• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৬ | এপ্রিল ২০২২ | রম্যরচনা
    Share
  • সে (৩) : সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়
    | | ৩ | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২



    ধানোয়া মাঝির ছোটো ভাই সানুয়া মাঝি। ওরা এবং ওদের কিছু বংশধর গুটি আষ্টেক ঘর তুলে বাঙালী পাড়ার কাছে, খুবই কাছে, থাকতে এলো। সে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার সময়ের কথা, আমার বয়স তখন ঋণাত্মক দুই।

    প্রায় তিন বিঘের বাগান ছিলো আমাদের তখনকার ভাড়া করা বাংলোটিতে। দাদুর গোলাপ ছিলো কিছু, আর ছিলো পেয়ারা, আতা, কাগজী লেবু আর টোপা কুল। পিছন দিকের ভাঙা পাঁচিল পেরিয়ে কয়েকটা শেয়াল আসতো কুল খেতে।

    বিঘে আড়াই থাকতো পড়ে।

    ওই জমিটুকুতে অড়হর বোনবার অনুমতি নিতে দাদুর কাছে এলো মাঝিরা। চারিদিকে সিকি মাইলের মধ্যে আর কোনো লোক ছিলো না। অবসরপ্রাপ্ত হাকিম দাদুর বন্দুক, রিভলভার, রাইফেল থাকা সত্বেও আমাদের মনে হলো যে ওরাওঁ মাঝিদের মতো দুর্ধর্ষ তীরন্দাজ ক'জন কাছাকাছি থাকলে ভালো। তাই ওই ছোট্ট গ্ৰামটির সঙ্গে অড়হর বোনার মধ্যে দিয়ে একটা সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেলো।

    বছর দুয়েক পর আমাদের পরিবার কলকাতায় চলে আসে।

    ষাটের দশকের গোড়ায় আবার আমরা ওই শহরেই থাকতে ফিরে গেলাম। ওই মহল্লাতেই একটু দূরে আরেকটা বাংলোয়। খবর পেয়ে মাঝিনরা সব বেগুন, ঢেঁড়স, ডিম ইত্যাদি উপহার নিয়ে এসে দিদার সঙ্গে দেখা করে গেলো। ন' বছরের আমি নতুন কিছু বন্ধু পেয়ে গেলাম।

    চার মেয়ে নিয়ে পাড়ায় থাকতেন এক দুঃস্থ মহিলা। তাঁর স্বামী থাকতেন পাকিস্তানে, মাঝে মাঝে আসতেন, তাঁদের "জমিদারী"র এটা সেটা নিয়ে। তাঁদের পঞ্চম কন্যাটি আমরা যাওয়ার পরে জন্মগ্রহণ করে।

    তা মাঝিরা সব দেখে প্রায়ই ওনাদের তরকারী, মকাই এসব দিয়ে‌ যেতো। তা না হলে ওনাদের চলা খুবই দুষ্কর হতো।

    বিরাট ফলের বাগানের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বত্রিশটি বাংলো নিয়ে ছিলো আমাদের পাড়া। হুগলি জেলার ইঁটেচোনার জমিদার কুণ্ডুবাবুদের সম্পত্তি ওই বিখ্যাত "কুণ্ডু বাংলো" এলাকা। শোনা যেতো ওনারা নাকি মহারাষ্ট্রের লোক, বর্গীদের দলের সঙ্গে এসে বাংলায় থেকে যান।

    ওই ফলের বাগান বছর বছর ইজারা নিতো ঠিকাদার মেওয়ালাল। কয়েকটি স্ত্রী, সন্তান সন্ততি ও পৌত্র পৌত্রী নিয়ে বুড়ো বাগান পাহারা দিতো।

    যা হয়, স্বাদের জন্য কয়েকটি আমের বেশ সুনাম ছিলো, যেমনটা ছিলো একটি কাঁঠাল গাছের। ওই গাছটার ফলগুলি ছোটো হতো, কিন্তু ঘ্রাণে স্বাদে ছিলো মনমাতানো। নাম ভুলে গেছি।

    তা একদিন ভরদুপুরে দেখা গেলো যে ওই গাছের একটি তৈরী ফল পূর্বকথিত পরিবারটির দোরগোড়ায় শোভা পাচ্ছে।

    কিছু না ভেবে আনন্দ করে কাঁঠালটা খেয়ে ভূতি, খোসা বাইরে ফেলে রাখলো ওরা। আর তার কিছু পরেই সদলবলে এসে হাজির ইজারাদার মেওয়ালাল

    - এ তো আমার গাছের কাঁঠাল
    - এরা নিশ্চয়ই তুলে এনেছে
    - মোটেই আমরা আনিনি, এইখানটায় রাখা ছিলো
    - চোর, চোর, ঝাড়ে বংশে চোর এরা
    - খবরদার বলছি, চোর বলবে না একদম
    - না, বলবো না, আমরা এনে রেখে গেছি, তাই না?
    - বলছি না, এখানে ছিলো
    - সবাই জানে তোরা চুরি করিস
    ...
    একটু দূরে, একটা ভাঙা পাঁচিলের আড়ালে:

    - এবার কি হবে‌ রে
    - সবাই তো ওদের দোষ দিচ্ছে
    - কি করি বল তো? আচ্ছা দাঁড়া

    আমাকে জোরে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে ঝগড়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে:
    - ওরা কিছু করেনি গো, ওরা চোর নয়, আমি তুলে এনে ওদের দিয়েছি তো
    - অ্যাঁ তুই! তখনি জানি এই কাহারগুলো...

    শুরু হলো চড় চাপড়। যাদের কাঁঠাল তারাও, যারা খেয়েছে তারাও। আমি এগিয়ে গেলাম, কিন্তু একটা ভয়ঙ্কর শক্ত হাত আমাকে সরিয়ে দিয়ে বললো
    - বাবু তু সোরে যা রে, মু টুক যাই দেখি
    এই বলে সানুয়া মাঝি মাঝখানে দাঁড়িয়ে:
    - এই কি হয়েছে, বাচ্চাটাকে অত মারছিস কেন? কি করেছে?
    - না মারবো না, পূজো করবো! আমাদের কাঁঠাল চুরি করেছে!
    - কতগুলো?
    - ওই তো দেখ না গোটা একটা কাঁঠাল
    - আর তোরা কটা চড় মেরেছিস? এবার পূজো কর?
    এই বলে হাতের লাঠিটাকে মালিশ করতে লাগলো সানুয়া মাঝি। জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেলো।
    - সানুয়া তুই বিশ্বাস কর, আমি নিজের জন্য নিইনি রে। দিদিরা বলছিলো অনেক দিন কাঁঠাল খায়নি...
    - আমি সব জানি। যা যা এখন ভাগ।
    অত মার খেয়েও এতক্ষণ কাঁদেনি, এবার মাঝির কথায় আমার হাতটা ধরে একেবারে ভেঙে পড়লো সে।



    অলংকরণ (Artwork) : দীপঙ্কর ঘোষ
  • | | ৩ | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments