জানালা দিয়ে উত্তম ফিসফিস করে ডাকছিল । শোভন ঘুরে তাকাতে বুড়ো আঙুল আর তর্জনির ডগায় ঘষে টাকা গোনবার মুদ্রা করে দেখালো একবার । অর্থাৎ স্কলারশিপের টাকা এসেছে । খবরটার জন্য শোভন প্রায় বিরহিণী রাধার মত অপেক্ষা করছে গত এক সপ্তাহ ধরে । এ অবস্থায় জি আর এর একশো মিনিটের দুটো ক্লাস পরপর চালাবার কোন মানে হয় না । শোভন হাতের কলমটা বন্ধ করে ঠক করে ডেস্কের ওপর রাখল । সমাদৃতা নোট নিতে নিতেই আড়চোখে চেয়ে দেখল একবার । ঘটনাটা নতুন নয় । ক্লাস চলাকালীন শোভনের কলমের কালি ফুরিয়ে যাওয়াটা প্রায়শই ঘটে থাকে এখানে । অভ্যেস মতো সাইডব্যাগের চেন খোপে হাত ঢুকিয়ে অন্য একটা কলম বার করে আনতে যাবে সে, তখন শোভন ইশারায় মানা করল । তারপর হঠাৎ গলাটা মিষ্টি করে ডাকল, `স্যার' ।
জি আর মনোযোগ দিয়ে হাতের ডায়েরি থেকে নোট লেখাচ্ছিলেন । ডাক শুনে থমকে ঘুরে চাইলেন । ভুরুদুটো গিঁট পাকিয়ে গেছে । এইভাবে মন:সংযোগ বিঘ্নিত হলে ওঁর নোটের লাইন উলটোপালটা হয়ে যায় । আগেও ঘটেছে ।
শোভন মুখটাকে যথাসম্ভব বোকাবোকা করে আদুরে গলায় বলল, "আমার কলমটায় লেখা পড়ছে না সার । আপনার কলমটা একটু ধার দেবেন ?"
জি আর এর কপালের শিরা দুটো ফুলে উঠল । হাই প্রেশারের রুগী, চটাতে চাইলে বেশি কসরৎ করতে হয় না । দাঁতে দাঁত চেপে একবার শুধু শোভনের দিকে তাকিয়ে বললেন, "গেট আউট" । তারপর ফের বোর্ডের দিকে মন দিলেন । সমাদৃতা বেশ একটু রাগ রাগ চোখে শোভনের দিকে ঘুরে দেখল একবার । শোভন একগাল হেসে ওর হাত থেকে কলমটা টেনে নিয়ে নোটের খাতার আধভর্তি পাতার তলায় খস খস করে লিখল, "নোটের বাকিটা কার্বন করে রাখিস । স্কলারশিপের টাকা এসেছে । ভালো মেয়ের মতো ক্লাস শেষ করে অ্যাডাম বিল্ডিং এর ক্যান্টিনে চলে আয় । ফিশ ফ্রাই খাওয়াবো ।" অত সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা নোটটার এমন দশা হতে দেখে সমাদৃতা প্রথমে হাঁ হাঁ করে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু তারপর লেখার বিষয়বস্তুটা দেখে একগাল হাসল । শোভন ততক্ষণে ঝোলটা টেনে নিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে ক্লাসের বাইরে পৌঁছে গেছে । জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, দু'পাশে নিচু মাঠের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে যাওয়া আলের মত রাস্তা ধরে লাফাতে লাফাতে শোভন আর উত্তম চলে যাচ্ছে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং-এর দিকে । বাতাসে ভেসে আসছিল, বিচিত্র উচ্চারণে গাওয়া গানের একটা কলি -------
"মুই হইনু অবলা নারী ডিহির বান্ধা জলসেদিকে এক ঝলক চেয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে আনমনে হাসল সমাদৃতা । এ গানটা নিয়ে বেশ একচোট অশান্তি হয়ে গিয়েছে কালকের রিহার্সালে । গানটা শোভন সমাদৃতাকে দিয়ে তোলাবেই, আর সমাদৃতার জিভেও ওই উচ্চারণ উঠবে না । শেষমেষ রেগে গিয়ে শোভন বলেছিল, "রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ আর রজনীকান্ত গেয়ে তোর জিভ পলিউটেড হয়ে গেছে মাদ্রি । বাংলার আসল মাটির গান তোর দ্বারা আর হবে না ।"
নিদয়া ভাতারটা মুর করেছে যে ছল -------"
সমাদৃতাও রেগে পালটা প্রশ্ন করেছিল, "কেন, রবীন্দ্রনাথ অতুলপ্রসাদট্রসাদেরা বাঙালি নয়তো স্প্যানিশ ছিল নাকি ?"
জবাবটা দিয়েছিল শোভনের মানিকজোড় উত্তম । বলে, "না, তা নয় । সংস্কৃতি একটা মাল্টিলেয়ার্ড অ্যাফেয়ার সেটা তো মানবি । এঁরা সেই বহুতল সংস্কৃতির দোতলা তিনতলার লোক । গ্রাউণ্ড ফ্লোরের ধুলো কাদার গন্ধ এঁদের গানে আসে, তবে সরাসরি না । আসে, নাগরিক শিক্ষার ফিল্টারে পরিশ্রুত হয়ে, সচেতন দার্শনিকতার সুগন্ধ মেখে, বুদ্ধিনন্দন ও শ্রবনমোহন হয়ে । যে গানে সরাসরি ধুলোমাটির গন্ধ আসে সেই একতলার গানের কথা বলছে শোভন ।"
শোভন খুশি হয়ে মাথা নেড়ে তাল দিয়েছিল উত্তমের কথায় । অত গুছিয়ে কথা বলা তার আসে না । কৃষিজীবী পরিবারের এই মেধাবী ছেলেটি ভাবের রাজ্যে যে স্তরে বিচরণ করে ভাষার দুনিয়ায় তার সেই স্তরের দখল নেই । যা সে বলতে চায় সেটাকে এই নাগরিক সহপাঠিদের বোধ্য ভাষায় অনুবাদ করতে উত্তমের সাহায্য তার প্রতিমুহুর্তে দরকার হয় ।
উত্তম বড় ভালো বোঝে শোভনকে । দুই বন্ধু সেই ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম দিন থেকেই যাকে বলে হরিহর আত্মা । অবশ্য সমাদৃতাও ওই একই সময়ের বন্ধু ওদের, কিন্তু গলাগলি ভাবটা হতে ফার্স্ট ইয়ারের শেষাশেষি হয়ে গিয়েছিল । তার পর থেকে এতগুলো বছর কেটে গেল একসাথে -------
------- হঠাৎ করেই বাবার একটা কথা মনে পড়ে গেল সমাদৃতার । এক লাইনের অ্যানালিসিস । সমাদৃতার জন্মদিনের নেমন্তন্নে এসে দুই বন্ধুর তর্ক-বিতর্ক শুনে সেদিন রাতে বাবা বলেছিলেন, "শোভনটা হল একতাল কাঁচা সোনা । আর উত্তম হল স্যাকরা । চয়েস ইস ইয়োর্স ।" বাবা চিরটাকাল যখন খুশি, যা নয় তাই বলে ফেলেন । সমাদৃতার কান লাল হয়ে উঠেছিল । বলে, "আমার চয়েস বলতে তুমি কী মিন করছো ?"
বাবা হো হো করে হেসে বলেছিলেন, "নাথিং ডার্লিং । জাস্ট মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল কথাটা । তিনজনকে যেরকম অবিচ্ছেদ্য হরিহর আত্মা রূপে দেখে আসছি গত কয়েক বছর ধরে, তাই বলে ফেললাম আর কি ! ক্লাসে এক গাদা মেয়ে থাকতে জন্মদিনেও কেবল মানিকজোড়ের নেমন্তন্ন ! সিনেমা, থিয়েটার, গানের জলসায় তিন বন্ধুর গ্রুপ । এক সময় না এক সময় তো গ্রুপটাকে ছাঁটতে হবে একটু, নাকি ?"
মা সেবারে সমাদৃতাকে এসে উদ্ধার করেন । ঝংকার দিয়ে বলে উঠেছিলেন, "আচ্ছা, তোমার বয়সটা কি আর বাড়বে না কখনো ? চিরটাকাল আলটপকা কথা বলে আমায় জ্বালিয়ে গেলে, এবারে মেয়েটার পেছনে লেগেছো ?"
বাবার ওপর সে'সময় বেশ রাগ গোঁসা করলেও প্রশ্নটা কিন্তু সেই থেকে সমাদৃতার সঙ্গ ছাড়েনি । আর একটা মাত্র বছর । তারপর যার যার পথে রওয়ানা । সময় নেই বেশি । সিদ্ধান্ত একটা নিতেই হবে তাকে । আজ নয়তো কাল । আর সে প্রশ্নটা সচেতনভাবে মনে আসতেই দেখা গিয়েছিল, দ্বন্দ্বটা তার অবচেতনে তৈরি হয়ে রয়েছে বহুকাল আগেই । হৃদয় আর বিষয়বুদ্ধির চিরকেলে সেই দ্বন্দ্বের ভিন্নমুখী টানের যন্ত্রণা মাঝে মাঝেই বড় তীব্র হয়ে ওঠে । কয়েক মাস যেমন ঘটল । সুন্দরনগরের সতীমায়ের মেলায় গানের আসরে । মুনির ফকিরের সম্প্রদায়ের গান ছিল সেই রাত্রে । শ্যামচাঁদ বলে একটা বাচ্চা ছেলে গান ধরেছে -------
ছেলেমানুষের মত হাত ধরে টানাটানি জুড়েছিল শোভন । প্রিয় বন্ধুটিকে প্রিয় গানের ভাগ না দিয়ে তার শান্তি নেই । সমাদৃতার ঈষৎ জ্বরতপ্ত হাতের স্পর্শ তাকে অন্য কোন দুশ্চিন্তা দূরস্থান, কোন কৌতুহলেও ভোগায়নি সেই সন্ধেয় । শোভনের হাতের ঠাণ্ডা স্পর্শ আরাম দিয়েছিল সমাদৃতাকে । হাত ছাড়িয়ে নেয়নি সে । মৃদু হেসে বলেছিল, "তার চাইতে সত্যি কথাটা বলে ফেল দেখি, আমি সঙ্গে না থাকলে তোর গানের আসর জমবে না । তাই তো ?" দুষ্টুমি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়া বালকের মত মুখ করে হেসেছিল শোভন । তারপর বলেছিল, "চল, ওঠ । তাড়াতাড়ি কর ।"
শ্যামচাঁদের গলা উঁচু থেকে উঁচুতর স্বরগ্রামে চড়ছিল তখন । সুরেলা শব্দগুলো গলিত সিসের মত সমাদৃতার সমস্ত চেতনায় এক যন্ত্রণাময় অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছিল । মাথায় তীব্র ব্যাথা । জ্বরটা বোধহয় বেড়েছে । পাশে চেয়ে দেখে শোভন মগ্ন হয়ে ডুব মেরেছে গানের গভীরে । তার বড়ো বড়ো চোখদুটি স্টেজের দিকে নিবদ্ধ । এমন সময় পিঠে কার ছোঁয়া পেয়ে ঘুরে দেখে, উত্তম এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে । কানের কাছে মুখ এনে বলে, "ঈশিতার সঙ্গে মিত্রপাড়া স্টেশনে দেখা হল । বাড়ি যাচ্ছে হোস্টেল থেকে । বলল তুই জ্বর গায়ে শোভনের সঙ্গে গান শুনতে চলে এসেছিস । ভালো করিসনি । হিম পড়ছে । উঠে আয় । পৌঁছে দিচ্ছি ।"
সে উঠে দাঁড়াতে শোভনের জ্ঞান ফিরল । সমাদৃতার দিকে ফিরে বলে, "কিরে, ফিরবি ? আর একটু বোস না ! শ্যামচাঁদের গানটা শেষ হোক, তোকে দিয়ে আসছি ।" উত্তম তাড়াতাড়ি বলল, "না, না শোভন, তোকে ডিস্টার্ব করব না । তুই গান শোন । আমি হস্টেলে যাবার পথে মাদ্রিকে ছেড়ে দিয়ে যাব'খন ।"
মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে শোভন ফের ফিরে গেল তার গানের ভেতর । সেই রাতে আমবাগানের ঝুপসি অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে উত্তমের হাতে ভর দিয়ে ফিরতে ফিরতে বড় নিশ্চিন্ত বোধ করেছিল সমাদৃতা । তার মন পড়ে ছিল শোভনের সঙ্গে গানের আসরে, কিন্তু জ্বরতপ্ত দেহে অন্ধকার হোস্টেলের আশ্রয়ে ফেরবার পথে পাশে উত্তমের থাকা তাকে একটা বিচিত্র নিরাপত্তার অনুভূতি দিয়েছিল । গত একুশ বছরের জীবনে এই প্রথম । নিজের অজান্তেই বোধ হয় সেই মুহুর্তেই বাবার প্রশ্নটা তার সামনে খুব বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল এসে । কেন এমন হয় ? এরা দু'জন যদি একটিই মানুষ হত । মাদ্রি এখন কোনদিকে যায় । অন্ধকারের আবডালে নিজের ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকেছিল সে -------
"কী রে ক্ষেপি । আবার চোখ খুলে স্বপ্ন দেখছিস ?" উত্তমের গলার আওয়াজে চেতনা ফিরল সমাদৃতার । ক্লাস শেষ হয়ে গিয়েছে কখন যেন । জানালা দিয়ে ছুটে আসা শীতের দুপুরের হাওয়ায় তার অসমাপ্ত নোটের পাতা আর তার তলায় রাখা কার্বন কাগজের টুকরোটা অশান্ত দুষ্টু ছেলের মত লাফঝাঁপ করছিল । সেইদিকে তাকিয়ে সমাদৃতা বলল, "খানিকটা নোট মিস হয়ে গেল শেষের দিকে । কারো থেকে টুকে নিতে হবে আবার ।"
"ধুত্তোর নোট । এখন চল তাড়াতাড়ি । আমাতে শোভনে মিলে হাজার তিনেক পাওয়া গেছে । ছ'মাসের টাকা ডিউ ছিল । ক্যান্টিনে অর্ডার দিয়ে শোভন বসে আছে । আমি তোকে ডাকতে এলাম ।"
অতীনের অবশ্য ঠাণ্ডায় বিশেষ ভ্রুক্ষেপ নেই । কাঁধের ব্যাগটা গার্গীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলন্ত ট্রেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে । স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালেই ঠেলে বার হয়ে আসা যাত্রীদের স্রোতে দেহ ছেড়ে দিয়ে ভেসে যাওয়া বাইরে, তারপর আবার ঢুকে আসা নতুন স্রোতে ভেসে স্বস্থানে ফিরে আসা । তারপর দরজার মাঝের রডটাকে এক হাতে ধরে, অর্ধেক শরীর ট্রেনের বাইরে উল্টোদিকে ছুটে যাওয়া হাওয়ায় মেলে ধরে উদ্দাম ছুটে চলা । একটা অদ্ভুত মাদকতা আছে এই ধরনের যাত্রায় । শোভন চেষ্টা করে দেখেছে দু'এক বার । ভালো লাগেনি । একটা ভীষণ অস্থিরতা তৈরি হয় বুকের ভেতর ।
"বাদাম খাবি ?"
গার্গী পেছন থেকে ডাকছিল । শোভন মাথা নেড়ে বলল, "দে" ।
"হাত বাড়া" ।
শোভন মাথা ঘুরিয়ে গার্গীর অবস্থানটা একবার দেখে নিয়ে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হাতটা ওর দিকে এগিয়ে দিল । মেয়েরা সব পারে । ওই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও গার্গী বাদাম কিনছে । ব্যাগ খুলে পার্স বের করে পয়সা মিটিয়েছে । শোভনের বাড়িয়ে ধরা হাতে ছোট দুটো কাগজের ঠোঙা গুঁজে দিল সে । তারপর বলল, "একটা অতীনকে দিয়ে দে" ।
"দাঁড়া, চাকদা আসুক । দিচ্ছি ।"
পালপাড়া থেকে কয়েক মিনিট পরে চাকদা । লোক নামছে হুড়মুড় করে । তার মধ্যে উল্টোমুখে সাঁতার কেটে শোভনরা করিডোর ছেড়ে ভেতরে সিটিং এরিয়ায় ঢুকে এল । বন্ধ জানালার পাশে মুখোমুখি বেশ কয়েকটা জায়গা খালি হয়েছে । অতীনও ঢুকে এসেছে এবারে । চারপাশটা দেখে নিয়ে বলল, "বা:, পিচে অনেক উইকেট পড়ল দেখছি এই ইনিংসে । বেশ, বেশ । একটু আরাম করে বসা যাবে ।"
"বসে আর হবে কী ? নামবি তো আর দু'স্টেশন বাদে ।"
জানালার ধারের একটা সিটে বসে সামনের খালি সিটে পা তুলে দিতে দিতে অতীন বলল, "তবু, যতটা আরাম করা যায় ।"
বসতে না বসতেই ব্যাগ থেকে একটা বড়োসড়ো বই বার করে নিয়ে তাতে ডুবে গেল অতীন । গার্গী তার কাছে ঘেঁষে বসেছে । বইটা শোভনের চেনা । `বাসু'-র "ইনট্রোডাকশান টু দ্য কনস্টিটিউশন অব ইণ্ডিয়া" । অতীন এবং গার্গী দু'জন ইউ পি এস সি-র পরীক্ষায় বসেছে এবারে । ঝকঝকে ছেলেমেয়ে দুটো । ইউনিভার্সিটিতে নাম আছে বেশ । লাইব্রেরিতে, ক্যান্টিনে, ট্রেনে, প্ল্যাটফর্মে দুই বন্ধুকে অতএব অহরহ বই মুখে দেখা যাচ্ছে আজকাল । ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসিও মন্দ হয়নি চারপাশে । মন্তব্যও হয়েছে অনেক । তাদের মধ্যে সমাদৃতার কমেন্টটা তো এখন গোটা আর্টস ফ্যাকাল্টিতেই বেশ জনপ্রিয় । একদিন দুপুরে ক্লাসরুমের জানালার পাশে বসে সমাদৃতা হঠাৎ বলেছিল, "পুস্তকপ্রেম শব্দটা কিন্তু দ্বন্দ্ব সমাস ।" শোভন অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকাতে জানালা দিয়ে আর্টস ক্যান্টিনের পাশে গুলমোহরের গাছটা দেখিয়ে দিয়েছিল সে । তার তলায় গার্গী আর অতীন । গার্গী কিছু একটা লিখছে । পাশে বসে তার ওপর ঝুঁকে উঁকি মেরে দেখছে অতীন । বেশ সুন্দর ছবি তৈরি হয়েছে একটা । চারপাশে কোনদিকে খেয়াল নেই দু'জনের ।
খানিক সেইদিকে দেখে ভেতর দিকে মুখ ঘোরাতে চোখ নামিয়ে সমাদৃতা বলেছিল, "দেখলি তো ! যাহা পুস্তক তাহাই প্রেম, হল কিনা দ্বন্দ্ব সমাস !"
কথাটা চাউর হতে হতে এখন ফ্যাকাল্টি রুমেও পৌঁছে গেছে । খোদ এম ডি-হেন গম্ভীর মানুষ সেদিন ক্লাস টেস্টের খাতা দিতে দিতে মন্তব্য করে গেলেন, "ইউনিভার্সিটিতে তো এখন পুস্তকপ্রেমের বন্যা ছুটেছে । দ্বন্দ্ব সমাসেই ব্যস্ত সবাই, পড়াশোনার সময় কোথায় ?"
ট্রেনের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে । ঝমঝম শব্দের মধ্যে এক আশ্চর্য নির্জনতা ছেয়ে থাকে । কামরার উল্টোদিকের বেঞ্চে বসে কে যেন গুন গুন করে গান ধরেছে -------
"চার রঙা এক ফুল ফুটেছে -------"
-------কামরার অন্য দিক থেকে ভেসে আসা গুনগুন সেই সুরটিও সেই সুগন্ধের এক পরিপূরক শব্দ অনুসঙ্গ হয়ে ছেয়ে ফেলছিল তার চেতনাকে । এ এক অদ্ভুত ভেসে চলা ------- নিজের অস্তিত্বের গভীর থেকে গভীরতর অঞ্চলে -------
"এই ব্যাটা পল সায়েন্স । না ঘুমিয়ে এখানটা একটু দেখে দে দেখি !" অতীনের ডাকে সম্বিত ফিরল শোভনের ।
সামনে খুলে ধরা বইয়ের পাতায় সার সার অক্ষরের মিছিল । `কেশবানন্দ ভারতী' বনাম ভারত সরকারের কেস ------- বেসিক ফিচার্স অব দি কন্স্টিটিউশন ক্যানট বি চেঞ্জড -------
"অসুবিধেটা কোথায় ?"
এবারে গার্গী কথা বলল, "না, মানে অ্যামেণ্ডমেন্ট করালেই তো সংবিধান বদলানো যায় । সেটাও তো কনস্টিট্যুশনাল রাইটের মধ্যেই পড়ে । সুপ্রিম কোর্ট তবে ওকথা বলল কী করে ?"
শোভন তার মুখের দিকে একবার দেখে বলল, "একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি । দ্যাখ, আমি হলাম মুরালীপুরের শোভন মণ্ডল । ছোটবেলা থেকে হাল চষেছি, মই দিয়েছি । আসরে আসরে বাউল কীর্তন শুনেছি । এখন শহরে এসে ইউনিভার্সিটিতে পলিটিকাল সায়েন্স পড়ে, বলতে পারিস, আমার অনেক অ্যামেণ্ডমেন্ট হয়েছে । আচারে, আচরণে, শিক্ষায়, দীক্ষায়, চলনে, বলনে ------- সবকিছুতেই । কিন্তু তবুও, অতীনের পাশে আমি যদি দাঁড়াই তবে, তুই নিজেই বলতো, তফাত্টা তোর চোখে পড়বে না ? আমার হাতে এই যে লাঙলের মুঠ ধরা কড়া, চামড়ার এই যে রোদপোড়া রং, কথার যে সূক্ষ্ম অ্যাকসেন্ট, সেগুলো কি কখনো বদলাবে ? বদলাবে না । কারণ ওগুলো আমার বেসিক ফিচার । আমার প্রকৃত পরিচয় । আমার অনেক অ্যামেণ্ডমেন্ট মানে বাঙলায় যাকে বলে সংশোধন, সেই জিনিসটা হয়েছে শহরে এসে । আরও হবে । কিন্তু বেসিক ফিচারগুলো কখনো পাল্টাবে না । আর যদি প্লাস্টিক সার্জারি, স্পিচ থেরাপি ইত্যাদি করে বাইরেটা বদলে দেওয়া যায়ও, কিন্তু তখনও বনমালীর আলকাপের খবর পেলে তোদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর ছেড়ে ছুট লাগাবো সোজা । বুকের ভেতরটা বদলাবো কী করে ? অ্যামেণ্ডমেন্ট হয়, বুঝলি ? কিন্তু বেসিক ফিচার বদলায় না ।"
"ওয়াণ্ডারফুল । ভালো বলেছিস শোভন । তুই কিন্তু একেবারে বর্ন টিচার মাইরি । কনসেপ্টটা একদম পরিষ্কার হয়ে গেল-------" অতীনকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল ।
ট্রেনের গতি কমে আসছিল এবার । লোহার চাকায় ব্রেকের তীক্ষণ ধাতব শব্দ পাওয়া যাচ্ছে । সিধে লাইনের ওপর ছুটে চলা চাকার ছন্দময় শব্দ বদলে যাচ্ছিল লাইন থেকে অন্য লাইনে সরে আসবার বেসুরো শব্দে । সেদিকে কান পেতে শুনে গার্গী উঠে দাঁড়াল হঠাৎ । অতীনও বইটই ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল । রাণাঘাট আসছে ।
অতীন, গার্গী নেমে যেতে একটা বেঞ্চি শোভনের একেবারে একার হয়ে গেল । তাতে আরাম করে পা ছড়িয়ে বসতে বসতে গার্গীর গলাটা কানে এল হঠাৎ । বন্ধ জানালার বাইরের প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে অতীনের উদ্দেশ্যে মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছে সে ------- "মাদ্রির কপালে দু:খ আছে রে অতীন । এ যা একগুঁয়ে ছেলে -------"
"চিন্তা করিস না । তোদের মেয়েদের একটা ন্যাচারাল ইনস্টিংকট কাজ করে গার্গী । সেল্ফ প্রিজার্ভেশন-এর ইনস্টিংকট । মাদ্রিও নিজের স্বার্থে ঠিক ডিসিশানটা নিয়ে নেবে ঠিক সময়ে ।"
"কী ? কী বললি ? মেয়েরা স্বার্থপর ? তুই &স্রুছযচ্"
ওদের ত্রক্রমশ দূরে সরে যাওয়া কথাগুলোর দিকে বেশি কান দিল না শোভন । এই মুহূর্তে দূরে সরে যাচ্ছে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্বটিও । এগিয়ে আসছে মুরলীপুর গ্রাম । একটি দ্বিতীয় জীবন । দ্বিতীয় অস্তিত্ব । সেখানে অতীন, গার্গী, সমাদৃতা কেউ নেই । ক্লাসরুম, ক্যান্টিন, কেরিয়ারের স্বপ্ন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বকথা নেই । আছে শুধু &স্রুছযচ্
&স্রুছযচ্ গাড়ি প্রায় খালি হয়ে গেছে একরকম । এদিক ওদিক দু'একজন যাত্রী নজরে পড়ে শুধু । নগরসন্নিহিত ঘনবসতি এলাকাগুলি প্রায় পার হয়ে এসেছে এই ট্রেন । এরপর কালীনারায়ণপুর । তারপর চুর্ণী পেরিয়ে মেন লাইন ছেড়ে এই গাড়ি ঢুকে পড়বে নদীয়ার গ্রাম এলাকার গভীরে । এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে । শীতের সন্ধ্যায় এই গ্রাম অভিসারী যানে যাত্রীর সংখ্যা অতএব বড়ই কম ।
কামরার অন্যপাশ থেকে গুনগুন করে ভেসে আসা গানের শব্দ এইবারে সতেজ হয়েছে -------
     "চার রঙা এক ফুল ফুটেছেচতুবর্ণ পুষ্পরূপ জীবন । তার বুকে মধুর ভাণ্ডার আছে । অলিরূপ চৈতন্য তার বর্ণচ্ছটায় আকৃষ্ট হয়ে কাছে আসে, তারপর মধুভাণ্ডের তল্লাশে যায় &স্রুছযচ্
     এক ফুলেতে জরদ লাল
     আর এক ফুলে মধু
     চার রঙা এক ফুল ফুটেছে &স্রুছযচ্"
পরিচিত সুর । পরিচিত কন্ঠ । এ গলা শোভন চেনে । ছুটন্ত ট্রেনের তালে তালে দুলতে দুলতে গলাটি ত্রক্রমশ এই দিকেই এগিয়ে আসছিল ।
"তা ছোট গোঁসাইয়ের পড়াশুনা এই হপ্তার জন্য মিটল, না কি ? আরে না-না------- উঠতি হবে না, উঠতি হবে না&স্রুছযচারাম করিয়ে বসো । আমি এই মুখোমুখি বেঞ্চিতে বসছি&স্রুছযচ্"
স্নেহের আদেশটি অমান্য করেই শোভন তাড়াতাড়ি বেঞ্চি থেকে পা দুটো নামিয়ে ঘুরে বসল । ভুবন দাস মুখোমুখি এসে বসেছেন ।
"গানটা ভালো গাইছিলা ভুবনদা । শরৎ ফকিরের পদ, তোমার গলায় মানায় ভালো ।"
"শুনতে পেয়েছিলা তবে ? হালিশহর থিকে গাড়ি ধরেছি । সুন্দরনগরে দেখি বাবু এসে উঠলেন । সঙ্গে দুই সাহেব মেমের মত বন্ধু । কথায় কথায় ইংরেজি ঝাড়তিছে । তোমারও তখন অন্য রূপ ছোট গোঁসাই । ক্যামন ত্যাজ ! জ্যোতি বারায় যেন । তখন তোমায় দেখি কে বইলবে তুমি আমাদের ছোট গোঁসাই । সেই যে ------- মনে আছে হরকান্ত দাদা তোমার জন্য গান বেঁধে দিইছিল &স্রুছযচ্
অন্তরে বাহিরে জ্যোতিহাতে তালি দিয়ে আধো গলায় গাইতো, পায়ে ঘুঙুর বাজতো ঝম ঝম, আর হরকান্তদাদা আমাদের বলত, `নিজের ছেলে বলে বলছি না গোঁসাই, এ ছেলে অনেক দূরে যাবে-------' তা সেই কদ্দুর যাবার পথ ধরিছ সেই দেখতেছিলাম অবাক হয়ে । তখনই গানটা জিভের ডগায় চলে এল । ভগবানের দুনিয়ায় কত রং ------- নয় গোঁসাই ?"
আলোর নদী বয় গো
সেই নদীতে স্নান করিয়ে
মানব পাগল হয় গো &স্রুছযচ্
বলতে বলতে হঠাৎ করেই জীর্ণ চোখ দুটি তার উধাও হয় পরিচিত দুনিয়ার গণ্ডি ছেড়ে । আনন্দলহরীর তারে শান্ত, গম্ভীর গুব গুব শব্দ ওঠে । আধভাঙা, দানাদার গলায় ফের সুর ভর করে আসে । খানিক পরে তার সঙ্গে যোগ দেয় শোভনের সতেজ, তরুণ কন্ঠ । আর, তাদের নিয়ে বৈদ্যুতিক সেই লৌহযান তার তীব্র আলোয় অন্ধকার খুঁড়ে খুঁড়ে ত্রক্রমশ ঢুকে চলে গভীর থেকে গভীরতর গ্রামাঞ্চল অভিমুখে ।
শান্তিহাট হল্টে গাড়ি দাঁড়ায় একটা মিনিট । সারি সারি আলোকময় কামরাগুলি তাদের প্ল্যাটফর্মে রেখে দূরের কুয়াশার ভেতর অদৃশ্য হয়ে যেতেই অবিমিশ্র অন্ধকার ফিরে এল ফের । তাতে এদের কারও কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয় অবশ্য । নিশ্চিত পদক্ষেপে প্ল্যাটফর্মের খানাখন্দ ভেঙে এক প্রৌঢ় আর তার তরুণ সঙ্গী এগিয়ে যায় স্টেশনের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের দিকে । শীতের রাত্রি আটটা মানে এই দিগরে গভীর রাতই বটে । আকাশে উজ্জ্বল তারাগুলি, কুয়াশায় আবছায়া অন্তরাল থেকে তাদের ওপর হাল্কা একটি আলোর আভাস ছড়িয়ে দেয় ।
হাঁটতে হাঁটতেই ভুবন বলল, "মুরলীপুর যে যাবা, তা বাস পাবা কি ? লাস্ট বাস তো বোধায় ছাড়ি গ্যাছে ।"
"হতে পারে ভুবনদা । ট্রেন আজ অনেকটাই লেট করল । তবু যাই, দেখি ! যদি থাকে !"
"হ্যা: । বাদ দাও তো ছোট গোঁসাই ! না থাকলো তো ভারি বয়েই গ্যালো ! বিরামনগর তক ভ্যান তো পাবো এখুনো ! মাইলছয়েক রাস্তা । ওমনি কেটে যাবে । রাতটা আখড়ায় কাটায়ে সক্কাল উঠি ফাস্ট বাস ধরবা'খন । হবে না ?"
সামনে ছড়িয়ে থাকা অন্ধকার পথের দিকে চেয়ে আনমনে মাথা নাড়ে তরুণটি । মুরলীপুরের বাড়িতে আজ আর তার পৌঁছোন হবে না । মা ভাববে না অবশ্য । মাঝেমাঝে এমনটা তার হয়েই থাকে । শান্তিহাটের প্ল্যাটফর্ম তার এমন অনেক রত কাটানোর সাক্ষী । আজ তো বরং ভালো হল । রাতের মধ্যে বিরামনগর অবধি এগিয়ে থাকা যাবে । সকালে সেখান থেকে বাস ধরে নিলেই হল । টেনে চালালে আধ ঘন্টার মামলা । শান্তিহাট থেকে কৃষ্ণনগরের ফার্স্ট বাস ছাড়ে ভোর চারটেয় । কাঁচামাল স্পেশাল । বিরামপুর থেকে সেটা ধরে নিলে ভোর ছ'টার আগেই বাড়ি ।
হঠাৎ হাঁটা বন্ধ করে পেছন পেছন আসতে থাকা ভুবনের দিকে ফিরে সে বলল, "তাই চলো ভুবনদা । তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই । রাতে বরং তোমার গান শোনা যাবে ।
"কিন্তু, কী করে হয় ?"
"কী করি কী হয় ছোট গোঁসাই ?"
ভুবনের প্রশ্ন শুনে একটু লজ্জা পেয়ে শোভন বলল, "না, মানে আমাদের ইউনিভার্সিটির ক্লাসে এক মাস্টারের বলা কথা ভাবছিলাম দাদা, তা ভাবতে ভাবতে মুখ ফসকায়ে বেরিয়ে গেছে । ও কিছু নয়-------"
"ওহো ! কলেজের মাস্টারের কথা ! জ্ঞানের কথা ! বড় তত্ত্বের কথা ! তা, আমায় খানিক বলো না দাদা ! বুঝি না বুঝি, জ্ঞানের কথা শুনতে দোষ তো নাই-------" তার কাছ ঘেঁষে আসা ভুবন ফকিরের চোখদুটি তারার আলোয় এক রহস্যময় কৌতুকে জ্বলজ্বল করে । রহস্যপ্রিয় শিশুটি যেন । উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে তার বন্ধুর দিকে ------- বন্ধুর অভিজ্ঞতার ভাগ নেবে বলে ।
শোভনের প্রশ্নটা শুনে খানিক স্তব্ধ হয়ে থেকে হঠাৎ একটি হাতে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে ভুবন বলে, "ও গোঁসাই, তোমার পেটে পেটে এত ? তোমাদের ইংরাজি কলেজে তবে এ তত্ত্বকথাও শেখায় ? তবে কথা হল, এ তো বাউল-ফকিরের গুহ্যতত্ত্বের কথা । তোমার মাস্টারে এর জবাব দেবে কেমন করে ?"
"তুমি জানো ভুবনদা ? এর জবাব ?"
"জানি । তবে বলা বারণ আছে যে ! এ জ্ঞান মুখে এনে এঁটো করে দিতে নাই গো ভাইটি ! আধার যদি ঠিক থাকে তবে জ্ঞান একদিন আপনি এসে তাকে পূরণ কইরবে । কাউরে হাতে ধরি দিতি হবে না ।"
"ধূর ! নিজে নিজে জ্ঞান আসবে ? হয় ?"
অন্ধকারে সাদা দাঁতগুলি দেখিয়ে নি:শব্দে হাসল ভুবন । তারপর শোভনের দিকে ঘুরে বসে বলল, "কথা বলি শোন ছোট গোঁসাই । জঙ্গলে তো হাজার গাছ । তা সব গাছে পক্ষী বাসা বান্ধে কি ? বান্ধে না । যে গাছ তার উপযুক্ত হয় সে গাছে সে আপনি এসে আশ্রয় করে । গাছকে কি ডাল বাড়ায়ে ডাকতি হয়, না পাখির বাসা বানানো শিখতি হয় ? বলো ? যে গাছের কপালে পাখির বাসা আছে সে আপনি তার যুগ্যি হয় । কাউরে বানাতে হয় না ।"
"তুলনাটা ঠিক দিলে না ভুবনদা । পাখি একটা জীবন্ত অস্তিত্ব । তার সঙ্গে-------"
তার কথাটা শেষ করতে না দিয়েই চকিতে পাল্টা প্রশ্নে জবাব দেয় ভুবন দাস, "আর জ্ঞান ? সে বুঝি জ্যান্ত নয় গোঁসাই ? সে বুঝি মরা ? বইয়ের পাতায় বাঁধা ? না গোঁসাই । সে কিন্তু ঠিক কথা নয় ।"
"তাহলে তোমরা অতো গুরু গুরু করো কেন বলতো ? জ্ঞান যদি নিজের পায়েই হেঁটে হেঁটে আসবে তাহলে গুরুর কাজটা আর কী রইল ?"
"আছে । গুরুর কাজে আছে । একটা নমুনা দিই শোন । জল যদি চঞ্চল হয় তবে তাতে চাঁদের ছবি পড়ে ? পড়ে না, তাইতো ? তার জন্যি তাকে সুস্থির হতি হয় । তার অস্থিরতা কমাতি হয় । কাঁচা মাটির পাত্রে জল থাকে ? থাকে না । প্রথমে তারে পোড়ায়ে শক্ত করতি হয় । তবে সে হয় যোগ্য আধার । গুরুর কাজ ওই । মনকে স্থির করাই বলো, আর পোড়ায়ে পাকা বানায়ে তোলাই বলো, সেই কর্ম করতি হলি গুরু লাগে । গুরু বিনে পথ দেখায় কে বলো দেখি ? বলতে বলতেই হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটায় ভুবন । বিনা পূর্বাভাষে হঠাৎ তার থুতনিটি ধরে নেড়ে দিয়ে গেয়ে ওঠে -------
   "তোমার পেটে এত বিদ্যে আগে জানিনে"এঁ ! কী বললে ? আমি কী ?-------"
   আমি ভেবেছিলাম কমলালেবু
   এ ব্যাটা গালপোড়ো ওল কে জানে ?-------"
বিরামনগর বটতলায় ভ্যান থেকে নেমে একটা বিড়ি ধরাল ভুবন । তারপর ডানদিকে প্রসারিত গ্রামমুখী পথটির বদলে তার বিপরীতে নদীর দিকে এগিয়ে যাওয়া পায়ে চলা পথটি ধরল তারা দু'জন । ওই দিকে অন্ধকারে অপেক্ষা করে আছে ভুবন দাসের আখড়া । আজ প্রায় দু'সপ্তাহ পরে মানুষের পা পড়বে সেখানে ।
সমাদৃতা মুখোমুখি সিটে বসে ঘামছিল । এপ্রিলের শেষ হতে না হতেই বিশ্রী গরম পড়ে গিয়েছে এবারে । রুমালে মুখ মুছতে মুছতেই ভ্রুভঙ্গি করে বলে উঠল, "হয়ে গেল । আজ কলেজ স্ট্রিটের কাজ তো পণ্ড হলই, এখন ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরতে পারলে হয় !"
উত্তম আড়চোখে চেয়ে দেখল তার দিকে, "রেগে গেছিস মনে হচ্ছে মাদ্রি ?"
"না রাগবো না । সোদপুর স্টেশনে বারোটায় আসব বলে বাবু এলেন একটা দশের ট্রেনে । তুই দেরিটা না করলে আজ এই ঝামেলায় পড়তে হত ? অবরোধ শুরু হবার আগেই পৌঁছে যেতাম ।"
"হুম । বড্ড রেগেছিস বুঝতে পারছি । কিন্তু লেট ফি তো দিলাম । এতবড় চকলেটটা নিয়ে এলাম, সেটা তারিয়ে তারিয়ে খেলি, একটা টুকরো অবধি দিলি না ।"
"না উত্তম, দেখ, ব্যাপারটা সিরিয়াস । তোর কি আর কোন দিন টাইম জ্ঞান হবে না ? এক্সকিউজ তুই দিবি একগাদা । সে আমি জানি । মিথ্যে কথা তো তোর ঠোঁটের আগায় তৈরিই থাকে ।"
"কাম অন । তুই কিন্তু একটু হাইপার হয়ে যাচ্ছিস মাদ্রি । কুল ডাউন ।-------"
"কুল ডাউন-------" মাদ্রির গলা ভারী হয়ে এল, "মার কাল থেকে জ্বর তুই জানিস ? সকালে উঠে এক ব্যাচ পড়িয়ে, রান্না করে সাড়ে এগারোটার মধ্যে বেরোতে হয়েছে । লেট হবে সে খবরটা দিয়ে আগে থেকে একটা ফোন করে দিলে একটু ধীরে সুস্থে গুছিয়ে বাগিয়ে রেখে বেরোতে পারতাম । তা না, তাড়াহুড়ো করে আধখ্যাঁচড়া কাজ সেরে নাকে মুখে গুঁজে বেরিয়েছি । তারপর এসে যদি দেখি এরকম ডিলে, কার মাথা ঠাণ্ডা থাকে বল ? তার ওপর কাজকর্মও পণ্ড হল । সব তোর এই আনপাংকচুয়ালিটির জন্য ।"
"উফ ! আচ্ছা হয়েছে হয়েছে । আয় নেমে মেট্রো নিয়ে বেরিয়ে যাই । টিকিট আমি কাটছি ।"
"সে তো কাটবিই । ইরেস্পন্সিবিলিটির দণ্ড দিতে হবে না ? তারপর এই রোদে মহাত্মা গান্ধী থেকে কলেজ স্ট্রিট অব্দি রিকশাতেও চড়াতে হবে । সব তোর অ্যাকাউন্টে । নে এখন ব্যাগটা ধর ।"
মাদ্রির ব্যাগটা বেশ ভারী । সেটা হাতে ধরে তার পেছন পেছন ভিড় ঠেলে গেটের দিকে যেতে যেতে উত্তম ব্যাগটার মধ্যে উঁকি মেরে দেখে নিল একবার । একটা ছাতা, গোটা দুই বই, আর স্টিলের বড়োসড়ো টিফিন কৌটো একখানা ।
কলেজ স্কোয়ারের মাঝখানের গেটের উল্টোদিকে ফুটপাথে উঠে হাঁটতে হাঁটতে পরিচিত একটা দোকানের সামনে গিয়ে থামল উত্তম । মাঝবয়সী দোকানদারটির সামনে গিয়ে বলল, "মদনদা, তোমার নতুন খদ্দের নিয়ে এলাম । কী বই চায় দেখো । গোটা কলেজ স্ট্রিট ঘুরে জোগাড় করতে পারেনি গত হপ্তায় । শুনে ভাবলাম, মদনদার কাছে নিয়ে যাই একবার ।"
দোকানি মানুষটি গম্ভীর । ভাবলেশহীন মুখে উত্তমের কথাটা শুনে নিয়ে তারপর সমাদৃতার দিকে ফিরে নির্লিপ্ত গলায় বললেন, "কী বই দিদি ?"
"অ্যানার্কিস্ট কুকবুক । পাওয়েলের । হবে ?"
মদনের ভঙ্গিতে কোনও বদল এলো না । মাথা ঘুরিয়ে পেছনে থাক থাক করে রাখা পুরনো বইয়ের দিকে চোখ ফেলে খুঁজতে খুঁজতেই বলল, "এককালে প্রচুর বিক্রি হয়েছে ও বই । হররোজ একটা দুটো খদ্দের হতই । কলেজেরই ছেলেপুলে সব । ইল্লিগাল বই ছিল । ব্ল্যাকে বেচতাম । দাম ভালোই পাওয়া যেত । কিন্তু সে তো সত্তরের দশকের কথা । এখন ওই বোমা বাঁধার বই নিয়ে আপনি কী করবেন ?"
"আপনি বইটা পড়েছেন ?" সমাদৃতা অবাক হচ্ছিল ।
উত্তরটা এল উত্তমের কাছ থেকে । বলে, "কাকে কী জিজ্ঞেস করছিস মাদ্রি ! মদনদার যা পড়াশোনা সে তুই-------"
তাকে বাধা দিয়ে লজ্জা লজ্জা মুখ করে মদন বলল, "কী যে বলেন ! সামান্য দোকানদার মানুষ; ওই মাঝেমধ্যে চোখ বোলাই একটু, এই আর কি !"
বলতে বলতেই অবশ্য অভ্যস্ত চোখের নিপুণ দৃষ্টিপাতে দোকানের গোটা সংগ্রহটির ওপরেই চোখ বোলানো শেষ হয়ে গিয়েছে তার । সমাদৃতার দিকে ঘুরে মাথা নেড়ে সে বলল, "সরি দিদি । এই মুহুর্তে স্টকে নেই । তবে ঘন্টাদুয়েক বাদে ঘুরে আসতে পারেন যদি তবে আনিয়ে রাখতে পারি । অরিজিন্যাল পাবেন না । ফটোকপি হবে । দেড়শো টাকা পড়বে । আনাবো ?"
টাকার পরিমাণটা একটু বেশি । তবে এত সহজে বইটা মিলে যাবার আশ্বাসের কাছে সে পরিমাণটা গায়ে লাগছিল না সমাদৃতার । বইটা তার বিশেষ করে দরকার । টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির অ্যানার্কিজম-এর ওপরে স্পেশাল পেপারের সেমিনার প্রেজেন্টেশান তার । পেপারটা দাঁড় করাতে এই রেফারেন্সটা বিশেষ জরুরি । মাথা নেড়ে সে বলল, "হয়ে যাবে । আপনি আনিয়ে দিন । আমরা ওয়েট করছি ।"
মদন মাথা নেড়ে বলল, "দাঁড়াতে হবে না । আপনারা বরং ঘন্টাদুয়েক এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে আসুন । আমি বই রেডি করে রেখে দেবো ।"
রাস্তা পেরিয়ে উল্টো ফুটে পৌঁছে চোখ নাচিয়ে উত্তম বলল, "কী রে ? হলো তো বইয়ের জোগাড় ?"
"হুঁ, হলো । তোর জন্যেই পেলাম । থ্যাংক ইউ ।"
"রাগ কমে গেছে মনে হচ্ছে ? ধীরে রজনী, ধীরে । এত তাড়াতাড়ি রাগ কমিয়ে ফেলোনা ম্যাডাম । দু'ঘন্টা পরে ফিরে গিয়ে যদি দেখিস বইটা পাওয়া যাবে না, তখন ফের কমিয়ে ফেলা রাগ ফিরিয়ে আনবি কী করে ?"
"ধ্যাৎ ! তুই না, একটা যা তা । ভয় দেখাবি না তো ! খিদে পেয়েছে না পায়নি, এখন সেইটা বল ।"
উত্তম মাদ্রির ব্যাগটার দিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে বলল, "খাবারটা কী সেটা শুনলে পরে খিদে পাবে কি না ঠিক করবো ।"
মাদ্রি হেসে ঘাড় নাড়ল, "তোর কী খেতে পছন্দ সেটা আমি এতদিনেও জানি না ভেবেছিস ? চল, কোথাও বসি । তারপর দিচ্ছি ।"
কলেজ স্কোয়ারের ভেতরে একটা বেঞ্চ বেছে নিয়ে বসে মাদ্রি ব্যাগ থেকে টিফিন কৌটোটা বের করে খুলে ধরল । রুই মাছের বড় বড় দুটো টুকরো । তার নিচে সোনালি ঝোলে জারানো ভাতে টইটুম্বুর কৌটোটা । তার মধ্যে পাশাপাশি দুটো চামচ ।
চামচ দিয়ে মাছের টুকরোসহ একখাবলা ভাত তুলে মুখে দিল উত্তম । অন্য চামচটা হাতে তুলে নিতে নিতে সমাদৃতা তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, "কী রে, কেমন হয়েছে বল ?"
"তার মানে তুই মিছে কথা বলেছিলি ।"
"কী প্রশ্নের কী উত্তর ! মিছে কথা আবার কখন বললাম ?"
"কেন ওই যে তখন গুল মারলি, মাসীমার শরীর খারাপ বলে তুই রেঁধেছিস আজকে ? এটা তোর রান্না ? ইমপসিবল !"
মাদ্রি চোখ বাঁকাল -------"কেন ?"
"না, মানে নুন, তেল, মশলা, সেদ্ধ, কষানো সব একেবারে ঠিক ঠিক প্রোপোরশানে এসেছে ! পুরো প্রফেশনাল রান্না । থাকিস তো হস্টেলে । এ রান্না তুই জানবি কী করে ? এ তো মাসীমার রান্না !"
এক চামচ ঝোলমাখা ভাত মুখে তুলতে তুলতে সমাদৃতা ঝাঁঝিয়ে উঠল, "আমাকে অতো আণ্ডারএস্টিমেট করিস না উত্তম । তোর সঙ্গে আলাপ হবার অনেক আগে রান্না শিখেছি আমি । স্কুলে থাকতে । উইক এণ্ডে আমায় কোনদিন হোস্টেলে থাকতে দেখেছিস ? শনি-রবি আমায় বাড়িতে রেগুলার রাঁধতে হয় । স্পেশালি রোববারে । ও দিন আমি না রাঁধলে বাবা ভুখ হরতাল করে দেবে ।"
মুখ ভর্তি সুস্বাদু ব্যাঞ্জনভরা ভাত নিয়ে উত্তম অস্ফুটে মন্তব্য করল, "বেঁচে থাক । তোর হবে ।"
"সে তুই বললেও হবে, না বললেও হবে । এখন ও'রকম গোগ্রাসে না খেয়ে আস্তে আস্তে খা । নইলে গলায় কাঁটা লেগে মরলে শেষে থানাপুলিশ করতে হবে ।"
"না: । স্বীকার করতেই হচ্ছে, যদি তুই সত্যি বলে থাকিস তাহলে তুই বেশ ভালো রাঁধিস ।"
"বেস্ট কুক-এর সার্টিফিকেটটা আমায় দিচ্ছিস তা হলে ?"
"না ম্যাডাম । দিচ্ছি না । এর চেয়েও বহুগুণে বেটার কুক আমার জানা আছে । শোভনের মা । গতমাসে ওদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তোকে বলেছি না ? ওদের আবার অত হাটবাজারের পাট নেই । ভদ্রমহিলা ঘরের পেছনের ঝোপজঙ্গল থেকে কি এক শাক তুলে আনলেন । আর শোভন কোথ্থেকে একবোঝা গুগলি এনেছিল । তাই দিয়ে লাঞ্চ হল । শাক, ডাল, গুগলির ঝোল । কিন্তু বিলিভ মি, সে যা টেস্ট হয়েছিল, ভাবা যায় না !"
"গু-গুগলি ? অ্যা:, শোভনরা গুগলি খায় !"
"অত অচ্ছেদ্দা দেখিও না ম্যাডাম । গুগলির ওই ঝাল একবার খেলে আঙুল চাটবি বসে । মাসীমার হাতে ম্যাজিক আছে, বুঝলি ? শোভন ছেলেটা বেশ লাকি । প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যায় । সপ্তাহে দু'দিন ওই স্ট্যাণ্ডার্ডের রান্না খেতে পেলে আমি বর্তে যেতাম ।"
সমাদৃতার গলা নরম হয়ে এলো, "তুই খেতে খুব ভালোবাসিস, নারে উত্তম ?"
"হুঁ", খাদ্যভর্তি মুখে মাথা নাড়িয়ে অস্ফুটে জবাব দিল উত্তম ।
একমনে অন্নব্যাঞ্জনের স্বাদ গ্রহণ করতে থাকা তরুণটির দিকে চেয়ে এক অব্যক্ত স্নেহ ভর করে আসে তরুণীটির মনে । মেদিনীপুরের কোন প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেটি ! লম্বা ছুটি ছাড়া বাড়িতে তার বিশেষ যাওয়া হয় না । আজ বাড়ি থেকে বেরোবার মুখে কী মনে হতে টিফিন কৌটোয় করে নিজের রান্না করা খাবার কিছুটা নিয়ে এসেছিলো সমাদৃতা । অতি সাধারণ আয়োজন । তা হোক ! তবু বাড়ির খাবার তো !
খাওয়া শেষ করে জল খেয়ে এসে উত্তম ঘড়ি দেখে বলল, "এখনও প্রায় ঘন্টাখানেক বাকি । এইবারে তবে কিংকর্তব্যম্ ?" সমাদৃতা ব্যাগ থেকে একটা বই বের করছিলো । সেটা দেখিয়ে বলল, "তুই কী করবি জানি না । কিন্তু আমি এই ফাঁকে এই বইটায় একটু চোখ বোলাবো ।"
বইটার দিকে একঝলক তাকিয়ে উত্তম বলল, "স্টাটনের অরিজিন অব স্টেট ? এ'রকম একটা রোম্যান্টিক সিচুয়েশনে, লেকের ধারে বসে, কেউ স্টাটন পড়ে ? মাদ্রি, তুই একটা হার্টলেস, আনরোমান্টিক দিদিমণি টাইপ হয়ে উঠছিস দিন দিন । এ'রকম করলে শেষে বিয়ে হবে না, তখন বুঝবি ঠেলা ।"
"আর তুই ? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ । একটা অকৃতজ্ঞ জীব । কষ্ট করে রেঁধেবেড়ে এনে খাওয়ালাম, তা সেটা পেট পুরে খেয়ে এখন আমায় গালাগাল দিতে বসেছিস । আমার না হয় বিয়ে হবে না, কিন্তু এমন স্বভাব থাকলে তোর যে নরকেও জায়গা জুটবে না সেটা ভেবে দেখেছিস ?"
"নরকে জায়গা পাবার কথা র্পএ ভাবা যাবে । উপস্থিত কলেজ স্কোয়ারের বেঞ্চিতে জায়গাও মিলেছে, পেট পুরে খাওয়াও মিলেছে, তার ওপর ঘন্টাখানেক সময়ও মিলেছে । অতএব, এই ফাঁকে আমি একটু চোখ বুজে গড়িয়ে নিচ্ছি । তুই জ্ঞানচর্চা করতে থাক, সময় হলে আমায় ডেকে তুলে দিস ।" বলতে বলতে সামনের দিকে ঝুঁকে বসে চোখ বুজল উত্তম । সামান্য সময়ের মধ্যেই নি:শ্বাস গাঢ় হয়ে এল তার । নির্জন, শেষ দুপুরের মৃদু উষ্ণাভ হাওয়া তার এলোমেলো চুলগুলিকে নিয়ে খেলা করে । তার পাশে বসে তরুণীটি তখন হাতে ধরা বইটির পাতা থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থার নানাবিধ জটিলতার আস্বাদ নিতে মগ্ন ।
মদনের সময়জ্ঞান দেখা গেল বেশ ভালো । ঠিক দু'ঘন্টার মাথায় মাদ্রিরা ফিরে আসতেই একটা প্যাকেট বাড়িয়ে ধরল সে । স্টেপল করা একগুচ্ছ ফটোকপি তার ভেতরে ।
"কী রে ? এবারে প্ল্যান কী ? বই তো হল । এবারে বাড়ি ফিরবি তো ?"
ফেরতের টাকা গুণে পার্সে ঢোকাতে ঢোকাতে মাথা ঝাঁকিয়ে মাদ্রি বলল, "উফ্ ! এতো ব্যস্ত কীসের ? ফিরবি তো সেই হোস্টেলেই, না কী ?"
"না, মানে সাতটার মধ্যে সুন্দরনগর মেইন-এ পৌঁছোতে পারলে প্রেম আউর পাপ দেখতে ঢুকে পড়বো ভাবছি সঙ্গম-এ । এই হপ্তায় লাস্ট । তারপর চলে যাবে । জোর পায়ে গেলে পাঁচটা পঞ্চাশের শান্তিপুরটা পেয়ে যেতে পারি এখনো ।"
"উ: কি সেলফিশ ছেলে রে ! শান্তিপুর থ্রু ট্রেন সেটা ভুলে গেলি ! সোদপুরে থামবে ? ফার্স্ট স্টপেজ তো সেই শ্যামনগরে !"
"হুম্ । খেয়াল ছিলো না । ওকে ম্যাডাম । তাহলে তো আর কোন প্রশ্নই নেই । ব্যাস্ততাও নেই । চল কোথায় যাবি ।"
"যাবো আর কোথায় ? কলেজ স্ট্রিটেই দু একটা জিনিস কিনতে হবে একটু ঘুরে । একটা পাঁজি নিয়ে আসতে বলেছে মা । আর টিনটিনের একটা বাংলা কমিকসও নিয়ে যেতে হবে । পরশু ভাইয়ের জন্মদিন-------মাসদুয়েক ধরে বায়না করে রেখেছে ।"
"যা বাব্বা ! আমি ভাবলাম কোথায় সিনেমা মিস হবার কমপেনসেশন হিসেবে একটু এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানোর প্রোপোজাল দিবি, তা নয়, মাঝবয়েসী গিন্নির মত মায়ের পাঁজি, ভাইয়ের বই কিনতে চললি । কেন তোদের সোদপুরের অরণ্যে কি এ'সব মডার্ন বস্তু জোটে না, যে কলেজ স্ট্রিট থেকেই নিতে হবে ?"
"জুটবে না কেন ? কিন্তু ডিসকাউন্ট দেবে না কি ওদিকে ? এখানে অন্তত ওয়ান ফোর্থ ডিসকাউন্ট পাবো । তার মানে দুটো মিলিয়ে প্রায় তিরিশ টাকা বাঁচবে । সোদপুর থেকে কলকাতা আসা-যাওয়ার ট্রেনভাড়া ষোল টাকা । কাজেই নেট লাভ চোদ্দ টাকা । বুঝলি ?"
"বুঝলাম । সে বেচারার কপালে সারাজীবন বড় দু:খ আছে রে ! সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারছি ।"
"মানে ?"
"বুঝলি না, না ? যার গলায় তুই ঝুলবি সে বেচারার কথা বলছি । এখনি যা হিসেবের অ্যাকুমেন দেখাচ্ছিস, তাতে সংসারে ঢুকলে তুই যে কি ফর্ম দেখাবি সেটা আন্দাজ করেই কথাটা বললাম আর কি !"
"সে তুই যা খুশি বলতে পারিস । আমাদের বাঁধা মাইনের সংসার । হিসেব করে চলতে আমাকে হবেই । চিরকাল চলবোও তাই ।"
নি:শব্দে পাশাপাশি হেঁটে চলে দুজন । মাদ্রি একটু অসন্তুষ্ট হলো কি তার কথায় ? উত্তম আড়চোখে তার দিকে দেখে একবার । গৌরবর্ণা মেয়েটির সুন্দর মুখের সাথে, মেদিনীপুরের কোন এক গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের এক ক্লিষ্ট, অকালপ্রৌঢ় মহিলার কোন সাদৃশ্য নেই, অথচ এই কথাগুলো আজ হঠাৎ করে সেই মহিলার মুখটিকে তার মনে এনে দিয়েছে । এই কথাটিই অন্য ভাষাবন্ধে শৈশব থেকে বারে বারেই শুনে এসেছে সে ------- পুজোয় নতুন পোশাকের অথবা ফার্স্ট হয়ে নতুন ক্লাসে ওঠবার পর অর্ধেক দামে পুরোন বই জোগাড় করবার বদলে অন্তত দু একটা বই নতুন কিনে দেবার ব্যর্থ দাবীর জবাবে । বড় দু:খ হত তার সেই মুহূর্তগুলোতে । সেই দু:খের স্মৃতিটিই আজ যেন দলা পাকিয়ে উঠে আসে তার গলার কাছে । মেয়েটির অলক্ষ্যে তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে, কোন এক অনুচ্চারিত সুখ দানের প্রতিজ্ঞাতেই হয়তো বা ঠোঁটদুটি নড়ে ওঠে তার ------- যদি কখনো একসঙ্গে জীবন গড়া হয়, তাহলে, যে স্বাচ্ছল্য তার মা কখনো পাননি, যে স্বাচ্ছল্য সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনে বড় হয়ে ওঠা মেয়েটি কখনো পাবে না বলে ধরে নিয়েই নিজেকে তৈরি করছে তার কিশোরী বয়স থেকেই, সেই অকারণ হিসেবী হবার বন্ধন তাকে টের না পেতে দেবার প্রতিজ্ঞাতেই হয়তো বা । স্বপ্ন তো হিসেববিহীন সুখসন্ধানেরই এক যাত্রা ।
পাতিরামের সামনের ফুটপাথে চারপাঁচরকম পাঁজির মধ্যে সঠিক পাঁজিটির সন্ধানে ব্যস্ত সমাদৃতার ব্যাগ থেকে ফটোকপির বাণ্ডিলটা বের করে নিয়ে তার পাতা ওলটাতে ওলটাতে একটা অধ্যায় খুঁজে বের করে সমাদৃতাকে ডাকল উত্তম, "বইটা তুই কখনো পড়েছিস ?"
"উঁহু । নেটে সার্চ করে একটা রিভিউ দেখেছিলাম । দেখে কাজে লাগবে বলে মনে হল, তাই জোগাড় করে নিলাম," একটা পঞ্জিকার পাতা ওলটাতে ওলটাতে অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল সমাদৃতা ।
"তাহলে এইখানটা একটু মন দিয়ে দেখ । এটা কিন্তু সত্যিসত্যিই নৈরাজ্যবাদীদের হ্যাণ্ডবুক । জাল নোট বানাবার পদ্ধতি, বোমা বাঁধবার ফরমুলা -------"
"তা তুই কী ভাবছিলি ? যে বইয়ের নামই অ্যানার্কিস্ট কুকবুক, সেটা ধর্মীয় লিটারেচার হবে ?"
"না, মানে, নামটা কতটা লিটারালি ট্রু সেইটাই তোকে একবার দেখাতে চাইছিলাম । তা হ্যাঁরে, লালগড় টালগড় যাবার প্ল্যান করছিস নাকি ? করলে বল, ওদিকে চেনা লোকজনকে রেফার করে দেবো ।"
"আজ্ঞে না মশাই । রাজনীতি নিয়ে ট্রাইবাল ওয়ারফেয়ারে যোগদান করা ছাড়াও আমার অন্যান্য অনেক কাজ রয়েছে । আমার স্পেশাল পেপার হচ্ছে টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির অ্যানার্কিজম, সেটা খেয়াল আছে ? তার সেমিনার প্রেজেন্টেশান বানাচ্ছি । ওর জন্যেই বইটার দরকার ছিলো ।"
"প্রেজেন্টেশনে বোমা বাঁধবার কেমিস্ট্রি দেখাবি, সেইরকম প্ল্যান করছিস নাকি ? লোকজন চটে যাবে কিন্তু ।"
সমাদৃতার পঞ্জিকা পছন্দের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল । ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দাম মেটাতে মেটাতেই জবাব দিল, "না রে, ব্যাপারটা ঠিক সে'রকম নয় । গোটা বইটা একবার খুঁটিয়ে পড়ে দেখতে চাই । আরও অসংখ্য আমেরিকান তরুণের মতই এই পাওয়েল লোকটাকেও ইচ্ছের বিরুদ্ধে ভিয়েতনাম যুদ্ধে পাঠিয়েছিলো মার্কিন সরকার । তাইতে ক্ষেপে গিয়ে সে লিখে ফেলল নৈরাজ্যবাদের রেসিপি । আপাত সম্পর্কহীন এই `কজ' আর `এফেক্ট'-এর মধ্যে সঠিক রিলেশনশিপটা কী ? পাওয়েলের যুদ্ধে যাওয়া আর তার হাতে এই বইটার জন্ম এ দুটো কি নিছকই সম্পর্কহীন কোইনসিডেন্স, নাকি রাষ্ট্রের নীতির সামনে ইচ্ছের বিরুদ্ধে মাথা নত করতে বাধ্য হওয়া দুর্বল ব্যক্তিমানুষের প্রতিবাদের একধরনের উন্মাদ বহি:প্রকাশ ? বইটার মধ্যে এই প্রশ্নের কোনও ক্লু থেকে গিয়ে থাকতে পারে । খুঁজে পেলে আমার পেপারের কাজে লাগবে ।"
"হুঁ । আইডিয়াটা একজোটিক, কিন্তু একটা গোড়ার কথা তুই ভুলে যাচ্ছিস মাদ্রি । অ্যানার্কিজমের গোড়ার কথাটাই হল ফ্রিডম উইদাউট রেসপন্সিবিলিটি । রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে এই ধরনের কোন সচেতন, বৌদ্ধিক প্রতিবাদকে বিপ্লব বলা যেতে পারে, অ্যানার্কি নয় ।"
"আরে এই, তর্ক করতে করতে কোথায় চললি", বলতে বলতেই সামনের দিকে মুখ করে এগিয়ে যেতে থাকা উত্তমকে থামাল সমাদৃতা, "রাস্তা ত্রক্রস করে ওপারে চল । শৈব্যার গলিতে ঢুকতে হবে একবার । টিনটিন কিনতে হবে না ?"
"উ:, মেয়েটা কিচ্ছু ভোলে না । ভাবলাম কথায় বার্তায় ভুলিয়ে ভালিয়ে একেবারে শেয়ালদায় নিয়ে তুলবো, কিন্তু ঠিক মনে করে রেখেছে-------" গজগজ করতে করতে ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় নামলো উত্তম । আরও অন্তত আধঘন্টা সময় লাগাবে এখন এই মেয়ে ।
খানিক বাদে, বই কেনা শেষ করে স্টেশনের দিকে রওনা হয়ে কথোপকথনের পুরনো সুতোটা ফের তুলে নিল মাদ্রি, "খানিক আগে তুই একটা টার্ম ইউজ করলি উত্তম ------- সচেতন, বৌদ্ধিক প্রতিবাদ । কিন্তু এ বইটার ব্যাপারে সে কথাটা খাটবে না । বই ছাপিয়ে বোমা বাঁধতে শেখানো কোন ধরনের সচেতনতার প্রমাণ ? একটা অন্ধ, উন্মাদ প্রতিক্রিয়া, যুক্তিহীন হাত পা ছুঁড়ে নিজের মনোকষ্টের ক্যাথারসিস ঘটানো, সেটা অ্যানার্কির উপাসনা নয় ? তাকে বিপ্লব আখ্যা দিয়ে তুই ফ্রেঞ্চ বা রাশিয়ান বিপ্লবের সঙ্গে এক আসনে বসাবি ?"
"না । বসাবো না । ওগুলো ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটা গোষ্ঠীবদ্ধ প্রতিবাদ । অথবা বলতে পারিস, সমসময়ের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতের নব্য রাষ্ট্রব্যবস্থার এক ক্ষমতাদখলের লড়াই । তার মোমেন্টাম অন্যরকম হতে বাধ্য । আর এ বইটা, একজন শিক্ষিত, সচেতন ব্যক্তির একক প্রতিবাদের দলিল । ফলে তার চরিত্রটা আলাদা । কিন্তু ভেতরে ঢুকবি যখন, দেখবি, দুটোই আসলে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে সচেতন প্রতিবাদ, কেবল ঢংদুটো আলাদা । কিন্তু বেসিক চরিত্রটা একই ।"
"মানতে পারলাম না । বেসিক চরিত্রটা এক নয় উত্তম । বিপ্লব শুধু ভাঙার কথা বলেনা । ভাঙার পরে নতুন করে সবকিছু গড়ে তোলবার একটা মডেল সামনে রেখে সে এগোয় । অথচ এ লোকটা তো শুধু ভাঙবার কথাই বলছে ! নিজের ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের সুযোগ নিয়ে তৈরি করেছে দায়িত্বজ্ঞানহীন একটা ডকুমেন্ট । অ্যানার্কির সংজ্ঞার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে না ? ফ্রিডম উইদাউট রেসপন্সিবিলিটি ।"
উত্তম খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে তারপর বলল, মাদ্রি, তুই কিন্তু এখনো বইটা পড়িস নি । ইন্টারনেটের একটা এনট্রি ছাড়া এই বইটার কনটেন্টের সঙ্গে এখনো তোর আলাপ হয়নি । অথচ এরই মধ্যে বইটার ব্যাপারে তুই একেবারে সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলি ?"
খোঁচাটা সঠিক জায়গায় পৌঁছেছে দেখা গেল । তার দিকে তীক্ষণ দৃষ্টি ফেলে সমাদৃতা পালটা প্রশ্ন করল, "আর তুই ? মন্তব্য তো তুইও করছিস বইটা নিয়ে । তুই এর কতটা পড়েছিস উত্তম ?"
"যদি বলি সবটাই পড়েছি ? বারবার, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি ?"
"তুই চাল মারছিস উত্তম ! তুই পড়লে আমি জানতে পারতাম না ভেবেছিস ?"
উত্তম হাসল, "না মাদ্রি । জানতে পারতিস না । কারণ যখন আমি এ বইটা পড়েছি তখনও তোর সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি ।"
"বাজে কথা বলিস না উত্তম । তখনও তুই শহরের মুখ দেখিস নি । তোদের ওই গ্রামে এই লেভেলের বই পাওয়া যেত যদি তাহলে সেটা আর গ্রাম থাকত না ।"
উত্তম হাসল, "আমাদের গ্রামের কতটুকু জানিস তুই ? জায়গাটা পশ্চিম মেদিনীপুর । সেটা কি ভুলে গেলি মাদ্রি ?"
হঠাৎ সমাদৃতা চমকে ফিরে তাকাল তার দিকে, তার গলার স্বরে মৃদু কাঁপুনির ছোঁয়া, "তুই-------"
তার অনুচ্চারিত, সশংক প্রশ্নটিকে বুঝে নিতে অসুবিধে হল না উত্তমের । মাথা নেড়ে সে বলল, "না রে, ঈশ্বর কিংবা মাও সে তুং, কোনটাতেই আমার বিশ্বাস নেই । দক্ষিণ নয়, বামও নয় । মধ্যবিত্তের মধ্যপন্থা । লেখাপড়া, চাকরি, সংসার-------"
তার কথার মধ্যে কোন প্রচ্ছন্ন দীর্ঘশ্বাস ছিল কি ? নিজের অজান্তেই সেই প্রশ্নটি নিয়ে নিজের মনে নাড়াচাড়া করে চলে মেয়েটি ।
নীরবে পাশাপাশি হেঁটে চলে দুটি তরুণতরুণী । খানিক বাদে, অস্বস্তিকর নীরবতাটাকে ভাঙবার জন্য উত্তম তাদের তর্কটার সুতো তুলে নিল ফের, "দেখ মাদ্রি, পার্সোনাল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আসল কথাটায় আয় দেখি, ফ্রিডম উইদাউট রেসপনসিবিলিটি বলতে তুই কী বোঝাচ্ছিস সেটা তুই একটু ক্ল্যারিফাই করবি ? প্রশ্নটা কিন্তু তোর পেপার প্রেজেন্টেশানের পর আসতে পারে । আর কেউ না করলেও আমি তো করবই । উত্তরটা কি ভেবে রেখেছিস ?"
মাদ্রি হাসল, "ভেবেছি । টেকনিক্যাল ডেফিনিশান না দিতে পারলেও একটা উদাহরণ দিতে পারি । দেখ উত্তম, আজ যদি আমি হুট করে তোর সঙ্গে কাউকে না বলে এক্ষুণি দু'দিনের জন্য দিঘা বেড়াতে চলে যাই, কেউ আমায় আটকাতে পারবে ? আইন আমাকে সে স্বাধীনতা তো দিয়েছে ! কিন্তু সেটা কি ফ্রিডম উইদাউট রেসপনসিবিলিটি হবে না ? সেটা, বলতে পারিস, অ্যানার্কির উদাহরণ । কিন্তু, সব সামাজিক নিয়ম ভেঙে আজ যদি আমি একটা অজ গ্রামের ছেলেকে বিয়ে করে তার এঁদো গ্রামের খড়ের ঘরে গিয়ে সংসার করতে বসি তবে সেটা হবে, বলতে পারিস বিপ্লবের উদাহরণ । প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ভেঙে কাজটা ঘটালেও সেখানে একটা সেন্স অব রেসপনসিবিলিটি থাকবে । ব্যাপারটা কি আমি বোঝাতে পেরেছি ?"
"হুম । অ্যানার্কি ব্যাপারটা কিন্তু বেশ অ্যাট্রাকটিভ ঠেকছে ।"
"মার খাবি উত্তম । এটা একটা অ্যাকাডেমিক উদাহরণ দিয়েছি আমি । নাথিং মোর ।"
"সে তো বুঝতেই পারছি । কিন্তু ------- ব্যক্তি বল আর জাতিই বল, তার বর্তমানের সঙ্গে ইনকমপ্যাটিবল কোন ভবিষ্যতের লক্ষ্যে যখন সে বিপ্লব ঘটায়, দীর্ঘ যাত্রায় সেটা কিন্তু ব্যর্থই হয় । সেটা তো মানবি ? রাশিয়াকে দেখ । যে জাতির গোটা অতীতটাই বৈষম্যের নীতির ওপরে দাঁড়িয়ে, সে বিপ্লব করেছিল একটা সাম্যবাদী ভবিষ্যতের লক্ষ্যে । সময়ের পরীক্ষায় সেটা টিঁকলো ? টিঁকলো না । টিঁকতে পারে না । তোর নাগরিক অতীত ও বর্তমান তোর ভবিষ্যতের গ্রামীণ ঘরণীর স্বপ্নকে একদিন ভেঙে দেবে মাদ্রি । সেদিন অনেকগুলো জীবন একসঙ্গে নষ্ট হবে ।"
"জানি উত্তম । কিন্তু, স্বপ্নকে আটকাবে কেমন করে মানুষ ? তার ওপর তো যুক্তির পাহারা চলে না ।"
"বুঝলাম । এই বিপ্লবটা তাহলে তুই নিজেই ঘটিয়ে ফেলবি বলে ঠিক করে ফেলেছিস মনে হচ্ছে ! কি রে ?"
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে তার দিকে ঘুরে দেখল সমাদৃতা । মুখটা লাল হয়ে উঠেছে তার । একটু চুপ করে থেকে বলল, "ছি: । তোর মুখে কি কিছুই আটকায় না রে ?"
"যা বাব্বা । স্টেটমেন্টটা করলি তুই, আর আমি তার একটা লজিক্যাল ইন্টারপ্রিটেশান দিতেই দোষ হয়ে গেল ?"
উত্তমের কৌতুকতরল কন্ঠস্বর সমাদৃতার বুকে এক বিচিত্র তোলপাড় তুলছিল । তাহলে কি সত্যি সত্যিই নিজের অজ্ঞাতে সিদ্ধান্তটা সে নিয়েই নিয়েছে ? কিন্তু, উত্তম তাকে ওই স্বপ্ন ভাঙবার কথাটা কেন শোনালো ? কীসের সতর্কবার্তা দিচ্ছিল সে তাকে ? সে কোন ভুল করছে কি ? না না, তা কী করে হবে ?
সেদিন ঘরে ফেরবার পথে জনাকীর্ণ সুন্দরনগর লোকালের ভিড়ের ধাক্কায় দুলতে দুলতে বারবারই এই প্রশ্ন, সমস্যা ও দ্বিধাগুলি তার মনকে ছেয়ে ফেলছিল এসে । লেখাপড়া, চাকরি, সংসার ------- চেতনা হবার পর থেকে জীবনের সংজ্ঞা হিসেবে তাকে যা যা শিখিয়েছে তার সমাজ, এই তিনটিই তার আত্মা । হ্যাঁ, এর প্রতিটিই তার চাই । তার অগণিত পূর্বজারা, যাঁদের গোষ্ঠীস্মৃতি জমা হয়ে রয়েছে তার অবচেতনায়, এইবারে তারা ধীরে ধীরে তার জীবনের দখল নিচ্ছে । তরুণীটি সম্পূর্ণ নারী হয়ে উঠছে নিজেরই অজান্তে । তার সমস্ত রোমান্টিকতা, তার আদর্শ, সবকিছুই এইবারে চালিত হবে সেই চিরন্তন পথে, যে পথে চলবার জন্য প্রকৃতি তৈরি করে পাঠিয়েছেন তাকে । আর, সেই পথটি গড়ে নেবার জন্য যে কোন মূল্য দিতে সে তৈরি । কিন্তু তবু, কোথায় যেন একটা অবুঝ দাবি কাজ করে চলে তার মনের গভীরে । এ পথটি তার ভবিতব্য, সে কথা সে নিজের অন্তরে অনুভব করেছে ঠিকই, কিন্তু সেইসঙ্গে, কোন এক গভীরতর এবং অজ্ঞেয় প্রাকৃতিক ষড়যন্ত্র তাকে এক নির্দিষ্ট পুরুষপ্রাণীর অভিমুখে ত্রক্রমশ ঠেলে দিতে চায় । কিন্তু সেই প্রিয় মানুষটি রয়েছে সেই পথের বৃত্ত থেকে বহুদূরে, এক দ্বিতীয় জীবনের কক্ষপথে । কক্ষান্তরে সরিয়ে আনতেই হবে তাকে এবারে, কারণ নিজের কক্ষ থেকে দূরে সরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় । এই কথাগুলি এমন স্পষ্টভাবে সে এখনও ভাবতে পারেনা বটে কিন্তু তার নিজেরই অজ্ঞাতে অবচেতনায় গড়ে ওঠা একটি যুক্তিশৃঙ্খল তাকে এক নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে এনে পৌঁছে দেয় আচমকাই । ইনটিউশন কোন জাদুচেতনা নয় । তা গভীরতর কোন বিচারপদ্ধতির সচেতন বহি:প্রকাশমাত্র ।
"মাদ্রি, সোদপুর আসছে । আস্তে আস্তে গেটের দিকে এগো । নইলে শেষে নামতে পারবি না কিন্তু ।"
চমক ভেঙে ঘুরে তাকাল সে । উত্তম তার একেবারে পাশে দাঁড়িয়ে । তার দিকে চেয়ে হাসল মাদ্রি, "এবারে সোদপুরে অনেক সিট ফাঁকা হবে ভেতরে । ঢুকে গিয়ে তুই পোজিশন নে বরং । আমি নেমে যাবো ঠিক ।"
জানালার পাশে একটা সিটে চুপ করে বসে সমাদৃতার ভিড়ের সঙ্গে মিশে যাবার দিকে তাকিয়েছিল উত্তম । বইটা আজ অনেক পুরোন কথা মনে করিয়ে দিলো তাকে । বাসুদা, অরিত্র, সুব্বুদা ------- গ্রাম ছাড়িয়ে, কোন জঙ্গলের নির্জন অন্তরালে রাজনীতির সেইসব প্রথম পাঠ ! নিষিদ্ধ স্বাদের রোমাঞ্চ । কিন্তু, সরে এসেছিল উত্তম । বেশি দেরি হবার আগেই । শহরের ধনী পরিবারের দুলাল সে নয় । আবার সেই অর্থে ঠিক সর্বহারাও নয় । তার চেতনারও বিকাশ ঘটেছে মধ্যবিত্ত জীবনের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞার খাঁচায় । ওর মধ্যেই তার মুক্তির আকাশ, তার অস্তিত্বের সংজ্ঞা । চরমপন্থার রাজনীতির রোমান্স তার জন্য নয় । অতএব গ্রাম ছেড়ে একসময় বিশ্ববিদ্যালয়, তার পরে এই চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি । মাঝে মাঝে একটা অস্বস্তিকর চিন্তা হঠাৎ জেগে উঠে উত্তমকে বড় জ্বালায় । আচ্ছা ধরো, বিডিও কিংবা ডি এস পি হয়ে সে তাদেরই জেলায় ফিরে গেল একদিন, হয়তো বা তাদেরই সাবডিভিশনে বা ব্লকে ! তখন ! অরিত্রকে কোনদিন সামনে পেলে গুলি করতে পারবে ? কিংবা সুব্বুদাকে হাতকড়া পরিয়ে ------- গোটা ব্যাপারটাকেই কেমন এক অবাস্তব স্বপ্ন মনে হয় তার । ওইরকম প্রগাঢ় পণ্ডিত ------- রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দিকে উত্তমের ঝোঁকটাতো ওই সুব্বুদাই তৈরি করে দিয়েছিলেন ------- আচ্ছা মাদ্রি যদি আজ তার সঙ্গে থাকতো, সবকিছু জানতে পারতো, তাহলে কী বলতো সে তাকে ? ট্রেইটার ? কিন্তু তাই বা বলবে কেন ? নিজের বিশ্বাসকে হত্যা হয়ত সে করেছে, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক সে নয় । একদিকে তার বাড়ি, তার মা'র অজস্র স্বপ্ন আর বিশ্বাস, আর অন্যদিকে সুব্বুদা, অরিত্র ------- কোন একটা সাইড তাকে নিতে হতোই । কিন্তু মাদ্রি -------না না; সে তো অন্য রাস্তায় চলেছে ------- ঠিক আছে । ভালো যার যার নিজের জীবন, নিজের সিদ্ধান্ত ! এক জীবনে সবকিছু তো পাওয়া যায় না । তাছাড়া শোভনও তো তার বন্ধু । সুখী হতে পারলে হোক না ওরা -------
ছেঁড়া ছেঁড়া, ধারাবাহিকতাবিহীন ভাবনাদের এক প্রগাঢ় কুয়াশায় নিজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে জড়িয়ে নিয়ে এক বিচিত্র নেশার ঘোরে যেন বুঁদ হয়ে বসে ছিল সে । ঘোরটা কেটে গেল কাঁধে কার হাতের ছোঁয়ায় । সুন্দরনগর মেন স্টেশন এসে গেছে । কামরা প্রায় খালি । শোভন তার মুখোমুখি বসে কাঁধে হাত রেখে ডাকছিল । ঘুরে তাকাতে বলল "কী রে ? শরীরটরির ঠিক আছে তো তোর, না কি ?" প্রায় মিনিটপাঁচেক হল উঠে সামনে বসে আছি, কোন হুঁশই নেই ! শেষে ডেকে তুলতে হল ।"
উত্তম সোজা হয়ে বসে আড়ামোড়া ভেঙে বলল, "অনেকদিন বাঁচবি তুই শোভন । তোর কথাই ভাবছিলাম ।"
"আমার কথা ? এমন ধ্যানস্থ হয়ে ? গুল মারিস না উত্তম । কেসটা আসলে কী ? গিয়েছিলি কোথায় ?"
উত্তম হাসল, "কলকাতায় । পরোপকার করতে । মাদ্রির একটা বই কেনবার ছিল । ম্যানেজ করতে পারছিল না । তাই সঙ্গে করে এক চেনা দোকানদারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম কলেজ স্ট্রিটে । গিয়ে প্রচুর ঝামেলা হল । প্রথমে ট্রেন অবরোধ, তারপর, মেয়েদের তো জানিস ! বই কেনার পর পাঁজি কেনা হল, ভাইয়ের টিনটিন কেনা হল, তারপর এই এতক্ষণে ছাড়া পেয়ে ফিরছি । কিন্তু, তুই এই ট্রেনে যে ! তোর তো এতক্ষণে হস্টেলে ঢুকে যাওয়া উচিৎ !"
"উচিৎ তো বটে । কিন্তু সবসময় কপাল কি আর অত ভালো থাকে ? সাড়ে পাঁচটায় গেদে লোকালে করে সুন্দরনগরে এসে নেমে সেই থেকে ব্রাঞ্চ প্ল্যাটফর্মে এসে ঠায় বসে আছি । ব্রাঞ্চ লাইনের একটা ট্রেন ক্যানসেল হলো, তারপর এইটা এলো ।"
"বাসে চলে গেলি না কেন ?"
"গিয়েছিলাম । স্ট্যাণ্ডৈ পৌঁছে দেখি আঠাশ নম্বর আজ বন্ধ । ভাড়া বাড়ানোর জন্য স্ট্রাইক করেছে । বসে বসে বোর হচ্ছিলাম । ভালোই হল তোকে পেয়ে গেলাম ।"
উত্তমের চোখ তখন মাথার ওপরে র্যাকে রাখা শোভনের ব্যাগটার দিকে গিয়ে পড়েছে । সেদিকে আঙুল দেখিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, "ইন্টারেস্টিং কিছু আছে ?"
"আছে । আজ একটা ইউনিক জিনিস পাঠিয়েছে মা । পটলের খোসা বাটা । খেয়েছিস কখনো ?"
"না । আমি পটল খাইনা । জঘন্য সবজি ।"
"হতে পারে । তবে এই পদটা খেয়ে কিন্তু আঙুল চাটবি এই বলে দিলাম । কালোজিরে আর আদা-রসুন বাটা মাখিয়ে পাতায় পুরে কাঠের আগুনে বেক করা । খেয়ে দেখিস । মা তোর জন্য স্পেশালি বানিয়ে পাঠিয়েছে ।"
"ফাইন । রাত্তিরে দেখা যাবে । তিনদিনের ছুটিতে কী কী করলি ?"
শোভন হাসল, "ঘরের চাল মেরামত করেছি একটা গোটা দিন । বাকি দুটো দিন স্রেফ আড্ডা মেরেছি ।"
উত্তম ভুরু কুঁচকে বলল, "নেক্সট মাসে পেপার প্রেজেন্টেশান আছে সে খেয়াল আছে ? মাদ্রি তো অলরেডি উঠেপড়ে লেগেছে দেখলাম । দিনরাত এক করে খাটছে । ওই ব্যাপারেই একটা বই খুঁজতে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আজ । আমাদের পিজি টু হস্টেলেও তো দেখছিস ! সবারই এক দশা । আর তার মধ্যে তুই কিনা এইরকম প্রেশাস একটা ছুটি আড্ডা মেরে কাটিয়ে দিলি ?"
"না স্যার । আড্ডা মানে ওনলি `আড্ডা' নয় । আমার পেপারের কাজটাও খানিক এগিয়েছে ওইসঙ্গে । আমার টপিকটা জানিস তো ? `আওয়ার ভিলেজ স্টেটক্র্যাফট -------আ স্কেল মডেল অব দা ন্যাশনাল স্টেটক্র্যাফট-------আ কেস স্টাডি ।" গ্রামের মানুষজনের সঙ্গে ছোটছোট ডায়ালগস, আর তার মধ্যে দিয়েই বের হয়ে আসছে গ্রামীণ শাসন ব্যবস্থার গোটা কনসেপ্টটা । তারপর সেটাকে কমপেয়ার করছি জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন ওয়েল ডিফাইনড প্যারামিটারগুলোর সঙ্গে । দুটো দিন আমার কাজে লেগেছে ঘুরে ঘুরে কিছু ডায়ালগস জোগাড় করে । কিছু রেকর্ডিং করেছি । সেগুলোর ট্রান্সক্রিপশান করে অনেক নোটও নিয়েছি বসে বসে । এইবারে হোস্টেলে ফিরে জিনিসটাকে একটা শেপ দেবো ।"
"ওরেব্বাস্ ! এ তো একেবারে সাংঘাতিক গবেষণা ! এইসব গ্রামের দু:খকষ্ট নিয়ে বাঙালিদের নোবেল পাবার বেশ একটা ঝোঁক আছে কিন্তু । পরপর দু'জন পেল । এইবারে তুই লাইনে আছিস । আমি শিওর ।"
"এই দেখো । এইজন্য তোদের আমি কখনো কিছু বলতে চাই না । কথায় কথায় এমন পেছনে লাগলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি ।"
বন্ধুর আহত মুখটির দিকে তাকিয়ে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল উত্তম । বড় সরল মানুষ তার বন্ধুটি । কেউ ব্যঙ্গ করলে জোরগলায় প্রতিবাদ করবার ভাষা জোগায় না মুখে । মনে মনে দু:খটাও তাই পায় অন্যদের চেয়ে বেশি । তাড়াতাড়ি বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে সে বলল, "সরি । কাজটা তোর খুব ইন্টারেস্টিং । কিন্তু এই বিন্দুতে সিন্ধুদর্শনের গবেষণা তো নতুন কিছু না । অনেক রথীমহারথীই করে গিয়েছেন তোর আগে । সেক্ষেত্রে নতুন আর তুই পাবিটা কী ? সবই তো কোন না কোন বইতে রয়েছে ! সেক্ষেত্রে এত খাটাখাটুনির কোন দরকার আছে কি ? প্রিন্টেড ম্যাটার থেকে খুঁজে কালেক্ট নিলেই হল ।"
"না উত্তম । সবকিছু বইতে নেই রে । সমাজ একটা ডাইনামিক ব্যাপার । আজকের তত্ত্ব সেখানে কালকে বাসি হয়ে যায়," শোভনের চোখদুটি জ্বলজ্বল করে ওঠে উত্সাহে, "একটা উদাহরণ দিচ্ছি । ১৯৬৩ সালে, আলজিরিয়ার চাষীদের ওপরে ফ্রানজ ফ্যাননের সেই যুগান্তকারী কাজটা আমাদের ফিফথ ইয়ারে পড়িয়েছিলো, তোর মনে আছে ?"
"আছে । বামপন্থী আন্দোলনের মূলতত্ত্ব । সামন্ততান্ত্রিক কিংবা ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবটা শুরু করে কৃষকরা । কারণ তাদের আর কিছু হারাবার নেই । এই সবহারানো কৃষকরাই প্রথম অনুভব করে, হিংস্র প্রত্যাঘাতই তাদের বাঁচবার একমাত্র পথ -------"
"আরে ! একেবারে মুখস্ত রয়েছে দেখছি তোর ! কিন্তু উত্তম, এ দেশে গত শতাব্দীর সত্তর বা আশির দশকে এ তত্ত্বটা যতটা খাটত, এই শতাব্দীতে এসে সেটা কিন্তু আর ততটা খাটছে না । ফ্যানন ইজ নো মোর দ্যাট রেলিভ্যান্ট টু আস ।"
"মানে ? লোকজন আর গরিব নেই বলছিস ?"
ম্লান হাসল শোভন, "না । দারিদ্র্য কমেনি । বরং বেড়েছে । কিন্তু, শুধু বস্তুগত নয়, দারিদ্র্য একটা পারসেপশানেরও ব্যাপার উত্তম । আগে ছিল শুধু খেতেপরতে না পাওয়ার দারিদ্র্য । ফলে তার অনুভূতি সীমাবদ্ধ ছিল কিছু নির্দিষ্ট ইনকাম ক্লাসের মধ্যে । গ্রামদেশে যে লোকটা দু'বেলা মোটা ভাতকাপড় পেত তার মধ্যে দারিদ্র্যের অনুভূতিটাই থাকত না আর । সুখের সংজ্ঞা ছিল, `আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে ।' তারপর, টেলিভিশন আর টেলিফোন বিপ্লবের পর, অন্যান্য জায়গার লোকজন যে কী কী ভালো ও লোভনীয় জিনিসপত্র পায়, তার খবর যত গ্রামাঞ্চলের গভীর থেকে গভীরতর এলাকায় পৌঁছোচ্ছে, ততই গ্রামের সব শ্রেণির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে নতুনতর এক দারিদ্র্যের পারসেপশান । অন্নাভাবের দারিদ্র্যের অনুভূতির সঙ্গে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রোজগার, নতুন নতুন ভোগ্যপণ্য, ফ্যাশান, শক্তিমানের সঙ্গে টক্কর দেবার ক্ষমতা ------- এই সবকিছুতে অন্যের চাইতে পিছিয়ে পড়বার অনুভূতি থেকে গড়ে ওঠা এক সর্বব্যাপী দারিদ্র্যের অনুভূতি । আর সেই অনুভূতিটাই এখন গ্রামরাষ্ট্রের পরিচালনব্যবস্থার আত্মার আসনে বসে তাকে নতুন শেপ দিচ্ছে । খেয়াল করে দেখ, শুধু খেতে চেয়ে মহাজনের গদি লুঠ এখনকার গ্রামীণ আন্দোলনের প্রধান রেসিপি নেই আর । তারা এখন আক্রমণ শানাচ্ছে প্রসারমান ইণ্ডাস্ট্রির হাতে তাদের জমি হারাবার বিরুদ্ধে, শানাচ্ছে বিভিন্ন সরকারী পলিসির বিরুদ্ধে । ইকুইটেবল ডিস্ট্রিবিউশানের দায়িত্বটা যাদের হাতে থাকে খাতায় কলমে, তারাই কিন্তু এখন গ্রামীণ আন্দোলনের প্রধান টার্গেট-------জোতদার-মহাজনরা নয় ।
"এবারে চলে আয় ন্যাশনাল পলিটিকসে । সেই একই ছবি দেখতে পাবি । পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্র হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে ভারতের কারেন্ট ইস্যুগুলোই এই বদলের একটা ভালো ইণ্ডিকেটার । গত শতাব্দীর সত্তর বা আশির দশকের মতন সেই সস্তায় চালগম কিংবা গ্রান্ট ইন এইড বা সফট লোনের দাবিতে হাঙ্গামা করবার জায়গায় এখন এসেছে আরো ভালোভাবে থাকবার, খাবার, পরিবেশকে উন্নততর করবার দাবি নিয়ে প্রথম বিশ্বের সাথে লড়াই । তোমাদের কার্বন এমিশান কেন আমাদের উন্নতির পথে বাধা দেবে ? তোমাদের পেটেন্ট আইন কোন অধিকারে আমার প্রথাগত জ্ঞানকে কেড়ে নেবে ? একটা ম্যাজিক ঘটে চলেছে উত্তম । ম্যাণ্ডেলব্রটের ছবির মত । গোটা ডিজাইনটা যেমন, তার একটা খণ্ডাংশেও হুবহু সেই একই ডিজাইনটাই আঁকা রয়ে গেছে । মাঝে মাঝে তাই ভাবি -------"
"উ:, থামতে কত নিবি বল," উত্তম গজগজ করছিল, "দুপুর থেকে এই তত্ত্বকথার বন্যা চলেছে মাথার ওপর দিয়ে । প্রথমে একজন জ্বালালো অ্যানার্কিজম নিয়ে ।
তার হাত থেকে ছাড়া পেলাম তো অন্যজন গ্রামীণ রাষ্ট্রতত্ত্বের কচকচি শুরু করল । মিত্রপাড়া ঢুকছি সে খেয়াল আছে ? নামতে হবে তো, না কি ?"
গাড়ির গতি ধীর হয়ে আসছিল । প্ল্যাটফর্মের গা বেয়ে এগোতে এগোতে ত্রক্রমশ গতিহীন হয়ে আসছে কামরাগুলো । ওরা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো । এক প্ল্যাটফর্মের এই ছোট স্টেশনটিতে ট্রেন দাঁড়ায় মাত্রই কয়েক মুহূর্ত ।
প্ল্যাটফর্মের একেবারে পশ্চিম ধার দিয়ে নেমে লেভেল ত্রক্রসিং পেরিয়ে ইউনিভার্সিটি ক্যামপাসে ঢুকে হস্টেলের পথ ধরল তারা । পিজি টু হস্টেলটা একটু একটেরেতে । বেশ খানিকটা হাঁটতে হবে । চলতে চলতে শোভন হঠাৎ বলল, "আচ্ছা উত্তম, আমার পেপার নিয়ে যে এতক্ষণ মাথা ঘামালি, তোর নিজের খবর কী ?"
উত্তম হাসল, "আমি ? নেটে বসে এটা ওটা দেখে টুকেমুকে একটা কিছু দাঁড় করিয়ে
দেব ঠিক প্রেজেন্টেশনের আগের দিন । উপস্থিত ওসব করবার সময় নেই আমার । নেক্সট জানুয়ারিতে পরীক্ষা । প্রচুর খাটতে হচ্ছে ।"
"জানুয়ারিতে মানে ? পুজোর আগেই তো হয়ে যাবে শুনেছিলাম । পিছোল কবে ?"
"আরে দুর ! ইউনিভার্সিটির পরীক্ষার কথা কে বলছে ? আমি ডবলু বি সি এস প্রিলিমিনারির কথা বলছি ।"
শোভন একটু থমকে গেল তারপর বলল, "আর মাদ্রি ?"
"মাদ্রি স্মার্ট আছে । অংক, বাংলা, ইংরিজি আর জিকে নিয়ে ওর কোন টেনশন নেই । প্রচুর টিউশন করে । মাধ্যমিক অবধি অল সাবজেক্ট আর হায়ার সেকেণ্ডারির আর্টস গ্রুপ । কাজেই ওই টপিকগুলো ওর আপনা আপনি উঠে যাবে । প্রিলিটা ওর কাছে কোন ব্যাপার নয় । আর, প্রিলি ক্লিয়ার করতে পারলে, মেইনস-এর অপশনালের জন্য নোট, সাজেশন সে-সবের ভার আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে এম এ ফাইনালের দিকে বেশি নজর দিয়েছে । শার্প মেয়ে, দু দিকেই ভালো করবে", বলতে বলতে হঠাৎ শোভনের দিকে ফিরে সে বলল, "তুইও আমাদের সঙ্গে অ্যাপিয়ার করনা শোভন ! তোর যা ক্যালিবার তাতে র্যাংক করে বেরিয়ে যাবি একবারেই ।"
পথ ছেড়ে ওরা এখন মাঠের ওপর নেমে এসেছে । চন্দ্রালোকিত ধূ ধূ সেই মাঠে পায়ের নিচে এঁকেবেঁকে সামনের আলোকিত অস্পষ্টতার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া পায়ে চলা পথের দাগটার দিকে চোখ রেখে অনিশ্চিত গলায় শোভন বলল, "মাদ্রিও একদিন বলছিলো বটে, কিন্তু ------- আ-আমি ঠিক ভেবে দেখিনি রে ।"
"তাহলে ভাব । সিরিয়াসলি ভাব শোভন । ইটস ইমর্পট্যান্ট ।"
কিছুটা নির্লিপ্ত গলায় শোভন জবাব দিল, "দেখি !" আর তারপর, সম্ভবত প্রসঙ্গটাকে চাপা দেবার জন্যই বলে উঠল, "গান শুনবি ? এবারে নতুন গান পেলাম একটা । রজবের গান । শোন শোন-------"
বলতে বলতেই উদাত্ত, চড়া গলায় গান ধরল সে । রজব নামে কোন এক ফকিরের সৃষ্ট সুরময় কথাগুলি যেন একএকটি ফুল হয়ে ফুটে উঠছিল সেই চন্দ্রালোকিত প্রান্তরে । এক উপভোগ্য হাহাকার ভেসে যাচ্ছিল রাত্রির ঘনীভূত বাতাসে -------
    "দিন গেল মোর হাহুতাশে
    কে লবে মোর তবিলদারী"