• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৪ | জুন ২০১৩ | উপন্যাস
    Share
  • যাত্রীঃ তৃতীয় পর্ব (৩) : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ (শেষ)





    || ৬ ||

    “অ্যাজেন্ডার সাত নম্বর আলোচ্য বিষয় এন আর এম স্কিম-এর কাজকর্মের পর্যালোচনা। বিরামনগর ব্লকের--”

    “দূর মশাই। আপনি দেখছি মহা বেরসিক মানুষ!” অমরেশবাবু চায়ের কাপের ওপাশ থেকে হাসছিলেন, “সমিতির অফিসে মিটিঙে এলেন, যা যৎসামান্য খাতিরদারির চেষ্টা করলাম, সেদিকে নজর না দিয়ে এই কাঠফাটা গরমে শুধু কাজই করে যাচ্ছেন লাস্ট থ্রি আওয়ার্স ধরে। অন্তত চা’টায় চুমুক তো দিয়ে দেখবেন একবার! খাঁটি দার্জিলিং চা মশাই। মকাইবাড়ির। যা ফ্লেভার— ”

    “হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়, নিশ্চয়। সরি-,” বলতে বলতে ফাইলের থেকে মুখ তুলে সোজা হয়ে বসল ব্রতীন। সামনে বড়ো একটা প্লেটে কিছু আম আর লিচু সুন্দর করে কেটে সাজানো। সেদিকে নজর না দিয়ে পাশে ধূমায়িত চায়ের কাপটাকে কাছে টেনে নিল সে।

    “একটা কথা অমরেশবাবু, এন আর এম স্কিমের জব কার্ড বিলি করা নিয়ে একটা কমপ্লেন এসেছিল আমার অফিসে, মুরলীপুর জিপি থেকে। সে ব্যাপারটা একটু কথা বলে নিতে চাই। সুবল, তোমার কাছে এন আর এম স্কিম নিয়ে যে চিঠিটা এসেছিলো তার ফাইলটা একটু বের করবে তো! ”

    অমরেশ ভুরু কুঁচকোলেন, “কমপ্লেন? মুরলীপুর জিপি নিয়ে?” বলতে বলতে ডাইনে মুখ ঘুরিয়ে খানিক দূরে বসা মহিলাটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, “ব্যাপার কী দিদি? আপনার মত একজন প্রধান থাকতে সেই জিপিতে কমপ্লেন হয় কী করে?”

    ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশের কোঠায়। জনসমক্ষে কথাবার্তায় এখনও ততটা সচ্ছন্দ নন। মাথার ঘোমটাটা একটু টেনে দিয়ে বললেন, “সবই তো বোঝেন। আপনাদের জামায়ের তো এ তল্লাটে শত্রুর অভাব নাই। কে এসে কী লাগায়ে গেছে! ঘরশত্তুর বিভীষণ হইয়েছে সব--”

    “আমারও তাই মনে হচ্ছে বুঝলেন ব্রতীনবাবু! স্বাধীন দাস আমাদের পার্টির জনপ্রিয় নেতা। এ অঞ্চলে বিশ বছর ধরে জনসেবা করছেন। নিজের কারবারের পয়সা লাগিয়েও কতবার এলাকার কত কাজ তুলে দিয়েছেন। লোকে দেবতার মত মান্যগণ্য করে। তাঁর স্ত্রী পঞ্চায়েত প্রধান, স্বাধীনদা নিজে বর্তমানে জেলাস্তরে এতবড় একটা নাম, সেখানে সত্যিকারের কোন অভিযোগ থাকলে লোকে তো তাঁদের আগে বলবে! বাইরের লোকের কাছে কমপ্লেন দিতে যাবে কেন? কিছু একটা চুকলির ব্যাপার আছে এতে। ও যে বলে না, ডাল মে কুছ—”

    “-কালা হ্যায়,” ব্রতীন পাদপূরণ করল। তারপর একটু হেসে বলল, “সে তো আছেই অমরেশবাবু, সে কালাটাকেই তো খুঁজে বের করতে চাইছি। এই যে--”

    “আরে ছাড়েন তো মশায়। বড় কাজ চলছে। এলাকার মানুষের উন্নতি হচ্ছে। এর মধ্যে কে এসে চুকলি খেল তার নিয়ে এত মাথা খারাপ না করে কাজটা ভালো করে করা যাক। এই যে সুকেশবাবু, ইন্সপেকশন রিপোর্টের একটা ড্রাফট তো বানিয়ে এনেছেন, না কী? ”

    গ্রাম-রোজগার সহায়ক ভদ্রলোক নিঃশব্দে উঠে এসে ফাইলটা অমরেশবাবুর হাতে দিলেন। সেটা খুলে একটু উল্টেপাল্টে দেখে নিয়ে মাথা নাড়লেন অমরেশ বাগচি। তারপর শেষ পাতাটা খুলে ব্রতীনের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, “নিন, সব ঠিকঠাকই আছে। আমি দেখে দিয়েছি। সই করে দেন একটা, তাহলেই কাজ শেষ। খাওয়াদাওয়া সব জুড়িয়ে গেল ওদিকে—”

    ব্রতীন ফাইলটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে একটু দেখল। তারপর তার একটা জায়গা সুবলের এনে দেয়া কমপ্লেন ফাইলটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে, পাশে বসা অডিট অ্যাকাউন্টস অফিসারের দিকে ঘুরে বলল, “কমপ্লেনের সঙ্গে এই রিপোর্টের জবকার্ড অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশনের কলামটা একবার একটু মিলিয়ে দেখুন তো অধীরবাবু!”

    অমরেশের ভুরুদুটো কুঁচকে উঠে গিঁট পাকাচ্ছিল আস্তে আস্তে। নিচু গলায় ফের একবার বললেন, “আমি বলছি সব ঠিক আছে তাতে আপনার ভরসা হল না?”

    ব্রতীন এবার একটু শক্ত হল, “না অমরেশবাবু। প্রশ্নটা ভরসা হবার বা না হবার নয়। আমার ইন্সপেকশান রিপোর্ট আমি নিজেই যা দেবার দেবো। সেটাই উচিৎ। আপনাদের তৈরি করা রিপোর্টের খসড়াটা আমার কাজে আসবে বেস ডেটা হিসেবে। তার বেশি কিছু নয়। আর সর্বোপরি, এই খসড়া রিপোর্টটা যেহেতু আপনারাই বানিয়ে এনেছেন সেক্ষেত্রে আমি ধরে নিতে পারি ওটা আপনার অফিশিয়াল স্টেটমেন্ট,তাইতো? ওটাকে আমি আমার রিপোর্টের অ্যানেক্সার হিসেবে দিয়ে দেবো পঞ্চায়েত সমিতির তরফ থেকে তৈরি করা ডেটাশিট হিসেবে।”

    ধুরন্ধর রাজনীতিবিদটি টের পাচ্ছিলেন কোথাও কিছু একটা ফাঁদ পাতা হচ্ছে তাঁকে ঘিরে। স্থির চোখে ব্রতীনের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “আমি তো মশায় থাকি কলকাতাতেই বেশি। ওসব রিপোর্ট-টিপোর্ট সুকেশবাবুর এলাকা। ভুলত্রুটি কিছু থাকলে সেসব-- ”

    “সে একটু তো আছে বলেই মনে হচ্ছে অমরেশবাবু,” অধীরবাবু ফাইলের থেকে চোখ না তুলেই বললেন, “কমপ্লেন ছিল, মুরলীপুর জিপিতে টোটাল হাউজহোল্ডের থেকে জবকার্ড বিলি হয়েছে বেশি। আপনার রিপোর্টেও দেখছি তাই। এই যে--টেবিল বি-তে দেখুন—টোটাল হাউজহোল্ড রয়েছে ঊনতিরিশ শো আটচল্লিশ আর এন আর এম স্কিমের জন্য রেজিস্ট্রেশন হয়েছে একতিরিশ শো আটচল্লিশটা হাউজহোল্ড। জবকার্ডও ইস্যু হয়েছে ওই একতিরিশ শো আটচল্লিশটাই। দুশো এক্সট্রা ভূতুড়ে জব কার্ড মানে, বছরে পার কার্ড নব্বই দিন কাজ ধরলে একশো ছত্রিশ টাকা পার কার্ড পার ডে হিসেবে মিনিমাম ওয়েজে কতো টাকা হয় বলুন তো?”

    “ইমপসিবল। সুকেশবাবু--”

    সুকেশবাবু ফ্যাকাশে মুখে তাড়াতাড়ি উঠে এসে অধীর সেনের পেছনে দাঁড়িয়ে ফাইলের ভেতর উঁকি দিতে দিতে বললেন, “টাইপোগ্রাফিক্যাল কোন গন্ডগোল হয়ে গিয়ে থাকবে হয়তো। আজকাল এইসব ভি এল ই-র ছেলেগুলোর কাজ এত জঘন্য হয়েছে! কম্পিউটারের মাথামুন্ডু কিছু বোঝে না, ওদিকে সব টাইপিং-এর কাজকর্ম ওদের দিয়েই করাতেও হয়! আমরা যে কী অবস্থায় কাজ করি-- ”

    অধীর বোস নিঃশব্দে খসড়া রিপোর্টটার পাতা উলটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ একজায়গায় থেমে গিয়ে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, “উঁহু, ভুল কিছু হয়নি সুকেশবাবু। এই যে, এইখানে দেখুন, চারটে পোস্ট অফিসে জবকার্ড হোল্ডারদের অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে একতিরিশশো আটচল্লিশটাই। এবারে তাতে টাকার হিসেবটা একবার--”

    ব্রতীন অমরেশের দিকে ফিরে তাকালো, “অমরেশবাবু?”

    অমরেশ গম্ভীর হয়ে সুকেশবাবুর দিকে ফিরে চাইলেন, “ব্যাপারটা একটু ভেঙে বলুন তো?”

    সুকেশ গুপ্তর মুখটা লাল হয়ে উঠছিলো। কোনঠাসা একটা প্রাণীর মতই নখদাঁত বের হয়ে আসছিল তাঁর এইবারে। হঠাৎ গলা উঁচিয়ে বললেন, “আমি তখনই আপনাকে বলেছিলাম স্যার--”

    অমরেশের গাম্ভীর্যের মুখোশটা একমুহূর্তের জন্য খসে পড়লো। সুকেশের দিকে তাকিয়ে হিসহিস করে বললেন, “বাজে কথা বলবেন না সুকেশবাবু। আমায় আবার আপনি কখন কী বললেন?”

    সমিতি অফিসের জানালা দিয়ে বেশ কিছু কৌতুহলী মুখ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল ভেতরে উত্তেজিত গলার আওয়াজ শুনে। তাদের মধ্যে থেকে একটা খসখসে অসংস্কৃত গলা হঠাৎ বলে উঠল, “ভেতরে আসবো নাকি অমরেশদা? কোন ঝামেলা হয়েছে? হলে বলুন, আমরা আছি।”

    সেদিকে তাকিয়ে অমরেশ ঠান্ডা গলায় বললেন, “না। তোরা যা। পার্টি অফিসে ওয়েট কর। আমি একটু বাদে আসছি।” তারপর ব্রতীনের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, “অনেকদিন ধরেই আপনার আচরণ দেখেশুনে একটা কথা আমার মাথায় ঘুরছে বিডিওসাহেব। আজ সেটা না বলে পারছি না। এ কেসটায় কী ঘটেছে তার ব্যাখ্যা কিছু একটা আছে নিশ্চয়। মাথা ঠান্ডা করে দেখলে সেটা বেরিয়ে যাবে। গোণাগুণতিতে গন্ডগোল হয়। গাঁ-ঘরে এক বাড়ি ভেঙে হামেশা তিনচার হাঁড়ি হয়ে যায়। তাতে জবকার্ডের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া কঠিন কিছু নয়। সেসব হিসেব-কিতেব আমি সব ঠিক করে দেবো। ভাববেন না। ওই করে করে তো হাড় পেকে গেল। কিন্তু আপনার অ্যাটিচুড দেখে মনে হচ্ছে আপনি আগে থেকেই আমার পার্টিকে সন্দেহটা করেই বসে আছেন। যেভাবে গোটা ব্যাপারটা খতিয়ে না দেখেই একটা কমপ্লেনের বেসিসে হল্লা তুলে দিলেন মিটিং-এ তাতে আপনার রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিয়েই তো আমার সন্দেহ হচ্ছে। জনতা কিন্তু এভাবে জনপ্রিয় নেতাদের অপমান করার চেষ্টা মাথা নিচু করে মেনে নেবে না। বাইরে লোকজনের মুডটা দেখলেন তো?”

    ব্রতীন খুব দ্রুত চিন্তা করছিল। কমপ্লেনটা সে আগেই দেখেছে। জবকার্ড নিয়ে এ গন্ডগোল প্রায় সব জায়গাতেই হয়ে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের টাকা। খানিকটা তার হরির লুট হবেই। তাকে পুরোপুরি আটকানো তাদের সাধ্যের বাইরে। ব্যাপারটা নিয়ে মিটিং-এ অমরেশবাবুকে একটু দাবড়ে দেয়া ছাড়া আর কিছু করবার উদ্দেশ্যও তার ছিল না। কিন্তু মধ্যে থেকে ব্যাপারটা যে এইরকমভাবে গরম হয়ে উঠবে সেটা সে ভাবে নি। জল এখন অনেকদূর গড়াবে বোঝা যাচ্ছে। অমরেশবাবুর হাত নেহাত কম লম্বা নয়। তবে তার পক্ষেও সরাসরি পিছিয়ে আসা সম্ভব হবে না আর এই অবস্থায়। মানসম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। খানিক চুপ করে থেকে সে বলল, “অমরেশবাবু, আমি সরকারি চাকর। আমার কাজ আমায় করতেই হবে সে তো বুঝতেই পারছেন। সমিতির এগজিকিউটিভ অফিসার হিসেবে ব্যাপারটা জেলাস্তরে রিপোর্ট আমায় করতে হবে। তাঁরা যা ভালো বুঝবেন করবেন। সামান্য এনকোয়ারি হবে একটা। সেখানে আপনি যদি কাগজপত্র দিয়ে হিসেবটা ঠিক দেখিয়ে দিতে পারেন তাতে আমার কিছু বলবার থাকবে না।”

    তার গলায় সন্ধির সুরটা ধরে নিতে অমরেশের ভুল হল না। পাকা সরকারী মাথা। পরোক্ষে জাল কেটে বেরোবার রাস্তাটাও ধরিয়ে দিয়েছে। তবে ওতে উৎপাত কিছুটা হবেই। অপোজিট পার্টির সুবোধ ঘোষ এ নিয়ে হল্লাও বাধাবে। সে’সব ঝামেলার মধ্যে যাওয়াটা আটকানো দরকার। ভেতরে ভেতরে একটা ভয়ানক রাগ গড়ে উঠছিলো তাঁর। কমপ্লেনটা মুরলীপুর গ্রাম থেকেই কেউ একটা করেছে। খুঁজে বের করতে হবে। তবে সেটা পরের ব্যাপার। আগে এই রিপোর্টের ঝামেলাটা মেটানো দরকার। এই বিডিও ছোকরা বাইরে পাবলিকের ভিড় দেখে একটু ঘাবড়েছে। সুযোগটাকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। অমরেশ মাথা নাড়লেন, “উঁহু বিডিও সাহেব। আমার অনুরোধ, রিপোর্টটা আপনি এইমুহূর্তে একটু চেপে রেখে দিন। মাসখানেক সময় নেবো। তার মধ্যে সব হিসেব-কিতেব ঠিকঠাক করে কাগজপত্র বানিয়ে দেবো’খন।”

    ব্রতীন ভাবছিল। গত মাসেই জেলাসদর থেকে চিঠি এসেছে, এন আর এম স্কিম নিয়ে সি এ জির অডিট শুরু হয়ে গেছে। গোটা জেলাতেই এন আর এম স্কিমের ব্লকওয়ারি মূল্যায়ন করবার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। রিপোর্টটা তার মধ্যেই যাওয়া দরকার। এ লোকটার কাগজ তৈরি করবার জন্য রিপোর্ট আটকে রাখলে, মুরলিপুর গ্রাম পঞ্চায়েত যদি তার মধ্যে অডিটের স্যামপ্লিং-এর আওতায় চলে আসে তাহলে তারও মুশকিল কম হবে না। সে ঝুঁকিটা এই লোকটাকে রাগাবার পরিণতির ঝুঁকির থেকে অনেক বেশি। সে মাথা নেড়ে বলল, “সেটা সম্ভব হবে না অমরেশবাবু। আজ বৃহস্পতিবার। কালকে আমার রিপোর্ট পাঠাবার ডেডলাইন। তার মধ্যে যদি কিছু করতে পারেন ভালো, নইলে আমায় আমার কাজ করতে হবে।”

    অমরেশের মুখচোখ লাল হয়ে উঠছিলো। খানিক চুপ করে থেকে বললেন, “ঠিক আছে বিডিও সাহেব। আপনি আপনার কাজ করুন, আমি আমার কাজ করি। তবে, কমপ্লেনটা কে করেছে সেটা জানতে পারি কি?”

    ব্রতীন মাথা নেড়ে বলল, “বেনামি চিঠি। টাইপ করে পাঠিয়েছে। কাজেই হাতের লেখা দেখে বোঝবারও উপায় নেই। এই যে দেখুন! ”

    চিঠিটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ সেটাকে উল্টেপাল্টে দেখে নিয়ে ফেরৎ দিয়ে অমরেশবাবু বিড়বিড় করে বললেন, “কমপিউটার প্রিন্টআউট! পাকা বাংলা। উকিলি ভাষা। ভুলভ্রান্তি একেবারে নেই। শিক্ষিত লোকের হাতের কাজ মনে হচ্ছে।” তারপর হঠাৎ সুবলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “চিঠিটা কি তোমার কাছেই এসেছিলো?”

    সুবল একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলো। নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো সে।

    “হঠাৎ করে তোমার কাছে এল যে বড়? তুমি তো বিডিও অফিসে ক্যাজুয়ালের কাজ করো। কদ্দিন হলো ঢুকেছো?”

    “তিন মাস হোলো স্যার। চিঠিটা ঠিক আমার কাছে আসে নি। কাল দুপুরবেলা শোভনদার কাছে স্কুলে গেছিলাম কমপিউটারের একটা ক্লাশ করাবার জন্য। এ অফিসে ফিরে এসে দেখি চিঠিটা আমার টেবিলে রাখা আছে। ওপরে বিডিও সাহেবের নাম দেখে ওনাকে গিয়ে বললাম। উনি চিঠিটা খুলে একটা ফাইল বানাতে বললেন--”

    “শোভন, মানে সেই গানওলা মাস্টারটা? ত্যাড়া ছোকরা। তার ইশকুলে আবার কমপিউটারও আছে? বেশ বেশ। তুমি ওর কাছে কদ্দিন যাতায়াত করছো?”

    “আ-আমি ওনার ইশকুল থেকেই পড়াশোনা করেছি সার। এ বছর রিপাবলিক ডে’র সময় সল্টলেকের একটা পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিং কয়েকটা পুরনো কমপিউটার বিলি করছিল গ্রামাঞ্চলের কিছু ইশকুলে, তার থেকে দুখানা জোগাড় করে এনে শোভনদা বলল ছেলেমেয়েদের একটা কমপিউটার ক্লাস চালু করতে। তাই গত মাসতিনেক ধরে--”

    “সল্ট লেকের কোন কোম্পানি?”

    সুবল একটু ভেবে নিয়ে বলল, “গিগাট্রন কমপিউটেশন লিমিটেড।”

    “বাঃ। এই তো রহস্য পরিষ্কার হয়ে আসছে। সুবোধ ঘোষ যখন এম এল এ ছিল, তখন ওর এক ছেলেকে ওখানে ম্যানেজিং ডিরেক্টর বানানো হয়েছিল। তাহলে মেশিনদুটো সুবোধ ঘোষই তোমাদের শোভন মণ্ডলকে পাইয়ে দিয়েছে, তাইতো?”

    “না স্যার। গিগাট্রনের বিজ্ঞাপনটা বেরোবার পর সুবোধবাবুর ছেলে অনিমেষদা শোভনদাকে বলেছিলো অ্যাপ্লাই করতে। অনিমেষদা আর শোভনদা ছোটবেলা এক ইশকুলে পড়েছে। অনেকদিনের চেনাজানা। সুবোধবাবু এ ব্যাপারে কিছু --”

    “জানেন না। তাই বলবে তো? সে তো বটেই। সাক্ষাত ধর্মপুত্র কিনা! আচ্ছা আরেকটা কথা। সুবোধ তো ম্যাট্রিক ফেল। ইংরিজি দূরে থাক, বাংলাটাও ভালো করে লিখতে পড়তে জানে না। কিন্তু এই শোভন ছোকরা আর তার সঙ্গে থাকে যে মুসলমান মেয়েটা সে দুটোই তো শুনেছি সুন্দরনগর ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করা পণ্ডিত। ল্যাংগুয়েজ ট্যাংগুয়েজে ভালো দখল। তাই না? ”

    ব্যাপারটা একেবারে অন্য দিকে বাঁক নিচ্ছিল। ব্রতীন তাড়াতাড়ি বলল,“আপনি যা ভাবছেন তা হতে পারে না অমরেশবাবু। শোভন এরকম কিছু-”

    অমরেশের মুখে একটা ধারালো হাসি ফুটে উঠছিলো। ব্রতীনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি কী ভাবছি তা তো কিছুই ভেঙে বলিনি বিডিও সাহেব! আপনি সেটা নিজে থেকেই বুঝে ফেলে বন্ধুর পক্ষে সাফাই গাইতে শুরু করলেন যে বড়? গোপন কিছু জানেটানেন নাকি এ ব্যাপারে?”

    “কী বলতে চাইছেন আপনি অমরেশবাবু?”

    “বলবার আমার বিশেষ কিছু নেই ব্রতীনবাবু। নিজের কানেই তো সব শুনলেন। এর পরেও কি আপনাকে সব ভেঙে বুঝিয়ে বলতে হবে? একজন অজ্ঞাত লোক একটা চিঠি নিয়ে এসে রিসিটে জমা না দিয়ে একজন অনুপস্থিত লোকের টেবিলে সাজিয়ে রেখে চলে গেল। আর সে লোক মাঝদুপুরে অফিসে এসে ঢুকেই পাকা ফলটির মত চিঠিটা পেড়ে নিয়ে আপনার ঘরে দৌড়ে গিয়ে হাজির হল। ব্যাপারটা কতটা বাস্তবসম্মত সেটা আপনিই ভেবে দেখুন। চিঠিটা তো বেনামি। আপনাদের ভিজিল্যান্স ম্যানুয়ালের নিয়ম অনুযায়ী বেনামি হলে তো তার ওপরে কোন অ্যাকশন নেবার বাধ্যবাধকতাও নেই আপনাদের। কিন্তু তার বদলে আপনিও সেই চিঠি নিয়ে, ধর্মযুদ্ধের নামে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির গায়ে কালি ছেটাবার জন্য কোমর বেঁধে লেগে গেলেন।”

    ব্রতীনের কান গরম হয়ে উঠছিলো। এই আকস্মিক আক্রমণের সামনে পড়ে ঠিক কী করা উচিত সেটা তার মাথায় আসছিল না তখন। জয়েন্ট বিডিও মন্মথবাবু বয়স্ক মানুষ। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় বললেন, “আহা অমরেশবাবু, উত্তেজিত হবেন না। বিডিওসাহেব সরকারী প্রতিনিধি, তাঁকে প্রকাশ্য সভায় এইরকম একটা অভিযোগে অভিযুক্ত করা-”



    অমরেশবাবু এইবার গলা চড়ালেন, “সরকারী চাকর আপনি হতে পারেন মন্মথবাবু। ওপরওলার হাজার অন্যায় চাকরি বাঁচাবার জন্য আপনি মেনে নিতে বাধ্য। আমার কিন্তু সে দায় নেই। একটা কথা মনে রাখবেন, জনতার ভোটে নির্বাচিত একটা পার্টির বিরুদ্ধে সংগঠিত কোন চক্রান্ত শুরু হলে জনতা তার যোগ্য জবাব দেয়। তেমন প্রয়োজন দেখা দিলে এ ষড়যন্ত্রের শেকড়শুদ্ধু এই এলাকার মানুষ উপড়ে ফেলে দেবে সেকথা আজ বলে যাচ্ছি। সুবোধ ঘোষ আড়ালে থেকে মেঘনাদ হয়ে অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি চালাতে এলে সেই কাঁধগুলো আমি ছেঁটে ফেলে দেবো।”

    এই অবধি বলে ব্রতীনের দিকে ফিরে গলা নরম করে বলেন, “বিডিওসাহেব, আপনি সরকারি লোক। শহরের মানুষ। পেছন থেকে ছুরি চালাবার এইসব উন্নয়নবিরোধী গ্রাম্য পলিটিকস আপনার বোঝবার কথা নয়। আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ, যা হয়েছে হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে আপনি আর থাকবেন না। কমপ্লেনটার কথা ভুলে যান। আমিও কিছু মনে রাখবো না। কথা দিচ্ছি, যেখান থেকে চিঠিটা টাইপ হয়েছে বা যারা এর মুসাবিদা করে দিয়েছে তাদেরও কিছু বলব না।”

    তীব্র একটা রাগ ব্রতীনের ভেতরে পাকিয়ে উঠছিলো। কিন্তু শব্দ হয়ে তা গলা থেকে বের হয়ে আসবার আগেই তার দীর্ঘদিনের সরকারী পদাধিকারের শিক্ষা তাকে আটকে দিলো। ব্যাপারটা এখন শুধু তার ভবিষ্যতের সঙ্গেই জড়িয়ে নেই। একটা বদলি ছাড়া তার তো আর কোন ক্ষতিই হবার নেই এতে। কিন্তু শোভনের অনেক বড় সমস্যা হতে পারে এর থেকে। তাকে গোটা ঘটনাটা না জানিয়ে এ ব্যাপারে হঠাৎ করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া তার পক্ষে ঠিক হবে না। তা ছাড়া অমরেশবাবু যেভাবে গোটা ঘটনাটা সাজিয়ে তুললেন, তাতে তার মনে শোভনের ইশকুল সম্বন্ধে ক্ষীণ একটা সন্দেহের খোঁচাও এসে লাগছিল না যে তা নয়। ব্যাপারটা নিয়ে শোভনের সঙ্গে কথা বলা দরকার। সরাসরি শোভন কিছু না করলেও ওর ওখান থেকে কোনভাবে আর কেউ--


    || ৭ ||

    বাড়িতে ঢোকবার খানিক আগে লোডশেডিং হয়ে গেল। অন্ধকারের মধ্যেই দরজা খুলে সাইকেলটা উঠোনের ভেতরে ঢোকাতে ঢোকাতে শোভন ফরিদার গলা পাচ্ছিল, “বলো, কাজলাদিঘির কালো জলে-” ভারি মিষ্টি আধো উচ্চারণে ফরিদার বলা কথাগুলোর প্রতিধ্বনি ভেসে আসছিল, “কাজলাদিদির কায়ো জয়ে--”

    “উঁহু, কাজলাদিদি নয়, কাজলাদিদি নয়, সেতো সেই বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই-তে আছে। বলো কাজলা দিঘি-- ”

    “বলব না। আগে তুমি আবার কাজলাদিদির গান গাও--”

    রেডিয়াম দেয়া ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছিল রাত সাড়ে ন’টা। ক্লাশটাশ সব শেষ হয়ে যায় আটটার মধ্যে। তার মানে ঘন্টাদেড়েক হল স্কুলের ছেলেমেয়েরা সব চলে গেছে। তারপর ফরিদা পড়েছে সুরভিকে নিয়ে। শোভন একটু বিরক্ত হচ্ছিল। ফরিদাকে অনেকবার সে বলেছে ন’টার মধ্যে মেয়েটাকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে তারপর নিজেও শুয়ে পড়তে। কিন্তু ফরিদা সে কথা শুনলে তো! পাঁচ বছরের একটা মেয়ে, তাকে এখনই রাত জাগিয়ে সব কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে পণ্ডিত বানাবার কী দরকার সেটা শোভনের মাথায় আসে না।

    পশ্চিমের লাইব্রেরি ঘরের মধ্যে একটা হ্যারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছিল। গুণগুণ করে পড়ার শব্দ আসছে সেখান থেকে। তিনটে ছেলে মাসখানেক হল এখানে থেকে পড়ছে। লাইব্রেরি ঘরেই শোয়। মাথা ভালো ছেলেগুলোর। বাড়িতে পড়াশোনার আবহাওয়াটা নেই ঠিকমত। শোভনই ওদের বাড়িতে বলেকয়ে মাধ্যমিক অবধি এইখানে রেখে যেতে বলেছিল। সাইকেলটা রেখে লাইব্রেরিঘরে গিয়ে কাঁধের ঝোলা নামিয়ে রেখে শোভন ডাকল, “আশীষ?”

    মাথায় ঢ্যাঙা একটা একটা ছেলে তার বইটা রেখে উঠে এসে দাঁড়াতে শোভন জিজ্ঞাসা করল, “খাওয়া হয়েছে?”

    “না। ফরিদাদিদি ইতিহাসের একটা টেস্ট দিয়েছে। দশটা অবধি টাইম। তার পরে খাতা দেখে খেতে দেবে বলেছে।”

    “আর ফরিদাদিদি নিজে?”

    “এখনো খায় নি। বলল, সুরভিকে পড়িয়ে উঠে ঘুম পাড়িয়ে আমাদের খাতা দেখে গিয়ে তারপর একসঙ্গে খাবে।” তারপর কী মনে পড়তে আবার বলল, “বাবা এসেছিল সন্ধের সময় শোভনদা। এক মণ চাল দিয়ে গেছে। তুলে রেখেছি।”

    “রাতে কজন খেলো?”

    একটু ভেবে নিয়ে ছেলেটা বলল, “সাতজন। আমাদের আর তোমাদের দুজনকে ধরলে বারোজন হবে।” “আচ্ছা ঠিক আছে। তুই কাজ কর গে যা। বেশি রাত জাগিস না।”

    হঠাৎ ওপাশের ঘর থেকে সুরভির চিল চিৎকার ভেসে এলো, “মা, মা, শোভনদাদা এসেছে-শোভনদাদা এসেছে-”

    শোভন হেসে ফেলল। ফরিদার হাত ছাড়িয়ে, ঘর থেকে বের হয়ে এসে সুরভি ততক্ষণে দৌড়ে এসে শোভনের একটা হাঁটু জড়িয়ে ধরেছে।



    তাকে কোলে তুলে নিয়ে গালে একটা চুমু দিয়ে শোভন হেসে বলল, “হ্যাঁরে , তোর মায়ের নাম কী?”

    সুরভি লাজুক মুখে বলল, “ফরিদা মণ্ডল।”

    “বাবার নাম?”

    সুরভি তার গালে আঙুল ঠেকিয়ে একটা মধুর টোকা দিয়ে বলল, “শোভনদাদা।”

    সুরভির পেছনপেছন ফরিদাও বের হয়ে এসেছিল। ভারি শরীর নিয়ে নড়াচড়া করতে একটু অসুবিধে হচ্ছে তার। সুরভির কথা শুনে হাসতে হাসতে বলে, “সেই ভালো। শোভনদাদা। চাঁদমামা, সূর্যিমামার মত ইউনিভার্সাল দাদা। নিজের মেয়েরও দাদা!”

    হঠাৎ হাসি থামিয়ে শোভন বলল, “কিন্তু তুমি এখনো খাওনি কেন?”

    ফরিদা একটু অপ্রস্তুত মুখে বলল, “না মানে ছেলেগুলো এখনো খায়নি--”

    “তা এদের খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিলে তো পারতে। ডাক্তার বার বার বলেছে। একটু নিয়ম মেনে তো চলবে।”

    ফরিদা ঠোঁট টিপে একটু হাসল। তারপর বলল, “আমার নিয়ম টিয়ম নিয়ে তোমাকে এত মাথা না ঘামালেও চলবে। আগে খাইয়ে দিলে সবকটা বসে বসে ঢুলত। কোন কাজ হত না। কাজ সেরে তারপর খেয়ে সোজা ঘুমোতে যাবে সব কটা। এখন চলো। হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নেবে। জলপাইগুড়ি থেকে তোমার একটা চিঠি এসেছে বিকেলের ডাকে। উত্তরবঙ্গের ফোকলোর রিসার্চ ইন্সটিট্যুট তোমার পেপারটা অ্যাকসেপ্ট করেছে। হাজার দশেকের চেক পাঠিয়েছে একটা। মাসকয়েক পরে ওই নিয়ে একটা সেমিনারে ডাকবে বলেছে।”

    শোভন হাসল, “বলে না ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়! টাকাটা এসে গেলো। এখন অন্য পেপারটা ব্যাঙ্গালোরের ওরা নিলে দারুণ একটা ব্যাপার হবে বুঝলে?”

    “নেবেনা মানে? এডিট করে দিয়েছে কে দেখতে হবে তো?”

    “তা ভুল বলো নি। আমার ইংরিজি যা ভয়ানক--”

    “আমার ক্রেডিটটা মানছো তাহলে?”

    “মানছি। কিন্তু তাই বলে তোমার এই ঠিক সময়ে না খাওয়ার ব্যাপারটা আমি সাপোর্ট করছি না সেটা বলে রাখলাম।”

    “উঃ। ফের--”

    “ফরিদাদি, আমাদের হয়ে গেছে। এখন পেপার চেক করবে?” ভেতর থেকে সুশান্ত নামের ছেলেটা ডাকছিলো।

    ফরিদা কিছু জবাব দেবার আগে শোভন বলল, “উঁহু। এখন না। ফরিদাদিকে ছেড়ে দে। খাওয়াদাওয়ার পর আমি বসে চেক করে দেবো।”

    ছেলেগুলো একটু হতাশ হল বলে মনে হল শোভনের। শোভনকে ওরা আজকাল একটু দূর থেকে সমীহ করে চলে। ততটা স্বছন্দ বোধ করেনা ওর সঙ্গে যতটা তারা করে তাদের ফরিদাদিদি কাছে থাকলে। মনে মনে একটু হাসল শোভন। এই ভালো হল। ফরিদাও তো তার নিজের মিশনেরই সৃষ্টি। মিশনের উত্তরাধিকারটা সে এইবারে শোভনের হাত থেকে নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। এই তো চেয়েছিল সে। বুকের ভেতর তার যে বাঁশিওয়ালা সর্বক্ষণ বসে তাকে বাইরের দিকে ডেকে চলে, তার ডাকে সাড়া দিয়ে পথে বের হত যখন, তখন এই ইশকুলভর্তি মুখগুলো তাকে পিছু টানত সবসময়। ফরিদা তাকে সে চিন্তা থেকে মুক্তি দিচ্ছে ধীরে ধীরে।

    সুরভি কাঁধে মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়েছে কখন যেন। দুটি হাত মালার মত তার গলাটি জড়িয়ে রেখেছে। তাকে কোলে নিয়ে ধীরে ধীরে সে ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার সামনে ওই যে মেয়েটা তার ভারি গর্ভটিকে বহন করে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলেছে, একদিন শোভনই তো তাকে ধুলো থেকে তুলে এনেছিলো। বৃহত্তর দুনিয়ার সন্ধানে সে-ই তো পাঠিয়ে দিয়েছিলো তাকে। আজ সে মেয়ে স্বয়মাগতা হয়ে তার জীবনে ফিরে এসে তারই কাজে হাত লাগিয়েছে। তার স্বপ্নকে মাথায় তুলে নিয়ে, তার সন্তানকে গর্ভে ধরে কেমন শ্রান্ত পায়ে সে হেঁটে যায় তারই ঘরের দিকে। একটা ভীষণ ভালো লাগার অনুভুতি গড়ে উঠছিলো তার বুকের ভেতর। ঘরের ভেতর ঢুকে এসে সুরভিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে বুকের মধ্যে টেনে নিল ফরিদাকে। তার শরীর জুড়ে গর্ভিনী নারীর কোমল ছোঁয়া, ছড়িয়ে পড়া চুলের এলোমেলো আদর, আর ঘন, উষ্ণ নিঃশ্বাসের স্পর্শ খেলা করে যাচ্ছিল।

    হঠাৎ দপ করে তীব্র আলোর ঝলকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল চারদিক। কারেন্ট এসে গেছে। ফরিদা চমকে উঠে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জানালার উড়ন্ত পর্দার দিকে ইঙ্গিত করল একবার, তারপর তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

    ***********

    “তোমার ফোনটা লাইব্রেরিঘরে বাজছে মনে হয়। ওখানে ফেলে রেখে এসেছো নাকি? ”

    চৌকিতে বসে একটা টেবিলের ওপর থালা রেখে খাচ্ছিল ফরিদা। মাটিতে বসতে একটু অসুবিধে হচ্ছে তার আজকাল। সেইখান থেকেই জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুনতে শুনতে সে কথা বলছিল। শোভন কান খাড়া করল। ফরিদা ভুল বলে নি। তার ফোনেরই রিংটোনের শব্দ আসছে বাইরে কোথাও থেকে।

    “ঝোলাটা লাইব্রেরি ঘরেই ফেলে এসেছো বোধ হয় শোভনদা। দাঁড়াও এনে দিচ্ছি,” বলতে বলতে তাড়াতাড়ি থালা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আশীষ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

    “এত রাতে আবার কে ফোন করল?” ফরিদার গলা একটু উদ্বিগ্ন শোনাচ্ছিল।

    “হবে কেউ। ভুলভাল ফোনও হতে পারে। দেখছি দাঁড়াও। এই তো—কী রে কেটে দিল নাকি? কার ফোন রে?”

    থেমে যাওয়া ফোনটার উজ্জ্বল পর্দার দিকে একবার দেখে আশীষ বলল, “ব্রতীনদার।”

    “ব্রতীন? এই মাঝরাতে তার আবার কী দরকার পড়ল?”

    বলতে বলতেই আবার বেজে উঠল ফোনটা।

    “কী ব্যাপার ব্রতীন? এত রাতে? কোন প্রবলেম?”

    “জেগে আছেন নাকি শোভনদা?” ফোনের ওপাশ থেকে ব্রতীনের গলা ভেসে এল।

    “হ্যাঁ, দুজনেই জেগে আছি। বলো।”

    “একটু আসবো?”

    “এখন? সিরিয়াস কিছু মনে হচ্ছে?”

    “হ্যাঁ। একটু সিরিয়াস। এতক্ষণ অফিসে কাজ চলেছে। এই ছাড়া পেয়ে বেরোলাম। আপনার সঙ্গে একটা জরুরি কথা ছিল। সামনাসামনি বলতে হবে।” ফরিদা আর বিছানায় ঘুমন্ত সুরভির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে শোভন বলল, “কাল বললে হত না?”

    “হলে পরে এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করতাম না শোভনদা। কথাটা আজ রাত্রেই বলে নেয়া খুব জরুরি।” ব্রতীনের গলায় কোথাও একটু অসহিষ্ণুতার স্পর্শ ছিল কি? একটু বিরক্তি হচ্ছিল শোভনের। সেটাকে চাপা দিয়ে বলল, “এসো তাহলে। পৌঁছোতে কতক্ষণ লাগবে?”

    “মিনিট দুতিন বড়জোর। প্রায় আপনাদের বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছি আমরা।”

    “আমরা—মানে—শর্মিষ্ঠাও আসছে?”

    “হ্যাঁ। বলল আজকে রাতে ফরিদার কাছে থেকে যাবে। তাই সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। ছাড়ছি। ড্রাইভ করছি এখন।”

    ফোনটা ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে হাত ধুয়ে এলো শোভন। ছেলে তিনটে মিলে বাসনকোশন গুছিয়ে তুলে ঘরটা পরিষ্কার করে ফেলেছে। শোভন ফরিদার দিকে ফিরে বলল, “তুমি সুরভিকে নিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি লাইব্রেরি ঘরে বসে ব্রতীনের সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। শর্মিষ্ঠাকে পাঠিয়ে দেবো তোমার কাছে।” সুরভির ওপর দিয়ে সাবধানে ঝুঁকে মশারির ওপাশটা গুঁজতে গুঁজতে ফরিদা নিচু গলায় বলল, “না। আমিও সঙ্গে থাকবো। সিরিয়াস কিছু হয়েছে নিশ্চয়। নইলে ব্রতীন আর শর্মিষ্ঠা এত রাত্রে ড্রাইভার ছাড়া নিজেরা গাড়ি নিয়ে দৌড়ে আসতো না। কী হয়েছে সেটা আমারও শোনা দরকার। আশীষ, তুই বরং বোনের কাছে এসে একটুক্ষণ শো। পায়ের কাছে হেরিকেনটা কমিয়ে রেখে গেলাম। লাথি মারিস না ভুল করে। আর, হাতপাখা রেখে গেলাম একটা। কারেন্ট চলে গেলে বোনকে একটু হাওয়া দিস। জেগে না ওঠে যেন।”

    শোভন গেটের বাইরে আসতে আসতেই ব্রতীনের জিপ এসে পৌঁছে গেল। প্যাসেঞ্জার সিট থেকে নেমে এসে শর্মিষ্ঠা জিজ্ঞাসা করল, “ফরিদা শুয়ে পড়েছে?”

    “উঁহু। সুরভিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে লাইব্রেরি রুমে অপেক্ষা করছে।”

    “এর কোন দরকার ছিল না শোভনদা। মেয়েটার শরীরের এই অবস্থায় এভাবে রাত জাগা ঠিক হবে না।”

    শোভন একটু বিরক্ত গলায় বলল, “সেটা তুমি তাকে বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করে দেখো না একবার। আমি বলে বলে টায়ার্ড।”

    “দাঁড়ান দেখছি। আপনারা আসুন। আমি এগোচ্ছি, ” বলতে বলতে শর্মিষ্ঠা এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে।

    “বিশ্রি একটা ব্যাপার হয়ে গেল দাদা,” গাড়ি লক করতে করতে ব্রতীন নিচু গলায় বলছিল,“একটা রুটিন সরকারী ঝামেলা এমনভাবে স্নো-বল করে গেল আজ! আপনার কাছে অ্যাডভাইস চাইতে এলাম তাই।”

    শোভন এগিয়ে এসে তার পিঠে হাত রেখে বলল, “তুমি খুব টেনশনে আছ বুঝতে পারছি। সৎভাবে কাজ করতে গেলে আমাদের দেশে অনেকরকম সমস্যা আসবেই ব্রতীন। আবার কেটেও যাবে। ঠান্ডা মাথায় সবকিছু খুলে বলো দেখি।”

    ব্রতীনের গাড়ি বন্ধ করার কাজ হয়ে গিয়েছিলো। ঘুরে এপাশে এসে কাঁপা হাতে একটা সিগারেট ধরালো সে। তারপর বাড়ির দিকে চলতে চলতে বেনামি অভিযোগের ঘটনাটা সংক্ষেপে বলে গেল। শোভন চুপচাপ শুনছিলো। উঠোন পেরিয়ে তারা ততক্ষণে লাইব্রেরি ঘরের সামনে এসে পৌঁছেছে।

    “কাজটা যে-ই করে থাকুক, খারাপ করেনি। অমরেশ বাগচি যে ব্যাপারে আছে সেখানে কিছু না কিছু গড়বড় থাকবেই। কিন্তু আমার ইশকুল এতে জড়িত নয় সেটা আমি বলতে পারি। আমার মিশনটা আলাদা। অন্যের ত্রুটি ধরে সমাজের অভিভাবকত্ব করা আমার কাজ নয় ব্রতীন। তবে তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে, পরিষ্কার করে মুখের ওপর না বললেও তোমার একটা সন্দেহ রয়েছে যে আমার এখান থেকেই চিঠিটা তৈরি হয়ে থাকতেও পারে, তাইতো?” লাইব্রেরি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শোভন বলছিল।

    “না, মানে শোভনদা, সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সগুলো বেশ স্ট্রং। এমন তো হতে পারে যে আপনার অগোচরে কেউ--”

    “খোলাখুলি কথা বলতে ইতস্তত কোর না ব্রতীন। সন্দেহটা হওয়া তোমার খুবই স্বাভাবিক। তোমার জায়গায় আমি থাকলে আমারও তাই হোত,” শোভনের হাসছিল, “তবে আমি না হলেও ফরিদার অগোচরে এই ইশকুলে কোন কাজ হয় না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।”

    “কাগজটা একবার দেখান তো ব্রতীনদা,” শর্মিষ্ঠার পাশ থেকে ফরিদা হঠাৎ বলল।

    “হ্যাঁ। এই যে।” ব্রতীন তার হাতের ব্যাগটা থেকে একটা হলুদ রঙের ফাইল বের করে এনে ফরিদার হাতে দিল।

    চিঠিটা খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে ফরিদা মাথা নেড়ে বলে, “এ চিঠি এখানে তৈরি হওয়া সম্ভব নয় ব্রতীনদা। কারণ বাংলা লেখবার সফটওয়ার আমাদের মেশিনে নেই। আর, কাগজটা দেখেছেন? মোটা আইভরি ফিনিশ বণ্ড পেপার। মাথার দিকটা কাঁচি দিয়ে কাটা। এটা কোন দামি লেটারপ্যাডের কাগজ। তার মাথা থেকে প্যাডের মালিকের নামঠিকানা ছিঁড়ে ফেলে চিঠিটা ছাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ কাগজের একটা প্যাডের দামে আমার ছেলেমেয়েদের দশ দিস্তা কাগজ হয়ে যাবে। এত দামি কাগজ ব্যবহার করা আমাদের সাধ্যের বাইরে।”

    ব্রতীনের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলো। বুকের থেকে একটা ভার নেমে গেছে যেন তার।

    “এরই জন্যে তুমি এত রাতে শর্মিষ্ঠাকে সঙ্গে নিয়ে এত দূর ছুটে এসেছিলে? ফোনে একটু ভেঙে কথা বললেই তো ব্যাপারটা মিটে যেত।”

    “না শোভনদা,” ব্রতীন মাথা নাড়ল, “আমার কাছে ব্যাপারটার গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণটা হল, কালকের মধ্যে এন আর এম প্রোজেক্টের ওপর আমার ইন্সপেকশন রিপোর্ট ডি এম অফিসে পাঠাবার কথা। না পাঠালে এক্সপ্ল্যানেশান কল হবে বলে সার্কুলার এসেছে। রিপোর্টটা জমা দিলে অমরেশ বাগচি প্যাঁচে পড়বে। যা বলে গেছে তাতে ভুয়ো কাগজপত্র বানিয়ে কদ্দিন বাদেই প্যাঁচ কেটে ও বেরোবে বটে কিন্তু হিউমিলিয়েশানটা ওর যা হবার তা তদ্দিনে হয়ে যাবে। পার্টির এই এলাকার ভোটব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে অমরেশ বাগচির ফ্যামিলি। অতএব পার্টি সদরে ওর কথার ওজন যথেষ্ট। সেক্ষেত্রে এ তল্লাট থেকে আমার বাস যে উঠবে সে ব্যাপারে আমি একশো ভাগ নিশ্চিত। সে নিয়ে বিশেষ কোন মাথাব্যথাও নেই আমার। সরকার যেখানে যা কাজ দিয়ে পাঠাবে, তাই করে দেবো। মাস গেলে মাইনেটা আমার আটকাবে না। আমার শুধু চিন্তা ছিল এতে আপনিও কোনভাবে জড়িয়ে আছেন কিনা। থাকলে আপনারও ভিক্টিমাইজ্‌ড্‌ হবার সম্ভাবনা ছিল। তাই তাড়াহুড়ো করে আজকেই আপনার এখানে চলে এলাম।”

    শোভন হাসল, “ভিক্টিমাইজ্‌ড্‌ হবার সম্ভাবনা আমার এখনো যায়নি ব্রতীন। তুমি হয়ত মেনে নেবে এ চিঠিতে আমার কোন হাত নেই, কিন্তু অমরেশ বাগচি সেটা অত সহজে মানবে না। সুবল আমার এখানে যাতায়াত করে। চিঠিটা তার টেবিলে পাওয়া গেছে। এইটুকু প্রমাণই অমরেশ বাগচির পক্ষে যথেষ্ট। ফরিদার ওসব সফটওয়ারের প্রমাণে তার কিছু যাবে আসবে না। সন্দেহটা ওর থাকবেই। তুমি বাইরের লোক, তোমাকে সরিয়ে দেয়াটাই যথেষ্ট; কিন্তু আমি লোকাল ছেলে। আমার কাছ থেকে ওর থ্রেট পারসেপশনটা অত কম পদক্ষেপে মিটবেনা। লোকটা গতবারও মেলা করার সময় ওর মতামতকে পাত্তা না দেবার অপরাধে আমাকে টার্গেট করেছিল। বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। এবারে এ ব্যাপারটা ঘটলে পরে ও আমায় খুব সহজে ছেড়ে দেবে বলে আমার মনে হয় না।”

    ব্রতীন কিছু একটা ভাবছিল। একটু পরে ইতস্তত করে বলল, “শোভনদা, একটা কথা বলি, ঠাণ্ডা মাথায় শুনুন। অমরেশ বাগচি একটা প্রস্তাব দিয়ে গেছে। কমপ্লেনটা নিয়ে নাড়াঘাঁটা না করলে সে-ও গোটা এপিসোডটা ভুলে যেতে রাজি। এই প্রশ্নটা নিয়েই আমার আসা। আপনি না চাইলে আমি রিপোর্টটা পাঠাবো না। এখন বলুন-”

    “প্রশ্নটা আমায় করে তুমি একটা অনৈতিক কাজ করলে ব্রতীন,” শোভনের গলা কঠিন হল, “পাবলিক সার্ভিসের যে দায়িত্ব তুমি নিয়েছো সেটা স্বজনপোষণের জন্য নয়, সেটা পাবলিকের প্রতি তোমার কর্তব্য করবার জন্য। সেখানে আইন আর বিবেক যা বলে সেটা করতে তুমি বাধ্য। তার জন্য আমার মতামত চাইতে এলে তুমি? পাবলিক মানির বিপুল পরিমাণ একটা নয়ছয় সামনে এসেছে। সেটার প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে গেলে তুমি এবং তোমার প্রিয় একজন মানুষকে তার ফল ভুগতে হবে। সেক্ষেত্রে জনস্বার্থ না ব্যক্তিস্বার্থ কোনটাকে তুমি অগ্রাধিকার দেবে সেটাই তো তোমার প্রশ্ন? এর জবাবে কী মতামত আমি দিতে পারি বলে তুমি আশা করে এসেছিলে বলো তো?”

    ব্রতীন আড়চোখে ফরিদার দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে মেয়েটার। একটা বালিশে ভারি হয়ে ওঠা শরীরটা হেলান দিয়ে শর্মিষ্ঠার গায়ে ভর দিয়ে বসে রয়েছে একপাশে। নীতির সংগ্রামে ব্যস্ত দুটি পুরুষমানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের কথা চালাচালি শুনছে। যুক্তি আর নীতির সেই পাশাখেলায় জয়পরাজয়ের ওপর নির্ভর করে আছে তার স্বপ্নের ভবিষ্যত। হঠাৎ সেই বহুকাল আগে পড়া সেই রাইম অব দা এনশেন্ট মেরিনার কবিতাটার কথা মনে পড়ে গেল ব্রতীনের। গলায় মৃত অ্যালবেট্রস বাঁধা সেই দুর্ভাগা নাবিক, তার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ভূতুড়ে জাহাজের বুকে তার ভবিষ্যত নিয়ে নিয়তির দাবাখেলার অসহায় সাক্ষি হয়ে অপেক্ষা করে চলেছে--

    একটু পরে নিচু গলায় সে বলল, “তাহলে, আর কিছু আমার বলবার নেই শোভনদা। আমি চলি। শর্মিষ্ঠা, তুমি আজ রাতটা এখানে থাকছো তো?”

    শর্মিষ্ঠা মাথা নাড়ল, “নাঃ। ইচ্ছে হচ্ছে না। ফিরেই যাবো তোমার সাথে।” তারপর উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগোতে এগোতে হঠাৎ পেছন ফিরে শোভনের দিকে তাকিয়ে তিক্ত গলায় বলল, “ব্যক্তিগতভাবে আপনার কথা ভেবে আমরা এ প্রস্তাবটা নিয়ে আসিনি শোভনদা। কর্তব্যের সঙ্গে আপোস ব্রতীনও কোনদিন করে নি। আমরা এসেছিলাম ফরিদার কথা আর আপনার মিশনটার নিরাপত্তার কথা ভেবে। তার জন্য ব্রতীন এ আপোসটা করতে তৈরি ছিল। কিন্তু আপনার মতামতটা না নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত আমরা নিতে চাইনি। জানতাম কোন মূল্যেই যে কমপ্রোমাইজ আপনি করবেন না, তবুও ক্ষীণ একটা আশা ছিল, ফরিদার কথা না হোক নিজের মিশনটার নিরাপত্তার কথা ভেবে হলেও আপনি এই একটা বারের জন্য একটু কমপ্রোমাইজ করবেন। কিন্তু আইন আর বিবেকের বাইরে ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট বলে যে একটা বস্তু আছে সে কথাটা আপনার জানা থাকবে এমন আশা করাটা আমারই ভুল হয়েছিল। চলি।”

    “আমায় একটু ধরবে?” ফরিদা শোভনের দিকে তাকিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। শোভন উঠে দাঁড়িয়ে তার হাতটা ধরে তুলল। তাকে নিয়ে আস্তে আস্তে বাইরের দিকে যেতে যেতে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে রেখেছিল সে। কতটা মূল্য দিতে হবে তাকে আজকের এই সিদ্ধান্তটার জন্য কে জানে!

    ***********

    “জেগে আছো ফরিদা?”

    ফরিদা পাশ ফিরে তার দিকে ঘুরে শুল, “ঘুম আসছে না।”

    হঠাৎ দু হাতে তাকে আঁকড়ে ধরে শোভন বলল, “আ-আমার খুব অসহায় ঠেকছে। এরকম ফিলিং আমার কখনো হয় নি এর আগে। কী করবো বুঝতে পারছি না ফরিদা। আ-আমি--”

    হঠাৎ তার ঠোঁটের ওপর ফরিদার আঙুল এসে পড়ে তার কথা বন্ধ করে দিল, “কিচ্ছু বোলনা। তুমি আমার স্বামী, বন্ধু, কিন্তু সবার ওপরে তুমি আমার শিক্ষক, সেটা ভুলে যেও না। সেই ছোটবেলা থেকে যে শিক্ষা আমায় তুমি দিয়েছো, আজ শুধু আমার কথা ভেবে যদি তুমি তার উল্টো পথে চলতে তাহলে তোমার ওপর শ্রদ্ধা হারিয়ে আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম বলো তো? সিকিউরিটির লোভে তো আমি তোমার সঙ্গে আসিনি! তার জন্য তো আমার সামনে অন্য পথ খোলা ছলই। সেইসব ছেড়েই তো আমি এসেছি। কত ক্ষতি করতে পারবে তোমার এরা? আজ সে সিদ্ধান্তটা তুমি নিলে তার জন্য তোমার সব চলে গেলেও জেনো আমি থাকবো, আমাদের সুরভি থাকবে, আর আমার পেটের এই মানুষটা থাকবে তোমার সঙ্গে। তুমি ঘুমোও।”

    ***********

    যুবতীটির হাতের আঙুলগুলি, তার বুকে ধরে রাখা যুবকটির মাথায় গভীর স্নেহে এলোমেলো খেলা করে বেড়ায়। যুবকটি ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে, গভীর সেই রাত্রির সঙ্গে একলা একলা জেগে থাকে সে।


    || ৮||

    আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। এ বছর বর্ষা আসতে দেরি হয়ছে কিছুটা। জুনের তৃতীয় সপ্তাহে এসে হাজির হবার পর মৌসুমী বাতাস তার দেরি হবার ক্ষতিটা পূরণ করবার জন্য একেবারে উঠে পড়ে লেগেছে।

    দুপুরের পরের দিকে বৃষ্টিটা ধরে এসেছিল একটু আজ দিনদুয়েক বাদে। ঝিম ধরা আকাশটা থমথম করছে। মাঝে মাঝে জোলো হাওয়া হু হু করে বয়ে যাচ্ছিল উঠোনের গাছগুলোর মাথা কাঁপিয়ে দিয়ে। বারান্দায় একটা চেয়ার নিয়ে শোভন বসে ছিল। নিচু ক্লাশের সব ছেলেমেয়েগুলোকে একত্র করে নিয়ে লাইব্রেরি ঘরে সেকেন্ড টার্মের আগের টেস্ট চলছে। ফরিদা ওখানে রয়েছে। শর্মিষ্ঠা আজ আসেনি। ফরিদা বারদুয়েক চেষ্টা করেছিল। ফোন বন্ধ রয়েছে শর্মিষ্ঠার। এইট আর নাইনের ক্লাশে ললিত, ইব্রাহিম দুজনেই এসে গেছে। শুধু ক্লাশ টেনের ঘর থেকে ছেলেমেয়েদের হইচইয়ের শব্দ ভেসে আসছিল। সুবিমল এসে পৌঁছোল না এখনো। ওর আজ শোভনের সঙ্গে একসাথে ক্লাশ টেনের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ইতিহাসের একটা লম্বা সেশন করবার কথা ছিল।

    ঘড়িতে সাড়ে তিনটে বাজছে। চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে শোভন ক্লাশ টেনের ঘরের দিকে এগোতে যাবে তখন সুবিমল এসে ঢুকলো।

    শোভন একটু বিরক্ত মুখে বলল, “কটা বাজে দেখেছিস?”

    “একটু দেরি হয়ে গেল শোভনদা,” সাইকেলটা রেখে প্যান্টের গোটানো ভাঁজ খুলতে খুলতে সুবিমল বলল, “বিরামনগরের দিকে গেছিলাম। ওখানে পোস্ট অফিসে মায়ের নামে একটা এম আই এস আছে, সেটার টাকা তোলবার ডেট ছিল আজ। সেখানে তো দেখলাম জোর হইচই চলছে।”

    “কী হল আবার?”

    “তুমি শোননি কিছু? বিডিও ব্রতীনবাবু ট্রান্সফার হয়ে গেছে তো! আজকেই দুপুরে ফ্যাক্সে অর্ডার এসে গেছে কলকাতা থেকে। পার্টি অফিস থেকে বিজয় মিছিলের তোড়জোড় চলছে দেখে এলাম। ‘গরিবের শত্রু দালাল বিডিও দূর হঠো,’ বলে পোস্টার পড়েছে চারপাশে।”

    আকস্মিকতার ধাক্কাটা একটু সামলে নিয়ে শোভন জিজ্ঞাসা করল, “কোথায় পাঠাচ্ছে কিছু শুনেছিস?”

    “নাঃ। অত খবরটবর কিছু পাইনি। ক্লাশ আছে তাই তাড়াতাড়ি করে চলে এলাম।”

    ভেতরের ছটফটানিটা প্রকাশ না করে শোভন শান্ত গলায় বলল, “যা, ক্লাশে যা। দেরি হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েগুলো তান্ডব শুরু করে দিয়েছে একেবারে। আমি একটু বাদে আসছি।”

    সুবিমল চলে যেতে একটু ইতস্তত করে শোভন ব্রতীনের লাইনটা ডায়াল করলো একবার। তিনচারটে রিং হয়ে যাবার পর ওপাশ থেকে ব্রতীনের গলা ভেসে এলো, “খবরটা পেয়ে গেছেন মনে হচ্ছে শোভনদা?”

    “হ্যাঁ। শুনলাম। আজকেই এলো?”

    “হ্যাঁ। হবে যে সেটা তো জানাই ছিল। কিন্তু সেটা যে এত তাড়াতাড়ি করে দেবে সেটা ভাবিনি। এই—দাদা, আমি এখন রাখছি। পরে কথা বলছি—”

    শোভনের ফোনটা তাড়াতাড়ি কেটে দিল ব্রতীন। তার ঘরের দরজা ঠেলে অমরেশ বাগচি ভেতরে ঢুকে এসেছেন তখন।

    “কী? অর্ডার হয়ে গেলো?”

    “হ্যাঁ মিঃ বাগচি। এইমাত্রই এসেছে। আপনি জানলেন কোত্থেকে?”

    সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক জেনেও প্রশ্নটা অমরেশ বাগচির দিকে ছুঁড়ে দিল ব্রতীন। তার ব্যাপারে অমরেশ বাগচির নালিশ রাইটার্স অবধি যে পৌঁছে গেছে সে খবর তাকে হোম থেকে জয়েন্ট সেক্রেটারি সুরেশদাই জানিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতায় ব্যাপারটার নিয়মিত তদ্বির করেছেন অমরেশের জামাই। ভদ্রলোক রাইটার্সের সিকিউরিটির চার্জে রয়েছেন। কাজেই এ ব্যাপারে যে কোন খবর ব্রতীনের ডেস্কে এসে পৌঁছোবার আগেই অমরেশের জেনে যাবার কথা।

    উল্টোদিকের চেয়ারে আরাম করে ভারি শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ঘরের চারদিকটা একনজর দেখে নিলেন অমরেশ। তারপর বললেন, “আসলে পাবলিক একটু গরম হয়ে আছে তো! বোধ হয় এই অফিস থেকেই খবর জেনেছে সব। এখানকার এমপ্লইয়িজ ইউনিয়ানটাও তো আমাদের। খানিক আগেই আবীরটাবীর নিয়ে দল বেঁধে একদল ছেলে বাড়িতে এসে হাজির। বলে, ‘দালালটা বিদায় হয়েছে। আজ বিজয় মিছিল হবে।’ তা আমি বললাম, ‘ওসব কথা বোলোনা। উনি সরকারি লোক। আইন দিয়ে হাত পা বাঁধা। আসল সমস্যা তো কমপ্লেনবাজি। সরকারি দপ্তরে কমপ্লেন এলে ওঁকে সেটা দেখতে হবেই। সে উনি যা উচিত বুঝেছেন করেছেন। আর, আখেরে তো তাতে আমাদের লোকসান কিছু হয় নি! লাভই হয়েছে উলটে।’ ওহো, লাভ বলতে খেয়াল হল, এই দেখুন। এন আর এম প্রজেক্টে মুরলীপুর গ্রামের জবকার্ডের হিসেবে সত্যিসত্যিই ভুল ছিলো মশাই,” বলতে বলতে কাঁধের ঝোলা থেকে একটা সরকারি খাম বের করে এনে ব্রতীনের সামনে খুলে ধরলেন অমরেশ বাগচি, “আসলে, আপনার ইন্সপেকশান রিপোর্টটা যাওয়ার ফলেই নতুন করে জব কার্ড হোল্ডার্স লিস্টিং-এর অর্ডারটা এল মুরলিপুরের জন্য। ওতেই ধরা পড়ল, বেশ কিছু হাউজহোল্ডে হাঁড়ি আলাদা হয়েছে গত দু’বছরে। আগের সার্ভের সময় সেগুলো ছিল না। একান্নবর্তী পরিবার আজকাল আর মোটে টিঁকছে না, বুঝলেন! তাছাড়া, সত্যি কথা বলব, বেশ কিছু মাইগ্রান্ট পরিবারও এসে ঢুকেছে রিসেন্টলি। বেশির ভাগই মুসলমান। গরিব মানুষ সব! তাড়িয়ে দিলে যাবে কোথায়? পাশাপাশি কমিউনাল সেন্টিমেন্টটার দিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে। তা, গত একটা মাস সেইসব নিয়ে খুব ব্যস্ততা গেছে। মাইগ্র্যান্ট ফ্যামিলিগুলোর রেশনকার্ডটার্ড করিয়ে নিয়ে সব হিসেব হতে দেখি হাউজহোল্ডের সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ডি এম সাহেব খুব হেল্প করেছেন গোটা ব্যাপারটায়!”

    কাগজটা হাতে নিয়ে একবার দেখে মৃদু একটা হাসি ফুটল ব্রতীনের মুখে। শোভনের ইশকুলের সূত্রে মুরলীপুর গ্রামের লোকজনের ছবিটা তার অজানা নয়। মুরলীপুর গ্রামের লোকসংখ্যার ছবিটা তার কাছে এইমুহূর্তে বেশ পরিষ্কার। এ লোকটা বেশ কিছু পরিবারকে টুকরো টুকরো করে দেখিয়ে ভুয়ো জবকার্ডের বন্দোবস্ত তো করেছেই, ইলেকটোরাল রোলটাকেও বদলাবার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে। বাংলাদেশি যে লোকগুলোকে ঢুকিয়ে রেশন কার্ডের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে তাদের নামও উঠে যাবে সেখানে। বেশ উইন উইন গেম। সে নীতি টিতি মেনে নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার রইল, সৎ অফিসারের কর্তব্যও পালন করল সরকারের কাছে নালিশ জানিয়ে, আবার অমরেশ বাগচিরও নিজের উদ্দেশ্যটা ষোলর জায়গায় আঠেরো আনা পুরো হয়ে গেল। সবাই জিতেছে এই খেলায়। তার বিবেক, অমরেশের লোভ আর বেআইনি অনুপ্রবেশকারী কিছু মানুষ, লাভ হয়েছে সবার। কাগজটা অমরেশের হাতে ফেরৎ দিয়ে দিল সে।

    তীক্ষ্ণ চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ মানুষটি। একটু করুণাই হচ্ছিল তাঁর। লোকটা একেবারে স্বচ্ছ। মনের ভাব মুখ থেকে সরিয়ে রাখতে জানে না। আজকে তাঁর এই মাপা, পরিশিলীত আক্রমণের প্রতিটা ঘা এর মেরুদন্ডটাকে ভেঙে দিচ্ছে একটু একটু করে। এর পর তাড়া খেয়ে পালিয়ে যেখানে যাবে, পলিটিশিয়ানের সঙ্গে লড়তে যাবার আগে দুবার ভাববে।

    তিনি ঘরে ঢোকবার সময় দাদা দাদা করে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিল। ওই সেয়ানা মাস্টারটা হবে। শোভনের কথা মনে হতেই অমরেশের চোয়াল শক্ত হল। এই লোকটা চেয়ার থেকে সরে চলে যাক একবার, তারপর অমরেশ তাকে দেখবেন। শালা হিঁদুর বাচ্চা হয়ে মুসলমানের মেয়ে রাখনি রেখে আবার আদর্শ মারাচ্ছে বসে বসে। তা যা করছিস কর, মেয়েবাজি এ বয়সে কে না করে। কিন্তু মাঝখান থেকে অমরেশের পেছনে কমপ্লেনবাজি করতে কে বলেছিল তোকে!

    মুখে সে ভাবটা প্রকাশ না করে তিনি ফের জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় দিলো?”

    “জলপাইগুড়ি। প্রবেশনার জীবন থেকে শুরু করে নর্থ বেঙ্গলেই প্রায় সবটা সময় কাটিয়ে দিলাম। সেই নর্থ বেঙ্গলেই ফিরিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে আবার।”

    “ভালো। ঘরের ছেলে এইবার ঘরে ফিরে যান। সুখেশান্তিতে থাকুন গিয়ে। তা যাচ্ছেন কবে?”

    “দেখি। রিলিভার আসুক আগে। বাঁকুড়া থেকে আসছে। দিনপনেরো সময় লাগবে বলে মনে হয়।”

    “আরে না না। সনাতন দাস আসছে। প্রমোটি অফিসার। এ জেলারই মুকুন্দপুরের লোক। আমার চেনা মানুষ। ডেকে বলে দিয়েছি। পরশু এসে চার্জ নিয়ে নেবে। আপনি বরং টিকিট ফিকিট যা করবেন--” বলতে বলতে হাতের ঘড়ির দিক একঝলক তাকিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন অমরেশ, “দেরি হয়ে গেল। চলি। অনেক কাজ পড়ে আছে ওদিকে। কাল কলকাতায় ফিরব। আপনার যাবার আগে আর দেখা হবে না হয়তো।”

    অমরেশ বের হয়ে যেতে ফোনটা বের করে শোভনের নম্বরটা লাগালো এবার ব্রতীন। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। বারপাঁচেক রিং হয়ে যাবার পর ওপাশ থেকে ফরিদার গলা পাওয়া গেলো, “কে ব্রতীনদা? শর্মিষ্ঠার নম্বরটা লাগছে না কেন বলুন তো? আজকে ইশকুলেও এলো না! ও তো এরকম করে না?”

    ব্রতীন একটু ইতস্তত করে বলল,“ওর আজকে শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে ফরিদা। ফোন বন্ধ করে রেখে ঘুমোচ্ছে বোধ হয়। আমি বাড়ি ফিরে লাইন ধরিয়ে দেবো। শোভনকে একটু দেবে?”

    “ও ক্লাশে আছে। ক্লাশের সময় ফোন ধরে না, জানেন তো। আমার কাছে ফোন রেখে দিয়ে যায়। কী ব্যাপার আমাকে বলবেন? আমি বলে দেবো।”

    “তোমায় কিছু বলে নি শোভন?”

    “উঁহু। আমিও ক্লাশে আছি। কেন, কী হয়েছে? শর্মিষ্ঠার--”

    “আরে না না সে’সব কিছু নয়। আমার অর্ডার এসে গেছে।”

    খানিকক্ষণ একেবারে চুপ করে থেকে ফরিদা যখন ফের কথা বলল, তার গলাটা আশ্চর্যরকম শান্ত, “তাহলে সরিয়েই দিল আপনাকে? কতদিন থাকতে পারবেন আর?”

    “সব বলব। কাল দুপুরে তোমাদের ওখানে খাব আমরা।”

    ফরিদা একটু ইতস্তত করে বলল, “কাল—মানে আমার কালকে এগারোটা নাগাদ ডাক্তারের কাছে যাবার ডেট ছিল--”

    ব্রতীন অসহিষ্ণু গলায় বলল, “তাহলে কাল সন্ধেবেলা যাব। তোমরা থেকো--”


    || ৯ ||

    “দিঘলগুড়ি ব্লক অফিস থেকে ওম্যান ডেভেলপমেন্ট অফিসার মিনতি দিদিমণি এসেছেন ম্যাডাম।”

    সমাদৃতা পর্দার থেকে মুখ না সরিয়েই নাম লেখা কাগজের টুকরোটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলল, “একটু বসতে বলবে সুভাষদা? হাতের কাজটা একটু সেরে নিই। তুমি মিনিটপাঁচেক পরে ডেকে দিও।”

    বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। কালেক্টরেটের এই পাশটায় সমাদৃতার ঘর থেকে নিচে খানিক দূরের রাস্তাটা দেখা যায়। এই দুপুরবেলার বৃষ্টিতে সেখানে লোকজনের দেখা নেই। মাঝে মাঝে শুধু একলা কোন মানুষ ছাতা মাথায় দিয়ে চলেছে। দূরে বটগাছটার আড়ালে যাযাবর রেস্তোঁরার বোর্ডটার খানিকটা চোখে পড়ে। স্বাভাবিক দিনে এ সময়টা ওর সামনে ভিড় লেগেই থাকে। আজ জায়গাটা একেবারে ফাঁকা। যাযাবর বেশ দামি রেস্তোঁরা। জলপাইগুড়িতে ও এসে জয়েন করবার পর ব্রতীনরা একবার বেড়াতে এসেছিল এখানে। ব্রতীনের তখন কোচবিহারে পোস্টিং। সেবার ওকে আর শর্মিষ্ঠাকে একদিন ওই যাযাবরে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছিলো সমাদৃতা। থালাজোড়া চিতল মাছের পেটির চেহারা দেখে শর্মিষ্ঠার মুখখানা এমন হয়েছিলো—

    একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনের কমপিউটারের পর্দায় চোখ ফেরালো সে। হোম-পার ডিপার্টমেন্ট থেকে সদ্য বের হওয়া ট্রান্সফার অর্ডারটা দেখে সেদিন ব্রতীনকে ফোন করেছিল। ব্রতীন ব্যস্ত ছিল। বেশি কথা বলতে পারেনি। বলেছিলো মেল-এ সব লিখবে। সেই মেলটা এখন ওর সামনে খোলা।

    শোভন বিয়ে করবার পর বেশ কিছুদিন ওদের কারো কোন খবর রাখেনি সমাদৃতা। রাখবার কোন তাগিদ আর অনুভব করেনি সে। ভালো থাকুক শোভন ফরিদাকে নিয়ে, তার মিশনকে নিয়ে। যা যা চেয়েছে, যেমনভাবে চেয়েছে, সেই সবকিছুই তো সে এইবারে পেয়ে গেল ঠিক সেইরকমভাবে। তাছাড়া ব্রতীন যে ওখানে রয়েছে এই ব্যাপারটাই তাকে একটা গভীর নিশ্চিন্ততা দিয়েছিল। ব্রতীন বুদ্ধিমান ছেলে। শোভনের সাহায্য হবে। এতদিন পরে ব্রতীনের এই মেলটা এসে সেই নিশ্চিন্ততার ভিৎটা ধরে সজোরে একটা নাড়া দিয়ে গেল।

    পাশে রাখা ফোনটাকে একবার হাতে তুলে নিয়ে দেখল সমাদৃতা। পর্দায় শোভনের নম্বরটা ফুটে আছে অনেকক্ষণ। মেলটা পাবার পর থেকে বেশ কয়েকবার নম্বরটাকে পর্দায় তুলে এনেছে সে, দীর্ঘ এতগুলো বছরের মধ্যে এই প্রথমবার। কিন্তু সবুজ বোতামটা আর টেপা হয়ে ওঠেনি। এবারেও হল না। একটু ইতস্তত করে ফোনটা আবার নামিয়ে রাখল সমাদৃতা। তারপর চেয়ার থেকে উঠে অস্থিরভাবে এদিক ওদিক কয়েক পা ঘুরে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল সে। বৃষ্টির ছাঁটমাখা বাদলা হাওয়ার ঝাপটা তার অবাধ্য চুলগুলোকে নিয়ে খেলা করছিল।

    “দিদি আসবো?”

    চমকটা ভেঙে গিয়ে বাস্তবের জমিতে ফিরে এল সমাদৃতা, “এসো মিনতিদি।”

    ছোটখাটো মানুষটির বয়স হয়েছে। বিধবা। পরনে চুড়িপার ধুতি, সাদা জামা। টেবিলের উল্টোদিকে চেয়ারে এসে বসে হাতের ফাইল ফোল্ডারটা খুলে তার ভেতর থেকে মুখ খোলা একটা খাম বের করে এনে সমাদৃতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “দিঘলগুড়ি মহিলা সমিতির ব্যাপারে বিডিও অফিস দিয়ে একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম দিদি। মাসখানেক আগে। এই যে একটা কপি নিয়ে এসেছিলাম।”



    খামটা সরিয়ে রাখল সমাদৃতা, “প্রস্তাবটা আমি আগেই দেখেছি মিনতিদি। আরেকবার দেখার কোন দরকার হবে না।”

    মিনতি একটু অবাক হলেন, “পেয়ে গেছেন? কিন্তু দিঘলগুড়ির বিডিও সাহেব তো মাসদুয়েক ধরে মেডিক্যাল লিভে আছেন। আমি ভেবেছিলাম কাগজটা ওখানেই পড়ে আছে হবে।”

    “উঁহু। পাশের ব্লকের সতীশ স্যান্যালকে অ্যাডিশনাল চার্জ দেয়া হয়েছে। গত সপ্তাহে উনি দিঘলগুড়ি গেছিলেন একদিনের জন্য। তখন পাঠিয়ে দিয়ে গেছেন।”

    “ও। আচ্ছা, আমাদের বিডিওসাহেব কবে নাগাদ ফিরবেন কিছু জানেন নাকি দিদি? বড় ভালো লোক। কাজটাও বুঝতেন।”

    সমাদৃতা মাথা নাড়ল, “উনি বোধ হয় আর এদিকে ফিরবেন না। হেলথ গ্রাউন্ডে অ্যাপ্লাই করে দিয়েছেন কলকাতায় ফেরার জন্য। হয়ে যাবে। নতুন লোক দেবার কথা হচ্ছে। কিন্তু সে কথা যাক। ট্রেনিং-এর প্রস্তাব দিয়েছো ভালো কথা। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে ট্রেনারের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে’খন। কিন্তু প্রশ্ন হল, সফট টয় তৈরি করতে হলে কাঁচামাল আনা আর ফিনিশড মাল ডেলিভারির জন্য সবচেয়ে কাছের পাইকারি বাজার বলতে তো সেই শিলিগুড়ি। তদ্দূর মাল টানাটানি করতে অতিরিক্ত খরচ যা হবে সেটা কীভাবে সামলাবে বুঝতে পারছি না। তা শিতলপাটির কাজটা তো দিঘলগুড়ি সমিতির ভালোই চলছে। বড় লোকাল মার্কেট রয়েছে। লাভও ভালোই হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এক্ষুনি অন্য একটা এই ধরনের নতুন কাজ হাতে নেবার খুব দরকার আছে কি?”

    “দরকার বলেন যদি তাহলে সেভাবে কিছু নেই। কিন্তু গেলবার শিলিগুড়িতে সরস মেলায় গিয়ে মেয়েরা ওই সফট টয় দেখেছে হিঙ্গলগঞ্জের একটা সেলফ হেল্প গ্রুপের মেয়েদের কাছে। নাকি পাটি বোনার চেয়ে কাজও কম খাটুনির আর লাভও থাকে টাকায় বারো আনা। সেই দেখে এসে তক একেবারে ক্ষেপে উঠেছে। ছ’মাস ধরে আমার পেছনে লেগে আছে ওই নিয়ে।”

    মিনতি নামের মহিলাটির বিপন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল সমাদৃতা। তারপর বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। গ্রুপটা চালান তো সন্ধ্যা মালো। আমায় চেনেন ভালো করে। তুমি গিয়ে সন্ধ্যাকে বলবে নারী উন্নয়ন দপ্তরের ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টারের তরফে থেকে এই নিয়ে একটা ইন্সপেকশন করতে আসবো আমি। দেখেশুনে তার পর যা ঠিক করার সব হবে।”

    “আপনি যাবেন?”

    “হ্যাঁ ভাবছি ঘুরে আসি। আগামি মাসে ও এলাকার আট দশটা সেলফ হেল্প গ্রুপের পরপর ইন্সপেকশনে বের হব। দিঘলগুড়ি মহিলা সমিতির নামটা লিস্টে ঢুকিয়ে নিচ্ছি।”

    “আগামি মাসে আসবেন? মানে ভরা শ্রাবণ! খুব বর্ষা চলবে তো তখন! আর একটা মাস বাদে আসুন না।”

    সমাদৃতা মাথা নাড়ল, “না মিনতিদি। বিল্টুর ইশকুলের পরীক্ষা আছে সেপ্টেম্বরে। জুলাইয়ের পর আমি কোথাও বের হচ্ছি না।”

    “কোন ক্লাশ হল বিল্টুবাবুর?”

    “টু চলছে।”

    “বড়ই হয়ে গেল দেখতে দেখতে। সেই সেবার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন ইন্সপেকশনে। কী দুষ্টুই না ছিলো। শান্ত হয়েছে একটু?”

    সমাদৃতা হাসল, “দুষ্টুমি আরো বেড়ে গেছে।”

    মিনতি মাথা নাড়লেন, “ছেলেগুলো এমনই হয় দিদি। ও মায়ের আদরে হয় না। আমারটাকে দেখেছি তো! সারাদিন পেছনে ঘ্যান ঘ্যান করে কাজ হত না। সন্ধেবেলা বাপ এসে দু ঘা দিতে তখন একেবারে কেঁচোটি হয়ে বই মুখে বসে যেত।”

    “কী করছে ছেলে?”

    “ইতিহাস নিয়ে এম এ পড়ছে দিদি। ভারি শান্ত হয়ে গেছে। দেখলে কে বলবে ওরকম বাঁদর ছিল। প্রায় রাতে বাপের হাতে পিটুনি না খেলে ভাত হজম হত না। এখন দেখি আবার বাপের কথা খুব বলে। দু বছর হয়ে গেল উনি চলে গেলেন, ছেলেটা এখনো সে শোক ভুলতে পারেনি।”

    “এরপর কী করবার ইচ্ছে?”

    “কে জানে দিদি। এই বছর ফাইনাল দেবে। তারপর কী যে করবে সেসব কিছু তো বলে না মুখে। ওর বাপও চলে গেল। কে-ই বা দেখে! আমায় তো হিসেবের মধ্যেই ধরে না। আ-আমি একদিন ওকে আপনার কাছে নিয়ে আসবো। একটু বলে টলে দেবেন?”

    “নিয়ে এসো একদিন। কথাবার্তা বলা যাবে।”

    মিনতি উঠে দাঁড়ালেন, “আজ তাহলে আসি দিদি। অনেকটা রাস্তা ফিরতে হবে। বাসটাসও কম আছে আজ--”

    মিনতি চলে যেতে পর্দায় মেলটা আরো একবার ভালো করে পড়ল সমাদৃতা। পরশু শনিবার সকালের গাড়িতে ব্রতীনরা এসে পৌঁছোচ্ছে। সার্কিট হাউসে একটা ডবল রুম বুক করে দেবার জন্য নাজিরবাবুকে একটা চিরকুট পাঠিয়ে দিয়ে মেলটার জবাব লিখতে বসবে তখন বাড়ি থেকে ফোনটা এলো। ওপাশে বিল্টুর চিলচিৎকার শোনা যাচ্ছিল, “মা তুমি কৃষ্ণামাসীকে বকো, মারো। ও আমার টিভি বন্ধ করে দিল কেন?”

    “তুমি ঘুমোও নি?” সমাদৃতার গলায় অনুযোগের সুর ছিল। বিল্টু কিছু বলবার আগেই ফোনে কৃষ্ণার গলা শোনা গেল, “দেখেন বৌদি। ইশকুল থেকে ফিরে ইস্তক টেলিভিশন নিয়ে পড়েছে। এইটুক ছেলে অত টিভি দেখা ভালো? দুবারের বেশি তিনবার বলেছি শুয়ে ঘুমাও অমনি আপনাকে ফোন লাগাচ্ছে, কি না কৃষ্ণামাসী আমায় বকেছে।”

    সমাদৃতা একটু বিরক্ত গলায় বলল, “কী হচ্ছেটা কী বলোতো কৃষ্ণা? একটা বাচ্চা ছেলেকে সামলাতে পারো না, অফিসের মধ্যে ফোন করে রোজ এই এক নাটক।”

    “আর বলবেন না বৌদি। ওকে সামলানো আমার সাধ্যি আছে? মেরেধরে খামচি দিয়ে একশা করবে।”

    মাথার ভেতর একটা মৃদু অস্বস্তি হচ্ছিল সমাদৃতার। ছেলেটা দিনকে দিন কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। কারো কথা শোনে না। সাংঘাতিক জেদ আর বায়না। ওর দিদিমা এসে কয়েকদিন থেকে গেলেন। যাবার আগে মায়ের মুখেও সেই দুশ্চিন্তার ছাপ দেখেছে সমাদৃতা। মা’র কথা মনে পড়তে মুখে একটা শুকনো হাসি খেলে গেল তার। সবার মুখে ওই এক কথা। এইমাত্র মিনতিদি পরোক্ষে বলে গেল, ছেলে মানুষ করতে গেলে বাপের শাসণ দরকার। গতমাসে ফিরে যাবার আগে মা-ও ফের সেই এক কাঁদুনি গেয়ে গেল, “এইভাবে কদ্দিন আর চালাবি মা? মিটমাট করে নে। উত্তম তো তোকে কোন অনাদর করে নি কখনো? আদর্শ টাদর্শ সব ঠিক আছে, কিন্তু ছেলেটা তোর এভাবে বিগড়ে যেতে বসলে ওসব আদর্শ নিয়ে লাভ কী হবে তোর? শেষে নিজেই ফাঁকে পড়বি দেখিস।”

    মা-বাবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলে উত্তম। মাঝেমাঝেই তাদের সোদপুরের বাড়িতে যাতায়াতও করে। আদর্শটাদর্শের চেয়ে মেয়ের জন্য সমাজনির্ধারিত সুখেই সমাদৃতার মা-বাবারও আগ্রহ বেশি। নিজেকে আজকাল ভারি কোনঠাসা লাগতে শুরু করেছে সমাদৃতার। মায়ের ব্যাপারটা তাও মানা যায়। স্বামীসন্তান নিয়ে সংসার তাঁর কাছে ধ্রুব সত্য। কোন মূল্যেই তার অন্যথা চলে না। এমনকি আদর্শ কিংবা সততার মূল্যেও নয়। কিন্তু বাবা? মাঝেমাঝে বাবাকে একটা প্রশ্ন করবার ইচ্ছে করে সমাদৃতার- কেন তবে আমায় ছোটবেলা থেকে শিখিয়ে এসেছিলে, আদর্শের জন্য প্রয়োজনে সবকিছু ছাড়া যায়? কেন তাহলে নিজে সারাজীবন অতবড় চাকরি করেও মায়ের একটা বড় বাড়ির শখ মেটাতে পারলে না তুমি?

    “কী হল বৌদি?” ফোনের ভেতর থেকে কৃষ্ণার ডাক ভেসে আসছিলো। সমাদৃতার হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়াটা ফোনের ওপার থেকেও তার নজর এড়ায়নি।

    “ না কিছু না। ফোনটা রাখ এবার। ছেলেকে নিয়ে শোয়াও গে যাও। আমার কাজ আছে।”

    “ও বৌদি দাঁড়ান দাঁড়ান। একটা কথা বলা হয় নি। কুরিয়ারে একটা বড় পার্সেল এসেছে। ”

    “পার্সেল?” সমাদৃতা অবাক হল, “আমায় আবার পার্সেল পাঠালো কে?”

    “আপনার নামে না বৌদি, বিল্টুর নামে। এসেছে, দাঁড়ান বলছি—এই –বি এল ইউ ই--”

    “ আর বলতে হবে না। বুঝেছি। ব্লু ডার্টে এসেছে। তুমি রেখেছো?

    “হ্যাঁ বৌদি। সই করে নিয়েছি।”

    সমাদৃতার মুখ কঠিন হল, “কতদিন বলেছি তোমায় কৃষ্ণা, আমাদের অ্যাবসেন্সে বাড়িতে কোন পার্সেল টার্সেল এলে আগে না জানিয়ে রিসিভ করবে না?”

    “সে তো জানি। কলকাতায় থাকতে তখন তো আপনাদের দুজনেরই মানা ছিল। আজকেও আমি কুরিয়ারের লোকটাকে মানা করেছিলাম। তা সে লোকটা নম্বর ডায়াল করে ধরিয়ে দিলো, দেখি দাদা কথা বলছে। বলে, ‘বিল্টুর জন্য পাঠিয়েছি। নিয়ে নে।’ নইলে, বিল্টুর জন্মের আগে থেকে আপনার সাথে আছি, আর আপনার কথা শুনবো না?”

    ফোনটা ছেড়ে দিয়ে খানিকক্ষণ কপালে হাত দিয়ে বসে রইল সমাদৃতা। মাথাটা টিপটিপ করছে। আবার একটা দামি জিনিস পাঠিয়েছে উত্তম। নিশ্চয় আগের বারের মত বিদেশে কোথাও গেছে, সেখান থেকে অস্বাভাবিক দামি কোন কিছু কিনে নিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে বিল্টুর নামে। এই জেশ্চারগুলো অসহ্য লাগে আজকাল সমাদৃতার। একটু বাদে একটা হাফ ডে সি এল এর দরখাস্ত লিখে ডি এম-এর ডাকপ্যাডে পাঠিয়ে দিয়ে ব্যাগটা তুলে নিয়ে অফিসঘর থেকে বের হয়ে এলো সে। সুভাষদা দরজারর বাইরে টুল পেতে বসে ছিলো। তাকে বের হতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলে “ম্যাডাম, চললেন? গাড়ি--” তাকে ইশারায় মানা করে দিয়ে লম্ব লম্বা পায়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল সমাদৃতা।

    ঝির ঝির করে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। তারই মধ্যে বৃষ্টিভেজা পথ ধরে এলোমেলো হেঁটে চলেছিলো সে। ভারি অস্থির লাগছে। অসহায়তার যে অনুভুতিটা আজকাল তার অফিসের সময়টুকু বাদে বাকি সব সময়ের সঙ্গী সেটা ফের পাকিয়ে উঠছে বুকের ভেতরে। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিল না তার। তিস্তার দিক থেকে এলোমেলো হাওয়া ছাড়ছে। সেই হাওয়ায় ভর করে বৃষ্টির জোর বেড়ে উঠছিলো ক্রমশ। ছাতাতে সে বৃষ্টির জলের তোড় আটকায় না। ভালোই হল। শুকনো চোখে পথ চলবার দায়টা রইল না আর—

    --উত্তম একদিন বলেছিলো, “তোকে ছাড়া আর আমার দুনিয়াতে কিছু চাইবার নেই মাদ্রি বুঝলি?” তাহলে হঠাৎ মাত্রই ক’টা বছরের মধ্যে কী এমন হয়ে গেল যে ওর পৃথিবীর কাছে যে কোন মূল্যে এতকিছু চাইবার প্রয়োজন হয়ে পড়ল? সে তো উত্তমকে কোন ফাঁকি দেয় নি? তাহলে কেন, কীসের জন্য?

    উত্তর এর একটা দিয়েছিলো উত্তম। চলে আসবার আগের দিন তার মুখটা দুহাতে চেপে ধরে চাপা, হিংস্র গলায় বলেছিলো, “কার জন্য করেছি এসব তুমি জানো না? তোমাকে আমি যেভাবে রাখতে চাই, বিল্টুর জন্য আমি যে ভবিষ্যত চাই, এ চাকরির টাকায় তা হয় না মাদ্রি। তোমাদের জন্য আমি সব করতে পারি।”

    চমকে গিয়েছিল মাদ্রি উত্তমের সেই কথা শুনে। ভিজিল্যন্সের খোঁজখবরে ওর যত বেনামের সম্পত্তির সন্ধান মিলেছিল তার খবর তার অজানা নয়। কেবল স্ত্রীপুত্রের ভবিষ্যতের সংস্থান করবার জন্য সে পরিমাণ টাকার এক শতাংশেরও প্রয়োজন হয়না। নিজের লোভ চরিতার্থ করবার ইচ্ছেটাকে একটা সংসারী রূপ দিয়ে কী অসাধারণ অভিনয় করে চলেছে উত্তম! মাদ্রির একবার ইচ্ছে হয়েছিলো বলে, একদিন তোমার মেদিনীপুরের গ্রামে কিশোর বয়সে যে আদর্শের পাঠ নেবার যে গল্প আমায় বলেছিলে, সে-ও কি তবে এমনই আর একটা মিথ্যে অভিনয় ছিল? আমাকে ইম্প্রেস করে দখল করবার জন্য? আর সত্যিই যদি সে পাঠ তুমি নিয়েও থাকো, তাহলে তাকে এত সহজে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারলে তুমি আমার জন্য? এরপর আর একটা নতুন খেলনা যখন হাতে পাবে তখন--”

    কিন্তু সে সব কথা আর উচ্চারণ করবার ইচ্ছে হয়নি তার। চলেই তো যাচ্ছে সে। কী লাভ শুধুশুধু যাবার আগে একরাশ তিক্ততা বাড়িয়ে? কিছুই তো বদলাবে না তাতে।

    “দিদি, ও দিদি, আপনি এখানে কী ব্যাপার?” চেনা গলার শব্দে চমকটা ভেঙে গেল সমাদৃতার। খেয়াল হল, উদ্দেশ্যবিহীনভাবে এলোমেলো চলতে চলতে কখন যেন সে আশ্রমপাড়ার দিকে এসে পড়েছে।

    রিকশাওয়ালা ছেলেটি তার পরিচিত। প্রতিদিন সকালে সে একটা ঢাকা ভ্যানে করে হাউজিং-এর তিনচারটি বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যায়। বিল্টুও যায় তার গাড়িতে।

    “এ হে, দেখেন দেখি, একেবারে ভিজে গেছেন। এই বৃষ্টি ছাতায় মানে নাকি? গাড়িতে আসেন নি? ওঠেন, গাড়িতে ওঠেন। কোথায় যাবেন বলেন, ছেড়ে দিই।”

    ছাতাটা বন্ধ করে রিকশায় উঠে বসতে বসতে সমাদৃতা বলল, “উঁহু। গাড়ি আনিনি আজ। আশ্রমপাড়ায় একটা কাজে এসেছিলাম। এমন বৃষ্টি নামবে কে জানতো! বাড়ি ফিরবো এবারে। হাউজিং-এ চলো।”



    তাড়াতাড়ি প্যাডেলে চাপ দিল ছেলেটি। তারপর গাড়ি চলাতে চালাতেই বলল, “বাড়ি গিয়ে মাথাটাথা মুছে এক কাপ আদা চা খেয়ে নেবেন দিদি। ঠান্ডাটান্ডা কিছু আর ধরবে না তাহলে। যা ভিজেছেন! ”

    এক আশ্চর্য মায়ার মিশেল ছিল তার সেই সরল উদ্বেগে। উত্তর বাংলার পথেঘাটে মানুষের এই অযাচিত উষ্ণতাটুকু বড় ভালো লাগে সমাদৃতার। কলকাতা থেকে এই শহরে যেদিন সে প্রথম এলো সেই দিনটা থেকেই এই মায়াময় মানুষগুলো তার বুকের ক্ষতটায় বড় আরামের প্রলেপ দিয়ে চলেছে।

    “হ্যাঁরে, তুই যে রিকশাও চালাস তাতো জানতাম না?” সমাদৃতার প্রশ্নের জবাবে প্যাডেল করতে করতে মুখ না ঘুরিয়েই ছেলেটি জবাব দিলো, “আগে চালাতাম না দিদি। এখন ছেলে হবার পর রিকশাটা ভাড়ায় নিলাম। বিকেলের দিকে নিয়ে এসে স্টেশনে লাগাই। দুটো বেশি পয়সা আসে। কাজে লেগে যায়।”

    চলতে চলতে সে তার সুখ দুঃখের গল্প বলে। মালিককে দিনে ত্রিশ টাকা গুনে দিতে হয়, সে বেরোতে পারুক কি না পারুক গাড়ি নিয়ে। তার ওপর রিপেয়ারের খরচ আছে মাঝেমধ্যেই। ছেলেটাকে নার্সারি স্কুলে দিতে হবে পরের বছর থেকে। সে খরচ তার জুটবে কোত্থেকে সেই নিয়ে চিন্তার শেষ নেই তার।

    ***********

    কলিং বেল টিপতে কৃষ্ণা এসে দরজা খুলে দিল। বিল্টুর উত্তেজিত গলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল শোবার ঘর থেকে। ছাতাটা কৃষ্ণার হাতে দিয়ে সমাদৃতা আস্তে আস্তে সেদিকে গিয়ে উঁকি দিল । বিল্টুর সামনে একটা খোলা বাক্স থেকে বের করা ধাতু আর প্লাস্টিকের অনেকগুলো বিচিত্র আকৃতির টুকরো আর যন্ত্রাংশ পড়ে আছে। তার মধ্যে কয়েকটা টুকরো কোনমতে একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে একটা হেলিকপটারের মাথার দিকটার চেহারা নিচ্ছে আস্তে আস্তে। ফোনে উত্তেজিত গলায় সে বলছিলো, “না, তুমি বলো—হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই তো পেছনের দিকে একটা গর্ত তার গায়ে তিন লেখা—দাঁড়াও তিন লেখা টুকরোটা খুঁজছি, তুমি ছেড়ে দিও না--”

    ফোনটা কানে চেপে রেখেই সে সামনে ছড়িয়ে থাকা খেলনার অংশগুলো হাঁটকাতে হাঁটকাতে ডাক দিল, কৃষ্ণামাসী—ও কৃষ্ণামাসী-ঈ—তিন নম্বরটা খুঁজে দিয়ে যাও না! --কী? না কৃষ্ণামাসী ঘুমোচ্ছে না। জেগে আছে—হ্যাঁ হ্যাঁ এইটার কথাই তোমায় বলেছিলাম—একদম ঠিক এইটা--উঁহু মাকে বললে জোড়া দিয়ে দেবে না-- শিলিগুড়ি সিটি সেন্টারে গিয়ে চেয়েছিলাম তো— না, দেয়নি—বললো ওরকম দামি খেলনা আমি তোমায় দিতে পারবো না—--হ্যাঁ বাবা, আমি ভীষণ খুশি—ভীষণ--দূর,মা জানতেই পারবে না—বিকেল হয়ে যাবার আগেই আমি ঠিক খাটের তলায়—”

    নিঃশব্দে পিছু হটে সরে আসছিল সমাদৃতা। দরজার দিয়ে বের হয়ে আসতে গিয়ে খুট করে একটা শব্দ হতেই পেছন ফিরে তাকে দেখে যেন পাথর হয়ে গেল বিল্টু। মাকে সে এই অসময়ে বাড়িতে আশা করে নি মোটেই। এক মুহূর্ত ওইভাবেই থেমে থেকে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলতে শুরু করল, “আমি চাইনি মা—আমি বাবাকে কিচ্ছু বলিনি, বাবাই তো--”

    মাথার মধ্যে একটা বিস্ফোরণ হল যেন সমাদৃতার। এইটুকু ছেলেটা মুহূর্তের মধ্যে কি সাংঘাতিকভাবে নিজের রূপ বদলাতে শিখে গিয়েছে! একটু আগের ওই ফোন কলটা পুরো দাঁড়িয়ে না শুনলে সে এই কথাগুলো বর্ণে বর্ণে বিশ্বাস করে বসত আজ। যেমন করে উত্তমকে বিশ্বাস করেছিল, বারবার, এমনকি তার অসৎ কাজগুলো ধরা পড়বার পরেও! যতক্ষণ না নিজে চোখে তার প্রমাণ দেখেছে ততদিনও কি সরল মুখে উত্তম তাকে বিশ্বাস করিয়ে যেতে পেরেছে যে সে নির্দোষ! বিল্টুর চোখে সে ওর বাপের ছায়া দেখতে পাচ্ছিল—

    খেলনার টুকরোগুলোর ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়া ছেলেটার হাত ধরে রূঢ় একটা হ্যাঁচকা টান মেরে সরিয়ে দিয়ে টুকরোগুলোকে মুচড়ে ভেঙে ভেঙে জানালার দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছিল সে। পেলমেটে, আধা বন্ধ জানালার কাচে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ভেঙেচূরে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ছিল ঘর জুড়ে—

    “এ কী? কী হচ্ছে বৌদি? কী পাগলামি করছেন আপনি? সরুন সরুন—ইশ হাতটা কেটে গেছে যে সে খেয়ালও করেন নি--”

    কৃষ্ণা তাড়াতাড়ি এসে তাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে করতেই বিল্টুর দিকে তাকিয়ে বলছিল, “কাঁদে না সোনা। ওঠো। দৌড়ে গিয়ে গিয়ে ও ঘর থেকে স্পিরিটের শিশিটা নিয়ে এসো তো! মায়ের হাত কেটে গেছে দেখছো না!”

    ***********

    রাত অনেক হয়েছে। সমাদৃতার ঘুম আসছিল না। আজকাল মাঝেমাঝেই সারারাত প্রায় জেগে থাকে সে। ডাক্তার একটা হালকা সিডেটিভ দিয়েছিলেন। সেটাতেও আজ কাজ হয় নি। তার বুকের কাছে গুটিশুটি মেরে এসে ঘুমিয়েছে ছেলেটা। নাইট ল্যাম্পের মায়াবি আলোয় তার ঘুমন্ত মুখটায় কী অসীম সারল্য মাখা! কিন্তু বেশিদিন আর থাকবে না। উত্তম তার ছেলেকে ছাড়বে না। মাদ্রিকেও ছাড়বে না সে। তার কাছে এটা পুরুষের অধিকারের প্রশ্ন। মা বাবাকে দলে টেনেছে, এবার তার একেবারে বুকের কাছটাতে টান দিতে শুরু করেছে ধরে! সব মেনে নিতে হবে মাদ্রিকে। মানিয়ে ছাড়বে উত্তম—

    —মাথার মধ্যে ফের সেই পরিচিত চিরিক দিয়ে ওঠা রক্তস্রোতের আভাস পেয়ে সমাদৃতা একরকম জোর করেই নিজেকে সংযত করল। এভাবে চলা যাবে না। আজকাল মনের ওপরের চাপটা তার কাজকর্মেও ছাপ ফেলতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। সেদিন মান্থলি মিটিং চলাকালিন তুচ্ছ একটা কারণে মেজাজ হারিয়ে অনাবশ্যক চ্যাঁচামেচি করবার পর ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর সৌমিদি তাকে ডেকে বলেওছেন কথাটা। সৌমিদির স্বামী মারা গেছেন কিছুকাল আগে। দুটো ছেলেকে একা মানুষ করছেন। সমাদৃতার ব্যাপারটা তাঁর খানিকটা জানা। খানিক সহানুভূতিও আছে তার ওপরে। কাজেই তার আচরণে বিরক্ত হলেও সংযতভাবেই যা বলবার বলেছেন। কিন্তু বেশিদিন এভাবে চলতে পারে না।

    কিন্তু—কী করবে সে? কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে? আকারে ইঙ্গিতে সৌমিদিও সেদিন সেই একই কথা বললেন- হাজার হোক স্বামী। ছেলেটাকে তো দেখবে। নিজে যা করেছে তার দায়িত্ব তো তোর নয়! তার ভালোমন্দ সে নিজে বুঝবে। তোর আর তোর ছেলের জন্য তার কাছে তোর যেটুকু পাওনা তা তুই বুঝে আদায় না করে নিয়ে এভাবে সাফার করছিস কেন?

    —আচ্ছা, শোভন? শোভনও কি সব শুনলে তাকে সেই একই উপদেশ দেবে? বলবে ফিরে যা মাদ্রি? নাঃ। কারো উপদেশ, পরামর্শের প্রয়োজন নেই তার। রাস্তা একটা খুঁজে সে পাবেই। যে উত্তমকে সে ভালোবেসেছিল, শোভনের হাত ছেড়ে এসে যাকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিল, সে মারা গেছে। নিজেকে বিধবা মনে করে সমাদৃতা। উত্তমের এই প্রেতটাকে শেষ হাসিটা সে হাসতে দেবে না কিছুতেই—

    —ঘুমের মধ্যে বিল্টু চিৎকার করে কেঁদে উঠল হঠাৎ। হাত বাড়িয়ে পাশে তাকে না পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসে মা মা বলে কাঁদছে। সমাদৃতার মাথা থেকে তার সারারাত্রের সমস্ত উদ্বেগের বোঝা এক মুহূর্তের জন্য সরে গেল। তাড়াতাড়ি বিছানায় ফিরে গিয়ে ভয় পাওয়া সন্তানটিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “এই তো আমি, বাবা—এই তো”

    কিছু একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে বিল্টু। মায়ের হাতের বন্ধনে এসেও তার কেঁপে কেঁপে ওঠা আর চিৎকার থামে না। খুব অসহায় ঠেকছিল সমাদৃতার। কেউ নেই চারপাশে। গলন্ত সীসের মত আওয়াজটা তার চেতনাকে এসে বিদ্ধ করছিল বারবার। কাকে বলবে সে , কী তীব্র অসহায়তার একটা বোধ গড়ে তুলছে ওই চিৎকারটা তার মধ্যে। একটা শিশুর চূড়ান্ত ভয়ের মুহূর্তে মা হয়েও সে তাকে ভরসা দিতে পারছে না--

    —তাড়াতাড়ি তাকে এক হাতে জাপটে ধরে রেখে অন্য হাতে বুকের কাপড় সরিয়ে একটা স্তন গুঁজে দিল সে তার মুখে। শিশুটির ঈষৎ উত্তপ্ত শরীর বড় মধুর উষ্ণতার জোগান দিচ্ছিল তার শীতার্ত শরীরে। দুধহীন বুকটি তার, কি পরম নির্ভরতায় দুহাতে আঁকড়ে ধরে ঠোঁট দিয়ে বৃন্তটির সঙ্গে খেলা করে তার সন্তান, বারে বারে গুঁতো দেয় দুধের আশায়। ফোঁপানি ধীরে ধীরে কমে আসছিল তার—

    খানিক বাদে সে আবার ঘুমিয়ে পড়তে সাবধানে তার হাত ছাড়িয়ে উঠল সমাদৃতা। হালকা একটা চাদরে তাকে মুড়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ফ্যান বন্ধ করল। বাইরে ভোর হয়ে আসছে। ঠান্ডা ঠান্ডা পড়েছে একটু। মশারিটা সাবধানে গুঁজে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলো সে। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে কখন যেন। ভোর ভোর ঠান্ডা হাওয়া ছেড়েছে। ভারি আরাম লাগছিলো তার।

    ***********

    “বৌদি, ও বৌদি,” তার কানের কাছে মুখ এনে মৃদু গলায় ডাকছিলো কৃষ্ণা, “কখন থেকে এখানে এসে বসে আছেন বলুন তো! আটটা তো বাজে প্রায়।”

    বারান্দার ইজিচেয়ারটাতে আধশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সমাদৃতা। ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, “সেকী? আমায় ডাকোনি কেন? বিল্টুর স্কুল--”

    “শ্‌-শ্‌- আস্তে কথা বলুন বৌদি। ছেলের গা’টা গরম মতো হয়েছে একটু। এইমাত্র গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম। ঘুমোচ্ছে, ঘুমোক। আমি ইশকুলের গাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে কাল আসতে বলে দিয়েছি।”

    “কোথায়,দেখি--”

    “আপনি এখানে চুপটি করে বসুন তো! ভয় পাবার মত কিছু হয় নি। ও একটু তাড়সে গা গরম হয়েছে। কাল যা হল! কিন্তু আপনিও সারারাত যে জেগেই রয়েছেন সে তো মুখ দেখে বুঝতে পারছি। চা করে এনেছি। আগে চা খান। ফ্রেশ হয়ে নিন। তারপর অন্য কথা।”

    “ফোনটা তাহলে একটু এনে দাও টেবিলের ওপর থেকে। এডিএম কে একটু বলে দি আজকে দেরি হবে আমার--”

    কৃষ্ণা মাথা নাড়ল, “অফিস কামাই করবার দরকার নেই। ভাববেন না। আপনি নিশ্চিন্তে বেরোন। আমি ঠিক দেখে রাখবো ছেলেকে। দরকার হলে আপনাকে ডাকবো।”

    ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ একটা অপরাধবোধ মাথা তুলছিল সমাদৃতার মনে। কৃষ্ণার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে খানিকটা আপনমনেই বলল, “খেলনাটা ওভাবে ভেঙে ফেলতে ছেলেটা খুব কষ্ট পেয়েছে। ও তো আর অতকিছু--”

    “ও আপনি ভাববেন না। বৌদি। আমি সব গুছিয়ে তুলে রেখেছি। দুএকটা টুকরো নষ্ট হয়েছে। বাকিটা ঠিকই আছে। ছবি মিলিয়ে মিলিয়ে দুপুরবেলা বসে বসে বানিয়ে দেবো’খন আমি। ছেলেমানুষ, ভুলে যাবে ঠিক! ইশ হাতটা অনেকটা কেটেছে দেখছি কাল! দাঁড়ান গরম জল করে পরিষ্কার করে দিই। নইলে এ থেকে কিছু একটা বাঁধলে পরে সামলাবে কে, হ্যাঁ?”


    || ১০ ||

    “এই যে বিল্টুবাবু—দেখি দেখি, কত বড় হয়ে গেছো! একেবারে জেন্টলম্যান!” ব্রতীনের বাড়িয়ে ধরা হাত থেকে গালটা সরিয়ে নিয়ে বিল্টু সমাদৃতার কাছে আরো ঘেঁষে এলো।

    সমাদৃতা হাসছিল, বলে, “লজ্জা কী রে? যা! মামা হয় তো! তোর মনে নেই, আগে কতবার ব্রতীনমামার কাঁধে চেপে ঘুরেছিস!”

    বিল্টু গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। এই অচেনা মানুষটিকে সে চিনতে পারছে না মোটেই। তাকে বিশেষ পছন্দও হচ্ছে না তার। লোকটার পাশে একটা বউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছিল। এইবারে সে এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “ছেলেটাকে তোমরা এমন করছো কেন বলো তো?” এই বলে তার সামনে নিচু হয়ে বড় বড় চোখদুটো তার চোখে রেখে বলল, “তুমি তো আমাকেও চেনো না, তাই তো?”

    বিল্টু চোখ না সরিয়েই দুদিকে মাথা নাড়ল আবার।

    “বেশ। এসো আলাপ করা যাক। আমার নাম শর্মিষ্ঠা। আমি এখানে এলাম। তোমাদের হাউজিং-এ থাকবো। এবার তোমার নাম বলো।”

    এই ব্যাপারটা বিল্টুকে ইশকুলে শিখিয়েছে অনেকবার। সে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, “আমার নাম সুশোভন প্রধান। গ্ল্যাড টু মিট য়ু--”

    তার হাতটা ধরে জোরে জোরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে শর্মিষ্ঠা বলল, “গ্ল্যাড টু মিট য়ু জেন্টলম্যান। তাহলে আমরা বন্ধু তো?”

    এই বউটাকে বিল্টুর বেশ ভালো লাগছিলো। গালটাল টিপে দেয়নি। সুন্দর একটা গন্ধ মেখেছে। হাতটাও শক্ত নয়। ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বলল। তারপর কি মনে হতে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি আমাদের হাউজেই থাকবে বুঝি? কোন ঘরটায় থাকবে?”

    হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠল ব্রতীন, “সে কী রে? একেবারে হাউজে নিয়ে তুলে তারপর ঘরটরও ঠিক করে ফেলছিস? আমার তাহলে কী হবে?”

    বিল্টু খুব গম্ভীর মুখ করে সন্দেহজনক লোকটার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার নতুন আলাপ হওয়া বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করল, “এই লোকটা খারাপ লোক বুঝি?”

    এইবারে মা, সেই লোকটা আর শর্মিষ্ঠা তিনজনে মিলে একসঙ্গে এমন হাসতে শুরু করল যে বিল্টুর কানটান লাল হয়ে গেল একেবারে। তাড়াতাড়ি হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছিল সে, কিন্তু বউটা তাকে ছাড়লে তবে তো! উলটে চেপে ধরে তার দুগালে দুটো চুমু খেয়ে বলে, “খারাপ লোকই তো। ভীষণ খারাপ লোক। তবে এখন একটু ভালো হয়েছে। লোকটার হাতে কী আছে দ্যাখ?”

    বিল্টু সন্দেহের চোখে সেদিকে তাকিয়ে দেখে লোকটার হাতে একটা বড়ো চকলেটের মোড়ক। সে তাকাতেই মোড়কটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “এটা তোর জন্য। চকোলেট খেতে ভালোবাসিস?”



    “উঃ। আবার একটা চকলেট! এই চকলেট খেয়ে খেয়ে ছেলেটার দাঁতটাতগুলো একেবারে গেল, এই এই, তুই নিবি না। আমার হাতে দে!” বলতে বলতে চকলেটটা একেবারে ছোঁ মেরে বিল্টুর হাত থেকে ছিনিয়ে নিল সমাদৃতা। লোকটা মুখে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে বলল,“এ মা। তোর মা তোর চকলেটটা নিয়ে নিল যে! একা একা খাবে। তোকে দেবে না।”

    ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভেবে দেখল বিল্টু , তারপর বলল, “মা আমায় টিফিনে দেবে।”

    “নাঃ। মাদ্রিদি, তোমার ছেলের সঙ্গে কথায় পারা খুব মুশকিল। ” ব্রতীন হাসছিল।

    “ওই কথাই তো আমার সমস্যা। যতক্ষণ জেগে আছে, বকবক করেই চলেছে। মাথা ধরিয়ে দেয় এক একবার-”

    “আমার বন্ধুর নামে এমন সব বদনাম দিলে আমরা এখানে আর থাকবোই না মাদ্রিদি,” বলতে বলতে বিল্টুর হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে শর্মিষ্ঠা বলল, “এই, চলো আমরা বাইরে গিয়ে একটু ঘুরে আসিগে। জায়গাটা তুমি আমায় একটু চিনিয়ে দাও দেখি!”

    প্রস্তাবটা বিল্টুর বেশ পছন্দ হয়েছে দেখা গেল। উঠে দাঁড়িয়ে নতুন বন্ধুটির হাত ধরে সে বলল, “আমাদের এখানে একটা তিস্তা নদী আছে। তুমি দেখতে যাবে? ”

    “উঁহু। তিস্তার দিকে এক পা-ও যাবে না বিল্টু এই বলে দিলাম। তুমি সামনের পার্কে একটু ঘুরে তারপর মামিমাটাকে নিয়ে সোজা বাড়িতে নিয়ে চলে যাও,” বলতে বলতে সমাদৃতা শর্মিষ্ঠার দিকে ফিরে বলল “তুমি একটু ঘুরেটুরে ওকে নিয়ে হাউজিং-এ চলে যাও। রিকশায় সার্কিট হাউস থেকে পনেরোটাকা নেবে। কৃষ্ণা বাড়িতে আছে। তাকে বোলো, চায়ের জলটল চাপিয়ে দেবে। আমি ব্রতীনের সঙ্গে দুটো কথা সেরে ওর সঙ্গে চলে আসছি।”

    “আগের কোয়ার্টারেই আছেন নাকি?”

    “না। বদলেছি। এফ থ্রি বাই থ্রি। বিল্টু চেনে। অসুবিধে হবেনা। দরকার হলে বাড়িতে ফোন কোরো। কৃষ্ণা বেরিয়ে এসে নিয়ে যাবে। বিল্টু নম্বর জানে।”

    “ওসব নিয়ে আপনি কিছু ভাববেন না মাদ্রিদি। বিল্টু সঙ্গে থাকলে আমার কোন চিন্তাই নেই--” বলতে বলতে হাত ধরাধরি করে তারা দুজন বাইরে বের হয়ে গেল।

    চুপ করে মুখোমুখি বসেছিল ওরা দুজন। ব্রতীন খানিক বাদে বলল, “ব্যাপারটা খুব জড়িয়ে গেল মাদ্রিদি। লোকটা যেভাবে কাউন্টারঅ্যাটাক শুরু করে দিয়েছে তাতে আমাকে সরিয়েই ব্যাপারটার শেষ হবে না। শোভনদা মধ্যে থেকে একরকম বিনা কারণে জড়িয়ে গেল জিনিসটায়। শোভনদার ওপরে যা ক্ষেপেছে তাতে ওকে অমরেশ বাগচি ছাড়বে না।”

    সমাদৃতা মাথা নাড়ল, “নিজেকে দোষ দিও না ব্রতীন। শোভনের ওপরে অমরেশ বাগচিদের চোখ পড়াটা অবধারিত ছিল। তুমি তো একটা উপলক্ষ্যমাত্র। আসলে শোভনের একটা বড় অ্যাসেট রয়েছে। ইলেকশন আসছে সামনে। ওই অ্যাসেটটার ওপরে পলিটিক্যাল পার্টিদের নজর পড়তোই। আজ না হোক কাল।”

    “ঠিক বুঝলাম না মাদ্রিদি। কী অ্যাসেটের কথা বলছেন? স্কুলটা?”

    “না। স্কুল নয়। ও দিয়ে পাবলিক রিলেশন হয় না। অ্যাসেট হল শোভনের মেলাটা। গতবার শুরুতেই যা পপুলারিটি পেয়েছে দেখেছিলাম কাগজেটাগজে, তাতে যে কোন পার্টির কাছেই ও মেলাটা একটা লোভনীয় প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। ওকে সরাসরি যে ব্যবহার করা যাবেনা সেটা এদের শোভন গতবারের ব্যবহারেই বুঝিয়ে দিয়েছে। নিজের জায়গায় শোভন একেবারে অনমনীয়। এইবার এই যে ঘটনাটা ঘটে গেল, তার ছুতোয় ওই মেলাটা দখলের জন্য ওর ওপর অ্যাটাকটা আসবে। তুমি দেখে নিও।”

    “ব্যাপারটা আমি এদিক দিয়ে ভেবে দেখিনি মাদ্রিদি। খুব খারাপ লাগছে জানেন? এ সময়টা অন্তত আমি কাছে থাকলেও ওর কিছুটা সাহায্য হতে পারতো হয়তো। পার্সোনাল ফ্রন্টেও তো একটা-- ”

    “আমি জানি। শর্মিষ্ঠার কাছে থেকে খবরটা পেয়েছি,” বলতে বলতে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলো সমাদৃতা, “কী প্রয়োজন ছিল ওর এই মেয়েটাকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়াবার বলতে পারো? একটা পাথর। দুনিয়ায় কারো জন্য নিজের নীতির থেকে একচুল সরে দাঁড়াবে না। এখন যে ঝাপটাটা আসতে চলেছে তাতে ও ফরিদার মুখ চেয়েও একবিন্দু কমপ্রোমাইজ করবে ভেবেছো? করবে না। ডন কুইকজোটের মতন লড়বে,লড়ে মরবে, মেয়েটাকে বাচ্চাশুদ্ধ পথে এনে দাঁড় করাবে। সেটাই যদি করবে তাহলে কেন একটা মেয়েকে এভাবে স্বপ্ন দেখালো ও? আসলে নীতিটীতি কিছু নয় ব্রতীন। সবকিছু নিজের সুখের আর আনন্দের জন্য করে এরা। জাস্টিফিকেশনের বন্দুকটা কেউ রাখে আদর্শের ঘাড়ে, আবার কেউ রাখে তার প্রিয়জনের ঘাড়ে। তার জন্য আর কে মরলো বাঁচলো, কার স্বপ্ন ধ্বংস হল সে’সবের কোন পরোয়া করে না। অনেক দেখেছি আমি—অনেক সহ্য করেছি—সব সমান-- ”

    ঠোঁট কাঁপছিলো সমাদৃতার। তার চোখের উদভ্রান্ত দৃষ্টি ব্রতীনকে কষ্ট দিচ্ছিল। এ কী অবস্থা হয়েছে মাদ্রিদির! খানিক চুপ করে বসে থেকে সে বলল, “ওরকম ভাববেন না মাদ্রিদি। এ বছরের মেলার কিছু কিছু কাজকর্ম তো শুরু হয়ে গেছে দেখে এসেছি। তেমন কোন সমস্যা তো এখনো চোখে পড়েনি। তাছাড়া আগামি মাসে শোভনদা জলপাইগুড়ি আসছে বোধ হয় কয়েকদিনের জন্য। তখন ওর সঙ্গে বসে ঠাণ্ডা মাথায় কথাবার্তা বলে নেয়া যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখবেন।”

    হঠাৎ একেবারে চুপ হয়ে গেল সমাদৃতা। খানিক বাদে শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, “শোভন জলপাইগুড়ি আসছে? হঠাৎ?”

    “ফোকলোর রিসার্চ ইন্সটিট্যুটে কি একটা পেপার পড়তে আসবে বলছিলো।”

    “ফরিদাকে এই অ্যাডভান্স স্টেজে একা রেখে চলে আসবে?”

    ব্রতীন মাথা নাড়লো, “আসতে ওকে হবেই মাদ্রিদি। বলছিল, ভালো টাকা দিচ্ছে ওরা। টাকাটা শোভনের দরকার। আর জানেন তো, হাত পেতে নিজের জন্য ও কারো থেকে কিছু কখনোই নেবে না।”

    একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল সমাদৃতার, “জানি। আজ থেকে তো চিনি না ওকে!”



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments