• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৭ | জুলাই ২০১৪ | উপন্যাস
    Share
  • যাত্রী: তৃতীয় পর্ব (৬) : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ (শেষ)





    “কোথায় চলে গিয়েছিলে হঠাৎ বলো তো সমাদৃতাদি?” ফোন করে করে পাই না। তারপর কৃষ্ণাদি গিয়ে আবিষ্কার করল, ফোনটা তোমার ব্যাগের মধ্যে থেকে বাজছে। বাড়িতে অতিথি ভর্তি রেখে মালকিন উধাও। শেষে আমি আর কৃষ্ণাদি মিলে খাবারদাবার বানিয়ে খাওয়ালাম সবাইকে। উত্তমদার তো সারাদিন কিছু খাওয়াই হয়নি। ব্রতীনও অফিস থেকে সোজা এসেছিল।”

    “কী বানালে?”

    “কী আর বানাবো। উত্তমদাই বলল, বেশি করে ফ্রেঞ্চ টোস্ট আর কফি বানিয়ে দিতে। আচ্ছা, বলছিল তুমি নাকি দুর্ধর্ষ ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানাও? কই কোনদিন তো—”

    সমাদৃতা প্রসঙ্গটা পালটাতে চাইছিল। বলল, “তুমি বাড়ি যাওনি এখনো শর্মিষ্ঠা? রাত তো প্রায় আটটা বাজে।”

    “যাবো কী করে? এই যে আমার দুই চ্যালা চামুণ্ডা হয়েছে না? এই বিল্টু আর সুরভি মিলে আমায় নড়তে দিচ্ছে না সেই বিকেলে আসবার পর থেকে। উত্তমদা এসে ফিরে চলে গেল অনেকক্ষণ বসে থেকে থেকে। শেষে ব্রতীন বলে, “তুমি ওয়েট করো মাদ্রিদি কখন ফেরে তার জন্য। আমি এগোচ্ছি।”

    “শোভন কোথায়?”

    “শোভনদার কথা আর বোলো না। উত্তমদা আর ব্রতীন চলে যাবার পর কিছুক্ষণ বাড়িতেই ছিল। এই খানিক আগে ছত্তিশগঢ় থেকে প্রফেসর মালহি ফোন করলেন। নাকি এক্ষুণি কীসব জরুরি দরকার হয়ে পড়েছে। কীসব মেলটেল পাঠিয়েছেন উনি। সেসব দেখতে হবে। এদিকে তুমি বাড়িতে নেই। ফোন করেও পাচ্ছি না। তোমার কমপিউটারের পাসওয়ার্ডটোয়ার্ডও তো জানিনা। শেষে শোভনদা ফোকলোর ইনস্টিটিউটে ফোন করে সেখানেই চলে গিয়েছে ক্যাম্পাসের কোন একজন পরিচিত প্রফেসরের বাড়িতে। এখুনি ফিরবে বলে গেছে।”

    একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সমাদৃতা। শোভন আর কোনদিন বদলাবে না। সে বাড়ি ফেরবার পর ছেলেমেয়েদুটো একটু শান্ত হয়েছে। শর্মিষ্ঠা বাড়ি চলে যাবার পর একটা বোর্ড গেম বের করে তাদের বসিয়ে দিয়ে কাপড়জামা পালটে সে গিয়ে ফরিদার কাছে বসল।

    বালিশে ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে কিছু একটা পড়ছিল ফরিদা। তাকে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসল। পাশে ছোট্ট একটা সুন্দর দোলনার ওপরে গোলাপি ঢাকনা দেয়া। তার ছেলেটা তার ভেতর ঘুমোচ্ছে। দোলনাটার দিকে একঝলক তাকিয়ে সমাদৃতা বলল, “এটা আবার কখন এল? শোভন নিয়ে এসেছে?”

    ফরিদা হাসল, “কী যে বলো সমাদৃতাদি? সে মানুষের এত কাণ্ডজ্ঞান কখনো হয়? উত্তমদাই আসবার সময় কিনে আনল।”

    “উত্তমকে তুমি চিনতে?”

    “নাম শুনেছি দু একবার শোভনের কাছে। ছোটবেলার বন্ধু শুনেছি। কিন্তু ওইপর্যন্তই। আগে দেখিনি কখনো। মানুষটাকে কিন্তু খুব ভালো লাগল আমার সমাদৃতাদি। ব্রতীনদাও বলছিলেন। যেভাবে নিজে থেকে এগিয়ে এসে শোভনদার জন্য প্রাণপণ করে করলেন সবকিছু-- মানে, উনি না থাকলে আজ শোভনের যে কী হত আমি জানিনা।”

    কোন উত্তর দিল না সমাদৃতা। ফরিদার সেন্টিমেন্টটা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু—কতটুকু জানে ও ওই মানুষটার? সমাদৃতা জানে। প্রসঙ্গ পালটে সে প্রশ্ন করল, “তুমি কেমন আছো বল। সারাদিন কোন অসুবিধে হয় নি তো?”

    “না না, অসুবিধে কেন হবে? অসুবিধে তো আপনারই। অসুস্থ হয়ে একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে সেই পড়তেই হল শেষে। একটু সুস্থ হয়ে নিয়েই--”

    “চলে যাবে? তাইতো? তোমার ওপর আমার অধিকারটা কী যে আটকাবো?” হঠাৎ করেই নিজেকে ভীষণ ক্লান্ত ঠেকছিল সমাদৃতার।

    “তুমি রাগ করলে সমাদৃতাদি?” ফরিদার গলায় একটু অপ্রস্তুত ভাব ছিল, “মানে আমি তো তোমার সুবিধের কথা ভেবেই—”

    “সবাই শুধু চিরকাল আমার সুবিধের কথাই ভেবে গেল, জানো ফরিদা? আজ তুমি আমার সুবিধের জন্য আমাকে রেখে তোমার স্বামী সন্তানকে নিয়ে চলে যেতে চাইছ। অন্যেরাও চিরকাল তা-ই করে এল। তোমার কাছে খোলাখুলি বলতে আমার কোন সংকোচ নেই। তোমার স্বামী শোভন--সে আমার ভালো চেয়েছিল। চেয়েছিল আমার কেরিয়ারের স্বপ্নটা যেন সফল হয়। তাই সে চলে গেল। কোন বাধা হল না আমার স্বপ্নের রাস্তায়। আমার স্বামী উত্তম, সে চাইল আমায় সুখে রাখবে, আমাদের ছেলেটার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে, অন্তত মুখে সে তাই বলেছিল। আর তার জন্য সে নিজের ধর্ম, নীতি সব ছেড়ে টাকার পেছনে ছুটল। নিজের আত্মাটাকেই বিক্রি করে দিয়ে আ-আমায় পথে দাঁড় করিয়ে চলে গেল। যাও। চলে যাও তোমরা। সবাই চলে যাও। তোমরা সবাই আমার ভালো চাও। আমি জানি ফরিদা।”

    তার শিক্ষা, দীক্ষা, তার পেশাগত প্রশিক্ষণ সবকিছুর বাঁধ ভেঙে উঠে আসা সেই কথাগুলো ফরিদার বুকের একেবারে ভেতরে কোথাও একটা ধাক্কা দিচ্ছিল গিয়ে। খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎ সে বলে ফেলল, “আচ্ছা সমাদৃতাদি, কোনভাবে কি তোমাদের একটা রিকনসিলিয়েশান—”

    “ফরিদা, তুমি এই কথা বলছ? আচ্ছা, বলো তো, তোমাদের এলাকায় তো অনেক স্মাগলিং র‍্যাকেট চলে। তুমি যদি কখনো শোন যে শোভন সেইরকম একটা কোন র‍্যাকেটের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছে তোমায় সুখে রাখবে বলে, তুমি কী করবে? তার স্ত্রী বলে নিজের পরিচয় দিতে রাজি থাকবে? বলো--”

    তার শিউরে ওঠাটা নজর এড়াল না সমাদৃতার। খাটের একটা কোণে এসে বসে ফরিদার একটা হাত ধরে সে বলল, “একটা অনুরোধ করব তোমাকে আমি ফরিদা। উত্তম আজ তোমার অনেক উপকার করেছে। শোভনকে একরকম ধ্বংসের মুখ থেকে ফিরিয়ে এনে দিয়েছে। তার কাছে তুমি তো কৃতজ্ঞ থাকবেই, আমিও কৃতজ্ঞ থাকবো সেজন্য। আমার ওপরে তার এখনও যে কত লোভ তা-ও আমি ভালো করে জানি। কিন্তু তার হয়ে তুমি আমাকে এই কথাটা আর দ্বিতীয়বার বোলো না। তাহলে আমাকেই হয়ত চলে যেতে হবে সব ছেড়েছুড়ে।”

    ফরিদা তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল, “সরি সমাদৃতাদি। আমি নিজে একটু ক্যারেড ওভার হয়ে গেছিলাম হঠাৎ করে। কিন্তু তাই বলে তোমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে হঠাৎ করে এমন কথা বলাটা আমারও উচিৎ হয়নি।”

    “বৌদিদি বেবিকে ফিড দেবার সময় হল তো!” কৃষ্ণা ঘরের ভেতর এসে নিচু গলায় ফরিদাকে বলল হঠাৎ। দেয়ালের ঘড়িটার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে ফরিদা বলল, সে কী? নটা বেজে গেল এর মধ্যে? সমাদৃতাদি, ওকে একটু তুলে দাওনা আমার কোলে!”

    শিশুটির নরম ত্বকের স্পর্শ লাগছিল সমাদৃতার হাতে। তার শোভনের সন্তান! তুলে ধরে বুকের কাছে একটুখানি জড়িয়ে ধরল সে একবার। তারপর তাকে তার মায়ের হাতে দিয়ে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে তখন ফরিদা আবার ডাকল পেছন থেকে, “আর একটা কথা ছিল সমাদৃতাদি।”

    “কী?”

    “না মানে, উত্তমদা কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিলেন বাচ্চাদের জন্য। অন্যদের জিনিসগুলো তো দিয়ে গিয়েছেন, শুধু বিল্টুর জন্য একটা প্যাকেট ছিল, সেটা আমার কাছে রেখে দিয়ে বলে গেছেন আপনাকে একবার বলতে, মানে, পুজো আসছে তো, কিছু জামাকাপড় নিয়ে এসেছিল--যদি আপনি সেটা বিল্টুকে দিতে রাজি হন।”

    “প্যাকেটটা দাও,” সমাদৃতা হাত বাড়াল।

    রঙিন কাগজে মোড়া একটা বড় বাক্স বালিশের পেছন থেকে বের করে নিয়ে এল ফরিদা। বাক্সটা তার হাত থেকে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল সমাদৃতা। বিল্টু দেখতে পায়নি। তাকে সে দেখতে দিতেও চায় না। আর একটা অশান্তির শুরু হবে তাহলে। পড়ার টেবিলে গিয়ে বসে ফোনে উত্তমের নম্বরটা মেলালো সে।

    উল্টোপিঠের ফোনটা বেজে বেজে কেটে যেতে খানিকক্ষণ চুপ করে দু হাতে মাথাটা ধরে বসে রইল সমাদৃতা। তারপর ফের লাইনটা মেলাল সে। এইবার প্রথম রিং-এই ফোনটা ধরে নিল কেউ। কাছে থেকেই উত্তমের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, “গিভ দা ফোন টু মি। ইটস মাই ওয়াইফ কলিং—”

    মৃদু একটা হাসির শব্দ হল কি? কিন্তু সেটাকে ডুবিয়ে দিয়ে প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই উত্তম ধরে নিল ফোনটা। সামান্য স্খলিত গলায় বলল, “বলো, কী বলবে?”

    “বিল্টুর জন্য তুমি আবার দামি জিনিস নিয়ে এসেছিলে?”

    একটুক্ষণ চুপচাপ থাকবার পর ফোনের ওপার থেকে ফের কথা বলল উত্তম। তার স্বরে পাথুরে শীতলতা ছিল, “এনেছিলাম। তুমি বাড়িতে থাকবে না সেটা আন্দাজ করেছিলাম। ফরিদার কাছে রেখে এসেছি। ওর আপত্তি হয় নি।”

    “কেন এনেছ?”

    “কেন নয়?”

    “কারণ আমার ছেলের ওপর তোমার আর কোন অধিকার নেই।”

    ফোনের ওপাশ থেকে মৃদু হাসির শব্দ ভেসে এল একটা, “মামলা করেছ যখন তখন অধিকার আছে কি না সে তো আদালত বুঝবে মাদ্রি। তবে ইতিমধ্যে তোমার বাবা কিন্তু অন্য কথা বলে দিয়েছেন আমাকে। তোমায় কিছু বলেন নি?”

    অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে হাতের ফোনটার দিকে তাকিয়েছিল সমাদৃতা। বাবা—

    উত্তম ফোনের অন্যপার থেকে তখন কথা বলে চলেছে, “ভেবেছিলাম কদিন কাটলে এমনিই তেজ ভাঙবে। তা যখন হল না তখন ব্যবস্থা তো কিছু নিতেই হয়।”

    “কী করেছো তুমি বাবাকে?”

    “কিচ্ছু করি নি। শোভন যেদিন অ্যারেস্ট হয় তার দিনকয়েক আগে তোমার উকিলের চিঠিটা পেয়েছিলাম। এরপর যেদিন ওকে পুলিশে ধরল সেদিন দুপুরবেলা সব খবরাখবর নিয়ে আমি তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। কোন রাখঢাক না করে সমস্ত খুলে বলেছি তাঁদের। তারপর বলেছি, সবকিছু সত্ত্বেও--”

    একটা অশুভ ইঙ্গিত ছিল উত্তমের কথায়। গলার কাছটা গিঁট পাকিয়ে উঠছিল তার--“কী খুলে বলেছ তুমি? তুমি—”

    “যা সত্যি তাই বলেছি। এই যে একটা লোক যার বিরুদ্ধে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠেছে, তার বউকে বাড়িতে এনে শেলটার দেয়া, তাকে নিজের বাড়িতে এনটারটেইন করা, এর ফলে তুমি ঠিক কী বিপদে পড়তে চলেছ সেটা বুঝিয়ে বলেছি তাঁদের। সেটা আমার কর্তব্য ছিল। আমিই শুধু করাপ্ট, ক্ষতিকর লোক না মাদ্রি? আমার থেকেই শুধু তোমার ক্ষতি হবে? এসআইবি-র ইনভেস্টিগেশান ফাইল আমি নিজে দেখে এসেছি। সেখানে ওর কিছুদিন আগের নর্থ বেঙ্গল ভিজিট এবং সে সময় সরকারী কোন ছাতার আড়ালে সংগঠনের কাজকর্ম করবার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। ব্যাপারটা আন্ডার ইনভেস্টিগেশান রয়েছে।”

    সমাদৃতা প্রায় ফিসফিস করে বলল, “এসব—এসব কী বলছো তুমি? আমি--”

    “সত্যি কথাটাই বলছি মাদ্রি। একটা দখলের লড়াই চলছে মুরলীপুর গ্রামে। আমাদের আইডিয়ালিস্ট ডন কুইকজোট কারো সঙ্গে আপোস না করতে চেয়ে একা একা যুদ্ধে নেমে মরতে চলেছে। তা সে মরলে আমার কোন আপত্তি ছিল না। এদের মতো বোকাদের মরাটাই নিয়তি। কিন্তু সে লড়াইয়ের নির্দোষ কোল্যাটেরাল ড্যামেজ হয়ে ওঠবার থেকে আমি তোমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি সমাদৃতা। এবং সেটা করছি তোমার বাবা মায়ের একান্ত অনুরোধে। ওঁরা কিন্তু তোমার ভালোমন্দের ভারটা ফের একবার নতুন করে আমার ওপরেই দিয়েছেন। আর সেইজন্যেই শোভনকে এই ফাঁদটা থেকে বের করে আনাটায় এত জোর দিচ্ছি আমি। ওকে বেকসুর খালাস করাটা জরুরি। তোমার জন্য মাদ্রি। শুধু তোমার জন্য। কিন্তু তার বিনিময়ে আমার ডিমান্ডটাও তোমাকে দেখতে হবে যে! তুমি এবং বিল্টু, এই দুজনকেই আমার ফেরত চাই। এবারে বলো, বিল্টুর গিফটটা ফেরত দিয়ে দেবে? চাইলে দিতে পারো। আমিও তাহলে নিজেকে এ কেস থেকে সরিয়ে নিয়ে নিশ্চিন্তে আমার পথে যাই। কিন্তু ডিসিশানটা নেবার আগে আর কারো না হোক বিল্টুর কথাটা আশা করি একবার ভাববে। ”

    একটা তিক্ত হাসি ফুটে উঠছিল সমাদৃতার মুখে। উত্তমের স্খলিত গলা, তার কথা বলবার আগের সেই অন্য একটা গলার মৃদু হাসির শব্দটা তার কানে তখনও ঝনঝন করে বাজছে, “আমাকে এবং বিল্টুকে ঠিক কী কারণে তোমার দরকার তা আমি জানি উত্তম। সামাজিক ঠাটটা বজায় রাখবার জন্য, তাই না? সেটা ছাড়া অন্য সব প্রয়োজন তো তুমি মিটিয়েই নিচ্ছ। ঠিক কতোটা নিচে তুমি নেমে গেছ জানো?”

    “আমি নিচে নেমে গেছি আজকে, তাই না মাদ্রি? কিন্তু এরকম তো আমি কোনদিন ছিলাম না! তোমার প্রতি ডেডিকেশানের কোন অভাব তো কোনদিন আমি দেখাই নি। কে টেনে নামিয়েছে আমায় এখানে?” উত্তমের গলায় ক্ষীণ একটা শ্লেষের স্পর্শ ছিল, “আর তুমি? ডিভোর্সের যে কেস ফাইল করেছো তুমি তাতে বারবার আমার অধোগমনের কথাটাই তুলে এনেছো তো। আমাকেও তাই বাধ্য হয়েই কিছু খোঁজখবর নিতে হয়েছে। শোভনের সঙ্গে তোমার দীর্ঘদিন ধরে একটা আন্ডারকভার সম্পর্ক রেখে চলা, তার কিছু এভিডেন্স--”

    হঠাৎ মাথাটা একবার ঘুরে উঠল সমাদৃতার। প্রায় ফিসফিস করে সে বলল, “কেন তুমি একটা মিথ্যে দিয়ে আমার এতবড় সর্বনাশ—”

    “—করব মাদ্রি। তোমার এবং প্রয়োজনে শোভনের। মিথ্যে হলেও। তোমাকে আর বিল্টুকে ফেরত না পেলে আমি তোমাদের শেষ করে দেব দেখে নিও। আই অ্যাম ইউ কে প্রধান! আই গেট হোয়াট আই ওয়ান্ট অর এল্‌স্‌--”

    ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে গেছে অনেকক্ষণ। শাঁ শাঁ করছে রাত। বাইরে থেকে বৃষ্টির মৃদু শব্দ আসছিল। কৃষ্ণা বাচ্চাগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে বোধ হয়। হঠাৎ এই বাড়ির ঘরে ঘরে বিশ্রামরত একদল নির্দোষ, অসহায় মানুষের মুখগুলো মিছিল করে ভেসে এল সমাদৃতার চোখের সামনে। পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে তার। অথচ যে হাতটা কোনদিন আর আঁকড়ে ধরতে চায় নি সে, সে হাতটাই আজ একটা লোভনীয় অবলম্বনের মতো তার সামনে। মানুষটা অনেক নিচে নেমে গেছে। কিন্তু তবু সে এখনো তাকে চায়। আর সেইটাই তার জ্বালা। সব জেনেশুনে, সব বুঝেও নিজের সব আদর্শ, ছেলেটাকে নিজের মতন করে গড়ে তোলবার সব স্বপ্নকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ফের সেই ক্লেদাক্ত সম্পর্কের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে তাকে। ফোনের শুরুতে উল্টোপিঠের সেই অদৃশ্য মৃদু হাসিটুকু বারবার বজ্রনির্ঘোষে কানে এসে বাজছিল তার। ফের একবার হেরে গেছে সমাদৃতা। একেবারে গোহারা হেরে গিয়েছে জীবনের কাছে, ওই মানুষটার কাছে। কেন এমন হয়?

    *****

    রাত শেষ হয়ে আসছিল। পুবের জানালা দিয়ে সকালের প্রথম আলোর ইশারা দেখা যায়। খোলা কমপিউটারের মনিটরটার আলো এসে পড়েছে তার মুখে। তার পর্দার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসেছিল সমাদৃতা। বায়োডেটার অ্যাটাচমেন্টটা লোড হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। টি ই এফ এল এর সার্টিফিকেটটা কেবল লোড হতে সময় নিচ্ছে একটু। ব্যাপারটা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করছিল সে, প্রস্তুতিও নিয়েছে। কিন্তু সিদ্ধান্তটা নিয়ে উঠতে পারছিল না। শেকড়বাকড়ের বন্ধন বড় শক্ত। আজকের এই ফোন কলটা তার সব দ্বিধা, সব দ্বন্দ্ব দূর করে দিয়ে গেল একেবারে---

    *****

    “একটু এদিকে আসবে?”

    একতাড়া কমপিউটার প্রিন্ট আউট হাতে শোভন বারান্দায় বসে ছিল। ফরিদার ডাকটা শুনে উঠে ঘরে এল।

    “জানালাটা খুলে দাও একটু। আর ছেলেটার গায়ে হাত দিয়ে দেখো তো গরম হয়েছে নাকি?”

    কাগজগুলো টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে শোভন ঝুঁকে পড়ে শিশুটির গালে তার গাল ঠেকাল। কর্কশ চামড়ার স্পর্শে একবার একটু কেঁপে উঠে কেঁদে উঠল সে।

    “উঁহু। গরম টরম কিছু মনে হচ্ছে না। সর্দিটাও তো কমেছে বললে।”

    “খিদে পেয়ে গেছে বোধ হয়। ওকে তুলে আমার কাছে দাও তো। দেখো ফেলে দিও না আবার।”

    তাকে সাবধানে তুলে ধরে ফরিদার পাশে নামিয়ে রাখলো শোভন। তার মুখের কাছে নিজের স্তনটি বাড়িয়ে ধরেছে ফরিদা। তারপর শিশুটির এলোমেলো ঘুরতে থাকা ঠোঁটদুটির মধ্যে যত্ন করে বৃন্তটি গুঁজে দিয়ে তাকে চুপ করিয়ে সে বলল, “কীসের এত মেল পাঠিয়েছেন প্রফেসর মালহি বলো তো! কাল সেই যে বেরোলে, ঢুকলে এসে একেবারে তো রাত দশটায় ওই একতাড়া কাগজ নিয়ে। কিছু হয়েছে নাকি?”

    শোভন মৃদু হেসে মাথা নাড়াল। একটা ভালো অফার দিয়েছেন প্রফেসর মালহি। লাখি জাগরের ওপরে আমাদের দুজনের প্রিলিমিনারি পেপারটা একটা পাইলট হিসেবে উনি মিনিস্ট্রি অব কালচারকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ওরা বছর চারেকের একটা ফেলোশিপ দিতে রাজি হয়ে গেছে। মাসে মোটামুটি হাজার বিশেক টাকা দেবে। তবে ইন সিটু প্রজেক্ট। ছত্তিশগঢ়ে হালবিদের এলাকায় থেকে গোটা কাজটা করতে হবে বললেন।

    “হঠাৎ এইভাবে নিজে থেকে এরকম একটা অফার দিলেন যে! উনি তো তোমার এদিককার কমিটমেন্টগুলোর কথা সবই জানেন। তাহলে--”

    “ঠিক হঠাৎ করে নয় ফরিদা। আসলে গত মাসে এখান থেকে ফিরে যাবার পর মুরলিপুরে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে বলবার নয়। প্রতিদিন একটা না একটা উৎপাত লেগে আছে। চোখের সামনে মেলাটা নিয়ে ছেলেখেলা করে একটা কমার্শিয়াল এন্টারটেইনার তৈরি করছে লোকটা। বাইরের একগাদা ছেলেপুলে এনে এলাকায় ঢুকিয়েছে। তাও মেনে নিচ্ছিলাম। যা খুশি করুক, গানটা তো অন্তত হবে। কিন্তু তারপর যেটা শুরু হল সেটা একেবারে সহ্যের বাইরে। মেলার নামটা নিয়ে গণ্ডগোল বেধেছিল সে তো তোমায় বলেছি। সে নিয়ে আমি অমরেশ বাগচিকে বলেও এসেছিলাম মামলা করব। সমরেশকে দিয়ে কলকাতায় একজন উকিল ধরলাম, তা অমরেশ বাগচি খবরটা পেয়ে গেছে দেখি দুদিনের মধ্যে। তারপর থেকে যা শুরু হয়েছে সেটা সহ্য করা যাচ্ছিল না। ছেলেমেয়েগুলোর বাড়ি বাড়ি লোক পাঠিয়ে থ্রেট করছে আমার ইশকুলে পাঠালে দেখে নেবে। ভয়ে কয়েকদিনের মধ্যে ইশকুল প্রায় খালি হবার অবস্থা। আমার আর সহ্য হচ্ছিল না ফরিদা। প্রফেসর মালহিকে একটা মেল করেছিলাম অবস্থাটা বলে। জাস্ট একটা ক্যাথারসিস। বিশেষ কোন আশা নিয়েও বলিনি। ভদ্রলোক তাই পড়ে বোধ হয় নিজেই উদ্যোগ নিয়ে--”

    “--তুমি—পালিয়ে যাবে? নিজের তৈরি সবকিছু এইভাবে ছেড়েছুড়ে—”

    হঠাৎ নিচু হয়ে তার গালে হাত বুলিয়ে শোভন বলল, “আমি পারছিলাম না আর ফরিদা। একা হলে এক কথা। ভুবনদাও এসে বারবার শুধু তোমার কথা বলছিলো। দুটো ছোট ছোট বাচ্চা বাড়িতে। তুমি আছো—

    “--কিন্তু না গো। আর বোধ হয় তার দরকার হবে না। উত্তমটা যে একেবারে কোথা থেকে এসে একেবারে ঠিক সময়ে উদয় হল! পার্সোনাল লাইফে যা খুশি করুক, আমার কেসটাকে নিয়ে কিন্তু একবর্ণ ছলচাতুরির আশ্রয় নেয় নি ও। হিয়ারিংটা যদি তুমি শুনতে! ও বলেছে সামলে নেবে সব। মামলার দিকটা তো দেখছেই, সেইসঙ্গে মুরলীপুরে লোকজন পাঠিয়ে কাজও শুরু করে দিয়েছে কিছু কিছু। নিজেও যাবে সামনেই। স্কুলটা নিয়ে ওর নিজের কিছু প্রফেশনাল ইন্টারেস্টও আছে সে তো বলাই বাহুল্য। সে কথা ও গোপনও করে নি আমার কাছে। সে থাকুগ গে যাক। আমি আমার কাজটুকু নিয়ে থাকতে পারলেই হল। আমি প্রফেসর মালহিকে জানিয়ে দেবো। একটু দুঃখ পাবেন অবশ্য। কাজপাগল মানুষ--

    “আসলে, আমার তো স্বপ্নগুলো খুব ছোটোখাটো! গান নিয়ে কাজ, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে মানুষ করা, আর তোমাদের নিয়ে জড়িয়েমড়িয়ে থাকা। একটা সময় ছিল যখন এমন ঘটনা ঘটলে লড়াই করবার তাগিদটা হত। কিছুদিন হল কেমন যেন সেই তাগিদটাই আর ভেতর থেকে আসছে না ফরিদা। যে কদিন ওখানে ছিলাম, বারবার শুধু তোমাদের তিনজনের মুখগুলো--”

    ফরিদা ঠোঁট চেপে চোখের জল আড়াল করল। নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই চিরকেলে প্রবৃত্তি থাকে তার ভালোবাসার মানুষটিকে বশে আনার। শোভনকে ফরিদার ক্ষেত্রে সে নিয়ে কোন চেষ্টা করতে হয় নি, স্বপ্নও দেখতে হয় নি। ফরিদা আপনি তার বশ মেনেছে। কিন্তু তার পুরুষটির এইভাবে একটুকরো সুখের লোভে বশ্যতা মেনে নেয়া চোখের সামনে দেখেও কেন যেন ফরিদার কোন সুখের অনুভুতি হচ্ছিল না। নিজেকে কেমন যেন ছোট ঠেকছিল তার। এই মানুষটি তাকে নিজের হাতে গড়েছেন। তার মত অনেক মানুষের বোধবুদ্ধি, ব্যক্তিত্বকে তৈরি করেছেন নিজের কঠিন উদাহরণটি সামনে রেখে। আজ সে মানুষ—

    শীর্ণ, দুর্বল হাতটি দিয়ে সে তার প্রিয় পুরুষের চুলে বিলি কেটে দেয়। তারপর হঠাৎ শিশুটির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঁচু হয়ে তার মাথাটিকে জড়িয়ে নিল সে নিজের বুকে। ফিসফিস করে বলল, “ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। বিপদের দিনে ঠিক সময়ে কেমন আসল বন্ধুটি এসে পাশে দাঁড়ালো দেখলে তো! ক’টা দিন যেতে দাও। উত্তমদা ওদিকটা একটু সামলে নিন। আমিও একটু সুস্থ হয়ে উঠি, তারপর ফিরে গিয়ে আবার নতুন করে--”


    || ১৬ ||

    “বলো সমরেশ।” বাইরের দিকে চোখ রেখে ফোনটা ধরে নিল উত্তম। গাড়ি ছুটছে বিরামনগর ছাড়িয়ে মুরলীপুরের দিকে।

    “যেমন যেমন বলেছিলেন সব বন্দোবস্ত করা হয়েছে উত্তমদা। গার্জেনদের বাড়ি বাড়ি খবর দেয়া হয়েছে -–না না মিটিং-এর কথা কিচ্ছু উচ্চবাচ্য করিনি—শ্যামলবাবুই মানা করে দিয়েছিলেন। শুধু বলেছি কাল সন্ধেবেলা ইশকুলের সামনের মাঠে গানের আসর হবে একটা। সঙ্গে খাওয়াদাওয়া থাকবে। তবে লোকজন কিন্তু ভয় পেয়ে আছে। কেউ বিশেষ সাড়াশব্দ দিল না। আসবে কি না সব—”

    “সে তুমি ভেবো না কিছু সমরেশ। ওদিকটা আমায় দেখে নিতে দাও। মঞ্চটঞ্চ তৈরি?”

    “কাজ চলছে। হয়ে যাবে। পার্টি অফিস থেকে লোক এসেছিল। শ্যামলবাবু হ্যান্ডল করে নিয়েছেন। কোন উৎপাত হয় নি।”

    “গুড। তোমার কাজ করে যাও। আমি সন্ধেবেলা স্কুলে আসছি। কথা হবে। শ্যামলবাবু যেন থাকেন।”

    ফোনটা ছেড়ে দিল উত্তম। কত বদলে গেছে গ্রামটা। পাকা বাড়ির সংখ্যা বেড়েছে অনেক। রাস্তাও চওড়া হয়েছে। একেকটা বাস স্টপেজে দোকানের ভিড় চোখে লাগে। বিরামনগরের পর থেকে মুরলীপুর অবধি গোটা রাস্তাটা দেখতে দেখতে বহুকার আগের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল উত্তমের। এই পথে সে বহুকাল আগে হেঁটে গেছে তার প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে। তখন জীবন অনেকটা বেশি বাকি ছিল সামনে।

    সাইলেন্ট মোডে রাখা ফোনটা পাউচের ভেতরে ফের মৃদু কাঁপুনি তুলছিল। বের করে এনে পর্দায় চোখ রাখল উত্তম। অমরেশ বাগচির ফোন। জবাব দিতে গিয়েও কি মনে হতে কলটা রিসিভ না করে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিল সে। “অন মাই ওয়ে। শ্যাল বি দেয়ার অন টাইম।” একটু ওজন রাখা ভালো।

    পার্টি অফিসের সামনে একটা স্করপিও দাঁড়িয়ে ছিল। তার পাশে গিয়ে গাড়িটা পার্ক করে নেমে এল উত্তম। ভেতর থেকে একটা লম্বামত ছোকরা বের হয়ে আসছে। উত্তমকে দেখে এগিয়ে এসে সসম্ভ্রমে বলল, “মিঃ প্রধান?”

    তারপর উত্তমের মাথা নাড়বার অপেক্ষা না করেই ফের বলল, “অমরেশদা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন ভেতরে।”

    বড়োসড়ো টেবিলটার উল্টোপিঠে অমরেশ বাগচি বসে ছিলেন। উত্তম গিয়ে ঢুকতে একইরকমভাবে বসে থেকেই বললেন, “আসুন, আসুন মিস্টার প্রধান। সেই কর্পোরেশনের মিটিং-এর পর আর তো দেখাই মেলে না। ডুমুরের ফুল হয়ে গেছেন একেবারে। থাকেন কোথায় বলুন তো মশায়?”

    “ঐ নিয়েই তো দৌড়ঝাঁপ চলছিল মশায়,” উত্তম একটু হাসল, “সবই আপনাদের অ্যাডভাইসরি কমিটির দয়া। কর্পোরেশনের কন্ট্র্যাক্টটা কেজরিওয়ালই পেয়েছে শেষপর্যন্ত। কাজটার ব্যাপারে ব্যাঙ্গালোর থেকে সিঙ্গাপুর দৌড়োদৌড়ি চলছেই এই ক’মাস ধরে।”

    “ভালো, ভালো। তা হঠাৎ করে একেবারে সিঙ্গাপুর ছেড়ে এই গ্রামগঞ্জে পার্টি অফিসে দৌড়ে এলেন যে বড়ো?” অমরেশের নিরীহ গলায় করা প্রশ্নটার ভেতরে একটা তীক্ষ্ণ খোঁচা লুকিয়ে ছিল। উত্তম সোজা হয়ে বসল। স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন উল্টোদিকে বসা মানুষটি।

    এ প্রশ্নের জন্য গত কয়েকদিন ধরেই তৈরি হয়েছে উত্তম। ফলে অপ্রত্যাশিত কোন চমক ছিল না এতে। অমরেশের চোখে চোখ রেখে ধীরস্থির গলায় বলল, “বেশ। কাজের কথাই হোক তাহলে। ফ্যাক্টস্‌গুলো দুজনেরই জানা আছে। ও নিয়ে অতএব অনাবশ্যক সময় নষ্ট করবার মানে নেই। গত কয়েকদিনের ডেভেলপমেন্টের ব্যাপারে আপনার কিছু প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাই দিয়েই শুরু করুন।”

    হাতের ইশারায় ঘরের অন্য লোকদের বাইরে যেতে বললেন অমরেশ বাগচি। তারপর দরজাটা বন্ধ হতে ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন, “এই শোভন ছোকরার ব্যাপারে আপনি এসে ঢুকলেন কেন বলুন তো?”

    “যদি বলি ও আমার ছোটবেলার বন্ধু সেইজন্য?”

    “বাজে কথা বলবেন না মিস্টার প্রধান। আপনাকে আমি আজ থেকে চিনি না। ওসব সেন্টিমেন্টালিটির যুক্তি আমায় শোনাবেন না।”

    টেবিলের ওপর থেকে কাচের পেপারওয়েটটা তুলে হাতের মধ্যে ঘোরাচ্ছিল উত্তম। সেটার দিকে চোখ রেখেই নিচু গলায় বলল, “আপনাকে ভোলানোটা আমার ডিউটির মধ্যে পড়ে না অমরেশবাবু। আপনার এখানে আমি একটাই প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। শোভনের পেছনে লাগাটা বন্ধ করুন।”

    “আপনার কথায়?”

    হাতের কাচখণ্ডটি টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে ফের অমরেশের চোখে চোখ রাখল উত্তম, “দুটো রাস্তা আছে আপনার সামনে। আমার কথা শুনলে আপনার কিছু লাভ হবে। আর না শুনলে, আপত্তি থাকলেও আমার অনুরোধটা আপনাকে রাখতে হবেই, তবে মধ্যে থেকে একটু মুশকিলে পড়ে যাবেন। এখন কোনটা আপনি চান সেটা আপনিই ঠিক করুন।”

    “আমার এলাকায় বসে আমাকে থ্রেট করছেন? জানেন, আমি ইচ্ছে করলে এই মুহূর্তে—” হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠলেন অমরেশ বাগচি।

    কিন্তু তাঁর বাক্যটা শেষ করবার আগেই উত্তমও উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর মুখোমুখি হল। হাতে ধরা মোবাইল ফোনের পর্দাটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “দাঁড়ান, দাঁড়ান। ছেলেদের ডাকবেন তো? তার আগে এটা একবার দেখে নিন। নামটা চেনেন নিশ্চয়! আপনাদের দলেরই এম পি মশায়। যতদূর জানি পার্টিতে আপনার গডফাদার বলেই পরিচিত। ওঁর ইলেকশান ফান্ডে কেজরিওয়াল কনসালট্যান্টের কত টাকার চাঁদা ঢুকেছে আপনার কোন আন্দাজ আছে? ডিলটা আমি কিন্তু নিজে হ্যান্ডল করেছি মিঃ কেজরিওয়ালের তরফে। এখানে আসবার আগে ওঁর সঙ্গে আমার এই কেসটার বিষয়ে কিছু কথা হয়েছে। মুরলিপুরের ব্যাপারে আমার কিছু ব্যক্তিগত অনুরোধ ছিল ওঁর কাছে। উনি তাতে সম্মত হয়েই আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটাকে রিজলভ করবার অনুমতি দিয়েছেন। এই মিটিংটায় কী ঘটে তার খবর আমি ওঁকে জানাব বলেছি। এবার বলুন, কোন রাস্তাটা নেবেন।”

    কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন অমরেশ। তারপর চেয়ারে ফের বসে পড়ে বললেন, “প্রস্তাবটা বলুন।”

    “খুবই সিম্পল। এই এলাকায় শোভনের ব্যাপক পপুলারিটি রয়েছে। সেটাকে আপনি কাজেও লাগাতে চেয়েছিলেন। পারেন নি। তাই এবারে ওর পেছনে লেগেছেন। তার ফলে আপনার শিবিরের ভেতরেও দুটো ভাগ হয়ে গেছে। এলাকাতেও একটা অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে-- না না, মাঝখান থেকে কথা কাটবেন না, আমি যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেই এখানে পা দিয়েছি। মামলায় জড়িয়ে, ইশকুলে উৎপাত করিয়ে একেবারে জেরবার তো করেই দিয়েছেন লোকটাকে। ওকে উত্যক্ত করা আপনাকে বন্ধ করতে হবে।”

    অমরেশ মাথা নাড়লেন, “মামলা পুলিশ করেছে। আমি তা বন্ধ করবার কে? আমি ওসব কিছু জানি না।”

    “তা তো বটেই। আপনি তো এর কিছুই জানেন না। জানতে আমি বলছিও না। আমি শুধু আপনার কাছ থেকে একটা চিঠি চাইছি। বয়ানটা আমি করেই এনেছি। এই যে দেখে নিন। এটা আপনার প্যাডে টাইপ করিয়ে একটা সই করে হোম পার-এর জেএসকে ফ্যাক্সে পাঠিয়ে দিন। পোস্ট কপিটা আমি হাতে করে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা ফিরব।”

    ব্রিফকেস থেকে বের করা কাগজটা অমরেশের হাতে দিতে সেটাকে উল্টেপাল্টে দেখে অমরেশ যখন ফের কথা বললেন, তাঁর গলায় উত্তেজনার হালকা স্পর্শ ছিল, “এ তো দেখছি ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট মশায়। ছোকরাকে একেবারে ধোয়া তুলসিপাতা বানিয়ে আকাশে তুলে দিয়েছেন। আমাকে এ চিঠি—”

    “সই করতে হবে অমরেশবাবু। আপনার ভালোর জন্য বলছি। শোভনের কেসটা দীপক স্যান্যাল হাতে নিয়েছেন সে তো আপনি জানেন। এ কেস সরকার হারবেই। প্রথম শুনানিতে কোর্ট যে স্ট্যান্ড নিয়েছে তাতে সরকারের বিরুদ্ধে একটা স্ট্রিকচার পাস যে হবে সেটা বলাই বাহুল্য। ব্যাপারটা মিডিয়াতে ফ্ল্যাশও হবে। ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের যুগ মশায়। সব কাগজ তো আর আপনাদের দলের নয়। কেউ এসে খুঁড়েটুঁড়ে শেষে আপনার সঙ্গে এ কেসের লিংকগুলো বের করে মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিলে ইলেকশনের আগে আগে ব্যাপারটা পার্টির ইমেজের পক্ষে ভালো হবে না। আপনার অপোনেন্ট সুবোধ ঘোষও ব্যাপারটা লুফে নেবার জন্য তৈরি হয়ে আছেন। ব্যাপারটা আমি আপনার এম পিকেও বুঝিয়েছি। এ অবস্থায় আপনার নিজের হাতটা পরিষ্কার রাখলে পার্টির সুবিধে হবে। দোষটা আমলাদের ওভার এনথুসিয়াজমের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে দু একটা বদলিটদলি করে হাত ধুয়ে ফেলতে পারবে।”

    অমরেশের মুখটা কালো হয়ে উঠছিল। যে ধরনের কেস তিনি সাজিয়ে দিয়েছিলেন শোভনের ব্যাপারে তাতে সাধারণত গ্রেফতারির পর আদালতে প্রথমবার তোলার পর পুলিশে আবেদন মেনে নিয়ে মাসখানেকের জন্যে হাজতে ঠেলে দেয়। সেটাই হিসেব ছিল তাঁর। কেউ কিছু টেরও পেত না। কিন্তু এই দীপক স্যান্যালের অ্যাপয়েন্টমেন্টটাই এ কেসের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ লোকটাই সেটা করিয়েছে। সে খবর তিনি পেয়েছেন। অথচ হাতদুটো নিশপিশ করলেও কিচ্ছু করার নেই তাঁর। খানিক বাদে একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “চিঠিটা দিন। টাইপে পাঠিয়ে দি।”

    উত্তম তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখছিল অমরেশের দিকে। ক্যারট অ্যান্ড স্টিক। এ-দুটোর সঠিক মিশ্রণ হলে এ দেশে কোন উদ্দেশ্য সাধনই অসম্ভব হয় না। এই শোভনটোভনদের মত গাড়লগুলো এই সহজ ব্যাপারটা কিছুতেই মাথায় ঢোকায় না। না ঢোকাক গে। তার উদ্দেশ্য বিজনেস টার্গেট অ্যাচিভ করা। সেটা করবার জন্য এবারে এর সামনে গাজরটা ঝোলাতে হবে।

    গলাটাকে অপেক্ষাকৃত নরম করে সে বলল, “ব্যাপারটাতে আপনার লাভও কম হবে না। প্রথমত পাবলিক সাপোর্ট। ছেলেটা এখানকার লোকাল হিরো। গ্রাসরুট লেভেলে শক্ত জমি আছে। পাবলিকলি ওকে সাপোর্ট করলে সে জমিটা আপনি বিনাযুদ্ধে পেয়ে যাচ্ছেন। আরেকটা লাভ হবে এতে। আপনার মেলাটার ব্যাপারে ওর আর কোন বিরোধিতা থাকবে না দেখবেন। ওকে সামনে সাজিয়ে রেখে মেলা আপনি নিজের মতো করেই করবেন। সে ব্যাপারে শোভনকে বোঝাবার দায়িত্ব আমার। শোভন ঘোরপ্যাঁচের লোক নয়। পার্সোনাল ঝামেলাতে উপস্থিত জেরবার হয়ে আছে। এই সময় আপনি এসে পাশে দাঁড়ালে এমনিতেই গলে জল হয়ে যাবে। সবই তো স্ট্র্যাটেজি মশায়। পলিটিকসে পার্মানেন্ট শত্রু বলে কিছু হয় নাকি?”

    অমরেশের মুখ থেকে ছায়াটা একটু সরে গেল। ঘন্টি টিপে চিঠিটা টাইপে পাঠিয়ে দিয়ে দু কাপ চায়ের কথা বলে দিলেন তিনি। তারপর, তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট ঘর থেকে বের হয়ে গেলে একটু বাঁকা হাসি হেসে বললেন, “অনেক খেটেছেন মশায়। সরকারের ওপরমহল থেকে শুরু করে দীপক স্যান্যালকে এনগেজ করবার খরচ, কিছু বাদ দেন নি। গোটা ব্যাপারটাই তো একা হাতে করলেন। একটা কৌতুহল কিন্তু আমার থেকেই যাচ্ছে। যে ইউ কে প্রধানকে আমি চিনি, তিনি শুকনো একটা বন্ধুত্বের খাতিরে এতসব করছেন বলে তো মনে হয় না। ধান্দাটা কি এবারে একটু বলবেন?”

    “উঁহু। ওটা আমার বিজনেস সিক্রেট। আপনাকে আমি তার ডিটেলস্‌ এখনই জানাব না। তবে ও থেকেও আপনার লোকাল পার্টি ফান্ডে একটা ভালো ডোনেশান আসবে আর কিছু ক্যাডারের চাকরি হবে সে কথাটা আমি আগেই দিয়ে রাখছি। কেজরিওয়ালের এডুকেশান উইং এবারে মুরলীপুরকে সেন্টার করে এই এলাকায় বিজনেস এক্সপ্যান্ড করতে চলেছে। ব্যতিক্রমী শিক্ষক হিসেবে শোভনের গুডউইলটা আমারও কাজে আসবে। কোম্পানি ওকে এই এলাকায় ব্র্যান্ড অ্যামবাসাডর হিসেবে প্রজেক্ট করবে বলে ঠিক করেছে। কাজেই ওকে মামলা মোকদ্দমা থেকে ক্লিয়ার করাটা আমাদের বিজনেস স্ট্র্যাটেজির জন্যেও জরুরি, এইটুকুই আপনাকে বলতে পারি।”

    “গুড। বুঝলাম। মেলাটা আমার থাকবে, স্কুলটা আপনার।”

    “কারেক্ট। তবে মেলাটা নিয়ে আমারও কিছু প্ল্যান আছে। ওটা কো-স্পনসর করতে আমার সংস্থা রাজি হয়েছে। এ মেলাটাকে আমরা কেজরিওয়াল এডুকেশনের এই এলাকার লঞ্চপ্যাড হিসেবে ইউজ করতে চাইছি, অবশ্য আপনার আপত্তি না থাকলে।”

    অমরেশের মুখের হাসিটা চওড়া হল এবারে। বললেন, “আপত্তি আর কীসের মশায়? স্পনসর তো আমরা নিচ্ছিই। আপনি টাকা ফেলবেন, বদলে নিজের প্রোডাক্টের অ্যাড করবেন, এতে আমাদের আপত্তি হবে কেন?”

    “বেশ। তাহলে টার্মস্‌, কন্ডিশানস্‌, রেট এইসব নিয়ে আগামী সপ্তাহে একটা মিটিং অর্গানাইজ করি, কী বলেন?”

    “তা করুন, তবে ভেনুটা কলকাতাতে রাখবেন। নেক্সট উইকটা আমি ওদিকে থাকছি।”

    “শিওর। তবে একটা কথা ছিল। মেলাটার টাইমিং একটু পিছোতে হবে। এই ধরুন জানুয়ারি এন্ড নাগাদ। মানে তদ্দিনে শোভনের কেসটাও মিটে টিটে যাবে, আমাদের বিজনেস প্রোজেক্টটাও সাজিয়ে নিতে পারবো যাতে মেলাটাকে ভালো করে ইউজ করা যায়।”

    “ও। তার মানে শোভন পুরোপুরি সেফ না হওয়া অবধি ব্যাপারটা আপনি ঝুলিয়ে রাখবেন, তাইতো?”

    উত্তম মাথা নাড়ল। এর সঙ্গে অভিনয় করে কোন লাভ নেই। হাতের তাস যা দেখাবার সে দেখিয়ে দিয়েই খেলতে বসেছে এখানে। বলল, “একদম ঠিক ধরেছেন। আমাদের ম্যানেজমেন্ট বিজনেস লঞ্চের সঙ্গে একই সময়ে মেলাটা হবে ধরে নিয়েই মেলা স্পনসরিং-এর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে সময় বিজনেসের ব্র্যান্ড অ্যামবাসাডর হিসেবে যাঁকে তুলে ধরা হবে তাঁর একটা পরিচ্ছন্ন ইমেজ থাকাটা জরুরি। কাজেই জানুয়ারি এন্ড-এর আগে মেলা হলে আমাদের স্পন্‌সরিংটা ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট হবে বলে ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত।”

    অমরেশের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভদ্রলোক একটা ফাইল হাতে দরজা ঠেলে ভেতরে এসে ঢুকছিলেন। সেই দিকে চোখ রেখে অমরেশ একটু অন্যমনস্কভাবে বললেন, “এ নিয়ে আমাকে একটু ভাবতে দিতে হবে। মানে অনেক কিছু নতুন করে সাজাতে হবে তো!”

    “সে তো হবেই। আপনাকেও, পুলিশকেও।”

    “পুলিশকে—মানে?”

    উত্তম একটু হাসল, “অমরেশবাবু, শোভনকে ডিসেম্বরের মধ্যে পুরোপুরি মুক্ত অবস্থায় আমার চাই। সেটা না হলে আমাদের বিজনেস প্রোপোজিশানটা মেটেরিয়ালাইজ করবে না। আর সেটা করতে হলে চার্জশিটটা দেবার সময়ও এগিয়ে আনতে হবে। ঐ কোর্টের দেয়া তিনমাসের চক্কর চলবে না।”

    “তা আমি তার—”

    উত্তমের মুখের হাসিটা চওড়া হল, “আরে ছি ছি, আমি কি তাই বলেছি? আমি শুধু বলছি চার্জশিটটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেয়ার বন্দোবস্ত করা। লালবাজারে আপনার কেউ একজন আছেন না? মানে লিভ সাবস্টিটিউট জে এস এর কাছে আপনার লোকজনকে নিয়ে যিনি দেখা করতে গিয়েছিলেন। পাওয়ারফুল লোক মশাই। এক মিটিঙে কেমন রেগুলার জে এস-এর মতটা উলটে দিয়ে গেলেন একেবারে। দেখুন না একটু তাঁকে বলেকয়ে—মানে সবই তো বোঝেন। ইন্টারেস্টটা তো আমাদের দু তরফেরই মিউচুয়াল। তাছাড়া মৃদুলবাবু, মানে এম পি সাহেবও খুশি হবেন। আমি ওঁকে বলবো আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন এ কেসটা নিয়ে--”

    কথা চলতে চলতেই ফাইলটা খুলে ভেতরে রাখা কাগজটা দেখে নিয়েছিলেন অমরেশ। এইবারে তার নিচে সই বসাতে বসাতে বললেন, “আচ্ছা দেখছি। আর, এই যে আপনার চিঠি এসে গেছে। নিন, একটা কপি আপনি নিয়ে চলে যান, অন্যটা থেকে আমি ফ্যাক্স করিয়ে দিচ্ছি--”

    “থ্যাংকস্‌ অমরেশবাবু,” অমরেশ বাগচির সই করা চিঠিটা পকেটে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে উত্তম বলল, “ভাবনাচিন্তা করে কোর্স অব অ্যাকশানটা একটু সাজিয়ে নিন। আমি আমার সোর্স থেকেই মনিটর করতে থাকবো। আর, নেক্সট উইকের একেবারে শেষের দিকে আমাদের মিটিংটা শিডিউল করছি। ভেনু আই টি সি সোনার বাংলা হলে চলবে তো? মিটিং মানে ওই ডিনার উইথ ককটেল আর কি। সঙ্গে সঙ্গে আলোচনাটাও হয়ে যাবে। মিস্টার কেজরিওয়ালকেও আসতে রিকোয়েস্ট করব। আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দিতে চাই ওঁর। এর মধ্যে ভেবেচিন্তে রাখুন। আমি আজ চলি।”

    দরজা ঠেলে বের হয়ে যেতে যেতে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল উত্তম, “ওহো আর একটা কথা। ইশকুলে যে কাল একটা মিটিং ডেকেছি সে কথা তো শ্যামলবাবু আপনাকে বলেছেন নিশ্চয়। গ্রামের লোকজনকে খবর দেয়া হয়েছে। যা শুনলাম তাতে লোকজনের রেসপন্স কম। ভয় পাচ্ছে একটু। সেদিকটা একটু দেখে নেবেন প্লিজ।”

    “ও নিয়ে আপনি ভাববেন না উত্তমবাবু,” অমরেশ হাত নাড়লেন, “ডিল যখন একটা হয়েই গেল তখন ওসব প্রবলেম আমি মিটিয়ে নেবো। আর কাল আপনার মিটিঙে আমি নিজেও যাবো একবার। নতুন এই ডেভেলপমেন্টটা হবার পর একটা পাবলিক অ্যাড্রেস করে ফেলতে চাই। তাতে আপনারও সুবিধে হবে একটু।”

    উত্তম হেসে মাথা নাড়ল। ঝানু রাজনীতিবিদ মানুষটি যে কোনও অবস্থার সুবিধেটি নিতে জানেন ঠিকই। উনি যেটা করতে চলেছেন বলে সে আন্দাজ করছে তাতে তার উদ্দেশ্যের সুবিধে বই অসুবিধে কিছু হবে না। বলল, “আসবেন নিশ্চয়। আমি আপনার জন্য একটা স্লট রাখতে বলে দিচ্ছি। আর, যদি পারেন কিছু ছেলেপুলে পাঠিয়ে দেবেন বিদ্যামন্দিরের সমরেশ নামে ছোকরার কাছে। খেটে জেরবার হয়ে যাচ্ছে একেবারে। এতবড় একটা কাজ এত কম সময়ে সাজিয়ে তোলা তো!”

    “হয়ে যাবে। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যান মিস্টার প্রধান।”

    উত্তম মাথা নেড়ে অফিসঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। বিকেল পড়ে আসছে।

    “কোনদিকে যাব স্যার?”

    “হেমলতা বিদ্যামন্দিরের দিকে চলো। চেনো তো?” গাড়ির দরজা বন্ধ করতে করতে উত্তম বলল।

    “চিনি স্যার। এই তো কাছেই—”


    || ১৭ ||

    “সমরেশদা, শ’খানেক লোকের রান্না করিয়ে দিচ্ছি, হবে তো?”

    সমরেশ মনে মনে একটু হিসেব করে নিল। তারপর বলল, “কুলিয়ে যাবে বোধ হয়। তা খাওয়াদাওয়ার দিকটা তোরাই সব সামলে নিচ্ছিস তো? আমার হাতে কিন্তু ওদিক দেখবার ছেলেপুলে নেই। এইটুকু সময়ের মধ্যে গার্জেন মিটিং-এর খবর দেয়া, গানের বন্দোবস্ত করা—ছেলেগুলোর যা হেনস্থা হচ্ছে বলার নয়।”

    জিনস আর টি শার্ট পরা ছেলেটি এ এলাকায় নতুন। আজকাল অনেক নতুন ছেলেরই আমদানি হচ্ছে এদিকে। সমরেশ তার মুখটা চেনে। এর আগে দুতিনবার ইশকুলে উৎপাত করতে যে দলগুলো এসেছিল তাদের একটাতে একে সে একবার দেখেছেও। নাম সুনীল বা ওইরকম কিছু একটা। সে মাথা নেড়ে বলল, “কেটারিংটা নিয়ে একদম ভাববেন না। অমরেশদা আমাদের তিনজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন যখন তখন খাইয়ে পেট ফাটিয়ে ছেড়ে দেবো দেখবেন।”

    ইস্কুলবাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়েই ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। সেখান থেকে গানের শব্দ ভেসে আসছিল। সেইদিকে কান খাড়া করে সমরেশ বলল, “ফাইন। তোরা তাহলে ওদিকটা সামলা। আমার এদিকে অনেক কাজ রয়েছে।”

    তার লম্বা লম্বা পায়ে চলে যাওয়াটা দেখতে দেখতে একটা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী করে সুনীল নামের ছেলেটি তার সঙ্গীকে বলল, “শুয়োরের বাচ্চার পেখমটা কেমন গজিয়ে গেল দেখলি একদিনে? কদিন আগেও দেখলে পরে লেজ পেটের ভেতর গুটিয়ে যেত, আর আজ একেবারে তুই তোকারি করতে শুরু করে দিয়েছে। শালা বড় খুঁটি পেয়ে গেছে, এখন আর ওকে পায় কে?”

    “এই আস্তে বল।” তার সঙ্গীটি আকে সাবধান করে দিল। “কে কখন শুনতে পেয়ে গিয়ে লাগিয়ে দেবে, তখন আবার কেস ক্যাঁচাল হয়ে যাবে’খন।”

    “ধুর ধুর, ভালো লাগে না। কর্তারা কার সঙ্গে কখন কি সাঁট করবে আর আমাদের আজ একজনকে পেছনে লাথি মারো আবার কাল তার পা ধোয়া জল খাও করতে হবে। এই কদিন আগে যে লোকগুলোকে ইশকুল নিয়ে হড়কেছি, সেই তাদেরই বাড়ি বাড়ি গিয়ে রিকোয়েস্ট করা--বুঝি না শালা।”

    “সে বুঝলে কি আর এইখানে পড়ে থাকতি মামা? সল্টলেকে বাড়ি উঠতো, পুলিশ জামাই হতো। রোববার রোববার মেয়েছেলে নিয়ে ফাস্টক্লাশ—”

    “আরে রাখ রাখ। তিমির ওপর তিমিঙ্গিল থাকে জানিস তো? সব নেতাগিরি কেমন কেজরিওয়ালের মাল এসে এক জুতোয় ঘুচিয়ে দিয়ে হালুম হালুম থেকে মিউ মিউ বানিয়ে দিয়ে গেল দেখলি না?”

    “চাঁদির জুতো রে ভাই। কত টাকার ডিল হয়েছে কিছু জানিস? ভাবতে পারবি না। পার্টি অফিসে কথাবার্তা হচ্ছিল আমি নিজে শুনেছি। নিজে খাবে চোদ্দো আনা, আর আমাদের কপালে যত ফালতু কাজ করে সিকিটা আনাটা--”

    “তরুণদা একবার এদিকে আসবেন। গ্যাসের সিলিন্ডার গণ্ডগোল করছে—”

    পেছন থেকে ডাকটা আসতে আলোচনাটা মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে সুনীল নামে ছেলেটি তার সঙ্গীকে রান্নাবাড়ির দিকে পাঠিয়ে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। কদিন আগেই এ ইশকুলবাড়িটা খালি করিয়ে দিয়ে জায়গাটা একটা ক্লাব করাবার প্ল্যান হচ্ছিল পার্টি অফিসে। লোকজনকে হড়কে রাখবার দায়িত্বটা তাদের কজনের ওপরে ছিল। তারপর হঠাৎ করে কোথায় কি ভোল পাল্টাল, এখন একেবারে ইশকুলবাড়িতে কলকাতার লোকজন এসে গার্জেন মিটিং ডেকে গানের আসর বসিয়ে একাকার কাণ্ড। খাওয়াদাওয়ার দিকটা তাদের তিনজনের ওপর দিয়েছে অমরেশদা। তাছাড়াও আরো দশটা ছেলেকে লাগিয়েছে গোটা প্রোগ্রামটার দেখভাল করে রাখতে, কোথাও কোন গণ্ডগোল না বাধে সেটা দেখবার জন্য কড়া অর্ডারও রয়েছে। মরুক গে যাক। ক্লাবের আশায় তো ছাই পড়লো। এখন এই কেটারিং-এর কাজটা থেকে যা একটু একসট্রা ম্যানেজ করে নেয়া যায় সেটুকুই লাভ। ভেতর থেকে গানের আওয়াজ আসছিল। আসলাম ফকির গাইছে। চেনা গান। আধখাওয়া সিগারেটটা পায়ের তলায় পিষে দিয়ে সে স্কুলবাড়ির ভেতরে গিয়ে ঢুকে পড়ল।

    *******

    গোটাকয়েক গানই গাইবার ইচ্ছে ছিল আসলামের। শোভনের কাছে সে আগেও গান গেয়ে গেছে অনেকবারই। মধ্যে শোভনবাবুকে নিয়ে কীসব গণ্ডগোল হয়েছে সে খবরটা জনান্তিকে তার কানেও এসে পৌঁছেছিল। খবরটা তাকে দিয়েছিল মুসিয়ের ফকিরই। তার চারদিকে লোকজন, সব খবরই রাখে। কাজেকাজেই তার ইশকুলে ফের যখন গান গাইবার জন্যে সমরেশবাবু খবর পাঠাল তখন আসলাম খুশিই হয়েছিল। কিন্তু এসে সব রকমসকম দেখে সে একটু হকচকিয়েই গেছে। বলল উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে হবে। সেটা আবার কী বস্তু? জিজ্ঞেস করতে ট্যারামত এক ছোকরা বলে “আরে যা হোক একটা কিছু গেয়ে দাও না। তাতেই হয়ে যাবে।”

    তা প্রথম গানটা শেষ করে পরেরটা শুরু করবার আগেই সেই ট্যারা ছোকরা এসে তার হাত থেকে মাইকটা তুলে নিয়ে সুইচ বন্ধ করে বলে, “হয়ে গেছে। এইবার নীচে চলো।”

    আসলাম কিছু একটা বলতে গেছিল, তা তাকে একরকম ধাক্কাধুকি দিয়েই স্টেজ থেকে নাবিয়ে দিল আরো দুই ছোকরা।

    মাইকে ইশকুলের সুবিমলবাবু বলছিল, “বন্ধুগণ, আজকে হেমলতা বিদ্যামন্দিরের ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের নিয়ে যে সভার আয়োজন করা হয়েছে তাতে আমাদের সুপরিচিত জননেতা শ্রী অমরেশ বাগচি হাজির আছেন। মূল সঙ্গীতানুষ্ঠান শুরু হবার আগে তিনি আপনাদের কিছু জানাতে চান।”

    নিচে ভুবন বৈরাগী দাঁড়িয়েছিল একপাশে। আসলাম তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল, “ব্যাপার কী ভুবনদা? ইশকুলে ডেকে এনে গান গাওয়াচ্ছে কিন্তু শোভনভাইরে কোথাও দেখি না যে? ইশকুল কি বিক্কিরি টিক্কিরি হয়ে গেল?”

    ভুবন মাথা নাড়ল, “আরে না না, সেসব কিছু নয়। এদিকের কাণ্ড শুনেছ তো?”

    “হ্যাঁ সেতো খবর পেয়েছি। ভালোমানুষের যুগ আজকাল আর নাই রে দাদা। নইলে এই মানুষের এমন দুগ্‌গতি হয় কপালে? তা আজকের গানের নেমন্তন্ন পেয়ে ভাবলাম মিটেগুটে গেছে বোধয়। খুশি খুশি আসছি, এসে দেখি যার ইশকুলে গান সে নিজেই নাই। গেল কোথা?”

    “সে আছে জলপাইগুড়িতে। বাচ্চা হয়েছে। ওখানেই আছে এখন।”

    “তা’লে গান দেয় কে?”

    “সে আছে শোভনবাবুর এক পুরানা বন্ধু। কলকাতায় মস্ত চাকরি করে। শোভনবাবুকে নিয়ে কেষ্টনগরে থানাপুলিশ কোট কাছারি করে জামিন দিইয়েছে, তার পর থেকে কদ্দিন ধরেই তো লোকজন নিয়ে এসে এইখেনে পড়ে আছে। মুখের কথা ভারী মিঠে। এই কদ্দিন ধরে থানায়, পাটি অফিসে ঘোরাঘুরি করে করে ইশকুলটার ফাঁড়া কাটায়ে দিয়েছে।”

    “তা সে তো ভালো কথা গো। বিপদের দিনে বন্ধুতে বন্ধুর করবে না তো করবে কে? সে সব তো বুঝলাম, কিন্তু এইটে কী হল বলো দিকিনি? বন্ধু রইল পরদেশে, তাকে সেখানে রেখি সে এখেনে এখন গান দেয় কেন? কেমনধারা লোক?”

    ভুবন মাথা নাড়ল, “সে আমিও ঠিক বুঝি নাই গো। তবে শুনিছি এ ইশকুলে নাকি ট্যাকা ঢালবে অনেক। ইশকুল বড়ো হবে। নামডাক হবে। সেই নিয়ে এলাকার সব লোকজন জড়ো করি কথা বলবে বলি লোক টানতি গান দিয়েছে বলল সমরেশ। ঘুঘু লোক। থানা আর পাটি অফিস, দুটোকেই হাতে এনে ফেলেছে। নইলে এই ক’দিন ইশকুলে যা চলল, তারপর ফের এমন দিন আসবে ভাবি নাই গো।”

    আসলাম দেখা গেল উত্তরটাতে ঠিক সন্তুষ্ট নয়। ভুবনের মনের মধ্যে বসে থাকা ক্ষীণ সন্দেহটা তার মধ্যেও ছায়াপাত করেছে। খানিক চুপ থেকে মাথা নেড়ে সে বলল, “ভালো হলেই ভালো। আমাদের আর কি? গান গাইলাম একখান, খ্যাঁটনও জুটবে ভালোমত। ওই যথেষ্ট।”

    বলতেবলতেই হাততালির একটা রোল উঠল উঠোন থেকে। ইশকুলের রক্ষাকর্তা, কলকাতার মস্ত চাকুরেটিকে পাশে নিয়ে অমরেশ বাগচি মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছে।

    চাকুরেটির ঝকমকে পোশাক, হাতের দামী আংটি আর কর্তৃত্বসুলভ চালচলন দেখে আসলাম একটু অবাক হয়ে নিজের মনেই বলল, “শোভনবাবুর যে কতো ঠানে কতরকমের বন্ধু গো! নাগাল পাওয়া ভার।”

    অমরেশ বাগচি মাইকটা হাতে নিয়ে হাততালি থামবার জন্য অপেক্ষা করলেন একটু। তারপর বললেন, “বন্ধুগণ, এই সভায় আমার কোন ভুমিকা নাই। শুধু একটি বিশেষ সুসংবাদ দিতে আপনাদের সামনে আমার আসা। এতদঞ্চলের বিশিষ্ট শিক্ষাকর্মী ও সঙ্গীতগবেষক, আমাদের ঘরের ছেলে শ্রী শোভন মণ্ডলকে আজ কিছুকাল ধরে যেভাবে হেনস্তা হতে হচ্ছে তা আপনারা জানেন। কোন্‌ রাজনৈতিক দল এখানে নিজেদের অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনবার জন্য এ চক্রান্ত করেছে তা-ও আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। কিন্তু আমরা তা হতে দিতে পারি না। আমাদের দলের নাম করে কিছু সমাজবিরোধী এই বিদ্যামন্দিরে যে কিছুকাল ধরে উৎপাত চালিয়েছে তা-ও আপনাদের অজানা নয়। ব্যাপারটি আমার গোচরে আসামাত্র আমি তাতে হস্তক্ষেপ করি এবং তা বন্ধ করবার উদ্যোগ নিই। কিন্তু চক্রান্তকারীরা তাতেও থেমে না থেকে কেন্দ্রীয় সরকারী একটি গোয়েন্দাসংস্থার সাহায্য নিয়ে শোভনবাবুকে ফের বিপদে ফেলবার চক্রান্ত চালিয়েছিল। এ অঞ্চলের পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে সে চক্রান্ত ব্যর্থ করতে আমি বদ্ধপরিকর। সে উদ্দেশ্যে সরকারকে যে চিঠিটি আমি পাঠিয়েছি তার কপি আপনাদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়া হবে। আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, পুলিশে ভয়ে ঘরছাড়া শোভন মণ্ডলকে সসম্মানে মুরলীপুরে আমি ফিরিয়ে আনবোই। তার জন্য আমাদের পার্টি প্রয়োজনে কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতে যেতেও পিছপা হবে না।”

    সভার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা একদল মানুষ ঘন ঘন জয়ধ্বনি দিচ্ছিল। ক্রমেই তা সংক্রামিত হচ্ছিল সভা জুড়ে বসে থাকা নিরীহ নির্বিরোধী নিম্নবর্গীয় চাষাভুষো মানুষগুলির মুখেও। স্রোতের মুখে নির্বাধ ভেসে যাওয়াকেই তারা জীবনধারণের একমাত্র উপায় হিসেবে মেনে নিয়ে এসেছে চিরকাল। প্রাচীন ভারত, পরাধীন ভারত হয়ে আধুনিক উন্নত গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে এসে পৌঁছেও তার কোন বদল আসেনি।

    শব্দের ঢেউটা থামবার জন্য একটুক্ষণ অপেক্ষা করলেন অমরেশ বাগচি। তারপর বললেন, “এইবারে আপনাদের সুসংবাদটা দিচ্ছি। আমাদের রাজ্যস্তরীয় নেতা, মাননীয় এম পি শ্রী মৃদুল ঘরাইয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন আলোর দিশারি কেজরিওয়াল এডুকেশান উইং শোভনবাবুর এই হেমলতা বিদ্যামন্দিরের পৃষ্ঠপোষকতা করতে সম্মত হয়েছেন। আজ সংস্থার অন্যতম প্রধান শ্রী উত্তম প্রধান আপনাদের মধ্যে হাজির হয়েছেন তাঁর পরিকল্পনাটি আপনাদের শোনাবার জন্য। আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, একদিন হেমলতা বিদ্যামন্দির এই অঞ্চলের শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন জোয়ার নিয়ে আসবে। ধন্যবাদ।”

    *********

    “কী, চলবে তো?” মাইকের সুইচটা বন্ধ করে দিয়ে উত্তমের পাশে গিয়ে বসে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করলেন অমরেশ বাগচি।

    “থ্যাংক ইউ অমরেশবাবু। থ্যাংক ইউ। যে জমিটা আপনি তৈরি করে দিলেন আজকে তাতে আমাদের সবার লাভ হবে। আমরা সবাই মিলে এবারে--”

    “স্যার আপনার ফোন,” উইং-এর পাশ থেকে তার ফোনটা হাতে ধরে শ্যামলবাবু উত্তমকে ডাকছিলেন। সেদিকে একবার তাকিয়ে ভুরু কুঁচকেই নিজেকে ফের সামলে নিল উত্তম। শ্যামলবাবু তাকে চেনেন। অত্যন্ত জরুরি কোন কল না হলে এ সময়ে তাকে তিনি বিরক্ত করতেন না। উঠে গিয়ে ফোনটা নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে দাঁড়াল উত্তম। কলকাতা থেকে অ্যাডভোকেট সত্যরঞ্জন পালিতের ফোন।

    “বলুন মিস্টার পালিত। ইমপর্ট্যান্ট কিছু?”

    ওপাশ থেকে উকিলটির ভরাট গলা ভেসে এল, “আপনার মিসেসের পাস্ট লাইফ নিয়ে খোঁজখবর যা করতে দিয়েছিলেন তার ফাইল এসে গেছে ‘ইউনিভার্সাল ইনসাইডার্স’ থেকে। মানে ওই শোভন মণ্ডলের সঙ্গে তাঁর পুরোনো যোগাযোগ এবং কন্টিনিউইটি অব রিলেশনশিপ নিয়ে পেপার্স, উইটনেস এটসেটেরার ফাইনাল লট—”

    “বেশ। ফাইলটা রেখে দিন। কাল আমি লোক পাঠিয়ে আনিয়ে নেব। যে যাবে তার হাতেই ইউনিভার্সালের বিলটাও দিয়ে দেবেন।”

    “কিন্তু মিস্টার প্রধান, ফাইলটা আমার কয়েকদিন দরকার হবে যে, মানে কেসটা সাজাবার জন্য আর কি! আগে যে কাগজগুলো আপনি নিয়ে রখেছেন সেগুলোও দরকার হবে। বুঝতেই তো পারছেন ডিভোর্সের কেস। ম্যাডাম নিজে বড় অফিসার। একটু সাবধানে ঘুঁটি না সাজালে—”

    তাঁর কথাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে উত্তম বলল, “না মিস্টার পালিত। ইনিশিয়ালি এ তথ্যগুলো ইউজ করবার প্রয়োজন নেই। ফাইলটা আমি আমার কাছে রাখব। একান্ত প্রয়োজন বুঝলে তখন ওটা ব্যবহার করব আমি। তার আগে নয়।”

    ঝানু উকিলটি একটুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, “অ্যাজ ইউ উইশ। কিন্তু একটা কথা আপনাকে বলে রাখি। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ব্যাংকশালের ফ্যামিলি কোর্টে বেশ কিছু ম্যাট্রিমনির কেস আমি করেছি। আপনাদের মত হাই প্রোফাইল কেসেও সম্ভবত মহামান্য আদালত আমাকেই সে দায়িত্বটা দেবেন। আমার এ কাজে যা অভিজ্ঞতা আছে তার থেকেই বলছি, মোটা অ্যালিমনি দেবার হাত থেকে বাঁচতে গেলে অথবা আপনার ছেলের কাস্টডি পেতে হলে এ ডকুমেন্টস আপনাকে বের করতেই হবে উত্তমবাবু।”

    “সে সিদ্ধান্তটা আপনি আমার ওপরেই ছেড়ে দিন মিস্টার পালিত। আমি বুঝে নেব। গুড ডে।”

    মঞ্চে গান শুরু হয়ে গেছে। কে যেন ইদু বিশ্বাসের জারি ধরেছে

    “ত্রিভূবনের মাঝে আমি দেখি নাই
    এমন ভারী কারখানা
    তার জজ কানা ম্যাজিস্ট্রেট কানা,
    কানা উহার খদগিরি
    আর কানা সদরের দ্বারী—”
    বুকের ভেতরটায় একটা মোচড় দিচ্ছিল উত্তমের। সেখানে এই মুহূর্তে যে তার কী চলছে তা তো কেউ দেখতে পাবে না। কারো সে চোখ নেই। সে চোখ যার থাকবার কথা ছিল, তার বিরুদ্ধেই রণকৌশল তৈরি করতে হচ্ছে এখন তাকে-- আমি তো তোমাকেই চেয়েছি চিরকাল মাদ্রি। যদি না হয়, তাহলে সব ভেঙেচূরে শেষ করে দেব তোমাকে। দরকারে ব্ল্যাকমেল করে—তোমার দেবতা শোভনকে ধ্বংস করে, তোমার ছেলেটাকে—”

    “জরুরি ফোন ছিল মনে হচ্ছে?”

    চমক ভেঙে ঘুরে তাকিয়ে উত্তম দেখল অমরেশ বাগচি কখন এসে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন।

    “হ্যাঁ অমরেশবাবু। পার্সোনাল কল।”

    “কোন প্রবলেম?”

    ফিকে হাসল উত্তম, না না, কোন প্রবলেম নেই। সব ঠিক আছে। কিন্তু আপনি স্টেজ ছেড়ে নেমে এলেন যে?”

    অমরেশ হাসলেন, “আমার কাজ শেষ। আজ রাতেই কলকাতা ফিরব। বাকিটা আপনার ব্যাপার, আপনি বুঝে নিন। আমি ওতে আর কী করব? চলি।”

    মঞ্চে গান শেষ হয়ে গেছে। আনসার নামে ছেলেটা এসে তাকে ডাকছিল, “উত্তমদা চলুন, স্টেজে বসবেন। শ্যামলবাবু এবারে গার্জেনদের অ্যাড্রেস করবেন। আপনাকে স্টেজে থাকতে হবে।”

    ফোনটার সুইচ বন্ধ করে সেটা আনসারের হাতেই ধরিয়ে দিয়ে মঞ্চে গিয়ে বসল উত্তম।

    *********

    রের ভেতর থেকে পরিচিত রিংটোনটা বাজছিল।

    “ শোভনের ফোনের শব্দ না?”

    ফরিদা মাথা নাড়ল, “ওই দেখুন সমাদৃতাদি, আবার বাড়িতে ফোন ফেলে রেখে বেরিয়েছে। দাঁড়ান দেখি আবার কার ফোন এলো—”

    “আপনারা গল্প করুন বৌদি, আমি এনে দিচ্ছি,” বলতে বলতে কৃষ্ণা গিয়ে ফোনটা এনে সমাদৃতার হাতে দিতে তার পর্দার দিকে একঝলক তাকিয়েই সমাদৃতা ফোনটা ফরিদার হাতে দিয়ে দিল।

    পর্দায় উত্তমের নামটা ভাসছিল। ফোন ধরে ফরিদা একটু উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “উত্তমদা—”

    “কে ফরিদা? শোভনকে ফোনটা দেবে একটু? আর্জেন্ট কিছু কথা ছিল ওর সাথে।”

    “সে বেরিয়েছে কোথায় যেন। আপনি আমাকে বলুন, আমি ফিরে এলে বলে দেবো—”

    “তোমাকে—মানে—” একটু ইতস্তত করল উত্তম, তারপর কী মনে হতে বলল, “ভালো, তোমাকেও বলে রাখি ব্যাপারটা। অমরেশ বাগচিকে পালটি খাওয়ানো গেছে। হোম ডিপার্টমেন্টে শোভনের ফেভারে একটা চিঠি পাঠিয়েছি ওকে দিয়ে সই করিয়ে। তার কপি আমি শোভনকে মেল করে দিয়েছি। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো ফরিদা, শোভনের গায়ে কোনো আঁচ লাগতে দেবো না আমি।”

    ফরিদার গলা আটকে আসছিল। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “উত্তমদা-আপনি—”

    “ফরিদা, দিস ইজ ওয়ার। এখন ইমোশন দেখাবার সময় নয়। যা বলছি ঠাণ্ডা মাথায় শোনো।এই পলিটিক্যাল এলিমেন্টগুলো ফোর্সড হতে ভালোবাসে না। শোভনকে এখন এলাকায় পেলে ও অন্যভাবে ঝামেলা পাকাতে পারে। ওর কেসটা এখনো পুরো মেটেনি।”

    “আমায় কী করতে হবে?”

    “বলছি। চিঠিটা দেখবার পর শোভন নিঃসন্দেহে ফিরে আসবার জন্য ছটফট করবে। ওকে আটকাতে হবে তোমায়। কোর্ট কেসের হাত থেকে ওকে পুরো ক্লিয়ার করা আর এই এলাকাটাতে অবস্থা পুরোপুরি কন্ট্রোলে আনতে আমার আরো কিছু সময় লাগবে। ততদিন ও যেন এদিকে আসবার চেষ্টা না করে সেটা তোমাদের দেখতে হবে। ডু হোয়াট ইউ ক্যান।”

    “কিন্তু উত্তমদা, ইশকুলটা নিয়ে ও প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছে কয়েকদিন ধরে। জানেন তো কীরকম ইমোশনালি অ্যাটাচড এ ব্যাপারটার সঙ্গে! এ খবরটা পেলে পরে আরো ব্যস্ত হয়ে উঠে—”

    “ইশকুল নিয়ে ওকে একদম ভাবতে বারণ কোরো ফরিদা। তুমি নিজেও উদ্বিগ্ন থেকো না। এ দিকটা আমি সামলে নিচ্ছি। তোমরা যখন ফিরে আসবে তোমাদের হাতে একটা সুন্দর প্রতিষ্ঠান তুলে দিতে চাই আমি। এখন ছাড়ি। টেক কেয়ার।”

    লাইনটা কেটে গেল। যন্ত্রটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসেছিল ফরিদা। ফোনটা তার হাতে তুলে দিয়ে সমাদৃতা বারান্দা ছেড়ে চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। তার কোলে শিশুটি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। শোভন কোথায়, কখন ফিরবে কে জানে। রাত বাড়ছিল। মাথার মধ্যে সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল তার। উত্তমদা যেভাবে এগিয়ে এসে শোভনের পাশে দাঁড়িয়েছে তাতে তার যতটা ভরসা হবার কথা, ততটা ভরসা কেন মনের ভেতর থেকে পাচ্ছে না ফরিদা? কোথাও একটা বাধছে। তার নারীসুলভ সতর্কতা মনের গভীর থেকে একটা বিপদসংকেত পাঠাচ্ছিল। একটা অজানা, অবয়বহীন ভয়। সমাদৃতার কাছে, খানিকটা শর্মিষ্ঠার কাছেও বিভিন্ন সময়ে উত্তমের যে ছবিটা সে পেয়েছে তার সঙ্গে কেন মিলছে না এই উত্তমের ছবিটা?

    ।। ১৮ ।।

    ফোকলোর রিসার্চ ইনস্টিট্যুটের এই ছোট্ট ঘরটা থেকে দূরে তিস্তা দেখা যায়। নভেম্বরের শেষ। তিস্তা এখন শান্ত। ধূ ধূ বালির চর ফের জেগে উঠেছে। তার মধ্যে দিয়ে ভালমানুষটির মত নীল ধারা নিয়ে সে শুয়ে থাকে রৌদ্রের গালিচায়। শোভনকে একটা কমপিউটার দেয়া হয়েছে এখানে। সেটা ছাড়া একেবারেই সাদামাটা নিরাভরণ ঘর। প্রফেসর সোনারাম দিউই বন্দোবস্তটা করে দিয়েছেন কিছুদিনের জন্য।

    পুজোর পরপরই চার্জশিট ফাইল হতে কেসটার একটা শুনানি পড়েছিল কলকাতায়। এবারে প্রফেসর দিউকে সাক্ষি হিসেবে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন দীপক স্যান্যাল। সেখান থেকে ফেরবার পর সমাদৃতার বাড়িতে একদিন এসে শোভনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন প্রফেসর দিউ। প্রস্তাবটা ছিল, এখন যখন শোভন কিছুদিন এইখানেই রয়েছে তখন চুপচাপ বসে না থেকে সময়টা সে ইচ্ছে করলে কাজে লাগাতে পারে। জায়গার বন্দোবস্ত তিনিই করে দেবেন। বিনিময়ে ইনস্টিটিউটে কিছু ক্লাশ তাকে নিতে হবে ফকিরি গানের ওপরে। বুদ্ধিমান এবং উদ্যোগি মানুষ। শোভনের এইখানে থাকাটাকে যে তিনি ইনস্টিট্যুটের কাজে লাগাতে চাইছেন সে কথাটা লুকোন নি।

    শোভন খুশি হয়েছিল। কয়েকদিন আগে ছত্তিশগঢ়ের ব্যাপারটা নিয়ে প্রফেসর মালহির সঙ্গে তার কিছু কথাবার্তা হয়েছে তখন। প্রফেসর মালহিকে শোভন পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, নিজের স্কুল ও অন্যান্য কাজ ছেড়ে অতদূর গিয়ে ইন সিটু কাজটা করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। প্রফেসর মালহি কোন জোর করেন নি। শুধু বলেছিলেন, “তবু আপনার জন্য অফারটা খোলাই রইল। আপনাকে আমি এই প্রজেক্টটাতে চাই। চলে আসতে পারলে ভালো। না পারলে প্রয়োজনে বাংলা থেকেই পার্টিসিপেট করবেন। শুধু মাঝে মাঝে এদিকে এসে--”

    শোভন আপত্তি জানিয়েছিল, “না স্যার। নিজে ফুলটাইম থেকে কাজ করতে না পারলে টাকা নিতে আমি পারবো না।”

    “ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভেবেছি মিঃ মণ্ডল। মিনিস্ট্রিকে আমি শুধু পাইলটটাই পাঠিয়েছিলাম। মূল প্রজেক্ট প্রোপোজাল এইবারে যাবে। সেখানটাতে আমি গবেষণাটাকে একটু নতুন ডিরেকশান দিতে চাইছি। দণ্ডকারণ্য প্রজেক্টে এই হালবিদের এলাকায় পুব বাংলা থেকে প্রচুর চাষীদের এনে সেটল করানো হয়েছিল তা তো জানেন?”

    “জানি।”

    “তৎকালীন মধ্যপ্রদেশ সরকার এতে যে রাজি হয়েছিল তার পেছনে তাদের একটা ইন্টারেস্ট কাজ করেছিল সেটা জানেন কি?”

    “উঁহু। কীরকম?”

    “মেইনস্ট্রিম আগ্রারিয়ান টেকনিকস ও কালচারকে এই আদিম জনজাতিদের কাছাকাছি নিয়ে এসে তার প্রভাবে তাদেরও কিছু উন্নতি ঘটানো। এককথায় এখানকার ট্রাইবাল পপুলেশনকে মেইনস্ট্রিমের সঙ্গে ইন্টিগ্রেট করাবার একটা উদ্দেশ্যও ছিল সরকারের এই সেটলমেন্টগুলো তৈরি করবার পেছনে। এই পেপারে আমি সে দিকটাকেও ধরব। অর্থাৎ পুব বাংলার যে লক্ষ্মী আরাধনা ও সেই সংক্রান্ত ফোক লিটারেচার, তার কতটা কীভাবে ইনফিউজড হয়েছে হালবিদের লাখি জাগরের গানে সে ব্যাপারটাও ডিটেইলে ধরব। বুঝতেই পারছেন সে কাজটা করতে গেলে বাংলার লক্ষ্মী আরাধনা সংক্রান্ত ফোক কালচারের এলাকাটাতে আপনাকে ছাড়া চলবে না। সে অংশটার জন্য ছত্তিসগঢ়ে এসে থেকে যাওয়াটা আপনার ক্ষেত্রে অপশনাল হয়ে দাঁড়াবে।”

    একটু অস্বস্তি নিয়ে শোভন বলেছিল, “মানে আপনি আমার জন্য—”

    “আরে না না ইয়ংম্যান, কী যে বলেন!” মালহির প্রাণখোলা হাসির শব্দ ভেসে এসেছিল ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে, “সবটাই স্ট্র্যাটেজি। এই অ্যাঙ্গলটা ধরতে পারলে এ কাজটায় সেন্টারের পাশাপাশি এম পি এবং ছত্তিশগঢ়ের স্টেট গভর্নমেন্টের ইন্টারেস্টটাও থাকবে তো। একদিক থেকে এটা দণ্ডক নিয়ে তাদের স্ট্র্যাটেজির ইভ্যালুয়েশানও তো হয়ে দাঁড়াচ্ছে, অন্তত পার্শিয়ালি। ফলে সেখান থেকে প্রচুর কো অপারেশান অ্যারেঞ্জ করে নিতে পারব আমরা। আমি এ ব্যাপারে স্টেট গভমেন্ট অফিশিয়ালদের একটু বাজিয়ে দেখেছি। দে আর কোয়াইট এনথুসিয়াস্টিক।”

    সুযোগটা ছাড়তে মন চাইছিল না শোভনের। বলেছিল, “আমায় একটু সময় দিন স্যার। একটু ভেবে নিই।”

    “সে ভাবুন না! কয়েকদিন সময় নিন। অসুবিধে নেই। আর আরেকটা অনুরোধ রয়েছে মিস্টার মণ্ডল। মানে প্রজেক্টটা আপনি আমার সঙ্গে করুন বা না করুন, একটা হেল্প আপনাকে করে দিতেই হবে।”

    “বলুন।”

    ডিটেইলড প্রোপোজালটার একটা ড্রাফট আমি তৈরি করছি। সেখানে পুব বাংলার কোজাগরী গান সম্বন্ধে আপনি যদি একটা ছোট পেপার তৈরি করে দেন তাহলে প্রোপোজালের টেক্সট তৈরি করতে সেটা আমার কাজে এসে যাবে। আপনার যা নলেজ বেস আছে তাতে কয়েকদিন একটু চেষ্টা করলেই আপনি মোটামুটি একটা লেখা দাঁড় করিয়ে দিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।”

    আর এই সময় খানিকটা কাকতালীয়ভাবেই প্রফেসর দিউ এসে তাকে ফোকলোর রিসার্চ ইনস্টিট্যুটের অফারটা দেন।

    শুনে শোভন একটু ইতস্তত করে বলেছিল, “মানে এটা তো সরকারী এইডেড ইনসটিট্যুট স্যার। আমার নামে কেসটা এখনো-”

    হাত নাড়িয়ে তার কথাটা উড়িয়ে দিয়ে প্রফেসর দিউ বলেছিলেন, “ছাড়ুন তো মশাই। সাক্ষি দিতে গিয়ে দেখে তো এলাম সব। চার্জশিটের কপি দেখে জজসাহেব সেদিন কী বললেন শুনলেন না? তড়িঘড়ি করে বানানো ভুষোমাল। সরকার এখন পিছু হটেছে এই কেসে। যা একজন উকিল দিয়েছেন মিস্টার প্রধান! আর সবচেয়ে ভালো কাজ হয়েছে আপনাদের লোকাল পঞ্চায়েত সমিতি থেকে আসা চিঠিটাতে। দু একমাসের মধ্যেই দেখবেন সব মিটেমুটে গেছে। স্যান্যালসাহেব বলছিলেন, পুলিশ যা চার্জশিট দিয়েছে তাতে আর বড়োজোর একটা হিয়ারিং-এর মামলা। তদ্দিন এখানে যখন থাকতেই হবে তখন--”

    এই একটা ব্যাপারে শোভন হেরে গেছে একেবারে। অমরেশ বাগচিকে দিয়ে লেখানো চিঠিটা দেখবার পর সে মুরলীপুরে ফিরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ফরিদা আপত্তি করেছে ভীষণভাবে। তার একটাই কথা। ওখানে তুমি একা ফিরবে না। ফিরলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরতে হবে। তবে না ফেরবার আসল কারণটা হল উত্তমের কথা। তার যুক্তিটা ভুল নয়। ফরিদা আর দুটো বাচ্চার দায়িত্ব মাথায় নিয়ে এইরকম রিসক নিতে তার নিজেওর মন সায় দিচ্ছিল না। স্কুলের ব্যাপারে উত্তম ভেঙে কিছু বলছে না। প্রসঙ্গ উঠলে শুধু বলে “ওদিকটা আমি দেখছি। তুই নিশ্চিন্ত থাক। যখন ফিরবি তখন তোর হাতে একটা সুস্থ প্রতিষ্ঠান তুলে দিয়ে তবে আমার ছুটি।”

    মধ্যে একবার স্কুল নিয়ে সমরেশকে ফোন করেছিল শোভন। সমরেশ উচ্ছসিত। বলে, “স্কুলটা নিয়ে উত্তমদার টিম যা করছে, সিম্পলি ভাবতে পারবেন না শোভনদা। আমাদের মডেলটা একেবারে ডিটো ফলো করছে। তবে আরো প্রফেশনাল ভাবে। কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অ্যাঙ্গলটাকে এত সুন্দর ধরছে যে ভাবা যায় না। আপনি ফিরে আসুন, তারপর দেখবেন। আমাকে এখানেই ফুল টাইম জব করতে রিকোয়েস্ট করেছে। আপনার অ্যাবসেন্সে স্কুলের ডে টু ডে অ্যাফেয়ার আমিই অ্যাক্টিং প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে চালাবো। বাড়ির ভাত খেয়ে কখনো ভালো মাইনের চাকরি করতে পারবো বলে ভাবিনি শোভনদা--”

    --কমপিউটারের পর্দার দিকে ফের একবার চোখ ফেরাল শোভন। কোজাগরীর ওপরে তার কাজটা সেখানে ভাসছে। ভালোই লাগছে শোভনের। ফের একবার সেদিকে মন দিতে যাবে এমন সময় খানিক দূরে রাখা তার ঝোলাটার মধ্যে ফোন বেজে উঠল ।

    “কে আবার ফোন করল এই সময়ে?” বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে যন্ত্রটা বের করে আনল শোভন। অচেনা নাম্বার। একটু ইতস্তত করে সবুজ বোতামটায় চাপ দিল সে।

    “শোনো, আমি বলছি।”

    শোভন একটু অবাক হয়ে বলল, “এটা কার নম্বর?”

    “একবার এসেই দ্যাখো না কে এসে বসে আছেন! এই যে কথা বলো। দেখো তো চেনো কি না?”

    উল্টোপিঠ থেকে ভেসে আসা গলাটা প্রথমে চিনতে পারেনি শোভন। আর তারপরই তার মনে পড়ে গেল। এ গলা সে ভুলবে কী করে? বলল, “মাসীমা আপনি?”

    সাবিত্রী বর্মনের গলায় কৌতুকের ছোঁয়া ছিল একটু। বললেন, “একবারে চিনতে পারলে না তো! ফরিদা মায়ের সঙ্গে আমার সেই নিয়েই বাজি হয়েছিলো। চলে এলাম তোমাদের দেখতে। আর শুধু দেখতে নয়, সঙ্গে করে বেঁধে নিয়ে যাবো আমার বাড়িতে। একেবারে তৈরি হয়েই এসেছি আজ।”

    হঠাৎ করে, বহুদিন পরে যেন বড় পরিচিত একটা আদরের ডাক কানে এল শোভনের। এই আহ্বানের কাটান নেই। “আসছি মাসীমা। আপনি একটু বসুন,” বলে ফোনটা কেটে দিয়ে তাড়াতাড়ি কমপিউটারটাকে বন্ধ করতে করতেই কলিং বেলের সুইচে হাত দিল সে।

    “কিছু লাগবে স্যার?”

    দরজায় লম্বামতো একজন মানুষ এসে দাঁড়িয়েছেন।

    শোভন মাথা নাড়ল, “না রাজেনদা। ক্লাশে গিয়ে একটু বলে দিও আজ বিকেলের সেশানটা হবে না। বাড়িতে লোক এসে বসে আছে। আমি কাল সকালে একসঙ্গে দুটো সেশান নিয়ে পুষিয়ে দেবো।”

    বাইরে বেরিয়ে এসে একটা রিকশা নিল সে। একটু তাড়াতাড়ি গিয়ে পৌঁছুতে হবে। সাবিত্রী বর্মন যে নিজে থেকে তাদের সঙ্গে দেখা করতে চলে আসবেন তা সে ভাবতে পারে নি।

    *******

    “এই যে দেখো দেখো, এইভাবে জড়িয়ে কোলে ধরে থাকবে, তাহলেই ভয়ে যে কেঁপে কেঁপে ওঠে সেটা আর হবে না দেখবে কক্ষণো। কী যে মেয়ে হয়েছো আজকাল তোমরা! শুধু বই পড়লে চলে?”

    বৃদ্ধার গলায় মমতার ছোঁয়া ছিল। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখল শোভন একবার। জানালা দিয়ে আসা পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ভারী সুন্দর ছবি তৈরি হয়েছে একটা। একটি সুন্দর নকশা করা কাঁথায় শিশুটিকে জড়িয়ে ফরিদার কোলে তুলে দিচ্ছিলেন তিনি।

    তাকে কোলে নিতেনিতেই দরজায় শোভনের দিকে চোখ পড়তে ফরিদা বলল, “এই যে এসে গেছে মাসীমা। আচ্ছা তুমি কেমন মানুষ বলো তো! মাসীমাকে একবার একটু খবরও দেবার দরকার মনে করো নি? কাছেই তো থাকেন বললেন। শেষে আজ কালেক্টরিতে গিয়ে সমাদৃতাদির কাছে সব খোঁজখবর করে নিজেই চলে এসেছেন আমাদের দেখতে। কত কি নিয়ে এসেছেন দ্যাখো সঙ্গে করে।”

    “কাকে কী বলছো তুমি ফরিদা? শোভন জানবে কোত্থেকে? ও ছেলে আছে নিজের দুনিয়া নিয়ে। এসব দুনিয়াদারীর হিসেবকিতেব কি ওর আসে?”

    শোভন লজ্জা পেয়ে বলল, “ না মানে শুনেছিলাম কালেক্টরী ছাড়িয়ে ওদিকে কোথাও—”

    “বাঃ এইতো অনেকটাই জানো। আমি আছি সারদাপল্লী কলোনিতে। একেবারে তিস্তার পাড়ে।”

    “এতা কী দিদু? ভাইয়ের বালিশ? এরকম গুরগুর করছে কেন?”

    সুরভি তাঁর কাছে ঘুরঘুর করতে করতে পাশে রাখা ঝোলাটার থেকে একটা ছোট বালিশ টেনে বের করছিলো।

    “ওটা ধরে না ধন,” বৃদ্ধা তাড়াতাড়ি তার হাত থেকে বালিশটা নিয়ে ফরিদার বিছানার ওপরে রেখে দিলেন। তারপর সুরভির মাথাটিতে একবার হাত বুলিয়ে বললেন, “এটা হল সরষের বালিশ।”

    ফরিদা জিনিসটাকে তুলে ধরে দেখছিল। তার দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধা বললেন, “নড়বড়ে মাথা তো! ওতে মাথা রেখে ঘুম পাড়াবে। দেখবে মাথা কি সুন্দর গোল হয়। ঠিক আমার এই সুন্দর দিদিভাইটার মতো।”

    রূপের প্রশংসায় সুরভি দেখা গেল খুশি হয়েছে। বলে, “আমি বুঝি সুন্দর?”

    তাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বৃদ্ধা স্নেহমাখানো গলায় বললেন, “তুমি হলে গিয়ে সাতসমুদ্দুরপাড়ের পরী। তোমার মতন রূপ কি আর চাঁদেরও হয়? এই যে এইটে তোমার জন্যে এনেছি। দেখো তো পছন্দ হয় কি না?”

    বলতে বলতে ঝোলা থেকে একটি ভারী সুন্দর কাজ করা কাঁথা বের করে তার গায়ে জড়িয়ে দিতে দিতে ফরিদার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঝোলাতে বেশ কটা ছোট ছোট কাঁথা আছে আরো। তোমার এই ছোটোটার জন্যে নিয়ে এলাম। আমারই বানানো ছিল ঘরে। খোকাকে পরিও। ওই দোকানের কেনা তোয়ালে টোয়ালে পরিয়ে রাখলে মা মাসীদের কি মন ভালো থাকে নাকি? নাও ধরো।”

    বেশ কিছুদিন পরে আজ ফরিদার মুখে চোখে সেই পুরোনোদিনের আলোটা ফের এসে পড়ছিল। কাঁথাগুলো বের করে দেখতে দেখতে সে বলল, “কী সুন্দর হাতের কাজ। আসলে আমদের ছোটোবেলা থেকে কেউ কখনো কিছু শেখায় নিতো মাসীমা।”

    তার গায়ে স্নেহমাখানো হাতটি বোলাতে বোলাতে বৃদ্ধা বললেন, “জানি মা। নিজের গল্প এটুকু সময়ে যতটুকু করলে তাতেই বুঝেছি সাধারণ মেয়ে তুমি নও। অনেক পাহাড়পর্বত ডিঙোতে হয়েছে তোমাকে জীবনে। সব শিখে যাবে দেখো। নাও এখন তৈরি হয়ে নাও দেখি--”

    ফরিদা একটু দ্বিধাজড়ানো চোখে শোভনের দিকে তাকিয়ে বলল, “মাসীমা বলছিলেন—মানে—”

    “থামো তো তুমি মা। মাসীর বাড়ি যাবে তার জন্যে পারমিশান নিতে হবে নাকি ওই ছোকরার? যা বলার আমি বলছি,” বলতে বলতে শোভনের দিকে ফিরে বৃদ্ধা বললেন, “বাড়িতে আজ কিছু গানবাজনার আয়োজন করেছি বাবা। তোমাদের নিয়ে যাবো। রাতে একেবারে খেয়েদেয়ে ফিরবে। মেয়েটা কদ্দিন হল একেবারে ঘরবন্দি। তারও একটু মুখবদল হবে।তুমি যেন আপত্তি কোরো না।”

    শোভন একটু ইতস্তত করে বলল, “কিন্তু মাসীমা , বাচ্চাটাকে রেখে—”

    “ওসব তোমায় একদম ভাবতে হবে না। তোমাদের হেডকোয়াটারে কথা বলে ফেলেছি। সমাদৃতা মা বলে দিয়েছে কৃষ্ণা দুতিনঘন্টা বাচ্চা সামলাবে বাড়িতে। সে নিজেও যাবে আমাদের সঙ্গে। অফিস থেকে সঙ্গে করে নিয়ে নেবো যাবার পথে। এখন নাও। মুখহাত ধুয়ে চা টা কিছু খাবে তো খেয়ে তৈরি হয়ে নাও। এই যে সুরভি দিদিভাই। তুমি একটা সুন্দর জামা পরবে আজ। আর তোমার বিল্টুদাদা কোথায়? গিয়ে তাকেও বলো দেখি চটপট তৈরি হয়ে নিক।”

    বুকের ভেতর একটা সুন্দর হাওয়া বইছিল শোভনের। আর কথা না বলে সে ঝোলাটা নামিয়ে রেখে আলমারির মধ্যে থেকে তার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছোট্ট রেকর্ডারটা সঙ্গে নিয়ে বলল, “আমি তৈরি।”

    ******

    ইখানে শহরের হইচই নেই। কালেক্টরি ছাড়িয়ে তিস্তার বাঁধের ওপর দিয়ে বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে এসে নতুন পল্লিটি। একেবারে তিস্তার গা ঘেঁষে। চাঁদের আলোয় পায়ের নীচে বিস্তীর্ণ বালুচরের বুকে তিস্তার ক্ষীণ জলধারা চিকচিক করছিল।

    একলপ্তে বেশ খানিকটা জমি নিয়ে বাড়ি। উঠনের একপাশে ছোট একটি ঘর, একচিলতে বারান্দা। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় উঠোনে বেশ কিছু মানুষের নিঃশব্দ চলাফেরায় একটা আসর ধীরেধীরে রূপ পাচ্ছ।

    ছোট ছোট ছেলেমেয়েদুটো কত সহজে মিশে গেছে উঠোনে জড়ো হওয়া পল্লির শিশুগুলির সঙ্গে। চাঁদের আলোয় তাদের ছুটোছুটি খেলা চলছে।

    সেইদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খানিকটা আপনমনেই বৃদ্ধা বলছিলেন, “ছেলেটা মাদ্রাজ চলে গেল বউবাচ্চা নিয়ে, তারপর একদম একা পড়ে গেছিলাম বুঝলে? শহরবাজারে কে কাকে দেখে। একা একা ওই একচিলতে ঘরের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসত। তখন এই সারদাপল্লীর মুস্তাক এসে বলে আপনি আমাদের কাছে চলে আসেন। ছেলেটাকে বহুদিন ধরে চিনি। অবশ্য আমি একা নই, এ দিগরে গান নিয়ে কাজকর্ম যারা করে, ভাওয়াইয়া গানের ব্যাপারে তারাও সবাই এই কেওট রাজবংশী ছেলেটাকে চেনে। এরা মানুষকে ভালোবাসতে জানে প্রাণ ঢেলে বুঝলে?

    “তা চলে এলাম। এদিকটা জমি এখনো খানিক সস্তা। বিঘেটাক জমি ওরাই বন্দোবস্ত করে দিল। সেই থেকে দিব্যি আছি এদের নিয়ে। প্রায়দিন গানবাজনা হয়, বিশেষ করে এই শীতের দিকটা। কতো গান যে আছে এদের সংগ্রহে— ”

    শোভন চুপ করে শুনছিল। খানিক দূরে ফরিদা আর সমাদৃতা পাশাপাশি বসে নিচু গলায় কিছু কথাবার্তা বলছে। এখান থেকে তার শব্দ পাওয়া যায় না। সেইদিকে চোখ রেখে নিচু গলায় সে বলল, “রত্নখনিতে বসে আছেন মাসীমা-”

    “তা ঠিকই বলেছো। ব্যাপার কি জানো বাবা? সারাটা জীবন তো এই এদের গান নিয়েই কাজ করলাম। কিন্তু কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছিল। ভাবতাম সেইটে কোনোদিন পূরণ হলে এদের নিয়ে পরিপূর্ণ একটা কাজ করা যাবে। একটা নথি বানিয়ে রেখে যাবো ভবিষ্যতের জন্যে। কিন্তু সে ফাঁক আমার কোনদিন পূরণ হয় নি। আজ বুঝি, এতদিন এরা আমাকে ভালোবাসলেও আসলে পর করেই রেখে দিয়েছিল। এই বুড়ো বয়সে এসে যখন অবশেষে এরা আমায় নিজেদের জায়গায় আশ্রয় দিলো, তখন সেই আপনপরের বাধাটা ঘুচে গেছে। আমাকে বড়োমা বলে ডাকে। নিজেদের রান্না করা খাবারের ভাগ দিয়ে যায় এসে। আর এতদিনে এদের আসল গানগুলো আমার সামনে এরা গায়।

    “কিন্তু বাধা যখন ঘুচলো তখন দেখি তাকে তোমাদের ভদ্রসমাজের জন্যে রেকর্ড করে রাখবার ইচ্ছেটাই গেছে শুকিয়ে। বুকের মধ্যে এতদিনে এদের গানটা বসেছে তো, কাগজে আর তাই তাকে ধরবার ইচ্ছেটাই নেই। তোমায় একটা অনুরোধ করি বাবা, কিছু মনে কোরো না। এসেছো যখন প্রাণ ভরে শোনো। কিন্তু তোমার ওই যন্ত্রে এ গান ধোরো না। এ গান বাইরের দুনিয়ার জন্যে নয়।”

    “বড়োমা, চলেন—চলেন গো। আসর তৈয়ার।”

    সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন যিনি তাঁর বয়স হয়েছে। মোটা হাড়ের কাঠামোয় পেশি জড়ানো খেটে খাওয়া চেহারা। কিন্তু, অসংস্কৃত উচ্চারণে ভারী কন্ঠে বলা সাধারণ কথাবার্তার আড়ালে সুরে বাঁধা একটা কন্ঠ যে রয়েছে তাঁর, সে আভাসটি পাওয়া যায় তাঁর কথার চালে।”

    “চলো বাবা। আসরে গিয়ে বসি গে,” উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বৃদ্ধা সমাদৃতাদের দিকে তাকিয়ে ডাক দিলেন, “তোমরা দুই সখীও এসো গো।”

    “যাই মাসীমা,” বলে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সমাদৃতা ডাক দিলো, “বিল্টু, সুরভি-তোমরা-”

    তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বৃদ্ধা বলে উঠলেন, “বাচ্চাদের ভাবনা এখানে ভাবতে হবে না তোমাদের। তারা আর পাঁচটা কুঁচোকাঁচার সঙ্গে মিশে ভালোই থাকবে দেখো। তোমরা মন দিয়ে গান শোনো এখন। ভালো লাগবে দেখো----”

    *******

    --এবং সেই চন্দ্রালোকিত রাত্রি ধীরে ধীরে যুবতী হয়ে ওঠে। ভাওয়া বা উচ্চাবচ জমিতে মহিষের পিঠে আরূঢ় মহিষচারকের গলায় জন্ম নেয়া সঙ্গীতধারার একটি খণ্ড তার চলনের ওঠাপড়ার ঠমকগুলিকে সযত্নে সুরশরীরে ধরে নিয়ে সেই উঠোন থেকে জন্ম নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে তিস্তার উন্মুক্ত চরে--

    মইষ চড়াং মোর মইষাল বন্ধু রে
    বন্ধু কোন বা চড়ের মাঝে
    এলা কেনে ঘন্টি বাজন
    না শোনোং মুই কানে মইষাল রে।

    অদিয়া অদিয়া যান মোর মইষাল রে
    মইষাল দোতরা বাজেয়া
    কোন বা কথায় হইছেন গোসা
    না দেখেন ফিরিয়া মইষাল রে।

    তখনে না কইচং মইষাল রে
    মইষাল না যান গয়ালপাড়া
    গোয়ালপাড়ার চেংড়ীগুলা
    জানে ধুলাপড়া মইষাল রে
    “আহা বড় চমৎকার গানটি শোনালে বাবা। ইটি কে? চিনলাম না তো?”

    হাতের সারিন্দাটি নামিয়ে রেখে গর্বভরা চোখে গায়ক তরুণটির দিকে চাইলেন প্রৌঢ়টি। তারপর বললেন, “হাঁ ঠাকরোন। আমার বড়মেয়ের ঘরের নাতি। জামায়ের আলিপুরদুয়ারে চাকরি। সেইখানেই বাসা। ইশকুলে পড়ে। দাদোর কাছে বেড়াতে এসেছে। এই, ইদিকে আয়, ইদিকে আয়, সালাম কর এনাকে—”

    ছিপছিপে, প্রাণসার চেহারার তরুণটি উঠে এসে সলজ্জে পা ছুঁল সাবিত্রী বর্মণের। তার লাবণ্যময় কিশোর চেহারাটিতে নগরশিক্ষার সামান্য প্রলেপ গ্রাম্য সরলতাটুকুকে এখনো ঢেকে দিতে পারে নি পুরোপুরি।

    খানিক দূরে বসে সেইদিকে চেয়ে দেখছিল শোভন। তার ঠিক সামনে কিছুটা এগিয়ে পাশাপাশি বসে রয়েছে ফরিদা ও সমাদৃতা। চাঁদের আলোয় ধুয়ে দিচ্ছিল তাদের দুজনকে। শিশুগুলিও এতক্ষণ ছোটাছুটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সমাদৃতার কোলে মাথা রেখে বিল্টু ঘুমিয়ে পড়লেও, সুরভির চোখে ঘুম নেই। লোকসঙ্গীতের যে উত্তরাধিকারটুকু তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছিল অতি শৈশবেই তারই আহ্বান তাকে জাগিয়ে রেখেছে সমস্ত ক্লান্তিকে দূরে ঠেলে। নৈশালোকে এই প্রাকৃত সঙ্গীতবাসরে তার জন্মগত অধিকার।

    আসরের মাঝখানে এইবারে এসে বসেছে একটি তরুণী। দোতারা, সারিন্দা, ঝুমকা ও বাঁশিতে নতুন সুর উঠেছে ফের। দ্বিচারী মহিষচালকের স্ত্রী, গোয়ালাপাড়ার যুবতী প্রতিদ্বন্দ্বিনীদের ভয়ে আকুল ছিল। এইবার তার বিলাপটির জবাব দিচ্ছে কোন অনুরক্ত স্বামীর আদুরে স্ত্রী। ভালোবাসার অনুযোগের কথাগুলি ভেসে আসে তার তীক্ষ্ণ সুরে—পুকুরের বাঁধা জলের মতন অবলা নারী সে। তার সব ভালোবাসাকে অবহেলায় দখল করে নেয় তার নির্দয়, কৌশলী স্বামী। ভালোবাসার নিগূঢ় কৌশলে তার মরার চেষ্টাকেও ব্যর্থ করে দেয় সেই পুরুষ--

    মুই হইনি অবলা নারী
    ডিহি বান্ধা জল
    নিদয়া ভাতারটা মোর করেছে যে ছল
    এলা মই কী করং
    নদিহায় ডুবি মরং
    ঝারিয়া নডায় নডায় ছিছরিহ জল
    ডুবারু ভাতারটা মোর করেছে বিফল---
    হঠাৎ সমাদৃতার বুকের ভেতর একটা ধাক্কা দিয়ে জেগে উঠল বহুকাল ধরে ঘুমিয়ে থাকা একটি কিশোরী। যেন গতজন্মের থেকে কয়েকটা কথা ভেসে আসছিল তার কানে—

    --“রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ আর রজনীকান্ত গেয়ে তোর জিভ পলিউটেড হয়ে গেছে মাদ্রি। বাংলার আসল গান তোর দ্বারা আর হবে না।”—কিছুই হল না রে শোভন আমার। ওদিকটাও হল না, আর যেদিকটায় সফল হবই বলে পণ করে নিয়ে সব ছাড়লাম সেখানটাতেও কেবল ফাঁকিই রয়ে গেল একরাশ--

    --নিজের অজান্তেই পেছন ফিরে সমাদৃতার চোখ চলে গেল চাঁদের আলোয় বসে থাকা যুবকটির দিকে—এক বসন্তের দুপুরে ক্লাশরুমের বাইরে ছড়িয়ে থাকা বিস্তীর্ণ ঘাসজমির মধ্যে দিয়ে ইঁটবাঁধানো সরু পথ—সেখান দিয়ে এই গানটা গাইতে গাইতে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যাচ্ছে তরুণটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং-এর দিকে—

    --একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে সংযত করল সে। ফরিদা আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে দেখছে। মুখটা ঘুরিয়ে একটু অপ্রস্তুত হাসি টেনে এনে কিছু একটা বলতে গিয়েছিল সমাদৃতা। কিন্তু তার আগেই ফরিদার একটা হাত এসে তার বাহুমূলে স্পর্শ করল। একান্ত নারীসুলভ প্রবৃত্তিতেই সে হয়ত সে ধরতে পেরেছে এই মেয়েটির মনের ভেতর কোন স্মৃতির আনাগোণার ছবিটিকে। স্পর্শের ভাষায় তাই মুছে নিয়েছে তার ধরা পড়ে যাবার লজ্জাটুকুকে।

    চাঁদের আলোর আবছায়া তাদের মধ্যে ঘটে চলা এই ছোট্ট নাটকটিকে আড়াল দিয়েছিল। একান্তই নিজস্ব শব্দহীন ভাষায় তারা পরস্পরের সঙ্গে আদানপ্রদান করে চলেছিল প্রিয় পুরুষটিকে নিয়ে নানা অনুভুতির খবরাখবর। তাদের থেকে খানিক দূরে বসে থাকা সঙ্গীতমগ্ন পুরুষটি তাদের সে ভাববিনিময়টির কথা খেয়ালও করেনি। সমস্ত ভাবনা, দুর্ভাবনার কথা ভুলে সে তখন মজে রয়েছে তার এই নতুন পাওয়া গানের আসরটিতে।

    তবু, তিস্তা তোর্সার তীব্রস্রোতা ধারাবিধৌত এই ভূমির নিজস্ব সঙ্গীতধারাও একইরকম বেগবতী ও খরস্রোতা। কোন একটি নির্দিষ্ট মনোভাবকে আশ্রয় করে বেশিক্ষণ সে স্থির থাকতে পারে না। আসরের সুর তখন হঠাৎ করেই বদলে গিয়েছে একেবারে। ভারী, ভাঙা ভাঙা গলায় অত্যন্ত ধীর লয়ে একটি চিরচেনা গানকে অপরিচিত ঢঙ ও উচ্চারণ মাখিয়ে বাতাসে ভাসিয়ে চলেছে মুস্তাক। একটু আগের সেই উচ্চগ্রামের চপল, তীক্ষ্ণ গায়কির থেকে একেবারে আলাদা সেই সুরচাল--

    ফান্দ বসাইচে ফান্দি রে ভাই পুটি মাছো দিয়া—,
    ওরে মাছের লোভে বোকা বগা পড়ে উড়া দিয়া রে—
    --উড়িয়া যায় চকোয়াক পংখী বগীক বলে ঠারে
    ওরে তোমার বগা বন্দি হইচে ধল্লা নদীর পাড়ে রে
    এই কথা শুনিয়া বগী দুই পাংখা মেলিল
    ওরে ধল্লা নদীর পাড়ে গিয়া দরশন দিল রে—
    বগাক দেখিয়া বগী কান্দে রে
    বগীক দেখিয়া বগা কান্দে রে—

    “--এ তোমার ফকিরি গানের চেয়ে আলাদা কিছু নয় বাবা,” সাবিত্রী বর্মন নিচু গলায় পাশে বসা শোভনের উদ্দেশ্যে বলছিলেন। ভালো করে শুনে দেখো, এতেও সেই ফকিরি আশুক-মাশুক তত্ত্বের কথাই বলে গো। জীবাত্মা আশুক ফাঁদে পড়ে যখন তখন পরমাত্মা মাশুকের তার জন্যে প্রাণ কাঁদে। মায়ার জালবাঁধনের এপারেওপারে বসে আশুক-মাশুক একে অন্যের জন্যে চোখে জল ফেলে বাবা। এ গানে সেই তত্ত্বকথাই আছে। মাথুরের শ্রীরাধার সঙ্গে এই বগীর কোন তফাৎ নাই গো। এ মাটিতে এসে না বসলে এ গানকে এভাবে তুমি কখনো শুনতে পাবে না--”

    **********

    “আবার এসো কিন্তু বাবা। ভালোমন্দ কিছু তো খাওয়াতে পারলাম না এ যাত্রা। শুধু দুটি ডালভাতই খেয়ে গেলে মাসীর ঘরে। পরে আরেকদিন নাহয়—”

    শোভন হাসল, “হ্যাঁ মাসীমা। আসবো তো বটেই। আপনার হাতে রান্না এমন ডালভাত খেতে আর এমন গান শুনতে পেলে আমি কিন্তু রোজই একবার করে আসতে পারি।”

    “আসবে বাবা। নিশ্চয় আসবে।”

    রাত্রি গভীর হয়েছে। সময়ের নিরীখে অবশ্য মাত্রই নটার ঘর ছাড়িয়েছে ঘড়ির কাঁটা, কিন্তু তিস্তাপাড়ের এই অঞ্চলে সে-ও অনেকটাই রাত। বিস্তীর্ণ বালুচরের ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই করে হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে এদিকওদিক রাতচরা পাখিদের ডাক শোনা যায়।গায়কের দল তাদের আসর গুটিয়ে যার যার ঘরে ফিরে গেছে। দুপুরেই আয়োজন করে রাখা সাদামাটা আহার্যগুলি গরম করে নিয়ে তাদের খাইয়ে দিতে বেশি সময় লাগে নি বৃদ্ধার। ফরিদা ও সমাদৃতা তাঁকে সাহায্য করতে গিয়েছিল। তিনি হেসে তাদের সরিয়ে দিয়ে বলে দিয়েছেন,”নিজের নিজের ঘরে করে খেও গে মা। বুড়ি হলেও এখনো নিজের ছেলেপুলেকে রেঁধেবেড়ে খাওয়াতে আমি একাই যথেষ্ট।”

    সুরভি আর বিল্টুকে আগে খাইয়ে দিয়ে তবে বাকিরা খেতে বসেছিল। খাওয়া হতে বিল্টুর ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল একেবারে। এখন বড়ো বড়ো চোখ মেলে সে চারপাশের আকাশবাতাস দেখছে। রাতের এমন চেহারা এর আগে তার খুব বেশি চোখে পড়েনি। সুরভি অবশ্য আর জেগে থাকতে পারে নি। বড়োরা যখন খেতে বসেছে তখনই সমাদৃতার পাশে এসে বসে তাকে আঁকড়ে ধরে সে শুয়ে পড়েছিল। এখন ঘুমের মধ্যেও সে তাকেই জড়িয়ে রয়েছে। বড় ভালোবেসে ফেলেছে সে তার এই ফর্সামাসীকে। তাকে কোলে করে কাঁধের ওপর সযত্নে তার মাথাটি রেখে সমাদৃতা সাবিত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এবারে একদিন আপনি কিন্তু আমাদের বাড়িতে এসে থাকবেন মাসীমা। শনি-রোববার দেখে আমি নিজে এসে নিয়ে যাবো। শোভনটার কাছে এই একটা ব্যাপারে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। ওর দৌলতে ঘরের কাছে আপনার মতন একজন গুরুজনকে পেয়ে গেলাম।”

    সাবিত্রী একটু লজ্জা পেলেন, “কী যে বলো মা! তোমরা হলে গিয়ে কত লেখাপড়া জানা চাকুরে। আমি এক বুড়ি, গান নিয়ে পড়ে আছি একটেরেয়। কোথায় আমি আর—” বলতে বলতেই হঠাৎ আকাশের দিকে নজর চালিয়ে তিনি বলে উঠলেন, “তবে আর দেরি কোরো না। এইবারে বেরিয়ে পড়ো। বাচ্চাগুলোও ক্লান্ত। ওদিকে ছোটটা যে আবার কৃষ্ণার কাছে থেকে কী করছে কে জানে—”

    ********

    নির্জন পথটিতে মানুষগুলি এগিয়ে চলে। বহমান কালস্রোত ভাসমান কাষ্ঠখণ্ডের মত এই মানুষগুলিকে কাছাকাছি এনে একসঙ্গে করে দিয়েছে এই মুহূর্তে। কাল তাদের কে কার সঙ্গে থাকবে আর কে-ই বা কোথায় ভেসে যাবে কে জানে। সুরভি ঘুমিয়ে আছে সমাদৃতার কোলে। বিল্টু ফরিদার হাত ধরে আগে আগে চলেছে। হাজারো প্রশ্ন তার মুখে। তাদের দুজনের হাসিগল্পে রাতের পথ উচ্চকিত হয়ে উঠছিল বারংবার।

    কাঁধের ব্যাগের মধ্যে ফোনটা থেকে টুংটাং করে শব্দ এল একটা। মেল এসেছে। এখানে রাত মানে এখন ওদেশে কাজের সময়। এ মেলটার জন্য কদিন ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে চলেছে সে। দাঁড়িয়ে পড়ে শোভনের এগিয়ে আসবার জন্য অপেক্ষা করল একটু সমাদৃতা। তারপর তার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, “সুরভিকে একটু ধরবি? আমি একটু মেলটা দেখি। কোত্থেকে এলো—”



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments