উল্টিয়ে দেখলাম। অস্পষ্ট পেন্সিলের রেখায় কেউ একজন কোনও একদিন লিখে গিয়েছিলেন ছবিটি আঁকবার সময়কাল। ১৯১৫। আমরা দুটি প্রাণী — আমি আর আমার সহকর্মী অলোক, সে ছবিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপলব্ধি করছিলাম, সে কালটি ছিল ছবিটি অঙ্কিত হবার প্রায় ৭২ বছর পরে — বেশ মনে আছে ১৯৮৮ সালের কোনও এক শ্রাবণের দ্বিপ্রহরে। এমন আলোছায়া মাখা পটপ্রান্তরে জীবন্ত এমন কোনও ছবি আমি আগে দেখি নি। ছবিটির ক্ষেত্র পুরনো কলকাতার চিৎপুরের জনসামাজিক পাড়ার একাংশ। বিষয়টি ছিল দেবী দুর্গার বিসর্জন। সম্মুখপটে আবছায়া আলোকের বৃত্তে কিছু অস্পষ্ট মানুষের সমাবেশ, পশ্চাৎপটে কোনও উজ্জ্বল রশ্মিমালায় বিধৃত কোন সাবেক যানের ওপর উপবিষ্ট মা দুর্গা। বিসর্জনের পরিবেশ ঝলমলে, কিন্তু এত দক্ষতার সাথে শিল্পী তাঁর চিত্রপটটি সাজিয়েছেন, যেন উজ্জ্বলতম আলোগুলোর মধ্যেই রচিত হয়েছে বিসর্জনের ধূসর পটভূমি। ছবিটি মনের মধ্যে নিজের মতো করে রূপক দিয়ে সযত্নে আদর করলাম চিরদিনের জীবনসজ্জায়।
এমন ছবি সে ভারতে সে সময়ে আঁকতে পারতেন একজন শিল্পীই। বলাই বাহুল্য, সে শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ, উচ্চারণের চটজলদি ছোট কলমে তাই লিখছি — গগন ঠাকুর। যেমন সবাই লেখে, যেমন অনেকেই জানে। গগন ঠাকুরের দুষ্প্রাপ্য চিত্রশৈলীর সাথে নিবিড় অনুষঙ্গ শুরু হয়েছিল তখন থেকে। বয়স তখন আমার কতই বা, বছর ছাব্বিশ হবে। এমনভাবে নিবিড় করে গগনবাবুর আঁকা ছবি তো আগে কখনও দেখিনি।
এমনিতেই এ বাড়িটির অবস্থান অত্যন্ত স্মৃতিপরায়ণ। পাশে ৬ নম্বর, প্রিন্স দ্বারকানাথ স্ট্রীটে লাগোয়া একই পরিধির মধ্যে ৫ নম্বর বাড়িটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও সেখানে পরিবর্ত যে বাড়িটি বর্তমানে দৃশ্যমান, ইতিহাসের পাতায় তার ভারও নেহাতই কম নয়। পাশে রবি ঠাকুরের জন্ম-মৃত্যু অট্টালিকা যদিও অবিকল রয়ে গেছে বহিরঙ্গে। ও বাড়িটি ছিল দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম পরিবারের বসতভিটে। আর এ বাড়িটি রবীন্দ্রনাথের খুড়তুতো ভাই গুনেন্দ্রনাথের হিন্দু পরিবার। আত্মীয়তা, ঘনিষ্ঠতা, সৃজনশীলতা, সাংস্কৃতিক ভাববিনিময়, বাংলার নবজাগরণে দু-বাড়ির যৌথ অবদান, বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্যে মেলবন্ধনের এক অমূল্য চিত্রপট চিৎপুরের জোড়াসাঁকোর এই ঠাকুর পরিবার। বাঙালি আজও তাদের মননে কর্মে চিত্তলোকে বহন করে চলেছে এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও বৈচিত্র্যময় সৃজনশীল বিশ্বকে, এই ঠাকুরবাড়ির অলিন্দে, দালানে, বারান্দায়, বিভাজিত অনেক ছাদের এক সামগ্রিকতার সে পৃথিবী, জীবনবোধে যে পরিবার আমাদের কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতিতে।
এ বাড়ির বিখ্যাত দক্ষিণের সেই বারান্দা আর নেই। সে বারান্দায় একসাথে ছবি আঁকতেন ভারতীয় চিত্রশিল্পের ইতিহাসের পাঁচ দিকপাল ভাইবোন — গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ, বিনয়নী ও সুনয়নী দেবী। বিকল্প তৈরী বাড়ি প্রথম দর্শনে মনে হয় নীরস শুকনো কোন ইঁট সিমেন্টের কাঠামো লাগামহীন অসুন্দরের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উঁচু উঁচু সিঁড়ি পেরিয়ে তিনতলায় তৈরী হয়েছিল রবীন্দ্র ভারতী সোসাইটি। ক্লান্ত দুপুর, স্নিগ্ধ দুপুর, টাপুর টুপুর দুপুর বা শীতদুপুরে প্রায়ই গিয়ে ওদের হেফাজতে গগন অবনদের ছেড়ে যাওয়া স্মরণীয় স্মৃতিগুলোর একটা প্রয়োজনীয় লিস্ট তৈরী করতাম আমরা। প্রথম দিন দেখেছিলাম বৃষ্টিস্নাত ঠাকুরবাড়ি। লাল রঙা সাবেক সে বাড়ি বৃষ্টির জলে আরো রাঙায়িত দেখাচ্ছিল, দেবদারুর সবুজ আরো সবুজ। ছিটেফোঁটা উঁকিঝুকি মারা চিলতে ফাঁকগুলোতে জ্বলে উঠেছে আজকের মিউজিয়ামের আপিস ঘরের হলুদ আলো। বাইরে লোক নেই। নির্জন নির্বান্ধব পুরী। সামনের বড় লোহা-গেট পেরিয়ে সোজা-বাড়ি লাল বাড়ি-রবীন্দ্রনাথের প্রাণবাড়ি। আর ডানদিকে লম্বালম্বি উঠে গেছে গগনবাবুদের ভেঙে যাওয়া বাড়ির ওপর পাল্টা নতুন বাড়ি। সময়টা বেশ পিছনের। বছর পঁয়ত্রিশের আশপাশ। রবি ঠাকুরের বাড়ি একটু আগে ঘুরে এলাম। ভেতরের সেই ঠাকুরদালান আজ চুপচাপ। এদিক ওদিক সিঁড়ি কোনওটা গেছে বারমহল, আর দুটো অন্দরমহল। দোতলা, আড়াইতলা, তিনতলার ছাদ একে যেন অপরের পরিপূরক। খুব নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম। পরে যখন ১৯১১ সালের প্রথম প্রকাশের রবি ঠাকুরের জীবনস্মৃতি বইয়ের ভেতর তাঁর ভাইপো গগনেন্দ্রনাথের আঁকা অলঙ্কৃত ছবিগুলো দেখেছিলাম, অথবা গগনেন্দ্রনাথের অঙ্কিত ঠাকুরবাড়ির অলিন্দে গবাক্ষে আলোছায়ার খেলা সম্বলিত ছবিগুলো দেখেছিলাম, বুঝতে অসুবিধে হয়নি এ বাড়ির রহস্যময়তা, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর হারিয়ে যাওয়া এক পরিবেশের বিবরণ, যা আজ চিরকালের মতো ঘুমিয়ে আছে ইতিহাসের কোলে।
তবু সামনে খোলা ময়দানের বাঁদিকে থিকথিকে সাদা ফুলের সৌরভে সুরভিত চাঁপাগাছটি বরণ করে অতিথিদের। খুব ভোরের একদিন। কেমন থাকে ঠাকুরবাড়ি? গেটের বাইরে ঘোলা পায়রাগুলো এখনও কি একসাথে জোটে গমের দানা খেতে? সে সময় তো অনেক তফাতে চলে গেছে। ডানদিকের হলুদ বাড়ির তেতলায় আলগা ঘুরে বেড়ানোর লোকও মেলা ভার। সোসাইটি অফিস খুলত দুপুর দুটোয়। চলত রাত ৯টা অবধি। প্রেসিডেন্ট প্রতাপবাবু (প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র) আসতেন ক্কচিৎ কদাচিৎ। সন্ধ্যের দিকে আসতেন সোসাইটির সেক্রেটারী আনন্দ মুখোপাধ্যায়। বিশিষ্ট আইনজীবী। আর দুপুরবেলা অফিসে থাকতেন সমীরবাবু, মদনবাবু, দেবুবাবুরা। একটা খুব বড় লাইব্রেরী ঘর ছিল এই তেতলাতেই। ভল্ট খুলে হিসেব করে সযত্নে ভারতীয় প্রথিতযশা ওরিয়েন্টাল শিল্পীদের দুষ্প্রাপ্য চিত্রশৈলী একে একে হাজির করতেন তাঁরা আমাদের কাছে, আমাদের কাজে।
আসলে প্রথম যখন সোসাইটির সাথে যোগাযোগ করি, তখন গগনবাবুর আঁকা ছবি নিরীক্ষণ করতে যাই নি। কালিঘাটের চৌকো পটের বিচিত্র সম্ভার ছিল এই সোসাইটিতে। তখন মাথায় ঘুরছে, এই পটের ওপর একটা যদি ছবি করা যায়। এই পট দেখতে এসেই গগন ঠাকুরের আঁকা ছবিগুলো দেখেছিলাম, দেখেছিলাম অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু আর অসিত কুমার হালদার অঙ্কিত গুচ্ছ চিত্র-রাজি, আর উপরি-পাওনা হিসেবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অঙ্কিত বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের প্রোফাইল বর্ণিত রেখাচিত্র। মনে বড় দাগ কেটে গেল গগনেন্দ্রনাথ। কিন্তু তার আগে শেষ তো করি আগের ছবি ‘জেনারেশান’। কালিঘাটের হারিয়ে লোকশিল্পী পটুয়াদের দল আমাদের অজান্তে এক অদ্ভুত প্রভাব বিস্তার করেছিল।
কালিঘাটের পটুয়াদের অঙ্কণরীতিতে একটা নিজস্বতা ছিল। নিজস্ব শৈলী ছিল, একটা ছন্দ ছিল যা সেই মহান পটুয়া চিত্রকরদের একান্তই নিজস্ব। ব্যবহৃত রঙ প্রকৃতিপ্রাপ্ত। গাছের পাতা, ফুল বা ফল থেকে নির্যাস করে তাঁদের রঙ তৈরী হত গৃহস্থালীতেই। কালিঘাট মন্দির চত্বরে আসা পুণ্যার্থীদের কাছে হিন্দু দেবদেবীকে নিয়ে আঁকা ছবিগুলো দু আনা তিন আনায় বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তাঁরা। কিন্তু কোথায় যেন শিল্পী হিসেবে সামাজিক দায়িত্ববোধ এড়াতে পারেন নি। ব্রিটিশ সাহেবদের তাঁবেদারির ফলশ্রুতি হিসেবে বাঙালি সমাজে তৈরী হয়েছিল মেকি আদব-কায়দা বিশিষ্ট নববাবু সমাজ। বাবুদের বাবুয়ানি আর বিবিদের বিবিয়ানি বুদ্ধিদীপ্ত বাঙালি সমাজের কাছে মজার খোরাক ছিল। পটুয়াদের রঙ আর তুলিতে বাবুসমাজের বিভিন্ন ব্যঙ্গাত্মক দৃশ্য রচিত হয়েছিল একের পর এক। গোটা গোটা মোটা বাবুদের বেশ গোলগাল পরিপূর্ণভাবে তাঁরা আঁকতেন বলিষ্ঠ রেখাচিত্রে। পরে রঙে রূপে সন্ধি করানো হতো। সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোও তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। তারকেশ্বরের মোহান্তির সঙ্গে এলোকেশীর সম্পর্ক নিয়ে কেচ্ছাকাহিনী তখন মুখরোচক এক ঘটনা ছিল।
ছবি তৈরীর প্রাককথা বলে ফেলা যাক। ‘জেনারেশান’ — কালিঘাট পটচিত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্রাঙ্কণের ওপর। ২২ মিনিটের ছবি ছিল এটা, ১৬ মিমি-তে তোলা, ইস্টম্যান কালার। আমাদের এই ছবিটি নির্মাণের বেশ আগে, ১৯৭০-এর প্রথম দিকে বিশিষ্ট পরিচালক পূর্ণেন্দু পত্রী এই একই বিষয় নিয়ে চমৎকার একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। সেটা কোথায় যেন আমরা দেখেছিলাম মনে নেই, তবে ছবিটির বিষয় ও উপস্থাপনা আমাদের বেশ নাড়া দিয়েছিল। আমার আর অলোকের (ব্যানার্জী)র প্রথম ছবিটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ‘অন্তরালে’ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর স্বত্ব কিনে নিয়েছিল পরিবেশনার জন্য। বেশ কিছু টাকা হাতে এসে গিয়েছিল। ‘অন্তরালে’ ছবিটি করার সুবাদে আমাদের মেন্টর ‘মহিনের ঘোড়াগুলি’-খ্যাত সঙ্গীত ও চিত্র পরিচালক গৌতম চট্টোপাধ্যায় (মণি দা)-র মারফৎ আলাপ হয়েছিল রানা দার সাথে। রাণা সরকার। তখন টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়া আজকের মতো এত তো বিস্তার লাভ করে নি। মাঝারি মাপের টানটান সংসার। ভালোবাসা আর আবেগময়তায় পরিপূর্ণ। তাই, নতুন কেউ ছবি করার বাসনা নিয়ে টালিগঞ্জে পা রাখলে, তাদের যার পর নাই উৎসাহ দেওয়াটা একটা রেওয়াজ ছিল। বড়রা সবাই বরণ করে নিত, স্নেহভরা হাতগুলো অজান্তেই চলে আসত নতুনদের পালে হাওয়া যোগাতে। অনেক দিন পরে, ১৯৯৯ সালে প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সাথে আমাদের পরিচালিত ‘উত্তরণ’ ধারাবাহিকে কাজ করার সুযোগ এসেছিল। তিনি একদিন কোনও এক একান্ত মুহূর্তে আমাদের একটি কথা বলেছিলেন যে, আগেকার সিনেমা শিল্পে সাদাকালোর যুগ ছিল, কিন্তু মানুষজন রঙিন ছিল। আজ বড় উল্টো বোধ হয়। এখন আমারও এটাই মনে হয়। আমাদের সেই রানাদা সেই রঙিন প্রজাতির মানুষগুলোর মধ্যেই পড়তেন, নতুনরা হাত বাড়ালেই বন্ধু হতেন। সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন নতুন যারা আসছে, তারা যাতে ইন্ডাস্ট্রিতে টিঁকে যায়, আর শুধু তো ইন্ডাস্ট্রি সর্বস্ব সিনেমা চর্চা নয়, নব-চলচ্চিত্রের আন্দোলনের যে ঢেউ আছড়ে পড়েছিল আমাদের মন-অন্দরে, সেটা সঠিক জ্ঞানে প্রতিপালিত করার দায়িত্ব ছিল রানাদা-দের মতো দুর্লভ সিনেমা স্বজাতির ব্যক্তিত্বদের। সে সময়ে ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্ট তুঙ্গে অবস্থান করছে, কত না কত সিনে ক্লাবগুলো থেকে স্বদেশী বিদেশী ছবি ঘনঘন দেখানো হচ্ছে শহরময়, সিরিয়াসধর্মী ম্যাগাজিন বেরোচ্ছে সিনেমা শিল্পের পাঠককূলের জন্য। আর, সেই ঘনিষ্ঠ ও একনিষ্ঠ সিনেমা-চর্চাকারীদের সাথে আত্মিক ও জাগতিক মেলবন্ধন ঘটানোর বিচিত্র ক্রিয়াপ্রক্রিয়ার কাজগুলি নীরবে করে গেছেন
“আজও মনে হয় শাপভ্রষ্ট দেবদূতের মতন রানা সরকার দাঁড়িয়ে আছেন রাসবিহারীর মোড়ে। এক মাথা চুল, ভারী ফ্রেমের চশমা, জ্যান্ত একটা ইন্টেলেকচুয়াল” — আরো লিখেছেন সঞ্জয়দা। একটা মানুষকে শরীরে-গঠনে-মননে ব্যাখ্যা করার পক্ষে যথেষ্ঠ। সত্যিই সঞ্জয়দা, আজো বড় মিস করি রানাদাকে। মুক্তাঙ্গনের পাশে গোবিন্দদার লেবু চায়ের দোকানে শেষ বিকেলের ঠেকে রানাদার উপস্থিতি আমাদের মনে সিনেমার রসদ জোগাতো। সিনেমার প্রতি দায়বদ্ধতার উস্কানি মিলতো। রানাদার সিনেমা ঘেরা মনোজগতের সঙ্গী হতাম আমরা। অনেক অফুরান ভাবনা, অনেক অপূরণ স্বপ্ন। সে ঠেকে পরিচালক রাজা মিত্র আসতেন, মাঝে মাঝে রানাদার মন-দরজায় কড়া নেড়ে যেত গৌতম ঘোষ, ন্যাপাদা (নৃপেন গাঙ্গুলী), অশোক বিশ্বনাথন প্রমুখেরা। নিরুত্তাপ শরীর কিন্ত বড় অস্থির মন ছিল রানা দার। সব সময়ে অন্যমনস্কতার ফাঁক-ফোকরে সিনেমা নিয়ে নতুন ভাবনাগুলো বড় কুরে খেত। মনে আছে, আশির দশকের শেষে সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ নিয়ে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সিনেমা করার জন্য ন্যাশানাল ফিল্ম ডেভেলাপমেনট করপোরেশান (এন.এফ.ডি.সি)-এ আবেদন করবে রানাদা। বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে প্রস্তাবিত ছবিটির বিশদ সারসংক্ষেপ তৈরী করা হয়েছিল। কিন্তু শেষমেষ ছবিটি করার অনুমোদন মেলে নি। রানাদা খুব হতাশ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সিনেমার মন্ত্রবলে হৃদয় যন্ত্রণা কাটিয়ে ওঠবার মহাশক্তি সিনেমাকারেরা পেয়ে যায় কেমন যেন অজান্তেই। তাই হতাশা গ্লানি অপমান এমন সব ব্যক্তিগত সম্পত্তি শিকেয়ে তুলে আবার চলচ্চিত্র ভাবনার মধ্যে দিয়েই তাদের প্রাণের সঞ্চার ঘটে। রানাদারও তাই ঘটেছিল।
এমন অজস্র অর্ধস্বপ্ন বুকে নিয়ে অনেক ভাবনা, অনেক চিত্রনাট্য, অনেক অর্ধ-সমাপ্ত, অসমাপ্ত ছবির কাহিনী নীরবে থেকে যায় রূপোলি পর্দার আড়ালে। এ প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেই সময়ের জ্যোতি বসুর সরকারের জন্য রানাদা একটা প্রচারমূলক ছবি করার বরাত নিয়ে এল। ছবির নাম ‘বামফ্রন্ট ও সংস্কৃতি’। ছবিটি রানাদা, মণিদাকে সঙ্গে নিয়েই করবে। মণিদার নাকতলা বাড়ির উল্টোদিকে আরেকটি বাড়ির একতলায় বেশ ক’দিন আমি আর অলোক মণিদার সহকারী হিসেবে চিত্রনাট্যের খসড়া তৈরিতে ব্যস্ত থাকলাম। হল তো বটে চিত্রনাট্য তৈরি, কিন্তু মণিদা তো আপোষহীন মানুষ, অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল সরকারী কমিটির সাথে সংঘাতে যাওয়া। মতে মিলল না। সে ছবির কাজও অর্ধেক বন্ধ হয়ে পড়েছিল বেশ ক’বছর। অবশেষে রানাদার মধ্যস্থতায় ছবিটি শেষ করে মণিদা।
রানাদার কিছু শারীরিক অসুস্থতা হল। ৮৭ সাল নাগাদ। রানাদার মা আর মাসীমা অতি সুরুচিসম্পন্না আর সু-সংস্কৃতি-মনস্কা মহিলা ছিলেন। মুদিয়ালী ক্লাবের পেছন দিকটায় থাকতেন তখন। আমার বয়স কম ছিল বলে আমি ওনাদের দুজনেরই স্নেহভাজন ছিলাম। মাসীমা বললেন রানাদাকে আকু পাংচার চিকিৎসার জন্য কালিঘাট মন্দিরের উল্টোদিকের এক চেম্বারে নিয়ে যাবার জন্য। বড় কষ্টকর ছিল সে চিকিৎসা পদ্ধতি। ব্যথা ভোলবার জন্য রানাদা খালি গায়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আমাকে পাশে বসিয়ে বিশ্ব সিনেমার গল্প শোনাতো। বুনুয়েল, অ্যান্তোনিয়নি, গদার, ত্রুফো, ভাইদা। সিনেমার জ্ঞান তাঁর ছিল প্রগাঢ়, সিনেমা নিয়ে তর্ক করার স্পর্ধা রাখত তার্কিকদের সাথে। অনেক নতুন দৃশ্যশ্রাব্য-গাথা ভরিয়ে দিয়ে যেত আমার হৃদয়কে। পরবর্তীকালে বেহালায় ঋত্বিক সিনে সোসাইটির সাথে যুক্ত হয়েছিল রানাদা। তখন ‘এফ’ বলে একটা সিনেমা পত্রিকা বের করতে উদ্যোগী হয়েছিল। সম্পাদকমণ্ডলীতে আমাদের রেখেছিল। আমার গোটা কয়েক লেখাও বের করেছিল পত্রিকাটিতে। তথ্যচিত্র নির্মাতা জরিস ইভেন্সের চীনের বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে তাঁর ছবি করার অভিজ্ঞতার ওপর আর একটা আমার বড় প্রিয় পোলিশ চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেঁ ভাইদার একটি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারের বাংলা অনুবাদ।
একদিন রানাদার হাতে দেখলাম ডব্লু. বি. আর্চারের লেখা কালিঘাটের পটচিত্র নিয়ে অসাধারণ একটি বই। খুব উৎসাহ নিয়ে পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখলাম। বিশেষ পড়াশুনো ছিল না আমার এই বিষয় নিয়ে। রানাদাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম, চটজলদি উত্তরও পেয়ে গিয়েছিলাম। বিষয়টি নিয়ে আমাদের আগ্রহ দেখে আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে গেল কালিঘাটে। মন্দিরের উল্টোদিকে প্যাঁড়ার দোকানগুলোর পেছনে কোণাকুণি কোনও এক গলির ভেতর অনেক পুরনো একটা বাড়িতে। আমাদের সাথে আলাপ করিয়ে দিল রানাদা। তিনি ছিলেন বিজয় রায়। উনিশ শতকের শেষ দিকে যে কয়েকঘর পটুয়া পট আঁকতেন কালিঘাটে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নিবারণ রায়, কালিচরণ রায় আর কানাই রায় প্রমুখ। বিজয় বাবু ছিলেন তাঁদেরই চতুর্থ উত্তরপুরুষ। তিনি ছবি আঁকতেন না, কিন্তু সে সময়ের সস্তা কাগজের ওপর সেই সব মহান লোকশিল্পীদের আঁকা বেশ কিছু ধূসর হয়ে যাওয়া দুষ্প্রাপ্য ছবিগুলো পারিবারিক ঐতিহ্যের অভিমানে বুকে আগলে রেখেছিলেন। হাঁ করে গিলছিলাম বিজয়বাবুর কাছ থেকে তাঁর পিতৃপুরুষের গল্প। বেরিয়ে এসে সেই প্রথম রানাদাকে জানিয়েছিলাম, আমাদের দ্বিতীয় ছবি জেনারেশান-এর ভাবনার কথা। এবার শুরু হবে বিষয়ভিত্তিক গবেষণা, তারপর চিত্রনাট্য আর তারপর শুটিং-এর প্রস্তুতি।
(ক্রমশ)