বাড়ির নাম - 'অনুপমা'। ডাক-বাক্সে গোটা হরফে লেখা সে বাড়ির ঠিকানা - এ-১২৩, কার্টার রোড, পশ্চিম বান্দ্রা। সুদূর কলকাতা থেকে এসে দ্বিপ্রহরে পৌঁছনো এক অচেনা পত্র-প্রেরকের চিঠি মনকে বিষণ্ন, বিচলিত করেছিল 'অনুপমা' বাড়ির প্রবাসী গৃহকর্তাকে। পত্রপ্রেরক জনৈক দুঃস্থ এক ব্যক্তি, যিনি তাঁর সাত বছরের মৃত্যুপথযাত্রী শিশুকন্যার অস্থিমজ্জার চিকিৎসায় বোম্বের আধুনিকতম পরিষেবা পাবার ব্যাপারে উদ্বেলিত, আকাঙ্খিত। তিনি শুনেছেন, বাঙালি সেই খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বটির হাত আর মন বড়ই উদার। তাই এই চিঠি যেখানে কন্যার চিকিৎসার স্বার্থে ঐ দুঃস্থ মানুষটি বোম্বেতে একটি সাময়িক মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছিলেন।
মধ্য আটের দশক। প্রবাসী সে গৃহকর্তাটির নামডাক তখন বিশ্বজোড়া। তিনি সম্মানিত ও জনপ্রিয়তম চলচ্চিত্র পরিচালকদের অন্যতম। ততদিনে তিনি একের পর এক অন্য ধারার ছবি সৃষ্টির কারিগর। 'মুসাফির' থেকে শুরু। ততদিনে 'আনাড়ি', 'মেমদিদি', 'অনুপমা', ‘অনুরাধা’, 'আশীর্বাদ', 'সত্যকাম', 'আনন্দ', 'নমক হারাম', 'অভিমান', 'মিলি', 'গোলমাল', মায় 'খুবসুরত' এর মতো হৃদয় ভরানো ছবি করেছেন। গোটা কতক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন। তৃপ্ত দর্শকেরা সে সব ছবি দেখে নিজেদের চেতনার অবস্থান সম্পর্কে চিত্তশুদ্ধির রসদ পেয়েছেন। এক ডাকে সারা দেশ যাঁকে চেনে হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় নামে। বোম্বে ইন্ডাস্ট্রির নক্ষত্র ব্যক্তিত্বদের কাছে 'হৃষি দা'। আসরানি বলতেন 'হেডমাস্টার'। রাজ কাপুরের কাছে তিনি ছিলেন স্নেহধন্য 'বাবুমশায়'। নব-প্রজন্মের অনেকের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘কা্র্টার রোড’-র ‘দাদামশাই’।
হৃষিকেশবাবু ভেবেছিলেন, অচেনা লোক, মেয়ের শিয়রেও অজানা বিপদ। তাঁদের পারিবারিক গোপনীয়তা কিছুটা ক্ষুণ্ন হবে ভেবেও হৃষিকেশবাবু সেই দুঃস্থ পরিবারটিকে 'অনুপমা'র নীচতলার অতিথি কক্ষটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। মেয়েটি দীর্ঘ ন'মাস চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে বাবার সাথে কলকাতায় ফেরে।
কার্টার রোডের সেই বাড়িটি দোতলা বাংলো-কুটির, 'বোম্বে' নামক সিনেমা-স্বপ্ন ভরা পরবাস-ভ্রমণে বাঙালি আর বাংলা-মনের অবয়বে তৈরি 'অবাঙালি'দের বাসভূমি এবং কর্মভূমিও বটে। ষাট-সত্তর-আশির দশকগুলোর সম্বৎসর হঠাৎ ভ্রমণে কেউ আবিষ্কার করতে পারতেন চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা ক্লান্ত ঋত্বিক ঘটককে, গভীর আলোচনায় লিপ্ত উৎপল দত্ত আর সলিল চৌধুরিকে, রাহি মাসুম রেজা বা রাজ খোসলার সঙ্গে গম্ভীর দাবার বোর্ডে চুপচাপ স্বয়ং হৃষিকেশকে, রাজিন্দার সিং বেদির চোস্ত উর্দু শায়রীর উদাত্ত মুখরা, রান্নাঘরে নিজের হাতে বাঙালি ঘরানার লাড্ডু বানাচ্ছেন স্বয়ং অমল পালেকারের বয়স্কা মা অথবা গণনাট্য সঙ্ঘের 'জশমা ওডান' থেকে পাঠ করা সংলাপ বলছেন দীনা পাঠক। এছাড়া ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না থেকে জয়া বচ্চন, শর্মিলা ঠাকুর থেকে রেখা - তামাম বলিউডের নিত্য যাতায়াত হৃষিবাবুর 'অনুপমা'-য়। বস্তুতঃ, অমিতাভ-জয়ার প্রাক-ভালোলাগার জন্মলগ্ন থেকে সংগঠিত বিবাহপর্ব অবধি নানান সুরধ্বনির সাক্ষীও 'অনুপমা'। অভিনেতা দিলীপ কুমার যে বাড়িটিকে মজা করে বলতেন -'মিনি বেঙ্গল লজ'। বহিরাগতরাও কেমন করে সেই সদানন্দের মেলায় হয়ে উঠতেন পরিবারসম।
নরম মনের পৃথিবীতে স্বচ্ছতার পূর্ণতায় ভরা হৃষিকেশের অবাধ যাতায়াত। ছোট ছোট আনন্দ, ছোট-বড় মুহূর্তগুলো কখনই তিনি কোলছাড়া করতে পারতেন না। তাঁর ছবিতে নানাভাবে যেমন এসেছে 'পাশের বাড়িতে দেখা' চরিত্রগুলো, বাঙালী-সত্তার অভিমানী উপলব্ধিগুলো, তেমনই খুব সহজভাবে উপস্থাপিত করেছেন জীবনের নানান স্তরের মূল্যবোধ, তাঁর জীবনবোধের দর্শনও। হাসি-আনন্দভরা এক নবজীবনের কাহিনী হয়ে উঠেছে তাঁর ছবিগুলো, গল্পবিন্যাসে তাঁর ব্যতিক্রমী দক্ষতার গুণে সুগভীর বৃত্তান্তগুলোতে ছন্দের প্রাণে সূক্ষ্মভাবে হৃদয়ের অন্তঃস্থলের দরজা খুলে দিতে পারতেন তিনি। স্বচ্ছন্দে তাঁর ছবিতে সংলাপের মাধ্যমে উপস্থাপিত হতো - "খুব বড় খুশির অপেক্ষায় আমরা এই ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তগুলো হারিয়ে ফেলি"('বাবুর্চি') অথবা "মানুষ তাদের জীবনের সবচেয়ে ছোট অথচ সবচেয়ে দামি শব্দটি ভুলে গেছে - যার নাম 'ভালোবাসা'" ('বাবুর্চি') অথবা "বন্ধুত্ব ভালো বা মন্দ হয় না - বন্ধু ভালো বা খারাপ হয়" ('মিলি') অথবা "জীবনটা অনেক বড় হওয়ার দরকার, লম্বা নয়" ('আনন্দ') - এমন অজস্র সংলাপে ভরা তাঁর ছবির সাউন্ড-ট্র্যাকে তাঁর জীবনদর্শন ভাগ করে নিতেন তিনি দর্শকদের সাথে। তিনি মনে করতেন যে "খুশি হওয়াটা সহজ, কিন্তু সহজ হওয়াটা কঠিন" (বাবুর্চি')। বম্বে টকিজে এবং তার পরবর্তী পর্য্যায়ে বিমল রায়ের মন্ত্রশিষ্য হৃষিকেশ তাই হিন্দি ছবিতে বাঙালি শিকড় গ্রথিত করর প্রয়াসী হলেন, আর সেখানেই বোধহয় হয়ে উঠলেন তাঁর সময়ের সফলতম পরিচালক। তাঁর সব কাল-অতিক্রমী অনুভূতিগুলোর অংশীদার করে রেখে গেলেন উত্তরসূরীদের।
দিন শুরু তাঁর অন্যভাবে, অন্য পরিচয়ে। ভবানীপুরের রূপচাঁদ মুখার্জী লেনের পৈতৃক বসতবাটি থেকে পায়ে পায়ে হাঁটা কম পথ পেরোলেই হাজরা পার্কের উল্টোদিকে প্যারাডাইস কাফেতে চুটিয়ে আড্ডার দিনগুলো ছিল চল্লিশের দশকে মোড়া। সেই আড্ডা একটা আইকনিক। ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, সলিল চৌধুরি, বসন্ত চৌধুরি, তাপস সেন তো বটেই, গণনাট্য সঙ্ঘের যেন সদস্য-মেলা লেগে থাকতো ঐ কাফের চৌহদ্দিতে। আশুতোষ কলেজ থেকে রসায়ন শাস্ত্রে সদ্য অনার্স ডিঙোনো বিশ-একুশ বয়সের হৃষিকেশের সমকালীন সে কলকাতায়, বুদ্ধিদীপ্ত দামালপনা ছিল এক সুপ্রশস্ত উপাখ্যান। তিনি নিজেও সেতার বাজাতেন, আকাশবানীতে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে পরিচিতও ছিলেন। একদিন শুনলেন বি.এন.সরকারের ঐতিহ্যশালী নিউ থিয়েটার্সের সিনেমা ল্যাবরেটরীতে নাকি কেমিস্ট নিয়োগ হবে। ১৯৪৫ সাল। নিউ থিয়েটার্সে ল্যাবরেটরীর দায়িত্বে ছিলেন হরিদাস মহালানাবিশ। হৃষিকেশের কাছে কাজটা খুব সৃষ্টিশীল ছিল। সেলুলয়েডের যুগ তখন, ল্যাবরেটরির সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে সিনেমার আলোকচিত্রের রাসায়নিক যোগদান। কিন্তু ঐ স্টুডিওর নিয়মনীতি অনুযায়ী সব টেকনিশিয়ানদের নির্দিষ্ট বিভাজিত বিভাগের বাইরে অন্য কোনও বিভাগে কাজ করার অনুমতি ছিল না। অবাক চোখে 'মুভিয়ালা' সম্পাদনা যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে থাকতেন তিনি। ইচ্ছে- ছবির সম্পাদনার কাজের সাথে যুক্ত হবেন। ক'দিন স্টুডিও পাড়ায় ঘোরাঘুরি করে হৃষিকেশ এটা বুঝে গিয়েছিলেন যে সিনেমার মেরুদন্ড যদি সত্যিই কিছু থাকে - তা হলো সম্পাদনা। সুবোধ মিত্তিরকে সবাই জানতেন ‘কচি’-দা হিসেবে, সম্পাদকের কাঁচি চালাতেন বলে সম্ভ্রমে কেউ ডাকতেন ‘কাঁচি’ দা বলে। সুবোধবাবু তখন দাপুটে সম্পাদক, ১৯৪৫ এ তিনি 'দুই পুরুষ' শীর্ষক একটি কাহিনীচিত্র সম্পাদনা ও পরিচালনা করেন। নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজনায় বিমল রায় পরিচলিত 'উদয়ের পথে' তখন দেশ বিদেশে সম্মানিত, সবে গত বছরই মুক্তি পেয়েছে। সেই ছবিটিরই হিন্দি সংস্করণ 'হামরাহী' ছবিটিরও শুটিং শুরুর সময়। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওটিও ছিল একটা পরিবারের মতো, গুণগ্রাহীরা কদর পেতেন ষোল আনা। হৃষিকেশের সিনেমা-ভাবনা অনেক উন্মোচিত হল এঁদের সান্নিধ্যে। অন্য প্রযোজকের প্রযোজনায় বিমল রায়ের চিত্রনাট্যে মনোজ ভট্টাচার্যের পরিচালনায় ১৯৫০-এ শুরু হলো 'তথাপি' ছবির কাজ। বি.এন.সরকারের অনুমতি নিয়ে বিমলবাবু হৃষিকেশকেই দায়িত্ব দিলেন ছবিটার সহকারী পরিচালনা আর সম্পাদনার।
হিমাংশু রায় ও দেবিকারানি প্রতিষ্ঠিত তাঁদের সোনার সংসার মালাডের 'বোম্বে টকিজ'-এর অন্তর্কলহে দেবিকারানি সরে গেলেন চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। শশধর মুখার্জি, জ্ঞান মুখোপাধ্যায় আর অশোক কুমার-এর যৌথ প্রযত্নে তখনও ধিকিধিকি করে চলছিল বোম্বে টকিজ ।যদিও পাশাপাশি শশধরবাবু তৈরি করে ফেলেছিলেন ''ফিল্মিস্তান'। কলকাতা থেকে বম্বে আসার ডাক পড়লো বিমল রায়ের। ১৯৫০ এর শেষ দিকে বিমল রায় চললেন বোম্বে। গন্তব্য বোম্বে টকিজ। তাদের ব্যানারে ১৯৫১ সালে শুটিং শুরু করেছিলেন বোম্বেতে বিমল রায় তাঁর প্রথম ছবি 'মা'য়ের। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল পরের বছর।
কলকাতায় বিমলবাবু মনের মতো নিজস্ব একটা ইউনিট তৈরি করেছিলেন, ২৭ বছরের হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় তো বটেই। সঙ্গে ছিলেন অভিনেতা (তখন সহকারী পরিচালক) অসিত সেন, লেখক নবেন্দু ঘোষ, অভিনেতা নাজির হুসেন আর কয়েকদিন পরেই, সলিল চৌধুরি প্রমুখ। একদিন ডাক এলো সবার। বিমল রায়ের বম্বে ইউনিটে কাজের ডাক। প্রান্তর পেরোনো অচেনা এক রাজ্যের সিনেমার স্বপ্নমগ্ন এক নতুন শহর দু বাহু মেলে আদর করলো হৃষিকেশকে। কত দূরে বেড়ে ওঠা কলকাতার সাথে ধীরে ধীরে পিছুটান হারিয়ে গেল হৃষিকেশের। প্রবাসী তখন তিনি, বিমল রায়ের পরিবারের এক সদস্য। ডিসেম্বরের শেষ, ১৯৫১। চার্চগেটের কাছে এরস সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে আকিরা কুরোসাওয়ার ক্ল্যাসিক - 'রশোমন'। বিমল রায়ের অভ্যেস ছিল সময় পেলেই নিজের বাড়িতে পরিবারের সব গেরস্থালীদের নিয়ে একসাথে বসে বিদেশি ছবি দেখা - বিশেষ করে হলিউড ক্ল্যাসিক্স আর সোভিয়েত সিনেমা। এর জন্য বাড়িতে একটা প্রোজেক্টারেরও বন্দোবস্ত করেছিলেন। কিন্তু জাপানী ছবির প্রিন্ট তখন আনানো খুবই সমস্যার ছিল। তাই হৃষিকেশদের সঙ্গে নিয়েই নাইট শো-এ সিনেমাটি দেখতে গেলেন সবাই। প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে 'বেস্ট' বাসে ওঠা ইস্তক কারোর মুখে কোন কথা ছিল না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো 'রশোমন' দেখেছেন সবাই, ছবির মাহাত্ম্যের গুণে সবাই বাকরুদ্ধ। ঐ অত রাতে চার্চগেট থেকে মালাড ঘন্টাখানেকের পথ। নিস্তব্ধতা ভাঙলেন স্বয়ং বিমল রায় -"আচ্ছা - আমরা কি পারি না এমন উচ্চস্তরের কোন ছবি বানাতে?" হাত তুলেছিলেন হৃষিকেশ, আছে বটে এক টানটান অনুভবের সাবলীল গল্প, লেখক সলিল চৌধুরী।
-"হ্যাঁ পারবো, আমিই চি্ত্রনাট্য লিখবো।"- হৃষিকেশ বলে ফেললেন। করে দেখালেন। ১৯৫৩ সালে শুরু হলো বিমল রায় প্রোডাকসন্সের প্রথম ছবি-"দো বিঘা জমিন"।
তারপর ইতিহাস। পরপর ছবি বিমল রায়ের - 'বিরাজ বহু', 'বাপ বেটি', 'নৌকরি', 'দেবদাস'। সহকারী পরিচালক ও সম্পাদক হৃষিকেশ। বিমল রায় যখন 'দেবদাস' ছবির শুটিং করছেন, তখনকার তারকা অভিনেতা দিলীপ কুমারের সঙ্গে খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ এক সম্পর্ক তৈরি হয় হৃষিকেশের। অনুভবী দিলীপকুমার সন্ধান পেয়েছিলেন হৃষিকেশের মন-অন্দরের ইচ্ছে-বার্তার। 'মধুমতী' তখনও বছরখানেক দূরে। আন্ধেরীর মোহন স্টুডিওর দোরগোড়ায় দেখা তাঁর হষিকেশের সাথে। সালটা ১৯৫৬ -র কোন এক শেষদিকের মাসে। দিলীপকুমার জানতে চাইলেন হৃষিকেশ নিজে কোন নতুন ছবি করছেন কিনা! 'মুসাফির'-এর ভাবনা জানালেন - তিনটি আলাদা গল্প, কিন্তু কোথাও যেন এক যোগসূত্র আছে যেখানে মানব জীবনধারার তিনটি ভিন্ন বৈশিষ্টকে গাঁথা হয়েছে। জন্ম, মৃত্যু আর বিয়ে। কনসেপ্টের সাহসিকতার প্রশংসা করলেও দিলীপকুমার সংশয় প্রকাশ করলেন ছবিটি দর্শকরা ঠিকঠাক গ্রহণ করবেন কিনা। ঋত্বিক ঘটক চিত্রনাট্যটি লিখলেন। ছবি হলো ১৯৫৭-এ। চললো না। কিন্তু রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়ে গেল। এটা একটা খুব বড় স্বীকৃতি। ছবিটি দেখে রাজকাপুর মুগ্ধ। তিনি একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন পরবর্তী ছবি ‘আনাড়ি’-তে কাজ করতে। সেই সময়ে, শুধু বিমল রায়ই নন, হৃষিকেশের পরবর্তী জীবনটাকে ভরিয়ে তুলেছিল বহু-ব্যাক্তিত্বের সুষম সমাবেশ আর পাশে দাঁড়িয়ে হৃষিকেশের শুভ ইচ্ছেগুলোর সলতে উস্কে দিতে। ‘মুসাফির' থেকে 'ঝুট বোলে কাউয়া কাটে' - ১৯৫৭ থেকে ১৯৯৮ - এই একচল্লিশ বছরে তাঁর পরিচালিত ছবির সংখ্যাও একচল্লিশ, খান কুড়ি ছবিতে তিনি ছিলেন সম্পাদক। এছাড়াও কিছুকালের জন্য তিনি সামলেছেন সেন্সর বোর্ডের সভাপতি বা এন.এফ.ডি.সি-র সর্বোচ্চ পদও। চুটিয়ে দাবা খেলেছেন, পোষ্য সারমেয়দের সময় দিয়েছেন, আর ঘর-বোঝাই সমঝদারদের তৃপ্ত করেছেন। সিনেমার শুটিং-এর সময় সেই মানুষটিই হয়ে উঠতেন এক বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তিত্ব।
জয়া বচ্চন বলতেন, হৃষিদা ছিলেন প্রযোজকদের পরিচালক। অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় খরচের ব্যাপারে নিস্পৃহ। এমনকি, অনেক সময়ে, অভিনেতা অভিনেত্রীদের পোশাক পরিচ্ছদ তাঁদের বাড়ি থেকেই নিয়ে আসতে বলতেন ছবির চরিত্র অনুযায়ী। 'চুপকে চুপকে' শুটিং-এর সেটে হৃষিবাবুর নির্দেশে আসরানি পরে এসেছিলেন একটা স্যুট। দৃশ্যের চাহিদা অনুযায়ী ধর্মেন্দ্র পরে এসেছিলেন ড্রাইভারের পোশাক। আসরানিকে অমন ধোপদুরস্ত পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখে ধর্মেন্দ্র তো রেগে আগুন! আসরানিকে জিজ্ঞেস করলেন -"আরে! এ সব কি হচ্ছে? দৃশ্যটি কী? তুমি কী করে স্যুট পেলে আর আমিই বা কেমন করে ড্রাইভারের পোশাক?... হৃষিদা নিজের বাবাকেও কখনও স্যুট দিয়েছেন কিনা সন্দেহ!" হৃষিকেশবাবু চুপচাপ নিজের মতো একটা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ধর্মেন্দ্রর চেঁচামিচি শুনে সটান বললেন, "অ্যাই ধরম..আসরানিকে তুমি কী জিজ্ঞেস করছো? দৃশ্যটির ব্যাপারে, তাইতো? গল্পটির সম্পর্কে তোমার যদি বিন্দুমাত্র জ্ঞান থাকতো, তাহলে তুমি কি নায়ক হতে?"
এমনই ছিলেন হৃষিকেশবাবু। 'আনন্দ' ছবির গল্পটি ধর্মেন্দ্রকেই প্রথম শুনিয়েছিলেন তিনি। তার আগে, জাতীয় পুলস্কারপ্রাপ্ত 'সত্যকাম' ছবিতে অভিনয় করে খুব প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি।। স্টার ইমেজ ভেঙে কাঙ্খিত 'অভিনেতা'র সম্মান পেয়েছিলেন তিনি। তাই হৃষিদা তাঁর কাছে পিতৃতুল্য এবং তাই তাঁর কাছে তিনি একটু বেশিই আবদেরে। শেষ মুহূর্তে, 'আনন্দ' চরিত্রটিতে ধর্মেন্দ্রকে বাদ দিয়ে রাজেশ খান্নাকে নিয়ে শুটিং শুরু করেছিলেন হৃষিকেশ। মদ্যপানের মাত্রা বাড়িয়ে রাতভোর বারবার ফোন করে নিজের অভিমান উগড়ে দিয়েছিলেন ধর্মেন্দ্র। হৃষিকেশ বারবার ধর্মেন্দ্রকে একটাই কথা বলেছিলেন -"অনেক রাত হলো, এবার ঘুমিয়ে পড়।"
কত তাঁর ছবি, কতই না জীবন্ত সব চরিত্র! 'আনন্দ', 'মিলি' বা 'গুড্ডি' তো বটেই, পার্শ্ব চরিত্রগুলোও, যেমন, 'অভিমান' ছবিতে সব সময়ে বিয়ের স্বপ্ন দেখা নর্তকী চিত্রা (অভিনয়ে বিন্দু), 'গোলমাল' ছবিতে সনাতনী মেজাজী ভবানীশঙ্কর (অভিনয়ে উৎপল দত্ত) যিনি বদলে যাওয়া সময়ে, শেষে কম্প্রোমাইজ করেছিলেন আধুনিকতার সাথে, 'চুপকে চুপকে' ছবিতে মদ্যপ আর কৌতুককর হিন্দি উচ্চারণের ড্রাইভার জেমস ডি'কস্টা (অভিনয়ে কেষ্ট মুখোপাধ্যায়) যিনি গাড়ি খারাপ হলেই বলে ওঠেন "গাড়ি মে লাফড়া হ্যায়" অথবা 'আনন্দ' ছবিতে মেট্রন ডি'সা (অভিনয়ে ললিতা পাওয়ার) যিনি জীবনের জয়গান গাওয়া প্রোটাগনিস্ট চরিত্র আনন্দের মৃত্যুতে পুত্রসম স্নেহে কান্নায় ভেঙে পড়েন যখন হঠাৎ বেজে ওঠা টেপ রেকর্ডারে আনন্দেরই কন্ঠে সংলাপে শোনেন - 'জীবন-মৃত্যু সবই উপরওয়ালার হাতে, আমরা সবাই রঙ্গমঞ্চের কাঠ-পুতুল'।
হৃষিকেশের ছবি আসলে গল্পভিত্তিক কোন তথ্যপ্রকাশ নয়, একটা দর্শন, একটা সামগ্রিক কনসেপ্ট। মানবজীবনের অনেক অন্তর্নিহিত ছবির পসরা - যেখানে আশা থাকে, আনন্দ থাকে, মান-অভিমান-দুঃখ থাকে, জীবনবোধের গল্প থাকে, মূল্যবোধ থাকে আর থাকে মানুষের প্রতি গভীর আবেগভরা অকৃত্রিম ভালোবাসা। বিষয় ভাবনায় বৈচিত্র্য, গল্পটিকে সিনেমার মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ আর খুব সূক্ষ্ম অনুচ্চ হিউমার তাঁকে এক 'নিজস্বতা' এনে দিয়েছিল। বিনয়ী হৃষিকেশ তবু মাঝে মাঝে বলতেন, চলচ্চিত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর ঊর্ধসীমা সীমাবদ্ধ। একবার সত্যজিৎ রায়কেও জানিয়েছিলেন সে কথা। হৃষিবাবু বিস্ময় প্রকাশ করতেন যে সত্যজিৎবাবু এত উন্নত ভাবনায় ছবি করতেন কি করে? প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্রকার হয়েও সত্যজিৎবাবুর সহকারী হিসেবে কয়েকটি ছবিতে তাঁর কর্মধারার সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছের কথা একবার ব্যক্ত করেছিলেন। উত্তরে সত্যজিৎ হা-হা করে উচ্চৈঃস্বরে শুধুই হেসেছিলেন। সত্যজিৎবাবু নিজেও সম্মান করতেন হৃষিকেশের সিনেমা উপস্থাপনাকে, শ্রদ্ধা করতেন তাঁর সম্পাদনার কুশলতাকে।
হৃষিকেশবাবুর জন্মশতবর্ষ। অনেক এলোমলো ভাবনার জট-পাকানো সম্ভার মনে উঁকি দিচ্ছিল। যে মানষটির ‘আদি’ আমাদের কাছে অর্ধ-পরিচিত, কিছু ক্ষেত্রে অপরিচিত, আর ‘অন্ত’ এক দিগন্ত বিস্তৃত সীমাহীন আলেখ্য — তাঁকে নিয়ে স্বল্প পরিসরে জীবনকাহিনীর ইতিবৃ্ত্ত রচনা করা খুবই দুঃসাধ্য। বার তিনেক খুব কাছ থেকে দেখা, একবার হাত-তিনেক দূর থেকে দুরু-বুকে কথা বলা — হৃষি-দার সঙ্গে সান্নিধ্য বলতে আমার ঐ টুকুই। ১৯৯১ সাল হবে। মুম্বাইয়ের ওরলির এন.এফ.ডি.সি-র অফিসে ঘোরাঘুরি করছিলাম আমার তথ্যচিত্র ‘গগনেন্দ্রনাথ’-এর ফরাসী সাব-টাইটেলের জন্য সাহায্য পাবার আশায়। ছবিটি চেন্নাইয়ে আন্তর্জাতিক ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ইন্ডিয়ান প্যানোরামা’ বিভাগে স্থান পেয়েছিল। ‘কলাইভানার আরঙ্গম’ প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হবার সময়েই সুইৎজারল্যন্ডের ‘ফ্রীবর্গ’ চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য নির্বাচিত করেন ঐ উৎসবের জনৈক প্রতিনিধি। কিন্তু বাধ সাধলো ছবিটির প্রদর্শনীর জন্য ফরাসী সাবটাইটেল। সেলুলয়েডর সে যুগে সিনেমার প্রিন্টে সাবটাইটেল বসানোর হ্যাপা অনেক, ব্যয় সাপেক্ষও বটে। অনুদানের আশায় তাই এন.এফ.ডি.সি-র শরণাপন্ন। হঠাৎ দেখলাম হৃষি-দাকে। কোনও এক উচ্চ-পর্য্যায়ের মিটিং উপলক্ষ্যে তাঁর আগমন। জটলা পেরিয়ে বুকে সাহস সঞ্চয় করে হৃষি-দাকে সরাসরি পরিচয় দিলাম। তথ্যচিত্র করি শুনে খুশি হলেন, সদ্য স্বীকৃতি পেয়েছি শুনে আরো খুশি হলেন, এক দশক আগে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ‘নাগমতী’ ছবিতে আমার কাজ শেখা শুনে আরো আরো খুশি হলেন।গৌতম দা-র কাছে শুনেছিলাম, ‘নাগমতী’ ছবিটি দেখে খুব প্রশংসা করেছিলেন হৃষিকেশবাবু। তাঁরই অনুরোধে শেষে এন.এফ.ডি.সি ফরাসী সাব-টাইটেলযুক্ত প্রিন্ট দিল্লীর ডাইরেক্টরেট অফ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালস-এর মারফৎ ফ্রীবর্গে পাঠানোর বন্দোবস্তো করেছিল। এটা হৃষিকেশবাবুর সিংহ-হৃদয়ের একটা দৃষ্টান্ত।
গৌতম(ঘোষ)-দাকে ফোনে বললাম ক’দিন আগে। হৃষিদাকে নিয়ে শতবর্ষে আমার ভাবনাচিন্তার প্রতি তাঁর ভলোলাগা ব্যক্ত করেছিলেন। সবার মাঝে মন-দরিয়ায় জমে আছে হৃষিদা-কেন্দ্রিক ননান স্মৃতিটুকরো। গৌতম দা’র মতো ঐ উচ্চ স্তরে বর্ষীয়ান চলচ্চিত্রকারের তো থাকবেই হৃষিদার সাথে জীবনের কিছুটা সময় জড়িয়ে থাকার কথিত-অকথিত স্মরণপঞ্জী! গৌতম দা জানালেন — তাঁর ‘পার’ ছবিটি হৃষিদার এত পছন্দ ছিল যে মুম্বাইতে পরপর অনেকগলো স্ক্রিনিং-এর আয়োজন করেছিলেন, আর প্রতিদিনই বিশিষ্ট্ ব্যক্তিদের আমন্ত্রন করতেন ছবিটি দেখার অনুরোধ জানিয়ে।বলতেন, “দেখে যাও, কলকাতার পরিচালক — কী অসামান্য ছবিটি বানিয়েছে”! কলকাতার প্রতি সেই নাড়ির টান কখনই ভুলতে পারেন নি হৃষিদা।
কিছু কিছু মানুষ সঙ্গগুণে, পরিধিগুণে কখন যেন ‘বাবু’ থেকে ‘দা’-সম্বোধনে তৃ্প্তবোধ জাগায়। বড় আপন আপন লাগে।সত্যজিৎবাবু অনেকের কাছে তাই ‘মানিকদা’, ঋত্বিক ঘটক বা মৃণাল সেনও তাই। হৃষিদাও তাই। অন্তহীন প্রাণদিশারীরা বড় নিজের কাছের মানুষ বলে বোধ হয়।
হৃষিদার শেষ জীবনে একাকী সন্ধ্যাগুলো কেটে যেতো নির্জনতায়। 'অনুপমা' বাড়িটি তখন শুধুই স্মৃতি। ভারত সরকারের স্বীকৃতি মিলেছে, সমগ্র পরিচালকজীবনের সম্মানস্বরূপ 'দাদা সাহেব ফালকে' পুরস্কারে। কত ছাপার অক্ষরে, কত ভিডিওর ফিতেতে তাঁকে স্পর্শ করা হয়েছে। তবু শেষ শয্যা তো বটে। ২০০৬ সাল। বোম্বেতে দেখা হলো তাঁর শেষ বর্ষার সাথে। এক পুত্র সন্দীপ তখন সদ্য প্রয়াত। সারা জীবন 'জীবন' খোঁজা মানুষটির মৃত্যুকালীন পরবাসে যাওয়ার সময়ে। ডায়ালিসিস চলছে তাঁর। মাঝে মাঝে শিয়রে দেখা মেলে চিত্র সমালোচক আলি পিটার জনের। পুত্র সন্দীপের গচ্ছিত চল্লিশ হাজার টাকা জনকে দিয়ে যেতে চাইছিলেন তিনি। ভালো কাজে দান করার জন্য। জন তাঁর পরিচিত এক নান-এর সন্ধান দেন, যিনি একটি অনাথ আশ্রম চালান। খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। একবার সুনীল দত্ত এলেন। বিমল রায়ের পরিচালিত 'সুজাতা' ছবির কত গাথা-স্মৃতি-কথা রোমন্থন করলেন। যাওয়ার আগে জনকে আরেকবার মনে করিয়েছিলেন নান-এর কথা। "দেরী করো না যেন, সময় কিন্তু খুব বেশি হাতে নেই"-বলেছিলেন হৃষিকেশ।
হাসপাতালের শেষ শয্যার দিনগুলোতে প্রায়ই তাঁর ‘ঈশ্বর-পিতা’ হৃষিকেশকে দেখতে যেতেন হৃষিকেশের স্নেহ-আদরের অমিতাভ বচ্চন, যাঁকে হৃষিকেশ ডাকতেন ‘মহারাজ’ বলে।। দিনান্তে বড় বিমর্ষ হতে হতো অমিতকে। ঐ ভাবে ঐ অবস্থায় রোগশয্যায় হৃষিকেশকে দেখা অমিতের পক্ষে বড় বেদনাতুর ছিল। এক দিন, হৃষিকেশ কিছুক্ষণের জন্য চোখ মেলে মিলিয়ে যাওয়া ঝাপসা আলোয় ঠাহর করলেন, তাঁর শিয়র স্পর্শ করলো অমিতাভের চেনা হাতের ছোঁয়া। মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল হৃষিকেশের অঞ্জনরেখা। পরমুহূর্তেই ক্লান্ত হাতের ইশারায় অমিতাভকে চলে বললেন। তিনি হয়তো বুঝতেই পেরেছিলেন, বিদায়বেলা আসন্নপ্রায়। জীবন শেষের আগের দিনের হৃষিকেশকে দেখা শেষ ছবি আজও চিরস্থায়ী অমিতাভর মনের মাঝে।
নানকে সময়মতো হজির করাবার আগেই আগস্টের ২৭ তারিখ মৃত্যু হলো ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের এক স্তম্ভ- প্রয়াত হলেন হৃষিকেশ। শেষ বিদায় জানাতে বাড়ি গেলেন অনেকেই। আলি পিটার জন-ও। চোখ পড়লো টেবিলের ওপর । একটা মুখবন্ধ খাম - ওপরে গোটা অক্ষরে হৃষিকেশের হাতে লেখা 'আলি পিটার জন'। কাঁপা হাতে খামটি খুললো জন। ভেতরে রাখা হৃষিকেশের শেষ ইচ্ছেটুকু — নানকে দেবার জন্য চল্লিশ হাজার টাকা।
আনন্দ' ছবির শেষ দৃশ্যের মতো টেপ রেকর্ডারে যেন বেজে উঠলো — "বাবুমশায়...এত ভালোবাসা ভালো নয়!"
হৃষিকেশের ছেড়ে যাওয়া, মানুষের প্রতি 'এত ভালোবাসা'-রই সময় এখন। এই ৩০ শে সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া তাঁর শতবর্ষের আলোকে।
(ক্রমশ)