সে জিগ্যেস করলো - কি রে তোরা সব কোথায় ছিলি?
রতন - ইয়ে, রামু বললো সেজদাদু না কি পাঁচপোয়া পেঁড়া নিয়েছেন, তাই একবার খবর…
- পেঁড়ার খবর নিতে গিয়েছিলি ? ও! তা আমারটা?
অনিচ্ছা সত্বেও কাপড়ের কোঁচড় থেকে পেঁড়া বার করে আমি বললাম - এই নে।
- এই তো লক্ষ্মী ছেলে।
পেঁড়াটা ভেঙে আধখানা ডান হাতে করে আমাকে ফেরত দিয়ে নিজেরটুকু মুখে পুরে -
- লাজওয়াব, না রে? শোন, তোদের ইয়ার এমরান এসেছিলো, দরকারী কথা আছে বলে গেছে, আবার পরে আসবে।
গণশা - কি বলে গেছে? বল না?
খুব ব্যস্ত ভাবে - কাজ আছে, ফিরে এসে বলছি - বলেই দৌড়।
বারো নম্বর কুয়োয় বসে জল খেয়ে তিনজনে ভাবছি কি হলো আবার, পুজোর সময়টা, এই সেদিন নদীপারের মেলায় এমরান ভালো রোজগার করেছে, মসজিদ টীমের সঙ্গে ম্যাচ লাগাতে এসেছিলো নাকি?
কিছুক্ষণ পর "গঙ্গাপ্রসাদ হাউস"-এর দিক থেকে নাচতে নাচতে ফিরে এসে চারটে পেঁড়া বার করে - - না, মতলবটা এমরান ভালোই এঁটেছে, বুঝলি।
- কখন এসেছিলো রে? এই তো সকালেই দেখলুম বিশুদাদের মিষ্টির দোকানের সিঁড়িতে বসে কানা পাগড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করছে।
- বেশ করেছে ঝগড়া করেছে। কানাটা এমন পাজী, একদিন দেখলুম সান্তিয়াকে এক আনার পরে একটা ফাউ দিলো, আর আমি যেদিন ফাউয়ের জন্যে দোনাটা এগিয়ে ধরলাম অমনি কি না আমাকে বললে যাও ভাগো।
ফুচকা ও দিগরে আনায় তখন ছ'টা।
- আরে বেচে তো কানোয়াটা ফুচকা, আসলে ওর তিন তিনটে ঘোড়া আছে, ডালমিয়া কূপের লাইনে পাথরোলের টাঙ্গাতে ভাড়া খাটে। ঘোড়ার ডাক্তারবাবুর মেয়েকে তো ও ডেকে ডেকে ফাউ দেবে রে।
- আর তা ছাড়া একচোখোমি কানোয়া করবে না তো করবেটা কে - যেই না আমি বলেছি কথাটা অমনি চারজনের সে কি হাসি!
এই কানা পাগড়ী বা কানা বা কানোয়া ছিলো সে সময়ে মধুপুরের একমাত্র ফুচকাওয়ালা। অনেকদিন আগে কোনো কারণে ওর একটি চোখ অকেজো হয়ে যায়। তাই কানা ওর শাদা পাগড়ীটা এমন ভাবে হেলিয়ে বাঁধতো যাতে সেই চোখটি ঢাকা থাকে। এটাই ছিলো আমাদের ওই নিষ্ঠুর হাসির কারণ!
সাইকেলের তিনটে সামনের চাকা আর একটা পিছনের চাকা দিয়ে তৈরি একটা চৌকো ঠেলাগাড়ীতে করে বিকেলে ফুচকা আর কাঞ্জি বড়া নিয়ে কানা পাগড়ী গান্ধী চকে আসতো। ওর একটা চূণাবাতি ছিলো। কোনো কোনো দিন কাঞ্জি বড়ার বদলে খেসারির ডালের পকোড়ি আনতো, সেটা আবার খেসারির ডালের তৈরি বলে অনেক বাড়িতে খাওয়া বারণ ছিলো। তা চকে পৌঁছে একটা চাকার নীচেয় একটা ইঁটের টুকরো লাগিয়ে দিতো, যাতে গাড়ীটা আমাদের ওই আধা পাহাড়ে শহরে গড়িয়ে না যায়। এখন হলো কি, অন্যদের ফাউ না দিয়ে শুধু বি ডি ও-র ভেটারিনারি ডাক্তারের মেয়ে শান্তি পাণ্ডেকে ফাউ দেওয়ার অপরাধে ওই ইঁটের টুকরোটা একদিন একটু সরিয়ে কানার গাড়ীটিতে এ-এ-একটু ঠেলা দেওয়া হয়েছিলো, "কেউ কিছু করিনি"। পাঠিকা, ভেবে দেখুন, গাড়ীর ওপর এক জালা ফুচকার জল, আর এক ডেকচি বড়ার কাঞ্জি! চূণাবাতিটাও!
- যাক, এমরান কি বলছিলো সেটা বল।
- বলছি। আরে ঐ দেখ এমরান নিজেই আসছে।
- অ্যাই এমরান কি ফন্দী এঁটেছিস রে তুই?
- আরে দূর কিছুই না, ডেঞ্চিবাবুরা যখন আসে তখন আমি যেটা করি সেটাই বলছিলাম।
- ও তোর সেই গিরিডির গাড়ীতে জায়গা ধরা?
- আরে আমি বলছিলাম কি যে কাহার গল্লির ছেলেগুলো তো বিশেষ কিছুই করছে না। আবার ইস্টিশনের খবর হলো যে আরো ডিব্বা নেই বলে গিরিডিতে আর বাড়তি গাড়ী দেওয়াও যাবে না। তাহলে তো বাঙালী বাবুরা আরো জায়গা চাইবে, তাই না?
একটু পিছিয়ে ব্যাপারটা বলি। সাধারণতঃ ছুটির মৌসুমে গিরিডির কাছে ওই ছোট্ট উশ্রী নদীর সুন্দর ছড়ানো ঝর্ণাটায় বিশেষ জল থাকতো না। আরে বাবা, রবীন্দ্রনাথের "সহজ পাঠ"-এ যে ঝর্ণার কথা আপনারা পড়েছিলেন সেটির কথাই বলছি। বিশ্বকর্মা পুজোর পর জল খুবই কমে যেতো। তাও জায়গাটা ভারী মনোরম ছিলো বলে লোকে পিকনিক করতে যেতে ভালোবাসতো। লুচির পিকনিক - মানে ওখানে রান্নাবাড়ি হবে না - দুটো কারণে। এক, জায়গাটা বড্ড পাথুরে আর দুই, রান্নার গন্ধে ভালুক চলে আসার ভয় ছিলো শুনেছিলাম অবশ্য অনেকে নাকি গজাধর কন্ট্র্যাক্টরকে খবর দিয়ে দুপুরে উশ্রীতে গরম গরম তৈরী খিচুড়ী ইত্যাদি আনিয়ে নিতো।
সারা দিনে বার চারেক একটা গাড়ী মধুপুর থেকে গিরিডি যেতো। ফিরেও আসতো। সকালে দু'বার, সন্ধ্যায় দু'বার। গাড়ীটায় বোধ হয় তিনটে থার্ড, আধখানা ফার্স্ট আর আধখানা গার্ড ইত্যাদি ডিব্বা লাগতো । বিনা টেন্ডারের ছোট্ট ইঞ্জিন। দুয়েকটা মালগাড়িও সারাদিনে যেতো আসতো। দুঃসাহসী স্থানীয় লোকজন অনেকে মালগাড়ীতেও যাতায়াত করতো - আমি? মালগাড়ীতে? এসব আজে বাজে কথা আপনাদের কানে কে তুললো? নৈব নৈব চ, পাঠিকা, বিশ্বাস করুন।
বাঙালী চেঞ্জার মাত্রেই বিশুদাদের "বর্দ্ধমান মিষ্টান্ন ভাণ্ডার - গিরিডি ভিন্ন ব্রাঞ্চ নাই"-এ যেতেন। ওই বিশ্ববিখ্যাত দোকানটির কাছাকাছি ঘোরাফেরা করতো আমাদের ওই হতভাগা এমরান। চেঞ্জারদের কাছে উশ্রীর ঝর্ণাটাকে পাবলিসিটি দিয়ে বেড়াতো আর জিগ্যেস করতো গিরিডির গাড়ীর কামরায় রিজার্ভ করা সীট চাই কি না। মধুপুর-গিরিডি তখন রেলে রিজার্ভেশন হতো না। যাত্রীদের চেহারা টেহারা, দলের জনসংখ্যা ইত্যাদি দেখে আধুলি থেকে গোটা টাকা কিছু একটা চার্জ করতো। তারপর ঠিক দিনে সকাল সকাল গিয়ে কামরার বেঞ্চিতে টুপিটা লুঙ্গিটা ফেলে রাখলেই হলো! শুনেছিলাম বাঁদরটা নাকি একবার মিষ্টির দোকান থেকে কয়েকটা খাবারের এঁটো চ্যাঙাড়িও রেখে এসেছিলো।
ও যা ফন্দী এঁটেছিলো তা ছিলো জলের মতো সহজ :-
কাহারপাড়ার ছেলেগুলোকে ও শিখিয়ে পড়িয়ে খদ্দের ধরবার আর সীট রাখবার কাজে একদম পোক্ত করে দেবে। আর ওরা সকালের ওই গিরিডির গাড়ী দুটোয় যা রোজগার তুলবে তার আনায় পয়সা পয়সা (মানে ২৫%) এমরানকে দেবে। এতে নাকি সকলেরই লাভ। আর রেলপুলিস? এখনকার মতো তখনও ওরা দু'রকমের হতো। আর পি এফ আর জি আর পি। এই সামান্য ব্যাপারে সেই রক্ষকদের ভক্ষণের জন্য যা কিছু করবার দরকার তা নাকি এমরানের হাতের মুঠোয়। আজ না হয় ঝাঝা স্টেশনে পোস্টেড হয়েছে, কিন্ত জি আর পি-র আজিজ হাবিলদার তো সেই এমরানেরই ইয়ের কে যেন।
নিজে না নিয়ে নতুন সেট-এর চারটে সেজদাদুর পেঁড়া আমাদের বাকি চারজনকে দিয়ে দেওয়া হলো। তার পর একটু থেমে আমাদের সকলের মুখ একবার ভালো করে দেখে নিয়ে -
- শোন এমরান, তুই যখন আমাকে সব বলে গেলি তখন আমার মনে হয়েছিলো ব্যাপারটা বেশ জমবে। এখন আরেকটু ভেবে কিন্ত অন্যরকম মনে হচ্ছে।
- কেন রে কি হলো আবার? তোদের বলছি এই জন্যে যে তোরা সবাইকে চিনিস, বুঝিয়ে টুঝিয়ে বলতে পারবি ছেলেগুলোকে।
(মাথাটা চুলকে - এসব ওদের ব্যাপার, বুঝলি? আমি আসছি ভাই, বেলা হলো - বলে পেঁড়া হাতে রতন হাওয়া; গণেশটা দাঁড়িয়ে রইলো।)
- শোন এমরান, তোরা এইসব ভাবছিস শহরে যখন ছুটি, চেঞ্জার বাবুরা যখন আসবে, ঠিক তখনকার সক্কালবেলার জন্যে, তাই তো? সেটা ঠিক হবে না রে। ছেলেগুলোর ভোরবেলা উঠে খেতখামারে কাজ শেখবার, কাজ করবার বয়স হয়েছে, এখন যদি ওরা এইসব করে তো ওই রোজগারে ওরা আজ ফুঁকবে বিড়ি, কাল গিলবে হাঁড়িয়া। কিম্বা ধর ইস্টিশনে পুলিস পাল্টালো, কি তুই মিহিজামের ইঞ্জিন কারখানায় কাজ নিয়ে চলে গেলি, তখন এদের কি হবে বল তো? তুই তো শুনেছি সত্যিই মিহিজামের কথা ভাবছিস, তাই না? এসব ধান্দা ওদের ধরাস না, তুই নিজেও ছাড়, বুঝলি?
পনেরো-ষোলো বছর বয়সের একজনকে এই সব কথা শোনালো এগারো-বারো বছর বয়সের আর একজন। আমরা বাকীরা সব দাঁড়িয়ে শুনলাম।
এমরান ধান্দাটা সত্যিই কিছুদিন পর ছেড়ে দেয়। শুনেছিলাম উশ্রীতলপিকনিকার্থী ডেঞ্চিবাবুরা পরে নাকি ওই সীট রিজার্ভেশনের পরিষেবাটা পেতেন রেলপুলিসেরই কয়েকজন সেপাইয়ের কাছ থেকে।
কি হলো পাঠিকা? কি ভাবছেন? সামনের বিষ্যুৎবার বিকেলে আমাকেও চায়ে ডাকবেন তো?