• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৮ | মে ২০১১ | উপন্যাস
    Share
  • যাত্রী: দ্বিতীয় পর্ব (১) : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য


    "গোপন পিরীতি বড় জ্বালা হে
    ছিনিমাতে হিরো দেখে
    সোয়ামি ঘরে রেখে
    তোমারি সন্ধানে পথে
    বাহির হলাম কালা হে----"

    "সে কী গো জামাই? রসের নাগরি যে একেবারে উপচে পড়ছে দেখছি! তা, এত ফুর্তির কারণটা কী সেটা জানতে পাই?" দুখানা নিচু চৌকি জুড়ে মূলমঞ্চ তৈরি হয়েছে। তার চারপাশে চারটে বাঁশের খুঁটি পুঁতে তার মাথায় আলো লাগাবার তোড়জোড় চলছে তখন। বাঁশের গায়ে বাতি বাঁধতে বাঁধতে গুণগুণ করে গান ধরেছিলো সুষেণ। পেছন থেকে ডাক শুনে হাতের কাজ থামিয়ে ঘুরে তাকাল। আগন্তুক তার বিশেষ পরিচিত। বয়সেও কাছাকাছি। মাসকয়েকের ছোট বই বড় হবে না। যদিও গ্রামসম্পর্কে তার খুড়শ্বশুর হয়।

    কামলা তিনটেকে কাজ চালিয়ে যেতে ইশারা করে চৌকিতে গিয়ে বসে বিড়ি দেশলাই বের করল সুষেণ। তারপর অতিথিটির দিকে একটা বিড়ি বাড়িয়ে ধরে বলল, "রঙ্গরসের দিন তো ফুরিয়েই এলো রে কাকা! আর কয়েকটা বছর গেলে তখন আর লোকসমক্ষে এ গান গাইতে পারবো নাকি? ফোকলা মুখে হরিনাম কত্তে হবে বসে বসে। তাই সময় থাকতে যেটুক পারি-- "

    বিড়িতে শোঁ শোঁ করে গুটিকয় টান লাগিয়ে তুড়ি মেরে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে ভানু প্রসঙ্গ পালটালো, "তা, এতো সকাল সকাল কাজে লাগলা যে জামাই? গান শুরু হতে হতে তো সেই সন্ধে!"

    "ছোটবাবুর হুকুম রে ভাই! এ বাড়ির তালগতিক তো ভালোই জানো। মুখের কথাটি খসলো তা তার আর কাটান নাই। সক্কাল সক্কাল ঘুম থিকে উঠে খবর হল, বারোটার প্যাসেঞ্জার গাড়িতে নাকি তেনার কোন বন্ধু আসছেন, তা তেনার জন্য সন্ধেবেলা কাপ-এর পালা দিতে হবে। অমনি আমার ওপর হুকুম হয়ে গেল, কামলা জুটিয়ে সক্কাল সক্কাল আসর সাজিয়ে রেখে, তারপর গাড়ি নিয়ে ভদ্দরলোকের ছেলেকে আনতে যেতে হবে ইশটেশানে। মধুবাবু বলতে গিছিল, একবেলার নোটিশে কাপ-এর দল মিলবে কেমন করে, তা তাকে বলে, যা রেট তার দ্বিগুণ দেবো, মাংস-ভাত ফ্রি আর ভাল দল এনে আসর খুশ করতে পারলে তোমার বখশিশ মিলবে তিন শো টাকা। সেই শুনে মধুবাবু পড়িমড়ি করে স্বর্ণখালি ছুটেছে সাইকিল নিয়ে, হীরু মাস্টারের দলকে খবর দিতে।"

    "এই মনে পড়েছে এইবারে!" কথার মাঝপথেই হড়বড় করে উঠলো ভানু, "এই হিরুমাস্টারের ছুকরি বীণাপাণির গান ওটা, তাই না? গেলবার নিকুঞ্জহাটের আসরে 'অসতী বৌ'-এর কাপ-এ গানখানা যা গেয়েছিল---উঃ! তা সেই বীণাপাণির শ্রীমুখখানি স্মরণ করেই বুঝি রস উথলে উঠেছে জামাই?"

    "একরকম তাই বলতে পারিস। আচ্ছা তুই ই বল, এতকাল ধরে আলকাপ দেখছিস, কিন্তু বীণাপাণির তূল্য ছুকরি কখনো নজরে পড়েছে তোর? যেমন মেয়েমানুষের বাড়া রূপ, তেমন তার গানের গলা।"

    "আর তেমনই রূপের ঠ্যাকার!' পাদপুরণ করে ভানু, "না জামাই, অংখার একটু বেশিই বটে বীণাপাণির। ট্যাঁক গরম না থাকলে তার কাছে ঘেঁষে কার সাধ্য!"

    "ঘেঁষতে গিয়েছিলি নাকি?"

    ভানু মিটিমিটি হাসলো খানিক। তারপর বলে, "বলি শোন। সে এক কেচ্ছা। আজ ওবদি কাউকে খোলসা করে বলিনি। বীণেপাণিকে দেখে ইস্তক বহুদিনের সাধ কাছে গিয়ে দুটি কথা কই, একটু ফস্টিনষ্টি করি, কিন্তু সে জো থাকলে তো!
    "তা, নিকুঞ্জহাটের আসরে হীরুর দলকে থাকতে দিয়েছিল হাটের বটতলায় ম্যারাপ বেঁধে চটের ঘেরা বানিয়ে। দিনে দশবার সেখানে গিয়ে ঘুরঘুর করি, কোন লাভ হয় না। তক্কে তক্কে থেকে পুকুর হোক, হাট-বাজার হোক যেখানেই বীণাপাণি যায়, পিছু-পিছু ধাওয়া করি। তা সে ছোঁড়া দেখি মাগীপনায় গাঁয়ের বৌ ঝিরও এককাঠি ওপরে। সদাসর্বদা চলনদার সাথে নিয়ে বেরোবে। এগিয়ে গিয়ে কথাটি যে কইবো তারও জো রাখে না।
    "তিন রাত্তিরের বায়না হয়েছিল, তার দুরাত্তির তক কাবার হয়ে গেল এইভাবে। তখন, বুঝলে জামাই, মাথায় কী রকম যেন রোখ চেপে গেল। ঠিক করে নিলাম এইবারে এর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বো। তিনদিনের দিন ভর দুপ্পুরবেলা, হীরুর দল যখন সারারাত্তির কাপ দিয়ে সব ম্যারাপে ঢুকে ঘুমিয়েছে, সেই ফাঁকে ম্যারাপের পেছনদিকের কাপড় তুলে ভেতরে উঁকি মেরে দেখি ঢালা বিছানার একেবারে একপাশে হীরু মাস্টারের হাতে বালিশ করে শালী তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। অবিকল মেয়েমানুষ যেন একখানা, বুঝলে? গায়ে সেই রাত্তিরের শাড়ি-বেলাউজ, গালে-কপালে সিঁদুরে মাখামাখি, বুকে গোঁজা ন্যাতাকাণিগুলোও বের করে নি। উঁচু উঁচু হয়ে আছে মাইরি!
    "হীরু মাস্টার তো জানা কথাই একখানা গোটা বোতল চড়িয়ে ঘুমিয়েছে। বুকে ছুরি ভুকে দিলেও জাগবে না। তা ম্যারাপের পেছন দিক দিয়ে গিয়ে যেখানটায় বীণাপাণি শুয়ে ঠিক সেই জায়গাটার ঢাকা উঠিয়ে মুখটা সেঁধিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকলাম, 'বীণেপাণি, ও বীণেপাণি, একবার শোন না---'
    "ওমনি পট করে চোখ খুলেই হাত বাড়িয়ে বলে, 'ও নাগর, আগে দশটা টাকা ছাড়ো দেখি, তাহলে কথা কই।' হ্যাঃ। টাকা যেন আমার কপনিতে একেবারে ঝনঝন করছে!"
    "হে হে হে--"
    "হেসো না জামাই, হেসো না। বাগে যেদিন পাবো না, সেদিন---"

    সুষেণ ভানুর দিকে কৌতুকমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়িতে মৃদুমন্দ টান দেয় আর গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ে কেবল। খানিক বাদে সে বলল, "বীণেপাণি তো আসছেই। সেইসঙ্গে আরও একটা খবর দি তোকে। হীরুর দলের সঙে পাল্লা টানতে সুখবিলিয়ার মহসিনের দলকে খবর দিচ্ছে কর্তা। সে দলের ছুকরি বিন্দুও শুনেছি খাসা বস্তু। বীণেপাণির সঙ্গে সুবিধে করতে না পারলে ওদিকে একবার হাত মেরে দেখবার চেষ্টা করে দেখতে পারিস আজ রাতে। দেখবি নাকি?"

    মহসিনের নাম শুনেই কেমন একটু চুপসে যায় ভানু নামের যুবকটি। জলঙ্গী নদীর ধারে বাংলাদেশের একেবারে সীমান্তবর্তী এই ধরিত্রীপুর গ্রাম ও তার আশেপাশের আরো বহু গ্রামেই এককালে ওই নামটি যে কি ভীষণ ত্রাসের সঞ্চার করতো তা তার বাল্যস্মৃতিতে গাঁথা হয়ে আছে। এককালের কুখ্যাত সেই ডাকাত আজ তার পেশা বদলে আলকাপের দল খুলে বসেছে।

    নামডাকও হয়েছে কিছু কিছু ইদানিং। কিন্তু তবু, তার নামটি এখনও এ অঞ্চলে বহু মানুষেরই অস্বস্তির কারণ হয়। তার দলের ছুকরির সঙ্গে ফস্টিনস্টি করবার সাহস এ দিগরে খুব কম লোকেরই হবে।

    মাথা নাড়তে নাড়তে বিড়বিড় করছিল ভানু, "ছোটবাবুর ভিমরতি হয়েছে। নইলে সেধে এনে কেউ ডাকাত ঢোকায় বাড়িতে?"
    "বড়লোকের খেয়াল, বুঝলি কাকা? নইলে, এত উঁচু বংশ, সবকটা ভাই দেশেবিদেশে বড় বড় চাকরি করে, সে মানুষ কখনো নিজের ভদ্রাসনে আমাদের ছোটলোকের মিন্সেনাচানো গান ঢোকায়? অবশ্য ছোটকর্তার আর কি? বসন্তের কোকিল। শখ করে দুদিনের জন্য দেশের বাড়িতে ঘুরতে আসা বই গাঁ ঘরের সঙ্গে আর তো কোন যোগ নেই। বদনামের ভয় ওনার থাকবেই বা কেন? তাছাড়া, দুদিন বাদেই তো ফের হাওয়াই জাহাজে করে ফুড়ুত করে উড়ে ডাকাতই পড়ুক আর ভূমিকম্পই হোক, তাতে তেনার কী আসে যায়?"
    "তা বটে। কিন্তু, হঠাত ভীমরতিটা হল কেন বলো দেখি? সকালে আলো ফুটতে না ফুটতে তোমাদের সাধন দাস দেখি গ্রাম জুড়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেমন্তন্ন করছে। নাকি সন্ধেবেলা আলকাপের পালা হবে এ বাড়িতে। তা পালা নেই, পার্বণ নেই, অসময়ে আলটপকা আলকাপের পালা দেয় কেন সে খবর নিতেই তাড়াতাড়ি আসা। ব্যাপারখানা কী জামাই?"
    "আরে আরে সাবধানে রে বাবা! ওটা তোর গরুর খোঁটা নয় রে! গুঁতিয়ে জোড়বার বস্তু ও নয়। ইলেক্টিরিক বাল্ব। কাচের জিনিস। অমন গুঁতোলে একটাও যে আস্ত থাকবে না বাবা! দাঁড়া আসছি---" বলতে বলতে বিড়ির লেজটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে গেল সুষেণ। তারপর একটা কামলার হাত থেকে একটা বিজলি আলোর বাল্ব কেড়ে নিয়ে নিপুণ হাতে সেটাকে হোল্ডারের মুখে লাগিয়ে দিতে দিতেই ফের বলে, "বলেছে তো মুরলীপুর থেকে নাকি কোন কলেজের বন্ধু আসছে অনেককাল বাদে। সে আলকাপ শুনতে চেয়েছে। তাই অসময়ে বন্দোবস্ত করা। কিন্তু, বুঝলি ভানু, আমার ঠিক ও কথায় বিশ্বাস হয় না। কোথাকার কোন সাতকেলে পুরনো বন্ধু, তার জন্য কয়েক হাজার টাকা কেউ এভাবে ফুঁকে দেয় নাকি? ও ছোটবাবুর অন্য কোন ধান্দা আছে। পরের ইলেকশনের আগে দেশে ফিরে ভোটের টিকিট নেবে মনে হয়। তার জন্যে প্রথমে কাপ দিয়ে লোকের মন ভোলান শুরু করছে, তারপর সময়ে ধীরে ধীরে খাপ খুলবে।"
    "হতে পারে জামাই। খুবই সম্ভব," চোখদুটি চকচক করে ওঠে ভানুর। এই হতদরিদ্র গ্রামের অভাবী মানুষগুলি কোনমতেই, বন্ধুত্বের দাবিতে অর্থব্যয়ের মতো একটি যুক্তিহীন ব্যাপারকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারে না। জীবন তাদের বড় নির্মমভাবে শিখিয়েছে যে স্বার্থ ছাড়া কেউ কোন কাজ করতেই পারে না। সেটা প্রকৃতির রীতিবিরুদ্ধ।

    ভানুও ততক্ষণে উঠে এসে হাত লাগিয়েছে সুষেণের সঙ্গে। অনেকগুলি হাতের একত্র চেষ্টায় আসন্ন সন্ধ্যার আলকাপ গানের আসরটি সেজে উঠছিল ধীরে ধীরে। তাকে ঘিরে শীতের বেলা বেড়ে উঠছিল ক্রমশ। গ্রামের একেবারে একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এই ভূতপূর্ব জমিদারবাড়িটির প্রশস্ত প্রাঙ্গণের সামনে ছড়ানো বিস্তীর্ণ গোচর পার হয়ে ছুটে আসছিলো শীতমাখা হাওয়া।

    মাঠের অন্যদিকে কিছুদূর দিয়ে বহে যাওয়া জলঙ্গী নদীর জলের হালকা স্পর্শমাখানো সেই হাওয়ার ছোঁয়ায় শীতের প্রখর সূর্যালোকেই শরীরে কাঁপুনি জাগে। ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এই গ্রামটিতে আজ সন্ধ্যায় আলকাপের আসর বসবে। একবিংশ শতকের নগর ভারতবর্ষের কাছে মৃত ও অজ্ঞাত একটি শিল্পধারা, যা কিনা আজও ফল্গুধারার মতই অন্তঃসলিলা হয়ে বহে চলেছে নদীয়া-মুর্শিদাবাদ-রাজসাহী-কুষ্টিয়া হেন বৃহৎ বঙ্গের কোন কোন অঞ্চলের বুকে, আজ তারই একটি প্রদর্শনীর আয়োজন চলেছে এইখানে।

    -----------------------------

    দশজনের পদমালা কন্ঠে ধরি
    আসরবন্দনা করি হে--
    রাখলে রাখেন মারলে মারেন
    দশই আমার হরি হে---
    এ দশ না থাকিলে কাহার তরে
    বান্ধিতাম এ গান
    শুরুতে করিলাম তাই
    দশের চরণসন্ধান-----

    আসরবন্দনার শেষ শব্দটিকে উচ্চগ্রামের একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বরবিন্দুতে ধরে রেখে হীরুমাস্টার কোমর বাঁকিয়ে দর্শকাসনের দিকে জোড়হস্ত হলো। লোক ভালোই জমেছে আজ। প্রণামের লক্ষ্যবিন্দু হচ্ছে বাজনদারদের ঠিক পেছনে বসা এই বাড়ির ছোটবাবু ও তাঁর অতিথি বন্ধুটি। সুরেন মজা পাচ্ছিল খুব। ছোটবেলা থেকেই গ্রামছাড়া। বারাকপুরের মামাবাড়ি থেকে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক সেরে সুন্দরনগর ইউনিভার্সিটি। সেখানে পাঁচটা বছর কাটিয়ে একটা স্কলারশিপ পেয়ে কম্পারেটিভ লিটারেচার নিয়ে গবেষণা করতে গেল বিদেশে। আর ফেরেনি। ওখানেই ঘরসংসার। গ্রামের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসে বটে, তবে সেটা নিতান্তই অভ্যাসের বশে। এ দেশে কখনো সখনো এলে এক দুটো দিন ঘুরে যাওয়া কেবল। বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে শৈশবের যে একদা ঝাপসা স্মৃতিগুলো ক্রমশ স্পষ্টতর হয়ে উঠে নাড়ি ধরে টান দেয় সেইসব স্মৃতিখণ্ডের পীড়াতেই সম্ভবত তার এই ক্ষণিকের অতীত ভ্রমণ।

    "কী রে এন আর আই পার্টি? কী বলেছিলাম? ভাল লাগছে কি না?"

    সুরেন চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে শোভনের মুখোমুখি বসলো, "তোর জন্যই হলো, বুঝলি শোভন! ভাগ্যিস ফেসবুকে এসেছিলি!"
    "হ্যাঁ। টেকনোলজি অনেক সুবিধেই করে দিয়েছে আজকাল, বুঝলি? সবার সঙ্গেই সবার যোগাযোগ থাকছে।"
    "কিন্তু একটা কথা বল দেখি শোভন, আমার নিজের এলাকার লোকজন সব, আমিই তাদের খোঁজ পেলাম না কখনো, অথচ এইসব হীরুমাস্টার-টাস্টারদের খবর তুই এত রাখিস কী করে? দেশে আসছি শুনে মেল পাঠালি গান শুনতে আসবি, তারপর কোথায় কাকে পাবো, কী করতে হবে সব লিখে দিলি। আমায় তো কিছুই বিশেষ করতে হলো না।"

    শোভন হাসল, "কিছুই করতে হলো না মানে? উয্যুগ-আয়োজন সব করলি, আসর বসালি, এমন কি একটা জেনারেটর এনে বিজলির অবধি বন্দোবস্ত করে ফেলেছিস। তবে?"

    সুরেন্দ্র মাথা নেড়ে বললো, "ছাড় তো। ও তো দু একটা হুকুম-হাকামের ব্যাপার। কিন্তু আমার প্রশ্নটার জবাব দে দেখি, এতো খবর তুই রাখিস কোত্থেকে? ইন্টারনেট তো------"
    "উঁহু। এদের খবর ইন্টারনেটে বিশেষ থাকে না। খুঁজলে হয়তো ক্বচিত দু একটা লিংক পাওয়া যায়, তবে সে'সব বিশেষ কিছুই নয়। "
    "তবে?"
    "ফেসবুকে আমার প্রোফাইলটা একবার ভালো করে পড়ে দেখিস। বুঝতে পারবি সব। এই নিয়েই তো আছি রে! বছর পাঁচেক আগে হীরুর আসর দেখেছিলাম একবার ওপারে। রাজশাহীর একটা গ্রামে। ইম্প্রেসিভ লেগেছিলো।"
    "বাংলাদেশ------গিয়েছিলি নাকি?"
    "সে তো মাঝেমাঝেই যাই। মানে, তোদের মতো পাসপোর্ট ভিসার বিদেশভ্রমণ নয়। এখানে এপার-ওপার গানের আসরে এমন কতই মানুষের আনাগোনা চলে-- ওতে কেউ কিছু মনে করে না। হীরুর বাড়ি তোদের ধরিত্রীপুরের পাশেই স্বর্ণখালিতে, সে কথা জানতাম। তাই এবারে তুই যখন বললি বাড়ি আসছিস তখন ভাবলাম----"

    তার বাক্যের শেষ অংশটুকু ঢেকে যায়, গুরু গুরু মৃদঙ্গের বোলের সঙ্গে কোলাহলের পটভূমি থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো এক বৃন্দগীতির শব্দে। হীরু মাস্টারের আসরবন্দনায় গলা মিলিয়ে তার গোটা দল এবারে গাইছে--

    দশজনের পদমালা কন্ঠে ধরি
    আসরবন্দনা করি হে--
    রাখলে রাখেন মারলে মারেন
    দশই আমার হরি হে---
    হরি হরি-----

    হরিধ্বনির সুরটি আসরের কেন্দ্রবিন্দু থেকে উত্থিত হয়ে এক দশদিগন্তগামী তরঙ্গের মতই মুহূর্তে আচ্ছন্ন করে ফেলে গোটা আসরটিকে। গায়ক, দর্শক সকলের মুখেই প্রতিধ্বনিত হয় সেই চিরকালীন দ্ব্যক্ষর ধ্বনিটি। তারপর সেই কলরোলের মধ্যে থেকে জেগে ওঠে একটি ঈষৎ খসখসে কিন্তু তেজি তরুণ কন্ঠ--

    "হৃদয়মন্দিরে আবাহন করি তোকে মা
    জিহ্বা অগ্রে নিমন্ত্রণ
    লহ গো কমলাসন
    ধন্য হোক অসার জীবন"

    সহসা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে আসর। এই সূচনার গানটি বড় গুরুত্বপূর্ণ। আজকের আসরের মূলসুরটি বেঁধে দেবে এই গানটিই। উঠোনজোড়া শতরঞ্জিতে গাদাগাদি হয়ে বসা মানুষগুলি বড় বড় চোখ করে শোনে সেই সুর। আর তার পর কে হঠাৎ একটা বিরক্ত গলার শব্দ ভেসে আসে ভিড়ের ভেতর থেকে, "ধুস্‌! হীরু ওস্তাদ বাবুবাড়ি এসে ভদ্দরলোক হয়ে গেল যে। সন্ধেটাই মাটি---"

    তার কথা শেষ না হতেই উল্টোদিক থেকে জোরদার চিৎকার ভেসে এল একটা, "ওহে হীরু! রঙ লাগাও হে। কাপের আসর শুনতে এসে শেষে হরিকেত্তন শুনে বাড়ি যেতে হবে নাকি?”

    সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেকগুলি গলা জেগে ওঠে আসরের চারধার জুড়ে। দাবি সকলেরই এক। আজকের রাত্রে ধর্মময় সুশীলতা নয়, চাই রঙদার, মশলাদার, ঝাঁঝালো গ্রামীণ সঙ্গীত সমর।


    চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নেয় হীরু। অভিযোগটা খানিক সত্যি বটে। ধরিত্রীপুরের প্রাক্তন জমিদারবাড়ির নামডাক আছে এ চত্বরে। জমিদারি গেছে বটে, তবু এ বাড়ি এখনও এ দিগরে মরা হাতি সওয়া লাখ। হীরু জাতে হাঁড়ি। তার বাপ পিতামহ কোনদিন এবাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ানো দূরস্থান, এবাড়ির ত্রিসীমানায় ঢোকবার কথা ভাবতেও পারতো না।

    সেই বাড়ির নাটমন্দিরে গান গাইবার ডাক পেয়েছে সে আজ, তাও আবার খোদ বাড়ির এক কর্তার সামনে। সে মানুষের আবার নাকি বিলেতে ঘরবাড়ি। এরোপ্লেনে ফুড়ুত-ফাড়াত আসে যায়। এহেন আসরে সে একটু উচ্চমানের গানটান শোনাবার আশা নিয়েই এসেছিল আজ। কিন্তু তা বোধহয় হবার নয়। অতএব ফের জোড়হাত করে আসরের দিকে ফিরল সে, "তা শ্রোতাগণ, আলকাপে যেমনি খেউর আছে তেমন কবিগানও আছে। তাই ভেবিছিলাম, আজ মহামান্য কর্তামহাশয়ের সম্মানে খেউর খেমটায় আর যাব না। কিন্তু দশজনের পদমালা কন্ঠে ধরেছি। তেনাদের আজ্ঞাতেই বা হেলা করি কোন সাহসে? এখন গৃহকর্তার যদি অনুমতি হয় তবে খানিক রঙ্গরসই নাহয়---------''

    বলতে বলতে সুরেনদের দিকে ঘুরে তাকায় সে। নীরবে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি দিল সুরেন্দ্র। তার সেই ভঙ্গিটুকু খেয়াল করে তুমুল হর্ষধবনিতে ফেটে পড়ে আসর। আর সেই শব্দটিকেই যেন লুফে নিয়ে দ্রুততালে 'চালান' বেজে ওঠে হারমোনিয়ামে, করতালের ঝম ঝম শব্দ বদলে গিয়ে এইবারে দ্রুতলয়ে রিনি রিনি বোল উঠেছে। আর সেই তালে তালে মঞ্চের পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি বীণাপাণি। ঠোঁটে সস্তা লিপস্টিকের চড়া রঙ। মুখে ফেস পাউডারের হাল্কা মেক আপ। কপালে সিঁদুরের টিপ। সাপের মতো লম্বা বেণী দুলছে পেছনে। নাচের ভঙ্গিতে চারপাশে ঘুরে ঘুরে প্রণাম জানালো সে দর্শককে। অমনি একটা গর্জন উঠলো দর্শকদের মধ্যে থেকে। সেই সঙ্গে হাততালির চটপট শব্দ ও একেবারে পেছন দিক থেকে দু-একটি সিটির আওয়াজ। হারমোনিয়ামের দ্রুত তালের সঙ্গে বাঁশিতে ফুঁ পড়েছে তখন। তার সুরের মায়াতেই যেন বা, ক্রমে নিস্তব্ধ হয়ে আসে শব্দময় আসরটি। মৃদু রুমুঝুমু বোল ওঠে বীণাপাণির পায়ে বাঁধা তোড়ার থেকে।



    স্বল্পস্থায়ী দ্রুত লয়ের চালান বাজনা দ্রুত থেকে দ্রুততর লয়ে উঠতে উঠতে এক চূড়ান্ত গতিতে পৌঁছে সমকে স্পর্শ করতেই গান ধরল বীণাপাণি। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের প্রায় মুখে এসে দাঁড়ানো তরুণটির গলায় ফাটল ধরতে শুরু হয়েছে সবে। নারীসুলভ তীক্ষ্ণতাযুক্ত বালক কন্ঠটিতে তার একটু ঘষা খসখসে ভাবের আমেজ এসে মিশেছে। তাতে স্বরের আবেদন বেড়েছে বই কমেনি। দেহটি তার স্বভাবতই একটু কমনীয়। ডাঁটো, মসৃণ হাত পা, উজ্জ্বল ঝকঝকে কপিশ দু'টি চোখে কাজল ভাল মানায়। এখনো না-ভাঙা গালে হাসলে টোল পড়ে।

    শুরুতেই অনেকটা চড়ায় ধরেছে বীণাপাণি। হীরুমাস্টার হার্মোনিয়ামে বসে সকলের অলক্ষ্যে মাথা নাড়ে একবার। এতটা চড়ায় সাধারণত ধরবার কথা নয়। তাহলে সঞ্চারী পেরিয়ে আভোগে গিয়ে শেষ করতে সমস্যা হতে পারে। তবে উপস্থিত সঙ্গে চলা ছাড়া উপায় নেই। দুষ্টুমিভরা হাসি মুখে রেখে বীণাপাণি গান ধরেছে-

    আমার ভাঙা দালানে
    ইঁট সুরকি ভেঙে নিয়ে গেলে কেমনে
    দেয়াল জোড়া ফাটা ভাঙা
    লাজে আমার মুখটা রাঙা
    ভাশুর শ্বশুর ঘরে ফেরে
    আমি ঘুমাই কেমনে
    নাগর
    ঘুমাই কেমনে।
    মঞ্চের কাঠের পাটাতনে ধপধপ শব্দ ওঠে। ঘুরে ঘুরে অঙ্গভঙ্গি করে নাচছে বীণাপাণি। কৃত্রিম লজ্জার ভঙ্গিতে প্রশ্নটি বার বার ছুঁড়ে দেয় সে দর্শকের দিকে। হঠাত করতাল ছেড়ে লাফ দিয়ে স্টেজের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল বৃদ্ধ পঞ্চানন। বীণাপাণির থুতনি ধরে নাড়া দিয়ে বলে,"কেন গো সুন্দরী? অঙ্গের বসন খুলি দেয়াল ঢাকলিই পারো। ঘরে নাগর থাকলে কাপড়ে কী কাজ?"

    দর্শকাসনে হো হো রব ওঠে একযোগে। আসর জমে গেছে এইবারে। বীণাপাণির গানের শেষ লাইনটি ধরে নিয়ে কোরাসে ধুয়া ধরেছে বাজনদারর দল। সরু মোটা নানান গলায় একসঙ্গে দ্রুত থেকে দ্রুততর চালে ঘোরে ফেরে তার প্রশ্নটি - ঘুমাই কেমনে.... নাগর ঘুমাই কেমনে---

    আড়চোখে সুরেন্দ্রর মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখলো শোভন। মুখটা লাল হয়ে উঠেছে তার। শোভন মজা পাচ্ছিল। চিরকালের সুবোধ ছেলে এই সুরেন্দ্র। ভালো ছেলে বলে ইউনিভার্সিটিতেও নামডাক ছিল বেশ। উঁচু তারে বাঁধা রুচি। এই প্রাকৃত সঙ্গীতমালা তার সেই রুচির সঙ্গে একটা সংঘাত তৈরি করছে। তার হাতে মৃদু চাপ দিল সে। তারপর গলা নামিয়ে বলল, "অস্বস্তি হচ্ছে সুরেন, তাই না? অশ্লীল ঠেকছে?"

    সুরেন্দ্র একটা ঢোঁক গিলে বলল, "না-মানে--এটা একটু--"
    "বাঙলার ফোকসং বলতে তোর যে পার্সেপশানটা আছে তার চৌহদ্দির বাইরের গান, তাই বলবি তো? আসলে বাঙলার ফোকসং বলতে আজকাল একটা বিচিত্র ধারণা তৈরি হয়েছে শিক্ষিত বাঙালির মনে। শুধুই বাউল কিংবা কীর্তন বা ছৌ অথবা কিছু নির্বাচিত লোকগীতি। একটা বিশাল সংগীত সংস্কৃতির অধিকাংশটাকে ছেঁটে ফেলে, নিজেদের বোধবুদ্ধি আর ভ্যালু সিস্টেমের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো কিছু নির্বাচিত সংগীত ধারার পৃষ্টপোষকতা করা। অথচ সেই চারপাঁচটা ধারার লোকগানের বাইরে যে আরও অজস্র শ্রেণীর গান গ্রাম বাংলার চেতনায় গেঁথে রয়েছে তার কথা তোদের জানার দরকার নেই?''
    "কেন জানতে চাইব শোভন? রুচির একটা প্রশ্ন থাকে তো?"
    "রুচি? কার রুচি? সংস্কৃতির একটা একক সংজ্ঞা তৈরি করে দেবার অধিকারটা কার হাতে? আসরের লোকগুলোর মুখের দিকে চেয়ে দেখ। ওরা এ গান ভালোবাসে। আবার এই লোকগুলোই কিন্তু পদাবলী কীর্তনের আসরে গিয়ে হরিবোল দেয়, কেঁদে ভাসায়। কেমন করে এই দ্বৈতসংজ্ঞা নিয়ে টিঁকে আছে ওরা সেটা বোঝবার প্রয়োজন নেই বলছিস? ওটা বুঝতে পারলে তবেই একটা সুবিশাল জনগোষ্ঠীর সত্যিকারের পরিচয় পাওয়া যাবে সুরেন্দ্র। নইলে নয়।"

    সুরেন্দ্র মৃদু হেসে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, "তুই বুঝেছিস? তাহলে আমায় বোঝা। একটা ইয়ং ছেলে, শাড়ি পরে মেয়ে সেজে নেচে নেচে গান গাইছে, আর কয়েকশো লোক তাই দেখে মজে আছে, এটাকেই তাহলে তুই বলতে চাইছিস আমাদের নিজস্ব গ্রামীণ সংস্কৃতি? ধুত!"
    "উঁহু। তুই আমার কথাটা বোধহয় বুঝতে পারছিস না সুরেন। তা আমি বলতে চাইনি। আসলে লোকসংস্কৃতি একটা বিশাল ক্যানভাস। তাতে অনেক রঙের সুতোর নকশা আঁকা। বেছে বেছে শুধু নিজের পছন্দের ফোঁড়গুলোকে দেখতে চাইলে গোটা নকশাটা ধরা পড়বে না চোখে। ভালো, মন্দ, আলো, কালো সবগুলো ফোঁড়কে এক জায়গায় করে একসঙ্গে দেখলে তবেই গোটা ডিজ়াইনটা চোখের সামনে পরিষ্কার ভাবে ধরা পড়বে। আমি সেই কাজটাই করে চলেছি। তবে সে কথা এখন থাক। এখন আয় পালাটা সবটা ভালো করে দেখা যাক। ছোকরার গান তো শেষ হয়ে এল।"


    * * * *

    রাত্রি বেড়ে চলে। হীরুমাস্টার নৌকাবিলাসের পালা ধরেছে আজ। রাধাকৃষ্ণের চিরায়ত নৌকাবিলাস পালাটিকে পশ্চাতপটে রেখে তার ওপরে আধুনিক গ্রামজীবনের ছবিটি ফেলেছে। সম্ভবত স্থানীয় কোন গ্রামীণ কুৎসার কাহিনিও এই পালার বীজ হিসেবে কাজ করছে। নদীপথে একলা শ্বশুরবাড়ি যাবার পথে নায়িকা নৌকা চালকের প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছে--কাহিনিসূত্র কেবল এইটুকুই।

    নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করছে বীণাপাণি আর রসিক নৌকাচালকের চরিত্রে হীরুমাস্টার নিজে। সুতীক্ষ্ণ ও রসালো সংলাপের ঠোকাঠুকিতে সমানে সমানে পাল্লা দিচ্ছে দুজনেই। মাঝে মাঝে গদ্যসংলাপ গলে মিশে গান হয়ে উঠছে। তারপর ফের ফিরে আসছে সংলাপনির্ভর অভিনয়। মাঝে মাঝে নায়িকার আত্মীয়স্বজনের ব্যাপারে কিছু সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত কিংবা নায়কনায়িকার চেহারার কিছু কিছু বিশিষ্টতার বিবরণ শুনে দর্শক আসন থেকে যে বিপুল সাড়া উঠছে তাতে বুঝতে বাকি থাকে না যে চরিত্র কিংবা বর্ণিত ঘটনা --এগুলি মোটেই কাল্পনিক নয়, বরং দর্শকদের কাছে বিশেষ পরিচিত তারা।

    উঠোনের দক্ষিণ ধারে মূল বাড়ির দোতলায় সুরেন্দ্রর শোবার ঘরের জানালার পাশে মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসেছিল দুই বন্ধু। এখান থেকে নিচের আসরটি পরিষ্কার দেখা যায়। সেদিক থেকে চোখ না সরিয়েই শোভন বললো, "আরো দেখবি, নাকি শুবি এবারে?"

    সুরেন্দ্র বলল, "সিডেটিভটা নিলাম সবে। এফেক্ট হতে হতে আরো ঘন্টাখানেক লাগবে। ততক্ষণ দেখে নিই আর একটু। তবে নীচে আর যাচ্ছিনা। এখান থেকেই দেখবো। তোর ঘুম পাচ্ছে? পাশের ঘরে তোর বিছানা টিছানা করাই আছে।"

    শোভন একটু অপ্রস্তুত গলায় বললো, " না, আমি তো আসরে রাত জাগবো বলেই এসেছি। তোর জন্যই বলছিলাম। রিসেন্টলি এতবড় একটা এটাক হয়ে গেছে তোর সেটা তুই আগে বললে--"
    "তুই আসতিই না, তাই তো? সেইজন্যেই তো বলিনি।"
    "কিন্তু বাধালি কেমন করে? সুন্দরনগরেও তো দেখেছি রেগুলার খেলতিস টেলতিস। ভালো স্বাস্থ্য ছিল--"

    ম্লান হেসে সুরেন্দ্র বললো, "ওসব খেলাটেলা সব গেছে এখন। বিদেশী ইউনিভার্সিটি তো, কাজের চাপ প্রচণ্ড বেশি। নিজের রিসার্চের পাশাপাশি রিসার্চ ফেলোদের নিয়েও অনেক সময় দিতে হয়। তাছাড়া রিসেন্টলি একটা ছোট ট্রান্সলেশান ফার্ম খুলেছি। তার প্রেশারও আছে।
    "অবশ্য ইউনিভার্সিটি কাজ যেমন করিয়ে নেয় তেমন কম্পেনসেটও করে। যেমন ধর, হার্ট এটাকটা যখন হলো তখন ওদেশের সেরা হাসপাতালে রেখে গোটা ট্রিটমেন্টটা করিয়েছে। যা অবস্থা হয়েছিলো বুঝলি, এ দেশে থাকলে বাঁচতাম না। কি যে দুর্দান্ত ইনফ্রাস্ট্রাকচার ওদেশের হাসপাতালগুলোতে, ভাবা যায় না। তবে, প্রাণে বেঁচে গেলেও, ডাক্তার কতগুলো রেস্ট্রিকশানও দিয়ে দিয়েছে। সেগুলো মোটামুটি সারাজীবনের সঙ্গী আমার। ঠিক সময়ে মেডিসিনটা নেয়া, একেবারে রাত না জাগা-- সবসময় মেনটেন করা যায় না।"

    শোভন একটু অস্বস্তিভরা গলায় বললো, "তুই বরং শুয়ে পড় এবারে সুরেন। আমি নিচে গিয়ে--"
    "উঁহু। তুই এখানেই বোস। খুব রিল্যাক্সড ফিল করছি তোর সঙ্গে কথা বলে। যতক্ষণ ঘুম না আসে অন্তত ততক্ষণ আমায় একটু কম্পানি দে!"

    খানিক চুপচাপ থাকবার পর কি মনে হতে শোভন হঠাৎ প্রশ্ন করলো, "আছা সুরেন, ইউনিভার্সিটিতে তোদের ইংরিজি ডিপার্টমেন্টের অতীন-গার্গীর সঙ্গে তোর কনট্যাক্ট আছে?"

    "উঁহু। বছর পাঁচ আগে অবধি ছিল। মেল করতো মাঝে মাঝে। বিয়ের কার্ডও পাঠিয়েছিলো স্ক্যান করে। তারপর একেবারে ভ্যানিশ। তুই কিছু জানিস?"

    "জানতাম না, তবে রিসেন্টলি ওদের খবর পেলাম আবার। ইনকাম ট্যাক্সের একটা বড়োসড়ো রেইড হয়েছিল মাস দুই আগে কলকাতায়। তুই তখন বাইরে। কাগজে রেইডটার খবর বের হচ্ছিল রোজ বড়ো বড়ো করে। তাতেই একদিন দেখি গার্গী-অতীনের ছবি। রেভেন্যু সার্ভিসের বড়ো অফিসার হয়েছে দুজনেই। রেইডগুলোও ওদেরই করা। খবরে পড়লাম এতদিন চেন্নাইতে ছিল। মাসকয়েক আগে কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছে দুজনে। এসেই হইচই বাধিয়ে দিয়েছে একেবারে।"
    "বলিস কী রে? স্ক্যামের বাজারে এ তো সরকারি সুপারস্টার হয়ে গেল। বেশ গর্ব হচ্ছে , জানিস? আমাদের অতীন-গার্গী! গাছতলায় বসে পুস্তকপ্রেম করতো। তারা আজ বড়ো অফিসার হয়ে চোরডাকাত ধরছে, ভাব? ওদের কন্ট্যাক্ট নম্বরটম্বর আছে কিছু?"
    "নাঃ। আমি আর কোন খোঁজখবর নিইনি। কোন আর্জ ফিল করিনি, বুঝলি? যে যার বৃত্তে কাজ করছি, সবার সঙ্গে সবার তো মেলে না। শুধু শুধু লোকজনকে পুরোন পরিচয়ের দাবি নিয়ে গিয়ে ব্যস্ত করা, নিজেও উদব্যস্ত হওয়া--ভালো লাগে না।"
    "তা আমার সঙ্গে যোগাযোগটা করলি যে বড়ো? আমিও তো অন্য বৃত্তে ঘুরছি। অন্য সমাজে বিলং করছি। এমনকি, ইউনিভার্সিটিতে মুখচেনা বন্ধু হলেও তোর ইনার সার্কেলে কোনদিন তো ছিলাম না! তাহলে?"
    "সত্যি কথা বলবো, না বানিয়ে বানিয়ে বলবো?"
    "দ্যাখ শোভন, এতোগুলো বছর একসঙ্গে এক ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। খানিকটা তো চিনেছি তোকে? বানিয়ে বলার অভ্যাসটা তুই রপ্ত করে ফেলেছিস এ কথা আমাকে মানতে বলবি তুই?"

    শোভন হাসলো, "নাঃ, পারিনি। বানিয়ে বললে নির্ঘাত ধরা পড়ে যাবো।"
    "তাহলে সত্যি কারণটাই বল।"

    শোভন খানিকক্ষণ চুপাচাপ থেকে বললো, "ফেসবুকে তোর প্রোফাইলটা দেখবার পর নেট খুঁজে তোর দুচারটে কাজ পড়েছিলাম। বিশেষ করে ওই 'কম্পারেটিভ এনালিসিস অব ইমেজারি ইন সিক্সটিনথ সেঞ্চুরি ইংলিশ ব্যালাডস য়্যাণ্ড সুফি সংস' প্রবন্ধটা। অসাধারণ। তারপরেই যোগাযোগটা করলাম।"
    "অর্থাত ক্রুডলি বললে আমার কাজ দেখে আমায় যোগাযোগ করবার যোগ্য মনে হয়েছে তোর।"
    "না সুরেন, ব্যাপারটা ঠিক সে'রকম নয়। আমি, মানে--"
    "কথা এড়াচ্ছিস? আচ্ছা, একটা কথা বল তো? তোদের ডিপার্টমেন্টের সেই সমাদৃতা ছিল না? তার সঙ্গে তোর কোন যোগাযোগ---" "ও কথা থাক সুরেন। তোর ওষুধ খাবার পর অনেকটা সময় কেটে গেছে কিন্তু। ঘুমোবি তো এবার?"
    "উঁহু, কথা এড়াবার চেষ্টা করবি না শোভন। যোগাযোগ আছে, নাকি তাকেও যোগাযোগ রাখবার যোগ্য বলে মনে হয়নি তোর?"

    কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর মাথা নাড়ল শোভন, "না। শুধু মাদ্রি কেন, ইউনিভার্সিটির কারো সাথেই এখন কোন যোগাযোগ আমার নেই রে। তবে হ্যাঁ, বছরকয়েক আগে একবার খবর পেয়েছিলাম মাদ্রি আর উত্তম বিয়ে করেছে। দুজন মিলে ডাবলু বি সি এস-এ আছে। ভালো আছে নিশ্চয়।"
    "তুই একটা বিচিত্র জীব শোভন। খ্যাপাটে ছিলি চিরটাকালই সেটা তো জানি। কিন্তু তাই বলে এইভাবে নিজের কেরিয়ার ছেড়ে, সবার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে হিন্টারল্যাণ্ডে পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হচ্ছিস, এ তো পুরোদস্তুর পাগলামো! ইটস আ ওয়েস্টেজ। তোর মতো ছেলে--"

    শোভন সুরেন্দ্রর চোখের দিকে চোখ তুলে হেসে বললো, "তুই আমায় ভুল বুঝছিস সুরেন। একা একা পাগলামো করে নিজেকে নষ্ট করছি না আমি। আমি একটা ইন্টারেস্টিং কাজ--বা বলতে পারিস খেলা--তাই নিয়ে ডুবে আছি। বাংলার উত্তর-দক্ষিণ-পূব পশ্চিমে এতো হাজারো গান, এতো ভ্যারাইটি-- তার কটারই বা খবর রাখে বল মেনস্ট্রিম সংস্কৃতি? তাদের মধ্যে বহু ভ্যারাইটিই হারিয়ে গেছে বা যেতে বসেছে। আমি এদের আর্কাইভিং আর ক্যাটালগিং-এর কাজটা করছি ঘুরে ঘুরে। যাতে হারিয়ে গেলেও তার কিছু স্যাম্পল টিঁকে থাকে। এক জীবনে এ কাজ শেষ হবার নয়। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো কাজটা শুরু করতে হবে, বল? উত্তরাধিকারসূত্রে আমার রক্তে রয়েছে লোকগান। আমি তাই এ কাজটার জন্য ভলান্টিয়ার করেছি।
    "তাছাড়া, বাড়িতে একটা পাঠশালা মতো করেছি। বাচ্চা ছেলেপুলেদের তুলে এনে পড়াই সেখানে। একটা ননকনভেনশনাল এডুকেশন মডেল নিয়ে কাজ করছি। এইসব নিয়েই চলে যাচ্ছে, বুঝলি? যারা জীবনের অন্য বৃত্তে ঘুরছে, তাদের সঙ্গে জোর করে আর যোগাযোগ রাখবার কোন চাড় অনুভব করি না। শুধু শুধু সময় নষ্ট। তবে ফেসবুকে তোর প্রোফাইলটা দেখে মনে হয়েছিলো তুই হয়তো ইন্টারেস্টেড হবি। গ্রাউণ্ডিংটা আছে তোর। তাই যোগাযোগ করলাম।"
    "মানে একেবারে পুরোদস্তুর ভবঘুরে। আয়াম ফিলিং জেলাস। মাঝে মাঝে আমিও ভাবিন, বুঝলি--জাস্ট কিক দ্য জব য়্যাণ্ড হিট দা রোড--গোটা সেন্ট্রাল এশিয়া জুড়ে কত ছোট ছোট পকেটস এখনো রয়েছে জানিস, যেখানে মিরিয়াডস অব ভ্যারাইটিজ অব সুফি সংস স্টিল এগজিস্ট ইন দেয়ার পিওরেস্ট ফর্ম--আঃ, যদি--"

    শোভন হাসল, "এক জীবনে সবার সবকিছু হয় না সুরেন। আমিই কি আর সবটা প্যানারোমাকে ধরতে পারবো? তবে হ্যাঁ। একটা নতুন এফর্ট নিচ্ছি, বুঝলি," বলতে বলতে হঠাৎ জ্বলজ্বল করে ওঠে যুবকটির চোখ। ভেতরে ভেতরে জমে ওঠা সুতীব্র আবেগের অভিঘাতে গলায় কাঁপুনি লাগে তার--"ভেবে দেখ সুরেন, এই এলাকার বাউল, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, আলকাপ, পঞ্চরস, কীর্তন, সারি, জারি, পুতুলনাচের গান, মালভূমিতে গেলে পাবি টুসু, ভাদু, ঝুমুর, গাজন, খেমটা, উত্তরে শিরালি, নাটুয়া, গৌরিপুরিয়া, ভাওয়াইয়া, চটকা--দু হাতের কড়ে কুলোবে না, এত ভ্যারাইটি। তাদের সকলের দর্শন, চাল, ভাষা,সামাজিক প্রেক্ষিত, সব আলাদা আলাদা, অথচ ভেতরে খুঁড়ে দেখ, কয়েকটা বেসিক প্যারামিটার কিন্তু এক। এই যে মিলগুলো, এগুলোই এদের একটা কমন চরিত্র দেয়-- তাকে বলতে পারিস বাঙালি চরিত্র। আমি এদের এখন একটা কমন প্ল্যাটফর্মে আনতে চাইছি বুঝলি! একটা মেলা। তাতে গোটা পনেরো মঞ্চ হবে। তিনচারদিনের উৎসব। তাতে বাংলার ফোকসঙের যতরকম ভ্যারাইটি আছে তার শিল্পীরা আসবেন, একত্রে গাইবেন, একে অন্যের গান শুনবেন, মানুষ জানবে, বুঝলি সুরেন---সুরেন--- এই--"

    বলতে বলতে হঠাৎ-ই গলার স্বর নিচু হয়ে আসে যুবকটির। বিপরীতমুখী সোফাটিতে বসা তার বন্ধুটির মাথা নেমে এসেছে বুকের কাছে। নিঃশ্বাস কখন যেন ঘন হয়ে এসেছে। কথা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো শোভন। সুরেন্দ্রর গা থেকে খসে পড়া চাদরটি ফের তার গায়ে ভালো করে জড়িয়ে দিয়ে, ঘরের আলোটি নিভিয়ে দিয়ে পা টিপে টিপে বের হয়ে গেল ঘরের থেকে।


    --------------------------------

    "ঝাঁকসু ওস্তাদের নাম জানা আছে বাবা? আলকাপের জন্মদাতা স্বয়ং বোনা কানার উপযুক্ত চ্যালা ছিলেন তিনি। সেই তেনার কাছে আমার নাড়া বাঁধা। মায়া যে কাকে বলে তা তিনি যেমনটি বুঝতেন--আ-হা-হা--আমরা তো তেনার নখের যুগ্যিও নই বাবা! সাক্ষাত মহাপুরুষ ছিলেন--"

    কথা বলতে বলতে হীরুমাস্টারের চোখের কোণদুটি চিকচিক করে ওঠে বুঝি। কাল রাত্রের মঞ্চের সেই প্রচণ্ড পুরুষ, সকালের প্রথম আলোয় তাঁর আসরের খোলশ ছেড়ে বেরিয়ে এসে নিতান্তই এক সাধারণ বৃদ্ধ। ভোর হয়ে এসেছে। শীত আটকাবার জন্য মাথার ওপর ছড়িয়ে দেয়া চটের ছাউনি ভেদ করে কুয়াশামাখা সূর্যের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়ছে আসরের এখানে ওখানে। এখনো ঘন্টাখানেক বাকি আছে আসরের আয়ু। ক্লান্ত রাতজাগা আসরকে জাগিয়ে রাখবার আপ্রাণ চেষ্টায় মঞ্চের ওপর ব্যস্ত মহসিনের দলটি। কাল হীরুমাস্টারের পালা শেষ হবার পর রাত আড়াইটে নাগাদ স্টেজ পেয়েছে মহসিন। জুবেদা বেগমের কাপ ধরেছে তার দল। পুরনো পালা। এক বাদশার অর্ধেক আয়ু নিয়ে মৃত জুবেদা বেগমের বেঁচে ওঠবার অমর প্রেমকাহিনি। পয়গম্বর সেজে মহসিন ডায়ালগ দিচ্ছিল, "জাগো বাদশাহ, দুনিয়ার মালিক। তোমাদের প্রণয়ে আল্লাহ তৃপ্ত হইয়াছেন। আপন অর্ধেক আয়ু দান দিয়া প্রাণ দাও জুবেদা বিবিরে------"

    সঙ্গে সঙ্গে সপাটে তান ধরেছে হারমোনিয়ামে। করতাল বাজছে ঝমর-ঝম--

    --সেইদিকে খানিক ফিরে তাকিয়ে থেকে নিজের উদগত আবেগটিকে সম্বরণ করে নিয়ে ফের কথার সুতোটা তুলে নিলেন হীরুমাস্টার, "শুনলাম আপনার খাতিরেই নাকি আজকার এই পালার উয্যুগ। তা, বাবু কি খবরের কাগজে লেখেন-টেখেন--"
    "না মাস্টারমশাই," হাসলো শোভন, "সে'সব কিছু নয়। আমার বাবা হরকান্ত মণ্ডল পদকর্তা ছিলেন। তা ছোটবেলা থেকে আমারও গানের নেশা--"
    "হরকান্ত মণ্ডল---দাঁড়াও দাঁড়াও বাবা। মুরলিপুরের হরকান্ত মণ্ডল নাকি?"
    "আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার বাড়ি মুরলিপুর।"
    "তিনি তো মহাগুণি লোক ছিলেন গো! ওই যে--

    নদীরো গহিন জল
    খুঁজি না মিলে গো তল
    তারই মইধ্যে গুপ্ত রহে
    মৃত্তিকারো প্রাণ
    যে গুরু তা জানতি পারে
    বর্ণ দেখি ধরে তারে
    সে গুরুর করহ সন্ধান--
    এ তো সেই হরকান্ত বাবাজির পদ! মহাজন মানুষ ছিলেন। তেনার ছেলে আপনি? কী ভাগ্য আমার--" বলতে বলতেই উত্তেজিত হয়ে বৃদ্ধ হাঁক পাড়েন, "বীণা, ও বীণেপাণি। ইদিকে আসো। দেখো কে এসেছেন--"

    খানিক বাদে, বৃদ্ধের উত্তেজনার প্রশমন হলে শোভন বলল, "মাস্টারমশাই, বছরকয়েক আগে ওপারের এক মেলায় আপনার গান শুনেছিলাম। আসরের একেবারে শেষের দিকে গিয়ে পৌঁছেছিলাম। তাই পুরোটা শুনতে পাই নাই। তবে যেটুক শুনেছিলাম, বড় ভালো লেগেছিল। সেই থেকে শখ ছিল একদিন আপনার গোটা একটা পালা শুনবো। আজ এতদিনে সে শখ পুরলো আমার। বড় ভালো কাপ দিয়েছেন গো।"



    হীরুমাস্টার একটু লজ্জা পেলেন যেন। বলেন, "না বাবা। ভালো আর কুথায়? আপনি মহাজনের ঘরের ছেলে বাবা, অতবড় পদকর্তার সন্তান। সেই আপনার সামনে ভাবের কথার বদলে খেউর গেয়ে গেলাম শুধু। আলোর বদলে শুধুই কালোর গান। কী করি, আসরের যেমন মর্জি।"

    শোভন হাসলো, "না মাস্টারমশাই। এ কাপেরও প্রয়োজন আছে। আলো কালো দুয়েরই তো প্রয়োজন ভুবনে, কী বলেন? কালো আছে বলেই না আলোর মর্ম বোঝে লোকে? আলোয় চৈতন্যপুরুষ জাগ্রত থাকেন। তাঁর নিদ্রার জন্যই অন্ধকারের সৃষ্টি। নিদ্রারও তো প্রয়োজন আছে গো!"

    খানিকক্ষণ স্থির হয়ে যুবকটির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বৃদ্ধ বললেন, "এ তো একেবারে নতুন কথা শোনালে বাবা। চৈতন্যের ক্লান্তিহরণের জন্য নিদ্রার প্রয়োজন, আর সেই নিদ্রার জন্য অন্ধকারের প্রয়োজন। বা বা বা-- এ আমার গানে বসাবো আমি। আর তেমন সুযোগ যদি কখনো পাই তাহলে এ ভাব নিয়ে নতুন পালা বেঁধে শোনাবো আপনারে।"
    "কিন্তু সে পালা কি আর আলকাপ থাকবে মাস্টারমশাই? সে তো দর্শনের তত্ত্বকথা হয়ে যাবে?"
    "থাকবে থাকবে," ক্লান্ত চোখদুটিতে হাসি মিটমিট করে হীরুমাস্টারের, " কাপ মানে যে কেবল রঙ্গরস তা নয় গো বাবা। ও অনেক বৃহত ব্যাপার। সর্বতত্ত্বের আধার যে!"
    "বেশ। তাহলে পরের বছরের কার্তিক পুর্ণিমায় আপনার সেই নতুন কাপ শুনবো মাস্টারমশাই। তবে সেবারে আমি আসবো না। আপনাকে যেতে হবে পালা শোনাতে।"
    "কোথা?"
    "মুরলিপুর। সেখানে, ইচ্ছে আছে একটা গানের মেলা দেবো। বেশ কয়েকটা মঞ্চ হবে। তাতে--"

    ধীরে ধীরে বৃদ্ধ মানুষটির কাছে নিজের স্বপ্নটি উজাড় করে মেলে ধরে যুবকটি। সেই নিয়ে তার যত আশা, যত ভাবনা, কোনকিছুই বাদ থাকে না। অবশেষে তার কথা শেষ হলে বৃদ্ধ তার হাতদুটি জড়িয়ে ধরে বললেন, "বড়োমানুষের উপযুক্ত কাজে নামছো বাবাজি। অর্থের সংস্থান নাই বলছো, সে তোমায় ওপরওলা জুটায়ে দেবেন ঠিক। আর মাসখানেক আগে শুদু খবর দিও একখান। স্বরণখালির দল ত যাবেই। পারলে আরও দুচারটা আলকাপ আর পঞ্চরসের দল জুটায়ে নিয়ে যাবো'খন। কড়ি তোমায় গুণতি হবে না বাবা। মেলা থেকে প্যালা তুলে খরচ তুলি নেবো আমরা। উল্টে তোমার ফাণ্ডে কিছু দিয়ে আসবো দেখো।"


    ।। ২ ।।


    শ্রীচরণেষু শোভন দা,

    ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরেই সবার আগে আপনাকে চিঠি লিখতে বসেছি। খবর আছে। আজ রেজাল্ট পেলাম। টেনেমুনে সেভেনটি ফোর পার্সেন্ট হয়েছে। ডিপার্টমেন্টে আপনার রেকর্ড আনব্রোকেনই রয়ে গেল। তবে আমার মার্কসে আমি খুশি, যদিও আপনি যে ওতে সন্তুষ্ট হবেন না সে আমি এখান থেকেই বুঝতে পারছি। বলবেন, 'আমায় তো বিট করতে পারলি না!' সে আপনি যা-ই বলুন, আমি কেয়ার করি না। ইশকুল থেকে আজ অবধি কোন পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েই তো আপনাকে পুরো খুশি করতে পারলাম না। যতই ভালো করি না কেন, মুখ বাঁকিয়ে বলবেন, 'ধুস, ও একটা নম্বর হলো? পরের বার--'

    এবারে তো আর সে সব কিছু বলতে পারবেন না! মাস্টার্সের পরে তো আর পরের বার হবে না! মানে আমি বলতে চাইছি, আপনি মারুন , বকুন যা খুশি করুন, পিএইচ ডির জন্য এনরোলমেন্ট আমি কিছুতেই করছি না। জোর করবেন না কিন্তু। করলে পরে এইবারে আমিও কিন্তু আপনাকে সেই একই কথা জিজ্ঞাসা করবো। অত সাংঘাতিক রেজাল্ট করেও আপনি পি এইচ ডির দিকে গেলেন না কেন? আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই। আপনি মুখে কোনদিন কিছু না বললে কী হবে, ইউনিভার্সিটিতে আমাদের ডিপার্টমেন্টে এখনও কিন্তু অনেকেই সেই নিয়ে আক্ষেপ করেন। পিডি সেদিন আমার বাড়ি মুরলিপুরে শুনে আপনার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। অনেক আফশোষ করলেন। বলেন, 'অমন একটা ছেলে, কোথায় হারিয়ে গেল!'

    আমিও আর আপনি কী করছেন, কেন করছেন সে'সব কথা ভেঙে বিশেষ কিছু বলিনি ওঁকে। বলে লাভ কী? আপনি যা করছেন সে'সব বুঝবে নাকি কিছু? ওদের চোখ ওই জেএনইউ-অক্সফোর্ড-কেমব্রিজের একটা সটান লাইন ছাড়া আর তো কিছুই দেখতে পায় না।

    কিন্তু শোভনদা, আমি কিন্তু এতদিনে একটু হলেও বুঝতে শুরু করেছি--অন্তত আপনার একখানা মিশনকে। আগে বুঝতাম না। মা যেদিন দশ বছর আগে প্রথম আপনার বাড়ির ইশকুলে আমায় ভর্তি করে দিয়ে গেল সেদিন আমি প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। আপনাকে দূর থেকে আসতে দেখলেই ভয়ে বুকটা কাঁপতো। তারপর একদিন ঝগড়া করতে করতে মানুকে একটা বাজে গালাগাল দিতে আপনি যখন ছুটে এসে দু গালে দুটো চড় মারলেন, সেদিন থেকে ভয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছিল ভীষণ একটা রাগ।

    তারপর, হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করতে যেদিন এসে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করে দিয়ে গেলেন, সেদিন প্রথমবার বাড়ির বাইরে একদম একলা রাতে, হস্টেলের চৌকির ওপর বসে কাঁদতে কাঁদতে আপনাকে যে কী সাংঘাতিক সব অভিশাপ দিয়েছিলাম-------
    -----তখনও জানতাম না, আমার পড়াশোনা , হোস্টেল এমনকি গায়ের শাড়িটাও আপনার খরচে কেনা। আমি ভাবতাম আমার বাবাই কোনমতে আমার পড়ার খরচ দেয় আপনার হাতে। সেজন্য গর্বও ছিলো একটা মনে মনে। তাই মাঝে মাঝে যখন রেগে গিয়ে গালাগাল দিতো, বলতো পড়াশোনা ছাড়িয়ে দেবে এবারে, তখন কিছু বলতাম না। ভাবতাম অভাবের জ্বালায় মানুষ কতকিছুই বলে। দাঁত চেপে সহ্য করে যেতাম সবকিছু।

    কিন্তু সেই কলেজে ভর্তি হবার বছরই সবকিছু জানলাম। গরমের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে দেখি বাবা আমার একটা বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে। লোকটার আতাখালির গঞ্জে কাপড়ের পাইকারি ব্যবসা আছে। দুই বিবি বর্তমান। আমি তার তিন নম্বর হতাম। খুব উদার পরিবার নাকি। আমি কলেজে ঢুকেছি জেনেও আপত্তি করেনি। আমি মানা করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আপনি বলেছেন আমাকে আরো অনেক পড়তে হবে। আমি পড়বোই। যদি বাবা আর খরচ দিতে না পারে তাহলে টিউশন করে নিজের খরচ জোগাড় করে নেবো আমি।

    শুনে রেগে গিয়ে বাবা চিৎকার করেছিলো খুব। মাকে গালাগাল দিয়ে বলেছিল, 'হিঁদু ছোঁড়ার হাতে মেয়েকে তুলে দেবার আগে কতোবার মানা করেছিলাম তোকে, শুনিস নি। এইবার তার ফল দেখ। এত বছর ধরে খাওয়াচ্ছে-পরাচ্ছে, পড়াশুনোর ট্যাকা দিচ্ছে, হস্টেলে নিয়ে রেখেছে। এরপর কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ঘর দিয়ে বসাবে ঠিক দেখিস। বিয়ে ও মেয়ে কেন বসবে? ভদ্দরলোকের বউ হয়ে বালবাচ্চা পালবার বদলে সে ছোঁড়ার----'

    ---থাক গে। সে'সব কথা আপনাকে লিখতে সংকোচ হচ্ছে। সেদিন বাবার কথার কোন উত্তর আমি দিইনি। দু'হাতে কান বন্ধ করে জোর করে চোখ টিপে এক কোনে বসেছিলাম চুপ করে। কী লাভ উত্তর দিয়ে? হয়তো মারতে আসবে। সেদিন সন্ধেবেলার ট্রেনে সুন্দরনগর ফিরে এসেছিলাম। চলে আসবার সময় বাবা বলেছিলো আমার মুখ দেখবে না আর। আমি কিছু উত্তর দিইনি। কিন্তু তারপর বাড়িও যাইনি আর। অভিমানে নয়। স্রেফ ভয়ে। যদি লোকজন নিয়ে আটকে দেয়! সেই চলে আসবার পর ফের বাড়িতে পা দিলাম গতবছর মে মাসে। মা'র মারা যাবার খবর পেয়ে। বাবা নিজেই খবর পাঠিয়েছিলো। অনেক ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে আজকাল।

    আসল কথাটা বলি এবারে। যেদিন জানতে পারলাম শুধু পড়াশোনার খরচ নয়, আমার পেটের ভাত, গায়ের আব্রু, মাথার ছাত সবই আপনার দয়ায়, সেদিন রাতে ট্রেনে করে সুন্দরনগর ফিরতে ফিরতেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, আমি আপনার কাছেই ফিরে যাবো একদিন। আপনার দয়ায় যা শিখেছি, আপনার ইশকুলেই তা কাজে লাগাবো ফিরে গিয়ে।
    আপনার ঋণ শুধতে হবে আমাকে। আজ আমার সময় হয়েছে।

    মানা করবেন না শোভনদা। করলে এই প্রথম আপনার অবাধ্য হব। বড় হয়ে গেছি। ছোটবেলার মত ঠাস ঠাস করে চড় তো আর মারতে পারবেন না!

    বিকেলবেলাই ভেবেছিলাম একবার, ফোন করে খবরটা আপনাকে দিয়ে দিই। নীলমের মোবাইল থেকে আপনার নাম্বারটা ডায়াল করেছিলাম একবার। কিন্তু কলটা থ্রু হবার আগেই কেটে দিয়েছি। সত্যি বলতে কি এখনও আপনার সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে গেলে ছোটবেলার সেই ভয়টা আমায় চেপে ধরে। ফোনে রেজাল্ট শুনে আপনি হয়তো গম্ভীর হয়ে বলতেন, এবারে পি এইচ ডি-টা শুরু করে দে। আর আমিও ভয়ের চোটে সবকিছু গুলিয়ে গিয়ে আপনাকে হ্যাঁ বলে ফেলতাম। তখন কী হত? তাই ঠিক করলাম, ফোন নয়। তারপর হোস্টেলে ফিরে কাগজ কলম নিয়ে আপনাকে লিখতে বসলাম। চিঠিতে অনেক কিছু কথা কনফিডেন্টলি বলা যায়।

    আমার টিউশনির ছেলেমেয়েগুলোর এনুয়াল আগামি মাসে। অতএব তার আগে সুন্দরনগর থেকে বেরোবার প্রশ্নই উঠছে না। পরীক্ষাটা করিয়ে দিয়ে একেবারে পোঁটলাপুঁটলি বেঁধে নিয়ে মুরলিপুর ফিরব। মা চলে যাবার পর গত দেড় বছরে বাবা একেবারে জবুথবু হয়ে গিয়েছে। এখন সবসময় দেখভাল করবার লোক দরকার একজন। আমি গেলে বাবার সে সুবিধেটা হবে। কিন্তু আসল কথা হল, হেমলতা বিদ্যামন্দিরে আমি এবারে নতুন একাডেমিক সেশনে পড়াতে ঢুকব এসে। আপনার কোন আপত্তি শুনবো না।

    প্রণাম জানবেন
    -ফরিদা

    "কার চিঠি শোভনদা? কোন খারাপ খবরটবর নয় তো?"

    শোভন মুখ তুলে তাকাল একবার, প্রভাত এসেছে। বেড়ার দরজায় আগড় খুলে সাইকেল ভেতরে ঢোকাতে ঢোকাতেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছে এদিকে।

    "না, না। সেইরকম কিছু নয়। ফরিদার চিঠি এসেছে। দিনদুয়েক হল এসে পড়ে আছে। আজ ফিরে এসে পেলাম। এম এ কমপ্লিট হয়ে গেল ওর এবারে।"
    "তা বেশ। কিন্তু গেছিলে কোথায় তাই আগে বলো দেখি। একেবারে এক হপ্তা ধরে নিখোঁজ! ফের সেই ধরিত্রীপুর না কোথায় সেই বন্ধুর বাড়ি যে গেছলে গতমাসে, সেখেনেই নাকি?"

    শোভন হাসলো, "না রে। ওখানকার কাজ তো সেই সেবারেই মিটিয়ে এসেছি একেবারে। এবারে গিয়েছিলাম একটু সুন্দরবনের দিকে। কিন্তু সে কথা থাক। তুই যে হঠাৎ এই বাড়িতে এলি? আমি ফিরেছি জানলি কার কাছে?"
    "তোমার খবর পেতে কোন ঝামেলা আছে নাকি? এলাকায় তোমার ছাত্রদল আছে না? তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এলাকায় কিছু হতে পারে নাকি? সাড়ে ন'টায় বাস থেকে নেমেছো আর ন'টা চল্লিশে আমার দোকানে এসে রতন খবর দিয়ে গেল।"
    "রতন মানে ক্লাস সেভেন তো?"
    "হ্যাঁ। তা সেই শুনে বাড়িতে শিপ্রাকে খবর দিয়ে দিয়েছিলাম। এখন দোকান বন্ধ করে বাড়ি গিয়ে দেখি টিফিন কৌটো ভর্তি করে তোমার জন্য খাবার তুলে রেখেছে। এই যে--এইখানটায় রাখি?"
    "খাবার আবার বয়ে আনতে গেলি কেন? চান করে দু'টো ভাতে ভাত নাহয় ওমনি ফুটিয়ে নিতাম এবেলার মতো!"
    "সে তুমি কতো ফুটিয়ে নিতে আমার জানা আছে। এতকাল ধরে তোমায় দেখছি। জানি না নাকি কিছু? এখন স্নান করে এসে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। তারপর সন্ধ্যাবেলা থেকে তোমার দলবল তো ফের আছেই। বিশ্রামের সুযোগ তো আর পাবে না।''

    শোভন মাথা নেড়ে হাসিমুখে বললো, "হয়েছে। হয়েছে। উঃ, একেবারে জ্যাঠামশাই টাইপের কথা শিখেছিস তুই প্রভাত---"

    সাইকেলের স্ট্যাণ্ড তুলে নিয়ে সেটা ঠেলে ঠেলে সদর দিয়ে বের হয়ে যেতে যেতে প্রভাত ফের এদিকে ঘুরে সাবধানবাণী দিয়ে গেল, "দেখো, অবেলা কোরো না যেন আবার। তারপরে আবার শেষে অম্বলটম্বল হয়ে---"

    শোভন হাসল, " তুই যা তো এবার প্রভাত! বেলা হয়েছে। চান খাওয়া করে ফের বিকেলে গিয়ে তোকে দোকান খুলতে হবে তো!"
    "হ্যাঁ, সে খুলতে তো হবেই," বিরক্ত গলায় বিড়বিড় করে বললো প্রভাত, " কামাই দেবার উপায় রেখেছে কোন? কি যে বছরবিয়ুনি মেয়েমানুষ ঘরে এনেছি! চার বছরে তিনটে ইসু। চার নম্বরটা এই আষাঢ়ে ডিউ। ভরসা বলতে ওই মুদির দোকানের আয়। কামাই দিলে চলবে কী করে--"

    বলতে বলতে সিটে উঠে বসে পেডালে চাপ দেয় সংসারভারানত যুবকটি। বাবার কাছ থেকে পাওয়া মুদির দোকানটিকে সে নিজের চেষ্টায় অনেক বড়ো করেছে। বাজারের ভিতরে চালু দোকান। সেখানে চারটি কর্মচারী তার উদয়াস্ত ব্যস্ত থাকে। তার এই আক্ষেপটি যে সুপ্রতিষ্ঠিত গৃহস্থমানুষের সুখের বিবৃতিমাত্র, তা সে নিজেও ভালো করেই জানে ও মেনে চলে। মাত্রই বাইশ বছর বয়েসে বাবার উদ্যোগে খোঁজখবর করে সংগৃহীত শিপ্রা নামের যুবতীটিকে বিবাহ করে নিশ্চিন্তে নিদ্রা গিয়েছে সে। এই কালনিদ্রায় কষ্ট অনেক থাকলেও দুঃখ তার কিছু নেই।

    তার চলে যাবার পথটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসি ফুটে উঠল শোভনের মুখে। আজকাল এই প্রভাত তাকেও মাঝেমাঝে উপদেশ দেয় এইসব পাগলামো ছেড়ে, একটা বিয়ে করে থিতু হয়ে বসতে। গত চার বছরে একটি রাতও কোন গানের আসরে যায়নি তার একদা ছায়াসঙ্গী এই প্রভাত! তবে প্রতি রবিবারে বাসে করে বিরামনগর বা আতাখালি গিয়ে ভিডিও হলে শিপ্রাকে নিয়ে সিনেমা দেখার কামাই তার হয় না। এই প্রভাতই তাকে গতবার বলেছিল হেমলতা বিদ্যামন্দিরের যে চাঁদা ওঠে তার খানিকটা আলাদা করে ব্যাংকে একটা বেনামি পাসবুকে জমা করে সেই টাকাটা তার দোকানের বিজনেসে খাটাতে। লাভের ফিফটি ফিফটি শেয়ার। মূলটা উঠে গেলে সেটা ইশকুলের ফাণ্ডে ফেরত দিলেই মিটে গেল। শোভন তাতে রাজি না হতে খুব রেগে গিয়েছিলো প্রভাত। দোকানের রেনোভেশনের জন্য তখন অনেক টাকার দরকার হয়ে পড়েছিল প্রভাতের। তবে হ্যাঁ শোভনের প্রতি ভালোবাসার টানটা তার রয়ে গিয়েছে এখনো। সেইখানে কোন বদল আসেনি তার।

    উঠে, বন্ধ টিফিন ক্যারিয়ারটা রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে একটা থালায় খানিক জল ঢেলে তার ওপর বসিয়ে দিলো সে। ওতে পিঁপড়ে ধরবে না। বারান্দায় ফের এসে একটা বাঁশের খুঁটির গায়ে হেলান দিয়ে দাওয়া থেকে পা ঝুলিয়ে বসল শোভন। বাড়ি পেরিয়ে রাস্তা। তার ওপারে আরও দু একসার বাড়ি পেরিয়ে ধূ ধূ গোচর। তারও ওপারে চূর্ণী নদী বয়ে যাচ্ছে দক্ষিণবাহিনী হয়ে।এখান থেকে তাকে দেখা যায় না। চৈত্রের উত্তপ্ত হাওয়ায় মাঠের ওপর ছড়িয়ে থাকা শুকনো ঘাস কাঠকুটোদের পাক দিয়ে তুলে মাঠময় ঘুরে বেড়াচ্ছে বায়ুকুণ্ডলি হয়ে। এ অঞ্চলে একে বাউলি বলে।

    চিঠিটাকে তুলে নিয়ে ফের একবার যত্ন করে পড়লো সে। আজ হেমলতা দিদিমণিকে বড় মনে পড়ছে। বলেছিলেন, "বিশ্বাস রেখো। একদিন না একদিন একজন-দুজন ছাত্র ঠিক ফিরে আসবে তোমার ঋণ শোধ করতে। সেদিন আর ততটা একলা ঠেকবে না দেখো।"

    প্রৌঢ়া মানুষটির নিরাভরণ হাত ও সিঁথির দিকে চোখ তুলে সেদিন শোভন জিজ্ঞাসা করেছিল, "কিন্তু আপনি তো চিরকাল একাই---"

    তাকে বাধা দিয়ে হেমলতা বলেছিলেন, "শবরীর প্রতীক্ষায় ছিলাম বাবা। কিন্তু অবশেষে তুমি তো এলে আমার উত্তরাধিকারী হয়ে! হোক দেরি। তবু আমার মিশনটা তো এগিয়ে যাবে! "

    ঠিক একযুগ আগের কথা। সে বছর শোভন গ্র্যাজুয়েশান শেষ করে এম এ তে ভর্তি হয়েছে সবে। তার ইশকুল তখনও হেমলতা বিদ্যামন্দির হয়ে ওঠে নি। আশপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েদের একত্র করে একটু আধটু পড়ানোর কাজ করতো শনিরবি দুদিন করে। ওই সময় একদিন বিরামনগরের একবাল ভ্যানওয়ালার বৌ হামিদা তার মেয়ের হাত ধরে শোভনের কাছে এনে দিয়ে গেল। বলে, "বাড়ির লোকের মেয়েরে ইশকুলে দিতি মানা। বলে ভ্যান চালায়ে খরচ দিতি পারবে না। তোমার কাছে নিয়ি এলাম। দেখো যদি পেটে দু অক্ষর দিয়ে দিতে পারো! আমার তো আর এ জীবনে হল না!"

    রোগা, কালো মেয়েটা জড়োসড়ো হয়ে, ফ্রকের একটা দিক মুঠো পাকিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো বারান্দার এককোণে। ডাকলেও নড়ে না। শেষে একটা ধমক দিতে মাথা নীচু করে বলে, ফ্রকের অনেকখানি ছেঁড়া। তাই মুঠো পাকিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওভাবে। নাম বলল মরণ। অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল শোভন। কোনো বাবা মা নিজের সন্তানের এমন নাম দেয়? সেদিন বিকেলে সে একটা নতুন ছিটের ফ্রক কিনে দিয়ে এসেছিল মেয়েটাকে।



    এর বছরদেড়েক পরে বিরামনগর বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করাবার জন্য শোভন নিয়ে গিয়েছিল মেয়েটাকে। হেডমিস্ট্রেস হেমলতা সরকার কলকাতার মেয়ে। তবে এ অঞ্চলে আছেন গত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। শোভনকে চেনেন ভালো করেই, মরণের বাবা একবাল রিকশাওয়ালাকেও চেনেন। মরণের পরীক্ষা নিয়ে খুশি হয়ে শোভনকে অফিসঘরে ডেকে বলেছিলেন, "ক্লাস ফাইভ স্ট্যাণ্ডার্ডের পড়াশনা তো এর ভালো করেই হয়ে আছে দেখছি। কবে থেকে আছে তোমার কাছে?"
    "দেড় বছর মতো হবে।"
    "ইনক্রেডিবল। বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করিয়ে এই মেয়েকে দেড় বছরের মধ্যে ক্লাস সিক্সে ভর্তির যোগ্য করে তৈরি করে দিয়েছো, তোমার ক্ষমতা আছে শোভন। তা মেয়েকে ইশকুলে দিতে এর বাপ রাজি হল যে বড়?"

    শোভন মাথা নেড়ে বলেছিল, "সহজে হয়নি দিদিমণি। শেষে পড়ার সব খরচটা, আর যতদিন ইশকুলে পড়বে ততদিন একবেলা খেতে দেব মেয়েকে এই কড়ারে রাজি করিয়েছি।"

    হেমলতা সরকার মাথা নেড়ে গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, "এই নিয়ে এ ইশকুলে পাঁচ নম্বর পুষ্যি হলো তোমার। চালাবে কী করে শোভন?"

    শোভন এক গভীর বিশ্বাসে স্থিত হয়ে বলেছিল, "চলে যাবে ঠিক দিদিমণি। আপনি দেখবেন! আমার নিজের স্কলারশিপের টাকাটা আছে, তার ওপর ছাত্রছাত্রীও জুটেছে অনেকগুলো। তাদের মধ্যে যারা পারে তারা যথাসাধ্য দেয়। সেগুলোও কাজে লেগে যাবে।"

    প্রখর বাস্তববুদ্ধিসম্পন্না অভিজ্ঞ প্রৌঢ়া অবশ্য কথাটা সহজে মানতে চাননি। ভুরু কুঁচকে বলেছিলেন, "কিন্তু এত ছেলেমেয়ের আশা জাগিয়ে, তাদের স্বপ্ন দেখিয়ে, তারপর এম এ-টা শেষ করে তুমি যখন আবার নিজের কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে অন্য জায়গায় যাবে তখন এদের অবস্থাটা কী হবে সেটা ভেবে দেখেছো?"

    শোভন মাথা নেড়ে বলেছিল, "না। ভাববার প্রয়োজন হয়নি। কারণ ওদের ছেড়ে আমি কোনদিন কোথাও যাবো না।"
    "আমি বিশ্বাস করিনা। তুমি একটা ইমোশনাল স্টেটমেন্ট দিচ্ছ শোভন। বাঙালি ছেলেরা এ বয়সে বড় বেশি ইমোশনাল হয়। তাদের মধ্যে মাথাটা যাদের ভালো তারা হয় কেরিয়ারিস্ট নয় কবি নয় বিপ্লবী হয়ে যায়। তোমার বাবা তো কবি ছিলেন শুনেছি।"

    ভেতরে ভেতরে গড়ে ওঠা রাগটাকে চেপে রেখে শান্তগলায় শোভন জবাব দিয়েছিলো, "জ্যোতিষবিদ্যায় আমার কোন আগ্রহ বা দক্ষতা নেই দিদিমণি। আজকে আমি কী করতে চাই শুধুমাত্র সেটাই আমি জানি। আগামিকালের ওপর তো আমার হাত নেই। আপনি বরং আজকের কাজটা করুন। ওকে ভর্তিটা করে নিন। আমি টাকা পয়সা নিয়ে এসেছি।"

    হেমলতা খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে তারপর মাথা নেড়ে বলেছিলেন, "তুমি একটা একগুঁয়ে, ইমোশনাল, নাইভ এণ্ড ফ্রেশ ইয়াং ব্র্যাট। টাকাটা ফেরত নিয়ে যাও। ওটা ওয়েইভ করা গেল। ইশকুলের চার্জটার্জগুলোও ফ্রি হয়ে যাবে," বলতে বলতে মরণকে ঘরের বাইরে থেকে ডাকিয়ে এনে তার দিকে একটা ফর্ম বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, "নিজে নিজে ফর্মটা ভরে ফ্যাল দেখি।"

    ফর্মটা টেনে নিয়ে কলম খুলেছিল মরণ। নামের জায়গায় গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছিল 'ফরিদা বিশ্বাস'। হেমলতা সেদিকে একবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে উঠেছিলেন, " ওটা আবার কার নাম লিখলি? নিজের নাম লেখ!"

    সে মেয়ে মাথা নেড়ে বললো, "না দিদিমণি। ওই মরণ নাম আমার চাইনা। তাই বদলায়ে দিছি।"
    "সে কী রে? বাপ-মায়ের দেয়া নামটা পছন্দ হলো না?"

    কলম তুলে নিয়ে গোঁজ হয়ে খানিকক্ষণ বসে রইলো মেয়েটা। তারপর বললো, "না। সবাই খেপায়।"


    কৌতুক বোধ করেছিলেন এই অভিজ্ঞ প্রধানশিক্ষিকা। এই গ্রামদেশে দীর্ঘ ত্রিশ বছরের শিক্ষকজীবনে এমন স্বাধীনচেতা বারো বছরের মেয়ে তিনি কখনো দেখেন নি। খানিকটা কৌতুহলবশেই ফের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "কিন্তু এতো নাম থাকতে ফরিদা নামটাই পছন্দ করলি কেন রে?"

    উত্তরে শোভনের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে মেয়েটা বলেছিল, "শোভনদাদার কাছে ফরিদা পরভিনের গান শুনি রোজ টেপরেকটারে। দাদা বলেছে আমার জন্মের বার তিনি ওপারে একুশে পেরাইজ পেয়েছিলো। আমি বড়ো হয়ে উনার মতো হতে চাই----"

    মেয়েটাকে কাছে ডেকে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে স্নিগ্ধ গলায় হেমলতা বলেছিলেন, "তাই হবে তবে। আজ থেকে তোর নাম ফরিদাই হলো। এখন যা দোতলার পূবকোণে সিক্স সি-তে গিয়ে বোস। অমৃতা দিদিমণি ক্লাস নিচ্ছে এখন। বলিস আমি পাঠিয়েছি।"

    চলে যাবার জন্য দরজায় হাত লাগিয়েছে ফরিদা এমন সময় পেছন থেকে ফের একবার ডেকেছিলেন তাকে হেমলতা। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "তুই গান গাইতে পারিস?"

    মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল কিশোরীটি। জানিয়েছিলো, সে লালনের গান গাইতে ভালোবাসে। দু-একটি গ্রামীণ আসরে সে গান গেয়েওছে ইতিমধ্যে।

    সে চলে যাবার পর মাথা নেড়ে হেমলতা বলেছিলেন, "এ মেয়ে একবালের ঘরে হলো কী করে? এ তো ছাইচাপা আগুন একেবারে! এর দিকে ভালো করে খেয়াল রেখো শোভন। হারিয়ে না যায়।"

    সিক্সের হাফ ইয়ার্লিতে সেকেণ্ড হয়েছিলো ফরিদা। তার পর আর কখনো সেকেণ্ড হতে হয়নি তাকে। যে বছর মাধ্যমিক দিলো সে, সেটা শোভনের পাঠশালারও প্রথম মাধ্যমিকের ব্যাচ। পাঁচটা মেয়ে আর গোটা আষ্টেক ছেলেকে তৈরি করে পাঠিয়েছিল শোভন। ছেলেগুলো পরীক্ষা দিয়েছিলো শেঠ শোভারাম বয়েজ থেকে আর মেয়েগুলো বিরামনগর বালিকা বিদ্যালয় থেকে। মোট দশজন ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলো তাদের মধ্যে। তিনটে স্টার। ফরিদা পঁচাশি পারসেন্ট নম্বর পেয়ে জেলায় মেয়েদের মধ্যে ফার্স্ট হয়েছিলো।

    কৃষ্ণনগরের ডি এম অফিসে প্রাইজ নিতে যাবার দিন সকালে হেমলতা লোক দিয়ে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন শোভন আর ফরিদাকে। ফরিদার হাতে দিয়েছিলেন একটা শাড়ি, তার জীবনের প্রথম দামি উপহার, পুরস্কার আনতে যাবার পোশাক। তারপর যত্ন করে নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়েছিলেন তাকে। রুখু চুলে তেল মাখিয়ে লম্বা বেণী বেঁধে দিতে দিতে বলেছিলেন, "এত সুন্দর দেখতে! নিজেকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে শিখিস না কেন?"

    তারপর তাকে রান্নাঘরে চা বানাতে পাঠিয়ে দিয়ে শোভনের হাতে একটা দু'লাখ টাকার চেক তুলে দিয়ে বলেছিলেন, "সংকোচ কোরো না। এটা আমার নিজের রোজগারের টাকা। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে তোলা। পাঁচ বছর আগে তুমি যেদিন এই ফরিদাকে আমার কাছে প্রথম নিয়ে এলে সেদিন বলেছিলে, ওদের ছেড়ে তুমি কোথাও যাবে না। গত পাঁচ বছর তুমি সেই প্রতিজ্ঞা পালন করে এসেছ। সেদিন আমি তোমাকে বিশ্বাস করিনি। বাস্তববুদ্ধিহীন, ইমোশনাল ছোকরা বলে গালি দিয়েছিলাম। তুমি আমায় ভুল প্রমাণ করেছ।"

    তাঁর চিকচিক করে ওঠা চোখের কোণদুটোর দিকে তাকিয়ে শোভন মৃদু হেসে বলেছিল, "এবার কি আপনিই ইমোশনাল হয়ে পড়ছেন না দিদিমণি? এইভাবে এতোগুলো টাকা আমাকে--"

    মাথা নেড়ে হেমলতা বলেছিলেন, "তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে দিচ্ছিনা শোভন। সংসার না করে, নিজের বাড়িঘর ছেড়ে সারাটা জীবন আমি এই এলাকাতে একটা মিশন নিয়েই কাটিয়ে গেলাম--গ্রামের মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনা ছড়িয়ে দেয়া। আমার দুঘরের পাঠশালা গত পঁয়তিরিশ বছরে এই বিরামনগর বালিকা বিদ্যালয় হয়ে উঠেছে একটু একটু করে। পৈত্রিক সম্পত্তির যা ভাগ পেয়েছি তার সবটাই গেছে এই ইশকুলবাড়ির পেছনে। আর, মোটা ভাতকাপড়টুকু বাদে মাসিক রোজগারের বাকি সবটাও চিরকাল আমার মিশনের পেছনেই খরচ করে এলাম। কিন্তু, ইশকুলটাও তো আস্তে আস্তে আমার আদর্শের থেকে সরে গিয়ে আর দশটা ইশকুলের মতই হয়ে গেল! ভাবতাম হেরে গেছি। আমি মারা গেলেই আমার মিশনও শেষ। কিন্তু তোমায় দেখে আমার সে ভয়টা গেল। এবারে তুমি নিজের মতন করে আমার মিশনটাকে সাকসেসফুলি এগিয়ে নিয়ে যাবে। আয়াম শিওর। চেকটা নাও শোভন। তোমার কাজে লাগবে।"

    বাড়িয়ে ধরা চেকটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর মাথা নেড়ে শোভন বলেছিলো, "না দিদিমণি। টাকার আমার খুব দরকার মানছি। খোলা উঠোনে ক্লাশ করাই। রোদেজলে ক্লাশ বন্ধ রাখতে হয়। ইমিডিয়েটলি কয়েকটা ঘর তোলা দরকার। লাইব্রেরি দরকার একটা। ফাইভ থেকে টেন অবধি এই মুহূর্তে আমার কাছে প্রায় পঞ্চাশটা ছেলেমেয়ে। তার মধ্যে অর্ধেক তো বাড়িতে খেতে পায় না। সেগুলোকে নুনভাত হোক আর রুটিগুড় হোক তা-ও একটু একটু জোগাতে হয়। পড়াবার কাজে সাহায্য করে যে দুতিনটে ছেলে, তাদের একটা পয়সা দিতে পারি না। আপনার টাকাটা পেলে আমার কাজে লাগবে। কিন্তু এইভাবে টাকাটা চাইনা আমার। আমি চাইবো, টাকার সঙ্গে সঙ্গে আপনি নিজেও আসুন আমার সঙ্গে। আমার কাজের ফর্ম্যাটটা কিন্তু ফর্মাল স্কুলশিক্ষার চেয়ে একেবারে আলাদা। ইশকুলের বাঁধাধরা শিক্ষা নয়। শিক্ষা ব্যাপারটাকে আমি--"
    "আরো অনেক ব্যাপক অর্থে প্রয়োগ করছো, তাইতো? তুমি যে তোমার ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে সেই কাজটা করছো তার আন্দাজ আমি তোমার মেয়েদের দেখেই পেয়েছি। পড়াশোনার পাশাপাশি এই ক'বছরে তাদের আচার-আচরণে কীরকম বদল এসেছে সে তো আমি নিজের চোখেই দেখেছি। আমার রিটায়ারমেন্টের আরো দু'বছর বাকি আছে। ভেবেই রেখেছিলাম, তোমার সঙ্গে গিয়ে জুটবো তার পরে। কিন্তু, চিরটাকাল যুক্তিবাদের আলোয় যাকে অস্তিত্ত্বহীন বলে বিশ্বাস করে এলাম, সেই নিয়তি এইবারে শেষ সময়ে তার খেলা দেখিয়ে দিয়েছে শোভন। কমাস ধরে মাঝেমাঝেই মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল। শেষে গত সপ্তাহে ডাক্তার বললেন কলকাতায় গিয়ে কয়েকটা টেস্ট করাতে। গতকাল তার রিপোর্ট এসেছে। দেখো।"

    বাড়িয়ে ধরা কাগজটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে শিউরে উঠেছিলো শোভন। সেরিবেলাম এলাকায় মস্তিষ্কের গভীরে ছোট্ট একটা টিউমার বাসা বেঁধেছে। পরীক্ষার ফল বলছে তার চরিত্র ম্যালিগন্যান্ট।

    "আমি অপারেশনে মত দিইনি। ডাক্তার বলেছিলেন এই জাতের কেসে সারভাইভাল রেট হাই কিন্তু অধিকাংশ কেসে পেশেন্টের ডিপ কোমায় চলে যাবার ভয় থাকে। কিন্তু, যে কটা দিন আমি বেঁচে থাকবো, আমি সজ্ঞানে বাঁচতে চাই শোভন। নাকে নল পরানো পোস্ট অপারেটিভ ক্যাবেজ হয়ে নয়। চেকটা নিয়ে গিয়ে তুমি কাজ শুরু করো। ও তোমায় একাই করতে হবে। এ জীবনে আর তোমার সঙ্গে একসাথে কাজ করা হবেনা আমার।"

    এইবারে হাত বাড়িয়ে চেকটা নিয়েছিলো শোভন। কোনরকম সান্ত্বনাবাক্য বের হয়নি তার মুখ থেকে। মিথ্যে স্তোক তার ভালো আসেনা কোনদিনই। শুধু নিচু হয়ে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে একটা প্রণাম করে বাইরে বের হয়ে এসে ফরিদাকে নিয়ে রওনা হয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণনগরের দিকে। এর দিনসাতেক পরে কৃষ্ণনগর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় হেমলতা সরকারকে। সেখান থেকে কলকাতার বড়ো হাসপাতালে। এম্বুলেন্সে শোভন সঙ্গে ছিলো। হাসপাতালের ট্রলিতে শুয়ে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে ঢুকে যাবার আগে অর্ধস্ফুট গলায় হেমলতা বলেছিলেন, "আ-আমার পার্সোনাল লাইব্রেরিটা--তোমার কাছে নিয়ে যেও--ওতে--আঃ--অনেক কাজের বই পেয়ে যাবে শোভন। হেডক্লার্ক রতনবাবুর কাছে চাবি রাখা আছে---"

    দুদিন বাদে আমেরিকা থেকে উড়ে এসেছিলেন দিদিমণির একমাত্র আত্মীয় তাঁর ছোট ভাই। কলকাতা থেকে দিন দুই বাদে মুম্বইয়ের টাটা মেমোরিয়ালে শিফট করেছিলেন তিনি তাঁর দিদিকে। মাস দুই বাদে যেদিন শোভনের বাড়ির পাঁচ বিঘে জমির প্রায় এক বিঘে অংশ জুড়ে চারটে টানা, লম্বা, টালিছাওয়া ছিটেবেড়ার ঘরের সার নিয়ে তার বিকল্প শিক্ষার ইশকুলের উদ্বোধন হচ্ছে, সেদিন বিরামনগর বালিকা বিদ্যালয়ে দু'শব্দের টেলিগ্রামটা এসে পৌঁছেছিল, "হেমলতা এক্সপায়ার্ড।"

    আগে থেকেই একটা সিদ্ধান্ত করে রাখা ছিলো শোভনের। নির্দিষ্ট কোন নাম থাকবে না তার স্কুলের। কোন ব্র্যাণ্ড নেম সে তৈরি করতে চায় না। কিন্তু সেদিন সন্ধেবেলা খবরটা পেয়ে কী যে হয়ে গেল, একখণ্ড বেড়ার ওপর খবরের কাগজ সেঁটে তার ওপরে রঙতুলি নিয়ে সে নিজেই বানিয়ে ফেললো ইশকুলের নামের প্রথম বোর্ড--হেমলতা বিদ্যামন্দির।


    বোর্ডটা এখন টিনের হয়েছে। সবুজের ব্যাকগ্রাউণ্ডে সাদা হরফে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা নাম। বাইরের রাস্তা থেকে বাড়িতে ঢোকবার সরু গলিটার মুখে লাগানো। শোভন একবার ঘুরে বোর্ডটার দিকে দেখে নিল। পেছন থেকে লেখাটা দেখা যায় না অবশ্য, কিন্তু বোর্ডটার দিকে তাকালে এখনো হেমলতা দিদিমণির মুখটা তার চোখের সামনে ভাসে।

    "শোভনদাদা!" কচি গলার মৃদু একটা ডাকে সম্বিৎ ফিরলো শোভনের। ছোট্ট ছেলেটি। ওর নাম আনিসুর। ক্লাস ফাইভে পড়ে। দাওয়ার নিচে দাঁড়িয়ে তার ঝুলন্ত পায়ে নাড়া দিয়ে ডাকছিল সে। ধড়মড় করে উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো শোভন। তিনটে বাজে। পেটের খিদেটাও প্রবলভাবে জানান দিতে শুরু করেছে এইবারে।

    "বোস গিয়ে চুপ করে। আমি পাঁচ মিনিটে খেয়ে নিয়ে আসছি।"
    "আমি তাহলে ততক্ষণ একটু বাগানে যাবো? ওখানে সুবীরদাদা ইরফানদাদারা কাজ করছে।"
    "হ্যাঁ যা। তবে হাতে খুরপি বা কাস্তে ধরতে পারবি না। আর শোন, এই যে এক হফতা আমি ছিলাম না, সে সময় ক্লাস টেন খেত পরিষ্কার করবার কাজ করেছে?"
    "হুঁউ। তবে ইরফানদাদা কিন্তু পরশু আসে নাই। তাই টুয়েলভের মতিদিদি তাকে খুব বকেছে। বলে কেলাশ টেনের এক বিঘার সর্ষে এবারে লাস্ট পেরাইজ পাবে অমন করে ফাঁকি দিলে। তাইতে ইরফানদাদা রেগে গিয়ে বলে--হি হি--"
    "রেগে কী বলে?"
    "বলবো না।"
    "তবে রে----বল বলছি!"
    "বলে--বলে--'মেইয়াছেলে উঁচা কেলাশে পড়ে বলেই ব্যাটাছেলেদের দলের ম্যান্টর হবে কেন? তায় আবার গলা উঁচায়ে বকে! আমার কি পেরেস্টিজ নাই?' সেই শুনে মতদিদি রেইগে গিয়ে করেছে কি, ইরফানদের বাড়ি গিয়ে আতাউর চাচার কাছে সব বইলে দিয়েছে। আপনারেও বলতো, কিন্তু ইরফানদাদা বাড়িতে মাইর খেইয়ে এসে কাল জোড়হস্ত হইয়ে বলে, 'দাদারে আর বলে দিও না মতিদিদি , আমার ঘাট হইয়েছে।' "
    "তা শুনে মতিদিদি কী বললো?"
    "খানিক ঘ্যানঘ্যান শোনবার পরে বইললো, 'যাঃ। ছেইরে দিলাম। এর পরে আর কোনদিন কাজে ফাঁকি দেছিস তো---' "
    "হুঁ। তার মানে মতিদিদি আমাকে কিছু জানাতে চায় নি। তাহলে তুই এসে বলে দিলি যে বড়?"
    "তাহলে ইরফানদাদা আরও পিটাই খাবে। হি হি হি--"
    "ইরফানদাদা নয়, পিটাই খাবে তুমি আমার হাতে বাঁদর ছেলে। অন্যকে মার খাওয়াবার জন্য এত ব্যস্ত, নিজের পিঠে কিল পড়লে কী করবি তুই সেটাই দেখতে চাই আমি। আয়--"

    আনিসুর নামের ছেলেটি অবশ্য শোভনের সেই ইচ্ছেটা পূরণ করবার কোন সুযোগ দিতে রাজি নয়। এক দৌড়ে সে তার দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে পেছনের বিস্তীর্ণ বাগানের মধ্যে হারিয়ে গেল।

    দূর থেকে কানে ভেসে আসছিল, তার কচি গলায় উচ্চগ্রামে গাওয়া গানের ছেঁড়া ছেঁড়া সুর-

    ত্রিভূবনের মধ্যে আমি দেখি নাই
    এমন ভারী কাচারি
    উহার জজ কানা, মেজিস্টর কানা
    কানা উহার খদগিরি
    আর কানা সদরের দ্বারী
    আহা কি চমৎকারি-----"
    শোভন কান খাড়া করে শুনছিল। ইদু বিশ্বাসের জারি গানের পদ। আনিসুর ছেলেটির গলা বেশ মিষ্টি। সুরজ্ঞানও ভালো। কিন্তু এ সদগুণটা থাকলেও ছেলেটার বদগুণও কম নয়। কত সহজেই তার কাছে এসে নিজের বন্ধুদের গোপন কথা জানিয়ে দিয়ে গেলো! অবশ্য, অপেক্ষাকৃত অধিক শক্তিশালী পক্ষের কাছে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তোলবার জন্য নিজের বন্ধুদের সংগে বিশ্বাসঘাতকতা করা--এ তো এ-দেশের চিরকেলে ট্র্যাডিশন! রামায়নের কাল থেকেই এ বিষ বইছে এ-দেশের ধমনীতে। আনিসুরের আচরণ অতএব একেবারে অপ্রত্যাশিত কোন কিছু নয়। তবে হ্যাঁ। সতর্ক হতে হবে। শোভন পয়েন্টটা মনে মনে নোট করে নিলো। ক্লাস নাইনের সুভাষ মণ্ডল এই ছেলেটার মেন্টর। তার সাথে কথা বলতে হবে। ছেলেটাকে একটু নজরে রাখা দরকার।

    -------------------------------


    স্নানখাওয়া সেরে আধঘন্টাটাক বাদে যখন বাইরে এসে দাঁড়ালো শোভন ততক্ষণে ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে সবকটা গ্রুপে। গুণগুণ শব্দ উঠছিলো গোটা এলাকা জুড়ে। বারান্দার একপাশে বসে ক্লাস এইটের চারপাঁচটা ছেলেমেয়ে বসে হ্যারিকেনের চিমনি মুছছিলো। এ সপ্তাহে এ ডিউটিটা ওই ক্লাশের। দশটা হ্যারিকেন সব মিলিয়ে। সাদা প্লাস্টিকের জেরিকেনের মধ্যে রাখা কেরোসিনের নীল রঙ একেবারে তলানীতে এসে ঠেকেছে। ঘরে ফিরে গিয়ে আলমারি খুলে একটা একশো টাকার নোট বের করে নিয়ে সে ডাক দিলো, "শুভ, এদিকে আয় একবার।"

    লম্বা, রোগামতন ছেলেটা হ্যারিকেন ছেড়ে উঠে আসতে তার হাতে টাকাটা গুঁজে দিয়ে সে বললো, "পাঁচ লিটার তেল নিবি। দৌড়ে যাবি আসবি। দেরি করিস না।"

    টাকাটা হাফপ্যান্টের পকেটে গুঁজতে গুঁজতে শুভ বললো, " বাকি পয়সার বাতাসা নিয়ে আসবো শোভনদা?"
    "বাতাসা কেন?"
    "বাবা বলেছে সন্ধেবেলায় আজ কিলোচারেক মুড়ির জলপান পাঠিয়ে দেবে ইশকুলে। মা মুড়ি ভাজতে বসেছে দেখে এসেছি। সঙ্গে দুচারটে করে বাতাসা হলে রাতের খাওয়ার লোকেরা ওই দিয়েই খেয়ে নিতে পারবে।"
    "হুঁ," মাথা নাড়লো শোভন, " তবে বাতাসা নয়। দিয়ে কুলনো যাবে না। বরং ভেলিগুড় নিয়ে আসিস যা পয়সা বাঁচে তাই দিয়ে। এক এক খাবলা করে দিলে সবার হয়ে যাবে। রাতে খাবার জন্য কজন আছে? গুনেছিস?"
    "আমি গুনিনি। রাতের খাওয়ার চার্জে অমিতদা আছে। সে ঠিক করে বলতে পারবে। তবে মনে হয় জনা কুড়ি হবে আজ।"
    "সে কী রে? আমি যেদিন বেরোলাম সেদিনও তো পনেরোজন দেখে গেছি! এর মধ্যে পাঁচজন বেড়ে গেলো কী করে?"
    "বলছি। আপনার যাবার দিন আমাদের ক্লাসের তরাজ-এর মায়ের কিছু একটা হয়েছে। তাকে হাসপাতালে দিয়েছে আর তরাজের বাবাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। তরাজ ওর ছোট ভাইটাকে নিয়ে সেদিন থেকেই ইশকুলে এসে উঠেছে। বাকি তিনজন মেয়ে। দুটো মণ্ডলবাড়ির, আর একটা মোল্লাগঞ্জের মুনির বিশ্বাসের নাতনি। কাল থিকে খাচ্ছে। কেন জানিনা।"
    "ঠিক আছে," মাথা নাড়লো শোভন, "আমি দেখে নিচ্ছি।" এবারে তুই যা। তাড়াতাড়ি ফিরিস। কাশীর দোকানে যদি তেলের জন্য লম্বা লাইন পড়ে তাহলে বলিস এখানে ক্লাশ আছে। তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবে দেখিস। যা।"

    শুভংকর নামের কিশোরটি একটি দ্বিতীয় প্লাস্টিকের জেরিকেন বারান্দা থেকে নামিয়ে নিয়ে লাফাতে লাফাতে বের হয়ে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে।


    এই ছেলেটি শোভনের প্রিয়। তীক্ষ্ণধী, শান্ত ও কৌতুহলী। কোন পাঠ্যবস্তু তাকে একবার বই দুবার দেখিয়ে দিতে হয় না। বাড়ির অবস্থা ভালো। বিদ্যামন্দিরে যেসব ছাত্র খেতে পায় তাদের খোরাকি সপ্তাহে অন্তত দুবার আসে এই শুভদের বাড়ি থেকে। সবসময় যে চালডাল বা আটাময়দা দেন ওঁরা তা নয়। যখন যেমন জোটে। আজকে যেমন, চার কেজি মুড়ি আসছে।

    শুভংকরের বাবা শোভনকে জানিয়েছেন, মাধ্যমিকের পরে ছেলেকে তিনি তাঁর ছোটোভাইয়ের কাছে কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন। ছেলেকে বিদেশে পাঠানো তাঁর স্বপ্ন। তবে হ্যাঁ। ছেলে চলে গেলেও বিদ্যামন্দিরকে, এখন যেমন করছেন তেমনই সাহায্য তিনি করেই চলবেন বলে জানিয়েছেন ভদ্রলোক। একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠলো শোভনের মুখে। সাহায্য! চালডালের ভিক্ষে। অথচ যে সাহায্যটা তার সত্যিকারের দরকার তা তো দেবার জন্য কেউ হাত বাড়ায় না! এতগুলো বছরে কতো নামি ছাত্রই তো বের হয়ে গেল এখান থেকে। তাদের মধ্যে, ফিরে এসে তাকে পড়ানোর কাজে সাহায্য করতে এসেছে এখন অবধি মাত্রই তিনজন। তা-ও গ্র্যাজুয়েশানের পর এখনো চাকরিবাকরি জোটেনি তাই দায়ে পড়ে সময় কাটাচ্ছে বিদ্যামন্দিরে , আর রোজ কলকাতায়, পাটনায়, ভুবনেশ্বরে গাদা গাদা এপ্লিকেশন পাঠাচ্ছে শিকে ছেঁড়বার আশায়। একটা কিছু একবার পেয়ে গেলে এদিকে আর ফিরেও তাকাবেনা ওরা। ফরিদার চিঠিটার কথা মনে পড়লো শোভনের একবার। চিঠিটা পেয়ে প্রথমে আনন্দ হয়েছিলো খুব। কিন্তু---থাক গে! বেশি আশা করা উচিৎ নয়। কেউ থাকে না। বড় বড় কথা যতই লিখুক, শেষমেষ এ-ও থাকবে না।

    অন্ধকার নেমে আসছিলো। জ্বলন্ত হেরিকেন লন্ঠনগুলি হাতে নিয়ে একেকটি ক্লাসের মনিটরেরা রওনা দিয়েছে তাদের ক্লাশের দিকে। অবশেষে, সবাই চলে গেলে, অবশিষ্ট দুটি বাতির একটিকে নিভুনিভু করে নিজের ঘরের মেঝেতে বসিয়ে রেখে অন্যটি হাতে করে শোভন চলল ইলেভেন টুয়েলভের ঘরের দিকে। ওখানে ছাত্র কম। উপস্থিত সাকুল্যে পনেরোজন।

    সকলেই আর্টস গ্রুপ। এরা বিদ্যামন্দিরের মাধ্যমিকের ঝড়তিপড়তির দল। হয় রেজাল্ট ভালো করতে পারেনি, নাহয় ভালো রেজাল্ট হলেও বাড়ি ছেড়ে দূরে বেরোবার অবস্থায় নেই একেবারে। অন্যান্য ক্লাশের ছাত্রদের মতই নামটা এদেরও লেখানো থাকে শোভারাম বয়েজ বা বিরামনগর গার্লসের খাতায়। পুরনো বন্দোবস্ত। শোভনের বিদ্যমন্দিরের ছেলেমেয়েরা সবসময় রেজাল্ট ভালোই করে। তাতে মুফতে ইশকুলের নামডাক বাড়ে। তাছাড়া ওই বেশি ছাত্র দেখিয়ে সরকারি সুবিধেটুবিধেও পাওয়া যায়। কাজেই ওনারা কখনো আপত্তি করেন না।

    সন্ধে সাড়ে আটটা নাগাদ বাইরে থেকে হট্টগোলের শব্দ উঠলো একটা। আওয়াজটা আসছে ক্লাস ফাইভের ঘর থেকে। একটু বিরক্ত হয়েই কন্সটিটিউশনের ওপর বইটা হাত থেকে নামিয়ে রাখলো শোভন। এভাবে পড়ানো যায় না। এই ক্লাস ফাইভেই ছাত্র সবচেয়ে বেশি হয় সবসময়। অবাধ্যতাও সবচেয়ে বেশি। বাইরের সমাজের নিম্নতম স্তর থেকে খুঁটে খুঁটে তুলে আনা ছেলেমেয়েগুলো প্রথম বছরটা সবসময় এরকম অবাধ্য থাকে। অভব্য ভাষা, নোংরা পোশাক, আর সবকিছুর ওপরেই একটা তীব্র অবিশ্বাসের দৃষ্টি থাকে তাদের চোখে। গ্রামের খোলশ ছেড়ে ধীরে ধীরে একটা গঞ্জ হয়ে উঠছে এই মুরলিপুর-বিরামনগরের চৌহদ্দি। চিরপরিচিত পেশা-জীবনধারা-শোষণপদ্ধতিগুলি সবই বদলে যাচ্ছে দ্রুত। গ্রামের বাসিন্দারা যেন হঠাৎ করেই জেগে উঠছে এক পরিবর্ত, অপরিচিত বাস্তবতায়, আর তার ফলে এক নিতান্তই জান্তব সারভাইভাল ইনস্টিংকট, অচেনা এই পারিপার্শ্বিকের প্রতি তাদের মধ্যে জন্ম দিচ্ছে এক তীব্র অবিশ্বাসের। জন্ম নিচ্ছে ক্ষোভ। অন্যদিকে ভিডিও হল, টেলিভিশন, মোবাইলফোনের পর্দা এই প্রতিটি জায়গায় বৈদ্যুতিন পর্দায় ভেসে ওঠা উদীয়মান ভারত নামক এক রূপকথার স্বপ্নপুরীর রঙিন ইশারা এসে তাকে অপ্রাপণীয় অসংখ্য ভোগের স্বপ্ন দেখাতে শেখাচ্ছে। আর সেই স্বপ্নের সঙ্গে রূঢ় বাস্তবের দারিদ্র্যের সংঘাতে জন্ম হচ্ছে রাগের ও তীব্র অভাববোধের। আর এই পরিস্থিতিতে চেতনা লাভ করা এই এলাকার শিশুগুলিও কিছুটা অস্বাভাবিক। তাদের শৈশব চাপা পড়ে যায় এক অকালপ্রৌঢ়তার মোড়কে।

    বহুদিনের অভিজ্ঞতায় শোভন তাই ক্লাস ফাইভে বিদ্যামন্দিরে প্রথম পা রাখা ছেলেমেয়েদের জন্য কোন প্রথাগত সিলেবাসের পড়ার ব্যবস্থা রাখে না। প্রথম বছরটা কাজে লাগানো হয় তাদের সংজ্ঞাহীন শৈশবকে খুঁজে বের করে এনে মানবোচিত রীতিনীতিতে তাকে পুনর্দীক্ষিত করে, স্বাভাবিক করে তুলতে। পড়াশোনার পালা শুরু হয় তার পর।

    শোভন একটু অবাক বোধ করছিল। ক্লাস টুয়েলভের মুন্নি নামের মেয়েটির হাতে এই ক্লাসটির ভার দেয়া হয়েছে গত সাতদিন ধরে। তার প্রজেক্ট ছিল এদের দিয়ে একটা নাটক তৈরি করিয়ে সেটা অভিনয় করিয়ে আগামিকাল সেটা সবাইকে দেখানো। কিছুক্ষণ আগে অবধি সেই রিহার্সালের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল ওই ঘরটি থেকে। হঠাৎ কী হল আবার? প্রথম বেঞ্চের একটি ছেলেকে ইশারা করে সে বলল, "বংকু, একবার গিয়ে দেখে আয় তো, কী হচ্ছে? এত হইচই কিসের?"

    বংকু নামের ছেলেটি উঠে দাঁড়াবার আগেই অবশ্য রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। হো হো শব্দটা একটা স্রোতের মত ছুটে এসে ভেঙে পড়ল তার ক্লাসরুমের দরজায়। একটা কচি গলা ডেকে বলল, "শুভনদাদা! দ্যাখো কে আইসছে!"

    শোভন ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে, একরাশ হাসিমাখা মুখের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন ভুবন দাস। চেহারাটি ভারি শীর্ণ কুব্জ হয়ে গেছে বয়সের ভারে। কিন্তু বলিরেখাংকিত মুখটির মধ্যে চোখদু'টি জ্বলজ্বল করে তাঁর। একহাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন ছোট একটি ছেলেকে। তাঁর আলিঙ্গনের নিরাপদ আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে সে ঘোষণা করল, "ভুবনদাদা এসেছে। আজ কিন্তু তালে আমাদের ছুটি।"

    ভুবনের চোখদুটিতে বালকসুলভ দুষ্টুমি মিটমিট করে। শোভনের দিকে আঙুল তুলে কৃত্রিম কোপ দেখিয়ে তিনি বলে ওঠেন, "হুঁ, ছুটি। আজ আর পড়াশোনা নয় ছোট গোঁসাই। তোমার ওই শুকনো কেতাব উঠায়ে রাখো দেখি। কতদিন পরে আলাম। আজ সবাই মিলে গান হবে।"

    "হুঁ, সে তো বুঝতেই পারছি," মাথা নাড়ালো শোভন, "তুমি এসে পড়েছো যখন তখন আর এরা আমার কথা শুনবে কেন?" বলতে বলতে মাথা ঘুরিয়ে তার উদগ্রীব ক্লাসটির দিকে তাকিয়ে সে বলল, "যা তোরা। আজ ছুটি। উঠোনে আসর সাজা গিয়ে। চারটের বেশি হ্যারিকেন জ্বালাবি না। বাকিগুলো নিভিয়ে বারান্দায় তুলে রাখা হয় যেন। আমরা আসছি।"

    আলো হাতে ছেলেমেয়েগুলো হই হই করে বের হয়ে গেলে অন্ধকারে দুটো বিড়ি জ্বালালেন ভুবন দাস। তার একখানা শোভনের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, "তা এই যাত্রায় কোনদিক ঘুরে আসলা ছোট গোঁসাই? পরশু ট্রেনে তোমার আশ্রমের এক ছোঁড়ার সঙ্গে দেখা। বইলল, তুমি নাকি ভাঁটির দেশে গেছো তোমার মেলার জন্যি গান খুঁজতি। সেই থেকে তক্কে তক্কে আছি। ফিরলিই এসে ক্যাঁক করি ধরবো। সে ছোঁড়া বলিছিল আজ ফিরলি ফিরতি পারো। তাই কপাল ঠুকে চলে আলাম সন্ধেবেলা, যদি ধরতি পারি। তা কাজ হইল কিছু?"

    শোভন মাথা নেড়ে বলল, "হল এবং হল না দুই-ই।"
    "এই দ্যাখো। কথায় কথায় হেঁয়ালি। সোজা কথাটা ভেঙে বলো দেখি?"
    "বলছি। গাজির গানের খোঁজে গেছিলাম, বুঝলে? জয়নগর ছাড়িয়ে সিদুলি, তার থেকে খানিক আগে সুমতি পার হয়ে হীরে রায়ের হাট। তার ওধারে কাঁচা বাদা একেবারে। এই শুকনোর সময় সেখানে লোকজন বনে যায় মধু আনতে। বনে যাবার সময়ে বাঘের ভয়ে কাটান দিতে সেখানে অনেকে গাজির পুজো করেন। এই যে বাঘ তাড়ানো গাজি, তাঁর নামে অনেক গান চালু আছে ও অঞ্চলে। তারই খোঁজে যাওয়া। তা হীরে রায়ের হাটে সে গান অনেক পেয়েছি বুঝলে ভুবনদা? ভারী ইন্টারেস্টিং গান সব।"---বলতে বলতে যুবকটির গলায় সদ্যশ্রুত সেই সঙ্গীতের সুর এসে ভর করেঃ

    "দোয়া নি করিবা আল্লা রে
    মুসলমানে বলে রে আল্লা
    হিঁদু বলে হরি
    নিদানকালে যাবো রে ভাই
    একই পথে চলি
    দোয়া নি করিবা আল্লা রে-----ঠিক যেন লালনের গান। তাই মনে হচ্ছে না ভুবনদা? একই বক্তব্য, একই উপলব্ধি, শুধু সুরে আর উচ্চারণে হেরফের। এ গানটা পেলাম সুমতির ঘাটে বাঁধা একটা নৌকোতে। তার লোকজন তখন গেছে হাটের কেনাকাটা সারতে। এক বুড়ো বাউলে নৌকোয় একলা একলা বসে বসে গাইছিলো। কাছে গিয়ে বসতে একটা দুটো করে অনেকগুলো গানই শোনালো।"

    ভুবন দাস বসে বসে মাথা নাড়ছিলেন। এইবারে বললেন, "খাসা গান। গাজির গান এ মুল্লুকে কেউ বিশেষ শোনে নাই। তা কী কথা হলো? মেলায় আইসবে?"
    "ওটাই তো হলো না ভুবনদা!"
    "কেন? ইচ্ছা নাই?"
    "না না, আসতে তাদের খুব ইচ্ছে। যে বাউলে এ গানটা শোনালেন তাঁকেই ধরেছিলাম। সব শুনেটুনে তিনি বললেন, কার্তিক অঘ্রাণে ওঁদের বেজায় ব্যস্ততার সময়। ও সময় লোকজন দলে দলে বনে যায়। গাজির গান গায় যারা সেই বাউলেদের তখন তাদের সঙ্গে সঙ্গে বনে যেতে হয়। সেসব ছেড়ে গানের আসরে আসা তখন তাঁদের হবে না। ওঁদের সময় হবে বর্ষাকালে। চারিদিক তখন জলে থই থই। বনে যাবে কে? বাউলেদের তখন পেটে গামছা দিয়ে পড়ে থাকবার দশা হয়।"
    "যাঃ বাবা। আইসবে না তবে, "ভুবন দাসের গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে। খানিক বাদে শোভনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে তিনি বললেন, "ও ছোট গোঁসাই, তবে চলোনা কেন একবার তোমাতে আমাতে, ফের ও মুল্লুকে গিয়ে একবার গাজির গান শুনে আসি। কী যে মিঠা গান শোনালে! আগের মাসে ধরিত্রীপুর থেকে যে গান এনে শোনালে তাতে কিন্তু এমন রস মেলে নাই গো। আ-হা-হা, কী কথাই শোনালে! মুসলমানে বলে গো আল্লা, হিন্দু বলে হরি, নিদানকালে যাবো রে ভাই একই পথে চলি----"

    অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ালো শোভন, "হ্যাঁ যাবো ভুবনদা। তবে এখন নয়। পরে কখনো। এখন হাতে আমার অনেক কাজ যে! আরো কত জায়গায় ঘুরতে হবে আমায়! এক জায়গায় দুবার যাওয়া এখন সম্ভব হবেনা আমার।"
    "হ্যাঃ। কাজ! তুমি যে আমার সাক্ষাৎ বিশ্বকর্মা হয়ে গেলা গো ছোটগোঁসাই! অত কাজের ঠ্যাকার কীসের হে তোমার?"
    "কী যে বলো ভুবনদা! নিজে তো গান গেয়ে ঘুরে বেরিয়েই খালাস। ওদিকে আগামি কার্তিকে মেলা। মাঘের শেষ হতে চললো। হাতে আর গোটা একটা বছরও নেই। বিদ্যামন্দিরের কাজকর্ম থাকে, তার ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে ঘুরে একেক জায়গায় গিয়ে গানের খোঁজ করা, গান শুনে, বুঝে, ঠিকঠাক লোককে নেমন্তন্ন করা, সব তো একলা হাতেই সারতে হয়! সে তুমি বোঝ না নাকি?"

    ভুবন দাসের কৌতুকতরল গলাটি স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে এইবারে, "বুঝি গো গোঁসাই, এই মেলা করতে নেমে বেজায় বড় কর্ম হাতে নিয়েছো, ভার তো একটু তোমায় বইতেই হবে। তা সঙ্গে কি কেউই নাই? তাহলে নাহয় আমিই বুড় বয়সে ফের একবার কোমর বেঁধে--"

    শোভন হাসলো, "না ভুবনদা। তোমাকে আর গায়ে খাটতে হবে না। সে লোক আমার জুটে গেছে। বিদ্যামন্দিরেরই দু হাজার পাঁচ আর ছয়ের ব্যাচের কার্তিক সুবিমলেরা জনাদশেক ছেলে নিজে থেকেই এসে দাঁড়িয়ে গেছে। ওদের ব্যাচেরই জনাপাঁচেক অন্য ছেলে এখন কলকাতায়। খবর পেয়ে তারাও সাহায্য করবে বলেছে। কিন্তু, সে যে-যেমনই সাহায্য করুক ভুবনদা, আসল কাজটা তো সেই আমাকেই করতে হবে। গোটা প্ল্যানিংটা, তার পর এই যে বাংলার নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেছেবুছে গানের দল বের করা, তাদের বায়না দেয়া, সে সবটাই তো আমার একলার কাঁধে। সেখানে তো ভার বইবার সামর্থ্য আর কারো নেই ভুবনদা!"

    ভুবন দাস এই মন্তব্যটির কোন উত্তর সঙ্গে সঙ্গে দিলেন না। অন্ধকারের মধ্যে ভ্রু দুটি একটু কুঁচকে উঠছিলো তাঁর। ষড়রিপুর দাস দেহ। রিপুর তাড়না তার থাকবেই। হরকান্তর ছেলেটিও তার ব্যাতিক্রম নয়। অহংকার হয়েছে এ ছেলের। শিক্ষাদিক্ষার আর ক্ষমতার অহংকার! হাতের বিড়িটায় ঘন ঘন দুটো টান দিয়ে সেটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তিনি বললেন, "তার মানে জন খাটবার মুনিষ আছে অনেক তোমার চ্যালাচামুণ্ডাদের মধ্যে, কিন্তু মন খাটাবার যুগ্যি মাথা একখানাই আছে, সে তোমার কাঁধের ওপরে। তাই বলছো তো ছোটগোঁসাই?"

    একটু অপ্রস্তুত বোধ করছিলো শোভন। আক্রমণটার জন্য কোন প্রস্তুতি ছিলো না তার। খানিক বাদে ইতস্তত করে সে বললো, "না মানে আমি বলতে চাইছিলাম-----"
    "সে তুমি যা-ই বইলতে চাও না কেন গোঁসাই, তার সারতত্ত্ব কিন্তু একটাই, সে হলো গিয়ে তোমার এতো সাধের ইশকুল নিয়ে এত তত্ত্ববুলি কপচায়ে শেষমেষ সেই কিছু জনমুনিষই বানায়েছো তুমি। সত্যিকারের কাজের মানুষ কিছু বানাতে পারো নাই। তবে কী কাজ হলো এমন ইশকুলে বলো দেখি গোঁসাই? এমলতা মাস্টারণীর ট্যাকাগুলো জলাঞ্জলি গেল মাঝখান থেকে।"
    "ভুবনদা তার মানে তুমি বলতে চাইছো---"
    "আমি বলতে চাইছি একটাই কথা, নিজের হাতে যে ছেলেপিলেরে বানায়েছ তাদের মাথার ওপরেও যদি তোমার আজ ভরোসা না থাকে তাহলে কাল যে নিজের মাথাটার ওপরেও ভরোসা থাকবে না গোঁসাই! শিষ্যের বুদ্ধির ওপর ভরোসা করতে না পারে যে গুরু, সে গুরু হবার যুগ্যিই নয়।"

    খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে তারপর মাথা নেড়ে শোভন বললো, "কথাটা তুমি ভুল বলোনি ভুবনদা। এদের ওপর সত্যিই কোন ভরসা আমার আসেনা। এতো ছোট ছোট দেখেছি সব, নিজের নামটাও ভালো করে বলতে পারতো না এক একজন। মানছি আজ সব বড়ো হয়েছে, কিন্তু এদের হাতে কোন বড় দায়িত্ব দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো বলছো?"
    "না গোঁসাই। কারণটা তুমি ঠিক বোঝ নাই? দাঁড়াও বুঝায়ে বলি। আচ্ছা ধরো আজ আমার হাতে, কিংবা ধরো যদি হেমলতা দিদিমণি বেঁচে থাকতেন তেনার হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারতা? ভালো করে ভেবে জবাব দিও গোঁসাই।"



    একটু বাদে আস্তে আস্তে মাথা নাড়লো শোভন, "না ভুবনদা। এদিক থেকে কখনো ভেবে দেখিনি, কিন্তু তুমি বললে বলে এখন ভেবে দেখলাম, না। পারতাম না।"

    ভুবন দাস হাসলেন একটু, "আচ্ছা এবার বলো দেখি, সাঁই এই যে এতবড়ো দুনিয়াটা বানালেন, তার ভার তিনি তুচ্ছ মনুষ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে কেমন করে নিশ্চিন্দি আছেন? তিনি তো কই কথায় কথায় সামনে এসে উপদেশ দেন না! কারণটা কি জানো গোঁসাই? নিজের সন্তানরে তিনি যেমন দয়ার সাগর হয়ে দয়া করেছেন, রুদ্র হয়ে শাসন করেছেন, তেমনি দয়া আর শাসনের পাশাপাশি নিজেকে উজাড় করে ভালোও বেসেছেন। ভালোবাসলে তবেই ভরোসা আসে গোঁসাই। তুমি তো কেবল দয়া আর শাসনই করতে শিখেছো সকলকে এতকাল। নিজের জ্ঞানের গরমেই মটমট করতে আছ। ভালোবাসা শিখতে তোমার এখনো ঢের বাকি। আর তাই নিজেকে ছাড়া কাউকে ভরোসা করতেও শেখো নাই। তুমি তাই একলা হে। সব্বাই তোমার নিচে আছে। কেউ তোমার পাশে নাই। এতে অন্যের কোন দোষ নাই গোঁসাই।"

    "ও শোভনদা, আমরা যে চাটাই বিছায়ে হেরিকেন টাঙায়ে বসে আছি তখন থিকে। তোমরা আসবে না নাকি?" চারপাঁচটি ছেলেমেয়ে এসে ঘিরে দাঁড়ালো তাদের দুজনকে। ভুবন দাস তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "ওই দ্যাখো। কথায় কথায় সময় গেলো, ওদিকে আসল কথাতেই ফাঁকি পড়ছিলো যে! ওঠ, ওঠ ছোটগোঁসাই। এর পরে আবার রাত বেশি হয়ে যাবে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো বাড়িতেও তো ফিরবে, না কি?"


    -------------------------------

    ঝুপসি কয়েকটি আমগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বহে আসা অগণিত চন্দ্রশলায় বিদ্ধ উঠানটির ওপর চাটাই পেতে হ্যারিকেন টাঙিয়ে মঞ্চ তৈরি হয়েছে। তার ওপরে শিশুর দলটি আপনমনে তাদের অনুষ্ঠান করে চলে। এই বিচিত্র আসরের মধ্যমণি ভুবন দাস। ক্লাস সেভেনের বীণা নামের একটি কিশোরীকে ডেকে নিয়ে সামনে বসিয়ে কৃত্রিম কোপের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করছিলেন,

    "ছয় গণ্ডা মাছ মারিলাম রাতে
    খাবার সময় একটা কেন পাতে?"
    কিশোরীটির দেখা গেল ছড়াটি অপরিচিত নয়। সে চটপট জবাব দিল,
    "সাঁতলাইবার কালে ভাঙলো হাঁড়ি
    মাছ পালাইলো জলে
    একখান মাছ ধরে রাখলাম
    তোমায় দিব বলে।"
    বৃদ্ধের দুই চোখে কৌতুক খেলা করে যায়। বলেন,
    "সন্দেহ হয় মনে
    হাঁড়ি ভেঙে মাছ পালালো,
    ঝোল রয় কেমনে?"
    জবাব দাও এবারে লোভী বউ। হাঁড়ি ভেঙে মাছ পালালে সে হাঁড়িতে মাছের ঝোল কেমন করে রয়ে যায়? এ প্রশ্নের উত্তর হয় না। অদৃশ্য এক নথের ঝামটা দিয়ে এক অপরূপ মুখভঙ্গি করে কিশোরী জবাব দেয়,
    "অতই যদি জানো
    বিশ্বেসপুকুরের মাছ
    তবে কেন আনো?"

    অমনি হাসির একটা হররা উঠলো গোটা আসর জুড়ে। এই অঞ্চলের এককালের জমিদার বিশ্বাসবাবুদের পরিবার কোন এক কালে বিরাট এক দিঘি খুঁড়েছিল। জমিদারী চলে গেলেও দিঘিটা আজও আছে। গত বিশ বছর ধরে সেই দিঘিতে মাছের চাষ করছেন বিশ্বাসরা। এই দিঘির মাছের স্বাদ এই এলাকায় বিখ্যাত। পুকুরের চারপাশে বিশ্বাসদের কড়া পাহারা থাকে। ফলত সেই দিঘির মাছ বড়ই দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় স্থানীয় মানুষের কল্পনায় সে স্বাদ আরও বহুগুণে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। অতএব সেই নিয়ে রঙ্গরসিকতা। কর্তা রাতে বিশ্বাসদিঘির মাছ মেরে এনেছেন সবার চোখের আড়ালে। লোভে পড়ে গৃহিণী তার একখানা রেখে বাকি সবগুলি আত্মসাৎ করেছে ও স্বামীর চোখে তার দুর্বল মিথ্যা ধরা পড়ে যেতে অন্তিম অস্ত্রটি হেনেছে--বিশ্বাসদিঘির অত সুস্বাদু মাছ নিয়ে এলে কেন তবে? জানো না কি ওর লোভ সামলানো কত কঠিন?

    হাসছিলো শোভনও। কত সহজেই বয়স ও জ্ঞানের বাধাকে অতিক্রম করে যেতে পারেন এই ভুবন দাস! ছেলেমেয়েগুলোও কেমন কোলেপিঠে চাপছে গিয়ে তাঁর। সম্পর্কের এই নৈকট্য শোভন কখনো অনুভব করেনি কারো সঙ্গে। কোথায় যেন সবসময় সুক্ষ্ম একটা দূরত্ব থেকেই গিয়েছে তার সঙ্গে বাকি দুনিয়ার। এই ছেলেমেয়েগুলো কখনও নিজে থেকে তার খুব কাছে আসেনা। তাকে পেছন থেকে এসে শোভনদাদা বলে জড়িয়ে ধরবার সাহস ওদের মধ্যে কারো নেই। শুধু ওরা কেন? কাছে তার কেউ কোনদিনই বিশেষ আসতে পারেনি। একটা ঔদাসীন্যের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে গেছে সকলেই। এখন অবধি একজনই জোর করে ধাক্কা মেরে দেয়ালটা ভাঙতে চেয়েছিলো। মাদ্রি। পারেনি। ধাক্কা খেয়ে ফিরে গেছে সে-ও। সেই যে সেবারে আতাখালির হাটের মোড় থেকে দুজনের পথ দুদিকে ভাগ হয়ে চলে গিয়েছিলো, তারা আর মেলেনি। মিলবেও না কখনো। আচ্ছা, এই জন্যেই কি তবে তার কাছে কেউ ফিরে আসেনা কখনো? কৃতজ্ঞতাবোধ বা কর্তব্যবোধের বাইরে আর কোনও দাবি সে কখনও রাখেনি কারো কাছে। ভালোবেসে তো কখনো কাউকে বলেনি সঙ্গে থাকো? নিজের ছাড়া অন্য কারো বুদ্ধির ওপর যে সে ভরসা রাখতে পারেনি কখনো সে-ও কি তবে এই ভালোবাসার অভাবের জন্যই। হবেও বা। বৃদ্ধ মানুষটির কথাগুলো আজ তাকে নতুন করে ভাবাচ্ছিলো।

    যে গুরু নিজের হাতে তৈরি শিষ্যের বুদ্ধির ওপরে ভরোসা রাখতে পারে না সে গুরু হবার যোগ্য নয়। সে ভরোসা আসে ভালোবাসার থেকে। ভালোবাসা কোথায় তার মধ্যে?

    একটা হাহাকার তৈরি হচ্ছিল তার বুকের ভেতরে। ভুবন দাস আজ যেন একটা আয়না ধরে দিয়ে গেলো তার মুখের সামনে!



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • | | | ৪ | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments