• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৬ | এপ্রিল ২০২২ | রম্যরচনা
    Share
  • সে (৫) : সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়
    | | | | ৫ | | | | | ১০ | ১১ | ১২



    কিছুদিন অন্য জগতে মানুষ হয়েছিলাম, সেই কিশোর বয়সের কথা। হিন্দুস্তানীই বেশী আসতো, সাঁওতালী একটু মেশানো হয়তো। অবশ্য বাংলা ইংরিজি অক্ষর পরিচয় খুব ভালোই ছিলো। নাগরী আর নাস্তালিকও অল্প সল্প। বাংলা ইংরিজি শিখেছিলুম বাড়িতে, নাগরী ডাবর কোম্পানির ক্যাটালগ থেকে আর নাস্তালিকটুকু রেল কোম্পানির আসানসোল ডিভিশনের নোটিস বই থেকে।

    যাকগে, বাংলায় মনে হয় যাকে কাঞ্চন বলা হয় সেই ফুলটির কথা বলছি। আমরা বলতুম কচনার। সব গাছের পাতা সাধারণতঃ সামনে পিছনে সরু হয়। এই গাছটির বেলায় তা হতো না। পাতাগুলির চেহারা হতো গিয়ে সামনে পিছনে হরতন-মার্কা। কে জানে বোঝাতে পারলাম কি না। সাহেবী নাম শুনেছিলাম বাউহিনিয়া।

    আর শাল গাছ তো আমরা সবাই জানি। ওই গাছের কাঠ দিয়ে তখনকার দিনে রেল লাইনের স্লীপার বা আড়কাঠ তৈরী হতো। তাই রেল কোম্পানি সে যুগে শাল গাছের চাষ করতো। মানে সে একেবারে ঘন জঙ্গল হয়ে যেতো। আমাদের কাছাকাছিই অমন একটা জায়গা ছিলো, মাইলের পর মাইল জুড়ে। শালের চারাগুলো অন্য জায়গা থেকে নাকি আনা হয়েছিলো, আর সায়েবরা যত্ন করে লাইন বেঁধে পুঁতে গিয়েছিলো। আমি যখন দেখেছি তখন গাছগুলো বড়ো হয়েছে, গায়ে সেগুলোর চুণ দিয়ে কি সব নম্বর আর দাগ, কয়েকটা কাটাও হয়েছে।

    ঘন জঙ্গলটা আড়ে আধ মাইল কি আরেকটু বেশীই ছিলো। আর লম্বায় ছিলো মাইল দু'তিন। ওই রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতর দিয়ে ছিলো দুয়েকটি শর্টকাট শুঁড়িপথ বা পাকদণ্ডী। কিছুটা ভেতরে গেলেই একদম অন্ধকার। শুধু সুড়ঙ্গের মতো সামনে বা পিছনে একটু আলো। ওগুলো দিয়ে রেলের লোকেরা যাতায়াত করতো।

    কাছেই ছিলো রেল কোম্পানির স্টীমে চালানো করাত কল।

    একদিন আমরা কয়েকজন দল বেঁধে ঢুকলাম। "দেখতে"। কারণ আর কিছুই নয়, হাতে সময়, মনে বজ্জাতি, তার ওপর ডাইনীর গুজব এই সব আর কি। তার ওপর যখন দলের একজন, যে "সামান্য স্ত্রীজাতি", বলে ফেললো যে সে আগে ভেতরে গেছে, সব চেনে তখন ব্যাপারটায় প্রেস্টিজের প্রশ্ন চলে এলো।

    যে শর্টকাটটা আমাদের পাড়ার কাছে ছিলো সেটায় সামান্য দু'পা ঢুকতেই জঙ্গলের মধ্যে বেশ কয়েকটা কচনারের গাছ চোখে পড়লো। শালের ফাঁকে ফাঁকে একদম সোজা উঠেছিলো ওগুলো। একটি বাদে।

    সেই একটি কচনার আর একটি শাল একদম মাটি থেকে উঠেছিলো একসঙ্গে। পরস্পরকে জড়িয়ে। এবং সাধারণতঃ সোজা চেহারার ওই গাছদুটি একটি আরেকটিকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বিলকুল যাচ্ছেতাই ইসকুরুপের মতো একটা চেহারা নিয়েছিলো। তাগড়া শাল আর রোগাপটকা কচনার করছিলো মারপিট। আর ওই মারপিট করতে করতে শুয়ে পড়ে আশপাশের বেশ কয়েকটা কচনার আর শালকে বেঁকিয়েও দিয়েছিলো।

    কেমন একটা বিশ্রী অন্ধকার গা ছম ছম করা ভয় ভয় ভাব ছিলো জায়গাটায়। পরে শুনেছিলাম ও ধরণের শালগাছকে লোকে বলতোও চুড়ায়েল, মানে ডাইনী গাছ। কচনারটাকে কেউ কিন্তু কিছু বলতো না।

    ওই প্যাঁচানো গাছদুটোর গায়ে এদিক ওদিক বেশ কয়েকটা কোটর মতন গর্ত বা ফাঁক ছিলো। কয়েকটায় বৃষ্টির জল, আর কয়েকটায় অন্য গাছের চারাও গজাচ্ছে দেখা গেলো।

    অসীম সাহস দেখিয়ে আমরা ছড়িয়ে পড়লাম। পাখি টাখি ডাকছিলো, অহেতুক ভয়েরও কিছুই চোখে পড়েনি। কাজেই।

    মানে দু'পা গিয়ে আবার একজন সঙ্গীর কাছে তাড়াতাড়ি ফিরে আসা, এই আর কি।

    তবে ওই - আমাদের মধ্যে বেশ ভীতু একজন ভালুকের ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে বাকীদেরও ভীতু করে তুলছিলো।

    হঠাৎ দেখি ডাইনীগাছের একটা খোঁদলে কয়েকটা আমলকী রয়েছে। রেলঝাড়ের বাইরেই একটা ছোটখাটো আমলকীর গাছ অবিশ্যি ছিলো। গুলতির অ্যামিউনিশন হিসেবে মোক্ষম জিনিস, কাজেই এদিক ওদিক তাকিয়ে কাপড়ের কোঁচড়ে পাকিয়ে নিলাম। মনটা ভালো হয়ে গেলো, তেষ্টা পেয়ে গেলো আর ফেরার কথা মনে হতে লাগলো।

    তা ফেরার সময়ে দেখা গেলো একজন কম। নাম ধরে ডাকাডাকিতে সে বেরিয়ে এলো, শুকনো মুখে ডাইনীগাছের দিকে তাকাতে তাকাতে। তারপর চোখ পড়লো আমার দিকে।

    - ওগুলো কি রে?
    - কিছু না
    - কিছু না মানে? দেখি
    - এই আমার কাপড়ে হাত দিবি না বলছি

    ততক্ষণে টেনে আমার কোঁচড় থেকে কয়েকটা আমলকী বের করে নেওয়া হয়েছে আর "কোত্থেকে পেলি" বলে আমাকে একটা ধাক্কা দেওয়াও হয়ে গেছে। দুজনেরই সাপোর্টার ছিলো, কাজেই ছোট্ট একটা মারপিট হলো। আমি বললাম

    - আরে আমি খোঁদলটায় দেখতে পেয়ে তুলে নিয়েছি তো
    - দূর, আমি কুড়িয়ে ওখানে রেখেছিলাম, ও গুলো আমার
    - তোর নাম লেখা আছে না কি
    - কুড়িয়ে পাওয়া আমলায় নাম তুই লিখগে যা, আমার বয়ে গেছে
    - দেবো না
    - ভালো হবে না বলছি, আমার আমলা আমায় ফেরৎ দে

    দেখা গেলো আমলকীর ভাগে নুন লঙ্কা ছুঁইয়ে খাওয়ার দিকেই অন্যরাও আস্তে আস্তে ভিড়ছে। বিভীষণদের ও রকম আচরণে আমিই একলা হয়ে পড়ছি।

    - নে তোদের আমলা, গিল গে যা। কি লোভ রে বাবা…

    আমলকীগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমি হন হন করে এগিয়ে গেলাম।

    তার পরের দু'দিন দেখলাম আমার কাছে বাংলা পড়বার সময়ে পড়তে না এসে সাহুদের কাঁচা ইঁটের পাঁজার ওপর বসে বসে ডাঁসা পেয়ারা চিবোচ্ছে। অন্য দিকে তাকিয়ে, পাছে কেউ পেয়ারা চেয়ে বসে।

    তৃতীয় দিনে "আমার পড়াবার সময় নেই" বলতে গিয়েও বলতে আর পারলাম না আমি। আর শেলেট পেন্সিল চুষে খাওয়ার অপরাধে পিঠে একটা কিলও কষিয়ে দিলাম।



    অলংকরণ (Artwork) : দীপঙ্কর ঘোষ
  • | | | | ৫ | | | | | ১০ | ১১ | ১২
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments