• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৭ | জানুয়ারি ২০১১ | উপন্যাস
    Share
  • যাত্রী (৩) : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য



    খাওয়াদাওয়া সেরে ঘরদোর বন্ধ করে বেরোতে বেরোতে আড়াইটে বাজল প্রায় । শোভনদের বাড়ি থেকে চূর্ণীর ঘাট প্রায় কিলোমিটারখানেক দূরে । ঝোপঝাড়ে ভরা খাড়াই পাড় নেমে গেছে নিচের দিকে । অনেকটা তলায় বাঁশের ছোট একটা মাচার গায়ে ডিঙি নৌকো বাঁধা ছিল একটা । প্রভাত অভ্যস্ত পায়ে তরতর করে নেমে গেল সেদিকে । শোভন নিচের দিকে দু পা গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে সমাদৃতার হাত ধরল ।

    "খেয়াল করে নামিস । মাঝে মাঝে মাটি ঝুরঝুরে হয়ে আছে কিন্তু ।"

    "সে তুই না বললেও খেয়াল আমি ঠিকই করতাম । উফ্‌ ! নদিয়ার গ্রামে থাকতে গেলেও যে মাউন্টেনিয়ারিং এর ট্রেনিং দরকার হয় তা কে জানতো ! কেন, ঘাট যখন আছে তখন দশজন মিলে একটা সিঁড়ি বানিয়ে নিলে কি দোষ হয় ?"

    শোভন হাসল, "ভালো আইডিয়া । পঞ্চায়েতকে চিঠি দিতে হবে একটা । এখানকার লোকজনের তো আর দরকার হবে না, তারা তো এভাবে ওঠানামা করতেই অভ্যস্ত । কিন্তু বাইরে থেকে ক্বচিৎ যখন তোর মতন কোনো নাগরিকার আবির্ভাব ঘটবে তখন তাঁর কথা ভেবে-------"

    "শোভন, মার খাবি কিন্তু ।"

    "মারবি ? কিন্তু মারতে গেলে হাতটা ছাড়তে হবে যে ! আর হাত ছাড়লেই-------দেখছিস তো নিচে-------"

    "আরে, তোমরা কি খালি বকবকই করবে নাকি তাড়াতাড়ি নিচে নামবে ? ক'টা বাজে সে খেয়াল আছে ?" প্রভাত নিচে থেকে তাড়া লাগাচ্ছিল । কথা বন্ধ করে নিচের দিকে পা চালালো ওরা ।

    ছোট্ট নদীটি । এপার-ওপার কথা চালাচালি করা যায় । দু'দিকের উঁচু পাড় পেরিয়ে খানিকদূর অবধি চোখ চলে মাত্র, দিগন্তে চোখ পড়েনা । নদীপথে চলতে চলতে সেই দৃশ্যমান ভূখণ্ডগুলিতে সতত বহমান জীবনস্রোতের চলচ্ছবি চোখে পড়ে । ছোট ছোট গ্রামগুলি হেমন্তের উত্তর মধ্যাহ্নের নরম রোদে গা এলিয়ে শুয়ে আছে । তাদের মাঝে মাঝে ধূ ধূ করে শস্যহীন মাঠ । দিনের এই সময়টিতে কদাচিৎ কোনো মানুষের দেখা মেলে চারপাশে । মাদ্রিকে মাঝখানে রেখে নৌকার দুই মাথায় বসেছে প্রভাত ও শোভন । ডাইনে ও বাঁয়ে দুটি বইঠার আঘাতে দুর্বলস্রোতা চূর্ণীর বুক চিরে নৌকো ছুটছিল উজানের দিকে । তরুণদুটির দেহে চকচক করছিল স্বেদবিন্দু ।





    শুরুতে নৌকার দোলানিতে একটু অস্বস্তি হয়েছিল সমাদৃতার । কিন্তু ত্রক্রমশ, সেই অস্বস্তির জায়গায় এক গতির নেশায় পেয়ে বসছিল তাকে । নদীর দু'দিকে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে থাকা গ্রামদৃশ্যের থেকে সরে এসে একসময় তার চোখ সংহত হল নৌকার দু'পাশ দিয়ে ত্রক্রমাগত পেছনের দিকে ছুটতে থাকা ঘোলাটে জলরাশির দিকে । এক অদ্ভুত মাদকতা ও চৌম্বক আকর্ষণ রয়েছে সেই দৃশ্যে ।

    "চাদর নিবি মাদ্রি ?" শোভনের ডাকে হঠাৎ চমক ভাঙল তার । কখন যেন বেলা ঢলে এসেছে । পশ্চিমের আকাশ লাল । নদীর জলের ওপরে সামনে পেছনে কুয়াশার হালকা আস্তর আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল । ঠাণ্ডা হাওয়ায় মৃদু কাঁপুনি উঠছিল তার শরীরে । এদিক ওদিক একবার ঘুরে চাইল সমাদৃতা । তারপর নিজের দোপাট্টাটাকেই ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে গুটিশুটি মেরে বসল ।

    "ওতে শীত মানবে না ম্যাডাম । একটু পরে আরো ঠাণ্ডা পড়বে । তোর পাশে আমার ব্যাগটা রাখা আছে দ্যাখ । ওতে তোর জন্য একটা চাদর এনেছি । বের করে গায়ে দে ।"

    শোভনের ব্যাগে দুটো চাদর রাখা ছিল । পুরোনো বিবর্ণ তুষের চাদর একটা, আর অন্যটা একখানা কাঁথা । দুটো শীতবস্ত্র হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে শোভনের দিকে চাইলে সে বলল, "চাদরটা আমার জন্য । কাঁথাটা কাচা আছে । তোর জন্য মায়ের বাক্স থেকে বের করে নিয়ে এসেছি । জানতাম, দরকার হবে ।"

    দুটো পুরোনো থানকাপড়কে অজস্র রঙিন সুতোর ফোঁড়ে জুড়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে এই পরিধেয়টি । সাদা পটভূমিতে রঙিন ফোঁড়ের দক্ষ বিন্যাসে ফুটে উঠেছে বিবিধ বিচিত্র মোটিফ । কাঁথাটা গায়ে দিয়ে অন্যদুজনের দিকে চেয়ে দেখে একটু ইতস্তত করে বলল, "তোরা কিছু গায়ে দিবি না ?"

    উত্তরটা দিল প্রভাত । বলে,"দাঁড় বাইছি তো মাদ্রিদি ! ওতেই গা গরম হয়ে থাকবে । চাদর আমাদের লাগবে পৌঁছোবার পর ; রাতে, আসরের সময় ।"

    মনোহরগঞ্জ গ্রামটা চূর্ণীর উত্তর পারে । এইদিকে নদীর পাড় অতটা উঁচু নয় । বেশ ক'টা নৌকা জটলা করে ভেসে ছিল ঘাটে । নৌকা বাঁধতে বাঁধতে সেই দিকে দেখিয়ে প্রভাত শোভনকে বলল, "মনজুরের আসরে আজ ভিড় মন্দ হবেনা ।"

    "তাই তো দেখছি ! ঠিকঠাক জায়গা জুটলে হয় এখন । নে নে, হাত চালা-------"

    নৌকো বেঁধে রেখে ওরা তিনজন নদীর পাড় ছেড়ে গ্রামের ভেতরের দিকে রওয়ানা হল । রাস্তা বেঁকে গিয়ে নদীর ধার বরাবর পুবমুখে চলেছে । পুবদিকে দিগন্তের ঠিক ওপরে কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ তখন আস্তে আস্তে লালচে থেকে স্বর্ণাভ রঙে বদলে যাচ্ছিল । নদীর বহমান জলে ছড়িয়ে পড়ছিল অজস্র চন্দ্রচূর্ণ ।

    কিছুক্ষণ চলবার পর হাতের বাঁয়ে ইশারা করে শোভন বলল, "আসরে লোকজন বসে গেছে মনে হয় । ওই শোন-------"

    মৃদু একটা গমগমে শব্দ ভেসে আসছিল তার ইশারা করা অভিমুখটি থেকে । রাস্তা এইখানে এসে নদীর পার ছেড়ে উত্তরমুখে বেঁকে গিয়েছে । দু'পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বনস্পতিদের তলা দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাওয়া সেই পথকে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মতন দেখায় । ওরা সেই সুড়ঙ্গপথ ধরে দ্রুত পা চালাল । অসমান, বন্ধুর পথ ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে গ্রামের বসতি অঞ্চলের দিকে এগিয়ে গিয়েছে । বর্ষার সময় তার নরম মাটির বুকে গোযানের চলাচলের গভীর চিহ্নগুলি শুকিয়ে উঠে এই প্রথম হেমন্তে এক অসমান, বন্ধুর রূপ দিয়েছে তাকে । হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছিল সমাদৃতার । এই দুই তরুণের মতো অন্ধকারে চোখ চলেনা তার । শোভন বোধ করি খেয়াল করেছিল তার এই সমস্যাটা । অন্ধকারের আব্রুর মধ্যে সে এসে তার বন্ধুর হাত ধরল । উষ্ণ, নরম সেই হাতে মৃদু সংকোচের স্বেদস্পর্শ ছিল প্রথমে, তারপর তার আঙুলগুলি দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরল তরুণটির কর্কশ ও কঠিন আঙুলগুলিকে । এই বিজন অন্ধকার পথে এই শক্ত হাতটিতে কোন এক অব্যক্ত নিরাপত্তার সন্ধান করছিল বুঝি তা ।

    মনজুরের বাড়িটি বেশ বড় । উঁচু দাওয়া ঘিরে পাঁচ ছ'টি ঘর । তার মধ্যে একটা ঘর অন্দরমহলের জন্য রেখে দিয়ে বাকিগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়েছে উত্সবের কাজকর্মের জন্য । সামনে প্রশস্ত উঠোন জুড়ে মাথার ওপর চটের আচ্ছাদন পড়েছে । তার মাঝে মাঝে বাঁশ দিয়ে উঁচু করে ঠেকনা দিয়ে রাখা । মানুষ জমেছে অনেক । তারই গমগম শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল দূরের থেকে । সদর পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল ভুবন হন হন করে এদিকেই আসছে । কাছে এসে শোভনের হাত ধরে বলে, "আসতে তাহলে পারলে ছোট গোঁসাই ?" বলতে বলতেই তার চোখ গিয়েছে শোভনের পেছনে দাঁড়ানো সমাদৃতার দিকে । খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর মিটিমিটি হেসে সে বলে, "এ যে সাক্ষাৎ আমার রাধারানি গো ! আসমানের চাঁদ কোন আঁকশিতে মাটিতে পেড়ে আনলা ছোট গোঁসাই ?"

    একটু অস্বস্তিভরা চোখে সমাদৃতার দিকে দেখে নিয়ে ভুবনের দিকে ফিরল শোভন, "কী যে বলো ভুবনদা ! ও আমার কলেজের বন্ধু । একসঙ্গে পড়েছি আমরা পাঁচ বছর । গান শুনতে এসেছে আমাদের সঙ্গে ।"

    "তা সে তুমি যা-ই বলো ছোট গোঁসাই, আমি কিন্তু এঁয়াকে আমার রাধারানি বলেই ডাকবো ঠিক করলাম । তা মাগো তোমার কোনো আপিত্য নাই তো ?" বলতে বলতেই গুনগুন করে গান ভেসে ওঠে তার গলায়-------

         গৌর দেহ সুচারুসুবদনী
         শ্যামসুন্দর নাহ রে ।
         জলদ উপরে তড়িত সঞ্চরু
         সরূপ ঐছন আহ রে ।
         পিঠপর ঘন দোলত শ্যামবেণী
         লিখন লেখু পাঁচ বাণ রে
         খন ন থির রহ সঘন সঞ্চর
         মানিক মেখল রাব রে ।
    বয়োজীর্ণ ঘসা গলায় সে সুরকে এক অন্যতর মাত্রা এনে দেয় মুহূর্তে । সমাদৃতা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল, হাজারো ভাঁজে ভরা তিলকচর্চিত মুখটির দিকে । শব্দগুলির আংশিক অর্থবোধ তার হয়েছে । নিজের রূপের প্রশংসা শুনে সংকোচভরা মুখটিতে তার একই সঙ্গে অস্বস্তি ও খুশির ছোঁয়া । তবে, পদটির পুরো অর্থ এখনো তার বোধগম্য হয়নি । রূপবর্ণনার বাইরে আরও কিছু একটা ছিল এই বৃদ্ধের কীর্তনে । সেইটির অর্থভেদ সে না করতে পারলেও শোভনের অভ্যস্ত কানের পক্ষে তার গূঢ় বক্তব্যটি বুঝে নিতে সমস্যা হয়নি কোনো । কৃষ্ণবর্ণ মেঘমালার বক্ষলীন শ্বেততপ্ত বিদ্যুন্মালার চিত্রকল্পটিতে শ্যামবর্ণ কৃষ্ণের বুকে গৌরী রাধার যুগলচিত্রের আভাসটি সে ধরতে পারল সহজেই ।

    "ভুবনদা, এতটা বুড়ো হলে তুমি, তবু তোমার বজ্জাতি গেল না । এবারে পথ ছাড়ো দেখি, ভেতরে গিয়ে বসি," বলতে বলতে তার পাশ কাটাতে গেল সে তাড়াতাড়ি ।

    "আরে আরে ছোটগোঁসাই, তাড়াহুড়ো কীসের ? চুপটি করে দাঁড়াও দেখি যুগলে । আজ মনজুরের হয়ে তার মেহমানের খাতিরদারির ঠেকাটা আমিই নিয়েছি, বুঝলে ? নিয়ম তো তুমি জান ।"

    "হুঁ জানি । কিন্তু যা করবে তাড়াতাড়ি করো," বলতে বলতে প্রভাতের পাশে ফের দাঁড়িয়ে পড়ল শোভন । এগিয়ে যেতে থাকা সমাদৃতাও থেমে গিয়েছে তার হাতের মৃদু স্পর্শের ইঙ্গিতে ।

    ভুবনের ইশারায় ততক্ষণে এগিয়ে এসেছেন একজন দীর্ঘদেহ প্রৌঢ় । দেহ-ঢাকা তালি দেওয়া আলখাল্লার মলিনতা তাঁর ব্যক্তিত্ত্বের ঔজ্জ্বল্যকে আবৃত করতে পারেনি এতটুকু । এগিয়ে এসে তাদের সামনে নিচু হয়ে বসে পাশে রাখা বালতি থেকে এক মগ জল তুলে নিয়ে ঢেলে দিলেন তিনি তাদের তিনজনের পায়ে । সসংকোচে সরে যেতে গিয়েও শোভনের হাতের মৃদু ইশারায় ফের স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সমাদৃতা । এই অপরিচিত আচার তার অভ্যস্ত সংস্কৃতির সঙ্গে এক সরাসরি বিরোধের, ও ফলত এক তীব্র অস্বস্তির সূচনা করছিল । প্রভাত ও শোভনের অবশ্য কোনো বিকার নেই । সেবাটুকু নিতে নিতে নিতান্তই স্বাভাবিক গলায় বাক্যালাপ চলেছে তাদের, সেবারত প্রৌঢ়টির সঙ্গে । কথাবর্তায় বোঝা যাচ্ছিল, এই বাড়ির বাসিন্দা অথবা তাঁদের কোনো নিকট আত্মীয়ই হবেন তিনি । পায়ে জল দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাশে দাঁড়ানো অন্য এক তরুণের হাত থেকে ধোঁয়া ওঠা একটা ধুনুচি নিয়ে তাদের সামনে নাড়িয়ে দিলেন একবার । ধুনোর মৃদু সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে । এক গভীর নি:শ্বাসে তার সুগন্ধ টেনে নিয়ে সমাদৃতা বলল, "ধুনোর গন্ধ আমার বড় ভালো লাগে ।"

    প্রৌঢ় মৃদু হেসে বললেন, "ধুনো বলতে নেই মা । বলো আগরবাতি । আমরা হলাম গিয়া বে-শরা ফকির কিনা ! আমাদের অতিথ বরণ হয় আগরবাতি দিয়া ।" বলতে বলতে হঠাতি তাদের পেছনদিকে চোখ ফেলে এক গাল হেসে তিনি বলে উঠলেন, "আসো আসো আমির ভাইজান । দেরি করলা যে বড় ? ফলারের সময় হয়ে এলো, আমি ভাবি কী আবার দিককত হল ভাইজানের-------" দীর্ঘ পদক্ষেপে শোভনদের অতিক্রম করে প্রৌঢ় এগিয়ে গেলেন পেছনের দিকে এসে দাঁড়ানো অন্য এক অতিথির দিকে ।

    "যাও গোঁসাই । এইবারে ছুটি । রাধারানিকে নিয়া আসর আলো করে বসো গিয়া । ভালো করে দেখায়ে দাও সবকিছু," ভুবনের চোখে তখনও সেই দুষ্টুমির ভাবটি লেগেই আছে । তারপর শোভনের জবাবের অপেক্ষা না করেই প্রভাতের দিকে ফিরে বলে, "তুমি একটু চলো দেখি আমার সঙ্গে ! কাজ আছে । একটাবার রান্নাবাড়িতে গিয়া ওনাদের বলতি হবে, বুঝলা কি না-------"

    ভুবনের কথাগুলি আস্তে আস্তে সমবেত মানুষজনের গুঞ্জনের মধ্যে হারিয়ে যায় । এগিয়ে যাওয়া বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলল শোভন । মুখফোঁড় বুড়ো । কখন যে কী বলে ফেলে-------

    "বে-শরা------- মানে সুফি ?"

    সামনে এগোতে এগোতে ঘাড় নাড়ল শোভন । এই সংলাপটা চালাতে সে বিশেষ উত্সাহী নয় । সমাদৃতা অবশ্য সে নীরবতায় দমে না গিয়ে ফের প্রশ্ন করল, "মানে ওই যে মইনুদ্দিন চিশতি, নিজামুদ্দিন আউলিয়া, বা-শরা, বে-শরা------- ওইসব ?"

    হালকা বিরক্তিভরা গলায় শোভন বলল, "এটা তোর জিকে-র পেপার নয় মাদ্রি । চিশতির প্রশ্নই উঠছে না । আর আউলিয়ার কথাই যদি বলিস তাহলে বলব, এরা বে-শরা, কিন্তু ঠিক আউলিয়াপন্থীও নয় । এরা ফকির । এদের কথা জিকের বইতে লিখবে না । পরীক্ষাতেও আসবে না । আর, এখানে তুই টার্কিশ সুফি নাচ বা তার কোনো দিশি ভার্সান, অথবা কাওয়ালি টাইপের গান আশা করলে ভুল করবি সে কথা আগেই বলে রাখছি ।"

    সমাদৃতা মুখ টিপে হাসল একটুখানি । শোভনের এইসব সোজাসাপটা, কড়া কথায় প্রথম প্রথম বিরক্তি হত খুব । এখন আর হয়না । মজা লাগে । নিজের দুনিয়া নিয়েই মশগুল রয়েছে শোভন । দ্বিতীয় কোনো মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীকে কখনও দেখতে শেখেনি । ফলে সমাদৃতার একান্তই স্বাভাবিক কৌতূহল ও অজ্ঞতার মিশ্রণকে সহানুভূতির সঙ্গে ক্ষমা করে নেবার ক্ষমতা ওর নেই ।

    আসরটি এতক্ষণে বেশ ভরে উঠেছে । এই অঞ্চলে ইরশাদের এক সময় যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা ছিল । তার সাধনা ও সঙ্গীতধারাকে এখন সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে চলেছে মনজুর ও তার অন্যান্য শিষ্যের সম্প্রদায় । ফলে তার মৃত্যুদিনের স্মরণোত্সবে জমায়েত নিতান্ত কম হয়নি । নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের বহু আখড়া বা আশ্রমের বাসিন্দাই এসেছেন আজকের উত্সবে । আসর জুড়ে এক এক জায়গায় দল করে বসেছেন তাঁরা । সঙ্গে রয়েছে নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র গুলি ও ভ্রমণের ঝোলাঝুলি । ফকির বাউলের জীবন । পাখির জীবন যেন । কথায় বলে যেথায় রাত, সেথায় কাত । দিনযাপনের সহজ, সাধারণ উপকরণগুলি সাথেসাথেই চলে ।

    শোভনের সঙ্গে এঁদের অনেকেরই পরিচিতি রয়েছে । তাঁদের ফাঁকে ফাঁকে এগোতে এগোতে বারেবারেই থেমে দাঁড়াতে হচ্ছে তাকে । দুটি-একটি কথা, শুভেচ্ছা ও সম্ভাষণের বিনিময়, পরিচিতজনের নাম ধরে কুশল প্রশ্ন, তারপর ফের এগিয়ে যাওয়া আরও একটু সামনের দিকে ।

    সভায় প্রায় মাঝামাঝি পৌঁছে এসে একটু জায়গা করে নিয়ে বসলো ওরা দু'জন । সামনেই দু তিনটি সারির পরেই একখণ্ড খালি জায়গা । সেখানে চারটি কলাগাছের চারা পুঁতে কাপড় দিয়ে তাদের ঘিরে একটা ঘরের আকার দেয়া হয়েছে । ভেতরে রাখা হয়েছে একটি মাথা বাঁকানো লাঠি । সেদিকে ইশারা করে শোভন বলল, "ইরশাদ ফকিরের শেষ চিহ্ন । তাঁর বৃদ্ধ বয়সের লাঠি ।"

    স্মৃতিচিহ্নটির সামনে একটা প্রদীপ জ্বলছে । সভা জুড়ে দূরে দূরে হ্যাজাক জ্বলছে পাঁচ-ছ'টি । তার পোড়া তেলের মৃদু গন্ধ ভাসে বাতাসে । চারপাশে বহু মানুষের উপস্থিতি ও ওপরের চটের আচ্ছাদন ঠেকিয়ে দিয়েছে ঠাণ্ডার কামড়কে । গরম ঠেকছিল সমাদৃতার । গায়ের কাঁথাটা খুলে কোলের ওপর ভাঁজ করে রাখল সে । পাশে শোভন বসে নীচু গলায় কথাবার্তা বলছে একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে । মানুষটির পরণে আপাদমস্তক কালো পোশাক । বুক অবধি কাঁচাপাকা দাড়ি । শান্ত, গভীর দুটি চোখ । চারদিকে তাকাতে তাকাতেই ওদের কথাবার্তার টুকরোটাকরা ভেসে আসছিল সমাদৃতার কানে-------

    "বলেন কী ? মওলার নামে ফতোয়া ? এমন কী গুণাহ করল সে ?"

    "করেছে ভাই । সব গুণাহের সেরা গুণাহ । শাহিদ বাঁশিয়ারে মনে আছে তোমার ? সেই যে, রোগা-পাতলা ছেলেটা, বড় বড় চোখ-------"

    "হ্যাঁ, হ্যাঁ------- পাঁচুর ছেলে তো ? মিঠা হাত । মওলার দলেই তো ছিল । তার আবার কী হল ?"

    "ওরে নিয়াই তো গড়বড়ি ! আসামের করিমগঞ্জে আসরে গেছিল মওলা দল নিয়া । আসরে শাহিদ বাঁশিয়ার প্যালার রোজগার হইয়ে গেল মওলার চাইতেও বেশি । সে ট্যাকার ভাগ নিয়া যত অশান্তি । শেষমেষ শোনা যায় মওলা ছোঁড়ারে চলতি গাড়ির নীচে নাকি ধাক্কা মারি-------"

    "বলেন কী ?"

    "হ্যাঁ, তবে আর বলি কী ? দলের অনেকেই নাকি দেখেছিল মওলারে ধাক্কা মারতে । তারা তারে ধরতেও গিছিল । কিন্তু মওলারে তো জানোই । গায়ে অসুরের শক্তি । একটি লম্ফে সেই যে ভাগিছে, আর তার কোনো অতা-পতা নাই । সেই নিয়া শেষ হাজারো অশান্তি । ফতোয়া দেছে, ওরে দেখা গেলে-------"

    রক্ত, লোভ ও হিংসার স্বাদবাহী সেই শব্দমালার সঙ্গে এসে মিশছিল মৃদুকন্ঠে দ্বিতীয় এক তত্ত্ব আলোচনার শব্দ------- "আরে ধুৎ । মনিরুদ্দি কী যে করে তার ঠিক নাই । দল টিঁকবে না ওর, দেখে নিও । এই আমি বলে দিলাম । ওই অকালষেঁড়ে মদ্দাকানু, তারে বানাবে আলকাপের ছোকরা ? বলি শোন । দেশ থিকে ও'সব পাট উঠেছে অনেককাল । এখন পঞ্চরসের যুগ । তার আসরে লোকও আসে মেয়েমানুষ দেখতে । তার উপর, এখন আর ছোকরা হবার মতন ছেলে তুমি পাবা কুথায় ? ও হতি গেলে সাধন লাগে হে । দেহে পুরুষ, অন্তরে নারী ; শয়নে, স্বপনে, অশনে, বসনে নারী ভাব, তবে না মায়া জমবে ! ওই কানু ছোকরা তো মেদমজ্জার পাহাড় ! ওতে মায়া কুথা ? তার চেয়ে ডবকা একখানা মেয়েমানুষ নিতে পারতো দলে । মায়া না হোক নেশা তো হত ।"

    "ধুৎ ! কী যে বলো ওসমানদাদা তুমি । মুখের কোনো আড় নাই-------"

    "কেন ? ভুল বলিছি ? আজকাল তো এইসবই হতেছে । ঝুমুরউলীর অভাব আছে দেশে ? তাদেরই একখান নাদুসনুদুস দেখে ধরে আনলেই তো হল ! মানা করবে কে ? বলি শোন । আলকাপের মরণ হয়েছে আজ অনেক কাল । আমায় দেখো । বোনা কানার চ্যালা আমি । হাতে ধরায়ে শিখায়েছেন । রাখতে পারলাম ? সেই তো মাগী ঢুকাইতে হল দলে । তারা বুকপেট দেখায়ে ধেই ধেই নাচে । লোকে টাকা ছোঁড়ে । নাড়া বান্ধলাম আলকাপের, আর হয়ে গেলাম পঞ্চরসের গাঁঠেদার-------"

    মানুষটির গলায় কোথায় যেন এক গভীর বেদনার ছোঁয়া ছিল । অচেনা, অজানা শব্দবন্ধগুলির দেয়াল পেরিয়েও তা মাদ্রির কানে এসে ঠেকছিল । কোন একটা সঙ্গীতধারা মরতে বসেছে । এই প্রাকৃত, কর্কশ শব্দগুলি তারই স্মৃতিতর্পণ যেন বা ।

    "কী রে, বোর হচ্ছিস না তো ?" শোভন ডাকছিল ।

    "না না বোর হবো কেন ? এই চারপাশের গল্পটল্প শুনছিলাম । ইন্টারেস্টিং । আচ্ছা শোভন, হোয়াট ইজ আলকাপ ?"

    "অ্যাঁ ! বলিস কী রে ? ভালো পিক আপ করছিস তো ? এর মধ্যেই আলকাপের নামও শুনে ফেলেছিস ?"

    "আরো জেনে ফেলেছি । ফর এগজামপল, পঞ্চরস । মোটামুটি আজ রাতটা এখানে কাটালে কাল সকালে ফোক এক্সপার্ট হয়ে এখান থেকে বেরোব বলে মনে হচ্ছে । আর উত্তমের যা ক্যালিবার তাতে ও তো আজ এখানে থাকলে কালকে ফিরে গিয়ে একটা গোটা থিসিসই সাবমিট করে ফেলতে পারতো রুরাল বেঙ্গলের ফোক কালচারের ওপরে ।"

    "হুঁ তা পারতো । যেভাবে প্রেজেন্টেশানের পেপারটা নামালো সেবার ! `প্রাচীন রেড ইণ্ডিয়ান সমাজে রাষ্ট্রচেতনার বিকাশ' । একটামাত্র সিনেমা দেখে একটা গোটা পল সায়েন্সের প্রজেক্ট পেপার যে লিখে ফেলতে পারে তার পক্ষে কিছুই বিচিত্র নয় । কিন্তু উত্তমটাকে নিয়ে এলি না কেন রে ? খবর দিলেই হত একটা !"

    "খবর দেবার কোনো রাস্তা রেখেছে নাকি ? ষষ্ঠীর দিন বাড়ি গিয়েছিল । আগামী পরশু ফিরবে বলে গেছে । আর সেইসঙ্গে আমায় বিরাট একটা হোমটাস্কের লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে গেছে । তার মধ্যে বেশ কয়েকটা ফুল লেংথ মক টেস্টও আছে । উ:, পুজোটা যা বোরিং কেটেছে এবার, সে বলবার নয় ।"

    "বসে বসে হোম টাস্ক করেছিস, তাই তো ? উত্তম একেবারে তোর উপযুক্ত ওষুধ, বুঝলি !"

    "সে তো বলবিই । প্রাণের বন্ধু যে । তার কোনো দোষ তুই দেখবি কেন ? আমি এক্সপেক্ট করছিলাম পুজোর মধ্যে অন্তত একবার আসবি । তাহলে আমার কাজটা অনেক সিমপল হয়ে যেতো । কিন্তু তোর কাছে ও'সব জেশচার আশা করাই ভুল ।"

    শোভন মাথা নাড়ল, "আমারও একবার মনে হয়েছিল বুঝলি, পুজোর মধ্যে সোদপুর ঘুরে আসব একবার । তারপর ভাবলাম, শুধুমুদু তোর প্রিপারেশানে ডিস্টার্ব না করি । তাই-------"

    "মিস করছিলি আমাকে ?"

    "হ্যাঁ, মানে ওই আর কি-------"

    "মিথ্যে কথা বলিস না শোভন । তুই আছিস তোর দুনিয়া নিয়ে । ভালোই আছিস । সত্যি বলতে কি, তোর বাড়িতে আসবার পর থেকে আমার কেবল মনে হচ্ছে আমি তোর দুনিয়াতে এসে ইনট্রুড করছি ।"

    "মাদ্রি, এটা কিন্তু তোর দুনিয়াও হয়ে উঠতে পারে । লোকে তো বিদেশে গিয়েও সিটিজেনশিপ নেয় ! সেখানকার আচার-আচরণ, রীতি-নীতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে-------"

    "সে অনুরোধ তো আমিও তোকে করেছি শোভন ! না অনুরোধ নয়, দাবিই করেছি বলতে পারিস ।"

    "করেছিস । আর তাকে সম্মানও দিয়েছি আমি মাদ্রি । পরীক্ষাটাতে বসবো বলে আমি তোকে কথা দিয়েছি । এই বারে তোর পালা । আমার দুনিয়াটাকে মেনে নিতে পারবি তুই ? সামান্য একটু অ্যাডজাস্টমেন্ট, সামান্য-------"

    "খাবার জায়গা করেন গো," ধামা হাতে এক বৃদ্ধ পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ডাকছিলেন । কথা বন্ধ করে শোভন তাড়াতাড়ি তার ঝোলা থেকে একখণ্ড খবরের কাগজ বের করে এনে সেটি সামনে পেতে দিয়ে বলে, "এই যে এইখানে দুইজনের মতন দিয়ে দ্যান গো !"

    "ভালো, ভালো । মিঠায় নোনতায় এক পাত্র হতে ভাগ করি খাবা, তবে না সুখ," বলতে বলতে খবরের কাগজের ওপরে নেমে আসে একরাশ মুড়ি, কিছু বাতাসা ও দুটি পাকা কলা । মাদ্রির কৌতূহলী চোখের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় শোভন বলল, "এই হল `ফলার' ।" আসরের শুরুতে কাস্টমারি জলযোগ । ফকিরি সংস্কৃতির নিয়ম মেনে ফলার রাখবার পাত্র নিয়ে আসতে হবে অতিথিকেই । ভাগ্যিস খবরের কাগজটা এনেছিলাম-------" বলতে বলতেই হঠাৎ সমাদৃতার মুড়ি ও বাতাসা ভরা হাতটা চেপে ধরে সে বলল, "আগেই মুখে তুলিস না মাদ্রি । ওয়েট কর-------"

    "সে কী রে ? খাবার দিলো, কিন্তু খেতে মানা ?"

    "আহা, একটু দাঁড়া । হচ্ছে-------"

    বলতে বলতেই সকলের নজর ঘুরে গিয়েছিল কেন্দ্রস্থ সেই কলাগাছের মণ্ডপের দিকে । ইরশাদের লাঠির সামনে হাঁটুতে ভর করে বসেছেন এক প্রৌঢ় । প্রদীপের হলদেটে আলো তাঁর মুখে এসে পড়েছে । তালি মারা আলখাল্লায় ঢাকা শরীরটি বসা অবস্থাতেও যথেষ্ট দীর্ঘ দেখায় । সৌম্য মুখশ্রী । শান্ত দৃষ্টি । হাবেভাবে বোঝা যাচ্ছিল, ইনিই আসরের প্রধান মনজুর ফকির হবেন । কয়েক মুহূর্ত লাঠিটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে তিনি হঠাৎ উচ্চকন্ঠে বলে উঠলেন, "আল্লা আলেক ।"

    সঙ্গে সঙ্গে সমাগত হিন্দু-মুসলমান-বাউল-ফকির-বৈষ্ণব-দরবেশ একসঙ্গে জিগির দিয়ে উঠল, "আল্লা আলেক-------"

    সহজ মন্ত্র । সর্বশক্তিমান নন, দুনিয়ার মালিক নন, ঈশ্বর হলেন `আলেক', অর্থাৎ কাছের জন ।

    সেই `কাছের জন'-এর মন্ত্রে ঈশ্বরের প্রাথমিক উপাসনা শেষ করতেই আসরের সকলে মনোযোগ দিলেন ফলারে । বাতাসার সঙ্গে এক মুঠো মুড়ি তুলে নিয়ে মুখে দিল সমাদৃতা । মুড়মুড়ে লালচে মুড়ির সঙ্গে বাতাসার গুড়ের স্বাদ মিশে যাচ্ছিল মুখের ভেতর । বড় সুস্বাদু আহার । সামনে রাখা মুড়ির স্তূপ নি:শেষ হয়ে আসছিল ধীরে ধীরে । আনমনে খেতে খেতেই হঠাৎ সমাদৃতা খেয়াল করল, শোভন কখন যেন হাত তুলে নিয়েছে খাবারের থেকে । তার ভালোলাগাটুকুকে বুঝতে পেরে নীরবে তাদের যৌথ অধিকারের থেকে সরিয়ে নিয়েছে নিজের দাবীটুকুকে । তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে মৃদু হেসে সে জিজ্ঞাসা করল, "আরো নিবি মাদ্রি ?"

    দু'দিকে মাথা নাড়ল সমাদৃতা । আর প্রয়োজন নেই তার । শোভনের সব পেয়েছির ঝোলা থেকে ততক্ষণে বের হয়ে এসেছে এক বোতল জল ।

    মনজুর ফকির তাঁর হাতে ধরা তারবাদ্যটিতে আঙুল বোলাচ্ছিলেন । মৃদুমন্দ শব্দ উঠছে তাতে । বিচ্ছিন্ন সেই নিরবয়ব শব্দখণ্ডগুলি এইবারে হঠাৎ একে অন্যের কাছাকাছি আসতে শুরু করল । ভাঙাচোরা কতগুলি মৃত্খণ্ড যেন এক অলৌকিক আকর্ষণে একে অন্যের ফাটলে জুড়ে গিয়ে তৈরি করছে একটি সুরের নিটোল দেহাবয়ব । পাশে রাখা একটি হারমোনিয়াম এইবারে জেগে উঠে ধরে নিল তারযন্ত্রে ভাসমান সুরশরীরটিকে । তার চড়া, সুমিষ্ট শব্দে সেই দেহটিতে রক্ত-মাংস লাগতে শুরু করেছে । গানটিকেও চেনা যায় যেন প্রায় । অথচ সঠিকভাবে ধরে ফেলা যায় না-------

    - তারপর হঠাৎ করেই সমস্ত আসরকে এক মুহূর্তে স্তব্ধ করে দিয়ে, যন্ত্রসংগীতের সুরের ওপর ভর রেখে উঠে এল তীক্ষণ, চড়া একটি পুরুষকন্ঠ-------

         নয়ন ফিরাও রূপ দেখি
         দেখি বা দয়াল বন্ধু
         নয়ন ফিরাও রূপ দেখি
         এপারে নদী সেপারে নদী
         না জানি সাঁতার,
         হস্ত ধরি করো পার-------
    প্রতিটি পঙ্ক্তির সঙ্গে সঙ্গে পর্দার পরিবর্তনে ত্রক্রমশই উঁচুতে উঠে চলেছিল সেই সুর । প্রয়াত পিতা, গুরু, অথবা অজ্ঞেয় কোনও ঈশ্বর------- ফকিরের ভাষায় যিনি কেবলই কাছের মানুষ------- তাঁর উদ্দেশ্যে লালনশিষ্য পাঞ্জু শা'র অমর প্রার্থনাসঙ্গীত । সমস্ত সভাটিকে মুহূর্তে একটিমাত্র সুতোয় গেঁথে একমুখী করে তুলেছিল সেই গানটি । সুতোর অন্যপ্রান্তটি যাঁর কন্ঠে ধরা সেই মনজুর ফকিরের চোখদুটি বোঁজা । ধীরে ধীরে ভূমি আসন ছেড়ে তিনি উঠে দাঁড়াচ্ছেন ইরশাদ ফকিরের স্মৃতিচিহ্নটিকে সামনে রেখে । কাছাকাছি বসা শ্রোতারা নীরবে সরে গিয়ে জায়গা বানিয়ে দিয়েছে তাঁকে । এখন এই আসরের আর সব কথা থেমে গেছে । এখন এই আসরের সমস্ত চোখ ওই দুটি বুঁজে থাকা চোখে স্থির হয়ে আছে । গোটা সভাটি যেন একটিই জড়ময় জীবদেহ, আর ওই মানুষটি তার প্রাণস্পন্দন ।

         না জানি সাঁতার
         হস্ত ধরি কর পার
    এই পঙ্ক্তিদুটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইতে গাইতে তাঁর পায়ে বোল ফুটল । ধীরে------- বড় ধীরে সমস্ত শরীরটি উঠে নেমে ঘুরে চলেছিল তাঁর । কন্ঠ নয়, সুর ক্ষরিত হচ্ছিল তাঁর সমস্ত সত্ত্বাটি দিয়েই যেন-------

         না জানি সাঁতার
         হস্ত ধরি করো পার
         আমি অধম গুণাগার
         এপারে ওপারে নদী
         উথলিছে ঢেউ
         কাকুতি মিনতি করি
         সঙ্গে নাই কেউ
         নয়ন ফিরাও রূপ দেখি
         দেখি বা দয়ালু বন্ধু-------
    - কখন যে গান শেষ হয়ে গিয়েছে, খেয়াল ছিল না সমাদৃতার । হঠাৎ খুট করে একটা যান্ত্রিক শব্দ হতে পাশের দিকে ফিরে দেখল শোভন তার ছোট টেপরেকর্ডারটার সুইচ বন্ধ করছে । হঠাৎ চমকে উঠে সে বলল, "এ মা, আমার টেপটাই বের করতে ভুলে গেলাম যে ! ছি ছি-------"

    শোভন হাসছিল । বলল, "ক্লাসে আমার কত নোট তুই কার্বন-কপি করে দিয়েছিস বল তো মাদ্রি ! এইবারে তোর নোট আমার কপি করবার পালা । ও নিয়ে তুই মাথা ঘামাস না । রেকর্ডিংটা আমি দেখে নিচ্ছি । তুই মন দিয়ে গান শোন । বারবার তো আর এমন আসতে পারবি না !"





    কথাটার মধ্যে কোথাও একটা সূক্ষ্ম দীর্ঘশ্বাস লুকোনো ছিল কি ? হতে পারে । মাদ্রি সেদিকে নজর দেবার অবকাশ পেল না আর । কারণ ততক্ষণে আসরে উঠে দাঁড়িয়েছেন সন্ধ্যাবেলার সেই কালো আলখাল্লা পরিহিত, দীর্ঘদেহ মানুষটি । হাতের আনন্দলহরিতে দু তিনটি টোকা দিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়েছেন গানের ভেতর-------

         আছে হাজার হাজার সখের বাজার
         এক-এক দ্রব্যের নিশানী
         সারি সারি বসে দোকানি
         এপারে ওপারে নদী
         তারা করতেছে আমদানি
         মূল্য দিয়া ত্রক্রয় করিয়া
         নিতেছে সব ধনী
    বাঁশিতে ছোট ছোট অসন্তত সুরবিন্যাসে দ্রুতলয়ে সঙ্গত করে চলে তার সাথে । মিশে যায় সিংগল রিড হারমোনিয়ামের চড়া সুর------- আর যন্ত্রসুরের সেই ঠাসবুনোট পটভূমিতে একটি স্বর্ণসূত্রের মতই কথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে নকশা ফুটিয়ে দৃপ্ত, ছন্দময় পদক্ষেপে ঘুরে চলে এক চকিতগামী কালো চিতা যেন-------

    গীত, বাদ্য ও নৃত্যের সেই সম্মিলিত আবেদন, বোধকে অতিক্রম করে সরাসরি দর্শকদের চেতনার মূলে গিয়ে নাড়া দেয় বুঝি । তীক্ষণ একাগ্রতায় তাদের সমগ্র সত্ত্বাই যেন কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকে আসরের কেন্দ্রস্থলের দিকে ।

    নিজেকে এইবারে সত্যিই ভিনদেশি বলে ঠেকছিল সমাদৃতার । ওই শব্দমালাটি তার কাছে এক দুর্বোধ্য ধাঁধার মতন ঠেকছে কেন ? অর্থভেদ করবার জন্য দু একবার শোভনের দিকে ফিরে তাকিয়েছিল সে । কিন্তু বন্ধুটি তার, এই মুহূর্তে তার পাশ থেকে ফিরে চলে গেছে বহুযোজন দূরে, তার আশৈশব পরিচিত বৃত্তে । আশেপাশের আর সমস্ত প্রাকৃতজনের চোখের সেই অভিভূত অথচ সুতীব্র দৃষ্টি এসে ভর করেছে তার চোখেও । সমস্ত চৈতন্য দিয়ে সে-ও স্পর্শ করে চলেছে এই সঙ্গীতের ইঙ্গিতময় এবং অস্পষ্টভাষী আত্মাকে ।

    শুধু সমাদৃতা এই জনঅরণ্যে একলা বসে থাকে । অনুষ্ঠানবাড়ির বাইরে অপেক্ষারত ভিখারিণীর মত সে শুধু দেখতে পায় মনমোহন আহার্যের রূপগুণগুলিকে, তার গন্ধ ভেসে আসে তার নাকে, কিন্তু তার প্রকৃত আস্বাদ নেবার অধিকারিণী সে নয় । তার জন্ম অন্য কূলে, অন্য স্তরে । সেই কূলের বাসিন্দারা এই আনন্দযজ্ঞে প্রকৃত আত্মিক অংশগ্রহণের অধিকারী নয় ।

    একটা তীব্র অপমানবোধ গড়ে উঠছিল তার মধ্যে । আশেপাশে সবাই যেন তাকে দেখছে । নীরবে, সবার অলক্ষ্যে যেন একে অন্যের প্রতি ইশারা করে দেখাচ্ছে তাদের মধ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসা এই বিজাতীয় জীবটিকে, যার কিনা জন্ম ও কর্মগতভাবে তার আনন্দের ভুবনে ঢোকবার অধিকার বা সাধ্য কোনটাই নেই । আর, এই অপরিচিত দুনিয়ায় যার ভরসায়, যার হাত ধরে সে এসেছিল, সে নিজেও এখন-------

    ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে । শোভন কিছুই খেয়াল করেনি । তার সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ রয়েছে ওই গানটির প্রতি । ধীরে ধীরে, মানুষজনের মধ্যে দিয়ে পথ করে উঠোনের একেবারে বাইরে চেল এল সে । ঘরের দাওয়ায় কিছু মহিলা একত্রে বসেছিলেন । তাকে উঠোন ছেড়ে এগিয়ে আসতে দেখে নীরবে একটা পিঁড়ি এগিয়ে দিলেন একজন । তাতে বসে বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে সামনের দিকে চাইল সমাদৃতা । এখান থেকে গানের শব্দ অনেক ক্ষীণ । উঠোনের চটের ছাউনি শেষ হয়ে গিয়েছে ঘরের খানিক আগেই । তার সামনে, বারান্দার বাইরে একফালি রাতের আকাশে পূর্ণিমার ঠাণ্ডা চাঁদটা সাঁতরাচ্ছিল ।

    খানিকক্ষণ সেইখানে বসে থাকবার পর ফের উঠে পড়ল সমাদৃতা । খোলা আকাশ তাকে টানছে । ধীরে ধীরে বাড়ির একেবারে বাইরে এসে দাঁড়াল সে । পেছনে উঠোন থেকে গানের শব্দ ভেসে আসছিল । সামনে, পথের অন্যপাশে আর একটা বাড়ি । তার প্রশস্ত উঠোন চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে । হাতের বাঁয়ে ছড়িয়ে আছে কুয়াশামাখা, আলোকিত বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্র । পথ চলে গিয়েছে তার বুক চিরে । সেই নির্জন পথের একপাশে ধুলোমাটির ওপরেই বসে পড়ল তরুণীটি ।

    "মাদ্রি !"

    চমক ভেঙে ঘুরে তাকাল সমাদৃতা । শোভন কখন যেন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে । সে ঘুরে তাকাতে মৃদু হেসে বলল, "জহিরুল এসে বলল, তুই বাইরে একা একা এসে বসে আছিস । তাই উঠে এলাম । কী হল ? ভালো লাগছে না ?"

    মাথা নাড়ল মাদ্রি, "না না, ভালো তো লাগছে ! খুব ভালো লাগছে । তবে ওখানে বড় ভিড় । এখান থেকে একলা একলা বসে শুনতে আমার আরও বেশি আরাম হচ্ছে । তুই যা না, গিয়ে বোস না ভেতরে ! আমি ভালোই আছি তো !"

    "উঁহু । বাইরে এসে দেখছি আমারও বেশ ভালো লাগছে । একটু দূর থেকে শোনা ! দারুণ ! কিন্তু, এখানে নয় । আয় আমার সঙ্গে । সুন্দর জায়গা আছে বসবার ।"

    "গান রেকর্ড করছিলি যে !"

    "প্রভাতের কাছে টেপ দিয়ে এসেছি । ও সামলে নেবে । চল । হাতটা ধর-------"

    শোভনের হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল মাদ্রি । তারপর রাস্তা পেরিয়ে তারা বিপরীতদিকের বাড়িটির উঠোনে গিয়ে দাঁড়াল । শান্ত নিস্তব্ধ বাড়িটি চাঁদের আলোয় বুঁদ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । তার ঘরগুলো খালি করে বাসিন্দারা গিয়েছে গান শুনতে । শুধু একটি ঘর থেকে কোন এক বৃদ্ধের গলা খাঁকারির শব্দ শোনা যায় মাঝে মাঝে । একপাশে গোয়ালে গরুগুলির লেজ নাড়িয়ে মশা তাড়াবার ছপ ছপ শব্দ পাওয়া যায় কেবল । একটি জনহীন ঘরের দাওয়ায় উঠে বসল শোভন । সমাদৃতা দাঁড়িয়ে ছিল তার ঠিক সামনে, সেই উজ্জ্বল চাঁদের নিচে । তার চুল বেয়ে পিছলে যাচ্ছিল গলিত মোমের মতন চাঁদের আলো ।

    রাত বেড়ে চলে । দুটি মানুষমানুষীর স্থানু ও ঘনিষ্ঠ অস্তিত্ত্বকে ঘিরে সময়ের স্রোত বহে যায় অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে । অন্তরের গভীরে সেই ভবিষ্যমুখী বহুধাবিভক্ত স্রোতের দুটি ভিন্নগামী ধারার অমোঘ টান অনুভব করে তারা । এই জাদুরাত্রির কোলে, সঙ্গীতকে অবলম্বন করে তারা, সেই ভিন্নগামী টানকে মাত্রই কিছুক্ষণের জন্য ব্যর্থ করে দিয়ে বড় কাছাকাছি এসেছিল, স্রোতে ভাসমান দুটি তৃণখণ্ডের মত । এই ঘনিষ্ঠতা সত্য, তবু আর দশটা সত্যের মতই, শেষ সত্য নয় । সেই কথাটি অন্তরের গভীরে উপলব্ধি করেই যেন, প্রকাশ্য কোনো ভাববিনিময় ছাড়াই তারা বড় নিবিড়ভাবে পরস্পরের সঙ্গটিকে উপভোগ করে চলে । আরও একটুক্ষণ, আর ক'টিমাত্র মুহূর্ত------- তরুণীটির হাতদুটি ধরা থাকে তরুণটির শ্রমকর্কশ মুঠিতে । ত্রক্রমশ তার চাপ বাড়ে । দুটি তরুণ শরীর একে অন্যের ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে । এবং স্বর্গ নেমে আসে সেই অনন্তসময়ব্যাপী কালখণ্ডটিতে-------

    "শোভন । কোথায় রে ? শ্রীধরের দল উঠছে এবারে । পাল্লা শুরু হবে," প্রভাতের গলা । ও বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক মুখ ঘুরিয়ে ডাকছে ।

    "কে প্রভাত ? তুই গিয়ে বোস । আসছি আমরা," গলা উঁচিয়ে প্রত্যুত্তর দেয় শোভন । তাদের একত্রবাসের মেয়াদ এইবারে শেষ হয়েছে । তার গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকা মাদ্রির হাতদুটি ছাড়িয়ে নিতে নিতে সে বলে, "চল । ওঠ । এ জিনিস আর কখনো দেখতে পাবি কিনা সন্দেহ ।"

    অনুষ্ঠানের শেষ অধ্যায় এই পাল্লাগান । দুই গায়কের সাঙ্গীতিক দ্বৈরথ, কিন্তু নিছক কবিগান এ নয় । গান এখানে গভীরতর তত্ত্বআলোচনার বাহনমাত্র । আসরে পৌঁছে প্রভাতের কাছে জানা গেল, আজ পাল্লা হবে গুরুশিষ্য সংবাদ নিয়ে । ভিন্ন ভিন্ন পদকর্তার রচিত গানগুলি চয়ন করে করে, কখনো বা তাত্ক্ষণিক গান বেঁধে প্রশ্নোত্তরের ঢংয়ে চলবে সঙ্গীতসংগ্রাম । দার্শনিক তত্ত্ব ও প্রশ্নকন্টকিত সমস্যার উথ্থাপন করবেন শিষ্য । তত্ক্ষণাৎ গুরু তাঁর সংশয়ের নিরশন করবেন উপযুক্ত জবাব দিয়ে, অথবা প্রশ্নের উত্তরে উথ্থাপন করবেন কূটতর কোন প্রশ্নের । সেই উতোরচাপানের ত্রক্রীড়াচ্ছলে শ্রোতার সামনে খুলে যাবে নতুন নতুন উপলব্ধির দরজা । প্রশ্নোত্তরের কষ্টিপাথরে ঘষা খেয়ে অতিপরিচিত কোন গান, নতুনতর কোন দার্শনিক সমস্যা বা তার সমাধানের রূপ ধরে এসে দাঁড়াবে হয়তো ; কখনো বা প্রাপ্তি হবে আনকোরা নতুন কোনো গান । ইন্টেলেকচুয়াল ঘাতপ্রতিঘাতে সৃষ্ট অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো সেই গান মুখ থেকে মুখান্তরে ভেসে হয়তো বা দীর্ঘজীবি হবে, অথবা, ব্যর্থ কোন স্ফুলিঙ্গের মতো সঙ্গীতের সেই দ্বৈরথে জন্ম নিয়ে সেইখানেই ফের মিলিয়ে যাবে ক্ষণিকের ঔজ্জ্বল্য বিকীরণ করে ।

    আসরে ফিরে এলেও তার ভেতরে আর ঢুকে আসেনি তারা দুজন । কেন্দ্রীয় আলোকবৃত্তের বাইরে, চাঁদের আলোয় পিঠ দিয়ে বসে পড়েছিলো আসরের একেবারে একপ্রান্তে । তাদের ঠিক সামনে বসেছে জালনা-গোবিন্দপুরের সুধীন বৈরাগির আখড়ার একটা দল । কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছিল, মাত্রই দুটি গান গাইবার সুযোগ পেয়েছে তারা আজকের আসরে । প্রাণের সাধ মেটেনি তাতে । গঞ্জিকাগন্ধী বিড়িতে টান মারে ঘন ঘন তারা । গল গল করে ছড়িয়ে পড়ে নীলচে ধোঁয়া আর তার সাথেসাথেই এর তার কন্ঠ থেকে বের হয়ে আসে উন্মুখ কোন গানের কলি------- আসরে গাইতে না পারা কোন প্রিয় সঙ্গীতের অংশ ।

    তেমনই আরও সব বিচ্ছিন্ন সঙ্গীতখণ্ড চারপাশেই শোনা যাচ্ছিল ইতি উতি । তারপর হঠাৎ সেই শব্দকে ডুবিয়ে দিয়ে ভেসে উঠল শ্রীধর দাসের প্রাচীন অথচ পৌরুষদৃপ্ত কন্ঠে পাঞ্জু শা'র পদ-------

    কাল কাটালি কালের বশে

    মিছে মায়ায় এ ভববন্ধনে------- এ-এ

    মুহূর্তে, যেন এক অদৃশ্য জাদুদণ্ডের স্পর্শে নিস্তব্ধ হয়ে গেল গোটা আসর । শ্রীধরের গান শেষ হতেই উঠে দাঁড়াল এক তরুণ । বয়স বেশি নয় । ছোটখাটো দৃঢ়বদ্ধ চেহারা । চুড়ো করে বাঁধা চুলে, গৈরিক পোশাকে তাকে একটি ছবির মতো লাগে । জোড়হাত করে প্রথমে গুরুকে, তারপর আসরকে প্রণাম করে সে ফিরে দাঁড়াল শ্রীধরের দিকে মুখ করে । হারমোনিয়ামের মৃদু চাপা সুরের সঙ্গে গলাটিকে মিলিয়ে প্রশ্ন করল-------

    কাল কাটালাম মায়ার বশে হে গুরুদেব, মায়া দহে অবগাহন করে । তাতে কি চৈতন্যের দোষপ্রাপ্তি হয় ? আমায় বুঝায়ে দেন গো গুরু, বুঝায়ে দেন-------

    বলতে বলতেই হারমোনিয়ামের সুর তীক্ষণতর হয়ে উঠে নির্দিষ্ট এক চাল ধরে নেয় । তার তালে তালে পা ফেলে দুলে ওঠে প্রশ্নোন্মুখ শিষ্যের শরীর । গড়ে ওঠে গান-------

         "গেড়ে গাঙেরে খ্যাপা
         হাপুশ হুপুশ ডুব পাড়িলে
         এবার মজা যাবে বোঝা
         কার্তিকের ওলানের কালে-------
         গেড়ে গাঙেরে খ্যাপা-------"
    মৃত্যুর প্রতীক শীত । আর অগ্রদূত প্রৌঢ়ত্বের প্রতীক হল কার্তিক মাস । সেই জীবন-হেমন্তে মায়ারূপ জলাশয়ে অবগাহনের অর্থ তো সাক্ষাৎ মৃত্যু ! চৈতন্যের নাশ । এর কাটান কী ? গুরু তুমি বলে দাও হে ।

    হারমোনিয়াম, শ্রীখোল ও বাঁশীর বৃন্দবাদনে, শেষ হয়ে যাওয়া গানটির মুখড়ার সুরটি নানা বিচিত্র রূপে ঘোরাফেরা করে চলে খানিকক্ষণ । তারপর শ্রীধরের নি:শব্দ ইশারা পেয়ে তা আবার এক বিশেষ সুরের রাস্তা ধরে । গুরু উঠে দাঁড়িয়েছেন জবাব দেবার জন্য------- শিষ্যের দিকে আঙুলের ইশারা করে তিনি গেয়ে ওঠেন-------

         দম কষে তুই পড়না ক্ষ্যাপা প্রেমের পুকুরে
         ধরবি যদি মীন মকরা কাম রেখে দে তফাতে
         গহীন জলে বাস করে মীন
         গুরুবলে ছড়াতেছে ঝিম
         যে চিনেছে সেই জলের হিম মীন ধরা দেয় তার হাতে
    প্রেমে ও কামনায় না গুলোলেই `কার্তিকের হিম' থেকে মুক্তি । নিষ্কাম প্রেমই মায়ার চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দেবার শক্তি রাখে । কামনাবিহীন হয়ে মায়াসমুদ্রে ডুব দিয়ে তার গভীরে পৌঁছোও যদি, তবে সেই গভীর জলের বাসিন্দা মীনরূপ জ্ঞানের সন্ধান পাবে-------

    এইভাবে প্রশ্ন ও প্রতিপ্রশ্নে এগিয়ে চলে পাল্লাগানের ধারা । শুরুর খানিকক্ষণের মধ্যেই তার খেই হারিয়ে ফেলেছিল সমাদৃতা । এলোমেলো কথা ও সুরের স্রোতে ভাসতে ভাসতে কখন যে দু'ঘন্টা সময় কেটে গেল তার খেয়াল সে রাখেনি ।

    অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে এইবারে । হাতের ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে রাত দুটো । লোকজন উঠে পড়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে । জনা দুয়েক বৃদ্ধ ঘুরে ঘুরে তাড়া দিচ্ছিলেন, "হাত ধুই আসেন গো সব । সেবা করিয়ে নেন এইবেলা । রাত তো ভোর হতে গেল প্রায় ।"

    কাছেই একটা পুকুর রয়েছে । সঙ্গীত-ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত অতিথিরা এইবার সেই দিকে দলে দলে রওয়ানা হয়েছেন । সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে বের হয়ে এসে প্রভাত তাদের সামনে এসে দাঁড়াল । হাতে গোটাকয়েক ক্যাসেট আর শোভনের টেপটা । সঙ্গে একটা হাতে লেখা কাগজ ।

    "নাও । সব গানই রেকর্ড করা গেছে । প্রথম লাইন আর গায়কের নামও নোট করে নিয়েছি । এবারে হাতমুখ ধুয়ে নেবে চল ।"

    "হ্যাঁ, এই উঠি । ক্যাসেটগুলো ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়িয়ে সমাদৃতার হাতে জলের বোতলটা ধরিয়ে দিল শোভন, "তুই খাবার জল দিয়েই হাত ধুয়ে নে । আমরা পুকুর থেকে হাত ধুয়ে আসছি । অন্ধকারে পিছল ঘাটে তোকে আর যেতে হবেনা ।"

    সামান্যই আয়োজন । মোটা, লালচে চালের ভাত, ধূমায়িত ডাল আর মাছভাঙা । বিচিত্রনামা পদটিতে মাছের গন্ধ ও স্বাদ মেলে, কিন্তু দেখা মেলে না । সমাদৃতার কৌতূহলী মুখ দেখে পাশে বসে খেতে থাকা একজন বয়স্ক গায়ক বুঝিয়ে দিলেন, সামান্য কিছু মাছকে মুচমুচে করে ভেজে নিয়ে তাকে মিশিয়ে দেয়া হয় আলু-বেগুনের ঝোলের সঙ্গে । তাই নাম মাছভাঙা । ওতে সামান্য মাছে বহু অতিথিকে মাছের স্বাদ দেয়া যায় । হাসতে হাসতে মানুষটি বলছিলেন, "এ-ও সেই সাঁইয়ের লীলার মতন গো মা, পঞ্চেন্দ্রিয় সজাগ থাকলি তাঁর গন্ধ পাবা, পরশও পাবা সর্বভূতে, কিন্তু দর্শনটি পাবা না ।"

    খাওয়ার শেষে হাত ধুয়ে এসে বসতেই তীব্র শীতের অনুভূতি ঘিরে এল তার শরীরে । অনুষ্ঠান শেষে সেই সভাচত্বরের ওপরেই এখানে ওখানে দল বানিয়ে বিশ্রামের আয়োজন চলেছে । কেউ কেউ শুয়েও পড়েছেন আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে । সমাদৃতা ঘড়িতে দেখল, রাত তিনটে । চোখ জুড়ে আসছিল তার । অথচ একটা অস্বস্তিও কাজ করছিল মনের মধ্যে------- এইখানে, হাজারো মানুষের মধ্যে শুয়ে-------

    "কী রে, ঘুম পাচ্ছে ?"

    "পাচ্ছে, কিন্তু-------"

    শোভন নিচু হয়ে তার হাত ধরে টানল, "আয়, জায়গা আছে ।"

    শোভনের পিছু পিছু উঠোন ছেড়ে বারান্দায় উঠে একটি ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সে । তার অন্ধকার অন্দরের দিকে ইশারা করে শোভন বলল, "এ ঘরে মেয়েরা শুয়েছেন সব । বড় ঘর । জায়গা একটা হয়ে যাবে । মেঝেতে মোটা চাটাই পাতা রয়েছে । ঠাণ্ডা লাগবে না । ঢুকে গিয়ে একটা কোন খালি জায়গা দেখে শুয়ে পড় কাঁথা মুড়ি দিয়ে ।"

    অন্ধকার ঘরটির ভেতর বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘুমন্ত মানুষের নি:শ্বাস ও নড়াচড়ার শব্দ ভেসে আসছিল । সেই দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে শোভনের দিকে ফিরল সমাদৃতা, "আর তুই ?"

    "আমিও আসরে আর শোব না বুঝলি ! বাইরে গিয়ে কোথাও একটা-------"

    "আর আমি একটা সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় অন্ধকার একটা ঘরে একা একা------- উঁহু । পারবো না শোভন । আমিও তোর সঙ্গে সঙ্গে থাকবো ।"

    তার বাহুমূলে সজোরে আঁকড়ে ধরা হাতটির দিকে তাকিয়ে শোভন বলল, "তাই চল তবে ।"

    সমস্ত আসরটি নিস্তব্ধ হয়ে গেছে । চাঁদ ঢলেছে পশ্চিমে । তার তীব্রোজ্জ্বল আলোতে ভেসে গিয়েছে উত্তরের কৃষিজমি । তাকে পেছনদিকে রেখে সরু পথটি ধরে তারা দক্ষিণে নদীর দিকে হেঁটে যায় । অজস্র প্রাচীন ও নবীন গাছ ছেয়ে আছে সেই পথের দু'পাশে । তাদের পত্রমুকুট চুঁইয়ে নেমে আসা ক্ষীরের দলার মতন খণ্ড খণ্ড চন্দ্রালোক ছড়িয়ে থাকে তাদের চারপাশে । সমাদৃতার মুখটির ওপর মাঝেমাঝেই নড়েচড়ে সরে যাচ্ছিল সেইসব চন্দ্রখণ্ড ।

    বেশ খানিকটা হেঁটে এসে পথের পাশে ছোট একটা ছাউনি মতো পাওয়া গেল । তার নিচে চওড়া একটা বাঁশের মাচা বাঁধা । সেইদিকে দেখিয়ে শোভন বলল, "আয় মাদ্রি । যেটা খুঁজছিলাম, পেয়ে গেছি । এটা এ গ্রামের মিটিং স্পট বলতে পারিস । দিনের বেলা ছেলেপুলেরা বসে আড্ডা দেয় । এইরকমই কোন একটা জায়গায় ফাঁকায় ফাঁকায় একটু ঘুমিয়ে নেবার মতলবে ছিলাম ।"

    "আমি সঙ্গে এসে সেটা ভেস্তে দিলাম, বল ?"

    "হ্যাঁ, ভেস্তে দিলি সেটা ঠিক, কিন্তু তার বদলে দুজন মিলে খানিকক্ষণ বসে গল্প করা সেটাও বেশ ভালো ব্যাপার কিন্তু ।"

    বাতাসে হিমস্পর্শ ছিল । শেষরাত্রের চাঁদের আলো গায়ে মেখে পরস্পর মগ্ন হয়ে বসেছিল নির্বাক মানুষমানুষীদুটি । খেয়াল করেনি তারা কোন ফাঁকে চাঁদ অস্ত গিয়ে আলো ফুটেছিল পূর্বে । সময় বড় রহস্যময় সঙ্গী বটে । সামান্য সেই কয়েকটি ঘন্টা তাদের কাছে ঠেকেছিল যেন যুগান্তব্যাপী এক একত্রবাসের মতো ।

    অবশেষে, যেন বা একটি সম্পূর্ণ জীবনই একত্রে পার হয়ে এসে ফের যখন জেগে উঠল তারা পরিচিত পৃথিবীতে, তখন সকালের আলো ফুটেছে সবে । পুবের দিক ফরসা হয়ে আসছিল ধীরে ধীরে । আকাশে তখনও দুটি একটি তারা রয়ে গেছে । এইবারে ফেরবার পালা । শোভন তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে যাচ্ছিল । সমাদৃতা তার হাত ধরে আটকালো, "আর একটুখানি বোস শোভন । কয়েকটা কথা ছিল ।"

    ম্লান চোখে তার মুখের দিকে চাইল শোভন । ফার্স্ট ইয়ারে সমাদৃতাকে দেখবার পর থেকে, নিজেরই অজ্ঞাতেই বহু বছর সে এই অবশ্যম্ভাবী মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করে এসেছে । এমনকি সমাদৃতার সেই স্বীকারোক্তির দিনটিতেও ট্রেনের জানালা ধরে তার চোখের দিকে চেয়ে নিজের অন্তরে সে ঠিকই অনুভব করেছিল সেই ধ্রুব পরিণতিটির ইঙ্গিত । যা কখনো হবার নয় তারই আশায় তারা দুজনেই বুক বেঁধেছিল একথা সত্যি, কিন্তু চেতনার গভীরে নিয়তির নির্দেশিত পথবিভাজনটির কথা তারা হয়তো দুজনেই অনুভব করত । তবু এক দুর্বল আশায় বুক বেঁধে সে প্রশ্ন করল, "এখনই বলতে হবে ? পরে বললে হয় না ?"

    "না হয়না । এরপর আর সময় জুটবে না আমার । শোভন, তোকে আমি ভালোবাসি । সেই ভালোবাসার জোরে ভেবেছিলাম, তোর সঙ্গে থাকবার জন্য আমি প্রয়োজনে সব ছেড়ে তোর এই গ্রামের ঘরেও এসে উঠতে পারি । আবার একবার ভেবেছিলাম, তোকে জোর করে, যেভাবে পারি পরীক্ষাটা দিইয়ে দু'জনে মিলে একটা নর্ম্যাল জীবন গড়ব । তুই কতটা বিতৃষ্ণায়, শুধু আমার মুখ চেয়ে, আমার জন্য, সে প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলি সেটা তোর চেয়েও সম্ভবত আমি বেশি অনুভব করতে পারি । সে জন্য যন্ত্রণা আমার একটা ছিলই । গত কয়েকদিন ধরে হঠাৎ নিজেকে খুব স্বার্থপর ঠেকছিল, জানিস ! বারবার মনে হচ্ছিল, আমি শুধু নিজের ভালোবাসার দাবিকে ব্যবহার করে আমার পারসপেকটিভ থেকে সুখের সংজ্ঞা তৈরি করেছি । আর, তুই সব যন্ত্রণাকে মেনে নিয়ে শুধু আমার জন্য সেটা মেনে নিচ্ছিস । নিজেকে ছোট ঠেকছিল খুব । তারপর ঠিক করলাম, তোর মতো আমিও তো আমার দুনিয়াটাকে ছেড়ে তোর কাছে চলে আসতে পারি ! ভালোবাসাটাই যদি আসল হয় তাহলে কে কার জেদ বা স্বপ্ন ছাড়ল সে তর্কের তো কোনো অর্থই থাকে না আর ।"

    "তোকে না দেখে আমি আর থাকতে পারছিলাম না শোভন । কষ্ট হচ্ছিল । বাবা তো চিরকালই আমার বেস্ট ফ্রেণ্ড । বাবাকে সব কিছু খুলে বললাম । শুনে বাবা বললো, সোজা তোর কাছে চলে এসে ঘুরে যেতে দু'একদিন । তারপর ডিসিশান নিতে । চলে এসেছিলাম তাই শোভন । আর তারপর, কাল সকাল থেকে এই অবধি তোর সঙ্গে রইলাম । পুরো সময়টা ধরে তোর প্রতিটি আচরণে ফুটে উঠতে দেখলাম তোর প্রকৃত প্রায়রিটিগুলোকে । তোর ছাত্রছাত্রী, তোর গানের আসর, তোর উদ্দাম বাউণ্ডুলে ভ্রমণ, এদের সবার জায়গা তোর কাছে আমার জায়গার থেকে ওপরে । ব্যাপারটা থিওরিটিক্যালি জানা ছিল আমার অনেক দিন ধরেই । কিন্তু বাস্তবে যখন বারংবার সেগুলোকে চোখের সামনে ঘটতে দেখলাম, যখন দেখলাম, আমি যদি সব কিছু ছেড়েছুড়ে উপযাচিকা হয়েও তোর কাছে চলে আসি তবুও তোর সব কর্তব্য, সব আনন্দ, সব উপেভাগের শেষে ক্লান্ত, গভীর রাতেই একমাত্র আমার জন্য সময় হবে তোর, তা-ও যদি আমি অসংকোচে হ্যাংলামো করতে পারি তবেই, তখন আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল । প্রতি মুহূর্তে কেবল মনে হচ্ছিল, ফিরে যাই এখান থেকে, জঙ্গল গ্রাম, অন্ধকার রাত কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে । প্রিয় পুরুষের নেগলেক্ট যে মানুষকে কতটা ত্রক্রুদ্ধ করতে পারে তা আমি কাল থেকে বারংবার অনুভব করে চলেছি । তবু, কাল প্রথম ও শেষ রাতে দু দু'বার যখন তোর কাছে এলাম, তোকে ছুঁলাম, দু'বারই আমি ফের গলে গেলাম শোভন । একবার তীব্র রাগ আবার পরমুহূর্তেই তীব্র আকর্ষণ, ইমোশনের এই ত্রক্রমাগত উথ্থানপতন আমার স্বভাববিরুদ্ধ । শোন শোভন, তোকে আমি ভালোবাসি এ কথা সত্যি । কিন্তু তোকে নিয়ে তোর জগতে ঘর আমি করতে পারবো না । একদিকে তীব্র অভিমান আর রাগ, আর অন্য দিকে প্রবল আকর্ষণ এই দুয়ের ত্রক্রমাগত পেষণে আমি ভেঙে চুরমার তো হবই, তোর জীবনটাও নষ্ট হবে । অন্যদিকে, এই জগতে যে আনন্দে তুই ডুবে আছিস তোর বিচিত্র সব খেলা নিয়ে । তার থেকে, শুধু নিজের ভালোলাগার উপকরণ বানিয়ে তোকে উপড়ে নিয়েও যেতে পারবো না আমি । তাহলে বাকি জীবনটা একটা গভীর অপরাধবোধে ডুবে থাকতে হবে আমাকে । এই ব্যাপারটা গত প্রায় চব্বিশটা ঘন্টা তোর সঙ্গে কাটিয়ে আমি বড় ভালো করে বুঝতে পেরেছি । তার চাইতে, তোকে আমি মুক্তি দিলাম । নিজের জীবনটাকে নিজের ইচ্ছেমতো বাঁচ তুই ।"

    তার জলভরা চোখদুটির দিকে তাকিয়ে শোভন প্রশ্ন করল, "আর তুই ?"

    "আমার ব্যবস্থা আমি ঠিক করে নেবো । আমি ভালো থাকব শোভন । চাকরি করব, ছেলেপুলে নিয়ে সংসারও হবে । সাধারণ মেয়ে আমি । আমার আশা আকাঙ্খা, রাগ, অনুরাগ সবই সেই মাপেই গড়া । দু:খ বা সুখ, এর কোনোটাকেই খুব বেশিদিন ধরে জিইয়ে রেখে তীব্রভাবে অনুভব করে চলবার মতো মনের শক্তিই আমার নেই । কাজেই সেন্স অব লস যে একটা হবে না তা নয়, কিন্তু সেটা অসহনীয় কিছু হবে না । বিশেষ করে তুই সুখে আছিস, আনন্দে আছিস এইটা যখনই ফিল করব, সেটা একটা বিরাট সান্ত্বনা হবে আমার ।"

    "মাদ্রি, তুই ভুল করছিস । দেখ, পরীক্ষাটা তো আমি দিচ্ছি ! আমি তো তোর জন্য-------"

    "না শোভন । পরীক্ষাটা তুই দিবি না । দিলে তারপর সারাটা জীবন কষ্ট পাবি, আর আমাকে দুষবি । সে আমি সইতে পারবো না । প্লিজ-------"

    ----------


    ভোর গড়িয়ে সকাল হল । নদীটিও জেগে উঠেছে ফের । তার দুপাশে সদ্যজাগ্রত গ্রামগুলির লোকজনের আনাগোনা । ঘাটে ঘাটে মানুষের জটলা, কথা বলাবলি, বাসনের ঠুংঠাং, কাপড় আছড়াবার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি । এই সবকিছুর মধ্যে দিয়ে নৌকাটি নীরবে মনোহরগঞ্জের ঘাট ছাড়িয়ে এগিয়ে যায় কিছুদূরের আতাখালির গঞ্জের উদ্দেশ্যে । তার যাত্রীদের এই মুহূর্তে সব কথা ফুরিয়ে গিয়েছে । কথা বলছিল না প্রভাতও । গত রাত্রের গান ও জাগরণের স্মৃতি ও ক্লান্তি তাকেও আচ্ছন্ন করে রেখেছে এই মুহূর্তে । মুরলীপুর থেকে একটা বিশাল বাঁক নিয়ে চূর্ণী নদী ফের পুব থেকে উত্তরাভিসারী হয়ে এগিয়েছে । ফলে আতাখালির গঞ্জ থেকে শান্তিহাট রেলওয়ে স্টেশন তুলনায় বেশ কাছেই পড়ে । আধঘন্টা পরপর ট্রেকার সার্ভিসও আছে স্টেশন অবধি । অতএব ঠিক হয়েছে ওই পথেই ফিরে যাবে সমাদৃতা ।

    নৌকার যে মাথায় শোভন দাঁড় হাতে বসেছে তার কাছে, তার পায়ের ঠিক নিচে পাটাতনে বসে ছিল সমাদৃতা । নিয়মিত ব্যবধানে তার পাশ দিয়ে ছপ ছপ শব্দ করে জল কেটে চলে দাঁড়টি । সেইদিকে চেয়ে থেকেও সে অনুভব করতে পারছিল, বারবার শোভনের চোখদুটি এসে স্থির হচ্ছে তার ওপরে । তারপর ফের তা উধাও হচ্ছে অন্য কোনখানে ।

    বেলা আটটা নাগাদ আতাখালির ঘাটে এসে নৌকা বাঁধল প্রভাত । টলমলে পাটাতন থেকে হাত ধরে সমাদৃতাকে পাড়ে তুলে এনে দাঁড় করিয়ে দিল শোভন । তারপর প্রভাতের দিকে ঘুরে বলল, "তুই বরং ফিরে যা প্রভাত । আমি এখন ফিরব না । মা'কে একটু বলে দিস, চিন্তা না করে যেন ।"

    হঠাত্‌, যেন একটা বিদ্যুচ্চমক খেলে গেল সমাদৃতার গোটা অস্তিত্ত্ব জুড়ে । প্রভাত ততক্ষণে নৌকার দড়ি খুলে দিয়েছে । স্রোতের অনুকূলে ভেসে চলেছে নৌকা মনোহরগঞ্জ হয়ে মুরলীপুরের দিকে । সেই দিকে চোখ রেখে প্রায় ফিসফিস করে সমাদৃতা জিজ্ঞাসা করল, "আ-আর তুই ?"

    তার গলার কাঁপুনিটুকু কি টের পেল শোভন ? কে জানে । একটুক্ষণ নীরব থেকে শান্ত গলায় বলল, "আমি ? তোকে শান্তিহাটের ট্রেকার ধরিয়ে দিয়ে আমি অন্যদিকে যাব একটু ক'দিনের জন্য । মা'কে তাই একটা খবর পাঠিয়ে দিলাম প্রভাতকে দিয়ে ।"

    ঠোঁট কামড়ে ধরে একটুক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে রইল সমাদৃতা । তারপর, নিজেকে সামলে নিয়ে একেবারে স্বাভাবিক গলায় বলল, "কোথায় যাবি ?"

    "যাব একটু ফুলেতারার দিকে । উসমানদের গ্রামে যাব ।"

    "উসমান-কে ?"

    "ওই যে রে, কালকে রাতে আসরে উসমানকে দেখলি না ? তোর পেছনেই তো বসেছিলো । আলকাপ আর পঞ্চরসের তত্ত্ব নিয়ে চ্যাঁচামেচি করছিল । এককালে নামকরা ডাকাত ছিল লোকটা । এখন সেই সব কিছু ছেড়েছুড়ে সাধু হয়েছে । পঞ্চরসের দল খুলেছে । ছোটবেলায় খাস বোনা কানার চেলাগিরি করেছিল কিছুকাল । ভাল গানের গলা । অনেকদিন ধরেই আমায় নেমন্তন্ন করছিল ওদের ঘাঁটিতে একবার ঘুরে আসবার জন্য । সময় হচ্ছিল না । কাল আসরে এক ফাঁকে ফের ধরে পড়ল এসে । বলে, মনজুরের ওখান থেকে সকালবেলা সটান নৌকো নিয়ে ফুলেতারা ফিরবে । ওদের সঙ্গেই নিয়ে চলে যাবে একেবারে । মানা করে দিয়েছিলাম প্রথমে । আসলে তুই সঙ্গে ছিলি তো ! তারপর এখন ভাবছি, একবার ঘুরেই আসি গিয়ে । ভালো কিছু গান পেয়ে যাবো হয়তো । সঙ্গে সঙ্গে ও এলাকার কয়েকটা গ্রামের সোসিও ইকনমিক একটা স্টাডিও করে নিয়ে আসতে পারবো । ডাকাতের আখড়া ওই এলাকাটা । লিটারেসি রেট প্রায় শূন্য । চাষবাস ভালোই হয় । লোকজনের ভাতের অভাব নেই । তা সত্ত্বেও প্রবলেমটা হচ্ছে কোথায় সেটা বুঝতে পারলে সলিউশান একটা ভাবা যেতে পারে ।

    "উসমানরা শেষরাতে কষে গাঁজা টেনেছে । উঠতে উঠতে একটু দেরি হবেই । তারপর নৌকো নিয়ে ফিরবে তো এই পথেই । ততক্ষণে তোকে ট্রেকার ধরিয়ে দিয়ে আমি ঘাটে ফিরে খানিকক্ষণ ওয়েট করলেই ওদের দেখা পেয়ে যাব । উসমান খুব খুশি হবে, বুঝলি ?" বলতে বলতে হঠাৎ ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে হাঁটকাতে হাঁটকাতে সে বলে, "এই দ্যাখো, একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম ।"

    "কিছু হারিয়েছিস ?"

    "না না হারাইনি, হারাইনি-------" বলতে বলতে ঝোলার ভেতর থেকে গোটাকয়েক ক্যাসেট বের করে এনে সমাদৃতার হাতে গুঁজে দিয়ে সে বলল, "কালকে রাতের রেকর্ডিং । দিতে ভুলেই যাচ্ছিলাম আর একটু হলে ।"

    মাদ্রি হাত পাতল, "দে । কপি করে ফেরৎ দেবো ।"

    শোভন হাসল, "কেমন করে ফেরৎ দিবি ?"

    "পেয়ে যাবি কখনো না কখনো । উপস্থিত ঋণটা থাক না !"

    আতাখালির হাটের মোড়ে ট্রেকার স্ট্যাণ্ড । সকালের ফার্স্ট ট্রিপের ট্রেকার হাঁকছিল ইঞ্জিন চালু করে । সমাদৃতা উঠে একেবারে বঁদিকের কোণ ঘেঁষে বসল । তার হাতটা ছুঁয়ে ছিল শোভনের বাহু । হাসলে ওর দু গালেই টোল পড়ে । হাসিমাখা মুখটা শোভনের দিকে তুলে ধরে সে বলল, "আসি রে । তুই এগো বরং ।"

    গঞ্জ একপ্রকার গ্রন্থিস্থল বটে । গ্রাম ও শহরের মাঝে যোগসূত্র হয়ে সেই গ্রন্থির অবস্থান । আতাখালি নামের সেই গঞ্জ হতে অতএব দুটি যান, নগর এবং গ্রাম এই দুই বিপরীত অভিমুখে এগিয়ে চলে ত্রক্রমশ । একটি মোটরচালিত যন্ত্রযান ছুটে চলে নগরের বর্ণময় জীবনের দিকে, আর মনুষ্যচালিত দ্বিতীয় যানটি চূর্ণীর বুক বেয়ে ত্রক্রমশই ঢুকে যায় গ্রাম বাংলার গভীর থেকে গভীরতর হৃদয়স্থলের উদ্দেশ্যে । দুটি মানুষ, দুটি ভিন্ন জীবন ও ভিন্নতর অস্তিত্ত্বের দিকে এগিয়ে যায় ।

    (প্রথম পর্ব সমাপ্ত)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • | | ৩ | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments