• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৮ | নভেম্বর ২০১৪ | উপন্যাস
    Share
  • যাত্রী: তৃতীয় পর্ব (৮,শেষ) : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ (শেষ)




    ******

    “এই যে স্যার এই পেপারটা একবার দেখুন, এখানে গোটা প্রজেক্টটার সিনপসিস লিখে দেয়া রয়েছে।”

    শ্যামল কর্মকার একটা নীল রঙের প্লাস্টিক ফোল্ডার খুলে ধরেছেন তার সামনে। শোভন সেটাকে সরিয়ে রেখে বলল, “পরে দেখবো। প্রথমে আপনি মুখে একটু বলুন। কী করতে চাইছেন এখানে আপনারা?”

    “স্পেশাল কিছু নয় স্যার। এটা একটা এস্টাব্লিশড বিজনেস মডেলের ইমপ্লিমেন্টেশান মাত্র। এই এলাকায় ব্যক্তিগতভাবে একটা বিরাট সুনাম আছে। সেটাকে ব্যবহার করে কেজরিওয়াল এই এলাকার এডুকেশান সেক্টারে ইনভেস্ট করতে চাইছে।”

    “কীভাবে?”

    “রুরাল বেঙ্গলের এডুকেশানের যা হাল সে তো আপনার চেয়ে ভালো কেউ জানে না স্যার। সেইজন্যেই তো আপনি নিজেই একটা প্যারালাল এডুকেশান সিস্টেম চালু করেছিলেন এখানে। কেজরিওয়ালের সাহায্যে মিস্টার প্রধান সেইটেকেই আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন শুধু। একটা লজিক্যাল এক্সটেনশান। ব্যাপারটা সিম্পলি বললে বলা যায় স্কুল উইদিন আ স্কুল। জেলার বিভিন্ন স্কুলগুলোর কাছে আমরা একটা প্যাকেজ অফার করছি প্রাইমারিলি। তাদের স্কুলের মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক লেভেলের সমস্ত ছাত্র আমাদের এডুকেশান উইং-এ রেজিস্টার করলে আমরা প্রত্যেকটা স্কুল প্রেমিসেস-এ দুটো করে রুম নিয়ে একটা করে ব্রাঞ্চ তৈরি করে তাদের এই পরীক্ষাদুটোর জন্য তৈরি করে দেবো। প্রত্যেকটা স্কুলেই স্কুল কর্তৃপক্ষের জন্যে একটা ইনসেনটিভ স্কিম থাকবে, মানে সবচেয়ে বেশি এনরোলমেন্ট যে স্কুল করাবে কোন শিক্ষাবর্ষে, তার প্রিন্সিপ্যালের জন্য একটা ফুল পেইড ফরেন ট্রিপ বা ইক্যুয়াল অ্যামাউন্টের ক্যাশ রিওয়ার্ড এইরকম আর কি। ভালো রেজাল্ট হলে তাতে ছেলেদের আর স্কুলের দুতরফেরই লাভ। এদের মধ্যে যারা মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্টে বা প্লেন লাইনে ভালো কলেজে এন্ট্রান্স দিয়ে প্লেসমেন্ট পেতে চাইবে তাদের জন্যে স্পেশাল কোচিং-এর বন্দোবস্ত থাকবে। এই যে দেখুন স্যার প্ল্যানটা—কেজরিওয়ালের তরফে একটা প্লেসমেন্ট গ্যারান্টির অফার দেয়া থাকছে। তাতে শিওরিটি দেয়া থাকছে যে প্লেসমেন্ট না পেলে প্রথমবারে টিউশন ফি-র ফোর্টি পারসেন্ট ফেরত দেয়া হবে, তবে সেটা হবে পরের বার এনরোলমেন্টের সময় মোট প্যাকেজের ওপর ফোর্টি পারসেন্ট ছাড় হিসেবে। তৃতীয় অ্যাটেম্পটের সময় সেটা ষাট পারসেন্ট করে দেয়া হবে। আরো আছে স্যার, এই যে দেখুন, স্টেজ টু-তে—”

    তার সামনে বাড়িয়ে ধরা ফোল্ডারটাকে একটু ঠেলে দিয়ে শোভন প্রশ্ন করল, “দুটো প্রশ্ন আছে শ্যামলবাবু। একে একে জিজ্ঞাসা করি। প্রথমত, “এই বিজনেসে আমার ভূমিকাটা কী?”

    “আপনাকে আমরা বেশি জড়াবোই না স্যার। আপনি নিশ্চিন্তে আপনার নিজের কাজ করতে পারবেন। শুধু এই এলাকায় কেজরিওয়ালের প্রজেক্ট ডিরেক্টার হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় যে প্রোপাগান্ডা ড্রাইভ চলবে তাতে আপনাকে লিডারশিপ দিতে হবে—না না—সে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না কিছু। টোটাল প্ল্যানিং, আপনার ইমেজ প্রজেকশান করা, কিছুটা মিডিয়া কভারেজ সে সবের ডিটেইলড প্ল্যান আমাদের পাবলিসিটি উইং-ই সামলে দেবে। আপনি শুধু ব্যাপারটার ওপরে একটা অ্যাকাডেমিক গ্লস দেবেন, অবভিয়াসলি এগেইন্সট আ রেমুনারেশান। আর এই হেমলতা বিদ্যামন্দিরকে আমরা গোটা প্রজেক্টটার হেডকোয়ার্টার হিসেবে ইউজ করতে চাইব। অবশ্যই একটা মিউচুয়ালি এগ্রিড বার্ষিক রেন্টের বিনিময়ে। সেই প্ল্যানের অংশ হিসেবে প্রথমে আপনার লিভিং কোয়ার্টারটাকে একটা মেক ওভার দেয়া হয়েছে। এবারে এই স্কুলবাড়ির পেছনের জমিটাতে একটা চার কামরার ছোটো অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং-এর প্ল্যান অ্যাপ্রুভ করেই রাখা আছে। আপনার প্রেজেন্সে তার শিলান্যাস করানো হবে এখানকার ওই মেলাটার শুরুর দিনে। সম্ভবত এডুকেশান মিনিস্টারকে সেদিন এখানে নিয়ে আসবেন অমরেশবাবু। তাঁর হাত দিয়েই—”

    “কিন্তু আমার জমিতে যে বিল্ডিং তৈরি করবেন বলে প্ল্যান করেছেন, তার জন্য আমার কোন অনুমতি নেবার প্রয়োজন বোধ করেন নি আপনারা? আমি যদি এতে মত না দিই—”

    শ্যামল কর্মকার প্রচণ্ড অবাক হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “জমি, বিল্ডিং সবই কিন্তু আপনার নামেই থাকবে স্যার। মিস্টার প্রধানের ভাষায় ওটা ওঁর তরফ থেকে আপনার জন্য একটা গিফট। যে পাঁচ ছ লাখ টাকা খরচ হবে বিলডিং তৈরি করতে সেটা কোম্পানি প্রজেক্টের ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে দেখাবে। এখানে মার্কেট যা দেখেছি, ওসব টাকাপয়সা উঠে এসে ব্রেক ইভেন করতে আমাদের দু বছরের বেশি সময় এখানে লাগবে না। ইট্‌স আ উইন উইন প্রোপজাল স্যার—”

    “কিন্তু—”

    তার দীর্ঘকালের সঙ্গী ছেলেগুলি তাদের দুজনকে ঘিরে বসেছিলো। চকিতের জন্য একটা উদ্বেগের গাঢ় ছায়া চলে গেল তাদের মুখের ওপর দিয়ে। তারপর সমরেশ হঠাৎ নিচু গলায় বলল, “এটা নিয়ে তুমি কোন কিন্তুর জায়গা রেখো না শোভনদা। তোমার তো কোনো ক্ষতিই হচ্ছে না এতে। উলটে ফিনানশিয়াল গেইন হচ্ছে প্রচুর। আমরা এতগুলো ছেলে একটা রেগুলার কাজ পাচ্ছি—আর তাছাড়া গোটা এলাকায় প্রজেক্টটা নিয়ে যা আশা গড়ে উঠেছে তাতে তুমি এখন মাঝখানে এসে পড়ে আপত্তি করলে—”

    তার কথায় মনোযোগ না দিয়ে শোভন তার দ্বিতীয় প্রশ্নটা রাখল, “আর যারা এ টাকাটা দিতে পারবে না? মানে, আমার এখানে যে ধরনের ছেলেমেয়েগুলো পড়তো, সমাজের যে স্তরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করতাম আমি, তাদের কী হবে শ্যামলবাবু? হেমলতা বিদ্যামন্দির তো কখনো—”

    “আরে ছি ছি স্যার। হেমলতা একটা লফটি আইডিয়াল নিয়ে চলে। ওটাই তো আমাদের শো পিস। ওটা থাকবে স্যার। একদম এই রুরাল আশ্রম টাইপ অ্যামবিয়েন্সটাকে ধরে রেখে। কোম্পানির রেসপনসিবিলিটির ফাঁকে ফাঁকে আপনি যেতুকু সময় পাবেন, নিজের ইচ্ছেমতো ওতে দুটো একটা প্রোগ্রাম চালিয়ে নেবেন। যতটুকু হয় আর কি। মানে রেগুলার কিছু হয়ত হবে না, তবে মাঝে মাঝে ওই গরিব ছাত্রদের বিনামূল্যের স্বাস্থ্যশিবির, ফিল্ম শো, কিছু বইখাতা বিলি, কিছু পড়াশোনার সেশান—যা আপনার ভালো বোধ হয়। আমাদের লোক আপনাকে সবরকম অ্যাসিস্ট্যান্স দিয়ে যাবে সেজন্য।

    “তবে, যেহেতু আপনাকে অন্যান্য দিকে কমপেনশেট করা হবে তাই কোম্পানি শুধু একটাই ফেভার চাইবে আপনার কাছে ওটা নিয়ে। আমাদের কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির খাতে একটা মোটা বরাদ্দ করতে হয়। তাতে ট্যাক্স বেনিফিট পাওয়া যায় অনেকটাই। ওই বরাদ্দটা আমরা আপনার এই ফিল্যানথ্রপিক ইনস্টিটিউশানটার খাতে দেখাবো। এর একটা পারসেন্টেজ আপনাকে পার্সোনালি দেয়া হবে আপনার ডিরেক্টরের রেমুনারেশানের মধ্যে অ্যাড করে। পরিমাণটা আমরা মিউচুয়ালি এগ্রি করে নেবো আলোচনার মাধ্যমে—”

    “এই যে শোভন, ফিরেছো তাহলে?”

    একজন বয়স্ক মানুষ এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন উঠোনে তাদের মিটিং-এর জায়গাটাতে। সেইদিকে ফিরে শোভন তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আরে সুখদাবাবু, আপনি নিজে এসেছেন? আসুন আসুন—”

    বিরামনগর গার্লসের স্কুল কমিটির বয়স্ক সেক্রেটারিটির দেখা গেল শোভনের প্রতি আচরণটায় একটা বড়ো বদল এসেছে। হেসে বললেন, “আরে তুমি হলে এখন বিখ্যাত লোক। কেজরিওয়ালের উত্তম প্রধানের বুজুম ফ্রেন্ড। আমরা তোমার বাড়িতে আসবো না তো কি তুমি আমাদের বাড়িতে যাবে নাকি হে?”

    বলতে বলতেই এগিয়ে এসে একটা ফাঁকা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, “শ্যামলবাবু, শোভনের সঙ্গে দেখা করাটা একটা কাজ তো বটেই, তাছাড়াও একটা খবর দিতে এসেছিলাম। পার্টি অফিসে একটা মিটিং ডাকা হয়েছে। অমরেশবাবু সেখানে শোভনকে আজকেই মিট করতে চান। মানে মেলার মাঠে বাঁশ পড়তে শুরু করেছে। আগামি সপ্তাহে এই সময় সেখানে হই হই কাণ্ড শুরু হয়ে যাবে। তার আগেই গোটা মেলাটা নিয়ে একটা প্রেজেন্টেশানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কী হবে না হবে তার একটা বিবরণ পেশ করা হবে। তাছাড়া শোভনের সঙ্গে অন্য একটা আলোচনাও সেরে নিতে চাইওছেন অমরেশবাবু, সম্ভবত ফিনানসিয়াল কথাবার্তা বা যে সেমিনারটা ওখানে শোভন করবে বলে শিডিউলড আছে তার বিষয়ে। আপনাকেও ডেকেছেন।”

    “শ্যামলবাবু তাড়াতাড়ি হাতের ফোল্ডারগুলো গুছোতে গুছোতে বললেন, “টাইম কখন দিয়েছেন?”

    “এই ধরুন দুপুর দুটো নাগাদ যদি হয়—অসুবিধে হবে? মানে অমরেশবাবু আবার সাড়ে চারটের মধ্যে কলকাতার দিকে বেরিয়ে যাবেন। মেলার ইনগারেশানে আর এডুকেশান বিলডিং-এর শিলান্যাসে এডুকেশান মিনিস্টারের আসাটা ফাইনালাইজ করতে আজ সন্ধে সাতটায় সময় চেয়ে রেখেছেন নাকি।”

    শ্যামলবাবু শোভনের দিকে চাইলেন একবার, তারপর তার জবাবের অপেক্ষা না করেই বলে দিলেন, “ফাইন, আমরা দুজনেই পৌঁছে যাবো মিটিং-এ।”

    “তাহলে আমি চলি?”

    “আসুন স্যার।”

    *****

    নিস্তব্ধ দুপুর ঝিমঝিম করছিল। আজ রবিবার। এই দিনটা এ ইশকুলে একসময় জমজমাট হয়ে থাকতো কত শিশুর হইচইতে। আজ সব চুপচাপ। কেউ কোত্থাও নেই। সুরভি এসে ফরিদার কাছে ঘুরঘুর করছিল বারবার, “মা আজ ইশকুল বসবে না?”

    ফরিদা মাথা নাড়লো, “না মা। সবে এলাম তো, ক’টা দিন যাক। ভাই একটু ঠিকঠাক হয়ে নিক, তারপর সব হবে দেখো—”

    শিশুটি সরলভাবে তার মায়ের কথা মেনে নিলেও, নিজের বলা কথাগুলোকে নিজেরই ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না ফরিদার। ভেতর থেকে গোটা ব্যাপারটাতে সায় আসছিল না তার কোনমতে। সকালবেলার মিটিংটার পর শোভন এ নিয়ে কী ভাবছে সে ব্যাপারে তার সঙ্গে একটা কথাও বলে নি। নিজে থেকে কিছু না বলায় ফরিদাও তার জানতে চাইবার ইচ্ছেটাকে একরকম জোর করেই আটকেছে। স্নান সেরে ভাতের থালা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে উঠে নিজের ল্যাপটপটা নিয়ে বসেছিলো। ফরিদা একবার উঁকি দিয়ে দেখেছে চ্যাট উইন্ডোতে কারো সঙ্গে কথা বলছে সে। তারপর একসময় পোশাক পালটে চুপচাপ বেরিয়ে গেছে, সম্ভবত মেলার মিটিং-এর জন্যে।

    নিঃশব্দ উঠোনে টুপটাপ করে পাতা ঝরে পড়ছিলো। জামিলা খাতুন নামে গাছটা আরো ঝাঁকড়া হয়ে উঠেছে। এই বছর ওতে প্রথম ফল ধরেছিলো। পাতা দেখা যায় না এমন জাম। ছেলেমেয়েগুলো তার ওপর হামলে পড়ে—

    গাছটা আজ রবিবারের দুপুরে একা দাঁড়িয়ে আছে।

    সুরভি কখন তার পাশে বসে পড়ে উরুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। ডানহাতের কাছে কবীরের বেতের দোলনা। হাসিখুশি শিশুটি তার মধ্যে জেগে জেগে আপনমনে হাত পা নেড়ে খেলা করে। সাবধানে সুরভিকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফরিদা উঠোনে নেমে এলো। গাছটার তলায় গিয়ে দাঁড়াতে টুপটাপ করে তার মাথায় পাকা পাতা ঝরে পড়লো একটা দুটো। কবীর হয়তো কোনদিন জানতেও পারবে না এইখানে একদিন কতো ছেলেমেয়ে--কে জানে—

    এইখানে আর একটুও ভালো লাগছে না ফরিদার। অথচ শোভনের সামনে একটা বিরাট কেরিয়ার অপরচুনিটি—উত্তমদা অনেক করল ওর জন্য। সোজাসাপটা লোক। নিজের স্বার্থটা দেখেছে—নিজের মতন করে শোভনেরও ভালো চেয়েছে। বন্ধুর কর্তব্য করেছে, অন্তত গোটা সমাজের চোখ তো তাই বলবে। তবু ফরিদার বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা কাঁটার খোঁচা লাগে। সকালবেলা উঠোনের কথাবার্তাগুলো তার কানে এসেছে অনেকটাই। শোভনের ইশকুলটা শুধু নামেই টিকে থাকবে এবারে—এক ব্যবসায়ী সংস্থার কর ফাঁকি দেবার উপকরণ হয়ে—কতটুকু সময় আর পাবে শোভন তাকে চালিয়ে নিতে? সমরেশ, সুবিমলদের চোখে সে একটা স্বচ্ছল জীবনের লোভ দেখেছে। তাকে দূরে ঠেলে—নিজের স্ত্রীসন্তানের নিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানিকে দূরে সরিয়ে—

    কী সিদ্ধান্ত নেবে শোভন? মাথাগরম মানুষ। যদি একলা সবার বিরুদ্ধে লড়াইতে নামতে চায়? ফরিদা নিজেই তো কিছুদিন আগে তাকে পালিয়ে যেতে নিষেধ করেছিলো! কিংবা--যদি সব মেনে নিয়েই এইখানে থেকে যায় উত্তমের মাইনে করা কাজের লোক হয়ে? তখন?

    একলা একলা সেইখানে দাঁড়িয়ে তার চোখে জল আসছিল। শোভনের সামনে কেবল এই দুটো পথই খোলা রয়েছে এখন। দুটোই মৃত্যুছাওয়া পথ। প্রথমটায় পা রাখলে প্রতিষ্ঠানের জগদ্দল চাকা তাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে যাবে। আর অন্যটায় পা দিলে তার আত্মাটা মরে যাবে। যে শরীরটা অবশিষ্ট থাকবে তখন, সেই ধ্বংসস্তূপটাকে তো সে ভালোবেসে বিয়ে করে নি!

    *******

    “না স্যারস্‌। আপনারা ইনিশিয়ালি যে প্ল্যানটা করেছিলেন ওসব গণসঙ্গীত, নাট্যসঙ্গীত, রাগা ইভনিং ফিভনিং এসব গাঁগঞ্জে চলবে না। এখানে লোকাল ফুড খাওয়াতে হবে, তবে হ্যাঁ নিউ বটল-এ। পুরো প্রোগ্রামটাকে আমি একদম ফোকসং বেসড করে রিডিজাইন করে দিয়েছি।”

    “তার মানে? আমাদের একটা প্রোগ্রাম আমরা পাবলিসাইজ করে দিলাম এতদিন ধরে, লোকজনের মধ্যে একটা এক্সপেকটেশান তৈরি হল, তারপর আপনি এসে ফের ওইসব গাঁইয়া রিফর‍্যাফ দিয়ে—পয়সা বাঁচাচ্ছেন নাকি?”

    তড়িৎ ঘোষ মানুষটি কলকাতা থেকে এসেছেন। নামকরা ইমপ্রেসারিও। বম্বের আর্টিস্টদের নিয়ে নিয়মিত প্রোগ্রাম করিয়ে থাকেন কলকাতা, শিলিগুড়ি এবং বাংলার অন্যান্য বর্ধিষ্ণু মফস্বল অঞ্চলে। শহর মফস্বলে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে গুণ্ডা, স্মাগলার, মাছের ভেড়ির লোকজনকে ম্যানেজ করে চলাটা তাঁর পেশার অঙ্গ। তিনি চোখ তুলে প্রশ্নকর্তা নেতাটির দিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে একটু ভুরু কুঁচকে বললেন, “আরে না না স্যার। আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? কাইন্ডলি একটু ধৈর্য ধরে শুনুন। তারপর পছন্দ না হলে বলবেন। প্রোগ্রাম অ্যারেঞ্জ করাটা আমার প্রফেশান স্যার।

    “ভবানন্দ বাউলের ছেলেটা এখন প্যারিসে থাকে। স্মার্ট চেহারা। ওখানে কোন ইউনিভার্সিটিতে বাউলতত্ত্ব নিয়ে পড়ায়টড়ায়। তাকে আনা হচ্ছে একটা ইভনিং-এ এক ঘন্টার জন্য। কন্ট্র্যাক্ট হয়ে গেছে। তাছাড়া—এই—এই লিস্টটা একবার দেখুন—ফোক সং-এর হুজ হু। টেলিভিশানে, রেকর্ডের দুনিয়ায় তাবড় তাবড় সব নাম। একেবারে ফাটিয়ে প্রোগ্রাম হবে দেখবেন। সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। দু রাত পুরো দেয়া হবে এঁদের। আর থার্ড নাইটটায় সবচেয়ে বড়ো চমক—এই যে দেখুন--”

    শোভন কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই পর্দায় প্রেজেন্টেশানের পরবর্তী স্লাইডটা ফুটে উঠেছে। সেখানে ভাসমান চলচ্চিত্র ও রেকর্ডের জগতের সুপরিচিত মুখগুলো দেখে গোটা মিটিং হলে একটা গুঞ্জন উঠল। তড়িৎ ঘোষ তখন ফের বলতে শুরু করেছেন—

    “--একটা অসম্ভবকে সম্ভব করেছি আমি। বলিউড থেকে অভিষেক ভট্টাচার্য, শ্যাম লাহিড়ি আর মিলন চক্রবর্তীকে আনা হচ্ছে। বিলিভ মি, অভিষেক বাউল গাইবেন। মিলন চক্রবর্তী বাউলের ড্রেস পরে একটা ডান্স আইটেম রাখবেন তার সঙ্গে। তাছাড়া টালিগঞ্জ থেকে একঝাঁক আর্টিস্ট, ইন্দ্র চাটুজ্জে, শ্রীমন্ত, লোপা মিত্রঘোষ—এই যে পুরো লিস্টটা—ঝুমুর, বাউল, আর ওই কী যেন বলে—হ্যাঁ, ট-টুসু—এই তিন ধরনের গান গাওয়ানো হবে এঁদের দিয়ে। ‘কাঁটা’ ব্যান্ডকে দিয়ে চারটে দেহতত্ত্বের গান করানো হবে। ভাবতে পারেন? তিনতিনবার গোল্ডেন ডিস্ক পেয়েছে ‘কাঁটা’র অ্যালবাম। তারা চারখানা আনকোরা ফোক গাইবে। এই স্টেজে প্রথমবার। সবচেয়ে ভালো খবরটা হলো, বাজেট একেবারে একসিড না করেই আমি পুরো ব্যাপারটা সাজিয়ে ফেলতে পেরেছি স্যারস্‌।”

    গোটা মিটিং ঘর থেকে উঠে আসা গুঞ্জনটা থেকে বোঝা যাচ্ছিল, নতুন অনুষ্ঠানসূচিটি সত্যিই চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে সকলের।

    “তাহলে শিডিউলটা ফাইনাল করে ফেলি?”

    “সে করুন। কিন্তু উঠতি লোকাল আর্টিস্টদের একটা উইন্ডো থাকবার কথা ছিলো ফার্স্ট নাইটে—”

    মিটিঙে বসা একজন প্রৌঢ় বলে উঠলেন। সম্ভবত বিরামনগরের গ্রাম পঞ্চায়েতের কেউ হবেন, শোভনের ঠিক মনে পড়ছিল না, “সে উইন্ডোটা থাকছে তো? আমার নাতনিটা তো কদ্দিন ধরে প্র্যাকটিশ করে করে মাথা ধরিয়ে দিলো বাড়িতে—”

    “শিওর স্যার। একদম ভাববেন না। আপনার নাতনি, মানে কথাকলি মিত্র তো? এমএক্স টিভির ‘গাও বাংলা’ শো টায় চান্স পেল গতবার, তাই না? আমরা ইমপ্রেসারিওরা সব খবর রাখি। রাইজিং স্টার। তার জন্য একটা টাইম ধরে রাখা আছে। তবে পনেরো মিনিটের বেশি স্লট হোলো না স্যার। ফার্স্ট ডেতে ইনগারেশানের ঠিক পরে শোভনবাবুর লেকচার রাখা হয়েছে একটা বাউলতত্ত্ব নিয়ে, মানে ওই যে সেমিনারটার কথা ছিলো, ওটা বদলে লেকচার করে দিয়েছি। নইলে বড্ডো সময় খেয়ে যায়। লোকের পছন্দও হয় না। তা, ওতে কতটা সময় আপনি নেবেন বলুন তো শোভনবাবু?”

    কিন্তু শোভন তার উত্তরে কিছু বলবার আগেই তিনি নিজেই তার সময়টি স্থির করে দিলেন, “মোটামুটি পনেরো মিনিট আপনাকে দিতে পারছি স্যার। তারপর লোকাল ট্যালেন্ট দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হবে, সেখানে কথাকলিকে সেট করে রেখেছি।”

    কথাকলি—মানে বুল্টি! শোভনের এইবার মনে পড়লো। ছোট্ট মেয়েটা। তার পরিবার তখনো রাজনীতিতে উঠে আসেনি এখনকার মত। বড় অভাবের সংসার ছিলো। চমৎকার গানের গলাটি। ভাবও ছিলো। শোভন ওকে কতদিন সঙ্গে করে নিয়ে বসে বাবার লেখা পদ তুলিয়েছে। তারপর একদিন সে ইশকুল ছেড়ে চলে গেল—সে-ও অনেক দিন হল। ওর দাদু তখন এলাকায় একজন হোমরাচোমরা হয়ে উঠেছেন। বিরামনগর স্কুল কমিটিতে মেম্বারশিপ পেয়েছেন। বুল্টিকে আর পেছন ফিরে দেখতে হয় নি। কেমন দেখতে হয়েছে—গানটাই বা কেমন গাইছে এখন কে জানে—শোভনের বড়ো দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল মেয়েটাকে একবার। নাকটা বড্ডো ছোটো ছিল বলে ওকে বুঁচি বলে ডাকলে ভারী রাগ করত----

    “--শোভনদা একটু উঠে আসবেন।”

    তার পেছনে এসে দাঁড়ানো একটি অচেনা তরুণ তার কাঁধে হাত দিয়ে ডাকছিলো। সে ঘুরে তাকাতে বলল, “অমরেশদা এবার বেরিয়ে যাবেন। পাশের রুমে আপনার জন্য ওয়েট করছেন। একটু কথা বলে নিন।”

    শোভন নীরবে উঠে দাঁড়ালো। এই মিটিঙে তার আর কোনোকিছুই বলবার নেই।

    *****

    “আরে আসুন আসুন শোভনবাবু,” অমরেশ একগাল হেসে অভ্যর্থনা জানালেন তাকে, “সব প্রবলেম ট্রবলেম তো মিটে গেল তাহলে? বন্ধুভাগ্য করেছিলেন বটে একখানা।”

    শোভন নীরবে অমরেশের মুখোমুখি একটা চেয়ারে এসে বসল। তার দিকে সিগারেটের একটা প্যাকেট খুলে বাড়িয়ে ধরলেন অমরেশ। শোভন মাথা নাড়তে ফের একদফা হেসে বললেন, “আরে নিন মশায়। ওতে দোষ নেই। মনে কিছু ধরে রাখবেন না। আমরা হলাম পলিটিকসের লোক। জনসেবা করে খাই। আমাদের কোন পার্মানেন্ট শত্রুটত্রু থাকতে নেই। তার ওপর এখানে একটা এতবড়ো বিজনেস উইন্ডো খুলতে চলেছে। আপনিই তার মাথায় থাকবেন। এখন থেকে হাত মিলিয়ে চলতে শুরু করলে দু তরফেরই লাভ।

    শোভন আর কথা বাড়াবার সুযোগ না দিয়ে সরাসরি কাজের কথায় এলো, “কী বলবেন বলুন। আপনার তো আবার যাবার সময় হোলো।”

    “মেলাটা কেমন সাজিয়েছি কিছু বললেন না? পছন্দ হয়েছে?”

    শোভন মাথা নাড়লো, “আজ্ঞে না। পছন্দ হয় নি। এটা কোনোমতেই আর আমার মেলা নয়।”

    “তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন। ব্র্যান্ডটাই শুধু আপনার। মেলাটার আগের বারের পপুলারিটিটাকে ইউজ করেছি বটে, তবে বাকি খোলনলচে সব বদলে দিতে হয়েছে। এলাকার পালস্‌টা বুঝে সেই অনুযায়ী—”

    “যা উচিত বুঝেছেন করেছেন অমরেশবাবু। কিন্তু আমাকে কেন?”

    অমরেশ একটু গম্ভীর হলেন। তারপর ফের মুখে হাসি টেনে এনে বললেন, “প্রথমে একটা কথা বলে রাখি। আপনার একটা কথা কিন্তু আমরা মেনে নিয়েছি। উত্তমবাবু একান্তভাবে অনুরোধ করেছিলেন আপনার সম্মান রেখে যাতে বিনা অনুমতিতে মেলাটার অর্গানাইজারের নাম মুরলীপুর লোকসংস্কৃতিমঞ্চ হিসেবে না দেখাই। তা তাঁর কথা আমি তো আর ফেলতে পারি না। কী করি কী করি ভাবছি তখন উনিই বুদ্ধিটা দিলেন। এই যে দেখুন—এই লিফলেটটা দেখলে বুঝবেন, এই যে লোকসংস্কৃতিমঞ্চ শব্দটার আগে একেবারে ফাইন লেটারিং-এ একটা ‘নব’ জুড়ে দিলাম। এমনিতে বিশেষ চোখে পড়বে না কারো, কিন্তু নামটা নতুন হয়ে গেল—মুরলীপুর নব লোকসংস্কৃতিমঞ্চ। লোকের মুখে মুখে অবশ্য ওই আদি নামটাই চলছে, তবে কোর্ট কাছারি হলে তখন ওই ‘নব’টা কাজে আসবে। আপনার সম্মানটাও রাখা হল, আবার পুরোনো নামটাকেও কাজে লাগিয়ে ফেলা গেল। কী, খুশি তো?”

    “আর কিছু বলবেন?”

    “হ্যাঁ অল্প একটু কথা বাকি রয়েছে। উত্তমবাবুর বন্ধু যখন, তখন তো আপনিও আমার পার্টির প্যাট্রনই হলেন একজন। গত বছর মেলা নিয়ে মিটিং-এর শুরুতেই আপনাকে যা বলেছিলাম, সে কথার খেলাপ তাই আমি করব না। সেমসাইড হয়ে যাবে।”

    “কী বলেছিলেন?”

    “ওই যে, মেলা থেকে যা প্রফিট হবে তার খানিকটা আপনার কাছেও যাবে! আসলে উত্তমবাবু এ ব্যাপারটাতে বিশেষ করে ইনসিস্ট করেছেন। কী চোখে যে দেখেন আপনাকে উনি, কী সাংঘাতিক ভালোবাসেন আপনাকে, তার কোন ধারণা করতে পারবেন না মশায়। টোট্যাল রেভেন্যুর টেন পারসেন্ট আপনি পাবেন। তবে ক্যাশে। কী? হবে তো?”

    শোভন কিছু বলল না। একটুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর অমরেশ ফের বললেন, “আমি কিন্তু কম কিছু বলিনি শোভনবাবু। কেজরিওয়াল তো আছেই, কিন্তু সে বাদেও স্পনসরশিপ যা জোগাড় হয়েছে, তাতে খরচখরচা সব সামলেও আপনার ওই পার্সেন্টেজে অ্যামাউন্টটা অন্তত লাখখানেক তো হবেই। বেশিও হতে পারে। ভেবে দেখুন, আপনার অর্গানাইজেশনের অরিজিন্যাল নামটাও ইউজ করছি না। শুধু আপনার নামটা ইউজ করবো, আপনাকে একটু প্রজেক্ট করতেও হবে—সেটাও কেজরিওয়ালের ডিম্যান্ডে। তবে আপনি খুব ইনসিস্ট করলে আর বড়োজো্র টু পারসেন্ট—মানে নেট রেভেন্যুর ওপরে কিন্তু—একটু ভেবে জানাবেন মশায়। আমি এখন উঠি—”

    “আমার একটা অনুরোধ ছিল অমরেশবাবু।”

    অমরেশ উঠতে উঠতে ফের একবার চেয়ারে বসে পড়লেন। হাসি হাসি মুখে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন—বলুন—”

    আপনার মেলায় আমার ওই লেকচার টেকচার না হয় নাই রাখলেন। ওটা আপনি বাদ দিন।”

    “সেকী মশায়? স্বয়ং এডুকেশান মিনিস্টার থাকবেন মঞ্চে সেদিন। আরো অনেক গণ্যমান্য লোকজন থাকবেন। তাঁদের সামনে নিজের জ্ঞানটাকে জাহির করে দেখাবার একটা এতোবড়ো চান্স, মিডিয়াতেও খানিক দেখাবে হয়তো দেখবেন। এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে?”

    শোভন মাথা নাড়ল, “আমি ছাড়ছি। ওতে আমার কোন প্রয়োজন নেই অমরেশবাবু। আপনাদের সময় কম। ও স্লটটা আপনি বরং আর কাউকে দিয়ে দেবেন।”

    অমরেশ একটু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। তারপর মৃদু হেসে বললেন, “ভালো কথা। ওসব তত্ত্ব ফত্ত্ব নিয়ে মেলায় আর কে মাথা ঘামায় বলুন। নেহাত আপনি উত্তমবাবুর কাছের লোক, তাই একটা প্রেস্টিজিয়াস স্লটে আপনাকে ফিট করে দিচ্ছিলাম। তা আপনি যদি না চান—”

    “আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি ওটা চাইছি না একেবারেই।”

    চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অমরেশ বললেন, “বেশ। আমি ওদের বলে দিচ্ছি অলটারনেটিভ একটা ব্যবস্থা করে নিতে। চলি।”

    ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে কী মনে হতে তিনি ফের ফিরে এসে বললেন, “একটা ফাইনাল রিকোয়েস্ট—এই রেট টেটের ব্যাপারে যদি কোন ডিসকাশানের দরকার হয় নিঃসংকোচে আমাকে ফোন করবেন। মিউচুয়ালি সেটল করে নেবো। উত্তমবাবুকে এর মধ্যে জড়াবেন না। হাজার হলেও একটা বড়ো প্রতিষ্ঠানের অফিসার—বাইরের লোক—মানে বুঝতেই তো পারছেন, ঘরের ডিবেটবিতর্ক বাইরে টেনে নিয়ে গিয়ে শেষে—”

    পার্টি অফিসের চৌহদ্দি ছেড়ে বাইরে বের হল যখন শোভন তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। অফিসের সামনেই মেলার একটা বিরাট সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। সেটার দিকে একঝলক দেখে নিয়ে সাইকেলের পাদানিতে পা রেখেছে সবে এমন সময় অন্ধকার থেকে সমরেশ আর সুবিমল বের হয়ে এলো।

    “কী কথাবার্তা হলো শোভনদা?”

    শোভন তাদের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইল, “আন্দাজ করতে পারছিস না?”

    সমরেশ চোখটা সরিয়ে নিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “পারছি শোভনদা। উত্তমবাবুই যোগাযোগগুলো সমস্ত করিয়ে দিয়েছেন। পরিকাঠামোর জন্য কলকাতা থেকে ‘জৈন ইভেন্টস’ কে ভাড়া করা হয়েছে আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের গোটা পরিকল্পনাটা বানিয়েছেন ওই ইমপ্রেসারিও ভদ্রলোক। আমাদের ইনভলভ করা হয় নি।”

    “আমি কল্পনাও করতে পারিনি—তোরা এখানে থাকতে--”

    হঠাৎ সুবিমল এগিয়ে এসে শোভনের হাতদুটো চেপে ধরল, “প্লিজ শোভনদা, তুমি অমত কোরো না। এলাকার প্রচুর ছেলে জড়িয়ে গেছে এতে। হাতে টাকা আসছে কিছু। মেলাটার চরিত্র একটু বদলে গেছে আপনার টার্গেট থেকে সেটা মানছি, কিন্তু তবু গানটা তো হবে! সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়াটাতো আটকাতে পেরেছি আমরা।”

    শোভন অবাক হয়ে তার এই প্রাক্তন ছাত্রটির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “কোন গান সুবিমল? যা হতে চলেছে এখানে সেটা—”

    সুবিমল নামে তরুণটি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, “সময়টা বদলে গেছে শোভনদা। এখন বেঁচে থাকাটাই আমাদের কাছে একটা প্রধান লড়াই। আগে বাঁচলে তবে তো গান? আমরা এতগুলো ছেলে আজ মুরলিপুরে থেকে ঘরের খেয়ে কিছু কাজকর্ম, রোজগারের সুযোগ পাচ্ছি সেটা কি তোমার গানের বিশুদ্ধতার চেয়ে বড়ো হয়ে গেল?”

    শোভন একটু বিস্মিত গলায় বলল, “তোদের রোজগারের সঙ্গে—মেলাটার কী সম্পর্ক?”

    “বলছি। মেলাটা অর্গানাইজ করবার জন্য কলকাতার জৈন ইভেন্টস-কে কন্ট্র্যাক্ট দেয়া হয়েছে তা তো কাগজপত্রে দেখেছো। সেটা হবার পর উত্তমদা আমাদের বলে, “তাহলে তোমরাই বা কেন ওর থেকে কিছু লাভ করবে না?” তারপর অমরেশদার সঙ্গে কথাবার্তা বলে মেলার প্যান্ডেল, সাউন্ড, লাইটিং, কেটারিং এই সব কাজকর্মের মেটেরিয়াল সাপ্লাই করবার জন্য আমাদের একটা সিন্ডিকেট মতন তৈরি করে দিয়েছেন উনি। আমরা এই হেমলতার ক’জন আছি, আর অমরেশদার তরফ থেকে পার্টির কয়েকটা ছেলে আছে। ওরা যা মাল চায়, এনে দি, টেন পারসেন্ট মত লাভ রেখে দাম নিয়ে নি। নগদের কাজ। মাল ফেললেই পয়সা। বাড়িতে আটটা মুখ আমার শোভনদা। আমাদের কারই বা ঘরের অবস্থা ভালো বলো?”

    একটা আশ্চর্য অসহায়তা এসে ঘিরে ধরছিল শোভনকে। অমরেশ বাগচি চিরকাল তাকে সরাসরি আঘাত করেছে। সে আঘাত জন্তুর আক্রমণের মতো—নিষ্ঠুর, প্রকট ও সরল। কিন্তু—এইভাবে তার ডানা কেটে, তার হাত পাগুলোকে তার অধিকার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া অমরেশ বাগচির মতো মোটা দাগের মানুষের বুদ্ধির নাগালের মধ্যে ছিলো না—

    তার এই নৈঃশব্দকে ভালোভাবে নিচ্ছিল না তার প্রাক্তন ছাত্র ও সহকর্মী ছেলেগুলো। খানিক চুপ করে থেকে এইবার সমরেশ মুখ খুলল, “তোমায় খোলাখুলিই বলি শোভনদা। স্কুলের আমরা সবাই, মানে সুবিমল, অনুপম, সুবীর, আনসার, সুনির্মল, আমি, অতনু, সুব্রত, আশুতোষ, বিনয়—আমরা সবাই মিলেই ব্যাপারটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলেছি। একটা ব্যাপারে সবাই ভয় পাচ্ছে—তুমি অমরেশ বাগচির সঙ্গে ফের মেলা নিয়ে হাঙ্গামা বাধালে তোমার লোক হিসেবে কোপটা আমাদের এই ক’জনের ওপরেও এসে পড়বে। আগেও তাই হয়েছে। তোমায় অ্যারেস্ট করাবার পর সবচেয়ে বেশি হ্যারাসড হয়েছি আমরা। রাত নেই বেরাত নেই বাড়ি গিয়ে গিয়ে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়েছে। আনসার তো মারও খেয়েছে একবার।

    “এখন সেসব মিটেছে। তবে ডাইরেক্ট পার্টির ক্যাডার তো আর নই, তাই অমরেশদা উত্তমবাবুর চাপে আমাদের মেলার সাপ্লাইয়ের কাজটায় রেখেছে বটে, কিন্তু আমাদের তাড়াতে পারলে পার্টির আরো কটা ছেলেকে সেখানে ঢোকাতে পারে। আর এখানে একবার গোল বাধলে, এডুকেশান প্রজেক্টটা থেকে যে একটা পার্মানেন্ট মান্থলি রোজগারের বন্দোবস্ত হচ্ছে আমাদের সেটাও থাকবে বলে মনে হয় না। না শোভনদা, এটা তুমি করতে পারো না। তোমার আইডিয়ালকে আমরা সবাই সম্মান করি, কিন্তু আমাদের খেয়েপরে সুস্থির হয়ে বাঁচতে তো হবে! তোমাকে আমরা সবাই মিলে একটা রিকোয়েস্ট করব, এ নিয়ে তুমি আর জলঘোলা কোরো না শোভনদা। আমাদের একটু ভালোভাবে থাকতে দাও।”

    “ভালো থাকবি? উত্তম আর অমরেশের ভিক্ষে নিয়ে—” বলতে বলতেই হঠাৎ নিজেকে সামলে নিল শোভন। দু জোড়া চোখ বড় আতংকে তার দিকে চেয়ে আছে। একটু সুখের স্বাদ পেয়েছে ওরা। পাক না! দোষ কি?”

    জিভের আগায় উঠে আসা কথাটাকে ফের গিলে নিয়ে সে বলল, “ঠিক আছে। তোদের ভালো থাকায় আমি আপত্তি করবার কে? কোনোদিন তো হাতে করে টাকাপয়সা, সুযোগসুবিধে কিছু কিছু দিতে পারলাম না।”

    “শোভনদা, ও কথা বোলো না। তুমি আমাদের কতোটা কাছের, কত গর্বের—”

    চেপে ধরা হাতটার বাঁধন সযত্নে ছাড়িয়ে নিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল শোভন। কোথায় একটা বড়ো ভুল হয়ে গেছে। মাটির দোষ? নাকি তার বোঝবার কোন ত্রুটি? তার আদর্শের কোন সিরিয়াস ফ্ল--? কে জানে?”

    পার্টি অফিসের চৌহদ্দি ছাড়াবার পর খানিকদূর যেতে ফরিদার ফোন এল। ওপাশে তার গলাটা উদ্বিগ্ন শোনাচ্ছিল।

    “মিটিঙ শেষ হল?”

    সাইকেল থামিয়ে ফোনটা ধরল শোভন, “হ্যাঁ ফরিদা।”

    “কী হল?”

    কিছুক্ষণ তার উত্তর না পেয়ে ফের ফরিদা কথা বলল যখন, তার গলায় তখন উত্তেজনার স্পর্শ ছিল, “আজ দুপুর থেকে তুমি আমাকে ক্রমাগত এড়িয়ে যাচ্ছো। সকালবেলার কথাবার্তার পরও আমাকে এসে কিছু বললে না। কেন? কী হল এখন মিটিঙে তা আমাকে তোমায় বলতে হবে শোভন। আমার জানবার রাইট আছে।”

    শোভন ক্লান্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ ফরিদা। তোমাকে ছাড়া আর কাকে বলবো বলো? রাতে বাড়ি ফিরে সব কথাই বলবো তোমায়। তবে এখন কিছুটা সময় আমাকে দাও প্লিজ। আমি একবার একটু ভুবনদার ওখানে যাবো। তুমি খেয়ে নিও। আমার ফিরতে রাত হবে।”

    উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো ফরিদা।

    *****

    “বারতিনেক রিং হয়ে যাবার পর উত্তম ফোনটা ধরতে কোনো ভুমিকা না করেই শোভন প্রশ্ন করলো, “এটা তুই কেন করলি উত্তম? কেন?”

    একটুক্ষণ থেমে থেকে উত্তম বলল, “আমি পরশু ফিরে আসছি। তখন সামনাসামনি কথা বলব তোর সঙ্গে। এখন—”

    “না। এখনই তোকে আমার এ প্রশ্নটার একটা জবাব দিতে হবে। কেন তুই আমার এ সর্বনাশটা—”

    হঠাৎ উত্তমের গলার স্বরে একটা অচেনা কাঠিন্য ভর করল এসে, “কোন সর্বনাশটা কেন করলাম বলে জবাবদিহি চাইছিস রে? লোককে গিয়ে জিজ্ঞেস করে দ্যাখ একবার। তোকে বাঁচালাম, তোর পরিবারকে নিরাপত্তা দিলাম, তোদের এলাকার শেয়ালকুকুরগুলোকে বশ করে বউবাচ্চা নিয়ে একটা সসম্মান জীবনের বন্দোবস্ত করে দিলাম। তোর নিজের লোকজনদের গিয়ে জিজ্ঞাসা করে দ্যাখ না একবার, কী বলে সবাই?”

    একটুক্ষণ চুপ করে থেকে শোভন ধীরে ধীরে বলল, “দ্যাখ উত্তম, আমাকে বাঁচাবার জন্যে তুই যা করেছিস তার জন্য আমি তোর কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার মূল্য হিসেবে, আমার গোটা মিশনটাকে তুই এভাবে আমার থেকে কেড়ে নিতে পারলি?”

    “মিশন? একটা আইডিয়ালিস্টিক মূর্খামি, একটা অ্যাডোলেসেন্ট ড্রিম--তাকে তুই মিশন বলছিস? ক’টা মানুষকে সুখ দিতে পেরেছিস শোভন তুই তোর ওই ‘মিশন’ দিয়ে? তোর ওই ম্যানিয়ার জন্য সমাদৃতা তোকে ছাড়লো। কিন্তু তারপরও তোর ওই ইললজিক্যাল আদর্শের নেশা ওর যায় নি। চিরটাকাল আমার পাশে শুয়ে মনে মনে তোকে পুজো করে গেছে ও। তোর আদর্শকে পুজো করে গেছে। আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছিস? ওই জন্যেই ও আমায় ছেড়ে নিজের সর্বনাশ করেছে, আমারও জীবনটাকেও শেষ করে দিয়েছে।”

    “উত্তম, তুই আমায়, তুই আমায় তোর ঘর ভাঙার জন্য রেস্পনসিবল করছিস? তুই—”

    “হ্যাঁ করছি। আমি তো সমাদৃতাকে বিয়ে করবার স্বপ্ন দেখা ছেড়েই দিয়েছিলাম! তোকে ও ভালোবাসে সেটা বুঝেই তো সরে গিয়েছিলাম একধারে। আজ তোদের দুজনের যদি বিয়ে হত, আমি হয়ত মেদিনীপুরের কোন গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করে সুখে সংসারটা করতে পারতাম। কিন্তু বাদ সেধেছে তোর মিশন, তোর আদর্শ! তোর—”

    হঠাৎ দীর্ঘদিন ধরে বুকের ভেতর জমতে থাকা তিক্ত কথাগুলো শোভনের মুখ দিয়ে বের হয়ে এলো, “কী বলতে চাইছিস উত্তম? আয়নায় নিজের মুখটা দেখেছিস কখনো? কতটা নিচে নেমে গিয়েছিস তুই, সেটা তোর নিজের জানা নেই? সেটা কী আমার আদর্শের জন্য না তোর নিজের লোভের জন্য? আমার আদর্শের জন্য তুই নীতিভ্রষ্ট হয়েছিস? আমার আদর্শের জন্য সমাদৃতা তোকে ছেড়ে গেছে?”

    “হ্যাঁ শোভন। ঠিক তাই। তোর ওই ভিখিরি আদর্শের জন্য আজ আমি এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। সেই কোথাকার যেন গানের আসরে গিয়ে তোদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার কিছুদিন পর ডাবলু বি সি এস-এ বসলাম। পেয়েও গেলাম দুজনেই। প্রবেশনে একসাথে পোস্টিং পেলাম মুর্শিদাবাদে। ট্রেনিং শেষ হবার পর ব্লক পোস্টিং পাবার সময় হঠাৎ করেই একদিন সাহস করে গিয়ে বলে ফেলেছিলাম, একসঙ্গে জীবনটা কাটালে কেমন হয়? রাজি হয়ে গেল। তাতে ওর চেয়ে অনেক বেশি কৃতিত্ব ছিল ওর বাবা মায়ের। সুখেই থাকতাম হয়ত। কিন্তু তার পর থেকেই পদে পদে তোর আদর্শটাকে আমার ওপরে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা শুরু করেছিল ও। আমাকে নয় শোভন, আমার মধ্যে দিয়ে তোকে আরো একবার পেতে চেয়েছিল সমাদৃতা। ভাবতে পারিস, একটা লোকের কাছে সেটা কতোটা অপমানের হতে পারে? জীবনে কোনোদিন অসৎ কিছু করবো বলে আমি ভাবিনি। শুধু ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে তোর উলটো রাস্তায় চলতে চেয়েছি বারবার। সেইসঙ্গে এ-ও ভেবেছি—মেয়েমানুষ, টাকা দিয়ে শক্তি দেখিয়ে ঠিক বশে আনব আজ না হয় কাল। একদিন না একদিন আমাকে এসে বলবে, তুমিই ঠিক। শোভন আমাকে এ সুখের জীবন কখনো দিতে পারতো না। সেই করতে করতে কখন যে মুখোশটাই মুখ হয়ে চেপে বসেছে আমার কাঁধে সেটা যখন বুঝতে পারলাম তখন আর ফেরার সাধ বা সাধ্য কোনোটাই আমার বাকি নেই।

    “দুটো জীবনের সর্বনাশ করল তোর মিশন। জানিস, যেদিন ওর কাছ থেকে ডিভোর্স স্যুট ফাইল করবার নোটিসটা পেলাম তাতে দেখলাম লেখা আছে একজন দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে সে আর জীবনটা কাটাতে চায় না, সেখানে আমি ফের একবার পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিলাম, যে আদর্শের মাপকাঠিটা দিয়ে ও আমার দুর্নীতি মাপছে সেটা তোর তৈরি। আমি তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম, তোর এই সর্বনাশা মিশন আমি ভেঙেচূরে দিয়ে তবে ছাড়ব। আমি সেটা করে দেখালাম। পারলি তুই আটকাতে?”

    শোভন এ অভিযোগের উত্তরে কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। খানিক চুপ করে থেকে সে দুর্বলভাবে শুধু বলল, “একটা পার্সোনাল গ্রাজ থেকে তুই এত মানুষের উপকারে আসা একটা প্রোজেক্টকে ভেঙে দিতে পারলি? তুই—”

    “উপকারে আসা? বাজে কথা বলিস না শোভন। তোর ওই মহামূল্যবান মিশন দিয়ে মুরলিপুরের কোন উদ্ধারটা করেছিস তুই বল তো? এতগুলো বছর এই গ্রামে মুখ গুঁজে পড়ে থেকে বানিয়েছিস তো কটা রিকশাওলা, তরকারিওলা আর দশ টাকা বাড়িয়ে ধরে ডাক দিলে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়া কিছু পড়াশোনা জানা ডিসগাইজড বেকার। এই সমরেশ সুবিমল টাইপের ছেলেগুলোকে পড়াশোনাটা শিখিয়ে তারপর খেয়েপরে একটু সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকবার মতো কিছু দিতে পেরেছিলি তুই? আমি পেরেছি। আদর্শের যে একটা ফাসাড তুই বানিয়ে বসেছিলি, একটু খেতে পরতে পাবার নিশ্চয়তা পেয়ে তাই ওর থেকে সব ছুটে এসে আমার কাছে এসে ঢুকেছে।”

    “সেই দশ টাকাটা ওদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তার বদলে যে বিরাট লাভের টাকাটা তুই এখান থেকে তুলবি—”

    “চুপ কর। ওই এক চিরকেলে ন্যাকামি নিয়েই তোরা আইডিয়ালিস্ট বাঙালিরা মরলি। লাভ একটা ট্যাবু ওয়ার্ড, না রে? আমি লাভ করবো, বেশ করবো। ক্ষমতা আছে, করেছি। কিন্তু স্বার্থপরের মত নিজের মিশন মিশন করে একগাদা লোককে নিজের সঙ্গে সঙ্গে ভিখিরির মতো জীবন কাটাতে বাধ্য আমি করি নি। যে মেয়েটা তোকে ভালোবেসে তোর সঙ্গে ঘর বাঁধল, তোকে বাঁচিয়ে দিল, তাকে আর তার ছেলেটাকে তুই কী দিতি শোভন? দুপুরের খাবার পরে রাতের চাল কোনো ছাত্রের বাপ এসে না দিয়ে গেলে উপোস, এই তো? আমার মুখ খোলাস না। আমি সব জানি। ওখানে তোর ইশকুলের সবকটা ছেলের রোজগারের ব্যবস্থা করে দিয়ে —ইনক্লুডিং ইউ—মাইন্ড ইট--তবে নিজের লাভের মডেল ইমপ্লিমেন্ট করেছি আমি।”

    “নিজের বিজনেস ইন্টারেস্টটাকে জাস্টিফাই করতে চাইছিস উত্তম? আমার আর আমার বউবাচ্চার উপকার করতে আমি তোকে ডেকেছিলাম? গিয়ে বলেছিলাম কখনো ‘আমায় বাঁচা?’ কে তোকে বলেছিল আমার মঙ্গল চাইতে?”

    “ওটাই তো সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। কেমন ভালো করলাম তোর তাই একবার বল! এইবারে তোকে ওর মধ্যে থাকতে হবে। বাকি সারাটা জীবন তুই ওতে আটকে থাকবি রে। বেরোবার চেষ্টা করে দেখ, তোর বন্ধুবান্ধব, তোর বউবাচ্চা কেউ তোকে ছাড়বে না। আমার সংসার ভেঙেছিস তুই তোর আদর্শ দিয়ে। এইবার আমি তোকে ভাঙবো, আমার মতো করে বানাবো, আর তারপর কিছুদিন বাদে যখন লাইনে আসবি, তখন ওই মহিলার কাছে তোর প্রোফাইলটা পাঠিয়ে দিয়ে বলব, এই যে তোমার পুজোর ঠাকুর। ওর খড় বের করতে উত্তম প্রধানের বেশি কসরৎ করতে হয়নি।”

    “স্টপ ইট, মাইন্ড ইয়োর হেলথ উড ইউ—” ফোনের ওধার থেকে ভেসে আসা নারীকন্ঠের শব্দটা বোধ হয় উত্তমকে একটু সচেতন করে দিল। অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায় সে কাউকে বলল, “তুমি একটু ওধারে যাও, আমি এর সঙ্গে কথাটা শেষ করে নিই—”

    “শোন শোভন। যা করেছি আমি সেটা মেনে নে। ঝামেলা করিস না। মেনে না নিয়ে তোর কোন রাস্তা নেই--”

    শোভন অন্ধকারে মাথা ঝাঁকালো একবার। চোখের কোণদুটো জ্বালা করে উঠছে তার, “না উত্তম। সে হয় না রে। আমায় তুই ছেড়ে দে। আমি এখান থেকে—”

    মৃদু হাসির শব্দ ভেসে এলো ওপাশ থেকে, “সে কী রে? লড়বি না? এত সহজে হাঁটু ভেঙে ভিক্ষে চাইতে বসবি? তোর অলমাইটি আদর্শ কোথায় গেলো?”

    “না রে। এত সহজেই হাল ছাড়ছি আমি। সমাদৃতার ব্যাপারে আমার ওপরে তোর ক্ষোভটা আমি ধরছি না। ওতে আমার ব্যক্তিগতভাবে কোন হাত যে ছিল না সে তুই ঠিকই জানিস। ওকে তুই ঘনিষ্টভাবে দেখেছিস অনেকদিন। চরিত্রের দোষ যে ওর হবে না সে তোর চেয়ে ভালো আর কেউ জানবে না।

    “আমি হালটা ছাড়ছি অন্য কারণে। যে ছেলেগুলোকে নিজেহাতে মানুষ করেছি এতদিন, তাদের দিয়েই আমার কাজটা চালাবো ভেবে আনন্দে ছিলাম। তুই কত সহজে ছেলেগুলোকে কিনে নিলি। পচে গেছে উত্তম। একটু ভালো খাওয়াপরা, একটু ভালো করে বেঁচে থাকবার লোভে পচে গেছে সবগুলো। এ মাটিতে আর কিছু হবার নয়। তুই একটা ভিরুলেন্ট ইনফেকশানের মতো—”

    “নো। পালাতে তোকে আমি দেবো না শোভন। দা ডাই ইজ কাস্ট। আমি তোকে ছাড়বো না। এবারে আমি কী করবো তাও তোকে বলে দিচ্ছি। তোর ফরিদাকে ফোন করব। একটাও মিথ্যে কথা বলব না। শুধু আমার প্ল্যানটায় ওর আর ওর ছেলেমেয়েদের কী কী লাভ হবে সেইটা বোঝাবো। তারপর তুই গিয়ে পারলে ওকে কনভিন্স কর। দ্যাখ তোর সঙ্গে ভিখিরির আদর্শ নিয়ে বাঁচতে কতোটা রাজি হয়? দ্যাখ তুই আমার প্রোপোজালটা ডিনাই করবি বললে তোকে কী করে।”

    “উত্তম প্লিজ। ফরিদাকে তুই এ নিয়ে কিছু বলতে পারবি না। আমি নিজে--”

    খুট করে একটা শব্দ হয়ে লাইনটা কেটে গেল। তাড়াতাড়ি ফরিদার লাইনটাতে একবার ডায়াল করে দেখল শোভন। এনগেজড। হঠাৎ একটা হিমশীতল অনুভূতি ছড়িয়ে গেল তার মেরুদণ্ড দিয়ে। উত্তম তাকে শেষই করতে এসেছে। বড়ো গাছ কাটতে গেলে প্রথমে তার ডালপালা ছাঁটতে হয়। সেইভাবে প্রথমে সে তার কাজের সঙ্গীদের সরিয়ে নিয়েছে। এইবারে হাত বাড়িয়েছে ফরিদার দিকে। অসহায়ভাবে সে ফের একবার ফরিদার লাইনটা মেলালো। সেটা তখনো এনগেজড। হঠাৎ মাথার মধ্যে যেন একটা বিস্ফোরণ হল শোভনের। হাতের ফোনটার সুইচ অফ করে দিয়ে সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল সে পাশের অন্ধকার ঝোপের ভেতর। যাক গে। সবাই চলে যাক তাকে ত্যাগ করে। অসম্ভব যুক্তি দিয়ে সাজিয়ে কথা বলতে পারে উত্তম। ফরিদা যদি ওর কথা শুনে ওর যুক্তিটাকে মেনে নেয়—যদি—যাক গে—

    এক আশ্চর্য ঔদাসিন্যের মোড়কে নিজেকে আবৃত করে পরাজিত যুবকটি সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে।

    বিরামনগর গ্রাম ছাড়িয়ে চুর্নির পাশ ধরে ধরে ভুবনের আখড়াতে এসে যখন পৌঁছালো সে তখন রাত প্রায় ন’টা। ভুবন ছিল না। হা হা করতে থাকা খালি ঘরটায় বেশ কিছুদিন মানুষের বসবাস নেই। তার খোলা দরজায় মাকড়শারা জাল বুনেছে। ভেতরের স্যাঁৎসেঁতে হাওয়ায় মানুষের বসবাসের উষ্ণতা ছিলো না।

    ভুবনদা কোথায় থাকছে আজকাল কে জানে? হয়তো এ অঞ্চল ছেড়ে চলে গিয়ে অন্য কোথাও ডেরা নিয়েছে। আদালতের সামনে সেদিন বলছিল বটে, --অনেক দূর থিকে আসছি—কথাটায় শোভন তখন ঠিকমতো গুরুত্ব দেয় নি। এই সুরহীন বিষাক্ত মাটিতে তারও মন টিকছিল না তাহলে আর—সুর বিনা তার জীবনের অর্থ নেই কোন। সেই সুরের সন্ধানে অন্য কোনখানে--

    বড়ো আশা করে ভুবনের কাছে এসেছিলো শোভন। জীবন আজ তাকে বিরাট একটা প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সে চিহ্নের একদিকে তার সমস্ত আদর্শ, তার মিশন, আর অন্যদিকে, সেইসব বিসর্জন দিয়ে তার প্রিয় নারী ও দুটি শিশুর জন্য একখণ্ড নিশ্চিন্ত জীবন। প্রথমটাকে আঁকড়ে থাকতে চাইলে পরিবর্তনের রথের চাকাটা তার বুকের ওপর দিয়ে চলে যাবে। ফরিদা আর তার সন্তানরাও রক্ষা পাবে না। আর দ্বিতীয়টার জন্য নিয়তি তার আত্মাকে দাবি করেছে মূল্য হিসেবে। কোন পথটা সে বেছে নেবে? ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরবার মতই ভুবন বৈরাগির আখড়ায় ছুটে এসেছিলো সে আজ। যদি কোন উত্তর মেলে তার কাছে। কিন্তু, সেই ভুবনও অবশেষে তাকে ছেড়ে--

    অন্ধকারের আব্রুর আড়ালে পৌরুষের সমস্ত অহংকারকে সরিয়ে রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল মানুষটি। দাওয়ার শুকনো মাটিতে তার উষ্ণ অশ্রু ঝরে পড়ছিল।

    হঠাৎ চুর্নি থেকে বয়ে আসা একঝলক হাওয়া এসে তার গায়ে শীতল আঙুল বুলিয়ে দিয়ে গেল। খোলা দরজাদুটি দুলে উঠে মৃদু ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করছে। সেই দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সারা শরীরে রোমাঞ্চ খেলে গেল তার। এতো সহজ কথাটা কেন তার আগে মাথায় আসে নি? ওই হা হা করতে থাকা খালি ঘরটা তো তার প্রশ্নের জবাব হয়েই দাঁড়িয়ে আছে এতক্ষণ তার চোখের সামনে---অন্য কোনখানে যেতে হবে— তার নিজে হাতে তৈরি প্রতিষ্ঠানটির সমস্ত অধিকার অবহেলায় ত্যাগ করে--আদিম কৃষিজীবি মানুষ যেমন বন্ধ্যা হয়ে যাওয়া জমির অধিকার অক্লেশে ছেড়ে দিয়ে পাড়ি দিত ক্রমাগত উর্বরতর অন্য কোনো ভূমির সন্ধানে—তাতে তার কৃষিকর্ম ব্যহত হত না—অস্তিত্ত্ব সমৃদ্ধতর হত—

    অন্ধকার পথ ধরে সাইকেলটি এগিয়ে যায় মুরলীপুর গ্রামের দিকে। রাত হয়েছে। ফসল ওঠবার পর এই হেমন্ত ও শীতঋতুটি কৃষকের আনন্দের সময়। হাজার অনটন ও দুঃখেও সে আনন্দের শিকড় কাটে না কখনো। দূরে কোথাও কীর্তনের আসর বসেছে। রাতের নিস্তব্ধ বাতাস তার সুরের রেশ বয়ে নিয়ে আসছিল। অনিয়ন্ত্রিত প্রতিবর্তক্রিয়াতেই যেন বা, সমস্ত উথালপাথাল থেকে সরে এসে মনটা সেদিকে ঘুরে গেল শোভনের। চেনা গলা নয়। তরুণ এবং সতেজ শব্দ, সুললিত উচ্চারণে গীতগোবিন্দ গাইছে—

    ললিতলবঙ্গলতাপরিশীলনা কোমল মলয় সমীরে মধুকরনিকরকরম্বিত কোকিলকূজিতকুঞ্জকুটিরে বিহরতি হরিরিহ সরস বসন্তে নৃত্যতি যুবতিজনেনসমম্‌ সখী বিরহীজনস্য দুরন্তে
    হঠাৎ বহু পুরোনো একটা কথা মাথার মধ্যে ফিরে এল শোভনের—সদ্য বিশ্বযুদ্ধ পেরোন জার্মানির দার্শনিক আদের্নের কথা—“টু রাইট পোয়েট্রি আফটার অসউইৎজ ইজ বার্বেরিক।”

    বাংলার ইতিহাসে মানবতার এক চূড়ান্ত অবমাননার যুগ ছিল সেটা। অথচ ওই সেনদের আমলের কীটদষ্ট, পতিত, অবক্ষয়ী এক সমাজের বুকে বসে এই অর্থহীন সুন্দরের ফুল ফুটিয়ে তাহলে অন্যায় করেছিলেন দরিদ্র কবি জয়দেব? বর্বরতা? নাকি প্রতিবাদ? সুন্দর দিয়ে অসুন্দরের বিরুদ্ধে লড়াই? কালের পরীক্ষায় তো তাঁর এই প্রতিবাদ সসম্মানে পাশ করে গেল? নইলে আজও সে গান কেন মানুষের গলায় জীবন্ত হয়ে থাকে? তাহলে শত অভাব আর দারিদ্রের মধ্যেও কেন জীবন্ত থাকতে পারবে না তার এতদিনের সুন্দর স্বপ্নটা? কেন? একজায়গায় মাটি দূষিত হয়ে গেলে কেন আর এক আয়গায় তার অংকুরোদগম অসম্ভব হবে?

    কোন এক অজ্ঞেয় পথে যুগান্তের অন্যপাড় থেকে ভেসে আসা সেই রূপোপাসনার সুর তাকে নতুন করে পথের সন্ধান দিচ্ছিল। কিন্তু—ফরিদা— --না না, ফরিদা বুঝবে। নিশ্চয় বুঝবে। তার নিজের হাতে তৈরি মেয়ে। জীবনের শুরুতেই অতিবড়ো লোভের হাতছানি প্রত্যাখ্যান করেই তো সে তার কাছে এসেছিলো?

    তবু, বিরাট একটা প্রশ্নচিহ্ন তার সামনে পাহাড়ের মত অটল হয়ে এসে দাঁড়ায় বারবার—যদি সে না বোঝে? যদি বলে, এখন তুমি একা নও, আমাদের ওপর তোমার একটা কর্তব্য আছে, এতবড়ো একটা সুযোগকে হেলায় ছুঁড়ে ফেলে দেবার অধিকার তোমার নেই-- যদি দাবি করে বলে ওঠে একবারও—আমার শরীর, মন, জীবনের মূল্য চোকাতে হবে তোমাকে, আমার সন্তানকে নিশ্চিন্ত সুখের জীবন দিয়ে? তাহলে? সে তো তার সে মূল্য চোকাতে পারবে না। তখন? আবার সেই একা একা—আবার কয়েকটা জীবনকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়ে নির্ভার-নিরবলম্ব জীবনের পথে একাকি মানুষ--

    হঠাৎ সাইকেলের ওপর লাফ দিয়ে উঠে প্রাণপণে প্যাডেল করতে শুরু করল সে। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছুতে হবে তাকে। সেইখানে জীবনের আদালত তাকে রায় শোনাবার জন্য তৈরি হয়ে আছে আজ। কালকের দিনটা কেমনভাবে সকাল হবে তা নির্ভর করবে আজ রাত্রের সেই রায়ের ওপর।


    || ২৪ ||

    “কী হলো আজকের মিটিং-এ?

    শোভন ভাতের থালার ওপর আঁকিবুঁকি কাটছিলো। উত্তর দিলো না।

    ফরিদা হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে তার চোখে চোখ রাখল, “আমায় বলবে না? ওকি উঠছো কেন? বোসো। খাওয়াটা শেষ করে নাও আগে।”

    হঠাৎ তার দিকে চোখ তুলে শোভন বলল, “ফরিদা—তোমায় একটা কথা বলবার ছিলো। আমি—”

    তার কাঁধে হাতটা রেখে যুবতীটি শান্ত গলায় বলল, “খেয়ে নাও। অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে---”

    ********

    শীতের রাত নিশুতি হয়েছে। চারপাশে ঘন হয়ে আসা নৈঃশব্দের মধ্যে মানুষদুটি মুখোমুখি বসে থাকে তাদের দুটি ঘুমন্ত সন্তানের পাশে।

    “সন্ধেবেলা ফোন করে উত্তমদা সব কথাটথা বলবার পর বলেছিলাম তোমার সঙ্গে কথা বলে তারপর ফের ওঁকে জানাবো। আমি যা বলতে যাচ্ছিলাম তাতে তোমার সায় কতোটা আছে সেটা জেনে নেবার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তারপর বহুবার তোমার ফোনটা বেজে গেল। ধরলে না। কেন ধরো নি?”

    শোভন মাথা নাড়ল, “ফেলে দিয়েছি। হঠাৎ এমন রাগ হয়ে গেল--আমি ওটাকে—”

    তার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে ফরিদা বলল, “একেবারে পাগল। যত রাগ যত দুঃখ সব ওই যন্ত্রটার ওপরেই দেখিয়ে বসলে?”

    “উত্তমের সঙ্গে আর কথা হয়েছিল?”

    “হ্যাঁ। নিজেই ফোন করেছিলেন আবার ঘন্টাখানেক বাদে। ফের একবার সমস্ত বোঝালেন আমায়। নিজের মতো করে উনি আমাদের ভালোই তো চান। যা করেছেন তাতে আমাদের বা আমাদের ছেলেমেয়েদের আর খাওয়াপরার কোন চিন্তা থাকবে না কোনদিন। সেইদিকটাই বারবার আমাকে ভেবে দেখতে বললেন। তারপর বললেন, রাতটা ভালো করে ভেবেচিন্তে নিয়ে, তোমাকে যেভাবে হোক রাজি করিয়ে তারপর সকালবেলা আমাদের সম্মতিটা ওঁকে জানাতে।

    “কিন্তু আমার অতক্ষণ অপেক্ষা করবার সাহস হচ্ছিল না শোভন। ভেতরটা ছটফট করছিলো। কনফিডেন্স পাচ্ছিলাম না। আমার ভয় হচ্ছিলো যদি আমার মতটা বদলে যায়? অথবা তুমি এসে যদি আমার মত বদলে দাও? তাহলে ছেলেমেয়েদুটোকে নিয়ে আমি বাঁচবো কেমন করে? আমি—আমি ওঁকে সরাসরি যা বলবার বলে দিয়েছি শোভন।”

    “তুমি—”

    “তুমি আমায় ভুল বুঝো না শোভন। তখন আমার মনের অবস্থাটা তুমি জানতে না। আমার গোটা জীবনটা একদিকে আর ওই ফোনকলটা একদিকে হয়ে গিয়েছিলো সেই মুহূর্তে। তোমাকে পাচ্ছি না বারবার চেষ্টা করেও। তুমি কী চাইবে, কীভাবে চাইবে কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। শেষে তুমি আমাকে চিরটাকাল যে শিক্ষা দিয়ে এসেছো, তার ওপরে ভরসা করেই তোমার হয়ে আমি ওঁকে বলে দিয়েছি, তুমি কেজরিওয়ালের এ চাকরিটা করতে রাজি নও। আমিও নই। বলে দিয়েছি আমরা এখান থেকে চলে যাবো। আমি ভুল করে থাকি যদি তাহলে এর জন্যে তুমি—”

    হঠাৎ দুটি হাত বাড়িয়ে প্রিয় মানুষটিকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো শোভন। তার বুকের সঙ্গে পিষ্ট হতে হতে অস্ফুটে ফরিদা একবার শুধু বলল, “আমি ঠিক করি নি? বলো?”

    ছেঁড়া ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটা তার উত্তরের খাতা বাড়িয়ে ধরেছে এক রাগী তরুণের সামনে। প্রশস্ত উঠোনে সকালের রোদ এসে পড়েছে। মেয়েটার উড়ু উড়ু লালচে রুক্ষ চুলে রোদহাওয়া খেলা করে যায়। সে জানে তার উত্তরটা সঠিক হয়েছে। তবু, বারংবার প্রিয় শিক্ষকের মুখের হাসিটুকু দেখবার জন্যেই যেন সে সেই একটাই প্রশ্ন করে যায় তাঁর কাছে—“আমি কি ঠিক করেছি? একবার নিজের মুখে তুমি আমায় বলো—”

    তারপর সেই গভীর অন্ধকার রাতে দুটি কর্কশ ঠোঁট এসে তার পেলব ঠোঁটে চেপে বসে তার সব প্রশ্নের নিষ্পত্তি করে দিয়ে গেল।

    *******

    “এই , ওঠো তুমি। আমায় ছাড়ো এবার—”

    জবাবে পুরুষটি আরো ঘন হয়ে আসে তার সঙ্গিনীর দিকে।

    “ওঠো। প্রফেসর মালহিকে জানিয়ে দাও—ইন সিটু ফেলোশিপটা তুমি নিচ্ছ; আর আমাদের সবাইকে নিয়েই ওখানে শিফট করতে চাও। যদি ফ্যামিলি শিফটিং-এ আপত্তি করেন তাহলে আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে একটা কোনো ব্যবস্থা করে নেবো এদিকে। বিষ্ণুদাসীদি আছেন--”

    “এখন? এতো রাতে? লোকটা ঘুমোচ্ছে হয় তো—” শোভন মৃদু আপত্তি করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ফরিদা তাকে বাধা দিল। তার গলা কাঁপছিল, “এটা আমাদের জীবনমরণের সমস্যা শোভন, কেন বুঝছো না তুমি। কাজটা তোমার কোনো কারণে না হলে আমাদের অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। দরকার হলে আমায় নিজেকেও কিছু একটা কাজটাজ খুঁজতে হবে। আমি এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি পারি চলে যেতে চাই। তুমি ওঁকে ফোন করো। এই যে আমার ফোনে ওঁর নম্বর রয়েছে। আ-আমি ধরে দিচ্ছি--

    *****

    শেষরাত্রের দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে তাকিয়ে ফরিদা দেখে শোভন গালে হাতের ভর দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে তাদের তিনজনের দিকে।

    “ঘুমোও নি?”

    “ঘুম আসছে না গো। এত তাড়াতাড়ি সবকিছু হয়ে গেল! টিকিট করে, সবকিছু গোছগাছ করে এতো কম সময়ে সব তৈরি করতে হবে--প্রফেসর মালহি তিনচারদিনের বদলে যদি অন্তত দুটো সপ্তাহও সময় দিতেন আমায়—”

    “সে যে সম্ভব নয় সে তো উনি তোমায় বুঝিয়ে বললেনই। সরকারী ডেডলাইনের ব্যাপারটা রয়েছে তো। সেটা তো আর ওঁর হাতে নেই। তাছাড়া আমিও প্রয়োজনের চেয়ে একটা দিনও বেশি এখানে দেরি করতে রাজি নই। যত তাড়াতাড়ি পারি এখান থেকে—”

    “সে তো আমিও চলে যেতে চাই। কিন্তু একটা কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে যে, সেটাই ভাবছিলাম।”

    “কোন কাজ বাকি রয়ে গেল তোমার এখানে?”

    “উত্তমের কাছে আমি--আমি কোন ঋণ রেখে যেতে চাই না ফরিদা। ওটা মিটিয়ে দিতে হবে।”

    “কী করতে চাও?”

    “একটা কাজ করতে চাইছি। কিন্তু তাতে আগে তোমার মত চাই ফরিদা। আপত্তি কোরো না। এখানকার এই বাড়িটা আমি--মানে এখন ওকে কিছু বলবো না। বললে আবার কোন ঝামেলা করে বসে? ওখানে গিয়ে কাগজপত্র বানিয়ে ওর ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবো ভাবছি।”

    ফরিদা নিঃশব্দে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর ঠোঁটে একটা বিচিত্র হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল, “আমাকে ভুলিও না। ওসব ঋণটিন সব বাজে কথা। পিছুটান একেবারে কাটিয়ে ফেলে বেরোতে চাইছো সেটা বলো।”

    শোভন লাজুক মুখে মাথা নামিয়ে শুধু বলল, “তোমার কাছে আমার কিছুই লুকোনো থাকে না, তাই না?”

    “থাকে নাই তো। তোমাকে কি আমি আজকে থেকে চিনি? অনেক জন্ম ধরে দেখে আসছি যে!”

    “সে কী? জন্মান্তর? এহেন ইর্‌র‍্যাশনাল কথা আমি কার মুখে শুনছি?”

    “হোক ইর্‌র‍্যাশনাল। ভাবতে আমার ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে গো। সামনে লম্বা রাস্তা পড়ে আছে। বাচ্চাদুটোকে নিয়ে দুজন মিলে—”

    বলতে বলতেই হঠাৎ তাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখটি নিয়ে সে বলল, “ধুস্‌। আমি আর বেশি কিচ্ছু ভাববো টাববো না। যা খুশি তাই করো তুমি আমায় নিয়ে। যেখানে খুশি নিয়ে গিয়ে তোলো। আই শ্যাল ওয়েট ফর দা সারপ্রাইজ ব্রট টু মি বাই মাই ম্যান—”

    তারপর দুটি হাত তার পুরুষটির গলায় জড়িয়ে নিয়ে সে ডাক দিলো—“এসো-”

    ****

    “তুমি কবে ফিরবে মা?”

    “ব্যাগ গুছোতে গুছোতে পেছন থেকে বিল্টুর গলাটা পেয়ে হঠাৎ একটু থমকে গেল সমাদৃতা। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “এই দুচারদিন লাগবে আর কি।”

    “আমায় তোমার সঙ্গে—”

    তার গলাটি অভিমানে ভারী হয়ে উঠেছে। বাক্সটাকে খোলা ফেলে রেখেই সমাদৃতা তাড়াতাড়ি ঘুরে বসে তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিল। এখনো তুলতুলে ভাবটা পুরোপুরি যায়নি বিল্টুর শরীর থেকে। ভারী উষ্ণ ও নরম। দুহাতে তাকে কোলে জড়িয়ে থেকে নিজের মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে সে বলল, “অমন করে না বাবা। আমি তো এই সামনেই চলে আসছি আবার। সেই ক’দিন তুমি তোমার বাবার সঙ্গে অনেক মজা কোরো।”

    তার বুকের মধ্যে মুখটা গুঁজে রেখেই ঘনঘন মাথা নাড়ালো বিল্টু, “উঁহু। আমি বাবার কাছে গিয়ে থাকবো না। তুমি আমায় মামীর কাছে দিয়ে এসো তাহলে। ওখানে সুরভি আছে, কবীর আছে। ফেরবার সময় আবার আমাকে নিয়ে আসবে।”

    “বোকা ছেলেটা আমার। তাই কি হয় নাকি? বাবা তোমায় কতোকিছু কিনে দেবে দেখো। লক্ষ্মী হয়ে থেকো কিন্তু।”

    “আচ্ছা মা, বাবাকে যদি বলি একদিন আমায় নিয়ে মামীদের বাড়িতে যেতে? বলবো?”

    “তোর মামীকে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, না রে?"

    বালকটি জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল একবার। গত কয়েকমাসের সুখস্মৃতিগুলো তার মাথায় ফিরে আসছে ভিড় করে। গত কয়েকটি বছর মায়ের সঙ্গে একাকি জীবনে তার এমন আনন্দের সময় বেশি আসে নি।

    “পাগলা কোথাকার। তোর বাবা হাজার কাজে ব্যস্ত থাকে। সে কেমন করে তোকে অদ্দূর নিয়ে যাবে সব ফেলে?”

    “না। নিয়ে যেতেই হবে। নইলে আমি কিন্তু তোমার সঙ্গেই যাবো।”

    বুকের ভেতর চলতে থাকা তোলপাড়টাকে অনেক কষ্টে আটকালো সমাদৃতা। ফিরে আসবার পর মামলার ফল শুনে শর্মিষ্ঠা আর ব্রতীন অবাকই হয়েছিলো। বারংবার তাকে জিজ্ঞাসা করেছে তারা, কেন সে এইভাবে সবকিছু মেনে নিয়ে ছেলের অধিকারটা ছেড়ে দিয়ে এলো। বোঝাতে চেয়েছে, এক্ষেত্রে ছেলের অধিকার দাবি করে এই রায়ের বিরুদ্ধে তার উচ্চতর আদালতে নালিশ করাটা কর্তব্য হবে। সমাদৃতা তাদের বলতে পারে নি। উত্তমের ওই ফাইলটার কথা, তার মধ্যে আপাত সত্যের পড়তে পড়তে মিশে থাকা কদর্য মিথ্যেটার কথা মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে পারেনি সে।

    ব্রতীনরা অবাক হয়েছে। এক কথায় কোনো কারণ ছাড়াই ছেলের অধিকার এইভাবে ছেড়ে দিয়ে তার দেশ ছেড়ে চলে যাবার ইচ্ছেটার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে না পেয়ে প্রথমে বিস্মিত, আর তার পরে বিরক্ত হয়েছে তার ওপরে। শর্মিষ্ঠা তো একদিন সরাসরিই তাকে বলে ফেলেছিল, “আপনি যে কাজটা করলেন এবং করতে চলেছেন সমাদৃতাদি, সেটা দেখে আমার মনে হচ্ছে উত্তমদার হয়তো এই ব্রেক আপটাতে পুরোপুরি একার দোষ ছিলো না।”

    সমাদৃতা কোন জবাব দেয় নি। দেবার মতো কোন জবাব তার কাছে ছিল না। তার নৈঃশব্দকে কোনো অজানা অপরাধের স্বীকারোক্তি এবং স্বার্থপরতার প্রমাণ হিসেবেই ধরে নিয়েছিল সম্ভবত ওই দম্পতি। তার পর থেকে তারা আর এ-বাড়ির দিকে আসেনি এই ক’দিন। না আসুক। মায়া যত কাটানো যায়। কিন্তু ওদের সব খুলে বলতে গেলে, কিংবা ছেলের অধিকার নিয়ে আদালতে মামলাটা চালাতে গেলে তাতে ওই মিথ্যেগুলো যদি সকলের সামনে আসত, তাতে যে কদর্যতার ভাঁড়ার খুলে যেত সবার সামনে, তার ঘায়ে হয়তো শোভনদের সংসারটা ভাঙত। কিন্তু তাতেও হয়তো কোন আপত্তি থাকত না সমাদৃতার যদি ওতে ছেলেটাকে ফিরে পাওয়াটা তার নিশ্চিত হতো। কিন্তু যেভাবে কেসটা সাজিয়েছে উত্তম, তাতে মামলা চালালে হার তো তার হতই, মধ্যে থেকে তার ছেলেটার সামনে তার মায়ের চরিত্র হনন হতো। আজকে ছোটো। কাল আর একটু বড়ো হয়ে তখন যদি সে তার সামনে আঙুল তুলে ধরে প্রশ্ন করতো, কেন তুমি—

    তার চেয়ে এই ভালো। উত্তম ছেলেটাকে ভালো তো বাসে। নিজের মতো করে তার যত্নও নেবে হয়ত সে। ভালো থাক ও। অল্প বয়েস। এ বয়সে মন অনেক নমনীয় থাকে। কদিন আর কষ্ট পাবে? সব ভুলে গিয়ে মিলেমিশে যাবে ঠিক।

    “তুমি কখন যাবে? কৃষ্ণামাসীও তোমার সঙ্গে যাবে?”

    “কৃষ্ণামাসী? দূর পাগলা? সে কেন আমার সঙ্গে যেতে যাবে? আসলে আমি তো থাকবো না, আর তোকে তোর বাবা নিয়ে যাবে ক’টা দিনের জন্য। তাই কৃষ্ণামাসীকে ছুটি দিয়েছি ক’দিনের জন্য। বাড়িতে একটু ঘুরে আসুক গিয়ে। কী বলিস?”

    “কৃষ্ণামাসির বাড়ির লোক খুব দুষ্টু, তাইনা মা?”

    “কেন?”

    “নইলে বাড়ি যাবে বলে কৃষ্ণামাসী আমাকে ধরে ধরে অত কাঁদলো কেন কালকে?”

    সমাদৃতা কোন উত্তর দিলো না। নীরবে বাক্সের দিকে মুখটা ঘুরিয়ে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও গিয়ে যাও। সন্ধেবেলা আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে যাবে না?”

    *******

    স্টেশনের আলোকিত ক্ষেত্র থেকে তার বাইরের অন্ধকারের বৃত্তে ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছিল ট্রেনটা। তার জানালা দিয়ে প্ল্যাটফর্মের ওপর কৃষ্ণার কোলে বসে হাত নাড়তে থাকা ছোট্ট মানুষটিকে বারবার খুঁজে নিচ্ছিল তার তৃষ্ণার্ত চোখদুটি। অজস্র মানুষের ভিড়ে একবার তাকে দেখা যায়, তারপর চলমান মানুষের স্রোতে তা ঢেকে যায় ফের। তারপর একসময় মিলিয়ে যেতে থাকা আলোকপুঞ্জটির মধ্যে মিলেমিশে এক হয়ে গেল সে। অন্ধকারের মধ্যে আলোর সুড়ঙ্গ খুঁড়ে খুঁড়ে ট্রেন ছুটে চলেছে দক্ষিণের মহানগরের দিকে। কাল সকালে সেইখান থেকে যন্ত্রপাখি তাকে কোন এক অচেনা দেশের নিয়ে গিয়ে ফেলবে। আরেকটা নতুন জীবন। আরেকটা যাত্রা। ফের একবার শূন্য থেকে শুরু।

    শুধু, এইবার তার চোখে আর কোন স্বপ্ন নেই। আছে এই জীবনটা থেকে ক্রমাগত যত দূরে সরে যেতে পারে তার তাগিদ। তবু সেই সন্ত্রস্ত দৌড়ের মধ্যে বারবার তার দৃষ্টিতে দুটি কোমল চোখের ছবি ভেসে ওঠে—কৃষ্ণার বুকে লাথি ছুঁড়ে ছুঁড়ে দুষ্টু ছেলেটা হয়তো এতক্ষণে--

    অফিসে ছুটির দরখাস্তও দেয় নি সমাদৃতা। যা খুশি হতে থাক গে। সে তার পরোয়া করে না আর। মা একবার ফোন করেছিলো। ধরে নি। উত্তম এই শহরেই এসে রয়েছে কাল থেকে। বলেছিলো এসে তার সঙ্গে একবার কথা বলে তারপর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। সমাদৃতা রাজি হয় নি। শুধু বলেছিলো, আগামীকালের ফ্লাইটে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে সে। একটু চমকে উঠেছিলো উত্তম। কিন্তু কোথায় চলেছে সে প্রশ্ন করেনি। সমাদৃতাও জানায় নি কিছু। লোকটার হাত অনেক লম্বা এখন। খবর জেনে নেবে ঠিকই। কৃষ্ণাকেও এসব নিয়ে বিশেষ কিছু ভেঙে বলে নি সে। বিল্টুর জেনে যাবার ভয় ছিলো ওতে। সে শুধু জানে, কলকাতায় যাচ্ছে সমাদৃতা, আর উত্তম কাল সকালে এসে ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। কৃষ্ণা তাকে ভালোবাসে। মনের গভীরে হয়তো আশা করে বসে আছে, এইবার দুজনের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হবে—ছেলেটাকে মাঝখানে রেখে—কাল উত্তমের সঙ্গে দেখা হবার পর সে আশাটাও শেষ হয়ে যাবে তার। যাক গে। যা হবার হোক। শুধু ছেলেটার চোখদুটো—

    “টিকিট ম্যাডাম—”

    সমাদৃতা তাড়াতাড়ি পার্সে হাত ঢুকিয়ে কাগজের একটা টুকরো বের করে বাড়িয়ে ধরলো সামনে।

    “ম্যাডাম, আপনি টিকিটটা দেখাবেন প্লিজ। এটা তো একটা—”

    চমক ভেঙে সমাদৃতা দেখল, বিল্টুর একটা ছবি পার্স থেকে বের করে টিকিট পরীক্ষকের সামনে ধরে রেখেছে সে। লজ্জিতভাবে সেটাকে ফের পার্সে ভরে টিকিটটা খোঁজার অছিলায় মুখ নামিয়ে প্রাণপণে নিজের ঠোঁটদুটো কামড়ে ধরল সে।


    || ২৫ ||

    “বন্ধুগণ। আজকের এই শুভ দিনে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী শ্রী অর্জুন গাঙ্গুলি মহাশয়। তার হাত দিয়েই শিক্ষাক্ষেত্রে এই জেলায় এক নবদিগন্তের সূচনা হতে চলেছে এ আমাদের সৌভাগ্য। এই মহান কাজটির পেছনে যে দ্বিতীয় মানুষটির অবদান মুরলীপুর কখনো ভুলতে পারবে না, এ গ্রামের রত্ন সেই শোভন মণ্ডলকে আমরা অনুরোধ করব মঞ্চে আসতে—”

    মোটাসোটা মানুষটি এই ঠাণ্ডাতেও গলাবন্ধ মোটা কাপড়ের পোশাক পরে গলগল করে ঘামছিলেন। অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এর শিলান্যাস উৎসব নিয়ে এলাকায় যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, তার ছিটেফোঁটাও তাঁকে স্পর্শ করে নি। প্রায় প্রতিদিনই এমন বেশ কিছু শিলান্যাস তিনি নিয়মিতই করে থাকেন। শোভন পাশে গিয়ে বসতে, গলা নিচু করে ফিসফিস করে বললেন, “কত পাচ্ছেন কেজরিওয়াল থেকে এটার জন্য? যতটা পারেন আদায় করে নিন মশায়।”

    শোভন তার জবাব দেবার আগেই ওপাশ থেকে অমরেশ বাগচি এগিয়ে এসে বিনীতভাবে বললেন, “এইবারে যদি একটু কষ্ট করে—”

    পেছনের এই জায়গাটায় একসময় ছাত্রদের তৈরি সবজির বাগান ছিল। গত বর্ষার দীর্ঘ অযত্নে এখন তাতে আগাছার ভিড়। তারই মধ্যে খানিকটা জমি পরিষ্কার করে নিয়ে সেইখানে একটি ছোট ইটের বেদি তৈরি করা হয়েছে। শোভনকে আগেই সেখানে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। অর্জুন গাঙ্গুলি আসতে তাঁর হাতে সিমেন্ট বালির মিশ্রণসহ একটা রুপোর কর্নিক তুলে দিল সে। কষ্টেসৃষ্টে বেদির সামনে গিয়ে নিচু হয়ে কর্নিক থেকে মিশ্রণটি কোনমতে ছুঁড়ে ফেলে তিনি যখন ফের সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন তখন ঘনঘন করতালি আর ক্যামেরার আলোর ঝলকে ছোট্ট জমিটা সরগরম হয়ে উঠেছে।

    “মন্ত্রীর সঙ্গে পার্টি অফিসের দিকে যাবেন তো? তাহলে আমার গাড়িতেই না হয়—”

    শোভন পেছন ফিরে দেখল একবার। অমরেশ বাগচি তার পেছনে দাঁড়িয়ে ডাকছিলেন। মাথা নেড়ে সে বলল, “আসল কাজটা তো করেই দিলাম অমরেশবাবু। এবারে আমায় ছেড়ে দিন।”

    অমরেশ তার মুখের দিকে খানিক চেয়ে থেকে বললেন, “ভালো। স্নান খাওয়া করে বিশ্রাম নিন। শুনলাম কোথায় যেন বেরোচ্ছেন আজ। উদ্বোধনে আসছেন তো?”

    “না অমরেশবাবু,” শোভন মাথা নাড়ল, “সময় হবে না। আটটার মধ্যে বেরোতে হবে আমাদের।

    “ঠিক আছে। অন্তত একবার একটা চক্কর লাগিয়ে যাবেন বেরোবার আগে। মানে আপনার হাতেই তো মেলার শুরু! লোকজন কেউ কেউ খোঁজ করবেই। একেবারে এলাকা ছেড়ে হাওয়া হয়ে গেলে আমাদের বদনাম হয়ে যাবে মশাই। অন্তত শুরুর সময়টা--”

    শোভনের ঠোঁটে একটা বিচিত্র হাসি খেলে গেল, “যাবো অমরেশবাবু। নিশ্চয় যাবো। যাবার আগে একবার চোখের দেখা দেখে তো যেতেই হবে।”

    “আসবেন তাহলে, কেমন? আর, যেখানে যাচ্ছেন সেখান থেকে ফিরে এসে কাজকর্ম টেক ওভার করবার আগে একবার দেখা করবেন। কিছু ডিসিশান নিয়ে নিতে হবে, মানে আমাদের কিছু ইনটার্নাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং আর কি। কাদের কাদের এমপ্লয়মেন্ট দেয়া হবে লোকালি, স্কুলকমিটিগুলোয় সঙ্গে বসা এইসব। ওতে কেজরিওয়াল ইনভলভড থাকবে না।”

    দলটা এইবারে মিছিল করে সেইখান থেকে বের হয়ে গেল। বাইরে দরজার কাছে হাঁকডাক, গাড়ির শব্দ উঠছে। পার্টি অফিসে একটা ঘরে এয়ারকন্ডিশনার বসিয়ে তৈরি করে রাখা রয়েছে আগের থেকেই। মন্ত্রী এখন সেইখানে গিয়ে বিশ্রাম নেবেন। কিছু স্থানীয় ডেলিগেশনের কথা শুনবেন, তারপর বিকেলে মেলার উদ্বোধন করে ফিরে যাবেন কলকাতায়।

    শোভন একা একা দাঁড়িয়ে ছিল জমিটার সামনে। অমরেশ চলে যাবার পর তাকে কেউ ডাকে নি আর। দুজন শ্রমিক মিলে মিলে দ্রুতহাতে বেদিটার জায়গায় একটা ছোট ফলকস্তম্ভ গেঁথে তুলছিলো। সেখানে সম্ভবত মন্ত্রীর হাতে উদ্বোধনের কথাটি লেখা একটি ফলক বসানো হবে।

    *****

    “যাচ্ছেন কোথায় মা?”

    বাক্সটার মুখ বন্ধ হচ্ছিল না ঠিক করে। তার ওপর চেপে বসে লক-এর জোড়া মেলাতে মেলাতে বলরাম প্রশ্ন করল।

    ফরিদা একমনে একটা লম্বা তালিকা হাতে নিয়ে মিলিয়ে দেখে নিচ্ছিল সবকিছু। অল্পদিনের সংসার তার। তবু এরই মধ্যে টুকটুক করে বহু জিনিস জমে গিয়েছে। সব নেয়া যাবে না। প্রয়োজনও হবে না। বলরামের কথাটা তার কানে গেল কিনা বোঝা গেল না।

    “আমরা? আমরা যাচ্ছি অনেক দূরের দেশে,” সুরভি এসে বলরামের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে কখন। এই অ্যাটেনডেন্টটির সঙ্গে বেশ একটা অসমবয়েসি বন্ধুত্ত্ব হয়ে গেছে তার গত একটা সপ্তাহে। তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটি তাদের গন্তব্যের এক রঙিন বিবরণ দিয়ে চলে। বাপ মায়ের মুখে এই ক’দিন ধরে শোনা টুকরোটাকরা কথাবার্তার সঙ্গে কল্পনার মিশেলে সুরভির কাছে তাদের গন্তব্যের অরণ্যপ্রদেশটি আস্তে আস্তে ঈশ্বরের বাগানে বদলে যাচ্ছে।

    “কিন্তু জঙ্গলে ঘুরতে যাবা তো সঙ্গে করে বাক্সভরা বইখাতা রঙপেনসিলের ডাঁই কেন নিয়ে চললা গো? এইসব দিয়ে কী করবা ঘুরতে গিয়ে। কদিনের জন্যে--”

    তার কথার মধ্যেই পাশের ঘরে ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ।

    “বলরামদা, ফোনটা একটু এনে দেবে?” বলতে বলতে ফরিদা শাড়ির আঁচলে কপাল মুছল একবার। ভারী বাক্সদুটো শোভনই সেরে রেখে গিয়েছে, কিন্তু টিচিং ইকুইপমেন্টের এই প্যাকিংটাও কম ওজনদার যে নয় সেটা এখন ফরিদা টের পাচ্ছে।

    গতকাল রাতে শোভন তাকে খবরটা দিয়েছিল প্রথমবার। অন্ধকারের মধ্যে শুয়ে শুয়ে বলেছিলো, “ওখানে গিয়ে আমি তো আমার কাজটা করতে থাকবো। কিন্তু তুমি সারাদিন ধরে কী করবে সেটা ভেবেছো?”

    “উঁহু। গিয়ে উঠি আগে, তারপর ভাববো।”

    শোভন তার মাথার চুলগুলোর মধ্যে বিলি কাটতে কাটতে বলেছিল, আমি একটা কাজ বলব?”

    “হুঁ?”

    প্রফেসর মালহির সঙ্গে কথা হল। বস্তারে ইন্দ্রাবতী নদীর ধারে দুটো গ্রাম আছে। একটা পাহাড়ের ওপরে হালবিদের গ্রাম। সেটার নাম পারুঠিয়া। আর অন্যটা পাহাড়ের ঠিক তলায়। দণ্ডকের বাঙালি রিফিউজিদের সেটলমেন্ট। সেটার নাম নয়া পারুঠিয়া। ওইখানটায় আমরা সেটল করব আগামী দু বছরের জন্য। প্রফেসর মালহির সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি তাতে ওখানে একটা ছোটোখাটো স্কুল বসালে সেটা ওদের খুব কাজে লাগবে। ঘরটর ওখানে কিছু একটা তুলিয়ে নিতে পারবো। তুমি পড়ালে, আমিও যেমন যেমন সময় পেলাম একটু পড়ালাম। হয়তো রোজগারও হবে কিছুটা। তাছাড়া সুরভি আর কবীরের স্কুলিংটাও নিজের বাড়ির লোকের কাছেই শুরু হয়ে যেতে পারবে। আসলে জায়গাটার কাছাকাছি ছোটোদের কোন স্কুল নেই। বাচ্চাদুটোর কথা ভেবেই তাই—”

    তার কনুইয়ের ভাঁজের মধ্যে মাথাটা গুঁজে দিয়ে বড়ো আরামে চোখ বুঁজে ফরিদা জবাব দিয়েছিল, “করব। বাঁচালে তুমি আমায়। সত্যি কথা বলি তোমায়, ওখানে গিয়ে সময় কাটবে কী করে সে নিয়ে আমি কিন্তু সত্যিই একটু চিন্তায় ছিলাম। তোমাকে এই অবস্থায় সে নিয়ে বিরক্ত করিনি তা ঠিক, কিন্তু তবু—”

    “এবারে নিশ্চিন্ত তো?”

    হঠাৎ কনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসে ফরিদা উত্তেজিত গলায় বলেছিল, “জানো এটা শুরু হলে ভাবছি—”

    তারপর বাকি রাতটা জুড়ে তারা দুজন মিলে সেই অনাগত স্কুলটির নানান দিক নিয়ে কথায় কাটিয়ে দিয়ে যখন চোখ বুঁজেছিল তখন পুবের আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে।

    রিং হতে থাকা ফোনটা তার কাছে এনে দিতে ফরিদা পর্দার দিকে একঝলক তাকিয়ে নিল প্রথমে। তারপর কলটা ধরে বলল, “বলুন উত্তমদা।”

    “শোভনকে ফোন করে করে পাচ্ছি না। ফোন কি অফ করে রেখেছে নাকি?”

    ফরিদা একটু হাসল, “সে অনেক গল্প। শিলান্যাস হল একটু আগে। ওইখানেই দাঁড়িয়ে আছে বোধ হয়। আপনি এলেন না যে?”

    “আমার আসতে আসতে সন্ধে হয়ে যাবে। বিল্টুকে নিয়ে একটু মার্কেটিং-এ বেরোব। সে’সব মেটাতে মেটাতে সময় লেগে যাবে অনেকটা। তোমরা বের হচ্ছো কখন?”

    ফরিদা মনে মনে একটু হিসেব করে নিয়ে বলল, “ভোর চারটেয় ট্রেন। গাড়িতে এখান থেকে হাওড়া রাতের বেলা চারপাঁচ ঘন্টার বেশি লাগবে না। এই ধরুন রাত আটটা নটা নাগাদ খেয়েদেয়ে বেরোব। কেন, কোনো দরকার ছিল?”

    “হ্যাঁ। একটু কাজ ছিলো তোমাদের সঙ্গে। বাড়িতেই যাবো। আটটা অবধি অন্তত থেকো। তখনও যদি রাস্তাতেই থেকে যাই তাহলে বেরোবার আগে একটা ফোন কোরো আমায়। পথে কোথাও মিট করে নেবো।”

    “আমি বলে রাখবো। ব্যাপারটা কী সেটা একটু বলবেন?”

    “সেটা একেবারে ওখানে পৌঁছেই বলব’খন। রাখি এখন।”

    ফোনটা হাতে নিয়ে একটুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল ফরিদা। দিনদুয়েক আগে, বিল্টুকে নিয়ে জলপাইগুড়ি থেকে ফেরবার পর তাকে কলকাতায় রেখে উত্তম মুরলিপুরে এসেছিল। এ বাড়িতে যখন এলো তখন শোভন ছিল না। শোভন যে তাদের নিয়ে মেলা শুরুর দিনই ছত্তিসগঢ় রওনা হচ্ছে সে কথাটা উত্তমকে তখনই জানিয়েছিলো ফরিদা। তবে তার বেশি আর কিছু ভেঙে বলে নি।

    উত্তম কী বুঝেছিল কে জানে, সে নিয়ে আর সে নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি। শুধু বলেছিল, “ফিরছো কবে? আর বাড়ির দেখাশোনা তদ্দিন—”

    ফরিদা একটু এড়িয়ে যাওয়া গলায় বলেছিলো, “ফিরবো। তাড়াতাড়িই ফিরবো। তবে সবই আপনার বন্ধুর মর্জি, বোঝেন তো! তদ্দিন বাড়ির দেখাশোনাটা আপনার ওপরে ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি উত্তমদা। যেমন ভালো বুঝবেন আপনি--”

    “সে রাখবো। তোমাদের ফিরতে যদি দেরি হয় তাহলে শুধু শোভনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নম্বরটা আমায় জানিয়ে দিও। মানে কেজরিওয়াল থেকে ও যা টাকাপয়সা পাবে সেগুলো তাহলে একেবারে সরাসরি সেই অ্যাকাউন্টে—”

    “সেসব কথা আপনি বরং আপনার বন্ধুকেই বলবেন উত্তমদা,” তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল ফরিদা। এই মানুষটিকে এখন এর চেয়ে বেশি কিছু জানাবার প্রয়োজন সে বোধ করে নি।

    উঠে যাবার আগে একবার একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করেছিল, “সমাদৃতা ঠিক কোথায়, কী অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে গিয়েছে তোমরা কিছু জানো? মানে বিল্টুটা সেই জলপাইগুড়ি থেকে আসবার পর থেকেই মা মা বলে একেবারে অস্থির করে তুলেছে। আমি ঠিক—”

    ফরিদা তার কাছে কিছু লুকোয় নি। তার পর থেকে গত দুদিন ধরে এপাশের কাজকর্ম শ্যামলবাবুই চালাচ্ছেন। উত্তম এদিকে আসে নি আর।

    “কার ফোন ছিল গো?” শোভন কখন যেন ঘরে ঢুকে এসে তার পেছনে দাঁড়িয়েছিলো।

    হাতের কাজটা সারতে সারতেই ফরিদা বলল, “উত্তমদার। আজ সন্ধেবেলা আসছে। আমরা যাবার আগে একবার দেখা করতে চাইছিলো।”

    “কী ব্যাপার কিছু বলল?”

    “উঁহু। তবে মনে হল আর্জেন্ট কিছু হবে।”

    শোভন আর কিছু বলল না। ফোনটা ফেলে দেবার পর থেকে নতুন কো্নো কানেকশান আর সে নেয় নি। ইচ্ছেই হয় নি। এর মধ্যে যারা যোগাযোগ করেছে, তাকে ফোন না পেয়ে ফরিদার সঙ্গেই কথাবার্তা যা বলবার বলেছে। ভালোই হয়েছে। ওই উৎপাতটা সে আর বয়ে বেড়াতে চায় না।

    “ভালো। এলে পরে দেখা যাবে’খন। হাওড়া যাবার গাড়ি বলেছো?”

    “সমরেশ বলেছে ব্যবস্থা করে রাখবে। সমস্যা হবে না। তুমি স্নান সেরে এসো। খেতে দিই।”

    *******

    ইবারে মেলাটা নিয়ে এই এলাকায় উত্তেজনা প্রচুর। প্রায় মাসখানেক ধরে নিবিড় প্রচারে রানাঘাট থেকে কৃষ্ণনগর অবধি বিস্তীর্ণ অঞ্চল গম গম করেছে। শান্তিহাট রেলস্টেশন থেকে শুরু করে মুরলীপুর অবধি গোটা রাস্তাটাতে প্রত্যেকটা বাসস্টপে বাজারে ফেস্টুনে ফেস্টুনে ছয়লাপ করে দেয়া হয়েছে। উদ্বোধন হবার কথা বিকেল পাঁচটার সময়। কিন্তু বেলা তিনটে বাজতে না বাজতেই লোকজনের ঢল নেমেছে মেলার মাঠে। ঝলমলে মাঠটার প্রবেশপথে কেজরিওয়ালের নাম লেখা বিরাট গেট। ভেতরে ছোট ছোট টুকরোয় বেশ খানিকটা জমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন সংস্থাকে তাদের প্যাভিলিয়নের জন্য ভাড়া দেয়া হয়েছে। গ্রামের হৃৎপিণ্ডের মধ্যে ধীরে ধীরে ঢুকে আসা নগরজীবনের প্রতিভু মোবাইল ফোন, মোটর সাইকেল, টেলিভিশন, নকল সোনার গহনা, পোশাকআশাকের ব্যবসায়ীরা সেই জায়গাগুলিতে তাঁদের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। মেলার মাঠে আসা মানুষজন অবাক বিস্ময়ে সেই দোকানগুলিতে ঢুকে ঢুকে অভূতপূর্ব যন্ত্রপাতি ও ভোগসামগ্রীগুলিকে স্পর্শ করে করে দেখে, তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়। তাদের সেইভাবে অভিভূত করে রেখে মূলমঞ্চটি ধীরে ধীরে প্রস্তুত হয় অনুষ্ঠানের জন্য।

    মাঠটার মধ্যে ভূতগ্রস্ত মানুষের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল শোভন। মাঝেমধ্যে পরিচিত ছেলেগুলির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। একটি দুটি কথার বিনিময়ও হয়। কিন্তু তারপরই তারা তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা কাজটির টানে ফের ভেসে যায় জনতার ভিড়ে। বড়ো অচেনা ঠেকে তার। এই ভূমিতেই কি মাত্রই কিছুদিন আগে সে তার দীর্ঘদিনের সেই স্বপ্নটাকে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে এনেছিলো। আবছা আবছা কিছু নাম—মুসিয়ের, মন্তাবাবু, দিঘলিগ্রামের পুতুল বাউরি—টুকরো টুকরো কিছু সুর—কিছু কথা--জোর করে মনের ওপর চাপিয়ে দেয়া কৃত্রিম বিস্মৃতির জগদ্দল পাথরটাকে নাড়িয়ে উঁকি মারে এসে বারংবার। ওরা কেউ নেই এখানে আর। থাকবেও না। নগরের বাঘে ধরেছে এই গ্রামকে। এইবারে তার শক্তিমান চোয়াল একে গুঁড়িয়ে দেবে আস্তে আস্তে। ভেঙেচূরে নতুন করে গড়ে তুলবে আরেকটা নগরগন্ধী মফস্বল শহর।

    এইখানে ওরা আর ফিরবে না কোনদিন। ওরা সরে যাবে আরো দূরে—গ্রামবাংলার আরো গভীরে—যেমন চলে গেছে ভুবন বৈরাগি—যেখানেই যাক, ভালো থাকুক ভুবন। এরাও ভালো থাকুক। যতদিন পারে পুরোনো অস্তিত্বকে ধরে রাখুক। তারপর একদিন তো মিশে যেতেই হবে নগরের স্রোতে।

    মঞ্চে প্রদীপ জ্বালাবার কাজ শুরু হয়েছে। কলকাতা থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা এক টিভি নায়িকা বিচিত্র ছাঁদের একটি শাড়ি পরে মন্ত্রীর হাতে তুলে দিচ্ছেন জ্বলন্ত একটা মোমবাতি। মঞ্চের একেবারে সামনে বসানো একটি ফুলে ঢাকা চন্দনচর্চিত গণেশমূর্তির সামনে দাঁড়ানো পেতলের পিলসুজের ওপর উন্মুখ প্রদীপগুচ্ছ মন্ত্রীর হাতের আগুন খেয়ে একে একে জ্বলে উঠছে দপদপ করে—

    “বন্ধুগণ। শুরুতেই লোকসঙ্গীতের ওপরে যে একটি ক্ষুদ্র বক্তৃতা হবার কথা ছিল, অনিবার্য কারণে সেটি বাতিল করতে হচ্ছে। সেই জায়গায়, আপনাদের একটি উদ্বোধনী লোকগান গেয়ে শোনাচ্ছেন আমাদের দলের একনিষ্ঠ সমর্থক কর্মী শ্রীমতী জগৎবালা দাসী। শ্রীমতী জগৎবালা এর মধ্যেই কলকাতা দুরদর্শনে একটি প্রোগ্রাম করে আমাদের গর্বিত করেছেন। আসুন, তাঁর কন্ঠে শোনা যাক একটি মাটির গান—

    মঞ্চের মাঝখানে একজন পৃথুলা মধ্যবয়সিনী এসে দাঁড়িয়েছেন। চোখে পড়বার মত রূপটান ও দামী শাড়িতে বয়সটিকে সযত্নে ঢেকে রাখবার চেষ্টা রয়েছে তাঁর। মাইকটি হাতে নিয়ে গোটা মঞ্চটি ঘুরে ঘুরে তিনি কয়েকবার “হ্যালো টেস্টিং” বলে তাতে ফুঁ দিয়ে বাজিয়ে দেখে নিলেন সেটি কাজ করছে কি না। তারপর সম্মুখমঞ্চে এসে কষ্টেসৃষ্টে কোমর বাঁকিয়ে দর্শকদের অভিনন্দন জানিয়ে একটু ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, “বন্ধুগণ, এই মঞ্চে উপস্থিত বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমার নমস্কার জানাই। আমাদের এতদঞ্চলের বিখ্যাত সমাজসেবী শ্রী অমরেশ বাগচি ও মঞ্চে উপস্থিত মাননীয় মন্ত্রীর পায়ে প্রণাম জানিয়ে আমি আমার যে সঙ্গীতটি নিবেদন করতে চলেছি সেটি আপনারা বিখ্যাত বেতার ও টিভি শিল্পী শ্রী উদ্ধব বোসের কন্ঠে বহুবার শুনেছেন।”

    বলতে বলতেই পেছনে অপেক্ষমান মিউজিক হ্যান্ডসদের দিকে ইশারা করে তিনি তালে তালে তুড়ি দিতে শুরু করলেন। ঝমঝম করে বেজে উঠেছে তালবাদ্যের দল। বিশালকায় একটি সিনথেসাইজার থেকে ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে একটি অতিপরিচিত গানের সুর।

    হঠাৎ সেই শব্দকে ছাপিয়ে একটা তীব্র , তীক্ষ্ণ কন্ঠের চিৎকার ভেসে উঠল মেলার বাতাসে--

    “ও নাগ-----র”

    আদিরসভিত্তিক এ গানটার সঙ্গে এ দিগরে সকলেরই কমবেশি পরিচিতি আছে। সে আহ্বানের প্রতিধ্বনি উঠল তাই গোটা আসর জুড়ে। সেই প্রতিধ্বনির শেষবিন্দুটিতে এসে পৌঁছে মানুষটি গানের দ্বিতীয় লাইনে ঢুকে এলেন--

    আমায় নিয়ে যাবি নাকি সুরতপুরের মেলাতে সুরতপুরের মেলাতে ও মেলায় রঙ্গে রসে হাসিখেলায় আমি পাগল রাতের বেলাতে যাবি নাকি---- বলেন বলেন— কোথায় যাবেন গো নাগর লয়ে আপনেরা--
    তাঁর ইশারায় গোটা আসরটি তখন উন্মত্ত হয়ে সুরে বেসুরে পাদপূরণ করে চলেছে—

    “সুরতপুরের মেলাতে, সুরতপুরের মেলাতে—”

    সুরটা চলতে চলতেই তাকে থামতে না দিয়ে তিনি ফের নতুন করে ধুয়া ধরে দিলেন, “মুরলীপুরের মেলাতে—বলো ভাই—একসঙ্গে বলো সব—” বাধ্য, উন্মত্ত শ্রোতারা যোগ দিল তাঁর সঙ্গে—

    “মুরলীপুরের মেলাতে মুরলীপুরের মেলাতে---”
    ভিড় ঠেলতে ঠেলতে শোভন কখন যে মেলার মাঠের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বের হয়ে এসেছে তা নিজেই খেয়াল করে নি। মাইকের নতুন ঘোষণার শব্দে সে একবার পেছন ফিরে চাইল, “এইবারে আপনাদের সামনে লোকসঙ্গীত পরিবেশন করবেন এই এলাকার উদীয়মান টিভি তারকা কুমারী কথাকলি মিত্র।”

    অনিচ্ছাসত্ত্বেও একবার ঘুরে মঞ্চের দিকে তাকালো। এখান থেকে সেখানে বসা লোকজনকে ছোটো ছোট দেখায়। পাদপ্রদীপের আলোয় সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে পুতুলের মতই একটি মেয়ে। দুহাত তুলে দর্শকদের একটি প্রণাম করল সে। তারপর সরাসরি গানের ভেতর ঢুকে এল—

    “কোন বা দেশে রইলারে আমার নদিয়ারো চান্দ আমি তোমারো লাগিয়া যোগিনী হব গো— আমি রাখব না কূলমান
    তার তীব্র তীক্ষ্ণ গলায় এখনো এক আশ্চর্য কুমারী পবিত্রতার স্পর্শ রয়েছে। শব্দের উচ্চারণগুলি—ঠিক যেমন করে শোভন শিখিয়েছিল তাকে তার শৈশবকালে সেই ভঙ্গিতেই নিখুঁতভাবে একে অন্যের সঙ্গে না জড়িয়ে স্বাধীনভাবে উচ্চারিত একসার মুক্তোর মতই ঝরে পড়ে। শোভন টের পাচ্ছিল বুকের ভেতর থেকে তার নিজেরই অজান্তে কখন যেন একটা পাষাণভার সরে যাচ্ছে। আছে। বীজগুলো এখনও বেঁচে আছে এই ভূমিতে। খরায়, আকালে তারা মাটির মধ্যে ঘুমিয়ে থাকবে কোন আগামী সুদিনে অপেক্ষায়। আবার একদিন—

    ইন্টারল্যুডের বাজনা তখন এক সুতীব্র উচ্চতায় পৌঁছেছে। ঘুরে ঘুরে মিউজিকটা নিচ্ছিল মেয়েটা। তারপর হঠাৎ তার সমে এসে পৌঁছে গানের সুরটাকে ফের ধরে নেবার আগে বলে উঠল, “বন্ধুগণ। এই গানটি এবং তার সঙ্গে আরো দশটি ভালো ভালো বিভিন্ন স্বাদের লোকগান আমার গলায় যদি সংগ্রহ করতে চান তাহলে মঞ্চের পাশে কিন্নর স্টুডিওর স্টল থেকে তা সংগ্রহ করে নিতে পারেন। আজ মেলার উদ্বোধন উপলক্ষে তাতে শতকরা পঁচিশ ভাগ ছাড়ের বন্দোবস্ত আছে। সীমিত স্টক। দেরি করলে এ সুযোগ হারাবেন—”

    কথাগুলোর পটভূমিতে নিচুতারে চলতে থাকা মিউজিক এবার ফের সরব হয়েছে। ধিক ধিক শব্দে তাল রেখে চলা একটি অজানা বাদ্যের শব্দ উঠছিল তাকে ছাপিয়ে। হঠাৎ তার তালটিকে ধরে নিয়ে তার সঙ্গেই পরের পংক্তিটিকে বাতাসে ভাসিয়ে দিলো সে—

    তোমার প্রেমের এমন জ্বালা কারো কাছে যায় না বলা গো— আমার মন করে আনচান হায় রে শিমুলের তুলা যেমন বাতাসে উড়ে গো—
    গানটি বেশ কঠিন চালের। এর সঙ্গে গলা মেলানো সহজ নয়। কিন্তু উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরীটির মঞ্চে উপস্থিতির সঙ্গে সেই মাদক সুরের নিপুণ মিশ্রণ দর্শকদের তখন উন্মত্ত করে তুলেছে। তার সঙ্গে গলা মেলাবার বদলে দর্শকের মধ্যে থেকে উঠে আসছিল সমবেত গলায় পশুদের গর্জনের মত অসম্বদ্ধ চিৎকার আর সিটির আওয়াজ। কে যেন একবার চিৎকার করে বলে উঠল—“হায় মেরে লাডলি—দিল মে আও মেরে জান—”

    হাত তুলে তুলে হাসি হাসিমুখে সেই ক্লেদাক্ত অভিনন্দন কতো সহজে গ্রহণ করে চলেছিল মেয়েটি। সঙ্গীতের সামান্য শিক্ষার সঙ্গে রূপযৌবনের মিশেল দিয়ে আনন্দদানের একটা প্রডাক্টকে নির্লিপ্তভাবে বাজারে বিক্রি করবার কাজে তার দক্ষতা তৈরি করে দিয়েছে শহরের টেলিভিশান চ্যানেলের চতুর পরিচালকেরা।

    “শোভন।”

    মাথা নিচু করে দ্রুতপায়ে মেলার মাঠ থেকে বের হয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একটা পরিচিত গলার শব্দ পেয়ে থমকে দাঁড়ালো সে।

    পেছন থেকে এগিয়ে এসে উত্তম তার হাত ধরেছে, “বাড়ি চল।”

    “তুই, কখন এলি?”

    “খানিক আগে। বাড়িতে বিল্টুকে ফরিদার কাছে বসিয়ে রেখে তোকে খুঁজতে এসেছিলাম।”

    “বিল্টুকে নিয়ে এসেছিস?” শোভন একটু অবাক হল।

    “হ্যাঁ। তোর কাছে ওকে যদি—”

    শোভন মাথা নাড়লো, “আমি আজ চলে যাচ্ছি উত্তম সেটা তো তুই জানিস। ফিরে আসি, তারপর না হয়--”

    উত্তম হাসল, “আমার কাছে তুই কিছু লুকোতে পারবি ভেবেছিস শোভন? ভেবেছিলাম তোকে ফাঁদে ফেলে, তোর যন্ত্রণাটা দেখব তৃপ্তি করে। কিন্তু তুই যে এইভাবে আমার ফাঁদটা কেটে বেরিয়ে যাবি—”

    “কী বলতে চাইছিস হেঁয়ালি না করে পরিষ্কার করে বল উত্তম।”

    “বেশ। তবে তাই বলি। ফরিদা আমার কাছে যতই লুকোক, যেদিন থেকে শুনেছি তুই ছত্তিসগঢ় যাচ্ছিস আমি সেদিন থেকেই বুঝেছি, মুরলিপুর তুই একেবারেই ছেড়ে চলেছিস। আমিই তোকে এখান থেকে তাড়ালাম তাই না?”

    শোভন বিরক্ত হচ্ছিল। একটু কঠিন ঘলায় সে ফের বলল, “কাজের কথাটা তাড়াতাড়ি বলবি?”

    “বলবো। আয় বাড়ি এসে গেছি। ওখানে গিয়েই একেবারে—”

    বাড়ির বাইরে দাঁড়ানো গাড়িতে বলরাম একে একে তাদের বাক্সগুলো সাজিয়ে রাখছিল। উত্তমকে দেখে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে একটা নমস্কার করল সে। তাকে ইশারায় কাজ চালিয়ে যেতে বলে শোভনকে সঙ্গে করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে এল উত্তম।

    উঠোনে একটা হইহইয়ের শব্দ উঠছিলো। তারা ভেতরে আসতেই আধো অন্ধকারের মধ্যে থেকে দুটি শিশু হাসতে হাসতে বের হয়ে এসে তাদের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। সুরভি হাসি হাসি মুখে শোভনের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা, এই দ্যাখো বিল্টু এসে গেল।”

    ছেলেটি লাজুক লাজুক মুখে শোভনের দিকে তাকিয়ে দেখছিলো। শোভন এগিয়ে যেতে হঠাৎ এক ছুটে বাড়ির দিকে চলে গেল সে। তাদের গলার শব্দ পেয়ে ফরিদা এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সে একেবারে সোজা গিয়ে তার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরল একেবারে।

    উত্তম সেইদিকে তাকিয়েছিল চুপচাপ।

    “ভেতরে আয় উত্তম। এখানে না দাঁড়িয়ে—”

    তার প্রসারিত হাতটাকে ফিরিয়ে দিল উত্তম। তারপর বলল, “একটাই অনুরোধ নিয়ে তোর কাছে বিল্টুকে নিয়ে আমি এসেছিলাম শোভন। চিরটাকাল সে চেয়েছিল যেন আমি তোর আদর্শের মানুষ হই। হতে পারলাম না। পাঁকে ডুবে গেলাম তার বদলে। আমায় যখন ত্যাগ করবে বলল, তখন তাকে একদিন না একদিন নিজের কাছে ফিরিয়ে আনবার আশায় জোর করে ছেলেটাকে কেড়ে নিলাম। সে কাজটা করবার জন্য ঠিক কতোটা নিচে আমি নেমেছি সে তোর আন্দাজেরও বাইরে। কিন্তু কী লাভ হলো তাতে বল? সে যে এইভাবে সবকিছু ছেড়ে—”

    খানিক বাদে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সে ফের বলল, “সমাদৃতাই যখন রইল না তখন তার কোনো চিহ্নেই আমার আর প্রয়োজন নেই শোভন। আমি জানি, তার অবর্তমানে তার ছেলেকে কার হাতে তুলে দিলে সে সবচেয়ে নিশ্চিন্ত হোতো। তাই হোক তবে। ছেলেটাকে তুই তোর সঙ্গে করে নিয়ে এখান থেকে চলে যা। তাকে তোর আদর্শে মানুষ কর। তারপর সে কখনো চাইলে তাকেই ফিরিয়ে দিস। শুধু—কখনো যোগাযোগ হলে একটু বলিস, আমি কিন্তু তাকে ভালোবেসেই— ধুস্‌! কীসব ইমোশনাল ট্র্যাশ ওগরাচ্ছি? আ—আমি যাই।”

    “উত্তম, তুই—একেবারে একা একা কীভাবে—”

    উত্তম মৃদু হাসল, “ভাবিস না। আমি আমার মতন করে ভালোই থাকবো। টাকা ফেললে সঙ্গী কেনা যায় রে। সেসব অভাব আমার কখনো হবে না। তুই তোর মতো করে ভালো থাকিস। বাচ্চাগুলোকে মানুষ করিস। আর ফরিদাকে যত্ন করিস। তুই খুব ভাগ্যবান রে শোভন—”


    ।। উপসংহার ।।

    বশেষে রাত কেটে ভোর হয়ে আসে। ইস্পাতের সুদীর্ঘ যন্ত্রদানবটি তার ভেতরে বহু শত ঘুমন্ত মানুষকে তাদের সমস্ত সুখদুঃখ, সাধ আহ্লাদের সঙ্গে বহন করে বাঙলা ছেড়ে ছত্তিসগঢ়ের অরণ্যপ্রদেশের দিকে ছুটে যায় অবিশ্রাম।

    জানালার বাইরে মৃদু প্রাকপ্রভাতের আলো ফুটেছে। উল্টোদিকে ছুটন্ত মাটিতে ক্রমবর্ধমান লালের স্পর্শ জানান দেয়, প্রায় বাংলার সীমান্তে এসে পৌঁছে গিয়েছে তাদের দূরপাল্লার গাড়ি। গোটা কামরাটার সমস্ত যাত্রীই ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে উঠে এসে ট্রেন ধরা। সকলের চোখেই ক্লান্তির রেশ ছিলো। বিভিন্ন বাংকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তার স্ত্রী ও শিশুগুলিও ঘুমিয়ে রয়েছে।

    শুধু, একাকী যুবকটির চোখে ঘুম আসে না। এক বন্ধ্যা, বিষাক্ত জমি ছেড়ে সে কিছু সম্ভাবনার বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে চলেছে নতুন এক অকর্ষিত ভূমির উদ্দেশ্যে। একদিন নগর সেইখানেও উপস্থিত হবে তার কর্ষিত জমি থেকে রাজস্ব আদায় করে নিতে। তবে যতদিন না সেই দিনটি আসে ততদিন এই কৃষক সেই জমিতে বীজ বুনে চলবে। তারপর সময় হলে সে, বা তার বংশধরেরা আবার হয়ত নতুন যাত্রায় বের হবে নতুন কোন অকর্ষিত ভূমির সন্ধানে।

    এ যাত্রার শেষ নেই।

    (শেষ)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments