দুটো বুড়ো আঙুল পরস্পরকে আলতো ছুঁলো। ময়ূর-পেখমের মতো ছড়িয়ে পড়ল দুটো হাতের দুটো তালু। ফ্রেম তৈরী হল তারই ফাঁকে আয়ত জায়গাটুকু ঘিরে। আর সেই ফ্রেমের মাঝখানে ঘটে যাওয়া টুকরো ঘটনাগুলো এলোমেলোভাবে ধরা দিল সিনেমার পরিচালকদের। সেই ঘটনাগুলোর ক্রমবিন্যাস আর ‘এটা, ওটা, সেটা’ কুড়িয়ে বাড়িয়ে সঞ্চিত প্রাপ্তিগুলোকে নিজের সৃজনশীলতায় রূপদান করা — পরিচালকদের অনেক ভাবনার একটা কোলাজ।
মুখের সামনে থেকে হাত নামিয়ে নিলেন মনমোহন। এতক্ষণ হাতের ফ্রেম মুখের সামনে রেখে, ডানহিল সিগারেটে আক্রান্ত আঙুল দুটোকে আলতো ছোঁয়ায় ঠোঁট-ভরা সুখটান দিয়ে মনমোহন একটু যেন রিল্যাক্স হলেন। এই ছোট্ট ঘরে আর কেউ নেই। শুধু আমি আর আমার সহকর্মী অলোক। আমাদের দুজনকে তখন দশ পর্যায় ব্যাখ্যা করছিলেন বার্গম্যানের ‘দ্য সেভেন্থ সিল’-এর বিখ্যাত সেই রূপক দৃশ্য — নাইট যেখানে মৃত্যুর সাথে দাবা খেলছে। আমরা বুঝতে চেষ্টা করছিলাম মনমোহনের ভালোবাসা-মন্দবাসার সিনেমা। প্রতিটি ফ্রেমের ব্যাখ্যা, প্রতিটি কম্পোজিশানের ব্যাখ্যা, প্রতিটি দর্শন ও নন্দনতত্ত্বের ব্যাখ্যা। আর এক্ষেত্রে অবাধ ছিল তাঁর বিচরণভূমি। সিনেমার কাটাছেঁড়া, গড়ন-গঠন আর উত্তরণ — সিনেমাময় এক অদ্ভুত জগৎকে সঙ্গী করে সারা জীবন কাটিয়ে গেলেন আদ্যন্ত এক ভদ্রলোক — ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমার অন্যতম এক পথিকৃৎ — মনমোহন মহাপাত্র।
আমরা তখন বয়সে খুবই তরুণ, গুটিকয়েক তথ্যচিত্র করে জাতীয় স্তরে একটু-আধটু সমাদৃত। ‘গগনেন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রটি তার আগে চেন্নাইতে ভারতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের (IFFI’90) ইন্ডিয়ান প্যানোরামা বিভাগে প্রদর্শনের সুবাদে সিনেমা জগতের বেশ কিছু দিকপালের স্বল্প সান্নিধ্যেও এসেছি। সিনে ক্লাব আন্দোলন, পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউট, ডাইরেকটোরেট অফ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালস, এন.এফ.ডি.সি-র সিনেমা পরিসর, পুনাতে ফিল্ম আর্কাইভ, মুম্বই ফিল্মস্ ডিভিশান, চলচ্চিত্র উৎসব — এই সব ঘিরে আমরা কখন যেন ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমার রূপে-রসে নিষিক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। বোঝবার চেষ্টায় ছিলাম আমরা। বোঝাবারও। গৌতম ঘোষ (তখন ‘হাংরি অটাম’, ‘মা-ভূমি’ ও ‘দখল’ খ্যাত), বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (তখন ‘দূরত্ব’, ‘নিম অন্নপূর্ণা’ খ্যাত), গৌতম চট্টোপাধ্যায় (তখন ‘নাগমতী’ খ্যাত) আর উৎপেলেন্দু চক্রবর্তী (তখন ‘ময়না তদন্ত’ আর ‘চোখ’ খ্যাত) আমাদের বাংলার প্যারালাল সিনেমার আইকন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরও তখন নানাভাবে নতুন ধারার সিনেমাগুলোকে উৎসাহিত করছিল। ফলে, সিনেমার আকাশে তখন সত্যিই বেশ ‘সিনেমা’, ‘সিনেমা’ ভাব ছিল। তখন থেকেই উড়িষ্যার দুই নতুন ধারার সিনেমা পরিচালকের কথা জেনেছিলাম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁদের ছবি সমাদৃত। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত। ঐ দুজনের মধ্যে একজন ছিলেন নীরোদ মহাপাত্র (‘মায়ামৃগ’-খ্যাত) আর একজন অবশ্যই — এই মনমোহন, বারবার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েও প্রচার বিমুখ ব্যক্তিত্ব হয়ে থেকে গেছেন আজীবন। তাঁর ছবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল — ‘নীরব ঝড়’, ‘সীতারতী’, ‘ক্লান্ত অপরাহ্ন’, ‘ভিন্ন সময়’। এবং অবশ্যই শেষের দিকে করা হিন্দী ছবি — ‘বীটস্ অ্যান্ড পিসেস’।
সালটা ১৯৯৪-৯৫ হবে। ভুবনেশ্বরের রাজমহল চকের একটা ঘেঁষা জায়গায় প্রেস কোয়ার্টারের একটির মধ্যে থাকতেন বরেন্দ্রবাবু। বরেন্দ্রকৃষ্ণ ধল, পেশায় খ্যাতনামা সাংবাদিক, আর পরবর্তীকালে অনুবাদ-সাহিত্যে অ্যাকাডেমি পুরস্কার প্রাপকও বটে। চওড়া মাপের চারচৌকো বারান্দা ছিল তাঁর স্বগৃহে আড্ডা মারার আস্তানা। এক আড্ডার সাতসকালে বরেন্দ্রবাবুর বাড়িতে সেই প্রথম মনমোহনের সাথে আলাপ। অতি অমায়িক, নিরহঙ্কার ও সুস্পষ্ট এক মনোরম ভদ্রলোক। অত বড় মাপের সিনেমা রচয়িতা অথচ এতটাই সাধারণ তাঁর জীবনযাত্রা — এক মোহময় টানে সটান চলে গিয়েছিলাম মনমোহনের ইউনিট-৮-এর বাড়িতে।
খুব সাধারণ ছিমছাম বৈঠকখানা ছিল মনমোহনের। তখন মনমোহন অফুরন্ত সিগারেট খেতেন, ঘন ঘন চা খেতেন। আর শুধু সিনেমা। একদিকে দেওয়াল ছাড়া ক্যাবিনেটে বিশৃঙ্খল ভাবে সজ্জিত পুরস্কারের স্মারক, অন্যদিকে আলমারি ভর্তি বইয়ের স্তূপ। মাঝখানে দুদিকে মুখ করা সোফায় মুখোমুখি আমরা। ছবির কথা শুনতেন, ছবির কথা বলতেন, ছবি অনুধাবন করতেন। কথায় কথায় পুনার ফিল্ম ইনস্টিটিউটের কথা বলতেন। সে সময়ে পুনায় আগে পিছে অনেক ছাত্রছাত্রীরাই ঋত্বিক ঘটকের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। মনমোহনের সমসাময়িক ছিলেন গিরীশ কাসারাভল্লি, সৈয়দ মির্জা, কুন্দন শাহ, জানহু বড়ুয়া, বিধু বিনোদ চোপড়া প্রমুখরা। সবাই দিকপাল, সবাই কৃতি। পরবর্তী প্রজন্মে চলচ্চিত্র শিল্পে প্রথম সারির শিল্প-বিপ্লবী।
শুধুমাত্র মনমোহনের টানে, শুধু গল্প করার জন্য, শুধু নিছক আড্ডা মারার জন্য, শুধু কিছু রসদ সংগ্রহ করার জন্য বারবার ছুটে গেছি ভুবনেশ্বরে। দিল্লীর ন্যাশানাল নেটওয়ার্কের দূরদর্শনের জন্য একটা হিন্দী টেলিফিল্ম পেয়েছিলেন মনমোহন। ২০০৪-০৫ হবে। ছবিটির নাম ছিল 'ঢোলকিওয়ালা’। আমরা তখন ইটিভি কলকাতায় ‘শ্রীমতী’ ভিডিও ম্যাগাজিনের জন্য কর্মরত। মনমোহন ছবিটা আমাদের করতে বললেন। সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য পাঠিয়ে দিলেন। প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সাও। অশোক সিং, নন্দিনী, প্রদীপ রাই প্রমুখ কলকাতাস্থিত কিছু হিন্দী বলিয়ে শিল্পীদের নিয়ে বেশ হইচই করে সে ছবির শ্যুটিং করেছিলাম, বামুনগাছির লোকেশানে। ছবিটি দূরদর্শন মহলে বেশ প্রশংসিত হয়, আমরা খুব সুখ পেয়েছিলাম, মনমোহনের মতো একজন লিজেন্ড পরিচালকের নিজের প্রোডাকসনের হয়ে ছবিটি করে।
ছবিটি সম্পর্কে মনমোহনের ব্যাখ্যা — কিছুটা তত্ত্বগত ও কিছুটা তথ্যগত। রেকর্ড করার বাসনায় মনমোহন তাঁর প্রিয়তম বন্ধু, ব্যাঙ্গালোর থেকে আরেক প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্রকার গিরীশ কাসারাভল্লিকেও ডাকলেন। একটা আলোচনা হোল। দুজনের যৌথ স্মৃতিচারণ। মনমোহন নিজেই উদ্যোগ নিলেন। একটা হোটেলের লবি বুকিং করা হল। গিরীশও চলে এলেন আমাদের মাঝে। পুনাতে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ‘পথের পাঁচালি’ ছবিটি পড়াতেন অধ্যাপক সতীশ বাহাদুর। ছবিটি সম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর এক অন্তর্দৃষ্টি। পুনাতে ছাত্রাবস্থায়, মনমোহন ও গিরীশ, সতীশ বাহাদুরের সেই অন্তর্দৃষ্টির ব্যাখ্যাগুলোকে খুব ছোটো আকারে আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন।
ছবিটি শেষ হয়ে যাবার অনেক পরেও ছবিটি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে খোঁজ নিতেন মনমোহন। ২০০৯ সালে ছবিটি ঢাকাতে একটি তথ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র উৎসবে কম্পিটিশানে যায়। স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিগুলোর বিচারের জুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন গিরীশ। সেখানে সান্ধ্যকালীন আড্ডায় প্রায় প্রতিদিনই উঠতো মনমোহন-প্রসঙ্গ। মনমোহনকে পরে সে কথা জানাতে তিনি খুশিই হয়েছিলেন।
সত্যিই অবাক করা বেশ কিছু ঐতিহাসিক কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন মনমোহন। ভুবনেশ্বরের খ্যাতনামা স্টুডিও ‘ডায়নামো’ তাঁর বেশ কিছু ছবির প্রযোজকও বটে। ১৯৯৬ সাল নাগাদ আমরা একটা নিজেদের প্রযোজনায় খোলামনে নতুন প্রেক্ষিত রচনা করার তাগিদে একটা তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলাম — মাদার ইমেজ। প্রখ্যাত মহিলা ভাস্কর উমা সিদ্ধান্তের কিছু নতুন ভাস্কর্য ছবিটির মুখ্য বিষয় ছিল। ‘মানুষের মধ্যে পাশবিক চেতনা’ শীর্ষক একগুচ্ছ abstract ভাস্কর্য। বেশ কিছু সময় নিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো রূপক-ডানা বিস্তৃত করার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আবহসঙ্গীত তৈরি করেছিলেন আমাদের যিনি প্রথম সিনেমার আলো দেখিয়েছিলেন — সেই গৌতমদা। ‘মহিনের ঘোড়াগুলি’ খ্যাত গৌতম চট্টোপাধ্যায়। আমাদের প্রিয় মনিদা। সম্পাদনা করেছিল সুদীপ্ত ভৌমিক। খুবই বুদ্ধিদীপ্ত উচ্চমানের সম্পাদক। ফলে, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ছবিটি ঘষে মেজে এক জায়গায় দাঁড়ালো। ছবিটি নিয়ে গিয়েছিলাম মনমোহনকে দেখানোর জন্য। মনমোহন খুব যত্ন সহকারে ছবিটি ডায়নামো স্টুডিওতে প্রদর্শনের বন্দোবস্ত করেছিলেন। আমরা অবাক হয়েছিলাম, অপ্রস্তুতও। নিজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেই ছবিটির প্রদর্শনীতে মনমোহন ডেকে এনেছিলেন নীরোদবাবুকে (‘মায়ামৃগ’ খ্যাত নীরোদ মহাপাত্র), ওড়িশার বিখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতি মিশ্র, উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য এবং আরো অনেককে। ছবিটি তো মনমোহন আগেই দেখে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সম্মানিত করে, তাঁর মহানুভবতা দেখিয়ে সবাইকে চা এগিয়ে দিয়েছিলেন মনমোহন। এমনকী, দু-একজনের ছবিটি সংক্রান্ত কিছু প্রশ্নের সরাসরি জবাবও দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা ঝুঁকে গেছিল। এমন এক দাদাকে পেয়েছিলাম সেদিন, যাঁর থেকে শুধু চলচ্চিত্র শিক্ষাই নয়, পেয়েছিলাম সংস্কৃতিবোধ, সহিষ্ণুতা আর অপরকে সম্মান করার শিক্ষাও। এ এক মন-জুড়োনো মূল্যবোধ।
২০১২-১৩ সাল নাগাদ মনমোহন তৈরি করেছিলেন তাঁর প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের হিন্দী ছবি — বীট্স অ্যান্ড পিসেস্। মোটামুটি বেশ ভালো কাস্টিং ছিল ছবিটিতে। রাহুল বোস, দিয়া মির্জা, নন্দিতা দাস, রাইমা সেন প্রমুখ। ছবিটা রিলিজ করেনি। ভালো পরিবেশক পাওয়া যায়নি। নাট্যকর্মীর জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের কাহিনি নিয়ে এই ছবিটি তৈরি করেছিলেন মনমোহন। ছবিটি দর্শকদের কাছে গিয়ে পৌঁছোয়নি বলে মনমোহন খুব আক্ষেপ প্রকাশ করতেন। আসলে, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে দেখেছি, মুম্বই বা দিল্লী ছাড়া অন্যান্য জায়গায় তৈরি করা হিন্দী ছবির জন্য জাতীয় স্তরে ভালো পরিবেশক পাওয়া সত্যিই খুব দুর্লভ।
এভাবেই বছর আর বছরান্ত কাটিয়ে গেছেন মনমোহন। নিজের পুরোনো ছবিগুলোর প্রিন্ট পরবর্তীকালে ভিডিও বা ডিজিট্যালে সংগৃহীত করার উদাসীনতা বারবারই চোখে পড়েছে। আমার মনে আছে, সিনেমা জগতের এক সম্পাদক, রথীন বসু (খোকন) আমাকে কথাপ্রসঙ্গে একবার বলেছিল মনমোহন সম্পর্কে তার বিচিত্র এক অভিজ্ঞতার কথা। কোনো এক ছবির সম্পাদনার জন্য রথীনকে ভুবনেশ্বরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন মনমোহন। যথাসময়ে, তাড়াহুড়ো করে ট্রেন ধরে কলকাতা থেকে ভুবনেশ্বরে পৌঁছেও গিয়েছিল সে। কিন্তু, সাত দিন ধরে কোনো কাজ শুরু করতে পারেনি। আড্ডা, ঘুম আর খাওয়াদাওয়া। কিন্তু সাতদিন বাদে থেকে যখন সম্পাদনার কাজ শুরু হয়েছিল, তখন তিনি ছিলেন অপরিচিত মনমোহন। চিন্তামগ্ন। সৃষ্টিশীল। ভাবগম্ভীরতায় স্বয়ংসম্পূর্ণ এক প্রকৃত চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্ব।
শুধু মুম্বই নয়, ভুবনেশ্বরে বসেই সবার সাথে যোগাযোগ রাখতেন মনমোহন। কলকাতার বন্ধুরা তো বটেই। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন তিনি, গৌতম ঘোষের সাথেও যোগাযোগ ছিল। কে কখন কি কাজ করছেন, সব ব্যাপারেই খুঁটিনাটি সব তথ্যই থাকত মনমোহনের কাছে। তাঁর আশেপাশের পাশ-করা বছরগুলোর সহপাঠী ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের তিন মহা-যন্ত্রী। শব্দ পুনর্যোজক অনুপ মুখোপাধ্যায়, ক্যামেরাম্যান রণজিৎ রায় আর সম্পাদক মৃন্ময় চক্রবর্তী। মনমোহনের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে কিনা জানি না, এই তিনজনই আমাকে বিভিন্ন সময়ে নানান পরামর্শ ও অনুষঙ্গ দিয়ে আমার চলচ্চিত্রসত্তা ও হৃদয়কে সমৃদ্ধ করে গেছেন।
শেষ দিকে, মনমোহনের শরীর স্বাস্থ্য ক্রমশ ভেঙে পড়ছিল। ২০১৬ - ১৭ সালে আমি মুম্বইয়ের ফিল্মস্ ডিভিশনের ন্যাশানাল মিউজিয়াম অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা (NMIC)-র তরফ থেকে ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমা বা Indian Parallel Cinema-র ওপর আর্কাইভাল ছবি করার জন্য অনুমতি পাই। বরাবরই, ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমার প্রতি আমার একটা ব্যক্তিগত দুর্বলতা থেকে গেছে। আমার কৈশোর আর যৌবনের সিনেমা ভালোবাসার দিনগুলোকে হৃদয়ের ভেতর সঞ্চারিত করেছিল তখন ভারতীয় নবতরঙ্গ সিনেমাগুলো। আঞ্চলিক ছবিগুলোর উত্থান আর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে এই ছবিগুলোর স্বীকৃতি সে সময়ের নব্য-সিনেমাকারদের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। মনে হতো, যে ধরনের সিনেমাগুলো দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য আমরা সিনে ক্লাব আন্দোলন করেছি, তারই বোধোদয় হল। বিদেশি সিনেমা স্বদেশের প্রেক্ষাগৃহে সরাসরি দেখানো সত্যিই একটা দুরূহ কাজ ছিল। না ডিভিডি, না ছিল ইন্টারনেট। সত্যজিৎ রায় বা মৃনাল সেন সারা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করার ফলে তাঁদের মাধ্যমে নতুন আন্তর্জাতিক সিনেমা সম্পর্কে জানতে পারতাম। আর তার পরের প্রজন্ম অর্থাৎ নব্য-চলচ্চিত্রের স্রষ্টারা যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, সেমিনারে, ওয়ার্কশপের মধ্যে দিয়ে নতুনতর চলচ্চিত্র ভাবনার কথা বলতেন, আমরা অনেক বেশি করে সিনেমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়তাম। মনমোহন মহাপাত্র বা তাঁর ছবি সম্পর্কে ধারণা বা বোধ সিনেমার প্রতি এই তীব্র আকর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতেই। তাই, তথ্যচিত্রটি করবার সময়কালে সরাসরি মনমোহনের পরামর্শ আমার কাছে মান্যতা পেল বেশি। সবার সাথে যোগাযোগের উৎসস্থল ছিল মনমোহনই। মুম্বইতে শ্যাম বেনেগাল থেকে ত্রিবান্দ্রামের আদুর গোপালকৃষ্ণন, শাজি করুণ, ব্যাঙ্গালোরে গিরীশ কাসারাভাল্লি থেকে দিল্লীতে কুমার সাহনী — সবার সঙ্গে যোগসূত্রের কাজটি নীরবে করে গিয়েছিলেন মনমোহন। ঐ সময়ে, ছবিটিতে ব্যবহার করার জন্য মনমোহনের পুরোনো ছবির ক্লিপিংস শত চেষ্টাতেও পাওয়া গেল না, স্থির চিত্র যাও বা দুটো একটা ছিল, তাই দিয়ে কাজ চালাতে হল। কিন্তু তাতেও মনমোহনের কোনো আক্ষেপ ছিল না। কারণ তিনি ততদিনে সিনেমাজীবন সম্পর্কে নিস্পৃহতা আর উদাসীনতাকে নিজের মননে আয়ত্ত করে ফেলেছেন। সিনেমা সম্পর্কে নয়। বিখ্যাত ব্রিটিশ সমালোচক জন উড ভারতীয় চলচ্চিত্র সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মনমোহন মহাপাত্র সম্পর্কে বেশ কিছু না-জানা কথা লিখে গেছেন। তাঁর জীবনদর্শন আর সিনেমা দর্শনের মেলবন্ধনকারী সূত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করে গেছেন। তাঁর প্রথম ছবি 'সীতারতি' প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে জোহান উড তাঁর "Essential Mystery" বইটিতে লিখেছেন — ছবির নায়িকা অরুণার সাথে প্রণবের সম্পর্ক যখন ছিন্ন হয়ে গেল, তখন গ্রামে ফিরে এসে অরুণা উপলব্ধি করেছিল সে একটা 'পণ্য' ছাড়া কিছুই নয়। এখানে অরুণার গ্রামের পথ ধরে একটা দীর্ঘ লং শট মনমোহন নিয়েছিলেন। উড লিখেছিলেন, "The long shot of her walking to her school across a largely bare and barren space is an excellent visual indication of her subordination and the reduced value of her life." মনমোহন তাতে তৃপ্ত, যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলেন।
মৃত্যুর একমাস আগেও আমাকে বলেছিলেন একটা ভালো বাংলা গল্পের সন্ধান দিতে। একটা বাংলা ছবি করতে চান তিনি। সে ছবি করার সময়টুকু তিনি আর কাউকে দিয়ে গেলেন না। ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমায় তিনি নিঃসন্দেহে এক ‘নীরব ঝড়’। ‘কিছু স্মৃতি কিছু অনুভূতি’ রেখেই ক্লান্ত এক অপরাহ্নে শেষ হল তাঁর জীবনযাত্রা। বিশ বছরের সম্পর্কের স্মৃতির বোঝা তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে সম্মান জানিয়ে আমার এই লেখাটি কিছুটা হলেও হাল্কা হল আমার মন থেকে। হৃদয়ভরা দুঃখটা কিন্তু থেকেই গেল — আরো কিছু ছবি কি তিনি নতুন প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারতেন না! এখানেই আমি অভিমানী।
(ক্রমশ)