আজকের দিনটাতে আনন্দ টানন্দ বাদ দিয়ে এই সেমিনার চলছে যে তার জন্যও ওই শ্যামল বিশ্বাসই দায়ী । গতকালই শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল তা বাবু গতকাল এলেনই না । অ্যালফাবেটিক্যালি নাম সাজিয়ে রোজ পাঁচজন করে পেপার প্রেজেন্টেশান চলেছে গত এক সপ্তাহ ধরেই । সুহানা, সমাদৃতা, শোভন আর উত্তম এই চারজনেরই কেবল বাকি ছিল কালকে । ভদ্রলোক বারোটা নাগাদ ফোন করে খবর পাঠালেন, শরীর খারাপ, অতএব আসতে পারছেন না । পরদিন আসবেন । ফোন ধরেছিলেন কে জি । তিনি আবার ড: বিশ্বাসেরই ছাত্র । পরদিন ডিপার্টমেন্টের অনুষ্ঠান জেনেও, প্রাক্তন মাষ্টারমশাইয়ের মুখের ওপর কিছু বলতে পারেননি । কেবল "ঠিক আছে স্যার", বলে ফোন নামিয়ে রেখেছিলেন । ফলে বিপদে পড়েছে ওরা চারজন ।
সবার শেষে বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ উত্তমের পালা এল । শেষ ক্যাণ্ডিডেট । পেপার লিখেছে `প্রাচীন রেড ইণ্ডিয়ান সমাজে রাষ্ট্রচেতনার বিকাশ ।' নামটা শুনেই শ্যামল বিশ্বাস চোখদুটো গোলগোল করে ওর দিকে তাকিয়ে নিয়ে হেড ডিপ ব্রজেনবাবুর দিকে ঘুরে দেখলেন । আধঘন্টার ঝকঝকে কাজ । প্রেজেন্টেশানের পরে প্রশ্নোত্তর পর্বটাও সংক্ষিপ্তই হল । হলে প্রশ্ন করবার মতো লোক বেশি নেই । যারা আছে তারাও কোনমতে ছাড়া পাবার জন্য ব্যস্ত । অবশেষে শ্যামলবাবু একটা মাত্র প্রশ্ন করলেন, "যা লিখেছ তা সত্যি সত্যি আছে না বানিয়ে বানিয়ে লিখেছ ? কোনো বিবলিওগ্রাফি কোথায় পাবো ?"
"হুঁ বুঝলাম । আজকাল এই কী যে এক ইন্টারনেট হয়েছে ! ছেলেমেয়েদের বই পড়বার ইন্টারেস্টটাই নষ্ট করে দিচ্ছে; বুঝলেন ব্রজেনবাবু, আমার বউমাও সেদিন কমপ্লেন করছিলেন, নাতিটি নাকি ক্লাসে অংক দিলে ইন্টারনেটে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে উত্তর জোগাড় করে ফেলছে । কালে কালে কী যে হল-," বলতে বলতেই ফের কী মনে হতে উত্তমের দিকে ফিরে বলেন, "বুঝলাম, কিন্তু-কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে গোটা ব্যাপারটা ! কোথাও পড়েছি কিংবা শুনেছি মনে হচ্ছে এর আগে-"
শোভন সশংকে উত্তমের দিকে তাকাল । এলিয়ট সিলভারস্টাইনের `আ ম্যান কলড হর্স' সিনেমাটার কথা যদি শ্যামল বিশ্বাসের একবার মনে পড়ে যায় তাহলেই সর্বনাশ । সত্তরের দশকের নামী ছবি । দেখেছে নিশ্চয় । ওটাই উত্তমের একমাত্র বিবলিওগ্রাফি । বাকিটা স্রেফ উর্বর কল্পনা ।
উত্তমের অবশ্য হাবেভাবে কোন বিকার নেই । বলল, "দ্যাটস কোয়াইট ন্যাচরাল স্যার । আ ম্যান অব ইওর স্টেচার মাস্ট হ্যাভ নোন অ্যাবাউট দেম লং বিফোর মি-"
চাটুবাক্যে স্বয়ং ঈশ্বর সন্তুষ্ট হন, আর ইনি তো সামান্য মানুষ । শ্যামল বিশ্বাস দেখা গেল বেশ হাসি হাসি মুখ করে মাথা নাড়ছেন । এইবারে, দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করবার সুযোগ আর না দিয়ে উত্তম গম্ভীর গলায় বলল, "নো মোর কোয়েশ্চেনস্ ? দেন থ্যাংক ইউ অল ।"
"উ:, জোর বেঁচে গেছি আজকে । শ্যামলবাবুর যদি একবার সিনেমাটার কথা মনে পড়ে যেত তাহলে-" আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে মাদ্রি ফুট কাটল, "বেঁচে না যাওয়াই উচিৎ ছিল । একেবারে ওস্তাদ জালিয়াত হয়ে গেছিস তুই । আর, বুকের পাটাও আছে বটে । ওই অবস্থায় কি কনফিডেন্টলি দাঁড়িয়ে রইলি ডায়াসে !"
"আরে কনফিডেন্স কি বলছিস ? আমার হাত পা তখন সেঁধিয়ে যাচ্ছে পেটের ভেতরে । দেখলি না কি হড়বড় করে থ্যাংক ইউটা বলে দিলাম !"
"ব্যাপারটা মনে হয় না অত ইজিলি শেষ হবে । বাজি ধর, আজ রাতের মধ্যে শ্যামলবাবু ওই সিনেমাটার ব্যাপারটা ধরে ফেলবে । লোকটা রিসোর্সফুল আছে," পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে শোভন ফুট কাটল ।
"বাজি ধরতে হবে না । আমি তোর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত । তবে মনে পড়লেও ক্ষতি নেই কোনো । মার্কস দিয়ে পেপারটেপার আজকেই সিল হয়ে গেছে । অরুণদা প্যাকেটের ওপরে গালা লাগাচ্ছিল । আমি নিজে দেখে এসেছি ।"
"তবে তো ঝামেলা চুকেই গেছে । ওসব পড়াশোনার কথা বাদ দে এখন । আজকের খাওয়াটা যে মার গেল, তার কী হবে ?" বলতে বলতে সমাদৃতার দিকে ফিরে তাকাল শোভন, "আজকে মেনু কী ছিল রে মাদ্রি ? তুই তো মেনু কমিটিতে ছিলি ।"
সমাদৃতা তার ভারি ব্যাগটার ওপর একটা মৃদু চাপড় মেরে বলল, "চিন্তা করিস না । সব ব্যবস্থা আছে । সেকেণ্ড ইয়ারের প্রিয়াংশু আছে না ? ওকে ফিট করে রেখেছিলাম । আমাদের চারজনের প্যাকেট আলাদা করে অরুণদার হাতে দিয়ে গিয়েছে । সুহানা ওরটা নিয়ে ফিরে গেছে । আমাদের তিনজনেরটা আমি নিয়ে এসেছি । স্টেশনে চল, দিচ্ছি ।"
উত্তম হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, "আমারটা আগে বের করে দিয়ে দিবি ? নিয়ে হোস্টেলে ফিরে যাবো ।"
"হোস্টেলে ফিরবি ? বাড়ি যাবি না ?"
"বাড়ি যাবার কোন লক্ষণটা দেখলি বল তো ? খালি হাতে ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে সোজা তোদের সঙ্গে আসছি । বাক্স-বেডিং কিছু আছে সঙ্গে ?"
"হুঁ তা বটে । কিন্তু ছুটি তো পড়ে গেল । বাড়ি যাবি কবে ?"
"দেখি কবে যাই । ছুটির মধ্যে হপ্তাখানেকের জন্য কখনো ঘুরে আসবো গিয়ে । বাকি ভেকেশানটা হোস্টেলেই থেকে যাবো ঠিক করেছি । জানুয়ারি অবধি ও'সব বাড়িটাড়ি সব অফ ।"
"অক্টোবরের পর কী করবি ? ফাইনাল হয়ে গেলেই তো তাড়াবে ।"
"সে বন্দোবস্ত করেই রেখেছি ম্যাডাম । সুন্দরনগর সীমান্ত স্টেশনের কাছে একটা বাড়িতে পেয়িং গেস্ট নেয় । সেখানে কথাবার্তা বলা হয়ে গেছে । পরীক্ষা দিয়েই শিফ্ট করে যাবো । হোস্টেল চার্জ থেকে স্লাইট বেশি খরচ কিন্তু তিনটে মাসের তো ব্যাপার । কুলিয়ে যাবে । তারপর, প্রিলিমিনারিটা ক্লিয়ার করতে পারলে তখন আবার ফিরে এসে ফের কিছুদিন-"
শোভন হাসছিল । উত্তম থামতে বলে, "এ তো একেবারে সাধনার স্বার্থে কৃচ্ছ্রসাধন ও গৃহত্যাগ ! চাকরির পরীক্ষা না দিয়া পিতৃমাতৃসন্দর্শন নিষেধ । কী কঠোর ত্যাগ !!"
"না রে । তা না । বাড়ি যেতে কার ইচ্ছেটা না করে বল তো ! কিন্তু ওখানে গেলে বইপত্রের বড় প্রবলেম হবে । এখানে সেন্ট্রাল লাইব্রেরিটা একটা বড় ফেসিলিটি, বুঝলি ?"
হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটে মাদ্রি বলল, "ওসব যা-ই হোক না কেন, এখন তুই আমাদের সঙ্গে স্টেশনে যাচ্ছিস । একসঙ্গে খেয়ে, আমাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে তবে যাবি । এখন, শান্তিতে খেতে চাইলে কথা না বলে তাড়াতাড়ি পা চালা তো ! ভিড় বাড়বার আগে স্টেশানে গিয়ে একটা বেঞ্চি রিজার্ভ করে রাখ । পরেশের চায়ের দোকানের পেছনের দিকটা চেষ্টা করবি । ওদিকটায় তত লোক যায় না । আমি পেছন পেছন আসছি । যা !"
দ্রুতপায়ে এগিয়ে চলা পুরুষদুটির দিকে চোখ রেখে ধীরে ধীরে হাঁটছিল সমাদৃতা । জীবনের সব হিসেব মেলে না । মিলতে চায় না । কেন, কে জানে ! উত্তম ভালো ছেলে । খুব কেরিয়ারমনস্কও বটে । ওপরের দিকে ওর চোখ আটকানো । অনেক উঁচুতে উঠবে ও । উঠতে বাধ্য । মাদ্রির ওপরে ওর গভীর দুর্বলতা আছে । সে কথা মাদ্রি জানে । ছেলেরা আর সব কিছু লুকোতে পারে, কিন্তু মেয়েদের কাছে তাদের ইমোশন কিছুতেই লুকোনো থাকে না । একটা নিশ্চিত, শান্তিময় ও প্রেডিক্টেবল জীবন ও দিতে পারে মাদ্রিকে । কিন্তু শোভন ? কোন পথে যাচ্ছে ও ? মাদ্রি বারবার জানতে চেয়েছে । বুঝতে চেয়েছে । কিন্তু নাগাল পায়নি । ওর আপাত সরল খোলসটার মধ্যে রহস্যময় কিছু একটা আছে । পরিচিত জীবনের বাইরে একটা অন্যতর জীবনের ইশারা । ওই ইশারাটাই মাদ্রিকে এক অমোঘ শক্তিতে টানে । আবার বিব্রতও করে । একদিকে এক নিশ্চিন্ত জীবনের হাতছানি, আর অন্যদিকে অজানার সুতীব্র আকর্ষণ এই দুইয়ের বিচিত্র টানাপোড়েন আর তার ভালো লাগছে না আজকাল । বাবা ঠিকই বলেছিল । এর একটা মীমাংসা প্রয়োজন এইবারে - ।
পৌনে সাতটার আপ সুন্দরনগরটা আসতে তাতে উঠে পড়ল মাদ্রি আর শোভন । একটা স্টেশন উজিয়ে গিয়ে টার্মিনাল স্টেশন সুন্দরনগর প্রান্তিক । সেখান থেকে ফের ডাউনের দিকে ফিরবে গাড়ি । শোভন সুন্দরনগর মেইনে নেমে আপে গেদে লোকাল ধরবে । মাদ্রি এই গাড়িতেই বেরিয়ে যাবে সোদপুর । সুন্দরনগর মেন অবধি একসাথে যাওয়া ।
প্রান্তিক স্টেশনে পৌঁছুতে গাড়ি একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল । শোভন নীচে গিয়ে শশা কিনে আনল দু'টো । নুন লংকার গুঁড়ো মাখা খোসা ছাড়ানো একটা ফল জানালার মধ্যে দিয়ে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে ধরল সমাদৃতার দিকে । শশাটা নিয়ে তাতে ছোট্ট একটা কামড় বসিয়ে সমাদৃতা বলল, "ভেতরে এসে বোস না ! বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ?"
"বাইরে বেরিয়ে দেখ । তবে বুঝবি । ভেতরটা বদ্ধ গুমোট । এখানে ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে ।"
সমাদৃতা ভ্রুভঙ্গী করে বলল, "বাজে কথা বলিস না তো ! দিব্যি ফ্যান ঘুরছে মাথার ওপর, আর তোর গুমোট লাগছে । আয়, উঠে আয় । নইলে ঝপ করে কখন ট্রেন ছেড়ে দেবে তখন বুঝবি মজাটা । পরের গেদে রাত সাড়ে দশটায় । শান্তিহাটে পৌঁছে ইষ্টিশনে শুয়ে থাকতে হবে ।
শশা চিবোতে চিবোতে শোভন বলল, "সেটা অবশ্য খুব কষ্টের কিছু হবে না । গরমকাল । খোলা আকাশের নিচে শুতে ভালোই লাগবে একটা রাত । থেকেওছি তো কতবার ।"
"হুঁ; তা থেকেছিস । তোর পক্ষে তো অসম্ভব কিছুই না । কিন্তু সেই গতবারের মতো রাতে পাশে এসে যদি কুকুর শুয়ে থাকে, তবে তো-"
বলতে বলতেই দীর্ঘ একটা হুইশিল বাজিয়ে ট্রেন নড়ে উঠল । জানালার ফ্রেম থেকে শোভনের মুখ উধাও । দৌড়ে এসে দরজার রডটা ধরে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে কামরার ভেতর উঠে এল সে । তারপর ট্রেনের দুলুনির সাথে তাল রেখে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে এল সমাদৃতার কাছে ।
"বোস শোভন । তোর সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে ।"
"বল না । আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনছি ।"
হঠাৎ বিরক্ত গলায় সমাদৃতা বলল, "আ: যা বলছি শোন । আগে এখানে এসে বোস । অত ঘাড় উঁচু করে আমি কথা বলতে পারবো না ।"
তার রুক্ষ গলায় কোথায় যেন একটা অধৈর্যের স্পর্শ ছিল । শোভন নীরবে তার পাশে এসে বসল । পা দুটো সামনের সিটে তুলে দিয়ে প্রায় আধশোয়া অবস্থায় বলল, "বল" ।
"শোভন তোকে একটা রিকোয়েস্ট করব । আমাদের সঙ্গে বি সি এস-টায় তুই বোস । যদি একান্তই না বসতে চাস, নেট বা গেটে অ্যাপিয়ার কর, কিংবা অন্তত ব্যাংকের পি ও তে । কিছু একটা কর শোভন । তোকে আমি জানি । যা করবি সেটাই পাবি তুই ।"
" না রে ! উত্তমও মাস কয়েক আগে আমায় এই রিকোয়েস্টটাই করেছিল । বেশ প্রেশারাইজও করেছে । ওর ধারণা আমার বি সি এস-এ বসাটা খুব জরুরি প্রয়োজন ।"
"কেন সেটা জরুরি সে কথা কিছু বলেনি ?"
"ও তো বলবার প্রয়োজন নেই ! দেশসেবা, কেরিয়ার, এটসেটরা এটসেটরা সে সব স্ট্যাণ্ডার্ড ফ্রেজগুলো কে না জানে !"
"ও । বলবার প্রয়োজন নেই । সব জানিস তুই । পড়াশোনায় সেরা ছাত্র । ক্লাসের টপার । প্রফ-দের নয়নমনি । তোর তো লেভেলটাই আলাদা । এইসব পাতি লেভেলের পরীক্ষা দেবার প্রয়োজন কেবল ওই সব কারণেই, তাই তো ? আচ্ছা শোভন তুই একবার আমার কথা ভেবেছিস ? আমার জন্য তোর এই পরীক্ষাগুলো দেয়া প্রয়োজন সেটা কি তোর মাথায় কখনো এসেছে ?"
তার তীব্র তীক্ষণ গলার স্পর্শে চমকে উঠে ঘুরে দেখল একবার শোভন । তারপর বলল, "তোর জন্য ! মানে-"
বড় বড় ভেজা চোখদুটি তার দিকে ঘুরিয়ে ধরে সমাদৃতা বলল, "এতেও যদি বুঝে না থাকিস, তাহলে তোকে আর বুঝতে হবে না শোভন । তোর সম্ভবত সে ক্ষমতাটাই নেই ।"
চুপ করে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে রইল শোভন । তারপর খুব আস্তে আস্তে বলল, "মাদ্রি তুই একবার ঠাণ্ডা মাথায় আমার কথাটা শোন । ভবিষ্যত নিয়ে প্ল্যান তো আমারও একটা আছে । আমি যা করছি বা যা বলতে পারিস করবার প্ল্যান করছি সেটা অন্তত একবার-"
হঠাৎ কৌতুহলী চোখে তার দিকে চেয়ে মাদ্রি বলল, "কী প্ল্যান রে ? বিদেশ যাবি ?"
ম্লান হাসল শোভন । তারপর বলল, "বিদেশই বটে । অন্তত তুই যে গণ্ডিটায় থাকিস, ভবিষ্যতেও থাকবার প্ল্যান আছে হয়তো, তার কাছে সেটা একটা ফরেন ল্যাণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয় ।"
"হেঁয়ালি ছাড় শোভন । সুন্দরনগর মেন স্টেশন ঢুকছে । সময় নেই বেশি ।"
বনাঞ্চল স্টেশন ছাড়িয়ে ট্রেন তখন তীব্র এক বাঁক নিয়ে পূর্ব থেকে দক্ষিণমুখী হচ্ছে । গতি কমে আসছিল তার । উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শোভন সমাদৃতার দিকে তাকিয়ে বলল, "শোন মাদ্রি । গ্রামের পাখি ডানা গজালেই শহরে উড়ে যায় । আমি সেরকমভাবে উড়ে যাবো না বলে ঠিক করেছি । কিছু কাজ আছে আমার । ওই গ্রামভিত্তিক কাজ । এইবারে তাতে পুরোপুরিই হাত লাগাবো । কেরিয়ার আমার ওইখানে । ওই আমার কর্মক্ষেত্র ।"
"তুই- ফিরে যাবি ? আর আ-আমি ? আমি যে- ?"
"মাদ্রি দেখ, তোর সঙ্গে পাঁচটা বছর একসাথে পড়াশোনা করেছি; গানের আসরে, সিনেমায়, আড্ডায়- একসাথে বড় হয়েই উঠেছি বলা যায় আমরা । তুই আমার খুব ভালো সঙ্গী । আ-আমি-আমি-ধুর-রোমান্টিক সংলাপ আমার ভালো আসে না । সোজাসাপটা একটা কথা তোকে বলি, তুই যদি আমার মিশনটায় আমার সঙ্গে থাকিস, তবে একসঙ্গে আমরা ভালো থাকবো । থাকবি তুই ?"
গাড়ি সুন্দরনগর মেন স্টেশনে ঢুকে প্ল্যাটফর্মে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে । শোভন উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে কামরার ভেতরে বসা সমাদৃতার দিকে চাইল একবার । আনুভূমিক চারটি গরাদের ব্যবধানে দুটো মুখ । একটুক্ষণ তার দিকে চেয়ে দেখে শোভন বলল, "কী রে ? জবাব দিলি না ?"
ঠোঁটে প্রায় জোর করে এক চিলতে হাসি এনে মাদ্রি বলল, "দাঁড়া একটু ভেবে দেখি । আ-আমি যে একেবারে অন্যরকমভাবে ভেবেছিলাম । নতুন করে ভাবতে হবে আমায় সবকিছু । একটু সময় চাই আমার শোভন ।"
"সময় নে মাদ্রি । ভালো করে ভেবে নে । এ রাস্তায় অনেক স্যাটিসফ্যাকশনও আছে আবার কষ্টও কম নেই । আমি তোর ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না ।"
মাথা নীচু করে একটুক্ষণ বসে রইল মাদ্রি । তারপর হঠাৎ তার দিকে ঘুরে তীব্র চোখে তাকিয়ে বলে উঠল, "কিন্তু, আমি চাপিয়ে দিতে চাই । পাগলামো করা তোর চলবে না । জেনে রাখ শোভন, এই পরীক্ষাটা তোকে দিতে হবে আমার সঙ্গে । অ্যাট এনি কস্ট । তোর মিশন তোকে ছাড়তে বলছি না একেবারে । ডবলু বি সি এস এগজিকিউটিভ-এ পেয়ে গেলে সারাজীবন সরকারি শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে তোর গ্রামসেবা চালাতে পারবি তুই । আর তারপর, তোর আদর্শের জন্য তোর মিশন রইল, আর তোর বাকি জীবনটার দেখাশোনার জন্য আমি-"
"কিন্তু মাদ্রি-"
"এটা আমার ডিম্যাণ্ড শোভন । তুই আমায় পুরো চিনিসনি এখনো । এ ডিম্যাণ্ডটা তোকে ফুলফিল করতেই হবে । আমি করিয়ে ছাড়বো তোকে -"
তার কথাটা শেষ হবার আগেই দীর্ঘ একটা হর্ন বাজিয়ে ট্রেনটা নড়তে শুরু করল এইবারে । সার সার আলোকিত কামরাগুলো তার পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে সামনের অন্ধকারের দিকে । এগিয়ে যাওয়া একটা জানালা থেকে একটা হাত বেরিয়ে ছিল । মাদ্রির হাত । খানিক পরে সেটাও মিলিয়ে গেল । পড়ে রইল উঁচু উঁচু স্তম্ভের মাথায় জ্বলা মৃদু ইলেকট্রিকের আলোয় আলোকিত নির্জন সেই প্ল্যাটফর্ম ও তাকে ঘিরে একরাশ অন্ধকার ।
হাঁটতে হাঁটতে ব্রাঞ্চ প্ল্যাটফর্মের একেবারে উত্তরে প্রান্তে পৌঁছে তার ঢাল বেয়ে রেললাইনে নেমে এল শোভন । তারপর একের পর এক লাইন পেরিয়ে মেন লাইনের আপ প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে চলল । সরাসরি উল্টোদিকে রেলের এলাকা ছাড়িয়ে স্টেশনের পুবপাশে সঙ্গম সিনেমাটা দেখ যাচ্ছে । নাইট শো শুরু হয়ে গেছে । দুলহানিয়া নামে একটা হিন্দি ছবি চলছে এখন । সিনেমা হলের গায়ের বিরাট পোস্টারে ঘোমটা পরা একটা তরুণ মুখ । ঝকঝকে উজ্জ্বল হাসি । পাশে ইনসেটে একটা দুধসাদা গাড়ির ব্যাকগ্রাউণ্ডে দুই সদ্যবিবাহিতের উদ্দাম, সহর্ষ জড়াজড়ি । সেই দিকে এক ঝলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল শোভন । মাদ্রি যে কথাটা বললো, সেটা খুব খারাপ কিছু কি ? কিন্তু -
- স্টেশনের মাইকে আপ গেদে লোকালের অ্যানাউন্সমেন্ট শোনা যাচ্ছিল । সে দ্রুত পা চালালো ।
বাখারি চাঁছতে চাঁছতে ঘুরে দেখল শোভন । প্রভাত এসে বেড়ার বাইরে দাঁড়িয়েছে । দা টা রেখে উঠে এসে দরজা খুলে দিল সে । মেহেন্দির বেড়ার গায়ে একখণ্ড ফাঁকা জায়গা । সেইখানে বাখারির দরজা । তার পাল্লা সরিয়ে সাইকেল ভেতরে ঢোকাতে ঢোকাতে বললো, "গানে যাবে নাকি ?"
"কোথায় ?"
"মনোহরগঞ্জ । ইরশাদ ফকিরের বর্ষী আছে কাল । আজ বিরামনগর থেকে ভুবন ফকির এসেছিল । সেই খবর দিল ।"
"ভুবনদা মুরলীপুর এসেছিলো ? কই এদিকে এলো না তো ?"
"সেই কথাই তো বলতে এসেছি শোভনদা । ভুবন ফকির বেজায় তাড়ায় ছিলো । নাকি ইরশাদের ব্যাটা মনজুর তাকে ডেকে পাঠিয়েছে । জোগাড়যন্তরের কাজে লোক দরকার । আজই সে তাই মনোহরগঞ্জে গিয়ে উঠবে । যাবার আগে একবার মুরলীপুরে এসে পাঁচুগোপাল বাবার আড্ডায় খবরটা দিয়ে বলে গেছে এ দিকের লোকজনকে খবর পৌঁছাতে । খবরটা দিয়েই ভুবনদা ছুটে চলে গেল বাস ধরতে । সন্ধ্যাসন্ধ্যায় পৌঁছে যাবে নাকি ।"
"আতাখালির আড়াইটার বাসটা ধরবে তো ? ওতে রাত ন'টার আগে পৌঁছোবার কোনো চান্স নেই । রাস্তার যা সাংঘাতিক অবস্থা ।"
"সে কি গো ? সেই মাসচারেক আগে সেবার তুমি যখন গরমের ছুটিতে এলো তখন দু'জনে মিলে গেলাম যে, সেই সময় তো দিব্যি রাস্তা ছিলো ।"
শোভন ততক্ষণে তার কাজে ফিরে গিয়েছে ফের । একমনে বাখারি চাঁছতে চাঁছতে বলল, "আমি তার পরেও একবার গেছিলাম । ফাইনাল দিয়ে ফিরে আসার পরপরই । বিশ্বকর্মা পুজোর পরদিন । রাস্তার যা হাল হয়েছে চারমাসের মধ্যে, কহতব্য নয় । পৌঁছোতে পৌঁছোতে কোমরে ব্যথা ধরে গিয়েছিল একেবারে ।"
"ইরশাদ ফকির তখন বর্ষীর কথা বলে নাই তোমায় ?"
"উঁহু । আমিও তাই ভাবলাম উদ্যোগ আয়োজন বিশেষ কিছু করবে না, নমো নমো করে সারবে, তাই হয়তো কাউকে কিছু বলে নাই । কিন্তু এতো দেখি এলাহি ব্যাপার । ফকিরের হল কী ?"
প্রভাত হেসে হাত উল্টে দিয়ে বললো, "সে ফকিরের মাথায় অচানক পোকা নড়েছে হবে । তাতে তোমার আমার কী ? আমাদের কাজের সুবিধাই হল । বর্ষীতে সাধারণত নানা জাতের সম্প্রদায় একসঙ্গে এসে জোটে । ভালো নমুনা পাওয়া যাবে । তা তুমি আবার মধ্যিখানে মনোহরগঞ্জে গেলা যে বড় ?"
"সে একটা বিচিত্র যোগাযোগ, বুঝলি ? তোর সাথে যখন গেলাম ওখানে তখন সাবি নামে একটা মেয়ে দুটো নতুন বিয়ের গান শুনিয়েছিল মনে আছে ?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ ! ওই তো কালো মতো লম্বা মতো মেয়েটা তো ? বাপ রে, কী টান গলার ! কী যেন গানটা ? আহা - ওই যে -
     আইজের রাতি থাকিবাম গো"হ্যাঁ । এই তো মনে আছে । তা পরীক্ষা দিয়ে ফিরে আমাদের অধীর মণ্ডলের ছেলের বিয়েতে বরযাত্রী গিয়ে ওই গানটাই ফের কানে এল । কনেপক্ষের দেশ খুলনা । মাস কয় হল এপারে এসেছে । টাকাপয়সা মন্দ আনেনি । গঞ্জে কাপড়ের দোকান দিয়ে বসেছে । রেশন কার্ডও হয়ে গেছে । শাঁসালো মানুষ । আসরে কনের মাসি গাইছিলেন । সাবির মতন অতটা না হলেও বেশ ভালো গলা । গানের ফাঁকে গিয়ে আলাপ করলাম । গানটা আগে শুনেছি শুনে জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় । তা, সাবির নাম শুনে তিনি তো যাকে বলে একেবারে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন । বলেন, সে নাকি এক আশ্চর্য মেয়ে । গোটা জেলায় তার গানের সুনাম ছিল খুলনায় । তারপর তার কপাল পুড়ল । বিধবা হবার পর খারাপ লোকের নজরে গিয়ে পড়েছিল । ওসব দিকে গাঁ গঞ্জের অবস্থা এখন একেবারেই সুবিধার নয় । শেষদিকে তো গানটান একেবারেই বন্ধই করে দিয়েছিল । বাড়ি থেকে বের হত না নাকি । তারপর একদিন একেবারে উধাও হয়ে গেল মেয়েটা । লোকজন ধরে নিয়েছিলো, সর্বনাশ হয়েই গিয়েছে মেয়েটার, তারপর মেরেটেরে ফেলে দিয়েছে হয়তো কোথাও । তা সে মেয়ে যে বর্ডার পেরিয়ে এপারে এসে বহাল তবিয়তে আছে তাই শুনে ভদ্রমহিলা বেশ খুশি হয়েছেন দেখলাম । নিজে ভালো গান, খবরটবরও রাখেন, গুণীর কদর দিতে জানেন । লোকগানের আর্কাইভে জেলাওয়ারি বিয়ের গানের এক একটা চ্যাপ্টার তৈরি করব বলে প্ল্যান করছি বলতে বললেন ওই সাবির কাছেই যেতে । খুলনা জেলার বিয়ের গানের জীবন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া নাকি সাবি । সেই শুনেই ফের যাওয়া ।"
     আইজের রাত্তি ঘুমাইবাম গো
     আমার বাবাজির মন্দিরে
     আমার মায়াজির খাট পালংয়ে গো ॥
     আইজের রাতি থাকিলে গো
     আইজের রাতি ঘুমাইলে গো
     আমার বাবাজি বিছড়াইয়া অয়রাণ অইব
     আমার মায়াজি কান্দিয়া লুটাইব গো ॥
"কাজ হয়েছিল কিছু ?"
"দাঁড়া দেখাচ্ছি ।"
শোভন উঠে গিয়ে হাত ধুয়ে ঘর থেকে দুটো মোড়া বার করে এনে বারান্দায় পেতে দিল । তারপর ফের ঘরে গিয়ে বের করে আনল তার ছোট টেপরেকর্ডারটা আর একবাক্স এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা ক্যাসেটের স্তূপ । তার থেকে খুঁজে খুঁজে একটা ক্যাসেট বের করে টেপ রেকর্ডারে চড়িয়ে বোতাম টিপল সে ।
মিনিট কয়েক খস খস ঘস ঘস আওয়াজ চলবার পর হঠাৎ করেই তীক্ষণ তীব্র একটা গলা যন্ত্রটির থেকে বার হয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ল শেষ বিকেলের ম্লান আলো মাখা উঠোনে আর প্রায় অন্ধকার সেই বারান্দাটিতে । খালি গলায়, প্রাকৃত উচ্চারণে গাওয়া এক মর্মস্পর্শী বিরহগীতি -
     ছোট্টিকালে পালিছি ময়নামেয়েকে চলে যেতে দিতে হবে বিবাহের পরে । অমোঘ সামাজিক বিধির সামনে অসহায়তা ও আসন্ন কন্যাবিরহের বেদনা এই দুই অনুভূতির টানাপোড়েনটি ভারী চমত্কার ধরা পড়েছে তার কথা, সুর আর গায়নে ।
     ময়না বুকের দুগ্ধ দিয়া রে
     সোনামন ময়না রে ।
     আগে যদি জানতাম রে ময়না
     ময়না তোরে নিবে পরে
     আতুর ঘরে নুন খাওয়াইয়া
     মাগো মারিতাম তোমারে রে ।
     সোনামন ময়না রে ।
গান শেষ হতে রেকর্ডারের সুইচ বন্ধ করতে করতে শোভন বলল, "দুটো নব্বই মিনিটের ক্যাসেট পুরো ভরে এনেছি । যে গানটা শুনলি সেটা ঢাকা বাংলা অ্যাকাডেমির পাবলিকেশানে খুঁজে পেয়েছি । বাকি গানগুলো একেবারে নতুন ফাইণ্ড । ভদ্রমহিলার সুরের চালও এদিককার থেকে খানিকটা আলাদা, খেয়াল করেছিস নিশ্চয়ই ।
"হুঁ । গানগুলোর কথা লিখে নিয়েছো ?"
"হ্যাঁ । সব লেখা আছে । অ্যালফাবেটিকালি সাজিয়ে ।"
"স্বরলিপি ?"
"ওই তোর এক ম্যানিয়া প্রভাত । কেন ? স্বরলিপি করবো কেন সেটা বলতে পারিস ? একি শহরবাজারের গান নাকি, যে একবার যদি কেউ বানালো তো তার একেবারে সাতপুরুষের মালিকানা হয়ে গেল গানটার ওপর ! তারপর তার বৌ ছেলে নাতি পুতি মিলে তিন চার জেনারেশান ধরে বন্দুক বাগিয়ে বসে গেল সে গানের পাহারাদারিতে । কেউ এলচুল এদিক ওদিক করলো কি ফায়ার ।" নিজের রসিকতায় নিজেই হা হা করে হেসে উঠল শোভন ।
"কিন্তু এটাও তো ভাববে ? স্বরলিপি করে নিলে গানটা তো বেঁচে থাকে ! অন্তত পস্টারিটির জন্য তার আদি বিশুদ্ধ রূপটার একটা দলিল তো থেকে যায় !"
"না প্রভাত । তোর দৃষ্টিকোণটা একটু বদলা । লোকগানের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটাকে একটু অন্যভাবে দেখা উচিৎ । আমাদের মুখের ভাষার কথাই ধর । প্রত্যেক প্রজন্মে কিংবা অঞ্চলে একরকম ভাবে একই কথা উচ্চারণ করে করে তার বদল আসতে থাকে । জিনিসটা বিবর্তিত হতে থাকে । ফলে দেহটা তার বদলাতে থাকে, বেঁচে থাকে আত্মাটা । যখন কোনো ভাষাকে একেবারে পাকাপাকি নিয়মের শেকলে বেঁধে ফেলা হয়, আইন করে দেয়া হয় আর তাকে বদলানো চলবে না কোন মতেই, তখন সে ভাষাটির মৃত্যু হয় । যেমনভাবে সংস্কৃত মরেছে, ল্যাটিন মরেছে । লোকগানও কিন্তু সেইরকম । লোকের মুখে মুখে মাঠেঘাটে তার জীবন কাটে । আর দশটা জীবন্ত জিনিসের মতই সময়ের সাথে সাথে তার বহিরঙ্গটাও বদলাতে থাকে । ভ্যারিয়েশানের সুযোগটা অবশিষ্ট না রাখলে গানটারও বিবর্তন বন্ধ হয়ে গিয়ে তার মৃত্যু হয় ।"
"ঠিক বললে না শোভনদা । রবীন্দ্রসঙ্গীতকে তো তাহলে বলতে হয় মৃতসঙ্গীত ।"
"না, এখনো মৃতসঙ্গীত নয় । মাত্রই তো পঞ্চাশ ষাট বছর কাটলো রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর । অমন শক্তিশালী একটা সঙ্গীতধারা, তার মরণ অত কম সময়ে ঘটবে না । কিন্তু মৃত্যুর চিহ্নগুলো এসে যাচ্ছে ওর শরীরেও । ভেবে দেখ, ওই ধারাটায় আর কোনো গান কিন্তু তৈরি হয়নি তারপরে । সাহসই পায়নি কেউ । অথচ গুরুদেবের চলে যাবার পর থেকে সমাজ বদলেছে, জীবনও বদলেছে অনেকটা । কিন্তু এখনও সেই গানের রেণ্ডারিংয়ে সেই পরিবর্তিত জীবনবোধের কোনো ছাপ আসেনি । রবীন্দ্রসঙ্গীত একচুলও বদলাচ্ছে না প্রভাত । বিশ শতকের চল্লিশের দশকের রূপ নিয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে এখনও । এটাই ক্ষয়ের একটা বড়ো চিহ্ন । আর কয়েকটা দশক যেতে দে, ও জিনিস হয়তো দেখবি অবোধ্য মন্ত্রে পরিণত হবে । কিছু অতিশিক্ষিত মানুষ হয়তো তার মানে বুঝবে, কিন্তু বাকি লোকজনের কাছে তা হয়ে যাবে অবোধ্য ভাষায় কোন অজ্ঞাত জীবনবোধের ধারাবিবরণী । তাকে ভক্তি করতে হয়, তিথিবিশেষে পাঠও করতে হয়, তবে ওই পর্যন্তই ।"
"বলছো কী গো ? এ তো র্যাডিকাল কথাবার্তা । শুনলে লোকে মারতে আসবে তো !"
"মারতে আসবে তো শহরের গুটিকয় মানুষ । তার বাইরে যে বিস্তীর্ণ বাংলা পড়ে আছে সেখানে আমি নিরাপদেই থাকবো । সেখানে এই বিবর্তনটা অনেকাংশেই এসে গিয়েছে যে ! খেয়াল করে দেখিস !"
"আচ্ছা হয়েছে । স্বরলিপি তুমি করবে না, এই হচ্ছে মোদ্দা কথা । তাই তো ?"
"হ্যাঁ তাই । লোকগান লোকের মুখে বেঁচে থাকে । যে গান বাঁধে তার নামটুকু শুধু কখনো কখনো পদের শেষে জোড়া হয় মাত্র । তা বাদে গানের মালিকানা থেকে যায় শ্রোতা আর গায়কের ওপরেই । তারা ভালোবেসে যে যেমন ভাবে গাইবে সেই হবে গানের সুর । গানটার যদি বাঁচবার ক্ষমতা থাকে তবে লোকের মুখে মুখে রূপ বদলে বদলে সে বেঁচে থাকবে । নইলে, মরুক না ! কতই তো জন্মাচ্ছে রোজ । জন্মমৃত্যু তো আছেই । মমি করে দেহটা বাঁচিয়ে রাখার দরকার কী ?"
কথা বলতে বলতে একটা বড় রেজিস্টার নিয়ে ফিরে এসে প্রভাতের হাতে দিয়ে দিয়েছিল শোভন । সে তার পাতাগুলো উল্টে উল্টে দেখে চলে । দিস্তাকাগজ সেলাই করে ওপরে কার্ডবোর্ডের মলাট দেওয়া মোটা খাতা । তার পাতায় পাতায় মুক্তাক্ষরে সাজানো একেকটি গান, পাশে উত্স, গায়ক ও ক্যাসেটের নম্বর যত্ন করে লেখা । সামান্য কটি পাতাই ভরেছে এখনো । বাকি রয়েছে আরো অজস্র পাতা । গ্রাম বাংলার পথেঘাটে ছড়ানো যে অজস্র গান জীবনের গল্প বুকে নিয়ে মুখে মুখে ভেসে থেকে অবশেষে একসময় হারিয়ে যায় নগরায়ণের কামড়ে, তাদের ভবিষ্যৎ আশ্রয় । একজন একাকী মানুষ সেই নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে । এই যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই কোনো । নগরসভ্যতা জিতবেই । জিতেই সে এসেছে চিরকাল । কিছু গান বেঁচে থাকবে হয়তো । নাগরিক উচ্চারণ ও যন্ত্রানুষঙ্গের বিকৃত রূপকে মেনে নিয়ে এক চরিত্রহননের সমঝোতাকে আশ্রয় করে । বাকি অধিকাংশই হারিয়ে যাবে । তবু, তারুণ্যের স্বভাব-সঞ্জাত আশাবাদের আবরণ-ঢাকা চোখে ছেলেদুটি সেই সুনিশ্চিত পরিণতিকে দেখতে পায় না অথবা অন্তরের গভীরতম অঞ্চলে তাকে অনুভব করলেও সেই অন্ধকার ও শীতল অনুভূতিকে সত্য বলে মেনে নিতে রাজি হয় না । তবে, হয়তো এই গানগুলি এই খাতা ও ক্যাসেটের জাদুঘর আশ্রয় করেই থেমে থাকবে হারিয়ে যাওয়া একখণ্ড সময়ের স্মৃতি হয়ে ; তরুণটির ব্যাঙ্গোক্তির সেই মমি হয়েই । মমিরা মৃত নয় । তারা এক বিশেষ সময়খণ্ডকে জীবিত রাখে নিজেদের পরিবর্তনহীন শরীর দিয়ে । তবে সে কথা এই তরুণ যোদ্ধাদের অনুভব করবার কথা নয় । তা নিয়ে, এতএব, তারা ভাবেও না । তারা কেবল যুদ্ধে যায়, যুদ্ধ করে বেঁচে থাকবার ও বাঁচিয়ে রাখবার অন্ধ প্রেরণায়, আর তাদের অগোচরে সমাজ তাদের দিয়েই নিজের অতীত জীবনের মিউজিয়াম গ্যালারি তৈরি করে চলে নি:শব্দে ।
হঠাৎ খাতাটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো প্রভাত ।
"উঠছিস কেন ? বোস, একটু চা বানাই ।"
"উঁহু । যেতে হবে । বাবা ওবেলা দোকান খুলতে যেতে পারবে না, হাল্কা জ্বর মতো এসেছে । বাড়ি গিয়ে অতএব বিকেলে দোকান খুলতে যেতে হবে ।"
"কালকে অবধি যদি মেসোমশাই ইমপ্রুভ না করেন তাহলে ? যাবি কী করে ?"
প্রভাত হাসল, "তোমার কোন কিছু খেয়াল থাকে শোভনদা ? কাল লক্ষ্মীপুজো না ? দোকান খুলবে নাকি ? বাড়িতে পুজো হবে তো !"
শোভন হেসে মাথা নাড়ল, "সত্যিই তো ! খেয়াল থাকা উচিত ছিল । এদের বর্ষী তো আবার কোজাগরী পূর্ণিমার রাতেই হয় । ইস ! মাথাটা গেছে একেবারে ।"
প্রভাত বেরিয়ে যেতে যেতে বাড়িটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল । মা সকাল থেকেই বিশ্বাসবাড়ি গিয়েছে । ও বাড়ির লক্ষ্মীপুজো এক বিরাট পর্ব । আজ আর কাল দুটো দিন মা'র ও বাড়িতেই কাটবে । চিরকাল তাই কেটেছে ।
সন্ধে হয়ে আসছিল । পুবে চতুর্দশীর চাঁদ ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে । শংখের শব্দ আসছিল কাছে, দূরে বহু বাড়ি থেকেই । সন্ধ্যার স্বাগত সম্ভাষণ । খানিকক্ষণ চুপচাপ মোড়ায় বসে থেকে উঠে পড়ল শোভন ।
বাখারির গেটটা বন্ধ করে ভেতরে ফিরে এসে আলো জ্বালল ঘরে । দুটো হ্যারিকেন । তার একটাকে মৃদু করে জ্বালিয়ে রেখে বারান্দায় বসিয়ে রেখে অন্যটা নিয়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে চৌকির মাথায় রাখা ছোট একটা টেবিলে বসাল । তারপর ফাইল গাঁথা একগুচ্ছ কাগজপত্র নিয়ে এসে বসাল তার সামনে । হাতে তার অনেক কাজ ।
"শোভন, উঠে পড় বাবা । দরজাটা দিয়ে দে । আমি বেরোচ্ছি ।"
শোভন কাঁথার নিচ থেকেই পিটপিট করে চোখ খুলে দেখল একবার । আলো ফুটে গেছে । আন্দাজ ছ'টা মতো বাজে । বেড়ার অজস্র ফুটো দিয়ে সরু সরু আঙুলের মতো সূর্যের আলো এসে ঘরের ভেতরে ঢুকছিল । ঠাণ্ডা পড়ে গেছে একটু একটু । ভোরের দিকে ঘুমের মধ্যেই বিছানার চাদরটা মুড়ি দিয়ে ফেলেছিল সে । এখন তার উষ্ণ আশ্রয় ছেড়ে বার হয়ে আসতে আলস্য লাগছিল ।
"কি হল, ওঠ ! কতক্ষণ দাঁড়াব আমি তোর জন্য ? ওদিকে ও'বাড়িতে রাজ্যের কাজ পড়ে আছে । আর দেরি হলে বড় গিন্নি লাফঝাঁপ শুরু করে দেবে'খন ।"
"উ: । উঠছি, উঠছি," বলতে বলতে শোভন ভালোভাবে চোখ খুলে তার মায়ের দিকে একবার চাইল । তারপর বলল, "এই ভোরে ঠাণ্ডায় তুমি চান করলে কেন ?"
"বা রে ! চান না করে গেলে ও বাড়ির পুজোর কাজকর্মে হাত দেবো কী করে ? বাসি কাপড়ে এ'সব কাজ হয় ?"
"তারপর জ্বরজারি যখন বাঁধাবে একট তখন তোমার ও বাড়ি এসে তোমায় বাঁচাবে ?"
মনোরমা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, "অকৃতজ্ঞের মতো কথা বলিস না তো শোভন ! উনি যখন চলে গেলেন তখন ছ'বছর বয়স তোর । ওয়ানে সবে ভর্তি হয়েছিস । জলপানি তো পেলি মাধ্যমিকের পর । সেই মাধ্যমিক অবধি তোর পড়ার খরচ জোগালো কে ? এই ঘর আর পাঁচবিঘে জমির বসতবাটিটার বন্ধকিও তো মকুব করিয়ে দিয়েছিলেন ওই বিশ্বাসমশাই । তাহলে ? তোর মাথার ওপর ছাউনি আর মাথার ভেতরের বিদ্যে, সবই তো ওই বিশ্বাসবাড়ির দয়ায় । আজ ওনাদের ঘরে লক্ষ্মী অচলা ছিলেন বলে তুই আর আমিও বেঁচে আছি সে কথাটা তুই ভুললেও আমি ভুলি কেমন করে বল ? তা সেই বাড়ির পুজোয় আমি অনিয়ম হতে দেবো নিজের শরীরের কথা ভেবে ? এ তুই ভাবলি কেমন করে ?"
বলতে বলতে হঠাৎ ছেলের অস্বস্তিভরা মুখটার দিকে নজর যেতে একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়লেন মনোরমা । ছেলে বড় হচ্ছে । এখন এইভাবে কড় কথাগুলো তাঁর বলা উচিৎ হয়নি । নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, "এখন দয়া করে ওঠো । দুপুরে যাহোক দুটি ফুটিয়ে খেয়ে নিও । আর শোন, সন্ধের মুখমুখ দোরে তালা দিয়ে ও বাড়িতে চলে আসিস । সাতটায় পুজো শুরু ।"
"উঁহু, আমি পুজোয় আসতে পার্বো না । মনোহরগঞ্জ যেতে হবে । ইরশাদের বর্ষী আছে আজ রাতে । নতুন গান পাবো অনেক ।"
বলতে বলতে আড়চোখে মায়ের দিকে একবার দেখে নিল শোভন । তার রক্তগত সঙ্গীতপ্রীতির উত্স রয়েছে এই মানুষটির রক্তে । এককালে গাইতেনও ভালো । শোভন শুনেছে, সেই সুকন্ঠের জোরই ছিল দরিদ্র পরিবারের মেয়েটির এই বাড়িতে প্রবেশের টিকিট । সে সময় নাকি তাদের পরিবারটি এক সমৃদ্ধ ও লক্ষ্মীমন্ত কৃষক পরিবার ছিল । তারপর একে একে সমৃদ্ধি, সৌভাগ্য, গানের গলা, সবই গিয়েছে তাঁর সময়ের গ্রাসে । অবশিষ্ট রয়েছে শুধু সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসাটি; তীব্র মাদকের নেশার মতই । ভালো গান শুনলে আজও শত দু:খের মধ্যে তাঁর মনটা ঘুরে বসে বড় আগ্রহ নিয়ে । এই মুহূর্তেও তার ব্যতিক্রম হল না । মনোরমার মুখের কঠিন রেখাগুলো হঠাৎ নরম হয়ে এলো । বললেন, "ভালো পাল্লাগান শুনিনি অনেকদিন । দেখিস তো, পাস যদি তবে তোর যন্ত্রে ভরে আনিস । যন্ত্রটা নিয়ে যাচ্ছিস তো ?"
ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানালো শোভন । বলল, "পাল্লা গান পেয়ে যাবো বোধ হয় । ইরশাদের কাজ । তাতে শ্রীধর বোষ্টম আসবেই । আর শ্রীধর এলে পাল্লাই গাইবে ।"
"শ্রীধর ! বেঁচে আছে এখনো ? অনেকদিন পরে নামটা শুনলাম । দেখা হলে একবার বলিস তো, যদি কখনো এদিকে আসে তবে একবার যেন অন্তত দেখা দিয়ে যায় । তোর বাবার নাম করে বলিস । বড় ভক্তি করত তোর বাপকে । ওঁর বাঁধা অনেক গান গেয়েছে শ্রীধর এককালে ।" বলতে বলতে হঠাৎ মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মনোরমার । শোভনের দিকে দুপা এগিয়ে এসে আগ্রহভরা গলায় বলেন, "আচ্ছা, জিজ্ঞাসা করিস তো, ও কি ওনার সেই গানটা এখনো গায় ? সেই যে -
     "নদিয়ার ওই পুষ্পবনেপ্রৌঢ়, ক্লান্ত কন্ঠটিতে হঠাৎ করে সুর ঘিরে আসে । দ্ব্যর্থক গান । `নদিয়ার' শব্দটিকে `ন দুয়ার' করলে গোটা গানটার অর্থই বদলে যায় । ন'টি দ্বারযুক্ত পুষ্পবন - অর্থাৎ মানবদেহ । তার অন্তরে যখন চৈতন্যোদয় ঘটে তখন সে খবর আপনি ছড়ায় । ভক্তরা এসে জোটে -
     শ্রীচৈতন্য ফুল ফুটেছে
     গৌর অঙ্গ শ্বেত বর্ণ তার
     বাতাসে তার বাস ছুটেছে ।
     দেখিয়ে শ্বেত কমলকলি
     মধুর লোভে জুটল অলি
     তাদের পাখায় আকাশ ছেয়ে
     হরি হরি ডাক উঠেছে ।"
- মা বারবারই প্রথম লাইনটা দু'বার করে গাইছেন । একবার `নদিয়ার' বলে, একবার `ন দুয়ার' বলে । বাবার কোন স্মৃতি নেই শোভনের । শুধু অসাধারণ এই গানগুলির উত্তরাধিকারটুকু রয়ে গেছে । আচ্ছা, এরা দুজন যখন তরুণতরুণী ছিল, নববিবাহিত, একজন গান লেখে, সুর দেয় আর অন্যজন গায় - কেমন ছিল এদের জীবন ? এই দারিদ্র্যজীর্ণ বাড়িটির অন্ধকার অন্দরমহলে তার ছিটেফোঁটা স্মৃতির গন্ধও মেলে না কেন ! মায়ের জরাক্লিষ্ট শীর্ণ চেহারার দিকে চেয়ে সেই তরুণীটিকে বারংবার খুঁজতে চেষ্টা করে শোভন ।
"হাঁ করে তাকিয়ে না থেকে এবার উঠে পড় । আমি বেরোচ্ছি," বলতে বলতে দরজা খুলে রেখেই বাইরে বের হয়ে গেলেন মনোরমা । অনেকক্ষণ চুপচাপ বিছানায় বসে থেকে তারপর উঠল শোভন । আটটা নাগাদ কয়েকটা ছেলেমেয়ে পড়তে আসবে । তার আগে চা খেয়ে জমির কাজ কিছু মিটিয়ে নেয়া দরকার ।
লালচে হলুদ রঙের রোদ ছড়িয়ে আছে চারপাশে । তার স্পর্শে আরাম লাগে । চাদরটা মুড়ি দিয়ে উঠে এসে রান্নাঘরের লাগোয়া পিঁজরেটা খুলে হাঁস চারটিকে ছেড়ে দিল সে । বাইরে বেরিয়ে তারা আড়মোড়া ভেঙে দুলতে দুলতে বাড়ির পেছনদিকে চলে গেল ।
বাড়ির পেছন দিকে অনেকটা জমি । বিঘেপাঁচেক জমির মধ্যে বাড়ি আর সামনের উঠোন মিলে বড়জোর দু'কাঠা হবে । বাকি সবটাই খোলা জমি । তার একপাশে ছোটছোট কয়েকটা বেড তৈরি করে তাতে কপি, মটর আর পেঁয়াজ লাগিয়েছে শোভন । লাউয়ের চারা বসিয়েছে গোটা কয়েক । কালকের চেঁছে রাখা বাখারিগুলো নিয়ে সে লাউয়ের চারাগুলোর ওপরে মাচা বাঁধতে বসলো । এখন লাগালে আর ফল দেবে কিনা সন্দেহ আছে । তবে ফল হোক না হোক, শাকটা তো খাওয়া যাবে ! মাচা বাঁধতে বাঁধতে এক অদ্ভুত শান্তির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছিলো শোভনের মনের মধ্যে । বাড়ির একেবারে পশ্চিম সীমান্তে জমির মধ্যেই ছোট ডোবা আছে একটা । অযত্নে মজে গিয়েছিলো প্রায় । সেটা নতুন করে সংস্কার করিয়েছিলো শোভন এই বর্ষার ঠিক আগে । এখন তাতে টলটল করছে জল । পোষা হাঁসগুলোর ডাক শোনা যাচ্ছিল সেখান থেকে । তিনটে মাদি আর একটা মদ্দা । এইবারে ডিম দিতে শুরু করবে । ডোবাটায় মাছ আছে কিছু । পুরোনো ল্যাটা, কুঁচে, শোল । তেলাপিয়াও কিছু ছেড়েছিলো এবারে । কালো কচুর ঝাড় লকলক করে বেড়ে উঠছে তার চারপাশ ঘিরে । দূর থেকে জল দেখা যায় না আর । সবুজ-কালোর একটা দেয়াল যেন গজিয়ে উঠেছে জল ঘিরে । সেই দিকে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হাতে বাখারিগুলো বেঁধে চলেছিল শোভন । ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে মাচার কাঠামোটি । এ বছরটা যেমন তেমন করে চললো, কিন্তু আগামী বছর থেকে গোটা জমিটাকেই ঠিকমতো ব্যবহার করতে হবে - মনে মনে ঠিক করে নেয় সে । বছর দুয়েক আগে বেনালিতে গান শুনতে গিয়ে একটা সেলফ হেল্প গ্রুপের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল - ওঁদের কাছে অয়স্টার মাশরুমের চাষ দেখে এসেছিল শোভন । পদ্ধতিটা জেনে এসে এখানেও সেটা কাজে লাগালে হয় । তেতলা মাচা বেঁধে তার ওপর ভিজে খড় বিছিয়ে চাষের বন্দোবস্ত । কম জায়গা, কম ইনভেস্টমেন্ট, কিন্তু লাভ হয় নাকি ভালো ।
শোভন কান খাড়া করল । বাখারির বেড়ার গেট খোলবার মৃদু খুটখাট শব্দ - কেউ ভেতরে আসছেন । সম্ভবত নতুন কোনো ছাত্রের গার্জেন হবেন । টিউশনে শোভনের এই এলাকায় বেশ নামডাক হয়েছে গত দু'মাসে । মাঝেমাঝেই ছাত্র নিয়ে কাছে-দূরের গ্রামগঞ্জ থেকে গার্জেনদের আনাগোনাও চলছে । কবজি উল্টে ঘড়ির দিকে চোখ ফেলল সে । পৌনে আটটা মতন বেজেছে । ব্যাচের ছেলেদের এখনো আসবার সময় হয়নি । মা-ও নেই বাড়িতে । ভদ্রলোক একা একা এসে খালি ঘরে ঢুকবেন ! বিরক্ত হয়ে ফিরে না যান । হাতে ধরা দড়িটায় গিঁট দিতে দিতে সে গলা উঁচু করে বলল, "কে ? একটু বসুন । আমি আসছি ।"
"শোভন ? কোথায় তুই ? ঘরটর সব হাঁ হাঁ করছে খোলা ! কোথ্থেকে কথা বলছিস ?"
মাদ্রির গলা ! মাদ্রি ! এখানে - বিদ্যুত্স্পৃষ্টের মতো একমুহূর্ত স্থির হয়ে রইল শোভন । তারপর তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল তার ভূমি আসন ছেড়ে ।
বারান্দার ঠিক নীচে ছাঁচতলাতে দাঁড়িয়ে ছিল সমাদৃতা । পুরোনো পুরোনো দেখতে একটা সালোয়ার কামিজ পরনে । মাথার চুল খোঁপা করে টেনে বাঁধা । কাঁধে একটা চটের ব্যাগ । শোভনকে দেখে বলল, "যা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, বুঝলি ! একে তো জায়গাটা ঠিকঠাক চিনিনা । তোদের মুরলীপুর বাসস্ট্যাণ্ড থেকে লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে আসছি । শেষে এক ভদ্রলোক এসে পৌঁছে দিয়ে গেলেন । তা পৌঁছে দেখি ঘরদোর সব খোলা পড়ে আছে, কেউ কোথাও নেই । মাসীমা কোথায় রে ?"
দাঁড়া, বলছি সব । আগে বারান্দায় উঠে এসে বোস তো ! ঘরে মোড়া আছে । দুখানা বের করে নিয়ে আয়, আমি হাত-পা ধুয়ে আসছি কুয়োতলা থেকে ।
সামান্য সময়ের মধ্যেই ফিরে এলো শোভন । মাদ্রিকে বারান্দায় দেখা যাচ্ছিল না । ঘরের ভেতর থেকে নড়াচড়ার শব্দ আসছিল । শোভন বারান্দায় উঠে ঘরের ভেতর গেল । তাদের ঘরদুটিতে একলা ঘুরে বেড়াচ্ছিল মাদ্রি । ব্যাগটা শোভনের চৌকির ওপরে রাখা ।
"কী রে, তোর হলোটা কী ? বসবি তো একজায়গায় ? না কি ?"
মাদ্রি হাসল, "হ্যাঁ, এই বসি । তুই হাত পা ধুয়ে আসতে আসতে, একজন হবু দার্শনিক কাম ফোক একসপার্টের বাসস্থানটা ঠিক কেমন হতে পারে তার একটা ফার্স্ট হ্যাণ্ড আইডিয়া নিয়ে নিচ্ছিলাম," বলতে বলতে তার চৌকির একটা কোণায় এসে বসল মাদ্রি ।
"কেমন ঠেকল আমার বাসস্থান ?"
"ফ্যানটাসটিক । মিউজিয়ামের ফোক কিংবা রুরাল ইণ্ডিয়ার গ্যালারিতে দুর্দান্ত ফিট করে যাবে, এস্পেশিয়ালি রান্নাঘরটা । কিন্তু সত্যি সত্যি থাকবার জন্য - ওরে বাবা ! তুই ম্যানেজ করিস কী করে শোভন ?"
বলতে বলতে খাটের মাথার কাছে তেপায়া টেবিলটার ওপরে ছড়িয়ে থাকা বইপত্রগুলো ঘাঁটছিলো মাদ্রি । খানিক পরে সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, "অ্যাডমিট এসেছে ?"
শোভন মাথা নাড়ল, "না । এখনও এসে পৌঁছোয়নি । গ্রামের পোস্টঅফিস তো ! ও একটু দেরি হবেই ।"
"আমি আর উত্তম, আমাদের দুজনেরই এসে গেছে কিন্তু । আচ্ছা শোভন, ঠিক করে বলতো, ফর্মটা তুই ঠিকঠাক ফিল আপ করেছিলি তো ?"
শোভন মাথা নাড়ল, "আমার ফর্মটা কিন্তু বেশিরভাগটা তুইই ভরেছিলি । টালিগঞ্জে গিয়ে জমাও দিয়ে এসেছিলি তুই । খুঁটিয়ে চেকও করেছিলি । তবু ডাউট হচ্ছে ?"
"না মানে ডাউট ঠিক নয়, কিন্তু এখনো এলো না কেন ? কাল পরশু তুই পোস্টঅফিসে খোঁজ নিবি একবার শোভন । না এসে থাকলে পরে একবার টালিগঞ্জে পি এস সি অফিসে যেতে হবে তোকে ডুপ্লিকেট বের করবার জন্য । অ্যাকনলেজমেন্টটা আছে তো ? নাকি সেটাও হারিয়েছিস ?"
"আছে । যত্ন করে রাখা আছে," শোভন হাসছিল, "মাথার ওপরে তুই বসে নজর রাখছিস । আমার বুঝি প্রাণের ভয় নেই ?"
"ধ্যাত্, বাজে কথা বলিস না তো ! পড়াশোনা কিছু করছিস, নাকি সে'সব শিকেয় তুলে গ্রামসেবা চলছে ?"
"সেই ইন্সপেকশানে এসেছিস বুঝি ? আরে বাবা ঠিক ম্যানেজ করে দেবো ।"
"দেখি, টেন ইয়ার্স কোশ্চেন কী কী কিনেছিস দেখা তো !"
"না-মানে -ও'সব সাজেশান টাজেশান করে পড়া আমার ঠিক আসে না রে মাদ্রি । জিনিসগুলো মোটামুটি জানা আছে । কোশ্চেন যা আসবে গুছিয়ে জবাবটা দিলেই তো হল । ও'সব কোশ্চেনপেপারটেপার আর-," শোভনের অপ্রস্তুত গলার জবাব ভেসে আসে । দুষ্টুমি করে ধরা পড়ে যাওয়া বালকটি যেন ।
"শোভন, জানুয়ারির কিন্তু আর বেশি দেরি নেই । ধরে নিইও যদি যে তুই সব জানিস, আমাদের চেয়ে একটু বেশিই জানিস, কিন্তু তবুও, একটু নিয়মিত প্র্যাকটিস তো অন্তত-"
বলতে বলতে হঠাৎ যেন একটা ঝাঁকুনি দিয়েই সংলাপের এই বিশেষ স্রোতটি থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে এলো সমাদৃতা । তারপর একগাল হেসে বলল, "আচ্ছা সে'কথা এখন থাক । তুই অনেক মাথাওয়ালা ছেলে ; আমার স্কেলে তোকে মাপতে বসাটাই আমার ভুল ।"
"ধুর, সে'সব কিছু না । তোর রেজাল্ট কবে আমার থেকে খুব বেশি খারাপ হয়েছে বল তো ? কিন্তু, এই পরীক্ষাটা নিয়ে তুই কিন্তু একটু বেশি নার্ভাস হয়ে পড়ছিস মাদ্রি । সেটা ভালো না । চাপটা বেশি নিস না । পারফরম্যান্সে তার ছাপ পড়তে পারে ।"
"খুব টেনশন করছি, না রে ?" শোভনের দিকে একঝলক চেয়ে নিয়েই চোখ ফেরাল সমাদৃতা, তারপর কতকটা নিজের মনেই বলল, "পরীক্ষাটা নিয়ে আমার কেমন যেন একটা ম্যানিয়ার মতো হয়ে গেছে আজকাল । সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারি । আসলে বাবার রিটায়ারমেন্টের আর এক বছর বাকি, বুঝলি ! পেনশান আর কতটুকু পাবে ? চাকরিটা পেলে আর কিছু না হোক প্রথম দু এক বছরে বাড়ির লোনের বাকিটা তো অন্তত আমার থেকে শুধে দিতে পারবো ! সেটাও তো অনেকটাই হেল্প হবে, বল ?"
"পেয়ে যাবি । ডোনট ওয়ারি মাদ্রি । তোর আটকাবে না দেখিস ! এবার ঠিক করে বল দেখি, পরীক্ষার প্রিপারেশান ছেড়ে হঠাৎ করে চলে এলি যে বড় ?"
"বলছি । তার আগে বল মাসীমা কোথায় ?"
"মা গেছেন পাশের পাড়াতে । এ গ্রামে মহাদেব বিশ্বাস বলে এক ভদ্রলোক আছেন । প্রাক্তন জমিদারবংশ । মা গেছেন তাঁদের বাড়ির লক্ষ্মীপুজোর কাজ সামলাতে । প্রতিবারই যান ।"
"তোদের বাড়িতে পুজো হয় না ?"
"উঁহু । আগে হত । বাবা মারা যাবার পর থেকে আর হয়নি । ফলে আজকের জন্য আমি যাকে বলে একেশ্বর । তবে একা নয় । একটু পরেই একদল ছাত্র পড়তে আসবে । তাদের নিয়ে এগারোটা অবধি চলবে । তারপর-"
তার গলায় কোনো দু:খের সুর ছিল কি ? সেটি টের পেয়ে তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ বদলালো সমাদৃতা, "কেমন ট্রেনে চেপে একা একা এক্সকারশানে চলে এলাম বল তো ! তোকে চমকে দিয়েছি কিনা বল ?"
"হুঁ, তা একটু দিয়েছিস বইকি ! কিন্তু তোর ব্যাপারটা কী ঠিকঠাক বল তো মাদ্রি ? পড়াশোনা ছেড়ে হঠাৎ এই অজ গ্রামে এসে হাজির হলি যে বড় !"
"এমনি । ইচ্ছে হল । পড়ে পড়ে বোর হয়ে যাচ্ছিলাম, তা বাবাই প্রপোজ করল, তোর এখানে একবার এসে ঘুরে যেতে । তাই চলে এলাম । অবশ্য বাবার একটা পার্সোনাল ইন্টারেস্টও ছিল । ছোট একটা ওয়াকম্যান দিয়ে দিয়েছে সাথে । সুযোগ পেলে এখান থেকে কিছু গান তুলে নিয়ে যেতে বলেছে । একদিন থেকে কাল সকালে ফেরবার প্ল্যান ছিল ।"
"ছিল মানে ? এখন আর নেই ?"
"না মানে মাসীমা বাড়িতে নেই- একা একা-"
শোভন হেসে ফেলল । মাদ্রির অস্বস্তিটা তার নজর এড়ায়নি । তারপর বলল, "প্ল্যানটা বদলাস না । মেসোমশাইয়ের ইচ্ছে পূরণ করে দেবার ব্যবস্থা একটা হয়েই আছে । একা একা বাড়িতে আমারও থাকবার কোনো প্ল্যান ছিল না । গানের আসর আছে একটা আজ রাতে । সেখানেই যাবার কথাবার্তা হয়ে আছে । তুই এলি । ভালোই হল । তোকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবো । সারারাতের আসর । সকালবেলা সেখান থেকেই সোজা নিয়ারেস্ট গঞ্জ থেকে তোকে শান্তিহাটের গাড়ি ধরিয়ে দেবো । সেখান থেকে বাড়ি । হল তো !"
"আসরটা কোথায় ? কাছাকাছি কোথাও ?"
"উঁহু । চল, দেখাবো । ভেবেছিলাম বাসে করে চলে যাবো । কিন্তু তুই এলি, অতএব প্ল্যান চেঞ্জ । তোকে একটু ইন্টারেস্টিং ট্রিপ করাবো আজ । চুর্ণী দিয়ে নৌকা নিয়ে যাবো । যাকে বলে রোম্যান্টিক ইভনিং ট্রিপ ডাউন দা রিভার !"
বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল শোভন । ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখা সাইকেলটা নামাতে নামাতে বলল, "প্রভাতকে বরং নৌকোর কথাটা বলে আসি গিয়ে । আর দেরি করলে জোগাড় করা যাবে না । ছেলেপুলেগুলো পড়তে চলে এলে তুই একটু বসাস । মিনিটদশেকের মধ্যে ফিরে আসছি আমি ।"
"কিন্তু - শোভন-"
মাদ্রির ডাকটা তার কানে পৌঁছোল না । সে ততক্ষণে সাইকেল হাতে পথে বের হয়ে গিয়েছে । বারান্দা থেকে নেমে এসে উঠোন পেরিয়ে বেড়ার ধারে এসে উঁকি দিয়ে একবার তাকে দেখবার চেষ্টা করল সমাদৃতা, তারপর বাখারির দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এলো ঘরে । বারান্দার এক কোণে দুটো খেজুর চাটাই পাকিয়ে রাখা রয়েছে । সেগুলোকে বারান্দায় পেতে রেখে রান্নাঘরের দিকে গেল একবার । প্রায় শেষরাতে উঠে ট্রেন ধরেছিলো । পথেও খাওয়া হয়নি কিছু । খিদে পাচ্ছিল তার ।
রান্নাঘরে ঢুকে একটু হতাশই হতে হল তাকে । এই হেঁশেলে তৈরি খাদ্যের কোনও সংস্থান নেই । থাকবার মধ্যে দু'তিনটি জংধরা টিন । তাদের মধ্যে রয়েছে চাল, ডাল, বড়ি, আমসি । গুটিকয় শিশিতে রান্নার তেল, আচার, চা ও চিনি । বাঁশের একটা চাঙারিতে ছোটো ছোটো প্লাস্টিকের কৌটায় মশলা রাখা । একটা পুরোনো কাঠের তাকে কিছু বাসনকোসন । খিদেটা বেশ জানান দিচ্ছিল এইবারে । চিনির কৌটো খুলে একথাবা চিনি মুখে দিয়ে একগ্লাস জল গড়িয়ে খেল সমাদৃতা । বাইরে থেকে ইতিউতি পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল । ছাত্ররা আসতে শুরু করেছে বোধ হয় । সে উঠে বাইরে গেল । দুটো ছোট ছোট ছেলে । কালো-কোলো । বছর দশ-বারো বয়স হবে । বারান্দার চাটাইয়ের ওপর বসে ছিল । পাশে তাপ্পিমারা বইপত্রের ঝোলা । সমাদৃতাকে দেখে একটু অবাক ও সন্ত্রস্ত অথচ কৌতুহলী দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার দিকে ।
প্রাথমিক অস্বস্তির মুহূর্তটা কেটে যেতে সমাদৃতা এগিয়ে এসে বসে পড়ল তাদের সামনে । ছেলেদুটি সরে গেল একটু । দু জোড়া সতর্ক চোখ নতুন মানুষটিকে নজরে রেখেছে । সেইদিকে চোখ রেখে একটু হেসে সে বলল, "পড়তে এসেছিস ?"
"হ্যাঁ ।" জবাব দিল ছেলেটি, "শোভন মাস্টারের কাছে । মাস্টারমশায় নাই ?"
"আছে । কোথায় যেন গ্যাছে । এক্ষুণি ফিরবে । ততক্ষণ আয় আমি পড়িয়ে দিচ্ছি । বইপত্র বের কর । কে কোন ক্লাসে পড়িস তোরা ?"
ছাত্র দু'জন নিরুত্তর । ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে ।
"কী রে ? জবাব নেই যে কোনো ! পড়বি না ?"
ঘন ঘন মাথা নাড়ল দু'জন, তারপর তাদের মধ্যে বেশি সাহসীটি আড়চোখে তার দিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে বলল, "আমরা শোভন মাস্টারের কাছেই পড়বো ।"
"কেন, আমি পড়াতে পারবো না ?"
ভেতর থেকে কুলকুল করে হাসি উঠে আসছিল সমাদৃতার । লয়ালটি ! এই অজ গ্রামের মানুষজন শোভনকে নিশ্চয় সাংঘাতিক কিছু একটা ভাবে । নগরশিক্ষিত স্থানীয় ছেলে বনগ্রামে শিয়াল রাজার স্টেটাস পেয়েছে । এতক্ষণে আরও জনাদশেক ছেলেমেয়ে এসে জুটেছে চাটাইটির ওপরে । সকলের চোখই তার দিকে । একটু পরে, হাসিটাকে কোনওমতে দমন করে সে বলল, "আচ্ছা ঠিক আছে । আমায় প্রশ্ন করে দ্যাখ না প্রথমে, পারি কি না !"
দু এক মিনিট নীরবতা এইবারে । একটু বাদে একটা হাত উঠল । ছেলেটা বসে ছিল সকলের পেছনে । সে সমাদৃতাকে প্রশ্ন করতে চায় ।
"বল । কী জিজ্ঞাসা করবি ?"
"ভারতের রাজধানীর নাম কি ?"
"জানি । দিল্লী ।"
ততক্ষণে দ্বিতীয় হাত উঠেছে একটা, "আপালো কাকে বলে ?"
এইবারে একটু সময় নিল সমাদৃতা । নামটা পরিচিত ঠেকছে বটে, কিন্তু- হঠাৎ খেয়াল হল, মানুষের প্রথম চন্দ্রাভিযানের যানটির কথা জিজ্ঞাসা করছে ছেলেটা । প্রাকৃত উচ্চারণে তা `আপালো' রূপ ধরেছে ।
তৃতীয় প্রশ্নটি করবার জন্য হাত তুলেছিল একটি কিশোরী । উজ্জ্বল চোখদুটিতে দুষ্টুমির দীপ্তি ছড়িয়ে সে বলল, "বলো তো লংকা গাছে পোকা লাগলে কী দিতে হয় ?"
খানিক পরে, নীরব সমাদৃতার দিকে তাকিয়ে সে ফের বলল, "জানো না তো ? শোভনদাদা জানে । আমাদের শিখিয়েছে । এ ওষুধে পয়সা লাগেনা । ঘুঁটের ছাইয়ের সঙ্গে একটুখানি কেরোসিন মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতে হয় । শোভনমাস্টার অমন অনেক জানে ।"
আক্রমণটা যে এমন পথে আসবে তা কল্পনাতেও আসেনি সমাদৃতার । মুখোমুখি পরীক্ষায় তাকে পরাস্ত করেছে ওই মেয়েটি, প্রথাগত শিক্ষার সীমানার বাইরে, অতি তুচ্ছ এক অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করে । এ প্রশ্নের যদি কোন উত্তর নাও থাকতো তা হলেও বৃহত্তর দুনিয়ার কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি তাতে হত না । কিন্তু সে কথা এই বালিকাকে কে বোঝাবে ? তার সীমাবদ্ধ চোখে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চেয়েও বেশি দরকারি তার লংকাগাছের পোকা ! ছি, ছি, এ কী করছে শোভন ? এত পড়াশোনা করে, এতকিছু শিখে এসেও নলেজ শেয়ারিংয়ের বেলায় সেই লংকাগাছের পোকা ! সমাদৃতার কেমন যেন হতবুদ্ধি ঠেকছিল নিজেকে ।
সামনে বসা শিশুগুলির চোখে উজ্জ্বল কৌতুক খেলা করে যাচ্ছিল । তাদের শোভন মাস্টারকে চ্যালেঞ্জ করতে আসা অচেনা মেয়েটিকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পেরে তারা খুশি হয়েছে । আরও একটা হাত উঠছিল । হাতের মালিকটি তার পার্শ্ববর্তিনীকে কানে কানে নিচু গলায় জানাতে সে হঠাৎ জোরেজোরেই বলে উঠল, "জিগেস করিস না, জিগেস করিস না, ও এসব জাইনবে কেমন করে ?" অতএব উদ্যত হাতটি নেমে এল ফের । একটা দুর্বোধ্য রাগ গড়ে উঠছিল সমাদৃতার মধ্যে । হঠাৎ সামনে বসে থাকা একটা ছেলের দিকে চোখ ফেলে সে জিজ্ঞাসা করল, "তোদের মাস্টার তোদের এইসব উল্টোপাল্টা জিনিসই শেখায় খালি, নাকি লেখাপড়াও কিছু করায় ?"
উত্তরটা এলো উঠোনের ওপাশ থেকে । সাইকেলটা বাড়ির ভেতর ঢোকাতে ঢোকাতে শোভন বলছিল, "দামী প্রশ্ন মাদ্রি । হোয়াট শ্যুড বি দা বাউণ্ডারি অব এডুকেশান ? অর শ্যুড দেয়ার বি এনি ? ফিলজফি তো তোরও সাবসিডিয়ারি ছিল । এই চিরন্তন প্রশ্নটার সঙ্গে তোর অপরিচিত থাকবার কথা তো নয় !" বলতে বলতেই নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, "সরি, ভুলে গিয়েছিলাম । বি সি এস-এ তো তুই পলসায়েন্স আর ইকো অপশন নিয়েছিস ! ফিলজফির বিদ্যে তোর এই মুহূর্তে মাথায় থাকবার কথা নয় ।"
"না শোভন । ও'সব থিওরি টিওরির কথা ছাড় । এরা তো স্কুলে যায় । সিলেবাসের পড়া বাদ দিয়ে লংকাগাছের পোকাতত্ত্বই যদি শুধু মাথাতে ঢোকাবি, তাহলে এদের ইস্কুলকলেজের ফর্ম্যাল শিক্ষাদীক্ষার কী হবে ? সে শিক্ষার কি কোনো মূল্যই নেই এদের জীবনে ?"
শোভন ততক্ষণে বারান্দায় উঠে এসেছে । কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে মাদ্রির পাশে এসে বসল সে । চোখদুটি হাসছিল তার । যেন একটি অবোধ বালিকাকে বোঝাচ্ছে এমনি গলায় বলল, এরা এখন দু-একঘন্টা আমার সঙ্গে থাকবে মাদ্রি । ততক্ষণ যে ইন্টারঅ্যাকশানটা চলবে তাতেই তোর প্রশ্নের জবাবটা তুই কিছুটা হলেও পেয়ে যাবি আশা করি । কিন্তু উপস্থিত তোর খিদে পেয়েছে নিশ্চয় । মুখ দেখেই বুঝতে পারছি । ব্যাগটা খুলে দ্যাখ, মুড়ি নিয়ে এসেছি । বাতাসাও আছে । আর রান্নাঘরে উনুন যেখানটায় তার উল্টোদিকে দেখবি একটা কুলুঙ্গীতে আমুলের একটা কৌটোয় নারকেল নাড়ু রাখা আছে । তুই খানিক নে । আমাকেও দে ।"
হেমন্তের বেলা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিল । দূরে দূরে চাদরের মতো ঝুলে থাকা সাদা কুয়াশার আবরণ একে একে মিলিয়ে গেল । বারান্দায় বসে বসে মাদ্রি তাই দেখছিল । তার তীক্ষণ, লক্ষ্যঅভিসারী একমুখী মনটি আজ এইখানে এসে কেমন এক আলস্যে আক্রান্ত হয়েছে । ছেলেমেয়েগুলিকে নিয়ে শোভন ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়ির চৌহদ্দি জুড়ে । এখান থেকে তাদের সম্মিলিত কলকাকলির শব্দ পাওয়া যায় । হাসি, গান, গল্প, আর তারই ফাঁকে ফাঁকে চলেছে প্রকৃতির পাঠ নেয়া, কিংবা ইতিহাস-ভুগোল-বিজ্ঞানের পাঠ । রামায়ণের গল্প বলতে বলতে হঠাৎ করেই যেন, নিতান্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই, উঠে আসছে আলেকজাণ্ডারের প্রসঙ্গ, অথবা দক্ষিণ ভারতের ভৌগে.ংআলিক বিবরণ । বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো একটা মইকে দেখিয়ে ছোট একটি মন্তব্যকে অনুসরণ করে বের হয়ে আসছে সমকোণী ত্রিভুজের তত্ত্ব আর পিথাগোরাসের উপপাদ্য । আর এই সব চলতে চলতেই গুরুর নির্দেশ মেনে দুটি ছেলে মিলে একটা ছোট বেড-এর সদ্য ওল্টানো মাটির ড্যালাগুলোকে ভেঙে মিহি করে দিল, কাঠের উনুন জ্বেলে অক্লেশে চা বানিয়ে এনে দিল দুটি কিশোরী ; জানালো, শোভনের কাছে এসেই তাদের এই বিদ্যায় হাতেখড়ি ।
এতগুলি প্রাণবন্ত শিশুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটেই চলেছে শোভন । ক্লান্তির চিহ্নমাত্রও নেই তার চেহারায় । সমাদৃতাও প্রথমে চেষ্টা করেছিল কিছুক্ষণ । তারপর ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে । সংকোচের বেড়াটা তার এরই মধ্যে কখন যেন একেবারেই ভেঙে গিয়েছে । মেয়েদুটি চা বানাতে এল যখন, তখন তাদের সঙ্গে রান্নাঘরে গিয়ে সে শিখে নিয়েছে কাঠের উনুনে কোন কৌশলে আগুন জ্বালাতে হয়, তারপর চা বানিয়ে মেয়েদুটি চলে যাবার পর ধোঁয়ার আক্রমণকে অগ্রাহ্য করেই আগুনটাকে জ্বালিয়ে রেখে তার ওপরে চালে ডালে মিশিয়ে একটা হাঁড়িতে করে চাপিয়ে দিয়েছে দু'জনের মতন । নাহলে, শোভনের যা হালচাল, তাতে দুপুরের রান্নাবান্নার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না তার এখনও । কাঠের ধকধকে আগুনে চালডাল ফুটে উঠছিলো অল্পক্ষণের মধ্যেই । খুঁজেপেতে দুটো বড় আলু পাওয়া গিয়েছিল, সে দুটোকে টুকরো করে ওর মধ্যে ছেড়ে দিয়ে নুন, হলুদ আর গোটাকয়েক কাঁচালংকা ফেলে দিয়ে হাঁড়ির মুখটা ঢেকে রেখে সে বের হয়ে এসেছে বাইরে । আগুনটা নিভে এসেছে । আসুক গে । আংরা জ্বলছে ধিকি ধিকি । ওর উত্তাপে বাকি সেদ্ধটা হয়ে থাকবে । তেল ছড়িয়ে খেয়ে নিলেই হল ।
খাবার তৈরির কাজটা হয়ে যাবার পর এইবার তার অখণ্ড অবসর । এক বিচিত্র, অচেনা জগতের দরজা খুলে যাচ্ছিল তার সামনে । এই শোভনের সন্ধান তার কাছে কখনও ছিল না । বিচিত্র, অপরিচিত, অথচ আকর্ষণীয় একজন মানুষ । চুম্বকের মতন সে টানছিল তাকে । আবার, একই সঙ্গে, বুকের গভীরে বসে কেউ যেন তার উদ্দেশ্যে বারংবার এক সতর্কবার্তা দিয়ে চলেছিল, এই পথের জন্য তার পা দুটি তৈরি হয়নি । অজানা এই পথ যে দেশের মাটি বেয়ে এগিয়েছে সে দেশ তার মাতৃভূমি নয় । সে দেশের নাগরিকত্ব পাওয়া তার আর এ জীবনে হবে না । অথচ পেছনের উঠোনে একরাশ শিশুর সঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছে তার প্রিয় যে পুরুষ, এই মাটি ও জীবনের সঙ্গেই তার প্রকৃত নাড়ির যোগ । এর বাইরের যে জীবনে তাকে চিরকালের জন্য টেনে নিয়ে যাবার জন্য মোহন খাঁচাটি তৈরি করবার স্বপ্ন সে দেখেছে, সে জীবনে সে হয়ত চিরকাল পরবাসীই থেকে যাবে । ভয় লাগছিল সমাদৃতার । ভয় আর লোভ, স্বপ্ন ও বাস্তব এই দুয়ের টানাপোড়েনে ছটফট করছিল তার সমস্ত সত্ত্বা । এই বাড়িটি এবং ওই যুবকটির সান্নিধ্য তার অন্তরে যে বিষামৃতময় আবেগটির উদগম ঘটাচ্ছিল সেই মুহূর্তে, তার তীব্র অভিঘাতে বড় কষ্ট হচ্ছিল তার । অনুভূতির এই তীব্রতার সঙ্গে তার কখনও আলাপ ঘটেনি গত বাইশ বছরের জীবনে -
"আরে এই মাদ্রি । হল কী তোর ? পাঁচ ছ'বার নাম ধরে ডেকেছি তখন থেকে । কোন সাড়া নেই । স্নান করবি তো ? নে ওঠ । তাড়াতাড়ি কর । মায়ের গামছা, কাপড় বের করে দিয়েছি । একটা ছোট লাইফবয় সাবানও দিয়েছি-"
শোভন পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত ছুঁইয়ে নাড়াচ্ছিল । চমকে ঘুরে তাকাল সমাদৃতা । শুনশান, নির্জন বাড়ি জুড়ে হেমন্তের দুপুর স্থির হয়ে আছে । ছেলেমেয়েগুলো কখন যেন চলে গিয়েছে । এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু অস্বস্তিভরা গলায় সে বলল, "স্নান ? মানে-কোথায়-"
"হুম । বাথরুম তো নেই । তবে, নো প্রবলেম । বাড়ির পেছনদিকটাতে চলে যা । সোজা বেশ খানিকটা গিয়ে ছোট একটা পুকুর পাবি । বাড়ির বাউণ্ডারির মধ্যেই । চকচকে জল । চারপাশে বেশ কচুর. ঝাড় আছে । নামবার জন্য প্রপার ঘাটও বানানো রয়েছে । একেবারে প্রাইভেট সুইমিং পুল । ত্রিসীমানায় জনমানব নেই । হাইয়েস্ট ডেপথ সাত ফিট । সাঁতার তুই জানিস । এইবারে ওঠ । গন্ধ তেলটেল দিতে পারছি না । আমরা মাথায় সরষের তেল দিই । ইচ্ছে হলে ইউজ করতে পারিস ।"
সমাদৃতা তার দিকে মুখ উঁচু করে হাসল, "থাক, তেলে আর কাজ নেই । ওই লাইফবয় সাবানেই চলে যাবে আমার ।"
ঘরে গিয়ে পোশাক পালটে মনোরমার একটা সাদা থান ও লম্বা হাতা জামা পরে গামছা আর সাবান নিয়ে পেছনবাড়ির পুকুরের দিকে চলে গেল সমাদৃতা । এখানে নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে এক অলৌকিক নির্জনতা, যেন বিস্তীর্ণ একটি আবরণের মতো ঘিরে রয়েছে তাকে । পুকুরের টলটলে জলে সোঁদা, মেটে গন্ধ । পাড়ে বসে জলে পা ডুবিয়ে হাতেমুখে সাবান মাখল সে একটু । তারপর নেমে গেল জলের ভেতর । পায়ের নিচে নরম পাঁক । আঠালো । প্রতি পদক্ষেপে ঘুলিয়ে উঠছিল প্রথমে । খানিকটা গভীরে গিয়ে থেমে দাঁড়াল সে । তারপর শরীরটাকে আনুভূমিক করে উপুড় হয়ে জলের ওপর শুয়ে পড়ল । হাত ও পায়ের মৃদু বিক্ষেপে নিজেকে ভাসিয়ে রেখে এগিয়ে চলল জলাশয়টির অন্য তীরের দিকে- ।
এইখানে সময় স্থির হয়ে থাকে । সেই স্থির দেশ ও কালের পটভূমিতে হরিতাভ জল ও একটি তরুণ শরীর একে অন্যের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে স্থির হয়ে থাকে । এখানে চঞ্চলতা নেই । মধুর আলিঙ্গনের আরামপ্রদ স্পর্শটুকু আছে শুধু । চারিপাশের বাঙময় নৈ:শব্দ মানুষীটির সমগ্র চেতনা জুড়ে এক আশ্চর্য মোহজাল ছড়িয়ে দেয় । তাকে ত্রক্রমশ ভুলিয়ে দেয় দ্বিতীয় সেই দেশকালখণ্ডটির স্মৃতি, যা কিনা তার আশৈশব পরিচিত প্রকৃত কর্মভূমি, যার শব্দময় তীব্র জীবনস্রোত প্রতি মুহূর্তের সংগ্রামে আত্মাকে রক্তাক্ত করে । শান্তির মূল্যে যেখানে সুখের ত্রক্রয়বিক্রয় চলে প্রতিনিয়ত ।
কিন্তু স্বর্গবাসের খণ্ডমুহূর্তটি তার বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না । দূর থেকে শোভনের ডাক ভেসে আসছিল । হঠাৎ সেই শব্দ কানে যেতে সচকিত হয়ে উঠল তরুণীটি । কতটা সময় সে ভেসে ছিল এই মোহময় হরিতাভ জলে ? হাতপায়ের দ্রুতসঞ্চারে পাড়ের দিকে এগিয়ে চলল সে । ছোট্ট ঘাটটি । সুন্দর । মধুময় এই আকাশ বাতাস । বড় স্নিগ্ধ এই হরিতাভ কোমল জলরাশি । এই সুখের হাতছানি বড় লোভের । কিন্তু তার মূল্য যে বড় চড়া ! দাম মেটাতে বিকিয়ে দিতে হবে তার আজ অবধি পরিচিত গোটা দুনিয়াটাকেই । না না অত চড়া দাম মেটাতে সে তৈরি নয়-
শোভন বারান্দায় খাবার দাবার সাজিয়ে বসে ছিল । সামান্য আয়োজন । সমাদৃতার বানানো খিচুড়ি । তার সঙ্গে একটুখানি ডিমের ভুজিয়া । চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ভুজিয়ার বাটিটার দিকে ইশারা করে সমাদৃতা বলল, "ডিম পেলি কোথায় ? আমি দেখিনি তো !"
শোভন হাসল, "ম্যাজিক ম্যাডাম । একজোড়া ডিম ঘরে ছিল । যেখান থেকে নারকেল নাড়ু বের করেছিলি, তার একটু পেছনেই একটা পুঁটুলিতে ।"
"স্নান করবি না ?"
"করে নিয়েছি তো । মাথাটা ভেজা, দেখছিস না ?"
শোভনের ভেজা, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুলের দিকে চোখ চালিয়ে একটু অবাক হয়ে সমাদৃতা বলল, "কিন্তু চানটা করলি কোথায় ? কখন করলি ?"
"কুয়োতলায় । ঝপাঝপ দু বালতি জল তুলে মাথায় ঢেলে নিলাম, ব্যস । তারপর উনুন জ্বেলে ডিম ভাজা করে থালাবাটি সাজিয়ে কখন থেকে বসে আছি, তোর দেখা নেই । পুকুরধারে উঠে যেতেও পারছি না খোলা খাবার দাবার ফেলে । শেষে গলা চড়িয়ে চিত্কার শুরু করলাম । কতক্ষণ পুকুরে কাটিয়েছিস জানিস ? সোয়া ঘন্টা ফ্ল্যাট ।"
"ইমপসিবল । আমার এস্টিমেট অনুযায়ী হার্ডলি মিনিট পনেরো হবে ।"
"ঘড়ি দ্যাখ । বুঝতে পারবি ঠিক বলছি কি না । কিন্তু এখন তর্ক করবার সময় নেই । তাড়াতাড়ি কর । দেরি হয়ে যাচ্ছে । আধঘন্টার মধ্যে প্রভাত আসবে ভ্যান নিয়ে । তারপর নৌকোয় প্রায় বিশ কিলোমিটার রাস্তা । আরও দেরি করে বেরোলে সন্ধের মধ্যে পৌঁছোন যাবে না । প্রোগ্রামের শুরুটা যদি না দেখতে পাস তবে অর্ধেক মজাই মাটি ।"