• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৭ | জানুয়ারি ২০২৫ | উপন্যাস
    Share
  • শিকড় (৯) : কৌশিক ভট্টাচার্য





    ।।২২।।

    — এ কি, কিংশুকদা, পায়ে কি হল তোমার?

    বান্দ্রা-কুর্লা অফিসের C-9 বিল্ডিঙের লম্বা করিডরের অন্য প্রান্ত থেকে এগিয়ে আসছে ইন্দ্রনীল।

    আজ এভাবে বান্দ্রা-কুর্লা অফিসে আসার সিদ্ধান্তটা কিংশুকের নিজের। বাড়ি থেকে দু মিনিট হাঁটলেই এই অফিস। মাঝে মাঝে মনে হয় এই অফিসে কাজ করতে পারলে যে কি ভালো হতো, রোজ রোজ ট্রেন আর বাসের গুঁতো সামলে ফোর্ট অফিসে যেতে হত না।

    সকাল ন’টার সময় বস দিলীপ সাহুকে ফোন করে নিজের পায়ের অবস্থার কথা বলে আজকের দিনটা ছুটি চেয়েছিল কিংশুক। কিন্তু ফোনটা রেখেই মনে হল আজ একটা জরুরি রিপোর্ট জমা দিতে হবে। দিলীপ সাহু বোধ হয় সেটা খেয়াল করে নি। যদিও মাত্র এক ঘন্টার মতন লাগবে রিপোর্টটা শেষ করতে, তবু কাজটা না হলে পরে গালাগালির বন্যা বইতে পারে ওর দিকে।

    প্রথমে কিংশুক ভেবেছিল যে লাঞ্চের পর সরাসরি ফোর্টে মেইন অফিসে যাবে। কিন্তু তারপরেই মনে হল যে তার আগে একবার এগারোটা নাগাদ বান্দ্রা-কুর্লা অফিস থেকে ঘুরে এলে ভালো হয়। বান্দ্রা-কুর্লার লাইব্রেরিতে এই বছরের ব্যাংকিং স্ট্যাটিসটিক্সগুলো একটু উল্টেপাল্টে দেখতে হবে একবার রিপোর্টটা ভালোভাবে তৈরি করতে গেলে। তাছাড়া যাচ্ছেই যখন, স্ট্যাটিসটিক্স ডিপার্টমেন্টের অনুরাগ জোশির সাথে দেখা করে একটা দুটো জিনিস বুঝে নিলেও ভালো হয়। অনুরাগ জোশি ভালো লোক, কিংশুককে পছন্দও করে। অন্য অনেকের মতন লেজে খেলায় না, সোজা-সাপটা কথা বলে।

    অনেকদিন পরে বান্দ্রা-কুর্লা অফিসে এল কিংশুক। এতদিন কাজ করার ফলে এখানেও অনেকে তার পরিচিত। ইন্দ্রনীল এদের মধ্যে একজন। ভালো ছেলে, কিন্তু একটু অতিরিক্ত গায়ে-পড়া আর বসতে-পেলে-শুতে-চাওয়া ধরনের। অভ্র একবার হাসতে হাসতে কিংশুককে বলেছিল, “অফিসে যদি কোনো গুজব ছড়িয়ে দিতে চাস, একবার শুধু ইন্দ্রনীলকে ডেকে ব্যাপারটা বলে দিস! ব্যাস, তারপর খালি চব্বিশ ঘন্টার অপেক্ষা!” অফিসে ইন্দ্র প্রায় সারাটা সময় নাকি টেলিফোনে থাকে। কি করে যে এরা কাজকম্ম সব ম্যানেজ করে কে জানে!

    করিডরে কাউকে দেখতে পেলে না দেখার ভান করার উপায় নেই, তাই ইন্দ্রনীলকে আসতে দেখে মুহূর্তের মধ্যে মুখে মোনালিসা-মার্কা একটা হাসি লাগিয়ে নিলো কিংশুক।

    এই হাসি হল মুখোশ, আসল মুখটাকে ঢেকে রাখে এই হাসি। শামুকের খোলসের মতন, এই হাসিটা একটা বর্ম-ও বটে। প্রয়োজনমতন মুখে এঁটে নিলে আজকাল খুব একটা কথা বলার দরকার পড়ে না কারুর সাথে, অথচ অভদ্রতার দায়েও পড়তে হয় না।

    — আর বলিস না, বাস-এ উঠতে গিয়ে হয়েছে গতকাল সন্ধ্যায়।

    ইন্দ্র থেমে দাঁড়িয়ে আছে করিডোরে। না থামলে অসভ্যতা হবে, তাই দাঁড়িয়ে গেল কিংশুক। মনে হচ্ছে এখন মিনিট পাঁচেক বান্দ্রা-কুর্লা অফিসে এই পদ-চর্চা হবে। কে জানে হয়তো আজ সারাদিন ধরে অফিসে এই পদ-চর্চা চলবে। মুহূর্তের মধ্যে খবর চলে যাবে ফোর্ট অফিসে।

    — ডাক্তার দেখিয়েছ?

    — না, কাল রাতে ব্যথা সেরকম হয়নি, ভেবেছিলাম আজ সকালে কমে যাবে।

    — এখন বাড়ছে নাকি ব্যথাটা?

    — হ্যাঁ, যদি ভোগায়, যেতেই হবে সেই ডাক্তারের কাছে।

    — আমার-ও মনে হচ্ছে একবার দেখানো দরকার। বেশ খোঁড়াচ্ছো!

    — হ্যাঁ, ভাবছি যাব সন্ধ্যাবেলা। তোর মেয়ের হাত ভাঙার সময় সেই যাকে দেখিয়েছিলি, কি যেন নাম, খার-এ ক্লিনিক, ভাবছি ওরই শরণ নেবো।

    — অনিল প্যাটেল? সেই মাধুরী দীক্ষিতের মতন রিসেপশনিস্ট, যাকে দেখে তুমি পুরো ফিদা হয়ে গেলে?

    — হ্যাঁ, ফিদা তো তুই ও হয়েছিলি সেবার। মেয়ের হাতের কথা ভুলে ওকে গিলছিলি হাঁ করে।

    — ওই জন্যই তো এখন হিংসে হচ্ছে তোমার উপর, কিংশুকদা! ঝুলে পড়ব নাকি তোমার সাথে যখন যাবে?

    — থাক! পা ভাঙল আমার, আর ন্যাকড়াবাজি করবি তুই! আগে হাত-পা কিছু একটা ভাঙ আমার মতন!

    ***

    মেয়ের হাত ভাঙার সময় সেবার বেশ দিশেহারা হয়ে পড়েছিল ইন্দ্র। এতদিন কলকাতা অফিসে কাটিয়ে সদ্য-সদ্য ট্রান্সফার নিয়ে বোম্বে আসা ওর। কোনোকিছুই ভালো চিনত না। অভ্র আর কিংশুক, দুজনে মিলে সেবার ওকে উদ্ধার করে। ডাক্তারের সন্ধানটা অভ্র-ই এনেছিল সেবার। এর পরে যখন ইন্দ্রর মুখে কোনো অভিযোগ বা অনুযোগ শোনে নি, তখন মনে করা অন্যায় হবে না যে অনিল প্যাটেল ভালো ডাক্তার।

    ইন্দ্রকে ডাক্তার দেখানোর কথা বললেও, এখনই সেখানে যাবার দরকার নেই। দেখাই যাক না, ব্যথা বাড়ে কিনা। রিসেপশনিস্ট যতই সুন্দরী হোক, ডাক্তার এবং boss, এই দুটি প্রাণীর সাথে যত কম দেখা হয় ততই মঙ্গল।

    ***

    লাঞ্চের আগে বেশ বেড়ে গেল ব্যথাটা।

    ব্যথা বাড়লে ব্যথা কমানোর ওষুধ রয়েছে, তাই ও নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয় কিংশুক। কিন্তু আসল মুশকিল অন্য জায়গায়। বিশ্রাম নিতে হলে বা একেবারে শয্যাশায়ী হতে হলে খুব বাজে ব্যাপার হবে সেটা। অফিস থেকে ছুটি পেতে সমস্যা হবে না, এতদিন ধরে কটাই বা ছুটি নিয়েছে কিংশুক? মুশকিল হল দোকানপাট, বাজার ইত্যাদি করা।

    কাজের লোক বা ক্যাম্পাসের সিকিউরিটি গার্ডদের কাজে লাগানো ছাড়া উপায় নেই আর।

    একটা ব্যাপারে নিজের কাছে পরিষ্কার কিংশুক। যতই অসুবিধে হোক, কিছুতেই অতসীকে ওর কাছে আসতে বলবে না ও।

    ***

    অসুখ বা শরীরঘটিত কোনো সমস্যা আরো অন্তর্মুখী করে দেয় কিংশুককে। দাদাকে দেখেছে কিংশুক, জ্বর বা কোনোরকম শরীর খারাপ হলে সারা বাড়িকে পাগল করে দিত দাদা। কিংশুক কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকেই জ্বর হলে আরো চুপচাপ হয়ে যেত। হয়তো একটা অপরাধবোধ কাজ করত ওর ভিতরে, সেই অল্প বয়স থেকেই, যার সাথে যোগ হয়েছিল এক তীব্র অপমানবোধ। নিজেকে দুবলা ভাবা এক যন্ত্রণা। কিংশুক তাই এসব দুর্বলতাকে অন্যের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চাইতো। সৌভাগ্যের বিষয় যে, গত কুড়ি বছরে মাঝে মাঝে সামান্য সর্দিজ্বর ছাড়া একটানা বেশি দিন বিছানায় পড়ে থাকতে হয় নি ওকে।

    জীবনে একবারই এখনো অবধি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে কিংশুককে আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে -- ছোটবেলায়, আট বছর বয়সে।

    ***

    ক্লাস টু থেকে থ্রিতে ওঠার সময় মেনিনজাইটিস হয়েছিল কিংশুকের। দশদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল সেবার। সেই প্রথম হাসপাতাল যাওয়া!

    স্মৃতি জিনিষটা একটা রহস্য। আজকাল সবকিছু ভুলে যায় কিংশুক, কিন্তু এত বছর আগের সব ঘটনাও চোখের উপর সিনেমার পর্দার মত ভাসে, যেন গতকাল-ই ঘটেছে।

    অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেছে।

    পাশের বাড়িতে কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছে সিধু আর গোলু। সারাটা সকাল চুটিয়ে ওদের সাথে গোলার মাঠে খেলাধুলা করেছে কিংশুক।

    দুপুরে খাবার পরে বারান্দার একটা সোফাতে শুয়ে রোদ পোয়াচ্ছিল কিংশুক। হঠাৎ করে খুব ভালো লাগতে শুরু করল রোদটা। কাঁটা দিচ্ছে শরীরটা আরামে, হালকা লাগছে মাথাটা।

    শরীরে কোথাও কোনো ব্যথা ছিল না সেবার। একটা তীব্র নেশার মতন আচ্ছন্নতা গ্রাস করেছিল শুধু। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ক্রিকেট খেলছিল কিংশুক। একের পর এক ক্রিকেট প্লেয়ারদের নাম আর তাদের ঠিকুজি-কুলুজি আবৃত্তি করছিল চিৎকার করে। আর বিছানার পাশে চোখ বড়-বড় করে সে সব শুনছিল মা আর জেঠিমা। কিংশুক নাকি ভুল বকছিল তখন, কিংশুক নাকি তখন জীবন আর মৃত্যুর খুব মাঝামাঝি একটা জায়গায় ছিল।

    রাত সাড়ে দশটার সময় অ্যাম্বুলেন্স এল বাড়িতে। পরের দশদিন হাসপাতালে, ডাক্তারদের অধীনে।

    সেই থেকেই, কেন জানি না, ডাক্তার ব্যাপারটাই ঘোর অপছন্দ কিংশুকের। ওরা জানে শুধু ইনজেকশন দিতে। দশদিনে প্রায় তিরিশবার ওরা সুঁচ ফুঁড়েছিল সেবার ওর শরীরে। রাগের চোটে নার্সের হাত থেকে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ কেড়ে নিয়ে সুঁচটাকে বাঁকিয়ে দিয়েছিল কিংশুক। অনেক কষ্টে ওকে শান্ত করেছিল ওর মা।

    ***

    এই দশ-টা দিন মা পুরো লেপ্টে ছিল কিংশুকের সাথে।

    বিছানায় পড়লে এখন আর কেউ থাকে না কাছে। কেউ আর থাকবেও না।

    যে থাকতে পারতো, সে এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। হয়তো কিংশুক-ই দায়ি সবকিছুর জন্য।

    ভালোবাসা পেতে গেলে ভালোবাসা দিতেও হয়। এই পৃথিবীতে সব-ই ট্রেড, এক জিনিস দিয়ে আর এক জিনিস নেওয়া। ভালোবাসাও কমোডিটি তাই। দাও আর নাও, দাও আর নাও, কিন্তু একবারও দিতে ভুল হলে তুমি গেলে!

    দর্শনে মাথা না ঘামিয়ে বরং এখন সত্যিকারের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড নিয়ে মাথা ঘামানো যাক। ব্যাংকিং স্টাটিস্টিক্সের কাজ হয়ে গেছে। এবার ট্রেডের স্ট্যাটিসটিক্স। টেবিলের উপর রাখা ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক আউটলুকটা টেনে নিলো কিংশুক। আর সামান্য কিছু তথ্য লাগবে রিপোর্টটা শেষ করতে। এর পরে আর শুধু অনুরাগ জোশির সাথে দেখা করে কথা বলে নেওয়াটা বাকি। তারপর ফোর্ট অফিস রওনা দেওয়া যেতে পারে।

    ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক থেকে নোট নিতে নিতেই বুঝতে পারল কিংশুক -- আজকের দিনটাতে boss-কে এড়ানো গেলেও ডাক্তারকে বোধ হয় এড়ানো যাবে না।

    ***

    — ইউ আর লাকি, ভেরি লাকি ইনডিড!

    এক্স-রে প্লেটটা আলোর দিকে তুলে ধরে ভুরু কুঁচকে বললেন ডক্টর অনিল প্যাটেল।

    এই ক্লিনিকের এটাই সুবিধে। এক্স রে হয়ে যাবার প্রায় সাথে সাথে ডাক্তার দেখে বলে দেয় কি করতে হবে। রিপোর্টের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে তারপর সেই রিপোর্ট বগলে আবার ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয় না।

    পাঁচ বছর পর এই ক্লিনিকে আবার এল কিংশুক। একই রকম আছে সবকিছু। সেই দুটো বাদামি রঙের সোফা, কিছু পুরোনো ইন্ডিয়া টুডে আর সিনেমার ম্যাগাজিন, আর সেই সুন্দরী রিসেপশনিস্ট। আজ ভালো করে লক্ষ্য করে দেখল কিংশুক, সুন্দরীর কপালের বাঁ দিকে দুটো ছোটো ছোটো তিল রয়েছে।

    ডাক্তারের চেহারাও একই রকম আছে। চিমসে রোগা আর হিলহিলে লম্বা, ছুঁচোলো মুখ এবং ততোধিক ছুঁচোলো গোঁফ, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা।

    — নো বোনস ব্রোকেন। লিগামেন্ট ইস স্ট্রেচড, বাট নট টর্ন।

    এর চেয়ে ভালো আর সুখের খবর এই মুহূর্তে আর কিছু হতে পারে না। লিগামেন্টের চোট পুরোপুরি সারতে অবশ্য প্রায় তিন সপ্তাহ সময় লাগবে। তবে কিছু সাধারণ সাবধানতা অবলম্বন করলে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে না।

    আর সবচেয়ে ভালো ব্যাপার এই যে অতসী বা অন্য কারুর কোনো সাহায্যের দরকার পড়বে না।

    প্রথমে ভেবেছিল ট্যাক্সি করে ফোর্ট অফিস যাবে, কিন্তু অনিল প্যাটেলের চেম্বার থেকে বেরিয়েই একটা বাস পেয়ে গেল কিংশুক। ফ্লোরা ফাউন্টেন হয়ে যাবে বাসটা। ওখান থেকে কিংশুকের অফিস হেঁটে পাঁচ মিনিট।

    লেংচে লেংচে হাঁকড়ে পাঁকড়ে কোনোরকমে বাসে উঠল কিংশুক। বাসে অফিস যেতে যেতে মনে মনে নিজেই নিজেকে আশ্বাস দিলো, “মৃত্যুর পরেও যেন হেঁটে যেতে পারি।” সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা অবাক হয়ে তাকাল ওর দিকে।

    অতিরিক্ত উৎসাহে ঠোঁট নড়ছিল কি ওর? না, একবার সময় করে ভেন্ট্রিলোকুইসমটা শিখে নিতে হবে, তারপর কখনো একা লাগলে নির্ভয়ে নিজের সাথে কথা বলবে কিংশুক।

    ।।২৩।।

    একা থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধে বা অসুবিধে এই যে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া থাকে না। কাজের মেয়েকে চাবি দিয়ে রাখলে দিনের শেষে একটা পরিষ্কার ঘর মেলে। আর কিছু সহজ সাধারণ রান্নাও মেলে গেস্ট হাউসে। একবার বাড়ি ফিরলে হাতে আর বিশেষ কোনো কাজ থাকে না অতসীর। অতসী আজকাল তাই সাধারণত সন্ধ্যা সাতটার আগে অফিস থেকে বেরোয় না।

    দিল্লি শহরটা, লোকে বলে, সন্ধ্যার পর মেয়েদের জন্য একেবারেই নিরাপদ নয়। অতসীকে অবশ্য এখনো অবধি খুব একটা কোনো ঝামেলাতে পড়তে হয় নি, তবু এই ব্যাপারে ওর একটা সিক্সথ সেন্স কাজ করে। বাসে-মেট্রোতে-রাস্তায় লোকেদের নজর ভালো নয়। সন্ধ্যার পর রাস্তাতে একা মেয়ে দেখলেই জিভ লকলক করে ওঠে সবার।

    এইসব কারণে অতসী গেস্ট হাউসে ফিরতে খুব বেশি দেরি করতে চায় না। নিজের গাড়ি আছে, তবুও। অফিস থেকে পয়ঁতাল্লিশ মিনিটের মতন লাগে গেস্ট হাউসে ফিরতে। আগে চার্টার্ড বাসে করে ফিরত অতসী, কিন্তু এখন কাজের চাপ এত বেশি যে প্রায়ই দেরি হয়ে যায়। দিল্লিতে পাবলিক ট্র্যান্সপোর্ট একেবারেই ভালো নয়। আর দিল্লির অটোওয়ালাদের দৌরাত্ম তো প্রবাদপ্রতিম। এক এক সময় অতসী ভাবে সেকেন্ড হ্যান্ড এই গাড়িটা না থাকলে কি যে হত ওর। ভাগ্যিস সস্তায় গাড়িটা পেয়ে গিয়েছিল অতসী। আর ভাগ্যিস বোম্বেতে থাকতে থাকতেই কিংশুকের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ড্রাইভিংটা শিখে নিয়েছিল ও।

    গেস্ট হাউসে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে পোষাক পাল্টে এককাপ গ্রিন টি খায় অতসী। আজও চায়ের জল চড়িয়ে ঘরের জানলাটা খুলতে গিয়েছিল অতসী, এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল সশব্দে।

    — হ্যালো!

    — অতসী?

    গম্ভীর, ভরাট এই গলা চিনবার জন্য একটা শব্দই অতসীর পক্ষে যথেষ্ট!

    — স্মরজিতদা? কি ব্যাপার?

    — শোনো, আমি এখন দিল্লিতে। একটা জরুরি কাজে ইন্ডিয়া আসতে হয়েছে হঠাৎ করে। কাল অফিস আসছো তো?

    — হ্যাঁ, কেন বলুন তো?

    — সাড়ে এগারোটায় একবার দেখা করো আমার সাথে। কথা আছে। ঐ সময়টাতে আধ ঘন্টার মতন একটু ফ্রি রেখো নিজেকে।

    কিছু প্রশ্ন করার আগেই ফোন রেখে দিলেন স্মরজিতদা।

    ঠিক কি জন্য মিটিং, মিটিং-এ আর কে কে থাকবে, অতসীকে কিছু তৈরি করে নিয়ে যেতে হবে কিনা -- এই সব জরুরি জিনিস জানার উপায় রইল না আর। ফের ফোন করলে জানা যেতে পারে, তবে স্মরজিৎদা নিজে থেকে যখন বলেন নি, ওনাকে বিরক্ত করাটা উচিত হবে না।

    আগের অভিজ্ঞতা থেকে অতসী জানে যে স্মরজিৎদা গুছিয়ে কাজ করা খুব পছন্দ করেন। যে কোনো মিটিংয়ের এজেন্ডা কি, ডিসিশন পয়েন্টসগুলো কি এই সব যদি আগে থাকতে সাজিয়ে না রাখা হয়, ব্যাকগ্রাউন্ড নোটস এর মান যদি উঁচুদরের না হয়, তাহলে যাদের ঘাড়ে এসব করার দায়িত্ব দেওয়া ছিল, তাদের রেহাই নেই। অতসীকে এই সব ব্যাপারে অবশ্য কখনো কোনো ধমক খেতে হয় নি। বরং গুছিয়ে কাজ করবার জন্য স্মরজিৎদার কাছ থেকে বারংবার অজস্র প্রশংসা পেয়েছে অতসী।

    স্মরজিতদার কোচিং সেন্টারের আর্থিক অবস্থা কেমন তা একদম সঠিক জানে না অতসী। কিন্তু এটা বুঝবার মতন বুদ্ধি ওর রয়েছে যে আর্থিক অবস্থা খারাপ হবার কোনো কারণ নেই। বোম্বেতে শাখা খুলেছেন স্মরজিৎদা চার বছর আগে। এখানে অফিসে জোর গুজব যে কলকাতাতে শাখা খোলা হবে শিগগিরই। কোচিং সেন্টারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে নিশ্চয়ই নতুন শাখা খোলা হত না।

    বোম্বেতে শাখা খোলার সিদ্ধান্তের সময় স্বভাবতই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল অতসীর। অতসী চাইলেই সেই সময় বোম্বে ফিরে যেতে পারতো, কাজ জানা লোকের সেই সময় দরকারও ছিল তখন বোম্বেতে, কিন্তু নিজে থেকে তখন কাউকে কিছু বলে নি অতসী। বলবেই বা কেন? এমন একটা সময়ে শাখাটা খোলা হল যখন ওর আর বোম্বে গিয়ে কোনো লাভ নেই। শমীক কানপুরে, এখন একা কিংশুকের কাছে ফিরে গিয়ে কি পাবে অতসী? তার চেয়ে এখানে দিল্লিতে নিজের যে জগৎটা ইতিমিধ্যে তৈরী হয়ে গেছে সেখানে থেকে যাওয়াই বরং ভালো।

    শেষ কয়েক বছরে দিল্লিতে ওদের কোচিং সেন্টারে ছাত্রসংখ্যা বেড়েছে প্রচুর। ছাত্রছাত্রীরা এবং তাদের মা-বাবারা যথেষ্ট খুশি ওদের কোচিং সেন্টারের উপর। ওদের সেন্টার থেকে এখন নিয়মিত ছাত্ররা ভালো মেডিক্যাল আর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সুযোগ পায়। স্মরজিতদা অবশ্য বারবার স্টাফেদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানোর গোয়ালঘর করতে রাজি নন তিনি নিজের কোচিং সেন্টারকে। বিজ্ঞানকে ভালোবাসতে হবে এখানকার ছাত্রছাত্রীদের, বিজ্ঞানী হয়ে বিজ্ঞানের সেবা করতে হবে তাদের। স্টাফেদের বলা আছে ছাত্রছাত্রীদের অঙ্ক, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর বায়োলজি নিয়ে পড়তে উৎসাহ দিতে। দরকার পড়লে পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গিয়ে গবেষণা করতে হবে তাদের। এখানে পড়া কোনো ভালো ছাত্র বা ছাত্রী যদি প্রথাগত ভাবে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে এইসব করতে চায়, সেইসব ছাত্র বা ছাত্রীদের কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে দরকার পড়লে তাদের জন্য বিশেষ কোচিংয়ের বন্দোবস্ত করে দেবেন তিনি।

    প্রথমদিকে কিছু সমস্যা হলেও ধীরে ধীরে কিছু ফল পাওয়া যাচ্ছে এখন। বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ছাত্রের সংখ্যা অল্প হলেও বাড়ছে আস্তে আস্তে। যতদূর জানে অতসী, স্মরজিতদার অখুশি থাকার কোনো কারণ নেই।

    তাহলে কি কলকাতার নতুন কোচিং সেন্টার নিয়ে কথা বলবেন স্মরজিতদা। এর আগে যখন বোম্বেতে নতুন কোচিং সেন্টার খোলা হল সেইসব মিটিঙে অতসীও ছিল। বহু সময় ধরে অনেকে মিলে চুলচেরা বিচার করার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বোম্বেতে শাখা খোলার। সেইসব মিটিং হত রীতিমতন নোটিস দিয়ে, কাকে কি তৈরি করে নিয়ে যেতে হবে মিটিঙে, সে সব ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া থাকত অনেক আগে থাকতে।

    রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত মিটিংটা নিয়ে তাই একটা অস্বস্তি হচ্ছিল অতসীর। এরকম খ্যাপার মতন হঠাৎ করে মিটিং ডাকা স্মরজিৎদার স্বভাব নয়। কোথাও কি কোনো দোষ করে ফেলল অতসী? নাকি, গত দুবছরের তুলনাতে এবছর বাচ্চাদের রেজাল্ট যে ততটা ভালো হয় নি তার দায় অতসীকেই নিতে হবে? কিন্তু স্মরজিৎদা তো রেজাল্ট ব্যাপারটাকে অত গুরুত্ব দেন না!

    ***

    এমনিতেই হালকা ঘুম অতসীর। তার উপরে মাথায় চিন্তা থাকলে তো কথাই নেই।

    অনেকক্ষণ বিছানায় ছটফট করল অতসী। দু-দুবার উঠল, জল খেলো। হজমের ওষুধও খেয়ে নিলো একটা, দ্বিতীয়বার ওঠার সময়। যদিও সত্যিকারের হজমের কোনো সমস্যা নেই, তবু এই ঘুম না হওয়াটা সমস্যার পূর্বাভাস। কালকের দিনটাতে কোনো ঝামেলা চায় না অতসী।

    শেষরাতে হালকা একটা ঝিমুনি এল। স্বপ্ন দেখল অতসী -- আবার প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছে ও। পাশে অপরাধী অপরাধী মুখ করে কিংশুক দাঁড়িয়ে, আর শমীক চেঁচাচ্ছে, “লজ্জা করে না তোমাদের দুজনের! যাও, অ্যাবর্শন করে ফেলো, অ্যাবর্শন …”

    ধড়মড় করে উঠে বসার পরও বেশ কিছুটা সময় লাগল থিতু হতে।

    আলো ফুটে গেছে, তবু আরও ঘন্টাখানেক শুয়ে থাকা যায় অনায়াসে। অন্যদিন হলে হয়তো শুয়েও থাকত অতসী, কিন্তু যদি আবার ঝিমিয়ে পড়ে আর আবার এমন সব স্বপ্ন দেখতে হয়?

    গা গোলাচ্ছে। সারা শরীরে একটা বমি বমি ভাব।

    মুখে দিয়েই মনে হয়েছিল -- কাল রাতে ডিম-তরখাটাতে মসলা বড্ড বেশি ছিল।

    ***

    মুশকিল হচ্ছে সকালের দিকটাতে নিজের শরীর নিয়ে ভাবার মতন সময়ও থাকে না হাতে। একবার অফিসে চলে এলে কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যায় কে জানে! আজকেও অজস্র কাজ অফিসে। দুটো লেসন প্ল্যান বানাতে হবে মিটিংয়ের আগে। খাতা দেখে ফেলতে হবে চটাচট গোটা কুড়ি। প্রশ্ন বানাতে হবে দুটো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। প্রশ্নের ডেডলাইন যদিও আরও দুদিন পরে, তবু শেষ সময়ের জন্য কিছু ফেলে রাখতে রাজি নয় অতসী।

    লেসন প্ল্যান দুটো শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকাল অতসী। ইসস! সাড়ে দশটা বেজে গেল এরই মধ্যে? মিটিংয়ের আগে খাতাগুলো বোধ হয় আর শেষ করা সম্ভব হবে না।

    শমীকের বর্দ্ধমান পৌঁছে ফোন করার কথা ছিল। এই সামান্য কাজটুকুও মনে করে করে উঠতে পারেন নি বাবু। যেমন বাপ, তেমনি ব্যাটা। অতসীর একার-ই দায় সকলের খবর নেবার।

    নম্বরটা বেজে গেল, কেউ ধরল না। বিরক্তির সাথে সাথে একটু চিন্তা-ও হল অতসীর। শ্রীমান হয়তো এখন তাঁর গবেষণার ভাবজগতে বিচরণ করছেন। মা-কে ফোনটি তিনি করবেন, তবে তাঁর সময় মতন।

    নাঃ, খাতা দেখা যখন শেষ হবে না, তখন প্রশ্ন দুটোর একটা অন্তত তৈরি করে ফেলা যাক।

    ***

    —আসতেপারি?

    — এসো, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ভালো আছো তো?

    এই বারো বছরে পাকা চুল সামান্য বাড়া ছাড়া চেহারায় কোনো বদল হয় নি স্মরজিৎদার। আগের মতোই ঝকঝকে, চকচকে, স্মার্ট। পড়াশুনায় ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র, অথচ আবার তুখোড় ব্যবসায়ী। নেতৃত্ব দেবার একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে স্মরজিৎদার। অতসী বেশ ভালো করে জানে ব্যক্তিগত জীবনে ঝড়ঝাপটা কিছু কম যায় নি ভদ্রলোকের। বৌ মারা গেছে অল্প বয়সে। কিন্তু আমেরিকার মতন জায়গায় থেকে আর বিয়ে না করে নিজের দুই বাচ্চাকে মায়ের মতন আগলে রেখে মানুষ করেছেন স্মরজিৎদা। অথচ এত বড় দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়লেও, কাজের জায়গায় এক ফোঁটা ফাঁকি দেন নি ভদ্রলোক।

    শিখার কাছ থেকে আরও কিছু স্মরজিৎদার গল্প শুনেছে অতসী। খুব ভালো রান্না করতে পারে স্মরজিৎদা। আমেরিকাতে বাঙালিদের সমস্ত প্রোগ্রামে বাইরে থেকে খাবার আনানো না হলে রান্নার দায়িত্ব প্রায়ই নাকি স্মরজিৎদার ঘাড়ে পরে। সেজন্য বিন্দুমাত্র রাগ বা অভিযোগ নেই স্মরজিৎদার। হাসতে, হাসতে সবার সাথে কথা বলতে বলতেই অনায়াসে পঞ্চাশজনের জন্য তিন-চার পদের রান্না সেরে ফেলতে পারেন দু’তিন ঘন্টার মধ্যে।

    স্মরজিৎদাকে দেখলে কিছুতেই একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখতে পারে না অতসী। অতসী তো মনেপ্রাণে চেয়েছিল কিংশুক এই রকম হোক, কথায় বার্তায় ব্যক্তিত্ব যেন ঝলক দিয়ে ফুটে ওঠে। পড়াশুনোয় তো স্মরজিৎদার থেকে কিছুমাত্র খারাপ ছিল না কিংশুক। কেন তাহলে ক্রমাগত এত জরদ্গবের মতন আচরণ করে চলে? বয়সের সাথে সাথে ওর এই পাগলামিগুলো যেন আরও বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে!

    — ভালো আছি। আপনি ভালো তো?

    — হ্যাঁ। ভালো আছি। শোনো, একটা ব্যাপারে তোমার সাথে একটু আলোচনা করা দরকার। তার আগে বলো, তোমার বর এখনও বোম্বেতে, তাই না? অন্য কোথাও ট্র্যান্সফার হয়ে যায় নি তো?

    — না, না, বোম্বেতেই আছে। কেন বলুন তো?

    — বলছি। তোমার তো এক ছেলে, ছেলেও তো বোম্বেতে ছিল বর-এর কাছে, যতদূর মনে পড়ছে!

    — হ্যাঁ, কিন্তু সে তো অনেক আগে। এখন আই আই টি কানপুরে রয়েছে। জার্মানি যাবার চেষ্টা করছে রিসার্চের জন্য।

    — এই দ্যাখো। কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যায়, ছেলে-মেয়েরা যে বড় হচ্ছে ভুলেই যাই আমরা। শোনো, যে জন্য তোমাকে ডাকা। বোম্বে ফিরে যাবে?

    — মানে! ছাঁটাই করছেন নাকি আমায়?

    হঠাৎ করে ভীষণ, ভীষণ একটা ভয় চেপে বসে অতসীর। কোনো ওয়ার্নিং না দিয়ে ছাঁটাই করার লোক স্মরজিৎদা নন, তবু কর্মজগতে আজকাল কাকেই বা বিশ্বাস করা যায়?

    অতসীর শুকনো মুখের দিকে চেয়ে হো হো করে হেসে ওঠেন স্মরজিৎ সেনগুপ্ত।

    — ছাঁটাই নয়, ছাঁটাই নয়, প্রমোশন। সত্যি কথা বলতে কি ডাবল প্রমোশন!

    অতসীর দিকে একটু ঝুঁকে টেবিল থেকে একটা কাগজ বার করলেন স্মরজিৎ সেনগুপ্ত।

    — বোম্বেতে আমাদের হেড নীরজা কার্ভে রিটায়ার করবেন আর দু’মাস পরে। ওই পোস্টটা নর্মালি পাবার কথা সুশান্ত যোগলেকরের। কিন্তু সুশান্ত আমাদের ছেড়ে নতুন কোম্পানিতে জয়েন করছে আগামী মাসে। এরকম যে ঘটতে পারে সেটা ভাবি নি, তাই তৈরি ছিলাম না একেবারে। ওখানে অন্য যারা আছে তাদের কারুর ঘাড়ে এত বড় দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যায় না। কাকে দেওয়া যায় ভাবতে গিয়ে, প্রথমেই তোমার নামটা মনে এল।

    — এ তো আমার মস্তবড় সৌভাগ্য, স্মরজিৎদা। হই বা না হই, আমার কথা যে ভেবেছেন এটাই যথেষ্ট।

    — তাহলে রাজি তো?

    — হ্যাঁ, তবে ভয় হচ্ছে, সামলাতে পারব তো? এখন অবধি একটা পুরো অফিস সামলানোর দায়িত্ব তো নিই নি কখনো।

    — কেন পারবে না? এখানেও তো সিনিয়রিটি লিস্টে তোমার নাম তিন নম্বরে। অফিস চালানোর কাজে তোমার পরামর্শ নিশ্চয়ই নেন অমিত শাকধের । শোনো, এই এত বছর ধরে লোক চড়িয়ে চড়িয়ে ঘুঘু আমিও কিছু কম হই নি। বিশাল ট্যালেন্ট আছে তোমার মধ্যে। বিশ্বাস করো, আমি জানতাম এখানে তোমাকে ঠিকঠাক সুযোগ দিতে পারছিলাম না। যখন সুযোগ এল …

    — আপনার যখন এত ভরসা আমার উপর, চেষ্টা করব প্রাণপণে।

    — গুড। শোনো তুমি আর দিন পনের পরেই বোম্বেতে রিপোর্ট করো। একটু তাড়াতাড়ি হয়ে গেল, কিন্তু আমি চাইছি নীরজা কার্ভে থাকতে থাকতে তুমি ওর কাছ থেকে কাজ বুঝে নাও।

    — এত তাড়াতাড়ি?

    — হ্যাঁ। যাচ্ছো যখন, আর মায়া-টায়া বাড়িও না, বিশেষ করে হাসব্যান্ড যখন বোম্বেতে। তোমার শিফটিংয়ের সব খরচ কোম্পানি দেবে, ভালো মুভার্স অ্যান্ড প্যাকার্স বেছে নিও, যাতে তোমার নিজের উপর লোড কম পড়ে। কফি খাবে?

    ***

    এত ভালো একটা খবর, তবু কেন আনন্দ হচ্ছে না অতসীর?

    দিল্লি আসার পর প্রথম প্রথম রোজ বোম্বে ফেরার স্বপ্ন দেখত অতসী। কখনো কখনো রাতে বালিশ ভিজে যেত ওর, চোখের জলে। প্রমোশনটা কেন সেই সময়ে এল না? আরও আগে ফিরে গেলে শমীক কি এতটা দূরে সরে যেতে পারতো?

    শমীকের মোবাইল নম্বর টেপে অতসী।

    রিং হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।

    একটা ফোন ধরবার মতন সময়ও ছেলের নেই। কখনো ফোন পড়ে থাকে দূরে, কখনো সুইচ অফ থাকে, কখনো চার্জ থাকে না, কখনো আবার বাবু অন্য কাজে এত ব্যস্ত থাকেন যে ইচ্ছে করে ফোন ধরেন না।

    এতদিন বলে বলেও যখন স্বভাব পাল্টানো যায় নি, ও আর পাল্টাবে না, যদি না কোনোদিন নিজে থেকে চায়। মনে তো হয় না সেদিন আবার কখনো আসবে।

    ঠোঁট চেপে নিজের মধ্যে একটা প্রবল কান্নার বেগ আটকে রাখে অতসী। শমীক আই আই টি যাবার পর ম্যানেজমেন্টের কোর্সে ভর্তি হয়েছিল অতসী। এবার আরও দূরে, বিদেশে চলে যাচ্ছে ছেলে। এখন তবে আর কি নিয়ে থাকবে অতসী? আর কী কোর্স করবে? যদি কিছু করেও, কতটা আনন্দ জুটবে তার থেকে?

    প্রোমোশনের আনন্দটুকু শমীকের সাথে ভাগ করে নিতে অপেক্ষা করে যেতে হবে অনেকক্ষণ, যদি অবশ্য শমীকেরও ভিতর থেকে আনন্দটা হয়।

    ***

    বোম্বে মানেই আবার সেই কিংশুকের সঙ্গে থাকা। পদে পদে ঝগড়া আর অ্যাডজাস্টমেন্ট। আজকাল আর এসব ভালো লাগে না অতসীর।

    বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেক কিছু নিজের মত করে এখন বুঝতে শিখেছে অতসী। একা একা থাকতে থাকতে কাউকে একটা কাছে পাবার আকুলি এসেছে যেন ভিতরে। দিনের শেষে একটা আশ্রয় যে এত দরকারি সেটা অল্প বয়সে বোঝে নি অতসী। একটা ঘর, তার ইঁট-কাঠ-সিমেন্ট নিয়ে আর এই আশ্রয় দেবে কি করে? আশ্রয় তো দেবে মানুষ!

    আশ্চর্য এই যে কিংশুকের বেলা যা ঘটছে তা একেবারে উল্টো। যৌবনের শান্ত, নির্বিরোধী কিংশুক বয়স বাড়ার সাথে সাথে উগ্র হয়ে উঠছে আরো। আজকাল কথায় কথায় খোঁচা দেয় কিংশুক, অভদ্রের মতন চেঁচায় টেলিফোনে। শমীক বড় হবার পর ওকে একটু ভয়ের চোখে দেখত কিংশুক। ও সামনে থাকলে গলা তুলত না বিশেষ। এখন শমীক হোস্টেলে থাকে বলে নিজের উপর স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণটুকু পর্যন্ত রাখার তাগিদ অনুভব করে না কিংশুক।

    ওর এই প্রোমোশনের খবরটা শুনে খুশি হবে না কিংশুক। অতসীর ক্যারিয়ারের ব্যাপারে কোথাও যেন একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষা রয়ে গেছে ওর। অতসী যে কারুর, বিশেষ করে কিংশুকের সাহায্য ছাড়াই নিজেকে আস্তে আস্তে বড় করে তুলছে, মুখে কিছু না বললেও কিংশুক যে সেই ব্যাপারটা ভালো চোখে নেয় না, সেটা বুঝবার মতন বাস্তববুদ্ধি অতসীর রয়েছে।

    তবু দিতে হবে খবরটা। পনের দিন মাত্র সময় হাতে। যাবার আগে বোম্বেতেও কিছু কাজ করিয়ে নিতে হবে অতসীকে। কিংশুক ছাড়া আর কেউ তো করে দিতে পারবে না সে সেসব।

    ***

    বেশ কিছুক্ষণ রিং হবার পর ওদিক থেকে আওয়াজ এল।

    -- হ্যালো!

    -- শোনো, তিসি বলছি। খবর আছে একটা।

    -- পরে শুনবো। মিটিং আছে এখন।

    কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দেয় কিংশুক।

    এরকম হবে জানাই ছিল। অফিসে কিংশুকের একমাত্র কাজ -- অতসী যতদূর জানে আর বোঝে -- মিটিং করা। রাজনৈতিক নেতারাও বোধ হয় এত মিটিং করেন না কিংশুকের মতন।

    সন্ধ্যার আগে আর কাউকে ফোন করে লাভ নেই। সন্ধ্যার পরেও হয়তো নেই।

    এই প্রমোশন ততক্ষণ অবধি গলায় চেপে বসে থাকবে অতসীর।

    ***

    আবার রিং হচ্ছে মোবাইলটা।

    অচেনা নম্বর। নেবে কি নেবে না ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত কলটা নিয়েই ফেলল অতসী।

    — হ্যালো!

    — হ্যালো, অতসী? আমি দেবু বলছি!

    — দেবু?

    কে দেবু? ভালো করে ভাববার আগেই উল্টোদিক থেকে গলা ভেসে এল, “দেবু, মানে দেবরাজ!”

    একটু অবাক হল অতসী। দেবরাজের নম্বর তো রাখা আছে ওর মোবাইলে। তার মানে কি দেবরাজ নম্বর বদলিয়েছে? ওর সব কাজই কেমন যেন রহস্যে মোড়া!

    হঠাৎ দেবরাজ কেন ওকে ফোন করছে এখন, এতদিন পরে? এক নম্বরের পাজি, স্বার্থপর, ধান্ধাবাজ একটা ছেলে! এক নম্বরের হিংসুক-ও। কিংশুকের ক্যারিয়ার ওর চেয়ে অনেক ভালো বলে আগাগোড়া কিংশুককে হিংসে করে এসেছে দেবরাজ। ওকে আজেবাজে আওয়াজ দিয়েছে। অতসীকে বিছানাতে কিংশুক সামলাতে পারে কিনা সেই প্রশ্ন অবধি করেছে অনেকের সামনে।

    বিয়ের পর ক্রমাগত এইভাবে কিংশুক আর অতসীকে খুঁচিয়ে কথা বলত দেবরাজ। হয়তো ভাবত যে বাড়ির জামাই বলে শালা আর শালাবৌকে যা খুশি বলা যেতে পারে।

    বর্ধমানের বাড়িতে একবার মাংস রান্না করেছিল অতসী। নিজেরা খুব রিচ খায় না বলে মসলা দিয়েছিল অল্প। সেই জন্ডিসের রুগীর মাংসের ঝোল নিয়ে সকলের সামনে ওকে এমন হ্যাটা করেছিল দেবরাজ যে এতদিনেও তা অতসী ভোলে নি। বাজে রসিকতার বন্যা বয়ে গিয়েছিল সেদিন ওর রান্না নিয়ে। কিংশুক সেদিন একটুও আড়াল দেয় নি ওকে। রাগে, অপমানে সেদিন ঠিক করে ফেলেছিল অতসী যে বর্ধমানের বাড়িতে আর কোনোদিন রান্নাবান্নার কাজে হাত লাগাবে না ও।

    আজ আবার ফোন করছে কেন দেবরাজ? কি ধান্ধায়?

    — ভালো আছো তো?

    খাজুরে আলাপ না করে সোজাসুজি কেন যে কথা বলতে পারে না এরা!

    — হ্যাঁ, ভালো আছি। কি ব্যাপার?

    দেবরাজ বা ওর বৌ আর মেয়েরা ভালো আছে কিনা জিজ্ঞাসা করে সময় নষ্ট করবে না অতসী।

    — শোনো, তোমাদের কোম্পানি কলকাতায় ব্র্যাঞ্চ খুলছে, তাই না?

    আশ্চর্য! অতসী নিজেই ভালো জানে না এ কথা, দেবরাজ জানল কি করে? কিন্তু যেভাবেই হোক, দেবরাজকে জানতে দেওয়া যাবে না যে অতসী নিজেই একথা জানে না ভালো করে।

    — এখনো ফাইনাল ডিসিশন হয় নি কিছু।

    — না, তোমাদের বোর্ডে হয়তো ব্যাপারটা পাস হয় নি। কিন্তু সেটা তো ফর্মালিটি মাত্র! স্মরজিতবাবু যদি ভেবে থাকেন খুলবেন, তাহলে নিশ্চয়ই এটা করে ছাড়বেন।

    — হ্যাঁ, সেটা ঠিক। কিন্তু তুমি হঠাৎ এই নিয়ে কথা তুলছো কেন?

    — বলছিলাম কি, নতুন ব্র্যাঞ্চ খুললে তো লোক লাগবে। এক্সপেরিয়েন্সড লোক পেলে আরও ভালো। তোমার সঙ্গে তো স্মরজিতবাবুর দারুন সম্পর্ক, চেষ্টা করো না একটু আমার জন্য স্মরজিতবাবুর কাছে। আমারও তো প্রায় বারো বছরের এক্সপেরিয়েন্স হয়ে গেল এখানে। শুনেছি অন্য কোচিং ইনস্টিটিউটগুলোর থেকে পয়সা একটু বেশি দেয় তোমাদের কোম্পানি আর অনেক ভদ্রসভ্য ব্যবহার করে।

    — ঠিক আছে। সি ভি টা জমা করে দিও এইচ আর-এ।

    আজকাল অনেক চালাক হয়েছে অতসী। হয়তো ম্যানেজমেন্ট পড়ার ফল এটা।

    সরাসরি দেবরাজের সাথে কোনো সংঘর্ষে যাবে না অতসী। তবে ওর জন্য কিচ্ছু কাউকে বলবে তো না-ই অতসী, বরং দরকার পড়লে সময়মতন ওকে বিশাল একটি বাঁশ দেবে। মুখে অবশ্য অনেক মিষ্টিমধুর ন্যাকামি করবে ও দেবরাজের সাথে, “চেষ্টা তো করেছিলাম ভাই অনেক, কিন্তু জানোই তো স্মরজিতবাবু কত ডিম্যান্ডিং! তা, তুমি পারলে না শেষ অবধি ওনাকে খুশি করতে?”

    হয়তো কাজ হবে না এই সব ন্যাকামিতে। হতাশ হয়ে দেবরাজ হয়তো স্মরজিতবাবুর সাথে ওর দারুন সম্পর্কর অন্য মানে করে আজেবাজে রটিয়ে বেড়াবে সবাইকে।

    করুক গে। তাতে কিচ্ছু যায় আসে না অতসীর।

    শুধুমাত্র এই রকম একটা টেলিফোন পাবার জন্যই সব মেয়ের উচিত মন-প্রাণ ঢেলে চাকরি করা!

    ***

    — কংগ্রাচুলেশন্স, দিদি।

    — দিদি, আপনে কামাল কর দিয়া ইসবার!

    — দিদি, বড়া পার্টি চাহিয়ে। সামোসা আউর রসগুল্লাসে নাহি চলেগা!

    অফিসের কোনো কথাই গোপন থাকে না। অফিসিয়াল চিঠি হাতে পাবার আধ ঘন্টার মধ্যে সবাই ঘিরে ধরল অতসীকে। বেশ কয়েকজন দুঃখও প্রকাশ করে ফেলল অতসী ওদের ছেড়ে বোম্বে চলে যাচ্ছে বলে। অতসী জানে, এই দুঃখপ্রকাশের সবটাই নাটক নয়। অফিসে নিজের সিনিয়রের প্রমোশন মানেই জুনিয়রদের দুঃস্বপ্নের শুরু। নতুন যিনি বস হয়ে আসবেন তিনি কেমন হবেন কে জানে?

    আজ বা কালের মধ্যে সেরে ফেলতে হবে পার্টিটা। এরপরে এত সব কাজ বেড়ে যাবে যে হাতে আর সময় পাওয়া যাবে না।

    আজ শুক্রবার। কাল অফিস ছুটি। কাল লাঞ্চেই পার্টিটা সেরে ফেললে কেমন হয়?

    টিম তরল পার্টি চাইছে, অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে সব, অফুরন্ত উৎসাহ সবকিছুতে। ওদের কাউকেই ভার দিতে হবে সব ব্যবস্থা করার জন্য।

    এখনই একটা ছোট্ট মিটিং ডাকলে কেমন হয়? যদিও অফিস ছুটি হবে এক্ষুনি তবে এমন একটা ব্যাপারে আরও আধঘন্টা থেকে যেতে কেউ আপত্তি করবে না!

    এখানে অফিসের লোকেদের নিয়েই এখন অতসীর সংসার।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments