• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫০ | ফেব্রুয়ারি ২০১২ | উপন্যাস
    Share
  • যাত্রী: দ্বিতীয় পর্ব (৩) : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য



    || ৭ ||

    সকালের বাতাসে এখনও ঠাণ্ডার ভালো কামড় রয়েছে। মধুকোণ্ডা স্টেশন থেকে গাড়ি ছাড়তে জানালার কাচ নামিয়ে ভালো করে চাদর মুড়ি দিয়ে বসলো শোভন। হাওড়াগামী এই দূরপাল্লার গাড়িটি এই স্টেশনে পৌঁছোবার কথা ছিলো ভোররাত্রের দিকে। বেশ কিছুটা দেরি করে অবশেষে তা এসে পৌঁছেছে সূর্য ওঠবার পরে। শেষরাত থেকে জেগে বসে থাকবার ফলে বেশ ঘুমঘুম পাচ্ছিলো শোভনের। গাড়ির দুলুনিতে চোখ জুড়ে আসছিলো তার। উল্টোদিকের সিটে মুখোমুখি বসে ভুবন গুনগুন করে কি একটা গান গাইছিলো। তার কথাগুলো বোঝা যায় না। কিন্তু সুরটা চেনা।

    হঠাৎ গান থামিয়ে ভুবন ডাকলো, “ছোটো গোঁসাই কি ঘুমায়ে গেলা নাকি?”
    “উঁহু," চোখ বুঁজে থেকেই মাথা নাড়লো শোভন।
    “একখান কথা বলবার ছিলো যে!”

    শোভন চোখ খুলে আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসে বললো, “বলো।”

    “সত্যি কথা বলবো। রাগ করতি পারবা না কিন্তু গোঁসাই।”
    “উঃ! ধানাই পানাই ছেড়ে কথাটা বলে ফেলো তো!”
    “হ্যাঁ। এই বলি। ফরিদারে তুমি বড় বেশি দায়িত্বও দিয়ে ফেলিছো গোঁসাই। কাজটা তোমার ভালো হতেছে না। আগে তাও পেছুটান তোমার একখান ছিলো। ফরিদা মা আসবার পর তো তার মাথায় গোটা ইশকুল, বাড়ি, সবকিছুর বোঝা ফেলে দিয়ে একেবারে হদ্দ ভবঘুরে হয়ে গেছো। গত তিনটে মাস তো একসঙ্গে দু তিন দিনের বেশি বাড়িতে থাকো নাই।“
    “ফরিদা তো খুব ভালোভাবেই সব সামলাচ্ছে ভুবনদা।“
    “সে সামলাতে পারে বলিই তোমার সব দায়দায়িত্ব তার ঘাড়ে ফেলে নিজে ঘুরনচণ্ডী হয়ে পাকসাট খেয়ে বেড়াবে? এ তোমার কেমন বিচার গোঁসাই? সে মেয়ের ঘরে একটা রুগি, অচল বাপ রয়েছে যে! সে খেয়াল তোমার আছে? বেটামানুষ তো নয় যে উদাসী বিবাগী হয়ে নিজেকে বাঁচাবে! এ যে মেয়েমানুষ গো গোঁসাই! মায়ের জাত। এ কূল ও কূল কোনোটাই এ ছাড়তে পারবে না যে! ওর বাপকে নয় বুঝলাম তার আল্লামিঞাঁয় মেরেছে। হাতরথ খুয়ায়ে মেয়ের কাঁধে বোঝা হয়ে বসেছে। কিন্তু তুমি তো আর হাতরথ খোয়াও নাই। তুমি কেন তবে তোমার কান্ধের বোঝা এইভাবে একটা মেয়ের কান্ধে তুলি দিয়ে পালায়ে বেড়াবে? এই যে এতবড় একটা কাণ্ড হয়ে গেল ইশকুলে, মেয়েটা সারারাত একলাএকলা বাড়িছাড়া হয়ে থাকলো, সে সময় তার বাপকে কে দেখেছে? সে মিঞাঁ তো আর এখন গতর নাড়ায়ে জলটাও গড়িয়ে খেতে পারে না।”

    এদিকটা শোভনের মাথায় আসে নি। একটু অপ্রস্তুত গলায় সে বললো, “ না, মানে আমি ঠিক—-”
    “এতদূর ভাবো নাই, তাই তো? তা গোঁসাই, মেয়েটারে একবার মুখের কথাটুকু তো জিজ্ঞেস করতে পারতা ফোনে, যে রাতভর যে ইশকুলে থেকি গেলি, তোর বাপের দেখভালের কী হলো? সেটুকুও তো করতে শুনলাম না! লোকে তো অন্তত কেনা গোলামেরও এইটুকু খবরাখবর নেয়। নিজের আনন্দে এমন মত্ত হয়েছো যে—”
    “এটা ভুবনদা তুমি ঠিক বললে না। কাজটা তো আমিও করছি।”
    “সে তো করছো দেখতেই পাচ্ছি। ফিরে গিয়াই আবার তো তিনদিন বাদে গাইয়ের বায়না দেবার জন্য মালদা দৌড়াবা। সেখান থিকে ফিরে আবার যে কোথায় যাবা সে তুমিই জানো। আর ওদিকে সব কেলাশের রেজাল্ট বেরনো, ভর্তিভার্তার রাজ্যের দৌড়োদৌড়ি ও মেয়ে একলা হাতে সামলাবে।“
    “ঠিক আছে। যাবো না যাও। বসে বসে ইশকুলই সামলাই গিয়ে। মেলা আর করতে হবে না। একা হাতে আর কতদিক সামলাবো!”
    “ওই দ্যাখো। এ তো রাগের কথা হয়ে গেলো গোঁসাই! কাজ পণ্ড করবার কথা তো আমি বলি নাই! আমি শুধু বলিছি, দুদিক সামলায়ে চলতি শেখো। বলি কি, ঘোরাঘুরির কাজ তো আর বেশি বাকি নাই! তুমি এইবারে বরং ইশকুলে থিতু হইয়ে বসো গে! এদিক সেদিক যেটুক যাবার বাকি রইল সে নয় আমি ফাঁকে ফাঁকে গিয়ে ঘুরে আসবো। শুধু ওই সুবল আর আনসার, এই দুটো ছেলে আমায় দিও।”
    “তুমি—“
    “কেন গোঁসাই? গত দুই মাস তো আমায় সঙ্গে নিয়াই ঘুরতিছ। কী মনে হয়? পারবো না?”
    “না তা নয়। মানে আমি বলছিলাম কি--”

    ভুবনের ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি ফুটলো। কৌতুকতরল গলায় সে ছদ্ম অনুযোগ জানায়, “বুঝিছি। নিজের হাতে যারে বানায়েছো, তার কাঁধে দুনিয়ার ভার চাপায়েও নিশ্চিন্দি হতি পারো গোঁসাই; আর তা বাদে অন্যের হাতে এতটুকু কাজ দিতেও তোমার ভরোসা নাই। তুমি গোঁসাই বড়ো পাজি। যাও।”

    তার শীর্ণ হাঁটুতে হাত ছুঁইয়ে যুবকটি বললো, “আমি তা বলতে চাইনি ভুবনদা। আমার শুধু চিন্তা, এ বয়সে তুমি একা একা—”

    তার দিকে শান্ত চোখ তুলে ধরে বৃদ্ধ মানুষটি হাসলেন, “সে আমার কোন অসুবিধা হবে না গোঁসাই। এই খোলাটা বড়ো পুরানো হয়ে গেছে। এমনিতেই তো দুদিন বাদে খসে যাবে। তার আগে এরে দিয়া যেটুক ভালো কম্ম হয়, হোক না! মন্দ কী?”

    খানিক চুপচাপ থেকে শোভন বললো, “সেই ভালো ভুবনদা। তাই করি তবে। ইশকুলের দেখভালটাও হবে, তাছাড়া মেলার এদিককার কাজকম্মও বাকি আছে অনেক, কলকাতাতেও দু এক জায়গায় গিয়ে কথা বলে আসতে হবে। বিডিও অফিস থেকে পারমিশান বের করবার খোঁজখবর নিতে হবে। মেলা কমিটি বানাতে হবে একটা। তার জন্যেও কদিন আমার থাকা দরকার।”
    “কমিটিতে রাখবা কারে কারে?”
    “পুরোপুরি ঠিক করে উঠি নি এখনো। এই ধরো গে যাও, বিরামনগর গার্লসের বড়দি, শোভারাম বয়েজের হেডমাস্টারমশাই, জাগ্রত সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট অমলবাবু, পঞ্চায়েত সমিতির অমরেশ বাগচি, সুধন্য স্যার—”
    “সুধন্য মানে কালীকাপুরের সুধন্য কুণ্ডু ? সে তো কলকাতাতেই পড়ে থাকে হপ্তার মধ্যে সাতদিন। নমাসে ছমাসে বাড়ি আসে কি আসে না। সে তোমার কোন কাজে লাগবে গো?”
    “লাগবে ভুবনদা। অতবড়ো জ্ঞানীগুণী প্রফেসর মানুষ! ফকিরি গানের ইতিহাস লিখেছেন চার খণ্ডে। নিজেও চমৎকার গান।”
    “বলো কী গোঁসাই? এতো দেখি এক্কেবারে সেই নৃসিংগি অবতার। বাইরে নরসিংহ, অন্তরে নারায়ণ! দু একবার যাতায়াতে চোখে পড়েছে। দেখতে তো সাক্ষাৎ যাকে বলে ডাকাতের সদ্দার। কালো পাহাড়ের মত দেহ, ঢুলুঢুলু লাল চোখ। তার পেটে এত গুণ!”

    অবাক হয়ে নিজের মনেই মাথা নাড়েন বৃদ্ধ। তারপর হঠাৎ কী একটা খেয়াল পড়তে বলেন, “তোমার কমিটিতে একটা জায়গা খালি মিলবে গোঁসাই? তাহলে একজনের নামে সুপারিশ দিতাম।”
    “বলো।”
    “বলছিলাম, আমাদের নতুন বিডিও সাহেবকেও তোমার দলে নিয়ে নাও না!”
    “ও বাবা, আবার সরকারী সাহেবসুবো কেন গো? কাজের বেলায় বিসমিল্লা, ওদিকে ছড়ি ঘুরোবার সাঁই একেকজন। ওসব অফিসারটফিসার আমাদের কোন কাজে লাগবে গো ভুবনদা?”
    “কাজ অকাজের কথা জানিনা গোঁসাই। ঘুরেফিরে ভিক্ষেসিক্ষে করে বেড়াই! লোকমুখে শুনলাম নতুন বিডিও লোক ভালো। মাস তিন হল বদলি হয়ে এসেছে দিনাজপুর থেকে! নাকি ধম্মপথে চলে। কুচবিহারে বাড়ি। নিজে ভালো চটকা, ভাওয়াইয়া গায়। বয়েসও তোমাদের আশেপাশে হবে। তাই ভাবছিলাম, তোমার সঙ্গে হয়তো জমতো ভালো!”

    ঝমঝম করে একটি সরু জলধারার ওপরে ধাতব সেতু পার হয়েই হঠাৎ গতি কমে এলো গাড়ির। জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি মেরে দেখে নিয়ে শোভন বললো, “বান্ধারী এলো মনে হয়। চলো ভুবনদা। প্ল্যাটফর্মে নামি। চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।”

    ******************


    বেলা বাড়ছিল। ফরিদা একবার কব্জি উলটে ঘড়িটা দেখে নিলো। দশটা দশ। দূরে ছড়িয়ে থাকা মাঠের ওপর ধূ ধূ রোদ উঠেছে। তার তাপটা আন্দাজ করা গেলেও এইখান থেকে সেটা অনুভব করা যায় না। ইশকুলবাড়ির উঠোন জুড়ে অনেক বড়ো বড়ো গাছ মিলে বিরাট একটা মণ্ডপের মত সবুজ ছাউনি দিয়ে রেখেছে মাথার ওপরে। তার আড়ালে রোদের তাত পৌঁছোয় না। এদের মধ্যে বেশির ভাগই আমগাছ। জাম, জামরুলও আছে। ফরিদার সেই আছাড় খাওয়ার জারুল গাছটাও রয়েছে। মধ্যে একদিন ফরিদা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বৃক্ষবরণ উৎসব করলো; সেদিন সবাই মিলে গাছগুলোর সুন্দর সুন্দর নাম রাখা হয়েছে। ছোট ছোট টিনের টুকরো কেটে সেইসব নাম তাদের গায়ে লটকেও দেয়া হয়েছে। যেমন এই যে জামগাছটার নিচে ফরিদা এখন বসে আছে জলচৌকি নিয়ে তার নাম জামিলা খাতুন। সামনে খানিকদূরে দেখা যাচ্ছে তৈমুর লং-কে। ওটা ল্যাংড়া আমের গাছ। ফরিদাকে ঘিরে উঠোন জুড়ে পাতা চাটাইয়ের ওপর ছেলেমেয়েদের দল এসে জড়ো হচ্ছিল আস্তে আস্তে।


    “দিদি শুরু করো না?”

    ফরিদা একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল। মোটামুটি সবাই এসে গেছে। উঠোন ভর্তি একরাশ রঙিন ফুলের মতো ফুটে আছে ছেলেমেয়েগুলো। গুনগুন শব্দ উঠছে তার চারপাশ থেকে।

    “হ্যাঁ, এই বলি। গত সপ্তাহে কোন অবধি হয়েছিলো? কে বলতে পারে?”

    একরাশ হাত উপরে উঠেছে। উদগ্রীব মুখগুলি প্রত্যেকেই তার নজর টানতে চায়। তাদের মাঝখানে বসা গোলাপি ফ্রক পরা একটি কিশোরীর দিকে ইশারা করে ফরিদা বলল, “অ্যাই সুরি--অ্যাই--ওই যে গোলাপি জামা, ক্লাস ফাইভ, তুই বল দেখি--”
    “অই যে, জরতকারু মুনি দ্যাখে গত্তের মাঝে গাছের শিকড় ধরে বুড়োমানুষেরা ঝুলছে আর ইঁদুরে শিকড় কাটছে। তারপর কী হল?”

    কোলাহল স্তিমিত হয়ে এসেছে। কৌতুহলী মুখগুলি তার দিকে চেয়ে আছে চারপাশ থেকে, এর পরে কী হল? গল্পের সুতোটা ফের তুলে নিল ফরিদা। এবং এক আশ্চর্য জাদুদণ্ডের স্পর্শে সুদূর অতীতের পটভূমিতে গড়ে তোলা পাপ ও পুণ্যের এক রহস্যঘন দ্বন্দ্বের কল্পকাহিনী যেন নিতান্তই সত্য হয়ে নেমে এল একবিংশ শতাব্দির এক রৌদ্র ঝলমল সকালে--


    ক্লাস টেনের ক্লাসঘরের বারান্দা থেকে, বাইরে থেকে ইশকুলের ভেতরদিকে ঢুকে আসা গলিটা পরিষ্কার দেখা যায়। ওদিকটা থেকে একটা গুঞ্জন উঠল হঠাৎ। ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে উঠে দাঁড়াচ্ছে। গল্প থামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফরিদা দেখে শোভন এসে ঢুকছে। গায়ের গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবিটা ঘামে লেপ্টে আছে। উশকো খুশকো চুল দাড়িভরা মুখে একগাল হাসি। কৌতুকভরা চোখ নিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে এসে আসরের একেবারে মাঝখানে এসে দাঁড়াল সে। তারপর চারদিকে একবার চোখ চালিয়ে নিয়ে একটু অবাক গলায় বলল, “এ কী? রোববারে এত ভিড় যে! বসে বসে গুলতানি চলছে, কাজকম্মো কিছু নেই নাকি?”



    উত্তরটা এল ফরিদার কাছ থেকে। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “কাজকম্মো সব হবে, সব হবে। আগে গল্পটা শেষ হোক। এক কাজ করো শোভনদা, তুমিও বসে পড়ো সবার সঙ্গে। আজ আমরা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞের গল্প বলছি।”
    “গল্প? দারুণ! কে বলছে? তুই?”
    “হ্যাঁ, আমি। শোন—” বলতে বলতেই অধৈর্য হয়ে ওঠা শ্রোতাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে গল্পের সুতোটা ফের তুলে নিল ফরিদা। বাসুকির বোন জরৎকারুর সঙ্গে বিয়ে হল জরৎকারু সাধুর। ছেলে হল তাদের। নাম আস্তিক। বাসুকি বলল, এই ছেলে একদিন সাপজাতির প্রাণ বাঁচাবে। তারপর তক্ষক সাপের ছোবলে প্রাণ হারালো অর্জুনের নাতি পরীক্ষিত। পরীক্ষিতের ছেলে জনমেজয় সাপদের সবংশে ধ্বংস করবার জন্য শুরু করলেন সর্পযজ্ঞ। মন্ত্রের টানে তক্ষক যখন সাপেদের মৃতদেহ ভরা অগ্নিকুণ্ডের দিকে ছুটে আসছে আকাশ বেয়ে তখন যজ্ঞস্থলে ঢুকে এলেন তরুণ আস্তিক। হাত তুলে মৃত্যুপথযাত্রী তক্ষককে বললেন ‘তিষ্ঠ’। মন্ত্রের টান এড়িয়ে মাঝ আকাশে থেমে গেল তক্ষক। তখন রাজার দিকে ঘুরে আস্তিক দান চাইলেন, সাপেদের প্রাণভিক্ষা। বেঁচে গেল বাকি সর্পজাতি। তারপর ঋষিরা জনমেজয়কে বললেন, অকারণে জীবজন্তু মারলে ভীষণ পাপ হয়। কী করলে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে? ঋষিরা বললেন, তোমার পূর্বপুরুষ পাণ্ডব আর কৌরবদের গল্প শোন রাজা। কে শোনাবেন সে গল্প? স্থির হল জনমেজয়েরই পূর্বপুরুষ ব্যাসদেব সে গল্প শোনাবেন তাকে। শুরু হল আঠারো পর্বের মহাভারতের গল্প।

    গল্প থামিয়ে এদিক ওদিক চাইল একবার ফরিদা। পেছন দিকে ক্লাস ফাইভের দলের থেকে ছোট্ট একটা হাত উঠেছে। সেইদিকে চেয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, “সেলিম, তুই কিছু বলবি?”
    “বাবা যে বাজারে রোজ মুরগি মারে দিদি? তাহলে বাবার তো--“ কথাটা শেষ হয়না তার। মৃদু ফোঁপানির শব্দ ওঠে। উঁচু ক্লাশের অপেক্ষাকৃত বড়দের দলগুলো থেকে মৃদু হাসির গুঞ্জন উঠেছে ততক্ষণে। পাপপুণ্যের ব্যাপারে তাদের ধারণা বদলাতে শুরু করেছে অনেকদিন হল। ক্লাস নাইনের দল থেকে হঠাৎ একটা ছেলে উঠে দাঁড়াল। তারপর বড় বড় পায়ে এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নিল সেলিমকে।

    সেই দিকে তাকিয়ে শোভন বলল, “কাঞ্চন না?”
    “হ্যাঁ শোভনদা। গতসপ্তাহে নতুন ক্লাস ফাইভের মেন্টরশিপ ডিস্ট্রিবিউট করে দিয়েছি। সেলিমের চার্জ পেয়েছে কাঞ্চন।”
    “বুঝলাম। কিন্তু সাবধান। এই কাঞ্চনটা কিন্তু ভারি শয়তান আর জেদি। এই সেদিন অবধি যা জ্বালিয়েছে আমায়, ভাবতে পারবি না। অতবড়ো নিয়মভাঙা ছেলে আশ্রমে আর দুটি নেই। সবাই আমায় শোভনদাদা তুমি করে বলে। ওই ডাকটা এখানকার ইউনিভার্সাল রুল। এমনকি, তুইওতো এই ফিরে আসবার পর দিন দুয়েক আমায় আপনি আজ্ঞে করে তারপর বকুনি খেয়ে তুমিতে নেমেছিস। আর ও ছেলে আমায় ভুগিয়েছে আশ্রমে ঢোকার পর পাক্কা তিনটে মাস। আমায় শোভন তুই করে বলতো। হাজার বকুনিতেও কাজ হয়নি। তারপর নিজের যেদিন ইচ্ছে হলো সেদিন থেকে শুধরেছে।”

    ফরিদা হাসল, “কী যে বলো শোভনদা। কাঞ্চন খুব ভালো ছেলে। অন্তত আমার কথা তো বেশ মেনেই চলে দেখছি। ওই শোনো--” ফরিদার ইঙ্গিতে কান খাড়া করলো শোভন। কাঞ্চন তখন ফোঁপাতে থাকা ছেলেটাকে প্রবোধ দিচ্ছে কোলে জড়িয়ে নিয়ে, “কাঁদে না ভাই। শোন, শোন। কাকা মুরগি মারে সে তো লোকের খাওয়ার জন্য। ওতে দোষ নাই, দোষ হয় অকারণে জীবহত্যা করলে, ফড়িঙের পিছনে সুতো বেঁধে দিলে, কিংবা ধর গে গুলতি ছুঁড়ে চড়াই মারলে। খাবার জন্য মুরগি মারলে পাপ কেন হবে?”

    বলতে বলতেই হঠাৎ কান্নার শব্দ ফোঁপানির সীমা ছাড়িয়ে জোরদার হয়ে উঠল। জড়িত গলায় যে কথাগুলো ভেসে আসছিল তার থেকে বোঝা যায় ছেলেটি কয়েকদিন আগে একটা বেড়ালছানাকে খেলাচ্ছলে জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। এইবারে সেই পাপের শাস্তির ভয় হয়েছে তার। চিন্তা হয়েছে মৃত্যুর দূতেরা তাকে নিশ্চয় দোজখ-এ টেনে নিয়ে যাবে এইবারে। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কাঞ্চন বলছিল, “তাতে ভয় কী? জনমেজয়ের পাপ তো মহাভারত শুনে চলে গেল ভাই। ফরিদাদিদিও তো আমাদের এরপর মহাভারত শোনাবে। ফি রোববার বসে বসে শুনিস, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে--”

    হাতের ঘড়ির দিকে একবার চোখ ফেলে দেখেই জলচৌকি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বারকয়েক হাততালি দিল ফরিদা। তারপর উঁচু গলায় হাঁক দিয়ে বললো, “গল্প শেষ। যার যার কাজে যা সব! ওঠ,ওঠ--”

    শোভন হঠাৎ খেয়াল করলো, গলার আওয়াজে একটা নতুন কর্তৃত্বের ছোঁয়া এসেছে ফরিদার। ছেলেমেয়েগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত বিনাপ্রশ্নে তার আদেশকে মেনে নিয়ে, আসর ভেঙে যার যার কাজে লেগে যাচ্ছে এইবারে। গাছের পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে রোদের কুচি এসে পড়ছিল ফরিদার চুলে, তার সাদা শাড়িতে। নিজের অজান্তে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ ফরিদার বাচনভঙ্গী আর শরীরিভাষা খুব পরিচিত ঠেকল শোভনের। যেন হেমলতা দিদিমনি ফিরে এসে দাঁড়িয়ে আছেন তার সামনে! হুবহু সেই দাঁড়াবার ভঙ্গী। সেই তর্জনি তুলে শরীর একটু সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে হাঁক দেয়া। মনের গভীরে তার রোল মডেলের যে ছবি ও শরীরিভাষার স্মৃতি লুকিয়ে রেখেছিল মেয়েটা, আজ শিক্ষকতার পেশায় এসে নিজের অজ্ঞাতেই সেই শরীরিভাষা তার বের হয়ে আসছে। বাইরের হৈ চৈ আর কানে ঢুকছিল না শোভনের। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল তার। হেমলতা সরকারের সেই শেষ কথাগুলো বারবার ফিরে আসছিলো তার কানে-- “ভেবেই রেখেছিলাম,তোমার সঙ্গে গিয়ে জুটবো--"

    “ছাত্র তো সন্তানবৎ দিদিমনি! সন্তানের মধ্যে দিয়েই তো বেঁচে থাকেন তার জন্মদাত্রী মা! আপনিও মারা যান নি দিদি! শেষ ইচ্ছেটাও অপূর্ণ থাকেনি আপনার। ওই দেখুন, সামনে—”
    “সেই থেকে কী এত বিড়বিড় করছো বলো তো শোভনদা?” ফরিদা হাসছিলো তার দিকে ঘুরে। শোভন তাড়াতাড়ি একটু হেসে মুখটা ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। চোখের কোনদুটো ভিজে উঠেছে তার।


    উঁচু ক্লাশের ছেলেমেয়েদের একটা দল লেগে গেছে ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কারের কাজে, আরও দু’তিনটি ছোট ছোট দল ঘুরে ঘুরে পরিষ্কার করে চলেছে ক্লাসঘরগুলো, মেয়েরা নিকিয়ে তুলছে উঠোনটি আর ঘরগুলির ভিৎ। একপাশে গান শেখার আসর বসিয়েছে টুয়েলভের প্রাণতোষ আর রমা। সেখান থেকে সুরে-বেসুরে বিচিত্র এক কোরাসে জেগে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের গান-–
    “খরবায়ু বয় বেগে
    চারিদিক ছায় মেঘে
    ওগো নেয়ে নাওখানি বাইও”
    গাছতলায় তখন শুধু তারা দুজন। উঠোনজোড়া এলোমেলো ছড়ানো চটের ওপর হাত পা ছড়িয়ে বসেছিল শোভন। মাঝে মাঝে ঝাঁকড়া চুলের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে নিচ্ছে। তার চোখ আকাশের দিকে আটকানো।

    জামিলা খাতুনের নীচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফরিদা বেশ একটুক্ষণ তাকিয়ে দেখল তার দিকে। তারপর মাথা নেড়ে নিচু গলায় বললো, “বাব্বা! কী চেহারা হয়েছে! ক’দিন স্নান করেননি বলুন তো?”
    “আর স্নান। পথে ঘাটে সে-সব অত জোটে নাকি? তবে হ্যাঁ, এ-যাত্রা খুব ভালো কাজ হল। অনন্ত বাউরির গোটা দলটাই আসবে বলেছে। ডিগলি থেকে। ঝুমুর আর টুসু গাইবে দু রাত। সে যা গান শুনলাম, বুঝলি--
    ” “উঁহু। এখন আমি কিছু বুঝব না। আগে ঘরে যাও। স্নান সেরে নাও। খিদে পেলে মুড়ি বাতাসা রাখা আছে। বললে এনে দেবে।”
    “মুড়ি নয়রে। দুটো ভাতের জন্য ভেতরটা একেবারে টা টা করছে।”
    “এখন নয়। ভাতের ঘন্টা দুয়েক দেরি আছে।”
    “দুপুরে খাবার জন্য কজন আছে আজ?”
    “স্টুডেন্ট দশজন। তার সঙ্গে আপনি, আর আমিও ভাবছি এখান থেকেই একেবারে খেয়েদেয়ে বেরোব। নইলে অবেলায় বাড়ি পৌঁছে খেয়ে শরীর বড় আইঢাই করে।”
    “রান্না কোন বাড়িতে হচ্ছে রে আজ?”

    ফরিদা ভারি বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ল, “ওই এক বিশ্রী ব্যাপার। এর বাড়ি ওর বাড়ি থেকে খাবার রান্না হয়ে আসবে কেন? রান্না এখানেই হচ্ছে। মেয়েগুলোর ওতে একটা ট্রেনিং-ও তো হয়। তিনটে করে মেয়ের টিম বানিয়ে দিয়েছি ইলেভেন টুয়েলভ থেকে। প্রত্যেক টিম এক হপ্তা করে রান্নার ক্লাশ করবে। তোমাদের বাড়ির রান্নাঘরটা ওদের ক্লাশরুম। সোম থেকে শনি সন্ধেবেলা, আর রোববার দুপুরে। আমি নিজেই ইনস্ট্রাক্টরের চার্জ নিয়েছি। রান্নাটা আমি--” বলতে বলতে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,“এখন উঠে ঘরে যাও তো! আমার হাতের কাজগুলো চটপট সেরে ফেলি এই ফাঁকে।”

    শোভন উঠতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ সদর দরজার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে ফরিদা বলে উঠলো, “ললিত! আয়, আয়। দেরি হল যে!”

    নবাগত তরুণটি লম্বা লম্বা পায়ে ভেতরে এসে কাঁধের বিরাট ঝোলা ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রেখে ফরিদার পাশের জলচৌকিটাতে বসে পড়ে বলল, “রোববারের সকালের গেদে লোকালটা যে বাতিল থাকে সেটা খেয়াল ছিল না। শেষে কৃষ্ণনগর সিটি ধরে ওদিক দিয়ে এসে বাসে আসছি। প্রথম দিনেই লেট।” বলতে বলতে শোভনের দিকে ঘুরে তার পায়ে হাত ছুঁইয়ে সে বললো, “শোভনদা, ভালো আছো?”

    শোভন অবাক হয়ে ললিতের মুখের দিকে চেয়েছিল। খানিক বাদে বলল, “তুই--কোত্থেকে এসে উদয় হলি বল তো? সেভেন থেকে এইটে উঠে কোরবা না কোথায় মামার বাড়ি চলে গিয়েছিলি না?”

    ললিত হেসে বলল, “গেছিলাম তো। বছর দুয়েক হল মামার সঙ্গে ফিরে এসেছি। মামা কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছে। সোদপুরে বাড়ি কিনেছে। বাবাও ওখানে উঠে গেছে এখানকার পাট গুটিয়ে। গতবার বঙ্গবাসী থেকে বিএটা কমপ্লিট করলাম। এবারে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ চান্স পেয়ে গেছি জানো শোভনদা। ওখানেই কমার্শিয়াল আর্টে ডিপ্লোমা কোর্স করছি একটা।”



    ফরিদা হাসছিল। বলে, “তুমি তো আর কারো কোন খোঁজখবর বিশেষ রাখো না, কিন্তু আমি যে ওর মেন্টর ছিলাম সেটা ভুলি কেমন করে? বকুনির সঙ্গে সঙ্গে কোলেও চেপেছে অনেকদিন। আমার সঙ্গে কন্ট্যাক্টটা ওর ছিলই। সেদিন ফোনে কথা বলতে বলতে প্রোপোজাল দিলাম সপ্তাহে একদিন যদি বাচ্চাদের আঁকা শিখিয়ে যায়। এককথায় রাজি হয়ে গেল। আর এখন তো দেখছোই। সশরীরে হাজির। হ্যাঁ রে, জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিস কিছু?”
    “হ্যাঁ, এই যে নাও,” বলতে বলতে ব্যাগ খুলে সে বের করে আনল কিছু সস্তার ড্রইং খাতার গোছা, রং পেনসিল ও ক্রেয়নের বাণ্ডিল।

    “কত লেগেছে রে?”
    “সস্তায় পেয়ে গেছি ফরিদাদি। বড়বাজারে আমার এক বন্ধুর দোকান আছে। কেনা দামে দিয়ে দিয়েছে। ও পয়সা তোমাদের দিতে হবে না। ওটা আমার কন্ট্রিবিউশান। আমি স্কলারশিপ পাই জানো তো? মাসে একবার করে সাপ্লাই দিয়ে যাবো রেগুলারলি।”
    “তাহলে তো হয়েই গেল। এইবার লেগে পড়।” বলতে বলতেই পাশে এসে দাঁড়ানো একটি কিশোরকে দেখিয়ে ফরিদা বলল, “এই হল তরুণ। ইলেভেনের ছেলে। আর্টস গ্রুপ। তরুণদের বাড়িতে পট আঁকা হয় জানিস? ওরা পুরুষানুক্রমে পটুয়া। তোর ছবির ক্লাশে ও হবে কো-অর্ডিনেটর।”

    ললিত কৌতুহলী চোখে তরুণকে দেখছিল। এইবার এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বলল, “চৌকো না জড়ানো, কেমন পট আঁকা হয় রে তোদের বাড়িতে?”
    “চৌকো পট। আগে কাপড়ে আঁকতো। এখন কাগজে এঁকে কাপড়ে সেঁটে দেয়।”
    “কে কে আঁকে বাড়িতে?”
    “বাবা আঁকে। জ্যাঠা জেঠিও আঁকে।”
    “তুই আঁকিস না?”

    মাথা নীচু করে দুপাশে ঘাড় নাড়ালো ছেলেটি। তারপর বলল, “না। মা মারে।”
    “মারে? কেন?”
    “বলে ছবি আঁকলে খেতি পাবি না। পড়াশুনা করগা যা।”

    স্মিত হাসিতে ভরে ওঠে ললিতের মুখটি। সে ফের প্রশ্ন করে, “পড়াশোনা করতে তোর ভালো লাগে না?”
    “লাগে।”
    “আর ছবি আঁকতে?”

    কিশোরটির চোখদুটি একবার ঝলসে উঠেই ফের স্তিমিত হয়ে গেল। সেই চকিত উদ্ভাস ফরিদার দৃষ্টি এড়ায়নি। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে তরুণকে ললিতের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, “এটাকে তুই তোর চ্যালা বানিয়ে নে ললিত। পার্টস আছে ছেলেটার মধ্যে। তোর ক্লাসেও সাহায্য করবে। কারা কারা ক্লাসে বসবে তার লিস্ট করেছিস তো তরুণ? দেখা দেখি।”

    তরু্ণ নামের কিশোরটি পকেট থেকে একটা কাগজের ভাঁজ করা টুকরো বের করে এনে এগিয়ে দিল ফরিদার দিকে। তালিকাটায় একবার চোখ বুলিয়ে ফরিদা আপন মনেই বলল, “একুশজন?” তারপর একটু অবাক চোখে তরুণের দিকে ফিরে বলল, “তুই টেস্ট করে দেখেছিস?”

    তরুণ মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ দিদি। কমবেশি সবকটারই হাতের দাগ ভালো। দু একটা তো নিজে নিজেই বেশ ভালো আঁকে। ফাইলে সব নমুনাগুলো রাখা আছে। তুমি দেখে নেবে একবার?”

    কী একটা ভেবে নিয়ে মাথা নাড়ল ফরিদা, “না থাক। দরকার নেই। তোকে দায়িত্বটা দিয়েছি যখন, ডিসিশানটাও তুইই নিবি। আমি মধ্যে থেকে নিজের মাথা ভারি করতে যাবো কেন?”

    বলতে বলতেই হঠাৎ শোভনের দিকে চোখ পড়তে ছদ্ম কোপে চোখদুটি বড় বড় করে সে বলে ওঠে, “এই যে। এখনো এইখানে বসে যে! যাও, আগে ফ্রেশ হয়ে এসো। তারপর বিশ্রাম নেবে দুপুরটা।”

    তরুণকে নিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে যাওয়া ললিতের দিকে চোখ আটকে রেখেই শোভন হাসল, “বিশ্রাম মানে? কতো কাজ পড়ে আছে জানিস?”
    “জানি। কিন্তু যত কাজই থাক, আজকে তোমার ছুটি। স্নান করে মুড়িটুড়ি খেয়ে নিয়ে চাইলে একটু ঘুমোতেও পারো। খাবার সময় ডেকে তুলবো। নাও, এখন চলো দেখি! আমি উঠবো। আমার স্টুডেন্টরা রান্নাঘরে এসে গেছে এতক্ষণে।”

    শোভন অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ফরিদার দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “গত প্রায় তিনটে হপ্তা আমি বাইরে বাইরে ছিলাম, তার মধ্যে এত কিছু বদলে ফেলেছিস তুই?”

    ঠোঁট টিপে হাসল ফরিদা। তারপর গলা নিচু করে বলল, “কিচ্ছু বদলাইনি শোভনদা। শুধু তুমি যেমনটা চাও সেইরকমটা একটু ভালোভাবে করবার চেষ্টা করছি। রোববারটা সবাই এসে এইখানে কাটাক, ইশকুলের বইয়ের বাইরে আর পাঁচটা জিনিস শিখুক এই তো চাইতে তুমি। কিন্তু বেশি ছেলেমেয়ে কখনো আসতো না। আমার নিজের ব্যাচে অনেককেই আড়ালে বলতে শুনেছি, ‘রবিবারেও বকাঝকা, গাধার খাটুনি? ও আমার দ্বারা হবে না। আমি বাবা রোববারের কেলাশে আসছি না।’ তাই রোববারটা সকালে একটা রিক্রিয়েশান সেশান জুড়ে দিলাম। তাতে গল্প বলা হবে, গান হবে, আঁকার ক্লাশ হবে। তিন হপ্তা ধরে চালু করে দিয়েছি। রেজাল্ট তো দেখতেই পাচ্ছো। ফুল প্রেজেন্স। তুমি খুশি তো?”

    শোভন মাথা নেড়ে বললো, “হ্যাঁ, খুশি। খুব খাটছিস বোঝা যাচ্ছে। তবে, নিজের দিকে খেয়াল রাখছিস তো? বাবা কেমন আছেন?”

    হঠাৎ কথা থামিয়ে তার মুখের দিকে ভুরু তুলে অবাক চোখে তাকালো ফরিদা।

    “কী হলো? প্রশ্নটা শুনে অবাক হলি মনে হচ্ছে?”
    “কথাটা কে শিখিয়ে দিলো বলো তো শোভনদা?”
    “মানে?”
    “মানে মাসকয়েক হয়ে গেলো এ ইশকুলে আছি, কোনদিন তো নিজের মিশন ছাড়া কারো পার্সোনাল সুখদুঃখ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছো বলে দেখিনি। ও তোমার স্বভাবে নেই। তা আজ হঠাৎ একেবারে দু-দুটো পার্সোনাল প্রশ্ন করে বসলে কিনা! তাই একটু অবাক হয়েছি।”

    ফরিদার ঘন কালো চোখদুটো তার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা অবধি পড়ে নিচ্ছিল যেন তার। একটু অস্বস্তিভরা গলায় শোভন বলল, “আমার প্রশ্নদুটোর উত্তর দিলি না কিন্তু। মানে আমি বলছিলাম, শরীর, পরিবার এইসব ঠিকঠাক না থাকলে কাজটাও তো ভালোভাবে--”
    “করা যাবে না, তাইতো?” পাদপূরণ করলো ফরিদা। তারপর ঠোঁট টিপে হেসে বললো, “বুঝলাম। লেটেস্ট হিউম্যান ম্যানেজমেন্ট টেকনিক! এমপ্লয়িকে খুশ ঔর তনদুরস্ত রাখা, যাতে সে আরো বেশি আউটপুট দেয়! নাথিং পার্সোনাল অ্যাবাউট ইট। যাক বাবা, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। তুমি বদলাও নি।”

    শোভন অস্বস্তিভরা গলায় বললো, “না মানে আমি ওসব কোন কিছু ভেবে বলিনি। আমি--”

    হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে তার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে ফরিদা নীচু গলায় বললো, “ব্যাখ্যা দিতে হবে না। আমি ভালো আছি। এখন যাও। বিশ্রাম নিতে চাইলে নাও। নইলে যা প্রাণে চায় করো গে। আমি যাই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করলে আমার চলবে না।”

    হাতের আঙুলগুলো তার নীরবে কিছু বলতে চাইছিলো যেন। এক অনুচ্চকিত অভিযোগের কথা। এ ভাষা সে আগেও শুনেছে। বহুকাল আগে এক গানের আসরে—এক চন্দ্রালোকিত উঠোনের পাশে--আর একটি হাত এইভাবে তার হাত ধরে অভিযোগ করে গিয়েছিল তার নামে--কিন্তু সে তো উজ্জ্বলগৌরী ছিলো। কত কালের কথা! যেন গতজন্মের বলে মনে হয়। আজ এত বছর পরে এই শ্যামলা মেয়েটার হাতের আঙুল কেন তাকে সেই একই ভাষায় অভিযোগের কথা শোনায়! কোথায় ত্রুটি হল তার! কেন এমন হয়!

    সেদিন সেই উজ্জ্বলগৌরী মেয়ে উপযাচিকা হয়ে এসে তার দরজা ধরে দাঁড়িয়েছিলো, নিজেকে বিলিয়ে দেবার প্রার্থনা নিয়ে। বিনিময়ে শোভনকে শুধু তার স্বপ্নটা ছাড়তে হত। শোভন তার স্বপ্নকে ছাড়েনি। আজ এত বছর পরে মেয়েটা আবার এসে তার দরজায় দাঁড়িয়েছে, এইবারে তার নিজের হাতের সৃষ্টি, তার স্বপ্নের পুত্তলির রূপ নিয়ে। তার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তার স্বপ্নটাকে নিজের স্বপ্ন বানিয়ে নিয়েছে বিনাপ্রশ্নে। এইবার কোথায় পালাবে সে? কোন আদর্শের দুর্গে গিয়ে লুকোবে? এক সর্বনাশা উথালপাথালের অভিঘাতে বুকের ভেতরটা কাঁপছিল তার।

    “শোভনদা! কী হল?”

    চমক ভেঙে ফিরে তাকালো শোভন। তারপর মাথা নেড়ে বললো, “কিছু হয় নি। তুই তোর কাজ কর ফরিদা। আমি গিয়ে একটু সাফসুতরো হয়ে নি।”

    || ৮ ||

    স্লিপে নিজের নামটা লিখে, সাক্ষাতকারের কারণ-এর জায়গাটাতে এসে একটু থমকে দাঁড়াল শোভন। তারপর একটু ভেবে নিয়ে খসখস করে লিখে দিল, “একটি লোকসঙ্গীত মেলার আয়োজনসংক্রান্ত।”

    কাগজটা হাতে নিয়ে চশমার ওপর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে টাইপিস্ট ভদ্রলোক বললেন, “দিচ্ছেন পাঠাচ্ছি। কিন্তু বিডিও সাহেব আজকে খুব বিজি আছেন সেটা কিন্তু আগেই বলে রাখছি। দিন দুই টুরে থেকে আজকে ফিরেছেন। টেবিলে ফাইলের পাহাড়। তার ওপর আধঘন্টাটাক বাদে পঞ্চায়েত সমিতির অমরেশ বাগচির আসবার কথা আছে। বাগচিবাবু একবার ঢুকে পড়লে তো সেদিনের মতো হয়ে গেল। তা, কী বলেন, স্লিপ পাঠাবো আজ, নাকি কালকে একবার সক্কাল সক্কাল এসে ট্রাই করে দেখবেন?”

    শোভন মাথা নাড়লো, “নাঃ। কালকে আবার আমি ব্যস্ত হয়ে যাবো যে। আপনি বরং আজকেই একবার স্লিপটা পাঠিয়ে দেখুন। যদি রাজি হয়ে যান, তাহলে আমার একটু সুবিধে হয়ে যায় আর কি!”
    “ঠিক আছে, পাঠাচ্ছি। আপনারা না মশাই একেবারে ইমপ্র্যাক্টিক্যাল লোকজন। কাজকম্মের সময় এসে গানফান নিয়ে ঝুলোঝুলি--” গজগজ করতে করতে স্লিপটা হাতে নিয়ে সুইং ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলেন ভদ্রলোক। মিনিটখানেক পরেই বের হয়ে এসে বলেন, “যান। সাহেব ডেকেছেন।” তারপরেই হঠাৎ কটমট করে তাকিয়ে বলেন, “সাহেবকে আপনি চেনেন সে কথাটা বলে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যেতো। শুধুমুদু নাটক করে কাগজ লিখে আমায় দৌড় করাবার দরকারটা কী ছিল মশায়?”
    “আপনি বোধ হয় কিছু একটা ভুল করছেন দাদা,” শোভন মাথা নাড়লো, “ব্রতীন সেনকে চেনা দুরস্থান ওনার নামটাও আগে শুনিনি কখনো।”

    টাইপিস্ট ভদ্রলোক মুখ বাঁকিয়ে বললেন, “আপনি উত্তমকুমার না প্রসেনজিত, যে চেনা না থাকলেও সাহেব আপনার নাম শুনেই লাফ দিয়ে উঠে বলবে, ‘শোভনদা এসেছেন। শিগগীর পাঠিয়ে দাও!’ ওই দেখুন লাল আলোও জ্বলে গেছে। তার মানে আপনার সঙ্গে কথাবার্তা হবে যখন তখন বাইরের লোকের সেখানে ঢোকা মানা। আর আপনি বলছেন চেনেন না! যান মশাই। ছোট চাকরি করি বলে আমার সঙ্গে রসিকতা হচ্ছে?”

    ব্রতীন সেন-এর ঘরটা একেবারেই শ্রীহীন। দেয়ালে রঙ পড়েনি বহুকাল। জানালার পর্দায় অনেকদিনের অযত্নের ধুলো। সবুজ বনাতে ঢাকা একটা বড়োসড়ো টেবিলের পেছনে বসে কাজ করছিলেন ভদ্রলোক। শোভন দরজা ঠেলে ঢুকতেই মুখ তুলে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ফোনটা তুলে বললেন, “দাসবাবু, দুটো চা পাঠিয়ে দেবেন। গ্লাসে না দেয় যেন। কাপডিশে দিতে বলবেন। আর, এখন আমি না বলা পর্যন্ত আর কোন ভিজিটর অ্যালাও করবেন না। --কী?—না। স্লিপও নয়।”

    ফোনটা রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে বের হয়ে এলেন ভদ্রলোক। বছর ত্রিশ-বত্রিশ বয়স হবে বড়জোর। সুন্দর ফরসা, নাগরিক চেহারা। চশমার ফ্রেম থেকে পায়ের জুতো অবধি প্রতিটি উপকরণে সুরুচির ছাপ।

    শোভন দু হাত জড়ো করে বললো, “নমস্কার স্যার। আমি--”
    “নমস্কার। আপনি মুরলীপুরের শোভন মণ্ডল। আপনাকে আমি ভালো করে চিনি। এতটাই চিনি যে রাস্তায় দেখলেও চিনে ফেলতাম। আপনি আমায় স্যার বলবেন না।”

    শোভন ভালো করে ব্রতীনের দিকে দেখলো একবার। নাঃ, এ ছেলেটিকে কখনো দেখেনি সে। কৌতুহলী গলায় বললো, “কিন্তু কোন সূত্রে আমায় চেনেন বলুন তো?”

    “সার্ভিসে আমার চেয়ে কিছু সিনিয়র কাপল আছেন একটি। আপনি বোধ হয় তাঁদের চিনবেন। উত্তমদা আর--”
    “—সমাদৃতা,” প্রায় ফিসফিস করে পাদপূরণ করলো শোভন।
    “হ্যাঁ। সমাদৃতাদি। আমি যখন প্রবেশনার হিসেবে মালদা গিয়ে জয়েন করলাম, ওনারা তখন সবে ব্লক থেকে উঠে ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টারে এসে জয়েন করেছেন। একই হাউজিং-এ থাকতাম। পাশাপাশি কোয়ার্টার। ওঁদের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিলো। এখনও রেগুলার যোগাযোগ আছে। উত্তমদা-সমাদৃতাদির মুখে আপনার অনেক গল্প শুনেছি দাদা। বিশেষ করে সমাদৃতাদির মুখে। মুরলীপুর ব্লক অফিসের থ্রু দিয়ে আপনার মোটামুটি সব খবরই রাখতেন সমাদৃতাদি তখন। আপনার হেমলতা বিদ্যামন্দির চালু হবার খবর পেয়ে আমাদের মিষ্টি খাইয়েছিলেন ডেকে।”
    “কোথায় পোস্টিং এখন ওদের?”

    ব্রতীন মাথা নাড়লো, “পোস্টিং বলতে--সমাদৃতাদি জলপাইগুড়ি সদরে আছেন। আর উত্তমদা তো অনেকদিন হলো ডবলু বি সি এস ছেড়ে দিয়ে কেজরিওয়াল কনসালট্যান্ট গ্রুপ-এ জয়েন করে কলকাতায় চলে গিয়েছেন।”

    একটা অজানা আশংকা দানা বাঁধছিলো শোভনের মনের ভেতর। একটুক্ষণ থেমে থেকে বললো, “ওরা--ওরা ভালো আছে তো?”

    ব্রতীন মাথা নাড়লো, “না দাদা। ভালো নেই। সমাদৃতাদি একেবারে মাটির মানুষ। কাজ ছাড়া কিছু বুঝতেন না। অনেস্ট, এফিশিয়েন্ট অফিসার হিসেবে খুব নাম ছিলো। আমরা যখন নতুন নতুন প্রবেশনার হয়ে পোস্টিং-এ গেলাম, আমাদের নিয়ে বসতেন নিয়মিত। বলতেন, এটা জাস্ট আর একটা চাকরি নয়। সিভিল সার্ভিসটা একটা মিশন। সরকারি শক্তি ব্যবহার করে মানুষের ভালো করবার একটা সুযোগ। কাজেও করে দেখিয়েছেন বহুবার। অন্তত দুটো জেলার উইমেন’স ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টে ওঁর বিরাট কনট্রিবিউশান আছে। কিন্তু উত্তমদাকে চিরকালই একটু হাই প্রোফাইল টাইপ দেখেছি। গ্রাউণ্ড লেভেলে নেমে কাজে বিশেষ উৎসাহ ছিলো না। কিন্তু পাবলিক রিলেশনটা ভালো বুঝতেন। আমাদের অ্যাসসিয়েশনের পাণ্ডা ছিলেন। ফলে কেউ কিছু বলতে সাহস পেত না। তাছাড়া কানাঘুষোয় ওঁর নামে নানা বদনাম শোনা যেত। শুরুতে ব্যাপারটায় আমরাও গুরুত্ব দিই নি। কিন্তু তারপর, বছর দুয়েক আগে, ওঁরা যখন একসঙ্গে কলকাতায় পোস্টেড, তখন উত্তমদার এগেন্সটে একটা ভিজিল্যান্স কেস এলো। উত্তমদা তখন ইণ্ডাস্ট্রি মিনিস্ট্রিতে ডেপুটি সেক্রেটারি। ওমপ্রকাশ কেজরিওয়ালকে বেআইনি ভাবে একটা মাল্টি-ক্রোর রোড বিল্ডিং কনট্র্যাক্ট পাইয়ে দিয়েছিলেন নাকি। তার জন্য মোটা টাকাও নিয়েছিলেন। গোড়ায় সমাদৃতাদি বিশ্বাস করে নি। কথায় কথায় অনেকবার বলেছে আমাদের, ‘হি হ্যাজ বিন ফ্রেমড।’ কিন্তু তারপর চার্জশিট ফাইল হতে যখন দেখা গেল উত্তমদার এগেইন্সটে কেজরিওয়ালের সঙ্গে কনাইভ্যান্সের অনেকগুলো ট্যাঞ্জিবল এভিডেন্স রয়েছে তখন থেকে সমাদৃতাদি কেমন যেন হয়ে গেলেন। উত্তমদা অবশ্য বেজায় স্মার্ট লোক। সটান গিয়ে উঠেছেন কেজরিওয়াল-এ। ইভন চাকরিতে ইস্তফা পর্যন্ত দেননি ভদ্রলোক। ভালো প্যাকেজ পেয়ে গেছেন কেজরিওয়ালের কাছে। কোম্পানির গভর্নমেন্ট বিজনেস উইং-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট। হিল্লিদিল্লি হংকং সিঙ্গাপুর করে বেড়াচ্ছেন কলকাতা বেস করে। উত্তমদার প্রাইভেটে জয়েন করবার পর মাসচারেক সমাদৃতাদি কলকাতায় ছিলেন। তারপর ট্রান্সফার নিয়ে জলপাইগুড়ি শিফট করে গেছেন ছেলেকে নিয়ে।”

    বুকের ভেতর একটা বিপুল ভাঙচূর চলছিল শোভনের। এমনটা তো হবার কথা ছিল না! ওদের তো সুখে থাকবার কথা। যা অর্জন করতে চেয়েছিল দু’জনে তার কিছুই তো ফাঁকি পড়েনি। তাহলে কেন এমন হয়? কেন মেলেনা হিসেবগুলো?

    ব্রতীন তখনও তার কথা বলে চলেছে, “আমি এই ব্লকে পোস্টিং পেতে সমাদৃতাদি কদিন আগে ফোন করে বললেন, “শোভনের সঙ্গে আলাপ করে নিস। তুই লোকগান ভালোবাসিস এত, তোর সঙ্গে কমপ্যাটিবল হবে দেখিস। এসে ইস্তক ভাবছিলাম একবার যাবো আপনার ইশকুলে, তা আজ আপনি নিজেই এসে গেলেন।“
    “সমাদৃতার একটাই ছেলে?”
    “হ্যাঁ। বিল্টু। ভীষণ মিষ্টি ছেলে। আমার খুব ন্যাওটা ছিলো। এইবারে ক্লাস টু-তে উঠবে,”
    বলতে বলতেই প্রসঙ্গ পালটে ব্রতীন কাজের কথায় এল, “তা দাদা, বলুন এবার। মেলাটা ঠিক কীরকম ফর্মাটে করতে চাইছেন?”

    জোর করে নিজের মনোযোগকে কাজের দিকে ফিরিয়ে আনল শোভন, “হ্যাঁ ব্রতীন। খুব ইন্টারেস্টিং প্রোজেক্ট এটা, বুঝলে? পিওরলি ফোকসং এর মেলা হবে। তিরিশটার ওপরে মেজর সংগীত ধারা রয়েছে বাংলায়। মাইনর ব্রাঞ্চের তো শেষ নেই। প্রতি বছর কার্তিক মাসে তিন দিনের মেলায় যতগুলো করে সম্ভব এইসব ধারার এক্সপোনেন্টদের জোগাড় করে এনে মেলা। লোকজন শুনবে। গায়কেরা একটা পাবলিক মঞ্চ পাবে। গানগুলোও ছড়াবে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর লাইভ রেকর্ডিংএর বন্দোবস্ত করে অর্কাইভিংএর কাজটাও চালু করা হবে। তুমি তো শুনেছি নিজে ভালো চটকা গাও। এই দিকে ন্যাক রয়েছে। তুমি কী বলো?”
    “প্ল্যান হিসেবে তো খুব ভালো? স্পনসর পাওয়া গেছে?”
    “স্পনসর--না,মানে--”
    “স্পনসরের ব্যবস্থা কিছু ভাবেননি এখনো? মেলার খরচ উঠবে কোত্থেকে? আপনি পকেট থেকে দেবেন নাকি? খরচের এস্টিমেট কিছু করেছেন?”
    “হ্যাঁ সেটা মোটামুটি একটা বানিয়ে নিয়েছি। দাঁড়াও--”

    কাঁধের ঝোলাব্যাগ থেকে হাঁটকে একটা ছোট নোটবুক বের করে তার মাঝামাঝি বরাবর খুলে ধরে ব্রতীনের দিকে বাড়িয়ে ধরল শোভন।

    নোটবুকটার পাতা উল্টেপাল্টে খানিকক্ষণ দেখে নিয়ে মাথা নাড়ল ব্রতীন। তারপর বলল, “নাঃ। হবেনা শোভনদা। এভাবে এস্টিমেট হয়? চারটে স্টেজ হবে আর জেনসেট ধরেছেন একটা। তিনরাত এতগুলো লোক আসবে যাবে, তাদের অ্যাকোমোডেশান, ফুডিং সে সব তো ধরেনই নি কিছু।”

    শোভন ঢোক গিলে ফিকে গলায় বলল, “না মানে এদিকটা ঠিক এক্সপেরিয়েন্স নেই তো! ভালো হল তোমার কাছে এসে। তুমি কি কমার্স লাইনের লোক?”
    “খানিকটা। সি এ করছিলাম। চাকরিটা পেয়ে যেতে ছেড়েছুড়ে চলে এসেছি।”
    “ব্রতীন, তোমার কাছে এসেছিলাম মেলার পরিচালন কমিটির অনারারি প্রেসিডেন্ট হবার অনুরোধ নিয়ে। এলাকার কুড়িটা গ্রামের দণ্ডমুণ্ডের সরকারি মালিক হল তোমার চেয়ারটা। এই সাম্মানিক পোস্টটা বাই ডিফল্ট তোমার কাছেই যাবার কথা বটে। কিন্তু এইবারে তার সঙ্গে আরো একটা ফেভার চাইছি। সাম্মানিক পোস্টের বাইরে একটা হাতেকলমে কাজের দায়িত্বও তোমাকে নিতে হবে। মেলার বাজেট ও অ্যাকাউন্টসের দিকটার দায়িত্বও তুমি নাও। নেবে?”

    মধ্যযৌবনে এসে দাঁড়ানো মানুষটার চুলদাড়িছাওয়া মুখে তার জ্বলজ্বলে দুটি তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল। তার ছোঁয়াচ এড়ানো যায়না। ব্রতীন কিছুটা অবাক হয়েই খেয়াল করল সে কখন যেন একদিকে ঘাড় হেলিয়ে দিয়েছে।

    মাথার পেছনের ঘড়িতে ঢং করে বেলা একটা বাজবার শব্দ উঠতে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো শোভন। তাড়াতাড়ি টেবিলের ওপর রেখে যাওয়া চায়ের পাত্রটাকে একচুমুকে শেষ করে খালি পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। তারপর নামিয়ে রাখা ঝোলাব্যাগটা কাঁধে তুলতে তুলতে বলল, “এই রে! দেরি করে ফেললাম। বিরামনগর গার্লস ইশকুলে যেতে হবে যে একবার! বড় দিদিমনি সাড়ে বারোটায় টাইম দিয়ে রেখেছেন।”
    “যাবেন কীসে?” জিজ্ঞেস করতে করতেই উঠে দাঁড়ালো ব্রতীন। তারপর বলল, “আমার জিপসি পৌঁছে দিয়ে আসবে’খন। আসুন,” বলতে বলতেই দরজার দিকে মুখ করে উঁচু গলায় হাঁক দিল সে, “অ্যাই, শিশিরবাবু, গাড়ির চাবিটা, নিয়ে--”

    তাকে থামিয়ে দিয়ে শোভন তাড়াতাড়ি বলল, “আরে না না। গাড়িটাড়ি দিয়ে কী হবে। আমার সঙ্গে সাইকেল আছে। তাতেই চলে যাব। এবারে বলো, কবে বসবে? কাজ এখন অবধি যা যা এগিয়েছে সেসব তোমাকে একবার দেখিয়ে নিতে চাই।”

    ব্রতীন একটুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “কাল দুপুরে যদি দুটো নাগাদ গিয়ে উঠি তাহলে প্রবলেম আছে কোন?”
    “চলে এসো। দুপুরে আমার ওখানেই খেয়েও নিও তবে।”
    “না দাদা। আমি খেয়েই আসবো। ও নিয়ে আপনাকে ব্যস্ত হতে হবেনা। আর সঙ্গে যদি আমার স্ত্রী শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে আসি আপনার আপত্তি হবে না তো?”
    “না, না, আপত্তি কেন হবে? তবে, একটা গ্রাম্য স্কুল বইতো কিছু নয়। উনি বোর হবেন না তো?”
    “উহুঁ। বোর হবেনা। আসলে সে নিজেই যেতে চাইছিল ক’দিন ধরে আপনার ওখানে। মাদ্রিদির সঙ্গে খুব ভাব আছে শর্মিষ্ঠার। ওর কাছে আপনাকে নিয়ে অনেক কথাবার্তা শুনে শুনে আপনার ব্যাপারে ও হাইলি ইম্প্রেসড। এসপেশিয়ালি আপনার ইশকুলের ব্যাপারে। নিজে অংকের গ্র্যাজুয়েট। বিয়ের আগে একটা ইশকুলে মাস কয় পড়িয়েও ছিলো। তাই ইশকুলের নামে ওর একটা ইন্টারেস্ট সবসময়েই থাকে।”

    ততক্ষণে সাইকেলে উঠে বসেছে শোভন। পেডালে পা রেখে বললো, “তাহলে তো নিশ্চয় নিয়ে আসবে। ফরিদা নামে আমার এক ছাত্রী এখন ওখানে সবকিছু দেখাশোনা করে। ভালো মেয়ে। পল সায়েন্সে মাস্টার্স করবার পর জে এন ইউ-এর ফেলোশিপ ছেড়ে আমাদের হেমলতায় ফিরে এসেছে পড়াবে বলে। আমরা যখন কাজে বসবো তখন সে-ই শর্মিষ্ঠাকে সব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখিয়ে দেবে’খন।”
    “তাহলে তো কথাই নেই। যাবো তাহলে কাল,” অফিসবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত তুললো একবার ব্রতীন।

    সামনে ঝুঁকে পেডালে চাপ দিয়ে সাইকেলটাকে দৌড় করানো শুরু করলো শোভন। শেষ আষাঢ়ের মেঘলা দুপুরে হু হু করে ভেজা হাওয়া ছাড়ছিলো। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছে। সাদা সাদা ভরহীন জলকণাগুলি কুয়াশার মতো ঝরে পড়ে চলমান সাইকেলে বসা যুবকটির এলোমেলো হাওয়ায় ওড়া চুলদাড়িতে, তার পরনের পাঞ্জাবিতে। সেইদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ না করে আপনমনে প্যাডেল করে চলেছিল শোভন। আজ সমাদৃতার মুখটা বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ভালো নেই সে। বুকের ভেতর বসে কে যেন অভিযোগের একটা আঙুল বারবার বাড়িয়ে ধরছিলো তার দিকে। কিন্তু—সে কেন দায়ী হবে? যা যা চেয়েছিলো জীবনে তার সবই তো পেয়েছিল মাদ্রি! কিন্তু, উত্তমটা যে এমন করবে—
    “আরে কানা নাকি মশায়? একবার রাস্তার মধ্যে দিয়ে, একবার ধার দিয়ে সাইকেল নাচিয়ে নাচিয়ে ইশকুলফেরতা মেয়েদের খেলা দেখাচ্ছেন নাকি? আমায় তো প্রায় ধাক্কা মেরে ফেলেই দিচ্ছিলেন আর একটু হলে--” নিজের সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বয়স্ক মানুষটি রাগি গলায় চিৎকার করছিলেন। শোভন চমকে উঠে তাড়াতাড়ি সামলে নিল নিজেকে। ঝাঁক ঝাঁক ইশকুলের পোশাক পরা কিশোরী চলেছে রাস্তা দিয়ে। শনিবার বলে হাফছুটি আজকে। খানিকদূরে বিরামনগর গার্লস স্কুলের মেন গেটটা দেখা যাচ্ছিল। শোভন মাটিতে নেমে এসে রাস্তার একপাশ ধরে সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল ইশকুলের দিকে।

    || ৯ ||

    “শোভনদা, এই শোভনদা।”

    শোভন ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো। বুকের ওপর থেকে বইটা একপাশে খসে পড়েছে কখন যেন। দেয়ালে টাঙানো ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে বিকেল পৌনে তিনটে। তাড়াতাড়ি উঠে বসে ফতুয়াটা গায়ে গলাতে গলাতেই সে উত্তর দিল,“কে ফরিদা? দাঁড়া আসছি।”
    “এই দেখুন, কারা এসেছেন আপনার কাছে!”



    বারান্দায় বের হয়ে শোভন দেখল, ফরিদার পেছনে ব্রতীন তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসে ব্রতীনের হাত ধরে শোভন বললো, “এসো এসো।” তারপর তার সঙ্গের তরুণীটির দিকে ঘুরে বললো, “আপনি নিশ্চয় শর্মিষ্ঠা। চিনে আসতে অসুবিধে হয় নি তো?”

    মেয়েটি মাথা নেড়ে বললো, “উঁহু। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই ফরিদাকে পেয়ে গেলাম।”
    “তুই আবার ওদের কোথায় পেলি?” শোভন কৌতুহলী চোখে ফরিদার দিকে তাকাতে সে বললো, “ললিতকে বাসে তুলে দিতে গিয়েছিলাম। ফেরবার সময় দেখি গলিতে ঢোকবার মুখে একটা সাদা জিপসি এসে দাঁড়ালো। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শর্মিষ্ঠাদি ইশকুলের রাস্তা জিজ্ঞাসা করছিলেন। সাথে করে নিয়ে চলে এলাম।”
    “তুই ওদের চিনতিস?” শোভন একটু অবাক হচ্ছিল।
    “চিনতে অসুবিধে কি? তুমিই তো বলেছিলে আজ ওঁদের আসবার কথা বিকেলবেলা,” বলতে বলতে ব্রতীনদের দিকে ফিরে ফরিদা বললো, “আপনারা ভেতরে এসে জিরিয়ে নিন একটু বরং। যা ঠা ঠা রোদ দিয়েছে আজ!”

    ব্রতীন মাথা নাড়লো, “কষ্ট আবার কী? গাড়িতে বসে বসে চলে এলাম। আমি বরং একটু ঘুরে ঘুরে দেখি চারদিকটা। আপত্তি নেই তো শোভনদা? ”

    শোভন হাসলো, “সেই ভালো। চলো তোমায় ঘুরে দেখাই। অবশ্য দেখবার মতো বিশেষ কিছু নেই এখানে--”

    তার পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে গোটা চত্বরটা দেখছিলো ব্রতীন। কথা খুব কম বলে ছেলেটা। তাদের পেছনে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে ফরিদার সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলতে বলতে আসছে শর্মিষ্ঠা। বয়সে ফরিদার চেয়ে কিছু বড়ো। সামাজিক অবস্থানেও দুস্তর ফারাক রয়েছে। কিন্তু তবুও কত সহজেই মিশে গেছে দুজনে। বহুকালের পরিচিত দুই বন্ধুর মতই গল্প করতে করতে ঘুরছে।

    পেছনবাড়ির উঠোনে পৌঁছে গাছের নীচে পেতে রাখা কয়েকটা চেয়ারের দুখানা টেনে নিয়ে ব্রতীনকে নিয়ে বসলো শোভন। সামনে একটা নিচু টেবিলে একটা মোটা ফোল্ডার রাখা। অন্য চেয়ারগুলোর দিকে দেখিয়ে ব্রতীন জিজ্ঞাসা করলো, “এতগুলো চেয়ার রেখেছেন যে? আরো অনেকে আসবে বুঝি?”
    “হ্যাঁ। আমার পুরো টিমটাকেই খবর দিয়েছি। গোটা দশেক ভলান্টিয়ার পেয়েছি, বুঝলে? ভালো ছেলে প্রত্যেকেই। বিভিন্ন লোকাল প্রফেশনে রয়েছে। ওদের নিয়ে কোর টিম গড়েছি একটা। এখুনি এসে পড়বে সব। আমার এক বৃদ্ধ বন্ধু আছেন। তাঁর নাম ভুবন বৈরাগি। তিনিও আসবেন। চারটে নাগাদ সবাইকে আসতে বলেছি। ততক্ষণ তুমি এই ফোল্ডারটা দেখতে থাকো। কিছু প্রশ্ন থাকলে করতে পারো।”

    ধীরে ধীরে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নেমে আসা সূর্যের আলোয় কমলা রঙ ধরে। একসময় সেই রঙও হারিয়ে যায়। গাছের নীচে একটি জ্বলন্ত হ্যারিকেনকে ঘিরে বসে থাকা দলটির তখনও নড়বার নাম নেই। কথাবার্তা, উঁচু নিচু গলায় তর্কবিতর্ক , আর সেই সব কিছুর ফাঁকে ফাঁকে উড়ে আসছে টুকরো টাকরা হাসির আওয়াজ কিংবা সিগারেটের ধোঁয়া।

    শেষমেষ শর্মিষ্ঠা এসে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “রাত আটটা বাজে। এবারে বাড়ি ফেরা হবে কি? দুবার চা দেওয়া হয়েছে। আর পাওয়া যাবে না।”

    চমকে উঠে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ব্রতীন বলল, “সে কী? খেয়ালই করলাম না কোনদিক দিয়ে টাইমটা বেরিয়ে গেল। আর একটুক্ষণ, বুঝলে? হাফ অ্যান আওয়ার মোর। তাহলেই আজকের কাজটা মোটামুটি শেষ হয়ে যাবে। হ্যাঁ সুবল, যা বলছিলাম। তোমার যখন কম্পিউটারের কাজটা ভাল আসে, সেক্ষেত্রে তুমি নেক্সট এক উইকের মধ্যে এখন অবধি অবধি যা চিঠিপত্র তোমার শোভনদা লিখেছে সেগুলোর টাইপড সফট কপি আমায় করে দেবে। বাংলা টাইপিং আসে তো? আর শোভনদা তোমায় একটা কথা বলি, কোন স্পনসর না নিয়ে শুধু চাঁদা আর মুষ্টিভিক্ষা দিয়ে মেলাটা চালাবার ফিজিবিলিটি নিয়ে আমার এখনো সন্দেহ রয়ে গেছে। বাজেট আর রিসোর্স এস্টিমেট নিয়ে নেক্সট রোববারের মিটিংয়ে ফের একবার ডিটেলগুলো দেখতে হবে। আর পরিচালক সমিতির অমরেশ বাগচিকে ধরতে হবে একবার। ওনাকে দিয়ে রেকমেণ্ড করিয়ে লোকাল এম এল এর ফাণ্ড থেকে কিছু ক্যাশ অ্যাসিস্টেন্স যদি নিয়ে নিয়ে আসা গেলে অনেকটা সুবিধে হয়ে যাবে।”
    “দেবে?” একটা সন্দিহান গলা ভেসে আসে টেবিল ঘিরে বসে থাকা জটলাটার ভেতর থেকে।
    “চেষ্টা করতে তো দোষ নেই,” ব্রতীন হাসছিল।
    “দেখো তবে, কাল পরশু যদি মিটিং একটা করা যায়।”
    “কালপরশু হবেনা দাদা। ভদ্রলোক থাকেন প্রধানত কলকাতায়, ছেলের কাছে। পার্টির হেডঅফিসেও কিছু কাজকম্মো দেখেন। মাসে দিন দুয়েক নিজের সমিতির এলাকায় এসে দরবার বসান। জনসংযোগের কাজ সেরে ফের ফিরে যান কলকাতা। হপ্তাদুতিন পরে আবার আসবেন বলে গেছেন। তখন ধরতে হবে।”

    শর্মিষ্ঠা আস্তে আস্তে ফিরে গেল শোভনের ঘরের ভেতর। ফরিদা হাসছিল তার দিকে তাকিয়ে। বলল, “কী হল শর্মিষ্ঠাদি? পারলে না তো?”
    “দূর! যা আড্ডা জমিয়েছে! আমার বরটা যে এত কথা বলে তাই কি আমি জানতাম কখনো? বাপ রে! কি চিৎকার চ্যাঁচামেচি চলছে সে তুমি ভাবতে পারবে না।”
    “ভাবতে পারবো না কি গো? এ তো এই ইশকুলে প্রায় রোজকারের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। একদিকে ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে হইচই, তার পাশাপাশি এই গানমেলা নিয়ে ভিড়ভাট্টা, চ্যাঁচামেচি তো লেগেই আছে।”
    “তুমি বরং কানে তুলো দিয়ে থাকবার বন্দোবস্ত করো,” বলতে বলতেই কি খেয়াল হতে শর্মিষ্ঠা প্রশ্ন করল, “আচ্ছা ফরিদা তুমি ফিরবে কী করে?”
    “সে একটা কিছু জুটে যাবে’খন। দশটা অবধি তো বাসই চলে।”
    “আমরা কি নামিয়ে দিয়ে যাবো? বলবো ব্রতীনকে?”
    “উঁহু দরকার নেই,” হাসিমুখে মাথা নাড়লো ফরিদা, “প্রয়োজন হলে তোমাদের শোভনদাই কিছু ব্যবস্থা করে দেবে কিছু একটা।”

    চুপ করে বাইরের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ তার দিকে ঘুরে শান্ত গলায় শর্মিষ্ঠা বলল, “আগেই মাদ্রিদির মুখে অনেক শুনেছি, তারপর আজ নিজেই দেখলামও, শোভনদা খুব অ্যাট্রাকটিভ পুরুষ। কিন্তু তার কাছ থেকে এতটা দায়িত্বজ্ঞান তুমি আশা করতে পারো কি? যতটুকু জেনেছি, তাতে সে জ্ঞানটা ওঁর থাকলে তাহলে আজ মাদ্রিদিকে এতটা কষ্ট পেতে হতো না। বড় ভালো মেয়ে , জানো? শি ইজ রুইনড্‌ নাও। হাসতে ভুলে গেছেন উনি। বাপের বাড়ির দিক থেকেও বিশেষ সাপোর্ট নেই--”

    নিচু গলায়, প্রায় আপনমনেই যেন বা, অতীতদিনের গল্প বলে চলে মেয়েটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রী। মেয়েটি যাকে ভালোবেসেছিলো তার মন পড়ে থাকতো বিচিত্র এক স্বপ্নের রাজ্যে। কোন মূল্যেই সেই স্বপ্নকে ত্যাগ করতে রাজি হয়নি সে। মেয়েটার সব চেষ্টা যেন এক পাথরের দেয়ালে মাথা ঠুকে ফিরে গিয়েছিল। তারপর, জীবনের উদ্দাম স্রোতে নিজের নিজের নির্ধারিত নিয়তির পথে ভেসে গেল তারা। আজ জীবন মেয়েটিকে যে বিষপাত্রটি উপহার দিয়েছে তার জন্যেও মেয়েটি কখনো দোষী করে না সেই প্রস্তরহৃদয় পুরুষটিকে।

    হঠাৎ শর্মিষ্ঠার সেই গল্পের স্রোতে বাধা পড়ল নিচু ও তীব্র গলায় ছুঁড়ে দেয়া পালটা প্রশ্ন, “হঠাৎ আমাকে এসব কথা বলছেন কেন শর্মিষ্ঠাদি? আপনাদের সমাজের ব্যাপারে তো আমি কিছুই জানিনা। জানবার ইচ্ছেও নেই। আর, আই অ্যাম ডুইং আ জব হিয়ার অ্যাজ পার্ট অব আ মিশন। শোভন মণ্ডলের পার্সোনাল লাইফে কোন দায়িত্বজ্ঞান থাক বা না থাক তা দিয়ে আমার কী দরকার? ডাজ হি কেয়ার? অর ডু আই?”

    শর্মিষ্ঠা মৃদু হাসলো, “তোমার কথা গতকাল প্রথম শুনেছি ব্রতীনের মুখে। আজ প্রথম মুখোমুখি আলাপ। তবু, গত কয়েক ঘন্টায় তুমি যা যা বলেছো আর তোমায় যতটুকু দেখেছি তার থেকে দুটো জিনিস কিন্তু আমি পরিষ্কার বুঝেছি ভাই। তোমায় আমার ভালো লেগেছে, তাই মুখের ওপর সেগুলো বলে দিচ্ছি, কিছু মনে কোর না। শোভনদা তোমার ব্যাপারে কতটা কেয়ার করে জানিনা, তবে তোমার ওপর নির্ভর করে অনেকটা, সেটা ঠিক। তুমি না থাকলে ওর কাজের অনেক অসুবিধে হবে নো ডাউট। আর তোমার কথা বলো তো বলি, মেয়ে হয়ে মেয়েদের চোখকে ফাঁকি তুমি দিতে পারবে না। ইউ হ্যাভ অলরেডি টেকেন দা ওথ। তোমার গল্প যেটুকু বলেছ বিকেল থেকে তাতে তুমি তো গোটা জীবনটাই ওর কাছে আনকণ্ডিশনালি উৎসর্গ করে বসে আছ। কেউ তোমায় কখনো সে কথা বলে দেয়নি?”

    চুপচাপ পাথরের মত বসে ফরিদা শর্মিষ্ঠার কথাগুলো শুনছিলো। আরও একজন মানুষ বুঝেছিলেন। প্রমথ স্যার। ক্যাটক্যাট করে বলেও দিয়েছিলেন মুখের ওপর। কিন্তু, যার বোঝবার দরকার সবার আগে, সে বোঝে কই। উন্মাদ, ভবঘুরে একটা। বুকের ভেতর একতাল পাথরের চাঁই বসানো। কাজটা বোঝে শুধু। তার বাইরে আর কোনকিছুই বুঝবে না ও দুনিয়ার। আগেকার দিনে মিশনারিরা বোধ হয় এইরকমই হতো।

    “কই গো? ডেকেডুকে আমাদের মিটিং ভঙ্গ করে দিয়ে এখন দুজনে মিলে যে গল্প জুড়েছো, তখন বাড়ি যাবার কথা খেয়াল হয় না?” ব্রতীনের ডাক ভেসে আসছিলো বাইরে থেকে। চেয়ার ছেড়ে তাড়াতারি উঠে দাঁড়িয়ে শর্মিষ্ঠা বলল, “আজ যাই। শোনো, আমার রিকোয়েস্টের কথাটা শোভনদাকে বোলো। উনি যদি রাজি থাকেন তাহলে-- ”

    নিজেকে সামলে নিয়ে একটুকরো হাসিফোটালো মুখে ফরিদা, “ও নিয়ে ভেবো না। বিনি মাইনের একজন ম্যাথ টিচার পেলে আমার সুবিধে হবে অনেকটা। নিজে তো মাস মাস হাত পেতে টাকা নিয়ে যাই। উপায় নেই, কী করবো? তোমাকে তো আর টাকা দিতে হবে না! উলটে কোনদিন আশ্রমে দশটা পাত বেড়ে গেলে হয়ত হাত পেতে কিছু চেয়েও বসতে পারবো। ও শোভনদা রাজি হয়েই গেছে ধরে নাও।”

    ***************************

    ব্রতীনরা চলে যেতে ভারি শুনশান হয়ে গেল গোটা বাড়িটা। ঘরের হাওয়াতে হালকা সুগন্ধ ভাসছিল একটা। গন্ধটা নাকে যেতে শোভনের খেয়াল হলো, দুটি মেয়ে আজ দীর্ঘক্ষণ সময় কাটিয়ে গিয়েছে এইখানে।

    রান্নাঘর থেকে খুটখাট আওয়াজ আসছিল। সেই দিকে তাকিয়ে গলা উঁচিয়ে শোভন বলল, “ফরিদা, বাড়ি যাবি না? সাড়ে আটটা বেজে গেছে সে খেয়াল আছে?”
    “হ্যাঁ, এইবারে যাবো। ভালো একটা খবর আছে শোভনদা। বিনি মাইনের টিচার পাওয়া যাচ্ছে একজন। আমি রাজি। এখন তোমার মত হলেই হয়।”
    “কে রে?”
    “শর্মিষ্ঠাদি। প্রেসি থেকে অংকে অনার্স করেছিলো। ভালো রেজাল্ট। বিয়ে হয়ে গিয়ে আর এগোতে পারে নি। নিজে থেকেই ভলান্টিয়ার করলো আজ।”
    “ঘর-বর সামলে রেগুলার আসতে পারবে তো?”
    “পারবে না কেন? এখনো ছেলেপুলে নেই। কর্তাগিন্নির সংসার। দুটো কাজের লোক আছে। ওর কোন অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া, আমি পারছি না? বুড়ো বাবাকে সামলে?”
    “তোর কথা আলাদা। তোর একটা মিশন আছে। বিয়েটিয়ে করে এখনো শেষ হয়ে যাস নি তুই।”

    হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে শ্লেষকঠোর দৃষ্টিতে শোভনের দিকে তাকিয়ে ফরিদা বললো, “খানিকটা ঠিকই বলেছো তুমি শোভন দা। যেমন ধরো সমাদৃতাদি। বিয়েটা করে শেষই হয়ে গেল একেবারে।”

    আচমকা, যেন একটা ধাক্কা খেয়ে ঘুরে তাকালো শোভন। প্রায় ফিসফিস করে বলল, “সমাদৃতা—কিন্তু তুই—তুই কোথা থেকে--”
    “শর্মিষ্ঠাদি বলেছে। আজ দুপুরের পর থেকে এই যাবার আগে পর্যন্ত শুধু ওঁর কথাই বলে গিয়েছে। অত ভালো একটা মেয়ে। কারো কোন ক্ষতি করে নি। একজনকে ভালোবেসে, তার সঙ্গে, আর সেইসঙ্গে নিজের একটা কেরিয়ার নিয়ে সুখে বাঁচতে চেয়েছিলো। খুব বেশি কিছু চেয়েছিলো কি, শোভনদা? তাও তো কিছুই পেল না। কিন্তু, এই যে বিয়েটিয়ে করে একেবারে শেষ হয়ে গেল মেয়েটা সেজন্য কি ওকে দোষী করবে তুমি? আর কারো কোন দোষ নেই তাতে?”

    হঠাৎ তীব্র একটা রাগ তপ্ত লোহার মত ছড়িয়ে পড়লো শোভনের শিরায় শিরায়। নিচু, কঠিন গলায় সে বললো, “তুই কিন্তু সীমা ছাড়াচ্ছিস ফরিদা। মেয়েলি গল্প অনেককিছুই শুনেছিস আজ শর্মিষ্ঠার কাছে সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু, সত্যিকারের কতটুকু জানিস তুই আমার? আজ যে তুই এখানে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আমার মুখে মুখে কথা বলছিস, সেই তোর নিজের ছোটবেলার কথাটা ভুলে গেছিস তুই? নিজেই তো মাঝে মাঝে বলিস, আমিই তোর পুনর্জন্ম দিয়েছি। কোথায় থাকতো তোর সেই পুনর্জন্ম , যদি আমি মাদ্রিকে বিয়ে করে সেদিন ওর বৃত্তে চলে যেতাম? আজ অবধি যে কয়েকশো ছেলেমেয়ে এখান থেকে নতুন জীবন পেয়ে বেরিয়েছে, কোথায় থাকতো তারা? তার জন্য যে পার্সোনাল স্যাক্রিফাইসটা আমাকে, মাদ্রিকে করতে হয়েছে, তার জন্য আজ তোর কাছে আমাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে?”

    মাথা নিচু করে বসে ছিলো ফরিদা। খানিক পরে নীচু গলায় বললো, “স্যাক্রিফাইস তুমি কিচ্ছু করোনি শোভনদা। দুনিয়ায় নিজের বলতে যে একমাত্র জিনিসটাকে বোঝো, সে তোমার এই মিশনটা। সে তো তুমি ছাড়ো নি! আত্মত্যাগ যা করার করেছে মাদ্রিদি। যাদের যাদের ও ভালোবাসতো তাদের জন্য সবকিছু ছেড়েছে। তোমার মিশন যাতে ভালো করে চলতে পারে, সেইজন্য তোমায় ছেড়েছে। তারপর বাপমায়ের কথা ভেবে সেই দুঃখকে হজম করে সংসার করেছে। আর শেষে, শুধু নিজের আদর্শটুকুকে স্যাক্রিফাইস করতে রাজি না হওয়ায় আজ একটা ছোট ছেলেকে নিয়ে বিধবার জীবন কাটাচ্ছে দূরদেশে।”

    হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে শোভন বলল, “রাত হয়েছে ফরিদা। এরপর বাসে লোকজন থাকবেনা। রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো নয় এদিকে। বাড়ি যা তুই এখন।”

    তিক্ত একটুকরো হাসি ছড়িয়ে পড়লো ফরিদার ঠোঁটে। কেটে কেটে বললো, “যাচ্ছি। যেতে তো হবেই আমায়। তবে কি জানো শোভনদা, গতকাল হলেও মনের ভেতর একটুকরো আনন্দ হতো তোমার এই উদ্বেগটুকু পেলে। ভাবতাম, পাথরের মানুষ হলেও, তার ভেতরে কোন একজায়গায় এতটুকু হলেও স্থান আছে আমার জন্য। ভালোবাসা না হোক, অন্তত একটুখানি কেয়ার। একটু কনসার্ন। কিন্তু আজ সন্ধের পর আর সে ভুল আমার হবে না কখনো। আজ আমার কিছু হয়ে গেলে পার্সোনালি কিচ্ছু যাবে আসবে না তোমার। কিন্তু কালকে থেকে স্কুলটা চালাতে যে একটু প্রবলেম হবে সেটাই তোমার উদ্বেগের কারণ। আমি ঠিক বলছি না?”

    তীব্র উজ্জ্বল সেই চোখদুটো, অন্য দুটো চোখের স্মৃতি ফিরিয়ে আনছিলো যুবকটির মনে। একটু পরে চোখ নামিয়ে ক্লান্ত গলায় সে বললো, “সিদ্ধান্তটায় তুই যখন নিজেনিজে পৌঁছেই গেছিস তখন ভালো হল। পার্সপেকটিভটা পরিষ্কার হয়ে থাকলো তোর কাছে। এরপর থেকে খোলা মনে কাজ করতে পারবি। এখন বাড়ি যা তুই। আমায় একা থাকতে দে।”

    ফরিদা হঠাৎ শোভনের একেবারে মুখোমুখি দাঁড়াল এসে। তার চোখে চোখ রেখে বললো, “যাবার আগে আরও একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে দিয়ে যাচ্ছি তোমার কাছে। শোভন মণ্ডল, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার ওপর রাগ, অভিমান, জোর এসবের কোনটাই খাটেনা সে আমি জানি। সেই করতে গিয়ে একটা মেয়ে এর আগেই হেরে গিয়ে তারপর নিজের সর্বনাশ করেছে। কাজেই সে চেষ্টা আমি করবোনা। কিন্তু আমি পাথর নই। সমাদৃতাদির মত বোকা আদর্শবাদীও নই। মন, রক্তমাংসের শরীর, স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করবার ইচ্ছে সবই আমার আছে। তাই একদিন হয়তো এই মিশন আর সেই ইচ্ছে এই দুইয়ের মধ্যে বেছে নেবার একটা সিদ্ধান্ত আমায় একটা নিতেও হবে। সেদিন যদি ভুল করি, তাহলে তার দায়টাও কিন্তু তোমারই হবে সেটা জেনে রেখো।”

    চোখ নামিয়ে শোভন বললো, “বাড়ি যা ফরিদা। কাল আবার এ নিয়ে কথা বলবো। কিন্তু আজ আর নয়--”

    তার সামনে থেকে সরে এসে ঝোলাব্যাগটা কাঁধে তুলে নিতে নিতে ফরিদা বললো, “না শোভনদা। আত্মসম্মান বলে আমারও একটা বস্তু আছে তো! কাল বা তার পরে আর কোনদিন পার্সোনাল লেভেলে কোন কথা আমি আর বলবো না তোমার সঙ্গে। কোন দাবিও আর করবো না। চিরকাল তোমাকে দেবতা বলে মান্য করে এসেছি। এর পরেও তার কোন ব্যতিক্রম হবে না। শালগ্রাম শিলার উপযুক্ত পুজোটা তুমি চিরকাল পেয়ে যাবে আমার কাছ থেকে। এখন চলি। ভেবো না। কাল ঠিক সময়েই পৌঁছে যাবো।”

    || ১০ ||

    “তা মেলা করবেন ভালো কথা। কমিটির সেক্রেটারিতে আমার নামটা রাখতে চান বলছেন তা রাখুন। কিন্তু ফোকসং-এর মেলা বলতে তাতে যদি ওই বাঁকড়ো বীরভূম মালদা দিনাজপুরের গেঁয়ো লোকের কিত্তনটত্তন কেবল হয় তাতে জনতার মনোরঞ্জন হবে কেমন করে? আটিস-ফাটিসও কিছু আনবেন তো? নাকি?”
    “আর্টিস্ট, মানে--”
    “মানে ওই টিভি রেডিওয় গানটান গায় এমন দুচারটে ধরে আনবার কথা বলছিলাম আর কি। কিংবা ধরেন গিয়ে ওই যে আজকাল কীসব উঠেছে—ভুমা, মায়াবি ক্যানভাস—কী যেন বলে—হ্যাঁ, ব্যাণ্ড। কলকাতায় আমার নাতিটাতিগুলো তো র নামে পাগল। যেখানে নাম শুনবে, দল বেঁধে শুনতে ছুটবে। তাই বলছিলাম কি, ব্যাণ্ডট্যাণ্ডের গানও থাকবে নাকি কেবল ওই আলকাপ, ঝুমুর-টুমুরই হবে?”



    শোভন কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু টেবিলের নিচে তার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে তাকে থামিয়ে ব্রতীন এবার আলোচনাটার দায়িত্ব নিল, “না, মানে অমরেশবাবু, বলছিলাম কি, এটা তো লোকসংস্কৃতি মেলা, এতে ব্যাণ্ডের গান ঠিক মানাবে বলে মনে হয় না। তাই ওসব আর--”
    “মানাবে না মানে? ওসব অপসংস্কৃতি নাকি? আহা কী সুন্দর গান হচ্ছিল সেদিন, ছেলের বাড়িতে এফ এম-এ--
    বাংলার সৌরভ ক্রিকেটে তুলকালাম,
    গানে গানে তোমারে দিলাম
    ভালোবাসার সালাম দিলাম—
    লক্ষ্য করে দেখুন মশায়, ভালোবাসা, সালাম—বাংলা ঊর্দু—হিন্দু মুসলমান ইউনিটি। তার সাথে আবার বেঙ্গলি সেন্টিমেন্ট, সৌরভ গাঙ্গুলি—সব আছে, সব আছে। দুটো মাত্তর লাইনে এত কথা বলে দিচ্ছে এইসব নতুন জাতের গান। কী যেন বলে—হ্যাঁ, জীবনমুখী। তা এইসব জীবনমুখী গান টান বাদ দিয়ে কেবল সেকেলে ফোকসং নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? ঐ যে, কী যেন গানটা?--
    কামরাঙা টকমিঠে
    মাছরাঙা মন্দ,
    হেসে কথা কই বলে
    মরদ করে সন্দ।
    আহা কথার কী ছিরি। এইসব গাঁইয়া রসিকতার গান শুনতে শুনতে সেই ছেলেবেলা থেকে কান ঝালাপালা। নতুন কিছু শোনান, তবে না মেলা জমবে!”

    শোভনের মুখে আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিত দেখে ব্রতীন শংকিত হয়ে উঠছিলো। টেবিলের নিচে পায়ে চাপ দিয়ে তাকে কোনমতে থামিয়ে রেখে সে বলল, “কথাটা আপনি ঠিকই বলেছেন অমরেশবাবু, কিন্তু ব্যাপার কী জানেন, ব্যাণ্ড ট্যাণ্ড আনতে গেলে আবার অনেক খরচের ধাক্কা। ভালো দল আনতে গেলে একটা ঘন্টাতিনেকের প্রোগ্রামের জন্যই সব মিলিয়ে লাখখানেক মতো খরচ পড়ে যাবে। প্রথমবারেই অতটা টাকার রিসক না নিয়ে--”
    “আরে রাখুন তো মশাই আপনার টাকার চিন্তা! ও নিয়ে কে ভাবছে? আমি ভাবছিলাম প্রোগ্রামটাকে কীভাবে সাজানো যায়। ওসব ফোকসংটং তো রইলোই। এম এল এ-র সঙ্গে সঙ্গে ধরুন গে ইনগারেশান আর শেষ দিনে কলকাতা থেকে গোটা দুই রাইটার তুলে এনে লেকচার করিয়ে দিলাম । ওটা প্রেসে ভালো খাবে। পাবলিসিটিটা পাওয়া যাবে। সাইড বাই সাইড দুটো কি তিনটে বাংলা ব্যাণ্ড, একটা গৌড়ীয় নৃত্য, আর অ্যাংকরিং-এর জন্য বাংলাদেশের ওই নতুন হিরোটা, কী যেন নাম, ওই যে ‘খুঁজে খুঁজে ফিরি’ তে এনায়েত ফকির করলো, হ্যাঁ, ইকবাল সাম্মী বাপী। ব্যাস, আপনার মেলা হিট। কী বলেন শোভনবাবু?”

    ব্রতীন দেখা গেল একটু অবাক হয়েছে। বলে, “ব্যাণ্ড-ট্যাণ্ড তো বুঝলাম! কিন্তু এই গৌড়ীয় নৃত্যটা কী জিনিস বলুন তো! আগে কখনো শুনিনি তো?”
    “ওই তো মুশকিল মশাই আপনাদের আমলাটামলাদের নিয়ে। গজদন্তমিনারে বসে থাকেন, নিজেদের কালচারের কোন খোঁজখবর রাখেন না। এ হল গে বাংলার নিজস্ব এনশিয়েন্ট ক্লাসিক্যাল নাচ মশাই। রিসেন্টলি আবিষ্কার হয়েছে। ভালো চলছে বাজারে।”

    ব্রতীন গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লো, “আপনি দেখছি সংস্কৃতির দুনিয়ার অনেক খোঁজখবর রাখেন!”
    “রাখতে হয় মশাই,” হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়লেন অমরেশ বাগচি, “পলিটিকস করে খাই। আপনাদের মত মাস গেলে বাঁধা মাইনে তো পাই না। পাবলিক আমাদের লক্ষ্মী। খুশি রইলো তো গদি রইলো। নইলে গেল। তাই পাবলিক কখন কোনটা খাবে তার খোঁজ তো রাখতেই হয়।”

    ব্রতীন একটু চিন্তিত গলায় বললো, “কিন্তু যেমন বললেন, তাতে তো অনেক টাকার বাজেট হয়ে যাবে! পাবো কোথায় অতো টাকা?”

    অমরেশ বাগচি এইবার দৃশ্যতই একটু বিরক্ত। বললেন, “কিছু মনে করবেন না। আপনি বিডিও হয়ে গদিতে বসেছেন বটে, কিন্তু এখনো ছেলেমানুষ আছেন। এই যে আপনি আপনার দোতলা বিডিও অফিসটায় বসে এখন মিটিং করছেন, সেটা বানাবার সাবকন্ট্র্যাক্ট পিডব্লুডির থেকে কে পেয়েছিলো বলুন তো? আপনার চেম্বারের পাশেই তো এক্সপেণ্ডিচার সেকশন। সেখান থেকে ফাইল তলব করে দেখুন তো গত পাঁচ বছরে এই ব্লকের প্রত্যেকটা রোড কন্ট্র্যাক্ট কে পেয়েছে? দুটো প্রশ্নেরই উত্তর এক। পেয়েছে আমজাদ মাস্টার। পার্টির সুনজরে না থাকলে এ কি হয়? কত টাকা বানিয়েছে লোকটা বলুন তো! দু পাঁচলাখ তো ওর হাতের ময়লা। ঘরের দেরাজ থেকে ক্যাশেই বের করে দিতে পারবে। খাতায় অবশ্য একটু বাড়িয়ে লিখবে ব্লকের উন্নয়ন ফাণ্ডে বিশ লাখ টাকা চাঁদা। এমনি আরো কত আছে! এ জেলা থেকে দু দুটো মন্ত্রী। একবার তু করে ডাক দিলে অমন হাজারটা বিজনেসম্যান ছুটে আসবে স্পনসর হবার জন্য। মেলা কমিটিটাকে ভলান্টারি সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন হিসেবে একটা রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিতে হবে শুধু। দেখবেন মেলার খরচ উঠে, আপনাদের হাতে টুপাইস আসবার পরেও পার্টিফাণ্ডের জন্য কয়েক লাখ টাকা তুলে নিয়ে যাবো।”
    “কমিটির রেজিস্ট্রেশন দরকার হবে? ওতে তো সময় লেগে যাবে অনেক! তাছাড়া, সাতদিনের একটা মেলা বই তো নয়। তার জন্যে রেজিস্টার্ড একটা কমিটি বানানো--”

    ব্রতীনকে কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই অমরেশ বললেন, “আহা ও নিয়ে আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না বিডিও সাহেব। কমিটির যাহোক কিছু একটা কনস্টিটিউশান লিখে নিয়ে একটা অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করে দিন শোভনবাবুর নামে। পরশু কলকাতায় গিয়ে পার্টি অফিসে নীরেনদাকে দিয়ে দেবো। হাতে হাতে রেজিস্ট্রেশান বের হয়ে আসবে। রেজিস্ট্রেশানটার দরকার আছে। ওতে করে চাঁদা দিয়ে রসিদ নিয়ে দেখালে ইনকাম ট্যাক্সের বেনিফিট পাবে। দেবে ধরুন দু লাখ, লিখবে বিশ লাখ, আর ওতে করে দু লাখের চেয়ে বেশিই বেনিফিট তুলে নিয়ে যাবে ইনকাম ট্যাক্স বাঁচিয়ে। আপনিও মেলার পয়সা পেয়ে চুটিয়ে কালচার করার শখ মিটিয়ে নেবেন, ওরও ঘর থেকে টাকা বের করতে হবেনা। মধ্যে থেকে অনেকটা ব্ল্যাক মানি হোয়াইটও হয়ে যাবে। সবার লাভ। আরে লাভ না দিতে পারলে লোকে টাকা দেবে কেন, অ্যাঁ?” বলতে বলতে শোভনের দিকে ঘুরে অমরেশবাবু বললেন, “কী মশাই? খুশি তো? ফাংশানটা থেকে আপনার ইশকুলের জন্যও বেশ দুপয়সা আসবে দেখে নেবেন। কালচারের সাথে সাথে ইনকামও হয়ে যাবে।”

    শোভন মাথা নাড়লো একবার। তারপর ব্রতীনের সমস্ত ইশারা-ইঙ্গিতকে উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আমার এতে মত নেই অমরেশবাবু। এইভাবে মেলা করবার কথা আমি কখনো ভাবিনি। আমার দ্বারা এ জিনিস হবে না।”

    স্থিরদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ শোভনের দিকে তাকিয়ে থেকে অমরেশ বাগচি একটু হাসলেন, “আপনার যা প্রোফাইল শুনেছি তাতে এইরকম কিছু একটা আপনি না বললেই আশ্চর্য হতাম। বিডিও সাহেব এর মধ্যে আছেন, নিজে থেকে আসতে রিকোয়েস্ট করলেন, তাই ওনার সম্মানরক্ষার্থে অনেক ব্যস্ততা বাদ দিয়েই আজকের মিটিংটায় এসেছিলাম; ভালো একটা উপদেশও দিয়েছিলাম। তবে তা নেয়া না নেয়া সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার। না নিলেও আমার কিছু যায় আসে না। খানিক সময় নষ্ট হল এই যা। আজ তবে উঠি,” বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ালেন অমরেশ বাগচি। তারপর সুইং ডোর ঠেলে বের হয়ে যেতে যেতে হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “আপনার এই বন্ধুটিকে একটু বোঝাবেন বিডিও সাহেব। টাইম পালটে গেছে মশাই। সেটাই যদি না বুঝলেন তবে আর অত কালচার ফালচার করে কী লাভ? এখন ওসব বিশুদ্ধ সংস্কৃতি করতে গেলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোই সার হবে। বেশ কিছু টাকা গাঁটগচ্চা দিয়ে তারপর মেলার মাঠে বসে মাছি তাড়াবেন। তখন আমার কথাগুলো মনে করে দেখবেন।”

    ব্রতীন তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আর একটু বসে গেলে হতো না অমরেশবাবু? অন্তত আজকের মিটিংটা শেষ হওয়া পর্যন্ত--”

    তাকে থামিয়ে দিয়ে অমরেশ বললেন, “ছাড়ুন তো মশায়! কমিটিতে সেক্রেটারি বানিয়ে নামটা রাখতে চান রাখুন। আপনার খাতিরে ওতে মানা করবো না। অমন কতগণ্ডা কমিটিরই তো মেম্বার হয়ে বসে আছি। কিন্তু তাই বলে আপনাদের এসব ছেলেমানুষী আদর্শবাদী মিটিং-ফিটিং-এ আমায় সময় দিতে বলবেন না। পঞ্চায়েত অফিসে জরুরি কাজকর্ম ফেলে এসেছি। আমি চলি আজ।”

    অমরেশ বাগচির গাড়ি চোখের আড়াল হতে ব্রতীন মাথা নেড়ে বললো, “যাঃ। ভেবেছিলাম কিছুটা ফাণ্ড একলপ্তে ম্যানেজ করে নেব। চান্সটা গেল। আচ্ছা, আপনি এত রিজিড কেন বলুন তো শোভনদা?”
    “রিজিড মানে? লোকটা আমার মেলার গোটা ওরিয়েন্টেশনটাই বদলে ফেলবার প্রস্তাব দিচ্ছিল, আর আমি সেটা আটকাবো না?”
    “আহা তা বলছি না। বটমলাইনটা হল, ওতে মেলাটা কিছুটা টাকা পেত। সে রাস্তাটা এখন একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। সেইজন্যই বলছিলাম, এইভাবে এককথায় বিদায় না করে একটু আলোচনা করে, বারগেন করে, একটা কমপ্রোমাইজে তো আসা যেত? তাতে হয়তো দু পক্ষকেই কিছু কিছু ছাড়তে হত, আবার দুপক্ষেরই কিছু কিছু প্ল্যান ফুলফিল হত।”

    শোভন হাসলো, “না ব্রতীন। তুমি হলে সংসারী, চাকুরে মানুষ। কমপ্রোমাইজ না করে চলা তোমার পক্ষে কঠিন। কিন্তু, আমার তো ওসব দায় নেই! আমি কেন কমপ্রোমাইজ করতে যাবো? আর, তার জন্য মেলাটা যদি এবারে ভালো করে না দাঁড়ায় তাহলে পরের বার আবার চেষ্টা করবো। এখানে না হলে অন্য কোথাও যাবো। আমার তো কোনকিছু হারাবার ভয় নেই!”

    একটু বিরক্ত গলায় ব্রতীন বলল, “আপনি দাদা ভারী পিকিউলিয়ার মানুষ। এইরকম একবগগা লজিক নিয়ে চলতে আমি কাউকে কখনো দেখিনি। কিন্তু, ছোটমুখে বড় কথা বলছি দাদা, কমপ্রোমাইজ একদিন না একদিন আপনায় করতেই হবে দেখবেন। ওর থেকে সারা জীবন ধরে বাঁচবার রাস্তা এখনো সামজিক মানুষ খুঁজে পায়নি।”
    “সে যখন হবে তখন দেখা যাবে’খন ব্রতীন। উপস্থিত আজকের সমস্যাটা নিয়ে মাথা ঘামানো যাক এসো। অমরেশ বাগচি তো স্লিপিং মেম্বার হয়েই গেলেন। এখন তুমি কী করবে বলো। সঙ্গে থাকবে তো?”
    “করবো আর কী? আমি সঙ্গে আছি। কিন্তু টাকাপয়সার ব্যাপারটা--”
    “বাঁচালে। তুমি থাকলে আমার অনেক সুবিধে হয়ে যাবে। উপস্থিত আমাদের চাঁদা আর মুষ্টিভিক্ষা নিয়েই কাজ শুরু করে দেয়া যাক। খর্চাপাতি, সে সব ঠিক উঠে যাবে দেখো। রইলো বাকি মেলায় লোক হওয়া। বিশ্বাস করো ব্রতীন, ওই বছরে নমাস কলকাতায় থাকা অমরেশ বাগচি এখানকার পঞ্চায়েত সমিতির মাথা হলেও এই এলাকার মানুষজনকে আমি অনেক বেশি চিনি ওর চেয়ে। এদের রক্তে যে গান রয়েছে, হাজার চেষ্টা করেও তার সুর বদলানো যায় না। বেহালার ছড়ে যেই টান পড়বে, শ্রীখোলে বোল উঠবে, বাঁশিতে সুর চড়বে, অমনি দেখবে আপনাআপনি লোক এসে জুটছে মেলার মাঠে। ও নিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থেকো। আমি এখন উঠি।”

    ব্রতীন হাঁ হাঁ করে উঠল, “উঠি মানে? দুপুরে আমার অফিস থেকেই একেবারে খেয়ে যাবেন বলেছিলেন ভুলে গেছেন?”

    শোভন মাথা নেড়ে বললো, “হবে না গো। এমনিতেই মিটিংটা খুব লম্বা চললো। তার ওপর ফরিদা আজ ইশকুলে আসেনি। ওর বাবার কিডনিতে কী একটা হয়েছে। কাল একটু বাড়াবাড়ি হওয়াতে আজ ছুটি নিয়ে বাবাকে কৃষ্ণনগরের হাসপাতালে দেখাতে গেছে।”
    “আহা শর্মিষ্ঠা তো আছে ওখানে। একটা দিন চালিয়ে নিতে পারবে না?”
    “না না তা বলছি না। সে তো ও পারবে জানা কথাই। খুব ভালো মেয়ে। পড়াচ্ছেও ভালো। কিন্তু আজ ক্লাশ টেনের ছেলেমেয়ে আর তাদের গার্জেনদের নিয়ে দুটো থেকে একটা কেরিয়ার কাউন্সেলিং-এর ক্লাশ হবার কথা। ফরিদা থাকলে সামলে নিতে পারতো। কিন্তু শর্মিষ্ঠা নতুন এসে এখনই ওটা পারবে না। ও আমায় গিয়ে ধরতে হবে।”

    ব্রতীন হাসলো, “ক্লাশ টেনেই কেরিয়ার কাউন্সেলিং করাচ্ছেন? এখনো তো বাচ্চা ছেলেমেয়ে সব। কেরিয়ারের ওরা বুঝবেটা কী?”
    “বুঝতে হয় ব্রতীন। এইসব অঞ্চলে শৈশব বস্তুটা কিন্তু অনেক তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। টেন পাশ করার পর বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই এখানে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে রোজগারের ধান্দায় লেগে পড়ে। বর্ডার এলাকা। চোরাই মাল এপার-ওপার করবার কাজে চোদ্দো পনেরো বছরের ছেলেমেয়েদের খুব ডিম্যাণ্ড এখানে। ওর ওপর গুলি চালাতে না বিএসএফ না বিডিআর, কারো হাত ওঠেনা সচরাচর।
    “প্রথম-প্রথম আটকাবার চেষ্টা করেছিলাম, বুঝলে। ওদের বাবা-মাকে ডেকে বোঝাবারও চেষ্টা করেছি। তারপর আস্তে আস্তে বুঝেছি, ওটাই স্বাভাবিক। সবাই তো আর বিএ এম এ পাশ করবে না! সেটা যার যোগ্যতা থাকবে তার আপনি হবে। যেমন ফরিদার হয়েছে। ললিতের হয়েছে। কিন্তু সবার তো সেই যোগ্যতা নেই! এরা গিয়ে ভিড়ে যায় বর্ডারের মাল পারাপার করবার কাজে। পেটের ভাতের প্রশ্ন। অতএব এদের ফাঁকা আদর্শের বড় বড় বুলি দিয়ে লাভ হবে না কোন। তার বদলে তাই ক্লাশ টেন থেকে এই কেরিয়ার কাউন্সেলিং-এর সেশনটা চালু করেছি। হকারি, ভ্যানওয়ালা, মুদির দোকান, এইরকম অজস্র যেসব পেশা ছড়িয়ে আছে চারপাশে সেই ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের ওরিয়েন্টেশন করাই, দোকানে বাজারে অ্যাপ্রেন্টিসশিপ করাতে পাঠাই। ওর ফাঁকে ফাঁকে যে যে চায়, হায়ার সেকেণ্ডারিটা এখানে থেকেই পড়ে নেয়। গণ্ডা গণ্ডা রাজা উজির না হয় না-ই তৈরি হলো। কিন্তু ফি বছর অন্তত কিছু ছেলেমেয়ের চোরাচালানের বিজনেসে হারিয়ে যাওয়া আটকে একটা সুস্থ কেরিয়ারের পথে পৌঁছে দিতে তো পারছি! ”

    ব্রতীন চুপচাপ শুনছিলো। শোভনের কথা শেষ হতে বললো, “রুরাল এম্পলয়মেন্ট জেনারেশন স্কিমে এ ব্লকে টাকা আসে অনেক নানা প্রোগ্রামে। দেখি তার থেকে কিছু গ্র্যান্টের ব্যবস্থা করে দিতে পারি কিনা।”
    “দোহাই ভাই। ওই চেষ্টাটি দয়া করে কোরনা। সরকারী টাকায় ছুঁলে আঠারো ঘা। আজ তুমি এলাকার দণ্ডমুণ্ডের মালিক। চেষ্টা করলে কিছু গ্র্যান্টও পাইয়ে দিতেই পারো জানি। একবার ওতে অভ্যাস হয়ে গেলে তারপর কাল যখন অফিসার বদলাবে, পার্টি বদলাবে, নতুন লোকজনের নতুন অ্যাজেণ্ডা হবে, তখন? তারা হয়তো গ্র্যান্টটা বন্ধ করে দেবে, অথবা হয়তো গ্র্যান্টের বিনিময়ে এমন কিছু কমপ্রোমাইজ দাবি করে বসবে যা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন আমি দাঁড়াবো কোথায় গিয়ে?”

    বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে ফের। সেইদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে খানিকটা নিজের মনেই ব্রতীন বলল, “আপনি কিন্তু একেবারে প্যারানয়েড স্টেটমেন্ট দিচ্ছেন একটা, শোভনদা। এ দেশে সরকারী অনুদান নিয়ে বহু সংস্থাই তো ভালোভাবে কাজ করছে। আমি নিজেই তো কত জায়গায় এমন সব সংস্থাকে সাহায্য পাইয়ে দিয়েছি! তারপর নিয়মিত মনিটর করে দেখেছি, সত্যিকারের কাজও হয়েছে অনেক। কাজেই সরকারী টাকা নিলে কাজ হয় না এটা মানতে পারলাম না।”
    “না পারাটাই তোমার পক্ষে স্বাভাবিক ব্রতীন। তুমি সরকারী নুন খাও যে! অধস্তন কর্মচারীর চোখে আর ফাইলের পাতায় উন্নয়নের মাপজোক করো। কিন্তু আমরা যারা টেবিলের উল্টোদিকের লোক, কাজটা যারা হাতে কলমে করি তারা কিন্তু অন্য একটা ছবি দেখি। তোমার টেবিল অবধি কোন বেনিফিশিয়ারির নাম না পৌঁছোবে না পৌঁছোবে সেইখানে কে কাকে ভোট দেয় ও পার্টিফাণ্ডে কে কতটুকু শেয়ার দেবে সেই হিসেব থেকে শুরু করে টাকা ডিসবার্সমেন্ট-এর সময় তোমার অফিসের কেরাণীবাবুর পেতে রাখা হাতটা অবধি বারে বারে কমপ্রোমাইজ করতে বাধ্য করে মানুষকে। টাকাটা হাতে আসবার আগেই অনেকটাই কমিটেড হয়ে যায় এইসব খাতে। ও আমার পোষাবে না।”
    “আপনি কিন্তু আমার নামে অন্যায় অভিযোগ করলেন একটা শোভনদা। ওরকম টেবিলে বাঁধা অফিসার হিসেবে আমি কাজ করিনি কখনো। আজ অবধি আমি যেখানে যেখানে আমি পোস্টেড থেকেছি, চেষ্টা করেছি যাতে--”
    “ভুল করছো ব্রতীন। আমি ব্যক্তি হিসেবে তোমায় কিছু বলিনি। ব্যক্তিগত স্তরে তুমি একজন সৎ অফিসার হয়তো। নিজের উদ্যোগে যতটুকু পারো মানুষের ভালো করবার চেষ্টা করছ, এবং, একেবারে বদলে যদি না যাও তাহলে ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষিতে তার মূল্য কতটুকু বলতে পারো? কালেকটিভ ইন্টিগ্রিটির কোন উন্নতিটা হবে ওতে? গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাটাকে যদি একটা একক চরিত্র হিসেবে ধরো তাহলে এই মুহূর্তে তার চরিত্রে সততার বড় অভাব ঘটেছে ব্রতীন। সত্যিকারের সামাজিক মঙ্গলের জন্য কাজ করতে গেলে তাই আজকের প্রেক্ষিতে সরকারী স্কিমটিমের থেকে দূরে থেকে এগোনোটাই ভালো।”
    “মানতে পারলাম না শোভনদা। ওটা আপনার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত। অন্তত আমি নিজের কেরিয়ারে সরকারী টাকাতেই বীরভূম ও নর্থ বেঙ্গলে বেশ কিছু প্রজেক্ট বেশ ভালো ভাবেই ইমপ্লিমেট করতে পেরেছি বলে মনে করি।”
    “তা পারবে না কেন? তুমি হয়তো সৎ, কাজপাগল মানুষ! কিন্তু যেসব জায়গায় ভালোভাবে কাজগুলো করছ বলছ, তুমি সেসব জায়গা থেকে বদলি হয়ে যাবার পর সেইসব প্রজেক্ট ও তাদের বেনিফিশিয়ারিদের ভবিষ্যতও কি একইরকম ভালো থেকেছে? থাকলে সেটা কত পারসেন্ট কেস-এ তার কোন হিসেব আছে তোমার কাছে?”
    ব্রতীন অসহিষ্ণু ভঙ্গীতে মাথা ঝাঁকালো, “না নেই। থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু সলিউশনটা কী? সে ব্যাপারে কিছু না বলতে পারলে খামোখা নিন্দে করবেন না।”
    “সমাধান আছে ব্রতীন। ওই অন্ধ ওয়েলফেয়ারের রাস্তা ছাড়তে হবে। খেয়াল করলে দেখবে, সেরকম একটা সমাধানের মডেল নিয়েই আমি কাজও করছি আমার হেমলতা ইশকুলে।”
    “এটা একটু কন্ট্রাডিকটরি হয়ে গেল না শোভন দা? আপনার এই এডুকেশন প্রজেক্টটা ওয়েলফেয়ার ছাড়া আর কী? ব্যবসা তো করতে বসেন নি?”
    “ব্যবসা করতে বসিনি তা ঠিক, কিন্তু পুরোপুরি উদ্দেশ্যবিহীন কম্বলদান আর লঙ্গরের ওয়েলফেয়ারও করছি না আমি এখানে। সেই ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির পথ ধরে চলতে গিয়ে তো এই হালে এসে পৌঁছেছি আমরা। প্রতিদান ছাড়াই ভিক্ষে দিতে দিতে অবশেষে নীচের মহলে একদল ভিখিরি আর ওপরের মহলে একদল চোর নিয়ে ধুঁকছি। ওর বদলে আমি এখানে বাজারি অর্থনীতির ডিমাণ্ড-সাপ্লাইয়ের মডেলটা ব্যবহার করছি। এই এলাকার দোকান, বাজার, পরিবহনের ব্যবসায় অল্প মাইনের স্কিলড ওয়ার্কারেরর চাহিদা প্রচুর। আমার ইশকুল থেকে আমি সেটা সাপ্লাই করি। এ ইশকুলের কিছু ছেলেমেয়ে নিজের মেধার জোরে উচ্চশিক্ষার দিকে চলে যায়, কিন্তু বাকি প্রায় সব ক্ষেত্রেই, বেসিক নীতিজ্ঞান আর পড়াশোনাটুকুর সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ওই স্কিলগুলো তৈরি করে দেয়া হয় এলাকার বিভিন্ন ছোট ব্যবসায়ীর কাছে বিনিমাইনের শিক্ষানবিশ হিসেবে পাঠিয়ে। তারপর তারা আস্তে আস্তে অ্যাবজর্ব হয়ে যায় সেইসব কাজের সঙ্গে। রোজগার হয়তো বেশি করেনা, কিন্তু খেয়েপরে তো বাঁচে! আর মজার কথা জানো, এই ছেলেমেয়েগুলোই তাদের সামান্য রোজগার থেকে একটু একটু করে টাকা দিয়ে আমার ইশকুলটাকে টিঁকিয়ে রেখেছে। সরকারী ডোল আমার চাইনা ব্রতীন। ভাবোতো, এই মডেলটা যদি রেপ্লিকেট করে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দেয়া যায়, অতিরিক্ত মানুষের যে বোঝা, সেটাকে যদি লায়াবিলিটি না ভেবে অ্যাসেটে বদলে দেয়া যায়, তাহলে একদিন ছবিটা কেমন বদলে যাবে! প্রত্যেকটা সমাজের সমস্যাগুলো ইউনিক, তার সমাধানও একএকটা ইউনিক পথেই তো করতে হবে--”

    তার স্বপ্নভরা চোখদুটো জানালার বাইরে বৃষ্টিঝরা দুপুরের ঘনায়মান অকালসন্ধ্যার দিকে চেয়ে থাকে। অভিজ্ঞ, পোড় খাওয়া সরকারী কর্মচারীটি তার দিকে তাকিয়ে নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু। এ স্বপ্নটাও আর দশটা সুন্দর স্বপ্নের মতো ভেঙে যাবে একদিন। ভাঙতে বাধ্য। সেটাই এই সময়ের নিয়তি বলে তার বিশ্বাস। কিন্তু তবু কেন যে কিছু মানুষ নির্বোধের মত কেবল স্বপ্নই দেখে যায়!

    “শোভনদা, বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। এই ফাঁকে--”

    চমকে উঠে দেয়ালের ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে শোভন বলল, “এই রে, কথায় কথায় কত দেরি হয়ে গেল দেখো। আমি চলি--”

    || ১১ ||

    অমরেশ বাগচি যে তাঁর মুখেমুখে কথা বলবার দুঃসাহসটিকে খুব সহজভাবে নেননি তার প্রমাণ পেতে বেশি দেরি হল না। প্রতি বছর পাঁচ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবসে হেমলতা বিদ্যামন্দিরে একটা অনুষ্ঠান হয়। ক্লাস টেনের কাউন্সেলিং-এর পর ফি বছর ছেলেমেয়েদের যে বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছে দিনে দু ঘন্টা করে বিনিমাইনের শিক্ষানবিশি করতে পাঠানো হয়, সেইসব প্রশিক্ষকদের মধ্যে থেকে সেরা তিনজনকে বেছে নিয়ে সম্বর্ধনা দেবার বন্দোবস্ত থাকে এদিন। ছাত্রদের বাপমায়েদের সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হন মুরলিপুর থেকে শুরু করে আতাখালির বাজার অবধি বিস্তীর্ণ এলাকার সমস্ত ছোট ব্যবসায়ীই।

    বিদ্যামন্দিরের ছড়ানো উঠোনের একপাশে একটা ছোট মঞ্চ হয়েছে। গোটা উঠোনটা ভরে গেছে মানুষে। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে তখন। শোভন শিক্ষকদিবস নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে, এই সময় ক্লাস টুয়েলভের অমিত উদ্বিগ্ন মুখে মঞ্চে উঠে এসে ফরিদার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে গেল। তাতে চোখ বুলিয়ে ভ্রু –দুটো একবার কুঁচকে উঠলো ফরিদার। পাশে চেয়ারে বসা শর্মিষ্ঠাকে নিচু গলায় বলল, “আমি অফিসঘরে যাচ্ছি। শোভনদার বক্তৃতা শেষ হলে বলবি একবার যেন আসে।”
    “কী হল হঠাৎ?”

    হাতের চিরকুটটার দিকে দেখিয়ে ফরিদা বললো, “বুঝতে পারছিনা। বিরামনগর থানা থেকে কন্সটেবল দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছে শোভনদাকে। দুটো কনস্টেবল এসে অফিসঘরে বসে আছে।”
    “পুলিশ পাঠিয়েছে? কিন্তু—কেন?”
    “গিয়ে জিজ্ঞাসা করে দেখি,” বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে মঞ্চের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল ফরিদা।

    ভিড়ের মধ্যে দিয়ে পথ করে করে হাঁটতে থাকা ফরিদার দিকে একটুক্ষণ উদ্বিগ্নমুখে তাকিয়ে থেকে হাতব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে ব্রতীনের নম্বরটা ডায়াল করলো শর্মিষ্ঠা। নিচু গলায় কয়েকটা কথা বলে ফের ফোনটা ঢুকিয়ে রাখল ব্যাগের ভেতর।

    শোভনের কথা ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। পাশে এসে বসতে নিচু গলায় শর্মিষ্ঠা বলল, “একবার অফিসঘরে যান শোভনদা। ফরিদা ওখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”
    “অফিসঘরে? অনুষ্ঠানের মধ্যে স্টেজ ছেড়ে---কী এত জরুরি ব্যাপার ঘটলো?” শোভনের গলায় স্পষ্টই বিরক্তির ছাপ।

    শর্মিষ্ঠা অধৈর্যভাবে মাথা নাড়ল, “ব্যাপারটা সত্যিই জরুরি। আপনি আগে যান। আমি এদিকটা সামলে রাখছি ততক্ষণ।”

    একটু অবাক চোখে তার দিকে একবার দেখে নিয়ে, মঞ্চ ছেড়ে নেমে গেল শোভন। আসরে একটা কৌতুহলী গুঞ্জনের শব্দ উঠছিল। এইবার সেইদিকে মনোযোগ ফেরাল শর্মিষ্ঠা। ব্রতীনকে খবরটা সে পৌঁছে দিয়েছে। এবার যা দরকার ব্রতীনই করবে। তার এখন অনুষ্ঠানটার দিকে মন দেয়া দরকার। এমন বিচিত্র শিক্ষক সম্বর্ধনার অভিজ্ঞতা তার জীবনে এই প্রথম। তালিকায় প্রথম নামটি হল আতাখালি বাজারের দয়াময়ী পান ভাণ্ডারের মালিক শ্রীপতি মণ্ডলের। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সেরা শিক্ষকের শিরোপা এ বছর পাচ্ছেন যথাক্রমে বিরামনগরের রফিক ভ্যানওয়ালা ও আলেখ্য টিন শপের মালিক সঞ্জয় দাস। দাসমশাইয়ের দোকানে টিন কেটে উনুন আর ট্রাংক তৈরি হয়।

    অফিসঘরে অপেক্ষা করতে থাকা লোকদুটোর চোখেমুখে স্পষ্টতই বিরক্তির ছাপ। ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমে তাদের ইউনিফর্ম ভিজে উঠেছে। টেবিলের একপাশে শোভনের চেয়ারটাতে জুড়ে বসে মাথার টুপি দিয়ে হাওয়া খাচ্ছিল তাদের মধ্যে একজন। অন্যজন ঘুরে ঘুরে ঘরটার চারপাশ দেখছে। টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে ফরিদা বসে। শোভনকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “শোভনদা, ইনি বিরামনগর থানা থেকে আসছেন। বলছেন বড়বাবু আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন।”

    চেয়ারে বসা লোকটার আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে শোভন জিজ্ঞাসা করলো, “কী ব্যাপার বলুন তো?”
    “সেটা বড়বাবুই বলবেন। আমাদের কাজ আপনাকে নিয়ে যাওয়া। ওসব কেন-ফেনর উত্তর আমি দেব না।”
    “আচ্ছা ঠিক আছে। প্রোগ্রামটা শেষ করে নিই। তারপর বিকেলের দিকে গিয়ে নাহয়--”

    তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই লোকটা অধৈর্য গলায় বললো, “ওসব বিকেল-ফিকেল ছাড়ুন। স্যার আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে বলেছেন। সঙ্গে গাড়ি আছে। চলুন।”
    “বেশ। চলুন তাহলে,” বলে শোভন দরজার দিকে পা বাড়াল।
    “শোভনদা, একটু দঁড়ান তো! আমি সঙ্গে যাব,” বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল ফরিদা।
    “এই যে দিদি শুনুন, চুপচাপ নিজের কাজ করুন গে যান। বড়বাবু একে ডেকে পাঠিয়েছেন, আপনাকে নয়।”
    “নিজের কাজটা করতেই তো সঙ্গে যাচ্ছি,” ঠোঁট শক্ত করে ফরিদা বললো, “ওয়ারেন্ট নেই কিছু নেই, একটা ইশকুলের প্রধানকে পুলিশ পাঠিয়ে থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন সেটা দেখতে হবে না? এই ইশকুলের কর্মচারী হিসেবে ওটাও আমার একটা কাজ।”
    “তক্কো করবেন না, তক্কো করবেন না। যা বলছি শুনুন। নইলে শেষে ঝামেলায় পড়ে যাবেন বলে দিলাম,” বলতে বলতে কোমরে বাঁধা অস্ত্রটির ওপরে হাত বোলাচ্ছিল লোকটা।
    “ভয় দেখাচ্ছেন?” বলতে বলতে ব্যাগ থেকে একটা ফোন বের করে এনে সেটার দিকে দেখিয়ে ফরিদা বললো,
    “এটা দেখছেন? দুটো কল করবো এটার থেকে। একটা হিউম্যান রাইটস কমিশনে, ওয়ারেন্ট ছাড়াই গানপয়েন্টে শোভন মণ্ডলকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে এই অভিযোগ জানিয়ে। আর অন্যটা যাবে উইমেনস কমিশনে। মাইনরিটি কম্যুনিটির কর্মরত মহিলা হিসেবে সে অভিযোগটা আমি করব আমার সঙ্গে পুলিশের দুর্ব্যবহারের অভিযোগ এনে। আপনার নেমপ্লেটটা দেখে রেখেছি। সুবিমল চ্যাটার্জি। এই আশ্রমের অন্তত দশটা মেয়ে কোর্টে গিয়ে সাক্ষি দেবে আপনি তাদের সামনে আমার সঙ্গে মিসবিহেভ করেছেন।”

    লোকটি ঠাণ্ডা চোখে তার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শেষে বললো, “আচ্ছা, চলুন।” এইবার তার গলায় একটু আগের সেই তাচ্ছিল্যের ভাবটা আর নেই।

    ****************

    বিরামনগর থানায় দুপুরবেলায় ভিড় ছিলোনা বেশি। বড়বাবুর ঘরের সামনে এসে সুবিমল চ্যাটার্জি পর্দাঢাকা দরজাটার দিকে ইশারা করে বললেন, “ভেতরে যান।”

    বড়বাবু লোকটি মাঝবয়সী। মাথার চুলে মেহেন্দি করা। ভারি চেহারা। সম্ভবত দুপুরের খাওয়া শেষ করেছেন একটু আগে। একটা খড়কে কাঠি নিয়ে দাঁত খুঁটছিলেন। শোভনরা ঢুকতে একটা বড়োসড়ো ঢেঁকুর তুলে ঘুরে বসতেই তাঁর চোখ গেল ফরিদার দিকে। চোখ দিয়ে তাকে কবার চেটে নিয়ে শোভনের দিকে ফিরে বললেন, “সঙ্গে করে ওটা আবার কাকে নিয়ে এলেন? গার্লফ্রেণ্ড?”



    বলতে বলতেই টেবিলের ওপর রাখা একটা হাতঘন্টিতে সজোরে থাবড়া দিলেন ভদ্রলোক। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পর্দা সরিয়ে ভেতরে এসে দাঁড়ানো সেপাইটিকে মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি আমার পিণ্ডি চটকাচ্ছিলে? ডেকেছি এই ছেলেটাকে। মেয়েছেলেটা সঙ্গে ঢুকে এল কী করে?”

    লোকটা মিনমিন করে বলল, “আমি কী করব? সুবিমলবাবু সঙ্গে করে গাড়িতে নিয়ে এলেন, তাই ভাবলাম আপনার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে।”
    “তাই আর কিছু বললে না। নাকি মেয়েমানুষ দেখে সব ভুলে গিয়েছিলে? শালা যতসব উজবুক নিয়ে হয়েছে কারবার। বের করে নিয়ে যাও! এক্ষুনি।”

    ফরিদা এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এইবার মুখ খুলল সে, “দেখুন, আমি কিন্তু--”

    হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন মানুষটি। তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে হিসহিস করে বললেন, “আপনি তো ফরিদা বিশ্বাস অ্যালিয়াস মরণ? শোভন মণ্ডলের পার্টনার। ফাইলে যা ডেসক্রিপশান পেয়েছি তাতে তাই মনে হচ্ছে। দেখুন ম্যাডাম, এখানে আমার অর্ডারে কাজ চলে। আপনাকে আমি ডাকিনি। জোর করে ঢুকে এসেছেন। হয় ওই দরজাটা দিয়ে সোজা বাইরে যাবেন, নাহলে লক আপে পুরে দেবো। কোনটা পছন্দ?”

    শোভন পেছন ঘুরে ফরিদাকে ইশারায় বাইরে যেতে বলল। এ লোকটা কোন কারণে তাকে ভয় দেখাতে চাইছে। এই মুহূর্তে ঝগড়া করে বসলে তাতে ওর সুবিধে হয়ে যাবে।

    ফরিদা উঠে চলে গেলে বড়বাবু চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর গলগল করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, “ক্ষমতা দেখাচ্ছেন?”
    “মানে?”
    “ন্যাকামো করবেন না। আপনি এখানে পৌঁছোবার মিনিট পনেরো আগেই বিডিওর ফোন এসে গেছে আমার কাছে, বিনা ওয়ারেন্টে আপনাকে ডেকে পাঠাবার কৈফিয়ৎ তলব করে।”

    আকস্মিক এই রূঢ়তার আঘাতে একটুক্ষণের জন্য কথা হারিয়ে ফেলেছিলো শোভন। কী বলবে সে? এ লোকটার অভিযোগটাই বা কী? ব্রতীনই বা এর মধ্যে এল কোথা থেকে? একটু বাদে ধীরে ধীরে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে এল তার। লোকটার চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় সে বলল, “দেখুন দারোগাসাহেব, ইশকুল চালিয়ে খাই। ক্ষমতাটমতা আমার বিশেষ কিছু নেই। তবে হ্যাঁ। ব্রতীন আমার ছোটভাইয়ের মতন। ভরা সভা থেকে লোক পাঠিয়ে তুলে আনলেন, খবর তার কাছে কোন না কোনভাবে পৌঁছে যাবেই। তবে সে কথা এখন থাক। আপনার ভয় দেখানো যদি শেষ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এবারে কেন ডেকে এনেছেন সেকথাটা বলবেন কি?”

    টেবিলের ওপর রাখা একটা ফোল্ডার খুলে তার ভেতর থেকে দশবারোটা ছবি বের করে এনে তার দিকে ঠেলে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “এদের চেনেন?”

    ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে শোভন মাথা নাড়ল, “না। কখনো দেখিনি। এরা কারা?”
    “মাওইস্টস অন দা রান। এই দশজন এই এলাকায় অপারেট করছে বলে ডেফিনিট খবর আছে আমাদের কাছে। আমার কাছে কমপ্লেন আছে, এদের মধ্যে অন্তত তিনজন আপনার স্কুলে মাঝেমাঝেই এসে শেলটার নেয়। সেইজন্যেই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি।”
    “কিন্তু আমি এদের কাউকেই চিনি না। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে স্কুল চালাই। সেখানে এইসব--”
    “প্রশ্নই ওঠেনা। তাই বলবেন তো? ফেঁসে গেলে সবাই তাই বলে। তবে এখন অবধি যা খবর নিয়েছি তাতে আপনার ক্লেইমটা অ্যাপারেন্টলি সত্যি বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু, রিটেন কমপ্লেন যখন এসেছে তখন এনকোয়ারি তো করতেই হয় একটা। ফাইলও খুলতে হয়েছে আপনার নামে।”
    “রিটেন কমপ্লেন? কে করেছে?”
    “সেটা তো আমি আপনাকে বলবো না! শুধু এইটুকু বলতে পারি আপনার এলাকারই কেউ চুকলিবাজি করেছে আপনার নামে।”

    শোভন খুব অসহায় বোধ করছিলো। একটা অপরিচিত, ছদ্মবেশী মানুষ। কোন অজানা কারণে তাকে ছোবল দিতে উদ্যত হয়েছে। একরাশ শিশু ও তরুণ মুখের ছবি ভাসছিল তার মনে। ওদের কী হবে?

    “শুনুন মশায়, বিডিও সাহেব আপনার বন্ধুলোক। সেইজন্যে আপনাকে একটা ফ্রেণ্ডলি অ্যাডভাইস দেব,” সিগারেটের বাটটা অ্যাশট্রেতে ঘসতে ঘসতে দারোগা ফের কথা বললেন। গলার সুর এবারে একটু যেন নরম হয়েছে, “ওসব বিডিও টিডিও আজ আছে কাল নেই। কিন্তু আপনাকে তো এইখানেই থাকতে হবে নাকি? যে এলাকায় থাকেন, সেখানকার লোকজনের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলতে শিখুন। নইলে কেউ না কেউ হরবখত এইরকম করে কাঠি করে করে জীবন দুর্বিষহ করে দেবে। আপনি শুনেছি বেশ রূঢ় ব্যবহার করে থাকেন লোকজনের সঙ্গে। মানীর মান রাখতে জানেন না। আপনাদের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অমরেশ বাগচিবাবু সেদিন দুঃখ করে বলছিলেন। ওনার সঙ্গে রিসেন্টলি আপনার কোন গড়বড় হয়েছে?”
    “গড়বড় ? কই না তো? মাসখানেক আগে একবার দেখা হয়েছিল অবশ্য। একটা গানের মেলা করতে চাইছি আমাদের এলাকায়, সেই ব্যাপারে। সেখানে কিছু ডিফারেন্স অব ওপিনিয়ন হয়েছিলো বটে, কিন্তু কোন অশান্তি তো হয় নি?”

    দারোগা মৃদু হাসলেন, “বাড়ি গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় গোটা ব্যাপারটা ভেবে দেখুন। পলিটিশিয়ানদের প্রেস্টিজজ্ঞান এখন হাফ গেরস্তের ইজ্জতের মতো মশাই। আড়ালে খেমটা নাচলেও দোষ নেই। কিন্তু পাবলিক প্লেসে যাকে বলে চোখে হারায়। কী বলতে কী বলে দিয়েছেন সবার সামনে, আর তাইতেই হয়তো ওনার মনে আঘাত লেগে গিয়েছে।”
    “কিন্তু তাই বলে এইরকম একটা--”
    “একটা কী? উনি কমপ্লেন করেছেন তা আমি বলেছি? এখন ছাড়ুন ওসব কথা। আপনাকে একটা ওয়ার্নিং দেয়ার দরকার ছিল, দিয়ে দিয়েছি। বাড়ি যান। মেলা করুন। ইশকুল চালান, যা খুশি করুন, কিন্তু জলে থেকে কুমীরের সঙ্গে ঝগড়াটা আর করবেন না। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে শিখুন। ফিরে গিয়ে ভালোয় ভালোয় সব মিটিয়ে নিন। এ কমপ্লেনটা আপনার ফাইলের রেকর্ডে রইল। লালবাজার থেকে ফরোয়ার্ড হয়ে এসেছে কমপ্লেনটা। অতএব এ ফাইল এত তাড়াতাড়ি বন্ধ হবেনা। আর জেনে রাখবেন, সেকেণ্ড টাইম আপনার বা আপনার স্কুলের নামে এ জাতের কমপ্লেন এলে আপনার বিডিও বন্ধুও কিন্তু আপনাকে বাঁচাতে পারবেন না এই বলে দিলাম। এসব ব্যাপারে স্টেট গভমেন্ট এখন খুব কড়া।”

    থানা থেকে বের হতেই ফরিদা ফোনটা বের করে রিডায়ালের বোতাম টিপে শোভনের হাতে দিয়ে বলল, “ব্রতীনদার সঙ্গে কথা বলুন। থানা থেকে বেরিয়েই ফোন করতে বলে দিয়েছে।”

    একটা রিং বাজতেই উল্টোদিক থেকে ব্রতীনের উদ্বিগ্ন গলা ভেসে এলো, “কী হল শোভনদা? হঠাৎ একেবারে--”
    “জানিনা ব্রতীন। এ ধরনের সিচ্যুইয়েশন আগে কখনো ফেস করিনি তো! ফোনে সব গুছিয়ে বলতে পারবো না। ফিরে এসে না হয়--” শোভনের গলা মৃদু কাঁপছিল।

    ওপাশ থেকে ব্রতীনের শান্ত গলা ভেসে এলো, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি আগে ফিরে আসুন। আমি অফিস থেকে চলে এসে আপনার ইশকুলেই ওয়েট করছি। শর্মিষ্ঠার কিচেন ক্লাসরুম থেকে ফার্স্টক্লাস গন্ধ বের হচ্ছে। আপনারা এলে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া সেরে তারপর বের হব।” ফোনটা ছেড়ে দিল ব্রতীন।

    ফরিদা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখছিলো শোভনের দিকে। তার হাত থেকে ফোনটা নিতে নিতে বলল, “খুব হিউমিলিয়েট করেছে তোমায়, তাই না? ডেকেছিল কেন?”

    শোভন ফিকে হাসল। তারপর ভেতরের কাঁপুনিটাকে চেপে শান্ত গলায় বলল, “নাথিং সিরিয়াস। চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

    ************

    রাত নটা নাগাদ খাওয়াদাওয়া সেরে ব্রতীনরা উঠল। এই বয়সেই একেবারে পোড় খাওয়া আমলা হয়ে উঠেছে ছেলেটা। কোন অবস্থাতেই নার্ভাস হবার কোন লক্ষণ দেখায় না। সব শুনে টুনে হাসি হাসি মুখে বলেছে, “ও কিছু না। লোকাল পলিটিক্স। অমরেশ বাগচি প্যাঁচ খেলেছে। ভদ্রলোকের এক জামাই আই পি এস। লালবাজারে আছে। আপনি এসব নিয়ে একেবারে দুশ্চিন্তা করবেন না দাদা। সব ঠিক হয়ে যাবে। অমরেশবাবুকে কদিন একটু গুড মুডে রাখতে হবে শুধু। সেটা আমি দেখে নেব। আপনি ওসব না ভেবে আপনার কাজটা করুন। কয়েকদিনের মধ্যে অমরেশবাবুর সঙ্গে আপনার মিটিং করিয়ে দেব একটা। সে সময় কীভাবে কী বলতে হবে সব শিখিয়ে দেব।”

    আকাশে মেঘ ছিলো। ফরিদাকে আজ ব্রতীনরা তাদের গাড়িতে লিফট দিয়ে দেবে বাড়ি অবধি। গাড়ির এঞ্জিন চালু হতেই হঠাৎ শোভন বলল, “একটু দাঁড়াও ব্রতীন। আমিও আজ বিরামনগর যাবো একবার।”
    “বিরামনগর? এত রাতে সেখানে আবার কী কাজ পড়লো দাদা?”

    দরজা খুলে ব্রতীনের পাশের প্যাসেঞ্জার সিটে বসতে বসতে শোভন বলল, “কাজ না। ভুবনদার আখড়ায় রাতটা কাটিয়ে আসতে ইচ্ছে হচ্ছে হঠাৎ। মাসদুয়েক হল আখড়ায় যাইনি।”
    “সে কী দাদা? রোজই তো দেখা হচ্ছে। তাহলে?”
    “হ্যাঁ সে হচ্ছে। কিন্তু জানো, এই মেলার কাজ শুরু হয়ে ইস্তক ভুবনদা ভীষণ কাজের লোক হয়ে গেছে। গানটান গাওয়া বন্ধ। আজ তাই ওর আখড়ায় যাবো একদম অকাজ নিয়ে। গান শুনবো সারারাত। কতোদিন শুনিনি!”
    “কিন্তু—দরজা-টরজা যে সব খোলা পড়ে রইলো দাদা!”

    শোভন হাসল, “থাক গে যাক। চিরটাকালই তো ওইরকমভাবেই থেকে এসেছে। আমার বাড়িতে চুরি আর কে করবে এখানে। কিছু যে নেই সে তো সবাই জানে।”
    “আর তাই একেবারে দরজা খুলে রেখে উনি চলে যাবেন। আরে কুকুর বেড়ালেও তো ঘরে ঢুকে ময়লা করে রেখে যেতে পারে! শর্মিষ্ঠাদি, একটু জায়গা দাও তো,” বলতে বলতে হঠাৎ শর্মিষ্ঠাকে সরিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এসে ফরিদা ফের বললো, “এক মিনিট দাঁড়ান ব্রতীনদা। আমি এক্ষুণি আসছি।”

    মিনিট পাঁচেক পরে ফিরে এসে ছোট একটা চাবির গোছা শোভনের দিকে বাড়িয়ে ধরে সে বললো, “এটা সঙ্গে করে নিয়ে যান। হারালে কাল স্কুল খুলবে না।”

    নির্জন পথ বেয়ে গাড়ি ছুটছিলো। ড্যাশবোর্ডের আলোয় চাবির গোছাটাকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে শোভন হঠাৎ প্রশ্ন করলো, “তালা কিনেছিস?”
    “হ্যাঁ,”পেছন থেকে মাথা নাড়লো ফরিদা, “ছটা তালাচাবি কিনেছি গতমাসে। আমার মাইনের থেকে কিনেছি। ইশকুলের টাকা ছুঁইনি।”
    “কেন?”
    “ইশকুলটা আমারও। আপনি উদাসীবাবা হয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু এর কোন ক্ষতি হলে আমার দুঃখ হবে।”

    চাবির গোছাটা নিঃশব্দে পকেটে পুরে নিল শোভন।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • | | | | | ৬ | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments