ফরিদা,তোর চিঠি পেলাম। দিনকয়েক আগেই পেয়েছি অবশ্য। চিঠি পেয়ে প্রথমে ভাবলাম খুব করে বকবো তোকে। এই গ্রাম থেকে তুই প্রথম মেয়ে যে এম এ পাশ করলো। তোকে নিয়ে আমার স্বপ্ন ছিল, তুই পি এইচ ডি করবি, দেশে বিদেশে নাম হবে। একটা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুই দেখিয়ে দিবি ইচ্ছে করলেই মানুষ সব পারে। সামাজিক বৈষম্য, টাকাপয়সার অভাব, কোনটাই তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তাই, তুই যখন বললি ফিরে আসবি, সেটা মেনে নিতে আমার একটু অসুবিধেই হচ্ছিল। সেইসঙ্গে এ ভাবনাটাও মাথার ভেতর কাজ করছিলো যে যতটা আবেগ নিয়ে তুই এখানে কাজ করতে আসতে চাইছিস, কিছুদিন বাদে ইমোশনের সেই ইন্টেনসিটিটা তোর বজায় থাকবে কি না? আর যদি তা না থাকে তাহলে তখন তোর কাছ থেকে কাজ তো কোন পাবোই না, মধ্যে থেকে তোর কেরিয়ারটাও পিছিয়ে বা নষ্ট হয়ে যাবার ভয়টা থেকে যাবে। একটা দ্বিধা কাজেই তৈরি হচ্ছিল মনের ভেতর।
তারপর ভেবে দেখলাম, বড়ো হয়েছিস; নিজের জীবনটাকে নিয়ে কী করবি সে ব্যাপারে সিদ্ধান্তটা তোর নিজেরই হওয়া উচিৎ। ও জায়গাটায় অন্যের হুকুমদারী চালানো ঠিক নয়। সেইসঙ্গে, আমার এই মিশনটার ব্যাপারে যে ডেডিকেশনের কথা তোর চিঠিতে প্রকাশ পেয়েছে সেটা যদি সত্যি সত্যি তোর ভেতরে থেকে থাকে তাহলে কাজটাও তুই ভালো করেই করবি বলে আশা করা যায়। কাজেই আমি আমার মত বদলেছি। তুই ফিরে আয়। অনেক কাজ পড়ে আছে এখানে। যে স্বপ্নগুলো আমি দেখি সেগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে তোর মত মানুষজনের দরকার হবে আমার। আমার ভরসা আছে তুই পারবি। একসময় তুই আমার ছাত্র ছিলি। আজ তুই অনেক বড়ো হয়ে গেছিস, বুঝলি? আর ছাত্র নয়। কাঁধে কাঁধ দিয়ে কাজ করবার মতো শক্তি হয়েছে তোর এই আমার বিশ্বাস। আমি অপেক্ষা করবো। ভালো থাকিস,শোভনদা।
চিঠিটা লেখা শেষ করে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল শোভন। বিদ্যামন্দিরে আজ ছুটি। রবিবারের নির্জন দুপুরে শুকনো পাতা খসবার টুপটাপ শব্দ হচ্ছে উঠোন জুড়ে। ভীষণ ফুরফুরে একটা অনুভুতি হচ্ছিল তার। বুকের মধ্যে কোথায় যেন একটা পাথর-চাপা আবেগের উৎসমুখ খুলে গিয়েছে। খুলে দিয়ে গেছেন ওই ভুবন দাস। স্কুল কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হয়তো তাঁর নেই। কিন্তু তবুও অন্য কোন গূঢ়পথে সত্যের উপলব্ধি তাঁর হয়েছে। ভালোবেসে সেই উপলব্ধির স্পর্শটুকু তিনি তাকে দিয়ে গেছেন এইবারে। সেদিন সন্ধেবেলার কথাগুলো ফের একবার ফিরে এলো তার স্মৃতিতে--
"তুমি তো কেবল দয়া আর শাসনই করতে শিখেছো সকলকে এতকাল। নিজের জ্ঞানের গরমেই মটমট করতে আছ। ভালোবাসা শিখতে তোমার এখনো ঢের বাকি। আর তাই নিজেকে ছাড়া কাউকে ভরোসা করতেও শেখো নাই। তুমি তাই একলা হে। সব্বাই তোমার নিচে আছে। কেউ তোমার পাশে নাই-------"
ইনল্যাণ্ডটার দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু হেসে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললো যুবকটি, "তোমার কথাই মানলাম ভুবনদা। ভরসা করে পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করবার অনুমতি দিলাম আজ প্রথম। দেখি তাতে লাভ কিছু হয়, নাকি---"
----ইনল্যাণ্ডের মুখটা আটকে, উঠে দাঁড়িয়ে উঠোনে বের হয়ে এল শোভন। ঘরের দরজা তার খোলাই থাকে। তালা সে কখনো ব্যবহার করেনি। উঠোনের একপাশে দাঁড় করানো সাইকেলটা নিয়ে, চিঠিটা পকেটে ভরে সে বের হয় এল বাড়ির বাইরে। এখন কাজ আছে অনেক।
"দিদি নিচে যাবে একবার। ভিজিটার আছে।"
চারপাশে ছড়ানো ছেটানো জিনিসপত্র থেকে মুখ না তুলেই ফরিদা বললো, "এখন আবার কে ভিজিটার এলো মালতিদি? রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। গোছগাছ সব বাকি যে।"
"ডিপার্টমেন্ট থেকে ডাকতে এসেছে সুবোধদা। প্রমথবাবু খবর দিয়েছেন। জরুরি কি কাজ আছে। একবার দেখা করতে বলেছেন। এখন দেখো তোমার কি মর্জি যায়।"
"ছুটির দিনে আবার কী কাজ পড়লো? কিছু বলেছে?"
"না বাপু। অতশত কিছু জানি না। নিজে গিয়ে কথা বলে নাও না! আমি এই হাঁটু নিয়ে অতো বারবার ওপর-নিচ করতে পারবো না বাপু। তাছাড়া, রান্নাঘরে কড়াতে ডাল ফুটছে। পুড়ে গেলে মুখে তুলতে পারবে?"
একটা বেডকভার ভাঁজ করতে করতে ফরিদা বললো, "আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। আর উঠতে হবে না। নেমে গিয়ে রান্নাঘরে যাবার পথে সুবোধদাকে শুধু বলে দিও আমি আধঘন্টার মধ্যে যাচ্ছি।"
নীলম খাটে শুয়ে আড়ামোড়া ভাঙছিল। মালতিদি চলে যেতেই লাফ দিয়ে উঠে বলে, "উ-হু-হু, সবুজ হয়ে যাচ্ছি রে ফরিদা, উ-হু,এই দ্যাখ, টিজিওজে---"
"সবুজ হয়ে যাচ্ছিস! টি জি ও জে!!-----------মানে?"
"ওঃ লল! গেঁয়ো ভূত কোথাকার। টার্নিং গ্রিন অব জেলাসি। এটাও বুঝলি না? সাক্ষাত পি জি নিজে ডেকে পাঠিয়েছেন। টল, ডার্ক, হ্যাণ্ডসাম এণ্ড আনম্যারেড!! উঃ। ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে এলিজিবল ব্যাচেলর, অথচ ওদিকে সাক্ষাত ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি। অর্চনাদি, অবন্তিকাদের মত ডাকসাইটে সুন্দরীরা সব হাবুডুবু খেয়ে কেটে পড়ল, অথচ মহাদেবের ধ্যান ভাঙলো না। আর সেই পি জি আজ নিজে থেকে লোক পাঠিয়ে -------ওরে ও ফরিদা, আমায় একটা আনফেয়ার এণ্ড আনলাভলি ক্রিমের খবর দে রে, আমি যে তোর মতো কালো হতে চাই। কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি---এইবারে বুঝেছি---ও-হো-হো--আসলে কালো রঙটাই লোকটার টার্ন অন। এতদিন কেন বুঝিনি রে! আমরা কেউ বুঝিনি----যতসব ফালতু, বস্তাপচা ট্রিক খেলে খেলে-----"
"নীলম, তুই থামবি? মাথাটা একেবারেই গেছে মনে হচ্ছে তোর। কী যা তা বকছিস তখন থেকে?"
"গেছেই তো! মাথা একেবারেই গেছে। এইরকম একটা খবর শুনলে কার না যায়?" বলতে বলতেই উঠে এসে ফরিদার থুতনিটা ধরে একবার নেড়ে দিয়ে কৃত্রিম রাগের ভঙ্গি করে সে বলল,"হ্যাঁ রে। সত্যি করে বল, কদ্দিন ধরে চালাচ্ছিস? এমনিতে তো ভেজা বেড়ালটির মতো থাকো। সর্বক্ষণ বই মুখে দিয়ে আছো কিম্বা ওই কীসব অ্যাং-ব্যাং ফোকসং গাইছো। কিছুদিন ধরেই পি জির ঘরে ঘুরঘুর করছিলি সে তো দেখেছি। তখন কিছু ভাবিনি অবশ্য। ওরকম কত মেয়েই তো ওনার চারপাশে ঘোরাঘুরি করে আর উনি তাদের মধ্যে শিবঠাকুরটি হয়ে ধ্যান করে যান। তা হ্যাঁ রে, লোকটাকে বধ করলি কী দিয়ে? স্টুডিয়াস ভাব দেখিয়ে না গান শুনিয়ে? লুকোবি না। আমি তোর রুমমেট। আমিই কিছু জানলাম না! লোকে শুনলে বলবে কী?"
বলতে বলতেই হঠাৎ কী একটা মনে পড়তে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। বলে, "দাঁড়া দাঁড়া। এইবারে ব্যাপারটা কানেক্ট করছে। বর্ণা আমায় সেদিন বলেছিল বটে, তুই ওঁর রুমের সামনে দিয়ে গেলেই নাকি উনি ঘুরে একবার দেখেন। শুনে আমিও কয়েকবার খেয়াল করে দেখেছি ব্যাপারটা, তবে গুরুত্ব দিইনি। তারপর খবর পেলাম বাড়িতে ডেকে খাইয়েছেনও তোকে কয়েকবার। আর তারপর আজ একেবারে শনিবার ছুটির দিনে ফাঁকা ডিপার্টমেন্টে এসে বসে ডেকে পাঠিয়েছেন হোস্টেল থেকে। এই সবকিছু যে একটা দিকেই পয়েন্ট করছে ডিয়ার ওয়াটসন! ও ফরিদা আমার মোবাইলটা নিয়ে যা না। এম এম এস করিস একটা ওখান থেকে, শনিবারের নির্জন দুপুরে ডিপার্টমেন্টের ফাঁকা ঘরে গুরু-শিষ্যায় কী ইন্টারঅ্যাকশান হয় তার ভিডিও রেকর্ডিং করে----"
ফরিদা একটু বিরক্ত হচ্ছিল। সাব-আর্বান পলিটিকাল ডেভেলপমেন্ট তার স্পেশাল পেপার ছিল। ওটা পি জির স্পেশালাইজেশন বলে ডিসার্টেশান তৈরির আগে মাঝে মাঝেই সে গিয়ে পি জির কাছে বসত। ওই ব্যাপারেই ওনার কোয়ার্টারেও গিয়েছে বেশ ক'বার। লোকটা ভালো। বেশ কড়া হাবভাব। তবে বদমেজাজি নয়। ওনার মা-ও বেশ ভালোমানুষ। বাড়ি গেলে ফরিদাকে আদর-যত্নও করেন। বেশ মা মা ভাব আছে একটা। মাঝে মাঝে পথে ঘাটে দেখা হলে গল্পসল্পও করেন নিজে থেকে ডেকে। পিজি নিজেও মাঝে মাঝে যে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন এটাও খেয়াল করেছে সে। কিন্তু তাই বলে এরা যে তার থেকে এইরকম কিছু একটা বানিয়ে বসবে সেটা ভাবতেই গা-টা রী রী করে উঠছিল ফরিদার। খানিক চুপচাপ থেকে নীলমের বকবকানি একটু কমলে সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, "তোর উচ্ছ্বাস যদি শেষ হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে এইবারে একটা কথা বলি। আমি কাল ফিরে যাচ্ছি মুরলীপুরে। শহরে আমার কাজ শেষ। এইবারে ওখানে গিয়ে অনেক কাজ আছে আমার। আমার মাস্টারমশাই ডেকে পাঠিয়েছেন।"
"আ-হা! গরবিনী ভাও বাড়াচ্ছেন! যা না,দেখাটা করে আয় আজ। একদিকে গাঁয়ের বুড়ো থুবড়ো মাস্টারের ডাক আর অন্যদিকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টের কেরিয়ার আর রাজপুত্তুরের চিরকুট। ব্রাভো! দেখি মতি কোন দিকে ঘোরে! এ তো ওই সিনেমাটার ক্লাইম্যাক্স হয়ে যাচ্ছে-- কী যেন নাম--ওই যে অমিত খান আর রিংকু গুপ্তা স্টারার--গেল মাসেই তো দেখলাম-------"
ঠোঁট টিপে হাসল ফরিদা। নীলম মেয়েটা বড়ো ভালো। শুধু একটু বেশি রোম্যান্টিক। ওটাই ওর দোষ। দু-দু'বার দুটো অ্যাফেয়ার ফেল করেছে। একটা ভালো বর পাকাড়ানো ছাড়া আর কোন স্বপ্নই এখন আর ধরা পড়ে না ওর চোখে। ওই রঙে মাখিয়েই বাকি দুনিয়াটাকেও দেখতে চায় ও। উঠে দাঁড়িয়ে একটা সালোয়ার কামিজ হ্যাঙার থেকে নামিয়ে নিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে সে বলল, "উচ্ছ্বাসটা একটু কমা। আর আমি ঘুরে আসতে আসতে পারিস তো আমার বড়ো সুটকেসটা একটু গুছিয়ে রেখে দে নীলম। আমি যাবো আর আসবো।"
হোস্টেল থেকে বেরিয়ে একটা আমবাগানের মধ্যে দিয়ে লাল ইঁটবাঁধানো রাস্তা এঁকে বেঁকে এগিয়ে গিয়ে এডাম বিল্ডিং-এ মিশেছে। সেই পথ ধরে খানিক এগিয়ে গিয়ে কী মনে হতে পথ ছেড়ে ডানদিকের মাঠের মধ্যে নেমে পড়লো ফরিদা। মার্চ চলছে। শেষ বসন্তে এসে চারপাশের গুলমোহর গাছগুলো লাল-হলুদ ফুলে ছেয়ে আছে। মাঠকোণাকুণি ঠিক উল্টোদিকে তেমনই একটা বিরাট লালহলুদের ছোপের মধ্যে তাদের পলসায়েন্স ডিপার্টমেন্টের দোতলার কয়েকটা জানালা চোখে পড়ে। বাঁয়ের দিক থেকে তার তিন নম্বর জানালাটা পিজির রুম-এর। ভদ্রলোক অবসর পেলেই টেবিলের ওপর পা দুটো তুলে দিয়ে ওই জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন। ফরিদার কেমন একটা অনুভুতি হচ্ছিল, এই মুহূর্তে ভদ্রলোক ঠিক সেইরকমভাবেই বসে রয়েছেন, তাকিয়ে রয়েছেন তার আসবার দিকে। একটা বিচিত্র অনুভুতি এসে ঘিরে ধরছিল তাকে। তার শরীরের ওপরে একজোড়া অদৃশ্য চোখের স্পর্শ পাচ্ছিল যেন সে।
|| ২ ||
"স্যার, আসবো?"
তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে পা নামিয়ে ঘুরে বসলেন প্রমথ গুপ্ত। ফরিদা দরজায় দাঁড়িয়ে সুইং ডোরের একটা পাল্লা ধরে ভেতরে উঁকি দিচ্ছিল।
"এসো ফরিদা। অসময়ে ডেকে পাঠিয়ে ডিস্টার্ব করলাম না তো?"
"না না। মানে--কাল বাড়ি ফিরে যাবো তো! তাই জিনিসপত্র গোছগাছ করছিলাম একটু। কিন্তু সে ঠিক আছে।"
"ওই জন্যেই তো তোমাকে তাড়াতাড়ি ডেকে পাঠানো! আসলে তোমাকে একটু আগে থেকেই ব্রিফ করে রাখা উচিৎ ছিলো বুঝতে পারছি। কিন্তু একটা কনফার্মেটরি ডকুমেন্ট হাতে না পেয়ে তোমায় কিছু বলবার ইচ্ছে আমার ছিলো না। দেয়ারজ মেনি আ স্লিপ---- জানোই তো! সেই কনফার্মেটরি মেলটা আজ সকালেই পেলাম। আমি ঠিক করেছিলাম সোমবার সকালে তোমাকে সুখবরটা দেবো। কিন্তু মা শুনে বললেন, তুমি নাকি বলেছ, তুমি কালকেই তোমার গ্রামে ফিরে চলে যাচ্ছ।"
"মানে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না সার--কীসের মেল!?"
"আসলে আই অ্যাম সো গ্ল্যাড আই ডোন্ট নো হাউ টু কনগ্র্যাচুলেট ইউ। তোমার ডিসার্টেশান পেপারটা আমি জে এন ইউ-এর ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস-এর প্রফেসর নকভিকে মেল করে দিয়েছিলাম গত মাসে, উইথ মাই রেকমেণ্ডেশানস। ইনিশিয়াল সামারিটা পড়েই উনি একটা এনথুসিয়াসটিক রিপ্লাই দিয়েছিলেন। সেই থেকেই আই ওয়জ কিপিং মাই ফিংগারস ক্রসড। তা আজকেই ফাইনাল মেলটা এলো। তোমার পেপারটা কেমব্রিজের বৃটিশ জার্নাল অব পলিটিক্যাল সায়েন্স-এ পাবলিশড হচ্ছে নেকসট মাসে। উইথ য়্যান ইন্ট্রোডাকটরি নোট ফ্রম নান লেস দ্যান ডক্টর ডবলু জেড নকভি! ক্যান ইউ বিলিভ ইট ফরিদা? আমি যে আমি, প্রমথ গুপ্ত, সেই আমার একটা পোস্ট ডক্টোরাল লেভেলের পেপার অবধি ওনারা গ্রাজিংলি অ্যাক্সেপ্ট করেছিলেন ছ' বছর আগে, তা-ও উইথ প্লেন্টি অব এডিটিং। অ্যাণ্ড লুক অ্যাট ইউ--ইউ স্মার্ট লি'ল গার্ল-- তোমার মিয়ার মাস্টার্সের ডিসার্টেশান পেপারটাই ওখানে---কনগ্রাটস মাই গার্ল। আয়াম সো হ্যাপি অ্যাণ্ড প্রাউড অব ইউ!"
বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের ভেতর পায়চারি করছিলেন মানুষটি। ফরিদার মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠছিলো। নিচু হয়ে প্রমথ গুপ্তকে প্রণাম করবার জন্য হাত বাড়ালো সে।
"ও নো। প্রণাম করবে না। কারো সামনে মাথা নিচু করবে না কখনো।" নিচু হয়ে হঠাৎ ফরিদার হাতদুটো নিজের উষ্ণ, ঈষৎ ঘর্মাক্ত দুটি হাতের মুঠোয় ধরে নিয়ে তার চোখের দিকে চাইলেন প্রমথ গুপ্ত। তীক্ষ্ণ,উজ্জ্বল দুটি চোখ অনেক কথাই বলে চলেছিল তাকে উদ্দেশ্য করে। ফরিদার নারীসুলভ চেতনায় সে-কথার অর্থ ধরা পড়তে কোন সমস্যা হচ্ছিল না।
হঠাৎ সচেতন হয়ে তার হাতদুটি ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন মানুষটি। তারপর বড়ো বড়ো পায়ে হেঁটে গিয়ে তাঁর চেয়ারে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলেন চুপচাপ। তাঁর চোখেমুখে একটু অপ্রস্তুত ভাবের স্পর্শ। ফরিদা চুপ করে একটা চেয়ার এগিয়ে নিয়ে টেবিলের উল্টোদিকে গিয়ে বসল। একটুক্ষণ এটা ওটা নয়ে নাড়াচাড়া করে প্রমথ একসময় ফের বললেন,
"আরো একটা খবর আছে। ডক্টর নকভি তোমার পেপারে এতটাই ইম্প্রেসড যে, তোমাকে সরাসরি ওঁর আণ্ডারে পিএইচডি করবার অফার দিয়েছেন। ফর্মালিটিজ যা প্রয়োজন হবে সে'সব উনি সামলে নেবেন। শুধু তোমাকে উনি চান। চার বছরের ফেলোশিপ অফার করেছেন। আফটার দ্যাট, আণ্ডারস্ট্যাণ্ডেবলি দ্য ওয়ার্ল্ড ইস অ্যাট ইওর ফিট! ফিরে যাওয়া তো তোমার এখন হবে না ফরিদা!"
"না স্যার, মানে --আমি—আমার পক্ষে--"
"নো ফাম্বলিং প্লিজ। ডঃ নকভির মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পোলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট নিজে থেকে কাউকে পি এইচ ডি-র অফার দিচ্ছেন, ইটস সিম্পলি অ্যান ইনক্রেডিবল পিস অব লাক! নোবডি শুড বি ইনসেন এনাফ টু ইভন ড্রিম অব টার্নিং দ্যাট ডাউন, অ্যাণ্ড আই অ্যাম সিওর দ্যাট ইউ আর আ প্র্যাকটিক্যাল গার্ল। আমি তাই তোমার হয়ে সকালেই কনফার্মেশান পাঠিয়ে দিয়েছি ডঃ নকভিকে। শুধু কবে গিয়ে জয়েন করতে পারবে ওখানে সেই ডেটটা কনফার্ম করবার জন্যে তোমাকে ডেকে আনা।"
ফরিদার মুখটা আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠছিলো। একটু ইতস্তত করে সে ফের একবার চেষ্টা করল কথা বলবার, "স্যার। এক মিনিট--আমার একটা কথা ছিল। একটু--"
প্রমথ গুপ্ত মাথা নাড়লেন, "দাঁড়াও দাঁড়াও। আই অ্যাম নট ফিনিশড ইয়েট। দেয়ারস মোর। আমিও ফাইনালি এই সুন্দরনগরের বনবাস ছেড়ে তোমার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই দিল্লিতে শিফট করছি। ডি ইউ থেকে একটা অফার ছিলই কিছুদিন ধরে। কিন্তু আমি ডিসাইড করতে পারছিলাম না। এইবারে তোমার ব্যাপারটা ফাইনালাইজ করে ফেলেই আমিও ডিসিশানটা নিয়েই নিলাম। তো-তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে চাই না। সকালেই এ নিয়ে মা'র সঙ্গে কথা বলেছি। শি ইজ এক্সট্রিমলি হ্যাপি। জাতপাত নিয়ে মা'র যে কোনকালেই কোন ইস্যু নেই সে তো তুমি জানোই। আজ রাত্রে তুমি আমাদের বাড়িতে ডিনার খাবে। মা নিমন্ত্রণ করে দিয়েছেন। তোমাকে একবার ভালো করে ইন্টারভ্যু করে নিতে চান তিনি।"
মনে যেটুকু দ্বিধা ছিলো ফরিদার এইবারে সেটুকুও কেটে গেল তার। লোকটা তার কেরিয়ার, তার ব্যক্তিগত জীবন, এই সবকিছুর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তার অনুমতির অপেক্ষা না করেই কি অক্লেশে সমস্ত সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে চলেছে! খুব অপমানিত বোধ করছিল সে। প্রমথ গুপ্ত কথা শেষ করে উজ্জ্বল চোখদুটি মেলে চেয়ে রয়েছেন তার দিকে। সেইদিকে সরাসরি তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় কেটে কেটে সে বললো, "আজ রাতে আপনার বাড়িতে যে আমি আসতে পারবো না স্যার!"
"কেন?"
"কারণ আজ সন্ধের ট্রেনে আমি আমার গ্রামে ফিরে যাচ্ছি।"
"বাট--"
"দেয়ার্স নো ইফ অর বাট ইন দিস। আমি আজ সন্ধ্যায় ফিরে যাচ্ছি।"
"কিন্তু, তুমি তো কালকে ফেরবার প্ল্যান করেছিলে ফরিদা?"
"করেছিলাম। কিন্তু এক্ষুণিই সেটা চেঞ্জ করলাম। কাল নয়, আমি আজ সন্ধ্যাতেই যাবো।"
"মে আই নো হোয়াই?"
"নো ইউ মে নট। ইটস পার্সোনাল।"
খোঁচাটা ঠিক জায়গাতে গিয়ে লেগেছে দেখা গেল। হঠাৎ মানুষটির চোখদুটোতে যেন বিদ্যুতের একটা ঝিলিক খেলে গিয়েই ফের শান্ত হয়ে এলো তারা। আস্তে আস্তে তিনি বললেন, "আই অ্যাম সরি ফরিদা। এতোগুলো বড়ো বড়ো সিদ্ধান্ত নেবার আগে, তোমার যে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করবার জন্য কিছু সময়ের প্রয়োজন সেটা বোঝা আমার উচিৎ ছিলো। আফটার অল, ফর আ গার্ল অব ইয়োর সোশিওইকনমিক ব্যাকগ্রাউণ্ড, ইটস অলমোস্ট আ সিণ্ডারেলা অ্যাফেয়ার। ঠিক আছে তবে। কতদিন থাকতে চাও বাড়িতে? আ ফোর্টনাইট উইল ডু, আই বিলিভ! আমি তাহলে ডঃ নকভিকে সেইমতোই---"
"অফারটা আমি নিতে পারছি না স্যার। আপনি ডক্টর নকভিকে জানিয়ে দেবেন।"
তার দৃঢ় ও শান্ত কন্ঠস্বরটি প্রমথ গুপ্তের পর্বতপ্রমাণ আত্মবিশ্বাসে কোথাও যেন একটা ঘা মারলো গিয়ে। একটু কাঁপা গলায় তিনি বললেন, "বাট আই অলরেডি রোট টু হিম----
"লিখবার আগে আমার মতামতটা একবার আপনার জিজ্ঞাসা করে নেয়া উচিৎ ছিলো।"
স্থির চোখে তার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়লেন প্রমথ গুপ্ত, "আই য়্যাম সরি ফরিদা। তোমার ভালোর জন্যেই স্টেপটা নিয়েছিলাম আমি। ইটস আ ড্রিম কেরিয়ার ফর এনি স্টুডেন্ট অব পলিটিক্যাল সায়েন্স! ভেবেছিলাম এতে কোন অ্যাসপায়ারিং স্টুডেন্টেরই আপত্তি থাকতে পারে না। আর-- সবার ওপরে----ভেবেছিলাম আই হ্যাভ গট দা রাইট--"
ফরিদা হাসল একটু, "এই ‘রাইট’-এর ব্যাপারেও আবার সেই একই প্রশ্ন করবো, আপনি কি এই ব্যাপারেও আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন কখনো? নাকি রাইটটা নিজেনিজেই অ্যাজিউম করে নিয়েছেন?"
ফরিদা নিজের চেয়ারটা পেছনে ঠেলে দিয়ে উঠে প্রমথ গুপ্তের মুখোমুখি দাঁড়ালো। তারও চোখে তখন আগুনের ঝিলিক দিয়েছে। শান্ত গলায় সে বললো, "ইউ মে বি মুভিং টু ডেলহি, বাট ডেফিনিটলি নট উই। আমার কেরিয়ার ও জীবনধারণের প্ল্যানটা আমার নিজস্ব এবং সেটা আপনার এই ফাইভ স্টার প্ল্যানটার থেকে একেবারেই আলাদা। মোরওভার, মুরলিপুরে আমার এক মাস্টারমশায়ের স্কুলে কাজ করতে চেয়ে তাঁকে চিঠি পাঠিয়েছিলাম; সৌভাগ্যবসত মাস্টারমশাই রাজি হয়ে আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন। ফিরে আমাকে যেতে হবেই স্যার"।
ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছিলো প্রমথর মুখ। সারা জীবন ধরে মেয়েদের পুজো পেয়ে আসা মানুষ তিনি। মেয়েদের মধ্যে নিজের কদর তাঁর ভালো করেই জানা আছে। কোনও মেয়ে, বিশেষ করে ফরিদার মতন অত্যন্ত সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা মেয়ে যে তাঁকে এইভাবে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে পারে সে কথা তাঁর দূরতম কল্পনাতেও আসেনি। খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় হিসহিস করে তিনি বললেন, "আই নো হু ইওর মাস্টারমশাই ইজ। শোভন মণ্ডল, তাই না! আমাদের একই ব্যাচ। আমি প্রেসিডেন্সি আর ও এই ধ্যাধধেড়ে সুন্দরনগর ইউনিভার্সিটি। এম এ শেষ করে, আই ফ্লু টু কেমব্রিজ, অ্যাণ্ড দ্যাট ভিলেজ বাম্পকিন, আমার থেকে প্রায় দশ পার্সেন্ট মার্কস বেশি স্কোর করেও, হি ওয়েন্ট ব্যাক টু হিজ রাস্টিক, ভালগার লাইফ। শোভন, দা গ্রেট রিফর্মার! হাঃ! দা গ্রেটেস্ট ফুল অব দা ব্যাচ! নিজেকে তো শেষ করেছেই, এখন আরও একটা ব্রাইট কেরিয়ারকে নষ্ট করবার ষড়যন্ত্র করেছে ওখানে বসে বসে। ইউ আর বিইং ব্রেইনওয়াশড। নাহলে, একটা ব্রাইট ফিউচারকে ছেড়ে কেউ ওই প্রিহিস্টোরিক সেটিংয়ে পার্মানেন্টলি ফিরে যেতে চাইতে পারে না। বাট নো। আই ওন্ট অ্যালাউ দ্যাট। -----আই ক্যানট।"
ফরিদার মাথার মধ্যে একটা আগুন জ্বলে উঠছিল যেন। কোনমতে নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতেই সে একবার শেষ চেষ্টা করল, "স্যার। আপনি এক্সাইটেড হয়ে পড়েছেন। আপনি বরং পরে একবার---"
"না। পরে নয়। এখুনি। আই সে নাও। শোন ফরিদা। মা ঠিকই বলেছেন। আই নো আই হ্যাভ ডিলেড ইট ফর কোয়াইট সাম টাইম। ডিপার্টমেন্টে আমার তিন বছর হয়ে গেল। তিনটে বছর আমি তোমাকে অবজার্ভ করেছি। অ্যাণ্ড ফাইনালি আই মাস্ট কনফেস, টুডে, আ-আই ডু লাইক ইউ। এণ্ড আই বিলিভ আমি নিজেও যথেষ্ট এলিজিবল অ্যাজ আ ম্যাচ।"
"আ ম্যাচ? মানে?"
"ওঃ কাম অন, ডোন্ট অ্যাক্ট লাইক য়্যান ইনোসেন্ট কিড। ডোন্ট য়ু ফাইণ্ড মি এট্রাক্টিভ? আই নো মাই প্লাস পয়েন্টস। নো সেন গার্ল উইল ফেইল টু ফিল এট্রাক্টেড টু মি। দেয়ার হ্যাভ বিন ডজনস অফ দেম। একসসেপ্ট য়ু। আমি অপেক্ষা করেছিলাম কবে তুমি ব্রেকডাউন করো তার জন্য। বাট য়ু ডিডন'ট মিন টু। সো ফাইনালি আয়াম কামিং ফরওয়ার্ড টু ব্রেক দা আইস। কাম'ন, টেল মি হাউ শুড আই ডু দিস? শ্যাল আই হ্যাভ টু স্টুপ ডাউন সো লো অ্যাজ টু নিল বিফোর য়ু অ্যাণ্ড প্রপোজ? ওয়েল আয়াম রেডি ফর দ্যাট। জাস্ট সে ইট এণ্ড য়ু উইল হ্যাভ ইট।"
মানুষটির সামনে প্রসারিত হাতদু'টি ঠেলে সরিয়ে দিয়ে তার মুখোমুখি সোজা হয়ে দাঁড়াল ফরিদা। তারপর বলল, "একটা ফোকসং আছে স্যার, তার ওয়ার্ডিংগুলো এইরকম-
"যেজন প্রেমের ভাব জানেনা"ওটাই আসল কথা স্যার। আমি কেবল একতাল মাংস নই যে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে চিবিয়ে আত্মসাৎ করে ফেলবেন। অথবা নিছক একটা চিন্তাশীল সফটওয়ারও নই যে সঠিক কম্যাণ্ডগুলো দিলেই সে আপনার সব কথা মেনে চলবে। । আমার একটা নিজস্ব সত্ত্বা আছে। সমস্ত যুক্তি, বুদ্ধি, ঐহ্যিক সাধ আহ্লাদের বাইরে তার জায়গা। গায়ের জোরে তাকে দখল করা যায় না স্যার। আপনি লোক ভালো। ভবিষ্যতে ভালো স্বামীও হবেন নিশ্চয়ই। বহু মেয়েই আপনার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে জানি। তাদের কাউকে আপনি বেছে নিন। সুখী হবেন। আমায় জোর করে দখল করতে চাইলে দুঃখই পাবেন শুধু। এইভাবে শুধু ডমিনেট করে আর নিজের দাবি জানিয়ে সবকিছু পাওয়া যায় না। আর শোভনদার ব্যাপারে আপনি যা বললেন, সেটা কেবল আপনার নয়, আপনার দুনিয়ার অনেকেরই সেই মত। গত পাঁচ-ছ'বছর ধরে শুনতে শুনতে ও আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। ওতে আমি কিছু মনে করিনি। নাও ইফ য়ু অ্যালাও মি, আমি এবারে যাবো। গোছগাছ বাকি রয়ে গেছে। আধঘন্টার মধ্যে বেরিয়ে যেতে হবে আমায়। নইলে সাড়ে পাঁচটার ট্রেনটা পাবো না।"
তার সঙ্গে নাই লেনাদেনা---
হঠাৎ একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেলেন মানুষটি। ক্লান্ত গলায় বললেন, "ওখানে গিয়ে কী করবে বাকি জীবনটা? একটা বাউণ্ডুলের ঘরের হাঁড়ি ঠেলবে। চার-পাঁচটা অ্যানিমিক বাচ্চার মা হবে। ব্যস! তাই তো? তাহলে গত পাঁচ-ছ'টা বছর সোসাইটির রিসোর্স ওয়েস্ট করে কেন থাকলে এখানে?"
বের হয়ে যেতে যেতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত চোখে ফরিদা বলল, "কাজ আমার অনেক আছে স্যার। তবে আপনাকে সেসব বললে আপনি বুঝতে পারবেন না। ইয়েস। ইউ ডু নট হ্যাভ দা ক্যাপাসিটি টু অ্যাপ্রিশিয়েট দ্যাট। আপনারা দিল্লি কেমব্রিজের ক্লাসরুম কনফারেন্স রুমে ঘুরে বেড়াবার জন্য তৈরি হয়েছেন। ওর বাইরে, গ্রাসরুট লেভেলে যে কাজগুলো করবার দরকার আছে সেটা যিনি বোঝেন তাঁর কাছেই ফিরে যাচ্ছি। হাঁড়ি ঠেলবার জন্য নয় স্যার, যাচ্ছি কাজটা শিখতে। তবে একটা কথা আপনি অবশ্য ঠিকই বলেছেন। শোভনদার কথায় ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি নিতে এসে এতগুলো বছর আমি নষ্টই করেছি বোধহয়। আমার আরও আগেই ফিরে যাওয়া উচিৎ ছিল।"
ট্রেনে ভিড় ছিল না বেশি। শনিবারের সন্ধে। এই দিনটা অফিস ফেরত মানুষের ভিড় তুলনায় খানিকটা কম থাকে এ লাইনে। রানাঘাট পেরোতে পেরোতে যেটুকু লোকজন ছিল, তা-ও মোটামুটি খালিই হয়ে গেল একরকম। লেডিজ কম্পার্টমেন্টে ইচ্ছে করেই ওঠেনি ফরিদা। এইরকম নির্জন সময়ে এইসব লাইনে লেডিজে মাঝেমধ্যেই কিছু না কিছু উৎপাত হয়। ওর থেকে জেনারেল অনেক ভালো। একজন মোটামতো ভদ্রলোক, জানালার ধারের প্রায় দু'খানা সিট জুড়ে বসে ছিলেন। এই শেষ মার্চেও তাঁর গায়ে ফুলহাতা পুলওভার। মাথায় বাঁদুরে টুপি। তারপর দু'টো জানালারই লোহার ও কাচের দু'খানা শাটার বন্ধ করে দিয়ে বসেছিলেন। কালীনারায়ণপুর আসতে ভদ্রলোক নেমে গেলেন। ফরিদা হাঁফ ছেড়ে ওঁর সিটটা দখল করে জানালাটা খুলে দিল। অমনি পাঁচমেশালি গন্ধ মেশা বসন্তের সন্ধ্যার কবোষ্ণ হাওয়া এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার সর্বাঙ্গ জুড়ে। তার বেণী না-বাঁধা চুলকে এলোখোঁপা খুলে উড়িয়ে দিয়ে, পরনের শাড়িটাকে এলোমেলো করে দিয়ে খেলা জুড়লো।
ডিপার্টমেন্টের নলিনাক্ষবাবুর একটা লেখা বেরিয়েছে ই পি ডবলুর এই সংখ্যায়। লেখাটা উনি পড়ে দেখতে বলেছিলেন। ম্যাগাজিনটা ব্যাগ থেকে বের করে এনে খানিক সেইদিকে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলো ফরিদা। ঝমঝম করে ট্রেন ছুটছে অন্ধকার ফুঁড়ে। মৃদু আলোকিত একটির পর একটি ছোট ছোট স্টেশন পার হয়ে গিয়ে, বাংলাদেশের একেবারে সীমান্তের গা ঘেঁষে তার শৈশবের গ্রামটি এগিয়ে আসছে ক্রমশ। বইয়ের পাতা থেকে নিজেরই অজান্তে তরুণীটির চোখ কখন যেন উঠে স্থির হয় বাইরের অপসৃয়মান অন্ধকার ল্যাণ্ডস্কেপের দিকে। ওইখানে অপেক্ষা করে আছে তার স্বনির্বাচিত ভবিষ্যৎ।
অহংকারী মানুষটার শেষ কথাগুলো তখনও তার কানে বাজছিল, "একটা বাউণ্ডুলের ঘরের হাঁড়ি ঠেলবে। চার-পাঁচটা এনিমিক বাচ্চার মা -----"
মা! শোভনের সন্তান--তার গর্ভে--তার ঘরণী হয়ে তার সামনে খাবারের থালা ধরে দেওয়া----হঠাৎ এক অচেনা, তীব্র পুলকে শরীরে রোমাঞ্চ হয় তরুণীটির। অনাস্বাদিত এক সুখানুভুতি একটা ঝলক বিদ্যুতের মতই বহে যায় তার দেহ বেয়ে। আর তারপরেই ঝাঁপিয়ে আসে একরাশ লজ্জা-- আ ছি ছি--শোভনদা--শোভনদার সঙ্গে---ছেঁড়া ফ্রকের ঝলঝলে ফুটো মুঠোয় করে ধরে সেই বারো বছরের তরুণীটি যেন ফের একবার এসে দাঁড়িয়েছে তার শিক্ষকের সামনে। কত দূরের মানুষ মনে হয়েছিল শোভনকে সেদিন-----
---ভাবতে ভাবতেই চমক ভেঙে বর্তমানে ফিরে এলো ফরিদা। ট্রেন থেমেছে আড়ংঘাটা স্টেশনে। ট্রেনের জানালার ঠিক পাশে, প্ল্যাটফর্মের ওপর একটা টি স্টলের দেয়ালে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটা আয়নায় তার ছবি পড়েছে। গেরুয়াপাড় সবুজ জমির শাড়ি আর খদ্দরের ব্লাউজে সাজা ঝকমকে একটি যুবতী আয়না থেকে তার দিকে তাকিয়ে দেখছিলো। তবে বেশিক্ষণ নয় অবশ্য। দু এক মূহুর্তের মধ্যে লম্বা হর্ন বাজিয়ে ট্রেন ফের রওনা হতেই প্ল্যাটফর্মের আলোকিত সীমা পার হয়ে ফের ঝাঁপিয়ে এলো অন্ধকার। বাইরের বাতাসে এইবারে শিরশিরে স্পর্শ এসেছে একটা। ফরিদা জানালার কাচটা নামিয়ে নিলো। কাচের গায়ে ফের তার ছবি পড়েছে। সেইদিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে মনে মনে সে বলছিলো, "নিজের হাতেই তো গড়েছো। বারো বছর বয়সে একটা ছেঁড়া ফ্রক পরে ভেতরে বাইরে নোংরা মেখে এসে সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। আর আজ চব্বিশ বছরের হয়ে ফিরে আসছি। এইবারে আমি তোমার কাছাকাছি দাঁড়াবার যোগ্য হয়েছি, বলো? না না, কিচ্ছু দাবি করবো না। শুধু-- যদি কখনো তোমার মনে হয়--যদি কখনো মনে করো-----"
|| ৩ ||
"শুন হে আল্লাহর নেক বান্দাগণ। আজিকার দিবসে দশ সহস্র সাল আগে নবী মহম্মদ জন্নত হইতে দীনদুনিয়ায় আবির্ভূত হন। সেই নবীর জয়গানের জন্যই আজিকার পাক দিনটিতে আমরা মিলাদ উন নবী উৎসব পালন করি। এইবারে শুন শুন আল্লাতালাহের ততোধিক চমৎকার করিশমার বিবরণ--
"পুরাকালে আরবদেশে আল্লাহর এক নেক বান্দা বসবাস করিতেন। হুজুরের নাম ছিল হজরত ইমাম সালি শরাফুদ্দিন আবু আবদুল্লা মুহম্মদ বিন হাসান আল বুসাইরি। একদা এক দুরারোগ্য বেমারিতে হজরত আল বুসাইরির সর্বাঙ্গ ফলজ হইয়া গেল। বুখারা হইতে দামাস্কাস অবধি সকল নগরের হেকিমগণ যখন হুজুরের সেই পঙ্গুব্যধির উপশম করিতে নাকাম হইলেন, তখন একদিন আল্লাহর এই নেক বান্দা, হজরত মহম্মদের শতসহস্র তারিফ করিয়া একটি সুদীর্ঘ নজম রচিলেন ও জুমরাতে, অর্থাৎ জুম্মাবারের পূর্বদিনের রাত্রে একাকি পবিত্রচিত্তে নজমটি পাঠ করিতে শুরু করিলেন। পাঠ করিতে করিতে হুজুরের চোখে গেহরা নিদ আসিয়া আশ্রয় করিল। নিদ্রার মধ্যে তিনি খোয়াব দেখিলেন, যেন সাক্ষাৎ নবী মহম্মদ তাঁহার শয্যাপার্শ্বে দাঁড়াইয়াছেন ও তাঁহার সর্বাঙ্গে একটি শাল বিছাইয়া দিয়া তাহার উপর আপন পাক হস্তটি বুলাইয়া দিতেছেন। তাঁহার সেই গৈবি স্পর্শের প্রভাবে বুসাইরির সব বেমারি মূহুর্তে নিরাময় হইল। খোয়াব ভাঙিলে বুসাইরি দেখিলেন তাঁহার দেহের ওপরে সেই চাদরটি বিছানো রহিয়াছে ও তাঁহার তনদুরুস্তি ফিরিয়া আসিয়াছে । বুসাইরি তখন আল্লাহর এই কেরামতিকে সহস্র সহস্র সালাম জানাইয়া সেই নজমটির নাম রাখিলেন কাসিদা বুরদা, অর্থাৎ ‘পবিত্র চাদরের কাব্য।’
“পরদিন প্রভাতে বুসাইরি যখন বাজারে গেলেন তখন এক দরবেশ অচানক তাঁহার পথরোধ করিয়া দাঁড়াইয়া অনুরোধ করিলেন, 'পুত্র, নবীর গুণকীর্তন করিয়া যে কাসিদাটি তুমি রচনা করিয়াছ তাহা আমাকে শুনাও।'
"বুসাইরি প্রতিপ্রশ্ন করিলেন, 'আমার সেইরূপ সহস্র সহস্র কাসিদা আছে । আপনি তাহার কোনটি শুনিতে চান?'
"উত্তরে দরবেশ বলিলেন,'আমি কাসিদা বুরদা শুনিতে ইচ্ছা করি।'
"বুসাইরি স্তম্ভিত হইয়া বলিলেন,'কিন্তু আমি তো কাল এই নজম একাকি রচনা করিয়া একাকিই পাঠ করিয়াছিলাম। আপনি তাহার কথা কীভাবে জানিলেন?'
"দরবেশ হাস্য করিয়া বলিলেন, 'আমার অজ্ঞাত কিছু নাই। আল্লাহতালার অসীম করুণা তোমার উপর। তুমি ধন্য।'
“তখন কৃতজ্ঞ বুসাইরি গদগদ কন্ঠে, বাজারের মধ্যে সেই দরবেশের সামনে দাঁড়াইয়া পুনরায় কাসিদা বুরদা গাহিলেন। সকলে সেই পাক নজম-এর পবিত্র ধারায় গোসল করিয়া তৃপ্ত হইল।
“হে আল্লাহের বান্দাগন, সেই হইতে দুনিয়ায় এই কাসিদা মশহুর হইল। মিলাদ উল নবীর দিনে ইহার পাঠ করিলে বেহেশতে অক্ষয়বাস হয়। তাহা ছাড়া, এই কাসিদা একাত্তর বার পাঠে বাধা দূর হয়, একশো ষোলবার পাঠে পুত্র সন্তানের জননী হয়, তিনশত বার পাঠে দেশের খরা দূর হয়, সাতশত একাত্তর বার পাঠ করিলে সকল কঠিন কাজ সরল হয়, সহস্র একবার পাঠ করলে সুদীর্ঘ জীবনের অধিকারী হয়-----"
"দূর! যতসব বাজে কথা।" ফরিদাকে একটা ঠেলা দিয়ে নাফিসা হাসল।
"চুপ!" ঠোঁটে আঙুল দিল ফরিদা, "সামনে তোর শাশুড়ি বসে আছে। শুনতে পেলে---------"
"দু ঘা দেবে তো?" ঠোঁট উল্টালো নাফিসা, "আমার বয়েই গেল। ও তো এমনিতেও সবসময়েই দিচ্ছে। মা ছেলে কেউ কম যায় না।"
একটা তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে নাফিসার দিকে ঘুরে চাইল ফরিদা। ছোটবেলার সই তার। বয়সে বড়জোর বছরখানেকের বড় হবে। এর মধ্যেই বুড়িয়ে গিয়েছে কেমন।
তবু নাফিসা হাসছিল। বলে, "একাত্তর বার পাঠ করলাম, কোন বাধাই দূর হল না। একশো ষোল বার পাঠ করলাম, ছেলের বদলে তাতে তিন তিনটে মেয়ে হল। বর বলেছে গর্ভের দোষ। আর একটা নিকা করবে। সাতশো একাত্তর বার পাঠ করলাম, তাতে কোন কাজ সরল তো হলই না, উল্টে বেঁচে থাকাটাই বড্ডো কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াল। রোজ রোজ মারে, একটা বাচ্চা দুধ টেনে খাচ্ছে, একটা পেটে। আর কত সামলাবো বলতো মরণ? তারপরে বুঝলি, পাঠ করা ছেড়ে দিয়েছি। কে জানে বাবা, হাজার একবার পাঠ করলে তারপর যদি দীর্ঘ জীবনের বদলে উল্টোটা করে বসেন উপরওয়লা? তেমনটা হলে আমার মেয়েগুলোর তখন কী হবে রে?"
মসজিদ চত্বরে মিলাদ উল নবীর আসর বসেছে। বেলা চড়ছিল। আসরের একপাশে মেয়েদের বসবার জায়গা। তার ঠিক পেছনে, কুয়োর পাশে একটা ঘেরা দিয়ে রান্নাবান্না চড়েছে। অনুষ্ঠানের শেষে ভক্তদের আনন্দভোজনের আয়োজন। এই গ্রামের হতদরিদ্র মুসলমান মানুষগুলির অধিকাংশেরই দুবেলা ঘরে হাঁড়ি চড়বার সংস্থান নেই। তাই মিলাদ উল নবীর আনন্দের দিনটিতে তাদের জন্য কিছু সুখাদ্যের সংস্থান করবার দায়িত্বটি নিয়েছিলেন এই অঞ্চলের দুই দীনদার ধনী পরিবার। গত তিন দশক ধরে এই দিনটিতে তাঁদের দানের অর্থে এই ভোজনের আয়োজন হয়।
মৌলবীসাহেবের পাঠ ও উপদেশে মনোযোগ দেবার অবসর ঘটছিল না আসরের প্রান্তবাসী এই মহিলামহলে। তাদের কাছে বসা চঞ্চল শিশুগুলির সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রিভূত হয়েছে রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা হালুয়ার সুগন্ধের দিকেই। ক্ষণে ক্ষণে মায়ের কোল ছেড়ে তাদের কেউ কেউ ছুটে যেতে চায় সেইদিকে। কেউ বা বারে বারে টান লাগায় মায়ের আঁচলটি ধরে, আর কত দেরি আছে ভোজনপূর্ববর্তী এই পাঠসভা শেষ হতে তা জানবার উদগ্র কৌতুহলে।
কথা বলতে বলতেই হঠাৎ তার পিঠে ধাক্কা দিতে থাকা বালিকাটিকে কর্কশ গলায় ধমকে উঠল নাফিসা, "ফতেমা,এইবারে মার খাবি, খাওয়ার লোভ ঘুচিয়ে দেবো তোমার একেবারে ইবলিশের বাচ্চা কুথাকার।"
মায়ের ধমক খেয়ে বালিকাটির চোখ জলে ভরে ওঠে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখদুটি কচলাতে কচলাতে সবে সে একটা দীর্ঘ কান্নার শুরুর সুরটি তুলতে শুরু করেছে ঠিক তখনই ফরিদা তাকে কোলে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললো, "কাঁদে না ফতেমা, মা আমার। দেখ না তোর মাকে আমি কী করি! জানিস তোর মা যখন ছোট ছিল না, তখন একবার মিলাদ উল নবীর দিন কী করেছিলো? আসর থেকে উঠে, রান্নাঘরে গিয়ে চুপিচুপি ঢুকে-----"
মেয়েটি কান্না থামিয়ে বড়োবড়ো চোখ করে ফরিদার দিকে তাকায়। শহর থেকে সদ্য দু'দিন হল ফিরে আসা তার মায়ের এই বাল্যসখীটি তাদের গ্রামের অনেকেরই আলোচনার বস্তু। কোন দূরবর্তী শহরের এক বিরাট ইশকুলে সে নাকি পুরুষদের সঙ্গে একসঙ্গে পড়াশোনা করে চলেছে অনেককাল ধরে, যা কিনা একপ্রকার রূপকথারই মতো। যে রূপকথা শুনতে ভালো লাগলেও, নিজের জীবনে তাকে সত্য বলে ভাবা বড় কঠিন কাজ।
“তারপর কী হল ফুফি?”
নাফিসা আড়চোখে একবার কটমট করে মেয়ের দিকে চাইল। মেয়ে অবশ্য নির্বিকার। নতুন আলাপ হওয়া ফুফিটির নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছে যে সে। মায়ের শাসনকুটিল দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সে চোখ ঘুরিয়ে রইল ফরিদার দিকেই।
"নে, গল্প শোনাবার লোভ দেখিয়েছিস একবার। আর ও ছাড়বে তোকে? এখন বোঝ ঠেলা।"
ফরিদা হাসল। বলে, "সেই ভালো। চল ফতেমা, আমরা বরং আসরের বাইরে গিয়ে গল্প করি। এখানে কথা বললে সবাই রেগে যাবে এখন।"
আসর থেকে খানিক দূরে বালিকাটির হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে তরুণীটি তাকে তার নিজের বালিকাবেলার গল্প শোনায়। চিরায়ত সেই ট্র্যাজেডির গল্পে নতুনত্ব কিছু নেই। অগণিত প্রজন্ম ধরে এ গ্রামের মেয়েরা সেই একই দুঃখ পার হয়ে এসেছে। একইভাবে তার বালিকারা সেই দুঃখের প্রস্তরভূমির খাঁজে খাঁজে শিকড় চালিয়ে খুঁজে নিয়েছে তুচ্ছ সব আনন্দের রসদ। আর তারই জোরে কৈশোরের বর্ণময় প্রান্তে পৌঁছোবার সঙ্গে সঙ্গেই সমাজরাক্ষসের এক নির্মম, নিশ্চিত আকর্ষণে ঢুকে গিয়েছে সন্তানধারণ, সন্তানপালন ও দারিদ্র্যের সঙ্গে অসম যুদ্ধ চালাবার এক আবহমান জীবনবৃত্তে।
গল্প শুনতে শুনতেই হঠাৎ অধৈর্য গলায় বালিকাটি প্রতিবাদ করে উঠল। বলে, "দূর! পচা গল্প। ফুফি তোমার শহরের ইশকুলের গল্প বলো না! সেখানে নাকি মাদিমদ্দায় একসঙ্গে থাকে সারাদিন!"
হঠাৎ চমকে উঠল ফরিদা। পাঁচ বছরের কচি গলায় এই ধরনের প্রাকৃত, অভব্য বুলি শোনবার অভ্যাস তার কিছুকাল হল একেবারেই চলে গিয়েছে প্রায়। হঠাৎ গালদুটো তার জ্বালা করে ওঠে দুটি প্রাচীন চড়ের স্মৃতিতে—
---বড় রেগে গিয়েছিল সে সেদিন ক্লাস এইটের মানু-দিদির ওপর। শোভনদাদার বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে তার সামনেই চিৎকার করে বলে উঠেছিল, "ও আমার কান ধরলো ক্যানে? মাগীরে আমি আজ পিছনে বাঁশ ঢুকাইয়ে-------" সে বাক্যটি আর সম্পূর্ণ করা হয়নি তার। তার আগেই দুটো শক্তিশালী হাতের চড় সশব্দে আছড়ে পড়েছিল তার মাংসহীন হাড়সর্বস্ব গালদুটোয়। ওই তার প্রথম রোজগার। প্রথম পাথেয়।
আস্তে আস্তে বড় সোহাগে নিজের গালে একবার আঙুল বুলিয়ে নিল ফরিদা। তারপর ফতেমার দিকে চোখ নামিয়ে নরম গলায় বলল, "আজকে নবীর জন্মদিনে অমনভাবে কথা বললে গুনাহ হবে ফতেমা। ইশকুলে কী হয় জানতে গেলে ইশকুলে যেতে হবে যে। তুমি যাবে নাকি?"
"হ্যাঃ। ইশকুল। মেয়েমানষের ওই দিয়ে হবেটা কী? ভাত জুটাবে ভাতারে, কলম ঘুইরে আমার কী লাভ?"
"ওঃ। কে বলল এ কথা তোমায়?"
"বাবা বইলছে। রাত্তিবেলা শুইয়ে শুইয়ে মা যখনই আমারে ইশকুলে দেবার কথা কয়, বাবা তখন ওই কথা বলে, আর তাপ্পর বাতি নিভায়ে দেয়। তাপ্পর-----হি-হি----"
একটা তীব্র যন্ত্রণা বুকের ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে উঠে আসছিল ফরিদার। প্রমথ গুপ্তর কথাগুলো আগুনের শলার মত ফের এসে খোঁচা মারছিল তার কানে, "একটা ব্রাইট ফিউচারকে ছেড়ে কেউ ওই প্রিহিস্টোরিক সেটিংয়ে পার্মানেন্টলি ফিরে যেতে চাইতে পারে না-------"
"----না স্যার। আমি পারি। আমি পারবোই। কাজের কথা বলছিলেন না? এই যে দেখুন, কত কাজে হাত ভর্তি আমার। আই অ্যাম অ্যান ইনডিস্টিংগুইশেবল পার্ট অফ দিস সয়েল স্যার। আই ওন্ট বিট্রে হার। আই শ্যাল ক্লিন ইট অর ডাই ইন দা প্রসেস। কিন্তু আর আমি পালাবো না। কিছুতেই না--"
তার অন্যমনষ্ক ঠোঁটদুটি বেয়ে প্রলাপের মতই ঝরে পড়ে একটা অসম্ভবকে সম্ভব করবার প্রতিজ্ঞা। এই মাটি এক জীবনে সজীব হবার নয়। তবে চব্বিশ বছর বয়সটা যুক্তির বাঁধা রাস্তায় চলবার জন্য তৈরি হয়নি। অসম্ভবের স্বপ্ন দেখাটাই তার জন্য প্রকৃতির বিধান। "ও ফুফি একলা একলা কটর মটর করি কার সঙ্গে কথা কও? ও ফুফি----"
বালিকাটির ডাকে ফের সচেতন হয়ে উঠল ফরিদা। চৈত্রের রোদ প্রখর হয়ে উঠেছে। দূরে হিন্দু পাড়ায় হো হো রব উঠছে। আজ দোলপুর্ণিমাও বটে। রঙের খেলায় মেতেছে মানুষ ওখানে। মৃদু হেসে সে বলল, "দাঁড়া আজ তোর মা বাবার সঙ্গে কথা বলে দেখছি কী করা যায়। ইশকুলে না গেলে ইশকুলের গল্প শুনে যে কিছু বুঝতে পারবি না মা!"
"না না। ও বললি হবে না। তোমার ইশকুলের গল্প তোমারে বলতিই হবে," অধৈর্য হয়ে বারবার মাথা নাড়ায় বালিকাটি।
"আচ্ছা বাবা, হয়েছে। চল আমরা হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে বলছি।"
আসরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে ধূ ধূ মাঠের মধ্যে দিয়ে নীচু গলায় গল্প বলতে বলতে এগিয়ে চলে ফরিদা। বালিকাটি তার পেছনে পেছনে হাঁটে। শহর থেকে আসা তার মায়ের এই রহস্যময়ী সখিটির গল্পের অধিকাংশই তার বোধগম্য হয় না বটে, তবে অজানা একটা রঙিন দুনিয়ার গন্ধ বয়ে আনে তা তার অপরিস্ফুট চেতনায়...........
"মরণ, আরে এই মরণ? কানের মাথা একেবারে খেয়েছিস মাইরি। কখন থেকে খুঁজছি। আসর শেষ হয়ে গেছে কখন! উঠে ইদিক ওদিক তাকায়ে দেখি আমার মেয়েসুদ্ধ তুই গায়েব। খুঁজতে খুঁজতে পাগল হবার জোগাড় আমার। শেষে দেখি এই ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিওয়ানার মত দুইজনে ঘুরে ফিরছো।"
নাফিসা হাঁফাচ্ছিল। ভারী পেট নিয়ে রৌদ্রের মধ্যে তাদের খুঁজে খুঁজে এতদূর এসে বেশ কষ্ট হয়েছে তার। ঘুরে তাকিয়ে একটু অপ্রস্তুত গলায় ফরিদা বলল, "ইস ছি ছি, এই শরীর নিয়ে রোদের মধ্যে এতটা হাঁটলি? মেয়ে কি তোর মাঠের মধ্যে হারিয়ে যেত নাকি?"
একটু সংকুচিত গলায় নাফিসা বলল, "না না হারাবে কেন? তুই সঙ্গে আছিস যে। তাছাড়া এ মাঠে তো রোজই আসছে গোবর কুড়ুতে। আমি গুসসা হচ্ছিলাম ওদিকে হালুয়া না আবার শেষ হয়ে যায় সেই ভয়ে। ভালোমন্দ তো বিশেষ খেতে পায়না বাড়িতে! ঘিয়ের হালুয়া হয়েছে। জলের বদলে দুধে ফোটানো। সঙ্গে কাজু কিশমিশও দিয়েছে।" বলতে বলতেই মেয়ের হাত ধরে টান দিয়ে সে বলে, "শিগগীর শিগগীর চল ফতেমা। নইলে শেষে----------"
মাঠ শেষ হয়ে মসজিদ প্রাঙ্গনে ওঠবার মুখে ডানদিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল ফরিদা। নাফিসা অবাক হয়ে পেছন থেকে ডেকে বলে, "খেয়ে গেলিনা? এর পরে এলে কিন্তু আর--"
তাকে থামিয়ে দিয়ে ফরিদা বলল, "আমার আর খিদে নেই নাফিসা। বাড়ি গিয়েই বরং-”
“ চাচাজানের জন্য একটু নিয়ে যাবি তো অন্তত।"
চলতে চলতেই মুখ ঘুরিয়ে হাসল ফরিদা। তারপর বলল, "বাবার অবস্থা তো জানিস। সেদ্ধ ভাতটাও পেটে সয় না আর। বাড়িতে জলে একটু সুজি ফুটিয়ে মিলাদের হালুয়া বাবাকে আমিই বানিয়ে দেবো'খন। আর শোন, তোদের বাড়ি যাব এর মধ্যে একদিন। ফতেমাকে হেমলতায় নিয়ে যাবো ভাবছি। কর্তাকে একটু বলেটলে রাখিস।"
"বলবো। তবে রাজি যে হবে না সে আমি আগেই বলে দিচ্ছি। খর্চা দেবে কে?"
"খর্চা লাগবে না। সে আমি বুঝিয়ে বলবো'খন। এখন তাড়াতাড়ি ওদিকে যা, নয়তো হালুয়া শেষ হয়ে যাবে পরে----"
বলতে বলতেই দ্রুতপায়ে বাড়ির পথ ধরল ফরিদা। বেলা হয়ে গেছে অনেক। ফিরে রান্নাবান্না করতে হবে আবার আজ।
|| ৪ ||
সন্ধের মুখ মুখ গা ধুয়ে একটা পরিষ্কার শাড়ি পরে নিল ফরিদা। একবাল ঘরে চৌকির ওপর বসে ছিল। সেখান থেকেই উঁকি দিয়ে ডাকল, "মরণ!"
বারান্দার কোনে দাঁড়িয়ে মুখ ধুচ্ছিল ফরিদা। সাবান মাখা হাতটা মগের জলে ধুতে ধুতেই বলল, "যাই আব্বা।"
খানিক বাদে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে ভেতরে মুখ বাড়াল সে, "কিছু বলবে?"
"বলি কি এই সাঁঝবেলায় চললা কোথায়?"
"বিদ্যামন্দিরে যাবো একটু।"
"অ। তোমার সেই শোভনবাবুর কাছে? তা, এত দিন থাকতি বেছে বেছে আজ রং খেলার দিনই বাবুবাড়ি যেতি হবে?"
ইঙ্গিতটা গায়ে না মেখে ফরিদা হাসল, "হ্যাঁ বাবা।"
"হঠাৎ এত জরুরি কী কাজ পইরলো যে আজকিই যাওয়া চাই? হিঁদুপাড়ায় আজ রং খেলার দিনে সাঁঝবেলায় ছেলেপিলে নিশা কইরে ঘুরবে। কাল সকালে গেলি হয়না?"
দ্রুত হাতে চুলের বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে ফরিদা বলল, "না বাবা। আজকেই যেতে হবে। শোভনদার আজ সকালে মুর্শিদাবাদ থেকে ফিরে আসবার কথা। বলে দিয়েছিলো আজ সন্ধেবেলা যেতে। যা বাউণ্ডুলে মানুষ। কথামতো না গেলে কাল সকালে গিয়ে হয়তো দেখবো ফের কোথাও উধাও হয়েছে। আর সাঁঝবেলায় কে নেশা করল না করল ওসব নিয়ে ভেবোনা। এতদিন শহরে থেকে এলাম, ওসব আমি সামলাতে পারব। বেশি দরকার হলে পায়ের চটিটা তো আছে!"
"দ্যাখো, যা ভালো বোঝ। বড় হইয়েছো। লিখাপড়া শিখেছো। এইবারে তোমার একটা শাদি দিয়া যার জিনিস তার হাতে গস্ত না করতি পারা অবধি বাপের প্রাণে একটু ভয় থাকেই গো মা।"
"বাবা তুমি থামবে? এসে ইস্তক গত সাতদিন ধরে সকাল-সন্ধে ওই এক মন্ত্রই তো জপ করে চলেছো। শাদি, শাদি। তা শাদি করে যদি চলে যাই, তোমার কী হবে? মা তো আর নেই যে তার ওপর হুকুম চালিয়ে কাজ করিয়ে নেবে! গত একটা বছর ধরে ফাঁকা বাড়িতে আছো। তা যখন যেমন দরকার লেগেছে আমি সুন্দরনগর থেকে এসে করে দিয়ে গেছি। এখন কদিন কাছে থেকে আর একটু নয় করলাম! শাদি করে পরের ঘরে গিয়ে উঠলে, তোমায় তখন দেখবে কে বলো দেখি? এই যে তিনদিন ধরে বিছানায় পড়েছো, তা আমি শ্বশুরবাড়িতে থাকলে আসতে দিতো? তাদের মর্জি মেনে চলতে গিয়ে তখন না হত আমার শান্তি, আর তুমিও বেঘোরে মরতে।"
"আমার কথা তুমাকে ভাবতে হবেনা," একবালের রাগী গলায় তার পুরোনো দিনের সেই বাবার ক্ষীণ আভাস পাচ্ছিল ফরিদা। তবে হ্যাঁ, আগের সেই তেজটা মিসিং। বিশেষ করে স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে গত এক বছর ধরে একেবারেই মিইয়ে গিয়েছেন তার একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাবা। আর এখন তো একেবারে বিছানা নিয়েছেন।
কাছে এসে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে ফরিদা বলল, "হ্যাঁ, ভাবতে হবেনা বইকি। তুমি এখানে শুয়ে একফোঁটা জল পাবানা মুখে, আর আমি শ্বশুরের ঘরে হাঁড়ি ঠেলবো আর হালুয়া খাবো। দূর! সে হয় নাকি? নাও এখন আর কথা বোল না তো বেশি। শুয়ে ঘুমাও। আমি দোর বাইরে থেকে টেনে দিয়ে যাচ্ছি। খিল দিও না। ঘরে তো আর কিছু নাই যে চোরে চুরি করবে।"
বাস স্ট্যাণ্ডের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল ফরিদার। কি বিচিত্র জীবনের গতি! চার বছর আগে গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি আসতে সেই বাবা যখন বিয়ে ঠিক করলেন সেদিন বাবা ছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুরুষ। ফরিদা যে তাঁকে মুখের ওপর ‘না’ শব্দটা উচ্চারণ করতে পারবে সেটা তিনি কল্পনা করতে পারেননি। সেই অভাবনীয় ঘটনাটা ঘটে যাবার পর, মুখে যা নয় তাই বলেও যখন কিছু ফল হলনা তখন দৌঁড়ে গিয়ে একটা গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে এসেছিলেন। একচুল নড়েনি ফরিদা তার জায়গা ছেড়ে। একবালের চোখে চোখ রেখে বলেছিল, "ওটা সরিয়ে নাও।" মারবার জন্য হাত ওঠাতে পারেনি একবাল। কিন্তু তার চোখে আগুন ঝরেছিলো। তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বারান্দায় বসে কাঁদতে থাকা মায়ের দিকে লাঠিটা ঘুরিয়ে ধরে বলেছিলো, "এই শেষ। এ আমার মেইয়ে নয়। শুনে রাখ, এই বাড়িতে ও যদি আর কোনদিন পা রাখে তো সেইদিন আমার হাতে তোর মিত্যু হবে।"
প্রায় তিন বছর বাড়িতে আসতে পারেনি ফরিদা। ভয় হয়েছিলো তার। প্রথম প্রথম বড় নিরাপত্তার অভাব বোধ করেছিলো। সেই দিনটির পর থেকে বহুদিন ধরে নিজের বাবাকে কেবলমাত্র একজন প্রতিশোধকামী পুরুষ ছাড়া আর অন্য কোন চেহারায় ভাবতে পারেনি সে । বাড়িতে পা রাখতে মানা করে দিয়েছিলো বাবা। তা-ও সে নিষেধকে অবজ্ঞা করে, নিজের ভয়কে অতিক্রম করে জোর করে বাড়িতে সে আসতে পারতো হয়তো। কিন্তু মন থেকে ইচ্ছেটাই আসেনি।
সেই বাড়িতে সে ফিরে এলো ফের, মায়ের মারা যাবার পরদিন। ডেকে পাঠিয়েছিলো একবাল নিজেই। একবালের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চোখ তুলে চেয়েছিল সে। কিন্তু সে চোখে আগুন ছিলো না আর। তার সব আগুন নিভে গিয়েছে তখন। তারপর, গত একটা বছর ধরে, আস্তে আস্তে শরীর, মন দুটোই হারিয়ে একটা প্রাণহীন মাটির ঢেলার মতো হয়ে গেছে মানুষটা। তবু সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে অন্য সুরে সেই একই আওয়াজ ওঠে, "শাদি দিতে হবে তোর----।" কন্যাসন্তানকে সমাজ নির্দেশিত ও আইনানুগ সন্তান উৎপাদন বৃত্তে ঠেলে না দিয়ে তার শান্তি নেই।
টার্নার পাজ-এর সেই এসেজ অন পলিটিক্স অব ম্যারেজ বইটার একটা প্রবন্ধের কথা মনে পড়ছিল ফরিদার - যুগে যুগে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে মানুষ নিজের সন্তানের পাত্র বা পাত্রী নির্বাচন করবার দায়িত্বটা নিজের কাছে রাখবার চেষ্টা করেছে। কেন? পাজ-এর বক্তব্য, মানুষের অবচেতনে একটা অস্তিত্বের সন্ততির ধারণা রয়েছে। কোন একটা স্তরে সে নিজের ফ্যামিলি লাইনটিকে এক অখণ্ড সত্বা হিসেবেই রেকগনাইজ করে। ফলে সে-ক্ষেত্রে অস্তিত্ব রক্ষার আবেগে জেনেটিক সিলেকটিভিজমের সেই অন্ধ ইন্সটিংকট জন্মদাতা প্রাণীটির চেতনায় বজ্রাক্ষরে মুদ্রিত করে দেয় একটিই দাবী, তার নিজের জিনের বাহক যে মানুষ বা মানুষীটিকে পৃথিবীতে এনেছে সে, সেই সন্তানকেও সৃষ্টি করতে হবে উপযুক্ত উত্তরসুরী বাহকের। আর সে-কাজটি করবার জন্য সন্তানের সঙ্গে মিশ্রণের উপযুক্ত প্রাণীটিকে নির্বাচন করে দেবে সে নিজে। অতএব মরবার মুখে দাঁড়িয়েও এই স্থবির মানুষটি সেই একই দাবীটি জানিয়ে চলে তার সন্তানের কাছে, যে দাবীকে সে একদা পরিবারের কর্তা হবার সুবাদে নিতান্তই গায়ের জোরে আদায় করে নিতে চেয়েছিল।
"দিদি যাবেন নাকি?"
পেছন থেকে আসা ভটভটি ভ্যানের চালকের উদগ্রীব ডাকের জবাবে ঘাড় নাড়ল ফরিদা, "না, বাসে যাবো।"
"বাস আর আজ পাবেন কই? সাড়ে তিনটেয় শেষ বাস চলে গেছে। আর যাবেনা আজ। আজ হোলি না?"
ভ্যানচালকের আপাদমস্তক বর্ণালীর সবকটি রঙের এক উন্মাদ মিশ্রণের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল ফরিদা, "হ্যাঁ সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তা, তুমি ভাড়া যাবে?"
"যাবেন কুনদিকে?"
"দূর আছে। মুরলীপুর যাবো।"
"মুরলীপুর কোথা?"
"আঃ যাবে কিনা তাই বলো না আগে?"
"আজ্ঞে অত বড় গঞ্জ। তার কুনখানে যাবেন না জানলি যাবো কিনা কী করে বলি?"
"হুঁ। হেমলতা বিদ্যামন্দির চেনো?"
এইবার হাসি ফুটল। হলুদ রঙের একরাশ দাঁত ছড়িয়ে তরুণটি ঘাড় নেড়ে জানাল, "শুভনদার ইশকুল তো? আমিও তো ওইখানে দুই কেলাশ পড়েছি। বসেন বসেন।"
"আরে কত নেবে আগে বলো?"
"সে হবে'খন। শোভনদাদা যত নিতি বইলবে নেবো। এখন তাড়া কইরে চলেন। আজ ইশকুলে ফাংশান হবে। আমায় যেতি হবে।"
নিজের আত্মজীবনীর বিবৃতি দিতে দিতেই ভারি গর্বের সঙ্গে শিবু জানায়, "মাসে দুইশো টাকা কইরে আমি বিদ্যামন্দিরে চাঁদা দেই দিদি। সেই সঙ্গে মাল টানার কাজকম্ম কিছু থাকলি সে-ও ওমনি------" বলতে বলতে হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে কৌতুহলী গলায় সে জিজ্ঞাসা করল,
"আপনি কি খবরকাগজের লোক?"
"তোমার তাই মনে হচ্ছে বুঝি?"
"আজ্ঞা। হেমলতার খবর ছাপবেন?" বলতে বলতে ভারী উত্তেজিত হয়ে সে তার চালকের আসনে বসেই পেছনে মুখ ঘুরিয়ে বলে, "আমি হেমলতার সবকিছু জানি। জিজ্ঞেস করিয়া দেখেন!"
ফরিদা হাসতে হাসতে বলল, "না। আমি ওসব কাগজটাগজের লোক নই। আমিও তোমার মতই তোমার শোভনদাদার ইশকুলের ছাত্র। আজকে তোমার মত ফাংশানে আমারও নেমন্তন্ন আছে যে!"
শিবু এইবারে দ্বিতীয়বার ঘুরে দেখল ফরিদাকে। তার পোশাকে, কাঁধের শান্তিনিকেতনী ঝোলায়, চোখের চশমা ও দৃষ্টিতে লেগে থাকা নাগরিক ঔজ্জ্বল্যকে দ্বিতীয়বার ভালো করে দেখে নিয়ে খানিক অবিশ্বাসের গলাতেই যেন বা সে বলে, "আপনি হেমলতায় পড়তেন?"
"কেন? মেয়েরা ওখানে পড়েনা?"
"না পড়ে, কিন্তু--মানে--"
কথাবার্তা এরপর বেশিদূর এগোল না আর। আরও আধঘন্টাটাক বাদে গাড়ি থামিয়ে কোমরের গামছাটা খুলে ঘাম মুছতে মুছতে সে বললো, "নেন, এসে গিছি।"
চাঁদটা তখন পূবের আকাশে মাথা জাগাচ্ছে সবে। ভারী হাল্কা, তিরতিরে একটা ছায়া পড়েছে তার পায়ের কাছে। ফরিদার বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল। কত স্মৃতি! কত ছবি! তিক্ত, মধুর, ঝাপসা ও উজ্জ্বল সেইসব ছবির সারি তার স্মৃতিকে আচ্ছন্ন করে তুলছিল। এইখানে তার দ্বিতীয় জন্মলাভ, তারপর শৈশব থেকে তারুণ্যে উত্তরণ। আজ এতগুলি বছর পেরিয়ে ফের সেই মাটিতে ফেরা। নতুন ভূমিকা নিয়ে, নতুন সাজে, নতুন রূপে----
"কী রে? রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছিস বলতো?"
চমক ভেঙে ঘুরে ফরিদা দেখল, শোভন কখন এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে।
"এ মা, আপনি কেন বেরিয়ে এলেন? আমি তো----"
শোভন হাসল, "বিকেলের লাস্ট বাসটা বেরিয়ে যেতে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম জানিস? ভেবে নিয়েছিলাম আজ আর আসতে পারছিস না। ফোনও তো নেই তোর যে জিজ্ঞেস করবো কী হল। নাচার হয়ে শেষে পরশু যে বুথটা থেকে আমার মোবাইলে ফোন করে আজ আসবি বলেছিলি তাতেই কলব্যাক করলাম। কিন্তু ফোনটা বেজে গেল। যা রাগটা হচ্ছিল আমার! ইশকুলের সব ছেলেপুলেকে বলে দিয়েছি আজ তাদের নতুন দিদিমনি আসছে, তারা সব এসে অপেক্ষা করে রয়েছে দুপুর থেকে, আর তুই প্রথম দিনেই কথার খেলাপ করলি।"
"না না খেলাপ করবো কেন? আসলে বাবাকে গুছিয়ে গাছিয়ে রেখে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। ভেবেছিলাম পাঁচটার বাসটা পাবো। তা স্ট্যাণ্ডে এসে দেখি বাস নেই। তখন শিবু নামে এক ভ্যানওলা, সে না কি আবার আপনার ছাত্র, সে আসায়----" বলতে বলতে এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু অবাক হয়ে সে বলে, "আরে, পয়সা না নিয়ে------"
"ঘাবড়াস না। শিবু কোথাও চলে যায়নি। ভেতরে গিয়ে ছেলেমেয়েদের ওপর সর্দারি করছে। ওর ভাড়া আমি মিটিয়ে দিয়েছি।"
"কত হয়েছে শোভনদা?"
"কুড়ি টাকা নিয়েছে। কিন্তু তোকে দিতে হবেনা। ওটা ফাণ্ড থেকে যাবে। ওটা নতুন দিদিমনির প্রথম ভিজিটের ট্র্যাভেলিং এলাওয়েন্স। এখন ভেতরে চল----"
চাঁদের আলো তখন উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে। সেই আলোয় শোভনের মুখে হাতে, চুল দাড়িতে লেগে থাকা রঙের প্রলেপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
"খুব রঙ খেলেছেন মনে হচ্ছে?"
"হুঁ। তবে কেবল আমি নয়। ভেতরে এসে বাকি সবকটার দশা দ্যাখ একবার। রঙ মেখে ভূত হয়ে আছে একেবারে সবগুলো।"
"ঠিক আমাদের সময়কার মতো, তাইনা শোভনদা? কিছু বদলায়নি বিশেষ।"
"উঁহু। গত পাঁচ ছ বছরে অনেক কিছুই বদলেছে। চল নিজেই দেখবি সব।"
সরু পথটা এসে একটা গেট-এ মিশেছে। তার দু'পাশে লাইন দিয়ে ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে ছিলো। ওরা এগিয়ে আসতে একটা মেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এলো সামনে। হাতের ঠোঙা থেকে লাল আবীর বের করে ফরিদার পায়ে আবীর ছুঁইয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে আবীরের রেখা টেনে দিল তার গালে। তারপর ঠোঙাটা বাড়িয়ে ধরল তার সামনে। তার ভেতরে আঙুল ডুবিয়ে মেয়েটির কপালে ছোঁয়ালো ফরিদা। তারপর একটু ইতস্তত করে সামান্য আবীর শোভনের পায়ে ছড়িয়ে দিয়ে একটা প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল।
শোভনের শান্ত চোখদুটি হাসছিল। ঠোঙা থেকে একচিমটি আবীর তুলে নিয়ে তার গালে কপালে ছুঁইয়ে নিল সে।
সঞ্চরমাণ আঙুলগুলো কি প্রয়োজনের চেয়ে সামান্য বেশিক্ষণ স্থির হয়ে ছিল তার গালে? হঠাৎ করেই বুকের ভেতর একটা অচেনা তিরতিরে কাঁপন টের পেল ফরিদা। উঠোন জুড়ে পাতা প্লাস্টিক শিট-এর ওপর শান্ত হয়ে বসে আছে গোটা স্কুল। ফরিদা সেদিকে চোখ বুলিয়ে নিল একবার। পাঁচবছরে ছেলেমেয়ের ভিড় বেড়েছে অনেকটাই, সেটা মানতে হবে। তাদের সামনে এসে দাঁড়াতে ছোট একটা ছেলে সেই দল থেকে উঠে এল। হাতে ধরা আমপাতা আর গন্ধরাজ ফুলের তোড়াটা হাসিমুখে এগিয়ে ধরলো তার দিকে। তার হাত থেকে সেটা নিতেই পুরো উঠোন জুড়ে ছেলেমেয়েদের দলটা উঠে দাঁড়ালো। তাদের সবার দৃষ্টি তখন ফরিদার দিকে। তারপর সন্ধ্যার নিস্তব্ধতাকে ভেঙে কচি গলার একটা কোরাস বেজে উঠলো সেখানে-- "স্বাগত স্বাগত স্বাগত----স্বাগত হে হেথা শুভ অতিথি-----"
"এটা কী হচ্ছে শোভনদা? এই সব---," ফরিদার গলায় একটু অস্বস্তির স্পর্শ ছিলো।
"করতে দে। আশ্রমের নতুন টিচারের প্রথম দিন। একটু ভদ্রতা করে নিক। ক'দিন পরে দেখতে পাবি, এইসব স্বাগত জানিয়ে গান গাওয়া দেবশিশুরা একএকটি দৈত্যশিশুবিশেষ।"
ফরিদা হাসলো, "সে আর জানিনা ভেবেছেন? আমাদের ব্যাচের সেই তরুণ আর জামাল কি সাংঘাতিক দুষ্টু ছিলো বলুন তো?"
"হুঁ। আর তুই নিজে? পাখি পাখি খেলতে গিয়ে জারুল গাছের ডাল থেকে এক লাফে সটান নিচে। কলার বোন সরে গিয়ে একমাস কাঁধেপিঠে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে ঘুরতে হয়েছিলো, মনে আছে?"
"আছে। সব মনে আছে। আচ্ছা শোভনদা, তরুণ, জামালরা এখন সব কোথায় আছে বলুন তো? কোন কনট্যাক্ট আছে?"
"তরুণ এলাকাতেই আছে। কল্যাণীতে এস্টেট অফিসে একটা কাজ জুটিয়েছে রিসেন্টলি। মাঝে মাঝে আশ্রমে এসে দু একটা ক্লাশও নিয়ে যায়। মাস মাস কিছু চাঁদাও দিচ্ছে চাকরি পাবার পর থেকে। তবে জামাল এখানে নেই। জামিয়া মিলিয়াতে চান্স পেয়ে গিয়েছিলো সে খবর তো বোধ হয় পেয়েছিলি। ওখান থেকেই একটা স্কলারশিপ জুটিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। ফেসবুকে আছে। ওই থেকেই খবরাখবর পাই মাঝে মাঝে। খুলে দেখিস কখনো!"
"তাহলেই আর আমার যোগাযোগ করা হয়েছে! মোটে ই মেল আই ডি নেই একটা, ফেসবুক, টুইটার তো দূর অস্ত।"
"নেই কেন?"
"প্রয়োজনটাই ফিল করিনি যে কখনো! যে কাজটা করবো বলে এতদিন তৈরি হয়েছি তার ফিল্ডটা আমার এইখানে, এই মাটিতে। এই রিয়েলিটির জমি ছেড়ে ভার্চুয়ালের দুনিয়ায় সোশালাইজেশান করে আমার লাভ কি?"
শোভন হাসলো, "লাভ নেই কেন বলছিস? একটা বড়ো এক্সপোজার হয় যে ওতে! কোথায় কে কেমন কাজ করছে তা জানতে পারা যায়। সেটা কাজেও লাগে। এই দ্যাখ সেদিন খুঁজতে খুঁজতে আলাপ হলো কম্বোডিয়ার সিয়েম রীপ-এর ইম পলি বলে একটা লোকের সঙ্গে। লোকটা খেমের রুজের জমানায় পল পটের অত্যাচারের শিকার। এখন "খেমের চিউই খেমের" নামের একটা ইশকুল খুলেছে। অনেকটা আমাদের হেমলতা বিদ্যামন্দিরের মতই ফর্ম্যাট। অনেকগুলো দরকারী টিপস পেলাম ওর থেকে। লোকটা কি কায়দা করেছে জানিস? ইশকুলের দুটো ঘর নিয়ে একটা ডর্মিটরি বানিয়ে দিয়েছে, কাছাকাছি একটা কলেজের ছেলেদের থাকবার জন্য। বোর্ড আর লজিং ফ্রি। ভাড়া হিসেবে ইনমেটদের সপ্তাহে ছটা করে ক্লাশ নিতে হয় ইম পলির ইশকুলে। এখানে অবশ্য সেটা সম্ভব নয়। কাছাকাছি কলেজ আর কোথায়। কিন্তু ওর পোস্টটা পড়ে একটা একেবারে নভেল আইডিয়া এসেছে মাথায়, বুঝলি? ভাবছি--"
"শোভনদা--"
ফরিদার নীচু গলার ডাকে হঠাৎ করে কথার স্রোত থামিয়ে হেসে উঠলো শোভন। তারপর লাজুক গলায় বললো, "এই দ্যাখো। সবে এলি, আর এরই মধ্যে বোর করতে শুরু করে দিয়েছি।"
"না না, বোর হবো কেন? তবে একটা কথা কি জানেন, আপনি আলাদা। আপনার ফিল্ডটা অনেক বড়ো। সেই বৃহত্তর জগতের এক্সপোজারের দিকটা আপনিই দেখুন। ও আপনাকে সাজবে। আমি সাধারণ মেয়ে। দুনিয়ায় কোথায় কে কী কাজ করছে সেটা জানবার বদলে, এই হেমলতায় কতটুকু কী করতে হবে সেটুকু আপনার কাছ থেকে শুনে নিলেই আমার চলবে।"
"হুঁ। আচ্ছা ফরিদা, পড়াবার পাশাপাশি তোকে যদি আমি হেমলতার ডে টু ডে এডমিনিসট্রেশানের চার্জটাও নিতে বলি তুই কি পারবি?"
"আ-আর আপনি? আপনি কোথায়--" একটা তিরতিরে উদ্বেগ উঠে এসে কাঁপুনি ধরায় তরুণীটির গলায়। শোভন বুঝি তার উদ্বেগটাকে পড়তে পারলো। মাথা নেড়ে সে বললো, "দূর আমি আবার কোথায় যাব? আসলে ব্যাপারটা কি জানিস, এই হেমন্তের শেষে মুরলিপুরে একখানা গানের মেলা করবো ঠিক করেছি। কাজটা বেশ বড়ো সড়ো স্কেলে হবে। সেই নিয়ে ছুটোছুটি চলছে বেজায়। সময় যতো এগোবে ও নিয়ে আমার ব্যস্ততাও তত বাড়বে। তাই ইশকুলের কাজটা ততদিন দেখভাল করবার জন্য একজন উপযুক্ত লোকের দরকার ছিলো আমার।"
"আ-আমি পারবো? মানে বলছিলাম কি, তরুণও তো কাছেপিঠেই রয়েছে! ওকে দিয়ে--"
"উঁহু। এ কাজটা হোলটাইম জব। তরুণদের মত পার্টটাইমার দিয়ে ঠ্যালাগোঁজা দিয়ে ক্লাশগুলো চালানো গেলেও একটা প্রতিষ্ঠানকে চালানোর কাজটা ওদের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না। আর তুই পারবি কি না পারবি সে ভাবনা তোর নয়। সেটা আমি বুঝে নেব।"
ফরিদা তা-ও একটা শেষ চেষ্টা করবার জন্য বললো, "শোভনদা, আমি বলছিলাম কি, না হয় আর কয়েকটা মাস আপনি---"
"ফরিদা, দা ম্যাটার ইজ ডিসাইডেড য়্যাণ্ড ক্লোজড।"
আড়চোখে শোভনের দিকে একবার ঘুরে দেখলো ফরিদা। রোদেপোড়া মুখের রেখাগুলিতে তার আশৈশব চেনা সেই কাঠিন্যের ভাবটি ফুটে উঠেছে ফের। গলার স্বরেও সেই চিরপরিচিত আদেশের সুর। এই আদেশকে চিরকাল নির্দ্বিধায় ও বিনা প্রশ্নে মানতে শিখেছে তারা। হাজার চেষ্টাতেও আর এর নড়চড় হবে না। শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে লাভ নেই কোন।
"ঠিক আছে। কিন্তু শুরুতে একটু দেখিয়ে টেখিয়ে দেবেন তো কদিন?"
"সে সব হয়ে যাবে। কাল সকাল এগারোটার সময় স্কুলে রিপোর্ট করবি। তখন ডিটেইলসে কথা হবে। এখন আর ওসব কথা থাক।"
কথা থামিয়ে হাত তুলে একটা ইশারা করল শোভন। অমনি একপাশের দর্শকাসন থেকে উঠে দাঁড়াল একটি কিশোর। সম্ভবত ক্লাস ইলেভেন বা টুয়েলভের ছাত্র হবে; তার গালে হালকা দাড়ির আভাস বোঝা যাচ্ছিল ঝুলন্ত হ্যাজাকের আলোয়। উঠে দাঁড়িয়ে মাঝ উঠোনের দিকে ঘুরে একবার হাততালি দিয়ে সে বলল, "সিক্স বি লাইব্রেরি-ঘরের বারান্দায় যাবে।" সঙ্গে সঙ্গে গোটা পনেরো ছেলেমেয়ে আসরের ঠিক মাঝখানের একখণ্ড জমি খালি করে দিয়ে রওনা দিল একপাশে দাঁড়ানো একটা ঘরের বারান্দার দিকে। উঠোন জুড়ে বসে থাকা বাকি ছাত্রের দল সরে সরে পথ করে দিল তাদের। ততক্ষণে অন্য একজন, একটা জ্বলন্ত হ্যারিকেন এনে ঝুলিয়ে দিয়েছে লাইব্রেরি ঘরের দরজায়। তার মৃদু আলোতে সুশৃংখল ভাবে বারান্দায় উঠে বসে পড়ল তারা। দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরটি এইবারে সামনে বসা একটি মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, "টুকি, আজকে কীসের পরব রে?"
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে জবাব দিল, "আজ তো মিলাদ উন নবী দেবনাথ দাদা।"
"হুঁ। আচ্ছা সুমন, তুই বল তো আজকে কোন পরব?"
"আজ তো হোলি।"
"বেশ। আচ্ছা মিলাদ উন নবী কাকে বলে বলতে পারবি সুমন?"
"মুসলমানের পূজাটুজা কিছু হবে," অপ্রস্তুত গলায় জবাব আসে।
"আচ্ছা টুকি, হোলিতে কী হয় বল তো?"
"রং খ্যালে।"
"তুই খেলিস?"
"ন্যা।"
"কেন?"
"বাবা মানা করেছে। বলে কাফিরি গুনাহ করতে নাই।"
"হোলি কিন্তু একটা রাক্ষসীর নাম। তা জানিস?"
"রাক্ষসী? তারপরে কী হলো?"
"ওমনি গল্পের লোভ হয়ে গেলো? চুপটি করে বোস, এক্ষুণি দেখতে পাবি।" এই বলে শোভন, ফরিদাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে সে বললো, "আজ দোলপুর্ণিমা। আর, সেইসঙ্গে আজ নবী মহম্মদের পুণ্য জন্মতিথিও বটে। তাই, আজকের সন্ধ্যায় আমরা দুটা ছোট ছোট নাটক করবো। একটি প্রহ্লাদ আর হুলিকা রাক্ষসীর গল্প, আর অন্যটি নবী মহম্মদের জীবনের গল্প।"
গুণগুণ শব্দটা গোটা উঠোন জুড়ে একবার জেগে উঠেই থেমে গেলো একেবারে। আর তারপরেই একটা হো হো শব্দ উঠলো চারপাশে-- রাক্ষসীকে দেখা গেছে। আসরের একপাশের একটা ক্লাশরুমের অন্ধকার থেকে লাফ দিয়ে বের হয়ে এসেছে সে! পরনে বাঘছালের মত একটা হলুদ কালোয় ছোপানো শাড়ি। হাতে পিচবোর্ডের কুড়ুল, কালিমাখা মুখে লাল টকটকে দুটি আঁকা ঠোঁট ঠিক যেন রক্তে মাখা! গলায় কাগজের মুণ্ডমালা দুলিয়ে দর্শকদের মধ্যে দিয়ে ছুটে এসে সে দাঁড়ালো মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটিতে। একটি শিশু কোথায় যেন কেঁদে উঠলো তাই দেখে। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই তাকে সান্ত্বনা দেয়া দ্বিতীয় একটি গলা ঘোষণা করলো, "কান্দে না। ভয় কী ভাই? ওইটা তো ক্লাশ এইটের শবনম দিদি। তোমারে লজেন দেয় না?"
তারপর সেই সান্ধ্য অনুষ্ঠান বহে চললো আপন গতিতে। আর্যাবর্তের ও আরবদেশের দুটি লোককথা ও বিশ্বাসের ধারা একদা অস্ত্রধারী হানাদার শাসকদের পিছু পিছু এসে পৌঁছেছিলো এই পাণ্ডববর্জিত প্রাকৃতভূমিতে। বহু প্রজন্মের বিশ্বাস ও ভালোবাসায় এতদিনে তারা তাদের বিদেশি গন্ধকে বিসর্জন দিয়ে একান্তই দেশজ হয়েছে। নাটকের মধ্যেও তাই মদিনার পথে চলতে চলতে মহম্মদ গেয়ে ওঠেন লালনের কোন অতিপরিচিত গান; অথবা, ভ্রাতুষ্পুত্র প্রহ্লাদের ঈশ্বরভক্তিতে অতিষ্ঠ হুলিকা রাক্ষসী অতি সহজেই স্বগতোক্তি করে ওঠে, "আবাগির ব্যাটা তোরে উলাউঠোয় নেয় না কেন রে?" যেন সে এই গ্রামবাংলারই অতিপরিচিত কলহপ্রিয়া রমণীটি।
অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত নটা বাজলো। বারংবার ঘড়ির দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকানো ফরিদার দিকে চোখ পড়তে শোভন একটু অপ্রস্তুত গলায় বললো, "এই রে। রাত হয়ে গেল যে! দাঁড়া তোর ফেরবার ব্যবস্থা করে দি।" বলতে বলতেই পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটি মেয়েকে ডেকে সে বললো, "ফুলি, শিবুদাদাকে খুঁজে বের করে বল তো চট করে খেয়ে নিতে! তারপর ফরিদাদিদিকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবে একেবারে। দশ মিনিট সময় দিচ্ছি।"
তারপর ফরিদার দিকে ফিরে বললো, "আয় ফরিদা, তুইও চট করে খেয়ে নে।"
ফরিদা মাথা নাড়লো, "না শোভনদা। বাড়ি গিয়েই খাবো একেবারে। রান্নাবাড়া করে রেখে এসেছি। বাবা একা একা বসে থাকবে। তুমি বরং শিবুকে তাড়াতাড়ি খাইয়ে ছেড়ে দাও।"
"খাবি না? আজ উৎসব বলে একটু ভালো মেনু করেছিলাম যে! আচ্ছা, ঠিক আছে। ব্যবস্থা হচ্ছে। তুই একটা কাজ কর, গেটের কাছে শিবুর ভ্যানটা রাখা আছে। তুই ওতে গিয়ে বোস। আমি আসছি।"
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অন্ধকার থেকে শিবুর উদয় হলো। হাতে তার দুটো পুঁটুলি। ভ্যানের ওপর সেদুটো নামিয়ে রাখতে রাখতে সে নিজের মনেই গজগজ করছিলো, "বলে, তাড়াতাড়ি খা, তাড়াতাড়ি খা! আরে বাবা অত নাকেমুখে গুঁজে খাওয়া যায় নাকি? ধোঁকা বানায়েছে, মালপো বানায়েছে। ও জিনিস রয়ে সয়ে খেতি হয়। নাকে মুখে গুঁজলে খাওয়ার সোয়াদটাই মাটি। শেষমেষ বললাম, "ফরিদাদিদির জন্য যেমন ছাঁদা বাঁধছো, আমার জন্যও তেমন ছাঁদা বেঁধে দিয়ে দাও একখান। টাইমও বাঁচবে, আমিও বাড়ি গিয়ে শান্তিতে আয়েস করে খাবো। নাও ধরে দেখি। ভালো করে ধরে বসো। আমি গাড়িটা ঘুরুই।"
ফরিদা কৌতুহলী মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। সেটা খেয়াল করে শিবু হঠাৎ বলল, "খুঁজি লাভ নাই। শোভনদাদা এখন ভাতের বালতি হাতে ছেলেপিলেদের খাওয়াতি লেগেছে। ওর এখন আর হুঁশ আছে নাকি?"
"না, মানে এখুনি আসছে বলে গেলো যে---"
"তাহলেই হয়েছে। সে কথা ওনার আর মনে আছে নাকি? তা তুমি এখন কী করবে তাই বলো। দেখা করবার জন্যি ভেতরে যাবে, নাকি রওনা হবে?"
খানিক ইতস্তত করে হঠাৎ হাসল ফরিদা। তারপর বলল, "তোমার শোভনদাদা চিরটাকাল সেই একইরকম খ্যাপাটেই থেকে গেল জানো শিবু। নাও চলো এবারে। ও মানুষের জন্য শুধুমুদু দেরি করে লাভ নেই।"
পেডালে চাপ দিতে দিতে বিরক্ত গলায় বিড়বিড় করে শিবু, "যা বলেছ দিদিমনি। এ লোকের একটা গার্জেন দরকার এখন। খাওয়াদাওয়াটাও তো কোনদিন খেয়াল করে করে না। শুধু ওই ইশকুল নিয়েই আছে দিনরাত। এখন তো আবার কী এক গানমেলার পোকা চেপেছে মাথায়। ওই নিয়ে ঘুরণচণ্ডে হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন করলি শরীল ট্যাঁকে, বলো?"
|| ৫ ||
রঘুনাথপুর গঞ্জ থেকে বেরিয়ে রাস্তা উঁচু হয়ে উঠে গেছে একেবারে আকাশমুখো। এখানে জমির চরিত্র আলাদা। তরঙ্গসংকুল কোন এক সমুদ্রের স্ন্যাপশট যেন। ঢেউগুলি চারিদিকে স্থির হয়ে আছে। সাধ্যাতিরিক্ত যাত্রীর বোঝা নিয়ে তেমনই একটি তরঙ্গের গা বেয়ে উঠতে গিয়ে অসহায় প্রতিবাদ জানাচ্ছিল বাসের এঞ্জিন।
টিলাটার মাথার কাছাকাছি পৌঁছোতে শোভনের গলা থেকে একটা মৃদু উচ্ছ্বাসধ্বনি বের হয়ে এলো। পেছনের সিটে বসে ভুবন দাস সাড়া দিলেন, "কী হইল গোঁসাই, পাইলা?"
"হ্যাঁ ভুবনদা। মনে হচ্ছে এইবারে সিগন্যালটা টিঁকে যাবে। তিনটে কাঠি দেখাচ্ছে।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ ইবারে টাউয়ার পাবেন গো। সামনেই কোতোয়ালবাড়ি আইসবে। সেইখেনে গত বৈশেখে টিলার মাথায় নতুন টাউয়ার বইসলো যে!" পাশে বসা সহযাত্রীটি গভীর মনোযোগ দিয়ে তার মোবাইলের পর্দাটি দেখতে দেখতে মুখ খোলে।
"শুনলে ছোট গোঁসাই, আর সেই 'ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলে আর মেলে না' করতি হবে না। নাও এখন মনের সুখে যতো পারো কথা কও। আমি শুনি। বাপরে যে ব্যাস্ত হইয়েছো কাল বিকেল থেকে ওই ফোনের তরে। তিনদিন ধরি পথে পথে আছি, একবারও ফোনের বোতাম টিপতে দেখলাম না। তারপর কাল থিকে একেবারে পাগলপারা হইয়ে ফরিদার সন্ধান চইলছে। তোমার মনের তল পাওয়া বড় মুশকিল গোঁসাই।"
"সে আর তুমি পাবে কী করে ভুবনদা, কাল দুপুরে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোল যে। টেনশান হয় না?" ফোনের বোতাম টিপে সেটি কানের কাছে ধরে শোভন বলল।
"হরি হরি! আমি ভাবলুম গে---------"
তিনি যে কী ভেবেছেন সেটি ভেঙে বলবার আগেই শোভনের উত্তেজিত গলার শব্দ উঠল সামনের সিট থেকে। চাপা গলায় সে বলছিল, "হ্যালো, ফরিদা, বল।"
নীরব হয়ে বসে কান পেতে শোনেন ভুবন দাস। টেলিফোনের একপেশে বাক্যালাপ থেকে আন্দাজ করতে চান কথোপকথনের মূলসুরটিকে। প্রায় মিনিট দশেক পরে ফোন করা শেষ হতে দ্বিধাজড়িত গলায় তিনি প্রশ্ন করলেন, "খবরাখবর সব ভালো তো?"
হাসি মুখে ঘুরে বসে শোভন বলল, "পঁচিশটা ক্যাণ্ডিডেটের মধ্যে সাতটা স্টার ভুবনদা! মোট বাইশটা ফার্স্ট ডিভিশানে গেছে। বাকি তিনটে হাই সেকেণ্ড ডিভিশান। রেকর্ড ভাঙা রেজাল্ট হল এবারে!"
"সব তোমার ফরিদার কল্যাণে গোঁসাই। ও তোমার বিদ্যামন্দিরের লক্ষ্মী। এসে বসল আর সোনা ফলতে শুরু করল। অদূরে আরও ভালো হবে দেখো।"
"দূর। ফরিদা তো এলো মার্চে। ততদিনে মাধ্যমিক শেষ। ওকে আর ক্রেডিট দিচ্ছো কেন ভুবনদা? তবে হ্যাঁ, অদূরে আরো ভালো হবে ওর থেকে সেটা কিন্তু তুমি ঠিকই বলেছো। কেন এ-কথা বলছি শোনো। কাল কী হয়েছে জানো? এই এখন ফরিদা বললো। বিপুল মণ্ডলের ছেলে অনুপমকে চেনো?"
"হ্যাঁ চিনি। যুগীপাড়ার বিপুল। অনাথ রায়ের জমিতে কিষানি করতো।"
"করতো নয়। এখনো করে। অনুপম ছেলেটা পড়াশোনায় ভালো, কিন্তু একটু নরমসরম। ভেবেছিলো স্টার পাবে, কিন্তু দু'নম্বর শর্ট হয়েছে। সে ছোঁড়া শোভারাম ইশকুলে গিয়ে মার্কশিটটা নিয়েই বেরিয়ে কোথায় চলে গেছিল। বিকেলে বিদ্যামন্দিরে ফিরে সবাই ফরিদাকে রেজাল্ট দেখাচ্ছে, তা তখন ধরা পড়ল অনুপম দলে নেই। বাকি ছেলেদের মুখে তার রেজাল্টের কথা শুনে ফরিদার সন্দেহ হতে দুটো ছেলেকে সাইকেল দিয়ে যুগীপাড়া পাঠিয়ে দেয় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। খানিক বাদে তারা ফিরে এসে যখন জানাল, অনুপম সেখানেও ফেরেনি, তখন মাধ্যমিকের পুরো ব্যাচটাকে নিয়ে বসে ফরিদা একটা সার্চপার্টি বানিয়ে চারপাশে পাঠিয়ে দেয়। ওদের বলে দিয়েছিলো, "নিজেদের বন্ধু হারিয়ে গেল খেয়াল করলি না, এখন তাকে খুঁজে না বের করে কেউ বাড়ি ফিরবি না।"
"খুঁজে পেল কি?"
"হ্যাঁ পেয়েছে। ছোকরা গিয়ে বিষ্ণুনিবাসের একশো আট মন্দিরের মধ্যে লুকিয়ে বসে ছিল। ভাবো দেখি একবার! পোড়ো ভাঙা কতগুলো মন্দির। সাপখোপের আড্ডা। ওর মধ্যে গিয়ে রাত্রিবেলা-------
"তা ফিরিয়ে আনবার পর, শেষরাত্রে সবাই মিলে মিছিল করে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তবে ক্ষান্ত হয়েছে ফরিদা। ভুবনদা, আমার খুব আনন্দ হচ্ছে জানো, আজ!"
ভুবন হাসলেন, "সে তো হবেই গোঁসাই। অত ভালো সব ফল হইল পরীক্ষায়--"
"না না। সে তো আছেই। কিন্তু আসল আনন্দটা অন্য কারণে। ফরিদা একা একা ভার নিতে শিখে গেছে ভুবনদা। আমার ছেলেমেয়েগুলো ওর হুকুম মানতে শিখে গেছে। নইলে ওর এক কথায় গোটা ব্যাচ বাড়িতে রেজাল্ট দেখানো শিকেয় তুলে রাতভর বন্ধুকে খুঁজতে যায়?"
যুবকটির চোখে মুখে একটা খুশির ফুরফুরে হাওয়া বয়ে যেন। সেই হাওয়া সংক্রামিত হয় তার সঙ্গী সর্বত্যাগী বৈরাগিটির মনেও। মৃদু গলায় তিনি স্বগতোক্তি করেন, "যেমন দ্যাবা তেমন তার দেবী জুটেছে। দুটোই পাগল। আত্মসুখ বলি কোন বস্তু নাই শরীরে। গুরু হে--------"
তার অস্ফুট প্রার্থনাটি অকথিতই থেকে যায় অবশ্য। কারণ বাসটি একটি মোড় ঘুরে এসে তীব্র এক ঝাঁকুনি মেরে তখন থেমে দাঁড়িয়েছে। দরজার থেকে কণ্ডাকটারের হাঁক উঠছে, "সারনির বাজার, সারনির বাজার--------কে কে নামবেন জলদি উঠে আসেন। এবারে এক্কেবারে সিধে মধুকুণ্ডা ইশটিশানে গিয়ে দম নেবো। মধ্যে আর কোন থামাথামি নাই--"
শোভন তাড়াতাড়ি তার ঝোলাঝুলি সামলে উঠে দাঁড়াল। বাইরে ধূ ধু করছে গ্রীষ্মের খরশান রৌদ্র। পেছন ঘুরে হাত বাড়িয়ে সে ডাক দিল, "এসো ভুবনদা। হাতটা ধরো। নামতে হবে যে।"
লোহা মেশানো জংধরা পাথরের টিলা পেরিয়ে হারিয়ে যাওয়া পথে গর্জন করে লাল ধুলোর কুণ্ডলি তোলা বাসটা হারিয়ে যেতে নির্জনতা নেমে এলো চারপাশে। বিশাল আকাশে আবৃত গ্রামটি। দিগন্তের গায়ে পাহাড়ের প্রাচীর আকাশ ছুঁয়েছে। সেইদিকে তাকিয়ে শোভন বলল, "ওই যে পাহাড়টা দেখছো ভুবনদা, ওর নাম বিহারীনাথ। মহাভারতে ওর নাম ছিল ক্রৌঞ্চপর্বত।"
ভুবনের অবশ্য সেদিকে চোখ নেই তখন। বাসরাস্তার পাশে খানিক জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা হাটটির দিকে তাঁর নজর গিয়েছে। ভরা দুপুরে তার বিকিকিনিতে খানিক ঝিম ধরলেও একেবারে বন্ধ হয়নি তা। সেই দিকে দেখতে দেখতেই তিনি জবাব দিলেন, "পাহাড় দেখি পেট তো ভরবে না ছোটগোঁসাই। বেলা কতটা হল সে খেয়াল আছে?"
শোভন হাসল, "এই দেখো। ভুলে গেছিলাম একেবারে। কিন্তু ভুবনদা, এখানে ভাতের জোগাড় হবে বলে তো মনে হচ্ছে না।"
চারপাশে সন্ধানী দৃষ্টি চালাতে চালাতেই হঠাৎ একটি অভিমুখে দৃষ্টি স্থির করে ভুবন বলে উঠলেন, "ভাত না মেলে তো মুড়িই সই। চল গোঁসাই, ওই হোথা মুড়ি ব্যাচে মনে হয়। তার সঙ্গে বাজার থেকে দুটো কাঁচা লংকা আর মুলো কিনে নিলেই হল। চলো গোঁসাই, পা চালাও।"
মুড়িওয়ালা কিশোরটি বেশ চালাকচতুর। এলাকার হালহদিশও রাখে দিব্যি। মুড়ি মেপে ভুবনের গামছায় ঢেলে দিতে দিতেই প্রশ্ন করল, "যাবেন কোথা?"
"ডিগলি গ্রামে যাবো। ওখানে অনন্ত বাউরির বাড়ি-----"
ঝকমকে দাঁত বের করে হাসল ছেলেটি। বলে, "আমার বাড়ি ডিগলিতেই। অনন্ত বাউরি আমার কাকা হয়। আমার নাম তারাপদ বাউরি। আপনারা?"
মুড়িভরা মুখে ভুবন জবাব দিলেন, "আমরা নদে থিকে আসতিছি বাবা। গানের বায়না দিব বলে আসা। তা সে গেরাম এইখান থিকে কদ্দূর?"
ছেলেটি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, "সারনার টিলা পার হতে পারবেন কি? তাহলে জোর পায়ে হাঁইটলে ঘন্টা, স'ঘন্টার পথ। আর পাহাড় বেড় দিয়ে যেতে চাইলে তিনচার ঘন্টা লাগতে পারে। তা, এই রোদ মাথায় করে গেলে কষ্ট হবে যে!"
বাইরে সূর্যের উত্তাপে যেন ধিকি ধিকি জ্বলন্ত লাল, পাথুরে প্রান্তরটির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন ভুবন, "ঠিক কথাই বলছ বাবা। তবে কিনা, কাজটাও মেটাতে হবে যে! এখন আর কী করা!" বলতে বলতেই আড়ে আড়ে বৃদ্ধের চোখ চলে যায় তাঁর তরুণ ভ্রমণসঙ্গীর দিকে। শোভনও চেয়ে চেয়ে দেখছিল ভুবনকে। বয়স্ক শরীরটিতে তাঁর নিদারুণ ক্লান্তির ছাপ। একটু অস্বস্তি হচ্ছিল তার। ভরা গরমে মালভূমি অঞ্চলে এই বৃদ্ধকে নিয়ে আসাটা সম্ভবত ঠিক হয়নি তার পক্ষে। গরমের মধ্যে বাসযাত্রার ক্লান্তিটাই যেভাবে জানান দিতে শুরু করে দিয়েছে তার শরীরে, এরপর রোদের মধ্যে ওই খাড়াই পাহাড়ি পথ বেয়ে দেড় ঘন্টা হাঁটলে সমস্যা হতে পারে। মাথা ঘুরিয়ে ছেলেটির দিকে চেয়ে সে বলল, "তাহলে নাহয় এইখানে খানিক বিশ্রাম করে, রোদের তেজটা একটু কমলে পরেই যাব। তা, তুইও তো হাটের পরে বাড়ি যাবি তো?"
ছেলেটা মাথা নাড়ল, হাট ভাঙবে পাঁচটায়। তারপর আপনারা আমার সঙ্গেই ডিগলি যেতে পারবেন। এখন এখানেই বসেন খানিকক্ষণ তবে।"
মাঠজুড়ে হরেক রকম গাছ ইতি উতি ছড়িয়ে আছে। তারই মধ্যে একটা অতিকায় জারুল গাছের নিচে মুড়িওয়ালার দোকান। মুড়ির বস্তার পাশে একটি বাঁশের চ্যাঙারিতে কিছু ভাজা ছোলা, কুঁচিয়ে রাখা ধনেপাতা, কাঁচালংকা ও পেঁয়াজের স্তূপ। এই ভরদুপুরে তার দোকানে ক্ষুধার্ত খরিদ্দারের অভাব নেই। যন্ত্রচালিতের মত কাজ করে চলে সে।
খাওয়া দাওয়া সেরে একঘটি জল খেয়ে ভুবন তাঁর গামছাটি মাটিতে বিছিয়ে শুয়ে পড়েছেন। ফুরুফুর করে নাক ডাকছে তাঁর। উষ্ণ, মৃদু হাওয়া তাঁর অবাধ্য চুলদাড়ি নিয়ে খেলা করে। তাঁর পাশে বসে চোখদুটো একটু লেগে এসেছিল শোভনেরও। হঠাৎ নিচু গলায় একটা সুরেলা ধ্বনিতে তার চটকাটা ভেঙে গেল একেবারে। চোখ খুলে দেখে, নিবিষ্ট হয়ে মুড়ি বিক্রির অনুপান পেঁয়াজ ও ধনেপাতা কুঁচোতে কুঁচোতে গান গাইছে কিশোরটি--
তুহার জন্য জরিমানাগাইতে গাইতে হঠাৎ করেই শোভনের সঙ্গে চোখাচোখি হতে গান থামিয়ে চুপ করে যায় তরুণটি।
তুহার জন্য জেলখানা
তবু শুনিব না মানা
না শুনিব রে মানা
করিব রে আনাগোনা
তুহার জন্য বিহার যাব
তুহার জন্য ছাতার যাব
তুহার জন্য ঝারগাঁ যাব
তুহার জন্য বরগা যাব
তবু শুনিব না মানা
না শুনিব রে মানা
তুহার জন্য প্রাণ দিব
তুহার জন্য হত্যা দিব
তুহার জন্য দিব্যি দিব
তবু শুনিব না-------
"থামলি কেন? গা----"
লাজুক হেসে মাথা নাড়লো তরুণটি। গাইবে না সে আর। চোখের আড়ালে থাকা কোন তরুণীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত গানটি তার একান্তই ব্যাক্তিগত সম্পতি। কারও সঙ্গে ভাগ করে নেবার বস্তু সে নয়। হাতে ধরা ছোট ছুরিটি তার দ্রুত উঠে নেমে চলে।
"বাবু, চলেন চলেন---"
ঘুম ভেঙে ঝেড়েঝুড়ে উঠে পড়লো শোভন। ভুবন দাস তার আগেই উঠে পড়ে ঝোলাঝুলি নিয়ে তৈরি হয়ে বসে রয়েছেন। তরুণটি তার পায়ে হাত দিয়ে ঝাঁকাচ্ছিল। মাঠ জুড়ে শেষ বিকেলের ছায়াছায়া আলো-আঁধারি নেমে এসেছে। সারা সপ্তাহের বিকিকিনি সেরে লোকজন এবারে বাড়িমুখো। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে ঝোলাটা কাঁধে তুলে নিল শোভন। ছেলেটাও এবারে তার দোকান মাথায় তুলে নিয়েছে। মাথার ওপর একটা বিড়ে বসিয়ে তার ওপর বাঁশের চ্যাঙারি, চ্যাঙারিতে রাখা রয়েছে বিক্রিবাট্টার শেষে অবশিষ্ট সামান্য কিছু মুড়ি ও অন্যান্য উপকরণ। শোভনরা উঠে দাঁড়াতে চ্যাঙারি মাথায় তারাপদ আগে আগে হাঁটা দিল।
মাঠের উত্তরপ্রান্ত ছাড়িয়ে বন্ধুর জমি হঠাৎ করেই আকাশমুখো বাঁক নিয়েছে। পথের কোন চিহ্ন নেই তার বুকে। তবু, অভ্যস্ত পদক্ষেপে কোন এক অদৃশ্য পথকে অবলম্বন করেই যেন বা, তরতর করে ওপরদিকে উঠতে থাকলো তারাপদ। নিচে প্রসারিত গ্রামটি ছাড়িয়ে যত ওপরের দিকে পৌঁছায় ততই ঘন হয়ে আসে শাল, মহুয়া ও পলাশের জঙ্গল। বনজ গন্ধে ছেয়ে আছে নির্জন পাহাড়ের দেহটি।
গাছের ফাঁকে ফাঁকে পথ করে চলতে চলতে ভুবন বললেন, "এই অন্ধকারে জঙ্গল পাহাড়ে কেন নিয়ে এলি রে ছোঁড়া? আর একটু আগে বের হলেই তো হত! দিনে দিনে বেশ----"
তারাপদ হঠাৎ থেমে দাঁড়ালো। একটা বড় পাথরের চাঙড় এইখানটায় পথকে আড়াল করে আছে। তার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে এক হাতে মাথার চাঙাড়ি সামলে অন্য হাতটা ভুবনের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, "সব হাটেই তো সেইরকমই করি গো! এ বনে ভালুকের গতায়াত আছে। সেই ভয়েই তো বিকেল থাকতে থাকতে বাড়ি ফিরতে হয়। আজ আপনারা সঙ্গে আছেন। বুকে একটু বল এসেছে। তাই সাহস করে ভাবলাম----"
তার হাতটিকে অবলম্বন করে পাথরের চাঙড়টির ওপরে উঠে এলেন ভুবন দাস। তারপর কোমরে হাত দিয়ে শরীর বাঁকিয়ে ক্লান্তি অপনোদন করতে করতে বললেন, "ভেবে আমাদের উদ্ধার করেছো বাবা! এখন তাড়াতাড়ি পা চালা । আর কতটা উঠতে হবে বল দেখি! সঙ্গে বাতিটাতি তো কিছু নেই। এই অন্ধকারে----"
তারাপদ হেসে বললো, "এক্ষুণি আলো হয়ে যাবে গো! পেছনে চেয়ে দ্যাখেন দেখি! আজ পুর্ণিমা নয়?"
পেছন ঘুরে তারা দেখলো, দূরে বিহারীনাথ পাহাড়ের অন্ধকার আবরণের পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে সদ্যজাগ্রত চাঁদ। এখনও তার শরীরে লেগে আছে প্রথম সন্ধ্যার লোহিতাভ ছাপ। মৃদু হাওয়া ছেড়েছে তখন। বুক ভরে সেই সুগন্ধ বাতাস ফুসফুসে টেনে নিয়ে শোভন বললো, "চলো ভুবনদা, পা চালিয়ে চলো দেখি এইবারে!"
বনপথ ধরে এগিয়ে যায় তিনটি মানুষ। তাদের পেছনে পুরাণবর্ণিত সেই ক্রৌঞ্চপর্বতের কোল ছেড়ে আকাশ সাঁতরে চাঁদ ক্রমশ উঠে আসে ওপরে। উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার ধারা গলিত রূপোর মতো ঝরে পড়ে তাদের মাথার ওপরে ছেয়ে থাকা অতিকায় বৃক্ষরাজদের পত্রমুকুটের ফাঁকফোকর গলে।
ভুবনের সঙ্গে ইতিমধ্যেই তারাপদর ভাব হয়ে গিয়েছে বেশ। হাত ধরাধরি করে তারা আগে আগে হাঁটে। মাঝে মাঝে ঘষা, প্রাচীন গলায় জেগে ওঠে পরিচিত সুর, "একবার এসো গৌর দিনমণি----"
পরক্ষণেই সদ্য ভাঙা তেজি, তরুণ গলাটি শুনিয়ে দেয় তার বয়সোচিত কোন চটুল ঝুমুর গানের কলি,
"সাইকেল নয়কো রেলগাড়ি
চলি যাবে তাড়াতাড়ি
বিহাই যাইছেন বাড়ি
বিহান দেখছেন ঘড়ি
সাইকেলে বিহাই যাইছেন ঘরে
দুটা ঠ্যাং ফাঁক করে"
যৌবন ও বার্ধক্য পাশাপাশি প্রবাহিত হয় আপন আপন সঙ্গীতের ধারায়। চন্দ্রালোকিত পাহাড়টি মৌন হয়ে তাই শোনে।
আন্দাজ আটটা নাগাদ অবশেষে পায়ের নিচে ডিগলি গ্রামের দেখা পাওয়া গেল। ছোট্ট গ্রামটি। জঙ্গলের মধ্যে খানিক জায়গা পরিষ্কার করে তার ওপর বড়জোর শ'খানেক মেটে ঘর, চাঁদের আলো মেখে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের কোন সাড়াশব্দ নেই সেখানে। সেইদিকে আঙুল তুলে তারাপদ ঘোষণা করল, "এসে গেলাম। সব শুয়ে গেছে। ডেকে তুলতে হবে।"
শোভন মাথা নেড়ে বললো, "এই তোর একঘন্টা স'ঘন্টা হলো? কম করে তিন ঘন্টা হাঁটিয়েছিস আমাদের তুই আজ।"
"কী করব? বুড়োবাবার জন্য আস্তে চলতে হলো যে! আপনারা বরং এইবার ধীরেসুস্থে আসেন, আমি আগে আগে গিয়ে কাকারে ডেকে তুলি গে।"
বলতে বলতেই ভুবনের হাতটি ছাড়িয়ে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে গেল সে। চন্দ্রালোকিত প্রস্তরভূমির ওপর তার ছায়াটি টলমল করতে করতে ছুটলো তার পায়ে পায়ে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তার দীঘল কালো শরীর মিলিয়ে গেল বনময় পাহাড়ের গায়ে।
মিনিট পনেরো বাদে গ্রামের সীমানায় পৌঁছে দেখা গেল, তারাপদ সহাস্যমুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আরেকজন প্রৌঢ়। তাড়াহুড়োয় ঘুম থেকে উঠে এসেছেন। চোখেমুখে এখনও সেই ঘুমের জড়তা মাখা। শোভনের দিকে এগিয়ে এসে তিনি বললেন, " আমি অনন্ত। বাবুদের আসা হচ্ছে কোথা থেকে? পরিচয়?"
শোভন বললো,"আমরা নদে জেলার লোক। সুন্দরনগর সাবডিভিশান কোর্টের নগেন উকিল আপনাদের ঠিকানা দিলেন।"
"নগেন ঘোষ? ও বাব্বা। তিনি তো অনেক উঁচাদরের মানুষ গো! কুমারহাটের জমিদারবাড়ির এক আনার শরিকের বড়ছেলে। আপনারা তেনার বন্ধু নাকি? আমার কাছে কী কাজ?"
অনন্ত বাউরির চোখেমুখে সম্ভ্রমের ছাপ। সম্ভবত তার পরিচিত বৃত্তে অত্যন্ত উঁচুস্তরের বাসিন্দা এই নগেনবাবু।
শোভন মাথা নাড়লো, "না না বন্ধু টন্ধু নই। ওনার দুই ছেলেমেয়েকে পড়াতাম, সেই থেকে জানাচেনা। ভালো ঝুমুরগানের সন্ধান করছিলাম, তখন তিনি আপনার খোঁজ দিলেন। তাই গান শুনতে আসা।"
"আচ্ছা আচ্ছা সে সব হয়ে যাবে'খন। নগেনবাবু পাঠালেন। গান তো হবেই। কালকের দিনটা থাকা হবে তো?"
"হ্যাঁ। পরশু সকালে ফিরবো ঠিক করেছি।"
"তবে তো মিটেই গেলো," প্রৌঢ় মানুষটি মাথা নাড়েন, "কালকে আসর বসায়ে দেব। এখন আসেন দেখি। খাওয়াদাওয়া করেন, আরাম করেন। দুপুরবেলায় তো শুনলাম মুড়ি ছাড়া কিছু জোটে নাই।"
আদরভরা ডাকটির পেছনে ভরপেট খাদ্য ও নিশ্চিন্ত শয্যার আহ্বান ছিল। এইবারে দুনিয়ার ক্লান্তি এসে যেন ভর করলো যাত্রী দুজনের দেহে। অলস পদসঞ্চারে তারা অনন্তর পিছুপিছু এগিয়ে গেল গ্রামের মাঝামাঝি একটি বাড়ির দিকে। তার পূর্বের ভিটার রান্নাশাল থেকে গণগণে কাঠের আগুনের আভাস আসছিলো। চুড়ির রিনিঠিনি, নারীকন্ঠের দু একটি মৃদু ফিসফাস, আর সেই সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠছিলো ফুটন্ত ভাতের সুগন্ধ।
উঠোন পেরিয়ে উল্টোদিকের ভিটার একটি ঘরে তাদের ছেড়ে দিয়ে তারাপদ রান্নাবাড়ির দিকে গেল। তার বারান্দায় একটি মাদুর পেতে ঝোলাঝুলি নামিয়ে আরাম করে দুটি বিড়ি ধরাল শোভনরা। কেরোসিন তেলে ভরা একটা কুপি রাখা রয়েছে সামনে। সেটাকে সামনে টেনে দেশলাইটা ফের বের করে এনেও কি মনে করে শোভন সেটাকে ঢুকিয়ে রাখল পকেটে। বারান্দা জুড়ে চাঁদের আলো পড়েছে। কুপি জ্বালিয়ে রেখে আর কী দরকার!
পরদিন সকাল থেকেই গ্রাম জুড়ে সাড়া পড়ে গেল। অনন্তর হাতে একশোটি টাকা দিয়েছিল শোভন। তাই দিয়ে হাঁড়িভরা ভাতের মদ জোগাড় করে আনা হয়েছে। উঠোন জুড়ে আসর বসাবার আয়োজন চলেছে। বাউরি নারীপুরুষেরা অনেকেই এসে হাত লাগিয়েছে সে কাজে। গ্রামের মানুষগুলির এই মূহুর্তে কোন কাজের চাপ নেই বর্ষার শুরু পর্যন্ত। শীতের মরশুমে যে সামান্য কিছু জমিতে মটর বা সর্ষের চাষ হয়েছিল সে ফসলও উঠে গিয়েছে অনেকদিন হলো। হাতে তাদের সময়ের অভাব নেই কোন। যারা গাইবে কিংবা সঙ্গত করবে তারা একে একে এসে জড়ো হচ্ছে অনন্তর উঠোনে। অনন্ত নিজে তাদের নিয়ে বড়োই ব্যস্ত। ঢোল, ধামসা, খঞ্জনী, কাঁসি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র এর ওর বাড়ি থেকে বের করে এনে সুরে চড়ানোর কাজ চলছে। উঠোন জুড়ে উৎসবের হাওয়া লেগেছে যেন।
দুপুর পার হতে না হতে গোটা গ্রামের লোকজন এসে জড়ো হল অনন্তর প্রশস্ত উঠোনে। উঠোনের মাঝখানে বসেছেন শিল্পীরা। তাঁদের ঘিরে চারপাশে গ্রামের মানুষ বসেছেন। তাঁদের সমবেত গুঞ্জনধ্বনি থেমে এলে পরে গান শুরু হল। অনন্তই ধরলেন প্রথমে। আসর বন্দনার গান-
বন্দিব গো গণপতি শিবেরই চরণ
তা পরে বন্দিব গো দশেরই চরণ
তা পরে বন্দিব গো প্রভু গো গেরামের চরণ--।
তীব্র, তীক্ষ্ণ অলংকারবহুল স্বর। শোভন অবাক হয়ে শুনছিল। কয়েকমাস আগে গঙ্গাবিধৌত বরেন্দ্রভূমির সীমান্ত অঞ্চলে শুনে আসা আলকাপ নামের সেই প্রাকৃত লোকসঙ্গীতের সঙ্গে প্রস্তরময় মালভূমির এই গানের সুরশরীরের আমূল পার্থক্য। তবু, শুরুতেই বন্দনার মূল আদর্শটি কিন্তু সেই একই রয়েছে। দশজনের পদমালা কন্ঠে ধরেছিলেন আলকাপের আসরবন্দনাকারী। সেই দশের চরণেই বন্দনা করে সংগীতবাসরের সূচনা হল ঝুমুর গানের এই বাউরি লোকশিল্পীর কন্ঠেও।
"কেমন করে হয়?"
"কেমন করি কী হয় গোঁসাই?"
শোভন সচকিত হয়ে ভুবনের দিকে তাকিয়ে একচিলতে হাসল। বলল, "না গো ভুবনদা! তাই ভাবছিলাম, কোথায় চুর্ণি আর কোথায় দামোদর। কোথায় আলকাপ আর কোথায় ঝুমুর। কিন্তু আসর যখন শুরু হল, তখন নদিয়ার বীণাপানি ছোকরা আর এই ডিগলির অনন্ত বাউরি দুই সুরে একই কথা কেমন করে বলে বলো দেখি! তাই মুখ দিয়ে ও কথাটা বেরিয়ে গেল।"
বৃদ্ধ কৌতুকভরা চোখে হাসলেন একবার। এ প্রশ্নের একটা উত্তর তাঁর কাছে আছে। পাঁচ শতাব্দী আগে এক মানবপুত্র এই দেশকে শিখিয়ে গিয়েছিলেন একটি মন্ত্র --
"তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা
অমানিনা মানদেন কীর্তনিয়া সদাহরি----"
সেই মন্ত্রের আত্মাটিই আজ এতকাল ধরে এ দেশের লোকসমাজের সমস্ত মরমী স্রষ্টা-শিল্পী-সাধকের চেতনায় ধীরে ধীরে প্রোথিত হয়ে গিয়েছে কতই বিচিত্র পথে। বিনয়ের বহিঃপ্রকাশের এই ঐক্য হয়তো বা তারই ফল।
তবে, সে তত্ত্বভাবনার সময় এ নয়। চটুল লঘু চালে একের পর এক গান উড়ে চলেছে তখন অনন্তর উঠোনে। শোভনের মন গিয়ে পড়েছে সেই সুরের স্রোতে। তার হাতের টেপরেকর্ডার নিঃশব্দে ধরে রাখছে সেইসব সুর ও কথাগুলিকে। বৃদ্ধের তত্বকন্টকিত মনটিও কখন যেন ঘুরে ফিরে ফিরে আসে গানের আসরেই। সেখানে তখন নকুল নামে এক ছোকরা বিচিত্র মুখভঙ্গী করে গান ধরেছে-
"পাতকুয়ো নাই বাড়ির কাছে
চাপাকল তো দূরে আছে
(সেথা) চান করতে গেলে ননদ
করে গালমন্দ
হেসে কথা কই বলে
মরদ করে সন্দ-----------"
রাধাকৃষ্ণের চিরন্তন প্রেমলীলার কাহিনী, নবরূপে, নতুন কালের অনুষঙ্গ নিয়ে ফিরে এসেছে তার গানে। যমুনা নদী ধরেছে চাপাকলের রূপ। তবু পরকিয়া রসের মূলতত্ত্বটি কিন্তু তাতে রয়ে গেছে অবিকল।
সারা দুপুর ধরে সুদর্শন, সত্যদাস, ঈশ্বর, সুদাম, ভক্ত, ফটিকরা পরপর গান গেয়ে চলল। কখনও মানভূমের, কখনও বাঁকুড়ার, কখনও বা পুরুলিয়ার ঝুমুর। শ্রোতা ও গায়ক, ভাতের মদের নেশা খানিক খানিক করেছে সকলেই। তারপর সন্ধ্যার মুখ মুখ পুরুষ গায়করা "টুকচু নিশা করিয়ে আসি গ" বলে সদলবলে পুরোন হয়ে আসা নেশাটিকে চাগিয়ে নিতে চলে গেলে আসরে এসে বসলেন অবগুন্ঠিতা মহিলারা। টুসু গাইবেন তাঁরা। অবগুন্ঠনের আড়াল থেকে একটি ক্লান্ত ও মধুর একক কন্ঠ সুর ধরল,
"হলুদ বনের টুসু তুমি হলুদ কেন মাখোনা?"
সঙ্গে সঙ্গে বাকি দলটির থেকে জেগে উঠল কোরাসে সুরেলা জবাব-
"শাশুড়ি ননদের ঘরে হলুদ মাখা সাজেনা।"
ফের প্রশ্ন আসে,
"ও টুসুর মা ও টুসুর মা তোদের কী কী তরকারি?"
এইবারে জবাব দেয় একটি একক কন্ঠ। মলিন স্বরে বলে,
"এই বাড়ির খেতের বেগুন
এই কানাচের গুগলি।"
তারপর হঠাৎই যেন প্রসঙ্গ পালটে অনুযোগের সুরে সে জানায়
"চিঠি পাঠাই ঘোড়া পাঠাই
জামাই তবু আসে না।"
জবাবে অদেখা জামাইয়ের উদ্দেশ্যে ফের জেগে ওঠে মিনতিভরা লোভ দেখানো কোরাস-
"জামাই আদর বড় আদর
তিনবেলা ভাই থাকো না।
আরও দু'দিন থাকো জামাই
খেতে দিব পাকা ধান
বসতে দিব শিতলপাটি
নীলমনিকে করব দান--।
কিন্তু ঠিক তার পর, সবেধন নীলমনি কন্যাটিকে দান করবার প্রতিজ্ঞার পরই ভেসে আসে একক কন্ঠে একটি সতেজ সাবধানবাণী,
"এক কিল সইলুম
দুই কিল সইলুম
তিন কিল বই আর সইবনা
আ লো ননদ বইলা দিবি
তোর ভাইয়ের ঘর করবো না।
আর এমনি করেই টুসু নামের আদরের দেবকন্যার চরিত্রটিকে অবলম্বন করে ডালপালা মেলে গ্রামীণ ঘরণী-কন্যা-মাতার হাজার সুখ দুঃখের কাহিনী। কখনও সে চপল কন্ঠে গায়,
"তোমার গালটা দেখি গন্ধ গন্ধ করে
তুমি মাখাছো নাকি লাক্স সাবান
আর মাইরো না অভাগীর পরাণ,
আবার পরক্ষণেই মাতৃকন্ঠে বেজে ওঠে এক প্রাকৃত বিজয়ার সুর,
"আমার টুসু ধনে
বিদায় দিব কেমনে
মাসাবধি টুসু ধনকে পুজ্যাছি যতনে
শাঁখা শাড়ি সিঁদুর দিলাম আলতা দিলাম চরণে
মনে দুঃখ হয় বড়ো ফির্যা যেতে ভবনে
দয়া কইরে আসবে আবার থাকে যেন মনে
ভুইল না ভুইল না টুসু আসবে আমার সনে।"
অথবা চটুল সখী টুসুকে দেখে সিনেমায় দেখা কোন আধুনিকার বেশে,
"টুসু আমার বাজার বেড়ায় পরিধানে নীল বসন
মিনি কাটিং ব্লাউজখানা বেশ মানাল হাল ফ্যাশান"-
গান ভাঙলো যখন, রাত তখন দুই প্রহরের মাঝামাঝি। আকাশে প্রতিপদের সামান্য ক্ষয়া চাঁদের জ্যোৎস্না ছিলো। অনুষ্ঠানক্লান্ত মানুষগুলি সেই আলো মেখে বাদ্যযন্ত্রগুলি নিয়ে একে একে ফিরে গেলে তাদের পিছু পিছু শোভনও এগিয়ে গিয়েছিলো খানিকটা পথ। ফিরে এসে দেখে ভুবনের সঙ্গে অনন্তর কথাবার্তা চলছে। মেলায় দুটি রাত গান গাইবার জন্য আসবে অনন্ত বাউরির দলটি। জনা পনেরো লোক হবে। টাকাপয়সা তারা নেবেনা কিছু। যাতায়াতের ভাড়াও লাগবে না। মধুকুণ্ডা স্টেশন থেকে ট্রেনে ট্রেনে বিনা ভাড়াতেই পৌঁছে যাবেন তাঁরা। হারি-বাউরির আবার ট্রেনের ভাড়া কি? জেলে ওঁদের কেউ কখনো পাঠাবে না। ওতে সরকারেরই লোকসান। মিনিমাগনার খোরপোশ দিতে হবে যে কদিন! এ দিগরে বিনি ভাড়ায় রেলের গাড়িতে চড়া মানুষদের তাই ধরা পড়লে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত দেয় রেলবাবুরা। বলতে বলতে চোখ টিপে হেসে উঠে অনন্ত বলে, "নামিয়ে দ্যায় তো দেবে! পরের গাড়িতে ফের উঠে চলে আসবো! সে আপনারা ভেবো না।"
তবে হ্যাঁ। দুবেলা পেটপুরে ভাত চাই দুটি আর নেশার দ্রব্যের পয়সা। ওটি না হলে গান জমবে কী করে?