“কার মেল রে? একেবারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে ফেলছিস! কোনো সমস্যা—”
শোভন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কখন যেন। সমাদৃতা তাড়াতাড়ি ফোনটা বন্ধ করে দিয়ে কথা ঘুরিয়ে বলল, “তুই আবার ফরিদাকে ছেড়ে পিছিয়ে এলি কেন? যা, আমি আসছি পেছন পেছন।”
তিস্তার বুক থেকে হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়ার স্রোত ছুটে আসছিলো। গায়ের চাদরটা ভালো করে মুড়ি দিয়ে নিল সমাদৃতা। বুকের ভেতর যে কাঁপুনিটা চলছে তার সে কাঁপুনি এই চাদরের আবরণে কমবে না। মনে মনে একবার প্রশ্নগুলোর উত্তর সাজিয়ে নিল সে। আজ রাতেই জবাবটা পাঠিয়ে দিতে হবে। এই জায়গাটায় তার আর বিল্টুর বোধ হয় আর স্থান হবে না।
|| ১৯ ||
“বাবা, তোমার ফোন। সমরেশকাকা করেছে। মা বললো, দূরে গিয়ে কথা বলতে, নইলে ভাই উঠে পড়বে।”
ফোনটা শোভনের হাতে দিয়ে সুরভি তাড়াতাড়ি টেপরেকর্ডারের সঙ্গে লাগানো ইয়ারফোনের তারটা শোভনের কান থেকে খুলে নিয়ে বাবু হয়ে বসে নিজের কানের ভেতর গুঁজে দিল। ছেলেটা পাশে দোলনায় ঘুমোচ্ছে। সেদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে শোভন হাতের কাগজকলম টেবিলের ওপর রেখে ফোনটা হাতে উঠে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। নটা বাজে প্রায়। হলদে থেকে ক্রমশ সাদা হয়ে ওঠা রোদে বারান্দাটা মাখামাখি হয়ে আছে। এ শহরে সকাল খুব সুন্দর হয়।
“বল।”
“কনগ্রাচুলেশনস শোভনদা,” ওপাশ থেকে সমরেশের গলা উত্তেজিত শোনাচ্ছিল।
“কী ব্যাপার রে?”
“কী ব্যাপার মানে? তোমায় উত্তমদা কিছু বলেন নি?”
“না। বেশ কয়েকদিন কোনো কথা হয় নি ওর সঙ্গে।”
“ও, তাই? তাহলে হয়তো খুব ব্যস্ত থাকায় আর কিছু যোগাযোগ টোগ করে নি। ডিসেম্বরের লাস্ট উইক থেকেই প্রায় দু সপ্তাহ হল এদিকেও আসছে না। শ্যামলবাবুকে ডেপুট করে দিয়ে গেছে। উনিই দেখাশোনা করছেন সমস্ত। কিছু একটা মামলা নিয়ে খুব দৌড়োদৌড়ি চলছে ক’দিন উত্তমদার।”
“মামলা মানে, আমার কেসটা তো?”
“উঁহু। পার্সোনাল কিছু। কীসব ডেট টেট পড়ছে সামনে বললেন সেদিন। ভেঙে বলে নি কিছু।”
শোভন ব্যাপারটা নিয়ে আর কথা এগোতে চাইছিল না। বলল, “ঠিক আছে। সে কথা থাক সমরেশ। হঠাৎ এত উচ্ছ্বাসের কী ব্যাপার হল সেটা বল।”
“উচ্ছ্বাস হবে না শোভনদা? শ্যামলবাবু আজ এসে খবর দিয়ে গেলেন। কেজরিওয়াল কনসালট্যান্ট এইখানে হেমলতা বিদ্যামন্দিরকে সেন্টার করে যে এডুকেশন প্রজেক্টটা বানাচ্ছে আপনি তার অ্যাকাডেমিক হেড হবেন। এলাকার প্রত্যেকটা স্কুলে একটা করে ব্রাঞ্চ তৈরি হচ্ছে কেজরিওয়াল কনসালটেন্সির এডুকেশান উইং-এর। হেমলতাতে ওর ব্রাঞ্চ হেডকোয়ার্টার হবে। বাড়িটা ওরা একেবারে নতুন করে তৈরি করে দেবে শোভনদা। আগামী সপ্তাহে তুমি ফিরে এলেই কাগজপত্রের কাজ শুরু হয়ে যাবে।”
“আগামী সপ্তাহে—আমি ফিরে আসছি একথা তোকে কে বলল?”
সমরেশ হঠাৎ চুপ করে গেল একটু। তারপর একটু হোঁচট খাওয়া গলায় বলল, “না মানে, শ্যামলবাবু বলছিলেন—”
“শ্যামলবাবু বলছিলেন? ঠিক আছে। ফোনটা তুই ছাড় এখন। আমি একটু খোঁজ নিচ্ছি ব্যাপারটা নিয়ে।”
সমরেশ একটু ইতস্তত করে বলল, “না মানে শোভনদা, বলছিলাম কি, উত্তমদাকে এখন ডিস্টার্ব না করলেই ভালো হত—মানে কয়েকদিন আগে ফোন করাতে একটু বিরক্ত হয়েই বলল, এখন কদিন এসব ব্যাপারে যা কিছু বলবার শ্যামলবাবুকে বলতে। আপনি বরং শ্যামলবাবুকে একবার যদি—”
ফোনটা কেটে দিল শোভন। একটু বিরক্ত লাগছিল তার। সমরেশের কথার মধ্যে উত্তম সম্পর্কে একটা প্রভুভৃত্য সম্পর্কের গন্ধ ফুটে উঠছিলো। ফোনের অ্যাড্রেস বুক থেকে উত্তমের নম্বরটা খুঁজছিল সে--
পেছন থেকে দুটো কচি গলার হাসির শব্দ উঠল হঠাৎ। বিল্টু কখন এসে সুরভির ইয়ারফোনের একটা বোতাম নিয়ে নিজের কানে গুঁজে তার পাশে বসে পড়েছে। উত্তরবঙ্গের বিচিত্র টানে উচ্চারিত লক্ষ্মীর পাঁচালির সুর শুনে মজা পেয়েছে দুজনেই। এ সুর তাদের চেনা নয় কিন্তু তার গদ্যঘেঁষা অথচ সুরেলা আমেজ তাদের মনের ভেতর কোথায় যেন নাড়া দিয়েছে। গালে গাল ঠেকিয়ে বসে ভাগ করে নিচ্ছে পূর্বপ্রজন্মের সংগ্রহের সুরের স্বাদ।
সেই দিকে চোখ রেখে মেঘ কেটে যাওয়া সকালবেলার মতই মনটা হঠাৎ ফুরফুরে হয়ে গেল শোভনের। বোতাম টিপে পর্দায় আনা উত্তমের নামটা মুছে দিয়ে সে গিয়ে তাদের দুজনের পাশে বসে বলল, “এই, নিজেরা তো খুব মজা করে শুনছিস। আমায় একটু শুনতে দিবি না তোরা?”
সুরভি শোভনকে বিশেষ ভয়ডর করে না বটে তবে বিল্টু এখনো তাকে একটু সমীহ করে চলে। তাড়াতাড়ি নিজের কান থেকে ইয়ারফোনের বোতামটা খুলে এনে তার হাতে দিয়ে দিল সে।
“উঁহু, ওতে চলবে না। আয় সবাই মিলে একসঙ্গে শুনি,” বলতে বলতে শোভন ইয়ারফোনের জ্যাকটা যন্ত্রের গা থেকে এক টানে খুলে দিতেই বিচিত্র সুরে উচ্চারিত পাঁচালির শব্দ ছড়িয়ে পড়ল সকালের আকাশে—
অবন্তীনগরে গিয়া হল উপনীত দেখে তথা ব্রত করে সব বামাগণ স্মরণ হইল তার পূর্ববিবরণ বুঝিল তখন কেন পড়িল বিপাকে অহংকার দোষে দেবী ত্যজিল তাহাকে—পংক্তির পর পংক্তি—স্তবকের পর স্তবক পার হয়ে যায়। ঠাণ্ডা মেঝে থেকে সরে সুরভি কখন যেন তার কোলের ওপর এসে বসেছে। অন্য শিশুটি মেঝের ওপর বসে তার প্রশস্ত এবং উষ্ণ কোলটির অনেকখানি ফাঁকা জায়গার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করল একটু। তারপর এগিয়ে এসে সেইখানে গুটিশুটি মেরে ঢুকে বসল। শোভনের শরীরে দুটি শিশুর কোমল ও মধুর স্পর্শ লাগছিল। পাশের দোলনায় তার সদ্যোজাত সন্তানটি জেগে উঠেছে। মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে তাকে চাপড় দেবার অজুহাতে তার স্পর্শটিও হাতে মেখে নিতে নিতে মধ্যবয়সের দিকে এগোতে থাকা যুবকটির হঠাৎ মনে হল, যুদ্ধ নয়, রক্তপাত নয়, কোনো ন্যায়-অন্যায়ের পক্ষেবিপক্ষে সংগ্রাম নয়, শুধু এই ছোঁয়াগুলো আর তার প্রিয় মানবীটির সঙ্গই তার আসল কামনার ধন।
“উঃ সক্কালসক্কাল কী শুরু করেছিস তোরা বলতো শোভন! ছুটির দিনে বেশ আরাম করে—”
বলতে বলতে সমাদৃতা তার ঘর থেকে বের হয়ে এসে দৃশ্যটা দেখে চুপ করে গেল হঠাৎ। শোভন তার তিন সঙ্গীকে নিয়ে মশগুল। সমাদৃতার হাঁকডাক তার কানেই যায় নি সম্ভবত।
তার গলা পেয়ে ফরিদাও বের হয়ে এসে সমাদৃতার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তাদের সামনে ছড়িয়ে থাকা ছবিটার মধ্যে এমন একটা জাদুকরী মায়া ছিল যে তা সেই যুবতীদুজনকে চুপ করিয়ে রাখল বেশ কিছুক্ষণ।
“ও কাকু, রোদের মধ্যে চলো না! ঘাসের মধ্যে সবাই মিলে বসে বসে বেশ শুনবো। তুমি ভাইকে কোলে নাও। আমরা ওর দোলনা টেনে নিয়ে যাচ্ছি,” বলতে বলতে বিল্টু উঠে দাঁড়ালো হঠাৎ।
শোভন একটু বিপন্নভাবে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ফরিদার দিকে ফিরে তাকালো। শিশুটিকে খোলা হাওয়ার মধ্যে নিয়ে যাবার ব্যাপারে এর আগে ফরিদা বহুবারই আপত্তি জানিয়েছে। এইবারও সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। সমাদৃতা তাকে বাধা দিয়ে বলল, “যাক না একটু। বারান্দার স্যাঁতসেঁতে ঠাণ্ডার থেকে ও বরং ভালোই হবে দেখো ফরিদা।”
ছোটোটিকে কোলে নিয়ে নিচে নেমে এল শোভন। ঘাসে ঢাকা উঠোনটায় রোদ এসে পড়েছে। তিস্তার দিক থেকে উঠে আসা প্রাক্মধ্যাহ্নের শনশনে হাওয়ায় তার এলোমেলো চুলদাড়ি উড়ছিলো। সবুজ উঠোনে একটা সাদা দোলনা আশ্চর্য একটি ছবি তৈরি করেছে। তাকে ঘিরে ছেলেমেয়েদুটি খেলে বেড়াচ্ছে। চঞ্চলমতি শিশু। টেপরেকর্ডারের পাঁচালির কথা আর তাদের মনেও নেই এখন। নিজেদের নিয়ে আনন্দেই মজে আছে দুজনে।
বারান্দায় বসে সেইদিকে দেখতে দেখতে হঠাৎ উল্টোদিকের চেয়ারে বসা ফরিদার দিকে চোখ ফিরিয়ে সমাদৃতা বলল, “এইবারে ছেলেটার আমার খুব কষ্ট হবে গো। কদিন পরে তোমরা চলে গেলে ফের সেই একা একা--”
“আমরা তো রইলামই সমাদৃতাদি। ছুটিছাটায় আসবো। আপনিও ওকে নিয়ে যাবেন। কখনো লম্বা ছুটিতে গিয়ে আমাদের কাছে থেকে আসবে কিছুদিন, এমনি করেই—”
“তোমায় একটা অনুরোধ করব?” হঠাৎ ফরিদার কথাটা মাঝরাস্তায় কেটে দিয়ে সমাদৃতা তার দিকে ঝুঁকে পড়ে চোখে চোখ রাখল তার, “মানে, আমি তো একেবারে একা! মা বাবারও বয়স হয়ে গেছে অনেক। একটা কিছু সমস্যা হয়ে গেলে ছেলেটার যাবার কোনো জায়গা থাকবে না। তেমন কিছু হলে তুমি—মানে বিল্টুর কিন্তু তোমাদের ওপরে বেশ টান হয়ে গেছে এই ক’দিনে। শোভনের বেশ ন্যাওটাও হয়ে পড়েছে, আবার ভয়ও খায়। এইরকম একজন ওর মাথার ওপর খুব দরকার--”
ফরিদা সমাদৃতার চোখে চোখ রাখল। তার অকথিত কথাগুলো সে নারীসুলভ অনুভূতি দিয়ে স্পর্শ করতে পারছিল বেশ। সমাদৃতা সসংকোচে চোখ সরিয়ে নিল। তাকে আর লজ্জা দিলো না ফরিদা। তার হাতটি নিজের হাতে টেনে নিয়ে বলল, “ঈশ্বর আল্লা জানিনা, কিন্তু তবু প্রার্থনা করি তেমন সময় যেন না আসে কখনো। আর তেমন কিছু হলে, ওর জন্যে আমি রইলাম দিদি।
নিচে হই হই করতে থাকা মানুষগুলির দিকে সস্নেহে চেয়ে দেখে সমাদৃতা ফরিদার হাতটাতে মৃদু চাপ দিলো একটা, “সেই ভালো। তুমি বললে, আমি নিশ্চিন্ত। নইলে শোভনটা যা ছেলেমানুষের মত রয়ে গেল এখনো, ওর ওপরে ভরসা করে—”
“মা, ওমা, ও মামি তোমরাও নিচে চলে এসো না! এইখানে কি সুন্দর রোদ—ও মা—”
বিল্টু হাঁকডাক জুড়ে দিয়েছে তলা থেকে। সুরভি খুব বেশি কথা বলে না। কিন্তু তার নীরব চাউনিতেও সেই একই নিমন্ত্রণ লেখা ছিল। তারা দুজন উঠে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো।
ফরিদা আর সমাদৃতাকে নিচে বাচ্চাদের কাছে রেখে ঘরে ফিরে এসে শোভন উত্তমের নম্বরটা মেলালো। মনের ভেতর খচখচানিটা ফিরে এসেছে আবার। বারতিনেক রিং হবার পর উত্তম ফোনটা ধরলো। তার গলায় তখনো ঘুম জড়ানো ছিল।
“শোভন বল। ওদিকে সব ভালো তো?”
“ভালো,” শোভন সরাসরি কাজের কথায় এলো, “সমরেশ ফোন করেছিলো। শ্যামলবাবু নাকি ওকে বলেছেন আগামী সপ্তাহে আমি ওদিকে যাচ্ছি। তুই কিছু জানিস?”
একটুক্ষণ থেমে থেকে উত্তম ফের যখন কথা বলল, তার গলায় একটু বিরক্তির স্পর্শ ছিল, “জানি। কিন্তু এসব সেনসিটিভ ব্যাপার নিয়ে এইভাবে শ্যামলবাবু ওপেনলি আলোচনা করতে গেল কেন সেইটাই বুঝতে পারছি না। এনিহাউ, জেনেই যখন গেছিস তখন বলছি শোন। তোর কেসের একটা মীমাংসা হয়ে গেছে প্রায়। দীপক স্যান্যাল নিজের চ্যানেলে যা খবর নেবার নিয়ে নিয়েছে। হিয়ারিঙের জন্য আর্লি ডেটেরও বন্দোবস্ত করে ফেলেছি। নেক্সট উইকেই ফয়সালা হয়ে যাবে একটা।”
“কোর্টের ডেটের বন্দোবস্ত—তুই করে ফেলেছিস—মানে?”
“ওসব মানে টানে নিয়ে তোর মাথা না ঘামালেও চলবে শোভন,” উত্তমের গলার বিরক্তিটা ফিরে আসছিলো ফের, “ঠিকমতো খেলতে জানলে সবকিছু করা যায় এ দেশে। ওসব আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে তুই তৈরি হ। এবারে ফরিদাদের একেবারে নিয়ে ফিরবি।”
“তুই এতোটা শিওর হচ্ছিস কী করে উত্তম?”
ফোনের ওপার থেকে মৃদু হাসির শব্দ হল একটু, “হচ্ছি, কারণ গোটা ব্যাপারটা আমার নজরদারিতেই ঘটেছে। সে’সব মানডেন ডিটেইলস তোকে আর নাই বা বললাম। তবে হ্যাঁ, এ কেসটা ডিসমিস হবার ফলে কয়েকজন আমলা মুশকিলে পড়বে একটু। কিন্তু সে সব নিয়ে তুই মাথা ঘামাস না শোভন। তোর জন্য কিছু সারপ্রাইজ রাখা আছে মুরলিপুরে। ফরিদা উইল বি হ্যাপি।”
“সে ব্যাপারে জানাটাও আমার তোকে ফোন করবার একটা কারণ উত্তম। সমরেশের কথাটা শুনে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। ওখানে আমাকে নিয়ে ঠিক কী প্ল্যান করেছিস তুই?”
মৃদু হাসির শব্দ ভেসে এল ফোনের ওপার থেকে, “বেশি কিছু নয়। সামান্য বন্ধুকৃত্য করেছি। এখন বলব না। তুই ফিরে আয় আগে, তারপর নিজের চোখেই দেখবি। কালপরশুর মধ্যেই মেসেজ চলে যাবে তোর কোর্টে হাজিরার। কোন ট্রেনে আসছিস শুধু সেইটা জানাবি। আমি স্টেশান থেকে তোকে পিক আপ করিয়ে নেবার বন্দোবস্ত করে দেবো।”
শোভন একটু অবাক হচ্ছিল, “তুই আসবি না স্টেশানে?”
উত্তম একটু ইতস্তত করল কি জবাবটা দিতে? গলাটা একটু কেঁপে গেল তার, “ঠিক বুঝতে পারছি না রে। হয়ত একটু ব্যস্ত থাকবো। না হলে—আসবো নিশ্চয়ই। আমি এখন ছাড়ি রে--”
বন্ধ হয়ে যাওয়া ফোনটার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল শোভন। যতটুকু সে দেখতে পাচ্ছে তার পেছনে আরো কিছু রয়েছে। তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় তাকে সতর্ক করে দিচ্ছিল বারবার। একটা অবয়বহীন অস্বস্তি পাকে পাকে জড়িয়ে ধরছে যেন তাকে। ঠিক কী করছে উত্তম জীবনটাকে নিয়ে? কেন করছে? হঠাৎ ধূমকেতুর মত তার জীবনে এসে উদয় হয়ে--
“কী হল? কোনো সমস্যা হয়েছে ওদিকে?” ফরিদা কখন যেন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
শোভন মাথা নাড়ল, “বুঝতে পারছি না ফরিদা। উত্তমের কথাগুলো কেমন যেন একটু ধোঁয়াটে ঠেকল।”
“ভেবো না। উত্তমদা যখন আছে, খারাপ কিছু হবে না। তুমি বেরোবে তো? স্নানে যাও। আমি কৃষ্ণাদিকে খেতে দিতে বলি।”
শোভন মাথা নেড়ে ঘরের ভেতর চলে গেল। ছেলেটা জেগে উঠেছে। ফরিদা ওর নাম রেখেছে কবীর। সে এখন তাকে নিয়েই স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। তাকে সেই সুখের বৃত্ত থেকে বের করে এনে দুশ্চিন্তাটার ভাগ দিতে তার মন চাইছিল না। থাক ওই নিয়ে। যে ক’টা দিন পারে আনন্দে থেকে নিক না!
ফ্যাক্সটা পুরো আসা শেষ হবার আগেই ব্রতীনের ফোন বেজে উঠল। ফোনের পর্দাটা একবার দেখে নিয়েই হাতের ফাইল বন্ধ করে কলটা রিসিভ করে নিল ব্রতীন, “উত্তমদা, বলুন।”
“ফ্যাক্স পৌঁছে গেছে তো?”
“ফ্যাক্স—মানে—ওহো আপনি পাঠিয়েছেন? দাঁড়ান দেখছি।”
“দেখে নাও। শোভনের ডেট পড়েছে সোমবার। মানে হাতে এখনো দিনচারেক সময় আছে। কপিটা ওকে দিয়ে দেবার বন্দোবস্ত কোরো।”
ব্রতীন ফোনটা ধরে রেখেই ঘন্টার বোতামে চাপ দিতে “ওকে। দেখছি,” বলতে বলতে ঘন্টা বাজিয়ে গোবিন্দকে ডেকে ইশারায় ফ্যাক্সটা দিতে বলে সে আবার বলল, “কী মনে হচ্ছে উত্তমদা? এই হিয়ারিং-এ ব্যাপারটা ওভার হয়ে যাবে, নাকি আরো টানবে?”
উত্তম একটু অন্যমনস্কভাবে বলল, “দীপক স্যান্যাল যা বললেন তাতে মনে তো হচ্ছে মিটে যাবার কথা। এনিহাউ, সেসব কোর্টে দেখা যাবে। তুমি ফ্যাক্সটা ওর কাছে পৌঁছোবার ব্যবস্থা করে দিও যেভাবে হোক। আমি এখন ছাড়ি। একটু ব্যস্ত আছি। বাই।”
ফ্যাক্সটা হাতে নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিল ব্রতীন। মামুলি দু লাইনের লেখা নোটিশ। কোর্টের ছাপ্পাছোপ্পা দেয়া। কাগজটা দেখে নিয়ে ব্রতীন ইন্টারকমে সমাদৃতাকে ধরলো। গোটাপাঁচেক রিং বেজে যেতে কেউ না ধরতে ফোনটা নামিয়ে রেখে সে গোবিন্দকে জিজ্ঞাসা করল, “সমাদৃতা ম্যাডাম লাঞ্চ থেকে ফেরেন নি?”
“ফিরেছেন স্যার। রুমেই তো আছেন দেখে এলাম একটু আগে। শ্যামাপদ উকিল এসেছেন কীসব কাগজপত্র নিয়ে। কথাবার্তা বলছিলেন।”
“তুমি এই কাগজটা নিয়ে একটু ওঁকে দিয়ে দাও, আমি ইন্টারকমে—” বলতে বলতেই কী মনে হতে বাড়িয়ে ধরা কাগজটা ফের ফেরত নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ব্রতীন বলল, “থাক, আমি নিজেই দিয়ে আসছি গিয়ে।”
“হ্যাঁ, মানে শোভনদার কেসের হাজিরার ব্যাপারে একটা ফ্যাক্স এসেছে। সেটা দিতে এসেছিলাম আপনার কাছে। সন্ধেবেলা শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে একটু বেরোবো। ওদিকে যেতে পারবো না আজ। আমি বরং এটা টেবিলে রেখে দিয়ে যাচ্ছি। আপনি হাতের কাজটা সেরে নিন।”
সমাদৃতা তার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনে মনে কিছু একটা স্থির করে নিল। তারপর বলল, “টেবিলে না রেখে কাগজটা বরং আমার হাতে দাও। তারপর এখানে এসে বোসো। ভাল হল তুমি এসে পড়লে। একটু সময় আছে তো হাতে?”
ব্রতীন কাগজটা সমাদৃতার হাতে দিয়ে শ্যামাপদবাবুর পাশের চেয়ারটাতে বসল গিয়ে। উকিলটি তার পরিচিত। কালেক্টরেটের বিভিন্ন কেসে সরকারের হয়ে কাজ করেন। তাকে দেখে মৃদু হেসে বললেন, “সব ভালো তো?”
“ভালো। কোন্ কেস? সেই উইমেন উইভার্স গ্রুপের ক্ষতিপূরণের মামলা নাকি?”
শামাপদবাবু মাথা নাড়লেন, “না-মানে-ম্যাডামের পার্সোনাল একটা—”
হাতের কাগজটার দিক থেকে মুখ না তুলেই সমাদৃতা বাকি কথাটা বলে দিল, “কলকাতায় ফ্যামিলি কোর্টে আমার সেপারেশানের মামলার কাগজপত্র নিয়ে বসেছি। সেই নিয়েই কথাবার্তা বলছিলাম। তুমিও একটু কাগজগুলো দেখে নাও একবার।”
“শ্যামাপদবাবু কি আপনাকে রিপ্রেজেন্ট করছেন?”
সমাদৃতা হাসল, “না। ফ্যামিলি কোর্ট। উকিল থাকবে না। প্রথম হিয়ারিং-এ তো নয়ই। কাজেই শ্যামাপদবাবু যাচ্ছেন না। যাক সে কথা। রাতে ফিরে কথাবার্তা বলে নিয়ে শোভনের টিকিটটা আমি করিয়ে দেবো। আমি নিজেও যাবো ওর সঙ্গে।”
“শোভনের সঙ্গে আপনি—যাবেন?”
“হুঁ। আসলে মঙ্গলবার আমার কেসটারও হিয়ারিং-এর ডেট পড়েছে ব্যাংকশালে এক নম্বর ফ্যামিলি কোর্টে। ভেবেছিলাম একাই চলে যাবো। এবারে সে চিন্তাটাও আর রইল না। এখন তুমি বরং আমার সাবমিশানটার ওপরে একটু চোখ বুলিয়ে নাও। শ্যামাপদবাবু, কপিটা ব্রতীনকে একবার দেখান তো!”
একটা নাতিদীর্ঘ নোট তার দিকে এগিয়ে দিলেন শ্যামাপদবাবু। মাথা নেড়ে বললেন, “এর চেয়ে বেশি উনি আর কোনো অ্যালিগেশন আনতে রাজি হলেন না স্যার। এতে করে চেষ্টাচরিত্র করলে সেপারেশান হয়ত পেয়ে যাবেন, কিন্তু অ্যালিমনি পাবেন কিনা সন্দেহ। চাইল্ডের কাস্টডি নিয়েও সন্দেহ থেকে যাবে। আসলে, স্বামী ঘুষ খান, কেবলমাত্র এই অভিযোগে স্ত্রী ডিভোর্স চাইছেন এরকম কোনো প্রিভিয়াস ইনসট্যান্স তো দেখাতে পারবো না মহামান্য আদালতের সামনে! থাকলে তাতে স্ত্রী কী কী বেনিফিটস পেয়েছেন সেইটার ব্যাপারে কিছু কেস ল রেফার করা যেতো। কিন্তু, ওরকম কোন কেস এখনো এই সাবকন্টিনেন্টে হয়েছে বলে আমার জানা নেই স্যার। কাজেই ক্যারেক্টার সম্পর্কিত কিছু সলিড অ্যালিগেশান না থাকলে, বা কনজুগাল লাইফে ভায়োলেন্স, ইমপোটেন্স কি বিশ্বাসভঙ্গটঙ্গ না দেখাতে পারলে--মানে বুঝতেই তো পারছেন, এখনো আমাদের সিস্টেমে বাপের রাইটটাই কিছুটা আপারহ্যাণ্ড--”
কাগজটা তুলে নিয়ে চোখ বোলালো ব্রতীন একবার। কথাটা শ্যামাপদবাবু তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে ভুল বলেন নি। সমাদৃতা তার ডিভোর্স চাইবার সপক্ষে একটাই শুধু কথা বলেছে, তা হল, উত্তম কর্মক্ষেত্রে নীতিভ্রষ্ট হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সরকারের তরফ থেকে দুর্নীতির মামলা চালানো হচ্ছে। একজন দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের স্ত্রীর পরিচয়ে সে থাকতে আর রাজি নয়।
শুধু এই অভিযোগের ওপর কেসটাকে দাঁড় করাতে চাইলে তাতে খুব বেশি একটা কাজ যে হবে না সে’কথাটা ব্রতীন পরিষ্কার বুঝতে পারছিল। অভিজ্ঞতা তারও কম হয় নি জীবনে। এই মুহূর্তে দুর্নীতি আর দুশ্চরিত্রতা এই দুটো আর এক নয় সমাজের চোখে। উপরি রোজগার ব্যাপারটাকে নীতিহীনতা বলে মেনে নেয় খুবই কম সংখ্যক মানুষ। তাকে মূলধন করে বিবাহবিচ্ছেদের মামলায় মিউচুয়াল সেপারেশন হয়ত কোর্ট মেনে নেবে, কিন্তু--
সমাদৃতা তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল ব্রতীন। তারপর নীচু গলায় বলল, “কিন্তু এ ছাড়া আর কী-ই বা বলতে পারে সমাদৃতাদি। উত্তমদার ওপরে সেসব ধরনের মিসকন্ডাকটের অভিযোগ আনবার কোন রাস্তা তো নেই। ছেলেকে ভালোবাসে, চরিত্রের দোষটোষও—”
সমাদৃতা হঠাৎ নিজের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো। তার মুখচোখের মুহূর্তের রক্তহীনতা পুরুষদুটির নজরে পড়েনি। কানের কাছে তার ঝনঝন করে বাজছিল সেদিন রাতে ফোনের ওধার থেকে ভেসে আসা সেই মৃদু মেয়েলি হাসিটার শব্দ—তার সঙ্গে উত্তমের গলার আওয়াজ--““গিভ দা ফোন টু মি। ইটস মাই ওয়াইফ কলিং—”
কিন্তু তবু, এই অভিযোগটা সে তুলতে পারবে না। তার মন জানে এটা সত্যি, কিন্তু দুনিয়াদারীর হিসেবে এর কোনো প্রমাণই যে নেই তার কাছে। আস্তে আস্তে মাথা নাড়লো সে, “না মিস্টার সেন। এর চেয়ে বেশি কিছু লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
“অন্তত ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের কিছু ইনসট্যান্স ম্যাডাম—মানে মুখে বললেই হবে—ওটার তো আর কোনো প্রমাণট্রমাণ অত লাগে না। একটু সুন্দরভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে ইমোশনালি বললে-”
হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সমাদৃতা। দু হাত বুকের কাছে জড়ো করে একটা ছোট্ট নমস্কার করে বলল, “আপনি এবারে আসুন মিঃ সেন। ড্রাফটটা পেয়ে গেলাম। দরকার হলে ওর বেসিসে মুখে যা বলার বলবো, চাইলে এইটেকেই রিট্ন্ সাবমিশান হিসেবে জমাও করে দেবো ওখানে।”
শ্যামাপদবাবু একটু হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন, “আপনার যেমন মর্জি ম্যাডাম। আমার বিলটা আমি পাঠিয়ে দেবো কালপরশু।”
“হ্যাঁ পাঠিয়ে দেবেন। পরে দরকার হলে ফের যোগাযোগ করে নেবো আপনার সঙ্গে। আচ্ছা, আজ তাহলে—”
“হ্যাঁ। আমি চলি।”
শ্যামাপদবাবু চলে যাবার পর চুপচাপ খানিকক্ষণ বসে রইল সমাদৃতা। তারপর ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে শোভনের নম্বরটা মেলাল। ওপাশ থেকে ফোনটা ধরতে সংক্ষেপে কথাটা জানিয়ে সমাদৃতা বলল, “আমি টিকিটদুটো কাটতে দিয়ে দিচ্ছি তাহলে। রোববার রাতে যা ট্রেন পাই—কী? কী বললি?—”
ওপাশ থেকে ভেসে আসা কথাগুলো শুনতে না পেলেও সমাদৃতার মুখের ভঙ্গি থেকে ব্রতীন বুঝতে পারছিলো অপ্রত্যাশিত কিছু একটা বলেছে শোভন। সমাদৃতা নিঃশব্দে তার কথাগুলো শুনে নিয়ে ফোনটা যখন বন্ধ করল, তখন তার মুখে একটা ছায়া পড়েছে।
“কী ব্যাপার সমাদৃতাদি? শোভন—”
সমাদৃতা একটু চেষ্টা করে হাসি ফোটালো মুখে, “ভালো খবর ব্রতীন। শোভন বলছে, উত্তম ওকে গত রোববারই জানিয়ে দিয়েছে মামলা এই নেক্সট হিয়ারিং-এই ডিসমিস হয়ে যাবে। ওদের আমাদের সবার টিকিটই একসঙ্গে কাটতে বলে দিলো।”
“গ্রেট,” ব্রতীন নিজের উচ্ছ্বাসটা চাপতে পারছিল না, “অ্যাট লাস্ট, লোকটা সুবিচার পেতে চলেছে—কিন্তু শোভনদা কথাটা এর মধ্যে একবারও—”
“না ব্রতীন। আমাকেও বলেনি। ফরিদাকেও কিছু জানায় নি আগে। বললো ডেট ঠিক হয়ে গিয়েছে, এইবার বলবে। ইটস্ অলরাইট। আচ্ছা, একটা কথা, নেক্সট উইক শর্মিষ্ঠা থাকছে তো?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। আছে। এর মধ্যে আর কোথাও বাইরে যাবার প্ল্যানট্যান নেই আমাদের।”
“ভালো। মানে ভাবছিলাম, বিল্টুটাকে শর্মিষ্ঠা ক’টাদিন যদি একটু—”
“সে কী? ওকে নিয়ে যাবেন না সঙ্গে?”
“না ব্রতীন। এখন ওকে কিছু জানাবো না। তাহলে বাড়ি মাথায় করে তুলবে। কিন্তু আমি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবো না আমি। তোমার কোনো অসুবিধে হবে না তো ওকে ক’টাদিন রাখতে?”
“এতে এত জিজ্ঞাসা করবার কী আছে সমাদৃতাদি? যদ্দিন দরকার রেখে যাবেন। কিন্তু এ সময়টা ওর দাদু দিদিমার কাছে একটু ঘুরিয়ে আনতে পারতেন তো? সবাইকে ছেড়ে এইভাবে একা একা কি ও থাকতে চাইবে?”
হঠাৎ তার দিকে ফিরে চাইল সমাদৃতা। তার চোখে বিদ্যুৎ ছিল। সামান্য ইতস্তত করে তারপর নিচু গলায় বলল, “একা থাকাটা যার নিয়তি তার সে শিক্ষাটা যত আগে শুরু হয় তত মঙ্গল ব্রতীন। বিল্টুকে আমি শর্মিষ্ঠার কাছে রেখে যাবো। ওর কেউ নেই। কাউকে দরকারও নেই আমার ওর জন্য।”
“আপনি উঠবেন কোথায়? হোটেলে টোটেলে না উঠে মিডলটন রো তে এম এল এ হস্টেলে একটা রুমের ব্যবস্থা করে দিতে পারি যদি বলেন।”
“থ্যাংকস্। আমি সেই কথাই তোমায় বলব ভাবছিলাম।”
ব্রতীন উঠে দাঁড়ালো, “ফাইন। আমার একটা মিটিং আছে সেটা সেরে নি আগে। আপনি ততক্ষণে ডিটেইলসগুলো একটা কাগজে লিখে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিন। ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
বিকেলবেলা বাড়ি ফিরে সোজা ফরিদার ঘরে এলো সমাদৃতা। সন্ধে হয়ে এসেছে। বাচ্চাদুটোকে একসঙ্গে নিয়ে পড়াতে বসেছিলো ফরিদা। মেয়েটা জাত শিক্ষক। এই ক’দিনে বিল্টুর মত দুর্দান্ত ছেলেও দিব্যি বশ মেনে গেছে তার কাছে।
ঘরে ঢুকতেই দুজনেই বই ফেলে তার দিকে চাইল। তার বাড়ি ফেরা মানেই কিছু না কিছু একটা পাওনা হয় দুজনেরই। ব্যাপারটা সমাদৃতা উপভোগও করে বেশ। নিচু হয়ে বসে গালটা বাড়িয়ে দিয়ে সে বলল, “আগে আমারটা হোক।”
দুদিক থেকে তার দু গালে উষ্ণ, সুগন্ধী ঠোঁটের ছাপ লাগতে তাদের কোলের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে সে পার্স থেকে দুটি চকোলেট বার বের করে দুজনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আজ তোদের পড়ার ছুটি। যা, পালা।”
সুরভি আর বিল্টু নড়লো না। সামনে বসে থাকা শিক্ষিকাটিকে তারা ভালো যেমন বাসে তার শাসনে তাদের সমীহও কম নয়। ফরিদা হেসে বলল, “আচ্ছা যা। ছেড়ে দিলাম। কাল সব কাজ ঠিকঠাক না করে এলে কিন্তু—”
চকোলেটের মোড়ক খুলতে খুলতে দুজন একসঙ্গে বলে উঠল, “রোববারের বেড়াতে যাওয়া ক্যা—নসেল—।”
সমাদৃতার ভ্রুদুটো কুঁচকে উঠল একটু। বিল্টু আর সুরভি তখন হাত ধরাধরি করে কী একটা গান গাইতে গাইতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। বারান্দা থেকে তাদের হাসির শব্দ উঠছিলো।
সেইদিকে ইশারা করে ফরিদা হেসে বলল, “দুপুরবেলা শোভন খবরটা দিলো। রোববার সবাই মিলে ট্রেনে করে বেড়াতে যাওয়া হবে শুনে ইস্তক মহাফূর্তিতে আছে দুটোতে। টিকিট কি হয়ে গেছে সমাদৃতাদি?”
“হয়েছে। তবে একটা কথা আছে ফরিদা।”
“কী?”
“বিল্টুকে আমি এখানে রেখে যাচ্ছি। ও যাবে না।”
ফরিদা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “কেন?”
আমি খুব প্লেজেন্ট কিছু করতে কলকাতা যাচ্ছি না ফরিদা। বাপ মায়ের সেপারেশানের মামলার মধ্যে ওকে আমি নিয়ে যেতে চাই না।”
ফরিদা একটু চুপ করে থেকে তারপর ধীরে ধীরে বলল, “সমাদৃতাদি, সেদিন তাহলে আমাকে যে কথাগুলো বললেন, সেগুলো কি শুধু মুখের কথা? আপনি ব্যস্ত থাকবেন বলে আমি ওর একটু দেখাশোনা করতে পারবো না?”
“পারবে ফরিদা। তোমাকে আমি খোলাখুলি একটা কথা বলি। শোভন আমাকে দুপুরবেলা জানিয়েছে উত্তম সম্ভবত মামলার ক’টা দিন তোমাদের ওর বাড়িতে বা ওর অ্যারেঞ্জ করা কোন অ্যাকোমোডেশানে নিয়ে তুলবে। ও তোমাদের অনেক উপকার করেছে। আরো করবে। তোমাদের কাছে সে অফারটা গ্রহণযোগ্য হলেও আমি আমার ছেলেকে ওর মধ্যে থাকতে দিতে যেতে রাজি নই। এটা শুধু সেন্টিমেন্টাল রিজনে নয়। এতে কাস্টডি ইস্যুটাও জড়িয়ে আছে। এই সময়ে ওকে উত্তমের নাগালের মধ্যে আমি নিয়ে যাবো না। কিছুতেই নয়।”
ফরিদা চুপ করে তার কথাগুলো শুনছিলো। এইবার তার একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “দিদি, শোভন আপনাকে কী বলেছে না বলেছে আমি জানি না। তবে আমাদের থাকবার ব্যবস্থা অন্য জায়গায় হবে এইটুকু আমি আপনাকে বলতে পারি। শোভন আমায় খবরটা যখন ফোনে জানায় দুপুরে, তখনই ও বলেছিলো উত্তম আমাদের থাকবার বন্দোবস্ত করছে। আমি তাকে মানা করে দিয়েছি। আপনার সঙ্গে থাকবো আমি। বাচ্চারাও একসঙ্গে থাকবে।”
“ওতে একটু সমস্যা হবে ফরিদা। আমার অ্যাকোমোডেশান হয়েছে এম এল এ হস্টেলে। ওখানে একটার বেশি ঘর পাওয়া মুশকিল হবে।”
“না সমাদৃতাদি। ওসব সরকারি গেস্ট হাউস টাউস নয়। আমাদের বন্দোবস্ত আমি অন্য জায়গায় করে নিয়েছি। যাদবপুরের দিকে। গিয়ে দেখুন, খারাপ লাগবে না।”
“কারো বাড়ি?”
“বলতে পারেন একরকম তাই। তবে এর বেশি কিছু বলব না। সারপ্রাইজ দেবো একটা আপনাকে।”
সমাদৃতা কিছু একটা ভাবছিলো। একটু পরে বলল, “কিন্তু উত্তমের ফ্ল্যাটও তো সাউথের দিকে। টালিগঞ্জে, তাই না? বিল্টুকে নিয়ে ওর কাছাকাছি—”
হঠাৎ ফরিদা সোজা হয়ে বসল। সমাদৃতার চোখে চোখ রেখে বলল, “আমার ধমনীতে কিন্তু অন্য রক্ত বইছে দিদি। সে রক্ত ভদ্রলোকের রক্ত নয়, দুর্বলের রক্তও নয়। ওর দায়িত্ব আপনি নিশ্চিন্তে আমার ওপরে ছেড়ে দিতে পারেন। আমি বুঝে নেবো। কিন্তু আমি থাকতে ছেলে এইভাবে একা একা ছেলে ফেলে আপনি যেতে পারবেন না।”
কিছু একটা ছিলো তার গলায়। সমাদৃতা কোন প্রতিবাদ করল না। বহুকাল ধরে একলা একলা নিজের আর নিজের সন্তানের সব দায়িত্ব বয়ে বয়ে হঠাৎ আজ তার বড়ো ক্লান্ত ঠেকছিল নিজেকে। বুকের ওপর থেকে বড়ো একটা বোঝা যেন নেমে গেল তার। খানিক বাদে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ফোনে একটা নম্বর মিলিয়ে সে বলল, “সুরেনবাবু, আমার ছেলেটার জন্যেও একটা বুকিং করবেন—হ্যাঁ হ্যাঁ নাম, বয়সটয়স সব আমি এস এম এস করে দিচ্ছি আপনাকে এক্ষুণি-- হয়ে যাবে তো?—ধন্যবাদ—কাল অফিসে কাউকে দিয়ে টিকিটটা পাঠিয়ে পেমেন্ট নিয়ে যাবেন—”
|| ২০ ||
বিল্টুর টিকিটটা আলাদা হয়ে যাওয়ায় কোচ আলাদা হয়ে গিয়েছিলো ওর। শেষে সমাদৃতাদের এস টু কোচের এক ভদ্রলোককে বলে সেটা অদলবদল করে নিতে নিতে ট্রেন কিষাণগঞ্জ ঢুকে গেল। টুরিস্ট সিজন এখনো শুরু হয় নি। স্কুলগুলোতে পরীক্ষার পালা চলছে। বেশি ভিড় ছিলো না ট্রেনে। ওপরের একটা বার্থ ফাঁকাই রয়ে গেছে তাদের কুপটাতে। ভালো করে গুছিয়ে বসে সেইদিকে দেখিয়ে ফরিদা শোভনকে বলল, “একটা বার্থ তো এমনিতেই ফাঁকা রয়ে গেলো। কী দরকার ছিলো ভদ্রলোককে বলেকয়ে অন্যদিকে পাঠানোর। বিল্টুকে তো এখানে এমনিতেই—”
শোভন সিটের নিচে রাখা মালপত্রের বাক্সটাক্সগুলো বের করে এনে ফাঁকা বার্থটাতে গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলল, “এই যে দেখছো, এইজন্য। বাইরের রিজার্ভেশান লিস্টে দেখে নিয়েছি ওটা ফাঁকাই যাচ্ছে। মালপত্রগুলো ভালোভাবে রাখা যাবে আর কি।”
সুরভি আর বিল্টুকে খাইয়ে দিচ্ছিল সমাদৃতা। তাদের অবশ্য সেদিকে মন নেই তখন মোটে। এতজন প্রিয় মানুষের সঙ্গে দল বেঁধে একসাথে রেলগাড়িতে করে দূরযাত্রার স্বাদ তারা এর আগে কখনো পায় নি। খাবার ভরা মুখেই একে অন্যের সঙ্গে বুকের ভেতর অনবরত তৈরি হতে থাকা কথা আর হাসির ফোয়ারা ভাগ করে নিতেই তারা ব্যস্ত।
“আর একটা লুচি নিবি সুরভি?”
“উঁহু। মাংস দাও ফর্সামাসি।”
“নে মা আর একটা। এই দ্যাখ, তোর শর্মিষ্ঠা মাসী এত কষ্ট করে বানিয়ে দিলো সবকিছু—”
কিন্তু সুরভি তাতে একেবারেই রাজি নয়। পাতলা, টুকটুকে লাল ঠোঁটদুটি চেপে ধরে আছে সে।
“তবে রে দুষ্টু মেয়ে! দ্যাখ তো দাদা কেমন লক্ষ্মীছেলের মতো খাচ্ছে!”
সুরভি অমনি বিল্টুর দিকে তাকিয়ে হাসি টলটল গলায় বলে, “এ মা, লক্ষ্মী ছেলে, এ মা—”
সমাদৃতা এই সুযোগটার জন্যেই অপেক্ষায় ছিলো। মাংসে জড়ানো লুচির একটা বড়ো টুকরো সে সেই ফাঁকে গুঁজে দিয়েছে সুরভির মুখে।
খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ছিলো বিল্টু। সুরভির রাগ হয়ে গেছে খুব। গা মুচড়ে সমাদৃতার হাতের বাঁধন ছাড়াবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে সে। শেষে ফরিদা উঠে এসে ধমক দিতে তার দৌরাত্ম্য থামে। গজগজ করছিল ফরিদা, “এদের আমি চিনি। তুমি এত মিষ্টি করে বললে এদের কাজ হবে ভেবেছো? দুটোতে মিলে আমার ছেলেটাকে ঘুমোতে দেবে না সারারাত ওরকম দস্যিপনা করে।”
“এই, এসব একদম বলবে না। সুরভি হল পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়ে। তাই না সুরভি? শোন শোন ট্রেনটা কী বলছে?”
কিষাণগঞ্জ ছাড়িয়ে ট্রেন ততক্ষণে ফের পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় ঢুকে পড়ে গতি বাড়িয়েছে যাত্রা শুরুর দেরিটুকু পুষিয়ে নেবার চেষ্টায়। সমাদৃতার কোলে গুটিশুটি মেরে মুখের খাবার চিবোতে চিবোতে বালিকাটি ট্রেনের চাকার শব্দের মানে ধরবার চেষ্টা করে।
বিল্টুর একটু হিংসা হয়েছে বোধ হয়। তাড়াতাড়ি উল্টোদিকের সিট থেকে উঠে এসে টলোমলো পায়ে সমাদৃতার গা ঘেঁষে বসে বলে, “আর আমি?”
“তুই? তুই একটা—”
“উঁহু। মন্দ বলবে না আমাদের ছেলেটাকে। আমি তোর দলে, বুঝলি বিল্টু! আয় তুই আমার কাছে এসে বোস তো? নইলে মা একা একা দুজনকে সামলাতে পারবে না,” বলতে বলতে ফরিদা বালকটিকে নিজের কোলের কাছে টেনে নিল।
সমাদৃতার মনের ভেতর ছড়িয়ে থাকা অন্ধকারটা বারংবার যেন গিলে খেতে আসছিলো তাকে। মধ্যে মাত্র একটা দিন। তারপর, পরশু—সুরভির ছোট্ট শরীরটাকে দু হাতে প্রাণপণে জড়িয়ে রেখে মুখে হাসিটুকু ধরে রাখবার চেষ্টা করছিল সে—লিভ ফর টুডে—টুমরো ইজ ফার এনাফ—
“কোথায় রে?”
ফোনটা কানে ধরে শোভন তাড়াতাড়ি ওপরের বাংকে উঠে বসলো। অন্য বাংকগুলোতে সবাই এখনো ঘুমিয়ে আছে। নিস্তব্ধ কামরায় শুধু ছুটন্ত ট্রেনের শব্দ।
“বর্ধমান ঢুকছে। আরো ধরে নে দু ঘন্টা।”
ফোনের ওপাশে উত্তম একটু সময় নিয়ে তারপর বলল, “তার মানে মোটামুটি সাড়ে ছটা পৌনে সাতটা বাজবে তোদের শেয়ালদা পৌঁছোতে। ট্রানসপোর্ট আর অ্যাকোমোডেশান নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না তুই শিওর তো? না হলে এখনও বললে আমি—”
“উঁহু। তোকে তো বললামই সেদিন, ফরিদা সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করে নিয়েছে। আমাদের পরিচিত একজন রয়েছেন এদিকে। ওঁরাই এসে ওদের নিয়ে যাবেন। আর আমি শেয়ালদা থেকেই সোজা ছ’টা পঞ্চান্নর কৃষ্ণনগরটা ধরে নেবো। দশটার মধ্যে কোর্টে ঢুকে যেতে পারবো বোধ হয়।”
“ট্রেনেফেনে যাবি, ভিড়ভাট্টায়—তার চেয়ে তুই দীপক স্যান্যালের সঙ্গে এক গাড়িতেই চলে যা না! আমি ওঁকে বলে দিচ্ছি। শেয়ালদার ওদিকেই একটু অপেক্ষা করিস—”
শোভন তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “প্রয়োজন হবে না উত্তম। আমি ঠিক পৌঁছে যাবো। তুই ও নিয়ে ভাবিস না এখন আর—”
নিচে নড়াচড়ার শব্দ হচ্ছিল। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে সেদিকে চোখ পড়তে সমাদৃতার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল তার। রাতে বিল্টু তার বাংক ছেড়ে এসে সমাদৃতাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল। তার মাথাটা বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে রেখে শোভনের কথা শুনছিল সে। শোভন তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিল সেদিক থেকে।
ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে শুরু করতেই শোভন উঠে দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেইখান থেকেই ঝুঁকে পড়ে হঠাৎ সে হাত নাড়িয়ে হাঁক দিল, “এই যে—এখানে—এখানে—”
গৌরাঙ্গী বিদেশিনী মেয়েটির শরীরে গেরুয়া কাপড় বড় সুন্দর মানিয়েছে। তার লালচে হয়ে আসা চুলগুলো চুড়ো করে মাথার ওপরে তোলা। কপালে, নাকে গেরিমাটি দিয়ে রসকলি আঁকা। শোভনকে দেখতে পেয়ে বড়ো বড়ো পায়ে এগিয়ে এক সে। তারপর ট্রেনটা থামবার জন্য অপেক্ষা না করে হাতল ধরে ভেতরে উঠে এলো ব্যস্তসমস্ত কুলিদের ভিড় সরিয়ে।
ফরিদা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে গোছগাছ করছিলো। সেই অবস্থাতেই সমাদৃতার দিকে তাকিয়ে বলল, “বলেছিলাম না সারপ্রাইজ দেবো একটা? এই যে। ওর নাম বিষ্ণুদাসী। বাপমায়ের দেয়া নাম মার্গারেট। আর বিষ্ণুদাসীদি, এই হল আমাদের—”
মেয়েটি তাড়াতাড়ি এসে সমাদৃতার পাশটিতে বসে পড়ে বলল, “বলতে হবে নাগো। ও আমি নিজের মানুষ দেখেই চিনেছি। আপনি তো সমাদৃতাদিদি। ফরিদার কাছে আপনার কথা শুনে থেকে আপনাকে দেখবার অপেক্ষায় ছিলাম গো। চলেন। গোছগাছ সেরে নেন চটপট। বাচ্চাদের তোলেন—”
ওপর থেকে ভারী বাক্সগুলো নামাতে নামাতে শোভন বলল, “কেমন আছো বিষ্ণুদাসী? আমাদের হরদাদা কেমন আছে?”
“সে খোঁজে তোমার কাজ কী গোঁসাই?” মেয়ের গলায় কপট অভিমানের স্পর্শ, “তোমার তো চোখের আড়াল না ভুবনের আড়াল। মানুষদুটো বাঁচলাম না মলাম একদিনের তরে তার খোঁজ নিয়েছো কখনো সেই মুসিয়েরের আখড়ায় দেখা হবার পর? আছো আত্মসুখে। পরের খোঁজে তোমার কাজ কী? ভাগ্যি ফরিদা ছিল, তাই মাঝেমধ্যে খবরটুকু পাই। এখন চলো তাড়াতাড়ি। সারা রাত গাড়িতে এসেছো, বাড়ি গিয়ে দুটি মুখে দিয়ে একটু হাত পা ছড়াও—”
শোভন হেসে মাথা নাড়লো, “না গো। সে হবার নয়। আমায় এখন ছুটতে হবে কৃষ্ণনগরে। সন্ধের পর ফিরবো বোধায়। তুমি এদের নিয়ে চলে যাও। ট্যাক্সি ধরে দিচ্ছি চলো।”
“ট্যাক্সিতে যে তুলে দিতে যাবে, ঘড়ি দেখেছো? পৌনে সাতটা বেজে গেছে কিন্তু। এরপর আটটার লালগোলার আগে কৃষ্ণনগর যাবার আর কোনো ট্রেন নেই কিন্তু,” ওপাশ থেকে ফরিদা বলে উঠল।
“এই রে, কী হবে তাহলে?” শোভন একটু অপ্রস্তুত হল, “তোমরা এত লটবহর নিয়ে একা একা”
“ভালো কথা বললা গোঁসাই,” খিলখিল করে হেসে উঠল বিষ্ণুদাসী, “তিনে মিলে একা একা। সেই যে বলে না,
সেথা লক্ষ দেহের এক মানুষে রঙ্গ করে সারাবেলা— মন দেখো নদীর খেলা—ততক্ষণে শিশুদুটিকে ঘুম থেকে তোলবার কাজে সমাদৃতার সঙ্গে এসে হাত লাগিয়েছে সে-ও। ঘুমন্ত সুরভিকে কোলে তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে ঝাঁকিয়ে তার ঘুম ভাঙায় সে। আর সেই করতে করতেই গলায় গুন্গুন্ করে সুর এসে বসে তার।
“কার পদ গো বিষ্ণুদাসী? আগে শুনি নাই তো?” একটা বড় সুটকেশ দরজার দিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে শোভন প্রশ্ন করল।
মার্গারেট নামে মেয়েটার হঠাৎ দু গালে সিঁদুরের ছোঁয়া লাগল যেন, “ভালো লাগল গোঁসাই? ও আমি নিজে বেঁধেছি গো। তোমার হরদাদা সুর বসালো—”
সুরভি ততক্ষণে জেগে উঠেছে। মুখের ওপর ঝুঁকে থাকা নতুন মুখটি দেখে সে একটু হকচকিয়ে গিয়ে মায়ের দিকে ঘুরে দেখল একবার। তারপর মার্গারেটের দিকে দেখিয়ে বলে, “ও মা, এই দেখো, ফর্সামাসীর চেয়েও বেশি ফর্সা।”
“উফ! এ মেয়েটা ফর্সা নিয়ে একেবারে অবসেসড্” ফরিদা হাসছিলো, “এতো যদি রঙের দিকে চোখ তাহলে এই কালো মায়ের ঘরে থাকতে হবে না তোর যা। তোর ফর্সামাসীকে বলি তোকে নিয়ে চলে যাক। নাকি এই নতুন আরো ফর্সা মাসীর কাছে যাবি? হ্যাঁ রে?”
সুরভি কোনো জবাব দিল না। নতুন মানুষটির খবর নিতেই তখন তার দু চোখ ভারী ব্যস্ত।
জানালা দিয়ে চোখে পড়ছিলো শোভন কুলির খোঁজে এদিকওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জিনিসপত্র মোটামুটি নেমে গিয়েছে ততক্ষণে। বাচ্চাদুটির ভার মার্গারেট আর সমাদৃতার কাছে দিয়ে কবীরকে কোলে নিয়ে ফরিদা তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এল।
“শোন, ঘড়ির দিকে দেখো একবার। বড়োজোর মিনিটসাতেক সময় আছে। তুমি এগোও, আমরা এদিকটা সামলে নিচ্ছি।”
শোভন ফরিদার দিকে ঘুরে তাকাল, “অসুবিধে হবে না তো?”
“দেরি করে তুমি কোর্টে পৌঁছুলে তার চেয়ে অনেক বেশি অসুবিধা হবে। তুমি যাও,” শোভনের গায়ে মৃদু ধাক্কা দিল ফরিদা, তারপর তার কানের কাছে আস্তে করে বলল, “ভালোভাবে ফিরে এসো আমার কাছে।”
তার চোখের দিকে একপলকের জন্য একবার চোখ ফেলে, শিশুটির মাথায় একবার হাত ছুঁইয়ে বড়ো বড়ো পায়ে প্ল্যাটফর্ম ধরে এগিয়ে গেল শোভন। বিল্টু আর সুরভি ততক্ষণে নিচে নেমে এসেছে। সুরভি তার আঁচল ধরে টানছিল, “ও মা, বাবা আবার কোথায় চলে যাচ্ছে?”
“বাবার কাজ আছে সোনা। তোমরা দুজন এখন লক্ষ্মী হয়ে এই মালপত্রের ওপরে বোসো দেখি। নড়বে না কিন্তু একদম। আমি মাল বইবার লোকের খোঁজ করি, কেমন?”
“যেকোন দেশ বা রাজ্যের সুশাসনের মস্তিষ্ক যদি হয় তার নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাহলে তার রাজকর্মচারীদের দক্ষতা ও কাজের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধকে তার মেরুদণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই মামলায় কিছু কিছু অসমর্থিত ইঙ্গিতে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের ভূমিকার কথা উঠে এসেছে, দুটি ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল এ নিয়ে পরস্পরের দিকে কাদাও ছুঁড়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলোতে। তবে যেহেতু বিবাদিপক্ষের তরফে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ বা প্রমাণ দাখিল করা হয় নি, অতএব রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা এই মামলার ক্ষেত্রে আলোচ্য বা প্রযোজ্য থাকবে না।
“আদালত বিস্মিত হয়েছে এক্ষেত্রে প্রশাসনের মেরুদণ্ডটির প্রকট অসুস্থতার নিদর্শন লক্ষ করে। সামান্য একটি অসমর্থিত সূত্রকে অবলম্বন করে যেভাবে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থাগুলি এবং স্থানীয় থানা অবধি সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধভাবে একজন উচ্চশিক্ষিত, পণ্ডিত সাধারণ নাগরিককে শিকার করতে বের হয়ে পড়েছিলেন এবং তার জন্য প্রয়োজনে সরকারী ব্যবহারবিধির নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অন্যায়ভাবে প্রয়োজনীয় আদেশ সংগ্রহ করে নিয়েছেন এ কেসে, তার তুলনা সভ্য গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় মেলা ভার। প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা দেয়া হয় ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও নাগরিকের রক্ষার জন্য। সেই ক্ষমতার এহেন চূড়ান্ত অপব্যবহার দেখে এই আদালত শংকিত এবং মর্মাহত হয়েছে।
অভিযুক্ত শ্রী শোভন মণ্ডলকে এই মামলায় বেকসুর খালাস ঘোষণা করা হল। এই আদালত এই কথাও জানিয়ে দিতে চায় যে ইচ্ছা হলে তিনি এই ব্যাপারে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা আনবার অধিকারী। আদালত আরও নির্দেশ দিচ্ছে, সরকার এই ব্যাপারে বিভিন্ন রাজকর্মচারীদের ভূমিকা নিয়ে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট আদালতের সামনে আগামী এক মাসের মধ্যে পেশ করবে। এই কাজটির ব্যাপারে শ্রী শোভন মণ্ডলকে সর্বোতভাবে প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করবার নির্দেশ দেয়া হল--”
আদালতঘরের বাইরে হঠাৎ একটা শোরগোল উঠল। কৃষ্ণনগরের সদর আদালতবাড়িতে এ মামলার রায় শোনবার জন্য আজ বহু মানুষ অপেক্ষায় ছিলেন। সকালে শুনানি ও সওয়াল শেষ হবার পর যখন ম্যাজিস্ট্রেট ঘোষণা করেন যে আজকেই দ্বিতীয়ার্ধে এ মামলার নিষ্পত্তিসূচক রায় দেয়া হবে, তখন থেকেই সে ভিড় জমতে জমতে ছোটখাটো একটা জনসমুদ্রে বদলে গেছে আদালতবাড়ির উঠোন। সেইখান থেকেই আওয়াজটা আসছিল। দীপক স্যান্যাল সেদিকে কান পেতে শুনে বললেন, “চলুন বাইরে যাওয়া যাক।”
শোভনের চোখের সামনে কতগুলো মুখের ছবি ভাসছিলো। হেমলতা দিদিমণি, ফরিদা, সমাদৃতা, ব্রতীন—কতো মানুষ—কতো ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের মুখ ভিড় করে আছে সেখানে। একরকম জোর করেই সেইসব ছবিগুলোকে সরিয়ে দিয়ে সে উত্তমের নম্বরটা মেলালো একবার। বারদশেক রিং হয়ে লাইনটা কেটে গেল।
“উত্তমবাবুকে ফোন করছেন নাকি?”
দীপক স্যান্যাল হঠাৎ বললেন পাশ থেকে।
“হ্যাঁ। ধরছে না।”
“ও নিয়ে ভাববেন না। উনি আমায় আগেই বলে দিয়েছিলেন আজকে বিকেলে উনি অ্যাভেইলেবল থাকবেন না। ওঁর কেসটার ব্যাপারে জানেন নিশ্চয়?”
“জানি,” শোভন মাথা নাড়ল।
“উনি আপনার ফোনে একটা মেসেজ পাঠিয়ে রাখবেন বলেছিলেন। একবার চেক করে নিন। আমি মামলার রেজাল্ট জানিয়ে ওঁকে অলরেডি একটা টেক্স্ট করে দিয়েছি। পরে কখনো রাতের দিকে কথা বলে নেবেন। এখন চলুন—”
ফোনে সত্যিই উত্তমের একটা মেসেজ এসে পড়েছিলো। হইহট্টগোলে সেটা তার খেয়াল পড়েনি। এইবারে সে সেটা খুলে দেখলো। সামান্য কটি কথা, “রাতে কলকাতা ফিরে আমার কাছে একবার আসিস। জোর করছি না। আমাদের অনেকদিনের বন্ধুত্বের দাবিতে একটা অনুরোধ করছি। তোকে আমার দরকার—”
হঠাৎ এক ঝটকায় অনেক পর্দা, অনেক ধুলো সরে গিয়ে তার চোখের সামনে পুরোনো ক’টা ছবি ফুটে উঠল যেন। মধ্যের এতগুলো বছর—এতো উত্থানপতনের সব ধুলোমাটির ভেতরেও সেই ছবিগুলো কেমন অম্লান হয়ে আছে। কাঁপা কাঁপা আঙুলে শোভন এক শব্দের একটা উত্তর পাঠিয়ে দিলো তাকে—“আসবো।”
দরজার বাইরে বের হতেই দুটি দুর্বল হাত কাঁপা কাঁপা আলিঙ্গনে তাকে জড়িয়ে ধরল এসে। শোভন চমকে উঠে বলল, “ভুবনদা! এত রোগা হয়ে গেছ কেন তুমি?”
“সে সব কথা শুনে আর কাজ কী বলো ছোটো গোঁসাই?” ভুবনের চোখদুটি চিকমিক করছিলো, “তুমি ছাড়া পাবা আর আমি সেইখেনে হাজির থাকবো না সে কি হয়? অনেক দূর থিকে আসছি, তবু বাঁচিমরি যাই হোক আমায় যে আজ এখেনে আসতেই হত বাবা! তোমার ইশকুলের দলবলও হাজির আছে দেখলাম অনেকগুলা। বেশ কদ্দিন বাদে সবগুলোর মুখ দেখলাম গো--”
“কই? সমরেশ সুবিমল-ওরা—ওরা এসেছে?”
“এসেছে, কিন্তু কাছে ঘেঁষতে পারে নাই গো গোঁসাই,” ভুবনের গলায় একটা প্রচ্ছন্ন কষ্টের স্পর্শ ছিল, “আমি বলে কোনমতে এর ওর কাছে হাত জোড় করে ভিড় ঠেলে এসে দাঁড়ায়ে আছি দরোজার কাছে সেই কখন থিকে। তুমি আজ রাজা হয়েছো তো বাবা। জয়ধ্বনি শুনতে পাও না? আজ ওরা আর তোমার কাছে ঘেঁষতে পারবে না গো।”
“এই যে শোভনবাবু বেরিয়ে এসেছেন—”
আপাদমস্তক সাদা পোশাকে মোড়া একজন মোটাসোটা মানুষ হঠাৎ এগিয়ে এসে ভুবনকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে শোভনকে দুহাতে ঘিরে নিলেন। তারপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার মুরলীপুর গ্রামপঞ্চায়েতের রত্ন শোভন মণ্ডল—”
হাতে অজস্র পতাকা নিয়ে তাকে ঘিরে আসা অজানা অচেনা মানুষের ঘন অরণ্যটা একসঙ্গে জিগির দিয়ে উঠল “জিন্দাবাদ।”
মানুষটা তাকে চেপে ধরে একরকম জোর করে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে যেতে ফের হাঁক দিলেন, “অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সৈনিক অমরেশ বাগচি—”
তার সেই ডাক ফিরে এলো নতুন এক প্রতিধ্বনি হয়ে—“অমর রহে—অমর রহে—”
“মুরলীপুরের সম্মান রক্ষা করল কে?”
“অমরেশ বাগচি আবার কে?”
চারপাশে ঘন হয়ে আসা ভিড়টার ওপারে আবছা আবছা দু একটা পরিচিত মুখ ছায়া ছায়া হয়ে ভাসছিল, ডুবছিলো। তারপর একসময় কোথায় হারিয়ে গেল মুখগুলো—গাড়িটার ওপরে তাকে দাঁড় করিয়ে গলায় বেশ কিছু মালা পরিয়ে দেয়া হয়েছে। গাড়ির নিচে বেশ কিছু তরুণ লাঠি হাতে এলোপাথাড়ি আঘাত করে লোকজনকে সরিয়ে পথ করে দিচ্ছিল তাদের জন্য।
পকেটের মধ্যে ফোনের মৃদু কাঁপুনি হঠাৎ তার চেতনা ফিরিয়ে আনল। ফরিদার ফোন। কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে তার গলা ভেসে এলো, “কী হল? এত চিৎকার হচ্ছে কেন চারপাশে?”
“ছাড়া পেয়েছি ফরিদা। সন্ধের ট্রেন ধরছি। সব ঠিক আছে। ভেবো না। সমাদৃতাকে খবরটা দিয়ে দিও তুমি। আমি এখন ছাড়ি—”
“সন্ধের ট্রেনে ফিরছেন মানে স্যার?” তার পাশে দাঁড়ানো মানুষটি হঠাৎ বলে উঠলেন।
“আমি সন্ধের ট্রেনে কলকাতায় ফিরে যাবো। আপনারা আমাকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে যাবেন।”
“সে কী করে হবে স্যার? অমরেশদা আপনার জন্য মুরলিপুরে অপেক্ষা করে আছেন। একটা সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়ে আছে ওখানে। তাঁর সঙ্গে একবার দেখা না করে—”
শোভন ফের ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আপনি কে আমি তা জানি না। তবে আজকে রাতে আমার কলকাতায় উত্তম প্রধানের সঙ্গে দেখা করবার কথা। আপনাদের সম্বর্ধনাসভায় যেতে হলে সেটা করা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। কাজেই আমি এখন ফিরে যাবো। প্রয়োজনে আপনি অমরেশ বাগচির সঙ্গে—”
তার কথাটা শেষ হবার আগেই লোকটি তার পকেট থেকে ফোন বের করে অমরেশ বাগচির নম্বরটা মেলাচ্ছিলো। একটু পরে লাইন মিলতে ফিসফিস করে তাঁর সঙ্গে কিছু কথা বলে নিয়ে রাগত গলায় সে শোভনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে। বাগচিদা মত দিয়েছেন। তবে কাজটা কিন্তু ভালো করলেন না। অত সম্মানিত লোক, আপনার জন্য এত করলেন—”
সন্ধ্যাবেলার কলকাতামুখী ট্রেন। ভিড় ছিলো না বিশেষ। ছুটন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া ভেসে আসছিলো। বাইরে কুয়াশামেশা সান্দ্র অন্ধকার ছড়িয়ে আছে। গভীর গ্রামভূমি ছেড়ে অন্ধকার খুঁড়ে খুঁড়ে যন্ত্রযান চলেছে শহরের দিকে। সেইখানে যুবকটির স্ত্রীপুত্রপরিজন, তার অজ্ঞেয়, অমোঘ নিয়তি-সকলে নিঃশব্দে অপেক্ষা করে আছে। জানালার পাশে পরিচিত স্টেশনগুলো শৈশবস্মৃতির মত মিছিল করে চলে যায়। কালীনারায়ণপুর--রানাঘাট—চাকদা—এবং অবশেষে সুন্দরনগর—
গাড়িটা থেমে ছিলো তার একান্ত পরিচিত শহরটির স্টেশনে। এখন সাতটা বাজে। ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে একটিদুটি মানুষ দেখা যায়। একটা অমোঘ আকর্ষণে শোভনের পা দুটি হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল—প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরোলেই বাসস্ট্যান্ড—দুটি তিনটি মাত্র স্টপেজ পেরোলেই ইউনিভার্সিটির সেই রাস্তাটা—
চোখদুটো জ্বালা করে উঠল কি একবার? আর একবার নতুন করে সবকিছু শুরু করতে পারলে হয় না? একেবারে নতুন করে? নতুন মাটিতে, নতুন কৃষিক্ষেত্রে ফের একবার বীজ ছড়িয়ে ধান বোনা—তার অন্তরের গভীরে ঘুমিয়ে থাকা কৃষকসত্ত্বাটি মাথা তুলে জেগে উঠে বারবার তার চেতনাকে পীড়িত করছিল সেই দাবি নিয়ে। এই বন্ধ্যাভূমিতে আর নয়—এখানে বিষাক্ত তৃণগুল্মে কৃষিক্ষেত্র ছেয়ে আছে। তার প্রাচীন পূর্বপুরুষেরাও তো এককালে নতুন নতুন কৃষিক্ষেত্রের সন্ধানে দেশ থেকে দেশান্তরে বহে নিয়ে গিয়েছিলো সৃষ্টিবীজ।
কামরার অন্যপ্রান্তে কেউ একটা গান গাইছিলো। পরিচিত সুর। গান গাইতে গাইতে মানুষটি এইদিকেই এগিয়ে আসছিলেন। চেনা গান। শরৎ ফকিরের পদ—
চার রঙা এক ফুল ফুটেছে এক ফুলেতে জরদ লাল আরেক ফুলে মধু—বুকের ভেতর থেকে একটা প্রতিধ্বনি জাগছিলো তার। বৃদ্ধ মানুষটি হাতে একটা কৌটো নিয়ে গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছেন এদিকে। কথায় সুরে মিলন হয় নি তাঁর গলায়। গুণগুণ করে গানটা ফের একবার ধরতে গিয়ে থমকে গেল শোভন। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠছে তার। সুর আসছে না কেন? সুরটা সে জানে, কত পরিচিত, কত আদরের গান তার এটা। কিন্তু গলায় তুলে আনতে গিয়ে তাল কেটে যাচ্ছে বারবার। তার ছিঁড়ে গেছে। বুকের মধ্যে যে সুরে বাঁধা তারটি তার সযত্নে রোপণ করে দিয়েছিলেন তার পূর্বপুরুষ, সে তারটাকে কোথায় হারিয়ে গেল? আঁতিপাঁতি করে সেই সুরকে খুঁজতে থাকে যুবকটি—গানের প্রথম পংক্তিটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার গায়—তবু—
বৃদ্ধ মানুষটি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ গালে হাত ঠেকিয়ে শোভন অনুভব করল কখন যেন ভিজে উঠেছে গালদুটি। নিঃশব্দে পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে বৃদ্ধের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাঁর দিকে পেছন ঘুরে বসল সে। এই সঙ্গীতময় ভূমির একজন নাগরিককে তার পরাজিত মুখটা দেখতে দিতে চায় না আর সেই নির্বাসিত যুবক।
টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশানে নেমে উত্তমকে ফোন করে তার ফ্ল্যাটের ঠিকানা নিয়ে শোভন যখন পৌঁছোলো তখন প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। উত্তম অপেক্ষা করছিলো দরজার সামনেই। একবার কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো এসে।
“কিছু খাবি?”
শোভন মাথা নাড়লো, “উঁহু। ওরা সবাই অপেক্ষা করছে রে। একটু দেরি হবে বলে দিয়েছি। গেলে পরে সবাই একসঙ্গে খেতে বসব।”
“ও, আচ্ছা,” উত্তম মাথা নাড়লো, “আসলে আজ একসঙ্গে খাবো ভেবেছিলাম, বুঝলি? এখানে একটা বাঙালি খাবারের ফুড বুটিক আছে, সেখান থেকে অর্ডার দিয়ে আনিয়ে রেখেছিলাম। তোর ফেভারিট কয়েকটা বাঙালি ডিশ। থাক গে!”
তার গলায় একটা ক্ষীণ হতাশার সুর শোভনের কান এড়িয়ে গেল না। মাথা নেড়ে সে বলল, “আচ্ছা চল। একসাথে বসি। খানিকটা এখানে খেয়ে যাই। খেতেখেতেই কথা বলা যাবে। এখানে আধপেটা, বাড়ি গিয়ে হর বাউলের বোষ্টমীর রান্না বাকি আধপেটা খাবো।”
হট কেসে ভরা বেশ অনেকগুলো পদ থেকে উত্তম একে একে তার তুলে দিচ্ছিল দুজনের থালাতেই।
সুস্বাদ ব্যঞ্জনগুলো মুখে তুলতে তুলতে শোভন বলল, “আজকাল দোকানে এসব পাওয়া যায় আমি ভাবতেই পারি নি রে। এসব তো মায়ের হাতে খেয়েছি কিছু কিছু। তবে এত দামী ইনগ্রেডিয়েন্টস তো আর ছিলো না, কিন্তু—”
“ওইটে বলিস না শোভন। মাসীমার রান্না আমায় তুই কমবার এনে খাইয়েছিস? সে সব স্বাদ আমার আজও মনে আছে। তার পাশে এ খাবার দাঁড়াতে পারবে না।”
শোভনের খাওয়া ততক্ষণে প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো। উঠে গিয়ে হাত ধুতে ধুতে বলল, “কীজন্য ডেকেছিস হঠাৎ বলবি না? আজকের কেস নিয়ে বা তোর প্ল্যানপ্রোগ্রাম নিয়ে কিছু--”
উত্তম পাত্রগুলো একত্রে করে বেসিনের ওপর ডাঁই করে রাখছিল। সেখান থেকেই বলল, “না শোভন। ওসব প্রফেশনাল ওয়ার্ল্ডের ব্যাপার নিয়ে বাইরের দুনিয়াতেই তোর সঙ্গে আমার দেখা হবে। আজ আমি তোকে একটা অনুরোধ করবার জন্য এখানে ডেকে এনেছি। তোকে সেটা রাখতে হবে। ওঘরে গিয়ে বোস তুই, আমি আসছি। বেশিক্ষণ আটকাবো না তোকে আমি।”
উত্তমের বসবার ঘরটা বেশ সুন্দর করে সাজানো। সাজসজ্জায় রুচি ও যত্নের ছাপ আছে। মিনিট পনেরো অপেক্ষা করবার পর উত্তম এসে তার পাশে বসল। হঠাৎ করেই মুখচোখের চেহারা পালটে গেছে তার। শোভনের একটা হাত ধরে বলল, “একটা জিনিস চাইব তোর কাছে। দিবি বল?”
“কী জিনিস?”
“মাদ্রিকে তুই আমার কাছে ফিরিয়ে এনে দে শোভন—”
অপ্রত্যাশিত কথাটার ধাক্কা সামলাতে কয়েক মুহূর্ত সময় নিল শোভন। তারপর ঠাণ্ডা গলায় কাটা কাটা স্বরে বলল, “তুই কী মিন করছিস উত্তম?”
উত্তম একটু থতমত খেয়ে বল, “এই, আমি খারাপ কিছু মিন করিনি রে! ইউ আর সো হ্যাপি উইথ ইয়োর লাইফ, ইওর লাভ। তোকে তেমন কোন ইঙ্গিত আমি করিনি রে। বিলিভ মি—”
শোভন নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিল। খানিক বাদে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে উত্তম ফের কথা বলল, “তোকে ও ভগবানের মত মানে শোভন। কাল আমাদের কেসটার হিয়ারিং। আমি—আমি ওকে চাই, আমার ছেলেটাকে চাই—তুই একবার ওকে গিয়ে আমার হয়ে কথাটা বল—আমি তো ওরই জন্যে —বিল্টুর জন্যে—ও একবার ফিরে এলে তুই যা চাস, যেমনভাবে চাস—তোর নিজের স্কুল—তোর গানের মেলা—সব—সব ফিরিয়ে দেবো আমি—সব--”
তার জড়িয়ে আসা কথাগুলো, তার মুখ থেকে ভেসে আসা মৃদু মাদক সুবাস, তার ঝুঁকে পড়া মাথাটা একজন পরাজিত, বিধ্বস্ত ভিক্ষুকের মত লাগছিল শোভনের কাছে। সময় এক লাফে পিছিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে দুই বন্ধু পাশাপাশি হাঁটছিল—তাদের চোখে তখন অনেক স্বপ্ন—অনেক ভালোবাসা ছিল—
কিন্তু তারপরই মাথা নেড়ে উঠে বসল শোভন। গত ক’মাসে সমাদৃতাকে খুব কাছ থেকে ফের একবার দেখেছে সে। উত্তমের শরীরের ভেতর বাসা করা এই মানুষটার কাছে সে আর কখনোই ফিরে আসতে পারবে না। সম্পর্কটা মরে গেছে। সমাদৃতা সেটাকে মেনে নিয়ে নতুন করে নিজের জীবনটাকে সাজিয়ে তুলেছে ফের। দুঃখ সে-ও কম পায় নি। কিন্তু সে দুঃখকে পেরিয়ে আবার একটা সুন্দর জীবনের খোঁজে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মেয়েটা। শোভন তাকে এ কথা বলতে পারবে না। বলে লাভও হবে না কোন। মাঝখান থেকে দুঃখই বাড়বে শুধু।
“উত্তম শোন। আমি চেষ্টা করিনি ভেবেছিস? রিকনসিলিয়েশানের জন্য আমি মাদ্রিকে বুঝিয়েওছিলাম। কিন্তু--”
হঠাৎ মাথা তুলে সোজা হয়ে বসল উত্তম, “বুঝিয়েছিলি, তাই না? মাদ্রির ডিভোর্স স্যুটের ডেটটা তোর মনে নেই? আমি বলছি। শোন। তুই প্রথম যেবার জলপাইগুড়ি গিয়ে উঠলি, তার কয়েকদিনের মধ্যেই চিঠিটা ও পাঠায়। তোকে জিজ্ঞাসা না করে ও কাজটা করেছিলো বলতে চাস? তুই তখন ওখানে হাজির ছিলি। আমি সব জানি শোভন। সব বুঝি আমি। তখন তুই সেটা আটকাবার জন্য একটা আঙুলও যদি তুলতি--কেন তুলিস নি, বল। নিজে তো দিব্যি নিজের বউ ছেলে নিয়ে--”
শোভন নির্বাক হয়ে শুনছিলো। পুরোনো মানুষটার খোলশ ছেড়ে এইবারে যে বের হয়ে আসছে তার সামনে, সেই উত্তমকে শোভন চেনে না। তবু সে আর একবার শেষ চেষ্টা করল, “উত্তম, মাদ্রির সঙ্গে বেশ ক’বছর সংসার করেও তুই ওকে তাহলে একটুও চিনিস নি। ও অন্য ধাতুতে গড়া রে। কারো কথা শুনে ও চলবে এ কথা--”
“অন্য ধাতু? তুই তো ওর সঙ্গে সংসার পাতিস নি শোভন! তুই তাহলে অন্য ধাতুটা চিনে ফেললি, আর আমি—আমি তার স্বামী হয়ে—তুই বলছিস—” বলতে বলতে উত্তম তার মুখটা শোভনের একেবারে সামনে নিয়ে এসে নিচু গলায় বলল, “তোকে একটা কথা পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি আমি। বোঝাতে যদি রাজি না-ও হোস, তাহলে অন্তত এটা ওকে গিয়ে বলে দিস। মাদ্রি যদি আমার কাছে ফিরে না আসে, তাহলে—আমি কিন্তু ওকে একেবারে শেষ করে দেবো। কয়েকমাস ধরে আমি সেজন্য তৈরি হয়েছি। ছেলে নিয়ে ঘর করবে? আর আমি রাস্তার কুকুরের মত দরজার কাছ থেকে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসবো? আমি ছাড়বো না ওকে। ছাড়বো না আমি। তোর নামও জড়াবে এর মধ্যে এই বলে দিলাম। ছাড়া তুইও পাবিনা। তিল তিল করে এই ক’মাস ঘুঁটি সাজিয়েছি আমি। পলিটিক্যাল কুত্তাগুলোকে প্যাঁচ খাইয়ে, মাংসের টুকরো ছুঁড়ে লাইনে এনেছি। জলের মতো টাকা ছড়িয়েছি। কাউকে ছাড়বো না আমি। কাউকে--”
ক্লান্ত, বিষণ্ণ মানুষটার মাথাটা বুকের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। তার গায়েই হেলান দিয়ে ফের চোখ বুঁজেছে সে। শোভনের আর কোন রাগ হচ্ছিল না পরাজিত মানুষটার ওপরে। বড়ো মমতায় সে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল একবার। তারপর দুটি শক্ত পেশল হাতে তার শরীরটাকে বয়ে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। বড়ো হালকা হয়ে গেছে উত্তমের শরীর। তার ঝকমকে পোশাকের ছটায় বাইরে থেকে তা ধরা পড়ে না।
তাকে শুইয়ে রেখে দরজাটা টেনে লক করে দিয়ে পথে নেমে এলো শোভন। সাড়ে দশটা বাজে প্রায়। ঠাণ্ডা পড়েছে আজ এদিকেও। রাস্তায় ক্বচিৎ একটিদুটি বাসের দেখা মেলে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর যাদবপুর ফাঁড়ির একটা বাস পেয়ে তাতে উঠে বসলো সে।
“তুমি এতো দেরি করলে? আমরা সবাই বসে বসে চিন্তা করছি। ফোনও সুইচ অফ করা--”
ফরিদার চোখে রাগ, উৎকন্ঠা সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়েছিল। ফোনটা খুলে দেখলো শোভন একবার। ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে কখন যে বন্ধ হয়ে গেছে খেয়াল করে নি। ফরিদাকে সে কথা বলে লাভ নেই। রাগের মুহূর্তে সে যুক্তির কথা মানতে চায়না।
“বাচ্চারা ঘুমিয়েছে?”
“সে খোঁজে তোমার কাজ কী বলো? আছো তো নিজের খেয়ালে। অন্য কেউ টেনশন নিয়ে অপেক্ষা করে আছে সে কথা তুমি মনে রাখবে কেন? কী হল কোর্টে?”
“ওসব কথা এখন থাক ফরিদা,” শোভনের গলায় ক্লান্তির স্পর্শ ছিল, “বাচ্চারা ঘুমিয়েছে?”
“আর ঘুম! সুরভি এই এখন অবধি জেগে বসেছিলো তোমার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে বিল্টুও জেদ ধরে বসেছে। শেষে জোর করে নিয়ে শোয়াতে কেঁদেকেটে অস্থির করে দিয়েছে একেবারে। পাকা মেয়ে। কান পেতে আমাদের কথাবার্তা শুনেছে। তাতে পুলিশ, মামলা এসব শুনে মাথায় কী খেলেছে কে জানে! শুধু বলে “বাবা কেন এখনো আসছে না? বাবা কোথায় চলে গেলো আমাদের রেখে?”
“কোথায় শুয়েছে?”
ফরিদা পাশের একটা ঘর দেখিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বলল, “দুটো ঘরের একটা আমাদের ছেড়ে দিয়েছে। অন্যটায় মার্গারেট শোবে সমাদৃতার সঙ্গে। তুমি আর হর-দা বারান্দায় শুয়ে পড়ো।
কাঁধের ঝোলাটা নামিয়ে রেখে শোভন তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে গেল। মশারির ভেতর মার্গারেট শিশুদুটির মাথার কাছে বসেছিলো। একপাশে রাবার ক্লথের ওপর কবীর ঘুমিয়ে আছে। অন্যপাশে বিল্টু আর সুরভি জড়াজড়ি করে ঘুমোচ্ছে। মশারি তুলে শোভন মাথাটা ভেতরে ঢোকাতে মার্গারেট ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করল তার দিকে।
ঘুমন্ত শিশুদুটিকে একটু আদর করে কবীরের দিকে হাত বাড়িয়েও হাত সরিয়ে নিল শোভন। বাইরের ধুলোময়লা মাখা হাতে তাকে এখন ছোঁয়া ঠিক হবে না। তারপর ফের নিঃশব্দে বাইরে বের হয়ে এলো সে। মার্গারেট আগেই বের হয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল। শোভন আসতে নিচু গলায় বলল, “চলো গোঁসাই। এইবারে ভাত বেড়ে দি সবাইকে।”
“সমাদৃতাকে দেখছি না যে? হরদাও নেই নাকি?”
“সমাদৃতাদিদি পাশের ঘরে কালকের কাগজপত্র নিয়ে বসেছে সেই সন্ধে থেকে। মধ্যে একবার তোমার খোঁজ করছিলো। আর তোমার হর দা—তার ফিরতে ফিরতে শেষ রাত। গানে গেছে। মোহরকুঞ্জে কী এক অনুষ্ঠান আছে। সেখেন থেকে ডেকে নিয়ে গেলো সন্ধেবেলা এসে। আমাকেও টানাটানি করছিলো, আমি মানা করে দিয়েছি। বাড়িতে কুটুম রেখে গিন্নি বের হয় কেমন করে বলো!”
শোভনের ঠোঁটে একটুখানি হাসি খেলা করছিল। বলে, “তবেই বোঝো বিষ্ণুদাসী, মায়া কাকে বলে? ছিলে সেই কোন দেশের পড়াশোনা জানা মেমসাহেব, আর এখন মায়ায় পড়ে হর বাউলের ঘর সামলাতে এসেছো। কেমন করে এমন জাদু হয় বলো দেখি?”
“সে উত্তর তো তোমার ক্ষেপিকে আমি সেই বচ্ছরকাল আগেই দিয়ে এসেছি গো গোঁসাই। তোমায় বলে নি?” মার্গারেটের নীল চোখে হাসি তিরতির করছিল, “সবই সেই তিন আখরের খেলা-চন্দ্রসূর্য ওঠে—মানুষে মানুষের গর্ভে মানুষ বানায়—জন্মায়–মরে—সবার মূলেই তো সেই তিন আখর গো। পী, রি আর তি। তা তোমাকেও সে জাদুতে ধরেছে গোঁসাই এবারে। ওই যে মশারির মধ্যে তিন সুতোর ফাঁস আর বাইরে একজন বসে আছেন, এই চারেতে মিলে তোমায় বেঁধেছে। পালাবা কোথা? এখন চলো, ভাত বেড়ে খেতে বসি সবাই মিলে। রাত তো কম হল না। তার ওপর তোমার খাটাখাটুনিও গেছে বেশ খানিক।”
সামান্য আয়োজন। আতপ চালের ভাত, একটি সবজি, একটু ডাল। এক গ্রাস মুখে দিয়ে শোভন বলে, “কে রাঁধল? মার্গারেট তুমি?”
“আর কে রাঁধবে বলো? তোমার বাউলদাদা ক’টা ঝি রেখে দিয়েছে আমার জন্যে এ বাড়িতে?” বলতে বলতেই কথা ঘুরিয়ে সে বলে, “কিন্তু সত্যি করে বলো গোঁসাই, এ রান্না তোমার বউ-এর চেয়ে ভালো না মন্দ?”
উত্তরটা ফরিদাই দিয়ে দিল। মুখে গ্রাস তুলতে তুলতেই সে বলে, “আমি যা খাবার করি সে তোমার এই রান্নার ধারেকাছে আসবেনা বিষ্ণুদাসীদি। তারজন্যে দায়ী কে জানো? এই যে এই মানুষ। ছোটোবেলা থেকে বড়ো করেছে শুধু পড় পড় বলে। চড়থাপ্পড়ও দিয়েছে অনেকবার। সেই করে করে শুধু বইটাই পড়তে শিখলাম। রান্নাবান্না আর আমার হল না। তবে হ্যাঁ, সমাদৃতাদির পায়ের ধুলো নিতে হয়। অত পড়াশোনা, অতবড় দায়িত্বের কাজ করে, কিন্তু রান্নার হাতটাও ভালো। খেলে তুমি ভুলতে পাবে না বিষ্ণুদাসীদি।”
সমাদৃতা একপাশে বসে যান্ত্রিকভাবে খেয়ে চলেছিলো। কোন সাড়া দিলো না সে। তারপর হঠাৎ মুখ তুলে শোভনের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “এত দেরি করলি যে? কোথায় গিয়েছিলি?”
শোভন একটু ইতস্তত করে বলল, “উত্তমের বাড়িতে। যেতে বলেছিলো একবার বিশেষ করে—”
“উত্তমদার বাড়িতে গিয়েছিলে তুমি? কেন আজকের দিনটা বাদ দিয়ে পরে কখনো গেলে হত না? যা দরকার সেসব তো ফোনেই সেরে নিতে পারতে? আশা করেছিলাম অন্তত আজকের দিনটা তুমি একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।” ফরিদার গলার ঝাঁজ তখনো কমে নি।
হঠাৎ মার্গারেট ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, “ওকি সমাদৃতাদিদি, উঠছো যে? খাবে না আর?”
সমাদৃতা অর্ধভুক্ত থালাটা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “আমার খাওয়া হয়ে গেছে মার্গারেট।” তারপর শোভনের দিকে ফিরে বলল, “খাওয়া শেষ হলে একটু এ ঘরে আসিস শোভন। দুটো একটা জরুরি কথা বলবার আছে তোর সঙ্গে।”
“মেয়েটাকে ভালো করে খেতেও দিলে না তুমি,” সমাদৃতার ঘরের বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজাটার দিকে তাকিয়ে ফরিদা কেটে কেটে বলল শোভনকে, “উত্তমদার বাড়িতে যাবার খবরটা ওর সামনে এই খাবার সময়েই না দিলে তোমার চলছিল না, না? ওর মনের ভেতর এখন কী ঝড় চলছে সে তোমার বোঝার ক্ষমতা আছে? এখানে এসে তক একটা কথা বলে নি কারো সঙ্গে। সন্ধের পর থেকে ওই ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা দিয়ে বসে আছে। এখন তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে গিয়ে দেখো কী বলে।”
শোভনের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিলো। শেষ গ্রাসটা মুখে তুলে সে থালা ঠেলে উঠে পড়লো।
“উত্তমের বাড়িতে তুই ঠিক কেন গিয়েছিলি শোভন? কেসের খবর দিতে?”
উত্তম মাথা নাড়লো, “না।”
“তবে?”
“সে কথাগুলো তোকে না বলাটাই ভালো হবে বোধ হয় মাদ্রি।”
সমাদৃতা শোভনের দিকে ফিরে চাইল, “না শোভন। তুই বল। কী বলবার জন্য ও ডেকেছিল তোকে? আমাদের কালকের হিয়ারিঙের ব্যাপারে, তাই না?”
“হ্যাঁ। মাদ্রি শোন, এ প্রসঙ্গটা থাক বরং।”
“না। থাকবে না। আমার জানা দরকার। ব্যাপারটা আমার আর উত্তমের মধ্যে শোভন। এখানে তুই গুরুত্বপূর্ণ নোস। ও কী বলেছে সেটা জানবার রাইট আমার আছে। তুই খোলাখুলি আমায় বল। আমি কিছু মনে করব না।”
শোভন একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলল, “উত্তম তোকে বোঝাতে রিকোয়েস্ট করেছিল আমাকে। ওর দাবি, তোকে নিঃশর্তে ওর কাছে ফিরে যেতে হবে বিল্টুকে নিয়ে। বলছিল, না রাজি হলে—”
“থাক। আর বলতে হবে না তোকে। একটা কথা বল তো। আজ তোর জাজমেন্টে ঠিক কী বলেছে?”
“বলবে আর কি? অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ওভারএনথুসিয়াজম, নির্দোষ মানুষকে অভিযুক্ত করে হ্যারাস করা এইরকম সাতসতেরো কথা। মোটের ওপর আমার এগেইন্সটে সব অভিযোগ খারিজ হয়ে গেছে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশানের সঙ্গে ইনভেস্টিগেশানে কো অপারেট করতে অর্ডার দিয়েছে আমায়। অর্ডারের কপিটা দুচারদিনের মধ্যেই পেয়ে যাবো, তবে ওই ইনভেস্টিগেশনের ব্যাপারে বোধ হয় এখন কয়েকদিন কলকাতায় থেকে যেতে হবে আমাকে। ফোনে একটা মেসেজ এলো খানিক আগে--”
“বেশ। তাহলে ও আমায় যে জুজুর ভয়টা দেখিয়ে রেখেছিলো এতদিন সেটা মিটে গেল। ফাঁকা ধমক দিয়ে যাচ্ছে ও এখন।”
“তোকে–আমার কেস দিয়ে-”
“সে অনেক কথা শোভন। তোর এগেন্সটে যে মাওইস্ট রিলেটেড অভিযোগটা উঠেছিলো, সেই জুজুর ভয় আমাকেও ও দেখিয়েছিল। বলেছিলো তোর সঙ্গে আমার যোগাযোগ, আমার বাড়িতে তোর সপরিবারে গিয়ে ওঠা এগুলো ওপরমহলে ভালো চোখে দেখা হচ্ছে না। সেই নিয়ে আমার বাবা মাকেও গিয়ে বুঝিয়ে তাঁদেরও দলে টেনেছে। এখন তোর কেসটাই যখন মিটে গেছে তখন ও আর অন্য যা খুশি বলতে থাক গে। আমি পরোয়া করি না।”
“কখন বেরোবি কাল তুই?”
“সাড়ে দশটায় টাইম। এখান থেকে অফিস আওয়ারে ব্যাংকশাল ঘন্টাখানেক লাগবে ধরে নিচ্ছি। নটা সাড়ে নটার মধ্যে বেরিয়ে পড়ব।”
“আমি সঙ্গে যাবো?”
“না রে। একলাই তো চললাম চিরটা কাল। এবারে এই লড়াইটাও আমায় একলাই লড়তে হবে শোভন। তুই নিজে একটা এতবড়ো সমস্যা থেকে উঠলি—তোকে আর এর মধ্যে জড়াবো না। ও আমি ঠিক চলে যাবো দেখিস। বিল্টুকে খেয়াল রাখিস তুই বরং এখানে থেকে। কাল আর কোথাও বেরোস না। ওকে নিয়ে আমি একটু নিরাপত্তার অভাবে ভুগছি রে। এই রিকোয়েস্টটা আমার রাখতে হবে তোকে।”
|| ২১ ||
“নাম?”
“উত্তম প্রধান।”
“পেশা?”
“বেসরকারী কর্মচারী।”
“উত্তমবাবু, আপনার স্ত্রী শ্রীমতী সমাদৃতা প্রধান আপনার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চেয়ে এবং আপনাদের সন্তানের ওপর নিরংকুশ অধিকার দাবি করে যে পিটিশনটি জমা করেছেন তার কপি আপনি পেয়েছেন কি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ ধর্মাবতার।”
“শ্রীমতী প্রধানের অভিযোগের ব্যাপারে আপনার নিজস্ব বক্তব্য কিছু আছে?”
উত্তম একবার ঘুরে তাকাল চেয়ারে বসে থাকা সমাদৃতার দিকে। সমাদৃতা মাথা নিচু করে বসেছিল। তার ঘুরে দেখাটা তার নজরে পড়ে নি।
“ধর্মাবতার, এ ব্যাপারে কিছু বলবার আগে আমার একটি নিবেদন রয়েছে। অনুমতি হলে তা আদালতে পেশ করতে পারি।”
“অনুমতি দেয়া হল।”
“আমার স্ত্রী কেন আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হবার জন্য আবেদন করেছেন তার প্রকৃত কারণটি সম্ভবত আলাদা।”
“আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?”
“ধর্মাবতার, যে কারণটি উনি পিটিশনে দেখিয়েছেন সেটি হল দুর্নীতির অভিযোগে আমার বিরুদ্ধে সরকারের মামলা গঠন। বিষয়টি এখনও সরকারের বিচারাধীন। সে সম্পর্কিত কাগজপত্র আমি পিটিশনের জবাবের সঙ্গে সংলগ্ন করেছি। অতএব একটি বিচারাধীন বিষয়ের ভিত্তিতে বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তির নিজের সন্তানের ওপর অধিকার হারানো কতটা আইনসঙ্গত হবে তা মহামান্য আদালতই বিচার করবেন। বিবাহবিচ্ছেদ ও সন্তানকে নিজের কাছে রাখবার অধিকারের দাবি জানাবার মতন যথেষ্ট ভিত্তি যে এই অভিযোগে গড়ে ওঠে না, একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী হিসেবে আমার স্ত্রীরও তা অজানা থাকবার কথা নয়। এই অনুমানের ভিত্তিতে আমি গত কিছুকাল ধরে তাঁর এই আবেদনের প্রকৃত কারণটি অনুসন্ধান করেছি। তবে, গত কয়েক মাস ধরে আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখবার ফলে এই পিটিশন জমা হবার পর আমার ওঁর সঙ্গে মুখোমুখি কোনো কথা বলবার সুযোগ হয় নি। ফলে আমি তাঁকে এ বিষয়টি নিয়ে কিছু বলে, বুঝিয়ে মীমাংসা করবার কোনো চেষ্টাও করতে সক্ষম হইনি। আমি সাধারণ মানুষ। স্ত্রীপুত্র নিয়ে সুখে সংসার করতে চাই। এ কথা আমার স্ত্রীর বাবা মাও স্বীকার করেন। প্রয়োজনে মহামান্য আদালত তাঁদের সাক্ষ্যও গ্রহণ করতে পারেন। অনুমতি পেলে আমি এখন একবার ওঁর সঙ্গে একটু নিভৃতে কথা বলে দেখতে চাই।”
“সমাদৃতা দেবী, এ বিষয়ে আপনার কোন বক্তব্য আছে?”
সমাদৃতা মাথা নাড়ল, “না ধর্মাবতার। এঁর সঙ্গে আর কোন কথাই বাকি নেই আমার। এ সম্পর্কের মৃত্যু ঘটেছে অনেকদিন আগেই।”
বিচারপতির গলা একটু কঠিন হল, “দেখুন সমাদৃতা দেবী, ইরিট্রিভেবল ব্রেকডাউন অব ম্যারেজের ক্লজ মোতাবেক আপনি যে-কোনো অবস্থাতেই বিবাহবিচ্ছেদের দাবি করতে পারেন। সেই কারণে উত্তমবাবুর বিরুদ্ধে আপনার আনা অভিযোগে আপাতদৃষ্টিতে কিছু দুর্বলতা এই আদালতের নজরে এলেও আপনার পিটিশান আমরা গ্রহণ করেছি। কিন্তু তবু, এই কেসে কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে বলে এই আদালতের বিশ্বাস। আপনাদের একটি সন্তান রয়েছে। ভালোভাবে বড়ো হয়ে ওঠবার জন্য মা ও বাবা, দুজনকেই তার প্রয়োজন। অতএব আপনার পিটিশনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমরা চাইব আপনি একবার উত্তমবাবুর সঙ্গে কথা বলুন। বেলা তিনটের সময় কোর্ট আবার আপনাদের বক্তব্য শুনবে।”
“বলো কী বলবে।”
“একটাই অনুরোধ সমাদৃতা, বিল্টুকে নিয়ে ফিরে এসো।”
“কেন শুধু শুধু এ কথা বলছ উত্তম? আমি ফিরবো না। ফিরতে পারবো না। আমার যা কিছু শিক্ষাদিক্ষা, সব বিসর্জন দিয়ে আমি একটা দুশ্চরিত্র চোরের সঙ্গে সংসার করতে রাজি নই সে আমি তোমাকে আগেই বলে দিয়েছি। নতুন করে আর তো কিছু আমার বলবার নেই।”
“যা বললে তার একটা প্রমাণও তো তোমার কাছে নেই সমাদৃতা? আদালতও যে সে কথা স্বীকার করছেন সে তো তাঁদের ভাবভঙ্গিতে তুমি বুঝতে পেরেছো। তুমি নিজেও আইনের ব্যাপারে কাঁচা নও।”
“আমি যেটা সত্যি বলে জানি উত্তম, তুমিও সেটা সত্যি বলে জানো, সে আমার কাছে স্বীকার করো আর নাই করো। তার আদালতে প্রমাণ অপ্রমাণে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।”
উত্তম মাথা নাড়লো। এই মুহূর্তটার জন্যই সে এতদিন প্রতিটা মুহূর্ত নিজেকে দগ্ধে দগ্ধে তৈরি করেছে। শেষ অস্ত্রটা তৈরি করবার জন্য নিজেকেই হত্যা করেছে তিলতিল করে। এইবার তার প্রয়োগ করতে হবে। নিজের ছেলেটাকে হারাবার ভয় হলে কথায় গিয়ে দাঁড়াবে তুমি? তার অনিচ্ছুক হাতটা প্রায় জোর করেই ব্রিফকেস থেকে একটা ফাইল বের করে আনলো, “এই তোমার শেষ কথা যদি হয়ে থাকে সমাদৃতা তাহলে আমার শেষ কথাটাও শুনে রাখো। তুমি যদি আমার কাছে না ফেরো তাহলে বিল্টুকেও তুমি পাবে না।”
সমাদৃতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, “পারলে সে চেষ্টা করে দেখো। আইন কিন্তু—”
“তোমার কোনো অসম্মান হোক সে আমি চাই না সমাদৃতা। তাই অনুরোধ করব, এখান থেকে বেরিয়ে যাবার আগে এই ফাইলটা একবার দেখো। বিল্টুর কাস্টডি পাবার জন্য দরকারে এ ফাইলটা আমি আদালতে পেশ করবো বলেই তৈরি হয়ে এসেছি।”
মিনিট পনেরো বাদে সমাদৃতা যখন ফাইলটা থেকে মুখ তুললো, তার ঠোঁটদুটি কাঁপছিলো, “তুমি—এত নিচে নেমে যেতে পারলে উত্তম? এতবড়ো একটা মিথ্যে--”
একে মিথ্যে বলে আমার চেয়ে বেশি কেউ তো জানে না সমাদৃতা। তাই তো তোমাকে এত করে পেতে চাই আবার। তোমাকে আমি ভালোবাসি, বিশ্বাস করি। কিন্তু ভেবে দেখো, এ ফাইল আদালতে পেশ হলে, ইউনিভার্সিটির সেই সোশ্যালের রাতে তোমার আর শোভনের ঘনিষ্টভাবে বসে থাকবার এই ছবিটা থেকে শুরু করে, আমাদের বিবাহিত জীবনের এই এতগুলো বছর ধরে, এমনকি শোভনের বিয়ের পরেও তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলা, প্রয়োজনে সরকারী পদের সুবিধে নিয়ে বারংবার তাকে বাঁচাবার জন্য ছোটাছুটি করা, শোভন জলপাইগুড়িতে আসবার পর তার সঙ্গে উপযাচক হয়ে গিয়ে দেখা করা, তার বিরুদ্ধে মামলা চলাকালিন নিজের চাকরি, সামাজিক প্রতিষ্ঠার তোয়াক্কা না করে তাকে আশ্রয় দেয়া, তার সঙ্গে নিভৃতে সময় কাটানো, এখানে ওখানে যাওয়ার এই যে রেকর্ডগুলো, এগুলোর সঙ্গে যখন তোমার কোনো কারণ ছাড়াই আমার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনটা একসঙ্গে মিলিয়ে আদালত দেখবে, তখন একজন দুশ্চরিত্রা মহিলার কাছে তাঁর সন্তানকে রেখে দেবার আবেদনটা কতোটা গ্রাহ্য হবে ভেবে দেখেছো?”
“তুমি—”
আরেকটু বাকি আছে। “আদালতে এ রিপোর্টটা পেশ হবার পর যে শুনানি ও রায় দেয়া হবে তাতে কিন্তু এই সন্দেহকেই প্রধান ভিত্তি করা হবে। সে রায়টা ফরিদা যখন শুনবে, তখন যতই সে তোমাকে বিশ্বাস করুক বা শোভনকে ভালোবাসুক, তার মনে একটা সন্দেহের বীজ গেড়ে বসবেই। এরপর সে-বিষে ওদের জীবনটাও নষ্ট হবে। এতগুলো জীবন সমাদৃতা। তোমার একটা সিদ্ধান্তের ওপরে সবকিছু নির্ভর করছে। এবারে যা করবার ভেবেচিন্তে ঠিক করো। আমি চলি। হিয়ারিং-এ দেখা হবে।”
মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল সমাদৃতা। সামনে আর একটাই মাত্র রাস্তা খোলা রয়েছে এখন। এ ছাড়া আর তার কোনও উপায় বেঁচে নেই।
“ম্যাডাম, স্যার চলে গিয়েছেন, আপনি কি আর কিছু অর্ডার করবেন?”
প্রৌঢ় ওয়েটারটি তার কাছে এসে নিচু আওয়াজে ডাকছিলো।
সমাদৃতা তাড়াতাড়ি চোখদুটো মুছে নিল। বুকের ভেতর একটা প্রবল ভাঙচূর চলছে। মানুষটা জিতে গেল। কিন্তু এ ফাইল সে কিছুতেই সামনে আসতে দিতে রাজি নয়। দুটো পরিবার ধ্বংস হবে। ফরিদার মুখটা তার চোখের সামনে ভাসছিল। তারপর তাকে আড়াল করে বিল্টুর মুখটা ভেসে উঠল সামনে—ভালো থাকুক ও—
“কিছু ঠিক করলেন?”
“আমি আমার যথাসাধ্য ওকে বুঝিয়েছি ধর্মাবতার। আমি এখনও ওকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, ওকে নিয়ে আর আমাদের সন্তানকে নিয়ে সংসার করতে চাই, সে কথা বারংবার বলেছি। আমার একান্ত আশা ও বুঝেছে বলেই আমার বিশ্বাস।”
“সমাদৃতাদেবী?”
সমাদৃতা উঠে দাঁড়ালো। তীব্র হলাহলের মত কথাগুলো তার ভেতরটাকে পুড়িয়ে দিয়ে উঠে আসছিল বাইরে—
“ধর্মাবতার, পিটিশনে আমি যে অভিযোগগুলো তুলেছিলাম, আইনের চোখে তার জোর কতোটা তা আমি জানি না, কিন্তু স্ত্রী হিসেবে ওর সত্যতা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমার চোখে উত্তম প্রধান একজন অসৎ মানুষ। আমার তরফে এ সম্পর্ক অনেকদিন আগেই মৃত। তাকে বাঁচাবার ক্ষমতা আমার নেই। কোনও প্রলোভন, কোনও ভয়েই আর তার কোনো পরিবর্তন হবে না।”
উত্তম স্থির চোখে তার দিকে দেখছিলো। সে দৃষ্টিতে আশাভঙ্গের যন্ত্রণার সঙ্গে মিশে ছিল উগ্র, সর্বগ্রাসী রাগের স্পর্শ। ধীরে ধীরে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফাইলটা এর করে এনে সে বলল,
“সেক্ষেত্রে ধর্মাবতার আমার অনুরোধ আমাদের ছেলেটিকে মানুষ করবার অধিকার আমাকে দেয়া হোক। তার কারণ হিসেবে আমি এই তথ্যগুলো—”
“এই প্রস্তাবে আমার কোন অসম্মতি নেই ধর্মাবতার।” সমাদৃতার ঠাণ্ডা গলায় কেটে কেটে উচ্চারিত শব্দগুলো আদালতের দেয়ালে প্রতিফলিত হচ্ছিল, “আমি স্বেচ্ছায় আমার সন্তানের ভরণপোষণের অধিকার উত্তম প্রধানের হাতে ছেড়ে দিতে রাজি আছি। ওঁর দাবির কারণ দর্শাবার জন্য কোন তথ্যপ্রমাণাদি পেশ করবার কোন দাবি আমার নেই।”
বয়স্ক বিচারকটি খানিক হতবাক হয়েই ঘুরে তাকালেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটির দিকে। দীর্ঘ বিচারকজীবনে সম্ভবত এমন কোনো উদাহরণ তিনি দেখেন নি। একটু পরে হতাশ গলায় তিনি বললেন, “সেক্ষেত্রে এ মামলাটিকে নাহক দীর্ঘায়িত করতে আমি রাজি নই। তবে সমাদৃতাদেবীকে একটিই কথা আমি বলতে চাই, যে ইরিট্রিভেবল ব্রেকডাউন অব ম্যারেজের দাবিতে আপনি আপনার স্বামীর তরফে বিয়ে ভাঙবার জন্য উপযুক্ত কোনো প্রমাণিত ত্রুটি ছাড়াই এ সম্পর্ককে ছিন্ন করতে চাইছেন, এবং নিজের স্বাধীনতার জন্য যেভাবে আপনি নিজের গর্ভজাত সন্তানের অধিকারও ত্যাগ করলেন, ভারতীয় বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা অভাবিত। আমি একটা কথা পরিষ্কার করে দিতে চাই, এক্ষেত্রে কোন খোরপোষের অধিকারী আপনি হবেন না।”
“একটু দাঁড়াও সমাদৃতা।”
পেছন থেকে উত্তমের গলার শব্দ পেয়ে সে ঘুরে দাঁড়ালো একবার।
“তুমি—তুমি এমনভাবে—”
“ছেলেকে কবে নিয়ে যেতে চাও তুমি?” সমাদৃতার গলায় ক্লান্তির স্পর্শ ছিল।
হঠাৎ উত্তমের গলাটাও ঠাণ্ডা হয়ে এলো। যুদ্ধজয়ের আনন্দ এত বিস্বাদ হয় কেন?
“আসবো এর মধ্যে একদিন। কিছু বন্দোবস্ত করতে হবে তো!”
“বেশ। আমাকে আগে একটা ফোন করে নিও। আমি কাল ফিরে যাচ্ছি বিল্টুকে নিয়ে। তারপর যেদিন তুমি বলবে—”
|| ২২ ||
“ডিয়ার প্রিন্সিপ্যাল, থ্যাংকস ফর কনসিডারিং মি ফর আ পোজিশান অ্যাট ইওর এসটিম্ড্ অর্গানাইজেশান। আই শ্যাল বি ফ্লাইং ডাউন টু মালয়েশিয়া—”
মোবাইলের পর্দায় গ্লোবাল ইন্ডিয়া স্কুল চেইনের মালয়েশিয়ান ক্যাম্পাসের প্রিন্সিপালের উদ্দেশ্যে চিঠিটার দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইল সমাদৃতা। আর একটামাত্র আঙুলের স্পর্শ বাকি--
আহিরিটোলার লঞ্চঘাট থেকে শেষ হাওড়াগামী লঞ্চটা ছেড়ে যাচ্ছিল। ভাসমান জেটিতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা একটু অবাক হয়েই তার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটাই কিন্তু শেষ লঞ্চ ম্যাডাম। এর পর হাওড়ার দিকে আর কোনো—”
তার দিকে একবার তাকিয়ে ফের পর্দার দিকে চোখ ঘোরালো সমাদৃতা। নীল রঙের ছোট্ট ‘সেন্ড বোতামটা তাকে ডাকছিল। কাঁপা কাঁপা আঙুলটা সেটার ওপর সামান্য উঁচুতে ধরে রইল সে একটুক্ষণ। শেষে একরকম জোর করেই সেখানে আঙুলটা ছুঁইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষটার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ঘাট ছেড়ে ওপরের রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল জেটি ধরে----
ফোনটা বেজে উঠল আবার। বিকেল থেকে কতবার বেজে গিয়েছে। ধরবার সাহস হয় নি সমাদৃতার। ওখানে বিল্টু রয়েছে। তাকে একেবারে শেষমুহূর্ত অবধি প্রাণে ধরে কিছু বলতে পারবে না সে। বড় একা ঠেকছিল তার। সবাই তাকে কমপ্রোমাইজ করতেই বলেছে। বাবা, মা, উত্তম এমনকি, শোভন অবধি—বড়ো হয়ে তার ছেলে বিল্টুও হয়ত তার কাছে এই একই কৈফিয়ত চাইবে এসে—‘কেন তুমি আমার জীবনটাকে অসম্পূর্ণ করে দিলে? বলো? তোমার সততার অভিমানের দাম কি আমার চেয়েও—তোমার একমাত্র ছেলেটার চেয়েও বেশি ছিল?’
গাড়ি ছুটছে শীতের ফাঁকা পথ বেয়ে দক্ষিণ কলকাতার দিকে। সার্কাস অ্যাভেন্যুতে পড়ে হাতের পাশে একটা বড়ো খেলনার দোকান দেখে সেখানে নেমে সমাদৃতা কয়েকটা খেলনা কিনে নিলো সঙ্গে। বিল্টু অনেকদিন ধরে একটা বড়ো রেডিও কন্ট্রোলড গাড়ি চেয়ে রেখেছিল। সুরভির জন্য একটা নরম পুতুল। দাম মেটাবার পর গাড়িতে ফিরে এসে বসে হাতের মোবাইলটাতে একটা ছোট মেসেজ টাইপ করে শোভনকে পাঠিয়ে দিল সে। বাড়ি এগিয়ে আসছে। একটা সত্যকে ঢাকতে অনেক মিথ্যের আশ্রয় নিতে হবে এইবার তাকে। নিজের সন্তানের কাছেও—
কি মনে হতে পার্সের মধ্যে থেকে বের করে বাসের টিকিটদুটো আরো একবার দেখে নিলো সে। সকাল সাড়ে সাতটায় ধর্মতলায় রিপোর্টিং। গিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে আজ। বড় ক্লান্ত লাগছিল সমাদৃতার।
ফোনটা আবার বেজে উঠল। ফরিদার ফোন। মিসড কলের তালিকায় ফরিদার নামটার পাশে দেখাচ্ছিল, এই নিয়ে পাঁচবার--
“ফোন ধরছে না কেন বলোতো?”
ফরিদা আরো একবার সমাদৃতার সঙ্গে যোগাযোগ করবার ব্যর্থ চেষ্টা করে ফোনটা পাশে সরিয়ে রাখল। ওঘরে শোভন আর হর বাউল বাচ্চাদের নিয়ে খেলায় মেতেছে। তাদের হইহই-এর শব্দ ভেসে আসছিল বারান্দাতে। অন্তাক্ষরী খেলা হচ্ছে। প্রৌঢ় গায়কটি তাঁর গানের ঝাঁপি খুলে বসে নিজেও শিশু হয়ে গিয়েছেন যেন তাঁর অন্য সঙ্গীদের সাথে।
“ব্যস্ত রয়েছে বোধ হয়। ভেবো না। সঙ্গে গাড়ি রয়েছে। চিন্তার কিছু নেই।”
ফরিদা অন্যমনস্ককভাবে মাথা নাড়লো, “মানে, রাত প্রায় ন’টা বাজল। কোনো খবরটবর নেই—”
“উত্তমবাবুকে একবার ফোন করে দেখবে?”
“করেছিলাম। নো রেসপন্স।”
“একসঙ্গে কোথাও যায়নি তো কোর্টের কাজের পরে? মানে কোর্ট এসব ক্ষেত্রে অনেকসময় নাকি দুজনকে একসঙ্গে সময়টময় কাটাতে বলে শুনেছি। ওতে অনেকসময়—” মার্গারেটের গলায় আশার সুর ছিল।
“বোধ হয় তা নয়,” শোভন কখন যেন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তাদের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা ঘুরে তাকাতে হাতের ফোনটা দেখিয়ে বলল, “সমাদৃতা ফিরছে আর দশ মিনিটের মধ্যে। একটা মেসেজ পাঠালো এইমাত্র।”
“কী লিখেছে?”
“লিখেছে বাড়িতে ঢুকছে, কিন্তু আমরা যেন ওই নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা না করি বাচ্চাদের সামনে।”
ফরিদা কোনো উত্তর দিল না। বিল্টু হঠাৎ গান ফেলে বাইরে বের হয়ে এসে উদ্বিগ্ন মুখে তাদের মুখের দিকে দেখছিল বারবার। তার ছোট জীবনে এতক্ষণ একটানা মায়ের সঙ্গে কথা না বলে সে থাকেনি কখনো। হঠাৎ ফরিদার কাছে এগিয়ে এসে তার হাতটা ধরে বলল, মামি, মা—”
“আসছে সোনা। মেসেজ করেছে। এসে পড়লো বলে এইবারে—”
কথা বলতে বলতেই বাইরে গাড়ির শব্দ উঠতে ফরিদার হাত ছাড়িয়ে বিল্টু বাইরে ছুটে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই ফের সুরভিকে ডাকতে ডাকতে ফের ঘরের ভেতর ঢুকে এলো সে, “সুরভি দেখবি আয়, মা কী নিয়ে এসেছে—দারুণ সারপ্রাইজ--সুরভি—”
তার পেছন পেছন সমাদৃতা ঘরের ভেতর ঢুকে এসে হাতের জিনিসপত্রগুলো নামিয়ে রেখে একটা চেয়ারে বসল। ফরিদা এগিয়ে এসে তার হাতটা ধরেছিলো। ঠাণ্ডা, ভিজে ওঠা হাতটাকে তার উষ্ণ মুঠির থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে মুখে হাসিটা ধরে রেখে সমাদৃতা বলল, “উঃ, সারাদিন যা গেল! খিদে পেয়ে গেছে। খেতে দেবে না?”
মার্গারেট ততক্ষণে উঠে গিয়ে খাবারের আয়োজন করতে লেগে গেছে। পাশের ঘরে মেঝের ওপর থালা সাজাতে সাজাতেই সে সসংকোচে বলল, “আজ একটু ডিম করলাম সমাদৃতা। কাল রাতে ভালো মাছ খাওয়াবো দেখো—”
সমাদৃতা মৃদু হাসল, “মাছ খাওয়াটা তবে তোমার কাছে আমার বাকি রেখে দিলাম মার্গারেট। কাল সকালের বাসে আমি বিল্টুকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছি।”
বিল্টু হঠাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে চিৎকার করতে শুরু করে দিল, “না মা আমি যাবো না। শোভনমামা কাল আমাদের দুজনকে নিয়ে চিড়িয়াখানায়--”
“বিল্টু, জেদ কোরো না। কাল আমাদের ফিরে যেতে হবে বাবা। জরুরি কাজ পড়ে আছে ওখানে—”
“কী এত তোর জরুরি কাজ পড়ল যে কালকেই ছেলেটাকে নিয়ে—” বলতে বলতেই শোভন সমাদৃতার চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। সে দৃষ্টিতে এক গভীর বিষণ্ণতা মাখানো মিনতির ছাপ ছিল। ফরিদা উঠে এসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। শোভন ইশারায় তাকে মানা করে দিল।
ঘুম আসছিল না সমাদৃতার। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছে। ঘরের ভেতর গুমোট ঠেকছিলো। বিল্টু তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঘুমোবার চেষ্টা করে শেষে সন্তর্পণে তার হাত ছাড়িয়ে উঠে বারান্দায় এসে বসলো সমাদৃতা। চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়েছে। এ জায়গাটায় কেমন একটু গঞ্জ গঞ্জ ছাপ রয়ে গেছে এখনও। খানিক দূরে নির্জন রাস্তায় হলুদ আলো জ্বালিয়ে জেগে আছে শহরের রাত। তার আলো পড়েছে সারসার দোকানগুলোর বন্ধ ঝাঁপের ওপর। দুচোখের পাতা জুড়ে আসছিল তার। কিন্তু প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই বারবার সেই ফাইলটার কাগজগুলো চোখের ওপর ভেসে আসে তার—আর তারপর সে ছবিকে ছাপিয়ে, বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে দিয়ে ভেসে উঠছিল বিল্টুর মুখটা। নাড়ি ছিঁড়ে, বড়ো আনন্দময় এক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তাকে পৃথিবীতে এনেছিল একদিন। আজ এই দ্বিতীয়বার নাড়ি ছেঁড়বার সময় যন্ত্রণাটাই রয়ে গেছে, আনন্দটা আর নেই।
“কী হয়েছে এবার আমায় একটু বলবি মাদ্রি?”
পেছনে এসে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে ঘুরে তাকালো না সমাদৃতা। শুধু তার বাড়িয়ে দেয়া হাতটাকে দুহাতের মধ্যে প্রাণপণে চেপে ধরল একবার।
“এ—এ আমি ভাবতে পারিনি রে! ও যে এইভাবে আমার কাছ থেকে ছেলেটাকে কেড়ে নিয়ে যাবে, এতোটা বিলো দা বেল্ট ঘা দেবে—তুই ধারণাও করতে পারবি না রে--বিল্টুটাকে আমি আর নিজের কাছে—”
“কী করেছে উত্তম। তুই আমায় বল—আর কিছু না হোক, একটু হালকা তো হতে পারবি--”
তার হাতটাকে প্রাণপণে চেপে ধরে তাতে মুখটা গুঁজে দিল সমাদৃতা। কান্নার অভিঘাতে কেঁপে কেঁপে উঠছিল তার গোটা শরীর—“সে আমি তোকে মুখ ফুটে বলতে পারবো না রে—বড়ো লজ্জার কথা শোভন--আমি—আমি-”
তার মাথার ওপরে তার বন্ধুর অন্য হাতটা বড়ো গভীর মমতায় বিলি কেটে দেয়। রাত বয়ে চলে নিজের গতিতে। মানুষদুটির মধ্যে কোনো কথার বিনিময় ঘটে না। কোনো কথার প্রয়োজন নেই আর। পাশে মেঝের ওপর মশারির ভেতর হর বাউলের নাক ডাকবার শব্দ আসছিল। জীবনকে অন্য পথে তৈরি করেছে সে। রাতে ঘুমের কোন সমস্যা হয় না হর বাউলের।
“শুয়ে পড় গিয়ে শোভন। আমি হেরে গেছি। একেবারে গোহারান হেরে গেছি মানুষটার কাছে। এবারে তোর লড়াইটা আসছে। আমাকে দ্যাখ। মনে করে রাখ। তুই যেন আমার মত এমন করে হেরে যাস না। তাহলে আমার জীবনের ওপরে যেটুকু বিশ্বাস এখনো বাকি রয়ে গেছে সেটুকুও আর থাকবে না রে।”
“হারজিত জানিনা মাদ্রি। শকুনের পাল হামলে পড়েছে এইটুকুই দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে। কিচ্ছু থাকবে না রে। এখানে সবকিছু বিক্রি হয়ে যায়। গতকাল যেটুকু দেখে এলাম তার পর আর কোন আশা করতে আমি ভয় পাচ্ছি। তবে এখনো হাল ছাড়িনি আমি। কিন্তু—যদি শেষ অবধি না পারি—তাহলে—”
অন্ধকারের ভেতর জ্বলজ্বলে চোখদুটো তার দিকে তুলে ধরে সমাদৃতা জিজ্ঞাসা করল, “তাহলে—কী?”
“ফরিদা আর বাচ্চাদুটোকে নিয়ে আরো একবার নতুন করে শুরু করতে চাই। নতুন কোনো জমিতে—নতুন ভাবে—আচ্ছা, এটাকে কি তুই হেরে যাওয়া বলবি? বল? অন্তত আত্মাটাকে বিক্রি করে দেবার এগেন্সটে লড়বার এটাওতো একটা স্ট্র্যাটেজি?”
একটুক্ষণ চুপ করে থাকলো সমাদৃতা। তারপর ক্লান্ত গলায় বলল, “তোর লড়াইতে তুই হারলি না জিতলি সে প্রশ্নের উত্তর তো শুধু তুই দিতে পারবি শোভন। আমি তার উত্তর দেবো কোথা থেকে? তবে একটা কথা কী জানিস? ইরশাদ ফকিরের বর্ষীর সেই রাতে আমি তোকে তোর নিজের পথে চলবার জন্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে—তোকে শোভন—তোকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম। শুধু তুই নিজের মিশনটাকে নিয়ে আনন্দে থাকবি বলে। আজ তোকে একটা সত্যি কথা বলে যাই। তুই আনন্দে আছিস, যে মিশনটার জন্যে আমি এতবড়ো একটা স্যাক্রিফাইস করলাম, সেটাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছিস, এইটেই এতগুলো বছর ধরে জীবনের হাতে মার খেতেখেতেও নিশ্চিন্তে জীবনটাকে বইবার একটা প্রধান পাথেয় ছিলো আমার। এবারে সেটাও যাবে আমি বেশ বুঝতে পারছি। এনি হাউ, যাই করিস, সুখে থাকিস। যে মেয়েটাকে সঙ্গী করেছিস তার যেন আমার মত কপাল কখনো না হয়।”
বলতে বলতে মাথার ওপর থেকে তার হাতটা সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সমাদৃতা, “আমি যাই।”
“আর তুই?”
“ওই যে বললাম, গোহারা হেরে গেছি। সেকথা আমি একেবারে নির্লজ্জ হয়ে স্বীকার করে বলে দিয়ে যাবো দুনিয়াকে। আজ কোর্টরুমে তার সূচনাটা করে দিয়ে এসেছি। আমার ছেলেটাকে আমায় নিজে হাতে তুলে দিতে বাধ্য করল--কেন এমন হলো শোভন? কেন--”
কথাটি শেষ না করেই ধীরে ধীরে সে তার ঘরের ভেজানো দরজার দিকে এগিয়ে গেল। নিঃশব্দ রাত্রে বারান্দায় চলতে থাকা কথোপকথনটুকুর টুকরো টাকরা শুনতে শুনতে উৎকর্ণ হয়ে থাকা ফরিদা তার সদ্যোজাত শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে পাথরের মত তাকিয়ে ছিলো ঘরের নিরন্ধ্র অন্ধকারের দিকে। একটা অজানা আশংকা কালো ছায়া ফেলছিল তার বুকে। পত্নীসুলভ বা প্রেমিকাসুলভ ঈর্ষা নয় আর। এক একান্তই আশ্চর্য ও নারীসুলভ স্বার্থপরতার আক্রমণে তখন তার মাথা থেকে অন্য নারীটির ট্র্যাজেডির, অথবা খানিকক্ষণ ধরে বারান্দায় চলতে থাকা ওই কথোপকথনের সমস্ত শব্দ ও দৃশ্য মুছে গিয়ে ভেসে আছে তার নিজের শিশুদুটির এবং তার স্বামীর মুখটি।
|| ২৩ ||
রায় বেরোবার পর আরো কয়েকটা দিন মার্গারেটের ওখানেই কাটিয়ে যেতে হল শোভনদের। আদালতের নির্দেশের পর একটা সরকারী ইনভেস্টিগেশন কমিটি তৈরি করা হয়েছিলো তড়িঘড়ি করে। সেখানে বেশ কয়েকটা হাজিরা দেবার পর ছাড়া মিলল। সন্ধের ট্রেন ধরেছিলো তারা শেয়ালদা থেকে। পথে অনেকটা লেট করে শান্তিহাট পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় রাত দশটা বাজল। সমরেশকে শুধু খবরটা আগে থেকে জানিয়ে একটাই অনুরোধ রেখেছিলো শোভন। তার আসার খবরটা যেন এই মুহূর্তে চাউর না হয়।
শান্তিহাট হল্টে গাড়ি ঠিক এক মিনিট দাঁড়ায়। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসে লোকজনভরা প্ল্যাটফর্মে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দূরে সমরেশকে দেখা গেল। এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করতে থাকা যাত্রীদের মধ্যে তার চোখদুটো শোভনদের খুঁজছিল। এইবারে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি কাছে এসে নিচু হয়ে শোভনের পায়ে একটা প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে ফরিদাকে বলল, “ভালো আছো ফরিদাদি? দেখি দেখি পুঁচকেটাকে দেখি একবার—উরিব্বাস, এ তো শোভনদার মুখ একেবারে কেটে বসানো গো! কী নাম রাখলে ওর ফরিদাদি?”
“কবীর। এখন যাবো কীকরে তাই বলো। লাস্ট বাস তো বোধ হয়—”
ফরিদার উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল সমরেশ। তারপর বলল, “সে নিয়ে আপনি ভাববেন না ফরিদাদি। হেমলতার প্রিন্সিপ্যাল কাম কেজরিওয়ালের এডুকেশন প্রজেক্টের লোকাল অ্যাকাডেমিক ডিরেক্টরের ট্রান্সপোর্টের অভাব হবে না। শ্যামলবাবু আপনাদের আসবার খবর পেয়ে সব বন্দোবস্ত করে রেখেছেন।”
“সমরেশ, তোকে যে মানা করেছিলাম কাউকে—”
সমরেশ তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলল, “না না আমি কেন বলতে যাবো? উত্তমদাই তো খবরটা দিয়েছেন শ্যামলবাবুকে। দিয়ে বলে দিয়েছেন তোমার কোনরকম অস্বাচ্ছন্দ্য যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে আর তোমাকে গোটা প্রজেক্টটা ভালো করে বুঝিয়ে দিতে।”
“উত্তম? কিন্তু গতকাল থেকেই তো ওর সঙ্গে--”
“হ্যাঁ গো। উনি কারো ফোনই রিসিভ করছেন না কাল থেকে। বাইরে গেছেন কয়েকদিনের জন্য। আজ দুপুরবেলা শ্যামলবাবুর কাছে ফোন এলো তোমার আসবার খবর দিয়ে। পার্টি অফিস থেকে বলা ছিলো তুমি এলেই যেন দেরি না করে সেখানে খবর দেয়া হয়। শ্যামলবাবু সেখানে ফোন করে বলতে যাচ্ছিলেন, তখন তোমার ফোনটা এলো আমার কাছে। আমি ওঁকে এখন কাউকে বলতে মানা করে দিয়েছি। এখন চলো—”
দুটি অপরিচিত ছেলে এসে তাদের মালপত্রগুলো তুলে নিয়ে আগে আগে চলতে শুরু করেছে ততক্ষণে। কবীর আর সুরভিকে নিয়ে ফরিদা এগিয়ে গেছে তাদের সঙ্গে। পেছন পেছন সমরেশের সঙ্গে চলতে চলতে শোভন খানিকটা অবাক হয়েই বলল, “কিন্তু আমরা কখন আসছি সে কথা উত্তম কলকাতার বাইরে থেকে—”
“সে উত্তমদা পেয়ে গেছেন ঠিক শোভনদা। কী করে জানি না, কিন্তু ভদ্রলোকের আশ্চর্য নেটওয়ার্ক। আমাদের মুরলীপুরের অনেক ঘটনার ব্যাপারেও অনেকসময় ইভন আমরা জানবার আগে উনি দেখি আপডেটেড হয়ে গিয়েছেন। সাধে এতবড় পদে উঠেছেন!” সমরেশের গলায় মানুষটির ব্যাপারে প্রশংসা প্রচ্ছন্ন থাকছিল না।
স্টেশনের বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। তাতে উঠে বসতে বসতেই একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল শোভনের কাছে। অপরিচিত একটি পুরুষকন্ঠ বলল, “আমার নাম শ্রী শ্যামল কর্মকার স্যার। নিজে এসে আপনাকে রিসিভ করতে পারলাম না বলে কিছু মনে করবেন না। সমরেশ আপনাকে এনে আপনার কোয়ার্টারে পৌঁছে দেবে। কাল সকালে যদি একটু টাইম দেন, ধরুন এই সাড়ে আটটা নটা নাগাদ, তাহলে—”
“আমার—কোয়ার্টার—মানে?”
“সে আপনি আপনার বাড়িতে এসে পৌঁছোলেই দেখতে পাবেন স্যার। আচ্ছা তাহলে কাল সকালে—”
“সেটা আমি কাল সকালেই নাহয় ঠিক করবো শ্যামলবাবু। আপনি বরং সকালবেলা আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ আমাকে একবার ফোনে—”
“এই আদেশটা আমাকে করবেন না স্যার প্লিজ,” উল্টোদিকের গলার স্বরে একটা বিগলিত ভাব ফুটে উঠছিল, “আমাদের অর্গানাইজেশান আসলে এইসব টাইম এটসেটেরার ব্যাপারে খুব পার্টিকুলার। আর মিস্টার প্রধানের এক্সপ্রেস অর্ডার আছে কাল সকালে আপনাকে ব্রিফ করবার। বেলা দশটা নাগাদ ওঁকে একটা রিপোর্ট মেল করতে হবে আমাকে এ বিষয়ে। না হলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে স্যার। প্লিজ।”
শোভন কথা না বাড়িয়ে ফোনটা নামিয়ে রাখল। সমরেশ দেখা গেল ব্যাপারটা জানে। ফোনটা শেষ হতে বলে, “তুমি শুধু একবার ওঁর কাছে গোটা প্রজেক্টটার ব্যাপারে শুনে দ্যাখো শোভনদা, এরকম ব্রিলিয়ান্ট প্ল্যান—ভাবতে পারবে না। আমাদের হেমলতার গোটা টিমটাকে আর তার সঙ্গে আরো অনেক নতুন হ্যান্ডস রিক্রুট করে সবাইকে নিয়ে একটা অসাধারণ পরিকল্পনা তৈরি করেছেন উত্তমদা আর শ্যামলবাবু মিলে। এমনকি, যাতে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারি সেজন্য আমি, সুবিমল, অনুপম, সুবীর, আনসার মিলে আমাদের মোট দশজন, যারা ইশকুলের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম, তাদের প্রত্যেককে কেজরিওয়ালের তরফে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে রীতিমত মাইনে দিচ্ছেন গত কয়েকমাস ধরে। এমন করে কে করবে গো? ঠিকঠাক এগোলে এ অঞ্চলে একটা—”
তাকে ইশারায় থামতে বলল শোভন। ঠিক কী করেছে উত্তম এখানে সেটা জানবার জন্য তারও আগ্রহ হচ্ছিল। কিন্তু এ ছেলেটার কাছ থেকে তার কোনো সঠিক জবাব মিলবে না এখন। উত্তমের ব্যাপারে একটা গভীর ভালোলাগা আর সমীহ মিলে তার আর সমস্ত বোধকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এই মুহূর্তে।
কথা বলতে বলতে কখন যে তারা মুরলীপুরের চত্বরে এসে ঢুকে পড়েছে তা শোভনের খেয়াল ছিল না। গোটা এলাকাটা অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। দৃশ্যটা শোভনের অপরিচিত নয়। লোডশেডিং চলছে গোটা চত্বরটা জুড়ে। চমক ভাঙল অন্ধকারের মধ্যে একটা তীব্রোজ্জ্বল আলোর রোশনাই চোখে এসে লাগতে। সমরেশ সেইদিকে ইশারা করে বলল, “এসে গেছি। জেনারেটার চালিয়ে রেখেছে তাহলে। গুড।”
গলির মুখটাতে ইশকুলের পুরোনো বোর্ডটা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেখানে চওড়া গ্রিলের গেট বসানো হয়েছে। তার মাথায় উজ্জ্বল সাইনবোর্ড ঘোষণা করছিল “হেমলতা বিদ্যামন্দির”। তার তলায় অন্য রঙের একসার উজ্জ্বল অক্ষর জানাচ্ছিল এটি কেজরিওয়াল এডুকেশন প্রজেক্ট, নদীয়া চ্যাপ্টারের প্রধান দফতরও বটে।
গাড়িটা তার মধ্যে দিয়ে ভেতরে ঢুকে এল সটান। তারপর তার বাড়ির উঠোনের ওপর পাতা ইটবাঁধানো একটা লম্বা পথ বেয়ে সরাসরি এসে তার ঘরটা যেখানে ছিল সেইখানে দাঁড়ালো। পুরোনো ঘরটাকে রদবদল করে একেবারে নতুন চেহারা দেয়া হয়েছে। জেনসেটের উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক প্রভায় সাদা রঙ করা দু কামরার বাড়িটা তার দিকে চেয়ে হাসছিল যেন।
গাড়ির শব্দ পেয়ে ঘর থেকে একজন বয়স্ক মানুষ বের হয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গাড়ি থামতে শোভনের দিকে ফিরে একটা নমস্কার করে বললেন, “আপনার কোয়ার্টার স্যার। মালপত্র তুলে দিচ্ছি। আপনারা নিশ্চিন্তে আরাম করুন। একটু পরে খাবার দেবো।”
“আপনি—”
“আমি বলরাম আদক স্যার, আপনার অ্যাটেনডেন্ট।”
সুরভি অবাক হয়ে বাড়িটার দিকে দেখছিল। ফরিদার পেছনে লুকিয়ে পড়ে তার হাতটা চেপে ধরে সে বলে, “ও মা, এটা আমাদের বাড়ি? আমরা এইখানে থাকবো?”