• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | রম্যরচনা
    Share
  • সে (১০) : সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২



    সে এক অন্য যুগ ছিলো।

    স্বস্তিক না কোন একটা কোম্পানি "ডেট" নামের একটা গুঁড়ো সাবান বার করলো - সাবানের আবার গুঁড়ো কি - এই বলে ভারতের গৃহিনীরা সেটি ছুঁলেন না।

    ভারতে স্টেনলেস স্টীল তখন তৈরী হতো না। হলে, পাঠিকা, আপনার মা দিদিমারা হয়তো নাকটা কুঁচকে - স্টীলের আবার স্টেনলেস কি - এই বলে ও সবের দিকও মাড়াতেন না।

    এই সব নানা রকম ভেবে, সম্ভবতঃ পাঁজিও দেখে, এক রবিবার বিকেলবেলা ওই ডেট কোম্পানি ঠিক করলো যে অফিসের দিন দুপুর বেলায় ওদের মহিলা কর্মচারীরা দুজন দুজন করে টীম বানিয়ে নানা শহরের গৃহিনীদের আক্রমণ করবেন। সামনে ধরে থাকবেন ব্রহ্মাস্ত্রস্বরূপ একটি ছোট সাইজের বিলিতি স্টেনলেস স্টীলের হাতা, হ্যাঁ হাতা, চকচকে পালিশ করা রূপোর মতো যে জিনিসটি টেবিল চামচের চেয়ে সামান্য বড় এবং, অবাক কাণ্ড, যেটির হ্যান্ডেলপ্রান্তে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র, যাকে বাংলায় বলা হয় ফুটো। ওই ছিদ্র দিয়ে সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারের বাংলা ক্যালেন্ডারের ওপরের পেরেক থেকে হাতাটিকে ঝোলানো যাবে, ক্যালেন্ডারেরই ওপর।

    "মাসীমা আমরা গিয়ে, এই, বল্ না।"

    "হ্যাঁ, আমরা স্বস্তিক কোম্পানী থেকে আপনার জন্যে একটা ফ্রী গিফট, মানে উপহার এনেছি, আমাদেরই বিশ্ববিখ্যাত গুঁড়ো সাবান ডেট-এর প্যাকেট। বিনামূল্যে, মাসীমা, এটি আপনার।"

    "না না, ও সব গুঁড়ো ফুঁড়ো চাইনে, কবে রাঁধুনী বামনী নুনের বদলে ভুল করে..." বলতে বলতে গৃহকর্ত্রীর চোখ কিন্তু ততক্ষণে আটকে গেছে সেই হাতাটির ওপর; ওই তখন বললাম না, ব্রহ্মাস্ত্র।

    "আর যদি এই বড় প্যাকেটটি নেন, মাত্র পাঁচ সিকে, তাহলে ছোট প্যাকেটের বদলে বিনামূল্যে পাবেন বিলিতি এই হাতাটি, একে বলে সার্ভিং স্পূন মাসীমা, মেমেরা খুব ব্যবহার করে। তবে কিনা মাসীমা, ভীষণ ডিমান্ড তো, তাই বাড়ি পিছু একটা করেই বিক্রি করার অর্ডার আছে আমাদের।"

    দাদু একটু দূরে ঈজি চেয়ারে ঘুমোচ্ছিলেন, মানে সব কিছু শুনছিলেন আর কি। আর এ দিকে গৃহকর্ত্রী মানে দিদা ভেতরে সরে এসেছেন, মেয়েদুটিও দরজার ভেতরে ঢুকে পড়েছে, একজন এক গেলাস জলও চেয়ে ফেলেছে। ভেবে দেখুন, প্রত্যেক বাড়িতে জল চেয়ে খাওয়ার চাকরি, কি শক্ত কাজ। আমেরিকানরা গুপ্তচর ধরে নাকি ঐভাবে টর্চার করে।

    "ও তোমাদের অর্ডার টর্ডার তোমরা বুঝো বাপু, আমি দু'টাকা দিচ্ছি, আমার দুটো চাই।"

    "মাসীমা তা কি করে হয় মাসীমা, এ তো কোম্পানির বেঁধে দেওয়া দাম মাসীমা।"

    এই শেষের বাক্যটির তৃতীয় "মাসীমা"য় বোধ হয় কাজ হলো, দিদা বললেন -

    "আচ্ছা আচ্ছা, ন'সিকেই দোবো 'খন। ওরে, জলটা কই।"

    "এই নিন মাসীমা, আপনি যখন বলছেন।"

    জল এসে পৌঁছবার আগেই চটপট ওরা দু'জন পালালো।

    এ হেন পদ্ধতিতে বাগানো চকচকে দুটি ছোট্ট হাতা নিয়ে আমরা কিছুকাল পরে মধুপুরে চলে গেলাম। সঙ্গে অন্যান্য জিনিসপত্রও ছিলো অবশ্য, যথা

    ১৭) প্রাইমাস স্টোভ ১
    ১৮) ঐ পাম্প করার নাতি ১
    ১৯) ঐ তেলের ফুঁদেল ১
    ২০) হ্যাসাক লন্ঠন ২

    তা সেখানে পড়শিনীরা এলে যেদিন হাতাগুলো ব্যবহার হয়নি সেদিনও দিদা অল্পবিস্তর গলাটা উঁচু করে বলতেন -

    "এই চাম্পার মা, টেনলেশের হাতা দুটো ঠিক করে মেজেছিস তো? দেখিস যেন মাছে টেনে না নেয়।"

    "কই আজ তো টেলনেশ গুলো পড়েনি গো মা।"

    "নিয়ে আয় একবার দেখি তো ওগুলো।"

    বারো নম্বরের পিসিমা, তিরিশ নম্বরের কম্পাউন্ডারবাবুর গিন্নী, গিরি কুটিরের মাসীমা এনারা সব অবাক হয়ে দেখতেন অ-মূল্য সেই সাত রাজার ধন এক মাণিক হাতা জোড়া।

    দিব্যি চলছিলো, নীলের ক'দিন আগে হঠাৎ গেলো ওই হাতা দুটোর একটা হারিয়ে। দুনিয়া উপুড় করে খোঁজা হয়ে গেলো, পুকুরটায় জাল ফেলা (!) বাকি, এমন সময়ে দাদু গেলেন চটে - "সামান্য একটা হাতার জন্য জ্বালাতন করে মারছো সবাইকে, নিকুচি করেছে তোমাদের হাতার। পেয়েছিলে তো সাবান গুঁড়োর সঙ্গে।"

    "সামান্য নয়, তুমি কি বুঝবে।" বলে দিদা ফোঁৎ ফোঁৎ ফোঁস ফোঁস করতে করতে চলে গেলেন, সবাই সবাইকে সন্দেহ করতে করতে সরে পড়লো। শুধু দিদার চাম্পার মা, যে অন্যদের চম্পার মা, সে একা পা ছড়িয়ে বসে কেঁদে ভাসিয়ে দিলো। এমন কি আমাকে একবার বলেই ফেললো আঁশবঁটিটা এনে ওর মুণ্ডুটা কেটে ফেলতে। ঘাট থেকে ধুয়ে এনে সে-ই হাতাটিকে ভেতরবাড়ির উঠোনের সিঁড়িতে রোদে শুকোতে দিয়েছিলো কিনা।

    দিদা একবার ভাবলেন চতুর্দিকে চোরছ্যাঁচোড়, অন্য হাতাটা তুলেই রাখবেন। তারপর মোহমুদ্গরের কায়দায় ভাবলেন দুত্তোর।

    নীলের দিন দুপুরে ঠিক একই জায়গা থেকে একই অবস্থায় যমজ অন্য হাতাটিও হাওয়া হয়ে গেলো। এবারে যা কাণ্ড হলো তা আর কহতব্য নয়। সবাই সবাইকে মুখের ওপরেই সন্দেহ করতে লাগলো। এক মাসের বাচ্চা ফক্স টেরিয়ার জ্যাকি পর্য্যন্ত ঘাবড়ে গিয়ে আমার পায়ের ফাঁকে দাঁড়িয়ে কুঁই কুঁই করতে লাগলো। দিদা বলে দিলেন যে আমরা কলকাতায় ফিরে যাবো। সবাই গেলো দমে।

    বিকেলের দিকে ব্রজ ধামের ছোট পিসি এসে তার দৃঢ় বিশ্বাস দিদাকে জানালো যে এ আর কিছুই না, ভুতুড়ে কাণ্ড। কোনো বেহারী পেত্নী, অমন জিনিস আগে দেখেনি তো, তাই অন্যদের মতো ওরও একটু লোভ হয়েছে। হাতা নিয়ে কি আর করবে, দু'দিন বাদে ঠিক ফেরৎ দিয়ে যাবে। আঞ্চি দেবী কন্যা বিদ্যালয়েতে পড়াতো ছোট পিসি, দিদা সমগ্ৰ ইস্কুলের মুখে ফুল চন্দন পড়ার আশীর্বাদ করে আমাকে দিয়ে স্টোভ ধরিয়ে ওকে চা খাইয়ে দিলেন - সে এক অত্যুচ্চ সম্মান।

    কিসুই হলো না।

    মাস খানেক পর। আম কাঁঠাল পাকছে। ঠেকাদার মেওয়ালালের অগুণতি ছেলেরা কর্মচারীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যাতে চুরি-চামারি না হয়। মাথায় ঝাঁকড়া চুল বা কানে জবার ফুল গোঁজা না থাকলেও তাদের হাতে লাঠি সততই বিদ্যমান। ভোরবেলা আমাদের বাংলোর কাছের কাঁঠাল গাছটার তলা দিয়ে যেতে যেতে তারা হঠাৎ শুনলো - "এই, তোদের একটা লাঠি একটু এগিয়ে দিবি?"

    ভেবে দেখুন পাঠিকা, দুটি নিরীহ ছোট ছেলে, মাত্র বছর পনেরোর হবে হয়তো, ভোরবেলা কাঁঠাল গাছের তলায় ওই সব শুনলো। ফলে যাকে বলে কালবিলম্ব না করে, যারপরনাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে একদৌড়ে আমাদের বাংলোর রোয়াকে উঠে ভূতের ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। তাদের আসার আওয়াজে আমরা বাইরে গিয়ে ওদের দেখতে পেলাম; একজন ডুকরে কাঁদছিলো, মাতৃবিয়োগের উল্টোটা হলো বুঝি এই ভেবে।

    আর দেখলাম পাঠিকা, আপনাদের সুপরিচিত তৃতীয় একজনকে। হাতে দুটো স্টেনলেস স্টীলের হাতা নিয়ে সে নেচে নেচে আমাদের বাড়ির দিকে আসছে। আর অন্য দুজনকে বলছে -

    "কি রে, ভূতের ভয় পেয়েছিলি বুঝি? আরে ভূতে তোদের কি করবে, তোরা তো নিজেরাই ভূত‌।"

    আর তারপর -

    "এই দেখো দিদা তোমার হাতা, কাক নিয়ে গিয়েছিলো, আজ ক'দিন হলো বাসাগুলোয় খুঁজে বেড়াচ্ছি, আজকে পেয়ে গেলাম। রোসো, ধুয়ে আনছি।"

    দিদা হাতা দুটো ওকে আর ওর পিসি, মানে চাম্পার মা-কে দিয়ে দিলেন।

    এই বিষ্যুৎবার চায়ের আসরে আসতে পারছি না পাঠিকা, একটু কাজ আছে। মানে, আরেক জায়গায় নেমন্তন্ন আছে।



    অলংকরণ (Artwork) : দীপঙ্কর ঘোষ
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments