ছোটবেলার থেকে অতসী দেখে এসেছে ওদের বাড়িতে বাবার কথা মানে শেষ কথা। বাবার প্রখর ব্যক্তিত্বের আড়ালে ওর মা পুরোপুরি চাপা পড়ে গিয়েছিলেন। এল আই সি-র মাঝারি মাপের অফিসার ছিলেন ওর বাবা। পুরোনো জমিদারবংশের রক্ত গায়ে ছিল বলেই হয়তো সুন্দর চেহারা ছিল অতসীর বাবা সুরেন্দ্রনাথের। বাবার মা এবং ঠাকুমা দুজনেই ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন। নিজের মা-ঠাকুমার মতন বাবারও ছিল কাঁচা সোনার মতন ফর্সা রং আর নজরে পড়বার মতন সামান্য কটা চুল আর চোখ। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি রাখতেন,আর ছিল পরিশ্রম করবার অগাধ ক্ষমতা। পড়ন্ত জমিদারবংশের সন্তান হিসেবে যৌবনে দারিদ্র্যের মুখোমুখি হলেও ক্রমাগত নিজেকে ভেঙে গড়ে তৈরি করে নেবার উচ্চাশা ছিল নিজের মধ্যে। তাই সাধারণ ক্লার্ক হিসেবে শুরু করে আস্তে আস্তে নিজেকে উন্নততর জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।
অন্যদিকে অতসীর মা যোগমায়া ছিলেন নরম ভালোমানুষ ধরনের। প্রতিবাদ করার বা জোর করে নিজের মত অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার কোনো চেষ্টা ছিল না ওনার। সারাদিন নিজেকে রান্না আর বাড়ির অন্য সমস্ত কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখতেন যোগমায়া। একটু বড় হবার পর অতসী জানতে পারে যে ওদের জন্মের আগে ওর মা একটা সরকারি ব্যাংকে চাকরি করতেন। মায়ের নিজের মা মারা যান অনেক অল্প বয়সে। দাদা যখন পেটে তখন মা-র পাশে দাঁড়ানোর মতন কেউ ছিল না, মা তাই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। হয়তো পরে আবার চাকরি খুঁজত মা, কিন্তু দাদা আর অতসী একদম পিঠোপিঠি ভাইবোন বলে, অতসীর জন্মের পর আর চাকরি করা তো দূরের কথা, চাকরি খোঁজাটাও মায়ের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে নি।
বাবা অফিস থেকে প্রায়ই দেরি করে ফিরত। অনেক সময় রাত আটটা বা ন’টা বেজে যেত ফিরতে ফিরতে। দাদা বা অতসী পড়াশুনো নিয়ে ব্যস্ত, তাই সারাদিন ধরে মা-কে আলাদা করে সময় দেবার মতন কেউ ছিল না বাড়িতে। সন্ধ্যের সময় অতসী বাড়ি থাকলে লক্ষ্য করত, মা কেমন যেন ছটফট করত। বাড়ির কাজ, রান্নাবান্না সেরে নেবার পর মায়ের হাতে আর কোনো কাজ থাকত না। ইচ্ছে করেই সন্ধ্যাবেলা টিভি চালাত না মা, যাতে দাদা আর অতসীর পড়াশুনোর ক্ষতি না হয়। অন্য কোথাও যাবার উপায় ছিল না কারণ বাবা কখন অফিস থেকে ফিরবে তার ঠিক ছিল না কোনো। অফিস থেকে বাড়ি এসে মা-কে না দেখতে পেলে খুব রেগে যেত বাবা। ছুটিছাটার দিনে বাবা বাড়িতে থাকলে বাবাকে ফেলে সিনেমা বা কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাবার উপায় ছিল না মায়ের। নিজের মত করে মা-কে ভালোবাসত ওর বাবা, কিন্তু সেই ভালোবাসার মধ্যে অধিকারবোধ ছিল তীব্র। একা কোথাও মা-কে ছাড়তে চাইত না বাবা। হয়তো সেটা শুধু আটকে রাখার জন্য নয়, সব ধরনের বিপদ থেকে আগলে রাখার জন্যও বটে! আসলে, মায়ের নিরাপত্তার ব্যাপারে বাবা ছিলেন অসম্ভব সাবধানী আর মা নিজেও এটা পছন্দ করত। ব্যক্তিত্বের অসম বন্টন হলেও বাবা আর মায়ের মধ্যে তাই বোঝাপড়ার কোনো অভাব দেখে নি অতসী।
একটু বড় হবার পর মা’র এই চুপচাপ সহ্য করে নেওয়ার ব্যাপারটা কিন্তু মেনে নিতে পারত না অতসী। আর কেন জানি না রাগটা বেশি হত মায়ের উপরেই। তোমাকে যদি কেউ ক্রমাগত চাপ দেয়, সবচেয়ে আগে তার প্রতিবাদ করা উচিত তোমার নিজের। তোমার একান্ত নিজের এই লড়াইটুকুও কি অন্য কেউ করে দেবে? কলেজে পড়ার সময় মা’কে একটু সময় দেবার জন্য অনেক সময় আগে বাড়ি চলে এসেছে অতসী, বন্ধুদের সাথে আড্ডা ফেলে। ক্রমাগত মা’কে আবার বাইরে কাজ করার ব্যাপারে উৎসাহ জুগিয়েছে ও। কিন্তু ওকে কিছুটা অবাক করে ওর মা ম্লানমুখে বলেছে, “আমার আর এ’জীবনে চাকরি-বাকরি করা হবে না!” কখনো কখনো একটু হেসে জানিয়েছে, “মন্দ কি আছি বল? বয়স তো অনেক হয়ে গেল, এই বয়সেও খাওয়া-দাওয়া পোশাক-আশাক সবই যখন জুটছে তখন আবার কেন ফালতু ঝামেলা ডেকে আনা!”
নিজের অফিস সংক্রান্ত কোনো কাজের সাথে বিন্দুমাত্র আপস না করলেও এবং নিজের ছোটখাট দাবিদাওয়াগুলি আদায় করে নিলেও, বাবা কিন্তু অন্যান্য সমস্ত ব্যাপারে মায়ের যত্ন করত খুব। মা’র শরীর খারাপ লাগছে কিনা সেটা বাবা মায়ের দিকে একবার তাকিয়েই বুঝে যেত। বাড়ির কাজের লোকেরা মা’কে ঠিকঠাক সাহায্য করছে কিনা সেই ব্যাপারে বাবার নজর ছিল তীক্ষ্ণ। মা’কে প্রায়ই নতুন নতুন পোশাক কিনে দিত বাবা। জন্মদিনে বা বিবাহবার্ষিকীতে নিজে মনে করে দামি গয়না উপহার দিত। কখনো কোনো বিয়ে বা অন্য অনুষ্ঠানে যাবার সময় মা ভালো করে না সাজলে রাগ হত বাবার। আর ছুটির দিনগুলোতে মাকে একা কোথাও যেতে না দিলেও, বাবা কিন্তু বৌ-ছেলেমেয়ের সাথে পুরো সময়টা কাটানোই পছন্দ করত। সারা সপ্তাহে রবিবার -- ওই একটা দিন বাবাকে পুরোপুরি পেত দাদা আর অতসী।
বিয়ের পর সংগত কারণেই তাই কিংশুকের কাছ থেকে একই রকমের অধিকারবোধ আর সময় দেওয়াটা আশা করেছিল অতসী। কিন্তু আরও অনেক কিছুর মতন এখানেও একরাশ হতাশা ছাড়া ওর কপালে আর কিছু জোটে নি। অতসী কোথায় যাবে আর কি করবে সেসব ব্যাপারে কিংশুক পুরোপুরি নির্বিকার। অফিসের বাইরে কিংশুকের উৎসাহ শুধু রাশিরাশি খাওয়াতে। টিভিতে সিরিয়াল দেখা একেবারে পছন্দ করত না কিংশুক, তবে পৃথিবীর সব দেশের যত আজেবাজে সিনেমা আর অ্যানিমাল প্ল্যানেট চ্যানেল দেখত ঘন্টার পর ঘন্টা। ওয়ান ডে ক্রিকেট থাকলে ওকে ক্রেন দিয়েও টিভির সামনে থেকে হঠানো যেত না। এই সারাদিন ধরে টিভি দেখে যাওয়াটা দুচক্ষের বিষ ছিল অতসীর। এভাবে নিজেকে নষ্ট করার কোনো মানে হয়?
বাড়িতে সবাইকে রোজ নিয়ম করে অনেকটা সময় দিলেও কিন্তু অকারণে বাবাকে নিজের সময় নষ্ট করতে দেখে নি অতসী। সবসময় সামনে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছে বাবা। এইসব লক্ষ্য পূরণের জন্য যেটুকু পড়াশুনো করা দরকার বা অফিসের জন্য অতিরিক্ত সময় দেওয়া দরকার বাবা তা করেছে, দরকার পড়লে রাত জেগে বা ভোরে উঠে। কোনোরকমে একটা ভালো চাকরি জোগাড় করলেই কি সব শেষ নাকি? পুরুষমানুষের যদি উচ্চাশা না থাকে, তাহলে রইল কি?
বিয়ের পর কিছুটা অবাক হয়েই অতসী লক্ষ্য করে যে নিজের ভালোমন্দের ব্যাপারে কিংশুক অনেকটাই উদাসীন। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কে কি করছে তাতে বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই কিংশুকের। প্রথমদিকে কিংশুককে এই নিয়ে অনেক বুঝিয়েছে অতসী, বারবার করে ওকে বলেছে লক্ষ্য রাখতে অফিসে ওর নিজের আর আশেপাশের ব্যাচের বাকি সকলে কি করছে। এদের অনেককে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়াতে দেখে বারবার করে কিংশুককে ও বলেছে বোম্বে আই আই টি বা আই জি আই ডি আর-এ পি এইচ ডি করবার জন্য ভর্তি হতে। কিংশুকের পেশায় না থাকলেও এটা বুঝতে ওর দেরি হয় নি যে নিজের যোগ্যতা ক্রমাগত না বাড়ালে এই পেশাতে উঁচুতে ওঠা কঠিন, বিশেষ করে ওদের মতন যাদের নৌকো কোনো বড় গাছে বাঁধা নেই।
আর নৌকো-ও কি আপনা-আপনি বড় কোনো গাছে এসে বাঁধা পড়ে? নিজের বাবাকে তো চোখের সামনে দেখেছে অতসী। একটা চাণক্য শ্লোক আউড়ে বাবা প্রায়ই দাদা আর অতসীকে বলতো যে ঘুমন্ত সিংহের মুখে কখনো হরিণ এসে ঢোকে না।
আশ্চর্য, অন্য সময়ে তুই করে বললেও কিছু বোঝাবার সময় বাবা দাদা আর অতসীকে তুমি করে বলতো, যেন একটু সম্মান দিয়ে কথা বললে ওরা আরো ভালোভাবে ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।
– তুমি নিজেকে সিংহ ভাবতেই পারো, তিনু, অনেক গাধা-গোরুও নিজেকে তাই ভাবে, কিন্তু যতক্ষণ না তুমি সফলভাবে শিকার করতে পারছ ততক্ষণ পৃথিবী জানবে যে একটা গাধার সাথে তোমার কোনো তফাৎ নেই।
– লোকে শুধু তোমার শিকার করবার ক্ষমতা কতটা তাই দিয়ে তোমার বিচার করবে না, তিসি-মা, তারা জানবেই না ঠিক কতটা ক্ষমতা তুমি ধরো। তুমি সফলভাবে শিকার করতে পারলে তবেই তোমার কতটা ক্ষমতা লোকে বুঝবে।
নিজের জীবনেও এই একই আদর্শকে সামনে রেখে এগিয়েছে বাবা। উপরে উঠতে গেলে যাদের সাহায্য দরকার শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাদের সাথে যোগাযোগ রেখে গেছে নিয়মিত। এদের অনেকেই মানুষ হিসেবে খুব সুবিধের ছিল না। বাবা কেন এদের সাথে যোগাযোগ রাখতে আগ্রহী তা বুঝতে এদের কোন অসুবিধে হয় নি, আর তার সুযোগও এরা নিয়েছে পূর্ণমাত্রায়। বাবা কিন্তু হাসিমুখেই এদের বেশ কিছু অন্যায্য আব্দার মেনে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেক সময় নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে আলাপ করেছে সরকারি অফিসের বড়কর্তা, ইউনিয়ন লিডার অথবা পাড়ার রাজনৈতিক নেতাদের সাথে। এক সময়ে এই সব যোগাযোগই বাবার নিজের কর্মজীবনের উন্নতির সোপান হয়ে দাঁড়িয়েছে। অফিসে ম্যানেজমেন্ট আর ইউনিয়নের মধ্যে যোগাযোগের সেতু ছিল বাবা। বাবার চেয়ে যোগ্যতর এক দুজন ক্যান্ডিডেট থাকলেও বাবাকে কর্মজীবনের শেষ প্রমোশনটি দেওয়া হয়েছিল ইউনিয়নকে সফলভাবে বুঝিয়ে একটি স্ট্রাইক প্রত্যাখ্যান করিয়ে নেওয়ার পুরস্কার হিসেবে।
কিংশুককে কিছুতেই এই নিয়মিত লোকজনের সাথে যোগাযোগ রাখার ব্যাপারটা বুঝিয়ে উঠতে পারে নি অতসী। লোকজনের ব্যাপারে কিংশুকের পছন্দ-অপছন্দ বেশ তীব্র। যাকে পছন্দ তার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতে কোন সমস্যা নেই কিংশুকের, কিন্তু যাকে পছন্দ নয়, তার আশেপাশেই যাবে না কিংশুক। আর অতসীর যেটাতে সবচেয়ে বিরক্ত লাগে সেটা হলো যে নিজের এই অপছন্দটা কিছুতেই চেপে রাখতে পারে না কিংশুক। কিংশুকের মুখ এসব ব্যাপারে একেবারে খোলা আয়না। হতে পারে তোমার কাউকে অপছন্দ, তাই বলে তার সাথে কথা বলবার সময় তুমি ছটফট করবে, বা হাই তুলবে? যাদের সাথে তুমি এমন করবে তারা কি তোমাকে পাগল বা অহংকারী ভাববে না? অতসীর সামনেই যদি এই সব হয়, তাহলে অতসী যেখানে নেই সেখানে কিংশুক যে কি সব করে বেড়াচ্ছে কে জানে? কেন জানি না, এই সব নিয়ে ভাবতে গেলেই মেরুদন্ড বেয়ে একটা ঠান্ডা ভয়ের স্রোত নামে অতসীর। অফিসের বসেদের সামনে যদি নিজের মনের ভাব চেপে রাখতে না পারে কিংশুক? এমনকি আড়ালেও যদি কিংশুক অফিসের বড় কারুর সম্বন্ধে নিজের মনের আসল ভাবটা প্রকাশ করে ফেলে, তাহলেও কি সেটা খুব কম বিপদের? বন্ধুর তো কোনো কমতি নেই অফিসে।
বোম্বেতে কিংশুকের অফিসের বন্ধুদের কাউকেই খুব একটা সুবিধের মনে হয় নি অতসীর। এদের একজন দুজন বেশ অসভ্য, অন্তত মেয়েদের ব্যাপারে। বাড়িতে থাকা বৌকে এরা ঝি-এর বেশি মর্যাদা দেয় না। আর এদের বেশির ভাগই চূড়ান্ত সুবিধাবাদী, নিজেদের দরকার থাকলে দশবার ফোন করবে বা দেখা করবে, কিন্তু দরকার মিটে গেলে আবার যে কে সেই। এদের মধ্যে অভ্রকে অবশ্য অতসীর মন্দ লাগে নি। বেশ ভদ্র-সভ্য হাসিখুশি অভ্র। ধবধবে ফর্সা চেহারা আর গোল্লু-গোল্লু গাল। অভ্রর নাকটা একটু বোঁচা, আর সেই ভালুকে খাওয়া নাকে পুরোনো দিনের মতন একটা মোটা কালো ফ্রেমের চশমা থাকায় সারা মুখে একটা পুরোনো বনেদি বাঙালি বাবু-মার্কা ছাপ রয়ে গেছে। সত্যি সত্যিই অভ্র কলকাতার পুরোনো বনেদি বাড়ির ছেলে। অতসীর সিক্সথ সেন্স প্রথম দেখাতেই বুঝে গেছে যে বন্ধুর বৌয়ের দিকে বিশেষ কোনো পুরুষসুলভ নজর নেই ওর, আর এটাও বেশ বোঝা যায় যে কিংশুককে ও সত্যিই খুব পছন্দ করে। প্রথম আলাপেই অভ্র হাসতে হাসতে অতসীকে বলেছিল যে কিংশুক না থাকলে ওর পক্ষে এতটা ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব ছিল না। (“ইকনোমেট্রিক্সে কিংশুক সেবার পেল ছিয়াত্তর – সারা ব্যাচের মধ্যে হায়েস্ট – আমি বাহাত্তর, ওর ঠিক পরেই। সবাই অবাক, এমনকি প্রফেসররাও। ভাগ্গিস এটা কেউ মনে রাখে নি যে পরীক্ষার সময় আমার সিটটা পড়েছিল তোমার হাসব্যান্ডের ঠিক পিছনে!”)
অন্যদের থেকে অনেক ভালো হলেও, নিজের ব্যাপারে অভ্রকেও কিন্তু যথেষ্ট চালু মনে হয়েছে অতসীর। তবে যতই চালু হোক, আড্ডা দিতে দিতে অনেক সময় অনেক আলগা কথা বেরিয়ে যায় মুখ দিয়ে। পরে সে সব নিয়ে ভাবলে দিব্যি দুই আর দুই মিলিয়ে চার করা যায়, যদি অবশ্য সেই ভাববার ইচ্ছেটা থাকে। পড়াশুনোয় কিংশুকের মতন অতটা ভালো না হলেও, অতসী কিন্তু লক্ষ্য করেছে যে ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র অফিসারদের সাথে অভ্রর যোগাযোগ কিংশুকের চেয়ে অনেক বেশি। ঘরোয়া আড্ডায় প্রায়ই কোন সিনিয়র অফিসার অভ্রকে কি বলল সেই প্রসঙ্গ এসে যায়। কিংশুকের কথাবার্তায় তো এক ওই গোস্বামী সাহেব ছাড়া আর কারুর কথা আসে না? বিয়ের ঠিক পরে পরে কিংশুকের অফিসে একবার গিয়েছিল অতসী, তাই ও জানে যে ওদের দুজনেরই টেবিল একই ফ্লোরে, একটা হলঘরের দু’ প্রান্তে। দুজনকেই সারাদিন বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়, তাহলে কোন সময়ে অভ্র এসব করে?
কিংশুক না বুঝলেও, অতসীর কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হয় নি।
কারণ, অতসীর বাবা!
বিয়ের পর প্রথম বাপের বাড়ি আসার সময় বাবার সাথে কিংশুককে নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল অতসীর। নিজে এল আই সি-র অফিসার ছিলেন বলেই জামাইয়ের কাজের জায়গা নিয়ে বেশ কৌতূহল ছিল বাবার। জামাইকে সরাসরি প্রশ্ন করার বদলে মেয়ের কাছ থেকেই সব জেনে বুঝে নিতে চাইছিল বাবা।
– কিংশুক একটু বোধহয় লাজুক, তাই না রে তিসি মা!
– লাজুক না ছাই, ইচ্ছে হলে তো দিব্যি কথা বলে অপিরিচিতদের সাথে। এই তো, এবার ট্রেনে আসতে আসতে পাশের বার্থের এক বাঙালি ভদ্রলোকের সাথে উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা নিয়ে ঘন্টা দুয়েক বকর বকর করে গেল।
শুনে হেসেছিল বাবা। বলেছিল, “লাজুক না হলে তো ভালোই। ওকে বলিস, অফিসে খাওয়ার সময়টা কাজে লাগাতে। মাঝেমধ্যে সম্ভব হলে যেন সিনিয়রদের সাথে একটু বসে। জানিস তো, অফিসে নিজের বস ছাড়া অন্য কোন সিনিয়রের কেবিনে গেলেই সবার সেটা নজরে পড়ে আর এই সব নিয়ে কেচ্ছা চলে, তবে খাবার টেবিলে কে কার সাথে বসলো সেটা অবশ্য কেউ মাথায় রাখে না। খেতে খেতে সিনিয়রদের সাথে তারা কে এখন কি কাজ করছে বা করবে আর সেই সব কাজে ও কোনোরকম সাহায্য করতে পারে কিনা এই সব নিয়ে একটু যেন আলোচনা করে। সব অফিসেই এখন এত পলিটিক্স যে অল্প বয়স থেকেই নিজের নেটওয়ার্ক নিজে বানাতে না পারলে টেঁকা মুশকিল।”
– তুমিই বল না! আমার কথা ও পাত্তাই দেয় না, এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। তুমি বললে তবু যদি শোনে!
আবার হেসেছিল বাবা, “ধুর, তাই কি হয়! জোয়ান ছেলে! শ্বশুর বেশি উপদেশ দিতে গেলে উল্টো ফল হবে। যদি শোনে, দেখবি তবে তোর কথাই শুনবে!”
বাবার কথাগুলো কেন জানি না মাথায় গেঁথে গিয়েছিল সেদিন।
অভ্রকে একবার দুবার প্রশ্ন করেই অতসী বুঝতে পেরেছে যে সিনিয়র অফিসারদের সাথে অভ্রর যোগাযোগ মূলত দুপুরে খাবার সময়। আজকাল কাজের অজুহাতে প্রায়ই কিংশুকদের সাথে লাঞ্চ করে না অভ্র। অতসী নিশ্চিত যে এই সব দিনগুলোতে ও কোন না কোন সিনিয়র অফিসারকে বেছে তাদের সাথে এক টেবিলে বসে।
বাবার কথা মতন কিংশুককে এসব বোঝাবার চেষ্টা করেছে অতসী। কোন ফল হয় নি। বুঝবার কোনো ইচ্ছেই নেই কিংশুকের। শেষের দিকে রাগারাগি করেছে অতসী, কিংশুককে গালাগালি দিয়েছে চিৎকার করে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে সব।
উপর উপর দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু নিজের ব্যাপারে ভয়ঙ্কর জেদি কিংশুক। আর কেন জানি না, ওর কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপারে, বিশেষ করে অফিসের ব্যাপারে, অতসী নাক গলাক, সেটা ও একেবারে পছন্দ করে না। নিজের চারদিকে একটা অদৃশ্য গন্ডি টানা রয়েছে কিংশুকের। এমনকি নিজের বউকেও তার ভিতরে ঢুকতে দিতে রাজি নয় ও। ঝগড়াঝাঁটি হলে অল্প কিছুক্ষণ ষাঁড়ের মতন গলা তুলে চিৎকার চেঁচামেচি করবে কিংশুক, তারপরই আবার একেবারে শামুকের মতন নিজের খোলসে ঢুকে যাবে। এই সব সময় অতসীর সাথে নেহাত প্রয়োজন না হলে কথাই বলবে না ও। অফিস থেকে ফিরবে দেরি করে। ফিরেই হয় টিভি চালিয়ে বসে যাবে সামনে, নয়তো কোন ইকনমিক্সের বই খুলে কাজের ভান করবে। দুজনের সংসারে এভাবে আর কতদিন চালানো যায়? সব ঝগড়াই শেষ হয় এক সময়, কিন্তু এই সব গোলমালে আসল কাজ চাপা পড়ে যায়। হয়তো কিংশুক চায় এসব চাপা দিতে, তাই ইচ্ছে করে অতসীকে স্রেফ অবহেলা করে করে জ্বালায়। নিজের প্রমোশন, ভবিষ্যৎ, বাড়ি, গাড়ি এসব নিয়ে যেন কোনোকিছুই আর ভাবতে চায় না কিংশুক। যে কোনো ঝামেলার মুখোমুখি হবার বদলে সেটাকে চেপে রাখাটাই ওর বেশি পছন্দ। তাতে ঝামেলা যে ঝামেলাই থেকে যায় সেটা বুঝবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই কিংশুকের। একটা ভালো পাকা চাকরি পেয়েছে, জীবন সার্থক হয়ে গেছে। যেমন খুশি খেতে পারছে, সিনেমা দেখতে পারছে, বই কিনতে পারছে। ব্যাস, আর কি চাই জীবনে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অতসী ভেবেছে, “আমার বাবার মতন আর কজন হয়?”
দিল্লিতে চাকরি করতে গিয়ে এই প্রথম আর এক জনকে দেখল অতসী যার হাবভাব বা স্বভাব অনেকটা ওর বাবার মতন। প্রখর ব্যক্তিত্ব স্মরজিৎ সেনগুপ্তর। প্রায় ছ’ফুট লম্বা, ছিপছিপে চেহারা, দৃঢ় চিবুক আর ভরাট গলা।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাবার আনন্দর তীব্রতা আর কতক্ষণ থাকে? পরের দিন থেকেই মাথার মধ্যে অজস্র চিন্তা ভিড় করছিল তাই, কোথায় থাকবে অতসী? একা কোনো মেয়েকে কে দেবে বাড়িভাড়া? একটা অচেনা শহরে এত তাড়াতাড়ি সবকিছু চিনে অফিস যাতায়ত করবে কিভাবে? রান্নাবান্নার কি হবে? কাজের লোক জুটবে কি কোনো?
স্মরজিৎ সেনগুপ্তর সাথে দ্বিতীয় মোলাকাত এই সব সমস্যা নিয়ে। ইন্টারভিউর সময়েই পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন যে এপয়েন্টমেন্ট লেটার আসার পর দরকার পড়লে আর একবার কথা বলবেন। সাধারণত চাকরিদাতারা এতটা উদার হন না, তাই অতসীর মনে হয়েছিল যে এই ব্যাপারে শিখার কিছু ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে।
অবশেষে সেই দ্বিতীয় মোলাকাতের সময় এল কিছুদিন পরে, বোম্বের তাজ হোটেলের লবিতে।
-- দ্যাখো, তুমি শিখার স্কুলের বন্ধু। শিখা খুব প্রিয় বোন আমার, তাই সেই অধিকারে তোমাকে তুমি করেই বলছি, ঠিক আছে তো?
-- না, সেটা ঠিক আছে, তবে …
সারা মুখে একটা ঝলমলে হাসি দিয়ে অতসীর মুখের কথা কেড়ে নিয়েছিলেন স্মরজিৎ সেনগুপ্ত, “ভয় আছে তো নতুন শহরে নতুন চাকরির জায়গায় মানিয়ে নিতে পারবে কিনা? এই ভয়টা খুব স্বাভাবিক। আমি বলি কি, আমি যা যা বলছি তুমি সেটা মিনিট পাঁচেক শোনো। তারপরে দরকার পড়লে আমার একটা ইন্টারভিউ নিও। আমি ইন্টারভিউতে পাস করলে তার পরে বরং আমরা ঐসব চিন্তাটিন্তা করবো, কেমন?”
এবারে হেসে ফেলেছিল অতসীও।
“দ্যাখো, আমার শিক্ষাজগতে ঢোকার উদ্দেশ্য লাভ করা নয়। আমেরিকাতে সম্পূর্ণ সৎপথে থেকে প্রচুর টাকাপয়সা রোজগার করবার অনেক উপায় রয়েছে। ফলে সেদিক থেকে আমার চিন্তা নেই। আমি চাইছি একটা সত্যিকারের ভালো কোচিং স্কুল, যা ছাঁচে ফেলা গরু তৈরির গোয়াল হবে না। আমি চাই এখানে যারা পড়বে, তারা সবাই যেন বিজ্ঞানটাকে ভালোবেসে পড়ে। তোমাদের কাজ তাই অন্য কোচিং ইনস্টিটিউটদের থেকে শক্ত। যারা পড়বে এখানে তাদের অধিকাংশের মধ্যে এই ভালোবাসাটা তোমাদের ঢোকাতে হবে। আমি নিয়মিত ছাত্রদের সাথে কথা বলে বুঝবার চেষ্টা করব শুধু এইটুকু তোমরা পারছো কিনা। ভালোবাসাটা থাকলে জীবনে এক সময় না এক সময় ভালো রেজাল্ট আসবেই, উল্টোটা কিন্তু সব সময় সত্যি নয়!”
এইটুকু বলে বোতল থেকে ঢকঢক করে অনেকখানি জল খেলেন স্মরজিৎ সেনগুপ্ত। তারপর আবার বলা শুরু করলেন,
“এবারে আসল কথায় আসি! আমেরিকানদের এত বছর খুব কাছ থেকে দেখে আমি শিখেছি যে কোনো ভালো কোম্পানি তৈরি করতে গেলে ভালো লোক দরকার সবার আগে। শুধুমাত্র ভালো লোক জোগাড় করবার জন্য ওরা দরকার পড়লে সারা পৃথিবী ঘুরতে পারে। এবারে আমার সমস্যাটা ভাবো। নিজের নিজের কাজে সবচেয়ে ভালো যারা, তারা সকলেই ছেলে হবে না আর তারা সকলেই দিল্লির বাসিন্দাও হবে না। একটা অন্য শহরে তাদের এনে, তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে গেলে আমাকে তো তাদের সমস্যার জায়গাগুলো ঠিকঠাক ধরতে হবে, তাই না? আমাকেও তো একটা সম্পূর্ণ অন্য দেশে, অন্য সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নিতে হয়েছে, লড়াই করে নিজের জায়গা আদায় করে নিতে হয়েছে! ফলে একটা ধারণা অন্তত রয়েছে, কি কি সমস্যা হতে পারে তোমাদের!
আমার মনে হয়, তোমার মূল সমস্যা থাকার জায়গা আর অফিসে যাতায়ত নিয়ে। এছাড়া, এমনকি একজনের সংসারেও কিছু সাধারণ জিনিষপত্তর প্রয়োজন হয়। তোমার চিন্তা এত তাড়াতাড়ি সেইসব জিনিস কোথা থেকে কিনবে, তাই না? সেজন্যই বলছি, আমাদের কোম্পানির গেস্ট হাউস রয়েছে। ছোট্ট ফার্নিশড ষ্টুডিও এপার্টমেন্ট একজনের থাকার মতন। ছোট একটা ফ্রিজ আর রান্নার জায়গাও রয়েছে তাতে। কোম্পানিতে কাজ করলে যতদিন খুশি থাকতে পারো সেখানে, তবে অবশ্যই মার্কেট রেটে ভাড়া গুনতে হবে থাকতে গেলে। আর যাতায়তের জন্য ওই কমপ্লেক্স থেকে একটা চার্টার্ড বাস আছে। আমাদের কোম্পানি যে কমপ্লেক্সে তার গেট অবধি পৌঁছে দেবে তোমায়। গেট থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটতে হবে তোমাকে। ওই বাসে যাতায়ত করলে তোমার একটা বড় সমস্যা মিটে যাবে। সব মিলিয়ে তুমি ধরে রাখো তোমার মাইনের চার ভাগের এক ভাগ এই সবের পিছনে যাবে।”
এত সোজা সবকিছু? আর অতসী কিনা সারারাত ধরে এইসব নিয়ে চিন্তা করেছে? কিংশুকের কাছে ঘ্যানঘ্যান করেছে দিল্লিতে গিয়ে দিন সাতেক থেকে ওকে সেটল করে দেওয়ার জন্য?
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে অতসীকে দেখছিলেন স্মরজিৎ সেনগুপ্ত। মনে মনে হাসল অতসী। ভদ্রলোকের নজর অতসীর চোখের দিকে, শরীরের অন্য অংশে নয়। লক্ষণ হিসেবে এটা ভালো, তবে পাকা খেলোয়াড়রা শিকারের নিয়মকানুন সব জানে। প্রথম আলাপে আজকাল কাউকেই ভদ্রলোক সার্টিফিকেট দিতে দ্বিধা হয়।
-- আর একটা কথা এই সুযোগে জানিয়ে রাখি, আমাদের কোম্পানিতে তুমি একা মেয়ে নও। দিল্লিতে আপাতত কুড়ি জনের অফিস আমাদের, মোট ছ’জন মেয়ে তাদের মধ্যে। এই কুড়িজনের মধ্যে বারোজন দিল্লিরই বাসিন্দা। আটজন বাইরের। এদের মধ্যে ছজন পাশের আর একটা গেস্ট হাউসে থাকে, এরা সকলেই অবশ্য ছেলে। প্রথমদিকে বাইরের শহরের মেয়েদের আমরা চাকরি অফার করতে পারি নি, কারণ মেয়েদের জন্য আমাদের সেই সেট আপটা ছিল না। এবারেই প্রথম আমাদের কোম্পানি বাইরের শহরের মেয়েদের চাকরির অফার দিচ্ছে। তুমি একা নও, তুমি ছাড়াও আরো দুজন মেয়ে রয়েছে। একজন মহারাষ্ট্রের আর অন্যজন তামিলনাড়ুর। দুজনেই ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী, কিন্তু ভালো সুযোগ পাচ্ছিল না এতদিন। দুজনেই আমাকে পাকা কথা দিয়েছে যে জয়েন করবে। তাই গেস্ট হাউসে যদি থাকো তাহলে এই দুজনের সাথেই তুমি থাকবে আর অফিসেও অনেকটা সময় এদের সাথেই কাজ করবে, যদি অবশ্য আসবার ডিসিশন নাও।
বলতে বলতে টেবিলের উপর সামান্য ঝুঁকে, স্মরজিৎ সেনগুপ্ত হাসলেন, “স্রেফ এইটুকুই। এবার আমার ইন্টারভিউ দেবার পালা। বলো, আর কি জানার আছে তোমার?”
এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতন স্মরজিৎ সেনগুপ্তর কথা শুনছিল অতসী। ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন! এত সহজ সবকিছু! আর এসব কিনা ওর ফাটা কপালে জুটছে! চোর-জোচ্চোরে ভরা ভারতীয় কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে ঠিক এরকম লোক রয়েছে ভাবতেই যেন কষ্ট হয়।
না। ছাড়ান দেবে না অতসী। চাকরি যদি না-ও জোটে, তাহলেও মনের মধ্যে প্রশ্ন যা যা খোঁচাচ্ছে, সেসব করতেই হবে ওকে।
-- আমার যা যা প্রশ্ন ছিল তার সবগুলোরই উত্তর দিয়ে দিয়েছেন আপনি। আমার আর যেটা জানার সেটা খুব ব্যক্তিগত একটা প্রশ্ন। ইচ্ছে হলে জবাব দেবেন, না হলে নয়। প্রশ্নটা কিন্তু করছি আপনি আমার বন্ধুর দাদা, সেই অধিকারে। আপনি আমেরিকাতে ওয়েল সেটেলড, আপনার টাকাপয়সার অভাব নেই, হঠাৎ এই ধরণের একটা কাজ -- কিছু মনে করবেন না -- প্রায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতন -- হঠাৎ করবার ইচ্ছে হল কেন? আর ভারতকেই বা বেছে নিলেন কেন?
প্রশ্নটা কি খুব অভদ্রের মতন, খুব আক্রমণাত্মক হয়ে গেল? সূক্ষ্ম একটা রহস্যময় হাসি দিলেন স্মরজিৎ সেনগুপ্ত।
-- দ্যাখো, নিজের প্রফেশনাল ফিল্ডে একবার এস্টাব্লিশড হয়ে গেলে আমেরিকার মতন দেশে টাকার অভাব হয় না। তার উপরে আবার ইনভেস্টমেন্ট আমার একটা প্যাশন, নেশা। লোকে ঘোড়ার উপর বাজি রেখে টাকা ওড়ায়। আর আমি মানুষের উপর বাজি রেখে টাকা ওড়াই না, বাড়াই। ভবিষ্যতে কি হবে জানি না, এখন পর্যন্ত অন্তত বাড়াতে পেরেছি। এবার দ্বিতীয় প্রশ্নোর জবাব, তুমি জানতে চাইছো শেষ পর্যন্ত ভারতকেই কেন আবার বেছে নিলাম, তাই তো?
বলতে বলতে চোখ দুটো কেমন স্বপ্নালু হয়ে গেল স্মরজিৎ সেনগুপ্তর, “ক্লাস ফাইভে লীলা মজুমদারের লেখা একটা গল্প পাঠ্য ছিল আমাদের। শেষ লাইনটা নিয়ে প্রশ্ন আসতো, ‘ব্যাখ্যা করো!’ বলে! লাইনটা হল, ‘বন থেকে জানোয়ার তুলে আনা যায়, কিন্তু জানোয়ারের মন থেকে বন মুছে ফেলা যায় না!’ আমি এই ভারতবর্ষ নামের জঙ্গলটার জানোয়ার, কি করে এই জঙ্গল আমার মন থেকে মুছে যাবে, বলো?”
কেউ জানে না, মায়ের ব্যাপারে শমীকের ভিতরে এখনো একটা অপরাধবোধ কাজ করে।
আসলে মা দিল্লি যাবার আগে থেকেই মায়ের উপর একটা অন্ধ রাগ দানা বাঁধছিল শরীরে। বর্ধমানের বাড়িতে মায়ের সেই ওকে অকারণে দোষ দেবার ব্যাপারটা শুনে ফেলার পর থেকেই ভিতরে ভিতরে অভিমানে পুড়ে খাক খাক হচ্ছিল শমীক। শমীকের সমস্ত ব্যাপারে বড্ড বেশি মাথা গলায় মা। কোথায় শমীক যাবে, কোথায় যাবে না, কি পরবে, কি খাবে, কখন খাবে, কার সাথে শমীক মিশছে না-মিশছে এর সব কিছু মায়ের জানা চাই আর এর সব ব্যাপারে নিজের মতটা চাপিয়ে দেওয়া চাই, যেন শমীকের নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে বলে কিছু থাকতে পারে না। আর আজ সেই মা বলছে যে শমীকের ইচ্ছের কাছে নিজের সব ইচ্ছে-অনিচ্ছে মা বিসর্জন দিচ্ছে?
এর আগে অনেকবার যখন মা ওর ইচ্ছের কোনো দাম রাখে নি, তখন চেঁচামেচি করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়েছে শমীক। মায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলতে শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলোয় নি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে?
মায়ের চাকরি পাওয়াটা মায়ের চাইতেও যেন ওর কাছে আশীর্বাদের মতন এসেছে। দিল্লি যাবে মা।
বাঁচা যাবে।
ভালো থাকবে শমীক।
সারাদিন ধরে পিছনে টিকটিক করার মতন কেউ থাকবে না।
বাবার সাথে মাকে দিল্লি ছেড়ে আসতে গিয়েছিল শমীক। ফিরবার পথেই অবশ্য বদলে গেল সব।
শমীকদের বোম্বে ফেরার সময় যত এগিয়ে আসছিল মায়ের মুখটা তত যেন ম্লান হয়ে আসছিল। কথা বলছিল আস্তে আস্তে, প্রায় ফিসফিস করে, যেন ভয় পাচ্ছে যে জোরে কথা বললে আশপাশের সব কিছু ভেঙে যাবে। শমীকেরও তাই ভাল লাগছিল না একটুও। ভিতরে ভিতরে কি কাঁদছে মা? একদম প্রথমে শমীকের মনে হচ্ছিল, কাঁদলে কাঁদুক গে। কিন্তু কতক্ষণ আর রাগ ধরে থাকা যায়।
ফেরার সময় তাই মায়ের মুখটা মনে পড়ছিল বারবার আর সেই সাথে বাড়ছিল অপরাধবোধ।
এসি থ্রি টায়ার কম্পার্টমেন্ট। জানলায় পর্দা, তাই বাইরেটা দেখা যাচ্ছে না। রাতের বেলা অবশ্য পর্দা সরিয়ে দিলেও ভালো দেখা যায় না বাইরেটা।
হু হু করে ট্রেন ছুটে চলেছে বোম্বের দিকে। কিন্তু শমীকের মন এখনো পড়ে রয়েছে দিল্লিতে। ঘরটা বেশ ছোট মায়ের। ওইটুকু ছোট একটা ঘরে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে যাবে না তো মা?
মা পাশে থাকবে না ভেবে প্রথমে কেন এত খুশি হলো শমীক? শমীক কি তাহলে আসলে স্বার্থপর – নিজের ভালো ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না? মা মরে গেলেও কি শমীকের একই রকম আনন্দ হবে? এই ধরনের চিন্তা কি আসলে মনে মনে মায়ের মৃত্যুকামনা?
ছোটবেলায় তো এমন ছিল না শমীক। মায়ের কোনো কষ্ট হলে কেন জানি না ওর নিজেরও সত্যিকারের দুঃখে বুকটা মুচড়ে উঠতো।
মা আর বাবার ঝগড়া বা চেঁচামেচি হলে বাবার উপরে ভয়ংকর একটা রাগ শরীরে বাসা নিত তখন।
একদৃষ্টে এখন জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে আছে বাবা, মনে হয় যেন অন্য জগতে।
ট্রেন ছেড়েছে প্রায় চার ঘন্টা। এর মধ্যে একবার শমীককে একটা চিপসের প্যাকেট বের করে দেওয়ার সময় ছাড়া আর কোন কথা বলে নি বাবা।
শমীক যে ঠিক পাশের সিটেই বসে রয়েছে সে খেয়ালই যেন নেই বাবার।
এই বাবার সাথেই এখন কাটাতে হবে দিনের চব্বিশ ঘন্টা।
হঠাৎ করে শমীকের তাই মনে হল ও একা, ভয়ংকর ভাবে একা।
আজ এই প্রথম স্কুলের দিন যেদিন মা কাছে নেই।
সকালবেলা শমীক স্কুলে যাবার সময় মা রোজ হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পাসের গেট পর্যন্ত আসত। শমীকের বাস না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করত মা। সেই সাথে চলত একটার পর একটা নির্দেশ। "জল খাবি কিন্তু মনে করে", "জুতোর ফিতেটা লুটোচ্ছে মাটিতে, বেঁধে নে!" "এ কি! বাড়ির খাতাটা স্কুলে নিয়ে যাচ্ছিস কেন?" ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষের দিকে শমীকের আর পছন্দ হচ্ছিল না ব্যাপারটা। মায়ের আঁচলে ঢাকা ছেলে মানেই বন্ধুদের খোরাক। কিন্তু মা-কে এসব কথা অনেকবার বললেও মা কানে তুলতো না। হেসে বলতো, “আরে আমি কি তোকে বাসে তুলে দিতে যাচ্ছি নাকি, এই সময়টাই আমার একটু হাঁটার সময়। বাড়ি থেকে বেরোই আসলে সেজন্যই।”
আজ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেও অভ্যাসবশে কলিং বেলটা টিপতে যাচ্ছিল শমীক। টিপতে গিয়ে মনে পড়ল যে মা এসে এখন থেকে আর দরজা খুলবে না। বাবাও অফিসে, সাড়ে সাতটার আগে বাড়ি ঢোকার সম্ভবনা কম। দিল্লিতে বাবাকে মা বলেছিল আজকের দিনটা ছুটি নিতে। শমীক প্রথম দিনটাই পুরো একা কাটাক সেটা চাইছিল না মা। কিন্তু শমীক-ই জোর করেছে একা থাকার জন্য। আর কেন জানি না, মা মেনেও নিয়েছে সেটা।
বাড়ির একটা চাবি বাবা ওর স্কুলব্যাগে গতকাল রাতেই রেখে দিয়েছে। ব্যাগের কোন খাপে চাবি রাখা আছে আর বাড়িতে ঢোকার পর কি কি করতে হবে ভালো করে ওকে সেসব বুঝিয়েও দিয়েছে।
চাবি বের করে ফ্ল্যাটের দরজার ইয়েল লকটা খুলে ভিতরে ঢোকে শমীক।
মা-বাবা কেউ নেই বাড়িতে। এখন থেকে চার ঘন্টা এই বাড়ির পুরো মালিক-ই-আজম শমীক। নিজের যা ইচ্ছে তাই করতে পারে এখন শমীক। একেই কি বড় হওয়া বলে?
স্কুলব্যাগটা সোফার উপর ছুঁড়ে দ্রুত পোশাক পাল্টে আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় শমীক। আসার সময়ই অভিজিৎ, বিনয় আর জিগনেশকে পাশের পার্কে ক্রিকেট খেলতে দেখেছে শমীক। ক্রিকেট খেলাটা যদিও শমীকের তত পছন্দের নয় তবু আজ এখনই খেলতে বেরিয়ে যাবে ও।
মা থাকলে এই সময়ে বেরোনোর উপায় ছিল না। রোদ গায়ে লাগানো নিয়ে অস্বাভাবিক টেনশন করত মা। ফলে বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে সেই সন্ধ্যা হয়ে যেত । আলো নিভে এলে তখন কি আর ক্রিকেট খেলা যায়? ওদিকে আবার এক ঘন্টার বেশি খেলার উপায় নেই। এক মিনিট দেরি হলেই বাড়ি ফিরে হাজার কৈফিয়ত।
চুটিয়ে ঘন্টা তিনেক ক্রিকেট খেলে প্রায় সাতটার সময় বাড়ি ফিরল শমীক। বোম্বে শহরে গরমের সময় সাতটাতেও বেশ আলো থাকে। ইচ্ছে হলেই তাই আরো কিছুক্ষণ খেলতে পারতো শমীক। কিন্তু এতক্ষণ একটানা খেলার অভ্যাস না থাকায় শেষের দিকে নিজেরই ক্লান্তি আসছিল বেশ। তবে ভিতরে ভিতরে আনন্দও হচ্ছিল এতক্ষণ একটানা খেলতে পেরে।
দেখা যাচ্ছে মা কাছাকাছি না থাকার মজাই আলাদা।
ফ্ল্যাটে ঢুকে ঘামে ভেজা জামা-প্যান্টটা সোফার উপরেই ফের ছুঁড়ে ফেলে দেয় শমীক, একটা তোয়ালে গায়ে চাপিয়ে ফ্যানটাকে ফুল স্পিডে চালিয়ে মেঝের উপরেই বসে পড়ে সোফায় হেলান দেয়, তবে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। এতটা সময় একটানা খেলার জন্য হঠাৎ করে খিদে পেয়েছে বেশ। বাড়িতে কাজের বাই সকালবেলা রুটি-তরকারি রান্না করে রেখে গেছে। তবে এখন সেসব খেতে ইচ্ছে করছে না একটুও।
এখন একটা ম্যাগি বানিয়ে খেলে কেমন হয়?
দিল্লির চাকরির অফার আসার পর থেকেই মা ওকে বেশ কিছু সাধারণ রান্না শেখানোর চেষ্টা করেছে। শমীক নিজেই খুব একটা আগ্রহ দেখায় নি তখন। আজ মনে হচ্ছে সেই সময় সব শিখে নিলেই ভালো হতো। তাহলে আজ ম্যাগির সাথে ডিমের গুজিয়া বানিয়ে নেওয়া যেত, মা যেমনভাবে ওকে বানিয়ে দেয়।
এখন এসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। ডিম নাহয় নাই জুটলো আজ, শুধু ম্যাগিই বা মন্দ কি?
গ্যাস জ্বালিয়ে সসপ্যানে জল ভরে গরম করতে দেয় শমীক।
বাইরে কলিং বেল বাজে, কেউ একটা এসেছে মনে হচ্ছে।
ইস্ত্রিওয়ালা ছেলেটা এসেছে জামাকাপড় নিয়ে। ইস্ত্রি করা জামাকাপড়গুলো নিয়ে ওকে নিজের দুটো প্যান্ট আর তিনটে শার্ট দিয়ে দেয় শমীক। বাবারটা দেওয়া হলো না। এটা অবশ্য খুব বড় সমস্যা নয়। ছেলেটা ওদের বিল্ডিং কমপ্লেক্সের সামনেই বসে। দরকার পড়লে বাবা অফিস থেকে ফিরে এসেও ওকে নিজের জামাকাপড় দিয়ে আসতে পারবে।
কিন্তু এটা কি হলো? ফ্ল্যাটের দরজায় বাবার নেমপ্লেট লেখার বাঁ পাশের স্ক্রু দুটো এত ঢিলে হয়ে গেল কি করে? স্ক্রু দুটোকে টাইট করে দিলে হয় না? শমীক জানে বাবা কোথায় স্ক্রু-ড্রাইভার রাখে।
স্ক্রু-ড্রাইভারটা এনে স্ক্রু দুটো ভালোভাবে টাইট করার জন্য দরজাটা বন্ধ করে শমীক।
দরজাটা বন্ধ হবার ঠিক পরেই ওর খেয়াল হয় বাড়ির চাবি ভিতরে।
ইয়েল লকের মজবুত দরজা ফ্ল্যাটের। একবার বন্ধ হয়ে গেলে খোলার আর কোনো উপায় নেই।
ভিতরে গ্যাসে গরম জল চড়ানো।
বাবার ফিরতে আরও অন্তত ঘন্টাখানেক বাকি।
খালিগায়ে তোয়ালে পরে সিঁড়ির উপর বসে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে শমীক।
যাক, খুব ভাগ্য ভালো যে পনের মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হয় নি। তবে এইবার বাবার কাছ থেকে যে গালাগালি শুনতে হবে সেটার কথা ভেবেই এতক্ষণ ভয় হচ্ছিল মারাত্মক।
কিন্তু শমীককে খুব অবাক করে কোনো রাগারাগি বা গালাগালির ধার দিয়েই গেল না বাবা। সব শুনে অল্প হেসে বললো, “ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে এই এক বড় সমস্যা। খুব ভাগ্য ভালো যে আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরোতে পেরেছি। নইলে বড় সমস্যা হতে পারতো, গ্যাস ফুরিয়ে যেত, এমনকি আগুনও লেগে যেতে পারতো বাড়িতে। যাক যে, এসব নিয়ে এখন আর ভেবে লাভ নেই, নিজেদেরই অনেক বেশি সাবধানে থাকতে হবে এখন। আমি আজকেই ভূপালের বাড়িতে ফ্ল্যাটের একটা চাবি দিয়ে আসছি, যাতে ভবিষ্যতে আর এরকম কোনো সমস্যা না হয়। যা, তুই চান করে নে আগে! সিঙ্গাড়া নিয়ে এসেছি তোর জন্য।”
শমীক পাশের ঘরের বাথরুমে ঢোকার আগে আবার ওকে ডাকল বাবা, “শোন, মা-কে এসব বলবার কোনো দরকার নেই।”
শেষ কথাটা আলাদা করে শমীককে বলবার কোনো দরকার ছিল না বাবার। শমীক ও মনে মনে ওই একই কথা ভাবছিল।
না, মা-কে এসব কথা বলার কোনো দরকার নেই।
আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যায় সব।
শমীকেরও অভ্যাস হয়ে গেল নতুন জীবন।
অ্যালার্ম ক্লক থাকলেও আগে শমীকের ঘুম ভাঙতো না সহজে। যত ঘুম তার সবটাই কি বেছে বেছে ভোরবেলা আসতে হবে? শমীককে তাই অন্তত দু তিনবার ডাকতে হতো ঘুম থেকে। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকতো বলে এই দায়িত্বটা ছিল কিংশুকের।
একবার ঘুম থেকে উঠে পড়লে অবশ্য আর কারুর খুব একটা সাহায্যের দরকার হতো না শমীকের। রাত্রেই স্কুলের ব্যাগ আর পোশাক গুছিয়ে রাখত শমীক নিজে। সকালে উঠে খালি চান করে স্কুলের পোশাকটা পরে নিতে হত।
তবে আগে ব্রেকফাস্টে বা টিফিনে নানারকমের খাবার জুটতো, সুজি উপমা, চিঁড়ের পোলাও, লেমন রাইস আর কখনো কখনো লুচি বা পরোটা।
এখন সকালে বেশির ভাগ দিনই দুধ-পাঁউরুটি আর কর্নফ্লেক্স। স্কুলের টিফিনেও তাই, খালি দুধটা বাদ।
একবার স্কুলের বাসে উঠলে অবশ্য কোথা দিয়ে সময় কেটে যায় বোঝা যায় না।
স্কুলের পরে, মায়ের জায়গায় এখন বন্ধুরা। আগে স্কুল থেকে ফিরে মায়ের শাসনে প্রায় ঘন্টা দুয়েক বাড়িতে কাটতো। এখন মা না থাকায় সেই সময়টা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে অথবা খেলে কাটে শমীকের, বাড়ির বাইরে বাইরে। বাবা অফিস থেকে আসে রাত আটটা নাগাদ। তারপর, কাজের লোকের রান্না করে রেখে যাওয়া খাবার খাওয়া, একটু আধটু পড়াশুনো আর শেষে সেই ঘুম।
মাঝখানে রাত নটা নাগাদ ফোন আসে মায়ের। মা যদিও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানতে চায়, তবু খুব বেশি কথা বলতে চায় না শমীক। মিছিমিছি মায়ের টেনশন বাড়াতে চায় না শমীক, তাতে মায়ের ঝামেলা আরও বাড়বে। এতদিনে শমীক এটাও বুঝে ফেলেছে যে মায়ের ঝামেলা বাড়লে ওর নিজের ঝামেলাও বাড়বে বই কমবে না। তাই অনেক হিসেবে করে কথা বলতে হয় এখন। কথা বলতে গেলেও যদি এত মাথা খাটাতে হয়, তার চেয়ে কথা বেশি না বলাই ভালো।
– তুই সব কথা আমায় বলছিস তো? লুকোচ্ছিস না তো কিছু?
– না, না, লুকোবো কেন?
– স্কুলে সব ঠিক আছে?
– হ্যাঁ, ঠিক আছে সব।
– আর বাড়িতে? বাড়িতে ঠিক আছে সব?
– বাড়িতেই বা বেঠিক থাকবে কেন কিছু? শোনো, বেশি ভেবো না। সব ঠিক আছে এখানে।
আরও একটা দুটো কথার পর ফোন ছেড়ে দেয় শমীক।
কি করে মা-কে বোঝাবে শমীক যে অনেক কিছু কথা এখন মায়ের না জানাই ভালো!
প্রজাপতি, মথ বা অন্য কোনো বড় পোকা একদম সহ্য করতে পারে না শমীক। সেই ছোটবেলার থেকে মাথার মধ্যে কেন জানি না একটা মারাত্মক ভয় কাজ করে এই শ্ৰীমানদের কাউকে কাছাকাছি দেখলে।
ছোটবেলায় কল্পনার চোখে ভাবতো শমীক যে ওর নিজের চাইতেও বড় সাইজের একটা প্রজাপতি হাসতে হাসতে ওর দুটো শুঁড় শমীকের গলায় পাকিয়ে ধরে চাপ দিচ্ছে আর ফড়ফড় করে ডানা দুটো নাড়াচ্ছে। ভাবলেই ভয়ে কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠতো ওর।
কেমন করে জানি না আজ একটা বড় প্রজাপতি ঢুকেছে বসার ঘরে। জানলাটা মনে হয় খোলা ছিল সকালে। এখন জানলার উপরে ছাতের কোনায় বসে আছে প্রজাপতিটা।
ছোটবেলার মতোই এখন আবার গা গোলাচ্ছে শমীকের। আগে শমীক এরকম ভয় পেলে মা যেভাবেই হোক প্রজাপতিটাকে বের করে দিত ঘরের থেকে।
এখন এই প্রজাপতিটাকে নিয়েই থাকতে হবে ওকে।
অন্য ঘরে যাওয়া যাক বরং।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে আবার গুলিয়ে ওঠে পেটটা। কেমন যেন একটা বমি বমি ভাব শরীরে।
এটা কি স্রেফ প্রজাপতিটার ভয়ে, নাকি অন্যকিছু?
রোহিতদের সাথে স্কুলে পানিপুরি খেয়েছিল শমীক টিফিনে। খাবার একটু পর থেকেই বেশ গা গোলাচ্ছিল।
গা গোলানোটা বেশ বেড়ে গেছে এখন। বমি পাচ্ছে। পেটের মধ্যে হাঁচোড় পাঁচোড় শুরু হয়ে গেছে এই অল্প সময়ের মধ্যেই। একটু জ্বর জ্বরও লাগছে। না, এটা স্রেফ ভয়ের জন্য নয়, মনে হচ্ছে পেটে ইনফেকশন হয়েছে কোনো।
বাথরুমে গিয়ে বমি করে এল শমীক। চেষ্টা করা সত্ত্বেও পুরো বমিটা কমোডে পরে নি। মেঝেতেও ঠিকরেছে একটু। কমোডের পাইপ দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়েছে সেটা, বাবা যাতে কিছু না বুঝতে পারে। তবে বমি করার পর একটু ভালো লাগছে আবার। কপাল ভালো থাকলে আর বেশি কিছু হবে না।
বাবার আজ দেরি হবে ফিরতে। অন্তত আটটা অবধি থাকতে হবে অফিসে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। কোনো জরুরি মিটিং থাকলে মোবাইলও হয়তো বন্ধ থাকবে।
আবার গা গোলানি শুরু হয়েছে। বমি পাচ্ছে আবার।
এক্ষুনি ওষুধ দরকার কিছু। তাড়াতাড়ি রোগ সারিয়ে ফেলতে হবে ওকে, বাবা আসার আগে। তারপর যেভাবেই হোক ভাগাতে হবে প্রজাপতিটাকে।
যতদূর মনে পড়ছে পেটের গন্ডগোলে ওটু বলে একটা ওষুধ খেতে হয়। মাস ছয়েক আগেই মা দিয়েছিল ডাক্তারের সাথে কথা বলে।
শমীক জানে যে শোবার ঘরের দেয়াল আলমারির মাঝের তাকে রাখা থাকে দুটো ওষুধের বাক্স।
ভাগ্য ভালো বলতে হবে। ওটুর একটা পুরো নতুন পাতা রয়েছে বাক্সের একদম উপরে। একবারে দুটো ওটু একসাথে খেয়ে নেয় শমীক।
তারপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে পরে বিছানায়।
চোখ বন্ধ করলে প্রজাপতিটাকে দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু ভয়টা কমে না।
গায়ের গোলানিও কমছে তো না-ই, বরং বেড়ে যাচ্ছে আরও। তবে কি ভুল ওষুধ খেয়ে ফেললো শমীক?
সর্বনাশ, দু দুখানা ওষুধ একসাথে খেয়ে ফেলেছে, কোনো ক্ষতি হবে না তো শরীরের? কেন এমন বোকার মতন কাজ করল শমীক? পাশের বিল্ডিঙের আদিত্যর মা আদিত্যকে সেদিন খুব বকেছে আদিত্য নিজে নিজে একটা অ্যান্টাসিড খেয়েছিল বলে।
কে জানে হয়তো প্রজাপতিটাই এই সব ভুলভাল কাজ করাচ্ছে শমীককে দিয়ে। হয়তো ওটা প্রজাপতি নয়, ভিনগ্রহী কোনো জীব? ওর উদ্দেশ্য শমীকের ব্রেনটাকে কন্ট্রোল করবার।
নাঃ, কি যত সব উল্টোপাল্টা ভাবছে শমীক পাগলের মতন!
আদিত্যর মা পূজা আন্টি ডাক্তার।
পূজা আন্টিকে এখন একবার ফোন করলে কেমন হয়?
ভাগ্য ভালো বলতে হবে। রিং হচ্ছে, প্রথম চেষ্টাতেই পূজা আন্টিকে পেয়ে গেল শমীক।
– উল্টি আ রাহা হ্যায়? বেটা এক ওন্ডেম চার এম জি পি লো। হ্যায় ঘর মে? পাপাকো ফোন দো একবার! কেয়া, পাপা ভি নেহি হ্যায় ঘরমে? হাঁ, ক্যায়সে আয়েগা আজ, আজ তো কাম বহুত হ্যায় অফিসমে! রুখো, ম্যায় আ রাহা হুঁ!
ঠিক পাঁচ মিনিট পরে ফ্ল্যাটে হাজির হয় পূজা আন্টি। সাথে ওন্ডেম ট্যাবলেট আর ইলেক্ট্রালের একটা প্যাকেট। শমীককে ওন্ডেম তো খাওয়ায়ই, মিনিট দশেক পরে এক গ্লাস ইলেক্ট্রাল জলে গুলে খাইয়ে দেয়। শমীক একসাথে দু-দুখানা ওটু খেয়ে ফেলেছে শুনে শমীককে মৃদু তিরস্কার করে। বলে, একটা ওটু খেলে ব্যাপারটা একদম ঠিক ছিল, কাউকে কিছু না জানিয়ে শমীক যেন কোনো ওষুধ আর না খায়। পূজা আন্টি রামপ্রকাশ আঙ্কল, মানে আদিত্যর বাবাকে দিয়ে খবর পাঠাবে ওর বাবাকে তাড়াতাড়ি চলে আসার জন্য।
পূজা আন্টিকে যেতে হবে এখন। রান্না চড়ানো রয়েছে, গ্যাস বন্ধ করে এসেছেন। বলেন, পরে আবার আসবেন, কোনো অসুবিধে হলে শমীক যেন ফোন করে।
ওন্ডেম খাবার পর থেকেই শরীরটা অনেক ভালো লাগছে। বমি বমি ভাবটা চলে গেছে শরীর থেকে, অস্বস্তি একটা আছে পেটে এখনো, তবে কম।
প্রজাপতিটা অবশ্য একই ভাবে বসে রয়েছে এখনো ছাদের কোনাতে। তবে কেন জানি না, এখন আর অতটা ভয়ংকর লাগছে না ওটাকে।
একটা ফুলঝাড়ু নিয়ে আসে শমীক। জানলা পুরো খুলে দিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে চেষ্টা করে প্রজাপতিটাকে বের করে দিতে।
অল্প চেষ্টার পর জানলা দিয়ে বেরিয়ে যায় প্রজাপতিটা।
একটা মস্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শমীক। অমঙ্গলের দূত বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। শমীক জানে যে ও এবার দ্রুত ভালো হয়ে উঠবে। স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
পূজা আন্টি বলেছে পুরো একটা দিন অন্তত লাগবে ভালো হতে। এই একটা দিন খুব হালকা কিছু খেয়ে থাকতে হবে আর ওষুধ খেয়ে যেতে হবে নিয়মিত তিন দিন ধরে। শমীকের কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একটা পুরো দিনও ওর লাগবে না পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে।
মুশকিল হলো বাবা সব জেনে যাবে রামপ্রকাশ আংকেলের থেকে। বাবাকে তাই বলতেই হবে সব।
কিন্তু কি হবে মা-কে এসব কথা বলে? বলতে হলে বাবা বলুক গে, শমীক নিজে থেকে তুলবে না এসব কথা।
এই একটা-দুটো দিন কি শমীক একটু অভিনয় করতে পারবে না মায়ের কাছে, একদম ঠিক রয়েছে বলে?