ইংরেজি সিনেমা দেখতে একদম ভালো লাগত না অতসীর। গাঁক গাঁক করে সাহেব-মেমেরা কি যে বলে বোঝা যায় না ছাই। কিংশুক অবশ্য ওই সব সিনেমা বলতে পাগল ছিল বরাবর। বিয়ের পর প্রথম দিকে কিংশুক জোর করে ওকে ওরকম বেশ কিছু মুভি গিলিয়েছিল। সেই সময় বহুবার কিংশুকের মুখে অতসী শুনেছে, “না, না, তিসি, চলো, দেখবে চলো, এটা অসম্ভব রকমের ভালো একটা মুভি! কত নামকরা জানো!” গিয়ে অবশ্য সেই বোর হয়েছে অতসী। কয়েকবার এরকম হবার পর,একটু বিরক্ত হয়ে তাই মাঝেমাঝে ঠাট্টা করত কিংশুক, “বেনহুর দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে, পৃথিবীতে এরকম স্যাম্পল একটি মাত্র এখনো অবধি তৈরি হয়েছে!”
ছবিতে ইংরেজিতে সাবটাইটেল থাকলে অবশ্য একটু ভালো। তাই হলিউডের ছবির বদলে ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান বা রাশিয়ান ছবি হলে অতসী কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচতো। কিংশুকের সাথে এরকম একটা রাশিয়ান ছবি দেখেছিল অতসী। নাম ভুলে গেলেও গল্পটা মনে আছে। যুদ্ধে বীরত্ব দেখিয়ে অল্প কয়েকদিনের জন্য সেনাপতির কাছ থেকে ছুটি আদায় করে মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে ছেলে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নানা ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে পৌঁছতে দেরি হচ্ছে বাড়িতে। শেষ পর্যন্ত মায়ের সাথে দেখা হল তার, কিন্তু থাকতে পারল মাত্র কয়েক মিনিট।
প্রথম ছুটির পর দিল্লি ফিরতে ফিরতে কেন জানি না গল্পটা বারবার মনে পড়ছিল অতসীর আর চোখে জল আসছিল।
কত মিল গল্পটার সাথে অতসীর, আবার কত অমিল!
ছেলের বদলে মা আসছে দেখা করতে, অল্প কয়েকদিনের ছুটি ম্যানেজ করে। অথচ গল্পটাতে মা যেরকম ছুটতে ছুটতে হাঁপাতে হাঁপাতে ছেলের সাথে দেখা করতে এসেছিল ক্ষেতের কাজ ফেলে সেইরকমভাবে অতসীর জন্য কে ছুটে এল? কেউ না! অতসী যাবার আগেও ছেলের চোখেমুখে ধৈর্যের অভাব। খেলতে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে ছেলের, মাকে বলতেও পারছে না কিছু অথচ চোখমুখের ভাব দেখে দিব্যি বোঝা যাচ্ছে যে মা বেরোলে ও বাঁচে।
অথচ আবার মিলের মধ্যে দেখো, এই কয়েকদিনের ছুটিকেও আজ ফিরবার সময় মনে হচ্ছে কয়েকটা মাত্র মিনিট।
চোখের জলটা বোধ হয় গাল গড়িয়ে পড়ছিল ট্রেন ছাড়ার পরে। উল্টোদিকে এক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বসে। বৃদ্ধাই প্রথম খেয়াল করে বৃদ্ধকে ফিসফিস করে বললেন কিছু। তারপর খুব নরম গলায় অতসীকে বললেন, “রো মত, বিটিয়া!”
কি যে ছিল এই কথাগুলোর মধ্যে থেমে গেল কান্না।
ব্যাপারটা ঠিক ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জা নয়, হয়তো অতসীর ভিতরটা শুধু একটা কাঁধ চাইছিল মাথা রাখবার জন্য। সম্পূর্ণ অযাচিতভাবে এই কাঁধ বাড়িয়ে দিলেন ওই অপরিচিত মাড়োয়ারি দম্পতি।
বোম্বেতে ছেলের কাছে গিয়েছিলেন ওনারাও। প্রথম নাতি হয়েছে তাঁদের। তিন মাস ছেলের বাড়িতে নাতি মহারাজের সেবাযত্ন করে এখন আবার জয়পুর ফিরে যাচ্ছেন ওঁরা। এবারে বধূমাতার মা-বাবা আসবেন আর দু দিন পরে।
অতসীর কেন জানি না মনে হল নিজের বধূমাতার থেকে খুব একটা যত্ন বা সম্মান পান নি ওনারা।
ট্রেনে যাওয়ার অলিখিত নিয়ম হল অপরিচিতর থেকে সাবধানে থাকা। কাউকে বিশ্বাস করা যায় না আজকাল। এতদিন পর্যন্ত অতসী সেই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে।
অতসীর সিক্সথ সেন্স কিন্তু এবার বলছিল যে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা যায় এই বৃদ্ধ দম্পতিকে। শুধু বিশ্বাসই নয়, অনেক কিছু বলা যায় যা আর কাউকে কখনো বলা হয়ে ওঠে নি। হয়তো এনাদের সাথে আর কখনো দেখা হবে না বলেই এসব কথা বলা যায়। কে জানে, হয়তো কয়েকটা মুহূর্তের জন্য খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল অতসী। গল্প করতে করতে এক সময় ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ওর অনেক হতাশা আর যন্ত্রণার কাহিনী।
ওর সমস্যাগুলোর কথা শুনে একটু গম্ভীর হয়েছিলেন দুজনেই।
বৃদ্ধ কিন্তু তাড়াতাড়ি সামলে নিয়েছিলেন নিজেকে, একটু হেসে ওকে বলেছিলেন, “মুম্বাইমে জব ঢুঁঢকে লো, বিটিয়া! থোড়াসা এক্সপেরিয়েন্স তো হো গয়া, অব কোশিস জারি রাখখো, মুম্বাই বড়া শহর হ্যায়, এক দো মাহিনামে উঁহা জব মিল জায়েগা!”
কথাটা শুনে একটু মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল অতসীর। মা-বাবার বয়সী সম্পূর্ণ অপরিচিত এক বৃদ্ধ দম্পতি ওকে বারবার ভরসা জোগাচ্ছেন, একবারও চাকরি ছাড়তে বলছেন না দুজনের কেউ, অথচ ওর নিজের মা-বাবা?
কিছুতেই যেন শমীককে রেখে অতসীর দিল্লি গিয়ে থাকাটা মেনে নিতে পারছেন না ওঁরা। এই নিয়ে মা-বাবার সাথে রীতিমতন ঝগড়া হয়ে গেছে অতসীর।
“একটা চাকরি কি তোর এতটাই জরুরি?”
“কিংশুক তো এত রোজগার করছে, তোর অভাবটা কিসের?”
"শমীকের শরীর খারাপ হলে কি করবি টা কি তখন? একা কিংশুক সামলাবে কি করে সব?"
“আর দু বছর পরে শমীকের বোর্ডের পরীক্ষা, আর এখন তুই ওকে এভাবে আল্লার নামে ছেড়ে দিচ্ছিস?”
“ভালো করে খুঁজলে বোম্বেতেই চাকরি পেয়ে যাবি!”
এক এক সময়ে এক এক যুক্তি মা-বাবার।
প্রথমদিকে অতসী ওদের ঠান্ডা মাথায় বোঝানোর চেষ্টা করেছে, শেষ পর্যন্ত রেগে চেঁচিয়ে বলেছে, “তোমাদের যত দরদ শুধু কিংশুক আর ওর ছেলের জন্য, নিজের মেয়েটার জন্য নয়!”
– কি বলছিস পাগলের মতন? কিংশুকের ছেলে কি তোরও ছেলে নয়?
– আমি কি সেটা অস্বীকার করেছি? ছেলে যখন আমার তখন আমাকেই ব্যাপারটা সামলাতে দাও!
অতসীকে ওঁরা সামলাতে দিতে রাজি নন, কারণ অতসীর উপর সেই ভরসা বা বিশ্বাসই নেই কোনো।
এখন এইসব ব্যাপার নিয়ে ওদের দুজনের কেউ কোনো কথা তুললেই অতসী রেগে ফোন নামিয়ে দেয়।
দাদাটাও সেই রকম।
এতসব ব্যাপার যে ঘটে যাচ্ছে ওর জীবনে তাতে দাদার যেন কোনো ভূমিকাই নেই। অতসীর জন্য মা বাবার সাথে ঝগড়া করতে বয়েই গেছে দাদার। সারাদিন চাকরি, দলাদলি, রাজনীতি, মাঝে মাঝে শখের সিনেমা, থিয়েটার, আকণ্ঠ পান, আর বাড়ি এসে প্রতিদিন মা-বাবার হোটেলে খাওয়া আর ঘুম।
ঈর্ষা হয় মাঝে মাঝে!
কি সুন্দর, সহজ, সরল জীবন দাদার!
আসলে পুরুষ জাতটাই এমন। স্বার্থপরের বাসা। মেয়েদের চুষে ছিবড়ে করবার জন্যই ওদের জন্ম।
নানান ধরনের গল্প আর কথাবার্তার মধ্যে বৃদ্ধাই প্রথম সতর্ক করে দিয়েছিলেন অতসীকে। উপরের সাইডের বার্থে একজন মধ্যবয়স্ক লোক যাচ্ছে। ফর্সা গোলগাল মুখ, চোখের কোলে নিয়মিত মদ খাওয়ার ভাঁজ। লম্বা জুলফি আর নাকের সামনে বিশাল মোটা গোঁফ লোকটার। নজর ভালো নয় ওর।
নিজের ভাবনাচিন্তা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল বলেই লক্ষ্য করে নি অতসী। ট্রেনে ওঠার পর থেকেই লোকটা নাকি অতসীকে মেপে যাচ্ছে সমানে।
অনেক হিসেবে করে ফেরার ট্রেনের টিকিট কাটা!
দুপুরবেলা বোম্বে সেন্ট্রাল থেকে ছাড়বে ট্রেন, যাতে সক্কালবেলা দিল্লি পৌঁছনো যায়। কিন্তু অতসীর ভাগ্যে সেই রাশিয়ান গল্পের মতনই যত ঝামেলা, তবে তফাৎ এই যে সব ঝামেলা বোধ হয় লুকোনো ছিল শুধু ফিরবার সময়।
রাত্রে উপরের বার্থে শুয়ে পাশের বার্থের লোকটার কথা ভেবে ঘুম আসছিল না অতসীর। বৃদ্ধা সতর্ক করে দেওয়ার পর নিজেও সাবধানে লক্ষ্য করেছে লোকটাকে অতসী। একদম ঠিক কথা বলেছেন বৃদ্ধা। কোনো সন্দেহ নেই, লোকটা খারাপ।
শুয়ে শুয়ে অতসীর মনে হচ্ছিল একজোড়া চোখ আধো অন্ধকারেই ওকে যেন মেপে চলেছে। এরকম হলে কেন জানি না অল্পবয়সের সেই জঙ্গলে ঘোরার স্বপ্নটার কথা অতসীর মনে পড়বেই আর অস্বস্তিতে ঘুম আসবে না।
কিছুক্ষণ বাদে অবশ্য একটা ঘড়ঘড়ে নাক ডাকার আওয়াজ এল সাইড বার্থ থেকে। নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ বুঁজল অতসী। ঘুম প্রায় এসে গেছে, এমন সময় হঠাৎ ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল ট্রেন।
রাতের ট্রেন কোনো স্টেশনে থামলে ঘুম ভেঙে যায় অতসীর। স্টেশন এসেছে ভেবে প্রথমে ব্যাপারটাকে খুব একটা পাত্তা দেয় নি ও। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার এবার আর কোনো নাম নেই। চিন্তিত হয়ে যখন কি করা যায় ভাবছে অতসী, তখন পাশের পার্টিশন থেকে “অ্যাক্সিডেন্ট” শব্দটা কানে এল অতসীর।
মালগাড়ি উল্টেছে একটা সামনে।
কখন ট্রেন ছাড়বে কোনো ঠিক নেই।
সকাল আটটায় পৌঁছনোর কথা দিল্লিতে।
ট্রেন দিল্লি পৌঁছল রাত বারোটার সময়।
মাত্র ষোল ঘন্টা লেট।
কিন্তু এই ষোল ঘন্টার দেরি অতসীর সমস্ত পূর্ব পরিকল্পনাকে নষ্ট তো করে দিলোই, উপরি হিসেবে বয়ে নিয়ে এল বড় কোনো বিপদের সম্ভবনাকে।
বৃদ্ধ দম্পতি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় নেমে গেছেন জয়পুরে। ওদের জায়গাতে আর কেউ ওঠে নি জয়পুর থেকে। উল্টোদিকের তিনটে বার্থ-ই এখন খালি। আর ওনারা নেমে যাবার পর থেকে এই পার্টিশনে আর কেউ নেই বলে যেন আরো অভদ্র, ইতর হয়ে উঠছে উপরের বার্থের লোকটা। অতসীর সাথে এখনো অবধি একটাও কথা বলার চেষ্টা করে নি লোকটা, কিন্তু এখন একদৃষ্টে চেয়ে আছে অতসীর শরীরের দিকে।
প্রথমে টের পায় নি অতসী, লোকটার পরিচিত আরো একজন আছে এই কম্পার্টমেন্টে। এখন দিল্লি এগিয়ে আসার সময় ওদের পার্টিশনে এসে বসে আছে সেই অন্য লোকটাও। গাঁট্টাগোঁট্টা, কদমছাঁট চুল, মাথার সামনে টাক আর করমচার মতন লাল চোখ। উপরের বার্থের লোকটার মতন এরও নজর ভালো নয়।
বলা বাহুল্য কন্ডাক্টর বেপাত্তা।
একটাই ভরসা যে পাশের পার্টিশনে একটা ফ্যামিলি যাচ্ছে। ছোট দুটো বাচ্চা রয়েছে তাদের, গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
লোকদুটো বেশি বাড়াবাড়ি করলে মনে হচ্ছে ওখানেই গিয়ে বসতে হবে।
ভাগ্য ভালো বলতে হবে
লোকদুটো কিছু বলার বা করার আগেই হঠাৎ দেখা গেল কন্ডাক্টরকে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অতসী।
দিল্লি আসতে নাকি আর মাত্র আধ ঘন্টা বাকি।
অতসীর সিট কামরার এক প্রান্তে, দরজার কাছে। মালপত্তর নিয়ে লোকের লাইন চালু হয়ে যাবে আর একটু পরেই।
একা একা মাঝরাতে দিল্লিতে নেমে কি করবে ভাবছিল অতসী।
লোক দুটোও অতসীর মতনই নেমেছে সময়মতন, কিন্তু এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে। যাবার কোনো লক্ষণ নেই। অতসীর সমস্ত সিক্সথ সেন্স আবার বিপদের গন্ধ পাচ্ছে।
ট্যাক্সি নেবার কোনো প্রশ্নই নেই, তবে অটো-রিক্সা হয়তো নেওয়া যেতে পারে। ড্রাইভার বদমায়েসি করলে বাইরে লাফ দেওয়াটা অন্তত অনেক সোজা হবে অটো-রিক্সার বেলা।
অটো-রিক্সা নিলেও গেস্ট হাউস পৌঁছতে অন্তত আধ ঘন্টা, কিন্তু একা মাঝরাতে এই ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। ফাঁকা রাস্তায় লোক দুটো যদি ফলো করে, অটো-ড্রাইভার লোক ভালো হলেও বিপদ হতে পারে। অজানা অন্য কোনো বিপদ যে নেই তাই বা কে বলতে পারে?
ওয়েটিং রুমে ভিড় থাকলে সেটা হয়তো নিরাপদ, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর কি অবস্থা দেখবে কে জানে?
সামনে দীর্ঘ রাত, অন্তত পাঁচ-ছ’ঘণ্টা কাটাতে হবে আরও, আর সেটা এমন জায়গায় যেখানে আরও অন্তত এক দুজন মহিলা আছে।
কোন মহিলা পুলিশকেও দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে।
– দিদি!
বিপুল উল্লাসের সাথে অতসী লক্ষ্য করল মীনা ওকে ডাকছে। মীনার পাশে অঙ্কিত কুমার, ওদের অফিসের সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর।
অতসী আসছে না দেখে খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল মীনা আর মেঘা। স্টেশনের টেলিফোন নম্বরে বার বার কল করেও কোনো সাড়া পায় নি ওরা। মেঘার বাবার এক বন্ধু দিল্লিতে রেলের বড় অফিসার। তাঁকে ফোন করে মেঘা জানতে পারে ট্রেন লেট হবার কথা।
সাথে সাথে ওরা সিদ্ধান্তে আসে অতসীকে এত রাত্রে একা ছাড়া যাবে না কোনোমতেই।
অঙ্কিত আর কপিলের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে সবাই মিলে স্টেশন চলে আসে ওরা, অতসীকে পিক আপ করে গেস্ট হাউসে নিয়ে যাবার জন্য। অঙ্কিতের মোটরসাইকেল এখন রাখা আছে গেস্ট হাউসে। অতসীদের গেস্ট হাউসে ছেড়ে ও কপিলকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দেবে মোটর সাইকেলে বসিয়ে। তারপর নিজের বাড়ি ফিরবে।
ওদের সাথে নিশ্চিন্তে ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে এই প্রথম অতসীর মনে হল যে এমন সব বন্ধু কাজের জায়গায় থাকলে সেই জায়গা নিজের পরিবারের মতনই হয়ে যায়।
দিন কেটে যাচ্ছিল একই ভাবে।
কোচিং ইনস্টিটিউটের কাজে ভালো-খারাপ দুটো দিক-ই রয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে বেশ ভালো লাগে অতসীর, তবে খাতা দেখতে একেবারেই নয়। অথচ পড়ানোর চাকরিতে এই কাজটির হাত থেকে রেহাই নেই। এছাড়াও এই চাকরির আর একটি খারাপ দিক হল কিছু কিছু মা-বাবার ব্যবহার। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এনারা সাধারণ চাকর-বাকরের বেশি অন্য কিছু যেন ভাবতে পারেন না। এনাদের শিক্ষার গুণে কিছু কিছু ছেলেমেয়েও বেশ অভদ্র, ছোটবেলার থেকে বেশি আদর পেয়ে বাঁদর তৈরি হলে যা হয়! অতসীর সাথে অবশ্য খুব বেশি ঝামেলা হয় নি ওদের, একটু বেশি বয়স্ক আর গম্ভীর বলে অতসীকে খুব বেশি ঘাঁটায় নি কেউই। তবে যথেষ্ট জ্বালিয়েছে মীনা আর মেঘাকে।
ওদের সাথে চার্টার্ড বাসে গেস্ট হাউসে ফিরতে ফিরতে এই সব নিয়েই কথা হত অতসীর। অফিস থেকে গেস্ট হাউসে ফিরবার পর আর খুব একটা কিছু করার থাকে না। রান্নাবান্নার দায় নেই। আগে থাকতে বলে রাখলে এই গেস্ট হাউসে রাতে রুটি ডাল সবজি ধরনের সাধারণ খাবার পাওয়া যায়। দামটা বাজারের তুলনায় একটু বেশিই পরে। গেস্ট হাউসে মাছ বা মাংস রান্না হয় না। তবে পয়সা দিলে ওরা অন্য জায়গা থেকে খাবার আনিয়ে দেয়। নিজেদের ঘরে তাই চা আর হালকা স্ন্যাক্স জাতীয় খাবার ছাড়া কিছু রাখে না ওরা।
গেস্ট হাউসের রুমগুলোতে একটা করে টিভি রয়েছে, তবে একা একা টিভি দেখতে একেবারেই ভালো লাগে না অতসীর। ছোটবেলায় বাড়িতে টিভি চলত কম, কিন্তু যতক্ষণ চলত অতসী টিভি দেখত মা’র কোল ঘেঁষে, গায়ে লেপ্টে থেকে। বিয়ের পর সারাদিন হাতে সময় থাকলেও একা একা টিভি দেখতে ভালো লাগত না একটুও, জোর করে তাই কিংশুককে সন্ধ্যাবেলা ওর সাথে অন্তত একটা সিরিয়াল দেখতে বাধ্য করত ও। আরও পরে, শমীক একটু বড় হলে অবশ্য আর কিংশুককে ওর দরকার হয় নি। সারাদিনে অতসী টিভি দেখত অল্পই, কিন্তু টিভি দেখার সময় আগাগোড়া ওর গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকত শমীক।
এখানে টিভি দেখতে বসলেই অতসীর তাই মনে পড়ে ছোট্ট শমীকের ওর গায়ে লেপ্টে থেকে টিভি দেখার আর ক্রমাগত বকবক করে যাওয়ার কথা।
টিভি দেখতে ভালো লাগে না, তবে রোজ নিয়ম করে প্রচুর ফোন করে অতসী। গেস্ট হাউসে ফিরে চান করে এক কাপ চা খাবার পর অন্তত ঘন্টাখানেক সময় অতসী ব্যয় করে এই টেলিফোনে। যা যুগ পড়েছে তাতে কিংশুকের মতন গোটানো জরদ্গব হলে চলে না আজকাল। সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়, তাতে সুবিধে এই যে খবর পাওয়া যায় অনেকরকম।
তবে শুধু ফোন করেই বা কত সময় কাটানো যায়?
খাতা দেখার চাপ বেশি না থাকলে রাতে তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বার চেষ্টা করে অতসী। আর শুয়ে শুয়ে চেষ্টা করে ভালো কিছু ভাবার।
প্রমোশন পেয়েছে অতসী।
ওকে কংগ্রাচুলেট করছে সবাই।
শমীকের মুখে হাসি। একটু দূরে অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে কিংশুক।
না, না, রাতে শুয়ে শুয়ে একদম শমীক আর কিংশুকের ভাবনা নয়।
নিজের মনটাকে অন্য দিকে সরাতে হবে। ওদের কথা ভাবলেই অকারণে মন খারাপ হবে আবার। বাজে চিন্তা আসবে ভিড় করে। আর এই সব বাজে চিন্তা হল গুন্ডার মতন। খেতে পেলে শুতে চাইবে তারা, মুহূর্তে দখল নেবে সারা মনের। মনের সুচাগ্র জমিরও তাই দখল দেওয়া যাবে না এদের।
এই তো এতক্ষণ প্রমোশন পেয়ে দিব্যি আকাশে উড়ছিল অতসী। আকাশেই উড়তে হবে ফের।
কল্পনায় একটা প্লেন চালানো শুরু করে অতসী। কিন্তু বেশিক্ষণ চালাতে পারে না।
প্লেন বা জাহাজ বড় বেশি দূরের জিনিস। চড়তে ভালো লাগলেও, কিভাবে এদের চালাতে হয় তার কোনো ধারণাই নেই অতসীর। অতসী ডাঙার প্রাণী, জল বা আকাশের নয়।
আবার নতুন করে গাড়ি চালানো শিখলে কেমন হয়? বোম্বেতে একবার কিংশুকের সাথে গাড়ি চালানো শিখতে গিয়েছিল অতসী। অনেক লড়াই আর ঝগড়ার পর রাজি হয়েছিল কিংশুক, দুজনে মিলে ট্রেনিং স্কুলের সাথে যোগাযোগ করে একসাথে গাড়ি চালানো শিখতে। আসলে, যে কোনো ব্যাপারে নিজের বাঁধা রুটিনের বাইরে যেতেই তীব্র আপত্তি কিংশুকের।
অনেকদিন হয়ে গেল সেই গাড়ি শেখার। বোম্বেতে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট খুব ভালো বলে গাড়ির সত্যিই খুব একটা প্রয়োজন ছিল না ওদের।
মনে তো হয় সেই গাড়ি চালানো এখনও ভোলে নি অতসী। নিজে নিজে প্রথম দিনের সেই গাড়ি চালানোর উল্লাস কি ভোলা যায় কখনো? কিংশুকের চেয়ে তো তখন মন্দ গাড়ি চালাতো না অতসী? তাহলে এখনই বা আবার পারবে না কেন? হয়তো আর একটু ট্রেনিং বা গাইডেন্স দরকার পড়বে ওর, তবে পারবে।
না, কালকেই ওদের অফিসের ড্রাইভার সতীশকে বলবে অতসী একটা ট্রেনিং স্কুলের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে। সতীশকে একটা মোটামুটি ভালো সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়িরও খোঁজ করতে বলতে হবে।
নিজের গাড়ি থাকলে চার্টার্ড বাসের সাথে অ্যাডজাস্ট করে ফেরার দরকার পড়বে না আর ওর। আজকাল কাজের চাপ বাড়ছে অফিসে। সব কাজ বাড়িতে এসে করা সম্ভব নয়। নিজের গাড়ি থাকলে যখন খুশি ফেরা যাবে, খুব সুবিধা হবে মীনা আর মেঘারও।
জেগে জেগেই আবার স্বপ্ন দেখা শুরু করে অতসী।
একটা বড় সেডান গাড়ি চালিয়ে লং ড্রাইভে যাচ্ছে অতসী।
একটা চওড়া রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলেছে একশ কিলোমিটার স্পিডে।
দিল্লি থেকে বোম্বে যাচ্ছে অতসী, গাড়ি চালিয়ে।
কাজের স্বপ্ন বলতে হবে।
জয়পুর আসার আগেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে অতসীর।
ভালো রেজাল্ট করতে না পারলে তুমি কেউ নও।
ক্লাস টেনের পরীক্ষার পর বেশ কিছু ঘটনা শমীককে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল যে ও এখন আর কেউ নয়।
ক্লাস এইট পর্যন্ত ক্লাসের প্রথম পাঁচ-ছ’জনের মধ্যে থাকত শমীক। নাইন বা টেনে স্কুলের পরীক্ষাগুলোতে অবস্থা একটু খারাপ হলেও বোর্ডের পরীক্ষা যে এতটা খারাপ হবে সেটা ও ভাবতেও পারে নি। বায়োলজি স্যার অমল চিত্রে প্রায়ই অপমান করতেন ওকে স্কুলে, পড়া না পারার জন্য, কিন্তু বায়োলজি পড়তে কোনোদিনই সেরকম ভালো লাগতো না বলে সেই সব অপমান গায়ে মাখে নি শমীক। অন্য সাবজেক্টগুলোতে তো আর এই হাল নয়। অঙ্কে বিশেষ করে খুবই ভালো শমীক। তাই কিছুতেই যেন বিশ্বাস হয় না – বোর্ডের পরীক্ষাতে এইটি পার্সেন্টের কম মার্কস, ভাবা যায়?
ওদের স্কুল থেকে প্রচুর বাচ্চা প্রতি বছর নব্বই শতাংশের বেশি নম্বর পায় বোর্ডের পরীক্ষায়। স্কুলের গড় নম্বর থাকে আশি শতাংশের একটু উপরে। নম্বরের হিসেবে শমীক তার মানে ওদের স্কুলের একজন খুব সাধারণ ছাত্রেরও নিচে এখন। কেন এমন হলো?
শমীকের যেটা সবচেয়ে ব্যথার জায়গা সেটা হলো ওর মার্কস ছবির চাইতেও প্রায় দু’ পার্সেন্ট কম।
ওদের বিল্ডিংয়েই থাকে ছবি, টপ ফ্লোরে। গত তিন বছর ধরে ছবি শুধু শমীকের সাথে এক ক্লাসেই নয়, একই সেকশনে পড়ে আসছে। স্কুলে ওদের সেকশনে অরবিন্দ, রাজেশ আর শমীকের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো প্রথম তিনজনে থাকা নিয়ে, ছবি ধারে কাছে থাকত না। অরবিন্দই সাধারণত প্রথম হতো। অরবিন্দর বাবা আর্মিতে চাকরি করতেন বলে ওরা থাকত অন্য জায়গায়। রাজেশও থাকতো গোরেগাঁওয়ে। স্কুলের বাইরে ফোনে ছাড়া কথা হতো না ওদের সাথে। পড়াশুনো সংক্রান্ত ব্যাপারে কিছু বুঝে নিতে হলে ছবি তাই বরাবর শমীকের কাছে আসত।
দুজনেই এক ক্লাসে আর এক সেকশনে, থাকে এক জায়গায়, ওদের বাবারা এক জায়গায় কাজ করে – তাই পড়াশুনো নিয়ে দুজনের, বিশেষ করে ছবির মায়ের, একটা সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল শমীক আর ওর মায়ের সাথে। একে অপরকে অনেক সময় সাহায্য করলেও, এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার হাত থেকে ওরা কেউই বেরিয়ে আসতে পারে নি। পরীক্ষায় কোনো নম্বর বেরোলে অতসীও তাই "ছবি কত পেয়েছে?" সেটা শমীকের কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করে নিতে ভুলতো না।
অন্য সাবজেক্টে ভালো হলেও অংকে বেশ কাঁচা ছিল ছবি। অংকের ব্যাপারে প্রায়ই তাই শমীকের সাহায্যের দরকার পড়ত ওর। ওদিকে আবার শমীকের সাথে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব পরীক্ষার খাতা ওর মেলানো চাই। শমীককে কোনো কারণে ওর চেয়ে এক নম্বর বেশি দেওয়া হলে প্রায়ই টিচারদের কাছে চলে যেত ছবি দরবার করতে। আর ছবি এসব ব্যাপারে ব্যর্থ হলে ওর মা বসুন্ধরা আণ্টি নামতেন ফিল্ডে। একবার, ছবির মার্কস বাড়ল না, কিন্তু ছবি শমীকের তুলনা দেওয়ায় শমীকের মার্কস গেল কমে। সেবার বেশ চটে গিয়েছিল শমীক। বেশ কিছুদিন খাতা দেখানো বন্ধ রেখেছিল ছবিকে। কিন্তু ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যান করলে কতক্ষণ আর না বলা যায়? সেজন্য শেষের দিকে কিছুটা ঘেন্নাভরে ওকে নিজের পরীক্ষার খাতা দেখতে দিত শমীক।
রেজাল্ট বেরোনোর পর প্রথমে শমীকের বিশ্বাসই হয় নি যে ছবির মার্কস ওর উপরে। ছবির আর ছবির মায়ের মুখের যে তৃপ্তির ছাপ ও সেসময় দেখেছিল, তাতে এটা বুঝতে ওর দেরি হয় নি যে আসলে এতদিন ওরা ঈর্ষা করতো ওকে। নিজের উপরই খুব রাগ হচ্ছিল শমীকের – বোকা, একদম বোকা ও! এতদিন এদের দেখেও কেন এদের চিনতে পারলো না ও? অতসী দিল্লি চলে যাওয়ার পর থেকেই তো ওদের হাবভাব খুব একটা গোপন থাকে নি। ছবির মা বসুন্ধরা আন্টি সারাদিন বাড়িতে থাকেন বলেই হয়তো অতসীর দিল্লিতে একা চাকরি করতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা হিংসেতে মেনে নিতে পারে নি। সেই সময় বসুন্ধরা আন্টি একবার শমীকের কাছে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন এত সহজে অতসী শমীককে ছেড়ে চলে যাওয়ায়। এখন নাকি উনি যাকে পাচ্ছেন বলে বেড়াচ্ছেন যে মা না দেখলে ছেলের তো এই হাল হবেই!
হয়তো মায়ের প্রভাব – ক্লাস ইলেভেনে উঠে ছবিরও তাই এখন বিরাট পরিবর্তন। শমীককে ও একদম খরচের খাতায় লিখে ফেলেছে। ও নিজে যেহেতু শমীকের চেয়ে ভালো নম্বর পেয়েছে তাই আজকাল নিজেকে বিরাট এক বিদুষী ভাবছে ও। শমীককে তাই আর পাত্তা দেবার কোনো প্রয়োজন নেই ওর।
সেদিন ক্লাসে অদিতি বুঝতে পারছিল না, কেন e বলে সংখ্যাটা দুই আর তিনের মধ্যে থাকবে। শমীকের ব্যাপারটা বুঝতে কষ্ট হয় নি। টিফিনের সময় অদিতিকে এটা বোঝাতে যাচ্ছিল শমীক। অদিতির পাশেই ছিল ছবি। শমীক মুখ খুলতেই ছবি মুখের একটা বিচিত্র ভঙ্গি করে ওকে বলে, "আবে! তু চুপ হো যা গান্ডু!" তারপর শমীকের সামনেই অদিতিকে নিয়ে ছবি অরবিন্দর কাছে ব্যাপারটা বুঝে নিতে যায়।
অপমানে মুখচোখ লাল হয়ে যায় শমীকের। একটু আধটু গালাগালি ক্লাসের অনেককেই ছবি দিয়ে আসছে অনেকদিন ধরে, হয়তো ও মনে করে এটাই স্মার্টনেস, তাই বলে গান্ডু!
আজকাল কথায় কথায় এই কদর্য শব্দটা বলে গালি দেয় ছবি।
অন্য কাউকে নয়, স্রেফ শমীককে।
শমীক লক্ষ্য করে দেখেছে ও অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে গেলেই এমন হয়।
ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েরা হাসে ছবির গালাগালি শুনে, যেমন আজ অদিতিও হেসেছে।
শমীক বোকা নয়। শমীক বোঝে যে শমীকের থেকে হয়তো অন্য কিছু আশা করেছিল ছবি। না পেয়ে অপমানিত হওয়ার জন্যই এই পাল্টা অপমান। কিন্তু শমীক এটাও বোঝে যে আহত বাঘিনীর প্রতিশোধ ভয়ানক কিছু নিয়ে আসতে পারে শমীকের জীবনে।
আজ না হয় বাকি সবাই হাসছে। একজন দুজন করে সবাই যদি এসব বিশ্বাস করা শুরু করে তাহলে কিভাবে তাদের সব বোঝাবে শমীক?
কাকে বলবে এসব কথা?
বিকেলবেলা সেদিন খেলতে যেতেও ইচ্ছে করছিল না শমীকের।
মন লাগছিল না পড়াশুনোতে বা গল্পের বইয়ে।
বাড়িতে বসে বসে কম্পিউটারে ঘন্টাখানেক গেমস খেললো শমীক। ম্যাগি বানিয়ে খেল একটা।
কোনোকিছু করতে ইচ্ছে না হলে সময় আর কাটে না। সবে সাড়ে সাতটা বাজে।
বাইরে আকাশ মেঘে থমথমে। কোনো তারা দেখা যাচ্ছে না। অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকে, থামার কোনো লক্ষণ নেই।
বাবার আসতে আরো অনেক দেরি।
আজ আবার বাবা একটু কাজে আটকে গেছিল। এখন অবশ্য বেরিয়ে পড়েছে অফিস থেকে, তবে সাড়ে আটটার আগে বাড়ি ঢুকতে পারবে না। বৃষ্টিতে আটকে গেলে দেরি হতে পারে আরও।
এর আগে স্কুলের কোনো ব্যাপারে বাবার সঙ্গে প্রথমে কোনো কথা হতো না শমীকের। আগে মা কে সব কথা খুলে বলত শমীক। মা বাবাকে সেসব জানালে তবেই না বাবার সাথে কথা।
কি হবে এখন, মাকে এসব কথা বলে?
ধুর, ভালো লাগছে না কিছুl
রাত সাড়ে নটার সময় ফোন আসে অতসীর।
– কি রে, সব ঠিক আছে তো?
– হ্যাঁ, ঠিক আছে।
– গলাটা ওরকম শোনাচ্ছে কেন তোর? কিছু হয়েছে?
– কি আবার হবে? ঠিক আছে সব।
– কী হলো তোর? বাবার সাথে ঝামেলা হয়েছে কোনো?
এবার বিরক্ত হয় শমীক।
– অকারণে বাবাকে টানছ কেন? বলছি তো ঠিকই আছে সব।
– তুই বাবাকে ফোন দে।
– বাড়িতে না থাকলে ফোন দেব কি করে?
– সে কি? সাড়ে নটা বাজে, বাড়ি ঢোকে নি এখনও? দাঁড়া, আমি ফোন করছি বাবাকে।
অতসী ফোন ছেড়ে দিতে না দিতেই কলিং বেলের আওয়াজ হয় দরজায়।
ঘরে ঢোকে কিংশুক। জবজবে ভিজে পোশাক। ছাতাটাকে ঘরের এক প্রান্তে রেখে শমীকের দিকে একটু অপরাধী অপরাধী মুখ করে বলে, "বৃষ্টিতে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম বান্দ্রা স্টেশনে। কমার কোনো লক্ষণ নেই দেখে বৃষ্টি মাথায় করেই বেরিয়ে পড়লাম।"
বান্দ্রা কুরলা কমপ্লেক্সের এই দিকটা সমুদ্রের কাছে বলে অনেক সময়ই বৃষ্টি আদর করে ডেকে আনে ঝোড়ো বাতাসকে। ছাতায় কোনো কাজ হয় না এখানকার বৃষ্টিতে। নিচু জায়গা বলে জলও জমে যায় অল্প বৃষ্টি হলেই। কোনো অটোরিক্সা এদিকটাতে আসতে চায় না বেশি বৃষ্টি হলে।
ভেজা পোশাকগুলোকে সাবান জলে চুবোয় কিংশুক। একটু দূরেই মিঠি নদী ওরফে মিঠি নর্দমা। এই নদীর পবিত্র জল প্যান্ট ভিজিয়ে দিয়েছে, পরিষ্কার না করে উপায় নেই।
ভালো করে স্নান সেরে বাড়ির পোশাক পরার আগেই ফোন বাজা শুরু হয় আবার। মা ফোন করছে দিল্লি থেকে, বাবাকে।
এখন আবার রাগারাগি, চেঁচামেচি হবে একচোট।
খিদে পেয়েছে বেশ, কিন্তু খেতে বসতে দেরি হবে আজ।
আগে ঝগড়াটা শেষ হোক, তারপর খাওয়া।
তাড়াতাড়ি শোবার ঘরে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি আটকে দেয় শমীক।
বাবা আর মায়ের মধ্যে ঠিক কি কথা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না ঠিক।
কিছুক্ষণ পরে বাবার দিক থেকে কোনো চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ না পেয়ে নিঃশব্দে দরজা খোলে শমীক।
পনেরো মিনিট হয়ে গেল, এখনও কথা চলছে মা আর বাবার। ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক।
চাপা গলায় কথা বলছে বাবা। মনে হচ্ছে লুকোতে চাইছে কিছু। এর একটাই মানে হয়, কথা হচ্ছে শমীককে নিয়েই।
মাকে বাবা বলছে, "না, না, ছেড়ে দেওয়া যাবে না ব্যাপারটা। আমি দেখছি কি করা যায়!"
কি ছেড়ে দেওয়া যাবে না? শমীককে নিয়ে কিছু?
জবাবে মা কি বলল বোঝা গেল না ঠিক।
এদিক থেকে বাবা আবার বলল, “কথা বলে তো দেখি আগে, তুমি চিন্তা করো না এটা নিয়ে।”
কার সাথে কথা? শমীক ছাড়া আর কেই বা রয়েছে কথা বলার? শমীক কি এখন এত বাজে হয়ে গেছে যে ও সকলের এত চিন্তার কারণ?
ভালো লাগছে না।
একটুও ভালো লাগছে না।
অনেকদিন পরে সেদিন রাতে আবার একটা স্বপ্ন দেখল শমীক।
নির্জন এক সমুদ্রের পারে একা দাঁড়িয়ে আছে ও। আশেপাশে কেউ কোত্থাও নেই, শুধু খোলা আকাশ আর সমুদ্র। সূর্য অস্ত যাচ্ছে সেই সমুদ্রে। আকাশ আর জল, দুই-ই লালে লাল।
সমুদ্রের অন্য পারের অচেনা রহস্যময় দেশ থেকে ডাঙার দিকে অনেক উপর দিয়ে উড়ে আসছে একটা পাখি। বোধহয় নতুন কোনো দেশে পাড়ি দিচ্ছে সেই পাখি, সাগর ডিঙিয়ে।
শমীককে দেখে একটু নিচে নেমে এল পাখি, উপর থেকে উড়তে উড়তে বাঁশির মত সুন্দর রিনরিনে মেয়েলি গলায় জিজ্ঞাসা করল, "দাদাকে দেখেছ? মা ডাকছে!"
অবাক হয়ে শমীক দেখল ওটা পাখি নয়, রুবি। পিঠে একজোড়া ডানা আঁটা রুবির, ঠিক পরীদের মতন। বিকেলের সূর্যের লাল আলোয় সেই দুই ডানা রুবির সারা শরীর সমেত আগুনের মতন জ্বলছে।
নিচে নেমে বালির উপর দাঁড়ালো রুবি, শমীকের দিকে মুখ করে। সূর্য এখন রুবির শরীরের ঠিক পিছনে। রুবির চারপাশে তাই একটা গনগনে লাল আভা।
আরো অবাক হয়ে এবার দেখল শমীক যে শরীরে কোনো পোশাক নেই রুবির, কিন্তু রুবির যেন সেই ব্যাপারে কোনো খেয়ালই নেই। হাসিমুখে একদৃষ্টে শমীকের দিকে চেয়ে আছে রুবি। দু চোখে স্পষ্ট নিমন্ত্রণ।
প্রবল এক দমফাটা উত্তেজনায় হাত বাড়িয়ে রুবিকে ধরতে গেল শমীক, কিন্তু শমীক ওকে স্পর্শ করার আগেই শমীকের পিছন থেকে কেউ একটা ব্যাঙের মতন কদর্য কটকটে গলায় বলে উঠলো, "আবে গান্ডু! আওরত নেহি, মর্দকে পাস যা তু!"
শুনে খিলখিল করে হেসে আবার আকাশে উঠে পড়ল রুবি।
"চলি, দিল্লি যাবো এখন, মায়ের কাছে!"
দেখতে দেখতে অনেক দূরে আকাশের উত্তর পূর্ব কোন বরাবর উড়তে উড়তে আবার দূরে মিলিয়ে গেল রুবি।
ঘুম ভেঙে যাবার পর উঠে জানলার ধারে এসে দাঁড়াল শমীক। অন্ধকারে বহুক্ষণ বাইরের খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন চেষ্টা করলে এখনও এক ঝলক দেখা যাবে রুবিকে। যেন অত দূর থেকেও শমীকের সব কথা শুনতে পাবে রুবি, বিশ্বাস করবে সত্যি বলে।
যাক, ফিরে যাক রুবি ওর মায়ের কাছে।
শমীক এখন কিছুতেই মায়ের কাছে যাবে না।
পরের দিন সকাল থেকে সারা আকাশ আবার মেঘে থমথমে।
স্কুলবাসে উঠতে না উঠতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। বাবা বলেছিল ইচ্ছে হলে স্কুলে না যেতে আজ, কিন্তু একা একা ফাঁকা বাড়িতে থেকে কি করবে শমীক সারাদিন?
বাবাই বরং অফিস না গেলে পারতো আজ। কাল রাত থেকে জ্বর হয়েছে বাবার। কিন্তু কোয়ার্টারলি রিভিউয়ের কাজ শেষ করে ফেলতে হবে বলে এখন ছুটি নেবার কোনো উপায় নেই বাবার।
জঘন্য পচা আবহাওয়ার মতোই জঘন্য পচা দিন গেল একটা স্কুলে।
যাবার সময় স্কুলবাসে অকারণে ঝগড়া হল নীলেশের সাথে। নিজের ভিজে রেনকোটটা সিটের উপরে রেখেছিল শমীক। না দেখে সেটার উপর বসে পড়েছে নীলেশ, প্যান্টের পিছনটা পুরো ভিজে গেছে ওর। ওর রাগ, কেন শমীক রেনকোটটাকে সিটের উপর রেখেছে। অন্যদিন হলে হেসে সরি বলে সব মিটিয়ে নিত শমীক। আজ মেজাজ খারাপ বলে কিছুতেই মানতে চাইল না যে ওর কোনো দোষ রয়েছে এ ব্যাপারে। চোখ তো নীলেশেরও আছে এক জোড়া। ও দেখতে পেল না কেন?
ফিজিক্স ক্লাসে আজ আবার পড়া পারল না শমীক। এক সময় ফিজিক্স স্যার অতুল ভোগলের খুব প্রিয় ছাত্র ছিল শমীক। কাউকে কখনো গলা তুলে কথা বলেন না অতুল স্যার, আজও গলা তুললেন না। শুধু শমীকের দিকে তাকিয়ে বললেন যে এত সহজ প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারলে পরীক্ষায় ভালো করার ব্যাপারটা ভুলে যেতে হবে পুরোপুরি।
কেমিস্ট্রি ক্লাসে হোমটাস্কের খাতাটা ব্যাগের মধ্যে খুঁজে পেল না শমীক। কাল রাতে মন খারাপ থাকায় ব্যাগ গোছাতে ইচ্ছে করছিল না। আজ সকালে আবার ঘুম ভেঙেছে দেরি করে। তাড়াহুড়োয় খাতাটা মনে হয় ভরা হয় নি ব্যাগে। এবারে বেশ এক প্রস্থ গালাগালি জুটলো কেমিস্ট্রির প্রেরণা ম্যামের। প্রেরণা ম্যামও গত পাঁচ বছর ধরে পড়িয়ে আসছেন শমীকদের। বক্তব্য ওনারও সেই এক: ছোটবেলার সেই মিষ্টি, ভালো ছেলেটা যত বড় হচ্ছে তত ফাঁকিবাজ, অকর্মণ্য বাঁদর হচ্ছে ক্রমশ।
গালাগালি হজম করার সময় মাথা নিচু করে ছিল শমীক। কিন্তু তার মধ্যেও ও পরিষ্কার দেখতে পেল ছবিকে। দ্বিতীয় সারির এক প্রান্তে অরবিন্দর পাশে বসে ছবি। ওর দিকে চোখ ঘুরিয়ে ছবি কিছু একটা বললো অরবিন্দকে। তারপর দুজনেই হাসি চাপার জন্য মুখ ঢাকল হাত দিয়ে।
ফেরার সময় স্কুলবাসের একদম সামনের সিটে জানলার ধারে বসলো শমীক। ইলেভেন আর টুয়েলভের বাচ্চাদের জন্য বাসের পিছনের সিটগুলো বাঁধা। ওরা নিজেরাই এই ব্যবস্থা করে নিয়েছে নিজেদের জন্য। আজকাল কিন্তু ওখানে বসতে ইচ্ছে করে না ওর। ওখানে এখন মক্ষিরানি হয়ে ছবি বসে। ইদানিং হাওয়ায় উড়ছে ও। প্রচুর নাকি প্রপোজাল পাচ্ছে ছবি আজকাল বিভিন্ন ছেলের কাছ থেকে। এই নিয়ে গর্বের শেষ নেই ওর। তবু শমীক যে ওকে কখনো প্রপোজ করে নি সেই অপমান যেন ভুলতে পারছে না ছবি, আর ভুলতে দিচ্ছে না শমীককেও।
বাড়ি এসে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে টেবিলে দুহাতে মাথা গুঁজে ছিল শমীক।
– কি রে, কি হয়েছে তোর?
এ কি? কখন এলো বাবা? এতটাই আনমনা হয়ে গিয়েছিল শমীক যে টেরই পেল না?
– কি আবার হবে? কিছু হয় নি!
"কিচ্ছু না?", শমীককে একেবারে অবাক করে বাবা দুষ্টু হাসি হাসলো একটু, "আসলে আমার নিজেরই এত কিছু ঘটে গেল সব। গায়ে জ্বর, অফিসে পুরো অকারণে ঝাড় খেলাম বসের, ট্রেন লেট, বৃষ্টিতে চুপ্পুস ভিজলাম আসতে আসতে – আর এদিকে তুই বলছিস, সব ঠিক আছে! হিংসে হচ্ছে তো তোর উপর!"
একটু অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকায় শমীক। ঠিক কি বলতে চাইছে বাবা?
"এখন তো অনেকেই অনেক কথা বলবে। হয়তো তোর আড়ালে বলবে, তবে সব তো আর তোর আড়ালে হবে না। সব তাই ঠিক থাকবে, এটাই অস্বাভাবিক।"
এবার রেগে গেল শমীক, "হেঁয়ালি না করে ঠিক কি বলতে চাইছ বল তো?"
"আমার মনে হচ্ছে কেউ তোকে কিছু বলেছে, হয় সামনে নয়তো আড়ালে, আর তুই সেটা ভুলতে পারছিস না।"
শমীক ফের রেগে উঠে কিছু বলার আগেই বাবা আবার বলে ওঠে, "না, না, আমি জানতে চাইছি না জোর করে। তোর ইচ্ছে হলে বলবি, নয়তো নয়। তবে কত লোক তো আমাকে নিয়েও কত কিছু বলে। আমার যত সব বোকামি নিয়ে, আমাকে অফিসে মুরগি করা নিয়ে, আর এখন তিসির দিল্লি চলে যাওয়া নিয়ে। ওসব নিয়ে যদি বেশি ভাবি তাহলে যারা এসব বলছে তাদের বেশি সম্মান দেওয়া হয়, ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয় তাদের হাতে। তাই যতটা পারি, চেষ্টা করি তাদের হাতে কোনো ক্ষমতা তুলে না দিতে।"
বিরক্ত হয় শমীক, লেকচার দেবার স্বভাবটা বড়দের কিছুতেই যাবে না।
–"অত কি সোজা নাকি ব্যাপারটা? তোমার কি ধারণা, আমি চেষ্টা করি না? তুমি জানো কি কি বলে আমায় লোকে?"
একটু গম্ভীর হয় বাবা, "না, জানি না। আন্দাজ করতে পারি, তবে আন্দাজ তো সব সময় সত্যি হয় না। ঠিক আছে, তুই-ই বল তাহলে।"
চুপ করে থাকে শমীক।
"যদি বলতে না পারিস", বাবা বলে, "তার মানে তোকে আঘাত দিতে সফল হয়েছে ওরা। যারা আঘাত দিয়েছে তারা হয়তো দিব্যি হেসে খেলে নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছে এখন। আর তুই মন খারাপ করে দু হাতে মাথা চেপে ধরে দেওয়ালের দিকে ঘণ্টার পর ঘন্টা চেয়ে আছিস। জানতে পারলে খুব খুশি হবে ওরা। এবারে তুই নিজেই ঠিক কর, তুই ওদের আরো খুশি হতে দিবি কি দিবি না!"
এবারে একটু অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকায় শমীক।
"শোন, কারুর দেওয়া কোনো কথার আঘাত তুই কতটা নিবি বা না নিবি, সেটা ঠিক করার ক্ষমতা পুরোপুরি তোর হাতে। আমার নিজের যদি এই ক্ষমতাটা থাকতো, খুব ভালো হতো তাহলে। হয়তো তোকে আর মাকেও অনেক বেশি ভালো রাখতে পারতাম। তাই ভাবলাম, তোকে একবার শিখিয়ে দিতে পারলে যদি আমার চেয়ে ভালোভাবে এটা করতে পারিস, হয়তো মাকে আর আমাকে আরো অনেক ভালো রাখবি তুই!"
চুপ করে কথাগুলো শোনে শমীক। এক সাথে এত কথা এর আগে বাবা বলে নি ওকে এর আগে। কেমন যেন একটা গভীর বিষণ্ণতার ছাপ বাবার চোখেমুখে। কি হয়েছে বাবার?
অফিসের ব্যাগটা বের করে আবার সেটাকে খোলে কিংশুক।
"অনেক দিন ধরে এই বই দুটো খুঁজছিলাম তোর জন্য। কি ভাগ্য দেখ, এমন একটা জঘন্য বৃষ্টিওলা দিনেও সব কিছু খারাপ হয় না! আসতে আসতে চার্চগেট স্টেশনের পাশের ফুটপাথে একটা পুরনো বইয়ের কারবারির কাছে পেয়ে গেলাম এই বইদুটো। পলিথিনে মুড়ে রেখেছিল, বৃষ্টির জন্য। সেসব খুলিয়ে, নর্মাল দামের প্রায় ডাবল দাম দিয়ে কিনলাম বই দুটো।"
ইয়া পেরেলম্যানের দুটো বই: Figures for Fun আর Algebra Can be Fun।
উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে চলে কিংশুক, "আমার ছোটবেলায় এত ভালো লেগেছিল এই বই দুটো। আমার মনে আছে, ক্লাস নাইনে পড়ার সময় জন্মদিনে জ্যেঠু উপহার দিয়েছিল আমায়। কলকাতায় হোস্টেলে থাকার সময় নিয়ে গিয়েছিলাম বইদুটো। তারপর যা হয়, কেউ একটা পড়তে নেবার নাম করে নিয়ে আর ফেরত দেয় নি।"
ব্যাগটা দরজার পিছনের হুকে ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে কিংশুক বলে, "আজ যারা তোকে খারাপ রেজাল্ট নিয়ে খোঁটা দিচ্ছে, কাল রেজাল্ট ভালো হলে তারাই দেখবি উল্টো সুর গাইছে। এই ছবিই তখন দেখবি আবার তোর পায়ে ধরবে অংক কষে দেবার জন্য!"
এবার সত্যি সত্যিই অবাক হয়ে গেল শমীক। বাবা জানলো কি করে? শমীক তো এই নিয়ে কাউকে কিছু বলে নি?
হাতের ঘড়িটা খুলে সেন্টার টেবিলে রেখে দেয়াল আলমারির থেকে ওষুধের বাক্সটা বের করে কিংশুক।
নাক টানছে কিংশুক। সর্দি লেগেছে বৃষ্টিতে ভিজে। চোখ দুটো করমচার মতন লাল।
"আবার জ্বর আসছে আমার। ক্রোসিন খেয়ে নিলাম একটা এখন। খাওয়ার পরেই শুয়ে পড়ব আজ তাড়াতাড়ি। তুই পরে শুলে আলোটালো সব নিভিয়ে দিস।"
অনেকক্ষণ ধরে বই দুটো পড়লো শমীক।
সত্যিই খুব ভালো বইদুটো। পড়তে পড়তে পুরো অন্য এক জগতে চলে গিয়েছিল শমীক। এই জগৎ অংকের জগৎ। এখানে ছবির মতন কোনো ফ্রাস্ট্রু খাওয়া বাজে মেয়ে নেই।
ঘড়ির দিকে তাকাল শমীক। রাত তিনটে বাজে। অন্যদিন এর অনেক আগে শুয়ে পড়ে শমীক। আজ কোথা দিয়ে সময় কেটে গেছে টেরই পায় নি।
পাশের ঘরের থেকে মৃদু নাক ডাকার আওয়াজ আসছে একটা। নিঃশব্দে দরজার পাশে দাঁড়ালো শমীক। বাবার ঘরের আলো নিভে গেছে অনেক আগে। এখন গভীর ঘুমে বাবা। শমীকের ঘরের আলোটা অন্যদিকে বলে বাবার ঘরে সেই আলো খুব একটা ঢোকে না। আজ নাইটল্যাম্পও জ্বলছে না ঘরে, তবে ঘরের অন্যদিকের জানলা খোলা বলে দূরে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো তেরছাভাবে ঘরে ঢুকে খাটের উপর পড়ে নাইটল্যাম্পের কাজ করছে।
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বাবা। দুহাত দুপাশে ছড়ানো। খাটে আর কেউ শুলে নিশ্চিত তার গায়ে লাগতো। চশমা খোলা বলে বাবার লোমশ দুটো ভুরুকে আরো বড় মনে হচ্ছে, ঠিক দুটো হোঁৎকা মোটা শুঁয়োপোকার মতন। ভুঁড়িটাও বেড়েছে বেশ ইদানিং, চুল পেকেছে অনেক। তবু ঘুমোলে কেন জানি না প্রকাণ্ড একটা বাচ্চা ছেলের মতন লাগে বাবাকে।
অনেকদিন পরে বাবা আবার ওর সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করছে।
বাবার আজকের একটা দুটো কথা কেন জানি না আজ মাথায় গেঁথে গেছে শমীকের। যে অপমান করছে তার কথা বেশি ভাবা মানে তাকে আরো ক্ষমতা দেওয়া।
কেন শুধু শুধু আরো বেশি ক্ষমতা দেবে শমীক ছবিকে?
পরের দিন আবার সকাল থেকে বৃষ্টি। এবারের মতন প্রায় টানা তিন চার দিন এত বৃষ্টি অনেক বছর বোম্বে শহরে হয় নি। তবে ভাগ্য ভাল বলতে হবে যে এখনো অবধি সেই দুহাজার পাঁচ সালের ছাব্বিশে জুলাইয়ের অবস্থা হয় নি এবার।
কিংশুক একটু ভালো আজ। জ্বর কমেছে, তবে সর্দিতে নাক, গলা বন্ধ। আজও অফিস বাদ দেবার উপায় নেই।
স্কুল বাদ দেবার উপায় নেই শমীকেরও। প্রেরণা ম্যামকে হোমটাস্কের খাতাটা দিতে হবে আজ। হয়তো আরো এক প্রস্থ গালাগালি জুটবে সেই সময়।
কিভাবে জানি না আজও আবার একটা বাজে ঘটনায় জড়িয়ে গেল শমীক।
টিফিনের সময় ক্লাস এইটের একটা বাচ্চাকে ধরে পেটাচ্ছিল ইলেভেনের দুটো ছেলে। সামান্য খেলার জায়গা নিয়ে ঝগড়া। টিফিনে ইলেভেনের ছেলেদের খেলার জায়গাটায় খেলছিল এইটের বাচ্চারা। ইলেভেনের ওই দুটো ছেলে ওদের সেখান থেকে সরে যেতে বলে। সবাই সরে যায়, তবে যাবার সময় ওদের দুজনকে নাকি বাজে গালাগালি দিয়েছিল এইটের ওই বাচ্চাটা। গালাগালি দেওয়ার ব্যাপারটা শোনে নি শমীক। একটু দূরে ছিল ও তখন ওদের থেকে। কিন্তু শমীকের সামনেই যখন ওরা দুজন মিলে বাচ্চাটাকে মারতে লাগলো, তখন সেটা আটকাতে গিয়েছিল শমীক। ওদের একজনের ঘুষি বাচ্চাটার বদলে তাই শমীকের পেটে এসে লাগে। মন এমনিতেই ভালো ছিল না, ভেঙেচুরে সব তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছিল ওর। একটা মারপিটের যেন সত্যিই প্রয়োজন ছিল শমীকের। অন্ধ রাগে যে ছেলেটা ওকে ঘুষি মারে তার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ফেলে ওকে উত্তম মধ্যম দিতে যাচ্ছিল শমীক। কিন্তু কপাল খারাপ। অন্য ছেলেটার মারে ঠোঁট ফেটে যায় ওর। ঠিক সেই সময় আবার বায়োলজির অমল স্যার সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। শমীক মারামারি শুরু করেছে ভেবে আগে উনি শমীককে একটি থাপ্পড় কষান, তারপর ওদের বাকি দুজনকে। এইটের সেই গালাগালি দেওয়া বাচ্চাটা ততক্ষণে সেখান থেকে হাওয়া।
এধরনের কেসে ফেঁসে গেলে স্কুল থেকে গার্জিয়ানকে ডেকে পাঠানোর কথা। তার উপরে আবার এমনই কপাল শমীকের যে অরবিন্দ আর ছবি সেই সময় একটু দূরে ছিল। কিন্তু শমীককে একেবারে অবাক করে ওর হয়ে অমল স্যারের কাছে ওকালতি শুরু করল অরবিন্দ। ক্লাসের সেরা ছেলে ওর হয়ে কথা বলায় তাই ছাড়া পেয়ে গেল শমীক। শুধু তাই নয়, ভুল বুঝে চড় মারার জন্য ওর কাছে মৃদু দুঃখপ্রকাশও করলেন অমল স্যার। ফার্স্ট এইডের জন্য নিজে স্টাফরুমে নিয়ে গেলেন ওকে।
ওষুধ লাগানো সত্ত্বেও ঠোঁটের কাছটা জ্বলছে বেশ, তার উপরে থাপ্পড়ের জ্বালা। তবু অরবিন্দকে থ্যাঙ্কস জানানো দরকার একটা এখনই। তাড়াতাড়ি করে তাই ক্লাসরুমে ফিরে আসে শমীক।
না, অন্য কোথাও দেখার দরকার নেই আর। ক্লাসরুমের পিছন দিকটাতে আরো চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ের সাথে বসে রয়েছে অরবিন্দ। ছবিও রয়েছে ওদের সাথে।
– থ্যাঙ্কস, ইয়ার।
বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই কোনো। নিজের সিটে ফেরার জন্য তৈরী হয় শমীক।
“কিঁউ?”, একটু যেন অবাক হয় অরবিন্দ, তারপর বলে, “গালি দে মুঝে। আচ্ছা কাম কিয়া তুনে। You know, I should have joined the fight!
কি যে ছিল অরবিন্দর ওই একটা কথায়, হঠাৎ করে মন খুব ভালো হয়ে যায় শমীকের।
মারের বদলে মার।
আজ ছেলে দুটোর সাথে মারামারি করতে যাওয়ার সময় এক তীব্র উল্লাস হয়েছিল শমীকের। পেটে লাথি পড়ার বদলা নিতে ভোলে নি ও। গায়ে জোর ওর নিজের কিছু কম নেই। অমল স্যার না এলে ওদের দুজনকেই মেরে শুইয়ে দিত ও।
অরবিন্দকে থ্যাঙ্কস জানানোর সময় চোখাচোখি হয়েছিল ছবির সাথে।
কেন জানি না, আজ একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছে ছবি।
অন্যদিনের মতন আজ হল্লা করছে না একটুও।
এতবড় একটা ঘটনার পরেও শমীকের সাথে কোনো কথা বলে নি ছবি, অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। দেখে মনে হয়, ভয় পাচ্ছে শমীককে।
তীব্র উত্তেজনায় টের পায় শমীক যে ছবির ভয় পাওয়ার কথাটা ভাবলেই প্যান্টের মধ্যে পুরুষাঙ্গ খাড়া হয়ে উঠছে ওর।
ছবি অপমান করলে ছবিকেও আর ছেড়ে দেবে না ও। পাল্টা অপমান করবে, সবার সামনে বলবে, “তোর দিকে তাকাই নি বলে আমার নামে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছিস তুই!” তাতে শাস্তি পেতে হলে তাই সই।
– পড়েছিলি বই দুটো?
– হ্যাঁ, শেষ করে ফেলেছি দুটোই। দুর্দান্ত বই, দুটোই।
"তাই?", এবারে সত্যিই অবাক হয়ে যায় কিংশুক। "এরই মধ্যে শেষ করে ফেলেছিস? সলভ করতে পারছিস প্রবলমগুলো?"
– হ্যাঁ, একটা দুটোয় একটু অসুবিধে হয়েছে, তবে একটু ভাবলে বেশির ভাগই পারা যায়।
– বাঃ, তাহলে তো আরও এরকম বই দেখতে হয়।
সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে আবার ব্যাগ খোলে কিংশুক। এই বইটা দেখ এবার। অদ্ভুত নাম বইটার
The Lady or The Tiger?
এবারে লেখক একজন আমেরিকান। রেমন্ড স্মালিয়ান।
বাবার মধ্যে কেন জানি না একটা যেন বদল লক্ষ্য করছে শমীক। যে বাবা আগে দূরে দূরে থাকত এখন মা না থাকায় যেন অনেকখানি বন্ধুর মতন ব্যবহার করছে আজকাল শমীকের সাথে। বাড়ি ফেরার পরে অনেকক্ষণ শমীককে সময় দিচ্ছে। এই সময় দেওয়াটা আবার বিভিন্ন ধরনের বই কিনে এনে, নিজে সেগুলো পড়ে আর তারপর শমীককে সেগুলো পড়তে দিয়ে। রাতে খাবার খেতে খেতে সেই বইগুলো নিয়ে বেশ কিছুটা সময় আজকাল কথা হয় ওদের দুজনের।
আগেও বিভিন্ন ধরনের বই পড়ত কিংশুক। কিন্তু সেই সব বই নিয়ে শমীকের সাথে আলোচনা হত খুবই কম। পড়াশুনো বাদ দিলে শমীকের সময় কাটত মায়ের সাথে সিরিয়াল দেখে আর প্রতিবেশীদের নিয়ে কূটকচালি করে। সিরিয়াল দেখায় প্রবল অনীহা কিংশুকের। প্রতিবেশীদের নিয়েও একেবারে নির্লিপ্ত সে। ফলে এর আগে ওদের মা-ছেলের সাথে ওর কথা হত খুবই কম।
আজকাল কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছে শমীক – মা আগে বাবাকে যতটা সংসারবিমুখ বলে গালাগালি দিত বাবা ঠিক ততটা নয়। বাবার পছন্দ-অপছন্দ বেশ তীব্র। কিন্তু যে জিনিসগুলো বাবা ভালোবাসে বা পছন্দ করে সেসব নিয়ে কারুর সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে বাবার আপত্তি নেই। যেমন, সিরিয়াল না দেখলেও দেশ-বিদেশের ভালো সিনেমা, বিশেষ করে মজার সিনেমা বা ঐতিহাসিক সিনেমা বা যুদ্ধের সিনেমা দেখতে বাবার দারুন আগ্রহ। চার্লি চ্যাপলিনের সব ছবি, বাইসাইকেল থিভস, ইয়ং ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, নাটি প্রফেসর, ইয়েস প্রাইম মিনিস্টার -- বাবার আগ্রহেই বসে প্রথম দেখা শুরু করে শমীক। এছাড়াও ছুটির দিনগুলোতে শমীককে নিয়ে বাইরে কোথাও খেতে যাওয়া প্রায় নিয়ম করে করা শুরু করে কিংশুক। এর আগেও অনেক সময় তিনজনে মিলে খেতে যেতো ওরা। কিন্তু সেখানে কিংশুক কাজের কথা ছাড়া অন্য কোনো কথা বিশেষ বলত না। এখন অতসী না থাকায় কিংশুক কথা বলে প্রচুর। আর এটা অন্তত শমীক অনুভব করতে পারে যে ওকে নিয়ে কোথাও এভাবে খেতে যাওয়াটা বাবা নিজের মন থেকে ভালোবেসেই করে। প্রায়ই বান্দ্রা স্টেশনের পশ্চিম দিকে এস ভি রোডের উপর লাকি রেস্টুরেন্টে খেতে যায় ওরা। মুসলিম রেস্টুরেন্ট বলে ওখানে ভিড় একটু কম। লাকির বিরিয়ানি আর তন্দুরি আইটেমগুলো শমীক আর কিংশুক দুজনেরই খুব প্রিয়। এক আধ দিন টেলিফোন-এ অর্ডার দিয়ে লাকি থেকে খাবার আনিয়ে নেয় ওরা।
তবু এমন কিছু একটা রয়েছে বাবার মধ্যে যা খুব একটা কাছে আসতে দেয় না কাউকে। মাঝে মধ্যেই কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়ে বাবা। তখন কিরকম একটা অস্বাভাবিক লাগে বাবাকে। কথাবার্তা বলতে চায় না, ঠোঁট দুটো নড়ে, যেন আপনমনে বিড়বিড় করছে কিছু, শমীক এই সময় কিছু বললেও প্রায় চমকে ওঠে বাবা।
বাবার এই স্বভাবটা এখানে অনেকেরই জানা। এই নিয়ে হাসাহাসিও কম হয় না এখানে। একটা ঘরোয়া বাঙালি ফাংশনে মধুমিতা আন্টি একবার এই নিয়ে মা-কে জিজ্ঞাসা করেছিল, “উনি একটু আলাদা, তাই না?”
কেন জানি না, সেদিন ভীষণ অপমান হয়েছিল মায়ের। এর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বাবাকে এই নিয়ে খোঁটা দিয়েছে মা, যেন এক গভীর লজ্জার ব্যাপার এই সবার থেকে আলাদা হওয়াটা। মুখের উপর কাউকে তো আর পাগল বলা যায় না, তাই যা বোঝাবার সেটা ভদ্র ভাষায় একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মধুমিতা আন্টি।
সেদিন মায়ের কথা শুনে বাবাকেও পাগল ভেবে নিয়েছিল শমীক। বাবা সম্বন্ধে তাই কেমন যেন একটা আতঙ্ক ছিল ভিতরে। এই ভয়টাকে কিছুতেই নিজের ভিতর থেকে দূর করতে পারে নি শমীক।
অভিমানে মা-কে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলেও, বাবাকে তার বদলে কাছে আনা সম্ভব হয় নি তাই।
এই কদিনের অভিজ্ঞতা কিন্তু একটু অন্যরকম।
না, পাগল নয় বাবা। তবু, ঠিক স্বাভাবিকও নয় যেন।
বাবাকে তাই ঠিক বুঝতে পারে না শমীক। কেন যে বাবা এত আলাদা?
মুশকিল হলো একা একা কিভাবে বাবাকে ঠিক করবে ও?
রাগের বশে মা-কে দিল্লি পাঠিয়ে কি ঠিক করল শমীক?
আস্তে আস্তে কিছুদিনের মধ্যে শমীকের জীবন অন্য এক রুটিনে বাঁধা হয়ে যায়, যে রুটিনে বাবার জায়গা সারাদিনে ঘন্টা দুয়েক। মা’র জায়গা শুধুমাত্র দিনের মধ্যে এক বা দুবার পাঁচ-দশ মিনিটের ফোনে।
এই রুটিন পাল্টাত একমাত্র মা দিল্লি থেকে বোম্বে এলে। প্রথমদিকে মায়ের আসার জন্য মুখিয়ে থাকলেও আস্তে আস্তে শমীক এই আসা যাওয়ার ব্যাপারেও বেশ কিছুটা নির্লিপ্ত হয়ে পড়ে ক্রমশ। সিরিয়াল দেখায় আগ্রহ এখন কমে গেছে অনেক। আর মায়ের কাছে দেশ বিদেশের গল্প-উপন্যাস নিয়ে বা সিনেমা নিয়ে কথা বলা যায় না। বাংলা ছাড়া মা জানে শুধু হিন্দি, কিছুতেই মা সেই হিন্দি সিনেমা বা সিরিয়ালের গন্ডি থেকে বেরোবে না।
মা না থাকলে এখন খালি বাপ-ব্যাটার সংসার। অতিথি বা বাইরের লোকের আসার ব্যাপারটা ওদের বোম্বের বাড়িতে নেই বললেই চলে। আগে বাবার কলিগ প্রদীপ্তকাকু আর অশোককাকু আসত মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে। আজকাল ওরা দুজনেই প্রভাদেবী কমপ্লেক্সে চলে যাওয়ায় সন্ধ্যার পর আর কেউ খুব একটা বাড়িতে আসে না।
বাবার বাড়ির দিক থেকে বোম্বেতে কারুর বেড়াতে আসা শমীকের জন্মের আগে থেকেই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শমীক জানে এর মূল কারণ ঠামির সাথে মায়ের বনিবনার অভাব। মায়ের দিক থেকে আগে দাদু-দিদা বছরে একবার করে আসতেন দিন পনেরোর জন্য -- প্রথমদিকে মামুও থাকত সাথে -- কিন্তু এখন অতসী-ই যখন বোম্বেতে নেই, ওঁরা আর তাহলে কার জন্য আসবেন?
তাই সেদিন রাত্রে বাড়িতে ঢুকে বাবা যখন ওকে বলল যে মামু আসবে বোম্বেতে, ওদের কাছে, হঠাৎ করে ভীষণ এক আনন্দ হয়েছিল ওর।