• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৩ | জানুয়ারি ২০২৪ | উপন্যাস
    Share
  • শিকড় (৫) : কৌশিক ভট্টাচার্য





    ১৪

    এর আগেও মামুর একবার আসার কথা ছিল বোম্বেতে, তিনজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে। গোয়া আর মহাবালেশ্বর ঘুরতে যাবে ওরা, যাবার আর ফেরার পথে বোম্বেতে সকলে মিলে ওদের বাড়িতে একটা করে দিন কাটাবে। বোম্বে রওনা হবার তিন দিন আগে পড়ে গিয়ে ঠ্যাঙ ভাঙে মামুর। বলা বাহুল্য, বোম্বে আসা ক্যানসেল হয়ে যায়।

    অতসী তখন বোম্বেতে। ভয়ানক বিরক্ত হয়েছিল অতসী।

    শুধু শমীক কেন, কিংশুকও অবাক হয়েছিল অতসীর বিরক্তিতে। শমীক তখন অনেক ছোট। তাই ওর সামনে এসব নিয়ে কথা হয়নি কোনো, তবে ভিতরের ঘর থেকে মা আর বাবার আলোচনা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিল শমীক।

    – আহা, পা ভেঙেছে, আসতে পারবে না, এতে এত রাগের কি আছে? অবুঝ হচ্ছ কেন? তোমারই তো দাদা!

    – রাগব না-ই বা কেন? মাঝরাতে বেপাড়ার পুকুরপাড়ে পড়ে গিয়ে ঠ্যাং ভাঙাটা তোমার খুব স্বাভাবিক মনে হয়? পাঁচ ইয়ারে মিলে ফুর্তি করবে, কোনো লিমিট থাকবে না, কোনো ডিসিপ্লিন নেই লাইফে, এসব তো হবেই।

    “ও, তাই নাকি?” এবারে একটু গম্ভীর হয় কিংশুক।

    “তাছাড়া কি?”, রাগে গরগর করে অতসী, “আমাকে হয়তো জানাতোও না পুরো কেসটা, নেহাত মায়ের মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল যে মাঝরাত্তিরে হাসপাতালে ছুটতে হয়েছে ওদের। বোঝো ঠ্যালা! তা, আমি তো ছাড়ার পাত্রী নই, জেরা করা শুরু করলাম মা-কে! তখন সব বলল।”

    রাগ যেন কিছুতেই কমছে না অতসীর, “মায়ের কথা দাদা পাত্তাই দেয় না, আর বাবা দাদার ব্যাপারে একেবারে অন্ধ। ইউনিয়নের নেতাগিরি করতে পারছে, স্টেট কমিটিতে ঢুকে পড়েছে এত অল্প বয়সে, ব্যাস, জন্ম সার্থক হয়ে গেছে! আর কি চাই বাবার?”

    এবারে সেই ইউনিয়নের কাজ নিয়েই বোম্বে আসছে মামু। বোম্বেতে ব্যাংক কর্মীদের ইউনিয়নের একটা কনফারেন্স আছে দুদিনের। আসছে বেশ ভালো সময়ে। শমীকের ক্লাস ইলেভেনের অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখন এক দু দিন একটু হাল্কা চালে চলা যেতে পারে। মামুর সাথে এই কটা দিন একটু অন্যরকম কাটলে ক্ষতি কি?

    ***

    ট্রেন লেট বলে মামু বাড়ি ঢুকলো মাঝরাতের পর।

    একটা জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় পরের দিন বাবার অফিস বাদ দেবার উপায় ছিল না। মামুকে সঙ্গ দেবার জন্য বাড়িতে তাই শমীক ছিল একা। এর আগে কলকাতার বাড়িতে গেলে মামুর দেখাসাক্ষাৎ বিশেষ পাওয়া যেত না। এখানেও পাওয়ার বিশেষ কথা ছিল না। কিন্তু কেন জানি না, যদিও কনফারেন্সের নাম করে আসা, তবু সেদিন কনফারেন্সেই গেল না মামু। ঘুম থেকে উঠল সকাল দশটার পর। উঠে আরাম করে নিজে চা বানিয়ে খেল দুবার, শমীককে ওমলেট ভেজে খাওয়াল, নিজেও খেল চায়ের সাথে।

    বাড়িতে শমীক একা এবং পড়াশুনোর তখন কোনো চাপ নেই। বেডরুমে আধশোয়া অবস্থায় রেমন্ড স্মালিয়নের বইটা থেকে একটা শক্ত প্রবলেম সলভ করার চেষ্টা করছিল শমীক। মামু ঘরে ঢুকল, ঢুকে শমীকের দিকে তাকিয়ে বলল, "অঙ্ক করছিস? অ্যানুয়াল পরীক্ষার পরেও? নরকে যাবি! স্রেফ নরকে যাবি এসব করলে!"

    এরকম টেনিদাসুলভ কথা অবশ্য মামু বলতেই পারে। শমীক জানে এম এ পড়তে পড়তে ইউনিভার্সিটি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল মামু। রোজ সকালে অবশ্য ইউনিভার্সিটি যাবার নাম করে বেরিয়ে যেত বাড়ির থেকে। বহুদিন দাদু আর দিদা জানতে পারে নি। জানার পর অবশ্য অনেক নাটক হয়।

    এই ঘটনার পর থেকে মামু দাদু-দিদাকে আর বিশেষ জ্বালায় নি। এক বছর ড্রপ দিয়ে কোনোক্রমে মোটামুটি একটা এম এ পাস করে তারপর কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে সরকারী ব্যাঙ্কে একটা কেরাণীগিরি জুটিয়ে নিয়েছে নিজের জন্য। তবে এতে দাদুর-ও হাত আছে। এই সব কম্পিটিটিভ পরীক্ষার কোচিং এর জন্য দাদু সেই সময় প্রচুর খরচ করেছে মামুর পিছনে। মায়ের এই নিয়ে ভীষণ রাগ দাদুর উপর। দাদুর শুধু মামুর ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা, মায়ের ক্যারিয়ার নিয়ে নাকি কিছুই যায় আসে না দাদুর।

    মুচকি হেসে মামুকে শমীক জানাল ওটা পড়ার বই নয়। অঙ্কেরও বই নয় ওটা, লজিকের বই।

    --বাঃ, তুই শখ করে লজিকের বই পড়ছিস, তাও আবার পরীক্ষার পরে! গ্রেট!

    বইটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল মামু। তারপর হাসতে হাসতে বলল, "এসব আমার মাথার উপর দিয়ে বেড়িয়ে যাবে!"

    তারপর বলল, "কি মনে হচ্ছে? আই আই টি পাবি?"

    -- দেখা যাক!

    -- দেখা যাক কি রে? না পেলে তিসি তোকে আস্ত রাখবে? ঠিক করে বল তো তিসি কতবার তোকে দিনে গড়ে আই আই টির কথা বলে?

    -- যতবার কথা বলে তাকে দশ দিয়ে গুণ করো চটপট!

    আবার হো হো করে হেসে উঠল মামু।

    -- সাব্বাশ। একেবারে আমার ভাগ্নের মত বলেছিস। তোর মা পিছনে লাগলে তোর রেহাই নেই।

    -- ক্লাস টেনের পরে তো লেগেছিল বাবার পিছনে। বাবা নাকি আমার পড়াশুনো কিছু দেখে নি, তাই এত খারাপ রেজাল্ট হয়েছে।

    একটু গম্ভীর হল অতনু।

    -- তিসির এই এক দোষ। অন্যকে বিনা কারণে দোষ দেওয়া। আমাকে কতবার দিয়েছে।

    "একবার কি হল জানিস!", গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রকারীর ভঙ্গিতে শমীককে গল্প বলা শুরু করল মামু, "তিসির দুটো বান্ধবী ছিল। শুভ্রা আর মধুলিকা -- দুটোই ফাটাফাটি দেখতে। মধুলিকা তো নয় যেন মাধুরী দীক্ষিত আর শুভ্রা তো নয়, যেন সুরাইয়া। কতদিন তিসিকে বলেছি, “তিসি, একটার সাথে ফিট করে দে আমাকে, যত পারিস মদ খাওয়াব তোকে” তা সে মাল কানেই নেয় না, বলে, ‘যা যা, ভাগ! তোর দিকে তাকানো যায় নাকি, গাছে উঠে একটা বান্দরী জোগাড় কর গে যা!”

    মামুর কথার ধরন এখনো একদম রকবাজ ছেলেদের মতন। তবে ভীষণ ফুর্তিবাজ। আর নিজেকে নিয়েও ঠাট্টা করবার ক্ষমতা রাখে।

    মুচকি মুচকি হাসছিল শমীক মামুর কথাবার্তা শুনে।

    “তা, আমাদের চন্দননগরের সাহেববাগানের ছেলেগুলোকে তো জানিস না! একবার যখন ওই দুই ফিল্মস্টার মাল আমাদের বাড়ি আসছিল, ওদের দেখে শিস দিয়ে নাকি ওরা বলেছিল, 'হাই বেবি! কাম হিয়ার!' সব শুনে তিসি রাগটা ঝাড়ল আমার উপর! আমার বন্ধুরা নাকি ওর বন্ধুদের অপমান করেছে! সব শুনে মা-বাবাও আমাকে এই মারে তো সেই মারে। বোঝো ঠ্যালা!"

    শমীকের দিকে তাকিয়ে এবার গলায় একটু দুঃখ এনে মামু বলল, "আমি জানি, কিংশুকদাকেও অনেক ব্যাপারে অকারণে দোষ দেয় তিসি। ওর ক্যারিয়ারটাকে নাকি ধ্বংস করে দিয়েছে কিংশুকদা। আমার প্রশ্ন, ক্যারিয়ারই যদি বানাবি, তাহলে তুই তখন বিয়ে করতে রাজি হলি কেন? মা-বাবা চাপ দিচ্ছিল তিসির উপর বিয়ের জন্য, কিন্তু আমি তো ছিলাম তোর হয়ে লড়ার জন্য। আমাকে অবাক করে শেষ মুহূর্তে রাজি হয়ে গেল তিসি। আমি তো হাঁ, যার হয়ে লড়ব সেই দিব্যি পাল্টি খেয়ে গেল, আমি তবে কার হয়ে লড়ব আর কেনই বা লড়ব?"

    -- তাই? মা প্রথমে বিয়ে করতে রাজি হয় নি বাবাকে?

    -- ঠিক! একদম ঠিক! কিংশুকদা প্রথম থেকেই ফিদা হয়ে গিয়েছিল তোর মায়ের উপর। জানত না তো তোর মা কি জিনিস।

    -- তাহলে পরে মা রাজি হয়ে গেল কেন?

    -- এক মাসের মধ্যে শুভ্রা আর মধুলিকার, দুজনেরই বিয়ে ঠিক হয়ে গেল যে। এক জনের এন আর আই আর অন্যজনের লারসন এন্ড টুব্রোর ইঞ্জিনিয়ার। তিসির কমপ্লেক্স ছিল যে ওদের তিন বান্ধবীর মধ্যে ও দেখতে সবচেয়ে খারাপ …

    সামান্য হেসে মামু বলল, "প্রথমে আমিও বুঝি নি, কিন্তু আমিও তো ওরই দাদা, জন্ম থেকে দেখছি ওকে। তিসির বিয়ের সাতদিন পরে শুভ্রার আর একমাস পরে মধুলিকার বিয়ে। অথচ নেমন্তন্ন করতে এসে ওরা দুজনেই বলল যে প্রায় এক বছর আগে থাকতে নাকি ওদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, তিসির বিয়ে ঠিক হবারও আগে। দুই আর দুইয়ে চার করতে আমার দেরি হয় নি।"

    ***

    কিছুক্ষণ ভোম মেরে বসে থেকে মামু বলল, "এই, কিংশুকদা কখন আসবে রে?"

    -- বাবা? বাবা চার্চগেট থেকে ছটা বেয়াল্লিশের বান্দ্রা লোকাল ধরে। সাড়ে সাতটা হয়ে যায় আসতে আসতে।

    -- তিসি যথেষ্ট ন্যাগ করে কিংশুকদাকে। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমি তিসির এই ঘ্যানঘ্যান করা পুরোপুরি সমর্থন করি। কিংশুকদার মতন লোকের আরো অনেক ভালো জায়গায় থাকা উচিত। কি ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল বল। আমাদের ব্যাংকের অনেক অফিসার ওকে চেনে। খুব রেসপেক্ট করে ওকে। অথচ আরবিআই সেই সিনিয়রিটি ধরে প্রোমোট করবে। ওকে তুলবে না। তিসি ঠিকই বলে। আরো অনেক আগে সব শালাকে লাথি মেরে বেরিয়ে যাওয়া উচিত ছিল ওর। একটু যদি শুধু উদ্যোগ থাকত কিংশুকদার!"

    ***

    দুপুরবেলা লাকি রেস্টুরেন্ট থেকে মাটন বিরিয়ানি আনিয়ে খেল ওরা। লাকির মাটন বিরিয়ানি বোম্বেতে শমীকের সবচেয়ে প্রিয় খাবার। খেয়ে মামুও বলল যে এত ভালো বিরিয়ানি ও খুব কমই খেয়েছে। খেয়েদেয়ে আড্ডার ফাঁকে একটা ছোট্ট ঘুম-ও দিয়ে নিলো ওরা দুজনে।

    ঘটনাটা ঘটল সন্ধ্যার সময়।

    ***

    বিকেল বেলা একটু বেড়িয়েছিল মামু একা একাই। সাতটার সময় ফিরে নিজের ঘরে খাটে শুয়ে ঠ্যাং নাচাল কিছুক্ষণ। কিরকম একটা উসখুস করার মতন ভাব, যেন কিছু একটা এক্ষুনি ঘটবে বলে আশা করছে।

    কিংশুক বাড়ি ঢুকল পৌনে আটটায়।

    কিংশুক বাড়ি ফিরতে না ফিরতে মামু বলল, “কিংশুক-দা, এনেছি, আজ হবে তো?”

    “কি হবে?” অন্যমনস্কের মতন প্রশ্ন করল কিংশুক।

    “আরে এইটা!” বলে ব্যাগ খুলে একটা ব্যাগপাইপার হুইস্কির বোতল খুলে টেবিলের উপর রাখল অতনু ।

    -- আরে এসব আবার আনলে কেন বাড়িতে?

    দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বিব্রত বোধ করছে কিংশুক।

    -- কেন? তুমি খাও না তা তো নয়! তিসি বলেছে আমাকে!

    -- হ্যাঁ, খাই না তা নয়, বিদেশে গেলে বা বিদেশিদের সাথে ভদ্রতার খাতিরে কয়েকবার খেয়েছি, কিন্তু সে তো হাতে গোনা যায়!

    হো হো করে হেসে উঠল অতনু ।

    -- কেন, আমরা দেশীরা কি দোষ করলাম যে আমাদের বাদ দিচ্ছো? দু’হাজার কিলোমিটার দূরে থাকি, না হয় এক দিনের জন্য আমায় বিদেশী-ই মনে করলে!

    মুখচোখ লাল হয়ে যাচ্ছে কিংশুকের বিড়ম্বনায়, যেন শমীকের সামনে কেউ উলঙ্গ করে দিচ্ছে ওর সত্ত্বাটাকে। আর যেন চুটিয়ে চুটিয়ে কিংশুকের এই দ্বিধা আর বিড়ম্বনা উপভোগ করছে অতনু ।

    -- আরে তুমি কি শমীকের কথা ভাবছো? ও মাল দু দিন পরে হোস্টেল যাবে, তখন তো খাবেই। আর দেরি করে কি লাভ? আজ ভাবছি দীক্ষা দেব ওকে!

    কথাটা বলে কিংশুকের জবাবের অপেক্ষা না করেই শমীকের দিকে মুখ ঘোরাল অতনু , “কি রে, হবে নাকি দীক্ষা?”

    হাসল শমীক, “বাবা একবার বললেই হবে!”

    হো হো হো করে হেসে লুটিয়ে পড়ল অতনু , “দেখেছো কিংশুকদা, কি স্মার্ট! আরে হবে না কেন? ভাগ্নেটা কার দেখতে হবে তো?”

    শমীকের দিকে তাকিয়ে আবার হাসতে হাসতে অতনু বলল, “আরে, চৌধুরি বংশের রক্ত তোর শরীরে বইছে, মদ না খেয়ে তুই যাবি কোথায়?”

    এবারে অবাক হবার পালা শমীকের, “কেন? চৌধুরি বংশে সবাই মদ খেত নাকি?”

    “খেত না আবার?”, অতনু বলল, “তবে সবাই নয়, বাড়ির পুরুষেরা। জমিদারবংশ বলে কথা। শিশুসন্তান জন্মাতই তো মদের চৌবাচ্চায়!”

    -- “ধ্যাৎ, তাই হয় নাকি আবার?”

    -- হয় না আবার! জানিস তোর মাতুলবংশের অলিখিত নিয়ম ছিল যে বাড়ির কোনো ছেলে চল্লিশের বেশি বাঁচলে তাকে পুরুষ বলে গণ্য-ই করা হত না। সত্যিকারের পুরুষমানুষ আবার অতদিন বাঁচবে কি? হয় লিভার পচিয়ে মরবে নয়তো সিফিলিসে। যদি বাঁচে তাহলে তো প্রমাণ হয়ে গেল যে সে এমন অপদার্থ যে কোনো ভালো কাজ জীবনে করে নি!

    “অতনু , নেহাত তিসি ধারেকাছে নেই তাই এসব বলতে পারছো!”, মৃদু প্রতিবাদ করল কিংশুক।

    -- আরে রাখুন কিংশুকদা! তিসিকে আমি থোড়াই কেয়ার করি। ও ভান করে যেন এসব কিছুই ঘটে নি আমাদের বংশে। ভণ্ডামি জিনিসটা সেই ছোটবেলার থেকে আর গেল না ওর!

    আবার শমীকের দিকে তাকাল অতনু ।


    -- মজার কথাটা কি জানিস, শমীক? এর পরেও আমাদের জমিদারবংশ নাকি ছিল ভালো বংশ! কেন? কারণ তারা প্রজার ঘরে আগুন দেয় নি, লুটপাট করে নি, চাষী বৌদের তাদের বরের ঘর থেকে জোর করে তুলে আনে নি! অবশ্য এসব একশ-দেড়শ বছর আগের কথা। আরও যদি পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে যাস, হয়তো -- হয়তো কেন, নিশ্চিত দেখা যাবে যে সে সব-ও ছিল ..

    ***

    চুপচাপ নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো শমীক।

    হল্লার আওয়াজ আসছে পাশের ঘর থেকে। হল্লার সবটাই মামুর গলার। প্রায় দু মিনিট পরে পরে হেসে গড়িয়ে পড়ছে মামু। এরই মধ্যে অল্প মাতাল হয়ে গেছে মামু। গালাগালি আর কেচ্ছার স্রোত বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে, আত্মীয়স্বজনের, পাড়াপ্রতিবেশী আর পারিবারিক বন্ধুদের গুপ্ত দিকগুলো উন্মুক্ত হচ্ছে আস্তে আস্তে। এতদিন এসব জানা ছিল না শমীকের।

    একেই কি বড় হওয়া বলে? যারা বড় তারা যেন অন্য আর এক চেহারায় ধরা পড়ে নিজের কাছে!

    মামু কেন জানি না আজ খালি নিজ-বংশের গুণকীর্তন করতে চাইছে। শমীক জানে মদ খেলে এক এক জনকে এক এক ধরনের কথাতে পায়। মামু হয়তো এই বিষয়টা নিয়েই কথা বলতে চায় মদ খেলে। কলকাতাতে এক গ্লাসের ইয়ারদের সাথেও হয়তো একই কাজ করে।

    ওর দাদুর বাবার নাকি বাঁধা রক্ষিতা ছিল একজন। জুয়া খেলে প্রায় সব সম্পত্তি উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দাদুর পিসির নাকি অ্যাফেয়ার ছিল এক সুদর্শন মুসলমান জেলের সাথে।

    এই সব কেচ্ছার কোনো কিছু মা বলে নি ওকে। ও শুধু জানত খুব অল্প বয়স থেকে ওর দাদুকে চাকরিতে ঢুকে পড়তে হয় সংসারের প্রয়োজনে।

    বাবা কি জানত এসব কেচ্ছা? এই সবের জন্যই কি বাবা পছন্দ করে না মাকে? একটা বাজে বংশের মেয়ে বলে?

    বাবার গলার আওয়াজ-ও এখন পাচ্ছে শমীক। মামুকে বোঝাচ্ছে বাবা, শুয়ে পড়তে বলছে।

    মামু ওর মা-কে নিয়ে কিছু একটা বলছে ওর বাবাকে নিচু গলায় আর বলতে বলতে খিলখিল করে হাসছে।

    কেন জানি না, ওর খুব ভালো লাগছে ভাবতে যে বাবা আজ ওকে মদ তো খেতে দেয়-ই নি, নিজেও খায় নি এখনো পর্যন্ত। শমীক জানে এসব আসলে শমীকের সামনে সংযমের উদাহরণ রাখার জন্য। নইলে মদ নিয়ে আলাদা করে বাবার কোনো ছুৎমার্গ নেই। তবে বাবার ভিতরে একটা ভয় রয়েছে, শমীক যেন হোস্টেলে গিয়ে বখে না যায়। হোস্টেলের ছাত্রদের মদের নেশা নিয়ে বাবার সাথে এর আগে অনেক কথা, অনেক গল্প হয়ে গেছে শমীকের।

    আসল কথাটা অবশ্য বাবা জানে না, মামু-ও নয়!

    দীক্ষা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে শমীকের, আর সেটা একবার নয়, একাধিকবার।

    মদ খাওয়ার ব্যাপারে শমীক এখন রীতিমতন অভিজ্ঞ।

    ***

    স্কুলে কোকাকোলার বোতল এনেছিল মিলিন্দ। টিফিনের সময় লাস্ট বেঞ্চে বসে সেই বোতল থেকে পালা করে কোক খাচ্ছিল, মিলিন্দ, সদাশিব, অভিজিৎ আর রোহিত। শমীককেও অফার করল ওরা। এক ঢোঁক মুখে দিয়েই কোকাকোলার স্বাদটা একটু অন্যরকম লাগল শমীকের সেদিন। এই কোকের ঝাঁঝ কি, স্বাদটাও যেন অন্য কোকের থেকে অনেক, অনেক ভালো! কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই চোখ টিপে রোহিত বলল, “ পি লে! পি লে! আসলি চিজ হ্যায় অন্দর!”

    কোলা দিয়ে রাম খাচ্ছে ওরা। মিলিন্দ বাড়িতে ওর বাবার বোতল থেকে রাম ঝেঁপে কোকের বোতলে মিশিয়ে এনেছে।

    আজ শমীককেও দলে টানতে পেরে ওদের ফূর্তি-ই আলাদা।

    প্রথম দিনটা একটু ভয়ে ভয়ে কেটেছিল শমীকের, কিন্তু প্রথম ভয় কেটে যাবার পর থেকে আর কোনো সংকোচ রইল না।

    এর পর থেকে মাঝে মাঝে মিলিন্দদের কোকাকোলায় ভাগ বসিয়েছে শমীক। এসব খাওয়া হত ছুটির ঠিক পরে, যাতে টিচাররা মুখে কোনো গন্ধ না পান। যে দিন ওসব খাওয়া হতো, সেই সব দিনগুলোতে চানাচুর বা বার্গার বা পিজা খাওয়াতে হত অবশ্য শমীককে ওদের সবাইকে। শিবাজী পার্কে বেশ কিছুটা সময় ধরে ক্রিকেট দেখে তারপর বাড়ি ফিরত ওরা, যাতে বাড়িতেও কেউ মুখে গন্ধ না টের পায়।

    ***

    বাবা বা মামু কত কি যে জানে না!

    মা কাছে থাকলে হয়তো অবস্থাটা অন্যরকম হতো। মা’র কাছ থেকে কোনো কিছু লুকিয়ে রাখা কঠিন শুধু নয়, অসম্ভব।

    তবে মা থাকলে মামু সম্ভবত বাড়িতে বোতল আনত না। মুখে যতই তড়পাক, মাকে মামুও ভয় পায়।

    আজ বেশ কিছুদিন বাদে আবার মায়ের কথা মনে হচ্ছে। মা কেন ওকে এই সব পারিবারিক ইতিহাস বলে নি? নিজে যে জমিদারবংশের মেয়ে সেই কথা বলতে ভোলে নি, অথচ সে বংশের অন্ধকার দিকগুলো চেপে গেছে একেবারে! মা’র গল্পগুলো শুনলে মনে হবে জীবনে দুধ ছাড়া বংশের কেউ মুখে অন্য কোনো পানীয় ঠেকায় নি!

    বংশের এই অন্ধকার দিকগুলো কি শমীকের মধ্যেও এবার প্রকাশ পাবে আস্তে আস্তে, জিনের প্রভাবে?

    কোলা দিয়ে রাম খাবার সেই স্বাদটুকু নইলে এত ভালো লাগবে কেন শমীকের? মামুর মতন শমীক-ও কি রোজ সেই স্বাদের সন্ধানে ঘুরবে বয়েস হলে, চল্লিশের আগেই পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে যাবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে? নিজেকে এত নোংরা, এত দূষিত লাগছে কেন হঠাৎ? মা’র উপরে একটা অন্ধ রাগ হচ্ছে একটা কঠোর সত্যি কথাকে চেপে যাবার জন্য?

    আজ মদ খায় নি বলে যেন হঠাৎ মায়ের সাথে লড়াইটাতে জিতে গেছে বাবা।

    ১৫

    রিং বাজছে মোবাইলটাতে।

    হাতে মোবাইল রাখবার অভ্যাসটা আজ পর্যন্ত করে উঠতে পারলেন না তমালবরণ। এর অবধারিত ফল: কখন কোথায় থাকে মোবাইলটা সেটা বের করাও কঠিন হয়ে ওঠে অনেক সময়। রিং হলে তাই অনেক সময় কাছে যেতে দেরি হয়ে যায়। হতাশ বা বিরক্ত হয়ে যারা ফোন করছিল তারা সরিয়ে নেয় নিজেদের।

    অতসী ফোন করলে সাধারণত অনেকক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করে। প্রথমবার না পেলে দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার ফোন করে। কিন্তু তাঁর নিজের পুত্ররত্নটির এই ব্যাপারে ধৈর্য কম। পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে কেউ ফোন না ধরলে সে নিজে ফোন ছেড়ে তো দেবেই, আর দ্বিতীয়বার ফোন করবে না।

    যাক, তাড়াতাড়ি-ই তুলতে পেরেছেন মোবাইলটা এবারের মত। ভালোই হয়েছে, কারণ ফোনটি করেছে কিংশুক।

    -- হ্যালো!

    -- বাবা? আমি বাবুন বলছি। শমীক পৌঁছেছে তো ঠিকমতন?

    -- হ্যাঁ, এই আধ ঘন্টা হল বাড়ি ঢুকেছে। তুই চিন্তা করিস না!

    --- শরীর ঠিক আছে তো তোমার? ডাক্তার যে ওষুধগুলো দিয়েছে খাচ্ছ তো ঠিকঠাক?

    -- আরে হ্যাঁ রে বাবা। ব্যস্ত হোস না তুই। এখনো অবধি ঠিক-ই আছে সব!

    কিংশুকের ফোন-কিপ্টেমি এই বাড়িতে প্রায় প্রবাদের মতন। আগেকার দিনে নাকি সংকেতে চিঠি-চালাচালি হত যাতে চিঠির পয়সা ডাকবিভাগকে দিতে না হয়। টেলিফোনের ব্যাপারে পারলে কিংশুক এক মিনিটের মধ্যে যা যা বলবার বলে ফোন রেখে দেয়!

    কিংশুকের এই মনস্তত্ত্বটি আবার তমালবরণ বুঝে উঠতে পারেন না -- তোরা তো ছোটবেলার থেকে ফোন দেখে বড় হয়েছিস, তোরা আর ফোন করা বা ফোন আসার দাম কোথা থেকে জানবি?

    এসব কথা বললে আবার কিংশুক তারস্বরে প্রতিবাদ করতো। না, কিংশুকের ছোটবেলাতেও বাড়িতে ফোন ছিল না কোনো। ফোন জিনিসটাই ওদের বাড়িতে আসে কিংশুক ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে। এক শহর থেকে অন্য শহরে কথা বলতে তখন অনেক ঝামেলা আর প্রচুর খরচ। কেন ফালতু ফালতু তাহলে বেশি কথা বলে অযথা ফোন কোম্পানির প্রফিট বাড়াবে কিংশুক? অনেক কিছু যদি বলার থাকে তাহলে একটা চিঠি লিখতে দোষ কিসের?

    তমালবরণ অবশ্য এসব কথা বলতেন কিংশুককে একটু তাতিয়ে দিতে।

    হ্যাঁ, তমালবরণের ছোটবেলায় ফোন ছিল না আশেপাশে। যোগাযোগের সেতু ছিল চিঠি। ছিল পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড আর খাম।

    চিঠি লিখতে কেন জানি না খুব ভালো লাগত তমালবরণের। যৌবনে আত্মীয় আর বন্ধুমহলে গুছিয়ে চিঠি লেখার ব্যাপারে বেশ খ্যাতি ছিল তাঁর। বন্ধুরা দূরে কোথাও গেলে তাদের লম্বা চিঠি লিখতেন অনেক সময়।

    যে দেয় সে পায়ও।

    তমালবরণকেও প্রাণভরে চিঠি লিখতেন তাঁর বন্ধুরা।

    একবার বারো পৃষ্ঠার একটা চিঠি পাঠিয়েছিল অমরেশ, চাকরি নিয়ে ডুয়ার্সের চা-বাগানে চলে যাবার পর পর। সে চিঠি দেখে দাদা পলাশবরণ ভাইয়ের প্রেমপত্র এসেছে ধরে নিয়েছিলেন। ফলে দাদাকে চিঠি খুলে দেখিয়ে কিছুটা পড়ে শুনিয়েছিলেন তমালবরণ। শুনে ঈর্ষামিশ্রিত গলায় পলাশবরণ হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “বন্ধুরা তোকে যে কি পরিমাণ ভালোবাসে, এই চিঠি-ই তার প্রমাণ।”

    ভালোবাসার চিঠির আর এক জায়গা ছিল চারু-কাকিমা।

    চারু কাকিমাদের বাড়ি ছিল সাতবেড়িয়ায় তমালবরনদের বাড়ির পাশে। তমালবরণের মায়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিলেন চারুকাকিমা। যুবতী বয়সে প্রায় একই সাথে বৌ হিসেবে তাঁদের সাতবেড়িয়ায় প্রবেশ। প্রায় একই সাথে দুজনে সন্তানসম্ভবা হন। যেহেতু শাশুড়ি-ননদদের কড়া শাসন মানিয়ে নিতে হয়েছিল দুজনকেই একসাথে, তাই একান্ত নিজস্ব সুখদুঃখের গল্পের মাধ্যমে পরস্পরের সাথ দিয়ে এসেছিলেন তাঁরা দীর্ঘদিন। চারুকাকিমাকে বাংলা অক্ষর লেখা শিখিয়েছিলেন তমালবরণের মা। আর তার বদলে চারুকাকিমা তাঁর মাকে শিখিয়েছিলেন সেলাই। বিভিন্ন ধরণের কাঁথা আর আসন সেলাই করতে পারতেন চারুকাকিমা। জটিল জটিল নকশার আসন সে সব। থান কাপড় থেকে পোশাক বানাতে পারতেন, বানাতেনও বাড়ির সকলের জন্য।

    চারুকাকিমার দুই ছেলে বিমল আর ভোম্বলের বয়স ছিল পলাশবরণ আর তমালবরণের খুব কাছাকাছি। একই সাথে খেলতেন তাঁরা সাতবেড়িয়ার মাঠে মাঠে।

    দেশভাগের ঠিক পরে পরেই সব ছেড়ে দিয়ে এপারে আসার সাহস করেন নি চারু কাকিমারা। উপায়ও ছিল না কোনো। তমালবরণদের মতন কলকাতা বা তার আশেপাশে মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই ছিল না ওনাদের, তাই যাবার সময় চোখের জলে বিদায় দিয়েছিল ও বাড়ির সবাই।

    দেশ ছাড়ার পর-ও কয়েক বছর যোগাযোগ রেখেছিলেন চারু-কাকিমা। গোটাগোটা মুক্তোর মতন অক্ষরে লেখা তাঁর চিঠি আসত মায়ের কাছে এক একটা মোটা খামে। পুজোর পরে বিজয়ায় বড়দের প্রণাম আর ছোটদের আশীর্বাদ জানিয়ে তাঁর চিঠি আসত প্রায় অংকের নিয়ম মেনে। বছরের এই একটা সময় বাড়ির সব্বাইকে আলাদা করে চিঠি দিতেন তিনি। আনন্দমোহনের মৃত্যুর পরে পরে হঠাৎ করে চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায় চারুকাকিমার। চিঠি আসত না, তবু প্রিয় বান্ধবীকে আরও বছর দুয়েক শুভ বিজয়া জানিয়ে চিঠি লিখে গিয়েছিলেন মা। শেষে অভিমানে চিঠি লেখা বন্ধ করে দেন। পলাশবরণ আর তমালবরণের কাছে এর পর থেকে নিয়মিত অনুযোগ করত মা, “চারু-ও ভুইল্যা গ্যাছে আমাগো হগলরে। পত্তর ল্যাখনের নাম নাই আর!”

    ঠিক কি হয়েছে চারুকাকিমার সেটা জানতেন তাঁরা দুই ভাই। ভোম্বল চিঠি লিখে তাঁদের জানিয়েছিল হঠাৎ করে সাত দিনের জ্বরে ভুগে চারুকাকিমার পরপারে চলে যাবার কথা। কিন্তু মা-কে সে কথা বলে উঠতে পারেন নি দুজনের কেউ। আনন্দমোহনের মৃত্যুর পর এক গভীর অবসাদ গ্রাস করেছিল তাঁদের মা-কে। খাওয়া কমে গিয়েছিল অস্বাভাবিক রকমের। এমনিতেই পারুলবালা কথা বলতেন কম, কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর হঠাৎ করেই যেন চুপ হয়ে গিয়েছিলেন আরো। শরীর খারাপ হলেও আর কাউকে কিছু বলতেন না। একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন প্রায়, পলাশবরণ পাশে ছিলেন বলে কোনো বড় সমস্যা হয় নি। পারুলবালাকে ধরাধরি করে বিছানাতে শুইয়ে দেওয়ার সময় তাঁরা দুই ভাই আবিষ্কার করেন তাঁদের মায়ের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এসব নিয়ে কোনো অনুযোগ করলে পারুলবালার বাঁধা বুলি ছিল, “আর বাঁইচা হইব ডা কি?” মৃত্যু সম্বন্ধে নিস্পৃহ হলেও, কারুর ভার হয়ে বিছানাতে দিনের পর দিন পড়ে থাকাকে ভয় পেতেন। অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মতোই পারুলবালার একান্ত ইচ্ছে ছিল কাউকে না জ্বালিয়ে ভুগিয়ে পরপারে যাবার। শরীর যতই খারাপ থাকুক, পলাশবরণ বা তমালবরণ বাড়ি থেকে বেরোলে অবশ্য শত কাজ থাকলেও পারুলবালা বাড়ির সদর দরজার কাছে ছুটে আসতেন, গুনে গুনে একশ আট বার দুর্গানাম জপ সম্পূর্ণ না হওয়া অবধি বাড়ির মধ্যে ঢুকতেন না।

    মায়ের মৃত্যুর খবরটা ভোম্বল আর বিমলকে চিঠি লিখে পলাশবরণই জানিয়েছিলেন। খুব দুঃখ পেয়েছিল ওরা দুজনেই। ছোটবেলায় পারুলবালার হাতের বানানো আড় মাছের ঝাল আর নারকেলের ছাপ খুব প্রিয় ছিল ওদের।

    ভোম্বল বা বিমল চিঠি লিখত কম। ওরা চিঠি লিখত বর্ধমানের বাড়ির ঠিকানায়। বসিরহাটে থাকার সময় আর তার পরে অল্প কিছুদিন বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বেশ কিছুদিন কাটানোর জন্য এ’সব চিঠি তমালবরণের পড়া হত না। ওদের খবর পেতেন দাদার মুখ থেকে।

    তবু ওদের চিঠি এলে বা ওদের কথা উঠলে তার মধ্যে যেন সাতবেড়িয়ার গন্ধ পেতেন তমালবরণ।

    ষাটের দশক থেকে চিঠি লেখালেখি অস্বাভাবিক রকমের কমে গিয়েছিল সাতবাড়িয়ার সাথে। ঠিক কবে থেকে চিঠি আসা বন্ধ হল তমালবরণের ঠিক মনে নেই, তবে এটা বেশ মনে আছে যে ১৯৭১ এর যুদ্ধের পর থেকে আর কোনো চিঠি আসে নি কারুর থেকে।

    ঠিক কি হয়েছিল সাতবেড়িয়ার বাসিন্দাদের সেটা আন্দাজ করতে পারতেন তমালবরণ। বাংলাদেশ গণহত্যার পর উদ্বাস্তুদের দ্বিতীয় বড় স্রোত তখন বাংলায়। কিন্তু কেন জানি না এই নিয়ে দাদার সাথে কোন কথা বলতে ভয় হত তাঁর। পরিবার বা বন্ধুবান্ধব জনিত সব কথা দাদা তাঁর সাথে ভাগ করে নেয়, তাই দাদা তাঁর কাছে ওদের কোন খারাপ খবর জানলে চেপে যাবে এমন কোন সম্ভবনা নেই, তবু তমালবরণের ভয় হত যে দাদা জানে যে ওদের কি হয়েছে আর দাদা তাঁকে সেসব বলতে চায় না। তমালবরণ নিজেও এই নিয়ে কোন কথা বলতে চাইতেন না, যেন এই নিয়ে কোন কথা বললে নিজের যেটুকু বিশ্বাস রয়েছে বিমল-ভোম্বলরা বেঁচে আছে বলে সেটুকুও আর থাকবে না।

    ***

    মা মারা যাবার পর মায়ের জিনিসপত্তর ঘাঁটতে ঘাঁটতে চারুকাকিমার লেখা চিঠিগুলো একটা ট্রাঙ্কের মধ্যে পেয়েছিলেন তমালবরণ। তারিখ অনুযায়ী সমস্ত চিঠি যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে মা। যত রাগ, যত অভিমান হোক প্রিয় বান্ধবীর উপর, প্রাণে ধরে চিঠিগুলো ফেলে দিতে পারে নি। কোনো কিছুই প্রাণে ধরে ফেলতে পারত না মা। ভাঙা বালতি, দেবে যাওয়া বাসন, পুরোনো ছেঁড়া কাপড় সব কিছুর জায়গা হত খাটের তলায়।

    “তৃণ হতে কার্য হয় রাখিলে যতনে!”

    বড় হবার পর মা’র এই কথা নিয়ে কত হাসাহাসি করেছেন তাঁরা দু’ভাই।

    “রাশিরাশি ঘাস আইন্যা দেই তাইলে তোমারে, দেহি কত কার্য হয় তুমার অই ঘাস দিয়া!”

    ***

    বহুদিনের পুরোনো কাগজের একটা বিশেষ গন্ধ থাকে। গন্ধটা খুব আরামের নয়। তবু ট্রাঙ্ক খুলে প্রথমবার চারুকাকিমার চিঠিগুলো হাতে নিয়ে পরিষ্কার সাতবেড়িয়ার কাদামাটির গন্ধ পেয়েছিলেন তমালবরণ।

    মা-ও নেই, চারুকাকিমাও নেই আজ। তাই একটু দ্বিধা হলেও চিঠিগুলো পড়ে ফেলেছিলেন তমালবরণ।

    প্রিয়সখীকে অনেক গুপ্ত ব্যক্তিগত কথা লিখেছেন চারুকাকিমা। নিজের মেনোপজের আগের আর পরের সমস্যা, ছেলে-ছেলে বৌয়ের যৌন সম্পর্ক নিয়ে উৎকণ্ঠা -- সব! আনন্দমোহনের পাগলামি নিয়ে চিন্তা ছিল তাঁর। মা নিশ্চয়ই চিঠিতে লিখেছিলেন এসব কথা। একটা চিঠিতে চারুকাকিমা জানতে চেয়েছেন মায়ের কাছে, আজকাল রাতের বেলা আনন্দমোহন পুরোনো দিনের মতন আদর-টাদর করছেন কিনা! মাকে উপদেশ দিয়েছেন নিজে উদ্যোগ নিয়ে বরের সাথে মিলিত হতে। নিয়মিত মিলন না হলেই নাকি পুরুষের এই সমস্ত পাগলামি শুরু হয়!

    পড়তে পড়তে ভাবছিলেন তমালবরণ। ভাগ্গিস এই সমস্ত চিঠি তিনি অল্পবয়সে পড়েন নি। অল্পবয়সে নিজের মা-বাবার মিলন সংক্রান্ত কোনো কথা জানলে কেন জানি না একটা ঘৃণা আসে তাদের প্রতি। অথচ এই ঘৃণার কোনো কারণ নেই। পলাশবরন-তমালবরন-অনিমা সকলেই তো এই মিলনেরই ফসল। তাহলে কেন এই ঘৃণা?

    পরিণত বয়সে চারুকাকিমার চিঠিগুলো পড়তে পড়তে মায়ের জন্য ভীষণ একটা মায়া হয়েছিল তমালবরণের। কে জানে মা চারুকাকিমার কথা মতন চেষ্টা করেছিলেন কিনা বাবার মন ফেরাতে। চেষ্টা করলেও সফল যে হন নি সেটা পরিষ্কার। কোনো মধ্যবয়সী মহিলা স্বামীর মঙ্গলের জন্য মিলন চেয়েও প্রত্যাখ্যাতা হচ্ছে, এর চেয়ে করুণ কিছু আর কি হতে পারে?

    এসব একান্ত ব্যক্তিগত কথা বাদ দিলেও চারুকাকিমার চিঠিগুলোর থেকে এমন বেশ কিছু পুরোনো তথ্য পেয়েছেন তমালবরণ যা তাঁর আগে জানা ছিল না। এর একটি হল চল্লিশের দশকের সাতবেড়িয়ার রাজনীতি। যদিও চিঠিগুলি অনেক পরে লেখা, তাই চল্লিশের দশকের কথা এখানে এসেছে চিঠিতে যেটা বর্তমান কাল তার প্রেক্ষাপটের প্রসঙ্গে, তবু যা রয়েছে সেটাও অনেক। চারুকাকিমার চিঠিগুলো তাঁকে চল্লিশের দশকের মুসলমান গ্রামবধূদের মনের ভাব বুঝতে সাহায্য করেছে। এদের অনেকের সাথেই একসময় ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল চারুকাকিমার। চারুকাকিমার কাছে সেলাই শিখতে আসত তারা। তবে ব্রাহ্মণ বাড়ির ভিতরে ঢুকত না তারা। দাওয়ার নিচে বসে থাকতো। আর দাওয়ার উপর থেকে তাদের শেখাতেন চারুকাকিমা। তারা চলে যাবার পর আবার পরিষ্কার করা হত দাওয়ার নিচটা।

    আশ্চর্য এই যে সেই সব দিনে এসব নিয়ে মনে হয় নি কিছু। নাওয়া খাওয়ার মত স্বাভাবিক ছিল এই সব সামাজিক নিয়ম।

    তারপর এল ঝড়। আজ মনে হয়, অবধারিত ছিল এই ঝড় আসা। ইতিহাস বলে যে একদল মানুষ অন্যদলকে ক্রমাগত অপমান করে এলে ঝড় আসবেই।

    রাজনীতি এমনই জিনিস যে চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি উঠল সেই তুফান, যাবার আগে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেল সব কিছু। এই সবকিছুর মধ্যে একটি হল তমালবরণের নিজের জীবন।

    ***

    মায়ের মতন সব কিছু যত্ন করে সাজিয়ে না রাখলেও, চিঠি -- তা সে যার-ই হোক -- যত্ন করে তারিখ অনুযায়ী সাজিয়ে রেখে দিতেন তমালবরণ। পরে নিজের স্মৃতিকথা লেখার সময় খুব কাজে এসেছে এই সব চিঠিগুলো। নিজে ঐতিহাসিক বলে চিঠি সাজিয়ে রাখাটা হয়তো স্বাভাবিক ছিল তাঁর কাছে, কিন্তু তমালবরণ জানেন সেটা খালি ইতিহাসের তাগিদে নয়।

    চিঠিকে এত গুরুত্ব দেবার আসল কারণ লুকিয়ে রয়েছে তাঁর ছেলেবেলার শিক্ষাতেও।

    দুপুরবেলা খাবার পর সাতবেড়িয়ার বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় আসনপিঁড়ি হয়ে বসে সামনে একটা জলচৌকি রেখে একের পর এক চিঠি লিখতেন অঘোরনাথ। আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, পুরোনো সহকর্মী কেউ বাদ যেত না এই সব চিঠির থেকে। আত্মীয়দের বাড়ি চিঠি পাঠালে বাড়ির প্রত্যেককে আলাদা করে এক দু লাইন লিখতেন অঘোরনাথ। ভাই ভূতনাথ-ও অবশ্য চিঠি লেখার ব্যাপারে খুব কম ছিলেন না। অনেক সময় পাশাপাশি বসে চিঠি লিখে যেতেন দুই ভাই।

    একবার কৌতুকের ছলে দুই দাদুকে প্রশ্ন করেছিলেন তমালবরন

    -- এত পত্তর লেখো ক্যান? কার লইগ্যা?

    ছোটদাদু ভূতনাথ হেসেছিলেন প্রশ্ন শুনে।

    হেসেছিলেন অঘোরনাথও।

    ভূতনাথ কোনো উত্তর দেবার আগে অঘোরনাথ বলেছিলেন, “নাতিবাবু, পত্তর হইল গিয়া আপোনের আত্মার অংশ। ইয়ারে অবহেলা কইরো না কোনোদিন!”

    ***

    চিঠি জিনিসটা উঠে যাবার পর ইমেল লেখার ব্যাপারে হাত পাকানোর চেষ্টা করেছিলেন তমালবরণ। কিন্তু সমস্যা হত এই যে টাইপ করতে পারতেন না দ্রুত। আর ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখাটা অনেকটা মাংস দিয়ে আম খাবার মতন লাগত তাঁর।

    মাঝে মাঝে টেকনোলজির অভাবনীয় উন্নতিতে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যেতেন তমালবরণ। তাঁদের সময়টাতে যদি টেলিফোন আর মোবাইল থাকতো! মানুষে মানুষে দূরত্ব এক নিমেষে ঘুচিয়ে দিতে পারে এই সব যন্ত্র। তবু মানুষ কেন যে এত একা …

    সারাক্ষণ ভালোবাসার লোকেদের সাথে কথা বলার উপকরণ সাজানো থাকলে বিদেশ আর বিদেশ থাকে না, নিজের ঘরের মতনই হয়ে যায় তখন।

    কে বলতে পারে, এসব জিনিস থাকলে হয়তো ছেঁড়া ঘুড়ির মতন লাটাই ছাড়া হয়ে তাঁকে ভেসে যেতে হত না নতুন দেশে ...

    ***

    আজ একটা চিঠি এসেছে আবার বহুদিন পরে।

    ব্যাংক থেকে এসেছে চিঠিটা, খামের ভিতরটা ফুলে রয়েছে যেন প্রেমপত্তর। ওই প্রেমপত্তর খুলে পড়বার ইচ্ছে নেই আর তমালবরণের। থাক, পড়ে থাক ওই চিঠি। একান্ত ব্যক্তিগত চিঠি ছাড়া অন্য চিঠি এমনকি খুলে দেখার ইচ্ছেটাও এখন আর নেই। অত মোটা চিঠি ঘনিষ্ঠ কেউ তাঁকে লিখলে অবশ্যই খুলে তা পড়তেন সাথে সাথে!

    অমরেশের সেই বারো পৃষ্ঠার চিঠিটা ছাড়া আর অবশ্য এত মোটা ব্যক্তিগত চিঠি পান নি তমালবরণ, সবই বড়জোর এক বা দুই পৃষ্ঠার।

    এমন কি কৃষ্ণারও।

    বেশি ফেনিয়ে লিখতে পারত না কৃষ্ণা। বেশি চিঠি লেখেও নি তমালবরণকে, লিখবার দরকারও পরে নি। খুব বেশিদিন একটানা তমালবরণকে ছেড়ে কাটায় নি কখনো কৃষ্ণা।

    শুধু একবার তিনমাস একটা লম্বা বিচ্ছেদে কেটেছিল তাঁদের। তমালবরণ যখন কামটিতে এনসিসি ট্রেনিঙের জন্য গিয়েছিলেন, সেই চীন যুদ্ধের সময়ে।

    ***

    সেদিন সন্ধ্যাবেলা কৃষ্ণার চিঠিটাই পড়ছিলেন তমালবরণ, কামটির ব্যারাকে বসে। প্রায় দশ দিন পরে চিঠি এল এবার কৃষ্ণার। মাঝের সাত দিন সর্দিজ্বরে ভুগেছে। শরীর এখনো দুর্বল।

    ভাবছিলেন তমালবরণ চিঠি আর লিখবেন কিনা। আর তিনদিন পরে বাড়ি ফিরছেন তাঁরা। ট্রেনিং শেষ হবার মুখে। এখন চিঠি লিখলেও কৃষ্ণা সেটা পেতে পেতে বাড়ি পৌঁছে যাবেন তাঁরা। কিন্তু অভিমানী কৃষ্ণা হয়তো সেটা বুঝবে না, জবাব না পেলে ঠোঁট ফোলাবে বাচ্চা মেয়েদের মতন।

    এক কাজ করলে হয় না? তমালবরণ চিঠিটা লিখবেন, কিন্তু পোস্ট করবেন না। বাড়ি পৌঁছেই সোজা হাতে ধরিয়ে দেবেন কৃষ্ণার। জীবন্ত প্রমাণ যে বর বিদেশে গিয়েও তোমাকে ভোলে নি, তোমার চিঠি আসার পর তার জবাব লিখতে বসে গেছে সাথে সাথে!

    মনে মনে মুচকি হেসে কাগজ আর কলম নিয়ে বসলেন তমালবরণ!

    -- হ্যালো টম, আই মিন চ্যাটার্জী!

    মেজর বিকাশ শর্মা দরজায়।

    ***


    এই এক আপদ হয়েছে এখানে। তমাল নামটাকে আরও ছোটো করে টম বলে তাঁকে ডাকা। উচ্চপদস্থ অফিসাররা ডাকলে কিছু বলাও মুশকিল, তবু হাসতে হাসতে এই মেজর সাবকেই বলেছিলেন তমালবরণ, “যে ইংরেজের বিরুদ্ধে এত লড়লাম আমরা সেই ইংরেজদের নামই দিয়ে দিলেন আমায়, স্যার?”

    -- “কেন নামটা পছন্দ হয় নি তোমার?”

    -- না, একেবারে নয়।

    “ঠিক আছে, জানা রইলো” বলে দুষ্টু হাসি হেসেছিলেন মেজর শর্মা। সেই থেকে তমালবরণ হয়ে গেলেন, “টম, আই মিন চ্যাটার্জী!”

    বেঁটেখাটো গাঁট্টাগোট্টা চেহারা মেজর বিকাশ শর্মার। মুখে সব সময় হাসি লেগে রয়েছে। সবার সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা করেন, সাধারণ সৈনিক থেকে নিজের বসেদের সাথেও।

    এখানে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে তাই ভীষণ জনপ্রিয় মেজর শর্মা।

    অথচ এই হাসি খুশি লোকটার মধ্যেই আবার একটা লৌহদৃঢ় চরিত্র লুকিয়ে রয়েছে। ট্রেনিঙের সময়ে সেটা বোঝা যায়।

    প্রথম দিন হাসতে হাসতে সবাইকে বললেন, “আজ দৌড় দৌড় খেল হোগা”। তারপর সকলে তাঁরা ছুটছেন তো ছুটছেনই। যতক্ষণ না হুকুম আসছে, থামতে পারবেন না।

    আর পাঁচজন বাঙালির মতন তমালবরণের অবশ্য খুব একটা অসুবিধে হয় নি দৌড়োনোর কোটা কমপ্লিট করতে। সেজন্য তমালবরণকে সেদিন থেকেই একটু আলাদা নজরে দেখা শুরু করেন মেজর শর্মা।

    ***

    -- Chatterjee, you know, you are just fantastic with guns!

    উত্তর ভারতের অন্য অফিসাররা সাধারণত হিন্দিতে কথা বলেন। কিন্তু মেজর শর্মার একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব রয়েছে যে অন্য অফিসারদের তুলনায় তিনি উচ্চশিক্ষিত। তমালবরণ যেহেতু অধ্যাপক, তাই তাঁর সাথে হিন্দি না বলে ইংরেজি বলেন মেজর শর্মা।

    তমালবরণকে থ্যাংকস জানানোর কোনো সুযোগ না দিয়েই আবার কথা বলা শুরু করেন মেজর শর্মা।

    -- No, no, I am serious! You know, I am one of the top shooters in the Indian army. At one point of time, I used to be among the top twenty in the entire army and you have beaten me today with virtually no training! You must pursue shooting! If you continue, we may offer you special sniper training. And who knows, with a bit of luck you may even represent India in international events!

    এবারে কাজের কথায় আসেন মেজর শর্মা। নাগপুরে তাঁদের পারিবারিক কাপড়ের ব্যবসা। চ্যাটার্জী ইন্টারেস্টেড থাকলে মেজর শর্মা তাঁর বড় ভাইকে বলতে পারেন তাঁকে ম্যানেজারের চাকরি করে দেওয়ার জন্য। মাইনে পত্তর বা সুযোগ সুবিধা অধ্যাপনার চেয়ে কম হবে না কিছু। উপরি পাওনা হল রাইফেল শুটিং চর্চা চালিয়ে যেতে অসুবিধে হবে না কোনো।

    এরকম একটা প্রস্তাবের জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিলেন না তমালবরণ। মেজর শর্মাকে জানালেন সেটা, বারবার করে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন একটু সময় দিতে।

    -- No hurry! Please go back and discuss with your family and then drop me a letter. You know the address of this cantonment, right?

    ***

    পরের তিন দিন ধরে ভেবে ভেবেও ঠিক করতে পারলেন না তমালবরণ তাঁর কি করা উচিত।

    ভালো চাকরি, মাইনে আর অন্যান্য সুযোগসুবিধা প্রচুর, কিন্তু প্রাইভেট চাকরিতে নিশ্চয়তা নেই কোনো। আজ বিকাশ শর্মা খুশি ওনার উপর, কাল বিগড়োলে তমালবরণ কোথায় যাবেন? নাগপুরে আসা মানে বর্ধমানের বাড়ির সবাইকে ছেড়ে আসা। কৃষ্ণা অবশ্য সঙ্গে আসবে তাঁর। সেটাও একটা বড় চিন্তার কারণ। কৃষ্ণা কি পারবে মানিয়ে নিতে এখানে নতুন করে? হিন্দি তো একেবারেই বলতে পারে না কৃষ্ণা, ইংরেজিও খুব একটা ভালো নয়!

    এছাড়াও একটা বড় ব্যাপার তাঁর গবেষণা। কাজ এগিয়ে গেছে অনেকটা। এখানে চলে এলে সেই কাজ বোধ হয় শেষ হবে না কোনোদিন।

    অন্যদিকে, অফারটা লোভনীয়, সন্দেহ নেই। মাইনে প্রায় এখন যা পাচ্ছেন তার দেড়গুণ, ভালো কাজ দেখাতে পারলে ভবিষ্যতে আরও বেড়ে যাবার সম্ভবনা রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে বন্দুক চালানোর দিকটা।

    মনে মনে স্বপ্ন দেখা শুরু করেন তমালবরণ, ন্যাশনাল কম্পিটিশনে প্রথম হয়েছেন তিনি। অলিম্পিকে তাঁর নাম নমিনেটেড হয়েছে। দেশকে মেডেল এনে দেবার জন্য বারংবার বিদেশে পাঠানো হচ্ছে তাঁকে সরকারি খরচে।

    ট্রেনে আসতে আসতেও এই সবই ভাবছিলেন তমালবরণ। প্রথম রাতটা ভেবেও কিছু ঠিক করতে পারলেন না। এরকম দ্বিধার মুখে তিনি এর আগে কখনো পড়েন নি।

    নিজের মনের কাছ থেকে জবাবটা হঠাৎ করেই পেয়ে গেলেন তমালবরণ যখন ট্রেন বরাকর নদী পেরিয়ে বাংলায় ঢুকল।

    তিন মাস পরে আবার বাংলার মাটিতে। অদ্ভুত এক উল্লাসে মন ভরে গেল তাঁর। রুক্ষ পাহাড়ি মালভূমি নয়, শ্যামল কোমল বাংলার মাটি -- এতদিন পরে আবার এই মাটিতে ফিরে এলেন তিনি।

    হঠাৎ করে ভীষণ, ভীষণ অধৈর্য লাগছে। এত আস্তে কেন যাচ্ছে ট্রেনটা?

    বর্ধমানে সবাইকে আবার দেখবেন তিনমাস পরে। পাড়াতে, কলেজে বন্ধুবান্ধব আর সহকর্মীদের সাথে মন উজাড় করে আড্ডা দেবেন। তিন তিন মাস কোনো কথা হয় নি এদের কারুর সাথে। হঠাৎ করে এরা সকলেই যেন ভীষণ আপন হয়ে উঠেছে তাঁর কাছে।

    এত আনন্দ একটা জিনিসই প্রমাণ করে।

    তিনি বাঙালি, তাঁর আসল জায়গা এই বাংলার মাটিতে।

    যত অভাব অনটন-ই আসুক, এই বাংলার মাটি ছেড়ে সুখী হবেন না তিনি। পারবেন না আর একবার রুক্ষ মালভূমির দেশে গিয়ে প্রবাসীর জীবন কাটাতে।

    না, বর্ধমান পৌঁছেই মেজর বিকাশ শর্মাকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেবেন তিনি যে নাগপুরের চাকরিটা নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments