• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | প্রবন্ধ
    Share
  • সব কিছু সিনেমায় : জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
    | | | | ৫ | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩


    || ৫ ||

    নবনীতাদির সাথে কিছু স্মৃতি

    বশেষে বৃষ্টি এল। কোপাই নদীর ধার ঘেঁষে বোলপুরের শালবনে। দুটো চোখ আবেশে বন্ধ করে মুখ তুলে দিলাম কালো-ছায়া মেঘের পানে। দুটো হাত প্রসারিত করে শ্রাবণের শেষ বৃষ্টির জলকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলাম। মনটা বড় পাগল হল।

    একটা ছাউনি বানানো হয়েছিল নদীর ধারে। বন্ধুরা সব টানলো আমায় ছাউনির তলায়। রাঢ়-বাউলের দরাজ কন্ঠে গান এলো বেশ।

    “বারে বারে আর আসা হবে না —
    এমন মানব জনম আর পাবে না।।”

    সেদিন ভোর-সকালেই পৌঁছে গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে। অমর্ত্যবাবু এসেছেন। আর আমাদের বেশ পরে, শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন নবনীতাদি। সাথে বড় মেয়ে অন্তরা, বড় জামাই প্রতীক আর দিদির তখন একমাত্র নাতনি। দিদির বড় আদরের।

    নবনীতা দেব সেনের ওপর তথ্যচিত্র। প্রামাণ্য তথ্যচিত্র। বড় ছবি, কেটেকুটে একটা ছোট ভার্সান। সাহিত্য একাডেমির জন্য তখন ছবিটি পরিচালনা করছিলাম আমি আর আমার সহ পরিচালক অলোক। এতদিন বাদেও ছবিটা যখন আবার আর বারবার দেখি, আমার মনের অলিন্দে, জাফরি কাটা ঝিল্লিতে, খোলা আর বন্ধ জানলায় ফাঁকফোকর আর আলো ছায়ায় ভিড় করে আসে ছবিটির দীর্ঘ নির্মাণকালে কত না মানুষের থেকে পাওয়া শুভক্ষণ। প্রথমেই মনে আসে সুনীলদার কথা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন সাহিত্য একাডেমির সভাপতি। ২০১২ সাল হবে। আমাদের অভিলাষ অতীন বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে সাহিত্য একাডেমির জন্য যদি একটা ছবি করা যায়। সাতসকালে ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্সের ‘পারিজাত’ এ পৌঁছে গেছিলাম সুনীলদার বৈঠকখানায়।

    সুনীলদার সাথে তারও অনেক আগে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে বহু আগে। ‘মহিনের ঘোড়াগুলি’র গৌতম চট্টোপাধ্যায় (মণিদা)র হাত ধরে সিনেমার বর্ণপরিচয় ঘটেছিল আমাদের। ১৯৮০ সালে ‘নাগমতী’ ছবিতে। আর ঐ সময়েই মণিদার এক মেন্টার দীপক মজুমদার দীর্ঘকালীন বিদেশ-থিতু পরিহার করে নাকতলায় মণিদার বাড়িতেই উঠেছিলেন। দীপক মজুমদারের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন সুনীলদা, বেশ কয়েক দশক আগে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা প্রকাশনার সময় থেকেই। ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য দীপকদার ছুটি শীর্ষক প্রবন্ধগুচ্ছ ধারাবাহিকভাবে বেরোতো। আর সেই লেখার পাণ্ডুলিপি সুনীলদার কাছে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব ছিল আমার আর অলোকের।


    সুনীলদা সেদিন, আসলে অনেকদিন বাদেই, আমাদের চিনতে পারলেন অথবা চিনতে পারলেন না। কোনো তফাৎ নেই। এমন কত নির্জন মানুষকে নীরবে নানাভাবে উৎসাহিত করে গিয়েছিলেন সুনীলদা। উনি বললেন, অতীনবাবুর ওপর অন্য কেউ একজন কোনো তথ্যচিত্র করছেন। নবনীতা দেব সেনের ওপর একটি ছবি করার কথা সাহিত্য একাডেমির চিন্তায় আছে, কিন্তু নবনীতাদির পছন্দসই পরিচালক পাওয়া যাচ্ছে না। সুনীলদা জিজ্ঞেস করলেন যে আমরা রাজি কিনা। সানন্দে সাগ্রহ দেখালাম, কিন্তু জানতাম না, নবনীতাদির পছন্দের সেই পরিচালক আদৌ আমরা হতে পারবো কিনা! খসখস করে দু-লাইনের চিঠি লিখে দিলেন সুনীলদা, আর সেই টুকরো কাগজ নিয়ে অদম্য উৎসাহ সঙ্গী করে আমরা তৎক্ষণাৎ পৌঁছে গেছিলাম নবনীতাদির বাড়ি ‘ভালো-বাসা’য়।

    হিন্দুস্থান পার্কের ‘ভালো-বাসা’ আক্ষরিক অর্থেই শুধুমাত্র ‘সু-গৃহ’ নয়, এই বাড়ির শরীরী ভাষায় পলকে পরতে স্নেহাচ্ছন্ন ভালোবাসা। আগলহীন প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়েও প্রস্তাবিত ছবিটিতে নিজেদের ভাবনার সারল্য ও স্বচ্ছতা ঠিকঠাক ব্যক্ত করলাম, দিদির পরম স্নেহের উষ্ণতায় আমরা অচিরেই যেন পরিবারের সদস্যই হয়ে গিয়েছিলাম। অন্তরা, নন্দনা আর পালিতা কন্যা শ্রাবস্তী, কানাইদার হাসিমুখে তৈরী করা চায়ের পর চা, আর ‘সই’ এর সদস্যা — সবাই মিলে আমাদের নানাভাবে নানা সময়ে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। সবার মিলিত প্রয়াসেই ক্যামেরা ক্যাসেটে বন্দী হলো নবনীতাদির জীবনের চেনা-অচেনা কাহিনী, স্বকন্ঠে স্বরচিত সরস কবিতাগুলো, তাঁর জীবনের নানান অভিজ্ঞতা, ভালো লাগা আর ভালো-বাসার স্মৃতি মুহূর্ত-পরিক্রমা।

    ‘নবনীতা’ নামটি রেখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। আর তাঁর সেই শান্তিনিকেতনে অমর্ত্য-গৃহের সামনে বেলায় এসে দাঁড়ালো নবনীতাদির গাড়ি। আমরা পুরো ইউনিট নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম বাড়ির ভেতরে, বাড়ির বাইরে। অমর্ত্য বাবুর শান্তিনিকেতনের বাড়িটি বেশ সবুজ। কাচের ফ্রেমে সাবেকী দরজা জানলার রং সবুজ। বাগানের রং সবুজ। বাড়ির পেছনে এক সুবৃহৎ লন, সবুজে সবুজ। অমর্ত্যবাবু নবনীতাদির কাজ নিয়ে বলতে গিয়ে বারবার বলছিলেন, যেটা তাঁর কাছে বিস্ময়কর এবং যা পড়ে তিনি অভিভূত — তা হল সংস্কৃত- উপাখ্যানগুলোর আধুনিক রূপান্তর, নবনীতাদির লেখনীতে রামায়ণের composition.

    এ কথাটি অনেকেই বলেছেন। নবনীতাদির লেখা ‘সীতা থেকে শুরু’ দিয়েই শুরু করেছিলেন যশোধরা বাগচী। যশোধরাদির বহু আগে থেকে অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন নবনীতাদি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যখন প্রথম ‘উইমেন স্টাডিজ’ বিভাগীয় অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত হলেন, নবনীতাদিই ছিলেন তাঁর প্রধান সহ-রূপকার। নবনীতাদির মানসিক দৃঢ়তার কথা যশোধরাদি বারবার বলেছেন, বলেছেন দিদির অসাধারণ humour sense–এর কথা। জীবনের নানান সুখ-দুঃখের মাঝেও নবনীতা দির মনটাও ছিল যেন সবুজে সবুজ।

    নাতনীর ছুঁড়ে দেওয়া লাল গোল প্লাস্টিকের বল অমর্ত্যবাবু ক্যাচ নিতে গিয়ে ফস্কালেন। যদিও দু-তিন বারের চেষ্টায় অমর্ত্যবাবু তাঁর নাতনি (অন্তরার মেয়ে)-কে বলটি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বেশ মজা হল গ্রুপ সিকোয়েন্সটায়। পারিবারিক সরস আলোচনা হল বেশ কিছুক্ষণ। ক্যামেরা বন্দী হল।

    পুরুষ: ঐ দিন সন্ধ্যারাতে
            কোকিলের স্বর
    নারী: ঐ দিন চন্দ্রহীন
            রাত্রি দ্বিপ্রহর।।

    নবনীতাদির পাশে বসে নন্দনা তাঁর মায়ের লেখা কবিতা পড়ছেন, পাঠ করছেন, কবিতাটির ইংরাজি তর্জমা সাবলীলভাবে প্রকাশ করছেন, মায়ের কাছ থেকে বুঝে নিতে চাইছেন তাঁর জীবন দর্শনকে। এই পুরো সিকোয়েন্সটাই আমরা শ্যুটিং করেছিলাম নবনীতাদির ‘ভালো-বাসা’য় দোতলায় তাঁর প্রিয় বৈঠকখানায়। এ ঘরে কত না দিন কত না কত বিখ্যাতদের নিখাদ আড্ডা হয়েছে — বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, মানিক, আশাপূর্ণা দেবী, বুদ্ধদেব বসু, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত থেকে নিশ্চয়ই হালফিলের প্রথিতযশারা। ‘সই’ এর কর্মদপ্তরও ছিল এই ঘরে। এক যোগে এত সাহিত্য-সদস্যা এই সাক্ষাতে আসতেন, আমাদের ক্যামেরা প্লেসমেন্টে খুবই অসুবিধে হয়েছিল। তাই, ছোটো ছোটো করে Compose করতে হয়েছিল ‘সই’ এর মিটিং এর দৃশ্য। কিন্তু পরিবেশটা এতটাই দরাজ ছিল, যে সেই আবহাওয়ায় আমাদের ক্যামেরাও যেন নিজস্ব গতি আর ছন্দ খুঁজে পেয়েছিল।

    সেবার ‘সই’ এর বইমেলা। ICCR-এর প্রেক্ষাগৃহে নবনীতাদির আহ্বানে এসেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী থেকে সুচিত্রা ভট্টাচার্য এবং আরো অনেকে। নবনীতাদির ‘সই’ যদি হয় নারীবাদী প্রতিচ্ছবির এক সম্পূর্ণ অবয়ব, আবার ‘জেরুজালেম টেলিভিশনে’ দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনিই তো বলেছেন ’৭০ দশকের কলকাতায় ঘটে যাওয়া র‍্যাডিক্যাল বামপন্থী আন্দোলনের কথা। অর্থাৎ জীবনের বৃত্তে ঘটে যাওয়া যা কিছু নতুন, যা কিছু তাঁর লেখনীচিত্তকে ব্যক্ত করতে সাহায্য করেছিল, সাদরে তিনি তা গ্রহণ করেছেন।


    পালিতা কন্যা শ্রাবস্তী এক অতি দুর্লভ জিনিষ আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। ৮ মি. মি.-এ তোলা মুভি রীল, যেখানে ধরা আছে, নবনীতাদির অতি শৈশব। চেন্নাইয়ে প্রসাদ স্টুডিওতে পাঠিয়ে কোনোক্রমে তা ভিডিও রূপান্তর করা হয়। বছর দুয়েকের নবনীতাদি। বাবা নরেন্দ্রদেবের ভালোবাসার ক্যামেরা-মোড়া তরতরিয়ে ছুটে চলা অতি শৈশবের নবনীতা। বহু পুরোনো সেলুলয়েড স্ট্রিপের একটা নিজস্বতা আছে, সাইড ফ্রেমগুলো নিভু নিভু কালচে প্রলেপের দপদপানি, আর অ-সম্পাদিত rush print-এ প্রতিটি শটের শেষে shutter বন্ধের flash। এমনিতেই সেলুলয়েড মুভি স্ট্রিপ আমাদের কাছে খুব নস্ট্যালজিক, হারিয়ে যাওয়া বা বহু পুরোনো চলমান মানবজীবনকে চোখের সামনে মুহূর্তে হাজির করে। আর সেই মুভি আমাদেরও আচ্ছন্ন করেছিল, অবাক করেছিল, দু বছরের নবনীতা মেমাবৃত পোষাক পরে ঝরনা ধারার জল ছুঁয়েছেন, ফুল ছুঁয়েছেন, পাখি দেখেছেন, আর পেছনে বেশ আকাশ- আকাশ ভাব। অর্থাৎ, মানবজীবনের সাথে primodial force-র জন্মগত সম্পর্কগুলো যেন সেই ছোটোবেলাতেই স্পর্শ করে ফেলেছিলেন শৈশবের নবনীতা।


    তাঁর জীবনের সেই শুরু আর আমরা যে ঘরে নবনীতাদির সামনে ক্যামেরা ধরলাম, তখন তো তিনি জীবনের শেষ বেলা। কিন্তু কি অফুরান প্রাণ শক্তি, কি অবনাবিল জীবনের ছন্দ। একটা জার্নি — এক পরিপূর্ণ জীবনের জার্নি — যার কথা তিনি বলছিলেন আমাদের ছবিতে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে, অধ্যাপক পবিত্র সরকারের সান্নিধ্যে। পবিত্রবাবু এই ছবির আরেক প্রাণপুরুষ বলা যায়। **[নবনীতাদির সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে বিশ্লেষনী চিন্তাবিদ, ভাষাবিদ এবং নবনীতাদির সান্নিধ্যে কাটিয়ে আসা জীবনের একটা phase পবিত্রবাবুর থেকে আর সুযোগ্য কাউকে ভাববার অবকাশ দিল না আমাদের।] (??) পবিত্রবাবু আসলে আমার কাছে পবিত্রকাকু। আমার বাবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শোভনলাল মুখোপাধ্যায়ের সাথে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের colleague ছিলেন। সেই সুবাদে, নবনীতাদির ওপর নির্মীয়মাণ সাহিত্য একাডেমির এই পূর্ণাবয়ব তথ্যচিত্রটিতে মুখোমুখি নবনীতাদির সাথে সাক্ষাতে বসার প্রস্তাব তিনি সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন। আর, ছবিতে সেই দৃশ্য পর্যায়ক্রম যে বিশেষ মাত্রা পাবে, তা তো বলাই বাহুল্য।

    বেশ কিছু অচেনা নবনীতাদিকে আমরা পেয়েছিলাম ছবিটা করতে গিয়ে। উনি খুব ভাল ছবি আঁকতেন। একটা সময়ে নৃত্যেও পারদর্শিনী ছিলেন, এমন তথ্য অনেকের কাছেই অজানা। দেওয়ালে ঝোলানো দিদির অঙ্কনশৈলী নিজেই আমাদের দেখিয়েছিলেন। তখনও তাঁর চোখের দৃষ্টিতে স্মৃতি-সুরভিত এক তৃপ্ত আবেশ। অতীতের সুখ স্মৃতিতে ফিরলে যে সবার মধ্যে ভালো লাগার ছোঁওয়া দেখতে পাওয়া যায়। এমন স্মৃতি-তৃপ্ত গভীর দৃষ্টি বারবার ধরা পড়েছে আমাদের ক্যামেরায় — প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাঙ্গণে, ফিরিঙ্গি কালী বাড়ির পাশের রাস্তায় দাদু বাড়িতে গিয়ে বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে।

    নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মহাশয় নবনীতাদির শিশু সাহিত্য নিয়ে বিশেষভাবে বলেছেন। মনটাই যদি শিশুসুলভ না হয়, তবে অমন অমূল্য শিশু সাহিত্য তো অধরাই থেকে যায়। দীর্ঘ দুটো বছর সঙ্গে করে ছবিটির নির্মাণকালে দিদির সাথে অনেক দিন, সন্ধ্যা আমরা ভাগ করে নিয়েছিলাম। শান্তিনিকেতনের বৃষ্টি ভেজা দিনটিতে তাই বাউল গানের লাইন দুটো আমার জীবনে বড় ফিরে ফিরে আসে।

    “বারে বারে আর আসা হবে না।
    এমন মানব জনম আর পাবে না।।”


    (ক্রমশ)



    অলংকরণ (Artwork) : ছবি : লেখক
  • | | | | ৫ | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments