কলকাতা ১৯৭১। বয়স তখন সবে আট, সময়কালের গভীরতা মনের আয়নার বাইরে। বাবা-মায়ের হত ধরে যেটুকু শহর পরিভ্রমণ করেছি, নড়বড়ে শহর তখন ঠিকঠাকই লেগেছে। হাওড়ার শিবপুর থেকে রাসবিহারী মোড়ের কাছে মামাবাড়ি — এই পর্যন্তই আমার নিবিড় পৃথিবী। রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে একটা যে ট্র্যানসিশান ঘটছে, শহরের তরুণ ও যুব সম্প্রদায় বেকারত্বে জর্জরিত, হতাশা থেকে যে বারুদের গন্ধ শহরের বাতাস জুড়ে, পরীক্ষা স্তব্ধ, নকশালবাড়ি আন্দোলনে ছাত্র জোয়ার, খিদের জ্বালায় উন্মত্ত পৃথিবী, মুক্তি খুঁজছে বহির্বিশ্ব ভিয়েতনাম, পাশে ছিল নিদ্রাহীন, মুক্তি খোঁজা শহরবাসী, বাংলাদেশে মুক্তি যুদ্ধ, নতুন লক্ষ শরণার্থী, সন্ধ্যে ৬ টায় মঙ্গল শঙ্খধ্বনির জায়গায় আকাশ-উজাড় করা সরকারী সাইরেনের বিপদঘন্টা — এক অন্য পৃথিবী শহরময়। বুঝি নি। তীব্রতা, যন্ত্রণা, হাহাকার, শঙ্কা — আঁচ পেয়েছি টুকরোয়, ঐটুকুই। ছাপ লেগেছিল প্রবীণদের, যাঁরা দুহাত দিয়ে আগলে রেখেছিলেন অঙ্কুরিত প্রজন্মকে।
কলকাতা ৭১। মুখোমুখি পরিচয় ১৯৭১। অনুধাবন করলাম বেশ পরে। তখন কলকাতা নিস্তরঙ্গ। 'মহীনের ঘোড়াগুলি' গান বেঁধেছিল —
"ভেসে আসে কলকাতা, কুয়াশা তুলিতে আঁকাএটা স্মৃতিপটের কুয়াশা তুলিতে আঁকা শৈশবের কলকাতা। শৈশবে বসে দাদা-দিদিদের লড়াই বুঝি নি। ঐ সেই মুক্তি-খোঁজা তরুণ হৃদয়ের পরশ পেয়েছিলাম মহীনের গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের আরেকটি লেখা গানে—
শহরতলীর ভোর মনে পড়ে,
কাঠচাঁপা আর কৃষ্ণচূড়ায়
শৈশব শুধু খেলা করে,
স্মৃতির ভেতর ট্রামের ধ্বনি বিবাগী সুর গড়ে
সেই প্রভাতের ক্যালেন্ডারে পাতায় শুধু ঝরে
কলকাতা, ও কলকাতা।"
"ফিরে আসবো, মা-গো কেঁদো না, ফিরে আসবো...নিংড়ানো সেই লড়াইয়ের প্রেম-অপ্রেম পরে জেনেছিলাম পরাজিত কিন্তু অপরাজেয় কিছু মানুষের সঙ্গ-গুণে। নীরব কত ঘটনার সুপ্ত ইতিহাস। আর ঐ সময়ের কলকাতা সিনে অ্যালবামে পাতা উল্টিয়ে ফিরে দেখা কিছু সিনেমায়। সত্যজিৎ রায়ের "প্রতিদ্বন্দ্বী" সিনেমায় প্রোটাগনিস্ট চরিত্র সিদ্ধার্থ (অভিনয়ে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়) ইন্টারভিউ বোর্ডে যখন নির্ভয়ে উত্তর দেয় যে বিগত দশকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষের লড়াই, যা চাঁদের দেশে মানুষের পদার্পণের চেয়েও আরো বড় ঘটনা।
এই আলপথ বেয়ে আসবো, মা-গো কেঁদো না, ফিরে আসবো"
প্রশ্নকর্তা সটান জিজ্ঞেস করে — Are you a Communist?
বেশি কিছু বলতে হয় নি সিদ্ধার্থকে। শহরের জনস্রোতে হাজার পথ-চলতিদের ভিড়ে পা মেলানো সিদ্ধার্থকে দেখে দর্শকরা বুঝে নিয়েছিল, সিদ্ধার্থর চাকরিটা হয়নি। Uncompromising শহরের নব-চরিত।
এ শহরে রাজনৈতিক ছবি প্রকৃত অর্থে শুরু করেছিলেন মৃণাল সেন। সোজাসাপটা কথা বলা, সোজাসাপটা লড়াই, যন্ত্রণা, হাহাকার। ঋজু চরিত্রগুলো নির্ভিক, জীবনবোধ নির্ভর, রাজনৈতিক সচেতন। পঞ্চাশ বছর আগের সেই কলকাতার প্রতিরূপ এখনও জীবন্ত, জ্বলজ্বলে এক কম্পমান দীপ্তিময় শহরের ইতিবৃত্ত। সেনের ক্যালক্যাটা ট্রিলজি। আরো না হয় পিছিয়ে যাই আরো পাঁচটা বছর। কলকাতাকে পাশে রেখে এক ঝলক ঘুরে দেখা যাক সুদূর প্যারিস।
১৯৬৮-র প্যারিস। এবারও সীন নদীর দুপাশ জুড়ে বসন্ত নেমেছে। এবারও সবুজ পাতা দেখেছে প্যারিসবাসী। ঘ্রাণ নিয়েছে নতুন ফোটা ফুলের ডালির। কিন্তু এবারের বসন্তে রক্ত দেখল শহর। প্রেসিডেন্ট দ্য গলের নৈরাজ্যবাদের অপসারণের দাবিপে সবোঁ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে তুমুল ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার সেই পরাক্রমী অগ্নিশিখায় স্নান করেছিল প্যারিস ছাড়িয়ে বিশ্ববাসীও। সমকালীন সেই প্রতিচ্ছবি ক্যানভাসে রাঙায়িত করেছিলেন স্পেনীয় শিল্পী জুয়ান মিরো। শুধু কিছু হাত — স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট । জুয়ান মিরো এভাবেই চিত্রিত করছিলেন তাঁর অঙ্কিত ক্যানভাস, সমকালীন ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে এটাই ছিল তাঁর শিল্পীমনের বহিঃপ্রকাশ। সমকালীন রাজনৈতিক পটভূমিতে মুক্তিকামী ছাত্র আন্দোলনের সেই অপরাজেয় চেতনার সমর্থনে মিরো-অঙ্কিত ক'টা হাতের ছবি ফিরিয়ে এনেছিল প্রাচীন স্পেনীয় গুহা আলতামিরায় মানব প্রজাতির আঁকা প্রথম চিত্রগুচ্ছ — ক'টি মাত্র হাত। নির্জন সেই পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবার আগে আলতামিরার একাকী মানবগোষ্ঠী তাদের হাতের ছাপে পরবর্তী সভ্যতাকে জানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, তারাও একদিন এই পৃথিবীর বুকে জন্মেছিল, বেড়ে উঠেছিল এবং মূত্যুর আগে পর্যন্ত ঘ্রাণ নিয়েছিল প্রকৃতির মুক্ত সৌরভের।
সে সময়ের রাজনৈতিক প্যারিস যেমন নানাভাবে ব্যক্ত হয়েছে রং-তুলিতে, সিনেমা-নাটক-গানে-গল্পে-কবিতায় অথবা আর নানান শিল্পসজ্জায়, কলকাতার উত্তাল- করা সত্তরের সাতসকালও ঘুরে ফিরে এসেছে মানুষের মনে লেখা চিঠিতে, শিল্পীদের মনের ডাকবাক্সে। পঞ্চাশ বছর আগে কলকাতার রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট সেলুলয়েডে প্রকাশ করার যে তাগিদ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিল 'সবসময়ের সমকালীন' মৃণাল সেন-কে, তার আগের বছর-বিশেক পেরোনো শহর কলকাতার রাজনৈতিক চিত্র বদলে গেলেও, অস্থিরতা পঙ্কিলময় হয়ে উঠলেও আর কই মৃণাল সেন? কনটেন্ট বা কনসেপ্টগত যে পরিবর্তন 'ভুবন সোম'-উত্তর ভারতীয় সিনেমায় নতুন পথ দেখিয়েছিল — সেই মরমে হাজার তরুণ সিনেমা-ভাবুক স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল নতুন আঙ্গিকে সিনেমা করার, নতুন ধারায় মুক্ত-পথে নব-তরঙ্গের সিনেমা দর্শনের। সাহস যুগিয়েছিলেন মৃণাল সেন। সে সাহসের সহিসও ছিলেন তিনি। আজ কই আর নতুন মৃণাল সেন? সেই তো তিনি আলতামিরার গুহামানবের মতো সেলুলয়েডে তাঁর হাতের ছাপ রেখে গিয়েছেন, সৃষ্টিতে অমলিন কলকাতা চিত্র-ত্রয়ী গ্রথিত করে দিয়ে গেছেন পঞ্চাশ বছর আগে — 'ইন্টারভিউ', 'কলকাতা-৭১' আর 'পদাতিক'-এর মধ্যে দিয়ে।
"আমি কলকাতায় তৈরি হয়েছি। কলকাতা আমাকে আকার দিয়েছে, আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, আমাকে হতাশ করেছে, আমাকে কাঁদিয়েছে, আমাকে হাসিয়েছে, ভাবিয়েছে, আমাকে উস্কে দিয়েছে।" — মৃণাল সেন বলেছিলেন জার্মান চলচ্চিত্রকার রেনার্ড হফ-এর তৈরি মৃণালবাবুর জীবনী-নির্ভর ছবিটিতে। মৃণাল সেনের সমসাময়িক সংবেদনশীলতা, যা তাঁর কলকাতায় তাঁর অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণে সেই অস্তিত্বরই প্রকাশ ঘটেছে। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে পরতে পরতে মৃণাল সেন সাজিয়েছেন তাঁর মনের আয়নায় ধরা দেওয়া শহরটিকে। রাতভোর থেকে জীবনভোর। তাঁর কলকাতা-ত্রয়ী ছবিগুলো পঞ্চাশ বছর ছুঁলো। কিন্তু এখনও কতই না প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
মৃণাল সেনের বড় প্রিয় শহর ছিল কলকাতা। প্রিয় বিষয়ও বটে। কলকাতার রোম্যান্টিসজম তাঁকে কখনই টানে নি, টেনেছে সংঘাত-লড়াই-বাস্তব রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিতে মুখোমুখি আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, ছাত্র-যুব রজনৈতিক অনুসন্ধান, শহর-মেয়ের অবস্থান। এই শহরের সমাজ-রাজনীতির মতোই তিনি ছিলেন ভাইব্রান্ট, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ও আধুনিকতার সংঘাতে নতুন কোনো তৃতীয় সূত্রের সন্ধানী।
পঞ্চাশ বছর আগে মৃণাল সেনের বয়স ছিল আটচল্লিশ। ১৯৭১-এর মৃণাল সেনকে ভাবা যাক। ঠিক তার আগের তিনটি বছর সিনেমাকে নিয়ে নতুনভাবে প্রকাশ করার আকাশ কুসুম ভাবনাকে এক পূর্ণতা এনে দিয়েছে। ভারতীয় ছবির জগতে বেশ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে তাঁর 'ভুবন সোম'। সত্যজিৎ রায়ের ১৯৫৫-র ক্ল্যাসিক 'পথের পাঁচালি' যদি দেশীয় নব্য-বাস্তবতাবাদী সিনেমার একটা ল্যান্ডমার্ক হয়, ১৯৬৯-এর মৃণাল সেনের 'ভুবন সোম' আধুনিক ভারতীয় নবতরঙ্গ সিনেমার নিঃসন্দেহে আর এক ল্যান্ডমার্ক। 'পথের পাঁচালি'-র পরের বছরগুলোতে বাংলার দর্শকরা বেশ কিছু ভালো সিনেমা পেয়েছে, সত্যজিৎ-এর ফি বছর একের পর এক ক্ল্যাসিক, ঋত্বিকের দেশভাগের যন্ত্রণার নির্যাসে তৈরি হৃদয়-উজাড় করা সমকালীন ভাবাবেগের প্রতিচ্ছবি। একই সিনেমা-নৌকোয় পাড়ি দেওয়া মৃণাল তবু স্বতন্ত্র। নিমতলা শ্মশানঘাটে ১৯৪১ এর রবি-প্রয়াণের অগ্নিদাহে অষ্টাদশের কিশোর মৃণাল কোনো রাবীন্দ্রিক-সত্তার অনুগামী না হয়ে বরং পরখ করেছিলেন ভিড়ে-ঠাসা রবি-চিতার পাশে দাহ করার এক টুকরো আগুনের জন্য সন্তান-হারা এক পিতার বুক-ভরা কান্না আর হাহাকার। মনের লিপিতে সে দৃশ্য ঠাঁই দিয়েছিলেন মৃণাল সেন। তিনি বুঝেছিলেন — সাধারন মানুষের কাছে নিজেদের সমস্যা বা যন্ত্রণা অনেক গভীরের — সেখানে রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বের মৃত্যুক্ষণও খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। অনেক পরে, সেই বাইশে শ্রাবণ ফিরে আসে ঐ নামের ছবিটিতে — যেখানে রবীন্দ্র-মৃত্যুর দিনে আশা নিয়ে ঘর বেঁধেছিল ছবিটির দুই দুঃস্থ, বিধ্বস্ত চরিত্রেরা।
দিনগুলো এভাবেই এসেছিল মৃণালের ছবিতে। কোনো সাজানো পরম্পরা নয়, নব্যবাস্তব গল্প-বিন্যাস নয়, মৃণাল সেন পথ দেখিয়েছিলেন 'সিনেমা এমনভাবেও হয়!' ষাট দশকের শেষে আন্তর্জাতিক সিনেমার চিরাচরিত ভাষা তো ভেঙ্গেচুরে গেছে। নিও-রিয়্যালিস্ট ছবিগুলোর নিজস্ব চরিত্র তো বদলেছেই, সাথে সিনে-ব্যাকরণকে ভাসিয়ে দিয়েছে মাত্র তার বছর দশেক আগের ফরাসী নবতরঙ্গের ঢেউ। এমন স্বাধীনভাবে রূঢ় সত্য স্পষ্টভাবে পার্সোনালাইজড অনুভূতিতে ব্যক্ত করার সিনেম্যাটিক স্পর্ধা মৃণাল সেনেরই হাত ধরে ভারতীয় সিনেমায় এসেছিল — এতে কোনো দ্বিমত নেই।
ষাটের দশকের মাঝের শেষ পথে খোসলা কমিটির একগুচ্ছ প্রস্তাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে নতুনভাবে দেশীয় সিনেমার পরিকাঠামো তৈরি করতে নানান ভাবনার সন্ধানে ছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়। একটা 'ঢেলে সাজানো'র ব্যাপার ছিল, তাগিদ এসেছিল আঞ্চলিক ছবিগুলোর জন্যও বিদেশে প্রদর্শন আর বাজার উন্মুক্ত করবার। নতুনভাবে সিনেমা আঁকার জন্য বৎসরান্তে এক ঝাঁক শিল্পীদল তখন পুনের ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের নান্দনিক রূপশিক্ষার কথকতা জানতে সক্রিয় হয়েছিল। অনেক রকম হরেক ভাবনার ঘাত-প্রতিঘাতে গড়ে উঠছিল সিনেমার প্রচলিত গ্রামার ভাঙার চিন্তা। পুনের ইন্সটিটিউট তো বটেই, এই পুনেতেই ফিল্ম আর্কাইভে ঠাঁই পেয়েছিল দেশি-বিদেশি নানান ছবির সম্ভার। শহর আর শহরতলিতে তৈরি হয়েছিল উৎসাহী সিনে ক্লাব। সুচিন্তন সাহিত্যপাঠ, সঙ্গীত ও কলাচর্চার প্রাসঙ্গিকতায় নবনিযুক্ত হল আন্তর্জাতিক সিনেমা-পাঠের উৎসাহ। সরকারি ব্যবস্থাপনায় তৈরি হয়েছিল ফিল্ম ফিনান্স কর্পোরেশান। বর্তমানের ন্যাশানাল ফিল্ম ডেভেলাপমেন্ট কর্পোরেশানের পূর্বসূরী। নতুনভাবে সাজানো হল ডাইরেক্টরেট অফ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালস। ঢেলে সাজানো সেন্সর বোর্ড। আঞ্চলিক সিনেমাকারেরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে নতুনভবে নতুন কিছু করে দেখানোর।
আধুনিক পৃথিবীও অনেকটাই বদলে গেছে, বদলে গেছে বাংলার তিন সিনেমা দিকপালের মননের বসুন্ধরা। সত্যজিৎ ডি সিকা-জাভাত্তিনির নিও-রিয়্যালিস্ট পথ প্রদর্শিত নব্য-বাস্তবদাবাদী ছবির পরিভাষাকেই প্রকাশ করেছেন তাঁর ছবির মধ্যে দিয়ে, যদিও 'অরণ্যের দিনরাত্রি' পরবর্তীকালে ছবির বিষয়-ভাবনায় কিছুটা সমকালীনতা আনার চেষ্টা করেছিলেন। '৭০ দশকের বাঙালি যুব-সম্প্রদায় রাজনৈতিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। কলকাতার বাতাসে বারুদের পোড়া ঘ্রাণ, আরেকদফা উদ্বাস্তু গৃহহারাদের অস্তিত্বের সঙ্কট, বেকারত্ব, শহরের ওপর দিয়ে প্রাণ জেরবার করা ভারত-পাক যুদ্ধের কলরব, আরেকদিকে অর্থ-প্রাপ্ত মধ্যবিত্তদের ভোগবিলাসের উচ্চাভিলাষ, শহরসমাজ জোড়া-ভাঙার খেলা সাথে দোসর নিয়ন্ত্রণহীন লাগামছাড়া প্রশাসনিক রক্তচক্ষু — সব মিলিয়েই আমাদের শহর তখন ফুটছে। ফুঁসছে রাজনীতি। ছাত্রসমাজ। কায়িক চাকবিকারিরা, শহরতলির শ্রমিকশ্রেণী। লড়াইয়ের মনন খুব স্বাভাবিক ছন্দেই আলিঙ্গণ করে নিয়েছিল শহরবাসী, তাঁদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার চিন্তা-সাথী করে।
হাজরা মোড়ে প্যারাডাইস কাফেতে চিন্তার আদান-প্রদানকারী দিনগুলো মৃণাল সেনরা এমনই দেখেছিলেন। ব্রিটিশ-শাসন পরবর্তী কলকাতাকে, যুদ্ধ-পরবর্তী কলকাতাকে, ওপার বাংলা থেকে চলে আসা লক্ষ মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই — এসবের মধ্যেই নতুনভাবে শিল্পভাবনা বিকশিত করার তাগিদে কলকাতা তখনও ফুটছিল। ফুঁসছিল। গণনাট্য সঙ্ঘের সংগ্রামী সঙ্গীত, নাটক আর সাহিত্যচর্চা এভাবেই 'সিন্থেসিস'এর মতো তৃতীয় কোনো সূত্রের সন্ধান দিয়েছিল যুব-সম্প্রদায়ের ভাবনাবহুল এক বৃহৎ স্পেসকে। নিমাই ঘোষ বোধহয় প্রথম সাহসী সেই চিত্রপরিচালক যিনি 'ছিন্নমূল' করার সাহস পেয়েছিলেন, দেশহীন শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর। ছবির মধ্যে দিয়ে এমন অ-বানিজ্যিক বিষয়কে যে ব্যক্ত করা যায়, সেই সাহসও যুগিয়েছিলেন অন্য ভাবনায় স্বপ্ন দেখা সিনেমা প্রজন্মকে। সেই সময়ে সে ছবি ছিল সমকালীন, সময়ের ইতিহাসকে জানান দিয়ে যাওয়া অনুসন্ধানী তথ্য বৈচিত্রকে। কিন্তু ছবির ভাষা ন্যারেটিভ, নিও-রিয়্যালিস্ট অ্যাপ্রোচ থেকেই নির্মিত হয়েছিল। সময়কাল স্বাধীনোত্তর ভারত, স্থান শহর কলকাতা, সন ১৯৪৯।
এখনকার সন ১৯৭১। স্থান - সেই শহরই। কলকাতা। সত্যজিৎ-এর 'প্রতিদ্বন্দী'তে সিদ্ধার্থ ইন্টারভিউ বোর্ড কর্তাকে মুখের ওপর সটান বলে আসার সাহসী - চাঁদে মানুষ যাবার থেকেও তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভিয়েতনামে সাধারণ মানুষের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই। আর মৃণাল তখন তাঁর 'ইন্টারভিউ' ছবিটির প্রস্তুতিপর্বে। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যাওয়া সেই সময়ের সমকালীন সবসময়ের জন্যেই চিরকালীন, তাই আজ সে ছবি মৃণালবাবুর ক্ল্যাসিক পর্য্যায়ভুক্ত। পরিচালকের মতে এটি ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার সম্পর্কিত একটি চলচ্চিত্র, প্রতিষ্ঠাবিরোধী, মধ্যবিত্ত ভীরুতা আর বেকারত্বের সমস্যাকে ছুঁয়েছে। দু বছর আগেই শেষ করেছিলেন 'ভুবন সোম'। একসাথে তিনটি তিন ধারার ছবি প্রযোজনা করেছিল ফিল্ম ফিনান্স কর্পোরেশান। মণি কাউল করেছিলেন 'উসকি রোটি', বাসু চ্যাটার্জ্জী করেছিলেন 'সারা আকাশ' আর মৃণাল সেন তাঁর কাল-অতিক্রমী ছবি 'ভুবন সোম'। সিনেমা ভাষা ভাঙার কাজ প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল সে বছর থেকেই। মুক্ত মনে নিজের ভাবনা অনুযায়ী সিনেমা সাজানোর সৌজন্যে ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমাধারা। মৃণাল একটু পরে আরো নতুন কিছু ভাবছিলেন। এমন কিছু যা ভারতীয় ছবির ফর্মের দিক থেকে নতুনত্ব আনবে, বৈচিত্র্য আনবে। যেমন ব্যাকরণ-ভাঙা কাজ বছর পঁচিশ আগে ফরাসী সিনেমায় পথ দেখিয়েছিল 'কাইয়ে দ্যু সিনেমা'র প্রতিবাদী সদস্যগোষ্ঠী - জাঁ লুক গদার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, জ্যাক রিভেটদের হাত ধরে। সমাজ আলাদা, রাজনীতি আলাদা, অর্থনীতি বা সাংস্কৃতিক পৃথিবীও আলাদা। কিন্তু সিনেমার ভাষা তো সার্বজনীন, সময়ের হাত ধরে পায়ে পায়ে এগিয়েছে, ভেঙেছে, নতুন ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে সিনেমাকারদের শিল্পরূপ। কম্যুনিকেশানের আধারটাকে উল্টেপাল্টে নেড়েচেড়ে দেখার একটা চেষ্টা। এই প্রক্রিয়াটাও যে একটা কম্যুনিকেটিভ ন্যারেটিভ স্টাইল হতে পারে, ভারতীয় সিনেমায় সেই সাহস প্রথম দেখালেন মৃণাল সেন। কোন অতিবাস্তবতা নেই, সোজাসুজি গল্পবিন্যাস নেই, সরাসরি বক্তব্য দর্শকদের সরাসরি বলা, সরাসরি ভণিতাহীন রাজনৈতিক অবস্থা, কোলাজধর্মী অনেক কথা প্রকাশ করার সুষম সমাহারে এই সত্তর দশকেই আবার নিজেকে ভাঙলেন মৃণাল। তাঁর কলকাতা-ত্রয়ী সিরিজেই তিনি তৈরি করলেন নতুন এক কাঠামোহীন ন্যারেটিভ — যা একান্তভাবেই বৈপ্লবিক, যা একান্তভাবেই মৃণাল সেনিয়। এর জন্যই 'সাইট অ্যান্ড সাউন্ড' ম্যাগাজিনে সমালোচক ডেরেক ম্যালকমের নেওয়া মৃণাল সেনের সাক্ষাতকারে শীর্ষকে লিখেছিলেন 'দ্য গেরিলা ফাইটার' হিসেবে।
সত্যজিৎ-এর 'তিন কন্যা' তিনটি ভিন্নধর্মীয় রাবীন্দ্রিক গল্পের সমাহারে এমন এক সম্পূর্ণ কাহিনীচিত্র যা প্রায়োগিক মৌলিকতা এনেছিল বাংলা ছবিতে। মৃণালের 'কলকাতা ৭১' সেজেছিল এমন চারটি ভিন্ন গল্পের সমাহারে। ভিন্ন গল্প। ভিন্ন পরিসর। কিন্তু একটা সম্পূর্ণতা ছিল বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প দিয়ে শুরু, দ্বিতীয়টা প্রবোধ স্যান্যালের 'অঙ্গার' গল্প অবলম্বনে, পরের দুটি সমরেশ বসু ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত। গল্প না বলে ঘটনার পর্য্যায়ক্রম বলা যায়। চার কাহিনীর সমাবেশে পূর্ণতা পেয়েছিল নকশাল আন্দোলন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ছাত্র যুব আন্দোলন, ক্ষুধার রাজ্যের গদ্যময়তা, বেকারত্ব, উদ্বাস্তু সমস্যা, উচ্চবিত্তের নিস্পৃহতা, অসহায়তা আর মুক্তি কামনায় মানুষের এক গতিময় লড়াই।
কলকাতার মধ্যে একটা ভাইব্রেন্সি খুঁজে পেলেন মৃণালবাবু। একটা স্পিরিট। একটা ফোর্স। কারণ একাত্তরের কলকাতা তাঁকে সেই রসদ জুগিয়েছিল। তাই মৃণাল সেন শহরের প্রতি দায়বদ্ধতা খুঁজে পেয়েছিলেন সমাজ ও রাজনৈতিক বৈচিত্র্যর মধ্যে। রোম্যান্টিক রাজনৈতিক আশ্রয় এড়ানো চিরকালীন সেই কলকাতকেই খুঁজে বেড়িয়েছিলেন সমকালীন শহরবৃত্তের মধ্যে। কলকাতা-ত্রয়ী সিরিজের পর পঞ্চাশ বছরের মৃণালের সেই রচিত ও গ্রথিত কলকাতা আজও আছে সেই কলকাতাতেই।
(ক্রমশ)