পকেটের ভেতর মৃদু কাঁপুনি উঠছিল। ফোনটা বের করে পর্দায় চোখ রাখল ব্রতীন। উল্লাস দত্তর নম্বর। ডি এম সাহেব কথা বন্ধ করে তার দিকে কৌতূহলি চোখে তাকিয়ে ছিলেন। ব্রতীন একটু অপ্রস্তুত হাসি হেসে বলল, “সরি স্যার। জরুরি ফোন। একটু অ্যাটেন্ড করতেই হবে। আমি বাইরে গিয়ে—”
কনফারেন্স রুমের বাইরে বের হয়ে একধারে একটা ছোট মতন জায়গায় একটু ঘেরা দেয়া হয়েছে কদিন আগে। ডি এম-এর নতুন ফরমান। ফ্লোরে কেউ সিগারেট খেতে পারবেন না। ইচ্ছে হলে এই ঘেরাতে এসে সিগারেট খেয়ে যেতে হবে। সেখানে ঢুকতে ঢুকতে ব্রতীন ফোনটাকে কানে লাগিয়ে বলল, “বলো উল্লাস। এনিথিং আর্জেন্ট?”
উল্লাস ছেলেটা ভালো। রাইটার্সে রয়েছে বেশ কয়েকবছর। উত্তর দিনাজপুরের ছেলে। ওদের গ্রামের বাড়িতে জমি নিয়ে একবার একটা গণ্ডগোল হয়েছিল। ব্রতীন তখন ওখানকার বিডিও। তখনই ওর ব্রতীনের সঙ্গে আলাপ। গণ্ডগোলটা ব্রতীন মিটিয়ে দেবার পর থেকে উল্লাস তাকে বেশ মান্যগণ্য করে চলে। শোভনের কেসটার ব্যাপারে তাকে একটু নজর রাখতে বলে নিজের ফোন নম্বরটা সে দিয়ে এসেছিল কলকাতা ছাড়বার সময়।
ব্রতীনের গলা পেয়ে উল্লাস বলল, “হ্যাঁ স্যার। কেসটা একটু গরম খাচ্ছে আবার, মানে আপনার বন্ধুর কেসটা--”
ব্রতীন চমকে উঠল একটু। ব্যাপারটা কিছুটা অপ্রত্যাশিত। হোমের জয়েন্ট সেক্রেটারি হিমাদ্রি সেন ব্রতীনের প্রথম এডিএম ছিলেন নর্থ বেঙ্গলে। আর কোন রাস্তা না পেয়ে সে গিয়ে হিমাদ্রি সেনকেই সবটা ব্যাপার খুলে বলেছিল কয়েকদিন আগে। মুরলীপুর নামটা শুনেই হিমাদ্রি সেন বলেন, “নামটা চেনা ঠেকছে হে। গতকালের ডাকে একটা চিঠি এসেছে মনে হচ্ছে। দাঁড়াও ডাকাচ্ছি।”
খানিক বাদে চিঠিটা আনিয়ে দেখে তিনি মাথা নেড়ে বলেছিলেন, “কমপ্লেনটা সিউডোনিমাস মনে হচ্ছে ব্রতীন। চিঠিটা এসেছে বেহালার রাউত সরণি থেকে। বেহালা চৌরাস্তায় আমি বিশ বছর ধরে আছি। ও এলাকায় রাউত সরণি বলে কোন রাস্তার খবর অন্তত আমার জানা নেই। তুমি নিশ্চিন্তে নর্থ বেঙ্গলে ফিরে যাও। আমি কমপ্লেনেন্টের ঠিকানা যাচাইয়ের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছি। সিউডোনিমাস কমপ্লেন প্রমাণটা হয়ে গেলে কোন ইনভেস্টিগেশান হবে না এর বেসিসে। আমিই ফাইল বন্ধ করিয়ে দেবো। এস আই বি আর সি আই ইডিতেও কপি দিয়েছে দেখছি। এ কেসে সি আই ডি কিছু করবে না। এস আই বি কেই ফরোয়ার্ড করে দেবে। আর এসআইবির জয়েন্ট ডিরেক্টরকে আমি বলে রাখব, অ্যাড্রেস ভেরিফিকেশান অবধি ওয়েট করতে। ওদিক থেকে কোন মুশকিল হবে না।”
ব্রতীন খানিক নিশ্চিন্ত হয়েই ফিরে এসেছিল জলপাইগুড়িতে। শোভনকে ফোন করেনি আর। নিজেকে কিছুটা আড়ালে রেখেই যা করার করবে ঠিক করে রেখেছিল। শোভনকে জানাতে গেলে না আবার বেঁকে বসে। আইডিয়ালিস্ট ফুল একটা। একে ভরসা নেই।
ফিরে আসবার আগে সে এই উল্লাসকে লাগিয়ে রেখে এসেছিল কোন ডেভেলপমেন্ট হলে তাকে যেন খবর করে সেই অনুরোধ দিয়ে। উল্লাস হিমাদ্রিবাবুর পার্সোনাল ব্রাঞ্চেই রয়েছে আজ কয়েকবছর। ইউনিয়নের পাণ্ডা। তার ট্রান্সফার নিয়ে কেউ বিশেষ ঘাঁটায় না।
“কেসটা নিয়ে ফের নাড়াচাড়া শুরু হয়েছে স্যার,” উল্লাসের গলা ভেসে আসছিল, “মুরলীপুর থেকে কয়েকজন লোক নিয়ে লালবাজার থেকে একটা অফিসার এসেছিল আজ জে এস এর চেম্বারে। এই একটু আগে বেরোল। জে এস তার পরেই আবার ফাইল চেয়ে পাঠিয়ে লম্বাচওড়া অনেককিছু লিখে ডেপুটি সেক্রেটারির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। ইন্টারকমে ডি এসকে ঝেড়েওছে বেশ খানিক। বলে--”
জে এস কী বলে তাঁর অধস্তনকে গাল দিয়েছেন সেটা জানবার কোন আগ্রহ ব্রতীনের ছিল না। সে গলাটা শান্ত রেখে বলল, “ফোনটা ছাড়ো উল্লাস। আমি হিমাদ্রিদার সঙ্গে একবার--”
“সেইটাই তো মুশকিল হয়েছে স্যার। রেগুলার জে এস হোম মিনিস্টার্স কনফারেন্সে চলে গেছেন দিল্লিতে মিনিস্টারের সঙ্গে। দুদিন কনফারেন্স, তারপর দিনতিনেকের ছুটি নিয়েছেন চণ্ডীগড়ে মেয়ের বাড়ি ঘুরে আসবেন বলে। ক্ষুদ্র শিল্পের সুশান্ত সেনকে চার্জ দিয়েছে। উনিই তো ঘোঁটটা পাকালেন। জেনারেলি এক হপ্তার চার্জে কেউ অফিসে এসে বসে না। ফাইলটাইল নিজের ঘরেই ডেকে নেয়। সুশান্তবাবু দেখি আজ একেবারে সকাল দশটার সময় এসে হাজির। এসে বসতে না বসতেই লালবাজারের লোক মুরলিপুরের ভিজিটারদের নিয়ে এসে ঢুকে পড়ল ঘরে। তারপর এই কাণ্ড। মনে হচ্ছে দু একদিনের মধ্যেই কিছু একটা অ্যাকশন—”
ফোনটা নামিয়ে রাখল ব্রতীন। গোবিন্দ দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে সে বলল, “ডি এম তাড়াতাড়ি আসতে বলছেন। আপনার রিপোর্ট নিয়ে এরপর কথা শুরু হবে স্যার--”
ব্রতীন ততক্ষণে বড় বড় পায়ে কনফারেন্স রুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হাতের ফোনটায় একটা মেসেজ টাইপ করছিল--
“--বিদ্যাপতি আর চণ্ডীদাসের লেখার মূল পার্থক্য ভাষায় নয়, ভাবে।” এর ওপর একটা আড়াইশো শব্দের উত্তর লিখবি পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত দিয়ে। বই দেখেও লিখতে পারিস চাইলে। কিন্তু বইয়ের একটা লাইনও উত্তরে থাকতে পারবে না। ঠিক আছে? সময় পনেরো মিনিট। নে শুরু কর—”
গোটা ক্লাসটা নিঃশব্দে লেখা শুরু করল। কাগজে কলমের ঘসার খসখস শব্দ উঠছে চারপাশে। গোটাপাঁচেক হ্যারিকেন জ্বলছে সতরঞ্জি জুড়ে। দিনকয়েক বাদে আজ বৃষ্টি হয়নি সকাল থেকে। ক্লাশ টুয়েলভের বাংলা ফার্স্ট পেপারের সন্ধের ক্লাসটা তাই উঠোনের তৈমুর লং নামের ঝাঁকড়া আমগাছটার নিচে বসেছে আজ।
বেশ কিছুদিন পরে আবার খোলা আকাশের নিচে ক্লাস। এখন সবে সন্ধেরাত। আকাশে মেঘ আছে। থমথমে হয়ে আছে চারদিক। সেদিকে চোখ তুলে একবার দেখে নিল শোভন। তার ভেতরের কৃষকসত্ত্বাটি টের পাচ্ছিল, মেঘ করলেও এখনই বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই এখানে। ভেজা মাটি আর জল পেয়ে তাজা হয়ে ওঠা গাছপালা থেকে মৃদু সুবাস ভেসে আসছিল। বুক ভরে শ্বাস টানল একবার শোভন। ফরিদা কী করছে কে জানে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে এনে একবার তার নম্বরটা ডায়াল করতে গিয়েও থেমে গেল সে। এই নিয়ে তিনবার হল। পর্দায় ভেসে থাকা ব্রতীনের দুপুরবেলার মেসেজটা চোখে পড়ছে বারবার। আর সঙ্গেসঙ্গেই ফরিদাকে ফোন করবার ইচ্ছাটা চলে যাচ্ছে তার। ফোন করলে তার গলার স্বর শুনে ফরিদা ঠিক বুঝতে পারবে কিছু একটা ঘটেছে এদিকে। ফরিদা তার প্রতিটি বাচনভঙ্গী চেনে। তার মনের দশা একেবারে নির্ভুলভাবে অনুমান করে নিতে পারে তার গলার শব্দ থেকে। তার উৎকন্ঠা বাড়িয়ে লাভ নেই। মাদ্রি আছে, শর্মিষ্ঠা, ব্রতীন সবাই আছে ওকে ঘিরে। ওর এখন একটু নিশ্চিন্ততা দরকার। মাদ্রিরা সামলে নেবে নিশ্চয়। দুপুর থেকেই বারবার একটা ইচ্ছে ফিরে ফিরে আসছিল তার মনে। ব্রতীন যেমন বলেছে, রাতের ট্রেন ধরে উত্তরবঙ্গেই চলে গেলে হয় আজকেই। কিন্তু বারংবার সে ইচ্ছেটাকে দমন করেছে শোভন। এইভাবে পালিয়ে গিয়ে—নাঃ। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চিন্তাটাকে মাথার থেকে ঝেড়ে ফেলল শোভন। ফোনের পর্দা থেকে মেসেজটাকে ডিলিট করে দিয়ে সমরেশের নম্বর মেলাল।
বারপাঁচেক রিং হয়ে যেতে ফোন ধরল সমরেশ। ট্রেনের হকারদের গলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল ফোনে। শোভন কিছু বলবার আগেই ওপাশ থেকে তার গলা ভেসে এল, “দেরি হবে শোভনদা। দুটো ট্রেন পরপর ক্যানসেল ছিল। রানাঘাটে অবরোধ হয়েছে একটা—”
“কোথায় আছিস এখন তুই?”
“সবে টিটাগড় এলো। এখনো অনেকটা সময় লাগবে গো। রাত হয়ে যাবে। কিন্তু কী হয়েছে তা একটু বলবে তো! এত তাড়াতাড়ি ডেকে পাঠালে! আমি তো দু-একদিনের মধ্যেই ফিরে আসতাম এমনিতেই--”
“ফোনে বলা যাবে না সমরেশ। তাড়াতাড়ি চলে আয়। মুরলীপুর পৌঁছে যত রাতই হোক আমায় একটা ফোন করবি। যদি আমি নিজে না ধরি তাহলে এদিকে আসবি না। পরে কাল এসে আমায় না পেলে ক্লাস টেনের দয়াময়ীর কাছে একটা চিঠি রেখে যাবো সেটা নিয়ে যা করবার করবি। কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে নিয়েছিস তো?”
“হ্যাঁ সে নিয়েছি। কিন্তু তুমি আবার এখন চললে কোথায়? জলপাইগুড়ি ফিরছো? ফরিদাদির শরীরটরীর—”
“সে’সব কিছু নয় সমরেশ। এসে সব শুনিস। এখন চলে আয় শুধু।”
ফোনটা বন্ধ করে দিয়ে একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইল শোভন। সমরেশটার শান্তিহাট পৌঁছোতেই বেশ রাত হবে। তারপর সেখান থেকে অত রাতে এদিকে আসবার গাড়িটাড়ি কী পাবে কে জানে। সেসব বন্দোবস্ত সেরে এখানে এসে পৌঁছোতে পৌঁছোতে দেরিই হয়ে যাবে সম্ভবত। অথচ ওকে ছাড়া বাকিদের ওপরে ঠিক ভরসাও রাখতে পারে না সে। একটা গভীর অসহায়তার অনুভূতি এসে গ্রাস করছিল শোভনকে। নিজেকে একটা নির্জন ডুবন্ত জাহাজের বুকে একলা নাবিকের মত ঠেকছে।
একটু বাদে মনের থেকে সেসব ভাবনাচিন্তা একরকম জোর করেই ঠেলে সরিয়ে দিয়ে একটা হেরিকেন কাছে টেনে নিল শোভন। তারপর একগোছা কাগজের ওপরে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখতে শুরু করল। কোন প্রিয়সম্ভাষণ নয়। তার প্রয়োজনও নেই এই ছেলেদের সঙ্গে। শুধু গোটা গোটা অক্ষরে কিছু নির্দেশ আর তথ্য সাজানো থাকছিল সে কাগজটাতে। ক্লাশ টেন আর টুয়েলভের ছেলেমেয়েদের প্রিটেস্ট এগিয়ে আসছে, সে ব্যাপারে কিছু নির্দেশ, ব্যাংকের কয়েকটা সই করা চেক থাকছে সঙ্গে। নির্দিষ্ট মাসিক পেমেন্টগুলো করবার জন্য। তাছাড়া—
মিনিটদশেক বাদে চিঠিটা শেষ করে খামে ভরে আলাদা করে রাখা একটা প্যাকেটের মধ্যে সেটাকে রেখে দিল শোভন। ছেলেদের লেখা হয়ে গেছে। সামনে তাদের খাতাগুলো ডাঁই করে সাজানো। সবার ওপরের খাতাটা তুলে নিয়ে সে ডাকল, “কেষ্ট, এদিকে আয়।”
রোগাভোগা ছেলেটা এখনো হাফপ্যান্ট পরে। ছোটখাটো চেহারা। সে এগিয়ে আসতে তার খাতাটা দেখতে দেখতেই শোভন খামটা বাড়িয়ে ধরল তার দিকে, “চিঠিটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দয়াময়ীকে দিয়ে দিবি। কাল সকালে আমি বা সমরেশ যেকোন একজন ওর থেকে চেয়ে নেব। এখন এদিকে দেখ, এটা কী লিখেছিস? সম্মানীয় মানুষের ব্যাপারে যখন লিখছিস তখন ‘সে করেছে’ এইভাবে লিখতে হয়? লিখবি—”
“শোভন মণ্ডল কে আছেন?”
হাতের খাতাটা নামিয়ে রেখে শোভন ঘুরে তাকাল। মোটাসোটা এক ভদ্রলোক এসে উঠোনে দাঁড়িয়েছেন তাদের পেছনে। উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, “আমি শোভন মণ্ডল। আপনি—”
ভদ্রলোক তাঁর কথার কোন জবাব দিলেন না। পেছনে অন্ধকারের দিকে ঘুরে চাপা গলায় বললেন, “হ্যান্ডকাফ হিম। আমি ওদিকটা দেখছি। আলোগুলো জ্বালান--”
অন্ধকার থেকে দুজন পাথুরে মুখের মানুষ এগিয়ে এল শোভনের দিকে। গোটা ইশকুল বাড়িটার এদিকে ওদিক ততক্ষণে অনেকগুলো বড় বড় আলো জ্বলে উঠেছে। অনেক উর্দিপরা মানুষ এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে। ঘরগুলোতে ঢুকে যাচ্ছে দল বেঁধে বেঁধে।
“আপনারা এভাবে—কোন ওয়ারেন্ট ছাড়া—”
একটা চড় এসে আছড়ে পড়ল শোভনের গালে। চকচকে দুটো চোখ তার মুখের একেবারে ওপরে ঝুঁকে পড়ে বিদ্ধ করছিল তাকে। মানুষটার মুখে তামাকের তীব্র গন্ধ। ফিসফিস করে তার কানে তরল আগুনের মত একরাশ অশ্লীল শব্দ ঢেলে দিচ্ছিল মানুষটা, “শালা হারামি, অ্যান্টিসোশ্যালের থাইদার শুয়োরের বাচ্ছা, আমাদের সঙ্গে আইন মারাচ্ছো? চল আজ তুই। তারপর তোর আইনের পেছন মারে কেমন করে তাই দেখাচ্ছি তোকে—”
ছেলেগুলো ছত্রখান হয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের চোখেমুখে এক বিপন্ন বিস্ময়ের ছায়া। লম্বাচওড়া চেহারার চারপাঁচজন মানুষ তাদের ঘিরে ধরে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা ঘরের দিকে। কেউ একজন চিৎকার করে আদেশ দিচ্ছিল, “ইন্টারোগেট না করে এদের একটাকেও ছাড়বেন না চৌধুরি। আরো কয়েকটা ছেলের খবর আমাদের দরকার—”
“প্লিজ, আমাকে যা করবার করুন, এরা স্কুলের ছাত্র। পড়তে এসেছিল। ওদের—”
“আবার কথা বলছিস? শালা ঢ্যামনা, মুখ বন্ধ। একেবারে মুখ বন্ধ—” দুটো কঠিন হাত তার নাকমুখ চেপে ধরেছে একেবারে। তার মাথায়, গায়ে পিঠে আঘাতের পর আঘাত নেমে আসছিল। গোটা স্কুলবাড়ি জুড়ে তাণ্ডব চলছে। তার লাইব্রেরি ঘরের দরজায় স্তূপাকার হয়ে উঠছিল ছুঁড়ে ফেলা বইপত্রের দল—
চকচকে একটা হার্ডটপ জিপসির পেছনের সিটে তাকে একটা বস্তার মত ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দুপাশে দুজন মানুষ উঠে বসল। গাড়িটার ইঞ্জিন চালু ছিল। বাঘের মতন একটা লাফ মেরে উঠে সেটা ছুটে গেল অন্ধকার রাস্তা ধরে। তার চালকের পাশে বসা মানুষটা মোবাইল ফোনে কাউকে উদ্দেশ্য করে জানাচ্ছিল, “পালের গোদাটাকে ধরেছি স্যার—থ্যাঙ্ক ইউ স্যার—থ্যাংক ইউ--না স্যার-ওখানে শেল্টার নিয়েছে বলে যে চারটে ছেলের খবর ছিল তাদের পাওয়া যায় নি—না স্যার-রেকি করবার টাইম ছিল না-হিন্ট পেলে এটাও পালাতে পারতো--হ্যাঁ হ্যাঁ, পুরো এলাকাটা কুম্বিং করা হবে আজ সারারাত ধরে—ইয়েস স্যার। জেলার ডিসিআইও নিজে অপারেশনটা অন স্পট লিড করছেন। আমি শোভন মণ্ডলকে নিয়ে কলকাতায় ফিরছি স্যার—ডোন্ট ওরি স্যার, হি হ্যাজ বিন প্রপারলি ফ্রিসক্ড্--না না—পালাবার কোন চান্স দেব না, ট্রাস্ট মি স্যার—”
ঠোঁটের কোণাটা একটু কেটে গিয়েছে মনে হয়। কষ বেয়ে চটচটে একটা অনুভূতি। হাতদুটো আটকানো। জিভ দিয়ে জায়গাটা একবার ছুঁয়ে দেখল শোভন। ধাতব, নোনতা একটা স্বাদ লেগে রয়েছে সেইখানে।
সুরভি এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। সমাদৃতা বলেছিল ওকে এখানেই কোন ইশকুলে ভর্তি করিয়ে দিতে। যে কদিন থাকে পড়াশোনাটা চলুক। ফরিদা রাজি হয় নি। বলেছিল, “অনেক তো করছো মাদ্রিদি। নিজের সব ঝক্কি ঝামেলা সামলে তার ওপর আমি এক বোঝা এসে পড়েছি ঘাড়ের ওপর, তারও দায়িত্ব নিয়ে বসে আছো।”
সমাদৃতা একটু হেসে জবাব দিয়েছিল, “বোঝা আর কোথায়? কাছে গিয়ে তো থাকলেও না। গেস্ট হাউসে এসে উঠলে।”
এই একটা ব্যাপারে সমাদৃতার হাজার অনুরোধেও কাজ হয় নি কোন। ফরিদা শুধু বলেছিল, “তুমি আমায় কোন একটা গেস্টহাউস খুঁজে দাও মাদ্রিদি। ওখানেই আমি সুরভিকে নিয়ে ঠিক সামলে সুমলে থেকে যাবো যে কদিন দরকার হবে। তোমার নিজেরই তো অনেক ব্যস্ততা রয়েছে। তার ওপর আমি অসুস্থ শরীরে আবার তোমার বাড়িতে গিয়ে উৎপাতটা নাইবা করলাম।”
আসলে এই একটা জায়গায় ফরিদার বড় অস্বস্তি হয়। সে কারো বাড়িতে গিয়ে উঠতে রাজি নয় একেবারেই।
“চা খাবেন তো দিদি?”
মদনদা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। ফরিদা মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে দেখে মাথা নাড়ল।
“মদনদা কি চা বানাচ্ছো? তাহলে আরো এক কাপ বানিও।” সিঁড়ির থেকে চেনা গলাটা পেয়ে ফরিদা বসে থেকেই বলল, “কে, শর্মিষ্ঠা? এসো এসো। এত সকালে যে?”
শর্মিষ্ঠা দুমদুম করে পা ফেলতে ফেলতে উঠে আসতে আসতেই জবাব দিল, “মাদ্রিদি কাল রাতে ফোন করে বলল আজ সকালে আসতে পারছে না। আমি যেন একটু তাড়াতাড়ি চলে আসি তোমার কাছে।”
শর্মিষ্ঠার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে ছিল। হেঁটে এসেছে অনেকটা রাস্তা। শাড়ির আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে একটা বেতের চেয়ার টেনে নিয়ে তার পাশে বসে বলল, “এবার বলো, শরীর ঠিক হয়েছে তোমার?”
ব্যথাটা একটু ঝিম ধরেছে। আস্তে আস্তে একটু উঁচু হয়ে বসে মুখে একটু হাসি টেনে আনল ফরিদা। তারপর বলল, “হঠাৎ কী হল ওর আবার? বাচ্চাটার শরীরটরীর—”
“আরে না না সে সব কিছু নয়। টি ই এফ এল জানো তো? ইংরিজি পড়ানোর বিদ্যে শেখবার ডিপ্লোমা। সমাদৃতাদি ওর একটা অনলাইন কোর্স করছে আমেরিকার একটা ইউনিভার্সিটি থেকে। তিন সপ্তাহের কোর্স। কাল রাতে ওর ফাইনাল পরীক্ষাটা ছিল অনলাইনে। সেইসব সেরে শুতে শুতে দেরি হয়ে যাবে বলেই আমায় বলল সকালবেলাটা যেন তোমার কাছে এসে ঘুরে যাই। দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারে অফিস থেকে বেরিয়ে তোমার এখানে এসে ঘুরে যাবে বলেছে। ও কী? কী হল আবার? এই ফরিদা—”
যন্ত্রণাটা ফের একটা তীব্র ঝলক দিয়ে ফিরে আসছিল ফরিদার। প্রাণপণে দাঁত চেপে ধরে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল সে। শর্মিষ্ঠার মুখে উদ্বেগের ছায়া পড়ল। তাড়াতাড়ি উঠে এসে ফরিদার হাতদুটো ধরে বলে, “এ কী? হাত একেবারে ঠাণ্ডা যে! ঘামছো তো তুমি? কী কষ্ট হচ্ছে? বলো আমায়--”
কোনমতে দাঁতে দাঁত চেপে ফরিদা বলল, “ব্যথাটা- আঃ-- বাড়ছে শর্মিষ্ঠা—ভোর থেকে একটু একটু জলও কাটা শুরু হয়েছে—তুমি একবার বরং—”
ফরিদার কাছে ফিরে এসে, একটা হাত তার গলায় জড়িয়ে ধরে বসল শর্মিষ্ঠা। মেয়েটা দরদর করে ঘামছে। দুহাতে প্রাণপণে তাকে আঁকড়ে ধরেছে। তার হাতের বাঁধন সরিয়ে শোভনের নম্বরটা লাগালো শর্মিষ্ঠা। একটু পরে তার ভ্রূদুটো কুঁচকে উঠল একবার। শোভনের ফোন সুইচ অফ করা। বেপরোয়া হয়ে, কোন ফল হবে না জেনেও ফের একবার ফোনটা রিডায়াল করল শর্মিষ্ঠা।
“তুমি একবার শোভনকে—”
ফরিদার যন্ত্রণাকাতর মুখটার দিকে তাকিয়ে মাথার ভেতর তীব্র একটা রাগ গড়ে উঠছিল শর্মিষ্ঠার। ইরেসপনসিবল লোক একটা। কোথায় গিয়ে বসে আছে কে জানে। মুখে সে সব কিছু না বলে সে বলল, “চেষ্টা করছি ফরিদা। লাইন থ্রু হচ্ছে না। আমি ব্রতীনকে বলছি। ও ঠিক যোগাযোগ করে নেবে। একটু ধৈর্য ধরো—”
ব্রতীন এক রিং-এই ফোনটা ধরে নিল। শর্মিষ্ঠা সংক্ষেপে তাকে অবস্থাটা বুঝিয়ে বলল। শান্ত হয়ে তার সব কথা শুনে ব্রতীন বলল, “শোনো। ওখানে কোন টিভি চলছে কি?”
“না। কেন?”
“কাল রাতে শোভনকে পুলিশ তুলে নিয়ে কলকাতায় এনেছে। এইমাত্র তিনচারটে চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ দেখালো। সমাদৃতাদিকে ফোন করলাম একটু আগে। উনিও এইমাত্র ব্যাপারটা দেখেছেন টিভিতে। পুলিশ দাবি করছে--”
গলা একটুও না কাঁপিয়ে শর্মিষ্ঠা ঠাণ্ডা গলায় বলল, “ওদিকটা তুমি খেয়াল রাখো। আমি আর সমাদৃতাদি মিলে এদিকটা দেখছি।”
তারপর ফরিদার দিকে ঘুরে বলল, “ব্রতীন বলল, কলকাতার লাইন সে-ও পাচ্ছে না অনেকক্ষণ ধরে। নেটওয়ার্কের কোন গণ্ডগোল আছে বোধ হয়। ও যেভাবে হোক শোভনকে খবর পৌঁছে দেবে। তুমি ভেবোনা। এখন নিজের ব্যাপারটায় কনসেনট্রেট করো।”
তলায় গাড়ির শব্দ উঠছিলো। সিঁড়ি দিয়ে পায়ের আওয়াজ উঠে আসছে। স্ট্রেচার হাতে দুজন মানুষ। কাছে এসে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় শর্মিষ্ঠাকে বলল, “আমরা এঁকে নিয়ে আসছি। আপনি একবার নিচে চলে যান। ম্যাডাম গাড়িতে বসে আছেন। আপনাকে এক্ষুণি একবার যেতে বললেন।”
অ্যাম্বুলেন্সের সামনের জানালায় সমাদৃতাকে দেখা যাচ্ছিল। কী ভীষণ শীর্ণ আর রক্তশূন্য দেখাচ্ছে মুখটা। শর্মিষ্ঠা কাছে যেতে তার মুখের দিকে একবার ঘুরে তাকালো সে। তার হাতটা চেপে ধরে শর্মিষ্ঠা বলল, “একটু নিজেকে কন্ট্রোল করুন দিদি। ফরিদাকে এই অবস্থায় ব্যাপারটা আন্দাজ করতে দিলে সেটা তার পক্ষে ভালো হবে না।”
“তুমি দেখেছো?”
“না। আমি সকালে উঠে বেরিয়ে এসেছি। ব্রতীন খবর দিল এইমাত্র। কিন্তু ও তো বলেছিল হোম-এ হিমাদ্রিবাবুকে--”
“—এ দেশের রাজনীতিতে প্রেডিক্টেবিলিটি বলে কিছু থাকে না শর্মিষ্ঠা। ব্রতীন যা বলল, তাতে বোঝা যাচ্ছে, হিমাদ্রিবাবু কয়েকদিনের জন্য বাইরে গিয়েছেন আর সেই সুযোগটাই নিয়ে নিয়েছে ওরা। ওর কাছে খবর ছিল দু একদিনের মধ্যে কিছু একটা অ্যাকশন হবে। ও সাবধানও করে দিয়েছিল শোভনকে। কিন্তু সেটা যে এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে—”
“স্টেট পুলিশ সার্ভিসে আপনার কেউ চেনাশোনা—”
“--কাজটা স্টেট পুলিশ করেইনি। করেছে এস আইবি আর এস টিএফ মিলে। স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশানের কাউকে ধরে কিছু করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। কী করব বলোতো শর্মিষ্ঠা আমি এখন?” হাতের আঙুলগুলো কাঁপছিল সমাদৃতার।
স্ট্রেচারে করে ফরিদাকে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে ততক্ষণে। ধরাধরি করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছিল তাকে। “তুমি সামনে এসে বসো শর্মিষ্ঠা। আমি পেছনে ফরিদার কাছে চলে যাচ্ছি,” বলতে বলতে গাড়ি থেকে নেমে এল সমাদৃতা। মদন এসে দাঁড়িয়েছিল সামনে। তার দিকে ফিরে বলল, “সুরভি উঠেছে?”
“না ম্যাডাম। এখনো ঘুমিয়ে আছে। আমি দরজা ভেজিয়ে দিয়ে এসেছি। উঠলে পরে আমি রইলাম, খাইয়েদাইয়ে—”
“উঁহু। বিল্টুকে ইশকুলে পৌঁছে দিয়ে আমার অফিসের গাড়ি এখানে আসছে মিনিটপাঁচেকের মধ্যে। গাড়িতে কৃষ্ণাদি থাকবে। সুরভিকে নিয়ে ও আমার বাড়িতে চলে যাবে। তুমি গিয়ে ওর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখো। দেখো, ঘুম না ভেঙে যায়।”
মেটারনিটি ওয়ার্ড থেকে বাইরে বের হয়ে সদর রাস্তার ওপর এসে দাঁড়িয়ে ছিল সমাদৃতা। রাস্তার এপাশ ওপাশ জুড়ে হাসপাতাল। ফুটপাথে অজস্র ছোট ছোট দোকানে সদ্যোজাত শিশুদের সারি সারি পোশাক দুলছে। কয়েকটি কমবয়সী পুরুষ সেখানে দরাদরি করে পোশাক কিনতে ব্যস্ত। সন্তানের জন্য প্রথম পোশাক কেনা! বিল্টু যখন জন্মালো, উত্তম এইরকম অজস্র ছোট ছোট সুন্দর পোশাক দিয়ে ঘর বোঝাই করে দিয়েছিল। শোভনটাকে এখন কোথায় রেখেছে, কীভাবে রেখেছে কে জানে? একটা খবরও তো পেল না।
নর্মাল ডেলিভারি হয় নি ফরিদার। সমস্ত দিন অসহ্য যন্ত্রণার লেবার কাটিয়ে সন্ধের মুখমুখ ডঃ কর সিজারিয়ান করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ফ্লুইড ডিসচার্জ হয়ে গিয়ে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছিল ততক্ষণে। খানিক আগে ওপর থেকে যখন নেমে এল সে, তখনো জ্ঞান ফেরেনি ফরিদার। ছেলে হয়েছে। বাচ্চাটার স্বাস্থ্য ভালো। তিন কেজির ওপর ওজন হয়েছে। একটু আগে একঝলক সমাদৃতাকে এনে দেখিয়ে গেল। অপারেশানের আগে সমাদৃতাই ফর্মে নিকট আত্মীয়ের সইটা করেছিল। রিলেশনশিপ কলামে লিখেছে ছোটবোন। শিশুটির ঝকঝকে চোখে অবিকল শোভনের দৃষ্টিটি বসানো যেন। মুখটা বারংবার মনে পড়ে যাচ্ছিল সমাদৃতার।
ব্যাগের ভেতর ফোনটা থেকে সুরেলা শব্দ এলো একটা। ই মেল অ্যালার্টের শব্দ। ফোনটা বের করে আনল সে। মেসেঞ্জারে মূল চিঠির শুরুর কয়েকটা লাইন জ্বলজ্বল করছে—“কনগ্রাচুলেশনশ মিসেস সমাদৃতা প্রধান। ইউ হ্যাভ সাকসেসফুলি কমপ্লিটেড দা টি ই এফ এল সার্টিফিকেট কোর্স, দা এসেনশিয়াল কোয়ালিফিকেশন ফর টিচিং জবস অ্যাট ইনটারন্যাশনাল স্কুলস অল ওভার দা—”
টিঁ টিঁ করে বেজে উঠল ফোনটা একবার। বাড়ির ফোন আসছে। মেসেজটা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি ফোনটা কানে লাগাল সে। ওপাশে বিল্টুর গলায় একটু ছটফটানির স্পর্শ ছিল, “ও মা। কী হল? কখন ফিরবে তুমি আজ?”
“আর একটুক্ষণ ধৈর্য ধর বাবা। ঘন্টাখানেক পরে আসছি। তোমার পরীক্ষা কেমন হল?”
“ভালো হয়েছে মা। ও মা, বোনটা কেবল টিভির রিমোট টেনে নিচ্ছে। আমায় দেখতে দিচ্ছে না।”
“আহা ওকেও একটু দেখতে দাও না! কিংবা দু একটা খেলনাও তো বের করে দিতে পারো ওকে।”
“না। দেব না। এই ছাড়—ছাড়—” ওপাশ থেকে একটা ঝটাপটির শব্দ উঠল। কৃষ্ণাদির গলা পাওয়া গেল একবার। তারপর ফোনটা কেটে গেল।
“কার ফোন ছিল গো মাদ্রিদি?”
শর্মিষ্ঠা কখন যেন নিচে নেমে এসে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
“বিল্টুর। সুরভির সঙ্গে মারপিট করছে। সারাদিন আজ দুটোতে মিলে কৃষ্ণাকে জ্বালিয়েছে।”
“তুমি বরং এবার বাড়ি ফেরো সমাদৃতাদি। সারাটা দিন যা ঝড় গেল! এবারে ফিরেও তো আবার দুটো বাচ্চাকে সামলাতে হবে। কাল অফিস আছে তো!”
হঠাৎ তার দিকে ঘুরে সমাদৃতা বলে উঠল, “তুমি দুটো দিন বাচ্চাদুটোকে একটু সামলে দিতে পারবে শর্মিষ্ঠা? মানে এই কদিন আগে ব্রতীন একবার কলকাতা থেকে ঘুরে এলো, এক্ষুণি ফের ছুটিও তো পাবে না।। বিল্টুর পরীক্ষা আজ শেষ হয়ে গেল তো! কালপরশু উইক এন্ডটাও পড়েছে। ভাবছিলাম আমি নিজেই যদি একবার—”
শর্মিষ্ঠা মাথা নাড়ল, “তোমায় বলা হয় নি আর। দুপুরের ফ্লাইটে ব্রতীন অলরেডি কলকাতায় বেরিয়ে গেছে। পুলিশ আজ খাতাকলমে অ্যারেস্ট দেখিয়েছে আজ সকালে। তার মানে শোভনদাকে কোর্টে তুলতে তুলতে কালকে। উকিলের বন্দোবস্ত করতে হবে তো! ডি এমকে গিয়ে খোলাখুলি সব বলেছে ও আজ সকালেই। ওর নিজেরও এখানে একটা ক্রেডিবিলিটি তো আছে সমাদৃতাদি! ডি এম ওর কথা ফেলতে পারেন নি। সব শুনেটুনে একটা ডিউটির বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। একেবারে দিনচারপাঁচ থেকে আসতে পারবে। যতটুকু করা সম্ভব ও করে নেবে। এখন নাও। চলো দেখি! আজ রাতে আমিও তোমার বাড়িতেই ঘাঁটি গাড়ছি। ভালো খাওয়াতে হবে কিন্তু!”
তার মেকি আনন্দের পাতলা আবরণটার নিচে খেলা করতে থাকা গভীর উদ্বেগ আর সারাদিনের টানাপোড়েনের ক্লান্তিটা চাপা থাকছিল না। হালকা স্বভাবের, ফুরফুরে মেয়েটাকে আজ একটু নতুন চোখে চিনছিল সমাদৃতা। তার হাতটায় একটু চাপ দিয়ে সে বলল, “চলো তবে। যাবার আগে ফরিদাকে আর একবার--”
“উঁহু। জ্ঞান ফিরেছে একটু আগে। ঘুমোচ্ছে। ডাক্তার বিরক্ত করতে মানা করে দিয়েছেন। ঘুমিয়ে নিক ভালো করে। বেবিকে পাশের কটে দিয়ে দিয়েছে। ভালোই আছে দুজনে। এখন চলো তো! বাড়ি গিয়ে তুমি ভালো করে ঘুমোবে, আর আমি বিল্টু আর সুরভিকে নিয়ে খেলবো। ছোটদের সঙ্গে খেলতে আমার যা দারুণ লাগে না সমাদৃতাদি!”
|| ১৪ ||
বাঘা যতীনের এ পাড়াটায় ব্রতীন আগেও এসেছে কয়েকবার। তবে এসব এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন ঘরবাড়ি দোকানপাট যে হারে উঠছে তাতে কিছুদিন পরপরই জায়গাগুলোর ভূগোল বেশ একটু বদলে যায়। সন্ধের মুখমুখ অন্ধকারের মধ্যে দীপক স্যান্যালের বাড়িটা খুঁজে বের করতে খানিকটা সময় লেগে গেল ব্রতীনের।
এ সময়টা স্যন্যালসাহেব বাড়িতেই চেম্বার করেন। আজকেও দেখা গেল অ্যান্টেচেম্বারে জনাকয়েক ক্লায়েন্ট রয়েছেন। বেশির ভাগই নানান সরকারী দফতরের লোকজন। ব্রতীনের নামের স্লিপটা নিয়ে ভেতরে গিয়ে দেবার পর দেখা গেল তিনিও ব্রতীনকে ভোলেন নি। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই ডাক পড়ল।
ব্রতীনকে ঢুকতে দেখে সামনের দস্তাবেজ থেকে চোখ না সরিয়েই হাতের ইশারায় তিনি উল্টোদিকের চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন।
“ভালো আছেন স্যার?” ব্রতীন চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে প্রশ্ন করল। এককালে ডাকসাইটে এই ব্যারিস্টারকে দিয়ে জমিসংক্রান্ত অনেক কেস করিয়েছে ব্রতীনদের অফিস। নিয়মিত যাতায়াতে ব্রতীনের সঙ্গে বেশ একটা অসমবয়স্ক বন্ধুত্বই গড়ে উঠেছিল তাঁর। তবে ইদানিং যোগাযোগটা একটু কমে এসেছে।
“এক সেকেন্ড ব্রতীনবাবু,” বলতে বলতে অন্য চেয়ারে অপেক্ষমান পুলিশের ঊর্দি পরা ভদ্রলোকটিকে তিনি বললেন, “এগজিবিট থ্রি আর ফাইভের দুখানা এক্সট্রা জেরক্স দিয়ে যাবেন আমাকে কাল সকালের মধ্যে। বাকিটা আমি দেখে নেবো। আপনাকে আর আসতে হবে না। পরশু কোর্টে হাজির থাকবেন। আপনি নিজে এলে সবচেয়ে ভালো হয়, আর নাহলে অন্য কোন সিনিয়র কাউকে ব্রিফিং দিয়ে পাঠাবেন। আর শুনুন, কোর্টে আপনাদের লোক না এলে আমি কিন্তু অ্যাডজর্নমেন্ট নিয়ে নেবো এবারেও।”
“না, মানে স্যার বুঝতেই তো পারেন, পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কাজ, কখন কি এমার্জেন্সি চলে আসে। তাই বলছিলাম মামলা উঠলে পরে যদি কেউ আসতে না পারে তাহলে আপনিই বরং--”
লোকটিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে দীপক স্যান্যাল একটু কড়া গলায় বললেন, “আজ্ঞে না। ওইটি হবে না। কোর্টে দাঁড়িয়ে ক্লায়েন্টের অ্যাডভাইস নেবার দরকার হতে পারে। রিট পিটিশনের কেস মশায়। নিজেরা হাজির না থেকে পরে অ্যাডভার্স ডিসিশান হলে তখন তো উকিলের ঘাড়ে দায় চাপাবেন। ওসব হবেনা। যদি আপনি এ ব্যাপারে আমায় কথা দিতে না পারেন তাহলে বলুন, আমি আপনার আইজির সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি।”
ভদ্রলোক হঠাৎ একটু অপ্রস্তুত মুখ করে বললেন, “তার দরকার নেই স্যার। আমি নিজেই হাজির হয়ে যাবো পরশু। সেদিন আপনার গাড়ি--”
“গাড়িটাড়ি পাঠাবার দরকার নেই মিঃ দাস। ও আমি নিজের গাড়ি নিয়েই চলে যাব। তবে পারলে আমার পেন্ডিং বিলগুলো একটু এক্সপিডাইট করুন। তাতেই আমি খুশি। আচ্ছা আসুন--”
লোকটি বেরিয়ে যেতে ব্রতীনের দিকে ফিরে একটূ হাসলেন দীপক স্যান্যাল। তারপর বললেন, “এই পুলিশের কেসগুলো বড় গণ্ডগোলের হয়। এ কেসটায় এরা ভালোরকম ফেঁসেছে।”
“কীসের কেস স্যার?”
“আরে কাস্টোডিয়াল ডেথ। বাড়ির লোক রিট পিটিশান করেছে কোর্টে। তাই স্পেশাল কাউন্সেল অ্যাপয়েন্ট করেছে আমাকে। ফাইলটাইলের যা অবস্থা, ভাবতে পারবেন না। তা আপনি হঠাৎ এতকাল বাদে কী মনে করে? এমনি সোশ্যাল ভিজিট? নাকি--”
“আরে কী যে বলেন! ব্যক্তিগত সমস্যা বলছেন সেক্ষেত্রে আমি তো আর উকিল রইলাম না। বন্ধু হিসেবেই শুনব। অত ফর্ম্যালিটির কিছু নেই।” দীপক স্যান্যাল হাতের কাগজপত্রগুলো সরিয়ে রেখে সোজা হয়ে বসলেন।
“আমার এক বন্ধুকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে আজ সকালে। মিডিয়াতেও বেশ হইচই চলছে সেই নিয়ে। তিনি একটা ইশকুল চালান। নাম--”
“শোভন মণ্ডল কি?”
“ব্রতীন একটু অবাক হয়ে বলল, “আপনি-- ”
“কেসটার জন্য পার্টির তরফে আমাকে অ্যাপয়েন্ট করা হয়েছে আজ দুপুরে।”
দীপক স্যান্যালের একেকটা অ্যাপিয়ারেন্স ফির অংকটা ব্রতীনের চোখের সামনে ভেসে উঠল একবার। তার একমাসের মাইনের সমান।
“কিন্তু আপনি তো স্যার লোয়ার কোর্টের কেস—”
“হ্যাঁ, এমনিতে করি টরি না, কিন্তু কেস যে ভদ্রলোকের থেকে রেফার হয়ে এসেছে তাঁর কোম্পানি আমার পুরনো ক্লায়েন্ট। ওঁদের কথা ফেলতে পারলাম না। আপনিও চিনবেন। কেজরিওয়াল কনসালট্যান্ট-এর নাম শুনেছেন তো? বিরাট কোম্পানি। এডুকেশন বিজনেসেও পা দিয়েছে রিসেন্টলি। শোভনবাবুর এডুকেশন মডেলটায় ওঁদের কিছু ইন্টারেস্ট আছে বলছিলেন।”
চমকে ওঠার ভাবটাকে একরকম জোর করেই গোপন করল ব্রতীন। তারপর বলল, “ব্রিফিং হয়ে গেছে?”
“উঁহু। কন্ট্যাক্ট করেছিলেন ওঁদের একজন ডিজিএম র্যাংকের অফিসার। ভদ্রলোকের নাম ইউ কে প্রধান। ইনফ্লুয়েনশিয়াল মানুষ। আপনাদের সার্ভিসেই ছিলেন আগে। অনেক কন্ট্যাক্ট টন্ট্যাক্ট আছে সরকারী মহলে। বললেন, এস আইবি থেকে অ্যারেস্ট মেমো আর প্রাইমারি ইনভেস্টিগেশন রিপোর্টটিপোর্ট জোগাড় করতে করতে কয়েকঘন্টা সময় লেগে যাবে। আজ রাতে আসবেন। নটা নাগাদ অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন। চেনেন নাকি ভদ্রলোককে?”
ব্রতীন মাথা নাড়ল।
তার দিকে দেখতে দেখতে দীপক স্যান্যাল মাথা নেড়ে বললেন, “তবে টাকা খরচই সার হবে মনে হচ্ছে। অ্যারেস্টের খবরটা টিভিতে দেখলাম। সোজা কথা বলব মশায়, টাকা নিয়ে কাজ করি, কিন্তু এইসব টেররিস্ট আউটফিটের থাইদারদের জন্য আমার কোন সিমপ্যাথি নেই। কোর্টে দাঁড়িয়ে গতানুগতিক যা বলবার বলব। তারপর যা হবার হবে, আমি টাকা পেলেই খুশি। আপনার বন্ধু বলছেন, কিন্তু অভিজ্ঞ লোকের একটা অ্যাডভাইস নিন, এসব এলিমেন্টসদের সঙ্গে বেশি সম্পর্ক টম্পর্ক রাখবেন না। কবে কথায় ফেঁসে যাবেন, তখন কেরিয়ার টেরিয়ার নিয়ে টানাটানি পড়বে একবারে।”
একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইল ব্রতীন। তারপর বলল, “পেপার্স আমার কাছে কিছু নেই। সে আপনি উত্তমদা এলে তাঁর কাছ থেকেই দেখে নেবেন। আমি শুধু এই ছেলেটির ব্যাপারে আপনাকে খানিকটা ব্রিফিং করতে পারি। একটু সময় হবে আপনার?”
“ইন্টারেস্টিং কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে?” দীপক স্যান্যালের গলায় কৌতুহলের স্পর্শ ছিল। অন্য একটা ফাইলের বাঁধন খুলতে খুলতে তিনি বললেন, “একটু ওয়েট করুন তাহলে। দুটো ছোট ছোট কেস আছে। আধঘন্টার মধ্যে সেরে নিই চট করে। তারপর সাড়ে সাতটা থেকে আপনার সঙ্গে বসব। আপনি ততক্ষণ বরং সোফাতে বসে চা টা খান, খবরের কাগজগুলো দেখুন—”
উত্তম একেবারেই ঠিক সময়ে পৌঁছে গেল। দীপক স্যান্যালের ঘরে ব্রতীনকে বসে থাকতে দেখে একটু হকচকিয়ে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে। তারপর তার দিকে একটা শুকনো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “কেমন আছো?”
“ভালো আছি। আপনি?”
জবাবে মাথা নেড়ে অনুচ্চ স্বরে কিছু একটা বলতে বলতেই উত্তম তার ব্রিফকেস খুলে একটা ফোল্ডার বাড়িয়ে ধরল স্যান্যালের দিকে। ফোল্ডারটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে ভুরু কুঁচকে উঠছিল স্যান্যালের। হঠাৎ সেটাকে বন্ধ করে বললেন, “করেছেন কী মশায়? পুলিশ তো অ্যারেস্ট মেমোই দিতে চায় না। আপনি একেবারে ওদের ফাইলের নোটশিট আর করেসপন্ডেন্স পেজ পর্যন্ত জেরক্স করে নিয়ে চলে এলেন?”
উত্তম মৃদু হেসে বলল, “আমাদের দেশে কিছুই ইমপসিবল নয় মিঃ স্যান্যাল। তবে হ্যাঁ। মূল কমপ্লেন আর অ্যারেস্ট মেমোর কপি বাদে বাকি কাগজগুলো আমি লিগ্যালি যে পাইনি তা তো বুঝতেই পারছেন। এগুলো আপনি লিগাল এভিডেন্স হিসেবে দেখাতে পারবেন না। কিন্তু—”
তাকে হাত নাড়িয়ে থামিয়ে দিয়ে স্যান্যাল বললেন, “লিগালিটির দিকটা নিয়ে আমাকে আর ব্রিফিং নাইবা করলেন উত্তমবাবু। কীভাবে আপনি কাগজ জোগাড় করেছেন সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু এই যে পুলিশ নোটে লিখছে সার্চ করে কোন টেররিস্ট ইনভলভমেন্টের এভিডেন্স খুঁজে পায়নি, এবং ইনভেস্টিগেশান আরো কিছুদিন করবার জন্য একে কাস্টডিতে রাখতে চাইবে কোর্টে গিয়ে, এবং হায়ার অথরিটি তাতে সম্মতি দিয়ে সই করেছেন কোন কোয়ারি না করে সেই জিনিসটাই আমাদের ব্রহ্মাস্ত্র হবে। কাগজের কথা আমি উচ্চারণই করব না।”
“কিন্তু সেটা মেনশান না করে কীভাবে—”
স্যান্যাল মাথা নেড়ে বললেন, “সেটা আমি বুঝে নেব। কালকে কোর্টে তো থাকবেন আপনারা? তখন দেখবেন কীভাবে কী করি। উপস্থিত এক কাজ করুন। আপনারা তো পূর্বপরিচিত। হাবেভাবে যা বুঝছি বেশ কিছুদিন পরেই দেখা হচ্ছে ফের। আপনারা এখন আসুন। যা শোনবার আমি শুনে নিয়েছি। এবারে পেপারগুলো একটু একা একা খুঁটিয়ে দেখতে চাই। কিছু লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগও করতে হবে আজ রাত্রের মধ্যে। আপনার খরচ কিন্তু একটু বাড়বে মিঃ প্রধান। আপত্তি নেই তো?” ঘর ছেড়ে বের হয়ে যেতে যেতে মাথা নাড়ল উত্তম, “ও নিয়ে ভাববেন না আপনি। খরচ যা লাগবে তা আমার।”
“ওহো, আরেকটা কথা। ব্রতীনবাবু, আপনি তখন কথায় কথায় বলছিলেন, শোভনবাবু উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলেন একটা পেপার পড়তে। তার কোন কপি হবে আপনার কাছে?”
ব্রতীন একটু থমকালো। তারপর বলল, রাতের মধ্যে আপনাকে মেইল করে দিলে চলবে?”
“হবে। সকালে দিলেও হবে। আমার মেল আইডিটা নিয়ে নিন তাহলে—”
ফোনের ওপাশ থেকে তার উৎকন্ঠিত গলা ভেসে এলে বলল, “ব্যবস্থা হচ্ছে মাদ্রিদি। ভাববেন না। গিয়ে সব খুলে বলব। উপস্থিত যেভাবে পারেন, শোভনের পেপারটার একটা কপি আমায় মেল করে পাঠান। উকিল চাইছেন।”
“পেপার! এত রাতে—দাঁড়াও দেখছি কী করা যায়। ইউনিভার্সিটির ডঃ দিউ-এর ফোন নাম্বারটা বোধ হয় আমার কাছে আছে। কিন্তু পাঠাবো কোথায়? তোমার কাছে কোন কমপিউটার আছে?”
“না। আমি উকিলের মেল আইডি আপনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি মেসেজ করে। ওখানে পাঠিয়ে দিয়ে আমায় একটা ফোন করে দেবেন।”
“ঠিক আছে। তুমি ছাড়ো। আমি দেখছি কী করা যায়।”
ঘন্টাখানেক বাদে সমাদৃতার ফোন এল। প্রফেসর দিউকে বাড়িতেই পাওয়া গেছে। শোভনের ব্যাপারটা শুনে ভদ্রলোক নাকি বেজায় উত্তেজিত। ওঁর কমপিউটারে শোভনের পেপারটা রাখা ছিল। সেটা তো পাঠিয়ে দিয়েছেনই, তার সঙ্গে লাখি জাগরের গানের ওপরে প্রফেসর মালহির সঙ্গে যে জয়েন্ট পেপারটার প্রাথমিক খসড়ার একটা কপি রাখা ছিল তাঁর কাছে সেটাও পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রফেসর মালহির মন্তব্যসহ। সমাদৃতা গোটা মেইলটাই ফরোয়ার্ড করে দিয়েছে দীপক স্যান্যালের আইডিতে।
ফোনটা কেটে দিয়ে দীপক সান্যালকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিল ব্রতীন। উত্তম নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিল এতক্ষণ। এইবার বলল, “চলো কোথাও গিয়ে রাতের খাওয়াটা সেরে নেয়া যাক। সারাটা দিন যা গেল, এবারে একটু রিল্যাক্সেশান দরকার।”
“এই খানিক আগে এসে পৌঁছেছি উত্তমদা।”
গ্লাসে সোডা মেশাতে মেশাতে উত্তম বলল, “তুমি সত্যিই নেবে না?”
“নাঃ। অভ্যাসটাই তৈরি হয় নি।”
“আরে অভ্যাস কি কেউ জন্ম থেকে নিয়ে আসে? আমারই ছিল নাকি? শুরু করে দিলাম একদিন, ব্যস। একটা নিলে ভালো লাগত দেখতে। ক্লান্তিটা কেটে যেত।”
“থাক গে উত্তমদা। এখন বলুন কেমন আছেন?” ব্রতীন কথা ঘোরালো। এই জয়েন্টটা নতুন হয়েছে এ তল্লাটে। দামি সাজগোজ করা। গ্রাম গ্রাম পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে একটা। চাপা আলোয় অনেক মানুষের যাওয়া আসা, নিচু গলায় গল্প আর হাসির হররা চলছে। খরিদ্দারদের মধ্যে কমবয়েসিদের ভিড়ই বেশি।
“ভালোই আছি। পৃথিবী জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কাজেকর্মে দিন কেটে যাচ্ছে একরকম। ওদিকের খবরটবর কী?”
“শোভনদার ছেলে হয়েছে আজ। আপনি জানেন?”
“নাঃ। কে জানাবে আর আমাকে। ফোনটোনও তো আর করি না ওদিকে। ওর স্ত্রীর কী যেন নাম? ফরিদা, তাই না? টিভিতেই বলছিল তাই শুনেছি।”
“হ্যাঁ। কিছুদিন আগে শোভন ফরিদাকে নিয়ে আমাদের ওদিকে গিয়েছিল একবার। তারপর এদিকে গণ্ডগোল বাধতে ফরিদাকে সমাদৃতাদি নিজের কাছে রেখে দিল। শোভন একাই ফিরে এসেছিল মুরলীপুরে। তারপর তো এই কাণ্ড।”
একটু অস্বস্তিভরা চোখে উত্তম একবার তাকাল তার দিকে। তারপর বলল, “সমাদৃতা—কেমন আছে? বিল্টু?” তারপর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল, “লিভ ইট। ভালোই থাকবে নিশ্চয়। ডিভোর্স স্যুট ফাইল করেছে শুনেছ?”
ব্রতীন অস্বস্তিভরা মুখ নিয়ে মাথা ঝাঁকাল একবার। উত্তমের কথা জড়িয়ে আসছিল। মাথা নিচু করে আপনমনেই বিড়বিড় করে বলছিল, “কিন্তু আমি ঠিক কী অন্যায়টা করলাম যে ও এত অ্যাডামেন্ট হয়ে আমায় ঠেলে সরিয়ে দিয়ে এভাবে—”
ব্রতীনের চোখের সামনে পরপর অনেকগুলো ছবি চলে গেল এক মুহূর্তের মধ্যে। তার সামনে বসে থাকা এই নেশাগ্রস্ত, অসৎ মানুষটি একদিন সমাদৃতাকে সুন্দর একটা জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। মুখটা কঠিন হয়ে উঠল তার। নিচু গলায় কেটে কেটে বলল, “ও প্রসঙ্গটা কি না তুললেই নয় উত্তমদা? সমাদৃতাদি জীবনে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেয় কোন জিনিসটাকে সেটা কি আপনি জানতেন না? সেইখানটাতে এভাবে ঘা দিয়ে—”
“শাট আপ ব্রতীন,” হঠাৎ ফুঁসে উঠল উত্তম, “জীবনের সবকিছু জেনে গিয়েছ, না? সততা! আদর্শ! ফুঃ। ওই দিয়েই তো লড়তে ময়দানে নেমেছিল শোভন। ওর ট্যালেন্টের ধারেকাছে ছিলাম আমরা? তার পুরস্কার কী পেল? না, পুলিশের পেটানি। ছবিতে দেখাচ্ছিল ওর ইশকুলটা তছনছ করে দিয়ে এসেছে পুলিশে। সুবিচার পেতে গেলে আমাদের এখানে আঙুল বাঁকা করতে হয় ব্রতীন। তোমরা দুজন সৎ সরকারী অফিসার মিলে বাঁচাতে পারলে ওকে? পারলে? না না, উঠো না। ডোন্ট গেট আপ আই সে। ভাবছ আমার সংস্পর্শ এড়িয়ে সততার পরাকাষ্ঠা দেখাবে? একটা কথা শুনে রাখো। যে ফাঁদে শোভনকে ওরা ফেলেছে তাতে ওকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে যাবে সরকারী জগন্নাথের চাকা। ওকে বাঁচাতে গেলে আমার এই বাঁকা আঙুলটা এখন কাজে আসবে ব্রতীন, তোমার ওই ফালতু দুটাকার চেয়ারটা নয়। আমায় ছাড়া তোমাদের চলবে না ব্রতীন।”
উত্তমের গায়ে জ্বালা ধরানো কথাগুলোর মধ্যেও সত্যের একটা অসহনীয় স্পর্শ ছিল। একরকম জোর করেই মাথা ঠাণ্ডা করল ব্রতীন। উত্তমের সাহায্য ছাড়া এখন সত্যিই চলবে না তাদের। হাসপাতালে ফরিদার কথা, তার সদ্যোজাত বাচ্চাটার কথা বারবার মাথার ভেতর ঘুরে আসছিল তার। শোভনদা খবরটা পায়ওনি বোধ হয়। যে অ্যালিগেশনে ওকে ধরেছে তাতে এই মুহূর্তে ওর ওপরে ঠিক কী চলছে সেটা ভাবতেও তার গা শিউরে উঠছিল। একটুক্ষণ চুপ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সে বলল, “কিন্তু যে পেশাটায় একদিন আপনি নিজেও একটা বড় আদর্শ নিয়ে এসে যোগ দিয়েছিলেন তাকে এভাবে—”
“ভুল করেছিলাম ব্রতীন। বড় ভুল। চোখের সামনে অজস্র অন্যায় দেখেছি। বারবার প্রতিবাদ করতে গিয়ে পারসিকিউটেড হয়েছি। হিউমিলিয়েটেড হয়েছি। কুকুরের মত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বদলি করেছে বারংবার। তুমি নিজে দেখো নি? তবে তোমরা বুদ্ধিমান ছেলে। বিবেকের সঙ্গে পেশার বিরোধ না ঘটিয়ে পার্সোনাল অনেস্টির অজুহাত দেখিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে শিখে গেছ তোমরা। শুধু একবার খোলশটা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে গিয়েছিলে। তোমার লাস্ট পোস্টিং-এ। আমি সব খবর রাখি। এক লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে তোমায় অমরেশ বাগচি। তারপর যতটুকু দু নম্বরী করছিল তার চতুর্গুণ করে নিয়েছে ওই কেস থেকে আর কলকাতায় এসে হ্যা হ্যা করে হেসেছে একটা পার্টিতে ওই কথা বলে। আমি সেখানে হাজির ছিলাম। নিজের কানে শুনেছি ব্রতীন। আমার মুখ খুলিও না। তোমাদের ওই অক্ষম সততা ধুয়ে জল খেতে আমি রাজি নই।”
চাবুকের মতন কথাগুলো আছড়ে পড়ছিল ব্রতীনের কানে। মৃদু গলায় আরো একবার প্রতিবাদ করতে গেল সে, “কিন্তু ভালো কাজ কি একেবারেই হয় না উত্তমদা? সমাদৃতাদি মেয়েদের নিয়ে এস এইচ জির যে কাজগুলো করছেন তাতে কি প্রমাণ হয় না যে—”
“কী প্রমাণ হয় ব্রতীন? প্রমাণ হয় সে পার্সোনালি একজন সৎ, কেজো অফিসার। লোকে প্রশংসা করে। বিবেকের তৃপ্তি হয়। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলো তো, যত টাকা সরকারী বরাদ্দ হয় এ খাতে তার মধ্যে যে বড়ো অংশটা চুরি হয়েছে তার কতটা ঠেকাতে পেরেছে সে? এ দেশের পাবলিক ডিসট্রিবিউশান সিসটেম-এ যত পাবলিক মানি ঢালে সরকার তার কতটা লিকেজ হয় জানো? ফর্টি ওয়ান পারসেন্ট। আটকাবার ক্ষমতা হয়েছে তোমার বা তোমার সমাদৃতাদির? এটা তোমাদের সার্ভিস কমিটমেন্ট বজায় রাখবার ব্যর্থতা নয়? কতবার, কত ক্ষেত্রে পলিটিকাল বা এগজিকিউটিভ ওপরওলার অন্যায় ডিসিশানের মুখে চুপ করে ওবিডিয়েন্সের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নিজের চাকরি বজায় রেখেছ তোমরা? নিজের সার্ভিস কমিটমেন্ট বজায় না রাখবার ব্যর্থতাটা সত্ত্বেও একটা করাপ্ট সিসটেমের নুন খেয়ে নিজেকে একজন ইন্টিগ্রিটিযুক্ত মানুষ বলে অহংকার দেখানোটা ভণ্ডামি ব্রতীন। চোরের বাড়ির তহশিলদারের আবার সততা অসততা কী? আর সে আমাকে মুখের ওপর কী বলেছিল জানো? বলেছিল, ‘তুমি একটা চোর। আমি যাকে বিয়ে করেছিলাম সে--মরে গেছে। আমি একটা অসৎ, ইন্টগ্রিটিহীন মানুষের সঙ্গে—’ এ কথা বলবার কোন রাইট ছিল ওর? বলো? ছিল?”
তার উঁচু হয়ে ওঠা গলা আশেপাশের টেবিলের মানুষজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। এ জায়গার কর্মচারীরা উত্তমকে চেনেন। তাঁদের একজন কাছে এসে ব্রতীনকে নিচু গলায় বললেন, “স্যার একটু টেনসড হয়ে পড়ছেন। মাঝেমাঝেই এখানে এসে ব্রুড করেন তারপর ভায়োলেন্ট হয়ে যান। আপনি ওঁর সঙ্গে আছেন তো! ওঁকে এখন এখান থেকে নিয়ে গেলে ভালো হয় স্যার।”
ট্যাক্সিতে উঠেও মাথা নিচু করে বিড়বিড় করেই চলেছিল উত্তম। টালিগঞ্জ এলাকায় তার ফ্ল্যাটে এসে যখন তারা পৌঁছোল তখন রাত বারোটা বেজে গেছে। বিছানায় নিয়ে গিয়ে উত্তমকে শুইয়ে দিল ব্রতীন। রাতটা এইখানেই থেকে যেতে হবে আজ। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা উকিলের বাড়ি চলে এসেছিল। থাকবার জায়গা কিছু ঠিক করে আসেনি। সঙ্গে গাড়িও নেই। এত রাত্রে আর যাবে কোথায় সে!
আস্তে আস্তে তার ঘর থেকে বের হয়ে আসছিল ব্রতীন, তখন উত্তম হঠাৎ পেছন থেকে তাকে ডাকল। কাছে যেতে মুখে একটা অদ্ভুত হাসি ছড়িয়ে বলল, “আমি ওকে ছাড়ব না ব্রতীন। ডিভোর্স নেবে? আমার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যাবে? কোন ইন্টিগ্রিটির অহংকারে? আমার বিল্টুর ওপর থেকে আমার রাইট কেড়ে নেবে? আমিও দেখে নেব। ইউ কে প্রধানের হাত অনেক লম্বা। কোন উকিল দাঁড়াবে ওর হয়ে? কোন জাজের কোর্টে বিচার হবে? সব আমি চিনি। সমাদৃতাকে আমার চাই ব্রতীন। বলে দিও গিয়ে তুমি, আমি ওকে--ওকে ছেড়ে আমি—”
আস্তে আস্তে কথা জড়িয়ে আসছিল মানুষটার। একসময় একেবারে চুপ হয়ে গেল সে। অ্যালকোহলের নিদালি মন্ত্র তার সব উত্তেজনার ওপরে একটা অসুস্থ শান্তির প্রলেপ ছড়িয়ে দিয়েছে। তার ঘুমন্ত যন্ত্রণাক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে একটা বিচিত্র অনুভূতি খেলা করে যাচ্ছিল ব্রতীনের বুকের ভেতর। পরস্পরবিরোধী আবেগের এমন অভিঘাত তার সরলরেখাচারী জীবনে খুব বেশি আসে নি।
উকিলটি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সুপরিচিত। সওয়াল করতে দাঁড়িয়ে বিশেষ কিছু মুখে বলেন না। সাধারণত পুলিশের দফতর থেকে লিখে নিয়ে আসা কাগজটি জমা করে দিয়ে তার শেষ লাইনের দাবিটিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে থাকেন। এই মহকুমা আদালতের ছোট্ট পরিসরে সেটাই দস্তুর। চুরি ছিনতাইয়ের বা বধূনির্যাতনের দু চারটি কেস ভিন্ন অন্যধরনের কোন কেস এখানে ওঠে না। আর পুলিশে সে’সব কেস নিয়ে এলে সাধারণত দুপক্ষের দুজন স্থানীয় উকিল এইভাবেই নিজেদের বক্তব্য পেশ করে থাকেন। তারপর, একেবারে কাঁচা কোন কেস না হলে প্রাথমিক জামিনের আবেদন নাকচই হয়ে যায়। উকিলেরা কতটা কী বললেন তার চাহিদা খুব বেশি থাকে না এখানে।
কিন্তু আজ পরিবেশ একটু আলাদা। দীপক স্যান্যাল, বার অ্যাট ল, আইনজগতে একটি সুপরিচিত নাম। দু দু বার হাইকোর্টের বিচারক হবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। সেই তিনি যখন আসামীপক্ষের হয়ে ব্রিফ ধরেছেন সেক্ষেত্রে সবাইকেই একটু সতর্ক থাকতে হচ্ছে আজ। প্রসিকিউশানের উকিলের বাড়িয়ে দেয়া কাগজটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, “সে তো যা লেখার আপনাকে আপনার ক্লায়েন্ট লিখেই দিয়েছে। কিন্তু আপনার নিজের বক্তব্য কী সেটাও তো একটু বলবেন? কেন জামিনের বিরোধীতা করছেন আপনারা?”
“ইয়োর অনার, আসামী একজন অতিশয় বিপজ্জনক উগপন্থী। বাইরে ছাড়া থাকলে--”
“অবজেকশন ইয়োর অনার। আমার লার্নেড ফ্রেন্ড আসামী সম্পর্কে এইমাত্র যা বললেন সেটি তাঁর নিশ্চিত সিদ্ধান্ত বলে মনে হল। অভিযোগ তিনি তুলতেই পারেন, কিন্তু আদালতে ওঠা কোন অভিযোগ সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া তাঁর জুরিসডিকশানের বাইরে।” দীপক সান্যাল অনুত্তেজিত গলায় কথাক’টি বলে থেমে গেলেন।
“অবজেকশন সাসটেইনড। লার্নেড অ্যাডভোকেট ফর দা ডিপার্টমেন্ট মে রেকটিফাই হিজ স্টেটমেন্ট।”
“ধন্যবাদ ধর্মাবতার। আমি বলতে চেয়েছিলাম, আসামী একজন বিপজ্জনক উগ্রপন্থী বলে ডিপার্টমেন্টের অভিযোগ। একটি ইশকুল চালাবার আড়ালে সে তার বাড়িতে নিয়মিত কিছু মাওবাদি উগ্রপন্থীকে আশ্রয় দিত এবং স্থানীয় কমবয়েসি ছেলেমেয়েদের উগ্রপন্থায় দীক্ষিত করত বলে প্রাথমিক রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে। দেশের নিরাপত্তার খাতিরে এবং ইনভেস্টিগেশানের স্বার্থে তাকে অন্তত একমাস পোলিস কাস্টডিতে রাখা জরুরি।”
মৃদু একটু গুঞ্জন উঠল প্রসিকিউশান বেঞ্চ থেকে। উকিলের পেছনে বসে থাকা সরকারী মানুষগুলি একসঙ্গে মাথা নিচু করে আলাপচারী করছেন। খানিক বাদে তাঁদের উকিল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ধর্মাবতার, রিজন টু বিলিভ নিশ্চয় রয়েছে, কিন্তু তদন্তের স্বার্থে ডিপার্টমেন্ট তা এখনই জনসমক্ষে আনতে প্রস্তুত নয়।”
“ধর্মাবতার, আমি আমার লার্নেড ফ্রেন্ডের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত। আমি আমার দাবি প্রত্যাহার করছি।” এই বলে সান্যাল একটু থামলেন। সরকারপক্ষের উকিলের মুখে একটা স্বস্তির হাসি ছড়িয়ে যাচ্ছিল। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সান্যাল ফের বললেন, “কিন্তু এ প্রসঙ্গে একটা অনুরোধ আছে। তদন্তের স্বার্থে অন্যদের সরকারী কেস ফাইল দেখানো না গেলেও ধর্মাবতার তা দেখতে চাইতেই পারেন। আর নিয়মানুযায়ী আদালতে আসামীকে তোলবার সময় কেস ফাইল সঙ্গে করে নিয়ে আসাই দস্তুর। একজন মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। এই অবস্থায় অভিযোগ যত বড়ই হোক না কেন, তার যথার্থতা আইনের চার দেয়ালের মধ্যে থেকেও যতদূর সম্ভব যাচাই করে নেয়াটাই জুডিশিয়াল প্রুডেন্সের মধ্যে পড়ে। ধর্মাবতারকে আমার অনুরোধ তিনি যেন কেস ফাইলটি ধর্মাবতারের সামনে পেশ করবার আদেশ দেন।”
প্রসিকিউশন বেঞ্চ থেকে একঝাঁক চোখ অসহায়ভাবে সান্যালের দিকে চেয়ে দেখছিল। হলুদ রঙের পাতলা ফাইলটি বিচারকের সামনে পেশ করা হল। তার ওপরে একবার চোখ বুলিয়ে মুখটা একটু কঠিন হয়ে উঠল তাঁর। সরকারী উকিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখানে তো আপনারা নিজেরাই স্বীকার করছেন যে সার্চে আসামীর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণই পাওয়া যায় নি। এ ব্যাপারে আপনার মক্কেলের কী বলার আছে?”
উকিলবাবু কিছুটা থতমত খেয়ে বললেন, “আমার মক্কেল একটু সময় চায় ধর্মাবতার। প্রমাণ তারা জোগাড় করে পেশ করবেন। এখনো এ কেস নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধান চলছে। এ অবস্থায় আসামীকে বাইরে ছেড়ে দিলে তদন্তের ক্ষতি হতে পারে, বিশেষত যেক্ষেত্রে তার কার্যকলাপের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট একটি অভিযোগ পুলিশের কাছে আছে।”
“আবারও অবজেকশন দিতে বাধ্য হচ্ছি ধর্মাবতার,” ফের একবার উঠে দাঁড়ালেন দীপক স্যান্যাল, “দয়া করে যদি অভিযোগপত্রটি দেখেন তাহলে দেখবেন, সেটি এসেছে কলকাতা ৭০০০৬০, বেহালার রাউত সরণি থেকে। এ প্রসঙ্গে কলকাতা রোডম্যাপ ডিরেক্টরির বেহালা অঞ্চলের রোডম্যাপটি আমি আদালতে পেশ করতে চাই। ওই এলাকায় এ নামের কোন রাস্তাই নেই ধর্মাবতার। অভিযোগটি প্রাইমা ফ্যাসাই একেবারেই ভিত্তিহীন।”
বিচারক এগিয়ে দেয়া কাগজটি মনোযোগ দিয়ে দেখলেন একবার। তারপর ফাইলের পাতায় ফের একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “এই তো, জয়েন্ট সেক্রেটারির নোট রয়েছে প্রথমে ঠিকানা যাচাই করে নেবার। সেটি আপনার মক্কেল করেছিলেন কি?”
“আ-আজ্ঞে না ধর্মাবতার। আসলে অভিযোগটি এতই গুরুতর ছিল যে জয়েন্ট সেক্রেটারি নিজেই এরপর ফাইল ডাকিয়ে এনে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। সেই অনুযায়ীই কাজ হয়েছে।”
“দাঁড়ান দাঁড়ান, দু জায়গায় জয়েন্ট সেক্রেটারির সই আলাদা কেন?”
“আজ্ঞে রেগুলার জে এস অর্ডার দেবার পর সরকারী কাজে বাইরে গেছেন। তাঁর জায়গায় কার্যনির্বাহী জে এস দ্বিতীয় অর্ডারটি দিয়েছেন ধর্মাবতার।”
“নিয়মিত অধিকারী চলে যাবার পর নতুন কোন তথ্য কি সরকারের হাতে এসেছিল, যার ভিত্তিতে তিনি এই পদক্ষেপ নিয়েছেন?”
“আ-আজ্ঞে ধর্মাবতার—তেমন কোন—”
তাঁকে থামিয়ে দিয়ে দীপক স্যান্যাল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ধর্মাবতার, তাহলে দেখা যাচ্ছে, নিয়মিত অধিকারীর সুচিন্তিত পদক্ষেপকে উলটে দিয়ে একজন কার্যনির্বাহী অধিকারী একজন মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করবার মত কঠিন সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলেছেন, এবং সেটি তিনি করেছেন কোন উপযুক্ত নতুন তথ্য ছাড়াই। সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলছি, এটি একটি এগজিকিউটিভ ওভারএনথুসিয়াজমের চিহ্ন। একটি গণতান্ত্রিক শাসনযন্ত্র এইভাবে নিজেকে পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে এগিয়ে দিতে চাইছে যে, সেটা কোনমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। আবার, সেই আদেশের ওপর ভিত্তি করে পুলিশ একেবারেই কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া একজন মানুষকে গ্রেফতার করেছে, তার ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করেছে এবং এখন আরো লম্বা সময়ের জন্য তাকে আটকে রাখতে চাইছে। এই পদক্ষেপটি নেবার সপক্ষে ভবিষ্যতে তারা এঁর কার্যকলাপের বিষয়ে কী প্রমাণ জোগাড় করবে সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু এই মানুষটির বর্তমান কাজকর্ম সম্পর্কে কিছু প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে। আমি তা মাননীয় আদালতের সামনে পেশ করতে চাই।”
বলতে বলতেই একটা মোটাসোটা ফোল্ডার বের করে এনে কোর্ট ক্লার্কের হাতে তুলে দিলেন তিনি। সেটা বিচারকের সামনে গিয়ে পৌঁছোলে বললেন, “যাঁকে সমাজবিরোধী বলে তুলে আনা হয়েছে, এই ফাইলের কাগজপত্র দেখাচ্ছে তিনি আসলে একজন লোকশিল্পের আগ্রহী গবেষক। এ প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিষ্ঠিত লোকসঙ্গীতের মেলাটির ব্যাপারে গতবছরের খবরের কাগজে প্রকাশিত রিভিউগুলি আমি সঙ্গে দিয়েছি। শ্রী শোভন মণ্ডলের কার্যকলাপের ব্যাপারে লোকসঙ্গীতের জগতে অন্যতম পণ্ডিত গবেষক সৌগত বসুর লেখা একটি চিঠিও এ ফোল্ডারে আপনি পাবেন। কালকে রাত্রে তাঁর ব্যাপারে জানতে পেরে তিনি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তাঁর সরকারী প্যাডে এই চিঠিটি লিখে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। প্রয়োজনে এই আদালতের সামনে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিতেও তিনি প্রস্তুত।
“সর্বোপরি, শ্রী মণ্ডলের লেখা দুটি গবেষণাপত্রও এখানে রাখা হয়েছে। তার একটি পেপারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিত ডঃ বিনোদ মালহির মন্তব্যগুলোর দিকেও আমি আপনার বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রয়োজনে এ বিষয়ে এঁর সাক্ষ্য নেবার আদেশও দিতে পারেন মহামান্য আদালত। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযোগ সত্যি না মিথ্যা সে কথা সময়ই বলবে, কিন্তু এ প্রসঙ্গে আমি উপস্থিত হাতে আসা তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আমার অনুমানটুকু এই আদালতে পেশ করতে চাই। তা হল, একজন পণ্ডিত মানুষ, যিনি এদেশের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য প্রাণপণে কাজ করে চলেছেন নিজের সুখস্বাচ্ছন্দের কথা না ভেবে, তাঁকে একটি হীন চক্রান্ত ও ভুলবোঝাবুঝির শিকার হতে বাধ্য করা হয়েছে। আইনের রক্ষকরাও তাতে সহায়তা করেছেন আগুপিছু কিছুই না ভেবে। সমাজের পক্ষে এহেন কাজ অত্যন্ত লজ্জাজনক বলেই আমার ধারণা।”
বেশ কিছুক্ষণ ফাইলটির দিকে চোখ রেখে অবশেষে বিচারক চোখ তুলে চাইলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “কোর্ট এখনকার মত মুলতুবি করা হল। দুপুর তিনটের সময় রায় দেয়া হবে।”
হাতের থেকে মুখটা তুলে কাঠগড়ার ভেতর থেকে শোভন উত্তমের দিকে ফিরে তাকাল।
“আই অ্যাম সরি। নিজের ঝামেলা নিয়েই এত মশগুল হয়ে ছিলাম যে আমি আগে তোর খবর নিইনি। নইলে ব্যাপারটা এতদূর--”
একটা ম্লান হাসি খেলে গেল শোভনের মুখে। গালে হাতটা ঘসতে ঘসতে বলল, “ইশকুলটা একেবারে ভেঙে তছনচ করে দিয়েছে, না রে?”
“ও কথা তুই ছাড়। আগে এখান থেকে বেরো, একটু সুস্থ হয়ে নে, তারপর তোর ইশকুল নিয়ে অনেক কথা আছে। আমার একটা প্রোপোজাল দেবো তোকে।”
“বললেই কি ভাবনা ছাড়া যায় রে! এতগুলো ছেলেমেয়ে—”
“আগে ঝামেলাটা মিটে নিক, তারপর ও নিয়ে কথা হবে। আমাকে তুই একটু শুধু সুযোগ দিস এবারে। তারপর দেখি তোর স্বপ্নটাকে কে আটকায়!”
“চলুন, চলুন, আসামীর সঙ্গে কথা বলবেন না,” পুলিশের একজন লোক এসে ধমক দিচ্ছিল। উত্তম সরে এল। শোভনকে কাঠগড়া থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিপজ্জনক আসামীটিকে মধ্যাহ্নবিরতির সময় গরাদের আড়ালে না রেখে স্বস্তি পাবে না প্রশাসন। সেটাই আইন।
আদালতের হোল্ডিং সেল-এর গরাদের আড়ালে বসে বসে উত্তমের কথাগুলো নিয়ে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করছিল শোভন। কোর্টে এসে উত্তমকে দেখে আজ তার একটা ধাক্কা লেগেছিল। একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল ব্যাপারটা। নামি উকিল ভাড়া করেছে উত্তম তার জন্য। কেন? ওর কথাগুলোতেও কেন যেন তার ঠিক ভরসা আসছিল না। সেই একই উত্তম রয়ে গেছে চেহারায় হাবেভাবে, কিন্তু কোথায় যেন কিছু একটা বদলে গেছে। ঠিক সেই মানুষটাই কিন্তু সে নয়—বদলটা কোথায় হল? ঠিক ধরতে পারছিল না সে।
“আদালত দশ হাজার টাকার ব্যক্তিগত বন্ডে শ্রী শোভন মণ্ডলের জামিন মঞ্জুর করছে। তবে পুলিশ অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে পারবে এবং শ্রী মণ্ডলকে তাঁদের সঙ্গে সবরকম সহযোগিতা করতে হবে। তিনমাস সময় দেয়া হল আপনাদের এই ব্যাপারে আপনাদের দাবির সমর্থনে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে চার্জশিট দেবার জন্য। অভিযুক্তকে আগামি তিনমাস হয় তাঁর নিজের এলাকাতে অথবা তাঁর জামিনদারের বাসস্থানের কাছাকাছি তাঁর নজরের আওতায় থাকতে হবে এবং প্রতি সোমবারে তদন্তকারী অফিসারের সামনে হাজিরা দিতে হবে এবং তাঁদের সঙ্গে সবরকম সহযোগিতা করতে হবে। চার্জশিট পেশ হবার পর এ মামলায় পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক হবে।”
“একটা আর্জি আছে ধর্মাবতার,” সান্যাল ফের উঠে দাঁড়ালেন, “গতকাল জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে তাঁর একটি ছেলে হয়েছে। গতকাল সকালে তাঁর সেখানে চলে যাবার কথা ছিল। তাঁর স্ত্রী সেখানে দুজন অনাত্মীয় মহিলার আশ্রয়ে রয়েছেন। তিনি অসুস্থ এবং এই মুহূর্তে হাসপাতালে আছেন। সেরে ওঠবার আগে তাঁর পক্ষে এখানে ফিরে আসা সম্ভব নয়। মানবিকতার খাতিরে আমার মক্কেলকে জলপাইগুড়িতে গিয়ে তাঁর সন্তানকে দেখবার অনুমতি দেয়া হোক।”
“অবজেকশন ইওর অনার,” প্রসিকিউশনের উকিল উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর বাক্যটা শেষ হবার আগেই তাঁকে থামিয়ে দিলেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, “অবজেকশন ওভাররুলড। আসামীপক্ষের আবেদন মঞ্জুর হল। তবে এই যাত্রা চলাকালে তাঁর জামিনদারকে তাঁর সঙ্গে থাকতে হবে এবং তদন্তকারী সংস্থার উত্তরবঙ্গের নিকটতম শাখায় সংস্থার নির্ধারিত অফিসারের কাছে রিপোর্ট করে তাঁকে তাঁর গতিবিধির ব্যাপারে অবহিত রাখতে হবে।”
“আমায় একটু কৃষ্ণনগর স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে যাবি?” গাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে শোভন বলল।
“তোমার ফোন থেকে ফরিদাদির নাম্বার মিলিয়ে দিয়েছি শোভনদা। রিং হচ্ছে। ধরো।” হঠাৎ ব্রতীন হাত বাড়িয়ে শোভনের ফোনটা তার হাতে দিল।
ফোনটা নিয়ে কানে লাগাল শোভন। গাড়ি ছুটছিল বাজারের ভেতর দিয়ে।
“কেমন আছো?”
“ভালো আছি। কতোবার ফোন করেছি তোমায় জানো? তোমার ফোন খালি সুইচ অফ বলছে। সমরেশ, সুকল্যাণ, ব্রতীন কেউ কল রিসিভ করছিল না আমার। কী হয়েছে? কবে আসবে তুমি? ওদিকে সব ঠিক আছে তো?”
ওপাশ থেকে ব্রতীন ইশারা করছিল তাকে। ফরিদাকে কিছু জানানো হয়নি এখনো। মুখ থেকে বের হয়ে আসা কথাগুলোকে গিলে ফেলে শোভন বলল, “আমার একটু সময় লাগবে ফরিদা। কটা দিন একটু সামলে নাও তুমি। মাদ্রি আর শর্মিষ্ঠা তো রইলো।”
চুপ করে রইল ফরিদা। তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় কু ডাক ডাকছিল। একটু বাদে সে বলল, “তোমার কিছু হয়েছে। নইলে ব্রতীন ফের কলকাতায় কেন ছুটে গেল হঠাৎ করে কালকে? তুমি আমায় ফ্র্যাংকলি বলো। কী হয়েছে।”
ব্রতীনের উদ্যত ইশারাকে হাত তুলে থামিয়ে দিল শোভন। ফরিদার অধিকার আছে জানবার। মিথ্যে স্তোক দিয়ে তাকে সে ভোলাবে না। বলল, “আমাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছিলো পরশু রাতে। জামিনে ছাড়া পেয়েছি এইমাত্র। আমার সঙ্গে ব্রতীন আছে। উত্তমও এসেছে খবর পেয়ে। আমি ঠিক আছি। দু একদিনের মধ্যেই তোমার কাছে পৌঁছোব।”
ফোনটা উল্টোদিক থেকে কেটে দিল ফরিদা। চুপ হয়ে যাওয়া যন্ত্রটাকে পকেটে রাখতে রাখতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে শোভন হঠাৎ বলল, “কোথায় যাচ্ছিস? আমাকে--”
“মুরলীপুরে তোর এখন ফেরা হবে না শোভন। তুই আমার সঙ্গে যাচ্ছিস। আমার কলকাতার বাড়িতে—”
“ইমপসিবল। ব্যাপারটা তুই একটু বোঝবার চেষ্টা কর উত্তম। আমার ইশকুলটার কথা ভাব। এখনই ওখানে না গিয়ে পড়লে ওটা আর থাকবে না রে! কী অবস্থা হয়ে আছে কে জানে।”
“শোভন, শোন। আমি গত দু’দিনে কিছু খোঁজখবর নিয়েছি তোর এলাকায়। কেজরিওয়ালের এডুকেশন কনসালটেন্সি ব্রাঞ্চ গোটা ওয়েস্ট বেঙ্গল জুড়ে এখন ব্যবসা ছড়াচ্ছে। নদীয়ায় সামনেই আমরা প্রজেক্ট রোল আউট করতে চলেছি। ওখানকার পার্টি ফর্মেশনে আমার ভালো ইনরোড আছে। পার্টিকে খুশি না রেখে এসব কাজ যে করা যায় না সেতো তুই ভালোই জানিস। খবর যা পেয়েছি তাতে তোকে নিয়ে তোদের অমরেশ বাগচির কিছু ব্যাক আপ প্ল্যান করা রয়েছে। ইনসাইডার নিউজ। তুই কোনভাবে এখন এলাকায় ঢুকলে জ্যান্ত ফিরবি না। ব্যাপারটা ও জনরোষ বলে চালিয়ে দেবে। শহিদ হয়ে ফটো হয়ে গেলে তারপর কাজ করবি কী করে?”
“কিন্তু তাহলে আমার ইশকুলটা—আমার মেলাটা—সব একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে যে!”
“ওয়ান অ্যাট এ টাইম শোভন। এদিকে মামলাটা চলুক। ওদিকে প্রথমে ইশকুলটা সামলাতে হবে। ওখানে এখন তোর সেকেন্ড ইন কম্যান্ড কে আছে তার নাম্বারটা আমায় দে। আমি কথা বলব। ট্রাস্ট মি, তোর স্কুলের কোন ক্ষতি হতে দেব না আমি। সেটা সামলে তারপর মেলার ব্যাপারটা দেখছি।”
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল শোভন। তারপর বলল, “আমি কাল জলপাইগুড়ি যাব। তোকেও তো আমার সঙ্গে যেতে হবে তাহলে।”
উত্তমের মুখের ওপর দিয়ে হালকা একটা ছায়া সরে গেল যেন। বলল, “জলপাইগুড়ি? মানে আমি বলছিলাম কটা দিন বাদ দিয়ে—”
শোভন মাথা নাড়ল, “সেটা সম্ভব নয় উত্তম। তুই যেতে না চাস, কাম হোয়াট মে আমি একাই যাব, সে তার কনসিকোয়েন্স যা-ই হোক না কেন।”
তার দিকে একবার ঘুরে তাকাল উত্তম। এই শোভনকে সে চেনে। এ কথার নড়চড় হবে না তার। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, “বেশ। কাল দুপুরের ফ্লাইটে তাহলে--”
“সকালের কাঞ্চনকন্যা ধরব ভাবছিলাম। ফ্লাইটে যাবার মত অবস্থা আমার নয় উত্তম।”
“হঠাৎ শোভনের হাতটা জড়িয়ে ধরল উত্তম, “তোর ছেলে হয়েছে শোভন। এটা আমার কাছেও একটা আনন্দের খবর। ধরে নে এটা তার কাকার তরফ থেকে একটা গিফট। কাল দুপুরের মধ্যে তার সামনে তোকে আমি পৌঁছে দিতে চাই। তুই আপত্তি করিস না।”
ফরিদা চোখ না তুলেই বলল, “তুমি নিশ্চয় সব কথা জানতে। তাহলে আমায় আগে--”
“বলিনি। আমার জায়গায় তুমি হলে তুমিও বলতে কি? এখন বলো, ওদিকের খবর কী?”
“এইমাত্র জামিনে ছাড়া পেয়েছে। দু একদিনের মধ্যেই জলপাইগুড়ি আসছে বলল। উত্তমদা আর ব্রতীন রয়েছে সঙ্গে।”
হঠাৎ মুখের ভাবটা বদলে গেল সমাদৃতার। নিচু গলায় প্রায় ফিসফিস করে নিজেকেই বলল, “উত্তম? সে এই ব্যাপারে—শোভনের সঙ্গে সে-ও এখানে--”
“জানিনা। আমি কিছু জানিনা গো। আমার বড় ক্লান্ত লাগছে সমাদৃতাদি, আমার—” বলতে বলতে হঠাৎ সমাদৃতার হাতটা জড়িয়ে ধরে তার মধ্যে মুখ গুঁজল ফরিদা। সেই ছোটবেলার পরে এই প্রথম সম্ভবত, দুচোখ ভেঙে জল নামছিল তার। অন্য হাতটা তার মাথায় রাখল সমাদৃতা। বড় শক্ত মেয়ে এই ফরিদা। শক্ত মেয়েরা যখন ভাঙে তখন তাদের যে কি নিদারুণ যন্ত্রণা সইতে হয় সে কথা তার চেয়ে ভালো করে আর কে জানে!
“এই যে, সরুন সরুন। আপনারা যে কেন বেসিক ব্যাপারগুলো বোঝেন না! সদ্য একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে গেছেন পেশেন্ট। তাঁকে এইভাবে ইমোশনালি ডিস্টেবিলাইজ করে দিলে ফল আপনাদেরই ভুগতে হবে।” ডঃ কর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে একটু বিরক্ত গলাতেই বলে উঠলেন পেছন থেকে। সমাদৃতা হাত উলটে ঘড়িটা দেখল একবার। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ডাক্তারবাবুরা রাউন্ডে বের হচ্ছেন। ফরিদার মুখটা দুহাতে ধরে তার চোখে চোখ রেখে সে বলল, “কেঁদো না। শোভনের মত মানুষের সঙ্গে নিজের ভাগ্য যখন জুড়েছো তখন তোমায় এমন অনেক সইতে হবে। আমি এখন আসি।” তারপর ডাক্তারবাবুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, “ওকে বাড়ি কবে নিয়ে যেতে পারব বলুন তো স্যার?”
ডঃ কর ফরিদাকে পরীক্ষা করতে করতে বললেন, “শি ইজ ডুইং ফাইন। কালকেও নিয়ে যেতে পারেন। তবে আমার মতে এখানেই আরো দু একটা দিন নাহয় রেখে দিয়ে তারপর একেবারে নিয়ে যাওয়াটাই অ্যাডভাইসেবল হবে।”
বাইরে বের হয়ে গাড়িতে উঠতেই শর্মিষ্ঠার ফোন এল। সে সকালবেলায় ফরিদাকে দেখে গেছে। দুজন মিলে তারা এই হাসপাতালে আসাটা দু বেলায় ভাগ করে নিয়েছে।
“কেমন আছে ফরিদা এবেলা?”
“ভালো আছে। বাচ্চাটার একটু সর্দিমত হয়েছিল। ওষুধটষুধ পড়েছে। সব ঠিক আছে আপাতত।”
“কবে ছাড়বে কিছু বলল?”
“এমনিতে তো ভালই আছে। কিন্তু ডঃ কর তো বললেন কালকেই নিয়ে আসা যায়। তারপর নিজেই আবার বললেন আরো দিন দুয়েক রেখে দিয়ে তারপর ছাড়বেন। সিজারিয়ান কেস তো! আমি আপত্তি করিনি। একেবারে ভালোভাবে সেরেসুরে নিক।”
“ভালোই করেছো মাদ্রিদি। কালকে নিয়ে এলে একটু মুশকিল হতে পারত। ব্রতীন ফোন করেছিল এইমাত্র। বলল, “কালকে দুপুরের ফ্লাইটে ওরা তিনজন ফিরছে। বাগডোগরা থেকে সোজা গাড়ি নিয়ে চলে আসবে।”
“তিনজন!”
“হ্যাঁ। উত্তমদাকেও আসতে হচ্ছে। ওকে জলপাইগুড়ি আসবার পারমিশান দিয়েছে, কিন্তু বেল-এর কন্ডিশানে বলে দিয়েছে জামিনদারকে সঙ্গে থাকতে হবে। উত্তমদাই জামিনদার হয়েছে তো! ও নইলে শোভনদারও আসা হত না এদিকে এখন আর।”
মাদ্রি তার কথার কোন জবাব দিল না। একটা তীব্র, অসহায় রাগ উঠে আসছিল তার বুকের ভেতর থেকে। অথচ কারো ওপরে তা প্রকাশ করবার কোন জায়গা নেই। ফোনটা কেটে দিয়ে হাসপাতালে ফোন করল সে। রিসেপশানে ফরিদার বেড নম্বরটা দিয়ে বলল, কাল সকালে সে পেশেন্টকে বন্ড সই করে বাড়ি নিয়ে যাবে। তারপর ফের শর্মিষ্ঠাকে ফোনে ধরে বলল, “কাল সকালে হাসপাতালে না গিয়ে তুমি ভোর ভোর উঠে আমার বাড়িতে চলে আসবে একবার?”
“আসবো। কিন্তু হলটা কী হঠাৎ করে?” শর্মিষ্ঠার গলায় কৌ্তূহলের স্পর্শ ছিল।
“কাল সকালে আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। ফরিদাকে আমি কালই বন্ড দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে চাই শর্মিষ্ঠা।”
তার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। শর্মিষ্ঠা আর কোন কৌতুহল প্রকাশ করল না এই নিয়ে। শুধু সম্মতি জানিয়ে ফোন নামিয়ে রাখল সে।
বাড়িতে ফেরার বাকি পথটা একেবারে চুপ হয়ে বসে রইল সমাদৃতা। কাল থেকে বাড়িতে শুধু বিল্টুকে নিয়ে থাকবার সাহস তার আর নেই। একলা উত্তমের মুখোমুখি সে আর কখনো হতে পারবে না।
|| ১৫ ||
“আর একবার কি চা দেবো স্যার?” লোকাল ইন চার্জ ভদ্রলোক ঘরের দরজাটা একটু ফাঁক করে মাথা গলাচ্ছিলেন ভেতরে। তাঁকে ইশারায় চলে যেতে বলল উত্তম। সুষেণ রায় থেমে যাওয়া কথাটার সুতো ফের তুলে নিলেন এবার, “এর কোন দরকার ছিল না। আপনার মত একজন ব্যস্ত মানুষকে এভাবে একজন অ্যাকিউজডের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে হলে কাজকর্মগুলো করবে কে? পুলিশ তাহলে আছে কী করতে? ও আপনি কিছু ভাববেন না। আমি তো রইলামই। শোভনবাবুকে বলে দিয়ে যাবেন শুধু যদ্দিন এখানে থাকবেন, সোমবার সোমবার সদর ফাঁড়িতে আমার ঘরে একবার করে একটু উঁকি দিয়ে যেতে। এখান থেকে রাস্তায় নেমে ডানদিক ঘুরে আধ কিলোমিটারটাক গিয়ে আবার ডানদিকে বেঁকলেই থানা। যে কেউ দেখিয়ে দেবে। আপনাকে এখানে জলপাইগুড়িতে বসে থাকতে হবে না। আমি উইকলি রিপোর্টে লিখে দেব যে আপনাকেও ওঁর সঙ্গে দেখেছি। নিশ্চিন্তে কলকাতায় চলে যান স্যার আপনি।”
“থ্যাংক ইউ সুষেণবাবু,” উত্তম হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা অ্যাশ ট্রেতে গুঁজতে গুঁজতে বলল, “আরেক কাপ চা চলতে পারে নাকি এবারে?”
“না, স্যার, এবারে আমি যাবো। রাউন্ডে বের হতে একবার রায়কতপাড়ার দিকে,” বলতে বলতে উঠে দরজার কাছে পৌঁছে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন মানুষটি। তারপর একটু ইতস্তত গলায় বললেন, “আর একটা কথা ছিল স্যার, মানে বলছিলাম, তাহলে শোভনবাবুর হাত দিয়েই কি সোমবার সোমবার—”
উত্তম ঘাড় নাড়লো, “একদম নয়। উনি যেন টাকাপয়সার কথা জানতেও না পারেন। ও আপনার কাছে ঠিক উইকলি টাকা পৌঁছে যাবে আমার লোক মারফত।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ সে তো নিশ্চয়। চলি তাহলে নমস্কার।”
ভদ্রলোকের চলে যাবার পথটার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠল উত্তমের মুখে। মানি! ব্রাইটার দ্যান সানশাইন, সুইটার দ্যান হানি! ওতে সব হয়। সততা! ফুঃ! কীসের সততা? এন্ড জাস্টিফাইস দা মিনস্। প্রায় ভুলে যাওয়া একটা মুখ আজ বহুকাল বাদে তার মনে পড়ে যাচ্ছিল। জঙ্গলের মধ্যে খানিক জায়গা পরিষ্কার করে ক্লাশরুম। সুব্বুস্যার সেদিন পোস্ট রেভোলিউশান রাশিয়ার কথা বলছিলেন। উত্তম সোলঝেনতসিনের গুলাগ আর্কিপেলাগোর কথা তুলেছিলো হঠাৎ। তুলেছিল উত্তর কোরিয়ার কথা, এসকেপ ফ্রম চায়না নামের বইটার কথাও। প্রশ্ন করেছিল, দেশবাসীর এত রক্ত ঝরিয়ে, এত নৃশংসতা দেখিয়ে বিপ্লবকে টিঁকিয়ে রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে। উত্তরে সুব্বুস্যার একটা কথাই বলেছিলেন, “এন্ড জাস্টিফাইস দা মিনস উত্তম। কথাটা ভুলো না।”
মাথায় একটা হালকা ব্যথা হচ্ছে তার আজকাল। সম্ভবত চোখের পাওয়ার বদলেছে। মাথাটা মৃদু ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে নিজের মনেই বলছিল, “ভুলিনি। একদম ভুলিনি আমি—”
“কিছু বলছিলেন স্যার?” লোকাল ইনচার্জ ভদ্রলোক ফের মাথা গলিয়েছেন ঘরের ভেতরে।
“নাঃ,” মাথা নাড়ল উত্তম, “পালবাবু, আপনি বরং মার্কেটিংএর নবীনবাবুকে আসতে বলুন। আর এই এলাকার সমস্ত হাইস্কুলগুলোর অ্যাড্রেসের লিস্টটা নিয়ে আপনিও চলে আসুন। কাল কলকাতায় ফিরবো। তার আগে আগামি সপ্তাহে ডিস্ট্রিক্টের সমস্ত হেডমাস্টারদের নিয়ে মিটিং-এর একটা ডেট ফিক্স করে নেব আজ।”
সতীশ পাল একটা মোটা ফোল্ডার হাতে ঘরের ভেতর ঢুকে এলেন, “বলছিলাম স্যার, হেডমাস্টারদের যে গিফট প্যাকেজটা হবে আর আমাদের ইনসেনটিভ যা দেয়া হবে তার বিষয়ে--”
উত্তম হাত নেড়ে তাঁকে থামিয়ে দিল, “ওটা পরে হবে। আগে মিটিংটা হোক, হাবভাব বুঝি, তারপর ওসব ঠিক হবে। আরে মশাই আগে টোপটা গিলুক, তারপর যে সবচেয়ে বেশি স্টুডেন্ট কাস্টমার দেবে তাকে তো গিফট দেয়া হবে। সে পরের ব্যাপার।”
“না-মানে আমি বলছিলাম কি স্যার, প্রজেক্ট স্মুথ লঞ্চ হয়ে গেলে আমারও তো ওইসঙ্গে—”
উত্তমের হঠাৎ মাথাটা চিড়িক করে উঠল। লোকটার লোভি মুখটা তার টেবিলের অন্যপাশে ঝুলছে। সেইদিকে একঝলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, “হবে। সব হবে পালবাবু। বিজয়ী হেডমাস্টার আপনাকে না নিয়ে ব্যাংকক প্যাকেজে যাবেন না। কথা দিলাম। এখন যান। যা বললাম সেইমত গুছিয়ে গাছিয়ে নিয়ে চলে আসুন। আমার তাড়া আছে। অন্য একটা জায়গায় যেতে হবে মিটিংটা সেরেই।”
সতীশ পাল চলে গেলে, ফোনটা বের করে অ্যাড্রেস বুকে একটা নম্বর খুঁজছিল উত্তম। ছেলেটার নাম তার খেয়াল নেই সমর বা ওইজাতীয় কিছু হবে। তবে নামের আগে মুরলীপুর প্রিফিক্স দিয়ে রেখেছিল। অতএব খুঁজে বের করতে সমস্যা হল না। ছেলেটার নাম সমরেশ। ভালো ছেলে। আগের দিন প্রথমবার উত্তম ফোন করতে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর পরিচয় হয়ে যেতে এখন বেশ স্বচ্ছন্দ হয়ে গেছে তার সঙ্গে। লাইন মেলাবার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই ফোনের ওপাশ থেকে সাড়া মিলল, “বলুন উত্তমদা।”
অন্যমনস্কভাবে হাতের পেপার ওয়েটটা ঘোরাতে ঘোরাতে উত্তম প্রশ্ন করল, “শ্যামলবাবু তোমাদের স্কুলে গিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ। আজ সকালেই কলকাতা থেকে এসেছেন। এখনো মুরলীপুরেই আছেন। থানায় গিয়েছেন। আমি সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম—”
উত্তম মাথা নাড়ল, “না সমরেশ। তোমাকে ওসব দিক নিয়ে ভাবতে হবে না। শ্যামলবাবু একজন কমপিটেন্ট মানুষ। এসব সিচুয়েশান হ্যান্ডল করে অভ্যস্ত। ওসব পুলিশি উৎপাত উনি হ্যান্ডল করে নেবেন। তুমি বরং তোমাদের স্টুডেন্টদের বাড়ি বাড়ি কন্ট্যাক্ট করো। নির্ভয়ে ইশকুলে আসতে বল। আর পরশু দুপুরে পারলে একটা গার্জিয়ান মিটিং কল করে দাও। আমি যাবো।”
“শোভনদা?”
“শোভনদাকে এখন কদিন ছেড়ে দাও সমরেশ। একটু ফ্যামিলির ব্যাপারস্যাপারগুলো দেখুক। তাছাড়া এই মুহূর্তে অবস্থা একটু কন্ট্রোলে নিয়ে না আসা পর্যন্ত আমি ওকে মুরলীপুরে ফিরতে দিতে রাজিও নই। ঠিক আছে। পরশু কথা হবে তোমার সঙ্গে, কেমন?”
সতীশ পাল তাঁর লোকজন নিয়ে এসে ঘরে ঢুকছিলেন। সেইদিকে তাকিয়ে ফোনটা ছেড়ে দিল উত্তম।
“আমি একবার ফরিদার ছেলেটাকে দেখতে আসতে চাই। একবার তোমার বাড়িতে আসতে পারি কি?”
কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থাকল সমাদৃতা। এ মুহূর্তটার জন্য হাজার চেষ্টা করেও সে নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করতে পারে নি। তারপর নিচু গলায় বলল, “কখন আসতে চাও?”
“ধরো ঘন্টাখানেক বাদে। একটা মিটিঙে ছিলাম। সেটা শেষ হল এইমাত্র। এখন কিছু কাজকর্ম গুছিয়ে রেখে বের হব। সাতটা নাগাদ পৌঁছে যাব।”
“বেশ। কতক্ষণ থাকবে?”
“কতক্ষণ? দেখা করে সামাজিকতা সারতে যতটুকু সময় লাগে। ধরো বড়জোর ঘন্টাখানেক।”
“বেশ। এসো। কিন্তু একটা অনুরোধ আছে। বিল্টুর জন্য কোন কিছু—”
ওপাশ থেকে ফোনটা ছেড়ে দেয়ার শব্দ এল।
ফোনটা টেবিলের ওপরে রেখে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল সমাদৃতা। ঘড়িতে ছটা বাজছে। অফিস প্রায় খালি। জানালার ফ্রেমে বাইরে মেঘে ছাওয়া আকাশটা দেখা যাচ্ছিল। ঘন্টিটা বাজাতে গোবিন্দদা এসে ঘরে ঢুকলেন। ছোট পার্স একটা অফিসে রাখা থাকে সমাদৃতার। সেটাকে বের করে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে ছাতাটা সঙ্গে নিল সমাদৃতা। তারপর অফিসের ব্যাগটা গোবিন্দর হাতে তুলে দিয়ে বলল, “ব্যাগটা ড্রাইভারকে দিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিও।”
“আপনি যাবেন না?”
“আমি একটু অন্য কাজ সেরে তারপর ফিরব। দেরি হবে।”
“গাড়ি কোথায় কটার সময় যেতে বলব?”
“কিচ্ছু বলতে হবেনা গোবিন্দদা, আমি নিজেই ফিরে যাব। গাড়ি আর লাগবে না আজকে।”
আকাশে মেঘ ঘন হয়ে ঝুলে রয়েছে। বর্ষা এবারে শেষ হয়েও হতে চাইছে না। বারংবার ফিরে ফিরে আসছে। ভেজা হাওয়ার ঝাপটা মারছিল, যদিও বৃষ্টি পড়ছে না এই মুহূর্তে। দূর থেকে তিস্তার জলধারার শোঁ শোঁ শব্দ ভেসে আসছিল। জল ফের বাড়ছে নদীতে। শাড়ির আঁচলটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে কালেক্টরেট ছেড়ে রাস্তা বেরিয়ে এল সমাদৃতা। ভারী অস্থির লাগছিল নিজেকে তার। কোথায় যাবে সে এখন?
বর্ষার সন্ধ্যায় অপরাহ্নে নির্জন শহরটা তার পায়ের নিচে এলিয়ে পড়েছিল। পথ বেয়ে আনমনে হেঁটে যায় মানুষটি। হাতের ডাইনে উঁচু হয়ে ওঠা বাঁধরাস্তাটির ওপরে বড় বড় গাছগুলো থেকে টুপটাপ জলের ফোঁটা ঝরছিল। তার ওপাশ থেকে করলার বয়ে চলবার মৃদু শব্দ ওঠে।
হাঁটতে হাঁটতে কখন যে সে রাজবাড়ির বিরাট দিঘিটির কাছাকাছি এসে পরেছে তা নিজেই খেয়াল করে নি। দিঘির এ পাশে বিশাল শিবমন্দিরটা নিঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বছরের এই সময়ে তার আশেপাশে কোন ফটোশিকারী পর্যটকের আনাগোনার চিহ্ন নেই। কাছাকাছি এসে কি মনে হতে মন্দিরের হাতার ভেতরে ঢুকে এল সমাদৃতা।
ভেতর থেকে মৃদু গানের শব্দ উঠছিল। হিন্দি ভাষায় চিরপরিচিত সরল একটা ভজনঃ
কিশোরী ইতিনা তো কিজোক্লান্ত অথচ মিষ্টি সুরের সম্মিলিত সঙ্গীত। সমাদৃতা ধীরে ধীরে সেইদিকে এগিয়ে গেল।
লাডলি ইতিনা তো কিজো--
নানা বয়সের অনেকগুলি মেয়ে একত্র হয়ে বসেছে মন্দিরের ভেতরের চত্বরের প্রবেশপথে। ডফলির মৃদু রুমুঝুমু শব্দের তালে তালে সমবেত বৃন্দগানের সুর ছড়িয়ে দিচ্ছিল তারা নির্জন মন্দিরচত্বরে-
কিশোরী ইতিনা তো কিজো“আও বেটি। ইয়ে লো। বাজাও ঔর গাও হমারে সাথ। সব ঠিক হো জায়েগা দেখনা। গাও—”
লাডলি ইতিনা তো কিজো--
জগজঞ্জাল ছুড়ায়ে বাস বর্সানে কো দিজো
ভোর হোত মহলন মে তারে
সেবা কে মিস যাউঁ
মঙ্গলা কে নিত দর্শন পাউঁ
জীবন সফল বনাউঁ
কিশোরি মোরে সেবা মে লিজো
লাডলি মুঝে সেবা মে লিজো
জগজঞ্জাল ছুড়ায়ে বাস বর্সানে কো দিজো
পরি রহু মৈ দ্বার তিহারে
রসিকন দর্শন পাউঁ
ভকতন কি পগধুলি মিলে তো
অপনে শীস চড়াউঁ
শাঁখা পরা দুটি শীর্ণ বয়োজীর্ণ হাত এগিয়ে এসেছে তার দিকে। কখন যে সে এসে তাদের কাছে বসে পড়েছে মাটির ওপর, সমাদৃতা তা খেয়ালও করেনি। তাকে সাদরে তাঁদের মধ্যে ডেকে নিতে চাইছেন মানুষগুলি। বুদ্ধির অগম্য কোনও পথে তাঁরা তার বুকের ভেতরে চলতে থাকা ঝড়টির খবর পড়তে পেরে গিয়েছেন। নিজেদের সাধ্যের মধ্যে তার অ-সুখের প্রতিকারটিও এগিয়ে ধরেছেন সামনে। সমাদৃতা বাদ্যযন্ত্রটি হাতে তুলে নিল। তার অপটু হাতের টোকা, তার দ্বিধাজড়িত অনভ্যস্ত গলার সুরোৎসার তাঁদের সম্মিলিত সুরের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছিল। সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-শিক্ষা-অশিক্ষার বাধাকে পার করে কখন যে সেই গানের কলিগুলি তার মুখ ছেড়ে বুকের একেবারে ভেতরে গিয়ে বাসা করে বসেছে তা সে টেরও পেল না--