেই। কেউ ভুল করে সেই গন্ডির মধ্যে পা দিলে তাকে অবশ্যই বুঝিয়ে দিতে হবে যে সে শালীনতার সীমা অতিক্রম করছে।
মা বা বাবার কাছে এসব ব্যাপারে উপদেশ চেয়ে কোনো লাভ নেই। অতসীর শমীককে ফেলে দিল্লি আসার সিদ্ধান্তটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না দুজনে। আর মনে মনে কিছুটা জেদের বসেই ঠিক করে নিয়েছে অতসী যে কিংশুককে কিছুতেই নিজের কাজের জায়গার কোনো সমস্যার সাথে জড়াবে না, উপদেশ দিয়ে মাথায় ছড়ানোর তো কোনো প্রশ্নই নেই। চাকরিতে জয়েন করার পর একমাত্র শিখার সাথেই তাই অতসীর বার দু-এক কথা হয়েছে এসব নিয়ে। প্রথমবার অতসীই ফোনটা করেছিল ওকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য। স্বভাবতই, নতুন চাকরি অতসীর কেমন লাগছে তাই নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেছিল শিখা। অতসীর কাছ থেকে সব শোনার পর শিখা অবশ্য এগুলোকে খুব একটা পাত্তা দেয় নি। অনেকদিন ধরে কলকাতাতে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করছে শিখা। বলেছে, “কাজের জায়গাতে তো একটু আধটু এসব হবেই!” তারপর একটু থেমে বলেছে, “আসলে জানিস তো, এটা এক ধরনের ৱ্যাগিং!”
পরে মাথা ঠান্ডা করে অতসীও ভেবে দেখেছে কথাটা একশ শতাংশ ঠিক।
অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেমন নতুন ছেলেমেয়েদের কিছুদিন পর্যন্ত র্গিং করা হয়, আমাদের কাজের জায়গাগুলোও অনেকটা সেই রকম। ৱ্যাগিং পিরিয়ড কেটে গেলে আবার যে কে সেই, তখন তুমি “আমাদের একজন”, তুমি তখন ৱ্যাগিং করবে, ৱ্যাগিংয়ের শিকার হবে না।
আর শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন, বিয়ে করে নতুন বৌ হয়ে শ্বশুরবাড়িতে গেলেও কি তোমার রেহাই আছে? অতসী নিজেই তো এই ব্যাপারে একজন ভুক্তভোগী, কম জ্বালিয়েছে ওকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন?
তাই দেখাই যাক না, একবার ৱ্যাগিং পিরিয়ডটা কেটে গেলে কি হয়!
দিল্লির যে গেস্ট হাউসে অতসী থাকে সেই একই গেস্ট হাউসে ওর আরও দুজন মহিলা সহকর্মী থাকে, মীনাক্ষী নটরাজন আর মেঘা দেশাই। মীনাক্ষী তামিলনাড়ুর মেয়ে আর মেঘা গুজরাটের, যদিও ছোটবেলায় বোম্বেতে মানুষ হওয়া আর এখন থাকে পুণেতে । ওরা দুজনেই বয়সে অনেক ছোটো অতসীর থেকে, বিয়ে হয় নি দুজনের কারুরই। অতসীর অত বড় ছেলে রয়েছে শুনে হাঁ হয়ে গিয়েছিল ওরা। ওরা দুজনেই তাই অতসীকে দিদি বলে ডাকা শুরু করে প্রথম দিন থেকে।
প্রথম দিকে দু’তিন সপ্তাহ মীনাক্ষী আর মেঘা প্রায়ই আসত ওর সাথে গল্প করতে। অতসীকে আনপ্যাক করতে আর ঘর সাজিয়ে নিতেও যথেষ্ট সাহায্য করেছে ওরা।
বোম্বেতে মানুষ হওয়া মেঘা প্রায়ই দিল্লির তুলনা করে বোম্বের সাথে। এখানে ভালো বড়া-পাও বা পাও-ভাজি পাওয়া যায় না বোম্বের মতন, বোম্বের মতন প্রতি দু’পা অন্তর চা বা কফি খাবার মতন ভালো রেস্টুরেন্ট নেই, অটোরিকশা-রা কেউ মিটারে চলে না, সন্ধ্যের পর মহিলাদের জন্য দিল্লি বোম্বের মতন নিরাপদ নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। বোম্বেতে দীর্ঘদিন থাকার জন্য অতসী মেঘার অভিযোগগুলোর সত্যতা উপলব্ধি করতে পারে, তবে এটাও বোঝে যে এরকম সব ব্যাপারে তুলনা করলে দিল্লির লোকেরা বিরক্ত হয়। এই জন্যই মেঘা এখানকার অফিসে লোকজনের মধ্যে অতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে নি। অনেকেই আজকাল মেঘা এই সব ব্যাপারে কথা শুরু করলে ওর আড়ালে হাসাহাসি করে, বলে বোম্বে যদি অতটাই ভালো তো ওখানে চাকরি নিয়ে থেকে গেলেই তো পারতিস! তবে এ’কথা সত্যি যে মেঘার দিল্লিতে আসা স্রেফ কিছুটা এক্সপেরিয়েন্স করে নেবার জন্য। সেটা হলেই ও বোম্বে, পুণে নয়তো আমেদাবাদ – কোথাও একটা ফিরে যাবে অন্য কোনো চাকরি নিয়ে, দিল্লিতে দীর্ঘদিন থেকে যাওয়ার কোনো বাসনা নেই ওর।
প্রথমদিকে অন্য সকলের মতন মীনাক্ষী আর মেঘারও খুব কৌতূহল ছিল অতসীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে, বিশেষ করে মীনাক্ষীর। ওরা দুজনেই খুব বুদ্ধি রাখে। প্রথমদিকে নিজেদের অনেক ব্যক্তিগত সুখদুঃখের গল্প করত ওরা অতসীর কাছে। মনে মনে হেসেছিল অতসী। ছোট মেয়ে বলে নানা ব্যাপারে ওদের আদর আর প্রশ্রয় দিলেও, প্রথমেই নিজের আর নিজের পরিবারের গল্প শুরু করে নি অতসী। অবশ্য সাধারণ লোকে এই অবস্থায় যেটুকু করে, যেমন বর আর ছেলের ছবি দেখানো, তাদের হাবভাব আর স্বভাব এসব নিয়ে একটু আধটু গল্প তো করতেই হয়েছে। এসব গল্প অতসী করেছে হাসিমুখে ঠাট্টা, তামাশার ছলে। যেমন, ছোট্টবেলার থেকে শমীক ওকে রাত্রে শুয়ে কতবার গুঁতিয়েছে মাথা দিয়ে এই গল্প শুনে মীনাক্ষী আর মেঘা দুজনেই হেসে খুন!
ওদের দুজনের সাথে এই একমাসে দিল্লির বিভিন্ন জায়গা, রেস্টুরেন্ট, মল আর শপিং কমপ্লেক্স ঘুরেছে অতসী। প্রথম দিকের সেই চমকটা অবশ্য আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে এখন।
কোচিং ইনস্টিটিউটে আসল কাজ শুরু হয় সাধারণ স্কুল, কলেজ বা অফিসের অনেক দেরিতে। বেশির ভাগ বাচ্চা এখানে আসে স্কুল ছুটি হবার পর। ফলে অফিস থেকে বেরোতে বেশ দেরি হয়ে যায়। গেস্ট হাউসে ফিরে আবার বেরোনোর সময় থাকে না, বেরোনো খুব একটা নিরাপদও নয়। ফলে বেরোতে হলে সেই ছুটির দিনে।
আজকাল ছুটির দিনগুলোতেও বেরোতে খুব একটা ভালো লাগে না আর, অথচ ঘরে থাকলেও একা একা বোর হতে হয়।
যত্ন করে কাজ করার জন্য আর অন্য সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার জন্য একমাসের মধ্যে যারা আড়ালে ফিসফাস করছিল তাদের অনেকের সাথেই একটা কাজ চালানোর মতন আলগা বন্ধুত্ব হয়ে গেল অতসীর। এমনকি পুষ্পেন্দ্র আর প্রেমের সাথেও।
এই অফিসে মাঝে মাঝেই পার্টি চলে স্টাফেদের মধ্যে, জন্মদিন-বিবাহবার্ষিকী ইত্যাদি সব পালন করা হয় বিপুল উৎসাহে। মেয়েদের মধ্যে একজন-দুজনের উদ্যোগ এই সব ব্যাপারে সাঙ্ঘাতিক। কার কবে জন্মদিন, কার বিবাহবার্ষিকীর কত বছর হল, সব তাদের মুখস্থ। একটা ভালো ব্যাপার লক্ষ্য করেছে অতসী – খুব বড় অফিস নয় বলে উৎসবের সময়টাতে ছোটবড় সকলেই মোটামুটি একসাথে মিশে যায় সেদিন। এই সব উৎসবপালন সাধারণত হয় সাড়ে পাঁচটা বেজে গেলে।
প্রথম মাসের মাইনে হাতে পেয়ে অফিসে সবার জন্য পার্টি দিলো অতসী। এই প্রথম নিজের রোজগারে কাউকে খাওয়ানো। এত আনন্দ হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল যে শুধু এর জন্যই সমস্ত কষ্ট সহ্য করা যায়। আনন্দের আতিশয্যে অফিসের পিওন জগমোহনকে দিয়ে অনেককিছু খাবার আনাল অতসী -- বার্গার, পনির পকোড়া আর বিভিন্ন ধরনের প্যাস্ট্রি আর বাঙালি মিষ্টি। সব্বাইকে পেট পুরে খাওয়ানোর পরও বেঁচে গেল অনেককিছু। অফিসের বাকি স্টাফেদের মধ্যে তাদের বাড়ির জন্য সেই সব ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিলো।
কেন জানি না, পঙ্কজ এলো না ওর পার্টিতে, একটা জরুরি কাজের নাম করে সেদিন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল অফিস থেকে।
পরের দিন সকালে অফিসে ঢুকে নিজের টেবিল চেয়ার গুছিয়ে তখনো ভালো করে বসে নি অতসী। দেখে, অঙ্কিত আর কপিল আসছে। দুজনের মুখেই ঝলমলে হাসি।
মুখ টিপে চোখ সামান্য নাচিয়ে কপিল বললো, “অতসী দিদি, খুশ খবর হ্যায়, ব্রহ্মা হাম সবকো ছোড় দিয়া!”
হাসতে হাসতে পাশের থেকে অঙ্কিত বললো, “লেকিন বিষ্ণু আউর মহেশ্বর আভি ভি নজদিকমে হ্যায় হাম সব কা ভালাই করনে কে লিয়ে!”
পঙ্কজ নাকি এই চাকরি ছেড়ে অন্য আর একটা কোচিং ইনস্টিটিউটে জয়েন করছে রাতারাতি। দিন দশেক আগেই ছেড়ে দিতে পারতো, মাঝের এই ক’টা দিন শুধু অপেক্ষা করছিলো এই মাসের মাইনেটার জন্য!
পঙ্কজ হঠাৎ করে চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় বাকি সকলের কাজ বাড়বে। অতসীরও। অতসীর অতিরিক্ত কাজে আপত্তি নেই। কাজের জায়গাতে শান্তি থাকাটা বরং অনেক বেশি জরুরি।
পার্টির পর থেকে দিব্যি অফিসের জুনিয়র ছেলেগুলোর দিদি বনে গেল অতসী। দেখা গেল প্রেম আর পুষ্পেন্দ্রও সহকর্মী হিসেবে খুব একটা খারাপ নয়। অতসীকে একদিন হাতে ধরে এখানকার সফটওয়্যার গুলো বুঝিয়ে দিলো প্রেম, যথেষ্ট যত্ন করেই বোঝালো। আর একদিন পুষ্পেন্দ্র না আসায় ওর ক্লাস সামলে দেবার পর থেকে দেখা হলে হাসিমুখে স্বাভাবিক ব্যবহার করা শুরু করলো পুষ্পেন্দ্র। নিজের পয়সায় সামোসা খাওয়ালো একদিন সবাইকে, অতসীকে এসে নিজের হাতে সামোসা দিয়ে গেলো ও।
ৱ্যাগিং পিরিয়ড শেষ হবার পর থেকে তাই অফিসের লোকজনদের সামলাতে আর খুব একটা কষ্ট হয় নি অতসীর। কাজ আর এইসব ছোটখাটো ফুর্তিফার্তা নিয়ে দিনের বেলাগুলো দিব্যি কেটে যাচ্ছিল ওর।
মুশকিল হত রাত্রে।
পাশে এমন কেউ নেই যে নাভিটাকে কেন্দ্র করে সারা খাট পাক দেয় আর মাঝে মাঝেই ঘুমের ঘোরে অতসীকে গুঁতোয়।
প্রথম কয়েকদিন রাত্তিরটাতে খুব কষ্ট হয়েছিল অতসীর। কে জানে এর শেষ কোথায়? এই রকম কেন, এর চেয়ে অনেক খারাপ কোনো চাকরি জুটলেও বোম্বে ফিরে যেতে রাজি অতসী, কিন্তু সেই চাকরিই বা কে দেবে ওকে। বোম্বেতে যে রয়েছে সে যদি একটু উদ্যোগ নিত হয়তো সেটা সম্ভব ছিল, কিন্তু এতদিনে অতসী পরিষ্কার বুঝে গেছে যে কিংশুককে দিয়ে এসব কাজ হবে না।
রাত্তিরবেলা উল্টোপাল্টা ভাবলে ঘুম হয় হালকা, ছেঁড়া ছেঁড়া।
ছোটবেলায় ঘুম নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না অতসীর। যে কোনো জায়গায় যে কোনো অবস্থায় চোঁখ বুঁজলেই সেই সময় ঘুমিয়ে পড়ত অতসী। দিনের মধ্যে দশ বা বারো ঘণ্টা ঘুমানোও কোনো সমস্যা ছিল না ওর কাছে। ওর ঘুম নিয়ে দাদা ভীষণ পিছনে লাগত ওর, সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো, “তিসি! বিয়ের মন্ত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে শেষ না হলে ও বিয়ের পিঁড়িতে বসেই ঘুমিয়ে পড়বে সেদিন!”
শমীকের জন্মের পর একেবারে হালকা হয়ে গেল সেই ঘুম। শমীকের যত ফূর্তি রাত্রে। সারাদিন ঘুমোবে আর রাত দশটার পর থেকে গাঁক গাঁক করে চ্যাঁচাবে, কখনো আনন্দে, কখনো রেগে, কখনো বা জেদ করে কোনোকিছু না পাওয়ার দুঃখে। অতসীকেও তাই জেগে থাকতে হত যতক্ষণ না নবাবপুত্তুর অতসীকে শান্তি দেবার জন্য ঘুমে ঢলে পড়ছেন।
শমীক বড় হবার পর আবার সেই ঘুম ফিরে এসেছিল অনেকখানি। সারাদিন বাড়ির অসংখ্য কাজের চাপে রাত দশটার পর শরীর আর টানতে পারত না কোনোকিছু। কিন্তু এই দিল্লি শহরটা ফের যেন ধ্বংস করে দিয়েছে সেই ঘুমকে।
এখন এখানে প্রতি রাতে অন্তত দুবার ঘুম ভাঙ্গে অতসীর। একবার রাত দেড়টা নাগাদ আর আর একবার ভোর চারটেতে। দেড়টার সময় উঠে এক গ্লাস জল খায় অতসী, বাথরুমে যায় একবার। তারপর চারটে অবধি বেশ গভীর হয় ঘুমটা। কিন্তু চারটের পর থেকে সকালে ওঠার চাপে ঘুমটা একেবারেই ভালো হয় না। হালকা একটা ঝিমুনির মতন রেশ থাকে শুধু।
এই ঝিমুনির রেশটা এমনিতে খুব একটা খারাপ কিছু নয়, বরং আরামেরই, কিন্তু মুশকিল হল মাঝে মধ্যেই আজেবাজে যত স্বপ্ন নিয়ে আসে এই ঝিমুনি। ছোটবেলার থেকে যতবার এরকম হালকা ঝিমিয়েছে অতসী, কোনো না কোনো স্বপ্ন এসে শখের ঝিমুনিটিকে পুরো চটকে দিয়েছে। আর সেগুলির কোনোটিকেই ঠিক সুখের স্বপ্ন বলা যাবে না। কখনো অতসী ফেল করেছে পরীক্ষায়, কখনো বা বাড়ির ছাত ভেঙে পড়েছে ভূমিকম্পে, কখনো বা অতসী মানিব্যাগ হারিয়ে ফেলে টাকা দিতে পারে নি অচেনা কোনো দোকানদারকে।
এই প্রত্যেকটা স্বপ্নের জন্যই হয়তো কিছু বাস্তব ঘটনা দায়ি। যেমন, একটা স্বপ্নের কথা কখনো ভোলে নি অতসী, ভুলতে পারা যায় না সেরকম স্বপ্ন।
জঙ্গলে একা একা ঘুরছে অতসী। ঘুরতে ঘুরতে ও লক্ষ্য করল গাছের আড়াল থেকে দুটো হিংস্র চোখ ওকে লক্ষ্য করে চলেছে। এঁকেবেঁকে জঙ্গলে ঢুকে গেছে পথটা। কিন্তু প্রত্যেক বাঁকের মুখে দেখা যাচ্ছে সেই দুটো চোখ। গাছের আড়ালের জন্য ঠিক বোঝা যাচ্ছে না চোখ দুটো আসলে কার। ভয়ে বুক ধুকপুক করছে অতসীর। সেই ধুকপুকানি চাপা দিতে বুকের উপর হাত রেখে শিউরে উঠল অতসী। শরীরে কোনো পোশাক নেই ওর।
কেন এরকম স্বপ্ন দেখল অতসী? ঐদিন দুপুরে কলেজে যাবার সময় একটা মধ্যবয়স্ক লোক ফলো করছিল ওকে। তিন চারটে মোড় ঘুরবার পরও অতসী দেখেছে ওর পিছনে আঠার মতন লেগে আছে লোকটা। সেই ভয় আর চিন্তাটাই কি রাত্রে এরকম স্বপ্নর রূপ নিয়েছে?
এরকম অবশ্য আরও কয়েকবার হয়েছে।
তখন বোম্বেতে অতসী। শেষ বিকেলে সিরিয়াল দেখতে দেখতে একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল।
শমীক সদ্য সদ্য একা একা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। হাতে তাই অনেকটা ফাঁকা সময় অতসীর। কোনো একটা কাজে সেদিন দুপুরবেলা বেড়িয়েছিল অতসী। বাস থেকে দেখতে পেল যে কোনো এক বড় চৌরাস্তার মোড়ে এক গরিব বুড়োকে ট্রাফিক পুলিশ ঠাস করে গালে চড় কষালো। এটা দেখার পর অনেকক্ষণ একটা বিষণ্ণতার রেশ রয়ে গিয়েছিল মনে, যেন থাপ্পড়টা মারা হয়েছে ওকেই। বাড়ি এসেও সেই বিষণ্ণতা কাটে নি।
স্বপ্নে অতসী সেদিন স্পষ্ট দেখল যে ফ্লোরা ফাউন্টেনের সামনে এক ট্রাফিক পুলিশ শমীকের গালে ঠাস করে এক চড় কষাল সিগন্যাল না মেনে রাস্তা পার হবার জন্য।
এখানেও কয়েকদিন আগে শেষরাতের ওই ঝিমুনির সময় কিংশুককে স্বপ্ন দেখল অতসী। মজার ব্যাপারটা এই যে কিংশুককে নিয়ে এটাই এখনো অবধি ওর প্রথম স্বপ্ন।
বর্ধমানের রাস্তায় কিংশুকের সাথে রিকশা চেপে যাচ্ছে অতসী। অতসীর গালে একটা পোকা বসেছে। রঙিন পোকা। পোকাটার মুখের কাছটাতে লাল আর নীল রং। শুঁড় দিয়ে অতসীর গাল চাটছে পোকাটা। আতঙ্কে অতসী চেঁচাচ্ছে, “শিগগির হাসপাতাল নিয়ে চলো আমায়, যে পোকা যত রঙিন হয় তার কামড়ে তত বিষ!”
মুখে একটা শুকনো, তেতো স্বাদ নিয়ে বিছানা ছাড়ল অতসী। কিংশুককে নিয়ে তার কোনো চিন্তা ছিল না এতদিন। সেজন্যই বোধ হয় প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কিংশুক এবার ওর স্বপ্নেও হানা দিতে শুরু করেছে।
না, কাল থেকে আর চারটের পরে ঘুমোবে না অতসী।
উঠে পড়বে। উঠে যোগ ব্যাম করবে আর কিছুদিন আগে খান মার্কেট থেকে কেনা সেই লেবু-তুলসী মেশানো গ্রিন টি-টা বানিয়ে খাবে এক কাপ।
নিজের অজান্তেই ক্যালেন্ডারের দিকে তাকায় অতসী।
বোম্বে যেতে এখনো আট দিন বাকি।
বোম্বে সেন্ট্রালে অতসীকে নিতে এসেছিল কিংশুক।
ট্রেনে আসতে আসতে যা যা বলবে ভেবে রেখেছিল অতসী তার সব কেমন গুলিয়ে গেল একা কিংশুককে দেখে।
শমীক নেই কিংশুকের সাথে।
হঠাৎ করে খুব মন খারাপ হয়ে গেল অতসীর। কেন আশা করেছিল অতসী যে শমীক থাকবে? বড় হচ্ছে, পড়াশুনোর চাপ বাড়ছে। সারাক্ষণ মায়ের আঁচল ধরে থাকবে সেটাই তো অস্বাভাবিক। তবু কৌতূহল চেপে রাখা মুশকিল। মন খারাপ চেপে একটু আহ্লাদী গলায় কিংশুককে জিজ্ঞাসা করল অতসী, “শমী-কে আনলে না? আমি তো ভেবেছিলাম ট্রেন থেকে নেমেই তোমাদের দুজনকে দেখতে পাবো!”
-- বলেছিলাম আসতে। ওর দুজন বন্ধু এসেছে বাড়িতে, স্কুলের একটা প্রজেক্ট আছে ওদের, একসাথে নাকি কাজ করতে হবে।
-- যা! আজ আমি আসবো, আজকেই ওদের এইসব করতে হবে? আগে বা পরে করতে পারল না?
-- তুমি বাড়ি ঢোকার আগেই ওরা চলে যাবে। তুমি আসার আগে এই সব কাজ সেরে ফেলতে চেয়েছে শমীক।
যাক, তবু এটুকু অন্তত ছেলে ভেবেছে মায়ের জন্য। এক নিমেষে আবার মনটা ভালো হয়ে গেল অতসীর। এক মুখ হাসি নিয়ে কিংশুককে জিজ্ঞাসা করল,
-- কেমন দেখছো আমায়? খুব পাল্টে গেছি এই ক’দিনে?
বাড়ি ঢোকার পর কিছুতেই শমীকের দিক থেকে নজর ফেরাতে পারছিল না অতসী।
এভাবে ওর দিকে মায়ের চেয়ে থাকাটা একেবারে পছন্দ করে না শমীক। বিরক্ত হয় খুব, কিন্তু আজ কোনো কথা শুনবে না অতসী।
আরো কি একটু লম্বা হয়েছে শমীক এই এক মাসে? কাঁধদুটোও যেন চওড়া লাগছে আরও। কিংশুকের মতন সামান্য কুঁজো নয় শমীক। কিংশুকের মতন নিজের শরীরকে অবহেলাও করে না অল্প বয়স থেকেই। অতসী লক্ষ্য করেছে একদম ছোটবেলাটা পার হবার পর থেকে এক্সারসাইজ করার ব্যাপারটাতে বেশ আগ্রহ রয়েছে শমীকের। নিয়মিত ব্যায়াম করে বাড়িতে আর পার্কে। ইদানিং নাকি মার্শাল আর্টের প্রতিও আকর্ষণ বেড়েছে। এখানে পাশের বিল্ডিঙের কিংশুকের এক সহকর্মী নাকি ক্যারাটেতে ওস্তাদ। বেশ কয়েকদিন ধরে তার কাছে রীতিমতন তালিম নিচ্ছে শমীক আরও কয়েকজন বন্ধুর সাথে। শুনে একটু চিন্তা হয়েছিল অতসীর। হঠাৎ মার্শাল আর্ট কেন? গুন্ডা হবে নাকি ছেলে? ভেবেছিল বোম্বে গিয়ে এসব নিয়ে মুখোমুখি কথা বলবে শমীকের সাথে। সে সব পরে হবে, তবে যেটা নজরে পড়ার মতন সেটা হলো যে এখন বয়ঃসন্ধির সময়টাতে সেই এক্সারসাইজের ফল শরীরে ফুটে উঠছে শমীকের। এখন আর রোগা বলা চলে না ওকে।
এই এক মাসেই যেন এক লাফে আরও অনেক বড় হয়ে গেছে শমীক।
ঠোঁটের উপরে গোঁফের রেখাটা কি গাঢ় হয়েছে আরো একটু? গালের দু পাশে ব্রণ হয়েছে অনেকগুলো। ওগুলো নোংরা থাকার জন্য না স্রেফ বয়ঃসন্ধির কারণে বোঝার উপায় নেই।
একটা পাজামা আর একটা পাতলা লাল টি-শার্ট পরেছে শমীক। পায়ে চটি পড়তেও ভোলে নি।
আজকাল নিজে থেকেই পাজামা পরা ধরেছে তাহলে শমীক। কিছুদিন আগেও এই নিয়ে যুদ্ধ কম করতে হয় নি অতসীকে। লোমশ দুটো পা হাফ প্যান্টে কি আর ঠিকঠাক ঢাকা পড়ে এখন? দেখলে লোকেই বা ভাববে কি? অথচ কিছুতেই হাফ প্যান্ট ছাড়বেন না বাবু। পাজামাতে ওনার নাকি বন্ধ-বন্ধ লাগে, ঘাম হয় দুই পায়ে।
-- শোনো, জেরা শুরু করার আগেই লিস্ট মিলিয়ে বলে যাই সব। জল খেয়েছি সকাল থেকে ছ’ গ্লাস। হোম টাস্ক সেরে রেখেছি। তোমার ঘরটাও গুছিয়ে রাখা আছে। কাল আমি আর বাবা মিলে যতখানি সম্ভব বাড়িটা সাফ রেখেছি। সমস্ত কিছু ঝেড়েপুঁছে রাখা। কাজেই এখন এসব নিয়ে কোনো চ্যাঁচামেচি না করে চুপচাপ নিজে সাফ হয়ে নাও।
অতসীর স্যুটকেস-টা এক হাতে আর ব্যাগটা অন্য কাঁধে নিয়ে শোবার ঘরের দিকে এগোতে এগোতে কিংশুকের দিকে তাকিয়ে শমীক বলে, “বাবা, আজ রাতে মাটন বিরিয়ানি। হোম ডেলিভারি নয় কিন্তু, লাকি-তে গিয়ে খাব আমরা।”
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল অতসী, কিন্তু হাঁ-হাঁ করে বাধা দিয়ে উঠল শমীক, “কথা বলার অনেক সময় পাবে, আগে চান-টান যা করবার সব সেরে নাও!”
ঠিক কি হচ্ছে ব্যাপারটা? আগে তো এই রকম অর্ডার দেবার সুরে কথা বলত না শমীক? এসব কি শুধু বড় হবার জন্য, নাকি অতসীর দিল্লি চলে যাবার জন্য ভিতরে জমে থাকা রাগের প্রকাশ?
ছেলে কি দূরে সরে যাচ্ছে অতসীর থেকে?
আস্তে আস্তে সেই দূরেই চলে গেল শমী।
কোথায় ভুল হল অতসীর? এর পর থেকে যখনই সুযোগ পেয়েছে বোম্বে ঘুরে গেছে অতসী। যখনই বাড়ি এসেছে, পুরো সময়টা শমীককে দেবার চেষ্টা করেছে। অসংখ্য বই আর খেলার জিনিস নিয়ে এসেছে ওর জন্য, যা যা ওর ভালো লাগে ওই অল্প কয়েক দিনেই ওকে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে।
সব খাবার চেটেপুটে খেয়েছে শমীক। বই আর খেলার জিনিসগুলো পেয়ে খুশির প্রকাশও কম করে নি। কিন্তু কেমন যেন এড়িয়ে এড়িয়ে চলেছে অতসীকে। আগে যেরকম অতসীর সাথে লেপ্টে থেকে গল্প করতো, আবদার করত নানারকম, সেসবের ধার দিয়েও যায় নি। অতসী জোর করে কথা বলতে এলে বিরক্ত হয়েছে। আর সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হল, কিংশুকের সাথে এখন যেন অনেক বেশি ভদ্র আর নম্র গলায় কথা বলছে শমীক। বলছে তা বলুক, তাই বলে অতসীকে এত দূরে ঠেলে দিচ্ছে কেন?
এমনই কি হবার কথা ছিল? আগে তো মায়ের সাথে গলা মিলিয়ে বাবার উপর চিল্লাত শমীক? এখন থেকে কি উল্টে গেল সবকিছু? কেউ দূরে চলে গেলে সত্যি সত্যিই কি সে আর নিজের জায়গা ফিরে পায় না সংসারে?
ক্লাস টেনের রেজাল্ট ভালো হল না শমীকের। ছেলেকে কিছু না বললেও ব্যর্থ রাগে সেই নিয়ে কিংশুককে আক্রমণ করেছিল অতসী। মা যখন অন্য শহরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, বাবা হিসেবে তারও তো কিছু দায়িত্ব রয়েছে ছেলের কথা ভাববার। ইলেভেনে উঠল শমীক। সামনে অজস্র পরীক্ষা। এখন এই দুটো বছরও কি একটুখানি অফিসে কম সময় দিতে পারে না কিংশুক?
কে জানে কেন, ভীষণ অপমান হয়েছিল শমীকের। চিৎকার করে বাবার সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল শমীক।
-- কেন বাবাকে শুধু শুধু দোষ দিচ্ছো বল তো? দোষ আমার! যা বলবার এখন থেকে সরাসরি আমাকে বলবে।
স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল অতসী। আরও কত কথা ছিল, কিন্তু আর কিছু বলতে পারে নি সেবার, কিংশুককেও না, শমীককেও না।
মনের মধ্যে জমাট বাঁধা একরাশ দুঃখ আর চিন্তা নিয়ে দিল্লি ফিরে গিয়েছিল ও। চাকরি কি সেই ছেড়েই দিতে হবে শেষ অবধি? ছেড়ে দিলেও কি আর আগের জায়গাটা ফেরত পাবে অতসী?
তারপর থেকে যতবার বোম্বে এসেছে অতসী, খাবার সময়টুকু ছাড়া শমীক পড়ার ঘর থেকে বেরোয় নি। অতসী ওর সাথে কথা বলতে চাইলে হোমটাস্কের নাম করে চেঁচিয়েছে, রাত্রে ওর সাথে শুতে চাইলে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে অতসীকে বলেছে, ও এখন অনেক রাত জেগে পড়বে, মা যেন অন্য ঘরে শুয়ে পড়ে নিজের সময় মতন।
নিজের মনকে প্রবোধ দিয়েছে অতসী। ছেলে বড় হচ্ছে। পড়াশুনোর ভীষণ চাপ মাথায়।
হয়। সব মা-বাবার-ই এরকম হয়।
ছেলে আই আই টি তে পড়ার সুযোগ পেলে আগের সব অপমান আর অবহেলা কি আর গায়ে লাগে? মনের মতন জায়গায় ছেলে সুযোগ পেয়েছে পড়বার, যা পড়তে চেয়েছে তাই পড়বার সুযোগ পেয়েছে -- আজকের দিনে ক’টা মা বাবার এই সৌভাগ্য হয়?
তবু এক বিরাট শূন্যতা অতসীর জীবনে। একেবারেই দূরে চলে গেছে শমীক। কাজের কথা ছাড়া ওর সাথে আর কোনো কথা হয় না এখন। ওর কি স্বপ্ন, কি নিয়ে কাজ করতে চায়, কোনো বান্ধবী জুটেছে কি জোটে নি -- এসব জানার ভীষণ কৌতূহল অতসীর। ওসব কথা তুলতে গেলেই গম্ভীর হয়ে অন্য কথা পাড়ে শমীক। নিজের চারদিকে যেন একটা গন্ডি এঁকে দিয়েছে তার ছেলে, সেই লক্ষ্মণরেখা ভেদ করে ভিতরে যাবার সাধ্য আর অতসীর নেই।
সব মা-বাবারই কি এক হাল নয়?
অগত্যা, নিজের ক্যারিয়ায়র। নিজের স্বপ্ন। মন খারাপ করে বসে থাকার মানে হয় না। আরও অনেক উপরে নিয়ে যেতে হবে নিজেকে।
দিল্লির এই কোচিং ইনস্টিটিউটে অতসীর প্রায় বারো বছর হতে চললো। যথেষ্ট সুনামের সাথে কাজ করার জন্য এর আগে দু’দুবার প্রমোশন হয়েছে ওর। আর একটা প্রোমোশনের সময় এগিয়ে আসছে। মন প্রাণ ঢেলে কাজ করতে হবে এখন কিছুদিন।
তবে তার আগে মনে হচ্ছে বর্ধমানটা একবার ঘুরে আসতে হবে দিন দু’একের জন্য।
এর আগে শমীক কখনো বর্ধমানের এই বাড়িতে একা আসে নি। বাড়িতে দাদুও তখন একা থাকতেন না। এত বড় বাড়ি, তবু শমীকরা যখন আসত সারা বাড়ি তখন যেন লোকজনে গমগম করতো। গমগম করার অবশ্য কারণ রয়েছে। শমীকরা আসত মাত্র এক বা দু দিনের জন্য, আসার উপলক্ষ অধিকাংশ সময়েই হত বৃহত্তর যৌথ পরিবারের কোনো না কোনো পারিবারিক মিলন অনুষ্ঠান। বিয়ে, পৈতে বা অন্নপ্রাশন ছাড়াও নিয়ম করে শমীকদের বাবার দিকের বৃহত্তর যৌথ পরিবারের সকলে বছরের মধ্যে এক-দু দিন একসাথে কাটাতেন। বর্ধমানের বাড়িতে অনেক ঘর বলে থাকার জায়গার কোনো অভাব হত না।
মিলনোৎসবকে কেন্দ্র করে আসা হত বলে এই বাড়ি নিয়ে শমীকের যা কিছু স্মৃতি তার প্রায় সব-ই তাই আনন্দ দিয়ে ঘেরা। মা-বাবার একমাত্র ছেলে বলে বোম্বের বাড়িতে একাই ওকে অনেকটা সময় কাটাতে হতো। এই বাড়িতে ওর সমবয়সী বা একটু ছোটোবড় তুতো-ভাইবোনের অভাব ছিল না। বর্ধমানে এলে তাই শুধু ঘুমের সময়টুকু ছাড়া বাকি পুরো সময়টা কাটত এই সব ভাইবোনেদের সাথে। টো টো করে ঘুরে বেড়ানো আর খেলাধুলোর জন্য হাতে থাকত অফুরন্ত সময়।
বোম্বেতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যে সোসাইটিতে ওরা থাকত সেখানে বাচ্চাদের খেলার জন্য একটা খুব ছোটো পার্ক ছিল। সেই অল্প একটু জায়গাতেই বন্ধুদের সাথে বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি ছুটোছুটি করত শমীক। একটু বড় হবার পরে এই ছুটোছুটি বদলে গেল ব্যাডমিন্টনে। সোসাইটিতে খুব ছোটো একটা জিম ছিল। বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা ক্লাবে টেবিল টেনিস, ক্যারম আর বিলিয়ার্ডস খেলারও ব্যবস্থা ছিল। একটু বড় হবার পরে সেই সব-ও খেলত শমীক। তবু তাতেও যেন তৃপ্তি হত না, ভেবে পেত না অফুরন্ত উৎসাহ আর উদ্যম নিয়ে আর কি কি ও করে বেড়াবে। স্বপ্ন দেখত সবুজ ঘাসে ছাওয়া একটা বড় খেলার মাঠের, টেলিভিসনের পর্দায় যেমন দেখা যায়।
বোম্বে শহর হল ইঁট আর কংক্রিটের এক সমুদ্র। বড় খেলার মাঠ আর কটা সেখানে? চার্চগেটের পাশে বা শিবাজী পার্কে গেলে অসংখ্য বাচ্চার সাথে মিশে ক্রিকেট খেলা যায় কোনো না কোনো ক্লাবে নাম লিখিয়ে। কিন্তু বোম্বে শহরটার শিরায় শিরায় ধমনীতে ধমনীতে ক্রিকেট থাকলেও কেন জানি না ওই খেলাটা শমীকের একদম পছন্দ ছিল না। ওর প্রিয় খেলা তখন ফুটবল।
বর্ধমানে আসার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ শমীকের কাছে ছিল ওই ফুটবল। ও বাড়িতে ঢুকলেই ওর দুই হাত ধরে টানাটানি শুরু করত অন্তু-সন্তু। বড়দাদু পলাশবরণের দুই যমজ নাতি। শমীকের চেয়ে দু’বছরের বড় হলেও ওদের কোনোদিন “দাদা” বলে ডাকে নি শমীক। ওরাও এ নিয়ে কিছু মনে করত না।
কোনোক্রমে পোশাক পাল্টে মুখে কিছু গুঁজেই অন্তু-সন্তুর সাথে মাঠে বেরিয়ে পড়ত শমীক। শীত গ্রীষ্ম যে ঋতু-ই হোক না কেন, সাথে থাকত একটা ফুটবল। শমীকের এই ফুটবল প্রীতির কথা অন্তু-সন্তুর অজানা ছিল না। শীতকালে যদিও ফুটবল কমই খেলা হত শহরে, ওদের সেসব নিয়ে কোনো ছুঁৎমার্গ ছিল না।
বড় রাস্তার থেকে পাড়ার একটু ভিতরের দিকে যেত ওরা বন্ধুদের ডাকতে। আরও দু তিনজন জুটে গেলে সবাই মিলে ছোটা হত মাঠে। শমীকের আর তর সইত না। রাস্তায় যেতে যেতেই টিম বানানো হয়ে যেত ওদের যাতে মাঠে নেমে একটা মুহূর্ত-ও নষ্ট না হয়।
দাদুর বাড়ির থেকে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই সেই মাঠ। গোলার মাঠ -- নামটা অদ্ভুত। বর্ধমান জেলা সারা বাংলার ধানের ভাণ্ডার। শহরে বা তার আশেপাশে তাই প্রচুর রাইস মিল। এই মাঠের গায়েও একটা রাইস মিল। হয়তো এককালে এই মাঠের আশেপাশে প্রচুর ধানের গোলা ছিল। এখন সেই সব গোলার চিহ্ন না থাকলেও মাঠটা সেই নাম বয়ে বেড়াচ্ছে। মাঠের একটা দিক জুড়ে ধানকলের উঁচু পাঁচিল।
মাঠটার অন্য তিনদিকে তিনটে রাস্তা। রাস্তার ধার বরাবর একটু দূরে দূরে বড়, বড় পাতাওয়ালা গাছ। বর্ধমানের মহারাজারা এক সময়ে শহরটাকে সুন্দরভাবে সাজিয়েছিলেন। এই সাজানোর একটা অঙ্গ ছিল দীঘি কাটানো, বাগান করা আর গাছ লাগানো। গোলার মাঠের আশেপাশের গাছগুলোও পুরোনো গাছ, এক সময়ের সেই শহর সাজানোর অংশ। এর মধ্যে কিছু গাছকে ঘিরে আবার বেদি বানিয়ে দেওয়া, যাতে লোকে দরকার হলে গাছের তলায় বসে বিশ্রাম নিতে পারে। গাছের মতন বেদিগুলোও পুরোনো বলে ওগুলোতে ফাটল ধরেছে।
অতবড় খোলা, সবুজ মাঠে শমীক বোম্বেতে কখনো খেলে নি। এক প্রান্ত থেকে চিৎকার করলে অন্য প্রান্তে শোনা যাবে কিনা সন্দেহ। মাঠের দু দিকে দুটো বারপোস্ট। পাড়ার যুবকদের ফুটবল খেলার মাঠ এটা। বিকেলে তারা খেলবার সময় মাঠটা ছেড়ে দিতে হত ছোটদের। কিন্তু একদিকের বারপোস্টের পাশেও যে খোলা জায়গাটা ছিল সেটা আকারে কম নয়। ইঁট দিয়ে গোলপোস্ট বানিয়ে নিজেদের মধ্যে চুটিয়ে ফুটবল খেলত ওরা। অন্তু-সন্তু ছাড়াও ছিল রঘু, মণি, সুকান্ত, অরুণ, নির্মল, প্রদীপ আর শুভ। শমীকের সাথে খুব সহজেই ভাব হয়ে গেছিল ওদের। অন্তু-সন্তুর সাথে ওকে মাঠে ঢুকতে দেখলে একগাল হাসি নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসত সকলে।
মাঝেমাঝে ওদের সাথে খেলায় যোগ দিত টেরু। টেরু ওঁড়াও -- সাওঁতাল পরিবারের ছেলে। টেরুর মা তখন গোলার মাঠের গায়ের সেই রাইস মিলে কাজ করতো। ওর বাবা নাকি কলকাতার কাছে একটা কারখানায় কাজ ধরে অন্য বৌ নিয়ে সেখানে থাকতো। উচ্চতায় ওদের থেকে একটু খাটো হলেও, কালো, পাথরে কোঁদা শরীর ছিল টেরুর। পকেটে সবসময় বিড়ি থাকত ওর। শুভ আর প্রদীপ শমীককে ফিসফিস করে জানিয়েছিল টেরু নাকি হাঁড়িয়াও খায়।
সেই চোদ্দ বছর বয়সেই রিক্সা চালানো জানত টেরু, রোজ-ই বেশ কয়েক ঘন্টা রিক্সা নিয়ে বেরোত ও। ওদের বাড়ির সামনে একটা ঝোপের আড়ালে রাখা থাকত রিকশাটা। অনেক অনুরোধের পর একবার শমীককে রিক্সাটা চালাতে দিয়েছিল টেরু। চালাতে গিয়েই শমীক বুঝেছিল যে কাজটা অত সোজা নয়। স্রেফ সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে রিক্সা চালানো যায় না, কব্জিতে জোর লাগে। কারণে অকারণে রিকশার হ্যান্ডেল বেঁকে যাচ্ছিল ওর। মৃদু হেসে ওর কাছ থেকে রিক্সাটা নিয়ে নিয়েছিল টেরু। তারপর ওকে পিছনে চাপিয়েই সিধে ওর বাড়ি। মজা হল, গায়ে এত জোর থাকলেও ফুটবলটা ভালো খেলতে পারত না টেরু। রিকশা না চালাতে পারা আর টেরুর উপর নির্ভর করে বাড়ি ফেরার মধ্যে যে সূক্ষ্ম অপমানের জ্বালাটা শমীকের ছিল , সেটা সেদিন অন্যভাবে মিটেছিল ওর -- টেরুকে কাটিয়ে দু’ দুটো গোল দেওয়ার পরে।
খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে গেলে এক এক সময় মাঠে বসে গল্প করত ওরা। প্রায় সব গল্পই হত ফুটবল নিয়ে। বাড়িতে আর স্কুলে অজস্র গল্পের বই আর ম্যাগাজিন গোগ্রাসে গিলে শমীকের তখন সব বড় ফুটবলারের ঠিকুজি-কুলুজি মুখস্ত। বোম্বেতে ওর স্কুলের আর হাউসিং সোসাইটির বন্ধুরা ফুটবলে সেরকম কোনো আগ্রহ দেখাত না। তবে বর্ধমানের বন্ধুরা সকলেই খুব মন দিয়ে ওর সব কথা শুনতো।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। আশেপাশের বাড়িতে আলো জ্বলে উঠতো। অন্তু-সন্তুর বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া না থাকলেও, মা-র কড়া শাসনে অভ্যস্ত শমীকের কিন্তু অস্বস্তি যেত না। খেলা বা আড্ডা শেষ হত সাধারণত শমীকেরই তাগাদায়।
বাড়ি ফিরবার পথে একটু এগোলেই রাস্তার ডানদিকে পড়ত পীরতলা। পীরের কবরে রোজ ফুল সাজিয়ে রাখত কারা যেন, সন্ধ্যাবেলা প্রদীপ জ্বালাতো। আর সেই কবরের পিছনের বাড়িটার থেকে আসত ধুনোর গন্ধ।
ধুনোর গন্ধের মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যে একবার নাকে নিলে স্মৃতির গভীরে মিশে যায়।
আজ এত বছর পরেও কখনো কোথাও ধুনোর গন্ধ পেলেই শমীকের একটা আধো-আলো আধো-অন্ধকার রাস্তায় ফুটবলে ড্রপ দিতে দিতে বন্ধুদের সাথে বাড়ি ফেরার কথা মনে হয়। আর কেন জানি না, মনটা একটা গভীর দুঃখে হু হু করে ওঠে।
সন্ধ্যাবেলা মাঝেমাঝেই গানের বসত এ বাড়িতে। বড়ো দাদু পলাশবরণের গানের গলা বেশ ভালো ছিল। এই আসর বসানোর মূলেও ছিল তাঁরই উৎসাহ। অন্তু-সন্তু বা শমীকের গলায় সুর নেই, বসে বসে গান শোনাও ধাতে নেই তাদের। ওদের মন পরে থাকত লুডো, ক্যারম আর অন্য যাবতীয় খেলায়। এই সব খেলায় অন্তু-সন্তু ছাড়াও আর থাকত ওদের পিসতুতো দিদি আর বোনেরা -- এলা, তুলি, রুমি, মিঠু, আর মৌ । এলা, তুলি আর রুমি ওদের চেয়ে বড় বলে ওরা চাইত যা কিছু হবে সব “বড়দের” কথামতন। মৌ আর মিঠু ওদের থেকে ছোট হলেও গলার জোরে কম ছিল না মোটেই। বোনেরা থাকলে তাই সব খেলার শেষ হত ঝগড়া দিয়ে। বাকি সন্ধ্যেটা কাটত অন্তু-সন্তুর সাথে চক্রান্ত করে কিভাবে বোনেদের জব্দ করা যায়।
একবার গলার জোরে বোনেদের কাছে হেরে যাওয়ার রাগে এলার দুদিকের দুটো বিনুনি ধরে হ্যাঁচকা টান মেরেছিল অন্তু-সন্তু। ব্যাপারটার মধ্যে শমীক সরাসরি না থাকলেও বোনেরা ধরে নিয়েছিল শমীকেরও পুরোপুরি নৈতিক সমর্থন আছে এতে, বিশেষ করে যখন একটু আগেই অন্তু-সন্তুর সঙ্গে মিলে ও ওদের জিভ ভেংচিয়ে নকল করছিল।
মা সেদিন খুব বকেছিল শমীককে, পইপই করে বুঝিয়েছিল শমীক যেন কখনো কোনো মেয়ের গায়ে হাত না তোলে। মায়ের উপর সরাসরি বিদ্রোহ করবার সাহস ছিল না শমীকের। তবু মনে হাজার প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল ওর: কেন? মেয়ে বলেই কি সব নবাবনন্দিনী নাকি? অন্তু-সন্তুর সাথে এক হলেই এই সব নিয়ে কথা হতো। এলা, তুলি আর রুমির অকারণ দিদিগিরি সহ্য করতে পারত না ওরা কেউ। অন্তু-সন্তু দুজনেই তখন ঘোরতর নারীবিদ্বেষী, তাই ওদের প্রভাবে ক্রমশ যেন নারীবিদ্বেষী হয়ে উঠছিল শমীক।
নারীবিদ্বেষ শমীকের প্রথম কাটে এই বাড়িতেই। ক্লাস এইটে পড়ার সময়।
এই গোলার মাঠেই প্রথম রুবিকে দেখে শমীক।
শরতের বিকেল -- সন্ধ্যা হবে একটু পরে, আকাশ লালে লাল। আজ পঞ্চমী। অনেক পাড়ায় ঠাকুর এসে গেছে। দূর থেকে কোথাও ভেসে আসছে ঢাকের আওয়াজ।
সারাদিন ধরে ফুটবল খেলে ওরা তখন ক্লান্ত। ফুটবলটাকে মাঝখানে রেখে বারপোস্টের ধারে গোল হয়ে বসে ওরা তর্ক করছে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার কে, পেলে না মারাদোনা। রঘু, মণি আর নির্মল পেলের দিকে, কিন্তু মারাদোনার জঙ্গি ভক্ত অরুণ আর প্রদীপ। পেলে আর মারাদোনার যাবতীয় স্ট্যাটিসটিক্স দেবার দায় যেচে নিজের কাঁধে নিয়েছে শমীক।
-- অ্যাই দাদা, মা ডাকছে।
রুবি -- প্রদীপের বোন।
লম্বা ছিপছিপে চেহারা রুবির, ফর্সা রং,ঘন কালো ভাঁজ-ভাঁজ চুল কাঁধ থেকে নেমে এসে বুকের উপরে আছড়ে পড়েছে। গভীর ঘন কালো দুটো চোখ। একটা লাল স্কার্ট আর সাদা ব্লাউজ পরে দাঁড়িয়ে রুবি, সারা গায়ে লাল আলো মেখে।
শমীক কথা বলছিল বলে শমীকের দিকে শুধু একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিল রুবি। তারপর কেন জানি না চোখ নামিয়ে নিয়েছিল নিচে।
যা বলতে যাচ্ছিল আর বলা হল না শমীকের।
একসাথে সকলে উঠে পড়ল সবাই বাড়ি যাবার জন্য।
সেদিন অন্তু-সন্তু লুডো নিয়ে বোনেদের সাথে প্রবল ঝগড়া করলেও কেন জানি না তাতে সঙ্গ দিতে যেন ঠিক ইচ্ছে করছিল না শমীকের।
বর্ধমানের বাড়িতে এবার আবিষ্কার, Lorna Doone। দাদুর ইংরেজি গল্পের বইয়ের সংগ্রহের থেকে নিয়ে আসা। আরো অনেকক্ষণ ধরে বইটা পড়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মা এসে জোর করে আলো নিভিয়ে দিলো রাত সাড়ে এগারোটায়।
আলো নেভার পর কোনো এক অজানা টাইম মেশিনের সাহায্যে মধ্যযুগের ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিল শমীক। নদীতে সাঁতার কাটছে এখন ও। প্রবল স্রোত নদীতে। অনেকক্ষণ ধরে জলে ভাসছে শমীক। ভেসে যেতে যেতেও লড়াই করে চলেছে বাঁচার জন্য। হাঁচড়ে পাঁচড়ে কোনোরকমে তীরে উঠল ও। কিন্তু শরীর আর নিতে পারছে না। মাথা ঘুরছে। টলমল করছে দেহ। এত ঘুম পাচ্ছে কেন? ও কি তাহলে মরতে চলেছে?
কেউ যেন ওর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে আস্তে আস্তে একটা রুমাল দিয়ে ওর কপাল ঘষছে। লম্বা রেশমি চুলে সুড়সুড়ি লাগছে মুখে। একজোড়া গভীর কালো চোখ ওর দিকে চেয়ে। আর দুটো লাল টুকটুকে ঠোঁট। ঠোঁটদুটো এবার নড়ছে, বলছে, “যাক বাঁচা গেল! কেমন লাগছে এখন?”
একটা ছোট্ট, মিষ্টি মেয়ে। মেয়েটার পিছনে ফুলের বাগান।
বড় বড় চোখে শমীকের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা। সে চোখে দয়া, মায়া আর আরো অজানা কত কি ...
মেয়েটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না শমীক। যেন সারা পৃথিবীতে তাকানোর মতন অন্য কিছু নেই আর!
এখন থেকে রোজ একবার করে জন আর লর্নার এই প্রথম দেখা হবার দৃশ্যটা পড়বে শমীক। এতদিন কেন পড়ে নি?
লর্না বলে ছোট্ট মিষ্টি সেই মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা নিজেও জানে না শমীক। আধোঘুমে ওর মনে হল কে যেন ওকে জাগাতে এসেছে।
যে জাগাতে এসেছে সে একটা লাল স্কার্ট আর সাদা ব্লাউজ পরা, এক ঝাঁক ঘন কালো চুল মাথায়। চুলসমেত মাথাটা আস্তে আস্তে নেমে আসছে ওর বুকের উপরে। ঘন কালো চুলে সুড়সুড়ি লাগছে ওর গলাতে আর বুকে। ক্ষুধার্ত আধখোলা দুটো ঠোঁট শমীকের ঠোঁটের এত কাছে যে জিভ দিয়ে তার স্বাদ নেওয়া যায়।
প্যান্টে একটা ভিজে ভিজে ভাব নিয়ে জেগে উঠল শমীক।
তারপর একটা উল্লাস মেশানো ভয় আর পাপবোধ।
বর্ধমানে এলে একটা বা দুটো দিন শেষ হয়ে যেত বড় দ্রুত। এখানে এসে যা যা করবে ভেবে রাখত তার অর্ধেক-ও শেষ হত না। প্রথম প্রথম মা-বাবাকে শমীক দু একবার বলেছে এখানে আরও কয়েকটা দিন থেকে যেতে। কিন্তু কথাটা উচ্চারণ করলেই শমীক দেখত যে মায়ের মুখটা কেমন যেন কঠিন হয়ে উঠছে, আর বাবার চোখেমুখে একটা প্রবল অস্বস্তি, যেন শমীক নয়, বাবা নিজেই মস্ত বড় কোনো অন্যায় করে ফেলেছে!
এই বাড়ি ছাড়া মানেই কলকাতা যাওয়া, মামাবাড়িতে। মামাবাড়ি অবশ্য নামে মাত্র। শমীকের একমাত্র মামা অতনু বিয়ে করে নি। সারাদিন ব্যাংকে চাকরি করে আর সারা সন্ধ্যা রাজনীতি আর সমাজসেবা। এসব নিয়ে এত ব্যস্ত মামু যে বাড়িতে সে থাকত না বললেই চলে। ওই বাড়িকে তাই দাদুর বাড়ি বলাই ভালো। দাদুরা আগে থাকতেন চন্দননগরে। এখন রিটায়ার করার পর চন্দননগরের বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে কলকাতা চলে এসেছেন। মামুর চাকরি কলকাতাতে, রোজ যাতে ওকে চন্দননগর-কলকাতা ডেইলি-প্যাসেঞ্জারি করতে না হয় তাই নাগেরবাজারের কাছে বেশ বড় একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট কিনেছে মামু। মামুর জন্যই কলকাতা আসা দাদু-দিদার।
দাদু আর দিদা প্রচুর আদর করতেন শমীককে, যা যা খাবার শমীকের পছন্দ মনে করে সেগুলো বানাতেন বা নিয়ে আসতেন! তবু শমীকের ভালো লাগত না। কলকাতা শহরটা ঠিক যেন বোম্বের মতন, তফাৎ শুধু এখানে ওর বন্ধুরা নেই! বাড়িতে ওর বয়েসী কেউ নেই যে যার সাথে শমীক খেলবে। সারাদিন খাটে শুয়ে কত গল্পের বই পড়া যায়?
সেবার বর্ধমানে আরও দু’দিন থাকা নিয়ে খুব জেদ করেছিল শমীক। মা আর বাবার উপর বিরক্তি আর অভিমান কলকাতা এসেও কমে নি। মামাবাড়ি ঢোকার পর পোষাকও না ছেড়ে সিধে একটা বই নিয়ে উঠে পড়েছিল খাটে। কিন্তু একটুও মন লাগছিল না পড়ায়। এখনো বারো দিন। কি করে শমীক এতগুলো দিন না খেলে কাটাবে? আরও দুঃখ হচ্ছিল এই ভেবে যে আগামীকাল ম্যাচ ছিল পাশের পাড়ার সাথে। শুধু অন্তু-সন্তু নয়, শমীক এবার ফরোয়ার্ডে খেলবে বলে কত খুশি হয়েছিল ওর বর্ধমানের বন্ধুরা।
রাত্রে শোবার সময় কান্নাটা আর বাঁধ মানে নি। মা-বাবা পাশের ঘরে মামু আর দাদু-দিদার সাথে গল্প করছে। সবাই খুশি, সবাই মজায় আছে। শুধু শমীকের কথা ভাবার-ই কেউ নেই।
অঝোর কান্নায় ভিজে যাচ্ছে বালিশটা। ভিজুক। কেউ না দেখলেই হল।
গায়ে মাখার ক্রিম আনতে ঘরে ঢুকল মা।
শমীকের শোয়া দেখেই কিছু একটা সন্দেহ হল মায়ের।
-- এ কি! এইভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে আছিস?
জ্বর হল নাকি ছেলেটার? এত দুবলা তার এই ছেলেটা। মোক্ষম সময়ে যদি জ্বর বাধায় তাহলে ছুটির বাকি দিনগুলো পুরো মাটি।
কপালে হাত রাখতে গিয়ে ভিজে ভিজে লাগল বালিশটা।
-- কাঁদছিস?
কোনো জবাব দিলো না শমীক। বালিশটাকে আঁকড়ে ধরে অন্য পাশ করে শুলো।
-- কাঁদছিস কেন? বল, আমাকে বল! কষ্ট হচ্ছে বর্ধমানের জন্য?
এবার-ও কোনো জবাব দিলো না শমীক।
দীর্ঘশ্বাস পড়ল অতসীর। শুধু রোগা-দুবলা নয়, এত চাপা তার এই ছেলেটা। এইটুকু তো বয়েস, কি করে যে এত চাপা হল? একা একা কেঁদে চলেছে ফাঁকা ঘরে, কি যে করবে অতসী ওকে নিয়ে?
একটা অজানা অপরাধবোধ কুড়ে কুড়ে খায় অতসীকে।
শমীককে জড়িয়ে ধরে প্রচুর আদর করে ওর রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে অতসী।
সেবার ছুটিতে বাড়ি ফেরার আগে আবার বর্ধমান। এবারে আরও দু দিন থাকা।
এই দু দিন চুটিয়ে ফুটবল খেলল শমীক। লুডো খেলল বোনেদের সাথে, ক্যারম পেটাল অন্তু-সন্তুকে নিয়ে । সারাদিন আড্ডা দিলো বন্ধুদের সাথে। এমনকি, বাড়ি রং করার ব্রাশ আর তেল রং দিয়ে উঠোনে বোনেদের চু-কিত-কিত খেলার একটা ভালো কোর্ট-ও বানিয়ে দিলো।
পরের দিন সকালে কলকাতা। ভোর পাঁচটায় গাড়ি আসবে। এখান থেকে সিধে দমদম এয়ারপোর্ট। তারপর, বোম্বে।
অন্তু-সন্তু-র সাথে ওর শেষ পড়া গল্পের বইগুলো নিয়ে আরও একটু আলোচনা করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ভোরে উঠতে হবে বলে শমীককে জোর করে বিছানাতে পাঠিয়ে দিলো মা। H G Wells পড়তে পড়তে কখন যে ও ঘুমিয়ে পড়ল তা ও নিজেও জানে না।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল।
মা আর বাবা ঝগড়া করছে নিজেদের মধ্যে চাপা গলায়। বাবা বলছে, “এখন আমাকে দোষ দিয়ে লাভ কি? আমি তো তোমাকে এখানে আসতে বলি নি। তুমি নিজের ইচ্ছেতে এসেছো!”
“নিজের ইচ্ছেতে?” হিসহিস করে জবাব দিলো মা, “নিজের ইচ্ছে বলে কিছু আছে নাকি আমার? এতদিন তোমার ইচ্ছেতে সব করেছি, এখন থেকে ছেলের ইচ্ছেতেই সব করতে হবে! কোন ইচ্ছেটা রেখেছো আমার? তুমি ও রাখো নি, ছেলেও রাখবে না!”
-- কেন বারবার করে খোঁচাও বল তো?
-- আমি খোঁচাচ্ছি? দায় পড়েছে আমার। এখনও বাকি রাতটুকু এই এইটুকু আধহাত জায়গার মধ্যে শুতে হবে আমায়। কোনো বড় খাট তো আমার জন্য রাখে নি তোমার মা। বাড়ির বৌ-এর আবার ঘুম কিসের? ঘুম না হলেও তার দায়টা তো আমার-ই, তাই না?
-- কত বড় খাট চাই তোমার? ইস্টবেঙ্গল মাঠের মতন?
-- বাজে বকছো কেন? এখন শমীক বড় হচ্ছে, এই এতটুকু চওড়া খাটে কখনো তিনজনের হয়? নিজের মা-বাবা-কে এইটুকু বলবার মতন সাহস-ও যখন নেই তখন একদম চুপচাপ থাকো!
একবার যখন শুরু হয়েছে তখন চলবে অনেকক্ষণ ধরে। শমীক লক্ষ্য করছে যে আজকাল ঝগড়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। আগের মতন আর একতরফা নেই ঝগড়াটা। আগে বাবা একটা দুটো কথার পরই চুপ হয়ে যেত, কিন্তু এখন আর যায় না। চিৎকার-চ্যাঁচামেচিটা এখন বাবাই মার থেকে বেশি করে। কি করবে এখন শমীক? ছোটবেলার মতন চিৎকার করে কান্না তো আর সম্ভব নয়। গলায় তবু একটা দলা পাকানো ভাব। কোনো শব্দ করা চলবে না এখন। কেউ যেন কিছু বুঝতে না পারে।
আধোঘুমের মধ্যেই এক গভীর বিষণ্ণতা গ্রাস করে শমীককে। এবারের ঝগড়াটা একটু আলাদা। এতদিন মা-বাবা দু’জন দু’জনকে দোষ দিয়ে গেছে প্রতিনিয়ত, এবার থেকে কি সব অন্যরকম হতে চললো?
মা দোষ দিচ্ছে ওকে, হয়তো বাবাও দেবে এরপর। মুখে বলছে না এখনো কিছু, কিন্তু শমীক কোনো ফুটবল ক্লাবে ভর্তি হবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেই বাবার চোখেমুখে যে বিরক্তিটা ফুটে ওঠে সেটা ওর নজর এড়ায় নি।
মার ইচ্ছের দাম ও নাকি দেবে না কোনোদিন? শুধু মা’র ইচ্ছে বলেই তো অতগুলো বিকেল না খেলে সিন্থেসাইজার শেখার পিছনে সময় দিলো ও। মা কি ভুলে গেছে সেসব?
ঠিক আছে। এখন থেকে বর্ধমানে আসা নিয়ে আর কোনো জেদ করবে না শমীক। শুধু তাই নয়, ওর যে বর্ধমানে না গেলে কষ্ট হবে সেটা বুঝতেও দেবে না কাউকে।
এখন থেকে বর্ধমানের নাম-ই মুখে আনবে না ও।
অনেকক্ষণ চোখ বুঁজে জেগে থেকে থেকে গলার মধ্যে সেই দলা-পাকানো ভাবটা নিয়ে পড়ে রইল শমীক। শুধুমাত্র ফুটবল খেলার ক্লান্তির জন্যই, শেষরাতে ঘুম এসেছিল একটু।
তারপর থেকে সত্যি সত্যিই আর বর্ধমানে আসা হয়ে ওঠে নি শমীকের।
মৃত্যু যদি আগে থাকতে খবর দিয়ে নিতে আসে আমাদের, তাহলে সেটা আশীর্বাদ না অভিশাপ?
মৃত্যুর সাথে তাঁর শেষ সংলাপ লেখার সময় এই ব্যাপারটা নিয়ে আজ সকালে আর একবার নতুন করে ভাবছিলেন তমালবরণ। এই চিন্তাটি তাঁর আজকের নয়, দীর্ঘদিনের। অল্পবয়সে সাধারণত এমন সব দার্শনিক চিন্তা কারুর মাথাতেই আসে না, তমালবরণেরও আসত না, কিন্তু কৈশোরকাল থেকে শুরু করে একের পর এক মৃত্যু তাঁকে এই বিচিত্র প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে বারবার।
দেশভাগের অনেক আগেই দূরদর্শী অঘোরনাথ আঁচ পেয়েছিলেন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে চলেছে। ভাই ভূতনাথকে উপদেশ-ও দিয়েছিলেন জমিজমা বা ভূ-সম্পত্তি যা রয়েছে নিজেদের, তার বেশ কিছু বিক্রি করে কলকাতার আশেপাশে জমি কিনতে। ভূতনাথ শোনেন নি। তখন সদ্য সদ্য বর্মা থেকে কাঠ আনানোর ব্যবসাতে নেমেছেন ভূতনাথ। কাঠ আনাতে গেলে কোনো বড় নদীর কাছাকাছি কাঠগোলা বানালে তাতে সুবিধে অনেক। ভূতনাথ এই প্রথম দাদার বিরুদ্ধে গিয়ে তাঁর সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে এই বিনিয়োগ করলেন নোয়াখালীতে।
নোয়াখালীর চৌমুহনী ততদিনে বাংলার পুবদিকের একটি বড় ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। চৌমুহনীর দুদিকে বেশ কিছুটা দূরে মেঘনা আর ফেনীর মতন দুটি বিশাল নদী। এই নদী দুটির সংযোগ স্থাপন করছে একটি প্রাচীন খাল যা এই ব্যবসাকেন্দ্রের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে। বহু প্রাচীন এই খাল তৈরী হয়েছিল বন্যার সময় এলাকার জল দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য। কিন্তু জল পরিবহনের সম্পূর্ণ উপযুক্ত হওয়ায় এটি বাংলার অন্যান্য জায়গাতে কাঠের যোগান দেওয়ার এক আদর্শ জায়গা দাঁড়িয়ে যায়। আশেপাশে প্রচুর ছোটোখাটো জঙ্গল আর তাতে জারুল, শিশু, মেহগনি বা সেগুনের মতন ভালো কাঠ পাওয়ার উপযুক্ত গাছ রয়েছে। তাছাড়া একটু দূরেই বার্মা। এই খালের ধার বরাবর কাঠগোলা বানালে তাই ব্যবসা জমে ওঠার সম্ভবনা প্রচুর। নোয়াখালীতে কয়েকবার আসা-যাওয়ার পর ভূতনাথ তাই ঠিক করলেন চৌমুহনীকে কেন্দ্র করে তাঁর ব্যবসাকে বাড়িয়ে তুলবেন।
প্রথম দিকে এই কাঠের ব্যবসায় বিপুল পরিমাণে লাভ হচ্ছিল ভূতনাথের। অঘোরনাথ বেঁচে থাকতে থাকতেই দুটি নতুন বড় কাঠগোলা চালু করেন ভূতনাথ চৌমুহনীর আশেপাশে। এই দুটি কাঠের গোলা দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল তাঁর দুই ছেলে জগদীশ আর অবিনাশের। কিন্তু এত লাভ হচ্ছিল এই ব্যবসায় যে বিশ্বাস করে কর্মচারীদের হাতে ব্যবসা ছেড়ে সাতবেড়িয়াতে থাকা আর সম্ভব হচ্ছিল না। এই সময় সস্তায় বেশ কিছুটা জমি পেয়ে গেলেন ভূতনাথ নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুরে। লাভের টাকায় সেই জমি কিনে তাতে নিজের জন্য বিশাল এক বাড়ি বানালেন ভূতনাথ। অঘোরনাথের মৃত্যুর কিছুদিন পরে শেষ হল সেই বাড়ি বানানো। ছেলেরা তো আগে থাকতেই নোয়াখালী আঁকড়ে পড়েছিল। গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানের জন্য কিছুটা জোর করেই দুই ছেলেবৌ সমেত নিজের পুরো পরিবারকে নোয়াখালী নিয়ে গেলেন তিনি। কিছুদিন তাঁরা সবাই মিলে নোয়াখালীতে থেকে নতুন বাড়ির সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবেন। গৃহপ্রবেশের দিন যাবে সাতবেড়িয়ার আরো অনেকে।
ভূতনাথ ঠিকই করে ফেলেছিলেন যে সাতবেড়িয়া ছেড়ে পাকাপাকিভাবে লক্ষ্মীপুরে চলে আসবেন। আনন্দমোহনকেও বারংবার মন্ত্রণা দিচ্ছিলেন পাকাপাকিভাবে নোয়াখালী চলে আসতে। অঘোরনাথ ও তাঁর পরিবারেরও অংশ রয়েছে তাঁর কাঠের ব্যবসাতে। এরপর ব্যবসা আরও বাড়াতে গেলে পরিবারের অন্য ছেলেদের কাজে লাগবে তাঁর। সাতবেড়িয়াতে চাষের জমি আর ভিটেবাড়ি ছাড়া আর কি আছে তাঁদের? নিজেদের সন্তুষ্টির জন্য ভিটেবাড়িটা রেখে বাকি জমিজমা বেচে দিয়ে নোয়াখালীতে চলে যাওয়াই ভূতনাথের মতে বুদ্ধিমানের মতন কাজ হবে এখন।
গেঁতেল স্বভাবের জন্য আনন্দমোহন অবশ্য রাজি হচ্ছিলেন না খুড়োর ব্যবসার সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে। ও সব ব্যবসা-বাণিজ্য তাঁর দ্বারা হবে না। ওসব খুড়ো আর তাঁর খুড়তুতো ভাইয়েরাই সামলাক। তিনি দিনের শেষে ভাগের অংশ পেলেই খুশি।
কিছুটা হতাশ হয়েই তাই ভূতনাথ শুধু নিজের পরিবারকে নিয়ে গেলেন লক্ষ্মীপুরে। এর ফল হল মারাত্মক। ১৯৪৬-এর নোয়াখালীর দাঙ্গায় ধ্বংস হয়ে গেলেন তিনি ও তাঁর পরিবারের সকলে। এক মেয়ে বিবাহসূত্রে ফরিদপুরে থাকায় রক্ষা পেল শুধু তাঁর ধারাটি।
সাতবেড়িয়াতে এই খবর যেদিন এসে পৌঁছল সেদিন থেকেই তমালবরণের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, মৃত্যু কেন তৈরি হবার সময়টুকু পর্যন্ত দেয় না আমাদের? আরো কত কি জানবার ছিল, শিখবার ছিল তাঁর দাদুর কাছ থেকে। মৃত্যু এসে এক থাবাতে ছিনিয়ে নিলো সব। দাদুর মৃত্যুর বছর ঘুরতে না ঘুরতে আবার সেই মৃত্যুর থাবা -- এবারে ছোটদাদু এবং তাঁর পুরো পরিবার। ভূতনাথ যদি জানতে পারতেন কি হতে চলেছে, তাহলে কি আর তাঁর পুরো পরিবারকে এইভাবে নিয়ে যেতেন নিজের সাথে? বড়কা আর ছোটকাও তো বোঝে নি কি হতে চলেছে নোয়াখালীতে। বোঝে নি ওদের বৌ ছেলেমেয়েরা।
না, এদের সক্কলের থেকে তিনি নিজে অনেক, অনেক ভাগ্যবান। মহাপ্রস্থানের পথে তিনি একা চলেছেন, যেভাবে গেলে যাবার আগে পৃথিবীতে নিজের সব কাজ শেষ করে যাওয়া যায়।
দুই কাকার মধ্যে ছোটকার সাথে পলাশবরণ আর তমালবরণের সম্পর্কটা ছিল অনেকটা বড় দাদার মতন। পলাশবরণের থেকে মাত্র বারো বছরের বড় ছিল ছোটকা। খুব হাসিখুশি মজার মানুষ। ছোটখাট গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা। কদমছাঁট চুল, তোবড়ানো চোয়াল আর প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে আসা দুটো চোখ। নিজের বাপ-জ্যাঠাদের নিয়ে প্রচুর রঙ্গ-রসিকতা করত ছোটকা। তাঁদের হাবভাব, কথাবার্তা খুব ভালো নকল করতে পারতো, বিশেষ করে অঘোরনাথের। ভোম্বল, বিমল, পলাশবরণ, তমালবরণ -- এদের সকলের সামনে যখন মুখ চোখের অদ্ভুত ভঙ্গি করে এইসব নকল করত ছোটকা তখন হাসতে হাসতে পেট ফেটে যেত ওদের। পাড়াপ্রতিবেশী কারুর বাড়িতে বিয়ে থাকলে বাসরঘর জমিয়ে দিতে একা ছোটকাই যথেষ্ট ছিল।
অঘোরনাথকে আড়ালে বুইরঘ্যা বলে ডাকত ছোটকা, জ্যাঠা না বলে ঝ্যাঁটা বলতো। যদিও অঘোরনাথকে ভয় পেত খুব, মুখে কিছুতেই তা স্বীকার করত না। বরং এমন একটা ভাব করত যে আর সকলে অঘোরনাথকে খুব ভয় পেলেও, ও বুইরঘ্যাকে থোরাই কেয়ার করে।
অঘোরনাথ তমালবরণকে যেদিন এয়ার গান উপহার দিলেন, ছোটকা তাচ্ছিল্যের সাথে বলল, “এয়ার গান দিয়া হইব ডা কি! এত বড় বীর হইছস তুই, বুইরঘ্যারে একখান কামান দেবার লগে কইতে পারলি না?”
দিন দুই পরে অঘোরনাথের একটা দামি ওষুধের বোতল ভেঙে ফেলার পর অবশ্য অত বড় বড় বাতেল্লা মাথায় উঠেছিল ছোটকার। সেদিন সারাটা সকাল আর দুপুর ছোটকাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না কোথাও। সন্ধ্যাবেলা পাশের বাড়ির পুকুরের পিছনের বাগানে ছোটকাকে আবিষ্কার করলেন পলাশবরণ আর তমালবরণ। কিছু বলার আগেই ছোটকা ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে ওদের চুপ করতে বললেন, “আগে ক দেহি, বুইরঘ্যার চোখ-মুখ দিয়া অহনো ধোঁয়া বাইরাইতাসে কিনা?” বলে চুপিচুপি ষড়যন্ত্রকারীর ভঙ্গিতে ওদের বলল, “বুইরঘ্যার লাঠিখান হাপিস কইরা দিসি। তোরা যা গিয়া, বাড়ির যত খড়ম সব হাপিস কইরা দে দেহি।” তারপর করুণ চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “সেই তহন থিক্যা প্যাটে কিল মাইরা বইস্যা আসি। খাওনের লাইগ্যা কিছু আসে?”
দাদুর সাথে জঙ্গলে যাবার দিনগুলোতে হাসতে হাসতে ছোটকা তমালবরণকে বলতো, “বুইরঘ্যারে নিজের গামছায় বাইন্ধ্যা ফ্যালছস, ভালো করছস। কিন্তু সাবধানে থাকস। বুইরঘ্যা ঠিক করসে, নিজের মাংস একদিন না একদিন বাঘেরে রাইন্ধ্যা খাওয়াইবে। দ্যাখস, তর নিজের মাংস আদর কইরা বাঘেরে খাওয়াইস না আবার!” মাত্র ছমাস আগে বিয়ে হয়েছিল ছোটকার। বৌকে ছেড়ে বেশিদিন একটানা নোয়াখালীতে থাকতে পারত না। এবার বৌ সাথে যাচ্ছে বলে তমালবরণদের কাছে নিজের প্রাণের উল্লাস গোপন করতে পারে নি ছোটকা।
বড়রা সামনে না থাকলে নতুন-কাকিমা অর্থাৎ ছোটকাকিমাকে ছুটকি বলে ডাকতেন পলাশবরণ আর তমালবরণ। হাসিমুখে এই সব অত্যাচার সহ্য করতেন ছোটকাকিমা। বিয়ের পর প্রথম দু তিনটে মাস নতুন বৌ বলে নিজেকে একটু গুটিয়ে রেখেছিল ছুটকি, কিন্তু শেষের দিকে এটা ক্রমশই পরিষ্কার হচ্ছিল যে রঙ্গ-রসিকতার বেলা ছোটকা আর ছুটকি একেবারে আদর্শ স্বামী-স্ত্রী।
ভালোই হয়েছে যে ছুটকিকে আর বৈধব্য যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় নি। একই সাথে চলে গেছে দুজনে।
বর্ধমানে আসার পাঁচ বছর পরে আবার মৃত্যু থাবা হানল তমালবরণের জীবনে।
দাদুর মতন, বাবাও হৃদরোগে চলে গেলেন, তবে দাদুর চেয়ে অনেক কম বয়সে।
ডাক্তারি বিদ্যেটা খারাপ জানতেন না আনন্দমোহন। কিন্তু ডাক্তারিতে তাঁর খুব একটা মন ছিল না। দিনের সারাটা সময় রোগী দেখা ও তাদের সময় দেওয়ার বদলে, তাঁর মন পড়ে থাকত বই পড়া ও সাহিত্যচর্চায়। কলকাতাতে ডাক্তারি পড়ার পর, শহরে চেম্বার খোলার বদলে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন আনন্দমোহন। সাতবেড়িয়ার মতন গ্রামে একজন ডাক্তার আর কত টাকা রোজগার করতে পারে? এর আগে অঘোরনাথ তাঁকে জোর করে দু-তিনবার কলকাতাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন স্বাবলম্বী হবার জন্য। কিন্তু প্রত্যেকবার কোনো না কোনো অজুহাতে আনন্দমোহন দেশে ফিরে আসেন। বাড়ির ভাত ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা ছাড়বার মতন মানসিক শক্তি তাঁর ছিল না।
প্রথমে পিতার ও তারপর পুরো পরিবারসমেত খুড়োর মৃত্যু ও সবশেষে পার্টিশন -- এই প্রথম একেবারে অথৈ জলে পড়লেন আনন্দমোহন। বর্ধমানের বাড়ি ও কলকাতার কাছাকাছি আরও অল্প কিছু জমিজমা থাকায় একেবারে পথে বসে না গেলেও, আগের সচ্ছলতা আর রইল না। ততদিনে তিনি দুই ছেলে আর এক মেয়ের বাপ। মাথায় অনেক দায়িত্ব।
বর্ধমানে একেবারেই মানিয়ে নিতে পারেন নি আনন্দমোহন। একে তো তখন তিনি আর যুবক নন, তার উপর নতুন শহর। এরকম অবস্থাতে নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে গেলে যে রকম দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করতে হয়, সেই লড়াইটা করবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না আনন্দমোহন। বর্ধমানের বাড়িতেই একটি ঘরকে চেম্বার বানিয়ে সেখানে প্র্যাকটিস করা শুরু করেছিলেন আনন্দমোহন। কিন্তু প্রথম দুই বছরে সে প্র্যাকটিস বিশেষ জমে নি। এই প্র্যাকটিস না জমার টেনশনে তাঁর শরীর আরও খারাপ হতে শুরু করে। অতিরিক্ত চিন্তা থেকে প্রথমে রক্তচাপ ও পরে সুগার বাসা বাঁধে শরীরে।
তারপর এল সেই প্রথম হার্ট অ্যাটাক।
গত কয়েকদিন ধরে বুকের বাঁ-দিকটাতে নাকি চিনচিনে ব্যাথা করছিল একটা। নিজে ডাক্তার হলেও কোনো এক অদ্ভুত জেদে এর চিকিৎসা করাতে রাজি হন নি আনন্দমোহন। ধূমপানের অভ্যাসও বজায় রেখেছিলেন আগের মতন।
সেদিনটা রবিবার বলে তমালবরণ বাড়িতে ছিলেন। সকালবেলা নিজেই সাইকেল চালিয়ে একটু দূরের একটা দোকান থেকে সিগারেট আনতে গিয়েছিলেন আনন্দমোহন। বুকে ব্যথার জন্য ফিরে এলেন সিগারেট না কিনে। এসে শুয়ে পড়লেন বিছানায়।
তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকা হল। তমালবরণ-ই ডাকলেন।
হাসপাতালে তিন দিন কাটিয়ে ফিরে এলেন আনন্দমোহন।
এই তিন দিন বাড়ি, হাসপাতাল করে করে ক্লান্ত তমালবরণ জোয়ান বয়স হওয়া সত্ত্বেও অসুস্থ বোধ করছিলেন। পরিষ্কার মনে আছে, সেদিন দুপুরবেলা খাবার পর বিছানায় মাথা রেখে যখন ঘুম থেকে ওঠেন তখন রাত ন’টা । শরীরের এত ঘুমের দরকার ছিল যে রাতে খাওয়াদাওয়ার পর আবার ঘুমিয়ে পড়তেও অসুবিধে হয় নি।
এই দ্বিতীয়বারের ঘুমটা হল ছেঁড়া ছেঁড়া। আজেবাজে সব স্বপ্নে ভর্তি।
স্বপ্ন দেখলেন তাঁর কলেজের প্রিন্সিপাল অলোক দাশগুপ্তর সাথে রাত্তিরবেলা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। তাঁর হাতে একটা বন্দুক তুলে দিচ্ছে এডিজি স্যার। জঙ্গলের শেষে একটা ঘাসজমি। সেখানে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে একটা বড় গাছের গায়ে বাঁধা অবস্থায় রয়েছেন আনন্দমোহন। মুখের উপর চাঁদের আলো পড়ছে আনন্দমোহনের। প্রিন্সিপাল বলছেন যে গুলি আনন্দমোহনের শরীরে না লাগলে বন্দুকটা কেড়ে নেওয়া হবে তাঁর কাছ থেকে।
মিউ মিউ করে প্রতিবাদ করছেন তমালবরণ। এডিজি স্যারকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন যে বাবাকে ভেদ করে গুলিটা গাছে লাগবেই আর গুলি লেগে এতবড় গাছটা মরে যাক সেটা তিনি চান না।
ধড়মড় করে উঠে বসলেন তমালবরণ।
বাইরে অল্প অল্প আলো ফুটছে। পাখির ডাক শুরু হয়ে গেছে গাছে গাছে।
আজ আরও একবার তমালবরণের মনে হল যে এডিজি স্যারের মুখের সাথে, বিশেষ করে কপাল আর ভুরুজোড়াতে, অঘোরনাথের সাথে বেশ মিল আছে।
হার্ট অ্যাটাকের পর আচরণে পাগলাটে হয়ে গেলেন আনন্দমোহন।
পাগলামির প্রথম লক্ষণ হল চোরের ভয়। বাড়ির সব দরজা, জানলা বন্ধ আছে কিনা দিনের মধ্যে ষোলবার করে নিজে যাচাই করে দেখতেন আনন্দমোহন, কাউকে বিশ্বাস করতেন না। বলা বাহুল্য এতবার করে এই সব নিজে দেখতে হত বলে রোগী দেখা আর সম্ভব হয়ে উঠত না তাঁর।
পাগলামির দ্বিতীয় লক্ষণ হল রাত্রে না ঘুমোনো। রোজ রাতে বিছানায় শুতে যেতেন আনন্দমোহন নিয়মমতন। কিন্তু সামান্য শব্দ হলেই উঠে বসতেন বিছানায়। তারপর আবার সারা বাড়ি চক্কর মেরে মেরে পরীক্ষা করে দেখতেন বাড়ির সব দরজা আর জানলা বন্ধ কিনা।
পাগলামির তৃতীয় লক্ষণ হল আপনমনে বিড়বিড় করা। যখনই সময় পেতেন বাড়ির কোনো একটা বারান্দায় পায়চারি করতে করতে বিড়বিড় করতেন আনন্দমোহন। বাড়ির কেউ এই অবস্থায় কিছু জিজ্ঞাসা করলে মুখ রাগে লাল হয়ে যেত তাঁর -- “আমি ঠিক আছি। আমারে লইয়া ভাবনের কি আছে এত?”
আরো মাস তিনেক পরে দেখা দিলো সর্বশেষ লক্ষণ: সন্দেহবাতিক আর অহেতুক আতঙ্ক। হার্ট অ্যাটাকের রোগী সিঁড়ি ভেঙে দু-দুতলা পেরিয়ে ছাতে উঠছে ছাতের দরজা বন্ধ আছে কিনা দেখতে। কারুর বারণ শুনছে না। ধরা পড়লে তখন আর রাগারাগি নয়, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতেন যে তাঁকে ধরেছে তার দিকে, যেন কোনো বাচ্চা মিষ্টি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে, “চুপ! চুপ! কাউরে যেন কইস না!”
বাড়ির লোকে শাসন করতে গেলে চোখে মুখে একটা আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠত আনন্দমোহনের।
“মাইরা ফ্যালবে! মাইরা ফ্যালবে আমারে” -- এই বলে পালানোর চেষ্টা করতেন অন্যদিকে।
বলা বাহুল্য এরকম রসাল সংবাদ পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে গোপন থাকে না। অন্য পেশা হলে হয়তো এই একটু আধটু পাগলামি লোকে মেনে নিতো, কিন্তু যেহেতু ডাক্তারের কোনো মার্জনা নেই. আনন্দমোহন-ও তাই খেপা ডাক্তার অপবাদ কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। শেষের দিকে পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েরাও পিছনে লাগত তাঁর।
সৌভাগ্যবশত এই পিছনে লাগা বেশি দিন সহ্য করতে হয় নি তাঁকে আর তাঁর পরিবারকে। বিড়বিড় করা শুরু হবার বছরখানেকের মধ্যে এক রাতে ঘুমের মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আনন্দমোহন।
যেদিন মারা যান সেদিন সকালে বাড়ির সবাইকে সদর্পে বলেছিলেন আনন্দমোহন, “ভগবান বিষ্ণুরে দ্যাখলাম কাল রাতে, জি টি রোডে। আমাগো বাড়ি আইতে কইলাম, হাইস্যা বললেন, ‘আজ নয়, আগে তুই আমার বাড়ি আয়, তার পরে আইব আনে!’”
বি.এ. পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস না পেলেও, যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট করলেন তমালবরণ।
ইতিহাস বিষয়টি তাঁর নিজের ইচ্ছেয় নেওয়া। দাদা পলাশবরণ বারবার বলেছিলেন অর্থনীতি নিয়ে পড়তে, পড়লে ছোটো ভাইকে সাহায্য করতে পারবেন বই আর ক্লাসনোটস দিয়ে।
কিন্তু বইপত্র কেনার খরচ বাঁচলেও অর্থনীতি নিয়ে পড়াতে তমালবরণের উৎসাহ ছিল না। দাদার পড়ার বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখে এই অর্থনীতি বিষয়টা বেশ শুকনো লেগেছিল তাঁর। মজা এই যে সাতবেড়িয়ায় স্কুলে পড়ার সময়ে ইতিহাস বিষয়টিকেও বেশ শুকনো মনে হত তাঁর। কিন্তু দেশভাগ আর পরবর্তী জীবনসংগ্রাম একটা বড় ধাক্কা দিয়েছিল তাঁর অন্দরে।
কেন মানুষে মানুষে এত বিবাদ? কেন এত লড়াই? কেন এইভাবে এক দেশ ছেড়ে অন্য আর এক দেশে গিয়ে কঠিন জীবনসংগ্রাম করতে হয় পৃথিবীর এত লোককে?
তমালবরণ নিজের মত করে উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে গেছেন এই সব প্রশ্নের। যেটুকু বুঝেছেন, পৃথিবীর প্রায় সব ঝগড়া, সব দলাদলি আর লড়াইয়ের উৎস অবিশ্বাস আর এই অবিশ্বাসের মূল অনেক সময়ই লুকিয়ে রয়েছে সুদূর অতীতে। এই অতীতকে না জানলে কেমন করে তাহলে বোঝা যাবে দোষটা আসলে কার? কেউ তাঁকে শেখায় নি, কেউ বলে নি তাঁকে এসব কথা, নিজে নিজেই তিনি ঠিক করে নিয়েছিলেন যে শরদিন্দুর ব্যোমকেশের মতন সত্যান্বেষী হবেন তিনি, তবে একটু অন্য ধরনের সত্যান্বেষী। অতীতের গভীরে গিয়ে খুঁজে বের করবেন তিনি যে কার দোষে তাঁদের মতন যারা নির্দোষ তাঁদের শাস্তি পেতে হয় কোনো ঘটনা ঘটবার বহু যুগ পরে।
কলেজে ইতিহাস পড়তে পড়তে ক্রমাগত এই সব প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন তিনি। কলেজ বা ইউনিভার্সিটির টেক্সট বইয়ের মধ্যে সব প্রশ্নের জবাব নেই।
সেজন্য মনে মনে তমালবরণ ভেবে রেখেছিলেন যে প্রথমে এম এ পড়া শেষ করবেন। তারপর ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করবেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয়ও ভেবে রাখা ছিল আগে থেকেই -- বিগত একশ বছরে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের বিবর্তন। এই বিবর্তনই জীবনের গতিমুখ পাল্টে দিয়েছে তাঁর। তাই কেন এই বিবর্তন তা গভীরভাবে না জানলে শান্তি পাবেন না তিনি।
বাবার মৃত্যু আবার পাল্টে দিলো তাঁর জীবনের গতিমুখ।
সৌভাগ্যবশত, পলাশবরণ ততদিনে ইটাচুনা কলেজে অধ্যাপনার কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। বর্ধমান রাজ কলেজে পড়ানোর চাকরি নিয়ে চলে আসবার একটা জোরদার সম্ভবনাও তৈরী হয়েছে সম্প্রতি।
তবু একা দাদার অর্থে সংসার চলবে আর তিনি নিজে শুধু লেখাপড়া করে যাবেন এটা মেনে নেওয়া যায় না। এম এ যদি পড়তেই হয়, তাহলে সেটা প্রাইভেটে। আর নিজে অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ স্বাধীন না হতে পারার আগে কোনো গবেষণা নয়।
একটা চাকরি দরকার তাঁর, এক্ষুনি।
তমালবরণের প্রথম চাকরিটি করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর কলেজের প্রিন্সিপাল অলোক দাশগুপ্ত।
তমাল তাঁর প্রিয় ছাত্র। ক্লাসে এবং ক্লাসের বাইরে প্রচুর তর্ক করতেন বলে তাঁকে স্নেহ করতেন এডিজি অর্থাৎ অলোকবাবু। অন্য ছাত্রদের কাছ থেকে খবর পেলেন যে তমাল এম এ-র ফর্ম ভরে নি। খবর দিয়ে ডেকে পাঠালেন তমালবরণকে:
-- কি ব্যাপার, তমাল, ফর্ম ফিল আপ করো নি? পড়াশুনো ছেড়ে দিচ্ছো নাকি?
মাথা নিচু করে তমালবরণ তাঁর অসুবিধার কথা জানালেন। শুনে গম্ভীর হলেন অলোকবাবু, বললেন, “পড়া চালিয়ে যাওয়া কি একেবারেই অসম্ভব? দুটো তো বছর! দেখো, যদি কোনো রকমে ম্যানেজ করতে পারো।”
দু সপ্তাহ পরে এক রবিবারের সকালে বাড়ি হানা দিলেন অলোকবাবু।
-- তমাল, তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো বসিরহাট চলে যাও। আমার শ্বশুরবাড়ি বসিরহাটে। ওখানে আমার বড় শালার অনেক চেনাশোনা। বসিরহাট গভর্নমেন্ট স্কুলের সেক্রেটারি ও। ও বলেছে ওই স্কুলে তোমাকে এখনই একটা চাকরি করে দিতে পারবে ও।
কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল তমালবরণের। অলোকবাবুকে কিছু বলার আগেই উনি একটু হেসে বললেন, “শোনো, এই নিয়ে অন্তত কোনো তর্ক করো না আর। পারলে কালকেই গিয়েই দেখা করো। আমি একটা চিঠি লিখে এনেছি। গিয়ে ওই চিঠিটা ওকে দিও।”
এই বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আবার তমালবরণের দিকে ফিরে গম্ভীর মুখে অলোকবাবু বললেন, “ওখানে যাবার তিন বছরের মধ্যে তোমার এম এ’র সার্টিফিকেটটা এনে আমাকে দেখাবে। না দেখাতে পারলে আবার চিঠি লিখব আমার বড় শালাকে, তোমাকে ভাগিয়ে দেবার জন্য!”
আবার বাড়িছাড়া। এবার আর সকলের থেকে আলাদা হয়ে।
বসিরহাটের একটা ছোট্ট দোতলা হোটেলে মেস করে আরও কয়েকজন চাকুরিজীবীর সাথে থাকা। মেসের বাকিরা প্রায় সকলেই কলকাতা বা তার কাছাকাছি কোনো এলাকার বাসিন্দা, এক-দুজন আশেপাশের গ্রামের। নিয়ম করে প্রতি শনিবার বিকেলে বাড়ি যায় তারা। সোমবার সকালে ফেরে।
বসিরহাট থেকে বর্ধমানের দূরত্ব অনেক বেশি। ভোরবেলা বেরোলে দুপুরের আগে পৌঁছানো যায় না। তবু মাসে একবার অন্তত বাড়ি যাবার চেষ্টা করেন তমালবরণ।
হোটেলে থাকার অনেক অসুবিধে। মালিক খাবারদাবার যা দেয় মুখে তোলা যায় না। মেনু বলতে প্রায় রোজ ট্যালট্যালে মাছের ঝোল আর ভাত। ঝোলের মধ্যে মাছ খুঁজে পেতে অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে। কখনো কখনো ডাল বা মরসুমি সবজি থাকে সাথে। আর মালিকের মন কোনোদিন ভালো থাকলে একটু আলুভাজা।
এসব মেনু-টেনু নিয়ে অবশ্য খুব একটা মাথা ঘামান না তমালবরণ। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন যে কিছুতেই তিন বছরের বেশি এখানে থাকবেন না। প্রাইভেটে এম এ পরীক্ষা দেবেন এখান থেকে, তার প্রস্তুতি শুরু করবেন এখন থেকেই। মোটামুটিও যদি ভালো রেজাল্ট করতে পারেন, অন্য কোনো চাকরি জুটিয়ে নেবেন বর্ধমানের আরও কাছাকাছি।
থাকার বা খাবার বন্দোবস্ত যেমনই হোক, এখানে এসে তাঁর একটা বড় পাওনা এই স্কুল আর তার হেডমাস্টারমশাই মৃত্যুঞ্জয়বাবু। বসিরহাট শহরের প্রবাদপ্রতিম ইংরেজির শিক্ষক মৃত্যুঞ্জয়বাবু। সারা বসিরহাট শহর এক ডাকে চেনে তাঁকে। এই শহরের বিগত প্রায় পঁচিশ বছরের সমস্ত ভালো ছেলেরা তাঁর নিজের হাতে তৈরি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে প্রথম সারির ছাত্র ছিলেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু। তাঁর মতন ছাত্রের এম এ পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে কলকাতার কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কথা। কিন্তু ছাত্র অবস্থায় কোনো এক অধ্যাপকের সাথে অনেকটা অকারণেই তর্কে জড়িয়ে পড়েন মৃত্যুঞ্জয়বাবু। নিজে পন্ডিত হলেও কুচুটে স্বভাবের ওই অধ্যাপক প্রতিশোধ নেন মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে পরীক্ষাতে একেবারে বসিয়ে দিয়ে। বসিরহাট শহরের সকলেরই এই গল্পটি জানা, তমালবরণেরও তাই এই গল্পটি জানা হয়ে গিয়েছিল স্কুলে যোগ দেবার প্রায় সাথে সাথেই।
তমালবরণ এম এ পরীক্ষায় বসতে চান শুনে বাচ্চা ছেলের মতন খুশি হয়েছিলেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু।
– বাঃ, তমাল, তুমিও তো এখন একজন ছাত্র তাহলে! খুব ভালো, খুব ভালো! একজন শিক্ষক নিজে যদি ছাত্র থাকতে পারে সেটা তার নিজের ছাত্রদের কাছে সবচেয়ে ভালো খবর।
তারপর থেকে নিয়মিত তমালবরণের পড়াশুনোর খোঁজ নিতেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু। তমালবরণের নোটের ইংরেজি ঠিক আছে কিনা দেখে দিতেন আর সেই ইংরেজি আরো ভালো করবার জন্য উপদেশ দিতেন নিয়মিত। মাঝে মাঝেই স্কুলের পরে মৃত্যুঞ্জয়বাবু তমালবরণকে ধরে নিয়ে যেতেন নিজের বাড়িতে আর একবার নিয়ে গেলে চা আর সিঙ্গারা না খাইয়ে ছাড়তেন না।
মৃত্যুঞ্জয়বাবুর সাথে সেই সব আড্ডায় একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে একটু বিচলিত হয়েছিলেন তমালবরণ। তাঁর সহকর্মীরা কেউ তাঁকে এই ব্যাপারে আগে থাকতে সাবধান করে নি। হয়তো তমালবরণের মতন মৃত্যুঞ্জয়বাবুর সাথে বন্ধু হিসেবে মিশবার সৌভাগ্য এদের কারুর হয় নি বহু বছর ধরে একসাথে কাজ করা সত্ত্বেও।
নাম মৃত্যুঞ্জয়, কে জানে সেজন্যই হয়তো মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করাটা ভদ্রলোকের একটা মস্ত বড় নেশা। আড্ডা দিতে দিতে কোনো না কোনো প্রসঙ্গে কারুর না কারুর মৃত্যুর কথা আনবেনই মৃত্যুঞ্জয়বাবু। যাদের কথা আনবেন তারা আলেক্সান্ডার বা হানিবলের মতন ইতিহাসের চরিত্র হতে পারে, হতে পারে কবি বা সাহিত্যিকদের দ্বারা কল্পিত চরিত্র, আবার কখনো বা তারা আমাদের আশেপাশের কাছের মানুষ।
তমালবরণের অনেক বন্ধুরই রাত্রে খাবার পর একটি সিগারেটের দরকার হয়। যতক্ষণ না মুখে সিগারেট পড়ছে, কেমন যেন ছটফট করতে থাকে তারা। সিগারেটটি শেষ করবার পর অবশ্য আবার সব স্বাভাবিক।
মৃত্যুঞ্জয়বাবুর ব্যাপারটাও অনেকটা ওই রকম।
কিছুক্ষণ একনাগাড়ে মৃত্যু নিয়ে বকে যাওয়ার পর মৃত্যুঞ্জয়বাবু আবার আমাদের মাটির পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। তখন বাজারদর বা অন্যান্য পার্থিব বিষয় নিয়ে কথা বলতে বা শুনতে আর কোনো অসুবিধে থাকতো না ওনার, যদিও এই সময়টাতে উনি সচরাচর পছন্দ করতেন স্কুলের সেরা ছাত্রদের নিয়ে কথা বলতে।
মৃত্যুঞ্জয়বাবুর সাথে আড্ডায় প্রথম দিনটা দিব্যি কেটে গেল রামায়ণ আর মহাভারতের সব মৃত্যুবর্ণনায়। তমালবরণকে এই প্রসঙ্গে গীতার বেশ কিছু শ্লোক আবৃত্তি করে শোনালেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু।
দ্বিতীয় দিনে ইউরোপ পারি দিলেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু। বাইবেলে, হোমারের বর্ণনায় আর রেনেসাঁস যুগের শিল্পীদের ছবিতে মৃত্যু কিভাবে ধরা পড়েছে সেই ব্যাপারে তমালবরণকে ছোটখাট ভাষণ দিলেন একটি।
তৃতীয় দিনে আবার ভারতে ফিরে এলেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু। এবার বিষয় রবীন্দ্রনাথ। একের পর এক মৃত্যু কিভাবে তাঁর ব্যক্তিজীবনকে ছারখার করে দিয়েছে আলোচনা এবার তাই নিয়ে।
চতুর্থ দিন রাশিয়ার মৃত্যুভয়হীন কসাক সৈন্যদের নিয়ে আলোচনা – “কসাকদের সেই গানটা শুনেছ তমাল, বৌ বিশ্বাস রাখে নি বলে যুদ্ধে মরতে চাইছে কসাক, অথচ নিজে মরবার এত প্রাণপণ চেষ্টা করা সত্ত্বেও শত্রুরা কেউ মারতে পারলো না তাকে, শুধু মরলো তার হাতে। এই হলো কসাক, এমনি এমনি জার্মানদের মেরে শুইয়ে দিতে পেরেছে রাশিয়া!”
পঞ্চম দিনে সারা পৃথিবী ভ্রমণ। এবারে শুধু একজন দুজন মানুষের মৃত্যু নয়, মৃত্যুর ব্যাপ্তি আরো অনেক বেশি। বিষয় গণহত্যা। চেঙ্গিস খান, নাদির শাহ, তৈমুর লং থেকে শুরু করে অবশেষে হিটলার আর এটম বোমাতে এসে থামা।
এরকম আরো একটা দিনের কথা বেশ মনে আছে তমালবরণের। সে দিনটাতে ছুটির পরে রীতিমতন কথা বলার মুডে ছিলেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু।
– কি ছেলে সব, তমাল! ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর “উই আর সেভেন” পড়াচ্ছিলাম, ছোঁড়া আগাগোড়া খাতায় বানান লিখেছে Whatsword. গৰ্জন করে বললাম, বইটা কি একবারও খুলেছিলি, উল্লুক? দেঁতো হাসি হাসলো এমন যে মার দিতে গিয়ে আমার নিজেরও কেমন যেন হাসি পেয়ে গেল!
হো হো করে প্রাণ খুলে হাসলেন তমালবরণ, আড্ডাটা আজ মনে হচ্ছে একটু অন্য দিকে যাবে, কিন্তু তমালবরণ কিছু বলে উঠবার আগেই আবার কথা শুরু করলেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু,
“ছোঁড়ার বাপও, জানো তো, কর্মী পুরুষ, সাত-সাতখানি ইস্যু তার এই অল্প বয়েসেই, ঠিক কবিতাটার মতনই। একদম আঠার বছর বয়েস থেকেই কাজে নেমে পড়েছে। ওকেও তো পড়িয়েছি বিশ বছর আগে, এখন লংকা বেচে বাজারে। বল দেখি, এই ছোঁড়াকে তুমি এই কবিতার ভিতরের মানে কি করে বোঝাবে? একটা বাচ্চা মেয়ে যে মৃত্যু কাকে বলে জানেই না, এটুকু বুঝবার মতন বুদ্ধিও নেই ছোঁড়ার!
তমালবরণ ততদিনে বুঝে গেছেন যে নিজের লাইনে ঢুকে পড়েছেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু। এখন বেশ কিছুক্ষণ ওনাকে থামানোর চেষ্টা করা বৃথা।
– আর ছোঁড়াটাকেই বা দোষ দেই কি করে? জানো, একবার আমার শ্বশুরমশাই যখন খুব অসুস্থ, কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি, ওনাকে দেখতে গিয়ে ওখানকার ক্যান্টিনে চা খেতে ঢুকেছিলাম ফেরার সময়। এক ছোকরা ডাক্তার দেখি কাঁচুমাচু মুখে অন্য কয়েকজনকে বলছে, “এই! তাড়াতাড়ি বলতো মরার সাইনগুলো কি কি!” বোঝো! জ্যান্ত না মরা তাই বুঝতে পারছে না, নিজে ডাক্তার হয়ে? বলি, তাহলে ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর কবিতার মেয়েটি আর কি দোষ করলো? সে তো আর মুশকো জোয়ান নয় ওই ডাক্তারের পো এর মতন, একটা বাচ্চা!
এতগুলো কথা প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে বোধহয় মৃত্যুঞ্জয়বাবুর এবার খেয়াল হলো যে একসাথে অনেক কথা বলে ফেলেছেন তমালবরণকে।
– মরুক গে এরা সব, আমাদের প্রায় সব কটা ছাত্তরই তো ওই ছোঁড়াটার মতন, কিস্যু হবে না ওদের দ্বারা, দু দিন বাদে সেই লংকাই বেচবে বাজারে। তুমি বরং প্রশান্তর কথা বল। প্রিপারেশন কেমন বুঝছ ওর? স্ট্যান্ড করবে?
মফস্বলের স্কুল বলে বসিরহাট গভর্নমেন্ট স্কুলকে অবহেলা করার কোনো জায়গা নেই। স্কুলের সাধারণ ছাত্রদের পড়াশুনোর মান অন্যান্য মফস্বল শহরের মতন হলেও প্রতি বছর একটি দুটি ছেলে এই স্কুল থেকে অসাধারণ রেজাল্ট করে। এই ভালো রেজাল্টের অন্যতম কারণ মৃত্যুঞ্জয়বাবুর সেই ছাত্রদের পিছনে আঠার মতন লেগে থাকা। ক্লাস নাইন আর টেনে মৃত্যুঞ্জয়বাবু নিজে ইংরেজি পড়ান। জহুরির মতন তাঁর চোখ ঠিক চিনে নেয় ভালো ছাত্রদের। তারপর থেকে শুধু নিজে নয়, স্কুলের অন্যান্য ভালো শিক্ষকদেরও লাগিয়ে দেন তাদের পিছনে। সেই প্রথম দিন থেকেই মৃত্যুঞ্জয়বাবু কি ভাবে জানি না বুঝে গিয়েছিলেন যে তমালবরণ নিজে ছাত্র হিসেবে ভালো। তাই তমালবরণকেও প্রথম দিন থেকে লাগতে হয়েছে এরকম কাজে।
এই স্কুলের এবছরের সেরা ছাত্র প্রশান্ত। আগাগোড়া ক্লাস ওয়ান থেকে এই স্কুলে ফার্স্ট হয়ে আসছে প্রশান্ত। অনেক আশা ভরসা মৃত্যুঞ্জয়বাবুর প্রশান্তর উপর। ওনার দৃঢ় বিশ্বাস যে সঠিকভাবে গাইড করলে প্রশান্ত কলকাতার সেরা ছাত্রদের সাথে পাল্লা দিতে পারবে। তমালবরণের নিজেরও সেই একই বিশ্বাস। অসাধারণ স্মৃতিশক্তি প্রশান্তর। কোনো জিনিস একবারের বেশি দুবার বোঝাতে হয় না ওকে। তমালবরণ দেখেছেন ওকে যা যা পড়তে বলেন, সেগুলো তো ও পড়েই, এছাড়াও পড়ে আরো অনেক কিছু। ছবির মতন হাতের লেখা। ওর পরীক্ষার খাতায় কোনো লাল কালির দাগ দেওয়া যায় না।
প্রশান্তর উপর অনেক আশা ছিল মৃত্যুঞ্জয়বাবুর। সেই আশা অবশ্য পূর্ণ হয় নি। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে গিয়ে দ্বিতীয় বছরের মাথায় খুন হয় প্রশান্ত। ততদিনে বসিরহাট ছেড়ে আবার বর্ধমানে ফিরে গেছেন তমালবরণ, খবরের কাগজে বেরিয়েছিল ব্যাপারটা, তাই জানতে পেরেছিলেন। কলেজের একটি সুন্দরী যুবতীর প্রেমে পড়েছিল প্রশান্ত, সেই মেয়ের অপর এক একতরফা প্রেমিক ছিল উত্তর কলকাতার এক কুখ্যাত গুন্ডা।
খবরটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তমালবরণ। যত না দুঃখ হয়েছিল, রাগ হয়েছিল অনেক বেশি। মনে মনে অজস্রবার সেই গুন্ডাটির শরীরের সব হাড় ভেঙে চুরমার করছিলেন শুধু। এই রাগের রেশ রয়ে গিয়েছিল পুরো একটা দিন। মনে মনে এ ও বুঝতে পারছিলেন তমালবরণ যে এই রাগ তাঁর নিজেরই ক্ষতি করছে, আর কারুর নয়। তবু কিছুতেই মাথার থেকে তাড়াতে পারছিলেন না ঘটনাটা। রাতের বেলা বিছানায় শুয়েও প্রশান্তর ব্যাপারটা মাথায় আসছিলো ক্রমাগত।
পরের দিন ভোরের আলো ফোটারও অনেক আগে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন তমালবরণ । শরৎকালের ভোরের রাঙা আকাশ আর বাড়ির বাগানে ফোটা শিউলি ফুলের গন্ধ তাঁর গতকালের ক্ষতবিক্ষত মনে প্রলেপ লাগিয়ে আবার তাঁকে চাঙ্গা করে তুলতে পেরেছিলো সেদিন।
প্রশান্তর ঘটনাটি ঘটার বহু আগেই অবশ্য চাকরি থেকে রিটায়ার করেছিলেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু। রিটায়ারমেন্টের পর বসিরহাট ছেড়ে লিলুয়াতে নিজেদের পৈতৃক বাড়িতে চলে যান তিনি। সময়ের নিয়মে তাঁর সাথে তমালবরণের যোগাযোগও ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তখন। তাই আজও তমালবরণ জানেন না প্রশান্তর মৃত্যুর খবরটা মৃত্যুঞ্জয়বাবু শেষ পর্যন্ত পেয়েছিলেন কিনা।
বসিরহাটে স্কুলের কাজ শেষ করে একবার মেসে ফিরে এলে বাকি প্রায় সারাটা সময় তমালবরণের এখন কাটছে এম এ পরীক্ষার প্রস্তুতিতে। প্রথমদিকে মেসের সঙ্গীরা তাঁকে তাস আর দাবার আড্ডায় ভেড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন বাদে তারা বুঝে যায় যে ওসব করে অযথা সময় নষ্ট করবেন না তিনি। তাই বলে এদের কারুর সাথে খারাপ ব্যবহার করেন নি তিনি। সকলের সাথেই একটা আলগা ঠাট্টা তামাশার সম্পর্ক রয়েছে তাঁর। রাত্রে খাবার পর আধঘন্টার মতন সকলের সাথে একটুখানি আড্ডাও মারেন কাজে বসার আগে।
একটা টেবিল ল্যাম্প কিনে নিয়েছেন তমালবরণ এখানে বড় রাস্তার মোড়ের সুধীরের দোকান থেকে।
রাত্রে অনেকক্ষণ ধরে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে কাজ করেন তমালবরণ। কিপ্টে হোটেলওয়ালা ভূদেববাবু একবার অতিরিক্ত ইলেকট্রিক বিল নিয়ে কথা শোনাতে এসেছিল। তমালবরণ সাথে সাথে ভূদেববাবুর সামনেই হিসেব করেন রোজ চার ঘন্টা একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বালালে কত খরচ হতে পারে। গম্ভীরভাবে ভূদেববাবুকে বলেন এখন থেকে প্রতি মাসে তিনি এই টাকাটাও থাকার আর খাওয়ার খরচের সাথে দিয়ে দেবেন।
তমালবরণ এত সহজে অতিরিক্ত খরচ করতে রাজি হওয়াতে ওনার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায় ভূদেববাবু। তারপর একটু লোক দেখানো সংকোচ করতে থাকে,
-- না, না, আমি টাকার জন্য বলি নি।
-- তবে কিসের জন্য বলছিলেন? আমার গেঞ্জি-জাঙ্গিয়ার জন্য? বলছি তো, আমার জন্য যেটুকু বেশি খরচ হচ্ছে আপনার সব আমি দিয়ে দেব। একদম কথা শোনাতে আসবেন না আমাকে।
ভূদেববাবু আসলে বোধ হয় এত তাড়াতাড়ি টাকার প্রস্তাব আসার জন্য তৈরি ছিলেন না। ভেবেছিলেন ঝগড়া করে দু কথা শোনাবেন তমালবরণকে যাতে এর পরে আর বাজে খাবার নিয়ে কোনো অভিযোগ না তুলতে পারেন তমালবরণ। স্ট্র্যাটেজি ফেল করায় মাথা নিচু করে চুপচাপ একতলায় নেমে আসেন ভূদেববাবু।
এরপর থেকে তমালবরণ লক্ষ্য করেন যে মেসে সবচেয়ে বড় মাছের টুকরোটি ভূদেববাবু আলাদা করে তাঁর জন্য তুলে রাখা শুরু করেছে।
বিকেলবেলা একটু হাঁটতে বেরোন তমালবরণ।
বসিরহাট শহরটার প্রাণ ইছামতী নদী।
এই নদী নিয়ে বাংলা সাহিত্যে কবিতা, গল্প বা উপন্যাসের খামতি নেই কোনো। এই নদীর নামের মধ্যেই একটা কিছু আছে, কোনো একটা জাদু।
হাঁটতে হাঁটতে প্রায়ই ইছামতীর ধারে চলে আসেন তমালবরণ। যতক্ষণ থাকেন চেষ্টা করেন এই নদীর অপ্রাকৃত সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে। লোকে বলে সব দুঃখ, সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে পারে এই নদী।
সত্যিই পারে কি? কেন তবে অন্য পারের দিকে তাকালে মনটা হু হু করে ওঠে।
ইছামতীর অন্য পারে বাংলাদেশ। তমালবরণের একসময়ের দেশ।
সেই দেশে যেতে গেলে অন্যের অনুমতি নিয়ে যেতে হবে এখন, যার অন্য গালভরা নাম পাসপোর্ট।
না, তমালবরণ অঘোরনাথের নাতি। ভিখারির মতন অন্য কারুর কাছে হাত পাতবেন না। এমনকি নিজের দেশের জন্যও নয়।
এম এ পরীক্ষার শেষ পেপারটা দেবার পরদিন বিকেলে ইছামতীর ধারে গিয়েছিলেন তমালবরণ।
দেখতে দেখতে প্রায় তিন বছর কেটে গেল বসিরহাটে।
আগামীকাল ভোরে বর্ধমান যাবেন তমালবরণ। দিন তিনেক থাকবেন। অধ্যাপক অলোক দাশগুপ্তর সাথে দেখা করে জানাতে হবে যে তিনি কথা রেখেছেন। বর্ধমানের আশেপাশে চাকরির কোনো খবর সংবাদপত্রে নেই, তবু এই তিন দিনের মধ্যেই যতজনের সঙ্গে পারেন কথা বলে দেখবেন বর্ধমানের আশেপাশে অন্য কোনো চাকরি জোটে কিনা।
আজ আর পড়াশুনোর চাপ নেই ফিরে।
ফিরতে ফিরতে তবু রাত হয়ে গেল। সময় ভুলিয়ে দিতে পারে ইছামতী।
হোটেলে ফিরতেই হোটেলওয়ালা ধরলো, “কোথায় ছিলেন মশাই? টেলিগ্রাম আছে আপনার!”
দাদার টেলিগ্রাম। চারটে মাত্র শব্দ। “Mother expired. Come immediately.”
বাড়ির দিকের আমগাছটার মগডালের কাছাকাছি কোথাও একটা লাল বুলবুলি পাখির বাসা আছে। ছানা হয়েছে ওদের। ভালো করে কান পাতলে কখনো কখনো ওদের চিঁ চিঁ করে ডাক শোনা যায়। মা পাখি আর বাবা পাখির কাজ বেড়েছে। এই সাতসকালে ছানাদের জন্য পোকা বা কেঁচো সংগ্রহে ঘুরছে জোড়ার একটা, খুব সম্ভবত বাবা পাখিটা। মাঝে মাঝে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে আশেপাশে।
এই জন্ম জিনিসটার সাথে মৃত্যুর কোথাও যেন একটা গভীর সংযোগ রয়েছে। যেমন কিংশুকের জন্ম। জন্ম দেবার সময় রক্তচাপ হঠাৎ করে খুব বেড়ে যায় কৃষ্ণার। বেশ কিছুক্ষণ যমে মানুষে টানাটানি চলেছিল সেবার। কৃষ্ণার এই অতিরিক্ত রক্তচাপের প্রবণতার জন্য বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন ডাক্তাররা, দ্বিতীয় কোনো বাচ্চার জন্ম না দেবার জন্য। তাঁদের দুজনেরই ইচ্ছে ছিল ফুলের মত ফুটফুটে একটি মেয়ের। সেই ইচ্ছে এ জীবনে আর পূর্ণ হল না।
এমন কত ইচ্ছেই যে অপূর্ণ রয়ে গেল এ জীবনে। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে।
প্রসবের সময় ডাক্তারদের মূল নজরটা কৃষ্ণার উপর থাকার জন্য বোধ হয় জন্মের পরে পরেই কিছুটা অবহেলিত হয়েছিল কিংশুক। দুঃস্বপ্নের মতন কেটেছিল কয়েকটা দিন। কৃষ্ণা আর কিংশুককে রিকশায় করে বাড়ি নিয়ে আসার দিনটাতে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন তমালবরণ।
মজাটা হল, এর ঠিক তিন দিন পরে নিজেই প্রায় মরতে চলেছিলেন তমালবরণ। রাত ন’টার সময় বাদামতলার কাছে এক মাতাল ট্রাক ড্রাইভার ইঁট ভর্তি একটা ট্রাক নিয়ে প্রায় তাঁর ঘাড়ের উপর এসে পড়ছিল। শেষ সময়ে টের পেয়ে সরিয়ে নিতে পেরেছিলেন সাইকেল সমেত নিজেকে। কিন্তু নিজেকে পুরোপুরি বাঁচাতেও পারেন নি। ধাক্কা এড়াতে তীব্রভাবে অকস্মাৎ বাঁক নেবার ফলে সাইকেল সমেত মাটিতে আছড়ে পড়েছিলেন তমালবরণ। রাস্তায় ঘষা লেগে হাত আর পায়ের তিন-চার জায়গা ভালো মতন ছড়ে গিয়েছিল তাঁর। তবে সৌভাগ্যবশত এর বেশি আর কিছু হয় নি।
নলিনী দলগত জলমতি তরলম -- একটু অসতর্ক হলেই পদ্মপাতা থেকে জলের মতন ঝরে পড়বে জীবন।
আজ বাবা-পাখিটার এত সতর্কতা দেখে নিজের কথা মনে পড়ল আবার। বিশাল দায়িত্ব আজ পাখিটার কাঁধে। চতুর্দিকে শিকারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে পাখির বাচ্চার, হয়তো বা তার মা-বাবার-ও সন্ধানে।
মা-বাবা মরলে বাচ্চাগুলোও মরবে।
যতদিন না বাচ্চারা উড়তে শেখে, মা বা বাবার মরেও মুক্তি নেই।
জবুথবু ভালোমানুষ ধরনের কিংশুক উড়তে শিখেছিল অন্য বাচ্চাদের তুলনায় অনেক দেরিতে। কখনো কোনো বাজে নেশা করে নি কিংশুক, পাড়ার বা বেপাড়ার মেয়েদের কখনো জ্বালায় নি। সিনেমা বা থিয়েটার কতদিন দেখতে গেছে তা হাতে গুনে বলে দেওয়া যায়। বিকেলবেলা ঘন্টাখানেক খেলাধুলা বা সাইকেল চালানো ছাড়া সাধারণত বাড়ি থেকে বেরোত না কিংশুক। বাকি সারাটা সময় বারান্দাতে বা ছাতে বই হাতে ঘুরে ঘুরে পড়াশুনো করতো।
পাড়াপ্রতিবেশীরা, বন্ধুরা, আত্মীয়-স্বজনেরা সকলেই এই নিয়ে সুখ্যাতি করত তাঁর আর কৃষ্ণার কাছে, “কিংশুকের মতন ভালো ছেলে আজকের দিনে বিরল”, “ওর মতন ছেলে থাকলে আপনার আর চিন্তা কি?” “আপনার পুত্র-ভাগ্য সত্যি হিংসে করবার মত, তমাল-দা!”।
সবার মুখে এই ধরনের কথা শুনলে কোন মা-বাবারই বা খারাপ লাগে?
তবু তমালবরণ চিন্তা করতেন।
ছেলে বড় হচ্ছে, স্কুলে ভালো রেজাল্ট-ও করছে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে পুরুষ হচ্ছে কি? বন্ধু-বান্ধবেরা সবসময় এত কেন ওর পিছনে লাগবার সাহস পায়?
হোস্টেলে যাবার পর এক ধাক্কায় বদলে গেল কিংশুক।
মুখে কোনোদিন কারুর কাছে বলেন নি, তবু তমালবরণের খুব ভয় ছিল কিংশুককে নিয়ে। ভয়টা পড়াশুনো নিয়ে নয় -- পারবে তো ছেলে মানিয়ে নিতে সকলের সঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতার স্মার্ট ছেলেদের সাথে?
আনন্দের সাথে লক্ষ্য করেছিলেন তমালবরণ যে জলে মাছের মতন কেমন কলকাতার সাথে একাত্ম হয়ে পড়েছে কিংশুক। একটু কি বেশি দ্রুত হয়ে গিয়েছিল সেই একাত্ম হওয়া?
প্রথম প্রথম ওর মা-মাসি-কাকিমা-জ্যেঠিমারা হোস্টেলের সুবিধে অসুবিধে, থাকা খাওয়া এসব নিয়ে প্রশ্ন করত অসংখ্য। প্রতিবারই গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ত কিংশু, “হোস্টেলে কি সব সুবিধে পাবে? কিছু তো মানিয়েও নিতে হবে!”
পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে দ্রুত মানিয়ে নিলো কিংশুক।
বাড়ি আসত না দিনের পর দিন। কোনো এস টি ডি নয়, চিঠি লেখার তো কোনো প্রশ্নই নেই।
এই নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করলে রাগে মুখ লাল হয়ে যেত ওর।
ব্যাপারটাকে খুব বেশি পাত্তা দেন নি তমালবরণ। কৃষ্ণা এই নিয়ে অনুযোগ করলে ওকে হেসে বুঝিয়েছেন যে বড় হয়ে গেছে কিংশুক। এখন বাড়ির চাইতে বাইরের টান অনেক বেশি হবে ওর। বরং ছেলে যে হোস্টেলে মানিয়ে নিতে পেরেছে, পড়াশুনোতে ভালো রেজাল্ট করছে, খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বখে যায় নি, এই সব ভেবেই খুশি রাখা ভালো নিজেকে।
কিংশুকের কলকাতা থাকাটাকে খুব একটা দূরে থাকা বলে কখনো মনে হয় নি তাঁর। বাংলাদেশে থাকার সময়ও কলকাতা তাঁদের সারা পরিবারের একটা অংশ জুড়ে ছিল সবসময়। পরিবারের ছেলেরা যে একসময় না একসময় পড়াশুনোর জন্য কলকাতা কাটাবে, এ তো জানা কথা।
কলকাতা ছেড়ে কলকাতার চেয়েও অনেক দূরের কোনো শহরে যে চাকরির জন্য যাওয়া যেতে পারে এই ধারণাটা অবশ্য তাঁর ছিল না।
তারিখটা কত মনে নেই, তবে সময়টা এপ্রিলের মাঝামাঝি ছিল সেটা মনে আছে। বাংলা নববর্ষের জন্য বর্ধমানের রেলওয়ে ইনস্টিটিউট-এ কোনো একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল সন্ধ্যাবেলা, তাই ফিরতে একটু রাত হয়েছিল তাঁর বাড়িতে। ফিরে দেখেন কিংশুক এসেছে হোস্টেল থেকে।
একটা কালো রঙের প্যান্ট আর হালকা আকাশি নীল রঙের টি-শার্ট পড়েছে কিংশুক। মুখে অল্প কোঁচকানো দাড়ি। গায়ের ফর্সা রঙের সাথে খুব ভালো মানিয়ে গেছে পোশাকটা। লম্বা ছিপছিপে চেহারা কিংশুকের। গায়ের রংটা ফর্সা কৃষ্ণার দৌলতে। বাবা হিসেবে হয়তো এটা তাঁর পরিষ্কার পক্ষপাতিত্ব, তবু তমালবরণের আজ মনে হল কিংশুককে রূপবান যুবক বললে সেটা খুব অতিরঞ্জন হবে না।
-- রিজার্ভ ব্যাংক চিঠি দিয়েছে, বাবা। আজ দুপুরবেলা হাতে পেলাম।
-- কিসের চিঠি?
“তুমি না আর বদলাবে না!”, পাশের থেকে কৃষ্ণা বলল, “একটু তো ছেলের ব্যাপারে খোঁজ খবর রাখো!”
আনন্দে, গর্বে মুখ ঝলমল করছে কৃষ্ণার। কিংশুকের মুখেও একটা হালকা হাসি লেগে আছে।
একটু দূরে আর্মচেয়ারে বসে চা খাচ্ছেন পলাশবরণ। তাঁর মুখেও ঝলমলে হাসি।
-- “বল এবার, বাবা-কে! আরে, আমি নিজে ইকনমিকসের লোক, আমি বুঝব না? আমি আগেই তো তোকে বলে রেখেছিলাম, তোকে কোনোভাবেই বাদ দিতে পারবে না কেউ। বাদ দেবেই বা কোন যুক্তিতে?”
চাকরি পেয়েছে কিংশুক রিজার্ভ ব্যাংকে। গ্রেড বি অফিসারের চাকরি। একজন অর্থনীতির ছাত্রের জন্য এর চেয়ে ভালো চাকরি ভারতবর্ষে আর হয় না। শুধু মাইনে নয়, থাকার ঘরও দেবে রিজার্ভ ব্যাংক।
চাকরিটা অবশ্য কলকাতাতে নয়, রিজার্ভ ব্যাংকের মূল অফিসে, বোম্বেতে।
ছেলে পড়াশুনোয় ভালো হওয়ার পর থেকে ভিতরে ভিতরে একটা অন্য স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন তমালবরণ। অল্পবয়সে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। পার্টিশন কেড়ে নিয়েছিল তাঁর স্বপ্ন। কিন্তু তাঁর নিজের সেই অপূর্ণ বাসনা সার্থক হয়েছে তাঁর ছেলের মাধ্যমে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি এ পাস করেছে কিংশুক। শুধু পাস-ই করে নি, ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। এম এ-তেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সেরা ছাত্রদের মধ্যে একজন হতে পেরেছে কিংশুক কিছুটা অনায়াসেই।
তমালবরণ তাই স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন যে অধ্যাপনা করবে কিংশুক, বড় গবেষক হবে, ডাকসাইটে পন্ডিত হিসেবে ওর নাম ছড়িয়ে পড়বে দিকে দিকে। দেশ চালানোতে কোনো সমস্যা হলে ওর দরজায় ভিড় করবে সরকারি আমলা আর মন্ত্রীরা। প্রেসিডেন্সি কলেজের সেরা ছাত্ররা যদি সেরা গবেষক না হয়, কারা হবে তাহলে?
এ কি হল হঠাৎ করে? গবেষণার ধারকাছ দিয়েও গেল না কিংশুক? কেন? সহজ জীবনের লোভ? টাকা বা ক্ষমতাই কি জীবনের সবকিছু?
তমালবরণ তো জানেন যে জীবনে কোনো কিছুই খুব সহজে জোটে নি তাঁর।
সপ্তাহের পর সপ্তাহ লম্বা যাতায়ত করে, ঘন্টার পর ঘন্টা গ্রামের স্কুলে পড়িয়ে, রাতের পর রাত জেগে গবেষণা শেষ করতে হয়েছে তাঁকে। স্কুল থেকে কলেজ, সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় -- প্রত্যেক স্তরে লড়াই করতে হয়েছে দাঁতে দাঁত চেপে। কিংশুককে যাতে তাঁর মতন এই রক্তক্ষয়ী লড়াই না করতে হয়, শুধু সেজন্যই নিজের কোনোরকম দুর্বলতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে লড়ে গেছেন তিনি।
কিংশুককে নিয়ে তাঁর এই স্বপ্নের কথা অবশ্য কাউকে বলেন নি তমালবরণ। এমনকি কৃষ্ণাকেও নয়। সেই যুবক বয়স থেকেই, কেন জানি না আশা করতে ভয় হয় তাঁর।
আশাভঙ্গের যন্ত্রণা এক তীব্র যন্ত্রণা। একে মৃত্যু যন্ত্রণাও বলা যেতে পারে। আশার মৃত্যু। কোনো প্রাণী মরে না এতে আলাদা করে। তবু আমাদের শরীরের ভিতরে কিছু বোধ হয় মরে। হয়তো মরে যায় মগজের কোন কোনায় সঙ্গোপনে লুকিয়ে থাকা কিছু নতুন, সজীব কোষ।
আরও যন্ত্রণা এই যে নিজের এই যন্ত্রণা অন্য কারুর কাছে প্রকাশ করা চলবে না। কিংশুকের জীবন ওর নিজের। সেখানে বাবা হলেও, কোনো অধিকার নেই তমালবরণের।
সিদ্ধান্ত যা নেবার নিয়ে ফেলেছে কিংশুক। এত ভালো চাকরির অফার ছেড়ে দেবার কোনো প্রশ্নই নেই।
আরো আনন্দ এই যে কিংশুকের কলেজের দুই বন্ধু অভ্র আর অমিতাভ-ও একই সাথে রিজার্ভ ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে এবার। ফলে নতুন শহরেও একেবারে একা হয়ে পড়বে না কিংশুক।
আর মাসখানেক পরে কলকাতার পালা গুটিয়ে তাই নতুন জীবন শুরু করবে ওরা তিনজনে, দেশের অন্য প্রান্তে, বোম্বাই শহরে।
যন্ত্রণা লুকিয়ে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে তোলেন তমালবরণ, “বাঃ, খুব ভালো খবর। চিঠিটা দেখা, দেখি কি লিখেছে!”
এও তো এক ধরনের মৃত্যু।
এতদিন পর্যন্ত যে জীবনটা ছিল, সেই জীবনের মৃত্যু।
নতুন করে বাঁচতে হবে এখন। অথবা, আরো ভালো করে বলতে গেলে, নতুন করে বাঁচা শিখতে হবে। সমস্যা একটাই, বয়সটা বেড়ে চলেছে বড় দ্রুতগতিতে। নতুন জীবন মানেই নতুন সব অভ্যাস, শারীরিক যত না তার চেয়েও বেশি মানসিক। এই বয়সে সেসব খুব সহজ নয়।
বোম্বে মেল ভায়া এলাহাবাদ বর্ধমান স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাবার পর-ও তাই প্ল্যাটফর্মে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন তমালবরণ। একটু পিছনে কৃষ্ণা দাঁড়িয়ে। কৃষ্ণার চোখে জল। কৃষ্ণার জ্যাঠতুতো দিদি নীলিমা এসেছে গতকাল মধ্যমগ্রাম থেকে। কৃষ্ণার কাঁধে হাত রেখে কি যেন বলছে ফিসফিস করে। মাথার পিছনে কোনো চোখ না থাকলেও তমালবরণ সব দেখতে পাচ্ছেন, সব বুঝতে পারছেন। খালি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না কারুর সাথে।
একটা নদী দরকার এখন তাঁর। বর্ধমানের বাঁকা-র মতন প্রায় লাফিয়ে পার হয়ে যাওয়া নদী না, গহীন জলের নদী। আর দরকার একটা জঙ্গল। বারবার কেন জানি না চোখের সামনে ভেসে আসছে সাতবেড়িয়ার নদীর পাশের জঙ্গলের সেই বিশাল বটগাছটার ছবি।
শান্তি যদি এখন কোথাও থাকে তা অথৈ জলের নির্জনতায়, আশ্রয় যদি থাকে তা বিশাল কোন মহীরুহের ছায়ায়। দেখতে দেখতে প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে গেল নদী-ছাড়া তমালবরণ, চল্লিশ বছর হয়ে গেল জঙ্গল-ছাড়া। আশ্চর্য, এতগুলো দিন কেটে গেল, পুরোনো ক্ষত তবু তো মিলিয়ে গেল না।
সময় কি তাহলে সত্যি সত্যিই পারে না সবকিছু ভুলিয়ে দিতে? এতদিনেও যখন পারে নি, আর হয়তো পারবে না কোনোদিন। হয়তো শেষ সময়েও খোঁচাবে।
সেই শেষ সময়ে কোনো নদী আর জঙ্গল থাকবে না তাঁর। সেই বটগাছ হয়তো তিনি চলে যাওয়ার পরও বেঁচে থাকবে আরও অনেক অনেক দিন। অন্যদের আশ্রয় দেবে সেই গাছ, তাঁকে নয়।
পাশের থেকে কেউ একটা আলতো করে হাত রাখছে তাঁর কাঁধে। মেয়েলি, নরম হাত। ঘাড় ঘুরিয়ে নীলিমাকে দেখতে পেলেন তমালবরণ। নরম গলায় খুব আস্তে আস্তে বলছে নীলিমা, “চলুন এবার, তমাল-দা!”
একটা সবুজ রঙের শাড়ি পড়েছে আজ নীলিমা। গায়ের রং কৃষ্ণার চেয়েও ফর্সা নীলিমার। দিব্যি মানিয়ে গেছে শাড়িটা।
গেটের কাছে এসে তমালবরণ আর কৃষ্ণার দিকে চেয়ে অল্প হেসে নীলিমা বলল, “বাবুন-টা কবে যে মানুষ হবে? অফিসার হতে চললো, অথচ এখনো ব্যাগের থেকে গামছা বের করে কপালের ঘাম মুছছে!”
হাসলেন তমালবরণ।
কলকাতায় দিব্যি মানিয়ে নিয়েছিল কিংশুক। মনে তো হয়, বোম্বেতেও মানিয়ে নিতে অসুবিধে হবে না ওর, কিছুদিন পর থেকেই হয়তো শুরু হবে ওর স্যুট-টাই পরে পকেট থেকে দামি সেন্ট মাখানো রুমাল বের করে ঘাম মোছা।
সেসব অবশ্য বড় কথা নয়, বড় কথা এই যে পাখির ছানা শেষ পর্যন্ত উড়তে শিখলো। সঙ্গিনী জুটিয়ে এবার নিজে বাসা বাঁধবে, অন্য কোনো গাছে। বাবা-মায়ের এর বেশি আর কি চাওয়ার থাকতে পারে?
তবু হঠাৎ এত দুর্বল হয়ে পড়ছেন কেন তমালবরণ? আবার কেন সেই বটগাছটার ছবি ভেসে উঠছে চোখের সামনে? কোনো অন্ধমুনির পুত্রকে হত্যা করেন নি তিনি, তবু কেন রাজা দশরথের কথা মনে আসছে বারবার?
নিজের বাবার শেষ সময়ে পাশে থাকতে পেরেছিলেন তমালবরণ।
তাঁদের বংশে তিনিই হবেন প্রথম যাঁর নিজের বেলা ছেলে কাছে থাকবে না।
সকালবেলা কোনোদিন টিভি খোলে না কিংশুক। খুলবার সময়ই থাকে না হাতে। আজ যখন সময় আছে তখন এই সামান্য আনন্দগুলো পূর্ণমাত্রায় লুটে নিলে ক্ষতি কি? বহুদিন কফি খেতে খেতে টিভি দেখা হয় না, আজ নিজেকে বরং একটু সময় দেওয়া যাক। ঠ্যাংয়ে চোট। এই সব চোট-ফোট এলে নিজের যত্ন নিজেকেই করতে হবে। শরীরের অবস্থা খারাপ হলে, মন বিগড়ে থাকলে নিজেরই ক্ষতি।
একটাই সমস্যা, একবার ল্যাদ খাওয়া শুরু করলে আর উঠে অফিস যেতে ইচ্ছে করবে না। কিন্তু সেটা কি খুব বড় কোনো সমস্যা? কি আর হবে একদিন অফিস না গেলে? বছর শেষ হতে চললো, তবু এবছর এখনো অবধি মাত্র-তো তিনটে সি এল নিয়েছে কিংশুক। লেংচে লেংচে চলতে হচ্ছে এখনো -- আজ আরো একটা সিএল নিলে সমস্যা কোথায়?
নিউজ চ্যানেল মানেই সেই তর্কাতর্কি, ঝগড়া-ঝগড়ি। অত কামড়াকামড়ি ভালো লাগে না সক্কালবেলায়। এর চেয়ে গান শোনা বরং ভালো। দেখা যাক বাংলা চ্যানেলগুলোর কোনো একটাতেও ভালো কোনো গানের প্রোগ্রাম চলছে কিনা।
রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে ষ্টার বাংলাতে। শিল্পী যে কে কিংশুক জানে না, তবে ভরাট গলা।
“জীবন যখন শুকায়ে যায় …”
বেশ সুন্দর গাইছে।
কিংশুকের জীবন এখন মরুভূমির মতন শুকনো খটখটে। করুণাধারা নিয়ে কেউ আসবে এমন ভরসা নেই, অন্তত কোনো ভগবান যে আসবে না সে ব্যাপারে কিংশুক নিশ্চিত। তবু বহুদিনের পরিচিত এইসব গানগুলো নতুন করে শুনলে বেশ কিছুক্ষণ শরীরে-মনে একটা ভালো লাগার রেশ থেকে যায়। হয়তো এই ভালোলাগাটাই সেই করুণাধারা।
হঠাৎ করে তবলিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল কিংশুক। এ কি! এ যেন পুরো দাদার মুখ বসানো!
মনটা আবার হঠাৎ করে তেতো হয়ে গেল অকারণে।
গানের গলাটা বেশ ভালো ছিল দাদার। তবলাটাও মন্দ বাজাত না।
গান-টান খুব একেবারেই আসে না কিংশুকের। তাই জ্যাঠতুতো দাদা রাজু অর্থাৎ সুরঞ্জনের উপরে সামান্য ঈর্ষা ছিল ওর ছোটবেলায়।
ছোটবেলায় ঝগড়া হলেই দাদা মুখ বিকৃত করে কিংশুককে ওর বাবুন ডাকনামটা না বলে বেবুন বলে ডাকতো। শুধু তাই নয়, দাদার জন্য ওই নামটা স্কুলের সহপাঠীরাও জেনে গিয়েছিল। প্রায়ই ক্লাসে গবেষণা হত অতবড় লেজটাকে ও কিভাবে প্যান্টের মধ্যে গুটিয়ে রাখে। স্কুলের কিছু মিচকে সহপাঠী আবার আর এক ধাপ এগিয়ে ওর কিংশুক নামটাকে বিকৃত করে হিংসুক বলতো। বেবুনের সাথে মিলিয়ে ক্লাসে তাই ওর নাম হয়ে গিয়েছিল হিংসুক বেবুন। নিজের বাবুন ডাকনাম বা কিংশুক ভালোনাম, দুটোকেই তাই মনেপ্রাণে ঘৃণা করত কিংশুক। স্কুলে কেউ এই সব নামে ডাকলে মা-বাবার উপরে এক তীব্র অভিমান হত ওর|
এই বেবুন নামের জন্য, নিজের পাড়াতেও কোনো বন্ধু হয় নি কিংশুকের। খেলার মাঠে বড়োরা কেউ থাকত না বলে দাদা আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা ক্রমাগত বেবুন বলে ডেকে পিছনে লাগত ওর। শেষের দিকে খেলাধুলোয় সেজন্য একটা বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছিল কিংশুকের।
এই বিতৃষ্ণার জন্যই হয়তো কোনো খেলাতেই সেইরকম ভালো হয়ে উঠতে পারে নি কিংশুক। অভ্যাসবশে বিকেল বেলা মাঠে যেত রোজ একটা বয়স পর্যন্ত। কিন্তু রোজই দেখত যে দৌড়োনো, লাফানো, সব কিছুতেই সকলের পিছনে ও। ফুটবল বা ক্রিকেটে দল ভাগাভাগির সময় ওকে নেবার পালা আসত সবচেয়ে শেষে। এইসবের জন্য ছোটবেলার থেকেই একটা হীনমন্যতা মনের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল কিংশুকের। তবু এই হীনমন্যতা যে কিংশুককে একেবারে মাটিতে শুইয়ে দিতে পারে নি, তার কারণ পড়াশুনো। স্কুলে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের দিনটা ছিল কিংশুকের দিন। পরীক্ষাতে দাদা কোনো প্রাইজ পেত না, কিন্তু একাই দু তিনজনের মতন প্রাইজ নিয়ে বাড়ি ফিরত বলে ওই সময় কয়েকটা দিন দাদা ওকে এড়িয়ে চলতো।.
দাদার সাথে এই সবের জন্য সম্পর্কটা কোনোদিনই ঠিক স্বাভাবিক হয় নি কিংশুকের। দাদার গুন্ডামি, অকারণ মাতব্বরি দু চোখে দেখতে পারত না কিংশুক। এই নিয়ে মা বা জেঠির কাছে নালিশ করে কোনো লাভ হত না। জেঠি বকতেন দাদাকে, কিন্তু সেই বকার মধ্যে কোনো ঝাঁঝ থাকত না। আর মাকে এইসব নিয়ে বলতে গেলে মা কিরকম যেন ঘাবড়ে যেত। কিংশুক জানতো, জেঠির সাথে ঝগড়া করার ইচ্ছে বা সাহস, এ দুটোর কোনোটাই মায়ের নেই।
দাদার গুন্ডামির শুরু সেই ছেলেবেলার থেকেই। ক্লাস টু-তে পড়ার সময় দাদার হাতে প্রথম বড় মার খায় কিংশুক। ঠিক কি নিয়ে প্রথম ঝগড়াটা শুরু হয় তা মনে নেই, শুধু মনে আছে ওর চুলের মুঠি ধরে পেড়ে ফেলে তবলাতে ওর মুখ ঘষে দিয়েছিল দাদা আর দু' গালে বেশ কিছু থাপ্পড় মেরেছিল। জেঠু-জেঠি দুজনেই খুব বকেছিল দাদাকে, কিন্তু সেই বকুনির মধ্যে কোনো ঝাঁঝ ছিল না। মারের জন্য শরীরে যত না ব্যাথা লেগেছিল, অপমান হয়েছিল সাংঘাতিক।
কেন জানি না সেই ছোট্ট থেকেই নিজের চোখের জল আর কাউকে দেখানোর মধ্যেও একটা তীব্র অপমান খুঁজে পেত কিংশুক। আর অপমান হলে কারুর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করত না। সেরকম কিছু হলে কিংশুক তখন চিলেকোঠার ঘরে চলে যেত। চিলেকোঠার ঘরে সংসারের অজস্র পুরোনো বাতিল জিনিসের সাথে সাথে একটা তক্তপোষ ছিল। তক্তপোষের গদিটাও পুরোনো হয়ে গিয়ে প্রায় কাঠের সাথে মিশে গিয়েছে। সেই তক্তপোষে শুয়ে একা একা বাইরের দিকে চেয়ে থাকত কিংশুক।
এ বাড়ির কেউ ওকে ভালোবাসে না। এ বাড়ির সমস্ত কিছু চলে দাদার ইচ্ছে-অনিচ্ছায়।
একদিন এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে কিংশুক।
কিংশুকের চোখের সামনে আঁকাবাঁকা একটা মাটির রাস্তা চলে গেছে আর সেই রাস্তা ধরে একা হেঁটে চলেছে ও। উজ্জ্বল শরৎকালের রোদ আকাশে। রাস্তার দুপাশে ধানের ক্ষেত। অল্প হাওয়ায় দুলছে ধানের শীষগুলো। আকাশে ওড়া প্রজাপতির ঝাঁক একবার করে সেই শীষগুলোর উপর বসছে আর আবার উড়ে বেরিয়ে চলেছে নতুন শীষের সন্ধানে।
কিংশুক হেঁটেই চলেছে, হেঁটেই চলেছে। সারাদিন হাঁটার পর যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে তখন জঙ্গলের ধারে একটা ছোট্ট দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল কিংশুক। বাড়িটা মানুষের ভাষায় ডেকে ওকে বলল ভিতরে আসতে।
সেই বাড়ি খাবার দিলো ওকে। মাথার উপর ছাত দিলো।
খেয়েদেয়ে অল্প একটু ঘুমিয়ে রাত্তিরবেলা আবার সেই বাড়ির দোতলার খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়াল কিংশুক। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে আশপাশ। মায়াবী নীল আলোয় সকালবেলার জঙ্গলের সবুজ গাছগুলো এখন কালো দেখাচ্ছে।
ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে চারপাশে, একঘেয়ে একটানা সুরে।
দূরে কোথাও শেয়াল ডেকে উঠল একটা।
বাড়ি কিংশুককে জিজ্ঞাসা করল, “এখন আর দুঃখ আছে তোমার?”
কিংশুক বলল, “না!”
বাড়ি আবার জিজ্ঞাসা করল, “ফিরে যাবে?”
কিংশুক বলল, “না!”
না, একাই থাকবে কিংশুক। আর ফিরে যাবে না বর্ধমানের বাড়িতে।
বাড়ি জিনিসটা যে হেলাফেলার নয় সেটা বোম্বে যাবার পর প্রথম উপলব্ধি করেছিল কিংশুক।
রিজার্ভ ব্যাংক ফ্ল্যাট দেবে ওকে। সেই ফ্ল্যাট ওর নিজের নামে। ফ্ল্যাটের দরজার উপরে থাকবে ওর নিজের নেমপ্লেট।
নিজের নামে ফ্ল্যাট হবার আত্মপ্রসাদ অবশ্য হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল চাকরিতে যোগ দেবার পরে পরে।
দীর্ঘ বেশ কিছু ফর্ম পূরণ করে, দুবার বোম্বে শহরের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত যাতায়ত করে অবশেষে বোম্বেতে নিজের একটা আশ্রয় মিললো। আপাতত একটা ঘর শুধু। ফ্ল্যাট শেয়ার করতে হবে আরও দুজন সহকর্মীর সাথে। পুরোপুরি একটা গোটা ফ্ল্যাট হাতে পেতে মাসকয়েক দেরি হবে। অন্য আর সবার মতন রিজার্ভ ব্যাংকও মনে করে যে যুবক ব্যাচেলর ছেলে মানে সে দরকার পড়লে রাস্তাতেও রাত কাটাতে পারে।
চাবি দিয়ে প্রথমে ফ্ল্যাট আর তারপরে নিজের ঘরটা খুলবার পর মুখে হাসি এসে গেল কিংশুকের। বেশ বড় ঘর। প্রায় বারো ফুট লম্বা আর বারো ফুট চওড়া। সাথে একটা এটাচ্ড বাথরুম। এক দেয়ালের গায়ে একটা বড় ওয়ার্ডরোব। দুদিকে বেশ বড় জানলা। আলোবাতাসের অভাব নেই ঘরটাতে।
সমস্যা এই ঘরটা পুরো ফাঁকা, কোথাও কোনো ফার্নিচার নেই।
অভ্র আর অমিতাভর অফিস থেকে ফিরতে আরো অন্তত এক ঘন্টা। এই কমপ্লেক্সেরই অন্য একটা ফ্ল্যাটে থাকছে ওরা।
রাস্তার ওপারের ছোট রেস্টুরেন্টটাতে বসে চা খেতে খেতে উল্টোদিকে কমপ্লেক্সের গেটের দিকে নজর রাখছিল কিংশুক। বোম্বেতে এরকম অজস্র ছোটো রেস্টুরান্ট। একটু গরিবের জন্য যে রেস্টুরেন্টগুলো সেগুলোতে ছোটো গেলাসে করে অল্প পরিমাণের চা বিক্রি হয়, যেটাকে এখানকার সাধারণ লোক কাটিং চা বলে। দ্বিতীয় কাটিং চা শেষ হবার মুখে কিংশুক দেখতে পেল দুই স্যাঙাত কমপ্লেক্সের সামনের স্টপে বাস থেকে নামলো।
কিংশুককে দেখে হৈ হৈ করে উঠল ওরা।
-- কি রে, রাজপ্রাসাদ জুটলো?
-- তোদের মত ফুটো ঘর দেবে নাকি আমাকে রিজার্ভ ব্যাংক? জানিস, আমার ঘরটাতে ছাদ পর্যন্ত রয়েছে!
-- আর বিছানা, বালিশ?
-- যে ভয় করেছিলাম! জানতাম তোরা ফাঁসাবি, সেটাই শেষ পর্যন্ত হল। ভাবছি, আন্ধেরিতে সিঙ্গল রুম নিয়ে নিলেই হতো। বেসিক জিনিষপত্তর অন্তত থাকত সেই ঘরে।
-- টিঁকতে পারতিস না। নোংরার হদ্দ ঘরগুলো। অন্ধকার, ঘুপচির মতন ঘর সব।
-- সে নাহয় হল. কিন্তু আজকের রাতটাতে করব টা কি শুনি? ভূমিশয্যা?
নতুন শহরে পুরোনো বন্ধু হাতের কাছে থাকলে অনেক সমস্যারই সমাধান জুটে যায় খুব সহজে।
শেষ সময়ে কনজাঙ্কটিভাইটিস হওয়ায় কিংশুক আরও এক মাস সময় চেয়েছিল রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে। সদাশয় রিজার্ভ ব্যাংক সেই আবেদনে সাড়া দেওয়াতে কিংশুকেরই সুবিধে হয়ে গেল এখন। ওর প্রায় এক মাস আগে কাজে জয়েন করেছে অভ্র আর অমিতাভ, তাই ইতিমধ্যেই ওরা পুরোনো পাপী, আর তাই চাকরিতে “সিনিয়র” বলে ওরা দুজনে কিংশুককে নিজেদের চ্যালা বানিয়ে নানা উপদেশের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে।
কিছু পুরোনো সোফার গদি জোগাড় করেছে অভ্র আর অমিতাভ। রিজার্ভ ব্যাংকেরই পুরোনো সোফা -- অন্য একটা ফাঁকা ফ্ল্যাটে নাকি রাখা ছিল ওগুলো, পরে কোনো এক সময়ে স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হবে বলে। চাকরিতে জয়েন করবার দিনই সেটা জেনে গিয়েছিল ওরা। ঐদিন রাতের অন্ধকারে কোনো এক ফাঁকে সেই ফ্ল্যাট থেকে কাউকে কিছু না জানিয়ে বেশ কিছু সোফার গদি নিজেদের ফ্ল্যাটে তুলে এনেছে অভ্র আর অমিতাভ। এখন যদিও ওদের দুজনেরই শোবার গদি আছে একটা করে, তবু সেই সোফার গদিগুলো ওরা ফেরত দেয় নি।
“আপাতত এক দু দিন ওই রাজশয্যায় শো”, অমিতাভ বলল, “পরে একটা মাদুর আর একটা সিঙ্গল বেড ম্যাট্রেস কিনে নিবি। এই কমপ্লেক্সেই দোকান আছে!”
হাসতে হাসতে অভ্র আরো জানাল যে রিজার্ভ ব্যাংকের নাকি এখন পুরোনো সোফার গদির হিসেব মিলছে না।
-- আমাদের ফ্ল্যাটে একবার কমপ্লেক্সের সিকিউরিটি গার্ড এসেছিল পুরোনো গদিগুলোর ব্যাপারে খোঁজখবর করতে। আমরা ভান করেছি যে হিন্দি বুঝি না। তোর কাছে এলেও তাই করিস, ভিতরে ঢুকতে দিস না, দরজা থেকেই বিদায় করে দিস।
-- যদি জোর করে ঢুকতে চায়?
-- অফিসারের ঘরে সাহস করবে না।
-- আর যদি অফিসারের সাথে আসে?
-- গদি ফেরত দিয়ে দিবি। গদি তো আমরা মেরে দিচ্ছি না, বাইরেও বেচছি না। কয়েকদিনের জন্য নিজেদের প্রয়োজনে ধার নিয়েছি মাত্র। কাজ হয়ে গেলে ফেরত দিয়ে দেব আবার!
না, হোটেলে কাটাতে হবে না! ভূমিশয্যারও দরকার নেই। রাতে শয়ন আপাততঃ সেই সোফার গদিতে।
শরীরে অপরিসীম ক্লান্তি, তবু প্রথম রাত্রে সেই সোফার গদিতে শুয়ে ঘুম আসছিল না কিংশুকের। এক একটা গদি ছোটো, একজনের বসার মতন। এরকম না’খানা গদি লম্বায় তিনটে আর চওড়ায় তিনটে করে সাজিয়ে কিংশুকের রাজশয্যা। একটু নড়াচড়া করলে কোনো না কোনো গদি পিছলে সরে যায়। ফলে ঘুমের ঘোরে হঠাৎ করে পিঠ, কোমর, বা পায়ের কোনো অংশ মেঝেতে গিয়ে ঠেকে।
ঘুমের আর দোষ কি?
ঘুম আসছিল না বলে মধ্যরাতে উঠে জানলা দিয়ে রাতের বোম্বে শহর দেখছিল কিংশুক।
ওয়েস্টার্ন এক্সপ্রেস হাইওয়ের ধারে এই কমপ্লেক্স। দিনের চব্বিশ ঘন্টা সেই হাইওয়ে ব্যস্ত। মধ্যরাতেও অসংখ্য গাড়ি রাস্তাতে।
জানলা দিয়ে চাঁদের আলো আসছিল ঘরটাতে। অনেকক্ষণ ধরে সেই জ্যোৎস্নার দিকে চেয়েছিল কিংশুক।
মহানগরী বোম্বে, যার অন্য নাম মুম্বাই। বিশাল এলাকা জুড়ে তার অবস্থান। কলকাতার মতই, ভারতবর্ষের অন্য আর এক প্রান্তে লক্ষ লক্ষ মানুষ এক হয়ে বছরের পর বছর ধরে গড়ে তুলেছে এই দানবাকৃতি শহরকে।
তবু আকাশের চাঁদ বা তারার দিকে তাকালে কিংশুকের মানুষ জাতিটার উপরে এক অসীম তাচ্ছিল্য হয়। এত বড় এই সব গ্রহতারারা।
আর এত দূরে।
একসময় এই চাঁদ নাকি পৃথিবীর অংশ ছিল। মহাজাগতিক কোনো এক দুর্ঘটনায় পৃথিবীর থেকে ছিটকে আলাদা হয়ে যায় চাঁদ।
এই চাঁদের মতনই অবশেষে নিজের বাড়ির থেকে, নিজের শহরের থেকে আজ ছিটকে গেছে কিংশুক। এই নতুন শহর হল ওর নতুন কক্ষপথ, জীবন আবর্তিত হয়ে চলবে এই পথে।
কলকাতা ফেরার রাস্তা হয়তো বন্ধ নয়, তবে অসংখ্য কাঁটা ছড়ানো সেই রাস্তায়। কাউকে না তেলিয়ে মোটামুটি সচ্ছল, মধ্যবিত্ত জীবন কাটানোর মতন চাকরি কলকাতাতে কোথায় আজ?
কলকাতাকে ত্যাগ দেওয়াটাই বোধ হয় ওর ভাগ্যে লেখা ছিল। কাগজে কলমে বোম্বে ভারতবর্ষেরই একটা অংশ, কিন্তু কিংশুকের কাছে এই শহর বিদেশ। মা, বাবা আত্মীয়স্বজনেরা সকলেই প্রায় দুহাজার কিলোমিটার দূরে।
ষোল বছর বয়সে রিফিউজি হয়েছিল বাবা, নিজের ছেলেবেলার দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল।
আজ শরীর ভরে জ্যোৎস্না মাখতে মাখতে কিংশুকের মনে হল রেফিউজির ছেলে নিজেও রেফিউজি আজ।
কেউ রেফিউজি হয় রাজনীতির চাপে, কেউ বা অর্থনীতির চাপে।
রেফিউজির মতই পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে অন্য দেশে বাস তোলা।
শুধুমাত্র দুটো বড় স্যুটকেস আর একটা রুকস্যাক ভরা জিনিস নিয়ে বোম্বে এসেছে কিংশুক। একা একা কত আর বওয়া যায়? গাদাগাদা মাল সাথে নিয়ে এসে কুলিদের সাথে ঝগড়া করে মাল সামলানো-টামলানো হবে না কিংশুকের দ্বারা। কলকাতার হোস্টেলের বেশির ভাগ জিনিস তাই কয়েক খেপে বর্ধমানের বাড়িতে রেখে এসেছে কিংশুক।
টিপে টিপে টাকা খরচ করতে হচ্ছে, সঙ্গে টাকা নেই বেশি। এটা প্রথম চাকরি, তাই হাতে টিউশনির জমানো টাকা ছাড়া আর কিছু নিয়ে আসতে পারে নি কিংশুক।
মাইনে পেতে এখনো প্রায় তিন সপ্তাহ। প্রথম মাইনের টাকা হাতে পেলেও সেটা খাট বা অন্যান্য বড় ফার্নিচার কেনার পক্ষে যথেষ্ট হবে না। অভ্র আর অমিতাভর কাছে ধার চেয়ে কোনো লাভ নেই। ওদের অবস্থাও কিংশুকের মতোই।
বোম্বে আসার আগে হাতেগোনা কিছু বই বাদে, নিজের প্রায় সমস্ত বইও বর্ধমানের বাড়িতে রেখে আসতে হয়েছে।
যে কখানা বই সাথে এনেছে কিংশুক সবই অর্থনীতির বই।
এখানে ধারেকাছে এমন কোনো দোকান নেই যেখানে বাংলা গল্পের বই পাওয়া যেতে পারে। সিনেমা হলগুলোতে কোনো বাংলা ছবি আসে না এখানে।
বাংলা খবরের কাগজ আসে না আশেপাশে। কাগজ কিনতে গেলে ভিটি বা চার্চগেট স্টেশনে যেতে হবে সারা শহরতলি ঠেঙিয়ে।
অফিস থাকলে অফিসের ক্যান্টিনেই ব্রেকফাস্ট সেরে নেয় ওরা তিনজন। সাড়ে ন’টার আগে খাবার জোটে না ক্যান্টিনে। অভ্র বা অমিতাভর তাতে অসুবিধে হয় না। হোস্টেলে থাকবার সময় ওরা অনেক সময় এত দেরি করে ঘুম থেকে উঠত যে ব্রেকফাস্ট মিলত না তখন। কিন্তু সেই ছোটবেলার থেকে সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাসের জন্য পেটে খিদে চেপে রাখতে হয় কিংশুককে। সকালে নিজে কিছু বানিয়ে নেবার মতন বাসনপত্তরও নেই নিজের কাছে। কিছুদিন থেকে তাই একটা দুটো বিস্কুট বা অল্প একটু চানাচুর জাতীয় শুকনো কিছু স্ন্যাক্স মুখে দিয়ে কাজ চালায় কিংশুক। সকাল সকাল এই সব জিনিস খেতে ইচ্ছে করে না খুব একটা, কিন্তু উপায় নেই।
কান্দিভালি থেকে চার্চগেটের ট্রেন ধরে ওরা। অফিসযাত্রী এত বেশি যে অভ্যাস না থাকলে কান্দিভালি থেকে সরাসরি চার্চগেটের ট্রেনে ওঠা বেশ শক্ত কাজ। অন্যান্য অনেকের মতন ওরাও তাই উল্টোদিকের বোরিভালির ট্রেন ধরে। সেই ট্রেন বোরিভালি পৌঁছে আবার চার্চগেটের ট্রেন হয়ে ছাড়ে। সেই কান্দিভালি হয়েই যায়। পুরো ব্যাপারটাতে মিনিট কুড়ি বেশি সময় লাগলেও, কান্দিভালিতে লাফ দিয়ে অন্যান্যদের আগে ট্রেনে উঠতে পারলে বসার জায়গা পাওয়া যায়। পরে উঠলেও ভিতরে দাঁড়ানোর জায়গা থাকে, ঝুলে ঝুলে যেতে হয় না।
বোম্বাইয়ের নিত্যযাত্রীদের মধ্যে অলিখিত নিয়ম, কষ্ট ভাগ করে নেওয়া। বোরিভালি থেকে যারা বসে আসছে তারা যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের দাদার স্টেশন এলে জায়গা ছেড়ে দেয়। প্রথম যখন একজন অপরিচিত লোক ওকে এইভাবে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল তখন খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল কিংশুক। বারবার করে ধন্যবাদ জানিয়েছিল লোকটিকে। দুদিন বাদে সেই লোকটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাদার স্টেশনে তাকে জায়গা ছেড়ে দেয় কিংশুক। একগাল হেসে বসে পড়েন ভদ্রলোক আর জানান যে গত কয়েকদিন ধরে ওদের লক্ষ্য করে করে তিনি বুঝেছেন যে ওরাও নিত্যযাত্রী। ভদ্রলোকের নাম সত্যানন্দ পট্টনায়েক। উড়িষ্যার লোক। এল এই সি তে কাজ করেন। সত্যানন্দ ওদের যা বলেন সেটাকে কাব্য করে প্রকাশ করলে দাঁড়ায় “নিত্যযাত্রীকে নিত্যযাত্রী না দেখিলে দেখিবে কে?” এই দর্শন বোম্বে শহরে টিঁকে থাকার একটি মূলমন্ত্র।
ব্যাচেলর বলে ছুটির পরেও অনেকটা সময় অফিসে কাটায় ওরা তিনজনে। এখনো অবধি সেরকম কাজের চাপ নেই। তবে আস্তে আস্তে ঘাড়ে দায়িত্ব চাপছে। ওদের ইনডাকশন ট্রেনিং হবে আর তিন মাস পরে। সিনিয়ররা বলেছে, ইনডাকশন ট্রেনিঙের আগে কোনো বড় কাজের দায়িত্ব নতুন অফিসারদের দেওয়া হয় না।
চার্চগেট টার্মিনাস স্টেশন। একটু দেরি করে ফিরলে তাই ট্রেনে বসার জায়গা পেতে কোনো অসুবিধে হয় না। সাতটার পরে অফিস থেকে বেরোয় ওরা। চার্চগেট স্টেশনে এক কাপ চা খায় অভ্র আর অমিতাভ, আর কিংশুক খায় এক কাপ কফি। ট্রেন কান্দিভালি পৌঁছয় প্রায় আটটায়। বাড়ি ঢুকে ভালো করে স্নান করে নেয় ওরা। তারপর রাত ন’টা নাগাদ রাস্তার ওপারের ছোটো রেস্টুরেন্টটাতে রুটি আর সাথে ডাল, তরখা বা অন্য কোনো সবজি দিয়ে ডিনার সেরে নেয়।
তারপর ঘণ্টা দুয়েক আড্ডা আর ঘুম।
প্রথম কয়েকদিনের মতন এখন আর সেই নখানা সোফার গদিতে শুতে হয় না কিংশুককে। অভ্র আর অমিতাভ এখানে একই ফ্ল্যাটের দুটো আলাদা আলাদা ঘরে থাকে। ওই ফ্ল্যাটের তৃতীয় ঘরটা এখনো অবধি ফাঁকা। ওদের ফ্ল্যাটে একটা আস্ত সোফা রয়েছে, যার উৎস সেই রিজার্ভ ব্যাংক। ওর শোবার অসুবিধের কথা শুনে প্রথমে ওরা ওকে সেই সোফাটা দিতে চেয়েছিল। পরে অবশ্য অভ্র আর অমিতাভ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বলল যে সবচেয়ে ভালো হবে যদি কিংশুক ওদের ফ্ল্যাটে চলে আসে। নিজের ঘর তালাবন্ধ রেখে তাই ওদের ফ্ল্যাটেই তৃতীয় ঘরটাতে সোফায় শুয়ে রাত কাটায় কিংশুক।
এক মাসের মধ্যে এই নতুন রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে কিংশুক।
ছুটির দিনগুলোতে কোনো কাজ থাকে না হাতে।
অভ্র আর অমিতাভ ছুটির দিনগুলোতে বেলা এগারোটার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। ফলে আলাদা করে ব্রেকফাস্ট খেতে হয় না ওদের। কিংশুকের কিন্তু বেশি সকাল অবধি শুয়ে থাকা পোষায় না। সকাল আটটার পর ঘুম থেকে উঠলে কেমন যেন মনে হয়, সারা দিনটাই নষ্ট।
রবিবারের সকালের ব্রেকফাস্ট তাই কিংশুক একা সারে। অন্যদিনের মতন তাড়াতাড়ি অফিস পৌঁছে ক্যান্টিনে ব্রেকফাস্ট নয়, রবিবারগুলোতে কমপ্লেক্সের অনেকটা ভিতরে মোটামুটি পরিচ্ছন্ন একটা রেস্টুরেন্টে পুরি-ভাজি আর চায়ের অর্ডার দেয় কিংশুক।
বর্ধমানে প্রত্যেক রবিবার ওদের বাড়িতে লুচি আর আলুর তরকারি হতো। কলকাতাতে থাকার সময় অনেক রবিবার হোস্টেলে কাটিয়েছে কিংশুক। আশেপাশে বাঙ্গালি খাবারের অভাব ছিল না বলেই হয়তো বাড়ির লুচি-তরকারির কথা মনে হয় নি সেরকম। এখানে প্রায়ই মনে হচ্ছে।
এখানে পুরি-ভাজির পুরি আটায় তৈরি, লুচির মতন ময়দায় নয়। তবে ভালো ব্যাপার এই যে সাথে কাঁচা পেঁয়াজ আর নারকোলের চাটনি দেয়। কিংশুকের খুব প্রিয় এই চাটনি। আর চা-টা পাঞ্জাবি ঘরানার, ঘন দুধ, প্রচুর চিনি আর এলাচ। অভ্র আর অমিতাভর খুব পছন্দ নয় এই ধরনের চা, তবে কিংশুকের মন্দ লাগে না।
রবিবার সকালে যাবার সময় এক কিলোমিটার আর ফেরার সময় এক কিলোমিটার হাঁটতে হয় এসবের জন্য।
ব্রেকফাস্ট খেয়ে ফিরবার সময়টাতে কেন জানি না ফাঁকা-ফাঁকা লাগে খুব। একা একটা ফাঁকা ঘরে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে কাটাতে নিজেকে কেমন একটা খাঁচায় বন্দি প্রাণীর মতন মনে হয়।
আজ বিকেলে তাই এক ঘন্টা ট্রেন ঠেঙিয়ে চার্চগেট যাবে কিংশুক। একটা বাংলা খবরের কাগজ কিনে মেরিন ড্রাইভে বসে সেটা পড়বে।
রবিবারের সন্ধ্যা মানেই অভ্র আর অমিতাভ কাছাকাছি কোনো সিনেমা হলে গিয়ে কোনো না কোনো অখাদ্য হিন্দি ছবি দেখতে ঢুকবে। ওদের সাথে ছুটির দিনের সন্ধ্যাটা নষ্ট করার মানে হয় না।
আজ একাই চার্চগেট যাবে কিংশুক। রাত্রেও একা খেয়ে ফিরবে একেবারে। কলকাতা থাকাকালীন অনেক দিন এগরোল বা চিকেন রোল দিয়ে ডিনার সেরেছে কিংশুক। এখানেও রাতের খাওয়াটা চিকেনরোল দিয়ে সারতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো, কিন্তু সেটা পাবার উপায় নেই। চার্চগেট স্টেশনে এক সর্দারজির ফ্র্যাঙ্কিকে চিকেনরোলের মর্যাদা দিতে রাজি নয় কিংশুক। রাতে চার্চগেট স্টেশন থেকেই চাউমিন জাতীয় কিছু একটা খেয়ে ফিরবে ও। অভ্র আর অমিতাভকে আগে থেকে বলে রেখেছে ওর জন্য অপেক্ষা না করতে। ওরা যেন নিজেদের সময় মতন রাস্তার ওপারের ছোটো রেস্টুরেন্টটা থেকে ডিনার খেয়ে আসে।
ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা হয়ে গেল।
রাত্তিরবেলা জানলার ধারের সিট পেলে ট্রেনে চড়ে ফিরতে মন্দ লাগে না। কামরাগুলোতে টিউব লাইট এখানে, কামরাগুলো তাই আলোয় ঝলমল করে সন্ধ্যার পর। কলকাতার ট্রেনগুলোর মতন টিমটিমে আলো নয় বলে খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিন পড়তে অসুবিধে হয় না।
বাড়ি ফেরার তাড়া নেই কোনো। অভ্র আর অমিতাভ দুজনেই অনেক রাত অবধি জেগে থাকে। ওদের সাথে আড্ডা দেওয়াটাকে যদি কাজ বলা যায়, তাহলে সেই কাজটুকুই আজকের জন্য বাকি।
আগস্টের শেষ। বোম্বাইয়ের বীভৎস বর্ষা এখন শেষ হওয়ার মুখে। দিনের বেলা শরতের উজ্জ্বল আকাশ এখন, রাত্রে গরম একটু কমের দিকে। সন্ধ্যার পর সমুদ্রের দিক থেকে হাওয়া দিচ্ছে আজ। ফলে গরম এক ধাক্কায় আরো অনেকটা কমে গেছে। আকাশে সন্ধ্যাতারা ঝিকমিক করছে। অন্য তারাগুলোকে অবশ্য কষ্ট করে দেখতে হয়, ভারতবর্ষের যে কোনো বড় শহরের আকাশ দিনের চব্বিশ ঘন্টা ধোঁয়ায় ভর্তি।
গণপতি উৎসব আসছে বোম্বেতে। বেশ কিছু জায়গাতে প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হয়ে গেছে তাই।
গণপতি উৎসব হবে ওদের কমপ্লেক্সের ঠিক বাইরে। ছোট একটা স্টেজ বাঁধা হয়েছে। টেপ চালিয়ে সেই গানের সাথে নাচছে কিছু অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে।
এরা নিজেরা গান গায় না। টেপ চালায়। প্রথমবার সেটা দেখে অবজ্ঞায় নাক কুঁচকে ছিল কিংশুক। এই কয়েকদিনেই এসব অবশ্য চোখে সয়ে যাচ্ছে।
শুধু খবরের কাগজ নয়, কিছু বাংলা ম্যাগাজিনও কিনে এনেছে কিংশুক। কিন্তু এখন কেন জানি না আর সেগুলো পড়তে ইচ্ছে করছে না।
গণপতি উৎসব মানে দুর্গাপুজো-ও এল বলে। বাংলার পাড়ায় পাড়ায় এখন তুমুল কর্মযজ্ঞের আয়োজন। কিংশুকদের বাড়িও জেগে ওঠে এই সময়। দুর্গাপুজোর মধ্যে অন্তত একটা দিন ওদের বাড়িতে বাবা-জ্যাঠাদের দিকের আত্মীয়স্বজনেরা সবাই এসে জড়ো হয়।
জন্মের পর থেকে একবারের জন্যও পুজোর সময় বর্ধমানের বাইরে কাটায় নি কিংশুক। এক বছর আগেও ভাবতে পারত না কিংশুক যে পুজোর সময়টুকু বর্ধমানের বাইরে কাটাবে।
এবারে কাটাতে হবে। কোনো উপায় নেই। নতুন চাকরি, রিজার্ভ ব্যাংকের বিজি সিজন ক্রেডিট পলিসি সামনে। এখন ছুটির কথা উচ্চারণ করলেও বসেরা ঘাড় ধরে ওদের অফিসের ছাতে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে সিধে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
অভ্র আর অমিতাভ বাড়ি নেই। মনে হচ্ছে কোথাও একটা নাইট শো এর সিনেমা দেখতে গেছে।
ওর ঘরে সোফার উপর চিঠি রাখা আছে একটা। রবিবার চিঠি আসার কথা নয়। হয়তো অন্য কোথাও পড়েছিল এক দিন।
মায়ের চিঠি। চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করে কিংশুক।
মা ধরেই রেখেছে পুজোর সময়টা বাড়িতে কাটাবে কিংশুক। কিন্তু সেটা হবার নয়।
কেউ জানে না, কিংশুকের মেরিন ড্রাইভ ঘুরে আসা আজ মন খারাপ কাটাতে।
বর্ধমানে ওদের প্রতিবেশী তিরকু-দা-র বিয়ে আজ। বাড়ির সকলের নিমন্ত্রণ রয়েছে। আলাদা করে ওকে কার্ড পাঠিয়েছে তিরকু-দা। ও যেতে পারবে না শুনে সামান্য হতাশ আর বিরক্ত হয়েছে তিরকু-দা।
কিংশুক ভেবেছিল বাড়ির মধ্যে একা না কাটিয়ে একটু ঘুরে এলে মনের অস্থিরতা একটু কমবে। কিন্তু কিছুতেই অস্থিরতা যাচ্ছে না। কে যেন যাত্রাদলের বিবেকের মতন একনাগাড়ে নিষ্ঠুর অপ্রিয় সত্যি কথাটা বারংবার ফিসফিস করে কিংশুকের কানে কানে বলে চলেছে, “এই শুরু, কিংশুক! আরো কত এমন সব অনুষ্ঠান আসবে যেখানে তুমি থাকতে পারবে না!”
নাঃ, আর দেরি নয়। মা কে আজই জানাতে হবে যে কিংশুক পুজোর সময় এবার বাড়িতে থাকবে না।
আলমারির থেকে পোস্টকার্ড বের করে একা একা ফাঁকা একটা ঘরের সোফায় বসে মা’কে চিঠি লিখতে শুরু করে কিংশুক।