• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৬ | এপ্রিল ২০২২ | রম্যরচনা
    Share
  • সে (৪) : সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়
    | | | ৪ | | | | | | ১০ | ১১ | ১২



    পূর্ব রেলওয়ের আসানসোল ডিভিশনের বড়ো জংশন, বাংলার সীমান্ত থেকে এমন কিছু দূরও নয়। শহরটিতে রেল অ-রেল মিলিয়ে থাকতোও প্রচুর বাঙালী। স্থানীয় অবাঙালীরা প্রায় সবাই বাংলা বুঝতো ও বলতো। তাদের অনেকেই বাংলা পড়তো এবং লিখতো। রেলের একটা ইসকুলে বাংলা পড়ানোও হতো।

    বহু বাঙালী ভদ্রলোক শহরটিতে কোথাও বাগানবাড়ি, কোথাও অট্টালিকা তৈরী করেছিলেন ছুটি কাটাবার জন্য - অন্যতম ছিলেন সার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।

    আর আমাদের বত্রিশটি কুণ্ডু বাংলো তো ছিলোই।

    তার ওপরে বছরে তিনবার, গরমে, পুজোয় আর বড়দিনে বাংলা থেকে প্রচুর হাওয়াবদলকারীদের সমাগম হতো। যাঁদের বলা হতো ড্যাঞ্চিবাবু।

    সব মিলিয়ে আমাদের শহরটিকে আধা-বাঙালী বলা যেতেই পারতো। তা সত্বেও বাঙালী দুর্গাপুজো (যার পদ্ধতির উৎস বিহারের বিদ্যাপতি) আর বাঙালী সরস্বতী পুজো মাত্র দুয়েকটি হতো। বিহারী পদ্ধতিতে দুর্গাপুজো অবিশ্যি হতো কয়েকটা।

    নতুন কাপড়চোপড়ের চলটা বাঙালীদের দেখাদেখি অনেক বিহারীরাও শুরু করেছিলো। বিশেষ করে যারা বাঙালীদের সংস্পর্শেই বেশী থাকতো।

    আর পুজোয় বেড়াতে আসার সময় আমার মা নতুন পুরোনো মিলিয়ে অনেক জামাকাপড় আনতেন, যার মধ্যে থেকে নতুনগুলো দিদা পুজো উপলক্ষ্যে অনেককে দিতেন। অন্যগুলি দেওয়া হতো প্রয়োজন বুঝে।

    ঠিক মনে নেই, বোধ হয় ইংরিজি ১৯৬২ সালে দুটো দুর্গাপুজো হয়। অষ্টগ্ৰহ, দৃক্ সিদ্ধান্ত ইত্যাদিও কিসব শোনা যাচ্ছিলো। কয়েকদিন পর কিউবা গোলমালের ফাঁকে চীন হামলা এসবও হয়। মনে হচ্ছে ঐ বছরেই দিদা কাপড় বিলোনো শুরু করেন আর "কোন পুজো?" তাই নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক ইত্যাদি হয়েছিলো। কে জানে হয়তো সবটাই ভুল বলছি।

    যাক, যা বলছিলাম। গুপ্তপ্রেশ পঞ্জিকা মতে পুজোর সময় মিলিয়ে হাইকোর্ট ছুটি হলো আর আমাদের কলকাতার বাড়ির লোকজন তখন আমাদের ওখানে বেড়াতে এলো। সকাল সাতটা কুড়িতে মোগলসরাই প্যাসেঞ্জারের রিজার্ভ কামরা খালি করে প্ল্যাটফর্মে ওদের পা পড়তে না পড়তেই বোধ হয় বাজারে খবর পৌঁছে গেলো - কেন না টাঙা চারটে আমাদের বাড়িতে ঢোকবার আগেই ঝাঁকা নিয়ে বুড়ো মুরগীওলা ফটকে দণ্ডায়মান!

    ওই মুরগীরা স্বর্গলাভ করার পর কালিয়া হয়ে যেতো কাঁটালতলায় তিনটে থান ইঁটের একখানা চুলোর ওপর।

    একদিন দিদা আর মা বসলেন কাপড় দিতে। যে জামাটি দিদার চোখে সবচেয়ে ঝলমলে মনে হলো সেটি প্রথমেই সরিয়ে রাখা হলো যে ম্যাক্সিমাম দিদাকে "ম্যানেজ" করে তার জন্য। যে কোনো চিলের হিংসে হবে এমন স্পীডে সেটি তুলে নিয়ে দিদাকে আর মাকে "গোড়" করাও হয়ে গেলো তক্ষুণি। তারপর পেলো অন্যরা।

    ক'দিন পর ষষ্ঠী। বিকেলে রেলবাগানের পুজোয় গেছি। বিভিন্ন বয়স, ধর্ম, জাতির স্ত্রী-পুরুষে প্যান্ডেল ভর্তি। কুণ্ডুবাংলোর আইসক্রীম, কানা পাগড়ীর ফুচকা, পাঁপড়ভাজা শুরু হয়ে গেছে। বৈজয়ন্তীমালার পাশে দাঁড়িয়ে তাজমহলে ফটো তোলাবার স্টুডিয়ো খুলে গেছে - সেখানে এরোপ্লেনের ককপিট, প্রমাণ সাইজে শ্রীরাধিকার পাশে বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণের শরীর, এ সব অপশানও লাগানো হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে বিশুদারা মিষ্টির দোকান খুলবে একটু পরেই। বাবাদের কয়েকজনকে ভালো চাঁদার আশায় চেয়ারে বসিয়ে চা সিগারেট (গোল্ড ফ্লেক) খাওয়ানো হচ্ছে। প্ল্যাটফর্ম টিকিট ব্ল্যাক করার ওস্তাদ আমারই বন্ধু এমরান গিরিডি লোক্যালের কামরায় উশ্রী যাওয়ার জন্য সীট "রিজার্ভ" চাই কি না নীচু গলায় জিগ্যেস করে বেড়াচ্ছে। হিন্দু বান্ধবীদের হাতে মুসলমতীরা প্রণামীর জন্যে আড়াই আধুলি গুঁজে দিচ্ছে। একদিকে অকারণে ঝগড়া হচ্ছে। আরেকদিকে কারণে ঝগড়া হচ্ছে। কয়েকজন বাঙালী মহিলা পাটাতনের ওপর বসে আছেন, বাকীদের এসে পৌঁছতে ঢের দেরী।

    মোট কথা পুজো জমজমাট।

    হঠাৎ আমার সামনে দিয়ে চলে গেলো সেই ঝলমলে জামাটি। সেটার ভেতরের জীবটি আমার চেনা কিন্তু সে সেদিনের সেই ছোঁ মেরে তুলে নেওয়া "চিল" নয়। কাহারদেরই আরেকজন।

    কি মনে হলো, ফিরলাম। ফেরার পথে দু'পা ঘুরে কাহারপট্টিতে হাজির হলাম গিয়ে। দেখি যার জামা সে তার সৎমার সঙ্গে বিহারী বাঘবন্দী খেলছে। যে খেলার নাম (গুজরাটী চায়ের মতো) বাঘ-বকরী। আমাকে দেখেই ছিটকে উঠে দাঁড়ালো, কিন্ত পালাবার একমাত্র পথ আমি আটকে।

    এক লহমা। আমি কিছু বলার আগেই গল গল করে শুরু হয়ে গেলো - এই তুই কাউকে বলিস না রে, ওরা কিচ্ছুটি পায়নি রে, তাই আমি ওদের জামাটা পরতে দিয়েছি, পুজোর পর ওরা ঠিক ফিরিয়ে দেবে, শুনছিস, তুই কাউকে বলিস না রে, দিদাকে কিচ্ছু বলিস না রে…



    অলংকরণ (Artwork) : দীপঙ্কর ঘোষ
  • | | | ৪ | | | | | | ১০ | ১১ | ১২
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments