শীত খুব--ভোর। পড়শীরা তখনও আবেশি সময়ের অন্তরালে। ধাক্কা খাওয়া গোলাপি বাড়িটির সামনে ত্রিমুখী রাস্তা ভাগ হয় ফের মিশেছে পেছনদিকের দু-পাশ জোড়া কিছু বাড়ির পর। গোলাপি বাড়িটির ঠিক উল্টো ডান-ঘেঁষা ফুটপাথে একটা বেঁটেখাটো চাঁপা গাছ প্রতি শীতে সৌরভী ফুল উপহার দেয়। সাতসকালের রোদহীন এই সময়টা ধূসর-রঙা থাকে প্রতিচ্ছবিটি - যেন আগস্তে রেনোয়াঁর আঁকা কোনও ল্যান্ডস্কেপ। গ্রাফিক্যাল লাইন ভেঙে যায় - একটা একলা হাতে টানা রিক্সা যাত্রীহীন - স্থবির। চাঁপাগাছ তলায় একটা সিমেন্ট-বাঁধানো বেদি - কে যেন কবে কোন রসিক আড্ডাবাজিরা উত্তরসূরীদের জন্য যত্নে বানিয়ে রেখেছিল। সেখানে বসে আনমনা রিক্সাওয়ালাটি, সবাই যাকে 'নাটা' বলে ডাকতো, আপনমনে দেহাতি সুরে বিবাগী গানের কলি গাইছে। ভাষাগত তারতম্যতার বিভেদপ্রকারে অজ্ঞ আমি ভেবেছিলাম - সে ভাষা বোধহয় ভোজপুরী। ভুল ভাঙলো। গোলাপি বাড়ির সাবেক প্রবীণ সদস্য - নৃপেনদা, পাড়া ও সিনেমা মহল্লায় অতি পরিচিত 'ন্যাপাদা' - তাঁর চির-পরিহিত ধুতি ও শীতকালীন শাল গায়ে জড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আমায় বললেন - "মৈথিলী ভাষা কিন্তু ভোজপুরী ভাষার চেয়ে বেশ আলাদা।" নৃপেনদার ভাষাকেন্দ্রিক প্রাজ্ঞময়তায় আমি খুব অবাক হই নি। কারণ সেই সময়ে, মহীশূরে অবস্থিত ভারত সরকারের সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ নামক প্রতিষ্ঠানের জন্য বাংলা ভাষার উৎস, ক্রমবিবর্তন ও প্রয়োগ-কেন্দ্রিক বেশ কিছু তথ্যচিত্র আমরা করছিলাম। আমার 'বৈষ্ণব পদাবলী'র ওপর একটা সিরিজ চলছিল, এবং নানাভাবে নৃপেনদার সাথে ঐ বিষয়ে পর্যালোচনা চলছিল। আমি নৃপেনদার অনুধাবনের ওপর যথেষ্ট আস্থাবান ছিলাম। তাই, সেই ভোরে চাঁপা-তলায় মৈথিলী বিবাগী সুরের অন্তর্নিহিত উপাখ্যান আমার মতো করে ছুঁয়ে দেখেছিলাম। এই ছোঁয়ানোর শিল্পেই পারদর্শী ছিলেন সেই সব বয়স্ক-যুগের নৃপেনদারা।
তিরানব্বুই ছুঁই ছুঁই মানুষেরা যখন পৃথিবী-সঙ্গ ত্যাগ করেন, সঙ্গে করে নিয়ে চলে যান পিছনে ফেলে আসা হাজারো অকথিত স্মৃতিকথা। অনেক না-বলা অনুভূতি। অনেক অধরা স্বপ্নকথা। এ বছরের নভেম্বর মাসের ২৩শে রাত পোহানোর আগে পর্যন্তও আমাদের বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির তিনি ছিলেন প্রবীণতম এক ব্যক্তিত্ব, এক আইকনিক চরিত্র। কী অদ্ভুত জীবনীশক্তি, কী ক্লান্তিহীন এক সিনেমা পথিক। সিনেমার সংসারে একডাকে যাঁকে সবাই জানতো 'ন্যাপা দা' নামে। বয়স তাঁকে হারিয়ে দিতে পারে নি। সর্বক্ষণের দিনের আলোর মতো প্রতিভাত হয়েছেন বর্ণময় এই অবাক করা চরিত্রটি।
মৃণাল সেন তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই - 'তৃতীয় ভুবন'-এর এক পরিচ্ছেদে 'প্যারাডাইস কাফে'-আড্ডাজনিত চর্চা করতে গিয়ে নৃপেনদার কথা লিখেছিলেন। হাজরা মোড়ের বিখ্যাত 'প্যারাডাইস কাফে'-র সেই দিনগুলোর সময়কার, নৃপেনদাই বোধহয় ছিলেন আড্ডাখানার শেষ ব্যক্তি। স্বাধীনতার আগে-পরের দশকের ঐ উত্তাল সময়ে সে কাফেতে ঢুকলে এক স্বর্গীয় তৃপ্তি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। এখনকার মতো কেতাদুরস্ত কাফে নয়। নড়বড়ে টেবিল, কাঠের বেঞ্চি পাতা এক চায়ের দোকানই বলা চলে। আড্ডা ষোলো আনা। মৃণাল সেন তো বটেই, সে আড্ডার মধ্যমণি আরো অনেকে। একসাথে। ঋত্বিক ঘটক, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, তাপস সেন - সঙ্গে সঙ্গী নৃপেনদা। ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির নিষিদ্ধ-যুগে, যখন ৪১, ধর্মতলা স্ট্রীটের অফিসে নিয়মিত পুলিশি তল্লাসী, তখন অনেকেই নিশ্চিন্তে চলে আসতেন এই প্যারাডাইস কাফেতে। কাফের মালিক রেসুড়ে, আড্ডাবাজদের কাছে তাঁর দোকানটি তদারকিতে রেখে নিশ্চিন্তে চলে যেতেন রেসের মাঠে। নৃপেনদা বলেছিলেন - এই কাফেতে মৃণাল সেনের কন্ঠে শোনা প্রথম 'পাবলো নেরুদা'। পাতা আষ্টেকের নেরুদার লেখা সেই কবিতাটি কাঁপা গলায় পাঠ করেছিলেন মৃণালবাবু। সবাই ছিলেন মুগ্ধ শ্রোতা। নৃপেনদাও।
মুদিয়ালির প্রতাপাদিত্য প্লেস অঞ্চলটি লম্বালম্বি এমন সুন্দর এক পাড়া ছিল - যেখানে বাঙালিয়ানার সংস্কৃতি চর্চা প্রকাশিত হতো সেই চাঁপাগাছের শুভ্র ফুলের সৌরভের মতো। বিখ্যাত অভিনেতা অসিতবরণ ঐ পাড়াতেই থাকতেন। ফলে, অসিতবরনবাবুর কনিষ্ঠপুত্র রজতবরণ (রজুদা)-র মুখে শুনেছিলাম - ফি পুজোয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উত্তমকুমার থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সক্রিয় উপস্থিতি ঐ পাড়াটিকে ধন্য করেছিল। ঘর থেকে বেরোলেই নৃপেনদার সাথে প্রথম দেখা হতো পাড়ার সেই সব সিনেমাচিত্তবহনকারী পরবর্তী প্রজন্মের গুণমুগ্ধদের সাথে। নৃপেনদার ভাই পলুদা ছিলেন এক বলিষ্ঠ সিনেমাকর্মী। পলুদা আমাকে খুবই স্নেহচ্ছায়ায় রেখেছিলেন আমাদের সেই পাড়ায়। পলুদার অকালমৃত্যুর পরে তাঁর পাড়ার সব বন্ধুই আমাকে বড় আপন করে নিয়েছিল। রজুদা (রজতবরণ) তো ছিলেনই, টুটুদাও ছিলেন। টুটুদা অর্থাৎ রণজিত চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বিখ্যাত বেহালা শিল্পী শিশির চট্টোপাধ্যায়ের ভাইপো, 'সিনে সাউথ'-এরও সক্রিয় সদস্য। বিখ্যাত গীতিকার রঞ্জিত দে থাকতেন নৃপেনদার বাড়ির কোনাকুনি উল্টো দিকে - সেই চাঁপা-গাছ ঘেরা বাড়িটিরই দো-তলায়। এমন একটা পরিবেশ, যা আমাকে সিনেমা ভাবনায় উৎসহিত করে গেছে নীরবে। 'কবি নজরুলের' ওপর নৃপেনদার করা একটি তথ্যচিত্রের শুটিংপর্বের কথা আমার বেশ মনে আছে। কবি অরুণ দের গড়িয়ার বাড়িতে ঐ আশি বছরের নৃপেনদা অক্লেশে চলে যেতেন তথ্য জোগাড়ের সন্ধানে, অধ্যাপক পবিত্র সরকারের সাথে প্রয়োজনীয় পরামর্শ সারতে। অনুসন্ধানী এক সুতীব্র মন ছিল তাঁর। সবার সাথে মাঝেমধ্যে দেখা-কথা না হলে বিচলিত হয়ে পড়তেন। সৌমিত্রদার (চট্টোপাধ্যায়) পারিবারিক বিশেষ বন্ধু ছিলেন তিনি। অকৃতদার নৃপেনদার কাছে পৌলমী (সৌমিত্র-কন্যা) স্ব-কন্যাসম। আর খুব ঘনিষ্ঠদের মধ্যে দেখেছি প্রয়াত পরিচালক-অভিনেতা নির্মাল্য সেনগুপ্ত, প্রয়াত পরিচালক গৌতম সেন, অশোক বিশ্বনাথন, বিশিষ্ট সিনেমা ঐতিহসিক, সমালোচক ও শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, আর অবশ্যই পরিচালক রাজা মিত্র ও গৌতম ঘোষ। আন্তর্জাতিক আঙ্গিক পত্রিকার সম্পাদক প্রয়াত রানা সরকারের প্রসঙ্গও আসবে নৃপেনদার কথা বলতে গিয়ে। রানাদাকে সঙ্গে নিয়ে চলচ্চিত্র টেকনিশিয়ানদের উন্নতির জন্য অনেক উদ্ভাবনী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন নৃপেনদা। তাঁর সাথে উদ্যোগী হয়েছিলেন 'ভিডিও গিল্ড' তৈরি করতে।
আসলে সিনেমার প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে অনুভূতি ও উপলব্ধি। নিজের মনের চিত্রপটে তা জারিত করা। এই অদ্ভুতভাবে পাওয়াটা আমরা, যারা সিনেমাচর্চা করে এসেছি, তার বৃহদংশই ঐতিহ্যগত পারম্পরিক প্রথায় পূর্বসূরীদের কাছ থেকে পেতাম। তাই প্রবীণ ব্যক্তিত্বদের হারানো আমাদের মাঝে একটা শূন্যতা সৃষ্টি করে। নৃপেনদাকে হারিয়ে আমরা এক শূন্যতায়েই ভুগছি, যেটা অনুভব করতে পারি, প্রকাশ করতে পারি না। কত যে গল্প, কাহিনী শুনতাম সিনেমাপাড়ার চল্লিশ দশকের, তার শেষ নেই। মুক্তাঙ্গনের পাশে, সাদার্ন এভিনিউর মোড়ে চায়ের দোকানে, আমাদের মুদিয়ালির শ্রীমোহন লেনের মুখে মনাদার চায়ের দোকানে - চোখ মেলে, মন মেলে উপস্থিতি অনিবার্য শ্রী নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়ের।
এই তো, মাত্র বছর আষ্টেকও হয় নি। নৃপেনদা তখন অশীতিপর। তবু পায়েহাঁটা পথে তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন নতুনতম কোনও সিনেমার ভাবনায়। ভারত সরকারের ফিল্মস ডিভিশনের সৌজন্যে মৃণাল সেনের নব্বুইতম জন্মদিন উপলক্ষ্যে নৃপেনদার ওপর দায়িত্ব ছিল একটা পূর্ণাঙ্গ তথ্যচিত্র বানাবার। ছবিটির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দেখেছি নৃপেনদকে। মৃণালবাবুর শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে নৃপেনদারও বড় উদ্বেগ ছিল। তার মধ্যে দুই জেদি প্রায়-সমবয়সী পরিচালকদের মধ্যে শুরু হতো সৃজনশীল বাক্যালাপ থেকে তর্কালাপ। মূল বিষয় ছিল এই তথ্যচিত্রটির প্রেক্ষাপট বুননের যুক্তিগ্রাহ্য দ্বন্দ্ব বিনিময়। শেষে দুতরফের পছন্দসই এবং মানানসই চিত্রনাট্য বিন্যাস। আসলে মৃণাল বাবুর বহুদিনের পুরনো বন্ধুই তো বটে নৃপেনদা। সম-বামধারায় দুজনেই বেড়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর সময়কালে। এক মননে, এক দর্পণে, এক পর্যবেক্ষণে বিকশিত এক চেতনার দুটি সমকালীন সত্তা। সুন্দরভাবে, যত্নশীল পরিবেশনায় নৃপেনদা গড়ে তুলেছিলেন মৃণাল সেনের জীবনালেখ্য। এখনও মনে আছে, ছবিটি নৃপেনদা শুরু করেছিলেন মৃণালবাবুর 'ইন্টারভিউ' ছবিতে কলকাতার চলন্ত বাসে অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিককে দিয়ে, যেখানে নিজের সাথে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। তথ্যচিত্র হিসেবে এই ছবিটি বহুমাত্রিক, বহু বিভাজনে বিভাজিত। সঙ্গে মৃণালদার নানান সময়ের চিন্তাভাবনার বিবর্তনের টুকরো টুকরো ইনফর্ম্যাল কথোপকথন, যা প্রতিটি পরতে দেখিয়ে দিয়ে যায় পূর্ণ এক মৃণাল সেনকে - রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবধারা মেশানো তাঁর সিনেমা ভাবনার বৈশিষ্ট্যকে।
তিরিশের দশকেই তিনি কলকাতায় চলে এসেছিলেন ওপার বাংলা থেকে। ঢাকায় জন্ম কিন্তু স্নাতক হন তিনি কলকাতা থেকেই। স্নাতকোত্তর দিনে, বন্ধু হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় ল্যাবরেটরি সহকারি হিসেবে কর্মী হয়েছিলেন নিউ থিয়েটার্সে, নৃপেনদা একই সাথে যুক্ত হয়েছিলেন ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওর সাথে। সেদিন থেকেই টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ায় সিনেমার সঙ্গে জড়িত শিল্পী ও কলাকুশলীর বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন নৃপেনদা। যদিও তখন তিনি সত্যজিৎ রায়, শান্তি চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটক বা হরিসাধন দাশগুপ্তের সাথে নানা ভাবে ও নানা ভাবনায় জড়িয়ে ছিলেন। ঐ সময়ে, সিনেমা পরিচালকদের ছবি করার বড় ভরসার জায়গা ছিল ফিল্মস ডিভিশান। বিভিন্ন তথ্যচিত্র ও নিউজরীল তৈরি করার বরাত দিয়ে<পরিচালকদের অস্তিত্বের স্বীকৃতি দিত। নৃপেনদা ষাট ও সত্তর দশকে বেশ কিছু এই ধরনের তথ্যচিত্র ও নিউজরীল করতেন। ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্টের এক সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালে সিনে টেকনিশিয়াদের প্রতিনিধি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চেকোস্লোভাকিয়াতেও যান। মনে মনে কুরে খাচ্ছিল পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সিনেমা না করতে পারার যন্ত্রণা। ১৯৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের অর্থানুকূল্যে তিনি তাঁর প্রথম ও একমাত্র পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিটি করলেন - 'ভোম্বল সর্দার'। খগেন্দ্রনাথ মিত্রের কাহিনীটি চলচ্চিত্রায়নের জন্য নৃপেনদা এই জন্যেই বেছে নিয়েছিলেন যে এক কিশোরের জার্নি-কথাকে সরল গ্রাম্য পটভূমিতে প্রকাশ করার জন্য।