বিগত শতক, পঞ্চাশ দশক। এই তো! মাত্র ক'টা বছর আগেই দেশ ভাগ হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বপ্ননীল তুলির টানে নতুন প্রজন্মের চোখ দুটো আঁকা হয়েছিল 'কিছু নেই' থেকে 'সব কিছু' পাওয়ার এক উদ্দীপনা আর উৎসাহের ভাবনা-তরঙ্গে। ফেলে আসা দশকগুলোতে দেশের সিনেমার চিন্তাশৈলি আর তার গুণমান ছিল এক রকম। বেশির ভাগ সিনেমাই তৈরি হত অতিনাটকীয় গল্পবিন্যাসে, 'সেট' এর মধ্যে 'মিসে এন সিনে' (স্টেজ সাজানো পদ্ধতি) প্রক্রিয়ায় সমাজচিত্রিত নাট্যকেন্দ্রিক অথবা পৌরাণিক বা দেব-দেবী নির্ভর অতি-অবাস্তব কাল্পনিক বিষয়-সম্ভার নিয়ে। সেগুলোই ফিরি করা হতো দেশ জুড়ে গড়ে ওঠা মায়াবিনী কল্পলোকের সিনেমা হলগুলোতে। সত্যিই বিস্ময় এই 'সিনেমা' তকমা-আঁটা কল্পলোকটি। চলমান মানুষ, জীবজন্তু, পাখি-আকাশ-প্রকৃতি-প্রান্তর, রাগ-অভিমান-দুংখ-প্রেম-ভালোবাসা, ত্যাগ-লালসা-হিংসা-স্বার্থপরায়ণতা, গান-গীত-সঙ্গীত আর সব মেলানো উপস্থাপিত উপস্থিতির বিচিত্র মুন্সীয়ানা প্রেক্ষাক্ষেহের আলোছায়ায় বসে ঐটুকু সময় একাকী-মনের সঙ্গী হয়ে দর্শকদের আকুল করতো, হাসাতো, কাঁদাতো, ভালোবাসাতো। এটা সর্বজনস্বীকৃত। আর অপূর্ণতায় আচ্ছন্ন মনগুলো আরো কিছু চাইতো, পরের ছবি রিলিজের অপেক্ষায় দর্শকেরা দিন গুনতো। কয়েকটা দু-একটা ছবি বাদ দিলে (যেমন 'নীচা নগর' বা 'ডক্টর কোটনিস কি অমর কাহানী' বা 'উদয়ের পথে' বা 'দো বিঘা জমিন' ইত্যাদি)বাকি অধিকাংশ দেশিয় ঘরানার ছবিগুলোর রূপসজ্জা নেহাতই সাদামাটা স্তরের সাদকালো যুগ। ছবিগুলোতে নিঃসন্দেহে নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা থাকলেও সিনেম্যাটিক উপস্থাপনায় বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের রকমফের তেমন ছিল না। তাই অনেক সিনেমাই সাময়িক রসোত্তীর্ণ হলেও কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠতে পরে নি। বহু কষ্টার্জিত উদ্ধার করা যে মুষ্টিমেয় সে সময়ের ছবির নেগেটিভ বা প্রিন্ট পাওয়া গেছে, সেগুলো আর্কাইভে সংরক্ষিত এবং তার মধ্যেও বহু ছবি এই প্রজন্মের কাছে অনাদরণীয়, তাই অপ্রদর্শিতও বটে।
দেশ ভাগ, বিশেষ করে বাংলা ভাগ ঐ সময়ের পদ্মাপাড়ের বাঙ্গালীদের কাছে গভীর এক অনুভব, এক কান্না-চাপা অভিমান। চল্লিশ দশকের শেষ দিকে পূব-বাংলা থেকে চলে আসা গূহহারাদের সমকালীন অবস্থান নিয়ে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক ভাবনার পরিসর অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল। এক অপরিসীম শূণ্যতা শুধু ঘর-বাড়ি্ গ্রাস করেছিল সব-হারাদের, তা নয়। গ্রাস করেছিল বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাসও। হৃদয়-গভীর অন্তস্থলে কুরে খাওয়া যন্ত্রণা। শুধু ঘর-রাড়ি-সংসার-পরিবেশ ছেড়ে আসাটাই নয়, পেছনে পড়ে ছিল হাজার স্মৃতি, লক্ষ ইতিহাস। সেই মন-নিংড়ানো বার্তাবহনকারী যন্তণার পাঁচ ভাগ স্থানও সমকালীন সিনেমায় মাধ্যমগত হয় নি। ঋত্বিক ঘটকের মতো বোধহয় আর কোনও চলচ্চিত্রকার বাংলাভাগ নিয়ে এতো বেশি আলোড়িত হন নি। সেদিক থেকে নিমাই ঘোষের 'ছিন্নমূল' (১৯৫০) নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী ছবি ছিল। 'ছিন্নমূল' ঠিক ছবি অর্থে ছবি বলা চলে না। ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার একটা ছিল নিঃসন্দেহে, তবু এই সিনেমাটা সেই সময়ের কলকাতা শহরর এক ঐতিহাসিক দলিলচিত্র বলা যায়। লড়াই করে বাঁচতে শেখা লক্ষ গৃহহারাদের নতুন করে নতুন দেশের মাটিতে স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার কাহিনীই বর্ণিত হয়েছে এই ছবিটাতে।
অন্য ভাবনার বাংলা ছবি তৈরি করার শুরুর সেদিনের পরে আরো কিছু হাঁটা পথ পরিক্রম করেছিল ভিন্ন স্বাদের, শিল্পমনের সিনে-চিত্রণ। ছবি নির্মাণের সংখ্যা ছিল কম, তাই বাংলা সিনেমার নির্মাণের কাজে ব্রতী মানুষদের দায়বদ্ধতা ছিল অনেক বেশি। প্রথম ও প্রধান কারণ ছিল অবশ্যই বড় অঙ্কের অর্থ লগ্নী। গল্পের গভীরতা বোঝার বা আগ্রহী প্রযোজকের সংখ্যাও নগণ্য। প্রযোজককে লগ্নী করা টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পরিচালকেরা তাঁদের দক্ষতার শেষ পর্য্যায়ে পৌঁছে যেতেন। টানটান গল্প, সাহিত্যাশ্রয়ী চিত্রনাট্য বিন্যাস, কালজয়ী অভিনেতাদর অসাধারণ অভিনয় আর সুর-গান-মাখা চিত্ররূপ আজও বাঙালির মন মাতায়। বাণিজ্যিকভাবে যদিও সেগুলো অধিকাংশই ছক বাঁধা গল্পের উপস্থাপনা। ঋত্বিক ঘটকের 'নাগরিক'-কে সে ক্ষেত্রে বলা যেতে শহর-সমাজ-জীবন নিয়ে প্রথম বাংলা বলিষ্ঠ ছবি, যেখানে পরিচালক নিজের কিছু চিন্তাধারা ও বাস্তবভিত্তিক জীবনচরিত সেলুলয়েডে এঁকে গেছেন। চেনা ছকের বাইরের সে ছবি মুক্তি পেল ঋত্বিকবাবুর জীবনাবসানের পরে।
সিনেমার প্রবহমানতায় সেলুলয়েডে কবিতার ছন্দে সিনেম্যাটিক কাব্য বিধৃত করা শুরু হয়েছিল 'পথের পাঁচালি' ছবিটির সূত্র ধরেই, সন্দেহ নেই। সে ছবির অপু-দুর্গার গ্রাম-প্রকৃতি ঘেরা জীবনের রোম্যান্টিসজম বাঙলির হৃদয়ে মিথ হয়ে আছে আজও। নিও-রিয়্যালিস্ট সে ছবি স্বদেশে বিদেশে ক্ল্যাসিক পর্য্যায়ভুক্ত। সত্যজিতের ছবিতে কলকাতা প্রথম ধরা পড়ে পরের ছবিতে — 'অপরাজিত'- এ কিশোর অপুর চোখে। শহর-শহর গন্ধ ভরিয়ে দেয় মন আঙিনা। 'অপুর সংসার' থেকে 'পরশ পাথর', 'মহানগর' থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী, জন অরণ্য. সীমাবদ্ধ থেকে শেষ ছবি পর্যন্ত্ও কলকাতা শহর ধরা দিয়েছে সত্যজিতের নানান ছবিতে, নানান ভাবে, ঘটনাক্রমের বিবরণ হিসেবে, ছবির সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান অনুযায়ী।
মৃণাল সেনের অধিকাংশ ছবিই কলকাতা কেন্দ্রিক। প্রিয় বিষয়ও বটে। কলকাতার রোম্যান্টিসজম তাঁকে কখনই টানে নি, টেনেছে সংঘাত-লড়াই-বাস্তব রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিতে মুখোমুখি আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, ছাত্র-যুব রজনৈতিক অনুসন্ধান, শহর-মেয়ের অবস্থান। এই শহরের সমাজ-রাজনীতির মতোই তিনি ছিলেন ভাইব্রান্ট, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ও আধুনিকতার সংঘাতে নতুন কোন তৃতীয় সূত্রের সন্ধানী, নিজেকে ভাঙার মনন। 'পথের পাঁচালি'-র পরের বছরগুলোতে বাংলার দর্শকরা বেশ কিছু ভালো সিনেমা পেয়েছে, সত্যজিতের ফি বছর একের পর এক ক্ল্যাসিক, ঋত্বিকের দেশভাগের যন্ত্রণার নির্যাসে তৈরি হৃদয়-উজাড় করা সমকালীন ভাবাবেগের প্রতিচ্ছবি। একই সিনেমা-নৌকোয় পাড়ি দেওয়া মৃণাল তবু স্বতন্ত্র। নিমতলা শ্মশানঘাটে ১৯৪১ এর রবি-প্রয়াণের অগ্নিদাহে অষ্টাদশের কিশোর মৃণাল কোন রাবীন্দ্রিক-সত্তার অনুগামী না হয়ে বরং পরখ করেছিলেন ভিড়ে-ঠাসা রবি-চিতার পাশে দাহ করার এক টুকরো আগুনের জন্য সন্তান-হারা এক পিতার বুক-ভরা কান্না আর হাহাকার। মনের লিপিতে সে দৃশ্য ঠাঁই দিয়েছিলেন মৃণাল সেন। তিনি বুঝেছিলেন — সাধারন মানুষের কাছে নিজেদের সমস্যা বা যন্ত্রণা অনেক গভীরের — সেখানে রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বের মৃত্যুক্ষণও খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। অনেক পরে, সেই বাইশে শ্রাবণ ফিরে আসে ঐ নামের ছবিটিতে — যেখানে রবীন্দ্র-মৃত্যুর দিনে আশা নিয়ে ঘর বেঁধেছিল ছবিটির দুই দুঃস্থ, বিধ্বস্ত চরিত্রেরা।
ষাটের দশকের মাঝের শেষ পথে খোসলা কমিটির একগুচ্ছ প্রস্তাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে নতুনভাবে দেশিয় সিনেমার পরিকাঠামো তৈরি করতে নানান ভাবনার সন্ধানে ছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়। একটা 'ঢেলে সাজানো'র ব্যাপার ছিল, তাগিদ এসেছিল আঞ্চলিক ছবিগুলোর জন্যও বিদেশে প্রদর্শণ আর বাজার উন্মুক্ত করবার। নতুনভাবে সিনেমা আঁকার জন্য বৎসরান্তে এক ঝাঁক শিল্পীদল তখন পুনের ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের নান্দনিক রূপশিক্ষার কথকতা জানতে সক্রিয় হয়েছিল। অনেক রকম হরেক ভাবনার ঘাত-প্রতিঘাতে গড়ে উঠছিল সিনেমার প্রচলিত গ্রামার ভাঙার চিন্তা। পুনের ইন্সটিটিউট তো বটেই, এই পুনেতেই ফিল্ম আর্কাইভে ঠাঁই পেয়েছিল দেশি-বিদেশি নানান ছবির সম্ভার। শহর আর শহরতলিতে তৈরি হয়েছিল উৎসাহী সিনে ক্লাব। সুচিন্তন সাহিত্যপাঠ, সঙ্গীত ও কলাচর্চার প্রাসঙ্গিকতায় নবনিযুক্ত হল আন্তর্জাতিক সিনেমা-পাঠের উৎসাহ। সরকারি ব্যবস্থাপনায় তৈরি হয়েছিল ফিল্ম ফিনান্স কর্পোরেশান। বর্তমানের ন্যাশানাল ফিল্ম ডেভেলাপমেন্ট কর্পোরেশানের পূর্বসূরী। নতুনভাবে সাজানো হল ডাইরেক্টোরেট অফ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালস। ফিল্ম সেন্সর বোর্ড। আঙ্কলিক সিনেমাকারেরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে নতুনভবে নতুন কিছু করে দেখানোর।
বাতাসে বারুদের ঘ্রাণ, আরেকদফা উদ্বাস্তু গৃহহারাদের অস্তিত্বের সঙ্কট, বেকারত্ব, শহরের ওপর দিয়ে প্রাণ জেরবার করা ভারত-পাক যুদ্ধের কলরব,আরেকদিকে অর্থ-প্রাপ্ত মধ্যবিত্তদের ভোগবিলাসের উচ্চাভিলাষ, শহরসমাজ জোড়া-ভাঙার খেলা, সাথে দোসর নিয়ন্ত্রণহীন লাগামছাড়া প্রশাসনিক রক্তচক্ষু - সব মিলিয়েই আমাদের শহর তখন ফুটছে। ফুঁসছে রাজনীতি। ছাত্রসমাজ। কায়িক চাকরিকারিরা, শহরতলির শ্রমিকশ্রেণী।
এই ভণিতাটুকু করলাম সত্তর দশকের শেষে বাংলায় যে তরুণ চলচ্চিত্রকারেরা সমান্তরাল ছবিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার ছবি এঁকেছিলেন, তাঁদের প্রসঙ্গে এই এবার এলাম বলে। সদ্য প্রয়াত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত প্রসঙ্গে কথায় কথায় ভোর দেখা হয়ে যায়। বাংলা সিনেমার আন্তর্জাতিক প্রবাদপুরুষ। তাই তাঁর কাজের মাপকাঠির দৈর্ঘ্য ছোট আকারে বললেও বাংলা সিনেমার নব্য-বাস্তবতাবাদের সীমা ছাড়িয়ে সমান্তরাল ছবি করার স্পর্ধা বিশ্লেষণে মুখবন্ধের এই ইতিহাসটুকু জরুরী।
..."তাঁর শুধু ভালো লাগত আলমারি খুলতে। যখনই কোনো কাজ থাকত না, কিংবা কিছুতেই আসত না ঘুম, আলমারি খুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকত আলমারির ভেতরে। দশ জোড়া শার্টপ্যান্ট তাঁকে লক্ষ্য করত। এমনকি দুটো পাল্লাও তাঁকে লক্ষ্য করত। শেষে আস্তে আস্তে আলমারি তাঁকে ভালোবাসতে শিখল। একদিন অবশেষে যখন সে খুলল পাল্লা। ভেতর থেকে এসে শার্টের লম্বা হাত জড়িয়ে ধরল তাঁকে। টেনে নিল ভেতরের দিকে। বন্ধ হয়ে গেল পাল্লা। এবং নানা রঙের জামারা তাঁকে শেখাল, কী করে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, এক জন্ম থেকে আরেক জন্ম, ঝুলে থাকা যায় শুধুমাত্র একটা হ্যাঙ্গার ধরে"...
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতার ইমেজ। তাঁর নির্মিত সিনেমাগুলোতেও যেন পাল্লা খোলা জানলা দিয়ে এমন শত ইমেজ দু-ডানা মেলে পাড়ি দিয়েছিল অসীমের স্নেয় বাহুবন্ধে, অনেকটা যেন আলমারির ভেতরের নানান রঙীন স্বপ্ন-আদর ফিরে ফিরে বারেবারে এসেছে তাঁর সিনেমাগুলোতে। তাই হয়তো মন-কোঁকানো মেঘ-বৃষ্টি 'দূরত্ব'-র মন্দারকেও মুহূর্তে আনমোনা করে, রাজনীতির বাইরেও স্ত্রী অঞ্জলিকে নিয়ে জীবনবোধের স্বপ্ন যোগায়, 'গৃহযুদ্ধ' সিনেমায় রাজনীতি ও সামাজিকভাবে পরাজিত বিজন-রা বারবার প্রাণ পায় 'উই শ্যাল ওভারকাম'-এর মাউথ অরগ্যানের সুরমালায়, জীবনসত্যকে নিবিড়ভাবে খুঁজতে গিয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে দিয়ে যায় বিজনের সাথে সাংবাদিক সন্দীপনকে, 'তাহাদের কথা'-য় ব্রিটিশ জেলে এগারো বছর কাটিয়ে ফেলা শিবনাথ বদলে যাওয়া পৃথিবীর অন্তঃসারশূণ্যতার মাঝেও রূপকথার ঘোড়ার ইমেজ দেখে পেরিয়ে যেতে চায় দুঃসময়ের গল্প।
মাঝ-সত্তরে মন-মুক্তির আলো উজাড়-করা এক যে ছোট্ট সিনেমা-করিয়েদের দল বাংলার স্টুডিও পাড়ায় পা রেখেছিলেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁদেরই অন্যতম। ষাটের শেষে মৃণাল সেনের 'ভুবন সোম', বাসু চ্যাটার্জীর 'সারা আকাশ' বা মণি কাউলের 'উসকি রোটি' ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমার নতুন শুরুর দিন। পুনের ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করা নাম করা সিনেমাকারেরা। ভারতীয় নব্য-ধারার সিনেমার কল্পলোকের বাস্তবতা। এখানে রাজনীতির স্রোত এসে মিলেছিল সামাজিক স্রোতে। বাংলা তখনও সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল মগ্ন। কি মন ভরা আবেগ, কি অসীম সাহস, কি নির্ভেজাল স্বপ্ন আর কি অসম্ভব আত্মবিশ্বাসদের সঙ্গী করে বাংলায় বুদ্ধদেব-গৌতম-উৎপলেন্দু-অপর্ণারা হৃদয়-মেধা ও মাথা দিয়ে স্তর-উত্তীর্ণ ছবি করে গেছেন বছরভোর - আজ সবই যেন স্মৃতিপটে আঁকা রূপকথাটি বটে। সিনেমা তখন সিনেমা ছিল, অর্থবহুল, নানা উদ্বিগ্নতায় আসতো না দিনান্তের ঘুমও। যান্ত্রিক জটিলতা, অর্থকষ্টে ক্লান্ত তবু হার না মানা ইচ্ছেটুকু সম্বল করে সব পেরনোর পথ পেরোতে হয়েছিল তাঁদের।
বুদ্ধদেববাবুকে আমি প্রথম দেখেছিলাম ১৯৮১ সালের এক শীত সন্ধ্যায়। আমি তখন ১৮ বছরের, সিনেমা-প্রেমে বিভোর এক কিশোর। ভবিষ্যতে যে নিজেই সিনেমার জগতে ঢুকবো, সে ভাবনা এসেছিলো অনেক পরে। সে সময়ে সিনেমা করা খুবই দুঃসাধ্য আর ব্যয়বহুল একটা প্রক্রিয়া ছিল। ফলে সিনেমার চর্চার দিকেই মনটা পড়েছিলো। একটা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের মধ্যেই থাকার চেষ্টা করছিলাম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সিনেমা দেখার সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম ছিল সিনে ক্লাবগুলো। কলকাতায় এবং নানান জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রচুর সিনে ক্লাব গড়ে উঠেছিল। নাকতলায় সেরকমই একটা সিনে ক্লাব তৈরি হয়েছিল 'সিনে সাউথ' বলে। স্বপন সেনগুপ্ত (ঝাঙ্কুদা)-র কাছে মূকাভিনয় শিখতে প্রতি সন্ধ্যায় নাকতলাতেই যাতায়াত করতে হতো আমায়। সেখানেই কাণাঘুষোয় শুনলাম পাশেই কোনও সহৃদয় ব্যাক্তির বাড়ি সংলগ্ন এক টুকরো জমিতে দরমা-টালির আন্তরিক সৌন্দর্য্যে একটা সিনে ক্লাব তৈরি হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত কর্মী সংখ্যা হাতে গোনা। 'দিনকাল' পত্রিকা সম্পাদক বিকাশ পাল, তাঁর ভাই সুভাষ (হাবুল দা) আর আমর দীর্ঘদিনের সহকর্মী অলোক (ব্যানার্জী)। এই সিনে ক্লাবটি তৈরির মূল ভাবনা ছিল অলোকেরই, বন্ধু পিনাকী গুহর সাথে মাঠ-শোয়া চাঁদের ঝর্ণাতলায় উৎসারিত সে ভাবনাকে রূপ দেওয়া হয়েছিল, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সহ-বুদ্ধিতে, সহ-ব্যাখ্যাতে। গৌতম দা (মণি দা) চিরকালই নতুন কিছু করার ব্যাপারে ‘ছক-বাঁধা’ পথ অতিক্রমী দিশরী।এক্সিকিউটিভ কমিটিতেও ছিলেন 'মহিনের ঘোড়াগুলি'-খ্যাত এই গৌতম চট্টোপাধ্যায় (মণি দা)। সিনেমা দেখা ও দেখানো, সিনেমা নিয়ে চর্চার আসর আর মানুষকে ভালো সিনেমার ব্যাপারে সচেতন করার তাদের সুতীব্র দায়বদ্ধতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমিও কখন কিভাবে যেন সিনে ক্লাবটাকে ভালোবসে ফেলেছিলাম। ক্লাবটা সদ্য নর্মিত।তাই ঐ দরমা-চাপা ঘরে সম্পত্তি বলতে কেরোসিন কাঠের একটা টেবিল আর খানকতক নড়বড়ে চেয়ার। লম্ফের হলদেটে কাঁপা আলো-রশ্মি মুখর ঐ ছোট্ট ঘরেই প্রায় বসতো সান্ধ্যকালীন সিনে-সভা। ক্লাবটার সভাপতি ছিলেন মৃণাল সেন, সহ-সভাপতি ছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, আলোক শিল্পী তাপস সেন প্রমুখ। নাকতলার বান্টি সিনেমা হলের মালিক হেমন্ত মান্নাও ঐ সিনে ক্লাবটার সাথে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। উনি খুবই উৎসাহিত হয়ে তাঁর বান্টি সিনেমা হলের পেছনের দিকে দো-তলায় ছোট হলঘরটি সিনে ক্লাবটার সিনেমা প্রদর্শন করতে বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। শ' দুয়েক সদস্যও হয়ে গিয়েছিল। বুদ্ধদেববাবু তখন আমাদর মতো সিনেমা-মাতোয়ারা কিশোর যুবকদের কাছে সিনেমার বহু-চাহিদা মেটানো এক ব্যক্তিত্ব, যাঁকে দেখতাম আর ভাবতাম, যে লোকটি 'দূরত্ব'-র মতো ছবি পরিচালনা করেছেন, 'নিম অন্নপূর্ণা' করছেন, তিনি আমাদের উপদেশ দিচ্ছেন কিভাবে 'সিনে সাউথ'-এর কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, কিভাবে কোন ছবি কোথা থেকে এনে প্রদর্শন করানো যায়- এমন অনেক বিষয় নিয়ে। আর হলুদ-কাঁপা আলোয় 'আমরা কজনের' দীর্ঘতর ছায়া যে পরিবেশ রচনা করতো, সেটা বড় মায়াবী কাব্যমাখা, রূপোলি পর্দার মায়ালোকর মতোই। প্রেক্ষাগৃহে প্রোজেক্টার প্রক্ষিপ্ত চতুষ্কোণী আলোক বিচ্ছুরণ যেমন করে দর্শকদের সিল্যুয়েটে রেখে পর্দায় চলমান জীবনের লিপি-গদ্য এ্ঁকে দিয়ে যেত কল্পলোকের মায়াবী প্রেক্ষাপট।
সেখানেই সেভাবেই বুদ্ধদাকে প্রথম দেখা ১৯৮১ সালের কার্তিক মাসের এক শীত-প্রারম্ভ সান্ধ্যপ্রহরে। কেমন যেন মনের আযনায় সিনেমার প্রতি শান্ত উষ্ণতার সন্ধান এনে দিয়েছিলেন তিনি। 'দূরত্ব" আর তাঁর প্রথম দিকের সিনেমাগুলোর মধ্যে 'গৃহযুদ্ধ" ছবিতে তিনি সত্তর দশকের রাজনৈতিক আর সমাজভিত্তিক অস্থিরতা ও সঙ্কটের উপলব্ধিগুলো যেভাবে চিত্রায়িত করেছিলেন, যে সাহসের সঙ্গে, যে বলিষ্ঠতার সঙ্গে আর সাবলীল বাস্তবভঙ্গীতে, যা সমান্তরাল ছবির বহুমাত্রিক প্রকাশকেই ব্যাখ্যা করে। তাই, আশির দশক ঘুরত না ঘুরতেই আমরা ঠিকঠাকভাবে পেয়ে গিয়েছিলাম বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, গৌতম চট্টোপাধ্যায় (মহিনের ঘোরাগুলি-খ্যাত 'নাগমতী' ছবির পরিচালক), সৈকত ভট্টাচার্য ('দুলিয়া' ও 'যাকে ঘুষ দিতে হয়'-খ্যাত) , সনৎ দাশগু্প্ত ('জননী' খ্যাত), অপর্ণা সেন, বিপ্লব রায়চৌধুরী ('বর্ণ বিবর্ণ', 'মহা পৃথিবী', 'শোধ'- খ্যাত), নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় ('আজ কাল পরশুর গল্প', 'চপার'-খ্যাত) প্রমুখ এক ঝাঁক পরিচালক, যাঁরা সমাজ-রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে চলচ্চিত্রের নতুনতর ভাঙা-ভাষা দিয়ে ভারতীয় বিশাল প্রেক্ষাপটে সমান্তরাল বাংলা ছবির নবতরঙ্গের ঢেউয়ে উজান বেয়েছেন। সিনে ক্লাব সার্কিটে এঁদের তৈরি ছবিগুলোর প্রায়শই প্রদর্শিত হতো। অধিকাংশ সদস্যই ব্যাঙ্ক কর্মচারী বা সরকারী কর্মচারীদের একাংশ, যাঁরা অফিস-ফেরৎ সান্ধ্যকালীন সময়গুলোর কিছুটা বা ছুটির দিনের বে-হিসেবী মুহূর্তগুলো স্বচ্ছন্দে ভাগ করে নিত সিনে-ক্লাব আয়োজনে। সিনে সাউথের তরফ থেকে বুদ্ধদেববাবুর 'দূরত্ব' বা 'নিম অন্নপূর্ণা', গৌতম ঘোষের 'মা ভূমি', 'হাংরি অটাম' (তথ্যচ্রচিত্র), 'দখল' বা উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর 'রূপসী বাংলা' (তথ্যচিত্র) বা 'ময়না তদন্ত' প্রায়ই দেখানো হতো। অনেক সময়েই বিভিন্ন শো-এ পরিচালকেরা নিজেই উপস্থিত থাকতেন দর্শকদের সাথে সরাসরি কথা বলার জন্য, তাঁদের জিজ্ঞাস্যর উত্তর দিতেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তও ব্যতিক্রম ছিলেন না। নতুন ভাবনার, খোলা জানলা-মনের নতুন শ্রেণীর সিনেমা দর্শক তাঁরাও নিজেদের মতো করে তৈরি করেছিলেন। একটু একটু করে।একটা একটা করে।
(ক্রমশ)