বিরামনগর বটতলায় শোভনকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা ডানদিকে বাঁক নিয়ে রওনা হয়ে গেল। এইদিকের রাস্তাটা বিরামনগর গ্রামের মধ্যে দিয়ে সোজা চলে গিয়েছে ব্রতীনের ব্লক অফিস ছুঁয়ে মনোহরগঞ্জের দিকে। বেশ কিছুদূর অবধি তার লাল টেলল্যাম্পটা দেখা গেল, তারপর ফের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নেমে এল চারদিকে।
বটতলায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো শোভন। বাঁদিকে খানিক দূরে চূর্ণীর থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া ছেড়েছে। ঘামে ভেজা গায়ের জামাটা খুলে ফেললো সে। সারা দিনের ভ্যাপসা গরমের পর খোলা শরীরে ঠাণ্ডা হাওয়ার স্পর্শে বড় আরাম ঠেকছিলো তার। মাথার ওপর প্রসারিত ছায়াপথ। চাঁদ ওঠেনি এখনো আজ। সারাদিন ধরে বুকের ওপর চেপে বসে থাকা দমবন্ধ করা অনুভূতিটা এইবার একটু একটু করে সরে যাচ্ছিল। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাসে বুকের ভিতর টেনে নিচ্ছিল সে সেই নদীসুবাসিত অন্ধকার বাতাস।
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবার পর অন্ধকারের মধ্যে প্রায় অদৃশ্য কোনো একটি পথরেখা ধরে সে এগিয়ে গেল গ্রামের বিপরীতে, চূর্ণী নদীর নির্জন পাড়ের দিকে। সেইদিকে কোনোখানে অন্ধকারে মিশে আছে তার আজ রাত্রের আশ্রয়টি। পকেটের ভিতর থেকে মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ খোঁচা দিয়ে যাচ্ছিল সেই চাবির গোছাটা। খোঁচাটা বুকের ভিতর কোথাও গিয়ে লাগছে। তার সুখ, তার দুঃখ, তার নিজের হাতে তৈরি প্রতিষ্ঠান, এই সবকিছুর ওপরে কি সহজ ভঙ্গিতে সমান অংশীদারিত্বের অধিকার দাবি করে বসেছে মেয়েটা!
তার কাজে বা স্বাধীনতায় দখলদারির চেষ্টা অমরেশবাবুও করেছেন, থানার বড়োবাবুও। কিন্তু সে চেষ্টায় শক্তির দাপট আছে। সে লড়াইটা শোভনের পরিচিত। ফলে এইসব আক্রমণে দুঃখ পেলেও বুকের ভিতরে গিয়ে তেমনভাবে ঘা দেয়না বিশেষ। সুযোগসন্ধানী এই মুখগুলো সেই কিশোর বয়স থেকেই তার চেনা হয়ে গেছে। কিন্তু, এই ফরিদাকে সে চেনে না। জীবনে আর যে একটিমাত্র মেয়েকে সে কাছ থেকে চিনেছিলো সে তো কই এমন জোর করে তার সবকিছু কেড়ে নেবার চ্যালেঞ্জ জানায়নি তাকে! তাকে তার সুখটুকু নিয়ে বাঁচবার পথ করে দিয়ে সরেই গিয়েছিলো তো! আজও বড়ো কষ্টে আছে মাদ্রি। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো তার। বুকের ভিতর একটা ভাঙচুর চলছে। অবচেতনে লুকিয়ে থাকা কিছু অপরিচিত আবেগ হঠাৎ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে তার একমুখী ও ফলত সরল জীবনচর্যাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে বহুমুখী ও বহুগামী জীবনের শক্তিশালী আবর্তে। তার অভিঘাতে একই সঙ্গে জেগে ওঠা উল্লাস, বিষাদ ও অপরিচিতির ভয় এই সবকিছু মিলে বড়ো অস্থির করে তুলছিলো তার মনকে।
আশেপাশের ঝোপে জোনাকির ঝাড় জ্বলছে নিভছে। বাতাসে শেফালির মৃদু গন্ধ মিশে যাচ্ছে কটু বনগন্ধের সঙ্গে। হঠাৎ খানিক দূরে কোনো ঝোপের মধ্যে সড়সড় করে একটা শব্দ হতে শোভন সতর্ক হলো। ভাদ্রের শুরু। সাপখোপের উপদ্রব আছে এদিকে। দাঁড়িয়ে পড়ে জোরে জোরে কয়েকবার হাততালি দিয়ে নিল সে। তারপর মাটিতে পায়ের শব্দ তুলে জোরে জোরে হাঁটতে লাগলো। পায়ের ধাক্কায় মাটির কাঁপুনি টের পেলে সরে যাবে ওরা।
বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে চলবার পর হঠাৎ দাঁড়িয়ে কান খাড়া করলো শোভন। বাতাসে মেশা সুগন্ধের মতো হালকা একটা সুর দূর থেকে ভেসে আসছে। আওয়াজটা নদীর দিক থেকে আসছিলো। শোভন কান খাড়া করে শুনলো একবার। চূর্ণির ধারে এই এত রাতে গান ওই একজনই গাইতে পারে। ওই শব্দের উৎস ভুবন দাসের আখড়া। শব্দ লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি পা চালালো সে।
খানিক এগোতে কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ভুবন হিন্দি ভজন গাইছিলেন একটা—
কহে মনসুর মস্তানা
কি হক ম্যায়নে দিল মে পহচানা
কি য়ঁহি হৈ মস্তোঁ কি ময়খানা
ঈসি কে বিচ আতা যা—
চারটি লাইনকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার গাওয়া। শুনতে শুনতে ভারি বিস্ময় হচ্ছিলো শোভনের। মনসুর নামে কোন সন্ত কত সহজেই অ-লোকপন্থী সংকেতময়তা কিংবা ভারতীয় সংস্কৃতির পরলোকমুখী দর্শনের বদলে ঐহিক জীবনকে বারংবার উপভোগ করবার স্বপ্ন দেখে চলেছেন! এক সমাজ, একই দেশ, একই সময়ে কেমন করে বিশ্বাসের এহেন সমস্ত বৈপরীত্যকে হৃদয়ে ধারণ করে তবুও অটূট থাকে!
ঘরের ছাঁচতলায় পৌঁছে নীরবে দাঁড়িয়ে গান শুনছিলো শোভন। বিশুদ্ধ বাংলা লোকসঙ্গীতের সুর নয় এ। এক তীক্ষ্ণ অথচ মধুর ভিনদেশী সুরচালের সঙ্গে ভুবনের আশৈশবলালিত বাঙালি সুর ও উচ্চারণ মিশে গিয়ে এক উপভোগ্য ঢঙ তৈরি করেছে। হঠাৎ গান থামিয়ে ভুবন বলে উঠলো “বাইরে কে?”
“আমি,” শোভন জবাব দিল।
“কে, ছোটগোঁসাই? আরে, ওখানে দাঁড়ায়ে কেন? আসো আসো—” ভুবন তাড়াতাড়ি গান ফেলে উঠে এসে বাইরে দাঁড়ালেন।
“না মানে গানটা ভালো গাইছিলে, তাই ভাবলাম, শেষ হবার আগে ডিস্টার্ব করবো না—”
“হুঁ। আমার আবার গান, তার আবার ডিস্টাপ! আচ্ছা যাওতো, বারান্দার কোণে জলের ঘড়া আর ঘটি আছে—”
“—ও থিকে জল নিয়ে পা ধুয়ে আসো। তাই তো?” শোভন পাদপূরণ করলো। তারপর হেসে ফের বললো, “আচ্ছা ভুবনদা, আমায় আবার ওসব মনে করিয়ে দিতে হয় নাকি? কতো দিন থেকে তোমার এখানে আসছি বলো তো!”
“সে তো আসতা কতোই আগে আগে। তবে আজকাল যজ্ঞির কাম নিয়ে মেতেছো। বৈরিগির আখড়ার রাস্তা তো ভুলেই গেছো গোঁসাই। তাই ভাবলুম মনে আছে কি নাই—”
হঠাৎ নিতান্তই স্বভাববিরুদ্ধ ঢং-এ প্রায় খেঁকিয়ে উঠলো শোভন, “অত কৈফিয়ৎ তোমায় আমি দিতে পারবো না ভুবন দা! আচ্ছা, সব জায়গায় কি কেবল হাতজোড় করে আর কৈফিয়তই দিয়ে যেতে হবে আমায়? কোথাও কি একটু নিজের ইচ্ছে মতো--” বলতে বলতেই হঠাৎ একেবারে চুপ করে নিজেকে ফের সামলে নিয়ে অন্ধকারে একটু হাসলো সে, “ওই দ্যাখো! তোমার ওপর শুধুমুদু রাগ ঝাড়ছি। ছাড়ো ওসব কথা। তুমি গান শোনাও বরং। সেইজন্যেই চলে এলাম। আজ রাতটা তোমার কাছে থেকে গান শুনবো শুধু।” বলতে বলতে বারান্দার একধারে রাখা ঘড়া থেকে ঘটিতে জল ঢালতে ঢালতে বলল, “গানটা কোথায় পেলে বলো তো ভুবন দা! এ তো এই এলাকার গান নয় বলে মনে হচ্ছে!”
নিজের জায়গায় ফিরে এসে ফের বসে পড়েছিলেন ভুবন দাস। দোতারার কান মুলতে মুলতে বললেন, “ধরেছো তুমি ঠিকই গোঁসাই। চিত্রকূট গেছো কখনো? না গেলে ঘুরে এসো একবার। ভারি চমৎকার জায়গা। সেখেনে মন্দাকিনীর ধারে সতী অনসূয়ার নামে আশ্রম আছে। তার দেয়ালে কতো যে গান লেখা তার লেখাজোখা নাই। তাই থেকে এই একখান গান তুলে এনেছিলাম। মন্দাকিনীর ঘাটে এক সাধুবাবা সুরটা শিখায়ে দিল। সে যা গলা, আমরা তার নখের যুগ্যি নই গো! আজ অনেকদিন পরে সে গানখান মনে পড়লো। তাই সুরটা একবার ভাঁজতেছিলাম। তা সে নাহয় হলো। কিন্তু ডাক নেই খবর নেই মাঝরাত্তিরে একেবারে তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে হুমহাম করে এসেই এই বুড়োটার ওপরে রাগ ঝড়তে বসলা কেন বল দিকি? কিছু হয়েছে নাকি? শুনলাম থানায় নাকি ডেকে পাঠিয়েছিলো? কী বললো পুলিশে?”
ভুবনের পাশে এসে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলো শোভন। তারপর ধীরে ধীরে দুপুরবেলার ঘটনাগুলো খুলে বলে গেলো একে একে। সব শুনে অন্ধকারে মাথা নেড়ে ভুবন বললেন, “কিন্তু যে-পথে তুমি হাঁটা ধরেছো গোঁসাই তাতে এমন বিপত্তি যে আসবে সে তো তোমার জানা না থাকার কথা নয়! তবে?”
“সে তো জানি ভুবনদা। এই সমস্ত নিয়েই তো চলতে হবে। কিন্তু তবু, মনটা বড়ো খারাপ লাগে যে! তার ওপরে তো আমার হাত নেই।”
“তাতো বটেই। আসলে কথা কী জানো গোঁসাই? তোমার এখনো হাড় পাকে নাই। এই যে আমায় দেখো না! ভিক্ষেসিক্ষে করে খাই। সে আমার ধম্মো। তা সেই করতে গিয়ে কম কথা শুনতে হয় নাকি? চোর ছ্যাঁচোড় জোচ্চোর, এইসব গালাগাল তো যেদিন থিকে পথে নেমেছি সেদিন থিকেই আমার অঙ্গের ভূষণ। শুনে শুনে হাড় পেকে গেছে। এখন আর গায়ে লাগে না। আমার ধম্মো আমি করি। তাতে যে যা বলে বলতে থাকগে না। ও শুনে মন খারাপ করলে নিজের ধম্মো ছাড়তে হবে যে! সে আমি পারবো নাকি? নাকি তুমি পারবা!”
মৃদুগলায় বলা কথাগুলো, জ্বরতপ্ত কপালে একটি স্নিগ্ধ হাতের ছোঁয়ার মতো ঠেকছিলো শোভনের। তার মনের সব উত্তাপ দূর হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কথা বলতে বলতেই দোতারায় মৃদুমন্দ সুর বাঁধছিলেন ভুবন দাস। পাশে পড়ে থাকা শ্রীখোলটি কোলের ওপর তুলে নিয়ে তাতে কয়েকটি আদুরে চাপড় মারল শোভন। তারপর বলল, “কথা রেখে এখন একটা গান ধরো তো ভুবনদা! আমি ঠেকা দিচ্ছি।”
“কী শুনবা?”
“ওই যে—পরের জায়গা পরের জমি। মনে আছে? বিশ্বেশ্বর দাস সেবার চাঁপাগঞ্জের মেলায় গেয়েছিলো? বুলিটা জানো তো?”
পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই গো আমি রই
আমি তো সেই ঘরের মানুষ নই
ঘরখানা যার জমিদারি আমি পাইনা তাহার হুকুমজারি
আমি চলি যে তার মন জুগাইয়া মনের দুঃখ কারে কই
আমি তো সেই ঘরের মানুষ নই।
জমিদারের ইচ্ছামতো দেয়না জমি চাষ
তাইতে ফসল ফলে না ভাই দুঃখ বারোমাস
আমি খাজনাপাতি সবই দিলাম
তবু জমিন আমার হয়গো নিলাম
পাইনা জমিদারের দেখা দাখিলে মিলে না সই
আমি তো সেই ঘরের মানুষ নই—
--শেষের দিকে গলা মিলিয়েছিলো শোভনও। অবশেষে একসময় কথার চলন শেষ হয়ে গিয়েও সুরের সুরভিটুকু রয়ে গেল শুধু আখড়ার অন্ধকার বাতাসে। শেষ পংক্তিটি তখনো শোভনের সঙ্গ ছাড়েনি। অন্যমনস্কভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে গুন্গুন্ করে চলেছিলো তার নির্ভাষ সুরটি। হঠাৎ ভুবনের কৌতুকতরল কথায় তার চমক ভাঙল, “না গোঁসাই, এ তো ভালো লক্ষণ নয়!”
“মানে?”
“মানে ভোগের বয়েসে হঠাৎ এমন ত্যাগের গানে ভক্তি দেখি, তাই বললাম আর কি! শুধু পুলিশের হাঁকডাকে তো এমনটা হবার কথা নয়! আরো কিছু কি হয়েছে নাকি গোঁসাই?”
একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে শোভন তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, “উঁহু। হবে আবার কী?” তারপর তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পালটে বললো, “এগারোটা বোধ হয় বাজতে চললো। খেতে দেবে না ভুবনদা?”
অন্ধকারে নিজের মনেই মৃদু মৃদু হাসছিলেন ভুবন দাস। শোভনকে তিনি আজ থেকে দেখছেন না। মন উচাটন হবার সবটা কারণ তাঁকে এ খুলে বলেনি। শুধুমাত্র দিনযাপনের প্রাত্যহিক রক্তপাতে দমে যাবার ছেলে এ নয়। তার পাশাপাশি অন্য কোন দ্বন্দ্বও চলেছে এর বুকের ভিতর। অভিজ্ঞ মানুষটি তার কারণ খানিকটা হলেও আন্দাজ করতে ভুল করেন না। উঠে ঘরে গিয়ে একটি কেরোসিনের লম্ফ জ্বালিয়ে রাতের খাওয়ার আয়োজন করতে করতেই সাবধানে জিজ্ঞাসা করলেন, “ফরিদাদিদি কিছু বলেছে টলেছে নাকি? বাব্বা, যে তেজি মানুষ!”
“নাঃ। সে আর কী বলবে!”
“না তাই বলছিলাম আর কি। ছাড়ো গোঁসাই ও কথা। খেতে দিয়েছি। এখন খেতে এসো।”
“ভালো খেলে গোঁসাই?”
শোভন একপাশে মাথা হেলাল। সেই সুদূর কৈশোর থেকেই ভুবনের রান্না এই পাঁচমেশালি চালডাল সিদ্ধর স্বাদ লেগে রয়েছে তার স্মৃতিতে। কলেজে পড়ার সময়—নাকি তারও বহু আগে--অতীতের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া কোনো প্রাক্তন জীবন থেকেই হয়তো বা--এই মাটির হাঁড়িতে রান্না করা মাধুকরির পাঁচমেশালি অন্নের স্বাদটি তার পরিচিত।
“সে তো বৈরিগির অন্ন তোমার মুখে ভালো ঠেকবেই,” মাথা নাড়লেন ভুবন, “কিন্তু, মন ভরলেও পেট তো বোধ হয় ভরে নাই। বুড়োমানুষ একা একা খাবো বলে একমুঠ চালেডালে রেঁধেছিলাম। সেই খাবার ভাগাভাগি করে খেলে তোমার মতো জোয়ান ছেলের পেট ভরে? শোন, ঘরে মুড়ি আছে এক ঠোঙা। কাঁচা লংকাও আছে। চাও তো--”
“উঁহু, দরকার নেই,” মাথা নাড়লো শোভন, “চলো বারান্দায় গিয়ে বসিগে ভুবনদা। হাওয়া ছেড়েছে বাইরে। ঘরের ভিতর যা গুমোট--”
“তুমি যাও গোঁসাই। গিয়ে বোসো গে, আমি হাঁড়িটাড়ি ধুয়ে রেখে আসছি,” বলতে বলতেই হঠাৎ কান খাড়া করে ভুবন দাস বললেন, “তোমার ফোন বাজলো মনে হয়?” শোভন তাড়াতাড়ি পকেটে হাত ঢুকিয়ে তার টেলিফোনটা বের অরে আনলো। তার উজ্জ্বল হয়ে ওঠা পর্দায় একটা বিদেশি ব্যাংকের নাম। তাকে বিনামূল্যে একটি ক্রেডিট কার্ড দেবার প্রস্তাব দিয়ে মেসেজ পাঠিয়েছে তারা।
ফোনটার সুইচ অফ করে দিয়ে বাইরে গিয়ে বসলো শোভন। চারপাশে ঘিরে থাকা সান্দ্র, সুগন্ধ অন্ধকারকে যেন বা হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। কুপি নিভিয়ে দিয়েছেন ভুবন। ঘরের ভিতরের অন্ধকার থেকে তাঁর কাজকর্মের খুটখাট শব্দ আসছিলো। অভ্যস্ত হাতে যৎসামান্য সাংসারিক কাজ সারতে তাঁর আলোর প্রয়োজন হয় না।
খানিক বাদে প্রায় নিঃশব্দে ভুবন এসে বসলেন তার পাশে। তারপর তার চাবির গোছাটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, “ফোন বের করবার সময় এইটে মেঝেতে পড়ে গেছিল। নাও গোঁসাই, ভরে রাখো ফের।”
চাবিটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে একটু ইতস্তত করে শোভন জিজ্ঞাসা করলো, “কীসের চাবি জানতে চাইলেনা ভুবনদা?”
“আমি তো আগেই জানি গো। তুমি তো আর নিজের ঘরের খবর রাখো না গোঁসাই। তোমার আর কী? ওদিকে চিন্তায় পড়ে আমার ফরিদা মা। আমায় ডেকে সেদিন বলে, ‘দেখো দেখি ভুবনদা। যখন তখন যেদিক খুশি চলে যায়, রাতের বেলা ঘরবাড়ি খোলা পড়ে থাকে। যদি কেউ--’ শুনে আমি ফরিদা মাকে বললাম, ‘ও পাগলের কি সে বোধশোধ আছে? তুমিই মা ঘর সামলাও। তালাচাবির বন্দোবস্ত করো।’ তা সে মেয়ে বলে, ‘শোভনদাদাকে জিজ্ঞেস করি একবার।’ আমি বললাম, ‘জিজ্ঞেস করবার তো কিছু নাই মা! ইশকুল তোমারও।’”
“ভুবনদা, তুমি নিজে কখনো আখড়ার দরজায় তালা লাগিয়েছো?”
“না গোঁসাই। আমি ভিখিরি মানুষ। হারাবার তো কিছু নাই। থাকবার মধ্যে এই একখান দোতারা আর শ্রীখোল, বুকে ভক্তি আর গলায় গান। দুনিয়ার ভার আমি বইনা গোঁসাই। সেই আমার ভার বয়। তালাচাবিতে তাহলে আমার কী হবে? কিন্তু, তুমি তো ভিখিরি নও গোঁসাই! দেশের-দশের কাজে লেগেছো কোমর বেঁধে। কত মানুষের নির্ভর তোমার ওপর। তোমার ঘর কেন খোলা থাকবে?”
“এতদিন তো খোলাই পড়ে থাকতো ভুবনদা! তখন তো কিছু বলো নি কখনো! আজ কেন তবে--”
“বলি শোন। ইরশাদের সেই বর্ষীর রাতে আমার রাধারানির সঙ্গে তোমায় জোড়-এ দেখলাম যখন, তখন বুক ভরে গেছিলো। মরি, মরি, কী রূপ। তা সেই রাধারানি গেলেন, আর তার পরপরই মা ঠাকরুণও দেহ রাখলেন। তোমার দেহপিঞ্জরে সেই তখন থিকে বৈরাগির বাস হয়েছিলো গোঁসাই। তারপর অসুরের মতো কাজে ঝাঁপালে। তবে সে ছিলো তোমার নিজেরে নিজে ভুলে থাকবার কল। চোরে চোর চেনে গোঁসাই। তা সে যে ভেকই নিক না! বৈরিগিও তেমন বৈরিগি দেখলে ঠিক চিনতে পারে। জানতাম আজ নয় কাল ঠিক সব ছেড়েছুড়ে এসে বলবে, ‘চলো যাই—’
“সেইদিনের অপেক্ষায় বসেছিলাম গোঁসাই। তা হঠাৎ করে ভৈরবি বেটি এসে সব দখল করে বসলো। এখন সে তোমায় নিজের মতে চালাবে। তোমার আর বৈরিগি হওয়া হল না।”
খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে অন্ধকারে মাথা নেড়ে শোভন বললো, “না ভুবনদা। সেসব হবার নয়। আমার পথ আমি নিজে ঠিক করে নিই ভুবনদা। অন্যে ঠিক করে দেয় না।”
“কী হবার আর কী হবার নয় সে কথা ঠিক করে দেবার হক তোমার আর নাই গোঁসাই। মেয়েজাতকে অত সহজ ভেবো না। ওই জাত পুরুষকে পেটে ধরে দশমাস, তারপর বুকের দুধ খাওয়ায়ে পুরুষ করে। ওর কাছে তোমার কোন জারিজুরি খাটবে ভেবেছো? সাক্ষাৎ হ্লাদিনী শক্তি। তার হাত থেকে স্বয়ং নারায়ণ পালায়ে বাঁচে নাই। বিন্দাবনে একটাকে ছেড়ে গেলো তো মথুরায় একেবারে তিনটেয় এসে ধরলো। তার কাছে তুমি তো কোন ছাড়!”
“রাখো তো তোমার ঘটকালি,” হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসলো শোভন, “কোথায় এলাম দুটো গান শুনবো বলে! তা না--”
“আহা চটো কেন গোঁসাই! শোন তবে একখান গান। সুফিয়া কাঙালিনীর নাম শুনেছো?”
সুরহীন বাক্যালাপের স্রোতটি ধীরে ধীরে ফের মিশে যায় নতুন এক সুরের ধারায়—
“ভাটির গাঙের নাইয়া শুনালি গান গাইয়া আমার ভাটির গাঙের নাইয়া সুন্দর তোমার নাও রে মাঝি রঙ্গিল পাল উড়াইয়া তীরে তীরে যাইও রে নৌকা পিলারী লাগাইয়া শিমুল তাকির নৌকা রে মাঝি নুনায় যায় খাইয়া কাঙ্গালিনী সুফিয়া বলে উঠবে পীড়া দিয়া তোমার হল সোনার তরী আমার রূপের বৈঠা মাঝি রে ভাটির গাঙে নাও রাখিয়া যাও উজানে বাইয়া--”
যুবকটি মুগ্ধ হয়ে শোনে। এ গান তার অজানাই ছিল এতকাল। কাঙালিনী সুফিয়ার নাম সে শোনেনি কখনো। দেহধারী মানুষ তুমি হে। ভাঁটার টান তুমি এড়াবে কী করে? উৎস থেকে পরিণতির দিকে অধোগমন তোমার নিয়তি যে। কিন্তু, দেখার চোখ যদি থাকে, তাহলে যে রূপের বৈঠায় ভর করে তোমার দেহ ভাসবে ভাঁটার অমোঘ টানে সেই বৈঠাই তোমায় অন্তরে উজানে বাইবার পথ দেখাবে। মৌখিক পরম্পরায় বহে আসা সেই ঘর ও বাহিরকে একসঙ্গে নিয়ে পথ চলবার শিক্ষাটি সেই অন্ধকার রাত্রে ফের একবার প্রবাহিত হয় গুরু থেকে শিষ্যের অভিমুখে।
গাইতে গাইতে অন্ধকারে মৃদু হাসি ফুটছিল ভুবন দাসের মুখে। পৌরুষাক্রান্ত যুবকটি তার নিজের ভবিতব্যকে মেনে নিতে পারে নি এখনো। অন্তরে নিশ্চিত পরিণতিটিকে অনুভব করেও স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে প্রাণপণ। একদিন তিনিও করেছেন। প্রায় বিস্মৃত অতিদূর যৌবনের সেই দিনগুলি আজও তাঁর স্মৃতিকে তাড়িত করে। সে বিষামৃতময় পথ তিনি পেরিয়ে এসেছেন বহু আগে, বহু দুঃখের আগুন পেরিয়ে।
এ গান তাঁকে শিখিয়েছিল টগর। মেয়ে হয়ে বছরদুয়েক থিতু হয়ে কাটাবার পর, ভুবনেরই তাড়নায় ফের ঘরবাড়ি ছেড়ে পথে বের হয়েছেন তখন তাঁরা। বর্ষার চারটি মাস কোনো আখড়ায় কাটিয়ে বাকি আটমাস পথে পথে মেলায় মেলায় ঘুরে সংসার। তাঁদের জুটির গানের খ্যাতি ছিল এলাকায়। মাধুকরির ঝুলি তাঁদের খালি ফিরতো না কোনদিন। রাতে কোনো আখড়ায় বা মন্দিরে মাথা গোঁজবার আশ্রয়ও জুটে যেত ঠিক। তবু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রাণে শান্তি থাকতো না যুবকটির। ধর্মনাশিনী যেন তাঁর পায়ের দ্বিতীয় শিকলটি হয়ে জন্মেছে! সেই অস্থিরতার সময়েই একবার, রাজশাহীর কান্তজির মন্দিরের নির্জন চাতালে ঘুমন্ত মেয়ের পাশে তাঁর গা ঘেঁষে বসে সুফিয়া কাঙালিনীর এই গান শুনিয়েছিল তাঁকে টগর। ভবানন্দ বৈরাগির মেয়ে। তত্ত্বজ্ঞানে তার অধিকার ছিল জন্মগত। সন্তান জন্মাবার পর ভুবনের বন্ধনভয় তার চোখ এড়ায় নি। হয়তো তাই সে যাবার আগে তাঁকে পথ দেখিয়ে গিয়েছিল এইভাবে।
তারপর চৌষট্টি সনের সেই দুঃস্বপ্নের দিনরাত--স্বপ্ন ভেঙে উঠে ভুবন ফের নিজেকে খুঁজে পেলেন রানাঘাটের হাসপাতালের বিছানায়। টগর তারপর তাঁর স্বপ্নেও আর আসেনি কোনোদিন। শিশুসন্তানটি কিন্তু বহুবার, বহু বিনিদ্র রাতের ক্ষণিক তন্দ্রার অবসরে তাঁর পিছনটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ দেখতে পান নি তার। চপল হাতে তাঁর চোখদুটি চেপে ধরে—
“কী হলো ভুবনদা? চুপ করে গেলে যে হঠাৎ?” চমক ভেঙে একটু অপ্রস্তুর গলায় ভুবন দাস সাফাই দিলেন, “ও কিছু না গোঁসাই। ঢুলুনি এসে গেছিল বোধ হয় একটুখানি। বুড়ো মানুষ! তোমাদের মতো কি আর জেগে জেগে রাত কাবার করে দিতে পারি?” “এই দেখো। আমার একেবারে খেয়াল ছিল না,” শোভনের গলায় অস্বস্তির আভাস, “চলো শুয়ে পড়ি।” “হ্যাঁ গোঁসাই। সেই ভালো। তোমারও তো ধকল কিছু কম যায় নাই আজ! চলো দেখি। ঘরে বিছানা পাতাই আছে।” “উঁহু, ঘরে আর ঢুকবো না ভুবনদা। যে গরম দিয়েছে!” “ভালো কথা। দাঁড়াও তবে। চ্যাটাই নিয়ে আসি একখান। ওইতে দুজন মিলে সেই আগেকার মতো--”
রাত্রি গভীর হয়। এতক্ষণে চূর্ণির বুক থেকে ফুরফুরে হাওয়া ছেড়েছে একটুখানি। পাশে শোয়া যুবকটি ঘুমের মধ্যেই অস্ফুট আওয়াজে কী যেন বলে চলে মাঝে মাঝে। তার পাশে নিঃশব্দে জেগে থাকেন ভুবন দাস। আজ বহুকাল পরে তাঁর চেতনার দখল নিয়েছে বিস্মৃতকালের স্মৃতির দল--
--টগরী আর তার সেই মুখ না-মনে-পড়া শিশুটি--স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে থাকা সেই ক্ষণস্থায়ী রূপের বৈঠাদুটিকে সম্বল করে, ভাঁটার অধোগামী পথ ছেড়ে উজানের পথে খেয়া বেয়ে বহু দুর এসেছেন তিনি। আজ আর কোন দুঃখ তাঁকে স্পর্শ করে না। জীবন বড়ো নিষ্ঠুর দাতা। তাঁর বন্ধনমুক্তির সাধ সে পূরণ করেছে বটে তবে তার জন্য বড়ো চড়া মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে। কে জানে, এই জেদি যুবকটির কাঙ্ক্ষিত অসংসারের জীবনের সাধও হয়তো সে পূরণ করে দেবে একদিন। আহা, তার বিনিময়মূল্য এত কঠোর না হয় যেন প্রভু! শীর্ণ হাতটি তাঁর, নিজের অজান্তেই আদরের স্পর্শ নিয়ে উঠে আসে যুবকটির পিঠের ওপর—
|| ১২ || ফোনটা টিঁ টিঁ করে বেজে উঠতে চমক ভেঙে শোভন তাড়াতাড়ি সেটা তুললো। ব্রতীনের কল। এই কলটার জন্যই অপেক্ষা করছিল সে এতক্ষণ।
“কী গো, ব্যবস্থা হল?”
“হয়েছে,” ওপাশ থেকে ব্রতীনের গলাটা বেশ খুশি খুশি শোনাচ্ছিল, “বিকাশভবনে আমার ব্যাচমেট অরিন্দম পোস্টেড আছে। তাকে দিয়েই ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছি। সৌগতবাবুকে পূর্বাচলের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে কাল দুপুর দুটোর মধ্যে ঢুকিয়ে দেবে এনে। ওই গাড়িতেই আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবে রাতে। ওদের অফিসে যেখান থেকে গাড়ি ভাড়া নেয় সেই কোম্পানির সঙ্গেই ব্যবস্থা হয়ে গেছে। মিনিমাম চার্জ নেবে। আপনার বাজেটের মধ্যেই এসে যাবে। চেনা ড্রাইভার দিচ্ছে ওরা। নো প্রবলেম।”
“গুড। একটা বড়ো টেনশন গেল। অমরেশবাবু লাস্ট মোমেন্টে যা করলেন, আমি তো ভাবলাম, গেলো বুঝি সব গণ্ডগোল হয়ে। থ্যাংক ইউ ব্রতীন। তুমি না থাকলে আজ--”
“থাংক ইউ বলবেন না শোভনদা। ভুলটা আমারই ছিলো। আসলে অমরেশবাবু নিজে থেকেই আগ বাড়িয়ে যখন বললেন উনি সল্ট লেক থেকে আসবার পথে নিজের গাড়িতেই সৌগতবাবুকে তুলে নিয়ে চলে আসবেন, আমি অবিশ্বাস করবার কোন কারণ দেখিনি। আপনি একবার সাবধানও করেছিলেন। আমিই কানে তুলিনি কথাটা। ভদ্রলোক যে শেষ মুহূর্তে এমন পালটি খেয়ে যাবেন--”
শোভন হাসল, “অতটা হার্শ হয়োনা ব্রতীন। ভদ্রলোকের হয়তো সত্যিই কোন জরুরি মিটিং পড়ে গেছে। পলিটিক্যাল লোক! কখন কোন দরকার পড়ে--”
“বাজে কথা শোভনদা। আমাদের সুরঞ্জনদা এখন পঞ্চায়েত মন্ত্রীর পি এস। আপনার ফোনটা আসবার পর ওকে ফোন করেছিলাম। ভদ্রলোক যে পঞ্চায়েত মন্ত্রীর হঠাৎ কাল মিটিং ডাকার কথা বলেছেন সেটা ডাহা মিথ্যে। মন্ত্রী আজ বিকেল থেকে রায়গঞ্জ ভিজিটে চলে যাচ্ছেন তিন দিনের জন্য। শুনে আমি অমরেশবাবুকে একবার ফোনও করলাম। মুখের ওপর তো আর মিথ্যেবাদি ডাকতে পারিনা, তাই কিছু না জানার ভান করেই জিজ্ঞাসা করলাম কাল আসছেন কি না। লোকটা মহা ধূর্ত। বলে, ‘সে কি? শোভন আপনাকে কিছু বলে নি? আমি তো যেতে পারছি না। হঠাৎ মিটিং পড়ে গেছে একটা। আর সেক্ষেত্রে সৌগতবাবুকেও ছেড়ে দিন বরং। বুড়ো মানুষ। ট্রেনে করে তো আর যেতে পারবেন না! তাছাড়া, আমি নিজেই যখন থাকতে পারছি না, তখন অতবড় স্টেচারের একজন মানুষকে ওরকম একটা ছোটখাট গ্রাম্য ফাংশানে ডেকে নিয়ে গিয়ে হেনস্থা করে কাজ নেই।’”
“তুমি কিছু বললে না?”
“উঁহু। আমার তখন মাথা গরম হয়ে গেছে। কথা বললে ঝগড়া হয়ে যেতো। ফোনটা ছেড়ে অরিন্দমকে ফোন করে সব ব্যবস্থা করে ফেললাম। সৌগতবাবুর সঙ্গেও কথা হয়ে গেছে। কাল বারোটা নাগাদ স্টার্ট করবেন।”
“শোভনদা, একবার মূল মঞ্চে যেও। মাইকওয়ালা ডাকছে,” জানালার পাশ দিয়ে হন হন করে যেতে যেতে সমীরণ উঁকি দিয়ে বলে গেলো।
আওয়াজটা ব্রতীনের কানে গিয়েছিল। সে তাড়াতাড়ি বলল, “ওই যে আপনার ডাক পড়েছে। ঠিক আছে, এখন রাখছি শোভনদা। হাতের কাজগুলো একটু গুছিয়ে রেখে ঘন্টাখানেকের মধ্যে মাঠে পৌঁছে যাবো। তারপর একেবারে কাল রাত অবধি টানা আছি।”
“সে কি? শর্মিষ্ঠা তো নেই। রাতে বাড়ি ফাঁকা রেখে আসবে?”
“ও কিছু হবে না। একটা রাতের ব্যাপার। শর্মিষ্ঠার ভাইয়ের ফ্লাইট আজ রাত সাড়ে বারোটায়। কাল সকালে সাতটা আটের ট্রেনটা ধরে ফিরবে। দশটার মধ্যে বাড়ি।”
“ফাইন। চলে এসো তাহলে। ছাড়ছি এখন।”
ফোনটা রেখে হাতের কাজের দিকে মন দিল শোভন। বিরামনগর বালিকা বিদ্যালয়ের একতলার এই ঘরটা থেকে পাশের গোটা মাঠটা চোখে পড়ে। উপস্থিত এ ঘরটায় শোভন একটা অফিসমতো করে বসেছে। খাতা হাতে সামনে বসে থাকা ছেলেদুটির দিকে তাকিয়ে সে বললো, “নে দেখা এবারে।”
“হ্যাঁ। এই যে। হাউজ টু হাউজ কালেকশনের হিসেব হলো--”
“ওটা পরে দেখবো সুকল্যাণ। আতাখালির গঞ্জের বাজারের হিসেবটা বল আগে। ওদিকটা আমি একেবারে দেখিনি।”
সুকল্যাণ নামের ছেলেটি তাড়াতাড়ি হাতের খাতাটির কয়েকটি পাতা দ্রুত উলটে গিয়ে একটি পাতায় এসে স্থির হয়ে বলে, “এই যে--গঞ্জের বাজার থেকে ক্যাশ কালেকশন এখন অবধি টোটাল বারো হাজার ছশো আটচল্লিশ। আরো কিছু আসবে। এটা দোকান টু দোকান কালেকশন। ব্যবসায়ী সমিতি একটা থোক টাকা দেবে বলে প্রমিস করেছে। সেটা কাল আনতে যাবো। আর চালডালের জোগাড় হয়েছে মোট—”
“শোভনদা। মাইকওয়ালা এবারে চলে যাবে বলছে কিন্তু। রেকর্ডিং-এর ব্যাপারে কী দেখিয়ে দেবে তাই দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে,” জানালার বাইরে থেকে অপেক্ষাকৃত তরুণ একটি গলার অধৈর্য আওয়াজ ভেসে এল ফের।
“এই রে! দাঁড়া আসছি। ওটা গণ্ডগোল হলে তো সব গেলো,” বলতে বলতে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো শোভন।
সুকল্যাণ একটু বিরক্ত মুখে বললো, “হিসেবটা একেবারে দেখে নিয়ে তারপর গেলে হয় না? দু-পাঁচ মিনিট তো লাগতো বড়জোর!”
“উঁহু। রেকর্ডিং নিয়ে প্রচুর ঝামেলা করছে বনমালী ইলেকট্রিক। পুজো, বিয়েবাড়ি আর রক্তদান শিবিরের লাইট মাইক করে এসেছে চিরকাল। এরকম ফুলস্কেল লাইভ রেকর্ডিং তো কখনো করেনি। দেখিয়ে না দিলে পরে গণ্ডগোল হয়ে যেতে পারে। এতগুলো মঞ্চে তিনরাতের প্রোগ্রাম! অতগুলো গানের ভ্যারাইটি ! একটা পারফর্মেন্সও খারাপ রেকর্ডিং হলে লোকসান হয়ে যাবে রে! ফরিদা মাঠে ফেরেনি এখনো? ওকে--”
“ফরিদাদিই তো বললো, আপনাকে একবার সবকিছু দেখিয়ে দিতে। দুপুরে মাঠ থেকে ফেরবার সময় বলে গেলো বিকেলে না-ও আসতে পারে। হিসেবপত্র যা আছে আপনাকে দেখাতে।”
শোভন একটু অবাক হয়ে বলল, “যাবার আগে কিছু বলে গেল না তো আমায়!”
“তোমাকে খুঁজছিলো। আমায় জিজ্ঞেস করছিলো কোথায় গেছো। বললাম বিরামনগরে গেছো, আসতে ঘন্টাদুয়েক দেরি আছে। ফোনও করেছিলো তোমায় কয়েকবার। লাইন পায়নি।”
“কী হল হঠাৎ? তোদের কিছু বলেছে?”
“না। তবে মনে হয় ফরিদাদির বাবার বোধ হয় আজ সকাল থেকে ফের শরীর খারাপ হয়েছে। শর্মিষ্ঠাদিকে ফোনে সেই নিয়ে কীসব বলছিলো।”
“হুঁ,” অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়লো শোভন একবার। তারপর বলল, “টাকাপয়সার হিসেবটা তাহলে তোরা বরং খানিক বাদে ব্রতীন এলে তাকে বুঝিয়ে দিস। আমি গিয়ে ওদিকটা সামলাই এখন।”
বিস্তীর্ণ মাঠটির ওপরে জায়গায় জায়গায় মাটি কেটে উঁচু করে সমতল কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করানো হয়েছে। তার ওপরে ঘাসের চাপড়া চেপে চেপে বসিয়ে জল ছিটনো হয়েছে কদিন ধরে। আড়ংঘাটার ওদিকে অষ্টসখীর গানের একটা বাৎসরিক উৎসব হয়। মাটির মঞ্চের পরিকল্পনাটা তাদের থেকে ধার নেয়া। ওতে করে খরচ বেঁচে গেছে অনেকটাই। মাটি কেটে জমি উঁচু করবার কাজে শোভনের গোটা স্কুলটাই হাত লাগিয়েছিলো এসে। দুপুরে তাদের সামান্য কিছু টিফিন খাওয়ানো ছাড়া আর কোন খরচ লাগেনি বিশেষ তাতে। তাদের ঘিরে মাঠ জুড়ে বাঁশের খুঁটির মাথায় মাথায়, হেমন্তের রাত্রে ঝরে পড়া শিশির আটকাবার জন্য পাতলা চটের আবরণ লাগানোর কাজ চলেছে তখনও।
“ক্যাচারগুলো আর একটু নিচু করে লাগাতে হবে বনমালীবাবু। মঞ্চপ্রতি একটা করে মাত্র ক্যাচার। হাইট বেশি হলে--”
বনমালী নামের প্রৌঢ়টি এতক্ষণ মনযোগ দিয়ে শোভনের কথা শুনছিলেন। এইবারে বাধা দিয়ে বললেন, “বলছেন যখন, নামিয়ে দিচ্ছি আর একটু, কিন্তু খুব বেশি নামাতে পারবো না আর। অন্তত সাড়ে সাত ফিট ক্লিয়ারেন্স তো দেবেন শোভনবাবু! নইলে হাত পা ছুঁড়ে গাইবার সময় ধাক্কা লেগে খুলে পড়ে গেলেই তো চিত্তির।”
“ওতে হবে?”
“খুব হবে। মোহনপুর ক্লাবের নাট্যোৎসবে মাইক করি তো আমি। ওরা তো প্রায় দশ ফিট ক্লিয়ারেন্স দেয়। সমস্যা হয় নাতো কিছু!”
শোভন অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল, “ওটা তো কেবল মাইকের জন্য। এখানে তো ওর ফিড নিয়ে রেকর্ডিং-ও হবে, তাইনা?”
“আরে হয়ে যাবে মশায়। মাইকের জন্য ফিড পেলে রেকর্ডারের জন্যও পাবে। ও আপনি ভাববেন না। তাহলে ওই সাড়ে সাত ফিটই--”
বনমালীবাবুর কথাটার মাঝখানেই শোভনের হাতের মুঠোর ভিতরে ফোনটা ফের শব্দ করে উঠল। পর্দায় ফরিদার নাম ভাসছে। সে তাড়াতাড়ি একপাশে সরে গিয়ে কলটা ধরল।
“কী রে? হঠাৎ চলে গেলি যে? সব ঠিক আছে তো?”
“শোভনদা--” যন্ত্রের ওপাশে ফরিদার গলায় মৃদু কাঁপুনির আভাস ছিলো, “বাবা একটু আগে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। হাত পা নড়ছে না। আমার খুব--” কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে ঠাণ্ডা গলায় সে বললো, “আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমায় কটা টাকা পাঠিয়ে দিতে পারো যদি কাউকে দিয়ে তাহলে খুব ভালো হয়। আর, আতাখালির হাসপাতালে কারো চেনাশোনা আছে?”
“কার ফোন শোভনদা?”
ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দিলো ফরিদা।
শোভন আনসারের দিকে ফিরে বললো, “ফরিদার বাবার সিরিয়াস কিছু একটা হয়ে গেছে বোধ হয়। হাজারখানেক টাকা দিয়ে দিচ্ছি। তুই নিয়ে এক্ষুনি বেরিয়ে যা। একটা ইঞ্জিন ভ্যান নিয়ে চলে যাস। তাড়াতাড়িও হবে, কাজেও আসবে। আর, আতাখালির হাসপাতালে--”
“টাকাটা দাও,” আনসার হাত বাড়ালো, “আতাখালির হাসপাতাল নিয়ে ভেবো না। পার্টির দুটো ছেলে মাসকয়েক হলো ওখানে টেম্পোরারি জিডিএ-র কাজ পেয়েছে। চেনা ছেলে। হোল্ড আছে ভালো। প্রবলেম হবে না। আমি যেতে যেতে ফোন করে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
“একা সামলাতে পারবি তো? নাকি আর কাউকে সঙ্গে লাগবে?”
সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে তার সিটে উঠে বসতে বসতে আনসার মাথা নাড়লো, “কাউকে দরকার হবে না। আমি একাই সামলে নিতে পারবো। কোন ত্রুটি হবে না। তুমি এখন এদিকে কনসেনট্রেট করো তো! আমি দরকারমতো খবর দিয়ে যাবো তোমায়। আর, ভালো কথা, আমি ইশকুলবাড়িতে আর্টিস্টদের অ্যাকোমোডেশনের ব্যাপারটা দেখছিলাম। আমার জায়গায় সুবিমলকে লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। ও সামলে দেবে ওদিকটা।”
কিন্তু তার নিজের তৈরি কাজ তাকে সেই ব্যক্তিগত অনুভূতির বিলাসিতাটুকু করবার সময় দিতে রাজি নয় তখন আর। মাঠ জুড়ে বহু মানুষের হাতে হাতে শেষমুহূর্তের কাজ চলছে তখন। একের পর এক এসে পৌঁছচ্ছে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনেচ্ছু বাউল ফকির বৈরাগির দল। কত পরিচিত ও অপরিচিত মুখ! নিমন্ত্রিত দলগুলির থাকবার ঠাঁই হয়েছে ছুটি চলা ইশকুলের বিভিন্ন ঘরে। একে একে তাদের সঙ্গে স্বাগত ও প্রীতি সম্ভাষণের পালা চলে যুবকটির।
অবশ্য আগন্তুকদের সকলেই যে নিমন্ত্রিত তা-ও নয়। গানের আসরের খবর মুখে মুখে ছড়ায়। আত্মসুখে গান। নিমন্ত্রণের পরোয়া কে করে। লোকমুখে খবরটুকু পেলেই যথেষ্ট। অনুষ্ঠানের এলাকার বাইরে পুকুরের পাশে, ফাঁকা কৃষিজমিগুলির ওপরে, গাছের তলায়, ধীরে ধীরে ছেয়ে আসা কুয়াশার হালকা আস্তরের মধ্যে যেন আপনা আপনি গজিয়ে উঠছে এমনই সব রবাহূত গায়ক দলেদের ডেরা। তাদের অনেকের সঙ্গেই মুখ চেনা আছে শোভনের। কেউ কেউ এসেছেন সীমান্ত পেরিয়ে কুষ্টিয়ার থেকেও। তাঁদের গানের দুনিয়ায় দেশকালের সীমান্তের বাধা নেই। মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলে প্রীতিসম্ভাষণের সঙ্গেসঙ্গেই ঝরে পড়ে অনুযোগ ভরা রঙ্গরসিকতা, “ভাবছো বুঝি খবর না দিয়া বাঁচবা গোঁসাই! এই দ্যাখো কেমন চলি আলাম সব। যা গান শোনাবো এবারে, দেখো খন।”
ডেরাগুলিতে ছোট ছোট অগ্নিকুণ্ড জ্বলে উঠছে একের পর এক। নানা উচ্চারণে নানা কন্ঠের হাঁকে ডাকে, হঠাৎ বেজে ওঠা বাদ্যযন্ত্রের শব্দে কিংবা অসমাপ্ত কোনো গানের কলিতে তখন জীবন্ত হয়ে উঠছে গোটা এলাকাটা। এইখানে, এই ভূমিতে, এই সুরময় , কর্মময় জনঅরণ্যে বাঁধা আছে যুবকটির আত্মা। বহুদূরে একলা একটা নির্জন বাড়িতে, তার সাহায্যের আশায় অপেক্ষা করে থাকা ম্লান মুখটা কাজেই ধীরে ধীরে তার সচেতন চিন্তার গণ্ডির বাইরে চলে যায়। এখন অনেক কাজ তার সামনে। কিন্তু তবু, মনের গভীরে কোথাও যেন একটা ছোট্ট কাঁটা বার বার বিদ্ধ করে চলে তাকে। সেই কাঁটাটুকুকে সঙ্গে নিয়েই সে যন্ত্রের মতো চড়কিপাক খেয়ে ঘুরতে থাকে কর্ম থেকে কর্মান্তরে। এত মানুষ, এত গান—সেইসব বাদে আর কিছু ভাববার তার সময় কোথায় তখন!
|| ১৩ ||
“করেছো কী হে! এ তো উত্তর-দক্ষিণ-পুব-পশ্চিম মিলিয়ে লোকগানের মহাসম্মেলন! বলা যায়, ফোক মিউজিক কংগ্রেস!” প্রৌঢ়ের গলায় উত্তেজনার স্পর্শ ছিলো। ইশকুলঘরের এই জানালাটা থেকে বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে আলো-আঁধারিতে অজস্র মানুষের নড়াচড়ার আভাস মেলে। তারই মাঝে মাঝে উজ্জ্বল আলোময় কয়েকটি দ্বীপের মতো জেগে আছে গানের মঞ্চগুলো। তাদের থেকে ভেসে আসা ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের সুরগুলি সমবেত জনতার গুঞ্জনধ্বনির সঙ্গে মিশে গিয়ে এক সুখশ্রাব্য ঐকতানের জন্ম দিচ্ছে। কান পেতে তাই শুনতে শুনতে প্রৌঢ় ফের বললেন, “জয়দেব-কেঁদুলি পৌষমেলার হুল্লোড় দেখে অভ্যাস। এখানেও অন্য তেমন কিছু দেখতে পাবো আশা করে আসিনি। কিন্তু তুমি করে দেখালে ভাই। খুব ভালো, খুব ভালো।”
“তাহলে সময়টা আপনার আর নষ্ট হল না, কী বলেন স্যার!” শোভন হাসছিলো।
মেলার মাঠের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই সৌগত বসু জবাব দিলেন, “আজকাল তো সবকিছুরই মেলা করবার রেওয়াজ উঠেছে। এমনকি বাড়ি-গাড়ি-চাকরিরও মেলা হচ্ছে। মোটা লাভ হয় শুনেছি। তাই যখন মেলা উদ্বোধনের নিমন্ত্রণ নিয়ে এলে তখন তোমাকেও সে ব্যবসায়ীদেরই একজন ভেবে নিয়েছিলাম। লেখা, কলেজের মাস্টারি আর তার বাইরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে গান জোগাড় করেই চিরটা কাল কাটিয়ে গেলাম। ব্যবসায়ীদের এড়িয়ে চলতেই স্বস্তি লাগে। তাই তখন তোমায় ও কথা বলে ফেলেছিলাম। কিছু মনে কোরো না।”
শোভন মাথা নাড়লো, “ও’রকম ভাবাটা আপনার পক্ষে স্বাভাবিক। আমি কিছু মনে করিনি স্যার। সত্যি বলতে কি, ব্যবসা ব্যাপারটা আমারো ঠিক আসে না। আশপাশের সতেরোটা গ্রাম থেকে চাঁদা আর মুষ্টিভিক্ষা তুলে মেলা করছি। দেখুন না, ভালো করে আলোও দিতে পারিনি গোটা মাঠে! দুটোমাত্র জেনারেটর ভাড়া করা গেছে সাকুল্যে।”
“ও তোমার শাপে বর হয়েছে শোভন। একটু অন্ধকারই ভালো। শুধু মঞ্চের ওপর আলো থাকলে অডিয়েন্সের মনোযোগও গানের দিকেই বাঁধা থাকবে। এদিক ওদিক দৌড়ুবেনা--”
কথা বলতে বলতেই হঠাৎ সামগ্রিক গুঞ্জনকে ছাপিয়ে ওঠা একটা বলিষ্ঠ, তরুণ কন্ঠের শব্দের দিকে মনোযোগ ফিরিয়ে মানুষটি উত্তেজিত গলায় বললেন, “এই গান এখানে কোথা থেকে এলো?” তীক্ষ্ণ, চড়া নারীকন্ঠে বিচিত্র উচ্চারণে গাওয়া গানটির মাদকতাময় শব্দগুলো তখন তারসপ্তকের চূড়াস্পর্শ করেও সুরবিচ্যুত না হয়ে স্বচ্ছন্দগমনে ভেসে চলেছে সন্ধ্যার বাতাসে—
“ওরে এলুয়া কাশিয়ার ফুল নদী হইল হুলুস্থুল রে— কেমন করিয়া দরিয়া হব পার ধন মোর কানাই রে-- “
হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সৌগত বসু। আসরের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন, “চলো, ওদিকে যাই একবার। এত দূর থেকে ভালো দেখা যাচ্ছে না।”
শোভন নিঃশব্দে তাঁর পিছু নিল।
স্কুলবাড়ির গেটে একটা ছোটখাটো জটলা চলছিল। তার পাশ কাটিয়ে যাবার সময় জটলা থেকে মুখ বাড়িয়ে বিরামনগর বালিকা বিদ্যালয়ের স্কুল কাউন্সিলের সেক্রেটারি সুখদাবাবু বললেন, “উঠছেন? আরেকটু বসে গেলে হত না স্যার? মিষ্টি এসে গেছিল। একটু মিষ্টিমুখ করে নাহয়--”
মৃদু হেসে প্রৌঢ় বললেন, “আজ্ঞে না। এত তাড়াতাড়ি উঠছি না। এখানে বসে না থেকে ভাবছি একটু আসরের দিকে যাই। আর, রক্তে চিনির দোষ ধরা পড়েছে কিছুদিন হল। মিষ্টি আমার একেবারেই চলবে না।”
“আসরে যাবেন? তাই বলুন। কোন স্টেজে যাবেন? দাঁড়ান ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। একেবারে স্টেজের ওপর নিয়ে বসিয়ে দিয়ে আসবে। অ্যাই ভূষণবাবু--”
“ব্যস্ত হবেন না সুখদাবাবু। আমি শোভনের সঙ্গে যাচ্ছি। ওর সঙ্গেই থাকবো। আসি, নমস্কার--” বলতে বলতে সুখদারঞ্জনকে আর কোনো কথা বলবার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে এগিয়ে গেলেন সৌগত বসু। মাঠের পুবপ্রান্তে ‘প্রতিমা বড়ুয়া’ মঞ্চ থেকে ভেসে আসা সেই গানের আওয়াজ ততক্ষণে তীক্ষ্ণতর হয়েছে। বিদ্যুতের আলোয় উদ্ভাসিত নিচু মঞ্চটিতে হলুদ পেড়ে সবুজ শাড়ি ফেরতা দিয়ে পরা কিশোরীটিকে ভিড়ের পিছন থেকে ভালো করে চোখেও পড়ে না। শুধু কানে ভেসে আসে তার জোয়ারি গলার শব্দ। বিরহাতুরা অভিসারিকা রাধা যেন উত্তরবঙ্গের কিশোরীটির রূপ ধরেছেন। তার কন্ঠে ঝরে পড়ে বিরহিনী রাধার আকুতি—
“ওরে আকাশে বিজলির হানা বুক হইল মোর ফানা ফানা রে হায় রে কেমন করিয়া দরিয়া হব পার ধন মোর কানাইয়া রে--”
প্রৌঢ় চলতে চলতে অন্যমনস্কভাবে বলছিলেন, “দীঘলনাসা ভাওয়াইয়া! গৌরীপুরের মাটিয়াগড় রাজপ্রাসাদে প্রতিমা পাণ্ডে বড়ুয়ার কাছে নায়েব আলির রেকর্ডে এই গান আমি শেষ শুনেছিলাম। সে-ও বিশ বছর হয়ে গেল। চল্লিশ সনের রেকর্ডিং। খোলা আসরে এ গান যে কখনো শুনতে পাবো আমি ভাবি নি। মেয়েটাকে পেলে কোত্থেকে?”
“আমি বলতে পারবো না। ওটা ভুবনদা জানে। ফরাক্কার ওধারের সমস্ত গানের দলের বায়না-টায়না সব ও-ই করেছে। আমি আর ওদিকটা গিয়ে উঠতে পারিনি।”
“ভুবনবাবুকে পাওয়া যাবে? কটা কথা জিজ্ঞাসা করতাম।”
শোভন মাথা নাড়ল, “তার কি কোন ঠিকঠিকানা আছে আর আজ? চড়কির মতো ঘুরছে। দশ হাতে কাজ করছে। এ কাজের যে কতো হ্যাপা--”
বলতে বলতেই মঞ্চের একেবারে সামনে পৌঁছে সার দিয়ে বসানো পাঁচ-ছটা চেয়ারের দিকে তাকিয়ে সে বললো, “অবশ্য ভাওয়াইয়া আর চটকার আর এক এক্সপার্ট তো এইখানেই রয়েছে। ব্রতীনের সরকারী পরিচয়টা তো স্টেজে পেয়েছেন স্যার। ওর বাইরে ও নিজে একজন ভাওয়াইয়া ও চটকা গায়ক। ও লাইনে নর্থ বেঙ্গলে ওর চেনাশোনাও অনেক।”
শোভনের গলা পেয়ে মঞ্চের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে পিছনদিকে তাকালো ব্রতীন। তারপর ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “সৌগতবাবু! ইনগারেশনের পর মঞ্চ থেকে নেমে তখন কোনদিকে যে চলে গেলেন, আর খোঁজও পেলাম না। আসুন, বসুন।” তারপর বাঁপাশে বসা শর্মিষ্ঠার দিকে ফিরে বললো, “দ্যাখো কে এসেছেন!”
“আপনি আমায় তুমি বলবেন স্যার,” বলতে বলতেই ব্রতীন ফের তাঁর পাশে বসে পড়লো। তারপর গায়ের চাদরটা গুছিয়ে নিতে নিতে বললো, “এক্সপার্টাইজ কিছু নেই, অনেকদিন ধরে নর্থ বেঙ্গলে পোস্টেড ছিলাম। সেই সূত্রেই একটু আধটু জানাশোনা আর কি!”
“আর ওই হলো ওর একটু আধটু জানাশোনার নমুনা,” স্টেজের দিকে আঙুল দেখিয়ে শোভন বলল, “নর্থ বেঙ্গলে কোথায় গিয়ে কাকে কাকে নেমন্তন্ন করে আনতে হবে তার খবরটবর এই ব্রতীনই ভুবনদাকে দিয়েছে, তাই না ব্রতীন?”
মঞ্চে ততক্ষণে তারযন্ত্র আর হারমোনিয়ামের সুরচাল বদলে গেছে। ষোলমাত্রার, ধীরলয়ের একটি সুরের সঙ্গে সঙ্গে এক মধ্যবয়সিনী সরে এসেছেন মাইক্রোফোনের সামনে। হারমোনিয়ামের গায়ে হাত ঠেকিয়ে কপালে ছোঁয়ালেন তিনি একবার। তারপর সঙ্গতের সঙ্গে একেবারে গলা মিশিয়ে গান ধরলেন,
“এপারে আমার বাড়ি, ওপারে বন্ধুর বাড়ি মধ্যে হইল খীরল নদীর খেওয়া--”
“আপনারা তবে বসুন সার। আমি বরং রান্নাবান্নার দিকটা একবার ঘুরে দেখে আসি। ভুবনদাকে পেলে পাঠিয়ে দিচ্ছি--”
মানুষদুটির কাছ থেকে কোনো জবাব এলো না। তাঁদের দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ হয়েছে মঞ্চের দিকে। মৃদু গলায় যুবকটি প্রৌঢ়কে জানাচ্ছে, “না না চিতুই নয় স্যার, চিতুই নয়, এ হল খীরল ভাওয়াইয়া। আর, ওই মাধবী ডিউ হলেন গিয়ে ধীরেন সরকারের আপন ভাগ্নী। মামার মতো নামডাক এত হয়নি বটে, কিন্তু--”
তাঁদের ছেড়ে ফিরে আসছিলো শোভন, এমন সময় চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে শর্মিষ্ঠা বলল, “এক মিনিট শোভনদা। ফরিদার বাবার কোনো খবর আছে?”
শোভন মাথা নাড়লো, “নাঃ। কাল সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে সেই যে বাবার পড়ে যাবার খবরটা দিল, তারপর থেকে ফোনের সুইচ বন্ধ।”
“কাউকে পাঠিয়েছেন?”
“খবরটা যখন এলো আমি তখন মাঠে প্যাণ্ডেলের কাজ দেখছি। ফোনটা আসতে, আনসারকে হাতের কাছে পেয়ে ওকেই সঙ্গেসঙ্গে টাকাপয়সা দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। রাত দুটোর সময় আতাখালির হাসপাতাল থেকে ফোন করে আনসারই জানিয়েছিলো, হাসপাতালে অ্যাডমিশান করে নিয়েছে। ডাক্তার বলেছেন সেরিব্রাল। কোমায় চলে গেছে। তার পর থেকে আর কোনো খবর পাইনি এখনো। ফরিদার তো ফোন বন্ধই, আনসারের ফোনেও যতবার করছি, বলে রুট বিজি।”
“আহা রে!” ঠোঁট কামড়ালো শর্মিষ্ঠা। তারপর রাগত গলায় বললো, “খবরটা একবার ব্রতীনকেও বলেন নি আপনি? আমি নাহয় আজই ফিরলাম বাড়ি থেকে। কিন্তু ব্রতীন তো ছিলো! অফিস থেকে কাউকে পাঠিয়ে কিছু একটা বন্দোবস্ত--”
তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে পা বাড়ালো শোভন। একজন মানুষ অসুস্থ হয়েছেন। তার জন্য যেটুকু ব্যবস্থা করা প্রয়োজন সে করেছে। এ ছাড়া আর তার কিছু করণীয় নেই। অন্যমনস্কভাবে ভিড় ঠেলে এগোতে এগোতে তার মন বারবার ফিরে ফিরে যাচ্ছিল মঞ্চে চলমান মাধবী ডিউ-এর গানটির দিকে—
“না জানং সাঁতার না জানং পংরিবার না জানং ভুরা বাহিবারে ওরে অগম দরিয়ার মাঝে কে দিবে খেওয়া রে আমি নারী কেমনে দিব পাড়ি--”
সুদূর উত্তরবাংলার প্রান্তবাসী একটি বাঙালি সংস্কৃতি থেকে গড়ে ওঠা এই আকুতিময় গানটির বাণীতে কোথায় যেন নদিয়ার অলোকপন্থী সাধকদের ফকিরি গানের প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল শোভন। বহুদিন আগেকার এক সন্ধ্যায় শোনা আর একটি গানের কথা মনে পড়ছিলো তার—
“না জানি সাঁতার, হস্ত ধরি করো পার--”
আর তার পরেই সেই সব স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ও পাণ্ডিত্যের পুরু আবরণ ছিঁড়ে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, বড়ো বড়ো চোখওয়ালা একটি শ্যামলা মুখ। গত ছ মাস ধরে বারে বারে অসুখে পড়া মানুষটিকে নিয়ে বড্ড ভুগে চলেছে ফরিদা! কিন্তু, মাঝে মাঝে ইস্কুল থেকে ছুটি নেয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন সাহায্য সে চায়নি শোভনের কাছ থেকে। এই প্রথম সে ফোন করে তার কাছ থেকে সাহায্য চাইলো। মৃত মানুষের মতো ঠাণ্ডা গলায় কাজের কথাকটি বলেই কোনও উত্তরের প্রতীক্ষা না করে ফোন নামিয়ে রাখলো। কী করছে এখন কে জানে!
ভিড় ঠেলে ঠেলে খাওয়াদাওয়ার এলাকাটার কাছাকাছি পৌঁছেছে এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে ডাক এলো, “শোভনদা--”
চেনা গলা পেয়ে শোভন ঘুরে দাঁড়ালো। আনসার ফিরে এসেছে।
“ফিরে এলি যে! সব ঠিক আছে তো? ফরিদা--”
“উঁহু। ফরিদাদি আসতে পারবে না এখন। আমাকে ফেরৎ পাঠিয়ে দিলো।”
“ফেরৎ পাঠিয়ে দিলো! ওর বাবা--”
“ভালো নেই শোভনদা। বিকেলে ডাক্তারবাবু রাউণ্ডে এসে বলে গেলেন, একেবারে ভেজিটেবল স্টেজে চলে গেছেন। এ অবস্থায় ডাক্তারি মতে আর কোনকিছু করবার নেই। রিলিজ নিয়ে বেড খালি করে দিতে বলে গেছেন। শুনে ফরিদাদি তখনি ডিসচার্জ করিয়ে নিল। হাসপাতালে বলে একটা ফ্রি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করিয়ে দেয়া গেছিলো, তাই ফেরার পথের গাড়িভাড়া লাগেনি আর। ওদের বাড়িতে পোঁছে দিয়ে এই আসছি।”
শোভন চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লো, “কাজটা ঠিক হলো না রে আনসার। ওরকম একটা রুগি নিয়ে একা একা মেয়েটা রাতে বাড়িতে থাকবে! থেকে গেলেই পারতি রে!”
“থাকতেই তো চেয়েছিলাম শোভনদা। ফরিদাদি মানা করলো। বলে, ‘পাড়াটা ভালো নয় আনসার। লোকজনের মুখের কোনো আড় নেই এখানে। তার ওপর আমি তো এমনিতেই শহরের হস্টেলে থেকে আসা বদনামী মেয়ে। সমাজের ব্যাপার! বুঝিসই তো সব। তুই বরং ফিরে যা। রাতে থাকবার কোনো দরকার নেই।’ ”
“আর তুই সেই শুনে কিছু না বলে একলা মেয়েটাকে ফেলে চলে এলি?”
“ফরিদাদিকে তো তুমি চেনো শোভনদা! ওর কথার সহজে নড়চড় হয়? প্রোপজাল দিয়েছিলাম, পাড়াতেই অন্য কোনো বাড়িতে গিয়ে উঠবো না হয়। রাতে মাঝে মাঝে এসে দেখে যাবো। তাতেও রাজি হল না। সটান বলে দিলো, ‘এখানে থেকে আর তোর কোনো কাজ নেই আনসার। এখন তো বসে বসে শেষ মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই! সেটা আমি একলাই করতে পারবো। তুই ওদিকে ফিরে গেলে বরং শোভনদার একটু সুবিধে হয়ে যাবে।’ তাই শেষমেষ চলে এলাম। এখন বলো, কাজ আছে কিছু?”
একটুক্ষণ চুপচাপ থেকে শোভন বললো, “তুই বরং কিচেনের ওদিকটা চলে যা। অনুপম আর সুবীর এই দুটোমাত্র ছেলে মিলে সামলাচ্ছে এতক্ষণ ধরে। আর একজন সঙ্গে থাকলে একটু সুবিধে হয়ে যাবে।”
খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রান্নাবাড়ির বিরাট ম্যারাপটার দিকে এগিয়ে গেলো আনসার। গমগম আওয়াজ উঠছে তার ভিতর থেকে। অনুষ্ঠানে গান গাইতে আসা ফকির-বাউল-বৈষ্ণবের হরেক সম্প্রদায়ের মানুষের পালা করে নৈশভোজ শুরু হয়ে গেছে। আশেপাশের বহু গ্রামের গৃহস্থবাড়ির থেকে শুরু করে গঞ্জের বাজারের ব্যবসায়ীরা যার যার ক্ষমতা অনুযায়ী চালডাল তেলনুন সবজি দিয়েছেন। তাই দিয়ে একপাশে কাঠের জ্বালে বিশাল বড়ো কড়াইতে রান্না হয়ে চলেছে একটিমাত্র পদ--পাঁচমেশালি সবজি মেশানো সম্বরাহীন খিচুড়ি। সঙ্গে স্বাদবর্ধনের জন্য পোড়া শুকনো লংকা। পদ্মপাতায় ঢেলে দেয়া সেই একটিমাত্র পদ দিয়েই মহানন্দে ভোজ চলেছে সেখানে। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে পাঁচমেশালি উচ্চারণে অজস্র সংলাপের স্রোত বয়ে চলেছে অবিশ্রাম। মাঝে মাঝে তার মধ্যে থেকে জেগে উঠছে অনাবিল হাসির হররা। কান পেতে তাই শুনতে শুনতে মনের ভিতর থেকে একটা ফুরফুরে তৃপ্তির ভাব বের হয়ে আসছিলো শোভনের। এই প্ল্যাটফর্মটাই তো সে বানাতে চেয়েছে। কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই তার চোখের সামনে থেকে সেই মেলাপ্রাঙ্গণের সব শব্দবর্ণ মুছে গিয়ে ভেসে উঠলো একটা নির্জন ঘর, সেখানে শোয়া এক মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ আর একটি একলা মেয়ের ছবি। বড়ো একলা পড়ে গিয়েছে মেয়েটা।
কিন্তু পরক্ষণেই তার চারপাশে বহুতর সুরের বর্ণময় প্রাচীর গড়ে উঠে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো ফের। ওই তো দিঘলী গ্রামের পুতুল বাউরি সুর তুলেছে টুসু বন্দনার,
“আমার টুসুর একটি ছেলে কুলতলী বই খেলে না। কোন সতীনে ধুল দিল, ধুলের চিহ্ন গেল না।”
ওই তো, হাঁসমারির গুপী ওস্তাদের পঞ্চরসের দলের গায়িকা রানিবালা তার সোনালী নথে ঝিলিক মেরে রঙ্গরসে আসর জমিয়ে তুলেছে! অন্য এক মঞ্চে শেফালি ডাকুয়া নামের এক অপরিচিত কিশোরী কামরূপী ডায়ালেক্টের উচ্চারণে ধরেছে গভীর তত্ত্বগান—
“একটা বর আসির কথা আছন দুইটা বৈরাতি কাহার লগত মই করং পীরিতি সকালে তুলিছং ফুল গাঁথিনু মালা গুরু কছেন হবার না হয় গাঁথা ফুলে মালা--”
তারই পাশাপাশি আবার আজমত শাহী ঘরানার পীতু ফকিরের ভাঙা ভাঙা গলায় শোনা যাচ্ছে ধীর লয়ে গাওয়া লালন শাহের গূঢ় এক সঙ্গীতদর্শন—
“আপনারে আপনি চিনিনি দীনজনের পর যার নাম অধর তারে চিনবো কেমনে আপনারে চিনতাম যদি হাতে মিলতো অটল নিধি মানুষের করণ হতো সিদ্ধি শুনি আগম পুরাণে”
প্রেম, রঙ্গ, লোকায়ত ও চিরায়ত দর্শনতত্ত্বের সেই সুরসঙ্গমে অবগাহন করতে থাকা যুবকটির চেতনা থেকে মুহূর্তে মুছে যায় একাকি মেয়েটির ছবি। প্রাত্যহিক দিনযাপনের সঙ্গীটির দেখা সে ফের পাবেই আজ নয়তো কাল। কিন্তু এই সুরময় মুহূর্তটি এমনভাবে আবার কখনো ফিরে আসবে কিনা কে জানে! যেন অনতিদূর ভবিষ্যতের গর্ভে লুকিয়ে থাকা কোন নিয়তিনির্ধারিত পরিণামকে এক অতীন্দ্রিয় শক্তিতে অনুভব করে নিয়ে নিয়তিতাড়িত যুবকটি, ঘটমান বর্তমানের তীব্রমধুর স্বাদ গ্রহণ করে চলে আর সবকিছু ভুলে।
|| ১৪ ||
“তখন কী হইল শোনেন সর্ব্বজনা--” বলতে বলতে একটা লাফ দিয়ে বাজনদারদের দিক থেকে দর্শকদের দিকে মুখ ঘোরালেন মানুষটি। যৌবনের শেষ সীমায় পৌঁছোন শিথিলপেশি দেহটির বিশাল আকার এখনো দর্শকের মনে সমীহের জন্ম দেয়। লাফিয়ে ওঠা পা দুটি মাটিতে ঠেকবার মুহূর্তে খোল-করতালের এক তীব্র যৌথধ্বনিতে যেন কেঁপে ওঠে পদভারানত মেদিনী।
শেষ শব্দটির টান ধরে রেখেই গানে ফিরে যান কথক,
“হীরা বাঘে সাজিয়া রায় হইল সোয়ার পৃষ্ঠে ঢাল, কাটারি, কোমরে যমধার পঞ্চ পাত্র চলে পঞ্চ বাঘের উপর ঘোর অন্ধকার রাত্রি আড়াই প্রহর দলবল লইয়া বাঘের মহাকায় ধাইল উত্তরমুখে দক্ষিণের রায়।”
উঁচিয়ে ধরা মোবাইল ফোনটা নামিয়ে মুখের কাছে ধরে যুবকটি অদৃশ্য কোন্ শ্রোতাকে উদ্দেশ্য করে মৃদুস্বরে বললো, “শুনলেন তো স্যার! শমিত বোসের সিক্সথ সেন্স কখনো ভুল করে না। সৌগতবাবু আসতে রাজি হয়েছেন শুনেই পোটেনশিয়ালটা ঠিক বুঝে নিয়েছিলাম—আরে হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়। স্বীকার করবো না কেন? ক্রেডিটটা তো পার্টলি আপনারই! ফাংশানটার কভারেজ করবার প্রোপোজালটা আপনি অ্যাপ্রুভ না করলে—যা দেখলাম, মোর দ্যান এক্সপেকটেড! বাউল ফাউল তো আজকাল কমন ফডার হয়ে গেছে স্যার। কিন্তু এ জিনিস ভাবা যায় না! রায়মঙ্গল পালা লাইভ! ইনক্রেডিবল্! হ্যাঁ হ্যাঁ ফুল রেকর্ডিং করে আনছি—হ্যাঁ—না – মানে সে তো বটেই! প্রোগ্রামটার অর্গানাইজার শোভনবাবুর একটা ইন্টারভ্যু তো অবশ্যই নেব। সেইসঙ্গে ওই ডান্সার ভদ্রলোক—কী যেন নাম—ও শোভনদা--”
তার কনুইয়ের মৃদু খোঁচা খেয়ে আসরের দিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই শোভন বলে দিল, “ছোট ঢাকির মন্তা রায়ের দল।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ মন্তাবাবু। ওনারও ইন্টারভ্যু একখানা—না না, বাইলিঙ্গুয়াল ইমপসিবল। এই আর্টিস্টরা তো দেখছি নর্ম্যাল বাংলাটাই ভালো করে বলতে পারেন না! হিন্দি বা ইংরিজির প্রশ্নই উঠছে না। পিকিউলিয়ার অ্যাকসেন্টের কোনো একটা সাবডায়ালেক্ট—না না প্রবলেম আর কী হবে? সৌগতবাবুকে দিয়ে একটা ট্রান্সস্ক্রিপ্ট করিয়ে হিন্দি ভয়েসওভার দিয়ে অন্যান্য কান্ট্রিওয়াইড চ্যানেলে—ইয়েস স্যার! সুব্রত কাল ভোরে কলকাতায় বেরিয়ে যাচ্ছে। কিছু বাইটস কালকেই পেয়ে যাবেন ওর কাছ থেকে। গোটা কাজটার ট্রান্সক্রিপশান আর ডাবিং-এর কাজ শেষ করতে একটা দিন লাগবে আমার। তরশু দুপুরে আমি অফিসে গিয়ে সিডি দিয়ে দেবো। ওরিজিন্যাল অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ হিন্দি ডাবিং—না না আমি আজ ফিরছি না। ফার্স্ট নাইটটা মিস করে গেলাম। আজ সেকেণ্ড নাইট আর আগামিকাল লাস্ট নাইটটা কভার করে ফিরবো একেবারে।”
ফোনে কথা বলা শেষ করে যুবকটি ফের ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার দলের কাজকর্মের পরিচালনায়। সৌগত বসু আগের দিন ফিরে যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন, কলকাতায় কথা বলেছেন, কয়েকজন সাংবাদিক আসতে পারেন দ্বিতীয় দিনে, মেলা কভার করতে। কিন্তু সেটা যে একটা পুরোদস্তুর একটা সাংবাদিকের দল হবে সেটা তখন আন্দাজ করতে পারেনি শোভন। সন্ধের মুখমুখ দুটো গাড়ি বোঝাই হয়ে হাজির হয়েছিল মূল দলটা। পরে আরো কয়েকজন ট্রেনে বাসে এসে জুটেছে। অবশ্য এরা কেউই শোভনের কাছে অতিথি সৎকারের দাবি জানায়নি। নিজেরাই প্রয়োজনীয় সব জোগাড়যন্ত্র সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।
গান গাইতে গাইতে মন্তা রায়ের চোখ বারবারই ঘুরে যাচ্ছিল মঞ্চের একপাশে ভিড় করে থাকা স্থির ও চলমান ক্যামেরাগুচ্ছের দিকে। মঞ্চে তখন গাজি ও দক্ষিণরায়ের বাঘেদের মধ্যে যুদ্ধ শেষে দুই মহাবীর সম্মুখসমরে নেমেছেন। দোহারের দল মূল গাইয়েকে অনুসরণ করে সুর তুলেছে,
“ক্ষিতি করে টলমল হেন বুঝি যায় তল বিকল সকল দেবগণ--”
“তখন বুঝলেন কিনা, যুদ্ধের তাপে ধরিত্রী ছাড়খাড় হয় দেখিয়া বিধাতাপুরুষ স্বয়ং আসি আল্লাহ ও নারায়ণের রূপ ধরিয়া অবতীর্ণ হইল্যে-এ-এ-এ-এ-ন-
অর্ধেক মাথায় কালা একভাগে চূড়া টানা বনমালা ছিলিমিলি হাসে ধবল অর্ধেক কায় অর্ধ নীল মেঘপ্রায় কোরাণ পুরাণ দুই হাতে”
“উঃ! ফ্যানটাসটিক! হিন্দু মুসলমান ইউনিটির কনসেপ্ট নিয়ে বাঘে বাঘে লড়াইয়ের ফোকলোর—একটা আনএজ্যুকেটেড সোসাইটিতে এই লেভেলের ফিলজফি—সিম্পলি ভাবা যায় না।”
ক্যামেরার থেকে চোখ সরিয়ে শোভনের দিকে মুখ ঘোরালো শমিত। তার মুখে অ্যালকোহলের হালকা সুবাস। শোভন হাসলো, “কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করবেন শমিত। এই লড়াইয়ের মূলে কিন্তু রয়েছে হিন্দু আর মুসলমানের এলাকা দখলের লড়াই। গোটা রায়মঙ্গলের পালাটাই কিন্তু এক অর্থে, এক অরণ্যময় নতুন জনবসতিতে ধর্মের অস্ত্র নিয়ে দুটি সম্প্রদায়ের রাজ্যবিস্তারের ইতিকথা। পালাটার শেষদিকে দেখবেন, কেমন করে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এলাকার ভাগবাঁটোয়ারা হয়।”
তাদের পেছনে দাঁড়ানো মাঝবয়সী লোকটি খসখস করে নোট নিতে নিতে মৃদু গলায় বললেন, “হুম্ম্! হিস্টরি অব আ সোশিও পলিটিক্যাল স্ট্রাগল ইন দা গাইজ অব মিথ।” ক্যাচলাইনটা পেয়ে গেলাম, বুঝলেন! আচ্ছা শোভনবাবু, এই যে ফোক কালচার নিয়ে আপনার ইন্টারেস্ট, এটা কি পারিবারিক হেরিটেজ? নাকি--”
“আপনার ফোনে বোধ হয় কোন কল বা মেসেজ আসছে শোভনদা,” ভদ্রলোকের বাক্যস্রোতে বাধা দিয়ে শমিত নামের সাংবাদিকটি হঠাৎ শোভনের পাঞ্জাবির বুকপকেটের দিকে ইঙ্গিত করলো। সাইলেন্ট মোডে রাখা যন্ত্রটায় জ্বলে ওঠা আলোর মৃদু আভাস পাওয়া যাচ্ছিল বাইরে থেকে। ফোনটা বের করে আনলো শোভন। ফরিদার মেসেজ। সবুজ বোতামটাতে চাপ দিতে দিতে সে বললো, “আমি একটু ঘুরে আসছি। দরকারি মেসেজ আছে একটা।” সুবিমল খানিক দূরে দাঁড়িয়েছিল। কথাটা শুনে সচকিত হয়ে এদিকে ফিরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে শোভন বলল, “সুবিমল, আমি এখুনি আসছি। তুই একটু এঁদের সঙ্গে থাক।--” কথাটা বলতে বলতেই বড়ো বড়ো পদক্ষেপে ভিড়ের মধ্যে থেকে বাইরে বের হয়ে এলো শোভন।
ভিড়ের বাইরে এসে ফরিদার মেসেজটায় চোখ বোলাতে বোলাতেই ব্রতীনের ফোন এল। কানে তুলতেই কোনো ভনিতা না করে সে বললো, “ফরিদার মেসেজটা পেলাম। আপনি দেখেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“আমার ড্রাইভার শিশিরবাবুকে বলে দিয়েছি। মেলার মেন তোরণে চলে যান। ওখানে আমার গাড়িটা থাকবে। ভুবনদাকে তিনচারটে ছেলে দিয়ে ওখানে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এদিকটা আমি সামলে নেবো।”
গাড়িতে উঠে বসে ফরিদার মেসেজটায় ফের একবার চোখ বোলালো শোভন। মাত্র দুটো শব্দ, “বাবা নেই।” কোনো শোকের উচ্ছাস নেই, সাহায্য বা করুণা কোনটারই প্রার্থনা নেই কোনও। শুধুই দু শব্দের একটা স্টেটমেন্ট। অবাক ঠেকছিল শোভনের। অদ্ভূত আচরণ করছে মেয়েটা। ফোন করে একবার কথা পর্যন্ত বললো না। নম্বরটা আরো একবার ডায়াল করলো সে। মেসেজটা পাবার পর থেকে এই নিয়ে তিনবার। এবারেও ফল হলো না অবশ্য। সুইচড অফ মেসেজ আসছে কেবল।
“কী হলো ছোটো-গোঁসাই?” পেছনের অন্ধকার সিট থেকে ভুবনের গলা ভেসে এলো।
“হবে আর কী? ফোন বন্ধ করে বসে আছে! তখন থেকে বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছি--”
“সে চেষ্টা কি এখন না করলেই নয়? ও মেয়ে কি এখন কথা বলবার দশায় আছে?”
“তাই বলে একটা মেসেজ পাটিয়ে ফোন সুইচ অফ করে দেবে? আরে দরকারি কিছু কথাবার্তাও তো থাকতে পারে? অন্তত দুঃখটাকে--”
“তুমি গোঁসাই মেয়েমানুষের মন কিছুই বোঝো না। বোঝ শুধু নিজের কাজটুকু। এমন মানুষের কাছে দুঃখের গাওনা গাইবার ভরসা করবে কোন মেয়েমানুষ! তায় আবার মেলা চলছে অতবড়ো। সেই নিয়ে চরকির মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছ, সে তো ও মেয়ে জানে। সখ করে কেন নিজের দুঃখুর কথা বলে শেষে গাল বাড়িয়ে চড় না খেতে হয়, সেই ভয়েই ও মেয়ে বোধহয় ফোন করেনি তোমায়।”
কথাটায় সত্য ছিল অনেকটাই, খানিক চুপচাপ থেকে শোভন আস্তে আস্তে বলল, “তোমরা সবাই আমাকে আমার থেকেও বেশি চেনো, না ভুবনদা?”
“চিনিই তো। তোমার বুকের খাঁচায় যে একটা জগদ্দল পাথর বাঁধা আছে সেটা আমরা জানিনা ভেবেছো? ও আমাদের সবার জানা খবর। তবে সে পাথরেও যে এখনও একটুক ধুকপুকুনি হয় সে-ও গুরুর দয়া। কিন্তু এখন থাকগে ওইসব কথা। ছেলেগুলো শুনছে। ছেলেমানুষ সব। কী বুঝতে কী বুঝে বসে আবার! এখন চলো দেখি তাড়াতাড়ি। ও ডেরাইভার দাদাভাই, চালায়ে চলো, চালায়ে চলো; রাত তিন পৌর হল যে!”
নির্জন পথ ধরে গাড়িটি তীব্র বেগে ছুটে চলে, হেডলাইটের আলোয় ঘন অন্ধকার প্রান্তর খুঁড়ে খুঁড়ে। গাড়িতে বসে যুবকটি নিঃশব্দে সামনে ক্রমাগত খুলে যাওয়া রাস্তাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। আর কতো দূর?
বলতে বলতে ঘরের ভিতর দ্বিতীয় একটা আলো জ্বলে উঠল। ভুবন এগিয়ে এসে বললেন, “বাইরে গাড়িতে চারটে ছোঁড়া আছে। ডেকে নিয়েন কাজে লাগে যদি।”
মহিলা মাথা নেড়ে বললেন, “মোছলমানের শেষ কাজ হিঁদু দিয়া--”
ভুবন হাসলেন, “না না হিঁদু কেন হবে? বেছে গুছে আল্লার চার নেক বান্দা ধরে এনেছি মা গো। এইখানে তো তোমাদের লোকবল বেশি দেখি না। ডেকে নাও। কাজে লাগবে দেখো।”
ছোট্ট ঘরটি। এ বাড়ির একমাত্র ঘর। তার অর্ধেকেরও বেশি এলাকা জুড়ে একটা নড়বড়ে চৌকি পাতা রয়েছে। পায়ের নিচে ইঁটের টুকরো দিয়ে উঁচু করে রাখা চৌকির তলায় সংসারের সমস্ত জিনিস ঠাসা।
মেঝের ওপর জ্বালিয়ে রাখা একটা কুপির পাশে ফরিদা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল। শোভনরা ঘরে ঢুকতে চৌকির দিকে ইশারা করে বললো, “বসুন। মেলা ছেড়ে চলে এলেন কেন?”
শোভনকে উত্তর দিতে না দিয়ে ভুবন দাস বলে উঠলেন, “সে কথা থাক না গো মা। এখন বল ইমামসাহেব কখন আসবেন? রাত তো অনেক হল।”
“সেই ভালো। সকাল হলে লোকজনও আরও কিছু জুটবে। হাতে হাতে কাজ উঠে যাবে।”
“নাঃ। লোকজন আর বেশি জুটবে বলে মনে হয় না ভুবনদা। শহরে বাজারে পুরুষের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করা বিয়ে না হওয়া সোমত্ত মেয়ে যে ঘরে পোষে সে ঘরে এ গ্রামের নেক মুসলমানেরা বেশি পা দেবেন না। দেখছেন না, সাকুল্যে লোক জুটেছে তিনজন। তাও ওই নাফিসা, আমার ছোটবেলার সই, কেঁদে কেটে তার বর আর দেওরকে রাজি করিয়ে ধরে এনেছে।”
ভুবন একটু হাসল, “মানবচরিত্র তুমি এখনও কিছুই বোঝ নাই মা। সারা গ্রামের লোক কাল ঝেঁপে আসবে দেখো। যে বাড়ির কত্তা মরলে বিডিও সাহেবের গাড়ি এসে খাড়া হয়ে যায়, সে বাড়িতে লোকের অভাব হয় না। সকাল তক অপেক্ষা করে মজাটা দেখো একবার!”
“ঘরে গন্ধটন্ধ কিছু আছে রে ফরিদা?” নাফিসা দরজা ধরে এসে দাঁড়ালো।
“দাঁড়া দিচ্ছি।” বলতে বলতে ঘরের এক কোণে দেয়ালের গায়ে আটকানো একটা ছোট কাঠের কুলুঙ্গি ঘেঁটে ছো্টো একটা ডিওডোরেন্টের শিশি বের করে এনে নাফিসার হাতে দিল ফরিদা।
শিশিটার মাথাটা পেঁচিয়ে খুলতে যাচ্ছিল নাফিসা। তাকে বাধা দিয়ে শিশিটা হাতে নিয়ে ফরিদা তার মাথায় আলতো চাপ দিতে মৃদু একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করে হালকা একটা সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে।
“এইভাবে করতে হবে, ওর মাথা ঘোরালে ভেঙে যাবে রে।”
নাফিসা একটু অবাক হয়ে শিশিটা দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল, “বিলিতি, না?”
“না না। বিলিতি হতে যাবে কেন? এদের কারখানা ব্যাঙ্গালোরে তো।”
“ওই একই হল। আমাদের কাছে বিলেতও যা আর তোর ব্যাঙ্গালোরও তাই। তুই মাখিস বুঝি?”
“মাখতাম। যখন ইউনিভার্সিটিতে ছিলাম তখন। গন্ধটা আমার এত ভাল লাগত, জানিস! তবে সে অনেককাল আগেকার কথা রে নাফিসা, গতজন্ম মনে হয়। এখন আর ওসব--”
হঠাৎ শিশিটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরে নাফিসা বলল, “না, তোর একটা শখের জিনিস, ও আমি ওই মরা বুড়োর গায়ে মাখাতে পারবো না। কিছুতেই না।”
“নাফিসা, কি পাগলামো হচ্ছে?”
“পাগলামো?” ঘন ঘন নিশ্বাস নেয় মেয়েটি। উত্তেজনায় তার নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। নীচু গলায় হিসহিস করে সে বলল, “জন্ম দেয়া বাদে কী দিয়েছে তোকে ইসমাইল চাচা? সারাটা জীবন তো শুধু সব্বোনাশ করবারই চেষ্টা করে গেল। যদ্দিন তুই বাইরে ছিলিস আর বুড়োর গায়ে তাকৎ ছিলো, তকে অভিসম্পাত না দিয়ে একটা দিন পানি গিলেছে? বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে তোকে গত পাঁচ পাঁচটা বচ্ছর? কোথায় থাকবি, কী করে খাওয়া জুটবে তার পরোয়া করেছে কখনও? মরণকালে এসে অ্যাদ্দিন ধরে কর্তব্য করেছিস সে ওর সাত জন্মের ভাগ্যি। এখন মরা বুড়োর বাসি গন্ধ ঢাকতে তোর একটা শখের জিনিস বরবাদ করতে আমি দোব না। ও তুই রাখ। আমি গিয়ে বাড়ি থেকে একঘটি জলে একছিটে আতর মিশিয়ে নিয়ে এসে দেব। ওতেই নিয়মরক্ষা হবে’খন।”
শিশিটা আবার কুলুঙ্গিতে তুলে রাখতে রাখতে ছোটো একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফরিদা বলল, “কাল থেকে থাকবো কোথায় তার ঠিক নেই, এখন আর ডিওডোরেন্টের শিশি বাঁচিয়ে কী লাভ?”
“থাকবি কোথায় মানে?”
“মানে হল, থাকবো কোথায়? বাবা বিয়ের পর এ বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলো কুড়ি টাকায়। সে ভাড়া ছাব্বিশ বছরে বেড়ে তিনশো হয়েছে। সে-ও নয় টেনেটুনে কোনোমতে চালাচ্ছিলাম। কিন্তু বাড়িওলা এবারে আর আমায় রাখতে রাজি না। আজ বিকেলেও এসেছিলো একবার। বাবার তখন শ্বাস উঠেছে। একেবারে শেষ দশা। সব দেখেশুনে একঝুড়ি মিষ্টি কথা বলেটলে শেষ মেষ নোটিশ দিয়ে গেছে, বাবার পরে এখানে সে আর ভাড়াটে বসাবে না। নাকি ভেঙে দালান বানাবে মেয়ে জামাইয়ের জন্য। আমি যেন অন্য বাড়ি দেখে নিই। ভাড়া বাড়িয়ে সাড়ে তিনশো অবধি দিতে চাইলাম। মানলো না।”
“তুই কিছু বললি না? চুপচাপ মেনে নিলি?”
“মানা না মানার কী আছে বল? ওনার বাড়ি, উনি যা ঠিক বুঝবেন, করবেন। আমি অন্য কোথাও--”
“পাবিনা রে ফরিদা। এই এলাকায় কোন শরিফ ঘরে তোর মতো মেয়েকে ভাড়াটে রাখবে না। একা সোমত্ত মেয়ে, সোয়ামী সংসার নেই, তাকে কে নিয়ে ঘরে বসাবে?”
“হ্যাঁ; রাখবে না! তোকে সবাই এসে বলে গেছে যেন।”
“বলেছেই তো। জাফরকাকা যে তোকে উচ্ছেদ করবে সেটা তুই এতদিন জানতিস না বটে, কিন্তু এলাকার প্রত্যেকটা লোক সেটা জানে। আর, সকলেই জাফরকাকার মতে মতও দিয়েছে। রইল গিয়ে বাড়িতে রাখবার কথা, একদিন বাড়িতে এই নিয়ে কথা উঠতে বলেছিলাম ফরিদাকে তবে আমাদের বাড়িতে এনে কেন রাখিনা? নিজে রোজগার করে। ভাড়াও পাওয়া যাবে, আবার মেয়েটারও একটা মাথা গোঁজবার জায়গা হবে। তার জবাবে আমার নিজের সোয়ামী তুই আর তোর টাকা নিয়ে যা বলেছে সে কথা আমি এনাদের সামনে মুখ ফুটে বলতে পারব না।”
বলতে বলতেই হঠাৎ শোভনদের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে সে বলে উঠল, “আপনারা তো ফরিদার ভালো চান, তাই না দাদা! আপনারাই বরং ওকে নিয়ে যান। এইখানে আর ওর জায়গা হবে না। আর কষ্টেছিষ্টে যদিবা জায়গা জোটে, কাকে চিলে দু’বেলা ছিঁড়ে খাবে। কথায় বলে একা তো বোকা, তার ওপর আবার কাঁচা বয়সের মেয়েমানুষ—”
শোভন একটু ইতস্তত করে বলল, “তাহলে না হয় ইশকুলেরই একটা ঘরে এসে না হয়—”
হঠাৎ দপ করে দুটি চোখ যেন জ্বলে উঠল ফরিদার। কঠিন, নীচু গলায় সে বলল, “ছোটবেলা থেকে আপনার ভিক্ষে খেয়ে এত বড়ো হলাম। এবারে ফের একবার ভিক্ষে দিচ্ছেন আপনি, আর আমাকে তা হাত পেতে নিতে হবে? আমাকে কী ভেবেছেন আপনি?”
“ছি ছি তুই এসব কী বলছিস ফরিদা?”
“ঠিকই বলছি আমি। কী ভেবেছেন কী আপনারা? আপনাদের দয়ার দান ছাড়া আমার বাঁচবার আর কোনো উপায় নেই? ভুল ভেবেছেন শোভনদা। নিজের জোরে জীবন গড়বার শক্তি আমার আছে। সুযোগও পেয়েছিলাম তার। সেই সমস্ত সুযোগকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে এইখানে ফিরে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম, এই আমার আসল কাজের জায়গা। ভুল করেছিলাম। কী বোকা আমি, না? শুনুন। কাল সকালে বাবার দফন শেষ করে আমি সুন্দরনগর চলে যাব। তারপর ব্যবস্থা কিছু না কিছু একটা হয়েই যাবে। কিন্তু এই নরকে আর আমি—”
“আর আশ্রমভরা ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলির কী বিলিব্যবস্থা হবে মা গো? গত সাত-আট মাস ধরে তাদের মানুষ করবার দায় নিয়েছো মাথায়, আর আজ বিপদের পয়লা ঘা খেয়েই তিনশো বাচ্চার দায়িত্ব ছেড়ে পালাবা? তাহলে, দূরে গিয়ে আত্মসুখে যখন থাকবে, তখন আরশিতে নিজের মুখটা দেখবার সাধ্যি যে আর থাকবে না মা!”
চৌকির এক কোণে বসে থাকা ভুবন দাসের বয়োজীর্ণ চোখদুটি একদৃষ্টে চেয়ে থাকে তরুণীটির দিকে। এই প্রশ্নের জবাব সে চায় ফরিদার কাছে। কয়েক মুহূর্তের নৈঃশব্দের পর তার দিকে যখন চোখ তুলে তাকালো ফরিদা তখন কুপির আলোয় তার দুটি চোখে চিকচিক করছে বহুকষ্টে আটকে রাখা জলের দুটি ফোঁটা।
“চুপ করে থাকলে তো চলবে না মাগো! ছেলেকে এর জবাব তোমায় দিতেই হবে আজ।”
“কিন্তু ভুবনদা, নিজের দাবিতে, নিজের জোরে গিয়ে ওঠবার মতো মাথা গোঁজবার একটা জায়গাও নেই যে আমার এখানে! আমি তবে থাকবো কোথায়?”
“কে বলে মা তোমার তেমন জায়গা নাই? এইখানে না হোক, বিরামনগরে তো আছে! মাগো, ছেলে বলে যদি মানো, তবে নিজের জোরে ছেলের ঘরেই গিয়া ওঠ না কেন? তুমি আমার সঙ্গে যাবা। আমার ঘরে আমার মা হয়ে থাকবা। আমি হব তোমার ব্যাটা। দেখি আমায় ঠ্যাকায় কোন ব্যাটায়!”
“কিন্তু ভুবনদা, আ-আমি—আপনার আখড়ায়—না না--”
“কেন নয়? আমি তোমায় দয়া দাক্ষিণ্যি করতে নিয়ে যাচ্ছি না মা! নিয়ে যাচ্ছি, কতোগুলি দুধের শিশু যেন তোমার মতন গুরুর সঙ্গ থেকে বঞ্চিত না হয় সেই জন্য। আর, যদি মা হয়ে ছেলের ঘরেও গিয়ে থাকতে আপত্তি হয় তাহলে না হয় মাস গেলে আমায় তিনশো ট্যাকা ভাড়া গুণে দিও। আমি হব গিয়া তোমার বাড়িওলা। কী? এবার আর কোন আপত্তি নাই তো!”
নিঃশব্দে মাথা নাড়লো ফরিদা। আর তার কোন আপত্তি নেই। সেইদিকে তাকিয়ে হঠাৎ মাথা নেড়ে ভুবন আপনমনেই বললেন, “গুরু হে! কত লীলাই যে করলা! মাতৃহীনে মা দিলা, বৈরিগি ফকিররে বানালা বাড়িওলা গেরস্ত। এখন মাস গেলে গুণে গুণে ভাড়াটিয়ার থেকে ট্যাকা নিয়ে মায়ের হাতে দেব, আর পায়ের ওপর পা তুলে দুই বেলা মায়ের হাতের রান্না খাব।”
ভেজানো দরজায় ঠেলা দিয়ে ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে ফরিদা ডাকল, “জাফরকাকা বাড়ি আছেন? জাফরকাকা!”
কিছুক্ষণ বাদে একজন অশীতিপর মানুষ দরজাটি খুলে এসে দাঁড়ালেন তাদের সামনে। ফরিদা একটা বড়ো চাবি তাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, “বাড়ির চাবিটা রাখেন কাকা।”
একটু ইতস্তত করে মানুষটি বললেন, “চাবি, মানে—আজকেই বাড়ি ছেড়ে দেবা? যাবা কোথায়?”
ফরিদা মৃদু হাসলো, “সে খোঁজে আপনার তো কাজ নেই কাকা! আপনার বাড়ি, আপনি ফেরৎ পেলেন। ব্যস্, মিটে গেল।”
হঠাৎ বৃদ্ধের পিছনে ঘরের ভিতর থেকে নিচু অথচ তীব্র একটা কন্ঠস্বর ঝংকার দিয়ে উঠলো, “বলে দ্যান, তেরাত্তির বাস করে তারপর যেতে। মরার তেরাত্তিরের মধ্যে চাবি নেবেন না। অমঙ্গল হবে।”
“হ্যাঁ, তাই ভালো মা। তুমি বরং আর তিনটা দিন--”
“না কাকা। আমি আজকেই চলে যাবো। চাবিটা বরং আপনি নিয়ে নিন।”
এইবার, ফরিদা কিছু বলবার আগেই তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে এলো নাফিসা। প্রৌঢ়ার দিকে জ্বলন্ত চোখ ফেলে বললো, “চাচি, তুমি থামবে? গোটা গ্রাম মিলে মেয়েটাকে তো তাড়িয়েই ছাড়লে শেষ পর্যন্ত! এখন যাবার মুখেও হুলটা কি না ফোটালেই চলছে না?”
প্রৌঢ়ার মুখটা দুঃসহ রাগে বিকৃত হয়ে উঠলো। একটা লাফ দিয়ে উঠে নাফিসার দিকে আঙুল নাড়িয়ে বললেন, “ওরে মাগী, অতই যদি দরদ তোমার উথলে উথলে পড়ে তাহলে পরের ঘাড়ে বন্দুকটা না রেখে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে তোল না দেখি কেমন মুরোদ! তারপর তোর শৌহরের মাথাটা কেমন চিবিয়ে খায় তাই দেখিস বসে বসে বুকে পাথর চাপা দিয়ে।”
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাফিসা বলল, “আমার সইকে আমি চিনি চাচি। ভাগ্যবতী সই আমার। বিদ্যা পেয়েছে। বুদ্ধি পেয়েছে। আমাদের মতো বছরবিয়ুনী হয়ে কুড়িতে বুড়ি হয়ে বেঁচে নেই। অমন মেয়েকে আশ্রয় দেবার খ্যামতা যদি আমার থাকতো চাচি, তাহলে অনেক আগেই নিয়ে গিয়ে তুলতাম। কিন্তু ওপরওলা সে শক্তি দিলে তো! নিজেই পরের ঠেঁয়ে পড়ে আছি, গতর ভাঙিয়ে খাই, আমি আবার কাকে ঠাঁই দেবো চাচি? “
“তাহলে আর অত বড়ো বড়ো কথা বলিস না। চুপচাপ নিজের ঘর যা। আমার সঙ্গে--”
তাঁর কথা শেষ হবার আগেই নাফিসাকে ঠেলে সরিয়ে ফরিদা সামনে এগিয়ে এলো। চাবিটা ছুঁড়ে জাফরের ঘরের বারান্দার ওপরে ফেলে দিয়ে বলল, “চল নাফিসা। চলুন আপনারা--”
বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়াবার পরও অনেক দূর অবধি শোনা যাচ্ছিল অপমানিত প্রৌঢ়ার অভিসম্পাতের কর্কশ শব্দগুলি, “দোজখে যাবি রে ইবলিশের বেটি! যে শহরের বাজারে বসতিস এতদিন সেইখানেই ফিরে যা। সন্ধেবেলা মুখে রঙ মেখে--”
ফরিদা মাথা নেড়ে বললো, “তোমার ঘরে তো হাঁড়ি-পাতিল সবই আছে ভুবনদা! আমার জিনিসপত্র বলতে তো দুচারটে বই আর কয়েকটা কাপড়। সেসব আমি একটা পুঁটুলি করে আগেই গাড়িতে তুলে রেখে দিয়েছিলাম এক ফাঁকে। আর বাকি যা রইলো, সেসব থাক গে! ওতে আর আমার কাজ নেই।”
ভুবন মাথা নেড়ে বললেন, “নতুন মা নিয়ে ঘরে যাব। কিন্তু সেখানে তো ভাঁড়ে মা ভবানী। মা আমার খাবে কী? বাজার থেকে মুদিখানা আর কাঁচাবাজারের একটু সদাই নিয়ে নিতে হবে তো! আসো ফরিদা মা। নেমে আসো দেখি! মা ব্যাটায় বাজারটাজার সেরে গিয়ে রেঁধেবেড়ে খাওয়াদাওয়া করি গে। তোমরা বরং এগিয়ে যাও ছো্টো-গোঁসাই। মেলার শেষদিন আজ। রাজ্যের কাজ পড়ে থাকবে ওদিকে। আমি বিকেল বিকেল পৌঁছে যাব গিয়ে ঠিক।”
শীতের প্রখর মধ্যাহ্নে ছোটো ছোটো ছায়াগুলিকে পাশে নিয়ে তরুণী ও বৃদ্ধটি এগিয়ে যান পথের পাশে মাঠ পেরিয়ে বাজারের দিকে। গাড়ি থেকে তার ভারি ঝোলাটা নামিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছে ফরিদা। এলোমেলো হাওয়া তার খোলা রুক্ষ চুল আর শাড়ির আঁচলটি নিয়ে খেলা করে। একমুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে দেখলো শোভন। তারপর বুকের ভিতর জেগে ওঠা একটা তোলপাড়কে সযত্নে চাপা দিয়ে শান্তগলায় বলল, “চলুন শিশিরবাবু। একটু চালিয়ে চলুন দেখি এবারে!”
গিয়ার বদলে অ্যাক্সিলারেটরে চাপ বাড়িয়ে শিশিরবাবু বললেন, “সাহেব ফোন করেছিলেন মাঝখানে সার।”
“কে, ব্রতীন?”
“হ্যাঁ।”
“কখন? আমায় ডাকলেন না কেন?”
“না মানে সাহেব বললেন আপনি ব্যস্ত আছেন তাই বিরক্ত করতে চাইছেন না। আমার কাছেই খবরটবর সব নিলেন। আপনি তখন ডেডবডি নিয়ে সিমেটারির ভিতরে ছিলেন।”
“কিছু মেসেজ আছে?”
“না স্যার সেরকম কিছু নেই। শুধু বলেছেন আমাদের সোজা ওনার কোয়ার্টারে নিয়ে যেতে। লাঞ্চ রেডি থাকবে। খেয়ে নিয়ে বেরোবেন একেবারে।”
“না না, সে কী করে হবে? এতগুলো লোক হুট বলতে দুপুরবেলা ভদ্রলোকের বাড়ি এভাবে চড়াও হওয়া—তার ওপর ওদিকে মাঠেও তো কাজকর্ম পড়ে আছে! দাঁড়াও আমি কথা বলছি।”
শিশিরবাবু হেসে বললেন, “ওতে লাভ হবে না সার। সাহেব বলে দিয়েছেন, এটা ম্যাডামের অর্ডার। ওর নড়চড় হবে না। ম্যাডাম ছ’সাতজনের মতো লাঞ্চ বানিয়ে রাখবেন। নাহয় গিয়ে তাড়াতাড়ি খেয়েই বেরিয়ে যাবেন!”
এর ওপরে আর কোনো কথা চলে না। চুপচাপ বসেই রইলো শোভন। তার মন পড়ে রয়েছে মেলার মাঠেই। কী চলছে এখন সেখানে কে জানে!
খানিক বাদে ব্রতীনের বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াতে শর্মিষ্ঠা বারান্দায় চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে এলো। গাড়ির জানালা দিয়ে তার সমস্ত যাত্রীর মুখ দেখে নিয়ে একটু অবাক গলায় প্রশ্ন করলো, “এ কী? ভুবনদা এলো না?”
শোভন মাথা নেড়ে বললো, “ভিতরে চলো। সব বলছি।”
“কোন প্রবলেম হয়নি তো? ফরিদা--” শর্মিষ্ঠার গলায় উৎকন্ঠা ছিল।
“নাঃ। কোন প্রবলেম হয় নি। ব্রতীন কোথায়?”
“অফিসে গেছে। এখন আমার সাথে আসুন তো! হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নিন আগে। আর শিশিরবাবু, আপনি বাকিদের সবাইকে নিয়ে গেস্টরুমে চলে যান। ওখানে সবিতাদি আপনাদের খাবারদাবার সব রেডি করে রেখেছে। বাথরুমে তোয়ালে টোয়ালে দিয়ে রেখেছি। ফ্রেশ হয়ে আপনারাও খেয়ে নিন তাড়াতাড়ি।”
খানিক বাদে, টেবিলে শোভনকে খেতে দিয়ে মুখোমুখি বসলো শর্মিষ্ঠা। সাধারণ আয়োজন। ডাল, আলুভাজা, ফুলকপি আর বড়ি দিয়ে পোনামাছের ঝোল। থালাটা কাছে টেনে নিয়ে শোভন শর্মিষ্ঠাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি খাবে না?”
“আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে। দুপুরে ও আসে আধঘন্টার জন্য। তখন একসঙ্গে খেয়ে নিই। আপনি এবারে খেতে খেতে বলুন তো, ভুবনদা এলো না কেন?”
“আখড়ায় গেছে ফরিদাকে নিয়ে। বিকেলে ওখান থেকেই মাঠে আসবে সোজা।”
“ফরিদা—ভুবনদার আখড়ায়—মানে?”
“বলছি--”
খুব সংক্ষেপে ব্যাপারটা শুনে নিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে শর্মিষ্ঠা বললো, “আপনি খেয়ে নিন দাদা। আমি এখুনি আসছি।”
মিনিটকয়েক বাদে আটপৌরে শাড়িটা পালটে বাইরে যাবার পোশাক পরে বেরিয়ে এলো শর্মিষ্ঠা।
“তুমি আবার কোথায় চললে এখন?”
“ভুবনদার আখড়ায় যাবো একবার। আপনার সঙ্গেই বেরিয়ে যাচ্ছি একেবারে। মেলার মাঠে আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আমি আখড়ায় ড্রপ নিয়ে নেবো। ওই গাড়িতেই ভুবনদাকে মেলার মাঠে পাঠিয়ে দেবো।”
“ফিরবে কীভাবে?”
“আজ আর ফিরবো না।”
বেসিনে মুখ ধুতে ধুতে ঘুরে তাকালো শোভন, “বাড়ি ফাঁকা রেখে--”
“ও ব্রতীন সামলে নেবে। আমাদের অশৌচের মতো ফরিদাদেরও তিন দিন মোর্নিং চলে জানেন তো? এই তিনটে দিন অন্তত মেয়েটার কাছে অন্য কোনো মেয়ের থাকা দরকার।”
ভীষণ হালকা লাগছিল নিজেকে শোভনের। বুকের ওপর থেকে ভীষণ ভারী একটা বোঝা যেন তুলে নিয়েছে কেউ। নিজেকে সে বলতে শুনলো, “থ্যাংকস্ শর্মিষ্ঠা। এই মুহূর্তে এই কম্পানিটা ওর খুব দরকার ছিল। আমি নিজে তো আর--”
“শুকনো থ্যাংকস্ দিয়ে কাজ চলবে না স্যার,” বলতে বলতে তার সামনে এসে হাত পেতে দাঁড়াল শর্মিষ্ঠা, “কিছু টাকা দিন তো! দুটো মেয়েতে মিলে আখড়ায় যে থাকব, তার এটা ওটা খরচ তো লাগবে! এই তিনদিন আপনার কাজ করে দিচ্ছি, তার খরচ আমার বরের থেকে নেবো কেন?”
পকেট থেকে তিনটে একশো টাকার নোট বের করে শর্মিষ্ঠার প্রসারিত হাতের ওপর রেখে শোভন বললো, “এতে হবে?”
“হয়ে যাবে। নইলে চেয়ে পাঠাবো আবার। ফোন তো সঙ্গেই রইলো। এখন চলুন দেখি তাড়াতাড়ি! বাইরে বেরোন। আমি দরজায় তালাটা লাগাই।”
শোভনের ক্লান্ত ঠেকছিলো বড়ো। চোখদুটো জুড়ে আসছে ফের। একটা হাই তুলে সে বললো, “আর তিনটে মাত্র ঘন্টার তো মামলা ভুবনদা! সূর্য উঠলেই মেলা শেষ। ততক্ষণ তোমরাই সবাই মিলে সামলে দাওনা! আমি আর একটু ঘুমুই।”
“উঁহু, ওটি হবে না যে! মেলার শেষ অনুষ্ঠানে তুমি থাকবা না তা কি হয়? চলো চলো ছোটো-গোঁসাই। সবাই তোমার খোঁজ করছে ওদিকে। ওঠো--”
আড়মোড়া ভেঙে বিচুলির গাদাটা ছেড়ে উঠে বসলো শোভন। তারপর মাথার চুল ও গায়ের সোয়েটার থেকে বিচুলির কুঁচোকাচা ঝেড়ে ফেলতে ফেলতেই বললো, “চলো তাহলে। সুখরঞ্জনের দুই মেয়ে এসেছে তো?”
“হ্যাঁ। এসেছে। বড়োটা রাধিকা হবে আর ছোটজন বিন্দাদূতী। এখন এসো তাড়াতাড়ি—”
বলতে বলতেই খানিক দূরে মূলমঞ্চে ফ্লুট, হারমোনিয়াম ও বেহালার বৃন্দবাদন এক সুনির্দিষ্ট চালে পৌঁছোতে কন্ঠসঙ্গীত তার সঙ্গ ধরে নিয়েছে। একটি তীক্ষ্ণ নারীকন্ঠে বৃন্দাবনদাসের অভিসার-এর পদ জেগে উঠেছে, শেষরাত্রের নিদ্রালু শীতল শরীরে এক মাদক উত্তাপ ছড়িয়ে—
“আর আমি ফিরিয়া ঘরে যাবোনাকো একেবারে কূলের ভয় যাহাদের তারা যাউক ঘরে প্রাণ যদি ছাড়ি যাবে ঘর লয়ে কিবা হবে ঘরে যেতে বোল না গো মোরে।”
বুকের ভিতর একটা কষ্ট তৈরি হচ্ছিল শোভনের। সমাজনির্দিষ্ট সংসারজীবন ছেড়ে দয়িত মিলনের উদ্দেশ্যে রাধার গৃহত্যাগের এই পদ শুনে ছোটোবেলায় আসরের সঙ্গে সঙ্গে সে-ও কেঁদেছে বহুবার। আজ রাত্রে এই আসরও কাঁদবে। আসরের মন নিয়ে খেলা করবার ক্ষমতা আছে এই সুশিক্ষিত গলাটির। আচ্ছা, সমাজনির্দিষ্ট সফল জীবনের হাতছানিকে বিনাদ্বিধায় ছুঁড়ে ফেলে তার কাছে এসে, তার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, তারই আদর্শের জন্য লড়বে বলে যে মেয়েটা পণ করে ফিরে এসেছিল, আজ নিজের ঘর থেকে তাড়া খেয়ে পরের আশ্রয়ে গিয়ে ঠাঁই নেবার পর এ গান শুনলে তার শুকনো চোখে জল আসতো কি? নিতান্তই বাস্তব এক দুঃখের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, বিরহাতুরা প্রেমিকার বিলাপ হয়তো মেকি ঠেকত তার কাছে। হয়ত মনে হতো কোন এক দায়িত্বজ্ঞানহীনা তরুণীর অসুস্থ দুঃখবিলাস!
একটা গভীর অপরাধবোধ মাথা তুলছিল শোভনের ভিতরে। সে কি কোন বিশ্বাসভঙ্গের কাজ করেছে? যৌবনের প্রথম লগ্নে একবার নিজের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে, অন্য একজন মানুষের স্বপ্নের মৃত্যুর কারণ হয়েছিলো সে। তারই জন্য সব হারিয়ে সেই মানুষটা আজ বড়ো কষ্টে আছে। তবু সমাদৃতা তাকে দোষ দেয়নি কখনো। আঙুল তুলে তাকে বলে নি, নিজের স্বপ্নের জন্য আমায় বলি দেবার প্রয়োজন কি সত্যিই ছিলো তোমার?
“আহা হা, বড়ো মিঠা গলা হে ছো্টো-গোঁসাই! শোনো, শোনো,” ভুবনের কথায় গানের দিকে ফের কান গেল শোভনের। তৃতীয় উইংসের পিছনের কাঠের সিঁড়ি দিয়ে তারা এইবারে উঠে এসেছে মঞ্চের ওপরে। বাজনদারদের পিছনে আধো অন্ধকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে ব্রতীন, সুবিমল, আনসার সহ শোভনের প্রায় গোটা দলটাই। তিনদিনের অনুষ্ঠানের শেষলগ্নে পৌঁছে সকলেই একটু টেনশনমুক্ত আজ। শেষ অনুষ্ঠানটিতে তাই তারা দল বেঁধে এসে হাজির হয়েছে মঞ্চের এক কোণে একসঙ্গে বসে গান শোনবার জন্য।
পদাবলী কীর্তনে নবদ্বীপের সুখরঞ্জন দাসের সম্প্রদায়ের খ্যাতি আছে। গৃহত্যাগিনী অভিসারিকা রাধা তখন দূতীকে উদ্দেশ্য করে তাঁর শেষ কথাক’টি জানিয়ে চলেছেন,
“ঘরে গিয়া ইহাই বোলো দানঘাটে রাই বিকাইল যার রাধা হইলো তাহার রাধানাম ধরি যেন তিলাঞ্জলী দেয় জন সুশীতল জলে যমুনার।”
আশৈশব পরিচিত সমাজ-সংসার, লোকধর্ম, সংকোচ এই সবকিছুকে পরিত্যাগ করে পূর্বাশ্রমে নিজেকে মৃত ঘোষণা করে নতুন এক জীবনের আশ্রয়ে এগিয়ে চলেছেন চিরকিশোরী। এই অভিসারের অন্তিম পরিণতিটি সকলেরই তো জানা। তাঁকে ক্ষণিকের সুখ দিয়ে তারপর বৃহত্তর জগতের আকর্ষণে হারিয়ে যাবেন পুরুষটি। তারপর, অসীম শূন্যতাকে সঙ্গী করে হারিয়ে যেতে যেতে উন্মাদ দুরাশায় নিজেকেই কৃষ্ণ ভেবে এক ইচ্ছাপূরণের আত্মরতিতে মগ্ন হবেন পাগলিনী।
হঠাৎ সমাদৃতার মুখটা ফের ফিরে এল শোভনের মনে। কেমন আছে মেয়েটা, তার একাকি দুনিয়ায়, এক ব্যর্থ সম্পর্কের চিহ্নস্বরূপ একটি শিশুকে সঙ্গে নিয়ে?
বিভিন্ন বৈষ্ণব পদকর্তার অনুপম সৃষ্টির মণিমুক্তাগুলি সুরসম্পৃক্ত হয়ে মায়াজাল ছড়িয়ে চলে শেষরাত্রির সেই আসরের ওপরে। দীর্ঘপথ চলবার পর অবশেষে কুঞ্জবনে রাধা মিলিত হয়েছেন কৃষ্ণের সঙ্গে। বৃদ্ধ সুখরঞ্জন দাসের কন্ঠে ভর করে সেই মুহূর্তটিকে পুনঃরচনা করে চলে নরোত্তম দাসবাবাজির এক অনুপম সৃষ্টি—
“রাই হেরল যব সো মুখ ইন্দু উছলল মন যাহা আনন্দসিন্ধু ভাঙল মান রোদন হি ভোর কানু কমলকরে মোছই লোর মানজনিত দুখ সব দূর গেল দুঁহু মুখ দরশনে আনন্দ ভেল। “
পশ্চিম দিগন্তে অস্তগামী চাঁদের ম্লান আলো ছড়িয়ে পড়েছে মাঠ জুড়ে। বাঁশের মাথায় মাথায় ছড়ানো পাতলা চটের চাঁদোয়ার ওপরে কুয়াশার ফিনফিনে আস্তরণ। সেই কুয়াশাকে ভেদ করে চাঁদের মৃদু আলো চুঁইয়ে আসছিলো আসরের ভিতরে। মানুষগুলি শীতার্ত, তবুও আসর ছেড়ে নড়েনি কেউ। তিনদিনের সঙ্গীতের এই মহাভোজে তাদের সামনে এসেছে কতই না পরিচিত ও অপরিচিত গানের সম্ভার! তৈরি হয়েছে নতুন নতুন ভালোলাগা ও মন্দলাগা, নতুন নতুন স্মৃতি। সেইসব সঙ্গীতের শেষে এই অনুষ্ঠানের শেষপর্বে সেই মঞ্চে ফিরে এসেছে, বহু শতাব্দি ধরে নদীয়া জেলার রক্তে মিশে থাকা চিরপরিচিত পদাবলী কীর্তনের গান। বাকি মঞ্চগুলি এই মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে আছে। তাদের আলোহীন দেহে কুয়াশার ঘন আস্তর। মূলমঞ্চটিকে ঘিরে থাকা নিস্তরঙ্গ জনসমুদ্র, এক চিরন্তণ প্রেমকাহিনীর উষ্ণতাকে অবলম্বন করে জেগে থাকে শুধু।
বৃহত্তর পৃথিবীর আহ্বানে কৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় চলে গেছেন। রাধার দুঃখ দেখে সখিরা কাতর হয়ে চললেন মথুরায় খবর দিতে—
দশমী দশায় বিলাপয়ে বিরহিনী শুনইতে আকুল হোই কানুক নিকট চলত তব সো সখী লখই না পারই কোই শুন শুন সুকঠিন শ্যাম মিলবি নিলজ বরজ কুল নাগরী পুছইতে আওল হাম।
কিন্তু তবু কৃষ্ণ এলেন না। মথুরাপতি তখন মহাভারতের ধর্মাধর্মের আগামি সংঘাতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতেই ব্যস্ত। তুচ্ছ ব্রজবালিকার জন্য তাঁর কাছে তখন সময় কোথায়?
গানে গানে গল্প এগিয়ে চলে। যার জন্য তিনি সুখের ঘর ছেড়ে পথে বের হলেন, সেই মানুষটাই যে হারিয়ে গেছেন, সে কথা রাধা মেনে নেবেন কেমন করে? মথুরাপতি মহারাজা কৃষ্ণ তো তাঁর কেউ নন। তাঁর স্বপ্নে জাগরণে এখন সম্বল শুধু সেই হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক কিশোরের ছবি। ধীরে ধীরে বাস্তব দুনিয়ার জ্ঞান হারিয়ে যায় তাঁর। প্রত্যাখ্যানের সুতীব্র আঘাতকে সইবার জন্য কল্পনায় গড়ে ওঠে তাঁর শাশ্বত ব্রজধাম। সেখানে হারাবার বেদনা নেই। আছে শুধুই চিরমিলনের সুখ।
চাঁদ অস্ত গিয়েছে কখন যেন। আসরের আলোগুলি ম্লান হয়ে এসেছে এবারে। গানের মধ্যেও তখন শেষরাত্রে স্বপ্ন দেখে চলেছেন রাধা—
পরাণ বন্ধুকে স্বপন দেখিনু বসিয়া শিয়র পাশে নাসার বেসর পরশ করিয়া ঈষৎ মধুর হাসে পিয়াল বরণ বসনখানিতে মুখখানি মোর মোছে শিথান হইতে মাথাটি বাহুতে রাখিইয়া শুতল কাছে অঙ্গপরিমল সুগন্ধী চন্দন কুকুম কস্তুরী পারা--
তারপর, হঠাৎ করেই সেই স্বপ্ন ভেঙে গেল তাঁর। যা ছিল পরম সত্য, মুহূর্তে তা মিথ্যে হয়ে গেল। স্বপ্নের বাস্তবকে সরিয়ে দিল জাগরণের রূঢ়তর বাস্তব। বাণবিদ্ধ কপোতিটির মতো আকাশে উড়তে উড়তে হঠাৎ তিনি আছড়ে পড়লেন এসে যন্ত্রণাময় মৃত্যুভূমির বাস্তবে—
--পরশ করিতে রস উপজিল জাগিয়া হইনু হারা কপোত পাখিরে চকিতে বাঁটুল বাজিলে যেমন হয় জ্ঞানদাস কহে এমতি অইলে আর কি পরাণ রয়?
তবু প্রাণ গেল না তাঁর। শত দুঃখের বাধা পেরিয়ে স্বপ্ন ও বাস্তবের দুনিয়ায় এমনই এক যন্ত্রণাদীর্ণ অভিসারের দীর্ঘপথ পেরিয়ে অবশেষে চেতনা হার মানলো অলীক কল্পনার কাছে। অনুক্ষণ কৃষ্ণকথা স্মরণ করতে করতে সুন্দরী নিজেকেই কৃষ্ণ বলে চিনতে পারলেন। অপেক্ষার শেষ হল তাঁর। দুঃখে-সুখে জড়ানো বাস্তব দুনিয়ার থেকে একেবারে বিদায় নিয়ে কল্পবাস্তবের জগতে স্বেচ্ছানির্বাসন নিলেন তিনি। প্রৌঢ় এক গায়কের পরিণত কন্ঠে ভাবসম্মেলনের সেই অমর পদটি তখন আসর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে--
অনুখন মাধব মাহব সুমরাইত সুন্দরি ভেলি মাধাই--
--চাঁদ অস্ত গিয়েছে কখন যেন। প্রাকপ্রত্যুষের চন্দ্রসূর্যহীন সময়টুকুও পার হয়ে গিয়ে, চটের ছাউনির ফুটোফাটা দিয়ে সকালের প্রথম আলো ঝরে পড়ছিলো মাঠ জুড়ে। দর্শকেরা আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন চারপাশে। মূল গায়কের গাওয়া পদটি বারংবার বহু কন্ঠে ভর করে ছড়িয়ে পড়ছিলো গোটা আসর জুড়ে। তারপর ধীরে ধীরে সেই গুঞ্জনধ্বনি তার চাল বদল করে ফিরে গেল তিন নাম বত্রিশ অক্ষরের সেই অমর কীর্তনধ্বনিতে—
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে—
গোছা গোছা ধূপ জ্বলে উঠেছে তখন গোটা মঞ্চ জুড়ে। উঠে দাঁড়িয়ে একে অন্যকে আলিঙ্গনের পালা চলেছে। দর্শক আসন থেকে উলুধ্বনি দিয়ে মঞ্চে উঠে আসছেন মেয়েরা। তাঁদের এক হাতে ছোট ছোট রেকাবিতে একটু বাতাসা কিংবা সন্দেশ। অন্য হাতে ঘটিতে জল। রাধামিলনের পালার শেষে মঞ্চের সকল গায়কই তখন তাঁদের চোখে পুণ্যবান। সামনে এসে তাঁদের পায়ে একফোঁটা করে জল দিয়ে মুখে একটুকরো করে মিষ্টান্ন গুঁজে দিয়ে সে পুণ্যের সামান্য ভাগ নিয়ে একে একে নেমে যাচ্ছিলেন তাঁরা—
মাঠের একপাশে রাস্তার ধারে গামছাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ভ্যানরিকশার ওপরে বসে ঢুলছিল শিবু। কাছে গিয়ে তার পিঠে হাত দিয়ে শোভন বলল, “একবার একটু যেতে হবে যে রে!”
চমকে উঠে চোখ খুলে শিবু বলল, “ও। শোভনদাদা!”
তারপর তাড়াতাড়ি নিচে নামতে নামতে প্রশ্ন করলো, “এতো সকালে আসর ফেলে কোথায় যাবা?”
ভ্যানের ওপর উঠে বসতে বসতে শোভন বলল, “একটু বিরামনগরে যাবো। ভুবনদার আখড়ায়। তাড়া আছে। চালিয়ে চল।”
“এই দ্যাখো। ভেবেছিলাম, সকাল সকাল অন্তত তিনটে টিরিপ মারতে পারবো ইশটেশান অব্দি। সেই থেকে একখানা কমে গেল। তা ওখানে কি দেরি হবে তোমার?”
“তুই চল তো আগে! তোর তিন টিরিপের ভাড়া আমি দিয়ে দেবো’খন।”
“হুঁ। বেজায় তাড়া দেখছি। জরুরি কাজ পড়েছে মনে হয়?” বলতে বলতেই সিটে উঠে বসে প্যাডেলে চাপ দিল শিবু।
“হ্যাঁ রে। তাড়া আছে একটু। একটা ভুল করে বসেছিলাম। সেটা শুধরোতে হবে।”
“ভুল! তুমি আবার ভুল করতে পারো নাকি দাদা?”
“ওটাই তো মস্ত ভুল কথা রে! সেই ভুলের ফাঁকে পড়েই তো—যাক গে! তুই পা চালিয়ে চল এবারে। তাড়াতাড়ি গিয়ে পৌঁছনো দরকার আমার।”
|| ১৫ ||
দূরে কোথাও ঘন্টা বাজছিল একটা। টং--টং--টং—উঁচুতে, খাদে, উঁচুতে, খাদে—মাত্র দুটো নোট, পরপর ঘুরেফিরে আসছে বারবার। শর্মিষ্ঠা কিছু একটা স্বপ্ন দেখছিলো। ঘন্টার একটানা শব্দটা তাকে আস্তে আস্তে বের করে আনলো সেই স্বপ্ন থেকে। জেগে উঠেও কিছুক্ষণ স্থির হয়ে শুয়ে শব্দটা শুনল সে। ছাঁচিবেড়ার দেয়ালের অজস্র ফাঁকফোকর চুঁইয়ে ভোরের কুয়াশামাখা নরম আলো এসে ঢুকছে ভিতরে। স্বর্ণাভ রোদমাখা আলো। ঘন্টার শব্দটা বাদে এই জায়গাটা আশ্চর্যরকম নীরব। ক্বচিৎ দু একটা পাখির ডাক শোনা যায় শুধু বাইরে থেকে। গ্রামের বসতি এলাকার বাইরে নদীর পাড়ে দাঁড়ানো এই আখড়ার আশেপাশে দৈনন্দিন জীবনের প্রভাতি ব্যস্ততার চিহ্নমাত্রও নেই। চারপাশের ফসল উঠে যাওয়া ফাঁকা চাষজমিগুলো এখন বিশ্রাম নিচ্ছে কুয়াশার আড়ালে।
পাশে শুয়ে ফরিদা অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। মুখটা চাদরের ফাঁকে টুলটুল করছে। বেদনার আবরণ পেরিয়ে ঘুমন্ত মুখটিতে একটুকরো হাসি লেগে আছে এখন। বোঁজা চোখের পাতার নিচে মণিদুটির অস্থির নড়াচড়া। স্বপ্ন দেখছে মেয়েটা। আনন্দের কোন স্বপ্ন হবে হয়তো! আহা দেখুক। বড়ো চাপা মেয়ে। ভাঙবে, তবু মচকাবে না। গতকাল সন্ধে থেকে একটা আক্ষেপের শব্দ অবধি তোলেনি শর্মিষ্ঠার সামনে। বিকেলবেলা শর্মিষ্ঠা এসে পৌঁছোতে কোন বিস্ময় প্রকাশ না করে শুধু বলেছিল, “এসো শর্মিষ্ঠাদি। রাত্রে থাকবে তো? তাহলে ভুবনদাকে ছেড়ে দেব এখন।”
তার পর থেকে আশ্চর্যরকম চুপ করে গিয়েছে সে। শর্মিষ্ঠা চেষ্টা করেছিল, কোনোমতে যদি মেয়েটাকে তাদের কোয়ার্টারে নিয়ে যেতে রাজি করানো যায়। বেশ কয়েকবার কথাটা বলবার পর ফরিদা শান্ত গলায় জবাব দিয়েছিল, “আমি যাবোনা শর্মিষ্ঠাদি।” একটা আশ্চর্য কাঠিন্য ছিল তার বলবার ভঙ্গিতে। প্রসঙ্গটা ফের একবার তোলবার সাহস পায়নি শর্মিষ্ঠা তারপর। ফরিদাও তার পর থেকে যন্ত্রচালিতের মতো সাংসারিক কাজকর্ম সেরে গিয়েছে। টুকটাক ঘর গুছিয়েছে। রান্নাবান্না করেছে। শর্মিষ্ঠাকে হাত লাগাতে দেয়নি। জোর করেনি শর্মিষ্ঠা। কাজ নিয়ে যদি ভুলে থাকে তো থাক। তাছাড়া, শুকনো লতাপাতার জ্বালে মাটির পাত্রে রান্না করবার কৌশলও তার জানা নেই।
খাওয়াদাওয়া সেরে রাত্রে বিছানায় শুয়েই চোখ বুঁজে ফেলেছিলো ফরিদা। অনেক রাত্রে হঠাৎ মৃদু ফোঁপানির শব্দ আর চাদরের নিচে শরীরটার বারবার কেঁপে ওঠবার স্পর্শ থেকে শর্মিষ্ঠা বুঝেছিলো, অন্ধকারের আড়ালে একলা একলা নিজের সব দুঃখের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সে এইবারে।
আলো বাড়ছিলো একটু একটু করে। শর্মিষ্ঠা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। আগের দিন বিকেলবেলা আসবার সময় একটু চা আর চিনি নিয়ে এসেছিলো সঙ্গে করে। একবার চেষ্টা করে দেখা যাক। কাঠকুটো দিয়ে উনুনটা যদি কোনমতে ধরিয়ে ফেলা যায় একবার তাহলে সকালবেলাকার চা’টা ফাঁকি পড়বে না।
দরজা খুলে বাইরে মুখ বাড়িয়ে একটা চমক খেল সে। বারান্দার ধারে পা ঝুলিয়ে, রাস্তার দিকে মুখ করে কে যেন বসে রয়েছে। চাদর মুড়ি দেয়া চেহারাটাতে পিছন থেকে চিনতে পারা যায় এমন কোন চিহ্ন নেই।
দরজা খোলবার শব্দ শুনে লোকটা বললো, “কে, ফরিদা? উঠলি?” গলাটা চেনা। শর্মিষ্ঠা একটু অবাক গলায় বললো, “শোভনদা! এত সকালে এইখানে এরকম ভূতের মতো এসে বসে আছেন যে! কিছু প্রবলেম হয়েছে?”
শোভন একটু থতমত খেয়ে ঘুরে বসে বললো, “ও, শর্মিষ্ঠা! না না, প্রবলেম কিছু হয় নি। এদিকে তোমাদের রাত্রে সব ঠিক ছিলো তো?”
“সেই খবর নিতে এসেছেন বুঝি?” শর্মিষ্ঠা ঠোঁট টিপে হাসল। তারপর নিচু গলায় বলল, “ফরিদা ঘুমোচ্ছে। ঘুমিয়ে নিক যতক্ষণ পারে। ক’দিন ধরে ধকল তো কম গেল না মেয়েটার ওপর দিয়ে! আপনি ততক্ষণ কাঠের উনুন জ্বালাবার কায়দাটা একটু দেখিয়ে দিন তো! চা তেষ্টা পেয়েছে খুব।”
“তবেই হয়েছে,” শোভন হাসলো, “উনুন ধরাবার ট্রেনিং নেবে প্রথমে। তারপর মাটির পাতিলে চা বানাবার টেকনিক রপ্ত করতেও সময় নেবে খানিকটা। চা তৈরি হতে হতে দুপুর হয়ে যাবে যে!”
“হলে হবে। এখন আগে উনুন ধরানোয় একটু অ্যাসিস্ট করবেন আসুন।”
উঠোনের একপাশে মাটিতে গর্ত করে তার ওপরে উনুন পাতা। একগোছা শুকনো নারকেলপাতা তার মধ্যে গুঁজে দিয়ে তাতে একটা জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি ফেলে দিল শোভন। তারপর শুকনো ডালপালার ছোট ছোট টুকরো তার মধ্যে গুঁজে দিয়ে দক্ষ হাতে উনুনটা ধরিয়ে ফেলে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে বলল, “নাও। এবারে তোমার ডিপার্টমেন্ট। এককাপ চা বেশি কোরো। ভ্যান নিয়ে শিবু এসেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ওকেও দিতে হবে।”
“শিবু এসেছে বুঝি? ভালোই হলো। ওকে ধার নেবো একটু,” চায়ের জল চাপাতে চাপাতে শর্মিষ্ঠা বললো।
“ওকে দিয়ে আবার কী করবে?”
শর্মিষ্ঠা একটু ইতস্তত করে বললো, “ব্রতীন সকালবেলা দুটো আয়ুর্বেদিক ওষুধ খায়। ওই খেয়ে সুগারটা ভালো আছে আজ বছরখানেক। কাল তাড়াহুড়োয় বের করে রেখে আসতে ভুলে গেছি। ফোনে বলে কিছু লাভ নেই। দায় তো সব আমার। নিজে থেকে খুঁজে নিয়ে খেতে তার বয়ে গেছে। মাঠ থেকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়বে সোজা। তাই তখন থেকে ভাবছিলাম কী করি। মেয়েটাকে একলা ফেলে রেখে যেতেও পারছিলাম না। এখন আপনি কিছুক্ষণ থাকুন এখানে। আমি শিবুকে নিয়ে চট করে একবার বাড়িতে ড্রপ নিয়ে ওকে দিয়েই ভুবনদাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ভুবনদা এলে তারপর আপনি যাবেন। আমি ওবেলা ফিরবো। ব্রতীন পৌঁছে দিয়ে যাবে। এখন চেষ্টা করে দেখুন যদি এখান থেকে আমার বাড়িতে গিয়ে উঠতে রাজি করাতে পারেন। আমি তো বোঝাবার চেষ্টা করে হেরে গেছি কালকে।”
শোভন হাসলো, “ফরিদাকে তুমি এখনো চেনো নি শর্মিষ্ঠা। ও চেষ্টা করে কিছু করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। তোমার বাড়িতে গিয়ে কোনমতেই ও উঠবে না। ছোটবেলা থেকে দেখছি তো! আমার হাতেই তো বড়ো হল!”
“হ্যাঁ। একেবারে নিজের ছাঁচে মনের মতো করে বানিয়েছেন সে তো দেখতেই পাচ্ছি। যেমন একগুঁয়ে, তেমন জেদি। আমার আর চেষ্টা করে কাজ নেই। আপনার হাতে তৈরি, কীভাবে সামলাবেন সে আপনিই জানেন। তবে এই বৈরাগির আখড়ায় পড়ে থাকা ওর চলবে না, এই বলে দিয়ে গেলাম।”
ফরিদা চোখ বন্ধ রেখেই বলল, “বলো। অনেকক্ষণ এসেছো, তাই না? বাইরে থেকে গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। মাঠ ছেড়ে হঠাৎ চলে এলে যে!”
উত্তর না দিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো শোভন। তারপর হঠাৎ শান্ত গলায় বললো, “তোকে নিয়ে যেতে এলাম। ওঠ। ব্যাগ গোছা। একটু বাদেই শিবু আসবে।”
চোখ বন্ধ রেখেই চাপা গলায় ফরিদা বললো, “আমি কোথাও যাবো না শোভনদা। এখানে আমি থাকতে এসেছি। তোমার দয়া আমি আর চাইনা। তুমি এখন যাও।”
হঠাৎ নিচু হয়ে ফরিদার কাঁধদুটো ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে তাকে তুলে বসিয়ে দিল শোভন। তাড়াতাড়ি তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে ফরিদা নিচু গলায় বলল, “ছাড়ো—শর্মিষ্ঠাদি বাইরে আছে--”
“শর্মিষ্ঠা চলে গেছে ফরিদা। এখন তোকে খোলাখুলি একটা কথা বলি শোন। আমি তোকে দয়া করতে এখানে আসিনি। পাগলি, আমি তোকে ভালোবাসি রে! আমি--”
তীব্রোজ্জ্বল চোখদুটি শোভনের চোখে রেখে খানিকক্ষণ স্থির হয়ে রইলো ফরিদা। তারপর চোখ নামিয়ে মৃদু গলায় বললো, “যাবো। এর চেয়ে বেশি ইমোশন তোমার মতো পাথরের কাছে আশা করাটাই যে ভুল সেটা আমার আরো আগেই মেনে নিতে পারা উচিৎ ছিলো। এখন বাইরে গিয়ে দাঁড়াও। শাড়িটা পালটে নিই—এ—ই , কী হচ্ছে---”