• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫২ | অক্টোবর ২০১২ | উপন্যাস
    Share
  • যাত্রী: তৃতীয় পর্ব (১) : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য



    || ১ ||

    “কিষ্টগোবিন্দপুর আগে আসবেন গো, কিষ্টগোবিন্দপুর—”

    জমাট ভিড়ের দেয়াল পেরিয়ে সামনের দরজার কাছ থেকে কণ্ডাকটরের হাঁক ভেসে আসছিল। ফরিদা ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসল। তারপর শোভনকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, “এই—”

    শোভন স্বপ্ন দেখছিল বোধ হয় কোন। একবার মাথা তুলে বিভ্রান্তভাবে চারদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলে উঠল। তারপর ফের মাথাটা ঢুলে এল তার।

    বাইরে ভরা দুপুরের রোদে ধুলো উড়িয়ে বাস চলেছে ঢিমে তেতালা চালে। জানালা দিয়ে মাঝেমাঝেই কাছেদূরে জলঙ্গীর দেখা মেলে। ভরা শীতে তার শরীর শীর্ণ।

    ফরিদা ফের একবার শোভনের কাঁধটা ধরে নাড়া দিল, “এ-ই, শুনছো? নামতে হবে তো!”

    “ব্যস্ত হইয়েন নাগো মা জননী, ঘুমায়ে নিক আরেকটু,” পাশে বসা আধময়লা কালো পোশাকপরা মানুষটি হাসিমুখে বলে উঠলেন হঠাৎ।

    ফরিদা মাথা নাড়লো, “একটু আগে থেকে উঠে না এগোলে ভিড় ঠেলে নামতে পারবো না।”

    মানুষটি হাসি হাসি মুখে ফের বললেন, “সে আপনি ভাববেন না। আমরাও তো ওইখানেই নামবো সব। ওই ব্যাটা রজব আলি কণ্ডাকটারের স্বভাবই এমন হাঁকডাক করা। সবে কিশোরপুর ছাড়ালাম। এখনো আধাঘন্টার ধাক্কা। তা বাদে, কেষ্টগোবিন্দপুরে গাড়ি রুকবেও বেশ খানিক। গাড়ি, মানুষ দু-ই জল খাবে, বিশ্রাম নেবে। সে-ও প্রায় ধরেন গে আরো বিশ মিনিট!”
    “বিশ মিনিট নয়, হাতে গোণা পাঁচ মিনিট রুকবো আজ আনিসুলদা। পনেরো মিনিট লেটে যাচ্ছি। পরের গুমটিতে গিয়ে ফাইন খেতে হবে,” ভিড়ের ওপার থেকে কণ্ডাকটরের গলা ভেসে এল। এত শব্দের মধ্যেও পরিচিত গলাটি সে ঠিকই শুনতে পেয়েছে।
    “আরে রাখো তোমার ডরপুকি কথা। ওসব ফাইনটাইনের ভয় তুমি আবার কবে পেলা? তুমি না আঠারোগাঁয়ের মরদ? দাঁড়াও, গিয়ে পড়ি আজ একবার, সবাইরে ডেকে না বলিছি এই কথা—”

    কথা বলতে বলতে এক বালকসুলভ দুষ্টুমি খেলা করে যাচ্ছিল মানুষটির কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফে ঢাকা মুখটিতে। তাঁর কাঁধে পেটফোলা ঝোলাব্যাগ একখানা। তার গায়ে নানা রঙের তালি। পিঠে ময়লা খোলে দোতারাটি বাঁধা। সামনে পিছে নানান সিটে তাঁর আরো তিনচারজন সঙ্গী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছেন।

    কণ্ডাকটর ততক্ষণে ভিড় ঠেলে পেছনের দিকে এগিয়ে এসেছে। বছর বিশবাইশের ছেলে একটি। শ্যামবর্ণ দোহারা চেহারা। হাসি হাসি মুখ। কাছে এসে আনিসুল নামের মানুষটির সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “যাও কোথা? আঠারোগাঁ নাকি মক্তবপুর?”
    “আঠারোগাঁ যাবো। মক্তবপুরের আসর শেষ না?”
    “উঁহু, কাল অবধি চলবে। তবে মেলাটেলা কিছু নাই আঠারোগাঁয়ের মত। মাজারে বসে শুকনা গানবাজনা—”
    “আরে জানিরে বাবা, সব জানি। কালকের ছোকরা এলেন আমারে আঠারোগাঁ আর মক্তবপুরের ব্যাপারে জ্ঞান দিতে,” বিরক্ত গলায় বললেন আনিসুল। তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ফের বললেন, “আরে তোর আঠারোগাঁয়েই বা কত মেলাটেলা হয়েছে বল দেখি আগে? কলকাতার গান কোম্পানির নজর এসে পড়ল বলেই না আজ এত রমরমা!”

    তরুণটির চোখে দুষ্টুমির ঝিকিমিকি খেলে যায়। আনিসুলকে রাগিয়ে দিয়ে বড় মজা পাচ্ছে সে। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “সে তুমি যা-ই বলো আনিসুলদা, গান কিন্তু মক্তবপুর ফকিরবাড়ি থিকে আমাদের আঠারোগাঁয়ের বিষ্ণু বাউলের আসরেই বেশি ভালো হয়। নইলে ক্যাসেট কোম্পানি মেলা করবার জন্য মক্তবপুর ছেড়ে আঠারোগাঁকে বাছবে কেন?”
    “সে তোর আঠারোগাঁয়ের কপাল,” মাথা নাড়লেন আনিসুল, “গান আমি আগে এই দুই আসরেই অনেকবার শুনেছি রে! গেয়েওছি দু জায়গাতেই। কেউই কম যায় না। এবারেও এসে যখন পড়েছি, আর মক্তবপুরের আসর যখন আরো একদিন আছে তখন সেখেনেও একপাক ঘুরে যাবো। বলি ও হরিদাস, যাবা নাকি কাল মক্তবপুরের আসরে? ঘুরে আসি, কী বলো?”

    সামনে দুই সারি আগে বসা কালো, বিশাল চেহারার তরুণটি বলল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, আজ রাতের বেলা আঠারোগাঁয়ের আসর তো সামলাই আগে! তার পরে, কাল যদি আর চান্স না পাই তখন দেখা যাবে।”
    “না মানে বলছিলাম মক্তবপুরে উমের খাঁসাহেবের মাজার আছে কিনা! বড় পাকপবিত্র থান। ভক্তিভরে গানবাজনাও হয় এখনো। সেখানে একবারটি যেতেই হবে রে!”
    “থামো দিকি এবারে তুমি কাকা!” ঝাঁঝিয়ে উঠলো ছেলেটি, “কীসে আর কীসে? কলকাতা থেকে রেডিও টিভির বাঘা বাঘা লোক এসে আঠারোগাঁয়ের মেলা করছে। যন্তরপাতি দিয়ে আসর ভরে দিয়েছে যাকে বলে। রোজ টিভিতে তার ছবি দেখাচ্ছে। ট্যাকাপয়সাও কিছু কিছু দিচ্ছে শুনতে পাই। সে আসর ছেড়ে তোমার কেবল মক্তবপুরের ভাঙা মাজারে যেতে মন। যত্তোসব!”

    আনিসুল বেশ রেগেছেন দেখা গেল। চাপা গলায় তরুণটিকে ধমক দিয়ে বললেন, “উমের খাঁয়ের মাজারের নিন্দে করিস না হরিদাস। জাগ্রত থান।”
    “আরে রাখো কাকা তোমার জাগ্রত। গতবার ওই আঠারোগাঁর থিকে সর্বেশ্বর আর লালচাঁদ এই দুজন কেমন উঠলো দেখলা না? কলকাতা থিকে ক্যাসেট বের হল। এখন আবার টিভিতে পোগ্রাম দ্যায়। তোমার জাগ্রত থানে হাতেগোণা দশটা লোককে গান শুনিয়ে আর মুসিয়েরের আখড়ায় ডালভাত খেয়ে ও জিনিস মিলবে? গিয়ে হয়তো দেখবা উমের খাঁয়ের ব্যাটা মুসিয়ের নিজেই আঠারোগাঁয়ের মেলাতে গিয়ে জুটেছে মক্তবপুর ছেড়ে।”

    শোভন কখন যেন ঘুম ভেঙে উঠে সেই কথোপকথনে মন দিয়েছিল। হঠাৎ সে মন্তব্য করল, “না গো। সেটা হবে বলে মনে হয় না। মুসিয়ের বাজারে গান বেচে বলে তো শুনি নাই এখনো।”

    আনিসুলের শীর্ণ মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল হঠাৎ। শোভনের কাঁধের ওপর হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন, “হক কথা বলেছেন গো। উমের খাঁ দশ পুরুষের অতবড় জমিনদারী বিলিয়ে দিয়ে ফকির হলেন। সে মানুষের ছেলে মুসিয়ের কি কখনো বাজারে বসে গান বিক্কিরি করতে পারে নাকি? সে করলে করবে আমাদের মত পোকামাকড়ে, নাকি গো বাবা?”

    শোভন একটু অপ্রস্তুত মুখে বলল, “না না মানে আমি সে কথা বলি নাই—”
    “তুমি বল নাই বটে, কিন্তু আমি বলিছি। পোকামাকড় ভিন্ন আমরা আর কী? কৃপার আশায় মাটি কামড়ে পড়ে আছি। যেদিন কৃপা হবে—” প্রৌঢ়ের চোখদুটি কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আসে হঠাৎ। একটু বাদেই সেই বিষণ্ণতাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হাসি হাসি মুখ করে ফের প্রশ্ন করলেন তিনি, “তা তোমাদের কোনদিকে যাত্রা গো বাবা, মা?”
    “আমরাও আঠারোগাঁয়ের আসরেই যাবো বলে বের হয়েছি। ওখানেই থাকবো দু রাত—”
    “মা জননীকে নিয়া গান শুনতে আসছো বুঝি? ভালো ভালো। তা আসা হচ্ছে কোথা থেকে?”
    “মুরলীপুর। চেনেন নাকি? শান্তিহাটের কাছে।”

    প্রৌঢ় হাসলেন, “যাই নাই কখনো, তবে নাম জানি। বিরামনগর গেছিলাম একবার গানে। ওর কাছেই তো মুরলীপুর?”
    “হ্যাঁ। আপনারা কোত্থেকে গো—”

    —কথায় কথায় রাস্তা ফুরিয়ে আসে দ্রুত। কিশোরপুর ছাড়িয়ে উত্তরমুখো কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ একটি তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে গাড়ি পশ্চিমমুখী হতে আদিগন্ত ফসলহীন ক্ষেতের সীমান্তে নগরচিহ্ন দেখা গেল। পথের ধারে কিছু দোকানপাট, ঘরবাড়ি, মানুষজনের আনাগোনা। দেখতে দেখতে বাস এসে দাঁড়াল একটি বাজার এলাকায়, কংক্রিটের তৈরি একটি ছোট শেডের সামনে। আনিসুল বললেন, “এসে গেলাম। চলেন গো এইবারে।”

    শেডটির নিচে সিমেন্টের বেঞ্চ বানানো রয়েছে। ফরিদা সেখানে গিয়ে বসল। এই ভরা দুপুরেও ছায়ার নিচে বসলে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে একটুখানি এখানে। শোভন তাকে বসিয়ে রেখে চায়ের খোঁজে গিয়েছে। ফরিদা বসে বসে আনিসুলদের জিনিসপত্র নামানো দেখছিল। ফকিরের দলটি ছোট। তিনি নিজে বাদে আর চারজন আছে দলে। হরিদাস ছেলেটি শ্রীখোল বাজায়। দোতারাতেও হাত নাকি ভালো তার। গলায় সুরও আছে। আসাদ নামে আরো একটি কিশোর রয়েছে দলে। সদ্য ভাঙা গলায় সর্বদাই তার সুর ভর করে আছে। দলের অন্য দুই সদস্য তুলনায় একটু বেশি বয়সী, একটু বেশি নীরব। আসরে তাঁরা বাঁশি ও হারমোনিয়াম বাজান।

    পোঁটলাপুঁটলি নামিয়ে আনিসুল এসে ফরিদার পাশে বসে জিজ্ঞাসা বললেন, “কথায় কথায় জিগেস করতেই ভুলে গেছি, মায়ের আমার নামটি কী গো?”

    ফরিদা অন্যমনস্কভাবে নিজের নাম বলল।

    “নতুন বিয়ে হয়েছে মনে হয়?”

    ফরিদার সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়া দেখে মৃদু হেসে ফের বললেন, “কোন খ্যাপার গলায় যে মালা দিলা মা গো! বিয়ের পরে ভদ্রলোকের ছেলে নতুন বউ নিয়ে কোথায় হিল্লি যাবে দিল্লি যাবে বেড়াতে, তা না, জোড়ে গান শুনতে চলল আঠারোগাঁয়ের আসরে।”
    “কেন? আঠারোগাঁ খারাপ হল কিসে?” দু ভাঁড় চা হাতে করে শোভন এসে ঢুকতে ঢুকতে পাল্টা মন্তব্য করল। একটা ভাঁড় ফরিদার হাতে ধরিয়ে দিয়ে অন্যটা আনিসুলের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে, “নাও, চা খাও।”

    আনিসুল মাথা নেড়ে বললেন, “উঁহু, ও তুমি নাও বাবা, আমাদিগের এখন চা চলবে না যে। আগে চান সারতে হবে।”

    স্নানের কথা শুনে ফরিদা কৌতুহলী চোখে তাকাচ্ছিল আনিসুলের দিকে। সেটা নজর করে, ছোট্ট ভাঁড়টি এক চুমুকে শেষ করে বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে শোভন প্রশ্ন করল, “এখানে স্নান করবে কোথায়? একটা কলটলও তো দেখিনা কোথাও?”

    ফরিদার কৌতুহলী নজর আনিসুলের চোখ এড়ায়নি। সে তাড়াতাড়ি বলল, “সে জায়গা আছে। ভালো জায়গা। যাবা নাকি? মা জননীর জন্য ঘেরা জায়গারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

    শোভন ফরিদার দিকে চাইল একবার। ফরিদার চোখে সম্মতির চিহ্ন। দিনে দুবার স্নান করবার অভ্যাস তার। আগের দিন গোটা দিনরাতটাই কেটেছে তাদের সুতিয়ার মেলায়। স্নানের কোন সুযোগ সেখানে ছিল না।

    “তবে আর দেরি কোরো না। উঠে পড়ো,” বলতে বলতে শোভন হাত বাড়িয়ে ফরিদার ঝোলাব্যাগটাও নিজের ব্যাগের সঙ্গে কাঁধে তুলে নিলো।


    || ২ ||

    দোকানপাটের ভিড় ছাড়িয়ে, পাকারাস্তা থেকে নেমে একটা শুঁড়িপথ মাঠকোনাকুনি পশ্চিমমুখে জলঙ্গীর দিকে চলে গিয়েছে। জমি থেকে হাতদুয়েক উঁচু পথটির গায়ে বর্ষার সময়কার নরম কাদার বুকে মানুষ এবং গো যানের চলাচলের চিহ্ন ধরা আছে এখনো। অসমান সেই পথে সাবধানে চলতে হয়। মিনিট দশেক হাঁটবার পর রাস্তার অপর প্রান্তে পৌঁছে ফের বসতির দেখা মিলল। ছোট গ্রামটি। নির্জন দুপুরে তার দেহে শিরশিরে হাওয়ামাখা রোদ ছেয়ে আছে।

    রাস্তাটি গ্রামের মধ্যে ঢুকে ধীরে ধীরে পশ্চিমদিকে ঢালু হয়ে গেছে। শোভন সেই পথে আনিসুলদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে বলতে এগিয়ে গিয়েছে বেশ কিছুটা আগে। ফরিদা ধীরে ধীরে চারদিকে দেখতে দেখতে আসছিল। টালি কিংবা টিনের চালওয়ালা বাড়িগুলি এখন নিঃঝুম। মাঝে মাঝে দুপাশের নিবিড় বাঁশবন পথের ওপর ছায়া ফেলেছে। দুপুরের খাওয়া পর আলস্যে গা এলিয়ে আছে গোটা গ্রাম। বাড়িগুলির উঠানে কিংবা কোথাও কোথাও রাস্তায় ওপরেই ধান রোদে দেয়া হয়েছে। তার থেকে সোঁদা গন্ধভরা ভাপ ওঠে। পাশে কঞ্চি হাতে পাখি তাড়াবার জন্য বসে থাকা প্রহরীদেরও চোখ বুঁজে এসেছে। ক্বচিৎ কেউ চোখ খুলে দেখে নেয় ভরা দুপুরে তাদের গ্রামে ঢুকে পড়া এই অপরিচিত তরুণীটিকে।

    “দিদি,”
    চমক ভেঙে তাকিয়ে ফরিদা দেখে আসাদ নামের সেই কিশোরটি তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সবে হালকা গোঁফদাড়ি বের হয়েছে তার। কিশোর বয়সের লজ্জাভাবটুকু এখনো যায়নি। চোখ নিচু করে রেখেই বলল, “ঐ দাদা বলল তাড়াতাড়ি করি আসতে। বলে, দুটা বেজে গেল—”

    কবজি উল্টে ঘড়ি দেখল ফরিদা। দুটো বেজে দশ। সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে।
    “ইশ, খেয়াল করিনি। অনেক বেলা হয়ে গেল। চল চল।”

    তাড়াতাড়ি পা চালালো তারা দুজন এবারে। চলতে চলতে ফরিদা জিজ্ঞাসা করল, “আনিসুল ফকির তোর কে হন রে?”
    “কাকা হয়।”
    “তোর বাবা কী করেন?”

    কিশোরটি চলতে চলতেই ঠোঁট ওলটালো একবার, “বাবা নেই।”
    “মা ?”
    “আছে। ”
    “চলে কি করে তোদের—”

    ফরিদার গলায় কোন এক কাম্য অথচ দুর্লভ সহানুভুতির স্পর্শ পেয়েছিল বোধ হয় কিশোরটি। আর কোন প্রশ্ন করতে হয়না তাকে। আপনা আপনিই সে তার গল্প বলে যায়। তাদের জমিজমা এককালে মন্দ ছিল না। বাবাই সব দেখাশোনা করতেন। কাকাটি তার গান গেয়ে ঘুরে বেড়াতেন আসরে আসরে। বিয়েশাদি করেন নি। আসাদের সাত বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। তার পরেও প্রথমদিকে বিশেষ কোন সমস্যা হয়নি তাদের। কারণ, বাউণ্ডুলেপনা ছেড়ে চাষবাস, জমিজমার ভার কাকা পুরোপুরি নিয়ে নিয়েছিলেন। বিয়ের কথাবার্তাও এগোচ্ছিল কাকার। কিন্তু তারপর কী থেকে কী যে হল, আনিসুল সংসারী কাজকর্ম ছেড়ে পথে নামলেন ফের—এবার একেবারে পাকাপাকি, ফকিরি ব্রত গ্রহণ করে। বসতবাটি আর দশ বিঘা ধানী জমি আসাদের মায়ের ভরণপোষণের জন্য রেখে দিয়ে বাকি সম্পত্তি একরকম বিলিয়েই দিয়েছেন তিনি। আসরে আসরে গান গেয়ে ঘোরেন। আজকাল আসাদকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে শুরু করেছেন। আসাদ বাঁশি বাজায়। ওতে তার এলাকায় নামডাকও হয়েছে খানিক। একটু আধটু গানও গায় কোন কোন আসরে। তা বাদে আজকাল দু একটা করে গান বাঁধতেও শুরু করেছে সে। কাকা বলেছেন, লেখার হাত ভালো নাকি তার।

    ফরিদা কৌতুহলী চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “নিজে গান বাঁধিস? কই, শোনা তো একটা।”

    তার সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কথা বলতে বলতেই কিশোরটির সমস্ত সংকোচ কেটে গিয়েছিলো। ফরিদার মুখের দিকে তাকিয়ে সে নিচু গলায় গান ধরল,

    “সাক্ষি রইলেন পঞ্চভূত গো—
    সাক্ষি রইলেন গুরু
    সাক্ষি রইলেন অন্তর্যামী
    আমার পথচলার শুরু হে গুরু—
    পথচলার শুরু—
    পথের শেষে মকান যার সেই
    ভালোবাসার জন
    তারই মুখচন্দ্রখানি
    স্মরি অনুক্ষণ হে গুরু
    স্মরি অনুক্ষণ—”
    কথাগুলি সরল ও সুন্দর। এখনো তাতে রসোত্তীর্ণ পদের গুণগুলি পুরোপুরি আসেনি, কিন্তু সম্ভাবনাটি আছে পুরোপুরি। প্রচলিত সুর। আসাদের গলাটিও সুরেলা। কিন্তু এখনো ভারসাম্যহীন। অবাঞ্ছিত ওঠাপড়ার দোষ রয়েছে তাতে। নিজের সঠিক স্কেলটিকে এখনো সম্ভবত খুঁজে পায়নি সে। তার সঙ্গে খানিক গুণগুণ করে নিয়ে ফরিদা এইবারে সুরে সুর মেলালো। তারপর তার চর্চিত গলাটি সঠিক মাত্রায় গানটিকে বেঁধে দিয়ে কিশোরটির গলাটিকে সঙ্গে নিয়ে এক সুশ্রাব্য উড়ালে ভেসে গেল সেই ঢলে আসা মধ্যাহ্নের নির্জন বাতাসে।

    গান শেষ হতে আসাদ অবাক হয়ে ফরিদার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে বলল, “তুমি এত ভালো গাও—”

    তার কিশোর চোখের মুগ্ধতাটি চোখ এড়াচ্ছিলো না ফরিদার। আসাদ নিজে এখনো নিজেকে পুরোপুরি জানে না, কিন্তু পুরুষের চোখের মুগ্ধ দৃষ্টি চিনতে মেয়েদের ভুল হয়না। একটু অস্বস্তিভরা গলায় প্রসঙ্গ পাল্টালো সে, “গান গাইছিস, গান বাঁধছিস সে তো ভালো কথা। কিন্তু লেখাপড়ার কী হল। কদ্দূর পড়েছিস?”
    “পড়েছি। ফোর অবধি।”
    “আর পড়তে ইচ্ছে যায় না?”
    “না দিদি। ও দিয়ে আমার হবে কী? আর তাছাড়া চাইলেও আর পড়াতো কে?”



    হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে তার কাঁধে হাত রাখল ফরিদা, “ওসব কে, কী এত প্রশ্ন বাদ দে তো! এইটুকু বয়সে এমন গান বাঁধছিস তুই! বড় হয়ে ভালো পদকর্তা হবি দেখিস। তার জন্যে গোড়ায় একটু পড়াশোনা করে নিলে ভালো হয়। তুই পড়তে চাস কিনা তাই আগে বল। আমাদের একটা ইশকুল আছে। তুই চাইলে সেইখান থেকে তোর পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। অন্তত ইশকুল ফাইনালটা পাশ করে নে। আমাদের কাছে থাকবি-খাবি, ইশকুলের কাজকর্ম করবি, পড়াশোনা, গানবাজনা সবই চলবে। কীরে—”

    তার দিকে চোখ পেতে তাকিয়ে রইল আসাদ। তারপর বলল, “উঁহু। ও বিদ্যেয় আমার কাজ নাই। মাছ রইল গভীর জলে, কিনারে জাল ফেলি লাভ কী বলোতো দিদি? বলতে বলতে তার গলায় সুর গুণগুণ করে ওঠে—”

    “শুধু মাছ ধরতে বাসনা
    জাল ফেলতে জানোনা
    জল দেখে জাল জড়িয়ে পড়ে
    ছড়িয়ে পড়ে না
    তুমি, কিনারাতে দিচ্ছো খেয়া
    মাছ রইল অগাধ জলেতে—”
    “হয়েছে, হয়েছে, থাম এবারে তুই। এইটুকু ছেলে সে এলো আমায় তত্ত্বকথা শেখাতে। পাকা ছেলে কোথাকার—”

    —হঠাৎ ফরিদার গলায় উষ্মার স্পর্শ পেয়ে মাঝপথে গান থামিয়ে দিল আসাদ। গ্রামের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে তারা ততক্ষণে জলঙ্গীর কিনারায় এসে পৌঁছেছে। একটা সুবিশাল বটগাছ এইখানে নদীর পাশে অনেকটা এলাকা জুড়ে ছায়া ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তার ইঁটবাঁধানো গুঁড়িটিতে ঘাসের আস্তর। ঝোলাটোলা সব সেইখানে নামিয়ে রেখে আনিসুলের দলটা বসেছিল। বিড়ির নীলচে ধোঁয়া শাখাপ্রশাখা ছড়িয়েছে ছায়াঘেরা জায়গাটা জুড়ে। গাছের একপাশে দুটি ছোট ছোট টালিছাওয়া পাকা ঘর ও একফালি বারান্দা। ঘরগুলোর দরজা হাট করে খোলা রয়েছে। ফরিদা এদিক ওদিক তাকিয়ে আনিসুলের কাছে গিয়ে একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল, “আনিসুলদা, শোভন কোথায় গেল?”
    “আসছে আসছে। দিনুর জলের কলসি নিয়ে নদীতে গেছে তোমার চানের জল তুলতে।”

    ফরিদা একটু অবাক হয়ে সামনের বাড়িটার দিকে দেখছিলো। তার দারিদ্র্যলাঞ্ছিত, অযত্নের ছাপ-মোড়া শরীরে মানুষের নিয়মিত বসবাসের সুস্পষ্ট চিহ্ন। অথচ দরজাগুলি হাট করে খোলা। মালিকের চিহ্ন নেই। তার দৃষ্টি লক্ষ্য করে আনিসুল বলল, “ভাববার কিছু নাই মা। এ আমাদের দিনু বৈরিগির আখড়া। কখন থাকে কখন না থাকে তার ঠিক নাই কোন। যখন বার হয়, ঘরের দরজা অমনি হাট করে রেখে চলে যায়। এ দিককার পথচলতি বাউল-ফকির সবাই দিনু বৈরাগির আখড়ার খবর জানে। দিন হোক, রাত হোক দরকার হলেই চলে আসে এখানে। তারাই ব্যাভার করে একটু গোছগাছ করে রেখে যায়, তাইতে—”
    “ফরিদা, এসে গেছো? চলো, ভেতরে চলো,” বলতে বলতে জলভরা মাটির কলসিটাদুটো দুহাতে ধরে শোভন নদীর পাড় বেয়ে উঠে এলো এক দৌড়ে।
    “অত দৌড় কীসের গো? পড়ে গেলি শেষে এক চিত্তির বাধবে—” আনিসুলের গলায় উদ্বেগের স্পর্শ।

    শোভন তার দিকে ফিরে বলল, “ভালো বুদ্ধি তোমার আনিসুলদা। খাড়া পাড়। দুহাতে দুখানা কলসি, এক দৌড়ে না উঠলে ব্যালেন্স হারিয়ে উল্টে পড়তাম যে—”
    “সে তুমি যতই ব্যাখ্যানা করো, পাঁচ আঙুলে ভাত তো আমরাও মেখে সেবা করি, না কী? কার জন্যে তোমার এত তাড়া সে আমি বুঝিনা ভেবেছো? এখন যাও—”
    “উঃ, একে নিয়ে না আর পারা গেল না। এসো ফরিদা—” বলতে বলতেই কলসিদুটো হাতে করে দিনুর ঘরদুটোর দিকে এগিয়ে গেল শোভন।

    দুটো ঘরের মধ্যে দিয়ে সরু একফালি গলি। সেখানে অযত্নে বেড়ে ওঠা আগাছার ভিড় মাড়িয়ে খানিক এগিয়ে ভেতরবাড়ির উঠোন। তার একপাশে তুলসীমঞ্চ। অন্যপাশে একটি সমাধির গায়ে বহুকালের পুরোন একটি শুকনো ফুলের মালা। সমাধিটির ওপরে ঝুঁকে রয়েছে স্থলপদ্মের একটা পাতাওয়ালা ঝাড়। তার পেছনে গিয়ে কলসিদুটো নামিয়ে রেখে শোভন বলল, “এখানটায় স্নান সেরে নাও। আমি ওপাশে উঠোনের মুখে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। কেউ আসবে না।”

    ফরিদা তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ তার পিঠে হাত দিয়ে বলল,“এই শোন, এদিকে তাকাও একবার—”



    শোভন ঘুরে দাঁড়াতেই হঠাৎ সুকঠিন বাঁধনে তাকে বুকে জড়িয়ে নিল ফরিদা। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চোখের ইশারায় বলল, “চুপ—”

    তখন সেই যুগলমূর্তিকে ঘিরে মাথা ঝুঁকিয়ে রইল মেঘমুক্ত শীতের আকাশ। তাদের শরীরে আলোছায়ার জাফরিকাটা আবরণ ছড়িয়ে দিল পশ্চিমগামী সূর্য আর সেই প্রিয়সান্নিধ্যের সাক্ষি রইল কোন অনামা বৈষ্ণবের সমাধি আর বিগতপুষ্প সেই গাছটি।

    ক’টি মুহূর্তই বা। তবু যেন এক অনন্ত সময় পার হয়ে গেল চোখের পলকে। তারপর, যেমন স্বেচ্ছায়, অযাচিতভাবে এসে সহজে ধরা দিয়েছিল সে তেমনই সহজে শোভনের বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ফরিদা বলল, “এবারে বাইরে যাও। নইলে হঠাৎ কেউ এসে পড়লে—”

    শোভন যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল হঠাৎ। তার মুখে তখনো লেগে রয়েছে প্রিয় নারীটির স্পর্শের কবোষ্ণ স্বাদ ও গন্ধ।

    “বাবা কোথা গেলে গো? আসো, আসো, চান সেরে নেও তাড়াতাড়ি। বেলা গেল যে। এর পরে নৌকা মিলবে না বলে দিলাম,” আনিসুল বাইরে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন হাঁক দিচ্ছিলেন।
    “ওই যে, ডাক পড়েছে। এখন যাও। নইলে শেষে ভেতরে ঢুকে আসবেখন। আমি তাড়াতাড়ি—,” শোভনের দিকে পেছন ঘুরে সোয়েটারের বোতাম খুলতে খুলতে ফরিদা বলল। তার দ্রুতসঞ্চরমান শরীরটির দিকে লোভের দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে নিয়ে পিছু ফিরল শোভন।

    বাইরে গাছতলায় ততক্ষণে আনিসুলের ঝোলা থেকে একটা প্লাস্টিকের বোতলভর্তি সর্ষের তেল বের হয়ে এসেছে। একটা নারকেলের মালায় তেল ঢেলে নিয়ে গায়ে মাখছিল তারা। শোভন নিঃশব্দে এগিয়ে এসে জামাকাপড় খুলে একপাশে স্তূপ করে জমিয়ে রেখে কোমরে একটা গামছা জড়িয়ে একখাবলা তেল তুলে নিল হাতে।

    ধীরগামিনী জলঙ্গী এইখানে বেশ গভীর। খাড়াই পাড় বেয়ে জলের ভেতর দুতিনটি পদক্ষেপ এগোতেই বুক অবধি জল। শীতের প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে যেতে ভারী আরামের একটা অনুভুতি ছড়িয়ে পড়ল তার রৌদ্রতপ্ত, ভ্রমণক্লান্ত দেহে। দ্রুত তিনচারটি ডুব দিয়ে উঠে জলের ওপর শরীরটি ছড়িয়ে দিল সে—

    ------------

    —স্নান সেরে উঠে এসে শোভন দেখে ফরিদা কখন এসে বটগাছতলায় বসে আছে। সাদা খোলের একট সরুপাড় শাড়ি পরনে। তার চুল থেকে তখনো একটু একটু জল ঝরছিলো। নিচে জলের বুক থেকে আনিসুলদের কথাবার্তার শব্দ আসছিল। ধীরেসুস্থে গল্পগাছা করতে করতে স্নান সারছে তারা। পোশাক বদলে শোভন এসে ফরিদার পাশে বসল। ঝরঝর করে হাওয়া দিচ্ছিল। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল শোভনের।

    “দাঁড়াও, চাদর বের করে দিচ্ছি একটা। মুড়ি দিয়ে বোসো,” ঝোলার ভেতর হাত চালিয়ে একটা চাদর বের করে আনতে আনতে ফরিদা বলল। তারপর একটু ইতস্তত করে বলে, “একটা কথা ভাবছিলাম। আসাদকে দেখলে তো? ওর ব্যাপারে—”
    “ওর ব্যাপারে—কী?”
    “না-মানে—ছেলেটাকে আমি ইস্কুলে নিয়ে গিয়ে পড়াশোনা শেখাতে চাই। তুমি কী বল?”

    শোভন হাসল, “তোমার ইচ্ছে। তাতে আমি আর কী বলব? কিন্তু হঠাৎ এরকম ইচ্ছে হল যে? আনিসুল বা আসাদ তোমায় কিছু বলেছে?”
    “না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, ছেলেটা ঠিক পথে চলছে না। ছোটবেলায় বাপকে হারিয়ে এখন এই বয়সেই ফকিরগিরির শিক্ষানবিশীতে নেমে গেছে কাকার পাল্লায় পড়ে। আসতে আসতে জিজ্ঞাসা করলাম ইশকুলে আরো পড়তে চায় কিনা। তাতে পড়াশোনার অনিত্যতা নিয়ে লম্বা এক গান শুনিয়ে দিল আমাকে।”
    “তাতে দোষটা কী হল? ফকিরি দর্শন যদি ওর রক্তে থাকে তাহলে—”

    ফরিদা মাথা নাড়ল, “ফকিরি কোন জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নয় শোভন। ওটা পরিণত মনের একটা অর্জিত বৈশিষ্ট্য। ষোল বছর বয়সটা দার্শনিকতা শেখার উপযুক্ত বয়স নয়। হেসেখেলে বড় হবার বয়স। মন পরিণত হলে তারপর স্বেচ্ছায় কোন পথ কেউ বেছে নিলে সেটাই স্বাভাবিক হয়। সে ফকিরিই হোক আর দুনিয়াদারীর রাস্তাই হোক। ওর এখনো অনুভুতির জগতটা তৈরি হবার বয়স হয় নি। কাকার নকল করছে অন্ধভাবে। কাকার ভাষাতে কথা বলছে কিছু উপলব্ধি না করেই। নকল করে বাউল ফকির হওয়া যায় না। জন্মফকির কেউ হয় না।”

    শোভন চুপ করে বসেছিল। খানিক বাদে আস্তে আস্তে বলল, “কিছু মনে কোর না ফরিদা। আসাদকে তোমার লেখাপড়া শেখাবার বিরুদ্ধে আমার কিছু বলবার নেই। তবে, আমার আপত্তি আছে অন্য একটা জায়গায়। একটা শিশু বড় হয়ে উঠে কোন পথ ধরবে সেটা অনেকটাই নির্ভর করে তার ছোটবেলার সামাজিক কণ্ডিশনিং এর ওপর, সেটা তো মানবে? জন্ম থেকে কেউ যেমন ফকির হয়ে ওঠে না, তেমনই জন্ম থেকে কেউ বৈজ্ঞানিকও হয়ে ওঠেনা। একেকজন মানুষকে সমাজ একেকভাবে গড়ে তোলে। ক্লাস থ্রির সামসুর এবারে রবীন্দ্র জয়ন্তীতে বন্দি বীর কবিতাটা আবৃত্তি করেছিলো নির্ভুলভাবে। কবিতাটা তুমিই তাকে বেশ কয়েকদিন ধরে ধৈর্য ধরে শিখিয়েছিলে। সামসুর কবিতাটার ঐতিহাসিক পটভূমি, তার গভীরতা, এসবের কোন আন্দাজ পেয়েছিল কি? কিন্তু তবু, তার সাফল্যে খুশি হয়ে তুমি যখন তাকে আদর করেছিলে তখন এটা ভেবেছিলে কি, সে আসলে তোমার শেখানো পথে রবীন্দ্রনাথের কথা বলে চলেছে না বুঝে? সেটা আসাদের, তার কাকার ভাষায় ফকিরি গান গাইবার চেয়ে আলাদা হল কোন যুক্তিতে?”
    “তার মানে তুমি বলছ ছেলেটাকে কবিতাটা শিখিয়ে আমি খারাপ কাজ করেছিলাম?” ফরিদার গলায় অবুঝ উষ্মার স্পর্শ ছিল।
    “না না, আমি মোটেই তা বলিনি। তুমি যা করেছো, ভালো করেছো। তুমি সামসুরকে বা তার মতো অন্য অনেককে একটা সুনির্দিষ্ট কণ্ডিশনিং-এর মধ্যে দিয়ে নিয়ে চলেছো। একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলে দেখতে পাবে ঠিক তেমনি করেই আসাদও একটা নির্দিষ্ট কণ্ডিশনিং-এর মধ্যে দিয়ে চলেছে। একটা সময়পরীক্ষিত জীবনের জন্য তৈরি হচ্ছে। তুমি তার জন্য তোমার পরিচিত অন্য একটা কণ্ডিশনিং-এর প্রস্তাব দিচ্ছ। তোমার রাস্তাটাই যে বেশি ভালো সেটা তুমি দাবি করছ কী করে?”

    ফরিদা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর বলল, “তাহলে তোমার ইশকুল তৈরির সিদ্ধান্তটাই তো প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। স্থানীয় আর্থসামাজিক পরিস্থিতি যেখানে শিশুদের একটা স্বাভাবিক কণ্ডিশনিং-এর মধ্যে দিয়ে বড় করে তুলছে, তুমি সেখানে তাদের নিজস্ব জমি থেকে উপড়ে এনে নিজের শিক্ষাদীক্ষা, মূল্যবোধ তাদের ওপরে আরোপ কেন করছ? আমাদের ইশকুলটার তাহলে প্রয়োজন কী রইল?”

    শোভন হাসল, “প্রয়োজন আছে ফরিদা। আমার ইশকুল তৈরির মূল উদ্দেশ্য আমি নিজেও আগে ভেবেছিলাম আধুনিক শিক্ষার প্রসার। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছি, ব্যাপারটা ঠিক সে’রকম নয়। সুস্থভাবে বেঁচে থাকবার জন্য কিছু প্রাথমিক মূল্যবোধ শেখবার প্রয়োজন হয়। সে শিক্ষা শিশুকে পশুত্বের স্তর থেকে তুলে এনে মনুষ্যত্বের পথ দেখায়। যে আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে আমাদের ইশকুলের শিশুরা বড় হয় তা তাদের সেই মূল্যবোধ শেখাতে পারে না। সেখানেই আমার ইশকুলটার প্রয়োজনীয়তা। ভেতরে একটা আলো জ্বালিয়ে দেবার চেষ্টাটা করি আমরা। তার জন্য কোন একটা পথ আমাদের ধরতে হবে। ফকিরবাউলের জীবনের শিক্ষা যেমন তার একটা পথ, আধুনিক শিক্ষাও সেইরকমই আর একটা পথ মাত্র। আমার কাছে এই দু নম্বর পথটা বেশি পরিচিত, তাই আমি সে পথটা বেছে নিয়েছি। তাই বলে আসাদেরও সেই একমাত্র পথটাই ধরবার প্রয়োজন আছে বলে আমার তো মনে হয় না। বেসিক মূল্যবোধের, বা, বলতে পারো মনুষ্যত্বের শিক্ষা সে পেয়ে চলেছে উপযুক্ত গুরুর কাছে, সেটা তো তুমি মানবে? আর তা-ই যদি মানো, তাহলে আনিসুলের থেকে নিজেকে বড় শিক্ষক হিসেবে ভাবা একটা অন্যায় অহংকার হচ্ছে না কি?”
    “উঃ। কথায় তোমার সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না। নিজে যা বলবে তা-ই একেবারে ধ্রুবসত্য। তার ওপরে কেউ কিছু বলতে এলেই কোমর বেঁধে তার যুক্তিকে খণ্ডাতে লেগে যাবে। আমি—”
    “বলি এবারে একটু সেবা করে নেন গো বাবা মা! বেলা তো অনেক হল। শুকনা কথায় কি পেট ভরবে?”

    আনিসুলের ডাকে চমক ভাঙল তাদের। কখন যেন পেছনে এসে বসেছেন তিনি। ঝোলা থেকে বড় একঠোঙা মুড়ি বের করে একখণ্ড কাপড়ের ওপর ঢেলে দিয়েছেন। পাশে গুটিকয় কাঁচা লংকা। সেইদিকে তাকিয়ে দেখে শোভনের পেটের ক্ষিদেটা নতুন করে জানান দিতে শুরু করল। দলের বাকিরা মুঠো মুঠো মুড়ি তুলে মুখে পুরছে। একটা কাঁচা লংকায় কামড় দিয়ে সে একমুঠো মুড়ি তুলে মুখে পুরলো।


    || ৩ ||

    দিনু বৈরাগির আখড়া থেকে জলঙ্গীর ফেরি প্রায় মাইলটাক দূর হবে। এইখানে নদী বেশ সরু হয়ে এসেছে। তার এপারে উষণা গ্রাম। উল্টোদিকে আঠারোগাঁ। সেদিকটা মুর্শিদাবাদ জেলার মধ্যে পড়ে।

    গোটা রাস্তাটা আনিসুল গজ গজ করে গেছে। পারাপারের নৌকা নাকি বিকেল নামলেই বন্ধ হয়ে যায় উষণার ঘাটে। এ-পথে তার আগে যাতায়াত ঘটেছে অনেকবার। এলাকার ঘাঁতঘোঁতও তাই তার নখদর্পণে।

    ঘাটে পৌঁছে দেখা গেল তার ভয়টা নিতান্তই অমূলক ছিল। এদিককার রাস্তায় ট্রেকারের মেলা বসে গেছে। প্রাইভেট গাড়িও দাঁড়িয়েছে অনেক। ঘাটে অনেক মানুষের ভিড়। তাদের মধ্যে মধ্যে দু একটি সোনালী বা বাদামি চুলের ভিনদেশি ঝলকও চোখে পড়ে। একটা ফেরির নৌকোর বদলে চারচারটে নৌকো পারাপারের কাজ করে চলেছে। অবশ্য এপার থেকে ওপারে যাবার লোকই বেশি। ওপার থেকে প্রায় খালিই ফিরছে নৌকাগুলো। সেইদিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে হরিদাস বলল, “কী বলেছিলাম কাকা? মিলিয়ে দেখে নাও এবারে। কলকাতার ওদিক থেকে ঝেঁটিয়ে লোকজন আসছে এবারে আঠারোগাঁর মেলায়। সাহেবসুবোও আছে। শিক্ষিত লোকজন সব। এখানে গান গেয়ে যা সুখ হবে সে তোমার মক্তবপুরের ভাঙা মাজারে গিয়ে পাবে?”

    ভিড়ের বহর দেখে আনিসুল কেমন যেন বোকা হয়ে গিয়েছিল। সেইদিক থেকে চোখ না ফিরিয়ে অন্যমনস্কভাবে বলল, “হক কথা রে হরিদাস। মেলা তো জবর জমেছে। কিন্তু—”

    হরিদাস সেই কিন্তুটুকুতে কোন কান দিল না। সে তখন ঘুরে ঘুরে লোক দেখতে মশগুল। কিন্তু আনিসুলের সেই দ্বিধাটুকু শোভনের চোখ এড়ালো না। যে গানের সুরে দীক্ষা হয়েছে এই গৃহত্যাগী ফকিরের, সে গান তো কেবল স্বস্থানে আপনজনের সামনে নিজের আত্মাকে উন্মোচিত করবার জন্য। তাকে এই বৈচিত্র্যপিপাসু ভিনদেশি শ্রোতাদের সামনে সাজিয়ে দেবার কথা ভেবে তার যে অস্বস্তিটুকু, তা ওই অধিকারবিহীন নব্য গায়ক হরিদাসের বোধগম্য না হবারই কথা।

    -------------

    আঠারোগাঁয়ের ঘাট ছাড়িয়ে বাসরাস্তায় গিয়ে হাঁটার গতি বাড়াল শোভনরা। মেলার এত কাছে এসে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আনিসুলের দল। যত তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায়। চারপাশে হালকা কুয়াশামাখা অন্ধকার নেমে এসেছে ততক্ষণে। শোভনের পাশে পাশে চলতে চলতে ফরিদা হঠাৎ তার বাহুমূল ধরে মৃদু টান দিয়ে নিচুগলায় বলল, “আস্তে চলো। তোমার এত তাড়া কিসের?” হাঁটার গতি কমিয়ে দিল শোভন। তার সঙ্গীরা ততক্ষণে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে মিশে যচ্ছে সামনের অন্ধকারে।

    খানিক বাদে চারপাশে নৈঃশব্দ নেমে এল তাদের। বাড়ি বাড়ি উনুন জ্বলেছে। সদ্য ওঠা ধানের গন্ধের সঙ্গে কুয়াশার ও জ্বলন্ত কাঠের গন্ধ মিশে গিয়ে শীতের একেবারে নিজস্ব গন্ধটি ছড়িয়ে ছিল তাদের চারপাশে। ফরিদার হাতের আঙুল জড়িয়ে নিয়েছিল শোভনের হাতের আঙুলগুলোকে—

    —হঠাৎ বুকের মধ্যে একটা কাঁপুনি দিয়ে উঠল শোভনের। সে-ও এক এইরকমই সন্ধ্যা ছিল। এমনই আর একটি পথ ধরে আধো অন্ধকারে পথ হেঁটেছিল সে, অন্য একটি গানের আসরের উদ্দেশ্যে। সেই সন্ধ্যাতেও তার কর্কশ আঙুলে এমনই কোমল ক’টি আঙুলের স্পর্শ ছিল। সেদিন রাত ভোর হবার আগেই স্বপ্নটা ভেঙে গিয়েছিল তার। আজ ফের একবার—

    —হঠাৎ চলা থামিয়ে তার মুখের দিকে চাইল ফরিদা। চোখদুটি যেন কিছু খুঁজে নিতে চাইল তার চোখের ভেতর। তারপর মৃদু গলায় বলল, “কী হল? কোন অস্বস্তি হচ্ছে তোমার?”

    নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নাড়লো শোভন, “না, কিছু না। চলো—”

    একটুক্ষণ চুপ করে থেকে, তার আঙুলগুলিকে আরো নিবিড়ভাবে স্পর্শ করে তাকে পড়ে নিতে চাইল যেন ফরিদা। তারপর বলল, “বলবেনা আমাকে, তাইতো?”

    শোভন ম্লান হাসলো, “বলবো, তবে আজ নয়, ফরিদা। এখন নয়। পরে কখনো—”

    মেলার মাঠ ততক্ষণে কাছে এগিয়ে এসেছে। সমবেত কন্ঠস্বরের ক্রমবর্ধমান গমগম শব্দে আস্তে আস্তে জেগে উঠছিল শীতের সন্ধ্যা। দূর থেকে উজ্জ্বল আলোর আভাস চোখে পড়ছিল। সেইদিকে চোখ রেখে তারা এইবারে তাড়াতাড়ি পা চালালো।

    -------------

    “প্রিয় সঙ্গীতামোদি বন্ধুগণ। আঠারোগাঁয়ের ঐতিহ্যময় মেলাপ্রাঙ্গণে আপনাদের স্বাগত। কলকাতা ও শহরতলী থেকে যে বিপুল সংখ্যক লোকসঙ্গীতপ্রেমী আজ এখানে উপস্থিত হয়েছেন, সংস্থার তরফ থেকে তাঁদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। যাঁরা রাত্রে মেলাপ্রাঙ্গণেই থেকে যেতে চান তাঁদের জন্য স্বল্প ভাড়ায় কিছু টেন্ট-এর বন্দোবস্ত করেছেন ওয়াণ্ডারলাস্ট অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্ট সংস্থা। ইচ্ছুক টুরিস্টরা আমাদের জনসংযোগকেন্দ্রে এসে যোগাযোগ করে তাঁবু বুক করে নিতে পারেন। উপস্থিত বাউল ও ফকিরবন্ধুদের জানাই, যাঁরা মঞ্চে গান গাইতে আগ্রহী তাঁরা অবিলম্বে তিন নম্বর কাউন্টারে গিয়ে নিজেদের নাম ও আখড়ার নাম নথীভূক্ত করিয়ে নেবেন এবং সেইসঙ্গে......”

    গ্রামের বসতি এলাকার একপাশে মেলার আয়োজন হয়েছে। এই গ্রামের বাসিন্দা প্রয়াত বিষ্ণুদাস বাউলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাঁর সমাধিমন্দিরকে ঘিরে কয়েকদিনব্যাপী সঙ্গীতবাসরের আয়োজন হয়ে চলেছে প্রায় গত চল্লিশ বছর ধরে। বিষ্ণুদাস জীবৎকালে খ্যাতনামা সঙ্গীতসাধক ছিলেন। লেখার হাতটিও ভালো ছিল। তাঁর বাঁধা পদ এখনো নদীয়া-মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফকির-বাউল-বৈষ্ণবের মুখে মুখে ফেরে। কিছুকাল আগে অবধি এই গানের আসরটির কথা একমাত্র রসিক সাধকজন ছাড়া আর কেউ বিশেষ জানত না। এ রাজ্যের গ্রামগঞ্জে স্বতস্ফূর্তভাবে আয়োজিত অজস্র লোকসঙ্গীতবাসরের ভিড়ে সে মিশে ছিল এতকাল। শহর তার দিকে আলাদা করে চেয়ে দেখেনি কখনো। কিন্তু গত দু বছর আগে হঠাৎ করেই কলকাতার ‘মিরর’ নামের একটি মিউজিক সংস্থার নজরে পড়ায় আঠারোগাঁয়ের এই আসরের কপাল খুলে গিয়েছে। দু বছর ধরে আসর থেকে বাউল গানের নতুন মুখ তুলে নিয়ে গিয়ে বেশ কিছু বাজারসফল সিডি বাজারে ছাড়বার পর এই বছর এই আসরকে পুরোপুরি ‘অ্যাডপ্ট’ করে একটি লোকসঙ্গীতমেলায় বদলে দিয়েছে মিরর। স্পনসর জোগাড় হয়েছে অনেক। দু মাস আগে থেকেই “সুরের ভুবনে বৌদ্ধিক সফর” নামের ক্যাচলাইন দিয়ে এ মেলার বিজ্ঞাপন পড়েছিল কলকাতার পথে, ইন্টারনেটের পাতায়। সাগরপাড়ের বিভিন্ন বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনগুলির সহায়তায় প্রবাসী বাঙালি এবং বিদেশী সঙ্গীতরসিকদের মধ্যেও প্রচার হয়েছে জোরকদমে।

    মিরর-এর এই প্রচেষ্টা যে আশাতীতভাবে সফল হয়েছে, তা মেলার জনসমাগমের দিকে একঝলক তাকালেই বোঝা যায়। শহরের মধ্যবিত্ত মধ্যবয়েসী নারীপুরুষের পাশাপাশি, কানে ইয়ারফোন গোঁজা বিচিত্র পোশাকে সজ্জিত তরুণতরুণীদের ভারহীন ওড়াউড়ি চোখে পড়ে এ মঞ্চ থেকে ও মঞ্চে। তারই ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়ে সোনালি বা বাদামি চুলের ঝলক। একপাশে নিজেদের মধ্যে একত্র হয়ে বাজনার তালে তালে উদ্দাম হয়ে উঠেছে কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ যুবক-যুবতী।

    বিষ্ণুদাস বাউলের সমাধিমন্দিরকে ঘিরে এই মেলার সঙ্গীতমঞ্চগুলির নির্মাণে বিবিধ গ্রামীণ কারুশিল্পের মিশ্রণ। চৌকো ও গোল ছোট ছোট মাটির বেদির মাথায় খড়ের ছাউনি দিয়ে তারা নির্মিত হয়েছে। কালনার মন্দিরগাত্রের হংসলতার মোটিফ থেকে শুরু করে বাঁকুড়ার পোড়ামাটির কাজ, উত্তরবঙ্গের বেত কিংবা দক্ষিণবঙ্গের পাটের হস্তশিল্পের অজস্র নিদর্শন সুকৌশলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে প্রাঙ্গণ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা গাছগুলির গায়ে লাগানো আলোকিত প্রদর্শন বাক্সগুলিতে। তাদের গায়ে লাগানো ক্রমিক সংখ্যাগুলি টুকে নিয়ে একপাশে বিক্রয়কেন্দ্রে ভিড় জমিয়েছেন নাগরিক নাগরিকারা। সব মিলিয়ে, এক মনোরম উৎসবসন্ধ্যার রূপ ধরেছে গানের মাঠটি।

    পশ্চিমদিকে, মাঠের একপ্রান্ত থেকে একটা চড়া ও সুরেলা নারীকন্ঠ জেগে উঠল হঠাৎ মেলার শোরগোল ছাপিয়ে—

    ও কোকিল তোর সুরে কাঁদে প্রাণী
    ডাক শুনিয়া ঘুম ভাঙিয়া হইলাম রে উদাসিনী
             ছিলাম রে আমি কাল স্বপনে প্রাণবন্ধু দেখি শ্যাম পরে
                     মিশাইয়া প্রাণে প্রাণে বলি দুঃখের কাহিনি—
    ফরিদা সচকিত হয়ে সেইদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “কার গলা গো? এত সুন্দর!!”

    শোভন মাথা নাড়ল, “আড়ংঘাটার অন্নপূর্ণা দাসীর গলা। তুমি চিনবে না। ওর গলা খুব কম লোকেই শুনেছে।”

    হঠাৎ তার হাত ধরে টান দিয়ে ফরিদা বলল, “চলো। কাছে গিয়ে শুনি একবার—”

    তার হাতটাকে সরিয়ে দিয়ে শোভন বলল, “নাঃ। ইচ্ছে হচ্ছে না। তুমি বরং ভেতরে গিয়ে গানটা শোন, আমি একটু এদিক ওদিক ঘুরি, চেনা লোকজন খুঁজে দেখি—”

    তার দিকে সামান্য বিস্ময়ের চোখে একবার চাইল ফরিদা। বুঝি বা তলিয়ে বুঝে নিতে চাইল প্রত্যাখ্যানের কারণটিকে। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে। দরকার হলে ফোন করে নিও তাহলে। এখানে নেটওয়ার্ক বেশ ভালো আছে।”

    দ্রুতপায়ে হেঁটে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল ফরিদা। অন্নপূর্ণা দাসী প্রাণ ঢেলে গাইছে। শোভন দূর থেকে কান পেতে শুনছিলো—

    কুহু কুহু গান শুনিয়া
    হঠাৎ গেল ঘুম ভাঙিয়া
    চক্ষু মেলি দেখি চাইয়া
    কাছে নাই গুণমণি—
    অন্নপূর্ণার সঙ্গী দুখু বাউল বছর দুয়েক হল মারা গিয়েছেন। শোভন তাঁকে চিনত। তাঁর আখড়াতে সে গিয়ে থেকেও এসেছে কয়েকবার। প্রকৃত সাধক ছিলেন তিনি। অন্নপূর্ণাকে অল্পবয়সে কোন এক মেলা থেকে কুড়িয়ে এনে মানুষ করেছিলেন নিজের হাতে, তারপর সে যৌবনে পড়লে নিজের সাধনসঙ্গিনী করে নিয়েছিলেন। বড় যত্ন করে গান শিখিয়েছিলেন তাকে। কিন্তু ভালো গাইতে পারলেও মেলায়, আসরে গাইতে যাওয়ায় মহা অনীহা ছিল অন্নপূর্ণার। শৈশবের সেই মেলায় গিয়ে হারিয়ে যাবার স্মৃতি বুঝি তাকে তাড়া করে ফিরত তখনও। দুখু তার ইচ্ছেকে সম্মান দিয়েছিলেন। কোনদিন জোর করে আসরে টেনে নিয়ে যাননি তিনি তাকে।

    তবে, একাধিকবার সময়ে অসময়ে দুখু বাউলের আখড়ায় গিয়ে অসমবয়স্ক দম্পতির সঙ্গীতবাসর দেখবার সুযোগ হয়েছে শোভনের। দুখুর মেঘের মতো গম্ভীর, শক্তিশালী গলার পটভূমিতে চকিত বিদ্যুতের মত নেচে বেড়াত অন্নপূর্ণার তীক্ষ্ণ, সুরসমৃদ্ধ, চকিতগামিনী সুরলহরী।

    শোভন আপনমনেই মাথা নাড়ছিলো। অন্নপূর্ণাকেও পথে নামতে হল শেষে। পেটের দায় বড়ো দায়। অন্নপূর্ণার চেহারাটি ভারী সুন্দর। নিজেকে সাজিয়েগুছিয়ে রাখতে জানে। গানের সময় মুখে ও শরীরে ভাবও আসে তার ভালো। আজকে যে গানটি সে বেছে নিয়েছে, তার সঙ্গে তার নিজের পরিস্থিতির কিঞ্চিৎ যোগাযোগ থাকায় তার পরিবেশনে একটা আলাদা মাত্রা এসেছে। সেইসঙ্গে গানের সুরচালে সুকৌশলে একটু দ্রুতি এনেছে সে। শ্রোতাদের চরিত্র বুঝে জোর দিচ্ছে ছন্দের ওপরে। দুঃখের গান তার গলায় এই সন্ধ্যায় হয়ে উঠছে যেন এক উৎসবের গান। স্বাভাবিকভাবেই মাঠের সেইদিকটাতে ভিড় বেড়ে উঠেছে এই মুহূর্তে। একটি শক্তিশালী নবজাগ্রত নক্ষত্রের মতোই আশেপাশের অন্যান্য গায়কের বৃত্ত থেকে মানুষকে নিজের বৃত্তে টেনে নিয়ে আসছে সে।

    ক্যামেরা আর চ্যানেলের লোগো লাগানো মাইক্রোফোন নিয়ে চন্দ্র বাংলা চ্যানেলের পুরো টিমটা এগিয়ে যাচ্ছিল অন্নপূর্ণার আসরের দিকে। তাদের পেছন পেছন সারদা চ্যানেল, জি বাংলা, ই টিভি বাংলার দলবল। শোভন বাইরের দিকে মুখ ফেরাল। একটা অদ্ভূত হারাবার অনুভূতি এসে ঘিরে ধরছিল তাকে। আড়ংঘাটার কাছে, উত্তরবাহিনী চূর্ণির ধারের এক নির্জন গ্রামের একটেরেতে, নদীর কোল ঘেঁষে দুখুর অতি সাধারণ আখড়ার ছবিটা বারবার তার চোখে ভেসে উঠছিলো। চন্দ্রালোকিত কোন রাত্রে তার গাছঘেরা উঠোনে সেইসব গানের আসরগুলি আর কোনদিন সারারাত জুড়ে জেগে থাকবে না। এইবারে নাগরিক পাদপ্রদীপের আলোয় হয়তো উজ্জ্বল হয়ে উঠবে অন্নপূর্ণার জীবন। বাঙলা এক নতুন তারকা পাবে হয়তো। চন্দ্র বাঙলা চ্যানেলটা আসলে মিরর-এর মালিকেরই আর একটা ব্যবসা। অতএব অন্নপূর্ণার গানে এ চ্যানেলের উৎসাহ দেখাবার সেই অর্থই দাঁড়ায়—
    “আরে! শোভনদা না? কতক্ষণ এলেন? দেখুন ঠিক এইখানেও ঠিক শুঁকতে শুঁকতে এসে গেছি—”

    পরিচিত গলার শব্দ পেয়ে শোভন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “আরে শমিত! তুমি এখানেও পৌঁছে গেছ!”

    শমিত হাসল, “পেশা, দাদা, পেশা। আপনার মেলার কভারেজটা ফাটাফাটি নিয়েছিলো পাবলিক। দেখেছিলেন নাকি? আপনাকে অনেকটা ফুটেজ দিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু।”



    শোভন একটু অস্বস্তিভরে মাথা নাড়লো, “না গো, দেখা হয়ে ওঠেনি। তোমাদের তো কেব্‌ল্‌চ্যানেল, না?”
    “হ্যাঁ। সারদা চ্যানেল। বেশ নামডাক হয়েছে আজকাল।”
    “ও। আসলে কেব্‌ল্‌কানেকশনটা এখনো নেয়া হয়ে ওঠেনি। সময়ও পাইনা বিশেষ টিভি দেখবার—”

    শমিত একটু অপ্রতিভ হল। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলল, “প্রোগ্রামটা কয়েকমাসের মধ্যে রিপিট টেলিকাস্ট হয়ে গেছে তিনবার। তারপর থেকে আমি সারদা চ্যানেলের ফোক মেলা স্পেশালিস্ট হয়ে গেছি। এইখানেও ঠিক শুঁকতে শুঁকতে এসে গেছি—”
    “হুঁ, তা মেলায় এসে কাজকর্ম না করে বাইরে ঘুরছো যে বড়?”

    শমিত একটু অধৈর্য ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো, “দূর দূর, গ্রামীণ সঙ্গীত উৎসব কোথায়? মনে হচ্ছে মোহরকুঞ্জ বা সল্টলেকের ইজেডসিসি-র কোন ফোক কার্নিভ্যালের কভারেজ করছি। শালা, ক্যাচলাইন দিয়েছে সুরের ভুবনে বৌদ্ধিক সফর। ওই নেকুপুসুপার্কা অ্যাড দেখেই স্যারকে বলেছিলাম, বাদ দিন। কিন্তু শুনলে তো! আমাদের সারদা চ্যানেলে মিরর-এর কুড়ি পার্সেন্ট শেয়ার আছে যে! কাজেই আসতেই হয়েছে। মিনিট পনেরো ভেতরে ছিলাম। তারপরে পালিয়ে এসেছি। বাকি ছেলেমেয়েগুলো মিলে কভার করে দেবে ঠিক। পরে আমি ক্যামেরার সামনে একটু মুখ দেখিয়ে নিয়ে ফুটেজটা মধ্যে মধ্যে খাইয়ে দিলেই কর্তব্য শেষ—”

    বলতে বলতেই হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটে পকেট থেকে একটা আধভর্তি ছোট কাচের বোতল বের করে এনে সে বলে, “এই দেখুন, অফার করতেই ভুলে গেছিলাম। একাএকাই সাবড়ে চলেছি তখন থেকে। একটু চলবে নাকি? গাটা গরম হয়ে যেতো—”

    শোভন মাথা নাড়লো, “আমি মদ খাইনা যে শমিত!”
    “বলেন কি? কালচার টালচার করেন, অথচ—ও বুঝেছি। আপনারা ফকির বাউলের সঙ্গ করেন, আপনাদের তো বোধহয় ধুম্রপথে যাতায়াত। তা সে ব্যবস্থাও আছে। দুটো পুরিয়াও আছে সঙ্গে। সেটা চলবে তো?”
    “উঁহু। তা-ও চলে না যে!”
    “দূর মশায়। আপনার দ্বারা হাই লেবেলের কালচার কিছু হবে না। একটু আধটু নেশা না করলে ব্রেনের সেলগুলো আবার ঠিক পুষ্টি পায় না, বুঝলেন?”

    শোভন অন্ধকারে হাসলো একটু। সাদাসিধে, খোলা মনের এই ফুর্তিবাজ ছেলেটাকে তার ভালোই লাগছিলো। মনে মুখে এক। যা ভাবে তা সটান বলে দেয় মুখের ওপরে। রাখঢাক নেই কোন।

    অন্ধকারে আস্তে আস্তে কথা বলতে বলতে পাশাপাশি হাঁটছিলো তারা দুজন। সন্ধ্যা এইবারে নিবিড় হয়েছে। চাঁদ নেই আজ। তারায় ছাওয়া আকাশ। আসরের পেছন দিক এটা। অন্ধকারের মধ্যে বড়ো বড়ো ঝুপসি গাছগুলো কালো কালো ছায়ার দলার মতো ছড়িয়ে রয়েছে এখানে ওখানে। তার তলায় তলায় নড়াচড়ার শব্দ আসে। দূরদুরান্ত থেকে আসা বাউল, ফকিরের দল আস্তানা গেড়েছে সেইসব গাছের তলায়। মাঝে মাঝে কোথাও আগুন জ্বেলে রাত্রের রান্নাবান্না চলেছে। কোথাও অন্ধকারেই দোতারার সুর ভেসে আসে।

    হঠাৎ এমনই একটা গাছতলা থেকে কেউ ডাক দিয়ে উঠলো, “চেনা গলা পাই মনে হয়?”

    গলাটা শোভনেরও চেনা। দাঁড়িয়ে পড়ে গাছতলার দিকে এগোতে এগোতে সে প্রশ্ন করল, “কে আনিসুলদাদা নাকি? আসরে যাও নাই?”

    আনিসুল তাঁর দোতারাটিতে মৃদুমন্দ সুর বাঁধছিলেন। টুকরোটাকরা সুরখণ্ড ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাঁকে ঘিরে। হাত না থামিয়েই জবাব দিলেন, “যাব, যাব। রাত সাড়ে বারোটায় আধাঘন্টার টাইম দিয়েছে। একেবারে তখন গিয়া উঠব। এখন আর ভিড়ে গিয়া লাভ নাই। এস বাবা, বস। সঙ্গে ওটি কে?”

    একটা দেশলাই কাঠি জ্বলে উঠলো হঠাৎ। গাছতলায় বড়ো একটা চাদর পেতে তার ওপরে আনিসুলরা সকলে বসে। আনিসুলের হাতে দোতারা। খঞ্জনী, শ্রীখোল, হারমোনিয়াম ও বাঁশি নিয়ে বসেছে দলের বাকিরা। চাদরের একটা কোণে বসতে বসতে শোভন শমিতকে দেখিয়ে বলল, “এর নাম শমিত। আমার বন্ধু। মেলায় এসে দেখা হয়ে গেল আজ।”

    অন্ধকারে শমিতের দিকে মুখ ঘুরিয়ে আনিসুল বলল, “আসেন বাবা, বসেন। এইখানে হট্টগোল নাই। প্রাণের সুখে একটু গান গাই, আপনারা শোনেন—”

    কথা বলতে বলতেই দোতারার এলোমেলো সুর একটি সুগঠিত রূপ ধরছিল। এইবারে কোন অদৃশ্য ইঙ্গিতে বাঁশি তার সঙ্গ ধরল। চঞ্চল কতগুলি আঙুলের স্পর্শে হারমোনিয়ামের রিড ছেড়ে একরাশ পরস্পর সংলগ্ন সুরখণ্ড ভেসে উঠল বাতাসে। তারপর সেই সবগুলি সুরের মিশ্রণ থেকে উঠে এল ভাঙা ভাঙা পুরুষকন্ঠটি—

    ক্ষ্যাপারে দেহ জানলে তবে জানবি বস্তুধন
    আগে জেনে আয় আমার মন
    মিছে কেন রে করো ভ্রমণ
    এই ভব মাঝে বারে বারে করো রে ভ্রমণ
    আগে জেনে আয় আমার মন
    ওরে দেহ জানলে পরে জানবি বস্তুধন
    সে আমার মূলাধারে চতুর্দল ক্ষ্যাপা রে
    সুষুম্নারে সঙ্গে করে চলো চতুর্দল
    ওরে ব্রহ্মনাড়ির ছিদ্র ধরে
    ওরে করো রে তারে অন্বেষণ—
    দেহতত্ত্বের ইঙ্গিতময় গানে ক্রমশই ডুব দিয়ে চলেছিলেন মধ্যবয়েসি ফকির। মুখটি তাঁর ঝুঁকে পড়েছে বুকের ওপর। চোখ বোঁজা। হাতের আঙুল মসৃণ যান্ত্রিকতায় কোলে ধরা সুরযন্ত্রটিকে সোহাগ করে চলেছে। স্পর্শ পেয়ে ঝনঝন করে বেজে উঠছে যন্ত্রের নিষ্প্রাণ শরীর। দেহকে আশ্রয় করে দেহাতীতের সন্ধানে সহস্রাব্দি পেরিয়ে যে অন্তর্মুখী অভিযানে পুরুষানুক্রমে এগিয়ে চলেছেন বাংলার এই অলোকপন্থী সাধকেরা, এই মুহূর্তে সেই পথে হেঁটে চলেছেন মানুষটি—
    ওরে আমার পাগল মন
    দেহ জানলে তবে জানবি বস্তুধন—
    দেহ আমার অস্তিত্বের মূল, তাকে আশ্রয় করেই তো চৈতন্যের বিস্তার। তাহলে চৈতন্যের আধারশিলাটিকে অস্বীকার করে চৈতন্যের সাধনা হবে কী করে? বরং এসো ভালো করে তার পরিচয় নিই। তার ভালোমন্দ চিনতে শিখি, তারপর—
    আবার রসিক সুজন এমনি সেদিন
    নীর রেখে ক্ষীর করে ভোজন—
    “—কেমন লাগলো বাবা?” চমক ভেঙে মাথা তুললো শোভন। কথার পরে কথা সাজিয়ে এগিয়ে চলা সুদীর্ঘ তত্ত্বগানটি কখন যেন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তখনো তার মাথার থেকে সে গানের রেশ যাচ্ছিল না। টুকরো টুকরো পংক্তি, বিচ্ছিন্ন কিছু সুরখণ্ডের বর্ণালী তখনও তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
    “এ গান আগে কখনো শুনেছো নাকি? কার গান জানো বাবা?”

    শোভন মাথা নাড়ল, “হাউরের গান। অনেকবার শুনেছি নানা জায়গায়, কিন্তু আনিসুলদাদা, সত্যি কথা বলি তোমার মতো দরদ দিয়ে আর কাউকে আমি এ গান গাইতে শুনিনি।”
    “ওই দ্যাখো, বাবা আবার আমারে মিঠেকথা শোনাতে লেগেছে। আরে রাখো দেখি কথাবার্তা, গান শোন, গান শোন—আসাদ, ধরতো দেখি বাপ—”

    গানের পরে গান হয়ে চলে সেই অন্ধকার আসরটিতে। কতক্ষণ সময় যে কেটেছে তার কোন খেয়াল ছিল না শোভনের। হঠাৎ পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠলো তার। ফরিদার ফোন। ওপাশ থেকে উৎকন্ঠিত গলায় প্রশ্ন করলো, “কোথায় তুমি? কটা বেজেছে দেখেছো?”

    গান থামিয়ে আনিসুল এইদিকে দেখছিলেন। কলটা শেষ হতে বললেন, “মায়ের ফোন নাকি? যেতে ডাকছে মনে হয়?”

    শোভন মাথা নাড়ল।

    ফকির মাথা নাড়িয়ে বললেন, “তা যাও বাবা। তাড়াতাড়ি করে যাও দেখি এবার। নতুন বউ, তারে একলা একলা ছেড়ে দিয়ে বনে বাদাড়ে ঘোরো, কেমন শৌহর হে তুমি?”

    শোভন আলোকিত ফোনের পর্দায় সময়টা দেখে সেটাকে ঘুরিয়ে ধরল আনিসুলদের দিকে। সেটার দিকে একনজর তাকিয়েই ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালো হরিদাস। বলে, “দেখো দেখি, কাণ্ড, আমরা এখানে পাঁদারে বসে মশার কামড় খেয়ে গান ভাঁজছি আর ওদিকে রাত হল বারোটা। এখন আধাঘন্টার মধ্যে সব গুছিয়েগাছিয়ে স্টেজে গিয়ে উঠতে পারবা নাকি?”

    আনিসুল নির্বিকার মুখে জবাব দিলেন, “ও তুমি কিছু ভেব না হরিদাস। গুরু চাইলে—”
    “রাখো তো কাকা তোমার গুরুর চাওয়া না চাওয়া—” দ্রুতহাতে যন্ত্রগুলি তাদের খাপে ভরতে ভরতে হরিদাস মুখ ঝামটা দিল, “কথা দিয়ে সময় না রাখলে ক্যাসেট কম্পানি ওসব গুরুটুরু মানবে না তোমার। এক মিনিট দেরি হলে স্টেজেই উঠতে দেবেনা বলে দিয়েছে কাউন্টার থেকে।”
    “ঠিক আছে আনিসুলদা, তোমরা এসো, আমি ফরিদাকে নিয়ে তোমাদের মঞ্চে চলে আসছি। চলো শমিত, যাবে তো?”

    বলতে বলতে শোভন উঠে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। শমিতও পেছন পেছন উঠে এসে লম্বা লম্বা পায়ে তার সঙ্গ ধরলো এসে।

    “কনগ্রাচুলেশনস শোভনদা, বাজিটা আমি হেরেই গেলাম, বুঝলেন?” শমিতের গলায় একটু জড়ানো ভাব টের পাওয়া যাচ্ছিল।

    সম্ভবত তার নেশা হয়েছে হালকা।

    হাঁটতে হাঁটতে মাথা না ঘুরিয়েই শোভন জিজ্ঞাসা করল, “কীসের বাজি হারলে আবার?”
    “না মানে আপনার এই বিয়ে করা নিয়ে।”
    “সে কি শমিত? আমি ফিল্মস্টার না পলিটিশয়ান, যে আমার বিয়ে নিয়ে আজকাল বাজি ধরা হচ্ছে?”

    শমিত হেসে ফেলল, “না না সে’রকম কিছু নয়। আসলে আপনাকে নিয়ে মেলার পরে আমাদের মধ্যে একটা স্পেকুলেশন হয়েছিলো। আমাদের ক্যামেরা করে সেই যে ঢ্যাঙামতো ছেলেটা, ওর নাম প্রীতম। মধ্যে একদিন কথা বলতে বলতে ক্যাজুয়ালি আপনার নামটা উঠে এসেছিল। তা আমি বললাম, আপনি ঠিক নর্মাল লোক নন—এই না না কিছু মনে করবেন না, আমি খারাপ কিছু মিন করি নি। নর্মাল নন মানে বলতে চাইছিলাম আমাদের এজ গ্রুপের আর দশটা লোকের মত আহার-নিদ্রা-মৈথুন-কেরিয়ার পার্টি নন আর কি। ডেডিকেটেড কালচারাল ওয়ার্কার। কাইণ্ড অব সন্ন্যাসী।

    তা, সেই নিয়ে প্রীতমের সাথে ঝগড়া। বলে, সন্ন্যাসী টন্ন্যাসী বাজে কথা। লাইনে সবাই চলে আসে। দুদিন আগে কিংবা দুদিন পরে। সেই নিয়ে বাজি। ব্যাটা বাজির টাকা না নিয়ে ছাড়বে না আজ। তবে সে নিক গে। আপনাকে আর একবার কনগ্র্যাচুলেশন্স শোভনদা। ওয়েলকাম টু আওয়ার ফোল্ড। চলুন মিসেসের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন। আপনাকে বাগে এনেছে যে সে যেমনতেমন কেউ হবে না নিশ্চয়—”

    শোভনের উত্তর দেবার ইচ্ছে হচ্ছিল না। নেশাগ্রস্ত ছেলেটার মুখের আগলহীন কথাগুলো শুনে তার মনের প্রশান্তিটা চলে যাচ্ছিল। নীরবে তাড়াতাড়ি পা চালালো সে। আসরের শব্দ ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছিল।

    মাঠের এপাশের গেটের কাছে ফরিদা দাঁড়িয়েছিল। শোভনকে আসতে দেখে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে বলল, “কোথায় ছিলে বলো তো এতক্ষণ। আমায় মাঠে ঢুকিয়ে দিয়ে সেই যে গেলে—”

    তার কথাটা শেষ করতে না দিয়ে শমিত হঠাৎ এগিয়ে এসে হাতজুড়ে নমস্কার করে বলে, “ম্যাডাম, আমাকে আপনি চিনবেন না। আমার নাম শমিত। একটা টেলিভিশন কম্পানির চাকর। এইসব মেলাফেলা ঘুরে রিপোর্টিং করি। শোভনদাকে আমি খুব অ্যাডমায়ার করে থাকি। শোভনদা যে বিয়ে করে সংসারী হয়ছে এটা আমার কাছে একটা বিরাট সারপ্রাইজ, তাই আপনার সঙ্গে আলাপ করবার ইচ্ছে হল।”

    ফরিদা প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে ছেলেটির দিকে হাত তুলে ছোট্ট একটি প্রতিনমস্কার করে একটুকরো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে সে শোভনের হাত ধরে টানল। তাদের পাশ দিয়ে তখন হনহন করে ভেতরে ঢুকে আসছে আনিসুলদের দলটি। যেতেযেতেই নিচু গলায় আনিসুল ডাক দিয়ে গেলেন তাকে, “চলে আসো বাবা।”

    হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাওয়া নারীপুরুষদুটির দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা সিগারেট ধরালো শমিত। ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময় শর্মিলা আর সে একসঙ্গে স্বপ্ন কম দেখেনি। দেশের কাজে উৎসর্গীকৃত সন্তানকামনাবিহীন প্রেমিক দম্পতি হবার যে স্বপ্নটা তাদের ছিল, সেটা অনেকদিন হল ভেঙে গেছে। পুরুলিয়ার একটা ট্রাইবাল গ্রামের বাচ্চাদের নিয়ে একটা প্রজেক্ট শুরু করেছিল তারা দুজন মিলে। এডুকেশন থ্রু ড্রামা। এন এস ডির থেকে কিছু অনুদান মিলেছিল। সে ছাড়া তখন রোজগার তাদের আর কিছু ছিল না। প্রয়োজনও ছিল না।

    তারপর, বিয়ের বছর দুয়েক বাদে, একবার সেই গ্রামে প্রজেক্টের একটা ওয়ার্কশপ করতে গিয়ে পূর্ণিমার নির্জন চাঁদমাখা রাত্রে খোলা বারান্দায় তার নিচে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে শর্মিলা বলল, “আমার একটা ইস্যু চাই। এসো—” সে আদেশ শমিত অস্বীকার করতে পারে নি।

    তারপর পরপর রাহুল আর শ্বেতার আসা, টিভি কোম্পানির চাকরি, টিআরপি-র হিসেব, প্রডিউসার মিটিং এইসব নিয়ে কীভাবে যেন একেবারে জড়িয়ে গেল সে। পরপর গোটাকয় হিট স্টোরি টেলিকাস্ট হবার পর রাস্তাঘাটে লোক আজকাল তাকে চিনেও ফেলছে মাঝেমাঝে। শর্মিলার চাপা গর্ব আছে তাকে নিয়ে—

    —কোন একটা স্টেজে একদল গায়কের গানের শেষে পরের দলের নাম অ্যানাউন্স হয়ে চলেছে। একপাশে, সম্ভবত কলকাতা থেকেই আসা একদল ছেলেমেয়ের নাচ চলেছে উদ্দাম। শমিত কান পেতে শুনলো একটু সেদিকে। অ্যাডাম ল্যাম্বার্টের নতুন গান—

    আই উইশ দিস নাইট উড নেভার বি ওভার
    দেয়ার’স প্লেন্টি অব টাইম টু স্লিপ হোয়েন উই ডাই
    সো লেট’স জাস্ট স্টে অ্যাওয়েক আনটিল উই গ্রো ওল্ডার
    ইফ আই হ্যাড মাই ওয়ে উই’ড নেভার ক্লোজ আওয়ার আইজ
    আওয়ার আইজ, নেভার—

    রাত্রিই জীবন এখন। মৃত্যুর প্রতীক রাত্রি শেষে দিন। তখন এই তরুণরা ঘুমাতে যেতে চায়, নিশাচরের অন্ধকার জীবনকে শেষবিন্দু অবধি উপভোগ করে—

    একটা হিমশীতল অনুভুতি তার ঈষৎ নেশাগ্রস্ত মস্তিষ্ককে ঘিরে ক্রমাগতই ঘুরপাক খেয়ে চলেছিল। শ্বেতা, রাহুল বড়ো হবে। একদিন তারাও কি এই গান হৃদয়ে নেবে? কী প্রয়োজন ছিল শর্মিলার ওদের পৃথিবীতে আনবার? সামনে শোভন আর তার স্ত্রী এগিয়ে গিয়ে ভিড়ের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। তাদের শরীরেও মৃত্যুর অতিপরিচিত মোহন চিহ্নগুলি দেখতে পাচ্ছিল শমিতের নেশাগ্রস্ত চোখ। হঠাৎ সামনের মাটিতে একদলা থুথু ছিটিয়ে শমিত গালাগাল দিয়ে উঠল, “শা-লা—”

    -------------

    রাত গভীর হয়েছে। মাথার ওপরে ঝুঁকে থাকা গাছপালার ফাঁক দিয়ে আকাশের তারা দেখা যাচ্ছিল। মঞ্চে সুরেন ক্ষ্যাপা গাইছিলেন। গত কয়েক বছরে তাঁর জনপ্রিয়তা বাঙলার মাটি ছেড়ে প্রবাসী বঙ্গসমাজেও পৌঁছেছে। শিকাগোতে বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনে তাঁর লাইভ প্রোগ্রাম নিয়ে যে সিডি টি প্রকাশিত হয়েছে তার জনপ্রিয়তার সঙ্গে হ্যারি বেলাফন্টে-র কার্নেগি হল কনসার্টের তুলনা করছেন অনেকেই। উদ্যোক্তারা বহুকষ্টে তাঁকে আজ এখানে আনতে পেরেছেন, আধঘন্টার বেশি গাইতে হবে না এই শর্তে।

    সুরেন ক্ষ্যাপার এই বিপুল জনপ্রিয়তার চাবিকাঠিটি লুকিয়ে আছে তাঁর শ্রোতা বুঝে সঠিক সঙ্গীত নির্বাচনে। নাম ঘোষিত হতেই অন্যান্য মঞ্চ ছেড়ে জনস্রোত এসে জমা হয়েছিল তাঁর মঞ্চের চারপাশে। আসরের সেই পাঁচমেশালি ভিড়টির জন্য তিনি নির্বাচন করেছিলেন এমন ক’টি গান, যাদের চলন দ্রুত, সুর সহজ এবং সবচেয়ে বড় কথা, যার কথাগুলি বহুল পরিচিত। এর ফলে দর্শক সহজেই তাঁর সঙ্গে গানগুলি গেয়ে উঠতে পারবে ও ফলত নিজেদের সাংস্কৃতিক ভিত সম্পর্কে গর্ববোধ করবে। শ্রোতার এই তৃপ্তিই তো গায়কের জনপ্রিয়তার রসদ! একে একে অতিপরিচিত ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’, ‘হৃদয়মাঝে রাখবো’, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’ ইত্যদি গানগুলি গেয়ে ও মাঝে মাঝেই দর্শকের দিকে হাত নেড়ে তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে গাইতে উৎসাহিত করে দর্শকোল্লাসকে এক উঁচু তারে বেঁধে দিয়ে তিনি তাঁর শেষ গানটি ধরলেন—

    গোলেমালে গোলেমালে
    পীরিত করো না
    পীরিতে কাঁঠালের আঠা রে
    ও আঠা লাগলে পরে ছাড়ে না রে ছাড়ে না—

    গানটি শুরু হতেই চারপাশে ঘিরে থাকা জনতার মধ্যেকার সমবেত গুঞ্জনধ্বনি গর্জনে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। সুরে বেসুরে অনেক দর্শকই ধূয়া ধরছিলেন তাঁর সঙ্গে। শুরু থেকেই দর্শকদের ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন সুদর্শনা যুবতী উঠে দাঁড়িয়ে নাচছিল তাঁর গানগুলির সাথে। এই গানটির দ্বিতীয় স্তবকে এসে, একতারাটি হাতে মাপা পদক্ষেপে নাচতে শুরু করেই সুরেন ক্ষ্যাপা তাদের দিকে হাত নেড়ে ইশারা করে ডাকলেন। যুবতীরা মঞ্চে উঠে এসে তাঁর সঙ্গে পা মেলালো। হ্যালোজেনের উত্তপ্ত আলোয় ও ক্রমাগত শরীর দোলাবার পরিশ্রমে তাদের পরনের বর্ণাঢ্য পোশাক এবং খোলা হাত মুখ গলা ক্রমশ ভিজে উঠছিল। সুরেন ক্ষ্যাপা ও তাঁকে ঘিরে যুবতীদের সেই নাচের এক আশ্চর্য জৈব আবেদন ছিল। সেইসঙ্গে গানটির উত্তেজক সুর, এবং ধুলো ও ঘামজড়িত মেলার গন্ধ এই তিন মিলে জন্ম দিচ্ছিল এক আশ্চর্য মাদক মিশ্রণের, যার আকর্ষণ সংস্কৃতিমনস্ক নাগরিক দর্শকের কাছে চিরকালই অপ্রতিরোধ্য ঠেকে এসেছে এবং ফলত তা জন্ম দিয়েছে বাংলার জনপ্রিয় ও লাভজনক লোকসঙ্গীতমেলাশিল্পের।

    গানটি শেষ হবার পর দর্শকদের মধ্যে থেকে আরো কয়েকটি গান গাইবার অনুরোধকে একরকম উপেক্ষা করেই মঞ্চ ছেড়ে নেমে গেলেন সুরেন ক্ষ্যাপা। বাইরে তাঁর গাড়ি অপেক্ষা করছে। পরদিন ভোরবেলার উড়ানে তিনি চলে যাবেন দিল্লির একটি সরকারী অনুষ্ঠানে গান শোনাতে। এ আসরের মেয়াদ অতএব দীর্ঘতর করবার উপায় নেই তাঁর।

    সুরেন ক্ষ্যাপার গানের রেশটি মেলাতে কিছু সময় নিল। বহু দর্শকই তাঁর গানগুলিকে রেকর্ড করে নিয়েছেন তাঁদের হাতে ধরা মোবাইল ফোনের রেকর্ডারে। সেই রেকর্ডিংগুলি একে অন্যকে বাজিয়ে শোনানো ও সেই সম্বন্ধীয় কলকাকলীতে পূর্ণ জনসভাটির একরকম অজান্তেই ঘোষিত হল পাতিকাবাড়ির আনিসুল ফকির ও তাঁর সম্প্রদায়ের নাম, এবং আনিসুল ও তাঁর সঙ্গীরা নিঃশব্দে মঞ্চে এসে বসলেন। তারপর, চোখদুটি বুঁজে নিচু গলায় আনিসুল গান শুরু করলেন,

    ওরে বলরে স্বরূপ কোথায় আমার
    ওরে সাধের প্যারী—
    ওরে যার জন্যে হয়েছি গো
    এই জন্মধারী—

    ধীরলয়ের এই গানটির সঙ্গে দোতারার মৃদু শব্দ ভিন্ন আর কোন সঙ্গত ছিল না। দর্শকদের সমবেত গুঞ্জনধ্বনিতে ডুবে যাচ্ছিল তাঁর গলার শব্দ। আনিসুলের অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই। ভাঙা ভাঙা নিচু ও ক্লান্ত গলায় নিজের গানের মধ্যেই নিজে ডুব দিয়ে চলেছেন তখন তিনি। স্বয়ং নারায়ণ, রাধাভাবে আপ্লুত শ্রীচৈতন্যরূপে নদীয়ানগরে আবির্ভূত হয়েছেন। কৃষ্ণপ্রাপ্তির জন্য তাঁর আকুতি আসলে নিজের অন্তরে সুপ্ত দেবচেতনারই অনুসন্ধান। সেই প্রতীকের আবরণে নিজের মধ্যে অমৃতের বীজ বহে বেড়ানো মরণশীল মানুষের চিরন্তন আত্মানুসন্ধানের গাথাটি প্রৌঢ় আনিসুল তখন নিবেদন করে চলেছেন উদাসী দর্শকদেবতার উদ্দেশ্যে—

    বলরে স্বরূপ কোথায় আমার
    রায় রামানন্দ দরশনে
    পূর্বভাব আমার উদায় মনে
    যাব আমি কার বা সনে
    সেই রূপ একবার চোখে হেরি
    “এটা কে রে? ভাঙা কাঁসর বাজিয়ে যাচ্ছে তখন থেকে? বিনবিন করে পুজোর মন্তর শুনতে অ্যাদ্দূর এসেছি নাকি?” একটি নিদ্রালু তরুণীকন্ঠ হঠাৎ জেগে উঠল দর্শকের ভেতর থেকে। মনমাতানো তাল ও গতিবিহীন এই ধীরলয়ের গানটি বলাই বাহুল্য তাদের জাগরণক্লান্ত স্নায়ুকে আরও জেগে থাকবার জন্য যথেষ্ট প্রেরণা জোগাতে সক্ষম হচ্ছে না। শোভন একবার হতাশ দৃষ্টিতে মঞ্চে বসা আনিসুলের দিকে চেয়ে দেখল। এই মেলা তত্ত্বগান গাইবার জায়গা নয়। তার জায়গা আলাদা। কেন আনিসুল বুঝছে না এ আসরে বসে এ গান গাইলে তাতে গানেরই অপমান হয়! দর্শক আসন থেকে দলে দলে লোক উঠে দাঁড়াচ্ছিল। তারা হাসছে, গল্প করছে। আসর জুড়ে তখন জ্বলে উঠছে সিগারেট, আলোকিত হয়ে উঠছে অসংখ্য মোবাইল ফোনের পর্দা। বেজে উঠছে অজস্র বিচিত্র সুরের রিংটোন। লোকজন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।

    গানটি শেষ করে হতাশ চোখে একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন আনিসুল। তাঁর আজন্ম পরিচিত সঙ্গীতবাসরগুলির দর্শকের সঙ্গে এ আসরের দর্শকচরিত্র একেবারে আলাদা। সে ফারাককে বোজাবার কৌশল তাঁর জানা নেই।

    হঠাৎ হরিদাস উঠে এসে হাত বাড়িয়ে মাইক্রোফোন স্ট্যাণ্ডটা আনিসুলের থেকে টেনে নিল নিজের দিকে। তার বোতামটা বন্ধ করে আনিসুলের দিকে মাথা নামিয়ে নিচু গলায় বললো, “ছাড়েন আপনে কাকা। পাবলিকের মন বোঝেননা, কিছু না। পাবলিক সব উঠে চলে গেলে গান কি গাছপালারে শোনাবেন? শ্রীখোল ধরেন আপনি। লোকজনরে আমি দেখতেছি এবারে—”

    নীরবে মাইক ছেড়ে দোতারাটি গলা থেকে খুলে এনে হরিদাসের হাতে তুলে দিয়ে তার রেখে আসা শ্রীখোলে গিয়ে বসলেন আনিসুল। মাইক্রোফোনের বোতাম টিপে সেটিকে চালু করে একবার চারদিকে তাকিয়ে নিল হরিদাস। তারপর তীক্ষ্ণ আওয়াজে আসরের সমস্ত শব্দকে ডুবিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “উপস্থিত বন্ধুসকল—জন্মস্থলের সদরমুখে থাকে মায়াচুম্বুকের কল—সেই কলের ফাঁদে পড়লে ব্রহ্মা বিষ্ণুর জীবন অচল—এইবারে সেই মায়াচুম্বুকের গান গাইবার আজ্ঞা দিবেন—”

    সঙ্গে সঙ্গেই তার হাতের দোতারাটি চটুল সুরে কথা কয়ে ওঠে। ঘন ও সুস্বাদু সুরস্পর্শে ঘুম ঝেড়ে ফেলে জেগে ওঠে সেই চন্দ্রহীন রাত। হারমোনিয়াম, বাঁশি ও শ্রীখোলের দ্রুতচালের বৃন্দবাদন দোতারার সদ্যজাগ্রত যৌবনকে স্বাগত জানায়। আর তারপর, সেই সুরকে আশ্রয় করে জেগে ওঠে হরিদাসের সামান্য খসখসে পুরুষালি গলাটি—

    “মায়া চুম্বুক কলে ফেলিছে গিলে জগতের জীবে।
    আবার সে কল জীব সকলে দেখলে ভোলে
    ভোলে না তো শিবে জগতের জীবে
    সে মায়া চুম্বুক কলের গো এমনি আকর্ষণ
    কীটপতঙ্গ স্থাবর জঙ্গম সবার ভরে মন
    বললেন ব্রহ্মা বিষ্ণু আর ত্রিলোচন—
    যেমন পতঙ্গ ধায় অনল দেখে মরণ ভাবে না হায় হায়
    বাবারা, মায়েরা, বলেন দেখি তবে এই পহেলির উত্ত—র? শিবে ভোলেনা কিন্তু চুম্বুকে ভোলে কীট-পতঙ্গ, স্থাবর, জঙ্গম—কোন সে মায়া চুম্বু—উ—উ—ক?”

    প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই যন্ত্রগুলির চটুল তালের মিলিত সুর ঢেউয়ের মত জেগে উঠে ঢেকে দেয় তার কন্ঠস্বরকে। ক্রমেই দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে চলে তাদের চাল। ধীরে ধীরে তার প্রশ্নের উত্তেজক সংকেত ও বেজে চলা সুরটির ছন্দের উন্মাদনা সাড়া জাগায় আশেপাশের মানুষজনের মধ্যেও। ফিরে থাকা মুখগুলি আস্তে আস্তে ঘুরে যেতে থাকে ফের মঞ্চের দিকে।

    দৃঢ় ও তালবদ্ধ পদক্ষেপে মঞ্চের ওপর ঘুরে ঘুরে তারযন্ত্রটি বাজাতে বাজাতে তীক্ষ্ণ চোখে আসরের দিকে নজর রাখছিল হরিদাস। এইবারে সময় হয়েছে। একটি নিখুঁত ঘূর্ণনে পরনের ঢোলা পোশাকটিতে ঢেউ তুলে মাইক্রোফোনের সামনে ফিরে এল সে। তারপর হাতের বাজনাটি থামিয়ে গলা নিচু করে পরের পংক্তিটিকে ভাসিয়ে দিল বাতাসে—

    সেই জন্মস্থলের সদর মুখে-এ
    সেই জন্মস্থলের সদর মুখে-এ
    মায়াচুম্বুক কলটি পাতা আছে ভাই
    বলব আর কাকে—
    ভাই বলব আর কাকে—
    সেথা ব্রহ্মা বিষ্ণু আর ত্রিলোচন কূল পায়না ভেবে
    হঠাৎ এক বিপুল উল্লাসধ্বনি ছড়িয়ে পড়লো আসরে। সুর, কথা ও ছন্দ মিলিয়ে জীবনের এই আসঙ্গসাধনার বর্ণিল ধারাবিবরণী তাদের ইন্দ্রিয়তাড়িত চেতনায় সাড়া তুলেছে। সুরেন ক্ষ্যাপার সুরবিস্তারের নগর-পরিশিলীত মার্জনা এই গ্রামীণ কন্ঠটিতে নেই বটে, কিন্তু সে ত্রুটিকে ঢেকে দিয়েছে আবহসঙ্গীতের দ্রুতলয়ের চটুল চাল ও গানের উত্তেজক, ইঙ্গিতময় কথাগুলি। সদ্য ফিরে পাওয়া আসরের মনোযোগটিকে হারিয়ে যাবার সুযোগ না দিয়ে হরিদাস এগিয়ে চলে গানের পরের পংক্তিগুলিতে ভর করে—
    গোঁসাই গুরুচাঁদ হলেন সেই কলের মালিক
    আমার ধন্য কোম্পানি
    স্বর্গ-মর্ত্য–পাতাল জুড়ে পেতেছে কলখানি
    ভেবে তাই কহে রাধেশ্যাম
    সেই কলের সন্ধান
    গুরু ভিন্ন কে দিবে জগতের জীবে—”

    “চলো, ওঠো। বাইরে যাবো একটু—” ফরিদা হঠাৎ শোভনের পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর দ্বিতীয় কোন কথা না বলে ভিড় সরিয়ে সরিয়ে বাইরের দিকে রওনা দিল। তার পিছু পিছু ভিড়ের বাইরে বের হয় এসে শোভন জিজ্ঞাসা করলো, “কী হল? কোন প্রবলেম—”
    বড়ো বড়ো শ্বাস পড়ছিল ফরিদার। চাপা গলায় বলল, “হচ্ছেটা কী শোভন? এই খেউড় শুনতে এসেছিলাম নাকি আমরা?”
    “খেউড় তুমি কাকে বলছো ফরিদা? দেহতত্ত্বের গানকে আক্ষরিক অর্থে কেন নিচ্ছো তুমি? ও তো—”
    “আক্ষরিক অর্থে আমি কোন কিছুই নিচ্ছি না। দেহতত্ত্বের গান আমিও বুঝি। দেহ থেকে দেহাতীতের সেই সাধনা অন্য জিনিস। আমার আপত্তি এ লোকটার গাইবার ভঙ্গিতে। লোকের মনোযোগ টানবার জন্য মেয়েদের শরীরটাকে ব্যবহার করছে এ। দেহতত্ত্বের গানকে খেউড়ের রূপ দিয়েছে। আ-আই অ্যাম ফিলিং মোলেস্টেড সিটিং দেয়ার। তুমি আমায় এখান থেকে নিয়ে চলো—”
    শোভনের হাতের মুঠোয় ফরিদার ঈষৎ ঘর্মাক্ত হাতটা থরথর করে কাঁপছিলো। তাতে মৃদু চাপ দিয়ে শোভন বলল, “সরি ফরিদা। আধুনিক পড়াশোনায় ও মূল্যবোধে শিক্ষিত একজন মহিলার কানে এ গান কেমন লাগবে সেটা আমার আগেই বুঝতে পারা উচিৎ ছিল। চলো, চারপাশে একটু হেঁটে আসা যাক। যাবে?”
    সন্ধ্যারাত্রের কুয়াশার আবরণ কেটে গিয়ে চারপাশ তখন পরিষ্কার হয়ে গেছে একেবারে। আসরের মাঠ থেকে বের হয়ে খানিক দূরে যেতেযেতেই অন্ধকার ঘিরে এলো তাদের। দূরে দূরে একেকটি গাছতলায় মৃদু আলোর আভাস দেখা যায়। মৃদু গানের শব্দ ভেসে আসে ইতিউতি। তাদের মাথার ওপর ছড়িয়ে ছিল আকাশগঙ্গার আদিগন্ত নক্ষত্রধারা।
    “কাল কিন্তু এখানে আর থাকবো না আমি। আমার ভালো লাগছে না,” হাঁটতে হাঁটতে ফরিদা হঠাৎ বলল।
    শোভন মাথা নাড়ল, “আমারও ইচ্ছে নেই। কাল আর পরশুর দিনটাই আর বাকি আছে হাতে। তারপর তো ফেরার পালা। এ দুটো দিন একেবারেই নষ্ট করতে চাইছি না আমি। চলো কাল এখান থেকে ভোর ভোর বেরিয়ে মক্তবপুরে যাই। মুসিয়েরদাদা আমার অনেকদিনের পরিচিত মানুষ। আমার বাবাকেও চিনতেন ভালো করে। বৌদিও লোক ভালো খুব। তোমার সঙ্গে দেখাও করিয়ে দেবো, আর মুসিয়েরদাদার মেজাজ ঠিক থাকলে কিছু সত্যিকারের ভাল গানও শুনে নিতে পারবে।”
    “খুব বদমেজাজি লোক বুঝি?” ফরিদার গলায় চাপা উৎকন্ঠার ছাপ ছিল।
    শোভন হাসল, “খানিকটা। এমনিতে একেবারে মাটির মানুষ। তত্ত্বজ্ঞান গভীর। গানের গলা অসাধারণ। কিন্তু কোন কারণে মেজাজ গরম হলো তো রক্ষা নেই। লোকে বলে এককালে নাকি গুণ্ডামি করে বেড়াত। তারপর বয়েসকালে সব ছেড়েছুড়ে ফকির হলেও মেজাজটা এখনো পুরোপুরি ছাড়তে পারে নি। মাঝে মাঝে সেটা বের হয়ে আসে বাইরে। তবে সে বেশিক্ষণের জন্য নয়। এই রাগছে, এই আবার জড়িয়ে ধরছে। বছরদুয়েক আগে একবার আমার এক বন্ধুকে নিয়ে ওর বাড়িতে এসেছিলাম উমের খানের গানের খাতার খোঁজে। সেবার একটা কাণ্ডই হয়ে গেল ওই মেজাজ নিয়ে! চলো বসি কোথাও। তারপর বলছি—”
    —এইখানে চারপাশ ভারী নির্জন। কথা বলতে বলতে কখন যে তারা আসরের জনবহুল চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছে খেয়াল হয় নি। শীতের রাতে সাপখোপের ভয় নেই। একটি ঝুপসি আমগাছের নিচে গিয়ে বসলো তারা দুজনে। কাছাকাছি কেউ সদ্য ধান মাড়াই করে গিয়েছে। গাছটির নিচে এখনো সেই খড়ের সুগন্ধী স্তূপ বিছানো—

    —রাত হয়েছে অনেক। অন্ধকারে ডুবে থেকে, খড়ের শয্যায় একটি উষ্ণ কম্বলের আবরণে নিজেদের মুড়ে দুটি ঘনিষ্ঠ মানুষ মৃদু গলায় কথা বলে চলে। তাদের ঘিরে সেই নির্জন রাত, আকাশে ছড়িয়ে থাকা নক্ষত্রগঙ্গা, দক্ষিণে আলস্যে শয়ান কালপুরুষ ও বহু নিশাচর কীটপতঙ্গের সম্মিলিত সঙ্গীত এক ষড়যন্ত্রের জাল বোনে। ধীরে ধীরে সব কথা, সব বৌদ্ধিক বিনিময় অর্থ হারায়। সুতীব্র প্যাশনের আঘাতে তপ্ত শরীরদুটি ক্রমশ ঘনিষ্ঠতর হয়ে অবশেষে একে অন্যের অস্তিত্বে মিশে গিয়ে স্থির হয়ে থাকে—

    —চোখে আলো পড়ে ঘুম ভেঙে গেল ফরিদার। শেষ রাত্রের চাঁদ উঠেছে। প্রাক্‌প্রভাতের বাতাসে গত সন্ধ্যার কুয়াশা ফিরে এসেছে ফের। তার আবরণ ঠেলে চাঁদের মলিন আলো আসছিল। তাকে জড়িয়ে ধরে শোভন তখনও গভীর ঘুমে। তার দিকে চেয়ে চেয়ে অক্টাভিও পাজের একটা কবিতা মনে ঘুরে ঘুরে আসছিল ফরিদার—

    —কাল রাতে তোমার বিছানায়
    আমরা তিনজন শুয়েছি—
    তুমি, আমি আর পঞ্চদশী জ্যোৎস্না—
    ঘুমন্ত মুখটির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কপালে একটি চুমু দিল সে। তারপর আস্তে আস্তে তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসল। শেষ রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় তার খোলা গায়ে কাঁপন ধরাচ্ছিল। পাশে অবহেলায় ছড়িয়ে থাকা পোশাকগুলোকে ধীরে ধীরে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে চুপ করে বসে রইল সে।

    বুকের ভেতর একটা তিরতিরে সুখ ডানা ঝাপটাচ্ছিল ফরিদার। শোভনকে সে কিছু বলেনি, কিন্তু রাত্রে তার আলিঙ্গনে পিষ্ট হতে হতে সে বারংবার মনে মনে একটি সন্তান কামনা করেছিল। সেই কামনা নিয়েই কাল রাত্রে সে প্রিয় মানুষটির বীর্য ধারণ করেছে শরীরে। সন্তর্পণে হাত বাড়িয়ে সে শোভনের ঘুমন্ত মুখটি একবার ছুঁল। কে জানে, হয়তো এই মানুষটির আর একটি সংস্করণের ভ্রূণ আজ রাত্রেই উপ্ত হয়েছে তার গর্ভে! কথাটা মনে হতেই একটা শিহরণ খেলে গেল ফরিদার গোটা শরীরে। শোভন! তার গর্ভে! নিজের দেহরস দিয়ে দশমাস দশদিন তাকে পালন করা, একটি ভ্রূণবিন্দু থেকে তাকে ধীরে ধীরে পূর্ণ মানুষের রূপ দেয়া, পৃথিবীর আলো দেখানো—

    নিচু হয়ে ঘুমন্ত শোভনের গালে গাল ঠেকাল ফরিদা—ঝলঝলে ছেঁড়া ফ্রক পরে খালি হাতে তোমার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম একদিন। সেই থেকে অনেক দিয়েছো তুমি আমাকে। আজ আমার সেইসব ফিরে দেবার পালা—যতটুকু পারি—

    অস্ফুটে কী যেন বিড়বিড় করতে করতে ঘুমের মধ্যেই পাশ ফিরে শুলো শোভন। ফরিদা তাকে ডাকলো না। ঘুমিয়ে নিক যতক্ষণ পারে। তার সামনে তখন শেষরাত্রের ক্ষণস্থায়ী চাঁদকে ফিকে করে দিয়ে ফরসা হয়ে আসছে পুবের আকাশ—

    *******

    যশোদে মা তোর
    কৃষ্ণধনরে গোষ্ঠে লইয়া যাই
    ও তোর সব রাখালই গেছে চলে
    কেবল বাকি আছে ও ভাই
    কানাই বলাই মা
    গোঠে যাই
    যশোদে মা তোর
    কৃষ্ণধনরে গোষ্ঠে লইয়া যাই

    —কুয়াশার মধ্যে থেকে গানের সুরটা ভেসে আসতে হঠাৎ চমকে চোখ খুললো ফরিদা। শোভনের পাশে বসে বসে কখন সে তার গায়ে ভর দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো নিজেই খেয়াল করেনি। হাত তুলে ঘড়ি দেখল সে। ছটা বেজে দশ। অন্ধকার কেটে গেছে, কিন্তু ঘন কুয়াশায় চারপাশে কিছু চোখে পড়ে না। দূরে দূরে মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর আবছা শ্যিলুয়ে নজরে আসে শুধু। তাদের মাথার চুলে, গায়ে, মুখে, পোশাকে, শোভনের কম্বলের রোঁয়ায় বিন্দু বিন্দু কুয়াশার দানা ছেয়ে আছে।

    গানের শব্দটা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছিল। ফরিদা শোভনের গায়ে ঠেলা দিয়ে বলল, “এই, ওঠো, ওঠো, সকাল হয়ে গেছে যে! এ-ই—”
    “চেনা গলা পাই যেন মনে হয়!” গান থামিয়ে, কুয়াশার মধ্যে থেকে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন আনিসুল। তারপর তাদের দুজনকে দেখে চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, “এ কী মাগো! এই ঠাণ্ডায় দুটিতে মিলে এই মাঠের মধ্যে রাত কাটায়ে দিলা। তার চেয়ে আমাদের আড্ডায় চলে এলেই তো পারতে! আগুনটুকু তো ছিলো সেখানে! এখন শরীর টরীর না খারাপ হয়।”

    কম্বলের মধ্যে থেকে ঘুম জড়ানো গলায় শোভন উত্তর দিল, “ভেবোনা দাদা। অত সহজে এ শরীরের কিছু হবে না গো—”
    “সে তোমার নাহয় কিছু না হল, কিন্তু আমার মায়ের কথাটাতো ভাববা, নাকি?”

    শোভন হাসি হাসি মুখে উঠে বসলো। কম্বলটা গা থেকে খুলে ফেলে ভাঁজ করতে করতে বলল, “ও সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন গানটা শেষ করো দেখি। ভোর ভোর বড় ভালো গাইছিলা। আহা--” বলতে বলতে শোভন নিজেই গুনগুন করে উঠলো—

    যশোদে মা তোর
    কৃষ্ণধনরে গোষ্ঠে লইয়া যাই—
    ও তোর মায়ের কোলে ঘুমায়ে রইলি
    ও তোর ঘুম ভাঙে না ও কানাই বলাই—



    এরপর মুখরাটিতে ফিরে আসতেই হঠাৎ তার ভারী গলার সঙ্গে মিশে গেল ফরিদার নিচু ও তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর। আনিসুল নিজে গান বন্ধ করে দিয়েছেন কখন যেন। চোখদুটি বুঁজে রয়েছে তাঁর। নিঃশব্দে, একটি তরুণ গাছের মতো তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন যুবক-যুবতী দুজনের সামনে। তারপর হঠাৎ করেই ফরিদার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আবেগতাড়িত ঈষৎ ভাঙা ভাঙা গলায় গানটির শেষপদটি কন্ঠে তুলে নিলেন তিনি—
    আমরা সবে রাখাল বলে মা
    থাকি আমরা বনে বনে
    ও মা তোর গোপালের ক্ষুধা পেলে
    দ্বারে দ্বারে মা কত ভিক্ষা চাই—
    তারপর, শেষবারের মত মুখরাটিতে ফিরে এসে তাঁর গলার সঙ্গে মিশে গেল শোভন ও ফরিদার গলা—
    —যশোদে মা তোর
         কৃষ্ণধনরে গোষ্ঠে লইয়া যাই—

    “হ্যাঁগো মা, বাবা, তোমাদের এই গুণ যে আছে তা তো ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দাও নাই কাল থিকে? এ তো বর্ণচোরা আমের জোড়া গো! তা ঘরে ভাবের গানের চর্চা আছে বলে মনে হয়!”

    ফরিদা লাজুক মুখে বললো, “আমার নেই। বাবা শরিয়ত মেনে চলতেন। ঘরে গানবাজনার পাট ছিলো না। তবে ওনার আছে। ঈশ্বর হরকান্ত বিশ্বাস আমার শ্বশুর ছিলেন।”
    “ওহো তাই বলো। তুমি তো বাবা মহাজনের সন্তান গো! আমাদের এদিকেও আসরে আসরে তেনার পদের খুব খাতির,” বলতে বলতেই ফের ফরিদার দিকে ফিরে আনিসুল বললেন, “তা মা, বাবা তো শরিয়ত মেনে চলতেন, তুমি মানো না?”

    ফরিদা একটু ইতস্তত করল, “না, মানে আমি ঠিক ও’সব—”

    আনিসুলের মুখে একটা চওড়া হাসি ছড়িয়ে গেল। বললেন, “তুমি তো মা তাহলে আমার পথের মানুষ গো! বে-শরা ধম্মের লোক। বাহা রে ওপরওলা। দেখো দেখি প্রেমের লীলা! ফকিরানি আর বৈরিগির সংসার, মাথার ওপর ছাদ নাই—হা হা হা—”

    শোভন বসে বসে মিটিমিটি হাসছিল। এবারে বলল, “তা কী ঠিক করলে আনিসুলদাদা? আজ মক্তবপুরের দিকে চলবে নাকি গো? গেলে চলো রওনা দিই। দুপুর হবার আগি মুসিয়েরের ডেরায় গিয়ে পড়া যাবে। যাবার পথে বাসস্ট্যাণ্ডের বাজারে নেমে একটু পাঁঠার তেল নিয়ে চলে যাবো ওমনি। বৌদিদি ওটা যা ভালো বানায়! একবার খাইয়েছিলো, এখনো মুখে লেগে আছে।”

    আনিসুল চুপ করে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, “না গো বাবা, আমার আর মুসিয়েরের ডেরায় যাওয়া হবেনা এ যাত্রা। কাল হরিদাসের গানের পরে বাবুরা আজও আবার গানের বরাত দিয়েছেন। একঘন্টা গাইতে হবে আজ।”
    “ভালো খবর। কী গাইবে? কালকের মতো তত্ত্বগান গেওনা আজ। এ আসরে সেসব গানের লোক নেই আনিসুলদাদা।”

    আনিসুল বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়লেন, “ও গান ছাড়া আর কোন গান আমার ভালো আসেনা যে বাবা! তাই ঠিক করেছি এ আসরে আজ আর আমি গান গাব না। বাবুরাও দেখলাম হরিদাসকেই গাইতে বলছিলেন বিশেষ করে। ওর গানই হোক আজ। মাঝে আসাদ খালি একখান গাইবে। আমি আজ কেবল বাজাবো।”

    তাঁর গলায় কোন দুঃখের সুর ছিল কি? শোভন ভালো করে চেয়ে দেখল একবার আনিসুলের মুখের দিকে। না, মুখ তাঁর সেই সবসময়েরই মত প্রশান্ত, নিরুদ্বেগ।

    কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শোভন আস্তে আস্তে বলল, “এ আসরে গানই যখন আর গাইতে পাবে না, তখন এখানে আর থেকে হবে কী? আমাদের সঙ্গেই চলো না!”
    “সে কি হয় নাকি বাবা? হাতে ধরে গান শেখালাম যারে, সেই চ্যালা আমার আজ গাইবার বায়না পেল। আমি আসরে গাইতে পেলাম না বলে তারে যদি ত্যাগ করে যাই সে তো অধর্ম হবে গো!” বলতে বলতেই হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠলেন আনিসুল। কুয়াশা ছিঁড়ে বের হয়ে আসা সূর্যের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, “বেলা হল যে! তোমরা এইবারে রওনা হয়ে পড় তাহলে। নটার বাসটা না পেলে পরে একেবারে দুটি ঘন্টার ধাক্কা।”

    শোভন, ফরিদার গোছগাছ হয়ে গিয়েছিল। যার যার ব্যাগদুটি কাঁধে তুলে নিয়ে উঠে পড়ল তারা।
    “তাহলে যাই আনিসুলদা।”
    “হ্যাঁ বাবা যেতে নাই, আসো গিয়ে। ভালোভাবে যেও, আর আমার এই বে-শরা ফকিরানির দিকে একটুক খেয়াল নজর কোরো। আর একটা কথা, শীতের রাতে এমন করে আর গাছতলায় ফেলে রেখোনা মাকে এই বলে দিলাম। আসো মা, আরে আরে ছি ছি—করে কী? করে কী?” তাঁর পায়ের দিকে উদ্যত ফরিদার হাতদুটিকে কোনমতে সরিয়ে দিলেন বিব্রত আনিসুল।

    ফরিদা একটু অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি আমার প্রণাম নেবেন না?”

    আনিসুল হাসলেন। তারপর তার চিবুকে হাত ঠেকিয়ে একটি চুমু খেয়ে বললেন, “ফকিরের যে প্রণাম নিতে নাই মাগো। তাছাড়া মা বলে একবার যখন ডেকেছি তখন ছেলে হয়ে প্রণাম নিই কেমন করে? তবে হ্যাঁ আল্লা আলেকের কাছে দোয়া করি স্বামীসন্তানে তুমি সৌভাগ্যবতী হয়ো মা। আর, কখনো পারলে আমাদের পাতিকাবাড়ির ডেরায় একবার জোড়ে পায়ের ধুলো দিয়ে যেও।”

    —রুক্ষ, ফসলবিহীন মাঠের মধ্যে দিয়ে সরু পায়েচলা পথটি এগিয়ে গিয়ে গ্রাম সড়ক যোজনার বাঁধানো রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। সে রাস্তায় উঠে একবার পিছু ফিরে দেখলো তারা। অনেক দূরে, দিগন্তের কাছে তখনো দাঁড়িয়ে রয়েছেন ফকির আনিসুল। সেইদিকে একবার হাত নাড়ল ফরিদা। কোন সাড়া এল না তাঁর দিক থেকে। দেখতে পেয়েছেন কিনা কে জানে!

    *********

    ন’দা-বহরমপুর রুটে বাস বড় বেশি থাকে না। দুতিনঘন্টা পরে পরে একটা করে বাসের দেখা মেলে। ফলে ভিড় হয় ভালোই। আঠারোগাঁ থেকে ওঠবার পর প্রায় আধঘন্টা সেই ভিড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝাঁকুনি সহ্য করবার পর হরিগঞ্জ স্টপে এসে পাশাপাশি জায়গা পাওয়া গেল দুটো। জানালার ধারে গদি আঁটা লম্বাটে সিট। প্রাকমধ্যাহ্নের হাওয়ায় তখনো শীতের কামড় ছিল। গায়ের চাদরটা দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসেছিল ফরিদা। খানিক বাদে, বাইরের ছুটন্ত গাছপালার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই হঠাৎ নিচু গলায় সে বলল, “আনিসুলদার জন্য আমার কিন্তু খুব খারাপ লাগছে, জানো!”

    হাতের বইটার দিকে চোখ রেখেই শোভন বলল, “কেন? আমাদের সঙ্গে আসতে পারলো না বলে?”
    “না, সেজন্য নয়। একদিনের আলাপ। এমন কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু তো নয়! দুঃখ হচ্ছে মানুষটার গান সম্মান পেল না বলে। লোকটা আজকে আর গাইতে পারবে না। তার বদলে একটা আপস্টার্টমার্কা ছেলে—আচ্ছা বলো তো, একটা জায়গার একেবারে নিজস্ব প্রাচীন সংস্কৃতির কোন ধারাটা চালু থাকবে আর কোনটা থাকবেনা সেটা বাইরে থেকে আসা কিছু মানুষ ঠিক করে দেয় কোন অধিকারে? আনিসুলের তত্ত্বগান বা হরিদাসের কোমর নাচানো গান&mdashআগামিদিনের লোকসংস্কৃতির বাহক এদের মধ্যে কোনটা হবে সেটা ঠিক করবেন এ গানের উৎসভূমির মানুষেরা। অন্য কেউ তা করতে গেলে সেটা হবে অনধিকারচর্চা।”

    শোভন জানালা থেকে ভেতরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “ইতিহাস পড়োনি ফরিদা? যার শক্তি বেশি সে চিরটাকালই তো নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছেটার দায় দুর্বলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে এসেছে। এটাই আমাদের সভ্যতার নিয়ম যে। আজ আঠারোগাঁয়ের মেলায় হঠাৎ করে তার ব্যতিক্রম হবে কী করে?”
    “কিন্তু তাই বলে সবাই সেটাকে মুখ বুঁজে মেনে নেবে? কেউ একটা প্রতিবাদও করবে না?”
    “না। করবে না। ওতে তিক্ততা বাড়া ছাড়া আর কোন লাভ হয় না ফরিদা। আর তাছাড়া এই যে সাংস্কৃতিক ঔপনিবেশিকতা এর একটা অন্য ইন্টারপ্রিটেশনও কিন্তু হয়। ভেবে দেখো, সমস্ত প্রাচীন ইণ্ডিজেনাস সংস্কৃতিকেই একসময় না একসময় একটা অস্তিত্বের যোগ্যতার পরীক্ষার মুখে দাঁড়াতে হয়। অন্য কোন শক্তিশালী সংস্কৃতির আক্রমণই সেই পরীক্ষা। সেই অস্তিত্বের সংগ্রামের মুখে দাঁড়িয়ে প্রাচীন সংস্কৃতিটির যে অংশগুলো দুর্বল তারা ধুয়ে মুছে যায়। টিঁকে থাকে শুধু তার যোগ্যতম দিকগুলো। তাতে সে সংস্কৃতির লাভ বই লোকসান কিছু হয় না। আর যে সংস্কৃতির ভিতে ঘুণ ধরে গেছে তা একেবারেই ধুলিসাৎ হয়ে যায় সেই আক্রমণে। তুমি যে কাল খেউড়ের কথা বলছিলে, সেই খেউড়ই এর একটা উদাহরণ কিন্তু। বিলিতি সংস্কৃতি যখন বাংলাকে এসে ঘা দিল তখন এই খেউড়ের মতো বাংলার সংস্কৃতির কিছু কিছু দুর্বল ধারা সেই স্ট্রাগল ফর এগজিস্ট্যান্সে একেবারে হারিয়েই গিয়েছে। অন্যদিকে আবার, নিজের শক্তিতেই টিঁকে গিয়েছে তার অন্যান্য অজস্র লোকগানের ধারা। শুধু টিঁকে গিয়েছে বললে ভুল বলা হয়। তার সুর ও দর্শন এসে বরং আরো পুষ্ট করেছে বিলিতি প্রভাবে সৃষ্টি হওয়া নগরকেন্দ্রিক অন্যান্য নব্য সঙ্গীতধারাকে। ‘আমি কোথায় পাবো তারে’র সুর শহরে এসে হয়ে গেল ‘আমার সোনার বাঙলা’র সুর। শুধু এই একটা নয়। গীতবিতানটা খুলে বসে দেখো একবার, অনেক উদাহরণ পাবে।”

    ফরিদা একটু বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়লো, “দেখো, তর্কে তোমার সঙ্গে আমি পেরে উঠবো না। কিন্তু মন থেকে ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারছি না।”

    শোভন হাসল, “তোমার মানতে পারা না পারায় সময়ের কিছু এসে যাবে না ফরিদা। পুরনোর সঙ্গে নতুনের লড়াইটা চিরকেলে ব্যাপার। ওতে যার কোমরের জোর আছে, সে টিঁকবে, যার নেই সে হারিয়ে যাবে কিংবা বেঁচে থাকবার জন্য নিজেকে বদলে নেবে।”
    “বদল মানে কি তুমি আনিসুলের তত্ত্বগানকে ফেলে দিয়ে হরিদাসের গানকে লোকসংস্কৃতির স্বীকৃতি দেয়াটাকে মিন করছো? সেটাকে তোমার খুব সুস্থ কাজ বলে মনে হচ্ছে কি?”
    “টিকিটটা করবেন দাদা।” কণ্ডাকটারের ডাকে আলাপের সুতোটা কেটে গেল তাদের। শোভন পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল, “মক্তবপুর দুটো দেবে। কতো?”
    “ছয় ছয় বারো টাকা দেবেন। পরের স্টপই মক্তবপুর কিন্তু। উঠে যান নইলে মেয়েছেলে নিয়ে শেষে নামতে পারবেন না,” বলতে বলতেই শোভনের হাতে টিকিটদুটো গুঁজে দিয়ে পেছনদিকে এগিয়ে গেল কণ্ডাকটার।
    “চলো, আগে নামা যাক। বাকি তর্কটা নয় মুসিয়েরের আখড়ায় গিয়ে সারা যাবে’খন,” ঝোলাদুটো কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল শোভন।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • | | | | | | | ৮ | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments