• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | উপন্যাস
    Share
  • শিকড় (৭) : কৌশিক ভট্টাচার্য





    ১৮

    গোলার মাঠের পাশের রাইস মিলটাকে একটা জাদুর দেশ মনে হত শমীকের। বোম্বে তো এত বড়ো একটা শহর, তবু ঠিক এরকম জায়গা বোম্বেতে কখনো দেখে নি শমীক।

    সেবার শীতকালে ক্রিসমাসের ছুটিতে বর্ধমান এসেছিল ওরা, দু দিনের জন্য। সকালবেলা কলকাতা থেকে বর্ধমানে পৌঁছতে না পৌঁছতে অন্তু-সন্তু রাইস মিলের ভিতরে নিয়ে গিয়েছিল শমীককে।

    বিশাল চওড়া শানবাঁধানো একটা আঙিনা রাইস মিলের ভিতরে। মাঝে মাঝে একটু করে জায়গা বাদ দিয়ে শঙ্কুর মতন সূঁচালো হয়ে উপরে উঠে এসেছে সেই শানবাঁধানো জমি। কিছু কিছু শঙ্কু আবার ঢাকা, বেত আর কঞ্চি দিয়ে বানানো বেশ কিছু আরও বড় শঙ্কু রাখা সেগুলোর উপর, দেখে মনে হয় চাষির মাথায় পড়বার বিশাল কিছু টুপি রাখা আছে। সেদ্ধ ধান রোদে দেওয়া হয় এই শানবাঁধানো জমিতে।

    শমীকরা যখন গেল তখন ধান ছড়ানো হচ্ছে মেঝেতে। ধান জিনিসটা এর আগে ভালো করে দেখে নি শমীক। চাল হয় এই ধান থেকে, আর সেই চাল থেকে ভাত? কি অদ্ভুত!

    -- কি বিশাল শানবাঁধানো জায়গা জুড়ে রাইসমিলটা।

    হাসল অন্তু-সন্তু। সন্তু বলল, “চল, আগে বয়লার-টা দেখে নে।”

    মস্ত বড় বয়লার। বোম্বের মাঝারি সাইজের ফ্ল্যাটবাড়ির মতন উঁচু। নিচের থেকে সঠিক উচ্চতা বোঝা যায় না, তবে শমীকের মনে হল এর উচ্চতা অন্তত সত্তর আশি ফুট হবে। ইঁট আর সিমেন্টের পাঁচিল বানিয়ে ছোট ছোট চৌবাচ্চার মতন করা বয়লারের আশেপাশে। সিঁড়ি বেয়ে সেই পাঁচিলের উপর উঠলে দেখা যায় চৌবাচ্চাগুলোর বেশির ভাগ-ই বিভিন্ন যন্ত্র আর পাইপলাইনে ভর্তি। এই পাঁচিলগুলো বেশ চওড়া। তিনজনে পাশাপাশি দাঁড়াতে অসুবিধে হয় না। উঁচুও প্রায় এক তলার মতন। এখান থেকে ধানকলের পিছন দিকটা দিব্যি দেখা যায়।

    -- কালো গুঁড়ো গুঁড়ো ওগুলো কি রে পাঁচিলের বাইরে?

    -- ওগুলো ধানের তুষ। অনেক সময় ধিকি ধিকি করে আগুন জ্বলে ওর ভিতরে।

    -- আর ওই বাড়িগুলো?

    পাঁচিলের একদিকে বেশ কিছু এক কামরার টালির চালের ঘর।

    -- ওগুলোতে ধানকলে যারা কাজ করে তারা থাকে। টেরু আর ওর মা আগে থাকত ওখানে। এখন ধানকলের বাইরে পাশের পাড়ার একটা ঘরে উঠে গেছে।

    এইটুকু একটা এক কামরার ঘরে থাকত টেরু?

    পাঁচিল থেকে নিচে নেমে এল ওরা।

    “তোরা প্রায়ই আসিস এখানে?”, শমীক জিজ্ঞাসা করল।

    অন্তু বলল, “না, এমনিতে রোজ রোজ আসি না মোটেই। আজ তুই এলি তাই তোকে নিয়ে এলাম দেখাতে।”

    পাশ থেকে সন্তু বলল, “শীতকালে অবশ্য আমরা মাঝে মাঝে ভিতরটাতে আসি। অনেকটা ফাঁকা জায়গা বলে এখান থেকে ঘুড়ি ওড়ানোর খুব সুবিধে!”

    -- ঘুড়ি ওড়াতে পারিস তোরা?

    -- হ্যাঁ। খুব ভালো অবশ্য পারি না, তবে ভালো হাওয়া দিলে অসুবিধে হয় না।

    -- শিখিয়ে দিবি আমায়?

    পাশ থেকে বিজ্ঞের মতন মাথা নাড়ল সন্তু, “একদিনে হবে না। দ্যাখ আগে কেমন করে ওড়াই আমরা। বাড়ি চল, বাড়ির ছাত থেকে ওড়াবো।”

    এর আগে ঘুড়ি জিনিসটার শুধু ছবি দেখেছে শমীক। সেই ঘুড়ি ওড়ানো হবে এখন? ছাতের থেকে?

    মনে হচ্ছে বর্ধমানে আসাটা সার্থক হয়েছে এবার।

    ***

    বেশ হাওয়া দিচ্ছিল। শীতের হাওয়া।

    বোম্বেতে সারা বছরই ঠান্ডা থাকে না সেরকম। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসেও একটা হাফ সোয়েটারই বেশির ভাগ সময়ে ঠান্ডা কাটিয়ে ওঠার পক্ষে যথেষ্ট।

    বর্ধমানে যদিও হাঁড়কাঁপানো ঠান্ডা পড়ে না, তবু হাওয়া দিলে একটা শিরশিরে ভাব লাগে সারা শরীরে। পিছনে একটু দূরে রাইসমিল আর সামনে অনেকটা পোড়ো জমি বলে এই ফাঁকা জায়গাটা জুড়ে জব্বর হাওয়া খেলে।

    দেখতে দেখতে অনেক উপরে উঠে গেল ওদের ঘুড়িটা।


    ঘুড়ি উপরে তোলবার সময় শমীককে কিছু করতে দেয় নি অন্তু-সন্তু। অবাক বিস্ময়ে শমীক দেখেছে কিভাবে হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে টেনে ঘুড়িটাকে উপরে ওঠাচ্ছে অন্তু-সন্তু। লাল রঙের ঘুড়ি ওদের, লেজের কাছটা অবশ্য বেগুনি। প্রথম দিকে বার দুয়েক ঘুড়িটা উপরে উঠতে চাইছিল না, যেন বলতে চাইছিল, “কেন শুধু শুধু বিরক্ত করছো আমায়, কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমোব এখন!”। ওদের সমবেত প্রচেষ্টায় তৃতীয়বারের বার উপরে উঠল ঘুড়িটা।

    কিছুক্ষণ পরে আঙ্গুল ছেড়ে লাটাই হাতে নিলো অন্তু। অবাক হয়ে শমীক দেখল নিজের থেকেই লাটাই থেকে সুতো টেনে নিচ্ছে ওদের ঘুড়ি।

    “ব্যাস, আর ভয় নেই, হাওয়া পেয়ে গেছে ঘুড়ি। এই নে!” বলে লাটাইটা শমীকের দিকে বাড়িয়ে দিলো অন্তু।

    লাটাইটা হাতে নিয়ে একটা অদ্ভুত উল্লাসে মন ভরে গেল শমীকের।

    -- টিপে ধরিস না। আলগা করে রাখ আঙুলগুলো। ঘুড়ি আপনা থেকেই সুতো টেনে নেবে লাটাই থেকে।

    তাই করছিল শমীক।

    -- দাঁড়া, এবার আমাদের দে একবার। ওই দেখতে পাচ্ছিস, দু দিকে আরও দুটো ঘুড়ি উড়ছে, একটা তুঁতে রঙের আর একটা পেটকাটি। সাবধানে না থাকলে প্যাঁচ লাগিয়ে দেবে।

    -- পেটকাটি মানে?

    -- ওটা ঘুড়ির নাম। ঘুড়িটার উপরের আর নিচের দুটো তিনকোনা দুরকম রং। পেট বরাবর রংটা আলাদা হয়েছে বলে নাম পেটকাটি।

    -- বাঃ, তোরা ভালো নাম দিলি তো ঘুড়িটার।

    -- আমরা কেন দেবো? নামটা আগে থেকেই আছে। এক এক ঘুড়ির এক এক নাম!

    যত শুনছে তত অবাক হচ্ছে শমীক। বোম্বেতে কেন যে লোকে ঘুড়ি ওড়ায় না!

    “সাবধান, অন্তু! পেটকাটি কিন্তু গোঁত্তা খেয়ে নিচে নামছে!”, সন্তু বলল।

    বলার দরকার ছিল না। ঘুড়ি ওড়ানোয় একই রকমের অভিজ্ঞ অন্তু। কিছু বলার আগেই পেটকাটিকে মেপে নিয়েছে ও।

    লাটাই নিয়ে কায়দা করে গোটাতে লাগল অন্তু। বাঁ দিকে টাল খেয়ে নিচে নামতে লাগল ওর ঘুড়ি, একদম পেটকাটি ঘুড়িটার খুব কাছে।

    কোথা থেকে কি হল কিছু বুঝতে পারল না শমীক, দেখল বিপুল উল্লাসে লাফাচ্ছে অন্তু-সন্তু, “ভোঁ-কাট্টা!”

    -- হল কি তোদের?

    -- আরে, প্যাঁচ লড়লাম, দেখতে পেলি না? ওই পেটকাটিটাকে কেটে দিয়েছি আমরা!

    পেটকাটি ঘুড়িটা ল্যাগব্যাগ করে হাওয়ায় ভেসে চলেছে। দিব্যি বোঝা যাচ্ছে লাটাইয়ের সাথে ওর আর কোনো সংযোগ নেই।

    পেটকাটির পর আরও দুটো ঘুড়ির সাথে প্যাঁচ লড়ল ওরা। দুটোকেই ভোঁ কাট্টা করে দিলো অন্তু-সন্তু।

    -- ঘুড়ি ওড়াচ্ছিস?

    বাবা যে কখন এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পায় নি শমীক।

    “দিবি নাকি একবার আমায়?”, অন্তু-সন্তুকে ইঙ্গিত করে ওদের হাত থেকে লাটাইটা নেয় বাবা।

    -- তুমি ওড়াবে, কাকু?

    খুশিতে মুখ ঝলমল করে ওঠে ওদের।

    এবার অবাক হবার পালা শমীকের।

    -- তুমি পারো ঘুড়ি ওড়াতে?

    “তুই তো জানিস না, ছোটবেলায় প্রচুর ঘুড়ি উড়িয়েছি আমরা।”, বাবার মুখ ঝলমল করছে হাসিতে, “অনেকদিন অভ্যাস নেই, তবু মনে হয় অসুবিধে হবে না।”

    সত্যিই অসুবিধে হচ্ছিল না কিংশুকের। দিব্যি সামলাচ্ছিল ঘুড়িটা, কখনো লাটাই দিয়ে কখনো বা দুই আঙ্গুল দিয়ে মাঞ্জাসুতো ধরে।

    -- সাবধান কাকু, পিছন থেকে তিলকধারী আসছে কিন্তু।

    -- আসতে দে।

    -- বড় ঘুড়ি, পেটে ঢুকে টান মারবে, সাবধান!

    -- জানি, বড় ঘুড়ি বলেই তো চুপচাপ অপেক্ষা করছি।

    উপর থেকে বাজপাখির মতন গোঁত্তা খেয়ে নেমে আসছে তিলকধারী ঘুড়িটা। হাতের কায়দায় নিজের ঘুড়িটাকেও একবার গোঁত্তা খাওয়াল কিংশুক, তারপর টাল খাওয়াল বাঁ দিকে। প্যাঁচ লেগেছে। লাট খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে কিংশুকের ঘুড়ি এখন।

    -- ভোঁ কাট্টা!

    আনন্দে বাচ্চা ছেলের মতন লাফিয়ে ওঠে কিংশুক। সাথে যোগ দেয় অন্তু-সন্তু আর শমীক।

    -- ওঃ, তুমি এইখানে! আর আমি সারাবাড়ি গোরু-খোঁজা খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমাকে!

    রাগে মুখ লাল হয়ে গেছে অতসীর।

    “কি হল আবার?” অপরাধী অপরাধী মুখ করে কিংশুক বলে অতসীকে।

    -- হবে আবার কি? বাথরুমে তেল, সাবান, শ্যাম্পু কিচ্ছু রাখে নি তোমার মা। প্রত্যেকটা জিনিস যদি চেয়ে নিতে হয় কেমন লাগে বল তো?

    -- ঠিক আছে, আমি গিয়ে চেয়ে নিচ্ছি সব!

    -- না, চাইতে হবে না আর দয়া করে। যে সাবান আর শ্যাম্পু জুটবে তাতে গায়ে খড়ি উঠবে আর মাথার চুল পড়ে যাবে সব। তুমি এক্ষুনি যাও, বাজার থেকে কিনে আনো ওগুলো!

    বলতে বলতে শমীকের দিকে নজর পড়ে অতসীর।

    -- এ কি? এই হাওয়ার মধ্যে একটা স্রেফ পাতলা হাফ সোয়েটার পরে রয়েছিস? আয়, নিচে নেমে আয় এক্ষুনি, ফুলস্লিভ আর মাফলার পর শিগগির।

    ফের রেগে লাল হয়ে কিংশুকের দিকে তাকাল অতসী, “শমীককে দেখবে তো একটু। এতক্ষণ ধরে এইসব চলছে অথচ তোমার কোনো নজর নেই। সবই আমার দায় কেবল!”

    শমীককে নিয়ে বকতে বকতে নিচে নেমে যায় অতসী।

    ***

    দুপুরবেলা খাবার পর আবার ছাতে।

    তবে এবারে ভালমতন গরম পোশাক পরে আর মায়ের অনুমতি নিয়ে।

    হাওয়া একটু কমে এসেছিল বলে ঘুড়িটা তুলতে এবার সময় লেগেছিল অনেকটা।

    নিচে না থাকলেও, উপরে অবশ্য হাওয়া রয়েছে। এখন দিব্যি উড়ছে ঘুড়িটা।

    ইতিমধ্যে লাটাই ছাড়াও দুই আঙুলে ঘুড়ি ওড়াবার চেষ্টা করে দেখেছে শমীক। বেশ শক্ত ব্যাপারটা। অন্যান্য সমস্ত কিছুর মতন অভিজ্ঞতা লাগে ভালো ঘুড়ি ওড়াতে। আঙ্গুল দিয়ে ওড়াতে গেলে এর উপরে আবার সাবধান-ও থাকতে হয়, মাঞ্জার কাঁচে হাত যাতে কেটে না যায়। তবে এর মধ্যে একটা জিনিস বুঝে ফেলেছে শমীক, ঘুড়ি অনেকটা উপরে উঠলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করাটা অনেক সোজা হয়ে যায়। লাটাই থেকে সুতো ছাড়ো বা গোটাও। গোটালে একটু উপরে উঠবে ঘুড়ি আর ছাড়লে এগিয়ে যাবে আপন মনে। একটু শুধু নজর রাখা দরকার যাতে সুতোটা নিচে নেমে কোনো গাছে জড়িয়ে না যায় বা কোনো উঁচু বাড়ির ছাতে ঘষা না খায়।

    দিব্যি কাটছিল সময়টা।

    আরও দুটো ঘুড়িকে কেটেছে ওরা এর মধ্যে।

    দ্বিতীয় ঘুড়িটা কাটার পর অন্তু শমীককে বলল, “তুই খুব পয়া, এর আগে একসাথে কোনোদিন এতগুলো ঘুড়ি আমরা কাটতে পারি নি।”

    হঠাৎ এক লাফে অন্তুর কাছে এসে সন্তু চ্যাঁচালো, “সন্তু, কালো ঘুড়ি!”

    -- কই? কোথায়?

    লাট খেতে খেতে পিছন থেকে এগিয়ে আসছে একটা কালো ঘুড়ি। যদিও অনেকটা উপরে, তবু নিচের থেকে দেখে মনে হয় আকাশের অন্য সব ঘুড়ির চেয়ে অনেক বড় সাইজের।

    -- নামা, নামা, শিগগির নামা।

    লাটাই ছেড়ে দু হাতে টেনে ঘুড়ি নামাতে থাকে ওরা। চোখেমুখে একটা ভয়ের ছাপ ওদের।

    -- কি রে, কি হল হঠাৎ? এত ভয় পেলি কেন?

    কালো ঘুড়িটাকে নাকি কখনো প্যাঁচে হারানো যায় না। আজ অবধি যতবার ওই ঘুড়িটাকে প্যাঁচ খেলতে দেখেছে ওরা, ততবারই জিতেছে ওই কালো ঘুড়িটা। পেটে হোক, ঘাড়ে হোক --ওই কালো ঘুড়ির সাথে লড়াইয়ে জেতার আশা নেই কারুর।

    অন্তু-সন্তুর ধারণা ওই কালো ঘুড়িটা অপয়া। শুধু ওদের নয়, ওদের পাড়ার সব ছেলেরও ওই এক ধারণা। ঘুড়ির প্যাঁচ খেলাতে হাতের কৌশলের পাশাপাশি ভাগ্যের সহায়তাও লাগে বেশ কিছুটা। একটানা একটার পর একটা প্যাঁচ লড়ে গেলে এক সময় না এক সময় নিজের ঘুড়ি কাটবেই। তাই কিছু না কিছু ভুতুড়ে ব্যাপার আছে এর মধ্যে।

    যেমন, কে যে ঐ কালো ঘুড়িটা ওড়ায় সেটা কেউ জানে না। রাইস মিলেরও পিছন দিক থেকে আসে ঘুড়িটা। একবার দুবার রাইস মিল থেকে পাড়ার ছেলেরা দেখবার চেষ্টা করেছে কে বা কারা ওটা ওড়ায়। কাউকে দেখা যায় নি অবশ্য।

    কেউ বলে ওই ঘুড়িটার মাঞ্জা সুতো নাকি স্পেশাল কাঁচ দিয়ে তৈরি। মণি নাকি একবার পাড়ার বড় ছেলেদের কাছে শুনেছিল একটা সদ্য কাটা মুরগির এক চামচ রক্ত কাঁচগুঁড়োর সাথে মিশিয়ে তৈরি হয় এই ঘুড়ির মাঞ্জা। তবে কেউ ঘুড়িটা তো দূরের কথা, ওর মাঞ্জাও হাতে নিয়ে দেখতে পারে নি। একবার যখন বেশ নিচু হয়ে প্যাঁচ লড়ছিল ঘুড়িটা, ঢিল-লংগ করেছিল অরুণ আর মণি, অর্থাৎ একটা ছোটো ইঁটের টুকরোতে সুতো বেঁধে ঘুড়িটার সুতোর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়েছিল উপরে যাতে ঢিলটা সুতোর উপর দিয়ে নিচে নেমে এলে সেই সুতো দিয়ে টেনে ঘুড়িটাকে নামানো যায়। কিন্তু শেষ সময়ে কেন জানি না প্যাঁচ না খেলে আবার উপরে উঠে গিয়েছিল ঘুড়িটা।

    “মনে আছে, সেইদিন সন্ধ্যাবেলা মণি বমি করল দশ-বারোবার আর অরুণের এল ধুম জ্বর।”, অন্তু বড় বড় চোখ করে বলল।

    -- যাঃ, তাই আবার হয় নাকি!

    শমীকদের ঘুড়িটা নেমে এসেছে অনেকখানি, কিন্তু কালো ঘুড়িও এসে পড়েছে ঠিক উপরে।

    গোঁত্তা খাইয়ে ঘুড়ি নিচে নামাল সন্তু, কিন্তু বেশি নামাতে পারল না, গাছ আছে একটা ঠিক নিচে, তাই শেষ মুহূর্তে বাধ্য হল ঘুড়িটাকে একটু উপরে তুলতে।

    ঠিক এইটুকু সুযোগেরই অপেক্ষা করছিল কালো ঘুড়িটা। শিকড়ে বাজের মতন নেমে এসে ওদের সুতোর তলা দিয়ে ঢুকে গেল গাছটাকে এক চুলের জন্য এড়িয়ে। এই খেল যে দেখিয়েছে তার ঘুড়ি ওড়ানোর দক্ষতা নিয়ে কোনো কথা হবে না। পরের মুহূর্তে শমীক দেখল ওদের ঘুড়ির সুতো এক লাফে নেমে এল মাটিতে।

    -- যাঃ, শেষ পর্যন্ত সেই কেটে দিলো ঘুড়িটা।

    কালো ঘুড়ি নাকি রোজ আসে না। হঠাৎ হঠাৎ কোনো একদিন আসে আর যেদিন আসে, আশেপাশের সব ঘুড়িকে কেটে দিয়ে বিদায় হয়। এখন আবার রাইস মিলের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছে কালো ঘুড়ি। যে বা যারা ওটা ওড়াচ্ছে এটা পরিষ্কার যে তারা ঘুড়িটাকে নামিয়ে নিতে চায়।

    শমীকদের ঘুড়িটা ল্যাগব্যাগ করে চলতে চলতে দূরের একটা বাড়ির বাগানে পড়লো।

    -- চল, যাই, আমাদের ঘুড়িটা নিয়ে আসি।

    -- পাগল নাকি?

    কালো ঘুড়ির কাটা ঘুড়ি নাকি আর কখনো ওড়ে না।

    -- জানলি কি করে? চেষ্টা করে দেখেছিস?

    অন্তু-সন্তু দুজনেই অবাক হয়ে এমনভাবে শমীকের মুখের দিকে তাকাল যেন এই নিয়ে আর কোনো কথাই হতে পারে না!

    ***

    সেদিন রাত্রে ধুম জ্বর এল অন্তু-সন্তু দুজনেরই।

    -- হবে না কেন? সারাদিন ধরে ছাতের উপর এই হাওয়ার মধ্যে! আপদ যত! কেন, ঘরে বসে কিছু খেলতে পারিস না?

    বিরক্ত হয়ে ওদের বকছিল জ্যেঠি। জ্যেঠি কোনো একটা কাজে বাইরে যেতেই, ফিসফিস করে অন্তু বলল, “রোদে বা হাওয়ায় আমাদের কিচ্ছু হয় না। সব আসলে ওই কালো ঘুড়িটার জন্য!”

    -- মানে?

    “ওই কালো ঘুড়িটা যাদের ঘুড়ি কাটে, তারা জ্বরে ভোগে সেদিন।”, সন্তু ফিসফিস করে জ্ঞান দিলো শমীককে।

    -- ধ্যাৎ! কি যা তা বলছিস?

    -- না, না, যা তা নয়। সেজন্যই তো আমাদের ঘুড়িটা নামানোর চেষ্টা করছিলাম!

    শমীকেরও গা হাত পা ম্যাজম্যাজ করছিল।

    শরীরটা ভালো লাগছিল না। একটু জ্বর-জ্বর ভাব। আর ঠোঁট আর মুখের ভিতরটা অস্বাভাবিক শুকনো।

    কাউকে বলা চলবে না কিছু।

    মা জানতে পারলে তুলকালাম করবে, তাই চুপচাপ একটা গল্পের বই নিয়ে তাড়াতাড়ি নিজেদের শোবার ঘরে লেপের তলায় ঢুকে পড়ল শমীক।

    ***

    রাত্রে স্বপ্ন দেখল শমীক, বর্ধমানের বাড়ির ছাতের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে ও।

    আকাশ থেকে নেমে আসছে একটা বিশাল কালো ঘুড়ি।

    ঘুড়ি শমীককে জিজ্ঞাসা করলো, “উড়বে আমার সাথে?”

    শমীক ঘাড় নেড়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ”

    কোথার থেকে যেন ঘুড়ির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল দুটো হাত, শমীককে শূন্যে তুলে নিল সেই দুই হাত।

    আকাশে আরো অনেক ঘুড়ি উড়ছে। সব ঘুড়ির সাথেই শমীকের চেনা কেউ না কেউ – মা, বাবা, দাদু, অন্তু-সন্তু।

    ঘুড়ি বললো, “চলো, এবারে উপরে উঠি আমরা। অনেক, অনেক উপরে।”

    সত্যিই অনেক, অনেক উপরে উঠে গেল ওরা। আশেপাশের অন্য সব ঘুড়িকে ছাড়িয়ে।

    ঘুড়ি শমীককে জিজ্ঞাসা করলো, “রূপকথার দেশে যাবে? সেই দেশ যেখানে রাস্তাঘাট সোনা দিয়ে বাঁধানো, বাড়ি বানানো হিরে দিয়ে, গাছে গাছে পান্না, নদীর জলে রুপোর রং?”

    শমীক আবার ঘাড় নেড়ে বললো “হ্যাঁ”

    খুব খুশি হলো ঘুড়ি, বললো, “ঠিক আছে, চলো তবে।”

    আতংকের সাথে শমীক দেখলো, সুতো ছিঁড়ে গেছে কালো ঘুড়ির, শূন্যে গোঁত্তা খেতে খেতে নিচে নামছে ঘুড়ি।

    চিৎকার করে উঠলো শমীক, “বাড়ি ফিরবো কেমন করে?”

    – ফিরবে কেন? থেকে যাবে জাদুর দেশে। কেউ ফেরে না। সোনার রাস্তা। হিরে দিয়ে বাঁধানো বাড়ি। গাছে গাছে পান্না। নদীর জলে রুপোর রং।

    – না! ফিরতে চাই আমি!

    – জাদুগাছের শিকড় চিনলে ফিরতে পারবে।

    – কোথায় সেই জাদুগাছ? বলো, বলো আমায়!

    এক ঝটকায় ওকে ফেলে দিল কালো ঘুড়ি। শূন্যে ভাসছে শমীক। নিচে নামছে দ্রুত। নিচে একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে সেই জাদুর দেশ, সোনা দিয়ে যার রাস্তা বাঁধানো, বাড়ি বানানো হিরে দিয়ে, গাছে গাছে পান্না, নিচে তিরতির করে বয়ে চলেছে নদী যার জলে রুপোর রং।

    অনেক দূর থেকে উত্তর ভেসে এলো কালো ঘুড়ির, “কেউ বলে না। নিজেকেই খুঁজে নিতে হয় সেই শিকড়!”

    জাদুর দেশে আছড়ে পড়ার আতংকে ঘুম ভেঙে গেল শমীকের। সকাল হয়ে গেছে। মাথার পিছনের ছোট জানলাটা দিয়ে একফালি রোদ এসে পড়ছে মুখে।

    এক লাফে বিছানার থেকে নিচে নামলো শমীক। মা বাবা কেউ ঘরে নেই।

    কাল রাতের সেই জ্বর-জ্বর ভাবটা এখন আর নেই, তবে এখন একা থাকলেই স্বপ্নটা ফের জ্বালাবে।

    অন্তু-সন্তু দুজনেরই ১০৩ জ্বর। জেঠু একটু পরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে দুজনকে।

    ১৯


    মরার আগে দাদাকে দিন তিনেক সময় দিয়েছিল মা। দাদা অবশ্য নিজের বেলা বাকি কাউকে সেই সময়টুকু দিলো না। দিলো না শুধু নয়, সাথে নিয়ে গেল বৌদিকেও।

    দেখতে দেখতে বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল, অথচ মনে হয় যেন গতকাল।

    মেয়ের বাড়ি গিয়েছিল দাদা-বৌদি। নাতনির জন্মদিনে। দাদার খুব একটা যাবার ইচ্ছে ছিল না সেবার। শরীর টানে না। তাছাড়া জন্মদিন মানেই অন্য ধরনের খাওয়া দাওয়া। মেয়ে জামাইকে মুখের উপর না বলতে সংকোচ হয়। অথচ খেলে পেট বিদ্রোহ করা শুরু করে প্রায় সাথে সাথে।

    কলকাতা থেকে পরের দিন সন্ধ্যাবেলা বর্ধমান ফিরছিল দাদা-বৌদি, গাড়িতে। একটা বোলেরো ভুল দিক দিয়ে প্রায় একশ কিলোমিটার স্পিডে ওভারটেক করতে গিয়ে পাশ থেকে ধাক্কা মারে ওদের গাড়িতে। সেই ধাক্কায় ছিটকে দাদা-বৌদির গাড়ি মাঝখানের ব্যারিয়ার টপকে উল্টোদিকের রাস্তায় সরাসরি অন্য একটা ট্রাকের সামনে এসে পড়ে।

    ড্রাইভার আর বৌদি সাথে সাথে চলে যান। দাদা যান হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথে।

    দুঃস্বপ্নের মতন কেটেছিল পরের কয়েকটা দিন।

    ***

    তমালবরণ জানতেন যে দাদু মারা যাবার পর থেকে তাঁর আসল অভিভাবক তাঁর দাদা পলাশবরণ।

    খুব ছোটবেলায় বড়োদের যখন ভয় পেতেন তাঁরা দুজনেই, সেই সময় থেকেই তমালবরণকে আগলে আগলে রাখত দাদা। তমালবরণের মতন জলা-জঙ্গলে ঘুরবার লোক নয়, বরং একটু কোমল, অনুভূতিপ্রবণ স্বভাবের লোক ছিল দাদা। ভালো গান গাইতো, বেশ ভালো হাত ছিল ছবি আঁকাতেও।

    সেই ছোট্টবেলার থেকে তমালবরণের শরীর খারাপ হলেই চিন্তায় কেমন যেন ছটফট করতেন পলাশবরণ। তমালবরণের মনে আছে, ছোটবেলায় একবার ফুটবল খেলতে গিয়ে মাথা ফেটে গিয়েছিল তাঁর। চিন্তায় প্রায় পাগলের মতন হয়ে গিয়েছিল দাদা। যে ক’দিন মাথায় ব্যান্ডেজ ছিল, সে কদিন দাদাও যেন সুস্থ থাকতে পারে নি। তমালবরণের কোনো দুঃখ হলে বা কষ্ট হলে কেমন যেন অপরাধবোধে ভুগতেন পলাশবরণ, যেন বড় হিসেবে এই সব ঝড় ঝাপটা তাঁর উপরেই আসা উচিত, ছোট ভাইটার উপর নয়।

    পার্টিশনের ঝড় অবশ্য একইভাবে মাথার উপর দিয়ে বয়ে গেছে তাঁদের দুজনের উপর। পরবর্তী কয়েক বছরের আর্থিক অনটনের ঝড়ঝাপটাও সামলেছেন তাঁরা একসাথে। দুজনেই অধ্যাপনার পেশায় ছিলেন বলে তাঁদের মধ্যে একজনের যারা বন্ধু, তারা বন্ধু ছিল অন্যজনেরও। ঘরোয়া বা পেশাগত আড্ডাতেও তাই কখনো আলাদা হতে হয় নি তাঁদের।

    এমন দাদার মৃত্যু মানে যেন নিজের আত্মার একটা অংশ আলাদা হয়ে যাওয়া।

    শ্মশানে বসে সেইদিন তমালবরণের কেন জানি না মনে হয়েছিল এমন যদি কোনো আয়না থাকত যেটাতে নিজের আত্মাকে দেখায়, তাহলে সেই আয়না আর তাঁর পুরোটা দেখাত না এখন থেকে।

    কেন যে এই চিন্তাটা হঠাৎ মাথায় এল?

    এরপর থেকে আয়নার দিকে তাকাতেই অসুবিধে হবে তাঁর।

    ***

    তমালবরণ জানতেন যে দাদার জীবনে একটা গভীর দুঃখ ছিল।

    পড়াশুনোয় ভালো ছিল বলে কিংশুককে খুব স্নেহ করতেন পলাশবরণ। পরবর্তীকালে কিংশুক যখন তাঁরই মতন অর্থনীতি নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে গেল, কি খুশি যে হয়েছিল দাদা। যে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা দুই ভাই অথচ পড়া হয়ে ওঠে নি ভাগ্য বিপর্যয়ে, আজ সেই কলেজে পড়ছে তাঁর নিজের ভাইপো। তমালবরণের কাছে এই নিয়ে কথা বলতে গিয়ে চোখে জল এসে গিয়েছিল দাদার।

    তমালবরণ অবশ্য সেদিন পরিষ্কার বুঝেছিলেন দাদাকে।

    এই জল শুধুমাত্র আনন্দের জল নয়।

    দাদার নিজের ছেলে আর মেয়ে পড়াশুনোয় একেবারেই ভালো নয়। বাড়ির গুঁতোয় দুজনেই প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও এম এ পর্যন্ত পড়তে বাধ্য হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার মতন যোগ্যতা দুজনের কারুরই ছিল না।

    ওদের দুজনেরই চাকরি বা বিয়ে নিয়ে কম চিন্তা করতে হয় নি দাদাকে।

    কলেজে পড়ার সময় থেকে পলাশবরণেরই এক সহকর্মীর মেয়ের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছিল রাজু অর্থাৎ সুরঞ্জনের। পড়াশুনোয় যথেষ্ট ভালো আর সিরিয়াস মেয়েটি। মেয়েটিকে তাঁরা দুই ভাই-ই পছন্দ করতেন খুব, কিন্তু ওঁরা দুজনেই বুঝেছিলেন যে এ সম্পর্ক টিঁকবার নয়। এই মেয়ের প্রেমিক বা বর হবার যোগ্যতা নেই রাজুর। ঠিক তাই হল। এম এ করার পর রাজু যখন বেকার, ভেঙে গেল সেই সম্পর্ক। হয়তো ভালোই হয়েছিল এতে। এইটুকু ধাক্কা দরকার ছিল রাজুর। এরপর থেকে কম্পিটিটিভ পরীক্ষাগুলোতে সামান্য হলেও মন দিলো রাজু। প্রায় দু বছর বেকার থাকার পর কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে এল আই সি তে একটা ক্লার্কের পজিশন জুটিয়ে নিলো রাজু। তারপর বাড়ির সকলের অমতে জোর করে বিয়ে করল ওরই অন্য এক সহপাঠিনী বিপাশাকে।

    মেয়ে মুনিয়াকে নিয়েও কম জ্বলতে হয় নি দাদাকে। বয়ঃসন্ধির পর থেকে একের পর এক প্রেমে কখনো নিজে ডিগবাজি খেয়ে আর কখনো বা অন্যকে ডিগবাজি খাইয়ে অবশেষে দেবরাজের সাথে সম্পর্কে থিতু হয় মুনিয়া। রাজুর ই সহপাঠী দেবু, ওরফে দেবরাজ। একই সাথে একই পাড়ায় বড় হয়েছে দুজনে। রাজুর মতনই প্রায় দেড় বছর বেকার ছিল দেবরাজও, তাই এই সম্পর্কটাও হয়তো মুনিয়ার টিঁকত না। কিন্তু সম্পর্কটা যখন প্রায় ভাঙবার মুখে, ঠিক সেই সময়ে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে একটা চাকরি জুটে যায় দেবরাজের। এক বছর গ্রামে থেকে মা-বাবার মাধ্যমে কি সব কলকাঠি নেড়ে কলকাতায় একটা ভালো স্কুলে পোস্টিং আদায় করে দেবু।

    এখন নাকি প্রচুর টিউশনি করে দেবু। স্কুলের সাথে সাথে টিউশনি করেই দিব্যি সংসার চালাচ্ছে। কলকাতায় ফ্ল্যাট হাঁকিয়েছে নিজের, গাড়ি কিনেছে। সকাল বিকেল ছাত্রের লাইন ওর বাড়ির সামনে।

    রাজু অবশ্য বিশেষ কিছু আর করে উঠতে পারল না জীবনে। বরং কি একটা গোলমেলে কেসে ফেঁসে ট্র্যান্সফার হয়ে গেল উত্তরবঙ্গে।

    তারপর থেকেই তমালবরণ লক্ষ্য করেছেন যে দেবরাজ আর রাজুর সম্পর্কে চিড় ধরেছে। পারিবারিক যে কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে দেখা হলে দুজনেই দুজনকে ক্রমাগত আওয়াজ দিয়ে চলে। এই আওয়াজগুলো ঠিক মজার নয়, যথেষ্ট ঝাঁঝ রয়েছে এদের মধ্যে।

    শেষ কয়েকটা বছর এই সব নিয়ে তাই বেশ কষ্টে কেটেছে দাদার।

    ***

    দাদার কষ্ট মানে নিজেরও কষ্ট।

    যৌথ পরিবার বলে, দাদার ছেলেমেয়েকে নিজের ছেলেমেয়ের থেকে আলাদা করে দেখতে চান নি তমালবরণ। রাজু আর মুনিয়া দুজনেই তাঁর প্রিয় ভাইপো-ভাইঝি, বিশেষ করে মুনিয়া। নিজের মেয়ে হয় নি বলে মুনিয়ার মাধ্যমেই সেই মেয়ের অভাব পুষিয়ে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। রাজুর সুরঞ্জন নামটি পছন্দ হয় নি তাঁর, অথচ দাদা-বৌদি দুজনেরই প্রিয় নাম বলে আপত্তি করতে পারেন নি। ভাইঝির বেলায় তাই অনেক ভেবেচিন্তে প্রস্তাব রাখেন ওর ভালোনাম অহনা রাখার। নামটি খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল দাদা-বৌদি দুজনেরই।

    কিন্তু যৌথ পরিবার হলেও আগেকার দিনের মতন কাকা-জ্যাঠাদের শাসনের অধিকার আর কতটুকু? দুঃখের সাথে তমালবরণ লক্ষ্য করেন যে ওরা কোনো ভুল করলে ওদের শাসনের অধিকার .তাঁর নেই। ওদের সামান্য বকলেও সেটা পছন্দ হত না বৌদির। আর সেটা প্রকাশ করতেন তীব্র স্বরে রাজু বা মুনিয়াকে বকে, যেন অন্য কারুর কাছে ওদের বকুনি খাওয়ার লজ্জাটাকে উনি চেপে দিতে চান নিজের গলা দিয়ে।

    বেশ কয়েকবার এরকম হবার পর কিছুটা হতাশ হয়ে ওদের বকা ছেড়ে দিয়েছিলেন তমালবরণ। অথচ শঙ্কার সাথে লক্ষ্য করছিলেন যে রাজু বা মুনিয়া কেউই ঠিকমতন মানুষ হচ্ছে না। নিয়ম করে পড়াশুনো করে না ওরা, নিয়ম করে বাড়ি ফেরে না, খাওয়া-দাওয়া বা সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাসও ওদের গড়ে উঠছে না ঠিকমতন। কিংশুককে শৃঙ্খলাপরায়ণ করার ব্যাপারে যতটা চেষ্টা তাঁর আর কৃষ্ণার, তার ছিঁটেফোঁটাও নেই বৌদির। দাদারও কেমন একটা গা আলগা ভাব, হয়তো বৌদির ভয়ে। এক এক সময় তাঁর ভয় হত যে হয়তো জ্যাঠতুতো ভাই-বোনের তুলনায় কড়া শাসনে আর একটা গন্ডির মধ্যে মানুষ হচ্ছে বলে কিংশুকের সাথে তাঁর আর কৃষ্ণার না আবার একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়।

    ***

    কৃষ্ণার মৃত্যু নিয়ে একটা বড় অপরাধবোধ আছে তমালবরণের।

    বাড়ির আর সকলের মতন ঘনঘন চা বা কফি খাওয়ার অভ্যাস কখনো গড়ে ওঠে নি কৃষ্ণার। শেষের দিকে অ্যাসিডিটির জন্য অসময়ে চা বা কফি খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল কৃষ্ণা।

    সেদিন আর সকলে তো বটেই, তমালবরণও বলেছিলেন, "আরে অত ভয় পাচ্ছো কেন? খাও! খাও!"।

    মুনিয়া আর দেবরাজ এসেছিল সেদিন কলকাতা থেকে। রাতে এই বাড়িতে থাকবে ওরা। পরের দিন দুপুরে এখান থেকে খেয়ে দেবরাজদের বাড়ি উঠবে। রাজুর তখনো উত্তরবঙ্গে ট্র্যান্সফার হয় নি। ফলে বাড়ি সেদিন জমজমাট।

    ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনাল সেদিন। রাত জেগে খেলা দেখা হবে সবাই মিলে।

    পলাশবরণের ছেলে-ছেলেবৌ মেয়ে-জামাই সবাই বাড়ি আছে আজ। শুধু তাঁর ছেলে আর তার পরিবার নেই। তমালবরণ একা হলে তবু নিজেকে সংযত রাখতে পারতেন, কিন্তু কৃষ্ণা কিছুতেই পারে না। তমালবরণ জানেন আজও রাত্রে বিছানায় শুয়ে চোখের জল বাঁধ মানবে না কৃষ্ণার। মাঝে মাঝে তাঁরও আজকাল মনে হয় বোম্বে শহরটা বড় বেশি দূর। যখন মনে হল হুট করে বাড়ি এসে সবার সাথে মজা করে যাবার উপায় নেই।

    মুনিয়া-দেবরাজরা আসা মানেই খাবার আসবে বাইরে থেকে। খাবে ওরা অনেক দেরি করে, রাত প্রায় এগারোটায়। সেদিনও তাই হল। আর হল খেলা দেখার সময় হাফটাইমে প্রায় মাঝ রাতে কফি খাওয়া।

    কফি খাওয়ার পর থেকেই শরীরটা ভালো লাগছিল না কৃষ্ণার। অ্যান্টাসিড খেয়েও অস্বস্তিটা গেল না। কিছুক্ষণ পরে শুরু হল বমি আর বুকে ব্যথা। তারপর মাত্র পনের মিনিটের মধ্যে সব শেষ।

    কোনো ডাক্তার ডাকবারও সুযোগ দিলো না কৃষ্ণা। সুযোগ দিল না হাসপাতালে নিয়ে যাবার। শেষ সময়ে স্পষ্ট গলায় একবার “ডাক্তার ডাকো!” বলেছিল কৃষ্ণা, কিন্তু ঠিক তার পরেই সেই যে চোখ বুঁজল সে চোখ আর খুলল না।

    শেষদিকে তাঁদের দুজনের আলোচনা হত মাঝেমাঝে -- একজন গেলে অন্যজন কি করবেন। কৃষ্ণার কেন জানি না বদ্ধ ধারণা ছিল যে ও নিজে আগে যাবে। কিছুতেই তমালবরণের আগে যাবার ব্যাপারটা মেনে নিতে পারত না কৃষ্ণা। কে জানে, ইচ্ছাশক্তি বলে যদি সত্যিই কিছু থাকে হয়তো সেই শক্তিই অন্য জগতে নিয়ে গেছে কৃষ্ণাকে।

    সেদিন শেষরাতে এক গভীর অপরাধবোধে আচ্ছন্ন ছিলেন তমালবরণ। ওকে কফি খেতে বলার অনুরোধটা কুরে কুরে খাচ্ছিল তাঁকে, আর কেন জানি না বারবার মনে হচ্ছিল যে মধ্যবিত্তের সংসারে কৃষ্ণার বেশির ভাগ ইচ্ছাই পূরণ করতে পারেন নি তিনি।

    একটা বড় গাড়ি কেনার ইচ্ছে ছিল কৃষ্ণার। ইচ্ছে ছিল জীবনে একবার অন্তত বিদেশ ঘুরে আসার। কিছুদিন আগে ইচ্ছে হয়েছিল নিজেদের শোবার ঘরটাকে রং করে নেবার।

    কৃষ্ণার শেষ অনুরোধ ডাক্তার ডাকার। পাড়ার ডাক্তার শংকর নিয়োগী মাঝরাতে এক ডাকে চলেও এসেছিলেন বিছানা ছেড়ে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।

    তমালবরণের একমাত্র সান্ত্বনা কৃষ্ণার তাঁর আগে চলে যাবার ইচ্ছাটা তিনি নিজে না চাইলেও পূর্ণ হয়েছে।

    ***

    দীর্ঘ জীবন মানেই মৃত্যুর মিছিল।

    কত মৃত্যু যে দেখলেন প্রায় চোখের সামনে। বড়দের, সমবয়সী সহকর্মী আর বন্ধুদের, পাড়ার লোকেদের, ছাত্রছাত্রীদের ...

    যারা তাঁর চেয়ে বড় তাদের মৃত্যু তবু মেনে নেওয়া যায়, তাঁর চেয়ে ছোটো যারা তাদের চলে যাওয়াটা মেনে নেওয়া কি যে শক্ত। কেমন যেন অপরাধী লাগে নিজেকে। মনে হয় আশেপাশে যারা রয়েছে তাদের চোখে, তাদের কথাবার্তায় একটা অভিযোগের সুর। যেন তারা বলছে ঐ বুড়োটা এখনো বেঁচে কেন? মৃত্যুর থাবার থেকে কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে লাইন ভেঙে?

    প্রায় বছর দশেক আগে দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও বন্ধু বরেনের শেষযাত্রায় যখন গিয়েছিলেন তমালবরণ, পথের মোড়ে একবার থেমেছিল গাড়িটা। অল্পবয়সী দুটো ছেলে নিছক কৌতূহলের বশে উঁকি দিয়েছিল ভিতরে। যেই দেখল বছর আশির এক বৃদ্ধ ভিতরে, সব কৌতূহল শেষ হয়ে গেল ওদের। একজন আরেকজনকে বলল, "আরে বুড়ো একটা! চল, অনেক হয়েছে!"

    কিরকম যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন তমালবরণ। মৃত্যুকে এত অশ্রদ্ধা? স্রেফ একটু বেশি বয়স অবধি কেউ বেঁচে আছে বলে?

    নাঃ, এত অশ্রদ্ধা মাথায় করে যাবার কোনো মানে হয় না। এর চেয়ে বরং আরো অনেক অল্পবয়সে অঘোরনাথের মতন চলে যাওয়া ভালো।

    সত্যিই ভালো কি? তাহলে সেদিন কেন দুচোখ ফেটে জল আসছিল তাঁর?

    অঘোরনাথকে যখন চিতায় তোলা হয় তখন চোখের জল লুকোতে একটূ দূরে সরে গিয়েছিলেন তমালবরণ। তাই লক্ষ্য করেন নি, চিতায় তাঁর দাদুকে তোলা হয় উপুড় করে।

    কিছুতেই যেন ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিলেন না তমালবরণ। নাস্তিক অঘোরনাথ তাঁর ঈশ্বরে অবিশ্বাস ততদিনে দৃঢ় করে দিতে পেরেছেন জোয়ান তমালবরণের মধ্যে। মৃত্যু মানে তো সব শেষ। একটা জটিল যন্ত্রের বিগড়ে যাওয়া, অন্য কিছু নয়। তবু সেই মুহূর্তে তমালবরণের যেন মনে হচ্ছিল দাদু না থেকেও আছেন, সব দেখছেন, সব বুঝতে পারছেন। আর পঞ্চভূতে বিলীন হবার আগে শেষবারের মতন খোলা আকাশটা দাদু দেখে যেতে পারলেন না তাঁরই দোষে। যেন তাঁর নিজের উচিত ছিল আরও অনেক শক্ত হওয়া। ঠিক ওই সময়ে কেন একটু দূরে সরে গিয়েছিলেন তিনি? কেন ওরকম দুর্বল হয়ে পড়লেন?

    নাঃ, আরও একটা কাজ বাকি রয়ে গেল।

    পিন্টুকে বলে যেতে হবে নিজের শেষযাত্রায় যেন কখনো উপুড় না করা হয় তাঁকে, আর কিংশুককেও এই ব্যাপারে চিঠি লিখতে হবে একটা, আজই।

    ***

    দাদা-বৌদিকে তৈরি হবার কোনো সময় দেয় নি মৃত্যু।

    প্রচুর ঝামেলা সহ্য করতে হয় সেজন্য রাজু আর মুনিয়াকে। নয় নয় করেও বেশ কিছু টাকা পয়সা রেখে গেছে দাদা-বৌদি। কিন্তু কোনোকিছুতেই রাজু আর মুনিয়ার নাম নেই। দাদার সব টাকাপয়সাতে নমিনি ছিল বৌদি। যেহেতু বৌদিও একই সাথে চলে যায়, তাই প্রচুর খোঁজাখুঁজি করতে হয় ওদের। কেউই সঠিক জানত না কোথায় ঠিক কত পয়সা রেখে গেছেন পলাশবরণ। খুঁজে খুঁজে যতখানি পারে সব বের করার পর-ও প্রচুর ছোটাছুটি করতে হয়েছিল ওদের ব্যাংকে, কোর্টে আর উকিলের কাছে।

    দাদা বৌদির হঠাৎ করে এই চলে যাওয়া চোখ খুলে দিয়েছিল তমালবরণের।

    পরবর্তী ছমাসের মধ্যে নিজে উকিলের সাথে কথা বলে, ব্যাংক আর কোর্ট গিয়ে নিজের যা যা আছে তার সব কিছুর একটা পাকা বন্দোবস্ত করে রেখে দিয়েছিলেন তিনি।

    এরপর লাইনে তিনি সবার আগে।

    তিনি চলে গেলে পরবর্তী জেনারেশনকে যেন এই ধরনের সব পার্থিব বিষয়-আদি নিয়ে খুব বেশি ভুগতে না হয়।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments