“চিনতাম না” বীরেনদাকে যেদিন থেকে ‘চিনে’ ফেললাম, আমার সিনেমার হাতেখড়ি হল। নৈহাটী সিনে ক্লাবের এক চিলতে অফিসঘরে দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেমে বাঁধানো সাদা কালো ছবিগুলোকে অতি উৎসাহে আমার মতো নব্য-কিশোরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। —ওটা আইজেনস্টাইন, উনি লুই বুনুয়েল, উনি ভিত্তোরিও ডি সিকা। মাথার ওপর তিনজনের ছবিই শুধু চিনতে পারলাম — মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক ও সত্যজিৎ রায়।
বীরেনদা কোনও অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব নন। কিন্তু অনন্যসাধারণ ব্যক্তি বটে। বীরেন্দ্র দাশ শর্মা সেদিন ছিলেন এক সিনে ক্লাব সেবক, মাঝ-জীবনে সিনেমাকর্মী ও শেষ-জীবনে সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের একজন শিক্ষক। সিনেমার প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা সেই আমার কিশোরমনে সিনেমার নেশা ধরিয়ে দিলেন। ভালো ছবির মানে কি — বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম তাঁর কাছ থেকেই।
ভাগলপুরে বেশ কিছু বিনা বিচারের বন্দীদের পুলিশ হেফাজতে অন্ধ করে ফেলা হল। ১৯৭৯-র একটা বিশেষ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। তপন বোস পরিচালিত তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছিল AN INDIAN STORY. ছবিটির বিষয়ভাবনা আমার মনে বড় রাগ সঞ্চারিত করেছিল। ছবিটির রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট, বিহারের পটভূমি আর তপন বোসের অসামান্য সম্পাদনার গুণে তথ্যচিত্রটি রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছিল আমাকে। Cine scene বলে নৈহাটী সিনে ক্লাবের একটা নিউজ ম্যাগাজিন বেরোতো। তাতে লিখেই ফেললাম ছবিটিকে নিয়ে।
৬০-এর দশকের শেষ থেকে ভারতীয় সিনেমা এক নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্রকারদের জন্ম দিয়েছিল। সত্যজিৎ রায় আর ঋত্বিক ঘটকের Neo-Realist ছবি তো ছিলই, ঐ সময়েই শুরু হল ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমা। আঞ্চলিক ভাষায় তৈরি উন্নতমানের আন্তর্জাতিক ছবি।
ভারতীয় ছবির মূল ধারার ছবিতে ক্রমবর্দ্ধমান যৌনতা ও হিংস্রতা ভারতীয় সংস্কৃতি-বিরোধী হয়ে উঠছিল। নতুনভাবে কি করে সিনেমা শিল্পকে একটা আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়া যায়, তার জন্য তৎকালীন ভারত সরকার একটা চিন্তা-ভাবনার মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছিল। খোসলা কমিটির রিপোর্টে সেই ভাবনাকেই নতুন রূপ দেবার চেষ্টা হল। সেন্সরশিপ আইনে বেশ কিছু রদবদল ঘটল। সার্টিফিকেটে ‘A’ অথবা ‘U’ ছাপানো অক্ষর বড়দের ছবি বা ছোটদের ছবির মধ্যে একটা বিভাজনের মাত্রা এনে দিল।
সিনে ক্লাব আন্দোলন তখন কলকাতায় তো বটেই, সারা ভারতবর্ষেই পুরোদমে চলছিল। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির জন্ম হয়েছিল দেশ স্বাধীন হবার সাথে সাথে। ১৯৪৭। এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, বংশী চন্দ্রগুপ্ত ও আরো বেশ কিছু মানুষজন, যাঁদের স্বপ্ন ছিল, হলিউডের ছবির বাইরে যে বৃহত্তর সিনেমার জগৎ পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে আছে, উৎসাহী মানুষদের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। সত্যজিৎবাবু তখন সিনেমা পরিচালনা করবেন বলে মনস্থির করেই ফেলেছিলেন। বিদেশ থেকে বেশ কিছু সিনেমার বই ও ম্যাগাজিনও তিনি তখন নিয়ে এসেছিলেন। ফলে ভালো সিনেমার দর্শক তৈরির নেপথ্যেও সত্যজিৎবাবুর একটা বিরাট ভূমিকা ছিল।
১৯৫০-এ বিশিষ্ট ফরাসী চলচ্চিত্রকার জাঁ রেনোয়াঁ কলকাতায় এলেন তাঁর The River ছবির শুটিং করতে। জাঁ রেনোয়াঁ ছিলেন বিখ্যাত প্রতীতিবাদী চিত্রশিল্পী পিয়েরে অগস্তে রেনোয়াঁর পুত্র। কলকাতায় শুটিং করতে আসার বহু আগেই তিনি একজন অসাধারণ চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন, মূলতঃ তাঁর অন্যতম দুটি ছবি — লা গ্রান্দে ইলিউশান (The Grand Illusion) এবং The Rules of The Game যথাক্রমে ১৯৩৭ ও ১৯৩৯ সালে সিনেমা শিল্পের অন্যতম সেরা দুটি ছবি হিসেবে আজও সমাদৃত। ২০০২ সালে লন্ডনের ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের বিখ্যাত পত্রিকা Sight and Sound-এর সমালোচকদের ভোটে তিনি পৃথিবীর সর্বকালীন সেরা পরিচালকদের মধ্যে চতুর্থ স্থানে ছিলেন। জাঁ রেনোয়াঁ ১৯৭৫ সালে Lifetime Achievement of Academy Award পেয়েছিলেন।
রেনোয়াঁ কলকাতায় আসার পর সত্যজিৎবাবুদের সামনে সরাসরি সৃষ্টিশীল ছবির অলংকরণের প্রেক্ষাপট খুলে যায়। তাঁর ছবি তৈরির বৈচিত্র্যময় কুশলতা খুব সামনে থেকে দেখার সুযোগ মেলে সত্যজিৎ রায়, হরিসাধন দাশগুপ্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, বংশী চন্দ্রগুপ্ত বা সুব্রত মিত্রের মতো চলচ্চিত্র-কর্মীদের। জাঁ রেনোয়াঁ তখন গঙ্গাস্নাত বাংলাদেশের রসাস্বাদনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কলাগাছের বাংলা, সবুজে শ্যামলে বাংলা, বাংলার রূপ আর বাংলার সবকিছু। তাই, উনি সত্যজিৎবাবুদেরও পাশে চাইছিলেন আমাদের প্রিয় বাংলার খুঁটিনাটি বোঝার জন্য। আলপনা দেখে তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাঁর The River ছবির শুরুতে উপস্থাপক দিয়ে বলিয়ে দিয়েছিলেন, “In India to honor guests on special occasions, women decorate the floor of their homes with rice flour and water, with this rangoli, we welcome you to this motion picture.”
ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির বিভিন্ন স্মারক বক্তৃতায় জাঁ রেনোয়াঁর উপস্থিতি বাঙালি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মধ্যে একটা মনন তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। সোভিয়েত সিনেমার মাইলস্টোন সের্গেই আইজেনস্টাইন পরিচালিত Battleship Potemkin এই ফিল্ম সোসাইটি দ্বারা প্রথম প্রদর্শিত ছবি। এই ফিল্ম সোসাইটি থেকেই বেরোত ‘চলচ্চিত্র’ বলে একটি পত্রিকা, যেখানে আরো অনেকের মতো সত্যজিৎ রায়ের লেখাও থাকতো। পরবর্তীকালে, তাঁর এই লেখাগুলোর থেকে বাছাই করে সত্যজিৎবাবুর Our Films Their Films (1973) রচিত হয়।
— “এই ছবিটি কার — চিনতে পেরেছো?”
বীরেনদার মৃদুভাষী কন্ঠে মনটা আবার ফিরে গেল বীরেনদার স্মৃতিতে।
— “আইজেনস্টাইন। সের্গেই আইজেনস্টাইন” — আমি অস্ফূট স্বরে বলেছিলাম।
চোখদুটো দীপ্ত হয়ে উঠেছিল বীরেনদার।
— “দেখেছো? ছবিটা?”
—হ্যাঁ — গোর্কি সদনে”।
স্মৃতিতে ১৯৭৯ সাল। স্মৃতিতে বীরেনদার সাথে কথোপকথনের কিছু হারিয়ে যাওয়া মুহূর্ত।
পুনেতে ঐতিহাসিক প্রভাত স্টুডিও ষাট দশকের শেষে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশান ইনস্টিটিউট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভারত সরকারের পরিচালনায় এটা অচিরেই একটা উন্নতমানের চলচ্চিত্র-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এক ঝাঁক তরুণ চলচ্চিত্রকার স্বপ্ন দেখেছিল সিনেমায় গল্প বলার স্টাইলে পরিবর্তন আনতে, form-এ বদল আনতে। ভারতীয় সিনেমাকে এক নতুন ভাষায় অলংকৃত করতে।
৭০-দশকের প্রথমভাগ আমার ছেলেবেলা, ৭০-দশকের শেষভাগ আমার কৈশোরকাল। সময়টা বড় অস্থির ছিল। ভারত-পাক যুদ্ধ, রাতের আকাশে বোমারু বিমানের আনাগোনা, সন্ধেবেলা সারা শহর জুড়ে ব্ল্যাকআউট, উদ্দাম ছাত্র রাজনীতি, নকশাল আন্দোলন, নতুন করে বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তুদের আগমন — সব মিলিয়ে এক অস্থিরতা। আর যত অস্থিরতা বাড়ে, শিল্পীরা তাদের নিজেদের স্বভাববৃত্তে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে। সত্যজিৎ রায়ও এই সময়ে যুব সমাজের অবক্ষয়, লড়াই আর প্রতিবাদী চিত্তলোককে নতুনভাবে প্রকাশিত করেছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী, সীমাবদ্ধ, জন অরণ্য। সত্যজিৎ-কৃত সিনেমার ভাষায় নব্যপ্রজন্মের বাঙালি যুবসমাজ। মৃণাল সেনের Calcutta 71, পদাতিক, কোরাস — তৎকালীন রাজনীতি আর সমাজের অনবদ্য মূল্যায়ন। কিন্তু — সত্যজিৎবাবুর পরিবেশনায় ছিল নব্যবাস্তবতাবাদ, মৃণালবাবু সেই তুলনায় অনেক radical. মৃণালবাবু সম্পর্কে গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক ডেরেক ম্যালকম খুব প্রশংসা করেছিলেন।
ভারতীয় সিনেমা, বিশেষত প্যারালাল সিনেমাকে পশ্চিমী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে-কজন সমালোচক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার মধ্যে ছিলেন এই ডেরেক। ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকা ছাড়াও তিনি British Film Institute থেকে প্রকাশিত Sight and Sound পত্রিকায় ভারতীয় চলচ্চিত্রকারদের নিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখা লিখেছেন। আমি তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম চেন্নাইয়ে “কলাইভারা আরাঙ্গাম” থিয়েটারের প্রাঙ্গণে। ১৯৯০। সেবার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আসর বসেছিল চেন্নাইয়ে। আমার তথ্যচিত্র ‘গগনেন্দ্রনাথ’ ভারতীয় প্যানোরামা বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছিল। সেখানে আমি দেখেছিলাম মাঝবয়সী ডেরেক ম্যালকমকে। সবাই ডেরেককে ঘিরে থাকতো। সবাই মানে যাঁরা ছবি করে নাম করেছেন, অথবা নতুন ছবি করার কথা ভাবছেন। আমি তখন বয়সে খুবই ছোট। ডেরেককে সম্ভ্রম করতাম, সম্মান করতাম। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বের আবরণে তাঁর সাথে গভীরভাবে মেশার সুযোগ হয়নি। সেটা হল অনেক পরে। ২০০৭ এর নভেম্বরে, লন্ডনে।
তখন আমি বিদেশ দপ্তরের হয়ে একটি তথ্যচিত্র করার সুবাদে এখানে ওখানে ঘুরছিলাম। ছবিটি সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’-র প্রাসঙ্গিকতা প্রসঙ্গে। ‘Pather Panchali: A Living Resonance’. একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে চলে গেলাম ডেরেকের বাড়ি। তিনি খুব খুশি মনে ‘পথের পাঁচালী’ ও সত্যজিৎবাবু সম্পর্কে লম্বা একটা interview দিলেন। আর সেখানেই তিনি বলেছিলেন, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেন ছিলেন বেশি radical filmmaker, কিন্তু সত্যজিৎবাবু ছিলেন ‘great story teller’.
ডেরেক ম্যালকম মৃণালবাবু প্রসঙ্গে বলেছিলেন – “Sen has traced the social and political ferment of India with greater resilience and audacity than any other contemporary Indian director.”
ঔদ্ধত্য তো বটেই। শিল্পীর ঔদ্ধত্য। মৃণাল সেন (১৯২৩-২০১৮) যখন যা ছবি করেছেন, তাঁর বিশ্বাসের জায়গা থেকে, আদর্শের জায়গা থেকে। বাণিজ্যিক স্বার্থে তাঁর ছবির মধ্যে সেই মেকি পরিপাটি নাটকীয়তা তিনি আনেন নি। মৃণালবাবু সবসময়েই সমকালীন। সত্তর দশককে তাই তিনি ভারতীয় সিনেমার মুক্তির দশক করে তুলেছিলেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবনায় ছবির মাধ্যমে তিনি দ্বন্দ্বমূলক বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন, সাধারণ লড়াকু মানুষের জীবনসংগ্রামের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বারবার বলতে চেয়েছেন – তিনি অসহায়, সংগ্রামী মানুষদের পাশে আছেন। তাঁদের দিন দিন প্রতিদিনের জীবন আলেখ্যই মৃণালবাবুর ছবির উপাদান হয়ে উঠেছে।
মৃণালবাবু তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী ছবি করেছেন। কোনও বাঁধাধরা গম্ভীর বৃত্তের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেন নি। তাঁর চলচ্চিত্র জীবন শুরু ‘রাতভোর’ ছবিটিকে দিয়ে। ছবিটি আমি কোনওদিনই দেখিনি। প্রিন্ট বা নেগেটিভ কিছুই বোধহয় আর কোনওদিন পাওয়া যাবে না। হয়তো অনেকেই সেই ছবি দেখেন নি। কিন্তু – “বাইশে শ্রাবণ” থেকে “নীল আকাশের নীচে” বা “আকাশ কুসুম” অবধি তাঁর ছবি করার ধারা বেশ কিছুটা নব্য-বাস্তবতাবাদীই ছিল। কিন্তু মৃণাল সেন নিজেকে ভেঙেছেন বারে বারে।
১৯৬৭ সালে ফিল্ম ফিনান্স কর্পোরেশন খুব কম বাজেটে তিনজন চলচ্চিত্র পরিচালককে দিয়ে তিনটি পরীক্ষামূলক ছবি বানাবার জন্য অর্থ সাহায্য করেছিলেন। মণি কাউল “উসকি রোটি” বানালেন। বাসু চ্যাটার্জী তৈরি করলেন “সারা আকাশ”। আর মৃণাল সেন তাঁর “ভুবন সোম” ছবিটির মধ্যে দিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে এক নতুন যুগের সৃষ্টি করলেন – Indian Parallel Cinema বা সমান্তরাল সিনেমা।
মৃণালবাবু টানটান গল্প বলা ভাঙলেন, সিনেমার প্রচলিত ব্যাকরণ টুকরো করলেন, বাস্তবের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বাস্তবময় চলচ্চিত্রের হাত ধরলেন। তিনিই বোধহয় ভারতের প্রথম চলচ্চিত্রকার যিনি পরবর্তী প্রজন্মের আঞ্চলিক ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সাহস জুগিয়েছিলেন – কিভাবে, কত কম খরচে ছবি তৈরি করে সেই প্রকাশিত মাধ্যমকে মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়।
সময়টা অবশ্যই মনে রাখা দরকার। পঞ্চাশ দশকে ফরাসী নবতরঙ্গ (French New Wave)-এর হাত ধরে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র তখন মুক্তমনা সাবালক। ছবি এমনও হয় নাকি? যেন মনে হয়, চলচ্চিত্রের বক্তব্য একটা খামবন্দী চিঠির মাধ্যমে দর্শকদের মনের অন্দরে পৌঁছে দেওয়া? জাম্প কাট, লম্বা লম্বা ট্রলি শট, আলট্রা বিগ ক্লোজ শট – ছবির প্রয়োজনে জাঁ-লুক গদার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, এরিক রোমার, ক্লদ শ্যাব্রল বা রিভেটরা যা মনে হয়েছে – তাই করেছেন। অর্থাৎ চলচ্চিত্র মাধ্যম আর তার চিরাচরিত Neo Realist বা নব্য-বাস্তবতায় সম্পূর্ণ নিটোল বাস্তবধর্মী গল্প বলার মধ্যে আর আবদ্ধ থাকলো না।
মৃণাল সেন আমাদের দেশে বসে সেটাই করে দেখালেন সত্তর দশকের উত্তাল রাজনীতি, কলকাতা জুড়ে সক্রিয় ছাত্র-যুব আন্দোলন, যুদ্ধের হাহাকার – এক বিক্ষিপ্ত সময়ে বসে তিনি বানিয়েছেন কলকাতা-৭১, ইনটারভিউ, কোরাস বা পদাতিক-এর মতো ছবি।
নব্যপ্রজন্মের চলচ্চিত্রকারেরা তখন সাহস পেয়ে গেছেন। এভাবেও সেলুলয়েডে ছবি আঁকা যায়! তখন সেলুলয়েড ফিল্মের একেকটা নেগেটিভ রোলের দাম ছিল প্রায় ১২ হাজার টাকা! ঘড়ঘড়িয়ে ছবি উঠতো ১০ মিনিট। অর্থাৎ একটা ছবি যদি ১৪ রিলের হতো – তবে শ্যুটিং করতে হত প্রায় ৫০ রোল নেগেটিভ। মৃণালবাবু তাঁর অসামান্য সম্পাদনা-সমৃদ্ধ মস্তিষ্ক দিয়ে খুব edited shot নিয়েছেন – যাতে কম negative expose করতে হয়। অর্থাৎ, বাজেটে রাশ। আর – প্রেক্ষাপট তো ছিল তাঁর বাস্তব সেট। চরিত্রগুলোর মধ্যে দিয়ে সটান সাপটা কথায় মৃণাল সেন তাঁর নিজস্ব বক্তব্য বলে গেছেন।
পরের দিকে ‘একদিন প্রতিদিন’ বা ‘খণ্ডহার’ বা ‘আকালের সন্ধানে’-তে তিনি কিছুটা হলেও গল্প বলতে চেয়েছেন, কিন্তু মৃণাল সেনের নিজের ছন্দে সেই ছবিগুলোর পরিবেশনাতেও ফুটে উঠেছিল ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্য। অবশ্যম্ভাবী সমাপ্তির পথে মৃণালবাবুর কোনও ছবিই শেষ হয়নি। তিনি বরাবরই গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে ছবি করেছেন – এবং দাপটের সঙ্গে।
আমার একটা সবুজ রঙের ছেঁড়া ডায়েরী ছিল। তখন ১৯৮০। মৃণালবাবুর বেলতলার ফ্ল্যাটে আমি প্রথম গিয়েছিলাম, বয়স তখন মাত্র ১৭। আমি তখন নাকতলায় ‘Cine South’ নামে একটা সিনে ক্লাবের সাথে জড়িয়ে ছিলাম। সে ক্লাবের সভাপতি ছিলেন মৃণাল সেন, সহ-সভাপতি পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আর নাট্যজগতের আলোকসম্পাতের বিশিষ্ট চরিত্র তাপস সেন। মৃণালবাবুর এক ভাই, কুমার সেন নানাভাবে সেই সিনে ক্লাবকে সমৃদ্ধশালী করার প্রয়াসী ছিলেন। আমার সহকর্মী অলোক ব্যানার্জী এই সিনে ক্লাবটির মূল দেখভাল করত। আর এই ক্লাবেই সভ্যদের মধ্যে ছিলেন আমার সিনেমা জীবনের দুই কারিগর – Mime এর স্বপন সেনগুপ্ত আর স্বনামধন্য সঙ্গীতকার ও চলচ্চিত্রকার মহিনের ঘোড়াগুলি খ্যাত গৌতম চট্টোপাধ্যায় – অর্থাৎ মণিদা।
যাই হোক, বেলতলায় মৃণালবাবুর ফ্ল্যাটে যখন পৌঁছলাম – বাইরের ঘরে বসে অনেক অনেক সিনেমা-সংসারের কথা উনি বললেন। আমার তখন কিশোর বয়স – স্বভাবসিদ্ধ লাজুক। মৃণালবাবু বলেছিলেন, শুধু ভালো সিনেমা দেখলেই হবে? ভালো ছবিও তো বানাতে হবে। আমি ভয় পেয়েছিলাম। অত বড় মাপের মানুষের সাথে তার আগে তো কখনও দেখা হয় নি। অতশত কিছু বুঝতামও না। বোঝবার চেষ্টা করতাম মাত্র। আর না বুঝেই কিছু কিশোরমনস্ক অতি উৎসাহী কাজ করে ফেলতাম – এবং যথারীতি, ওনার বাড়িতেও সেটাই করে বসলাম। সেই ছেঁড়া সবুজ ডায়েরিটা এগিয়ে দিয়ে মৃণালবাবুর কাছ থেকে একটা অটোগ্রাফ চেয়ে বসেছিলাম। মৃণালবাবু সটান ‘না’ করে দিলেন। -- “আমি তো autograph দিই না।“ আমি মনমরা হয়ে পড়েছিলাম। গীতা বৌদি (গীতা সেন) খুব মাতৃস্নেহ-পরায়ণা একজন মহিলা ছিলেন। তিনি বোধহয় সেদিনের আমার সে ব্যথা বুঝেছিলেন। মৃণালবাবুকে বললেন – “আহা – ছেলেমানুষ – একটা সই চাইছে – দিয়ে দাও--"
মৃণালবাবু একবার আমার দিকে তাকালেন। তারপর স্নেহভরে আমার কাছ থেকে ডায়রিটা নিয়ে সই করলেন – মৃণাল সেন। আমি একটু সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেললাম – “ওপরে একটু লিখে দিন না – ‘জয়দীপকে’।" উনি তাও লিখলেন – সঙ্গে ‘শুভেচ্ছা সহ’ কথাটাও লিখে দিলেন। কালের নিয়মে সে ডায়েরি কোথায় হারিয়ে গেছে। কিন্তু হারিয়ে যায় নি সেদিনের সেই মুহূর্তগুলোর স্মৃতি।
স্মৃতি-বিস্মৃতির মাঝে মৃণালবাবু আমার এই ক্রমশ-লেখার মাঝে আবার আসবেন। জীবন আর ছবির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ছবি অনেকেই করেন। ইতিহাস রচনা করেন কজনই বা! মৃণাল বাবু এমনই এক ব্যক্তিত্ব – উত্তরাধিকারী নব্য প্রজন্মের প্রথম উদ্যম আর অনুপ্রেরণা।
সাধারণ অনেক মানুষ হয়তো মৃণাল সেনের নাম শুনেছেন, ছবি দেখেন নি কিন্তু সম্ভ্রম করেছেন। যেদিন উনি মারা গেলেন, আমি অটোতে উঠে কারুর সাথে মৃণালবাবুর প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলাম। কথা শেষ হবার পর, অটোচালক আমায় জিজ্ঞেস করলেন – মৃণাল সেন মারা গেছেন? কখন? আমি অবাক হয়েছিলাম। আমি বললাম – আপনি মৃণালবাবুর ছবি দেখেছেন? উনি আমাকে আরো অবাক করে বলে উঠলেন – “’খারিজ’ দেখেছি। দারুন ছবি। অত বড় নামকরা মানুষটা চলে গেল – আমার তো খুব খারাপ লাগছে – আজকালকার অনেকেই তো মৃণাল সেনের ছবিই দেখে নি – দেখবেন – WhatsApp এ তারাই like করবে বা RIP লিখে তাদের দায়িত্ব পালন করবে।“
আমি সত্যিই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি। মনে হল – এটাই বোধহয় মৃণালবাবু চেয়েছিলেন। হোক না মাত্র একজন – আরো তো বোধহয় আছে কেউ কেউ মেহনতি মানুষ, যারা বুঝেছিলেন – মৃণাল সেন এমনই একজন পরিচালক যিনি তাঁদের মতো সংগ্রামী মানুষের কথাই বলে গেছেন তাঁর ছবিতে। মৃণাল সেন এবং মৃণাল সেনেরা তাঁদেরই পাশে ছিলেন। আমি অটোচালকের নাম জিগ্যেস করলাম। উনি জানালেন – ‘অলোক দাস’।
(ক্রমশ)