সরু খোয়া বিছানো পথ বিস্তীর্ণ সর্ষের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে দিগন্তের দিকে। প্রাক মধ্যাহ্নের মৃদু হাওয়ায় সেই পীতবর্ণ সমুদ্রে মৃদুমন্দ ঢেউ ওঠে। সেইদিকে তাকিয়ে পথ চলতে চলতে ফরিদা হঠাৎ নিচু গলায় বলল, এবারে বাড়িতে ক্লাস টেন সর্ষে বুনেছে প্রায় সাত কাঠা, না গো? ফুল আসছিলো দেখে এসেছিলাম—”
শোভন আগে আগে হাঁটছিলো। তাদের নামিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া বাসটা এরই মধ্যে দূরে উত্তরের দিগন্তের কাছে ছোট হয়ে এসেছে। সেদিক থেকে চোখ না ঘুরিয়েই বলল,“ সে কী ? পাঁচদিনও হল না বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছি, এরই মধ্যে—”
“এরই মধ্যে—কী? বাড়ির কথা মনে পড়বে না? একগাদা বাচ্চা, তাদের রেখে এলাম একা শর্মিষ্ঠাদির কাছে। তারও তো ঘরসংসার আছে, না কি? কত করবে?”
“আহা ভুবনদাও তো বলেছে মাঝে মাঝে এসে দেখে যাবে।”
“ওই আর একজন। নিজেই তো একটি বিরাট শিশু। আশকারা দিয়ে দিয়ে বাচ্চাদের মাথায় করে তোলে একেবারে। যা করে সবকটা মিলে ভুবনদা এলে! আমাকেও মানতে চায় না তখন আর। ও এলে শর্মিষ্ঠাদির আরো বেশি মুশকিল হবে দেখো।”
“দেখবো, দেখবো। আর তো দুটো দিন মোটে। পরশু সকাল থেকে ফের ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। এখন পা চালিয়ে চলো দেখি—এই যে , এখান দিয়ে –সাবধানে নেমে এসো--”
মূল রাস্তা ছেড়ে একটা সরু পায়েচলা পথ নেমে ক্ষেতের মাঝবরাবর সটান পুবমুখো চলে গিয়েছে। সেইখানে নেমে দাঁড়িয়ে শোভন হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকছিলো। ফরিদা কাছে এসে নিচু হয়ে তার হাতে ভর দিলো।
ফরিদার ডানহাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়েই হঠাৎ তার অনামিকার দিকে চোখ যেতে শোভন একটু অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করলো, “এটা কোত্থেকে বের করলে? আগে দেখিনি তো!”
অনামিকায় জ্বলজ্বল করতে থাকা ফুলকাটা আঙটিটার দিকে তাকিয়ে ফরিদা মাথা নেড়ে বলল, “সমাদৃতাদির গিফট। আমার সঙ্গেই রাখা ছিল। পার্সের মধ্যে। আজ সকালে উঠে পরতে ইচ্ছে হল।”
শোভনের বুকের মধ্যে একটা অপরিচিত অনুভুতি পাকিয়ে উঠছিলো। তাদের আড়ম্বরবিহীন বিয়েতে পাওয়া একমাত্র উপহার। সমাদৃতার পাঠানো বাক্সটাই সে শুধু দেখেছিলো। তার ভেতরে কী আছে তা ফরিদাও তাকে কখনো খুলে বলে নি, তারও কখনো কোন আগ্রহ হয় নি সে নিয়ে। কিন্তু সোনা! সোনা তো সে বর্জন করতেই চেয়েছিলো। ফরিদাও তাই। শুধু সোনা কেন, কোন উপহারই তারা নিতে চায়নি কারো কাছ থেকে। বিয়েটা একান্তই অনাড়ম্বরভাবে সারতে চেয়েছিলো দুজনেই।
শর্মিষ্ঠা বিয়েতে ফরিদাকে একটা গলার হার দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু সেই নিয়ে অনেক জেদাজেদি করে শেষে মুখ কালো করে তাদের জেদটাই মেনে নিতে হয়েছিলো শর্মিষ্ঠাকেও। সোনা ফরিদা নেয় নি। রানাঘাটের ম্যারেজ রেজিস্ট্রির অফিস থেকে বেরিয়ে শোভনের হাত ধরে ভুবন দাসের আখড়ায় ফিরে এসেছিলো একেবারেই খালি হাতে।
সেদিন রাত্রে ভুবন দাসের আখড়ায় খাওয়া দাওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছিল একটু। ভুবন দাস তাদের কোন কথা শোনেন নি। ফরিদাকে তিনি ধর্ম মেয়ে মেনেছেন তার বাবার মৃত্যুর পরদিন থেকে। অতএব তার বিয়ের সময় নিজের কর্তব্য স্থির করবার জন্য তিনি শোভন বা ফরিদার কোন মতামত নেননি। নিজের থেকেই নিমন্ত্রণ করে এনেছিলেন স্কুলের সমস্ত ছাত্রকে। বহুকালের সঙ্গী কিছু সাধক বাউল-ফকির-বৈরাগিকেও নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। উঁচু ক্লাশের কয়েকটি ছাত্রের সাহায্য নিয়ে খিচুড়ি,পাঁচ রকম ভাজা ও পাঁচতরকারির একটি লাবড়ার ভোগ সাজিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণের আসনটির সামনে। বিকেল বিকেল বরকণে নিয়ে শর্মিষ্ঠা ফিরে আসতে তাদের জোড়ে বসিয়ে নিজের হাতে গোপীচন্দনের ফোঁটায় সাজিয়ে দিয়েছিলেন মেয়ের উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখটিকে। তারপর উঠোন জুড়ে খিচুড়ি আর লাবড়ার সামান্য আয়োজনে বাল্যভোগের আসর বসেছিলো।
সন্ধের পর আখড়ার উঠোনে চাঁদের আলোয় গানের আসর বসেছে যখন, তখন ব্রতীন এলো। তার দফতরে সেদিন সারাদিন ধরে ডি এম ইন্সপেকশন চলেছে। ইচ্ছে থাকলেও রানাঘাটে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে হাজির থাকা তার হয় নি তাই। শোভনের কাছে এসে তার হাতদুটি ধরে মৃদু একটু চাপ দিয়ে সে ফরিদার দিকে ঘুরল। তারপর পকেট থেকে ছোট একটা পার্সেল বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, “এটা সমাদৃতাদি এক ভদ্রলোকের হাতে করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তোমার জন্য। আজ দুপুরবেলা এলো। সঙ্গে চিঠি আছে একটা। সমাদৃতাদি বলে দিয়েছেন, সেটাও একেবারেই তোমার একলার জন্য। উপহার তোমরা রিজেক্ট করছো আমি জানি অ্যান্ড আই রেসপেক্ট ইওর ডিসিশান। সমাদৃতাদিকে আমি সে কথা ফোনে বলেওছি আজ। কিন্তু এই উপহারটা রিজেক্ট করবার আগে তুমি যেন তাঁর চিঠিটা একবার পড়ে নাও এইটুকু অনুরোধ শুধু তিনি করেছেন। আশা করি তুমি তা রাখবে।”
সমাদৃতার চিঠিটা নিয়ে আসন ছেড়ে উঠে ফরিদা উঠোন ছেড়ে ঘরের মধ্যে চলে গিয়েছিলো। কিছুক্ষণ বাদে বের হয়ে এসেছিলো যখন তখন তার গলার স্বর ভারী হয়ে উঠেছে। ব্রতীনের কাছে এসে নিচু গলায় বলেছিলো, “বাক্সটা আমায় দিন ব্রতীনদা।” এর পর থেকে সে বাক্স বা চিঠি শোভনকে কখনো দেখায় নি ফরিদা।
চলতে চলতে ফরিদার আঙুলের আঙটিটার দিকে অন্যমনস্কভাবে একবার চেয়ে দেখলো শোভন। রোদ পড়ে তার ঠিক মাঝখানে ‘এস’ অক্ষরটা ঝিকিয়ে উঠছে মাঝে মাঝেই।
“আর কতদূর গো?”
ফরিদার গলায় ক্লান্তির ছাপ ছিল।
সামনের দিকে একবার দেখে নিয়ে শোভন বলল, “বেশিদূর নেই আর। কান পেতে শোন, লোকজনের আওয়াজ পাবে।”
নির্জন দুপুরে দূরে কোথাও থেকে বেশ কিছু মানুষের উপস্থিতির ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসছিলো। কথাবার্তার গুণগুণ আওয়াজের মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ করে বাতাসে ভেসে যাওয়া তিরতিরে সুরের ঝলক। ফরিদা কান পেতে সেইদিকে শুনে নিল একবার। সামনে কিছু দূরে ক্ষেতের সীমানা থেকে আকাশটা ঝুপ করে নেমে গেছে নিচের দিকে। ওদিকে নদী রয়েছে নিশ্চয়। জলঙ্গীরই উপনদী হবে হয়তো। তার বুক থেকে উঠে আসা ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীরে কাঁপুনি ধরছিল। শাড়িটা দিয়ে ভালো করে গা ঢেকে নিল ফরিদা। তারপর বড়ো বড়ো পায়ে এগিয়ে এসে শোভনের বাহুটা নিজের হাতে জড়িয়ে নিল। তার হাতে পরা আংটিটা শোভনের বুকের পাঁজরে এসে একটা কাঁটার মতোই খোঁচা দিচ্ছিল বারবার।
মিনিট দশেক চলবার পর ক্ষেত শেষ হয়ে গ্রামের সীমানা দেখা দিল। এদিক ওদিক একটি দুটি ছড়ানো ছেটানো বাড়ি। ইতিউতি পুকুর, আমবাগান। তার ধার বেয়ে বেয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া সরু পথ এগিয়ে গিয়ে পুরোন একটা দালানবাড়ির দরজায় মিশেছে। তার ভেতর থেকে মানুষজনের আওয়াজ এইবারে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। সামনের পাল্লাহীন ইঁট বের করা গেটটা দিয়ে নানান রকমের মানুষ যাতায়াত করছে। সেইদিকে ইশারা করে শোভন বলল, “এসে গেছি। ওই যে মুসিয়েরের আখড়া।”
ফরিদা অবাক হয়ে বলল, “আখড়া, মানে—এ তো বেশ সম্পন্ন গৃহস্থবাড়ি বলে মনে হচ্ছে।”
“সে তো মনে হবেই। সম্পন্ন গৃহস্থবাড়িই তো ছিল এককালে। মুসিয়েরের পূর্বপুরুষরা এ অঞ্চলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার ছিলেন। নবাবী আমলে এখানকার জায়গিরদারটার কিছু একটা ছিলেন এঁরা। নামকরা অর্থোডক্স মুসলমান পরিবার। এলাকার লোকজন ভয়েভক্তিতে মেনে চলত এঁদের।
কিন্তু মুসিয়েরের বাবা উমের খাঁর আমলে এসে সবকিছু একেবারে উল্টেপাল্টে গেল। ইনি বাপপিতামহের পথে যাননি একেবারেই। জমিদারগিরি করা তাঁর আসতো না। একদিকে দুর্দান্ত পুরুষ, আবার অন্যদিকে কোথা থেকে যে রক্তে কবিতা এসেছিল ওঁর কে জানে। লালন শাহের গানের ভক্ত ছিলেন। মজেছিলেন মুর্তজার যোগকালান্দর কাব্যের দেহতত্ত্বের দর্শনে। নিজের হাতের কলমও চলত ভালো। শেষমেষ ওই লালন শাহের গান আর মুর্তজার দেহতত্ত্বের দর্শনই ওঁর জীবনটাকে একেবারে বদলে দেয়। একদিন শরিয়ত বিসর্জন দিয়ে ফকিরি ধর্ম নিলেন উমের খাঁ। জমিদারী গেল। ভূসম্পত্তি যা ছিল তার থেকে বিঘে কয়েক স্ত্রীপুত্রের ডালভাতের জন্য আলাদা করে রেখে বাকি সব বিলিয়ে দিলেন পাত্রাপাত্র বিচার না করে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল, এতে কিন্তু লোকজন মোটেই এই বে-শরা ফকিরকে ধন্য ধন্য করেনি। উলটে—”
“আরে, গোঁসাই যে! আসো আসো। সঙ্গে করে আবার কাকে নিয়ে এলে গো?”
ডাকতে ডাকতে বাড়ির দিক থেকে আঠারো-ঊনিশ বছরের একটি তরুণ দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসছিল তাদের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে শোভন আস্তে আস্তে বলল, “জহিরুল। মুসিয়েরের ছেলে। একটু সামলে। ব্যাটা কিন্তু খুব আনপ্রেডিক্টেবল। গানের পাশাপাশি এলাকার গুণ্ডা বলেও বদনাম আছে।”
ছেলেটি রূপবান। পরনে আধাময়লা একটি ট্রাউজার। গায়ে হাতকাটা ফতুয়ার ওপরে চাদর। কয়েকদিনের না কাটা পাতলা দাড়িগোঁফের ফাঁকে দুটি জ্বলজ্বলে চোখ কৌতুহলী দৃষ্টিতে ফরিদার দিকে ঘুরে দেখছিল। সে চোখে নাগরিক সংকোচের বালাই নেই। তার চোখে চোখ রেখে হাসল ফরিদা। তারপর বলল, “তোমার নাম বুঝি জহিরুল? আমার নাম ফরিদা। আমি তোমার গোঁসাইয়ের গোঁসাইনী হই।”
চওড়া একফালি হাসি খেলে গেল ছেলেটির মুখে। তাদের সঙ্গে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে শোভনের দিকে ফিরে বলে, “এইবারে ঠিক হয়েছে গো শোভনদাদা। এক ছিলা, দুই হয়েছ। মা-গোঁসাই জুটায়ে নিয়েছো। বলে একা তো বোকা। চলো চলো, বাবা খুশি হবে।”
“বাবা ভালো আছে?”
“ওই আছে আরকি একরকম। এমনিতে তো শরীরগতিক বিশেষ ভালো নয়। তোমার মেলা থেকে ঘুরে এসেই রফিগঞ্জে গেছিলো। সেখানে গিয়া ধুম জ্বর। তাও বলে গাইবে। কারো কথা শুনল না। তারপর জ্বর গায়ে গাইতে উঠে চোখটোখ উল্টায়ে গিয়ে কেলেংকারি কাণ্ড। ফিরে এসে পনেরোদিন বিছানায় পড়ে রইলো। কিন্তু সেরে উঠে তক আবার যে কে সেই। কাঁহা কাঁহা মুল্লুকে চরকিপাক দিয়ে চলেছে।”
“কিছু বলো না কেন তোমরা?”
“বললে শুনবে নাকি? বাবাকে তো জানো। আপন খেয়ালে চলে, আবার তেমনি জিদ। এই তো দেখো না, তিনদিনের মেলা, বাড়ায়ে চারদিন করে দিল। কি না আমাবস্যা পড়েছে আসছে কাল। কাল দাদুর মাজারে গুরুবন্দনা হয়ে তবে মিলন হতে হবে। একদিন আগে করা যাবে না। কেন, একদিন আগে গুরুবন্দনাটি করে নিলে দোষটা কী হত!”
“তা মেলাটা একদিন পরে শুরু করলেই হত!”
“ও বাবা। আঠারোগাঁর মেলা যেদিন শুরু হয় সেদিন এ মেলাও শুরু হতে হবে তো! ওই বাবার আরেক জিদ। সে মেলা এবার মিরর কোম্পানি তাদের হিসাবে একদিন আগায়ে দিল তো বাবাও এই মেলা আগায়ে দিল। কারো কথা শুনলো না। এই তিনটা দিন তো পায়ের উপরেই আছে। ভিতরে চলো, নিজেই দেখবা। মা গোঁসাই আসেন গো—”
“ওই যে, ওই যে, এখনো বাড়ির ভেতরে পা দিলাম না, ওমনি শুরু হয়ে গেল। থামো দেখি! কেমন আছো তুমি?” বলতে বলতেই এগিয়ে এসে তাঁকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল শোভন। রোদ লেগে উষ্ণ আলখাল্লাটির স্পর্শ লাগছিল তার শরীরে। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রৌঢ়টি ফের বললেন, “এমন আকাশের তারাটি যখন নারী হইয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো, সেই তো তখন নিজেই তার ঠেঙে বশ মানলে গো!”
কথাগুলো শুনতে শুনতে ফরিদা সামান্য সংকোচ বোধ করছিলো। তার মুখের সেই অস্বস্তির ছায়াটুকু তীক্ষ্ণধী মানুষটির নজর এড়িয়ে গেল না। শোভনকে ছেড়ে দিয়ে তিনি ফরিদার দিকে ঘুরে বললেন, “আসো আসো, ভিতরে আসো। সন্নিসিকে ঘানিগাছে জড়ায়েছো, তুমি তো যেমন সেমন প্রকৃতি নও গো জননী!”
সরু প্রবেশপথটি দিয়ে ভেতরে ঢুকেই একটি প্রশস্ত উঠোন। তার একপাশে রান্নাবাড়ি আর অন্যপাশে এলোমেলোভাবে গড়ে ওঠা গুটিকয় ঘর নিয়ে একটি কোঠাবাড়ি। গোটা বাড়িটি জুড়ে বহু মানুষের যাওয়া-আসা চলেছে। তাদের উঠোনে ঢুকতে দেখে মধ্যবয়সী এক প্রৌঢ়া রান্নাবাড়ি থেকে আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে হাসিমুখে উঠে এসে বললেন, “আসো বাবা, আসো। আজ যে বড় ভাগ্যি হল! তা আসা হচ্ছে কোথা থিকে? মুরলীপুর থিকে নাকি?”
শোভন মাথা নাড়লো, “না। আঠারোবাড়ির মেলায় এসেছিলাম কাল বিকেলে। ভাল লাগলো না, তাই সকাল সকাল উঠে এখানে চলে এলাম।”
“তা ভালো আর লাগবে কী বলো বাবাজি? টিভি কোম্পানির গান। তার রঙঢঙই আলাদা। সে কি সবার সয় গো?” বলতে বলতে পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ছিলেন মুসিয়ের। তারপর হঠাৎ বললেন, “সেখানে কাল হর বাউলের গান শোনলা নাকি গো?”
শোভন মাথা নাড়লো, “উঁহু, শোনা হয় নাই। বিরাট বড়ো মেলা, কত লোকজন—”
“হ্যাঁ, তা বটে, তা বটে। তা, হরকে চেনো তো? ওই যে, মার্গারেট খেপীর বাউল গো।”
“মার্গারেট, মানে সেই অস্ট্রেলিয়ার মেয়েটা তো? তোমার এখানে এসে যে বছরকয়েক আগে কয়েকদিন ছিল গান রেকর্ড করবে বলে—”
“হ্যাঁগো বাবাজি। এখান থেকে বারায়ে তারপর এদিক ওদিক ঘুরে সে গেল হর বাউলের আখড়ায়, বাউল গান রেকড করতে। সেই যে গেল, তো গেলই। হর যে তারে কী জাদু করল, তার কাছ ছেড়ে সে মেয়ে আর নড়ল না। বছর দুয়েক হল সে তার সাধনসঙ্গিনী হয়ে বসেছে। দুয়ে মিলে চারিচন্দ্রের লীলাখেলা। তা বাদে হর এখন বছরে একবার শীতকালে শ্বশুরবাড়ি যায়। মার্গারেট নাম নিয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া দাসী। দিব্যি টরটর করে বাংলা বলে। গানটাও গায় ভালো। তেনার আমলে হররও উন্নতি হয়েছে। টিভিতে সিনিমা টিনিমাতে গাইছে আজকাল। বিলাতেও নামটাম হয়েছে। আখড়াতে এখন আর থাকেই না। কলকাতায় বাড়ি কিনেছে। বিষ্ণুদাসীরে নিয়া সেইখানেই থাকে।”
“সেকি গো? এ তো রূপকথার গল্প। বেহেশতের হুরি এসে আদমের পোর গলায় মালা দিল—”
তার বাকি কথাটুকু মুসিয়েরের উঁচুগলার হাসিতে ঢেকে দিয়ে গেল। তারপর হাসতে হাসতেই বললেন, তা সেই আদমের পো’র গলার গান আজ রাত্রে তোমারে শোনাবো বাবাজি। আমাদের সত্য গিছিল কাল আঠারোগাঁয়ের মেলায়, দেখা পেয়ে আজ সক্কাল সক্কাল একেবারে তার খেপিশুদ্ধু গেরেফতার করে নিয়ে এসেছে।”
বলতে বলতেই পেছনে এসে দাঁড়ানো গেরুয়াধারী যুবকটির দিকে কৌতুকমাখা চোখে ঘুরে তাকিয়ে মুসিয়ের বললেন, “ও সত্য, কী হল কাল, বলো না!”
যুবকটির মুখেও তখন মিটিমিটি হাসি। বললো, “শুনে দ্যাখবেন, সে এক বেজায় ব্যাপার—আহা—হর বাউল নেশার ঘোরে তেনাদের কুণ্ডগোলকোদ্ভব পানের কথা বলে ফেলিছিল, তা এক ফচকে ছোঁড়া নাকি মোবাইল ফোনে সে গপ্পো তুলে নিতে গিছিল। তাইতে চোখ টোখ পাকায়ে বাউল তারে—”
ফরিদা কৌতুহলী চোখে শোভনের দিকে তাকাচ্ছিল। বাউলের গুপ্তসাধনার ইঙ্গিতবাহী কথোপকথনটির মধ্যে সুক্ষ্ম একটা শ্লেষের বীজ যে লুকিয়ে আছে সেটা সে আন্দাজ করতে পারছিলো। কোথাও যেন বা একটু ঈর্ষারও গন্ধ রয়েছে। ব্যাপারটা শোভনেরও নজর এড়ায়নি। বাউল-ফকিরে এমনিতেই একটা সুক্ষ্ম টানাটানির সম্পর্ক যে আছে সেটা তার অজানা নয়। তাছাড়া, মুসিয়ের নিজে সাধারণ কোন ফকিরমাত্র নয়। ধমনীতে বয়ে চলা খানেদের একদা ভোগতপ্ত জমিদারী রক্ত তার চরিত্রে অন্য কিছু মাত্রাও এনেছে। সেসব খবরের খানিক খানিক শোভনের অজানাও নয়। তবে সে নিয়ে এইখানে দাঁড়িয়ে কোন মন্তব্য করা ঠিক হবে না। ফরিদার দৃষ্টির কোন প্রত্যুত্তর দিল না সে।
প্রৌঢ়াটি এইবারে বিরক্ত হচ্ছিলেন। হঠাৎ মৃদু গলায় স্বামীকে ঝেঁঝে উঠলেন তিনি, “রাখেন দেখি আপনাদের হর বাউলের গপ্পো! এতটা পথ এসে মায়ের আমার মুখটি যে শুকায়ে গেছে সে খেয়াল না আছে তার শৌহরের, না আছে আপনার।” বলতে বলতেই ফরিদার হাত ধরে টান দিয়ে তিনি বললেন, “চলো দেখি মাগো আমার সাথে—আরে ছি ছি—ওকী ওকী? পায়ে হাত দেও কেন, না না—”
—তাঁর সামনে মাথা নিচু করতে যাওয়া ফরিদাকে জোর করে তুলে ধরে তার কপালে ঠোঁট ঠেকালেন তিনি, “ওতেই হবে। পায়ে হাত দিতে নাই মাগো। ছালামত থাকো। নাম কী তুমার?” তাঁর হাতদুটির বেড়-এ নিজেকে ধরে রেখেই ফরিদা উত্তর দিল, “আমার নাম ফরিদা।”
মুসিয়ের একপাশে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়ছিলেন। এইবারে বললেন, “ভালো, ভালো। পরিবারে মা ডেকেছেন, তুমি তো তাহলে আমার শাউরি হলা গো মা! কী গোঁসাই, ফকিরের শ্বশুর হতে আপত্তি নাই তো?”
ফের একবার তাঁর খোলা গলার হাসির শব্দে সচকিত হয়ে উঠল উঠোনটি। হাসতে হাসতেই ফের বললেন, “তবে কিনা গোঁসাই, আগের থিকেই বলি সাবধান। এ পথে প্রথম পা রেখিছো। ছিলা তো শিঙ্গী মুনি, বিভাণ্ডকের ছা। বনবাস ছেড়ে বরবেশ ধরেছ ধরো, কিন্তু এঁয়াদের ক্ষমতার কথা তুমি জানো কতটুকু? শোন বলি—
নারী লয়ে সবাই তো ঘর করে নারীকে চিনিতে কেউ নারে নারীর মায়া অঙ্গের ছায়া কায়া পাল্টালেও ছাড়তে নারে——বলে আমিই এতগুলি বছর ধরি কূলে কূলে নৌকা বেয়ে ঘুরে মরেও কূল পেলাম না—”
দরাজ গলাটিকে খাদে নামিয়ে তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে সুরমাখা মৃদুশব্দগুলিকে একে একে বাতাসে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন মানুষটি। তাঁর তীক্ষ্ণোজ্জ্বল চোখদুটিতে দুষ্টুমির চিকিমিকি। “এখন গান থাক। এনাদের চানখাওয়া করতে দিবেন তো আগে! আসো ত মা তুমি আমার সঙ্গে, নাওয়া ধোওয়া সারি নাও,” বলতে বলতে ফরিদার হাত ধরে উঠোন পেরিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন ফকিরের গৃহিণী।
“যাও বাবাজি, তুমিও ভেতরে গিয়া হাতে মুখে জল দিয়া নাও। ভেতরে বিষ্ণুদাসী আছেন। আজকের মত তেনারে তেনার গুরুঠাকুরের কাছ থিকে কেড়ে এনে নিজের অন্দরে রাখিছি। আলাপ টালাপ করো। আমি গিয়া ওদিকটার অতিথদের একটু দেখাশুনা সেরে নেই। হরকেও ওই পেছনবাড়িতেই রেখেছি। তার হালহকিকত জিজ্ঞাসাবাদ করে আসি,” বলতে বলতে মুসিয়ের মুখ ঘুরিয়ে বাড়ির পেছনের দিকে চলে গেলেন। সেদিক থেকে তখন নানান মিশ্রিত কন্ঠের কথাবার্তার শব্দ উঠছে। মধ্যশীতের মধ্যাহ্নের অলস নীরবতাকে বাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ করে ভেসে ওঠা সুরসমৃদ্ধ দু-একখানি গানের কলি।
“সুধী বন্ধুজন। আজ আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন আন্তজ্জাতিক বাউল শ্রী হরনাথ দা-আ-আ-স—আপনারা সকলে তাঁকে করতালি দ্বারা স্বাগত জানান—”
এই অবধি বলে জহিরুল একটু থেমে চারিদিকে একবার চোখ চালিয়ে নিল। উমের খাঁয়ের মাজারের ঠিক সামনের চাতালে একটি প্রাচীন আমগাছের পত্রমুকুটের ছায়ায় মঞ্চ বাঁধা হয়েছে। সেখান থেকে বাড়ির ভেতর অবধি যাতায়াত করবার জন্য একটি শুঁড়িপথ ছেড়ে তার চারদিকেই দর্শকের ভিড়। মক্তবপুর ও আশেপাশের দুচারটে গ্রামের সমস্ত লোকজন এসে ভেঙে পড়েছে আসরে। মুসলমানপ্রধান এই এলাকায় উমের খানের ভক্ত অনেক। আজ, বার্ষিক এই আসরের শেষ রাতটিতে তাই লোকজনের ভিড় অন্যান্যদিনের তুলনায় বেশি। বিস্তীর্ণ উঠোনটিতে আলোর বন্দোবস্ত বিশেষ নেই। প্রায় অন্ধকার সেই আসরে কুয়াশার হালকা আস্তরণের নিচে চাদরে গা মাথা ঢেকে ধৈর্য ধরে বসে রয়েছেন বহু নারীপুরুষ। তাঁদের চেহারায় কোন বহুজাতিকত্ব নেই, আচরণে সংস্কৃতামোদী এবং নাগরিক অস্থিরতাও নেই।
“আঠারোগাঁ আর মক্তবপুরের দর্শকের তফাৎটা খেয়াল করেছো?” নিচু গলায় ফরিদা বলল। মঞ্চের ওপরে বসা গায়কের দলটির ঠিক পেছনে তাদের এনে বসিয়ে দিয়েছেন মুসিয়ের। সেখানে বসে ঘাড় উঁচু করে সামনের দর্শকদের দিকে দেখতে দেখতে ফরিদা প্রশ্নটা করছিল।
“দেখছি। গোটাটাই স্থানীয় মানুষ। বাইরের লোক বলতে বোধ হয় আমরা দুজনই রয়েছি।”
“হ্যাঁ সেটা তো বটেই, কিন্তু আমি একটা অন্য তফাতের কথা বলছি। এখানকার দর্শক কিন্তু অনেক বেশি ফোকাসড্। গানের মঞ্চটাই এদের একমাত্র লক্ষ্য, আর কিছু নয়।”
“তার কারণ এখানে একমাত্র ওই মঞ্চটা ছাড়া আর কোন বিনোদনের উপকরণ রাখা হয়নি। এ মেলায় তার প্রয়োজনও নেই।”
“তার মানে বলতে চাইছ আঠারোগাঁয়ের মেলায় ওর প্রয়োজন ছিল?”
“যদি মেলাটা কাদের জন্য আয়োজন করা হয়ছে তার বিচার করো, তাহলে নিশ্চয় ছিল। ও মেলাটা আর ওই এলাকার সাধারণ মানুষের জন্য নেই ফরিদা। শহর ওকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের বাসিন্দাদের বিনোদন উৎসবে বদলে নিয়েছে। শহরের মানুষের জীবনে অবসর বস্তুটা যে একেবারেই নেই সেটা তো মানবে! তাই যেটুকু সময় সে বিনোদনের জন্য বের করে নিতে পারে সেই সময়টুকুতেই বিভিন্ন বিনোদনের স্বাদ একত্র চেখে নেয়া ছাড়া তার উপায় নেই। সেইজন্যেই তো টেলিভিশনে এতো বেশি সংখ্যার চ্যানেল-- দশ মিনিটও সময় পেলে চ্যানেল সার্ফিং করে অ্যাডভেঞ্চার থেকে অ্যাস্ট্রোলজি, সবকিছুই চেখে নেবার বন্দোবস্ত; সেই জন্যেই তো এক ছাদের তলায় সিনেমা, খাওয়া, খেলা, উইন্ডো শপিং-এর একত্র আয়োজন রাখা মলগুলোর এত জনপ্রিয়তা।”
“তার মানে আঠারোগাঁয়ের বিষ্ণু বাউলের মেলাটা মিরর কোম্পানির হাতে পড়ে এথনিক এন্টারটেইনমেন্টের শপিং মল হয়ে উঠছে তাই তো?”
“তাই নয় কি? সেখানে তুমি গান পাবে, হ্যান্ডিক্রাফট পাবে, তাঁবুতে রাত্রিবাস করে ট্রেকিং-এর সুবাসও পাবে। পরের বছর থেকে হয়তো দেখবে ফকিরি ও বাউল গানের পাশাপাশি, ছৌ নাচ, ম্যাজিক শো, সার্কাস এইসবও জুড়ে গেছে বিষ্ণুদাস বাউলের মেলায়। বইমেলায় পিঠের দোকানের মতো—”
“—এই দাঁড়াও দাঁড়াও, জহিরুল কি একটা বলছে—”
দর্শকদের মধ্যে থেকে মৃদু হাসির একটা গুঞ্জন উঠছিল। মঞ্চের ওপরে দাঁড়ানো জহিরুল এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু শ্লেষের গলায় বলছিল, “ আমার মনে হয় বাউলসম্রাট মেকাপে গিয়েছেন তাই আসতে একটু দেরি লাগে।”
ফের চাপা হাসির শব্দ উঠল চারদিক থেকে। তারপর দর্শকের মধ্যে থেকে উড়ে এল একটা অনুরোধ, “তাহলে ততক্ষণ জহিরুল তুমিই না হয় একখান শুনায়ে দাও দেখি—”
“এই রে! ব্যাটা সমস্যায় পড়েছে এবারে,” ফরিদার কানের পাশে ফিসফিস করে বলছিল শোভন, “জহিরুলের শ্রীখোলে বা দোতারায় হাতটা খুব ভালো। কিন্তু গানটা সুবিধের নয়—”
দেখা গেল দর্শকমণ্ডলীরও সেটা অজানা নয়। তাদের মধ্যে থেকে সাবধানবাণী উড়ে আসছিল, “দেখিস বাপধন, আমাদের মক্তবপুরের নাম খারাপ করিস না রে—”
হঠাৎ একটু থমকে গিয়ে এদিক ওদিক চাইল তরুণটি। মঞ্চে গাইবার ব্যাপারে তার কিঞ্চিৎ জড়তা আছে বোঝা যাচ্ছিল। মঞ্চের ওপর বসে থাকা মুসিয়ের মুখ তুলে একবার চাইলেন. ছেলের দিকে ৷মৃদু হাসি তাঁর মুখে। মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হল দুজনে। তার পরেই নিচু হয়ে জহিরুল তাঁর দোতারাটি তুলে নিয়ে নিজের গলায় পরে নিল। যন্ত্রটি পুরনো। তার চেহারায় কোন চাকচিক্য অবশিষ্ট নেই আর। দু’এক মুহুর্ত তার শরীরে হাত বুলিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল জহিরুল। দক্ষ আঙুলের ঘায়ে কথা বলে উঠল তার পূর্বপুরুষের তারবাদ্যটি। এলোমেলো সুরখণ্ডগুলোকে একটি নির্দিষ্ট চালে বাঁধতে বাঁধতে নিচু গলায় সে কথা বলে চলেছে তখন, “হিঁদুর বইতে লেখে, পরমাত্মায় জীবাত্মার পায়ে ধরি বলে দেহিপদপল্লবমুদারম। শুদ্ধোদনে বাপ হইয়ে ব্যাটার পায়ে ধরিছিলো। তা সে বিষয়ে লালন সাঁই কী বলেন তাই নিবেদন করি --আলেফ অর্থাৎ আল্লাহ , তেনাকে স্পর্শ করতি গেলে দ্যাখবে স্পর্শটি লেগেছে গিয়া মিম, অর্থাৎ কিনা নবীর দেহে। তাই সাঁই বলছেন
আলেফ দিয়ে টোকা মারো লাগবে গিয়ে মিমের গায়
আলেফ দিয়ে টোকা মারো লাগবে গিয়ে মিমের গায় আয় নবীকে দেখবি যদি আয় রে আয়তা বন্ধুজন, শোনেন, আদিতে আছেন তিনজন--আল্লা অর্থাৎ আলেফ, তেনার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আদম অর্থাৎ লাম, আর আদমের শ্রেষ্ঠ সন্তান মিম অর্থাৎ কিনা নবী। তা আলেফ যখন নিখোঁজ হইয়ে যান তখন কী ঘটে? সাঁই বলতেছেন—
আজব এক সুরত দেখিয়া আলেফ যায়রে নিখোঁজ হইয়া লামটি তখন যায় ফাটিয়া তখন তাহার কী উপায় আয় নবীকে দেখবি যদি আয় রে আয়কিন্তু কথা হল, নিখোঁজ হইয়ে আলেফ যান কোথা গো? যান মাতৃগর্ভে। ভালোবাসার দায়ে নারীর গর্ভফান্দে আসি স্বেচ্ছায় দেহকারায় বন্দি হন তিনি। দশ মাস দশদিন মায়ের গর্ভে বসি যন্ত্রণা ভোগ করি তারপর ভূমিষ্ঠ হয়ে জীবনকারায় বন্দি হন। তারপর—
আলেফ পড়িয়া ফান্দে জারেদজার হইয়া কান্দে পড়িয়া নিরানন্দে ধরে গিয়া মিমের পায় আয় নবীকে দেখবি যদি আয় রে আয়হঠাৎ গোটা আসরটি যেন একসঙ্গে জেগে উঠে জহিরুলের পদটির ধূয়া ধরে নেয়। বাংলার বাউল-ফকির-বৈষ্ণব-শাক্ত নির্বিশেষে যুগে যুগে একটি জায়গায় এক; তা হল সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে ঈশ্বরত্ব থেকে সরিয়ে এনে নিজের মানুষ করে নেয়ার আকুতি। পিতা কিংবা সন্তান থেকে শুরু করে নর্মসহচর, এমন কত রূপেই না দেবতাকে বারেবারে গ্রহণ করে চলেছে তারা যুগে যুগে। আজ এই তরুণ ফকিরপুত্রের গানে আবার সেই নিবিড় সম্পর্কের পুনরুচ্চারণ শ্রোতাদের মনে নতুন করে সাড়া জাগিয়েছে। জহিরুলের দুটি গাল ভেসে যাচ্ছিল জলে। অশ্রুবিকৃত কন্ঠে তার গানের বাকি পদগুলি ভালো বোঝা যায় না। কিন্তু সে গান ততক্ষণে শব্দবোধের সীমাকে ছাড়িয়ে গিয়ে, বাক ও মনের অগোচর কোন অনুভূতিকে স্পর্শ করেছে। সেখানে মানুষের তৈরি শব্দবন্ধের সাহায্য ছাড়াই ভাবের বিনিময় ঘটে চলে—
“এ ছেলে তোমার নাম রাখবে দেখে নিও মুসিয়েরদাদা,” পাশে বসা মুসিয়েরের দিকে ঝুঁকে নিচু গলায় বলল শোভন। জহিরুল ততক্ষণে তার গান শেষ করে এসে শ্রীখোলটি নিয়ে তার জায়গায় বসেছে। সেদিকে অপাঙ্গে একবার তাকিয়ে নিয়ে মুসিয়ের বললেন,“ কে জানে। এ ছোকরার ভাব আছে, শিক্ষা আছে, কিন্তু আসল জায়গাতেই তো খোট। সুরলয়ের জ্ঞান কোথা গো--” বলতে বলতেই মাঝপথে কথা থামিয়ে মঞ্চের প্রবেশমুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বলে উঠলেন, “এই যে হর বাউল এসে গেছেন।”
মধ্যবয়স্ক মানুষটি প্রশান্ত মুখে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছিলেন মঞ্চের দিকে। পরনের মূল্যবান কাপড়ে তৈরি গেরুয়া পোশাকটিতে নিখুঁত পারিপাট্য। উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে হাত ধরে মঞ্চে নিয়ে এসে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে মুসিয়ের বললেন, “মক্তবপুরের সৌভাগ্য যে এই আসরে আপনার মতন মানুষের পদধুলি পড়েছে। তা কী শোনাবেন গো আজ আমাদের?” উত্তরে মৃদু হেসে দর্শকের দিকে ঘুরে সামান্য মাথা নোয়ালেন হরনাথ বাউল। তারপর, বিনা ভূমিকায় একেবারে সোজা ঢুকে এলেন গানের ভেতর,
আমি এমন জনম পাবো কীরে আর এমন চাঁদের বাজার মিলবে কি আবার
হাতের নিঁখুত টানে আনন্দলহরীর তারে সুর বেজে ওঠে। তার সঙ্গে সঙ্গতের মতই জেগে ওঠে মঞ্চের বুকে ঘুরন্ত দেহটির ছন্দময় পদাঘাত। তারপর সেই সুরের মধ্যে থেকেই ফের জেগে ওঠে গায়কের কন্ঠসুর,
এমন আনন্দ রসে আর কি গো যাবো ভেসে মানব জন্ম পাবো দেহের কামনা অপারকোথায় একটু বাধছিলো শোভনের। শব্দগুলি নিয়ে অনাবশ্যক দীর্ঘ তানকারী করছেন হর বাউল। গানের চালের মধ্যে কোথায় যেন নাগরিক ঔজ্জ্বল্যের মিশেল এসে গেছে। তার সুরের বিস্তারে হিন্দুস্তানী রাগসঙ্গীতের মৃদু হলেও সুনিশ্চিত সুবাস। এ গানে সৌন্দর্য আছে, কিন্তু তা এই শ্রেণীর সঙ্গীতের নিজস্ব সৌন্দর্য নয়।
ব্যাপারটা অন্যদেরও নজর এড়ায় নি দেখা গেল। তার পেছনে বসে থাকা গোপীবল্লভ নামের অপেক্ষাকৃত তরুণবয়সী ছেলেটি অনেকক্ষণ ধরেই উশখুশ করছিল। হঠাৎ সে এগিয়ে এসে শোভনের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, “কেমন বোঝেন দাদা হর বাউলের গান?”
শোভন একটু ইতস্তত করে বলল, “মানে, একটু বেশিই তানটান করছেন, অতটা--”
“তাহলে তানটাই করুক না, গান আর কেন?”
ফরিদা চমকে উঠে পাশে বসা বিষ্ণুদাসীর দিকে চেয়ে দেখল একবার। তার দৃষ্টিটিকে এড়িয়ে গিয়ে চোখ নিচু করে ফেলেছেন তিনি। তাঁর সুগৌর মুখটিতে কেউ যেন একমুঠো আবির মাখিয়ে দিয়ে গেছে একমুহূর্তের জন্য। কিন্তু তারপরেই নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। ঠোঁটদুটি তাঁর নিঃশব্দে নড়ছিল শব্দহীন কোন প্রার্থনায়।
ততক্ষণে হর বাউল তাঁর গানের শেষ পঙ্ক্তিগুলিতে এসে পৌঁছেছেন—
এহেন জনম পেয়ে কাল কাটালাম ঘুমাইয়ে জনম গেল রে বয়ে গেল আমার পরের গোয়ালে ধুয়া কাটালাম পথে কত কুঁয়া দীন দুদ্দু কয় দোহাই দিয়া সাঁই যা করো এবার—গান শেষ করে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। ঈষৎ দুলছে শরীরটি। সদ্যসমাপ্ত সঙ্গীতের ঘোর তখনও রয়ে গেছে তাঁর দেহে। হঠাৎ দর্শকদের মধ্যে থেকে এক প্রৌঢ় উঠে দাঁড়ালেন। সামনে এগিয়ে এসে মঞ্চের ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটি কুড়ি টাকার নোট বের করে মঞ্চের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, “গানটা তো ভালোই গাইলা, তাই তোমায় কুড়ি টাকা পুরস্কার দিলাম। কিন্তু জিগেস করি, আমাদিগের উমের খাঁ সাহেবের পদে তুমি দুদ্দুর ভনিতা দিলা কোন হিসাবে?”
শোভন হতবাক হয়ে গেল। এ আসরে এ ধরনের আক্রমণ সে আশা করে নি। পদটি দুদ্দু শাহেরই। এই মানুষটি ভুল করছেন। কিন্তু এটি দুদ্দু শাহের পদ না হয়ে উমের খাঁ সাহেবের পদও হত যদি, তা হলেও এ আসরে সে কথাটা এমন অভদ্রভাবে বলাটা রুচিবিগর্হিত কাজ। হর বাউল একটু হতচকিত হয়ে ঘুরে তাকালেন প্রশ্নকর্তার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “না, মানে জাত বাউল তো আর নই। ছোটবেলায় বাপ মা মরে ঘর ছেড়েছিলাম। পথে পথে ঘুরি, তা সর্বেশ্বর দাস বাউল দয়া করে তেনার আখড়ায় ঠাঁই দিলেন। তেনার কাছেই শুনে শুনে যেটুক শিক্ষা। তা বাদে আমি তো আর কিছু জানিশুনি না গো। চিরকাল শুনে এসেছি এ হল গিয়ে দুদ্দু শাহের পদ। তা ভুল যদি হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে—”
“না না ভুল হবে কেন, ভুল হবে কেন? ও দুদ্দু শায়েরই পদ, শোনেন বলি—” বলতে বলতে ব্যাপারটা সামাল দেবার জন্য মুসিয়ের উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁকে থামিয়ে দিয়ে মানুষটি ফের হর বাউলের দিকে ঘুরে বললেন, “চিরকাল ভুল শুনেছো হে দাসমশায়। শোন বলি, এ হল মক্তবপুর। তোমার হিল্লি-দিল্লি-কলকাতা নয় যে যা বললে সব ফকির-বাউলের গান বলি লোকে চক্ষু গোল গোল করি গিলল। এখানের লোকের এ গানে শিক্ষাদিক্ষা আছে কিছু। এ গ্রামের লোক যদি বলে এ উমের খাঁয়ের গান তাহলে তেনার নিজের ছেলে দূরস্থান স্বয়ং উমের খান আসি যদি বলে এ গান তেনার নয় তাহলি তারেও বলব, ‘নিজের গান তুমি নিজে ভুলে গেছ। ভুল তোমার হতে পারে, আমাদের ভুল হবে না।’ আমাদের বোকা বোঝাতে না এসে শহরের বাউল শহরে গিয়া গান শোনাও। এখেনে এসেছ কী করতে?”
আকস্মিক এই অন্যায় আক্রমণে হর বাউল বেশ অপমানিত বোধ করছেন দেখা গেল। দু একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীরে ধীরে মঞ্চ থেকে নিচের দিকে পা বাড়াচ্ছেন তিনি, তখন বিষ্ণুদাসী উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে ফিরিয়ে নিয়ে এসে তাঁকে বসিয়ে দিলেন নিজের খালি জায়গাটিতে, তারপর তাঁর হাত থেকে আনন্দলহরিটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে গিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর দু কাঁধ বেয়ে স্বর্ণাভ চুলের ঢেউ উপচে পড়েছে। পরনের সাদা খোলের কাপড়টি তাঁর গৌরবর্ণ শরীরে ভারী ভালো মানিয়েছে। গোটা আসর হঠাৎ একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল। বিষ্ণুদাসীর গানের খ্যাতি আছে এ অঞ্চলে। দর্শকদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে হাতের যন্ত্রটিতে ঘা দিলেন তিনি, তারপর হর বাউলের অপমানিত মুখটির দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে গান শুরু করলেন,
আমি আর চাহিনে জনম আর চাহিনে মরণ তোমার চরণতলে রেখে দাও শুধু তোমার চরণতলে রেখে দাও আমি বড় দুখি তাই তোমারে ডাকি সেই পলকে তবু ফিরে চাও আমারই এ চাওয়া তাই তোমারই দেওয়া আমার এ নশ্বর দেহে একটু হাওয়া দুদিনের তরে এসে বেড়িয়ে যাওয়া এ ভুল চিরতরে মুছে দাওতাঁকে ভালোবেসেই গ্রাম ছেড়ে নগরের পথে পা-বাড়ানো গ্রামের মানুষটি নিজের সংস্কৃতির বিশুদ্ধতাকে বিনা প্রতিবাদে বিসর্জন দিয়েছেন। অংশত তারই মূল্য চোকাবার দায়ে আজ এ আসরে তাঁর এই লাঞ্ছনাটুকু প্রাপ্য হয়েছে। সে গ্লানিকে মুছিয়ে দেবার জন্যই হয়ত বা বিদেশিনী মেয়েটি প্রেমিকের কাছে তার অকুন্ঠ আত্মদানের কথা স্বীকার করে নিচ্ছিলেন সভার মধ্যে দাঁড়িয়ে। ভবা পাগলার সৃষ্টি, ইষ্টদেবতার পায়ে আত্মদানের গানটি সাগরপারের মেয়ে মার্গারেটের গলায় হঠাৎ করেই যেন পরিপূর্ণ মানবিক প্রেমের গাথায় বদলে গেল।
জহিরুল মঞ্চ থেকে নেমে কোথায় যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল। এইবারে দেখা গেল সে ফের এসে মঞ্চে উঠছে। তার মুখে মৃদু হাসির স্পর্শ। হাসতে হাসতেই ঈষৎ তরল গলায় সে বলে উঠল, “ওরে বাস রে! পীরিতি যে কাঁঠালের আঠা গো, লাগলে পরে ছাড়ে না হে--”
দর্শকের ভেতর থেকে তখন সগর্জন দাবি উঠেছে, “আরেকখান হোক বিষ্ণুদাসী।”
মাথা নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন বিষ্ণুদাসী। জহিরুলের মন্তব্যটি তাঁর কানে গেছে। কিন্তু তাতে তিনি কোন প্রতিক্রিয়া দেখাননি। একটুক্ষণ বাদে মাইক্রোফোনটি হাতে ধরে নিয়ে তিনি বললেন, “এইবারে একখানা নতুন গান শোনাবার অনুমতি দিন। এ গানের পদকর্তা হলেন বরুণ দাস। নামটি আপনাদের তত পরিচিত নয়। তবে কিনা গানটি ভালো। ওতে লোকশিক্ষা হয়।” বলতে বলতেই গানে ঢুকে এলেন তিনি—
আগে জান রে মন কিসে হয় পিরীতি না জানলে পিরীতির মর্ম শেষে হয় অধোগতি পি শব্দে হয় ইন্দ্রিয় দমন রি শব্দে হয় রিপু দমন তি শব্দে হয় রে ভক্তি এই তিনে মিলে হয় পিরীতি আবার রতিতে আবদ্ধ হইয়া ঘনীভূত রস আস্বাদিয়া তবে হয় জীয়ন্তে মরা শুদ্ধ হয় চিত্ত মতি ভেবে দীন বরুণ কয় কোন কোন ভাগ্যবানের এই পিরীতি হয় সাধন ভজনে হয় রতির উদয় ঐ রতিতে মিলে জগতপতিগাইতে গাইতে তাঁর অভিযোগভরা তীক্ষ্ণ চোখদুটি বারংবার ছুঁয়ে যাচ্ছিল জহিরুলকে। চারিচন্দ্রের উপাসনায় দেহরসের আস্বাদনের মধ্যে দিয়ে দেহাতীতে পৌঁছোবার যে প্রেম আরাধনায় তিনি ব্রতী হয়েছেন তাঁর ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে, সেই প্রেমের এমন সগৌরব, উচ্চকিত প্রকাশে আসরে খানিক আগে তৈরি হওয়া সমস্ত গ্লানি যেন ধুয়ে মুছে যাচ্ছিল।
“আগুন আছে ছাইয়ের ভিতর আগুন বার করে নে— আগুন ইস্পাতেতে মজুত ছিল রে ভাই মজুত আছে পাথরে—”
“শীত করছে?”
“একটু করছে। আসরে যতক্ষণ বসে ছিলাম, লোকজনের ভিড়ে টের পাইনি--”গায়ের কম্বলটা ভালো করে জড়িয়ে নিতে নিতে কাঁপা কাঁপা গলায় ফরিদা জবাব দিল, “আজকের ঠাণ্ডাটা কিন্তু কালকের চেয়ে বেশি। নইলে কালকে দ্যাখো, রাতটা তো আমরা খোলা আকাশের তলাতেই কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু এতোটা ঠাণ্ডা ঠেকেনি। ”
“আজও মাথার ওপর এমন কিছু ছাদ কিন্তু নেই। ওই দেখো--”খড়ের জীর্ণ চালের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়া তারার আলোর দিকে দেখাল শোভন।
সঙ্গীত উৎসব শেষ। অধিকাংশ মানুষই ফিরে গিয়েছেন। শোভন, হর বাউলের মত দূর থেকে আসা দু-একজন শুধু রাতের মতন এ বাড়িতে থেকে গিয়েছেন। শোভনদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে বাড়ির একেবারে পশ্চিম প্রান্তে একটি ছিটেবেড়ার ঘরে। এমন ঘর এ বাড়ির চারদিকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেকগুলি। ফকিরের আখড়া। সম্বৎসর সেখানে সময়ে-অসময়ে কত মানুষের আসাযাওয়া। তার জন্যই এই ঘরগুলির ব্যবস্থা করা রয়েছে এইখানে। গোবর নিকানো মাটির মেঝের ওপর মোটা মোটা চট পেতে তার ওপর চাদর বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। একটি হ্যারিকেন মৃদু করে জ্বালিয়ে রাখা রয়েছে সামনে। সঙ্গে আনা কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে ছিল তারা দুজনে। সামনের প্রশস্ত আমবাগান পেরিয়ে দূরের মূল বসতবাটির লোকজনের কোন আভাস এখান থেকে পাওয়া যায় না।
“দেখো দেখো, সপ্তর্ষি দেখা যাচ্ছে,” চালের ফুটোটির দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছিল ফরিদা।
“কোথায়?”
“ওই যে। কাছে এসো--”
যুবকটির মুখটি যুবতীটি তার কাঁধের কাছে বড় আদরে জড়িয়ে ধরে রেখে ইশারায় চালের ফুটো দিয়ে উঁকি মারা সপ্তর্ষিমণ্ডলের দিকে দেখায়। তাদের ছুঁয়ে থাকা মুখদুটির দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকে সেই উদাসীন নক্ষত্রসভা। রাত্রি বহে যায়।
“শেষের দিকের দু নম্বর তারাটা দেখছো? উনি বশিষ্ঠ। আচ্ছা, খেয়াল করে দেখো তো ওর একেবারে কোলের কাছে একটা ভীষণ ফেইন্ট তারাকে দেখতে পাও নাকি!”
“কোথায়?”
“নজর করে দেখো । আছে। ঠিক দেখতে পাবে—”
মেয়েটি তীক্ষ্ণ চোখে অতল আকাশের দিকে তাকিয়ে সেই প্রায় অদৃশ্য তারাটিকে খোঁজে।
“পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি। খুব হালকা। নীলচে তারা একটা—দেখা যাচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে—কোন তারা ওটা?
“বশিষ্ঠর যুগ্ম তারা অ্যালকর। এদেশের নাম অরুন্ধতী। বশিষ্ঠর স্ত্রী। হিন্দুধর্মবিশ্বাসে স্বামীস্ত্রীর ভালোবাসার শ্রেষ্ঠতম আইকন। হিন্দু বিয়ের একটা আচার আছে জানো ফরিদা, বিয়ের সময় স্বামীস্ত্রীর একসঙ্গে আকাশে চোখ তুলে অরুন্ধতী দেখা। আজ আমরা—”
সঘন উষ্ণ নিঃশ্বাসের একটি ঝাপটা এসে তার বাকি কথাটুকুকে আর বলতে দিল না। খানিক বাদে তাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে মেয়েটি বলল, “অরুন্ধতীর গল্প আমি জানি। তুমি দেখে নিও, আমরাও--”
দূরে কোন একটি ঘর থেকে উচ্চকিত নারীকন্ঠের গান ভেসে আসছিল--
“তোমার ঘরে বাস করে কয়জনা ও মন জানো না, তোমার ঘরে বাস করে মন কয়জনা--”
সেইদিকে কান পেতে শুনতে শুনতে অন্যমনস্কভাবে শোভন বলল, “মার্গারেট গাইছে। শোন শোন--”
একই আধারে একের অধিক অস্তিত্বের সমাবেশের খবর দেয়া সেই গান শুনতে শুনতে নিজেদেরই অজান্তে কখন তারা নিজেদের গলাতেও তাকে তুলে নিয়েছিল তা খেয়াল করে নি। চমক ভাঙল বাইরে থেকে মুসিয়েরের গলার শব্দে, “এই যে, আন্ধারে বইসে বাবা গোঁসাই মা গোঁসায়ে যুগলে গান ধরেছো দিব্যি, তা পেটে কিছু দানাপানি তো দিতি হবে না কি? রাত কতো হল সে খেয়াল আছে? দশটা বেজে গেছে।”
তাড়াতড়ি নিজেদের সামলে নিয়ে সরে বসল তারা। বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে শোভন আওয়াজ দিলো, “দাঁড়াও, আসছি।”
মুসিয়ের হাতে একটি টর্চবাতি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বাইরে। আধো অন্ধকারে তাঁর লম্বা চেহারাটি একটি দীর্ঘ ছায়ার মতন লাগে। তাদের বের হয়ে আসতে দেখে বললেন, “সকলে খেইয়ে দেইয়ে যার যার ঘরে গেলো, আমি বলি এ দুটায় গেলো কোথায়। তাই ডাকতে এলাম। না এলে বোধায় আজ রাতটা না খেয়েই কাটতো, নাকি? ”
“না না, আর একটু পরেই উঠে আসতাম। চলো চলো, খিদে পেয়েছে খুব। টের পাইনি এতক্ষণ--”
“তাতে আর দোষ কী গোঁসাই। ক্ষুধাতৃষ্ণার বোধ যদি থাকলোই তা হইলে ভালোবাসা আর কী হল?” ফকিরের গলায় কৌতুকের ছোঁয়া, “এখন চলো দেখি তাড়াতাড়ি। ও বেলা ডাঁটা চচ্চড়ি আর মুসুর ডাল ছাড়া কিছু জোটে নাই। এইবেলা ভালো খাদ্য আছে। বিকালবেলা একজন এসে কয় কেজি পাঁঠার মাংস দিয়া গেল, তাই রেঁধেছে। তুমি ভালোবাসো বলি তোমার জন্য পাঁঠার তেলের বড়াও করে রেখেছে কয়েকটা। চলো চলো--”
|| ৫ ||
ফরিদা স্বপ্ন দেখছিলো। খণ্ড খণ্ড, এলোমেলো দৃশ্যগুলি সবই তার স্কুলটিকে ঘিরে। তার ছেলেমেয়েগুলি তাকে ঘিরে ছোটাছুটি করে বেড়ায় একঝাঁক প্রজাপতির মতো। জামিলা খাতুন নামে সেই প্রিয় গাছটির নিচে একটি চেয়ার পেতে সে বসে। তার কোলে বসে অনর্গল কথা বলে চলেছে সুরভি। টুকটুকে ফর্সা মেয়ে। বছর পাঁচেক বয়স হবে। চোখে হালকা নীলের আভাস আছে তার। নীলকরদের জমানায় এই এলাকার কোন কোন দুর্ভাগিনী আর্যরক্তবাহী সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। সেই রক্ত এখনো মাঝে মাঝে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে এইরকম দুএকটি জাতকের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে দিয়ে। স্কুলে এই মেয়েটি একেবারেই নতুন। বিয়ের দিন পনেরো পরে শোভন আধারকোঠায় একটা স্বেচ্ছাসেবি প্রতিষ্ঠানে কি কাজে গিয়ে সেখান থেকেই মেয়েটাকে নিয়ে এসে তার হাতে তুলে দিয়েছিলো। অনাথ মেয়ে। আর একটু বড় হলেই অন্ধকার দুনিয়ায় তার রূপের কদর হবে। সংস্থাটিও তাই তাকে একটা নিরাপদ হাতে তুলে দিতে চাইছিল। দিনকয়েক আগে, তার আর শোভনের চলে আসবার সময় খুব কঁদেছে সুরভি। তাকে ছেড়ে থাকতে চায়নি। কোনমতে তাকে নিয়ে শর্মিষ্ঠার কাছে রেখে এসেছে ফরিদা—
--পেছনে সবজি বাগানে ছেলেমেয়েরা কাজ করছে। বীজবপনের কাজ চলছে সেখানে। সুরভিকে আদর করতে করতে ফরিদা তাই দেখছিল। তাদের সঙ্গে ভুবন দাসও রয়েছেন। নিচু হয়ে বসে আপন মনে বীজ বুনছেন চষা মাটিতে। কাজ করতে করতে মাথাটি দুলিয়ে নিচু সুরে গান গাইছিলেন ভুবন দাস। ফরিদা কান পেতে তাই শুনছিল। কথাগুলো তার পরিচিত—
নাম ধরেছো পতিতপাবন— কোথা রইলা রে—এ-এ-এ- এ-হে- ওরে আমার পারের কাণ্ডারী------চমক দিয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল তার। ভোর হয়ে আসছে। ছিটেবেড়ার ফুটোফাটা দিয়ে ঝাপসা, নরম আলোর ইশারা দেখা যায় বাইরে থেকে। গানটা কিন্তু থেমে যায় নি। স্বপ্নের সীমানা পেরিয়ে জাগরণেও তার সুরসমৃদ্ধ কথাগুলি ঠিকই শোনা যাচ্ছে বাইরে থেকে।
শোভনও জেগে উঠেছে । উপুড় হয়ে মাথাটি তুলে কনুইয়ে ভর দিয়ে সে-ও কান পেতে শুনছিল। মুসিয়ের গাইছেন--
কোথায় রইলা হে ওগো আমার পারের কাণ্ডারী ওরে এ ভবতরঙ্গে আমার কিনারে লাগাও তরী—শোভন তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজার আগড় খুলে ডাকলো, “মুসিয়েরদাদা--”
“জেগেছো গোঁসাই? ভালো, ভালো। ব্রাহ্মমুহূর্তে জেগে উঠবা তো আলোয় কেমন করে অন্ধকার তাড়ায় তা দেখতে পাবা। এ মানষের তোয়ের বাতি নয় যে দশ হাত দূরে অন্ধকাররে ঠেকায়ে রাখবে কোনমতে। জাদু দেখো গোঁসাই। সূর্য নাই, চন্দ্র নাই, তবু কেমন আন্ধার গিয়ে দুনিয়া আলো হয়—”
বলতে বলতে দীর্ঘ পদক্ষেপে এগিয়ে এসে তাদের ঘরের ভেতরে ঢুকে এলেন ফকির। মোটা একটি আধময়লা কাপড় দুভাঁজ করে গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন। ওই তাঁর শীতবস্ত্র। দোতারাটি সঙ্গে আছে। ফরিদা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াচ্ছিল। তাকে হাতের ইশারায় বসতে বলে মুসিয়ের দরজার কাছে মেরুদণ্ড সোজা করে বসে পড়লেন। চোখদুটি বোজা। হাতের দোতারাটির তারে মাঝে মাঝে একটি করে মৃদু টোকা দিচ্ছেন মাত্র। বুক পার করে ছড়িয়ে পড়া কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফের মধ্যে তাঁর ঠোঁটদুটি কোন এক শব্দহীন উচ্চারণে ক্রমাগত নড়ে চলেছে। এক বাঙ্ময় নৈঃশব্দের আবরণ ঘিরে ছিল তাঁকে। তাঁর পাশ কাটিয়ে শোভনও এসে নিঃশব্দে বসে পড়ল ফরিদার পাশে। দরজার নরম আলোয় উজ্জ্বল ফ্রেমের ভেতর একটি ছবির মতই দেখাচ্ছিল মানুষটিকে।
খানিক বাদে, যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন এমনভাবে নিচু গলায় তিনি বললেন, “প্রভাতি গাই, শোন গোঁসাই। প্রেমে ডুবে আছো দুজনে, তাহলে প্রেমের গান করি শোন--”
কথা বলতে বলতেই তাঁর হাতের আঙুলগুলি দোতারার তারে সুর ফুটিয়ে তুলছিল। এইবার ক্লান্ত, ঘষা ঘষা গলায় গানের কথাগুলি এসে যোগ দিল তার সাথে—
প্রেম করবি কে আয়রে তোরা প্রেম করবি কে আয় আল্লা রসুল প্রেম করিয়া প্রেমের মজা পায় রে প্রেম করবি কে আয়রে তোরা প্রেম করবি কে আয় প্রেম করিল দীনের নবি দেখেছিল আল্লার ছবি ফকির দরবেশ মোল্লা মৌলবি প্রেমের মজা পায় রে-- প্রেম করবি কে আয়রে তোরা প্রেম করবি কে আয় প্রেম করিল কৃষ্ণ রাধা উভায়ে উভায় ছিল বাঁধা প্রেমের দায়ে সদা সর্বদাই বলিত রাই রাই রে—
--নিঃশব্দে বসেছিল তারা দুজন। গান শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। খানিক বাদে শোভন মাথা নেড়ে বলল,
“তোমরা মারফতি ফকিরেরা ভারী অদ্ভুত মানুষ মুসিয়েরদাদা। শরিয়ত মানোনা সে নয় বুঝলাম, কিন্তু প্রেম, পুজো, আল্লা, কৃষ্ণ সবাইকেই এত সহজে একসঙ্গে মিলিয়ে দাও কী করে? ঠিক কোন দেবতায় তুমি বিশ্বাস করো, বলবে?”
তার দিকে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসলেন প্রৌঢ় মানুষটি। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “তত্ত্বকথায় এ সওয়ালের জবাব আমি দিতে পারি গোঁসাই, কিন্তু সে তোমারও পথ নয়, আমার শাউরিরও পথ নয়। কিগো শাউরি, তাই তো? তোমাদেরে আমি এর জবাব দিবো অন্য পথে। এখন চলো দেখি আমার সঙ্গে। ওঠো। শাউরি তুমিও চলো। সক্কাল সক্কাল একচক্কর ঘুরে আসি গা--”
গ্রামটি বেশ বড়ো। বেশ কটি পাড়া রয়েছে এখানে। মাঝে মাঝে ক্ষেত। তাদের অধিকাংশই ফাঁকা পড়ে আছে। কিছু কিছু ক্ষেতে মরসুমী সবজির চাষ পড়েছে। সেইসব চাষজমির ফাঁক দিয়ে দিয়ে পথ। আগে আগে যেতে যেতে মুসিয়ের বিভিন্ন পাড়ার পরিচয় দিচ্ছিলেন। হিন্দুদের প্রাচীনতম কয়েকটি পাড়া বাদে বাকি গ্রামটিতে মুসলমানদের প্রাধান্য। তবে হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে সকলেই মুসিয়েরকে চেনেন। সম্মানও করেন। পথে যেতে যেতে অনবরতই সৌজন্য সম্ভাষণ চলছিল তাঁর।
“কথা জানো কি বাবাজি, এই যতো মানুষজন দেখো, এনাদের বাপ পিতামহ আমাদিগের প্রজা ছিলেন। জমিদারী চালানো সহজ ব্যাপার নয়। আমার ঠাকুর্দা, তেনার বাপ পিতামহ সকলেই সে কাজে দড় ছিলেন। লোকে তখন আমাদের দেখলি, সে হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক, ভয়েভক্তিতে পথ ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াত। সে ভয়ভক্তি ভাঙল গিয়া আমার বাবার কালে। তবে সে-ও বড় সহজ হয় নাই—”বলতে বলতেই পথের পাশের একটি বাড়ির ভেতরে চোখ ফেলে তিনি দাঁড়িয়ে গিয়ে পেছন ফিরে শোভনদের ডাকলেন, “রস খাবা নাকি? আসো। ও বকুলের বাপ, শোন দেখি ইদিকে--”
বাড়িটির প্রশস্ত উঠোনের একপাশে মাটির উনুনে কাঠকুটোর আগুন জ্বালিয়ে তার ওপরে একটি চ্যাটালো কড়াই বসেছে। সুগন্ধী ধোঁয়া ছড়িয়ে তাতে খেজুর রসের পাক দিচ্ছিলেন একজন বয়স্কা মহিলা ও একটি যুবতী। মুসিয়েরদের ঢুকে আসতে দেখে যুবতীটি তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টেনে উঠে দাঁড়ালেন। “বকুলের বাপ কোথা গো বৌমা?”
“আসি বাবাঠাকুর,” জবাব ভেসে এলো বাড়ি ছাড়িয়ে খানিকটা দূরের একটি মাঠের ভেতর থেকে। খানিক বাদে, গলায় দড়ি বাঁধা রসে টইটুম্বুর একটি হাঁড়ি নিয়ে মানুষটি ঢুকে এলেন বাড়িতে।
“দাও দেখি, ভালো করে রস খাওয়াও এনাদের। মেহমান এসেছেন গেরামে--”
হাঁড়ি নামিয়ে রেখে মানুষটি ব্যস্তসমস্ত হয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গিয়ে তিনটে গ্লাস নিয়ে ফিরে এলেন। রস ভর্তি দুটি গ্লাস শোভন ও ফরিদার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তৃতীয় গ্লাসটি বাড়িয়ে ধরলেন ফকিরের দিকে।
রসভরা গ্লাসটি হাতে নিয়ে ঠোঁটে ঠেকাতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেলেন মুসিয়ের। ছোট একটি মেয়ে, সম্ভবত তাঁর সাড়া পেয়েই ঘর থেকে বের হয়ে এসে ঘুমচোখে তাঁর আলখাল্লার কোণাটি টেনে ধরেছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে একহাতে তাকে কোলে তেনে তুলে নিলেন তিনি। তারপর অন্য হাতে ধরা গ্লাসটি তার ঠোঁটের কাছে ঠেকিয়ে বললেন, “ছোটবিবি, খাও, খাও, আমি আজ তোমার প্রসাদ পাবো--”
“কিচ্ছু হবো না। সেইদিন তুমি আমায় নিতে এলানা কেন?”
মুসিয়েরের মুখে একচিলতে হাসি ফুটল। সম্ভবত এই প্রিয় বান্ধবীটিকে এর মধ্যে কোনদিন তিনি ভোলাবার জন্য কোথাও নিয়ে যাবেন বলে মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। সে কথা তাঁর মনে ছিল না। কিন্তু এ মেয়ে ভোলেনি।
“এ হে হে, ভারী অন্যায় হয়ে গেছে গো বকুলসখী। আচ্ছা, এইবারে যখন গানে যাবো তোমারে ঠিক নিয়ে যাবো দেখো--”
বালিকার অভিমান তখনও কমেনি। ভারি গলায় বলল, “তুমি শুধু মুখেই বল কলকাতা নিয়ে যাবা, আসাননগর নিয়ে যাবা; তারপর আর কোত্থাও নিয়ে যাও না।” ফকির হাসি হাসি মুখে তার দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বললেন, “নিয়ে যেতে তো পারি বিবি, কিন্তু আমার সঙ্গে গেলে সভা ভরা লোকের সামনে গান গাইতে হবে। সে তুমি পারবা তো?”
“হুঁ” বলে ঘাড় বাঁকিয়ে সম্মতি জানাল সে, “গান আমি গাইতে পারি তো--”
“তবে শোনাও একখান, দেখি কতবড় গায়ক হয়েছো তুমি!”
কথাগুলি শুনতে শুনতেই মেয়েটির চোখ গিয়ে পড়েছে শোভনদের দিকে। এতক্ষণে ঘুমের ঘোরটি ঠিকঠাক ভেঙেছে তার। হঠাৎ চোখ কুঁচকে ফকিরের কোলে মুখটা লুকিয়ে ফেলল সে।
“কী হল, গাও?”
তাঁর কাঁধে মাথা শক্ত করে গুঁজে রেখে দুপাশে মাথা নাড়াল সে। অপরিচিত মানুষের সামনে গান গাইতে সংকোচ হচ্ছে তার।
“গাও দিদি, ফকিরবাবা বলছে, গাও—” ক্রমশ গাঢ় রঙ ধরতে থাকা ফুটন্ত খেজুর রসের কড়াইয়ে কাঠি নাড়তে নাড়তে প্রৌঢ়াটি বলছিলেন, “আচ্ছা, সেই বনদুগ্গার গানখান গাও দেখি আমার সঙ্গে--”
বলতে বলতে তাঁর ভাঙা ভাঙা ভারি গলায় জেগে উঠল একটি চটুল সুর--
“লাম লাম বনদুগ্গা ষাইট শ্যাওড়ার নিচে--”এইবারে বালিকাটির লজ্জা ভেঙেছে দেখা গেল। ফকিরের কাঁধের ওপর দিয়ে দুটি জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে সে প্রত্যুত্তর দিল,
“কিমতে লামিবাম আমি শাড়ী নাই আমার সঙ্গে”গানটি বালিকাটির মুখস্ত। এ অঞ্চলে বিবাহ, জাতাশৌচ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে বনদূর্গার উপাসনা হয়ে থাকে। মা ঠাকু্মার মুখে শুনে শুনে সেই বনদূর্গার গীত তারও মুখস্ত হয়ে গিয়েছে।
উত্তর প্রত্যুত্তরে তখন জমে উঠেছে গান। নবীন ও প্রবীণ গলায় একসঙ্গে সুর উঠেছে--
সইয়ারে পাঠাইয়া দিছি নশিরাবাদের শ’রে শাড়ী যে আনিছেন সইয়ায় সিঙ্গিরায় বইলেএইবারে ফের প্রৌঢ়া একক কন্ঠে মিনতি জানালেন,
“লাম লাম বনদুর্গা ষাইট শ্যাওড়ার নিচে--”বালিকা উত্তর দিল,
“কিমতে লামিবাম আমি শংখসিন্দুর নাই সঙ্গে”গান থামিয়ে খিল খিল হাসিতে ভেঙে পড়লেন প্রৌঢ়া, “ও দিদি, এখনই শংখসিন্দুরের শখ দেখি যে তোমার! আর কদ্দিন যেতে দাও,পাত্র একখান খুঁজি বার করি--”
“খুঁজতি হবে কেন গো! পাত্র তো এই মজুত--” হাসতে হাসতে মন্তব্য করলেন মুসিয়ের, “এখন লগনটা তয় করলিই হয়--”
“না, না, না--” বলতে বলতেই ছোট ছোট মুঠিতে হবু পাত্রটির বুকে কয়েকটি ঘা দিয়ে নিচে নেমে পালাবার চেষ্টা করছিল বালিকাটি।
তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মুসিয়ের বললেন, “উহু হু, লাগে রে দিদি। আচ্ছা ঠিক আছে। আর বলবো না। এখন বলো দেখি, মদিনাবিবির গল্প শোনবে?” বালিকাটি তার অভিমান ছেড়ে ফের ঘন হয়ে এল তাঁর কাছে, “বলো!”
“এখন নয়, এখন নয়। এখন এই এনাদের নিয়ে ফিরতে হবে যে গো! গিয়ে অনেক কাজকম্ম আছে। তুমি সখী বরং খানিক বাদে আখড়ায় এইসো। পুকুরে জাল পড়বে আজ। মাছধরা দেখবা, আর গল্পও শুনবা।”
শোভন আর ফরিদার রস খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে। হাতের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে শোভন বলল, “তোমার কিন্তু রস খাওয়া হল না মুসিয়েরদাদা।” “হয় নাই বুঝি?” তাঁর কোল থেকে নেমে উঠোন জুড়ে ছুটতে থাকা বালিকাটির দিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুসিয়ের বললেন, “থাক গে যাক। ফিরে গিয়া গুরুবন্দনা করবো আজ। তারপর মিলন টিলন করায়ে শেষে খাবো একেবারে। তার আগে আর মুখে কিছু দিব না গো! চলো বাবাজি, ফিরি--” সূর্য উঠে গেছে কখন যেন। ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ফরিদার দিকে ঘুরে মুসিয়ের মৃদ হেসে বললেন, “ফকিরে কোন দেবতায় বিশ্বাস রাখে সে কি কিছু বুঝতে পারলা গো শাউরি? আলেফের সন্তান মানুষ। সেই মানুষই ফকিরের দেবতা গো! তার পীরিতেই ফকিরের পুজা, আর গান হল গিয়া সেই পীরিতিপুজার মন্ত্র। মানবদেহেই ফকিরের দেবতার একমাত্র দলিজ। সে পীরিতের শতেক ধরন শতেক বরণ। যে পীরিতে তুমি বাবাজিতে মজি আছো, তা-ও পীরিত, আর আমার বকুলসখীর সঙ্গে আমার ভাবভালোবাসা সে-ও পীরিত, আর আল্লা-মুর্শিদ-কৃষ্ণ ভজনা সে-ও তো পীরিত--”
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রোদ উঠে গেল। সাড়ে সাতটা বাজে প্রায়। আমবাগানের ভেতরে তখনও কুয়াশার মৃদু রেশ রয়ে গেছে। প্রধান দরজা দিয়ে বাড়ির চৌহদ্দির ভেতর ঢুকে আমবাগানটিকে বাঁ পাশে রেখে একটুখানি এগিয়ে গিয়ে বড়ো একটি পুকুর। তার অন্য পার থেকে বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে চাষজমি শুরু হয়ে গেছে। পুকুরটির ঘাট এককালে বাঁধানো ছিল। এখন সেসব ভেঙেচুরে গিয়েছে। শুধু ছড়ানো ছেটানো ইঁটের গাঁথনি দেখা যায় কিছু। তেমনই একটি কাৎ হয়ে পড়া গাঁথনির মাথায় কেউ একজন বসেছিলেন চুপচাপ। সেইদিকে এগিয়ে গিয়ে মুসিয়ের হঠাৎ বিস্মিত গলায় বললেন, “এ কী হরনাথ বাবাজি যে। সাতসকালে পুকুরধারে কী মনে করে?”
হরনাথ কৌতুহলী চোখে পেছন থেকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসা শোভনদের দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললেন, “বিষ্ণুদাসী--আপনের সঙ্গে যায় নাই? ” “আমার সঙ্গে? কই, না তো!” ফকিরের চোখদুটি কৌতুকে ঝিলমিল করছিল, “কেন, সে ঘরে নাই?”
“না। ঘুম ভেঙে দেখি ঘরে নাই। তখন ভাবলাম তাহলে তোমার কাছেই গিয়েছে। তা তুমি বলতেছ আসে নাই। ঠিক কিনা? তাহলে গেল কোথা? একবার বলে তো যাবে-- ”
মুসিয়ের হাসলেন। তরুণী ভার্যাসক্ত মধ্যবয়স্ক মানুষটিকে নিয়ে একটু রসিকতা করবার লোভ তিনি ছাড়তে পারছিলেন না। মার্গারেট এদেশে প্রথমে এসে এই মুসিয়েরের কাছেই ছিল কিছুদিন। সম্ভবত সেজন্যই মুসিয়েরের প্রতি কোথাও একটি নিরুচ্চার সন্দেহের স্পর্শ থাকে তাঁর ব্যবহারে। এই মুহূর্তের প্রশ্নটির মধ্যে সেই সন্দেহেরই উঁকিঝুঁকি টের পেয়ে মজা পাচ্ছিলেন তিনি। একটু চুপ করে থেকে মুখটি গম্ভীর করে তিনি বললেন, “বলে যাবে? মানে, অনুমতি নিবে? তোমার? কেন? নারী কি তোমার? প্রকৃতির গর্ভে দশ মাস কাটায়ে আলো দ্যাখলে, আবার পরের পুরুষের জন্ম দেবার লেগে প্রকৃতির গর্ভপ্রবেশ ছাড়া দ্বিতীয় পথও তো পুরুষের জানা নাই হে বাউল। তাহলে মালিক কে? যার দয়ায় জন্ম নাও, জন্ম দাও তার ওপরে আবার ছড়িও ঘুরাবে এ কেমন কথা?”
হরনাথের অবশ্য তখন আর তত্ত্বকথায় মনোযোগ নেই। মুসিয়েরের কথার কোন প্রত্যুত্তর না দিয়েই তিনি পেছন ঘুরে দীর্ঘ পদক্ষেপে আমবাগানের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলেন। শোভন একটু বিরক্ত বোধ করছিল। মুসিয়েরের দিকে ফিরে সে বলল, “অদ্ভুত মানুষ তো! তোমাকে এসে এমনভাবে সরাসরি উল্টোপাল্টা সন্দেহ দেখিয়ে গেল। ওকে শুধু তত্ত্বকথা বলে ছেড়ে দেয়া ঠিক হয়নি মুসিয়েরদাদা। একটু--”
“একটু –কী? লড়াই ঝগড়া? নাগো বাবাজি। সন্দেহও তো পীরিতেরই আরেক রূপ গো। এনার আধারখানি তত ভালো নয় তাই রসায়নটি অমৃতগরলের মিশেল হইয়েছে, শুদ্ধু অমৃত হয় নাই। সে দোষ সময়ে কেটে যাবে। তাছাড়া এই আখড়ার মাটিতে লড়াই ঝগড়া আমি আগেও লড়েছি। কথার লড়াই নয়, সত্যিকার তীরধনুক টাঙ্গী বল্লমের যুদ্ধ। নিজের বিশ্বাসের তরে বাঁচা-মরার লড়াই লড়েছিলাম গো এই দিনটা। তার জন্য এই হাতে জান নিতে হয়েছিল সেদিন। সেই মাটিতে দাঁড়ায়ে এমন তুচ্ছ কারণে বিবাদ বিসম্বাদ করতে মন করেনা গো। বিশেষ করি আজকের দিনে—”
“তুমি-মানুষ মেরেছো?”
“হ্যাঁ বাবাজি। আ- আমি—”
ফরিদা কিছু একটা মন্তব্য করতে যাচ্ছিল। তাকে হাতের ইশারায় নিষেধ করল শোভন। ভয়ংকর স্মৃতিসঞ্জাত কোন একটি বিষাদ মানুষটিকে আবেগতাড়িত করে তুলেছে। মুসিয়েরের এই রূপ সে আগে কখনো দেখেনি।
কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে আমবাগানের অন্যদিকে বাড়ির সীমানাটির দিকে তাকিয়েছিলেন প্রৌঢ়টি। তারপর, নিজের মনেই বললেন, “দিন গেছে বটে সে’সব। বাবাঠাকুর গান লেখতেন তাতেও লোকে বেশি কিছু বলে নাই। বড়লোকের ব্যাটার খেয়াল বলে কাটায়ে দিয়েছে চিরকাল। কিন্তু যেদিন বিধি মেনে ফকিরি নিলেন সেদিন থিকে এলাকার বেশ অনেকঘর গোঁড়া হিঁদু-মোসলমান আমাদিগের শত্রু হয়ে গেছিল। প্রথম প্রথম আড়ালে আবডালে নিন্দেমন্দ চলত। বলত ব্যাটা জাতধম্মো খুয়ায়ে আখড়ায় বসি সাধনার নামে বেলেল্লাপনা করে। তারপর আস্তে আস্তে যখন গ্রামের হিঁদু-মোসলমান লোক একটিদুটি করে আখড়ায় আসি ভিড়তে লাগল, বাবার পসার বাড়তে লাগলো, তখন সে নিন্দেমন্দ আর আবডাল মানল না। হিঁদু বলল, এ ব্যাটা মোছলমান, ফকিরের ভেক ধরে আমাদের ঘর ভাঙাতে এসেছে। আর মোসলমানে বললো, উমের ফকির হয়ে পবিত্র ইসলামী শব্দে দেহতত্ত্বের গান বাঁধে। ইসলামী নামে সে ব্যাটা সহজিয়া বোষ্টমগিরির ঝাণ্ডা তুলেছে। সহজিয়া বা দেহতত্ত্বে দেহই সবকিছু। যে এই পথে হাঁটে, দেহকে খুশি রাখতে সে পরকীয়াকেও পাপ বলে মানেনা। দেহতত্ত্বে যে বিশ্বাস করে সে সমাজের বার নরপশু। উমের খানও তাই। বেটা ছদ্মবেশী বোষ্টম সাচ্চা ধার্মিকের ইমান হারাম করতি চায়।
“কাজেকাজেই বাবার নামে ফতোয়া জারি হয়ে গেল। হয় ফকিরি ছেড়ে ধম্মেকম্মে মন দাও নাহয় তোমার জানের জিম্মা আমাদের নয় এই বলে শাসানির উপর শাসানি চলল। বাবা জবাব দিলেন না। আপন মনে থাকেন, গান বাঁধেন, কে কী বললো না বললো তার পরোয়া করেন না। চারপাশে অনেক গেরামের অনেক মানুষ তখন বাবাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে। তারা এসে বারবার বলতো, ‘হাওয়া ভালো নয়। সাবধান হন।’ জবাবে বাবা বলতেন, ‘এই তো তোমরা আমায় ভালোবাসতে শিখেছ। ওরাও শিখবে ধীরে ধীরে। ধৈর্য ধর।’
“আমার তখন বয়স অল্প। পনেরো ষোল বছরের ছোকরা, কিন্তু চেহারা দেখলে লোকে বলবে পঁচিশ বছরের জোয়ান। রক্ত গরম। আমার বড় ভাই ছিল হুসেন। সাতাইশ বছরের জোয়ান। রূপ ছিল বটে তার! আর তেমন ছিল গান লেখার হাত। বাবার কাছে তার সবে দিক্ষা হয়েছে। কিন্তু হলে কি হয়, আমার মতো সে-ও তো খানের ব্যাটা। তিরধনুকে, তলোয়ারে হাত দুজনেরই পোক্ত। বাপের নিন্দা আমার মত তার গায়েও বাজত খুব।
“তা সেবার, এই আজকের দিনে ফতোয়াওলাদের দল আমাদের মেরে ঘরবাড়ি জ্বালায়ে দিতে এসেছিলো। বাবা তখন ঘরে নাই। উদ্ধবপুরের মেলায় গেছে গানে। সন্ধের পর টাঙ্গি, তলোয়ার আর মশাল নিয়ে সব এসে জড়ো হল উ-ই আমবাগানের ধারে। শালারা ভেবেছিলো ফকির হয়ে খানের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কিন্তু সেই দেখি আমার রক্ত নেচে উঠলো বাবা। বড় ভাইরে গিয়া ধরলাম। বললাম, ‘নিজে তুমি ফকিরি সাধন করে বেহেস্তে যাবা যাও, কিন্তু ঘরের মা বৌয়ের ইজ্জতটি যে যাবে তার খেয়াল তো করবা? নাকি মেইয়েছেলের ইজ্জত বাঁচানোও তোমার ধম্মে মানা?’ শুনে সে-ও লাফ দিয়ে উঠলো বাবা। তারপর ঘরে গিয়া তীরধনুক,তলোয়ারবন্দ হয়ে বের হয়ে আসলাম। বাবা নাই। বাধা দেবে কে? হাঁকার দিয়ে বললাম, ‘বাপের ব্যাটা হলে সামনে আয়। খানের বংশ এখনো নিব্বংশ হয় নাই রে!’ জবাবে তারাও জিগির দিয়ে উঠলো। আজ তারা খান-ফকিরের ভিটেমাটি পোড়ায়ে অধম্মের নাশ করে তবে জল খাবে।
“আমরা দুই ভায়ে তীর ধনুক পাতি বসলাম। সাঁওতালের কাছে হাতের বদলে পা দিয়ে তীর ছোঁড়বার অভ্যাস করেছিলাম। পায়ের জোরে তীর ছোটে, তার এমন জোর যে একশো হাত দূরে লোহার পাত ফুটা করি দেয়। দুই ভায়ে মিলে মশাল দেখে দেখে তীর ছুঁড়ি আর উল্টাদিকে চিৎকার উঠে। সেই করতে করতে দেখি আশেপাশের গ্রামের যারা বাবার কাছে দিক্ষা নিছিলো সেইসব লোকজন দল বেন্ধে চিৎকার করে দৌড়িয়ে আসতেছে। তাদের তাড়া খেয়ে শালারা ছুটে পালালো।
“তিনটা ইনসান সেদিন নিকাশ হয়েছিলো আমাদের হাতে বাবা। চোট পেয়েছিলো অনেক। কিন্তু তার দামও চুকাতে হয়েছিল আমারে। আমার বড় ভাই বাঁচে নাই গো। একটা তীরে বুকখান তার এফোঁড় ওফোঁড় হইয়ে গেছিল।
“সে সময় এই এলাকায় থানা পুলিশের অতো চল নাই। বিশ মাইল দূরে পুলিশ চৌকি। সেখান থিকে খবর পেয়ে দিন দুই বাদে পুলিশ যখন এলো ততক্ষণে সব সাফসুতরা হয়ে গেছে। মার খায়ে সব শালা সিধে হয়ে গিছিল। বাবারে খাতির করে এমন লোকের সংখ্যাও তখন কম নয়। থানাপুলিশ তারাই সব সামলায়ে নিল। কিন্তু মুশকিল হল তার দিন দুই বাদে। বাবা ফিরে এসে সব শুনে আমারে একটিও কথা বললো না। শুধু হুসেনের কবরের ওপরে গিয়া উপুড় হয়ে পড়লো। সেই যে শয্যা নিল বাবা, আর ওঠে নাই।
“এই হাতে মানুষের রক্ত মেখেছিলাম বাবা আজকের দিনে। এই আমি—আমি-- আমার ধম্মপথে থাকা বাপভাইকে খাইছি গো—সব এই আজকের দিনে--” বলতে বলতে মুষ্টিবদ্ধ দুটি হাতে নিজের অস্থিচর্মসার বুকটিতে দুমদুম করে কিল মারছিলেন মানুষটি। দুচোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। অশ্রুবিকৃত গলায় বলছিলেন, “ছিলাম খানের ব্যাটা গুণ্ডা, সেইদিন থেকে আমি সব হারায়ে ফকির হলাম। সেই থেকে আজ এই বচ্ছরকার দিনটাতে গুরুবন্দনা করি গো বাবা। তেনার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাই। ক্ষমা আজও পাই নাই বাবা গো। বুকের ভিতরটা আজও আমার তেমনি খাঁ খাঁ করে জ্বলে--”
--কাঁধের কাছে মৃদু একটা স্পর্শ পেয়ে চমকটা ভেঙে গেল ফরিদার। বিচিত্র একটা নাটকের অভিনয় দেখছিল যেন সে চোখের সামনে। কাঁধের ছোঁয়াটা তাকে বাস্তবের মাটিতে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। বিষ্ণুদাসী কখন যেন এসে তার পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে ঘুরে তাকাতে নিচু গলায় প্রশ্ন করলো, “কী হয়েছে?” “পরে বলবো তোমায়। এখন এখান থেকে চলো। ওঁকে একটু একা থাকতে দাও,” বলতে বলতে বিষ্ণুদাসীর হাত ধরে সে হাঁটতে হাঁটতে অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে গেল। শোভন একলা দাঁড়িয়ে রইল মাথা নিচু করে দাঁড়ানো ফকিরের পাশে।
“কোথায় গেছিলে গো? তোমার বাউল তো তোমায় খুঁজে খুঁজে হয়রান।”
“তাই বুঝি?” ফরিদার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বিষ্ণুদাসী ঠোঁট টিপে হাসল। ঝরঝরে বাংলা বলে সে। এতটুকু টান নেই, “গেছিলাম হুসেনের মাজারে। জায়গাটা ভারী শান্ত। লোকজনের ভিড় নেই। চুপচাপ বসে ছিলাম অনেকক্ষণ।”
“তুমি—হুসেনের গল্প জানো? এতক্ষণ মুসিয়ের আমাদের সেই গল্পই বলছিলো তো!”
নিঃশব্দে মাথা নাড়লো বিষ্ণুদাসী। তারপর অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মুসিয়েরের দিকে দেখতে দেখতে বলল, “প্রথম যেদিন হুসেনের গল্প শুনেছিলাম মুসিয়ের ফকিরের মুখে তখন এ দেশে আমার মাত্র ছ মাস হয়েছে। কম্পারেটিভ লিটারেচারের ছাত্রী ছিলাম এডিলেড ইউনিভার্সিটতে। স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে বিশ্বভারতীতে এসে ইন্ডিয়ান সুফি মিউজিকে অ্যাট্রাক্টেড হয়ে সবে ফিল্ড করতে বেরিয়েছি। বাংলাটাও ভালো করে জানিনা। লোকের থেকে রেফারেন্স নিয়ে এসে উঠলাম এই মুসিয়েরের আখড়ায়। ম্যাগনেটিক পার্সোনালিটি মানুষটার। আর, এতো কন্ট্রাডিকশন ওর চরিত্রে, যে আমার মতো একটা তুলনামূলক সরল সমাজের মানুষের পক্ষে সেটাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করাটা খুব কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিলো।
“তারপর, একদিন একটা হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে ও আমায় হুসেনের গল্পটা শুনিয়েছিল। নিজের ওপর থেকে সমস্ত আবরণ সরিয়ে নিয়েছিলো ও তখন। সেই ঘনিষ্ঠতম মুহূর্তটায় ওর সবক’টা মুখ, সমস্ত বৈপরীত্যকে আমি একসঙ্গে দেখেছিলাম। কে জানে, হয়তো আমার ধারণক্ষমতার পরীক্ষা নিচ্ছিল। পাশ করলে দিক্ষা দিয়ে সাধনসঙ্গিনী করত আমায়। কিন্তু আমি পারিনি, বুঝলে। ওকে সম্পূর্ণ ধারণ করা কোন মেয়ের পক্ষেই সম্ভব বলে মনে হয় না। আমার সেই মুহূর্তের ফিলিংস তুমি কল্পনাও করতে পারবে না । পরস্পরবিরোধী সব বিচিত্র অনুভূতির টানাপোড়েনে ছিঁড়েখুঁড়ে যাবার দশা হয়েছিল আমার। সেই তীব্রতা ধারণ করবার মত শিক্ষাদিক্ষা বা মনের জোর আমার ছিল না। পালিয়ে গেছিলাম, জানো। পরদিন সকালে আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে আখড়া ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে বাস ধরেছিলাম।
কিন্তু এদেশের এই গান আমায় আর ছাড়লো না। দেশে ফিরে গেলাম, কিন্তু টিঁকতে পারলাম না। ফিরে এলাম আবার কয়েক মাসের মধ্যে। তারপর হর বাউলের সঙ্গে আলাপ হল। ও অনেক সহজ মানুষ। ওর ফিলিংস আর ইমোশনগুলো অনেক সহজে পড়তে পারি আমি। হয়তো মুসিয়েরের অত ট্যালেন্টেড বা ক্রিয়েটিভ নয়, কিন্তু ডেডিকেটেড হয়ে ভালোবাসতে জানে লোকটা।
“শুধু ভালোবাসার খোঁজে দেশ ছেড়ে এতদূর এলে? আর কিছু নয়?”
মার্গারেট হাসল। হাসলে ওর গালে টোল পড়ে। তারপর ফরিদার চিবুকটি ছুঁয়ে বলল, “কেন? শুধু ভালোবাসাও কি কিছু কম নাকি? ডোন্ট ইউ থিংক ইউ ক্যান লিভ এভরিথিং এলস ফর ইওর লাভ?”
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল ফরিদা, “পারি। কিন্তু মার্গারেট, দ্যাট লাভ ইজ নট লিমিটেড টু আ ম্যান উইম্যান অ্যাট্রাকশান অনলি। একটা মিশনকে ভালোবেসে আমার নাগরিক জীবনকে ছেড়েছি আমি। আমার নিজের এলাকার গ্রামগঞ্জে শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেবার মিশন। আমার স্বামী সেই মিশনেরই একটা কম্পোনেন্ট। তার বেশি কিছু নয়।”
“এ কথা তুমি কখনো তোমার স্বামীকে বলে তার রিঅ্যাকশন দেখেছো?”
ফরিদা হাসল, “তার কোন প্রয়োজন বোধ করিনি আমি মার্গারেট। আমার স্বামীর ভালোবাসার দুনিয়ায় আমার ভূমিকাটাও ঠিক ওইরকমই। সবকিছু ছেড়ে আমার ওপর একমুখী আগ্রাসী ভালোবাসায় তার পতন হত যদি তাহলে সে আমার মরার সমান হত।”
মাথা নামিয়ে চুপচাপ বসেছিল মার্গারেট। তার চোখের কোণদুটো চিকচিক করছিল। খানিক বাদে নিজেকে সামলে নিয়ে একেবারেই স্বাভাবিক গলায় সে বলল, “লাকি ইউ। আমার ভালোবাসাটাও কিন্তু আসলে একটা মিশনের প্রতি। সে হল এই মাটির মিস্টিক গানকে চেনা, বোঝা, স্পর্শ করা, ও তার মধ্যে দিয়ে তার সৃষ্টিকর্তা এ অঞ্চলের মানুষদের ঠিকমতো বোঝা। একই সঙ্গে সরল ও জটিল, ব্যাকডেটেড ইয়েট ইন্টেলেকচুয়ালি হাইলি অ্যাডভান্সড, গরীব অথচ অহংকারী, অতিপ্রাচীন একটা কালচারের প্রেজেন্ট ডে ইনহেরিটর এই মানুষগুলোর ভালোবাসায় আমি মজে আছি ফরিদা। দুদিন এসে ফিল্ড করে ফিরে গিয়ে বইপত্র পড়ে পেপার লিখে এদের চেনা হয় না। ক্লাসরুমের পাণ্ডিত্য দিয়ে একে ছোঁয়া যায় না। এই মানুষ আর তাদের গানকে ফিল করতে গেলে এ মাটির অংশ হয়ে যেতে হয় নিজেকে। সেইজন্যেই আমি মার্গারেট থেকে বিষ্ণুদাসী হয়েছি। হর বাউলকে আমি গভীরভাবে ভালোবাসি ফরিদা। কিন্তু সে ভালোবাসাও আলটিমেটলি এই মিশনের প্রতি ভালোবাসারই একটা কম্পোনেন্ট।”
ফরিদা নিঃশব্দে হাঁটছিল বিদেশিনী মেয়েটির পাশাপাশি। খানিক আগেই এই কথাগুলির অনেক বেশি পরিণত ও মার্জিত প্রকাশ সে শুনে এসেছে। মুসিয়েরের বলা কথাগুলি তার কানে এসে বাজছিল, “সেই মানুষই ফকিরের দেবতা গো! তার পীরিতেই ফকিরের পুজা, আর গান হল গিয়া সেই পীরিতিপুজার মন্ত্র। মানবদেহেই ফকিরের দেবতার একমাত্র দলিজ। সে পীরিতের শতেক ধরন শতেক বরণ। যে পীরিতে তুমি বাবাজিতে মজি আছো, তা-ও পীরিত, আর আমার বকুলসখীর সঙ্গে আমার ভাবভালোবাসা সে-ও পীরিত, আর আল্লা-মুর্শিদ-কৃষ্ণ ভজনা সে-ও তো পীরিত--”
হঠাৎ কি মনে হতে মার্গারেটের হাতটি ধরে সে বলল, “লাকি ইউ কেন বললে তাহলে বিষ্ণুদাসী। লাকি তো তুমিও। নিজের মিশনকে সুন্দর এগিয়ে নিয়ে চলেছ।”
“তোমাকে ভাগ্যবতী বলেছি একটাই কারণে ফরিদা। সেটা হল তোমার পার্টনারও ভালোবাসার ব্যাপারে তোমার পথের পথিক। আই অ্যাম নট দ্যাট লাকি। হর বাউলের ভালোবাসা বড় একমুখী ফরিদা। সে আমায় অনেক দিয়েছে। তার হাত ধরে এ মাটির মরমিয়া গানের অর্থ বোঝাটা এখন আমার কাছে অনেক সহজ হয়ে এসেছে। কিন্তু তার বদলে সে আমার সবটা গ্রাস করতে চায়। ইট’স সো ক্লস্ট্রোফোবিক ইউ নো! ”
“একটা কথা বলি শোন মার্গারেট। এদেশের মানুষকে বুঝতে হলে তার সাইকিটাকেও ঘনিষ্ঠভাবে বুঝতে হবে তোমায়। নইলে তার দর্শনকে তুমি ঠিকভাবে অনুভব করতে পারবে না। ভারতীয় পুরুষ ভীষণ পজেসিভ হয়। বাঙালি পুরুষের চরিত্রে আবার সেই অধিকারবোধের সঙ্গে এসে মেশে এক্সট্রিম নির্ভরশীলতা। পার্টনারের কাছে সে একাধারে চিরশিশু ও ফিউডাল লর্ড। যৌথ জীবনে মেয়েদের কোন আলাদা স্পেস যে থাকতে পারে সে কথা সে স্বীকার করে না। যে সমাজে তোমার জন্ম সেখানে মানুষ হিসেবে জীবনের যে কোন পর্যায়ে যে স্পেসটা তুমি ন্যায্য অধিকার বলেই শিখে এসেছো, এদেশে সে স্পেসটার দাবী করা কিন্তু সমাজের সাধারণ নিয়ম অনুসারে তোমার অধিকারের বাইরে। এটা মেনে নিয়ে এগোতে হবে তোমায়। খেলতে নেমে খেলার রুল না মানলে তো চলবে না! ”
“কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে তো তা হয় নি! তোমার পার্টনার তো--”
“ওটা ব্যতিক্রম মার্গারেট। শোভন অন্যরকম মানুষ। হি ইজ অ্যান অ্যাসেটিক। কোন স্পেসিফিক এথনিক ছাঁচে ওকে ফেলা যায় না। আমি একরকম জোর করেই ওর সঙ্গে এসেছি। আমাদের দুজনের মিশন একটাই। উই আর মোর কমরেডস দ্যান লাভার্স।”
হঠাৎ ঘুরে বসে মার্গারেট বলল, “লাকি ইউ—লাকি ইউ—ইটস আ ড্রিম ম্যাচ ফর এনি রিসার্চার। তবে একটা কথা তোমায় বলি ফরিদা। বয়সে আমি তোমার চেয়ে খানিকটা বড়। অভিজ্ঞতাও একটু বেশি। তোমার চোখ আমায় কিন্তু অন্য কথা বলছে।”
“অন্য কথা-মানে--”
“তার চিবুকটি ধরে নাড়িয়ে দিয়ে মার্গারেট বলল, মানে হল, যতই তুমি মিশনটিশনের কথা বলো, তোমার চোখ বলছে ইউ আর ম্যাডলি ইন লাভ উইথ ইওর ম্যান অ্যান্ড ক্যান ডু এনিথিং ফর হিম। হয় তুমি সে কথা আমার কাছে লুকোচ্ছ, নয় এখনও তুমি সেকথা নিজের কাছেও স্বীকার করো নি।”
“মার্গারেট দেখো--”
“স-শ-শ-” মার্গারেট তাড়াতাড়ি ফরিদার ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে তার অস্বস্তিটুকুকে ঢাকা দিয়ে দিল, “বোল না। কিচ্ছু বোল না। আই ওয়ান্ট নো ক্ল্যারিফিকেশন, নো র্যায়শনালাইজেশন। ট্রেজার ইওর ফিলিং। ট্রেজার ইওর লাভ। ডোন’ট শেয়ার উইথ এনিবডি ইফ ইউ ডু নট হ্যাভ টু। ইটস দা ওনলি ওয়ে- লাভ! পীরিতি! তিনটি অক্ষর। ওতেই সবকিছুর শুরু—আবার ও-ই গোটা সৃষ্টিটার ডেস্টিনি--”
চুপ করে পাশাপাশি বসে রইলো তারা দুজন। সব কথা ফুরিয়েছে এইবারে। শীতের সূর্য ধীরে ধীরে আকাশের গা বেয়ে ওপরের দিকে উঠে আসছিল। পুকুরের এই ধারটা একেবারে নির্জন। দু একটা পাখির ডাক শোনা যায় শুধু মাঝে মাঝে। পুকুরের অন্য ধারে কেউ একজন জলে নেবেছে একটা জাল ঘাড়ে করে। তার হাতের ধাক্কায় জালটা একটা বৃত্ত তৈরি করে এসে জলের মধ্যে পড়ছে। সেই দিকে দেখতে দেখতে মার্গারেট ফের অন্যমনস্কভাবে বলল, “হরনাথের সঙ্গে থেকে থেকে আস্তে আস্তে অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি এখন। কনফিডেন্সটা এসে গেছে। মুসিয়েরের মুখোমুখি হতে এখন আর কোন ভয় লাগে না। হরনাথ আমায় অনেক দিয়েছে। অনেক শিখিয়েছে। কিন্তু জানো—মুসিয়ের একটা তীব্র নেশার মত। একবার ধরলে সহজে ছাড়া পাওয়া কঠিন। মাঝে মাঝে তাই দুচারদিনের জন্য এখানে চলে না এসে পারি না। আর যখন আসি, ওই হুসেনের মাজারে গিয়ে খানিকটা সময় কাটিয়ে আসি। মানুষটা দুর্ভাগা। ভীষণ ট্যালেন্টেড ছিল। ওর লেখা গান শোনাবো কখনো। অত অল্প বয়সে উপলব্ধির অত গভীরে যেতে আমি আর কাউকে দেখিনি।”
জালওয়ালা ততক্ষণে বারকয়েক জাল ঠেলে পাড়ে গিয়ে উঠেছে। সেদিকে একনজর ভালো করে দেখে ফরিদা বলল, “ এ তো জহিরুল, জাল ফেলছিলো। চলো গিয়ে দেখি কী উঠলো! ”
“চলো,” বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো বিষ্ণুদাসী।
জহিরুলের জাল ঘিরে কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন। কুঁচোকাচা কিছু মাছ আর গোটাকয়েক কাতলা মাছের চারা উঠেছে জালে। সেই দেখে মুসিয়ের হেসে হেসে বলছিলেন, “কি হে ফকিরের ব্যাটা। বড় মুখ করে সকালে বললা, বাজারে গিয়ে কাজ নাই, মাছ আমি ধরে দিবোখন। তা এখন এই দিয়া তুমি অতিথ সেবা করাবা?”
জহিরুল গামছার কোণায় কপালের ঘাম মুছছিলো। বিরক্ত গলায় বলল, “মাছ কি আমার পোষা নাকি, যে তু বলি ডাকলেই চলে এসে জালে পড়বে! ওই যা উঠেছে তাই দিয়েই--”
“হুঁ! তোমার দৌড় বোঝা গেছে বাপধন। দাও দেখি, জাল আমায় দাও,” বলতে বলতে গায়ের আলখাল্লাটি খুলে রেখে কোমরে একটি গামছা জড়িয়ে সেটিকে কাছা দিয়ে গুটিয়ে নিয়ে জাল হাতে মুসিয়ের জলে নেমে গেলেন। আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে কোমর জল অবধি পোঁছে এদিকসেদিক দেখে নিয়ে একটা এলাকা ঠিক করে জালটি ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন সেইখানটিতে। জলে কিছু বুদবুদ তুলে জালটি তলিয়ে গেল। একদৃষ্টে হারিয়ে যাওয়া জালটির জায়গাটিতে তাকিয়ে থেকে খানিক বাদে হাতে ধরা দড়িটিতে টান দিলেন ফকির। টানটান হয়ে গেছে দড়িটি। ধীরে ধীরে সেটি ধরে পাড়ের কাছে এসে জালটি গুটিয়ে তুলতে দেখা গেল একটি বড়সড় কাতলা মাছ তার মধ্যে লেজ আছড়াচ্ছে। মাছটি দেখিয়ে ফকির জহিরুলকে বললেন, “নাও হে সুপুত্তুর, মাছটি নিয়ে ঘরে যাও।” জহিরুল দেখা গেল একটু লজ্জা পেয়েছে। নিচু হয়ে নীরবে মাছটিকে জালে জড়িয়ে নিয়ে উঠে ভেতরবাড়ির দিকে রওনা হল সে। পেছন থেকে মুসিয়ের ফুট কাটলেন, “দ্যাখো হে, কুলতিলক জাল ছাড়লে পাঁচ কেজির মাছ ওঠে আর কুলাঙ্গারে জাল ফেললে চুনোপুঁটি—হা হা হা--” বয়সের ভার ঝরে গিয়ে যেন একটি দুষ্টু কিশোর এসে শরীরটিতে জুড়ে বসেছে তাঁর। সমবয়সী খেলার সাথীটিকে নিজের কৃতিত্ব দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়ে বড় আনন্দ পেয়েছে যেন সেই কিশোর। তাঁর হাসিমাখা স্বচ্ছ চোখদুটিতে কিছুক্ষণ আগের সেই বেদনাদীর্ণ বয়োজীর্ণ ফকিরের চিহ্নমাত্র নেই। সেই দিকে দেখতে দেখতে হঠাৎ করে মার্গারেটের সেই কালকে রাত্রের গানটাই ফের মনে পড়ে গেল শোভনের--“তোমার ঘরে বাস করে ক’জনা ও মন জানো না—তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা--”
জহিরুল ততক্ষণে বড় বড় পায়ে এগিয়ে গিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছে মাছটা নিয়ে। সেদিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে শোভনদের দিকে ফিরে মুসিয়ের বললেন, “এক কাজ করেন গো। সকলে স্নান টান সেরে নেন। এগারোটা নাগাদ গুরুবন্দনায় বসব। আজ আর সভা নয় । কেবল কাছের মানুষজন। আনন্দ ফকির, মাজহারুল, আপনারা কজন, ব্যস।”
আমগাছতলা থেকে কালকের সেই মঞ্চটি এর মধ্যেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে কখন যেন। মাজারের ঠিক সামনে চাতালটির ওপরে শতরঞ্জি বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। মাথার ওপর আমগাছের পাতার মধ্যে দিয়ে উত্তরের শুকনো হাওয়া চলবার সড়সড় শব্দ উঠছিলো। মাঝে মাঝে দুএকটি শুকনো পাতা টুপটাপ খসে পড়ে। একটি দুটি করে মুকুল ধরতে শুরু করেছে গাছটিতে। ফরিদা এসে দেখে মুসিয়ের ফকির তার আগেই এসে গিয়েছেন। মাজারের মধ্যে উমের খাঁয়ের সমাধিটির পাশে বসে আপনমনে তাকে ফুল দিয়ে সাজাচ্ছিলেন মুসিয়ের। একএকটি ফুলকে আলগোছে তুলে ধরে বসিয়ে দিচ্ছেন নির্দিষ্ট স্থানে। ধীরে ধীরে ফুলগুলি মিলে একটা নকশা গড়ে তুলছিলো দামি কাপড়ে ঢাকা সমাধিস্তূপটিকে ঘিরে।
সমাধিস্তূপের একপাশে কাঠের একটি ছোট তেপায়ার ওপরে শালুতে বাঁধা কয়েকটি খাতা রাখা। তেপায়াটিকে একটি দীর্ঘ মালা দিয়ে সাজাতে সাজাতে তিনি গুণগুণ করে গাইছিলেন,
এ ঘর মাপে শুধু চোদ্দ পুয়া চোদ্দ ভুবন তার ভিতর সে ঘর জলে পড়লে অগ্নি জ্বলে কভু স্থাবর কভু অস্থাবর-গাইতে গাইতেই হঠাৎ ফরিদার দিকে খেয়াল যেতে গান থামিয়ে বললেন,“এই খাতা কীসের তা জানো শাউরি? ওর মধ্যে পাঁচখান আমার বাবা উমের খানের গানের খাতা, আর দুইখান হুসেনের। সাড়ে চারশো গান লিখিছেল দুইজনে মিলে, তার মধ্যে জোর শ খানেক গানের চল আছে।”
“আর বাকি গান?”
“তার বেশির ভাগেরই সুর হারায়ে গেছে। কিছু কিছু আমি মনে করে রেখেছি আর কিছু আমার মায়ের স্মৃতিতে আছে, বিশেষ করে হুসেনের গানগুলি। দেখি যতদূর পারি উদ্ধার করে রেখে যাবো-- ”
কথা চলতে চলতেই তাঁর গানটির অসমাপ্ত পদটি ফরিদার পেছন থেকে কেউ একজন তুলে নিল-
এই ঘরে পাঁচিল শব্দপুর এ ঘরে আছে মধ্যে অন্তঃপুর যে সন্ধানী সে যেতে পারে অন্যের পক্ষে দুর“কে আনন্দ এলা?” কাজ করতে করতে মাথা না তুলেই ফকির প্রশ্ন করলেন। মানুষটির বয়স ত্রিশের নীচে। বেতের মতো পাকানো চেহারা। হাসি হাসি চোখদুটি তুলে সে ফরিদার দিকে দেখছিল। “আনন্দ আমার বুয়ার ব্যাটা হয়। আর আনন্দ, এই গোঁসাইন আমার শাউরি হয় কিন্তু। সাবধানে কথাবার্তা বলবা—”
ঝরঝর করে হেসে ফেললেন মানুষটি। তারপর ফরিদার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তবে তো তুমি আমার দিদিমা হলা গো বহিন, তাইতো?”
ফরিদা হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়লো। রসিকতাটি তার মন্দ লাগছে না।
একে একে সকলেই এসে পৌঁছোতে পৌঁছোতে বেলা সাড়ে এগারোটা বেজে গেল প্রায়। নিমন্ত্রিত দুচারজন মানুষ রয়েছেন। সেইসঙ্গে রয়েছেন মুসিয়েরের বাড়ির সমস্ত সদস্য। তাঁর অশীতিপর বৃদ্ধা মা-ও আজকের দিনটির জন্য নিজের শয্যা ছেড়ে উঠে এসে যোগ দিয়েছেন গাছতলার এই স্মরণবাসরে। আজকের অনুষ্ঠানে কোন মাইক্রোফোন নেই। নির্জন গাছতলাটিতে শুধু কজন মানুষ, পূর্ব প্রজন্মের একজন কবির সমাধির সামনে একত্র হয়েছেন। নিজের বংশপরম্পরায় প্রবাহিত ধর্মচর্চা ও জীবনযাত্রাকে ত্যাগ করে সেই মানুষটি ভালোবাসার নতুন ধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন এই অঞ্চলে। সে ধর্মের বীজমন্ত্র হল প্রেম আর উপাসনার মন্ত্র হল গান। প্রেম-অপ্রেমের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মৃত্যু ও পাপ এই দুয়ের হাতে নিজের দুই সন্তানকে শিকার হতে দেখে তিনি আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধের দিনটিতে পিতার ধর্ম থেকে সরে এসে হত্যাহেন পাপকে হাতিয়ার করেছিল যে কিশোরটি, শেষপর্যন্ত পিতার প্রেমের ধর্মেই সে তার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। আজ বহু বছর ধরে আজকের দিনটিতে সে তাই তার পিতার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই শ্রদ্ধাবাসরটির আয়োজন করে থাকে।
সকলে নীরবে একত্র হলে সমাধির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে মুসিয়ের গুরু বন্দনা শুরু করলেন,
শিষ্যেতে গুরুর বাস গুরু শিষ্যে একাকার কভু গুরু দর্শনধারী কভু গুরুর নেই আকার ওরে মানুষ নেই তোর হুঁশ বেহুঁশ রলি এ ভবে গুরু বিনে শেষ নিদানে সঙ্গী আর কে হবে পাগল সেবু হলো কাবু উদ্ধার করো গুরু এসেকোন যন্ত্রানুসঙ্গ ছিল না সেই গানে। উপস্থিত সব শ্রোতারাই একে একে গলা মিলিয়েছে সেই সম্মিলিত গুরুবন্দনায়। তাদের সকলের মাঝখানে একটি প্রাচীন বৃক্ষের মতোই মাথা উঁচিয়ে বসেছিলেন প্রৌঢ় মানুষটি। তাঁর বন্ধ চোখদুটি জলে ভেসে যাচ্ছিল। গানটি শেষ করেই একমুহূর্তও বিরতি না দিয়ে তিনি ধরলেন পরের গানটি-
বড় সঙ্কটে পড়িয়া দয়াল বারে বার ডাকি তোমায় ক্ষম ক্ষম অপরাধ......! দাসের পানে একবার চাও হে দয়াময় ক্ষম অপরাধ।অশ্রুবিকৃত কন্ঠে তাঁর সুর-তাল-লয় সব কেটে যায়। ওই একটি পঙ্ক্তিতে এসেই বাঁধা পড়ে গেছেন তিনি। অসহায়ভাবে মাথাটি ক্রমাগত দুলিয়ে চলেছেন, ঠোঁটের কষ গড়িয়ে ফেনা উঠছে তাঁর, আর ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি করে চলেছেন দুটিমাত্র শব্দকে—ক্ষম অপরাধ—ক্ষম অপরাধ।
একে একে তাঁর স্ত্রী, পুত্র, মা, ভিনদেশ হতে আসা অনুরাগিনী যুবতিটি সকলেই তাঁর কাছে ঘেঁষে আসে। মমতাময় একরাশ হাত তাঁকে ঘিরে যেন সহস্রদল পদ্ম ফুটিয়ে তুলেছে একখানি। তবু তাদের সেই সান্ত্বনা তাঁর বেদনাকে অতিক্রম করতে পারে না। নিজের সাধনার জগতে একেবারে একা মানুষটি আজ বহু বছর ধরে একান্তে পিতা ও গুরুর কাছে নিজের একদিনের একটি অপরাধের জন্য নিরন্তর ক্ষমা চেয়ে চলেছেন। অন্তরের সেই অশ্রুক্ষরণ আজ গুরুবন্দনার দিনে প্রকাশ্যে এসেছে। তাঁর প্রিয়জনেরা ঘিরে রয়েছেন যন্ত্রণাদীর্ণ মানুষটিকে।
বেলা ঢলে এসেছে প্রায়। এখানে কারও সেদিকে কোন হুঁশ নেই আর। নিজেদের কেমন যেন বহিরাগত ঠেকছিল শোভন ও ফরিদার। এই সাধনভূমিতে তারা অতিথিমাত্র, পরিবারের অংশ নয়। আবেগের এই সুতীব্র প্রবাহে অবগাহনের অধিকার তাদের নেই। তাদের এইবারে ফিরতে হবে নিজেদের কর্মভূমিতে। সেখানে অনেক শিশু তাদের অপেক্ষায় আছে--
“পা চালিয়ে গেলে তিনটের বাসটা পেয়ে যেতে পারি এখনো। তাহলে হরিহরপাড়া থেকে পাঁচটার লোকালটা পেয়ে গেলে রাতের মধ্যে বাড়ি পৌঁছনো যাবে। চেষ্টা করবে নাকি?”
“চলো--” বলতে বলতে ফরিদা উঠে দাঁড়িয়ে তার ঝোলাটি কাঁধে তুলে নিল।